২৯ সূরাঃ আল-আনকাবূত | Al-Ankabut | سورة العنكبوت - আয়াতঃ ৪৫
২৯:৪৫ اُتۡلُ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ مِنَ الۡکِتٰبِ وَ اَقِمِ الصَّلٰوۃَ ؕ اِنَّ الصَّلٰوۃَ تَنۡهٰی عَنِ الۡفَحۡشَآءِ وَ الۡمُنۡکَرِ ؕ وَ لَذِکۡرُ اللّٰهِ اَکۡبَرُ ؕ وَ اللّٰهُ یَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُوۡنَ ﴿۴۵﴾
اتل ما اوحی الیک من الکتب و اقم الصلوۃ ان الصلوۃ تنهی عن الفحشاء و المنکر و لذکر الله اکبر و الله یعلم ما تصنعون ۴۵

তোমার প্রতি যে কিতাব ওহী করা হয়েছে, তা থেকে তিলাওয়াত কর এবং সালাত কায়েম কর। নিশ্চয় সালাত অশ্লীল ও মন্দকাজ থেকে বিরত রাখে। আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। আল্লাহ জানেন যা তোমরা কর। আল-বায়ান

তোমার প্রতি যা ওয়াহী করা হয়েছে কিতাব থেকে তা পাঠ কর আর নামায প্রতিষ্ঠা কর; নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে বিরত রাখে। নিশ্চয়ই আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ (বিষয়)। তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন। তাইসিরুল

তুমি তোমার প্রতি প্রত্যাদিষ্ট কিতাব আবৃত্তি কর এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত কর। নিশ্চয়ই সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ হতে। আল্লাহর স্মরণই সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যা কর, আল্লাহ তা জানেন। মুজিবুর রহমান

Recite, [O Muhammad], what has been revealed to you of the Book and establish prayer. Indeed, prayer prohibits immorality and wrongdoing, and the remembrance of Allah is greater. And Allah knows that which you do. Sahih International

৪৫. আপনি(১) তেলাওয়াত করুন কিতাব থেকে যা আপনার প্রতি ওহী করা হয়(২) এবং সালাত কায়েম করুন।(৩) নিশ্চয় সালাত বিরত রাখে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে।(৪) আর আল্লাহর স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ।(৫) তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন।

(১) আপাত দৃষ্টিতে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করা হয়েছে কিন্তু আসলে সমস্ত মুসলিমদেরকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এতে দুটি অংশ আছে, কুরআন তেলাওয়াত ও সালাত কায়েম করা। কারণ এ দু'টি জিনিসই মুমিনকে এমন সুগঠিত চরিত্র ও উন্নতর যোগ্যতার অধিকারী করে যার সাহায্যে সে বাতিলের প্রবল বন্যা এবং দুস্কৃতির ভয়াবহ ঝঞ্ঝার মোকাবিলায় সঠিক পথে থাকতে পারে। [দেখুন: আত-তাহরীর ওয়াত তানওয়ীর]

(২) কুরআন তেলাওয়াতের এ শক্তি মানুষ তখনই অর্জন করতে পারে যখন সে কুরআনের শুধুমাত্র শব্দগুলো পাঠ করেই ক্ষান্ত হয় না বরং তার শিক্ষাগুলোও সঠিকভাবে অনুধাবন করে হৃদয়ের প্রতিটি তন্ত্রীতে সেগুলোকে সঞ্চারিত করে যেতে থাকে। আসলে যে তেলাওয়াতের পরে মানুষের মন-মানস, চিন্তা-চেতনা ও চরিত্র-কর্মনীতিতে কোন পরিবর্তন আসে না বরং কুরআন পড়ার পরও কুরআন যা নিষেধ করে মানুষ তা সব করে যেতে থাকে তা একজন মুমিনের কুরআন তেলাওয়াত হতেই পারে না। মূলত: কুরআনের হারামকৃত জিনিসকে যে হালাল করে নিয়েছে যে কুরআনের প্রতি ঈমানই আনেনি। এ অবস্থাটিকে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি ছোট্ট বাক্যের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছেনঃ “কুরআন তোমার পক্ষে বা বিপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ।” [মুসলিম: ২২৩]

