৪৪২০

পরিচ্ছেদঃ ৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - চুল আঁচড়ানো

৪৪২০-[২] আবূ হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ পাঁচটি জিনিস ফিতরাত- ১. খতনা করা, ২. নাভির নিম্নের অবাঞ্ছিত লোম পরিষ্কার করা, ৩. গোঁফ কাটা, ৪. নখ কাটা, ৫. বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা। (বুখারী ও মুসলিম)[1]

بَابُ التَّرَجُّلِ

وَعَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: الْفِطْرَةُ خَمْسٌ: الْخِتَانُ وَالِاسْتِحْدَادُ وَقَصُّ الشَّارِبِ وَتَقْلِيمُ الْأَظْفَارِ ونتفُ الإِبطِ

وعن ابي هريرة قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم الفطرة خمس الختان والاستحداد وقص الشارب وتقليم الاظفار ونتف الابط

ব্যাখ্যাঃ (الْفِطْرَةُ خَمْسٌ) ফিতরাহ্ অর্থাৎ ইসলামের ফিতরাত পাঁচটি। ফিতরাত বলা হয় মানুষের ঐ স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যকে, যে বৈশিষ্ট্যের উপর তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে। কাযী এবং অন্যরা বলেনঃ হাদীসে যে ফিতরাতের কথা বলা হয়েছে এর ব্যাখ্যা পুরাতন সুন্নাত দিয়ে দেয়া হয়ে থাকে। অর্থাৎ এ বৈশিষ্ট্যগুলো এমন পুরাতন সুন্নাত যা সব নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম গ্রহণ করেছেন এবং সকলের শারী‘আত এ ব্যাপারে একমত। এগুলো যেন এমন বৈশিষ্ট্য, যার উপর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে। ‘আল্লামা সুয়ূত্বী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘ফিতরাত’ শব্দের যত ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে তন্মধ্যে এ ব্যাখ্যাটি সর্বোত্তম। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

এখানে যে পাঁচটি ফিতরাত তথা স্বভাবজাত সুন্নাত বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে তার একটি হলো :

(الْخِتَانُ) ‘খিতান’ এর অর্থ হলো খৎনা করা। খৎনা কাকে বলে তা সকলেরই জানা। খৎনা সকল নবীদেরই পুরাতন সুন্নাত। আমাদের জন্যও খৎনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুন্নাত, এতে কারো দ্বিমত নেই। তবে এ সুন্নাতটির গুরুত্ব ও পর্যায় নিয়ে ‘উলামার মাঝে কিছুটা দ্বিমত লক্ষ্য করা যায়। ইমাম শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ)-সহ অনেক ‘আলিমের নিকট খৎনা করা সুন্নাতটি ওয়াজিব। অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কর্ম হিসেবে এটি সুন্নাত বা তাঁর পালিত একটি নিয়ম হলেও এ সুন্নাতটি আদায় করা সকলের ওপর ওয়াজিব। অপরদিকে ইমাম মালিকসহ অধিকাংশ ‘আলিমদের মতে খৎনার হুকুম সুন্নাত। (শারহুন নাবাবী ৩য় খন্ড, হাঃ ২৫৭/৪৯)

ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহিমাহুল্লাহ)-সহ অনেকেই খৎনা করাকে সুন্নাত বললেও এর গুরুত্ব সকলের নিকট ওয়াজিব পর্যায়ের। কেননা খৎনা করা ইসলামের এক বিশেষ নিদর্শন বলে গণ্য। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাহ্যিক নাপাকি থেকে পবিত্রতা রক্ষার ক্ষেত্রেও খৎনার বিশেষ ভূমিকা রয়েছে।

পুরুষের ক্ষেত্রে খৎনা করা যেমন সুন্নাত, মহিলার ক্ষেত্রেও সুন্নাত। তবে মহিলার ক্ষেত্রে খৎনার গুরুত্ব পুরুষের মতো নয়। মহিলার ক্ষেত্রে খৎনার বিধান নিয়ে ‘উলামায়ে কিরাম জায়িয, মুস্তাহাব, সুন্নাত, ওয়াজিবের মতানৈক্য করে থাকেন। তবে বিশুদ্ধ মত হলো, মহিলাদের ক্ষেত্রেও তা সুন্নাত। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ الْخِتَانُ سُنَّةٌ لِلرِّجَالِ مَكْرُمَةٌ لِلنِّسَاءِ ‘‘খৎনা পুরুষের জন্য সুন্নাত, মহিলাদের জন্য সম্মানের পরিচায়ক’’। ইমাম আহমাদ হাসান সনদে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

(الِاسْتِحْدَادُ) স্বভাবজাত সুন্নাতের আরেকটি সুন্নাত হলো ‘ইসতিহদাদ’। ‘ইসতিহদাদ’ এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘হাদীদ’ বা লৌহ বিশেষের ব্যবহার। এর দ্বারা ক্ষুর দ্বারা নাভির নিচের পশম কাটা উদ্দেশ্য। ক্ষুর দ্বারা নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা সুন্নাত। এর দ্বারা এই স্থানকে আবর্জনামুক্ত ও পরিষ্কার রাখা উদ্দেশ্য। ক্ষুর দ্বারা নাভির নিচের লোমকে চেঁছে ফেলা বা কামিয়ে ফেলা উত্তম। তবে কাঁচি দিয়ে ছাঁটা বা উপড়িয়ে ফেলা অথব চুনা ব্যবহারের মাধ্যমে লোম তুলে ফেলাও বৈধ। নাভির নিচের লোম বলতে পুরুষের লজ্জাস্থানের উপর ও তার আশপাশে যত লোম রয়েছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। এভাবে মহিলার লজ্জাস্থানের আশপাশে যত লোম রয়েছে সবই এর অন্তর্ভুক্ত। লজ্জাস্থানের সামনের রাস্তা ও পিছনের রাস্তার আশপাশের সকল লোম কামিয়ে নেয়া বা কর্তন করে নেয়া এ বিধানের অন্তর্ভুক্ত। (শারহুন নাবাবী ৩য় খন্ড, হাঃ ২৫৭/৪৯)