(৩) কুরআন তেলাওয়াতের পর দ্বিতীয় যে কাজটির প্রতি উম্মতকে অনুবর্তী করার নির্দেশ এখানে দেয়া হয়েছে তা হলো, সালাত৷ সালাতকে অন্যান্য ফরয কর্ম থেকে পৃথক করার এই রহস্যও বর্ণিত হয়েছে যে, সালাত স্বকীয়ভাবেও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত এবং দ্বীনের স্তম্ভ। এর উপকারিতা এই যে, যে ব্যক্তি সালাত কায়েম করে, সালাত তাকে অশ্লীল ও গৰ্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে। [ইবন কাসীর] আয়াতে ব্যবহৃত “ফাহশা’ শব্দের অর্থ এমন সুস্পষ্ট মন্দ কাজ, যাকে প্রত্যেক বুদ্ধিমান ব্যক্তিই মন্দ মনে করে; যেমন ব্যভিচার, অন্যায় হত্যা, চুরি, ডাকাতি ইত্যাদি। পক্ষান্তরে ‘মুনকার’ এমন কথা ও কাজকে বলা হয়, যার হারাম ও অবৈধ হওয়ার ব্যাপারে শরীআত বিশারদগণ একমত। [বাগভী; ফাতহুল কাদীর] ‘ফাহশা’ ও ‘মুনকার’ শব্দদ্বয়ের মধ্যে যাবতীয় অপরাধ এবং প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য গোনাহ দাখিল হয়ে গেছে। যেগুলো স্বয়ং নিঃসন্দেহরূপে মন্দ এবং সৎকর্মের পথে সর্ববৃহৎ বাধা। সালাতের মাধ্যমে এ সকল বাধা দূরীভূত হয়।

(৪) এখানে কেউ কেউ সন্দেহ করে যে, অনেক মানুষকে সালাতের অনুবর্তী হওয়া সত্বেও বড় বড় গুনাহে লিপ্ত থাকতে দেখা যায়। এটা আলোচ্য আয়াতের পরিপন্থী নয় কি? এর কয়েকটি জওয়াব দেয়া হয়। এক. প্রকৃত সালাত আদায়কারীকে সালাত অবশ্যই অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখবে। হাসান ও কাতাদাহ বলেন, যার সালাত তাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে দূরে রাখল না সে সালাত দ্বারা আল্লাহ থেকে দূরেই রয়ে গেল। [তাবারী] দুই. ইবন কাসীর বলেন, এর অর্থ যারা নিয়মিত সালাত আদায় করবে, তাদের এ অবস্থাটি তৈরী হবে। হাদীসে এসেছে, এক লোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, অমুক লোক রাতে সালাত আদায় করে, আর সকাল হলে চুরি করে। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অচিরেই তার সালাত তাকে তা থেকে নিষেধ করবে। [মুসনাদে আহমাদ: ২/৪৪৭]

(৫) অর্থাৎ আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ। এর কয়েকটি অর্থ হতে পারে। এক, আল্লাহর যিকির সবচেয়ে বড় ইবাদাত। সালাত বড় ইবাদাত হবার কারণ হচ্ছে, এতে আল্লাহর যিকির থাকে। সুতরাং যে সালাতে যিকির বেশী সে সালাত বেশী উত্তম। [ইবন কাসীর; মুয়াস্‌সার]। দ্বিতীয় অর্থ হচ্ছে, আল্লাহর স্মরণ অনেক বড় জিনিস, সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ। মানুষের কোন কাজ এর চেয়ে বেশী বড় নয়। [তাবারী] এর তৃতীয় অর্থ হচ্ছে, তোমার আল্লাহকে স্মরণ করার চাইতে আল্লাহ কর্তৃক তোমাকে স্মরণ করা অনেক বেশী বড় জিনিস। [তাবারী]

কুরআনে মহান আল্লাহ বলেনঃ “তোমরা আমাকে স্মরণ করো আমি তোমাদের স্মরণ করবো।” সূরা আল-বাকারাহ: ১৫২] কাজেই বান্দা যখন সালাতে আল্লাহকে স্মরণ করবে। তখন অবশ্যই আল্লাহও তাকে স্মরণ করবেন। আর বান্দার আল্লাহকে স্মরণ করার তুলনায় আল্লাহর বান্দাকে স্মরণ করা অনেক বেশী উচ্চমানের। বান্দা যখন আল্লাহকে স্মরণ করে, তখন আল্লাহ ওয়াদা অনুযায়ী স্মরণকারী বান্দাকে ফেরেশতাদের সমাবেশেও স্মরণ করেন। আল্লাহর এ স্মরণ ইবাদতকারী বান্দার সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। এ স্থলে অনেক সাহাবী ও তাবেয়ী থেকে এই অর্থই বর্ণিত আছে। এই অর্থের দিক দিয়ে এতে এদিকেও ইঙ্গিত আছে যে, সালাত পড়ার মধ্যে গোনাহ থেকে মুক্তির আসল কারণ হল আল্লাহ্ স্বয়ং সালাত আদায়কারীর দিকে অভিনিবেশ করেন এবং ফেরেশতাদের সমাবেশে তাকে স্মরণ করেন। [দেখুন: বাগভী]

তাফসীরে জাকারিয়া

(৪৫) তোমার প্রতি যে গ্রন্থ অহী করা হয়েছে তা পাঠ কর[1] এবং যথাযথভাবে নামায পড়।[2] নিশ্চয় নামায অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। [3] আর অবশ্যই আল্লাহর স্মরণ সর্বশ্রেষ্ঠ।[4] তোমরা যা কর আল্লাহ তা জানেন।

[1] কুরআন কারীম তেলাঅত (বা পাঠ) করার আদেশ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়েছে; নেকী লাভের উদ্দেশ্যে, তার অর্থ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার উদ্দেশ্যে, শিক্ষা ও উপদেশ দেওয়া-নেওয়ার উদ্দেশ্যে। তেলাঅতের এই আদেশের মাঝে সব কিছু শামিল আছে।

[2] কারণ (প্রকৃত) নামাযের মাধ্যমে মানুষের সাথে আল্লাহর এক বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। যার ফলে মানুষের উপর আল্লাহর সাহায্য আসে। যে সাহায্য তার জীবনের সর্বত্রই সুপ্রতিষ্ঠা ও দৃঢ় মনোভাবের কারণ এবং হিদায়াতের সহায়ক হয়। এই জন্যই কুরআন কারীমে বলা হয়েছে ‘‘হে মু’মিনগণ তোমরা ধৈর্য ও নামাযের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা কর।’’ (সূরা বাক্বারাহ ১৫৩ আয়াত) নামায ও ধৈর্য এমন কোন দৃশ্য বস্তু নয় যে, মানুষ তা ধরে বসে সাহায্য অর্জন করবে। এ তো অদৃশ্য বস্তু। উদ্দেশ্য হল, তার মাধ্যমে প্রভুর সাথে মানুষের যে বিশেষ সম্পর্ক কায়েম হয়, সেই সম্পর্ক তার জীবনের পদে পদে সাহায্য ও তাকে পথ প্রদর্শন করে থাকে। যার জন্য মহানবী (সাঃ)-কে রাত্রের অন্ধকারে নির্জনে তাহাজ্জুদ নামায আদায় করার প্রতি তাকীদ করা হয়েছিল। কারণ, নবী (সাঃ)-কে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্বভার দেওয়া হয়েছিল তাতে তাঁর জন্য আল্লাহর অনেক সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। আর এই কারণেই যখন নবী (সাঃ) কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজের সম্মুখীন হতেন, তখন তিনি নামায পড়তেন। (আহমাদ, আবূ দাঊদ)

[3] অর্থাৎ, অশ্লীল ও মন্দ কর্ম থেকে বিরত থাকার কারণ ও মাধ্যম হয়। যেমন ঔষধের নানা প্রতিক্রিয়া আছে এবং বলাও হয় যে, অমুক ঔষধে অমুক অসুখ ভাল হয়। আর বাস্তবে তা হয়েও থাকে। কিন্তু তা তখনই সম্ভব, যখন দুটি কথা পালন করা হবে, প্রথমতঃ ঔষধ ডাক্তারের পরামর্শ মত নিয়মিত সেবন করতে হবে। আর দ্বিতীয়তঃ এমন সকল জিনিস থেকে পরহেয করতে বা বিরত থাকতে হবে, যা ঔষধের প্রতিক্রিয়া-ক্ষমতাই নষ্ট করে ফেলে। অনুরূপ আল্লাহ তাআলা অবশ্যই নামাযে এমন আধ্যাত্মিক ক্ষমতা রেখেছেন, যা মানুষকে অশ্লীল এবং মন্দ কর্ম থেকে বিরত রাখতে পারে। কিন্তু তা তখনই সম্ভব, যখন নামায মহানবী (সাঃ)-এর সুন্নাহ ও তরীকা অনুযায়ী ঐ সকল আদব ও শর্ত পালন করার সাথে আদায় করা হবে, যা তার শুদ্ধ ও গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য অপরিহার্য করা হয়েছে। যেমন তার প্রথম হলঃ ইখলাস ও হৃদয়-বিশুদ্ধতা, অর্থাৎ কেবল তাঁর সন্তুষ্টির জন্য হওয়া এবং নামাযে আল্লাহ ছাড়া অন্যের দিকে মনোযোগ না হওয়া। দ্বিতীয়ঃ পবিত্রতা, তৃতীয়ঃ নির্দিষ্ট সময় মত জামাআত সহকারে তা আদায় করা। চতুর্থঃ নামাযের আরকান (ক্বিরাআত, রুকূ, কাওমাহ, সিজদাহ ইত্যাদি) পূর্ণরূপে ধীরতা ও স্থিরতার সাথে আদায় করা। পঞ্চমঃ একাগ্রতা এবং বিনয় বজায় রাখা। ষষ্ঠঃ নিয়মনিষ্ঠ হয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে তা আদায় করতে থাকা। সপ্তমঃ হালাল রুযী খাওয়া। বস্তুতঃ আমাদের নামায এই সকল আদব ও শর্তশূন্য, ফলে তার সেই প্রভাব আমাদের জীবনে প্রকাশ পাচ্ছে না, যা কুরআন করীমে বলা হয়েছে। অনেকে এই আয়াতের খবরকে আদেশার্থে গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ নামাযীদের জন্য জরুরী যে, তারা অশ্লীল ও মন্দ কর্ম হতে বিরত থাকবে।

[4] অর্থাৎ, অশ্লীল ও মন্দ কর্ম হতে বিরত রাখতে আল্লাহর যিকর (স্মরণ) নামায থেকেও বেশি প্রভাব-ক্ষমতা রাখে । কারণ, মানুষ যতক্ষণ নামাযে থাকে, ততক্ষণ মন্দ কর্ম থেকে বিরত থাকে। কিন্তু পরে তার প্রভাব কম হয়ে যায়। পক্ষান্তরে সর্বদা আল্লাহর যিকর মানুষকে সর্বক্ষণের জন্য মন্দ কর্মে বাধা দিয়ে থাকে।

তাফসীরে আহসানুল বায়ান