(قَصُّ الشَّارِبِ) অর্থাৎ গোঁফ কর্তন করা। অর্থাৎ উপরের ঠোটের উপর গজানো পশমকে একেবারে মূল থেকে না ছেঁটে কেটে নেয়া সুন্নাত। তবে গোঁফ কর্তনের বেলায় হাদীসে বিভিন্ন ধরনের শব্দ ব্যববহার করা হয়েছে। কাটা, ছাটা, কামানো, ছোট করা সব ধরনের শব্দই গোঁফ কর্তনের নির্দেশে ব্যবহার করা হয়েছে। তাই ‘উলামা এ ব্যাপারে মতানৈক্য পোষণ করেন। কারো মতে কাটা সুন্নাত, আবার কারো মতে ছাটা সুন্নাত, আবার কারো মতে উভয়টার অবকাশ রয়েছে। ইমাম তাবারী এ ব্যাপারে উভয় মতামত আলোচনা করে বলেন, সুন্নাতে উভয়টিরই অবকাশ পাওয়া যায়। তাই কোন বিরোধ নেই। (‘আওনুল মা‘বূদ ৭ম খন্ড, হাঃ ৪১৯৪)

(تَقْلِيمُ الْأَظْفَارِ) নখ কর্তন করা। স্বভাবজাত সুনণাতের আরেকটি হলো হাত ও পায়ের নখ কেটে নেয়া। ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) তাঁর শারহু মুসলিমে লিখেন, নখ কাটার বেলায় মুস্তাহাব হলো, প্রথমে হাতের নখ কাটা এবং পরে পায়ের নখ কাটা। হাতের মধ্যে আবার প্রথমে ডান হাতের শাহাদাত অঙ্গুলির নখ, এরপর মধ্যমা, এরপর অনামিকা, এরপর কনিষ্ঠা, এরপর বৃদ্ধাঙ্গুলির নখ কাটবে। তারপর বাম হাতের প্রথমে কনিষ্ঠা, এরপর অনামিকা- এই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে বৃদ্ধাঙ্গুলিতে আসবে। এরপর ডান পায়ের কনিষ্ঠা থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে বাম পায়ের কনিষ্ঠায় গিয়ে শেষ করবে। (শারহুন নাবাবী ৩য় খন্ড, হাঃ ২৫৭/৪৯)

এভাবে কেউ নখ কাটার মুস্তাহাব পদ্ধতি এবং মুস্তাহাব সময় বৃহস্পতিবারের কথা উল্লেখ করেন। মুল্লা ‘আলী কারী (রহিমাহুল্লাহ) এগুলো বর্ণনার পর বলেনঃ বৃহস্পতিবারে নখ কাটার ব্যাপারে কোন হাদীস নেই। বরং যেভাবেই প্রয়োজন পড়বে কাটবে। অনুরূপভাবে নখ কাটার পদ্ধতি ও তার বার নির্ধারণের বেলায় কিছুই প্রমাণিত নয়। নখ কাটার ধারাবাহিকতার ক্ষেত্রে ‘আলী  বা অন্যদের দিকে যা সম্পৃক্ত করা তার সবই বাতিল। (মিরক্বাতুল মাফাতীহ)

(نتفُ الإِبطِ) বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা। বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা সবার ঐকমত্যে সুন্নাত। যে ব্যক্তি উপড়িয়ে ফেলতে সক্ষম তার জন্য এটাই উত্তম। তবে কামিয়ে ফেললে বা চুনা দ্বারা তুলে নিলেও সুন্নাত আদায় হয়ে যাবে। ইউনুস ইবনু ‘আবদুল আ‘লা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ)-এর কাছে গেলাম। তখন তার কাছে সজ্জাকারী ব্যক্তি ছিল যে তার বগলের লোম কামিয়ে দিচ্ছে। শাফি‘ঈ (রহিমাহুল্লাহ) তখন বললেন, আমি জানি, সুন্নাত হলো উপড়িয়ে ফেলা। কিন্তু ব্যথার কারণে আমি তা করতে সক্ষম নই। (শারহুন নাবাবী ৩য় খন্ড, হাঃ ২৫৭/৪৯)

উল্লেখ্য যে, এ হাদীসে ফিতরাত বা স্বভাবজাত সুন্নাত পাঁচটির কথা বলা হয়েছে। আবার অন্য হাদীসে বলা হয়েছে-

عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ قَصُّ الشَّارِبِ وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ وَالسِّوَاكُ وَالاِسْتِنْشَاقُ بِالْمَاءِ وَقَصُّ الأَظْفَارِ وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ وَنَتْفُ الإِبِطِ وَحَلْقُ الْعَانَةِ وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ

‘‘দশটি বিষয় ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ ছাঁটা, দাড়ি ছেড়ে দেয়া, মিসওয়াক করা, নাকে (উযূ করার সময়) পানি নেয়া, নখ কাটা, আঙ্গুলের জোড়া বা গাট ধৌত করা, বগলের লোম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের লোম কর্তন করা, পানি দিয়ে ইসতিঞ্জা করা।’’

এখানে দশটি ফিতরাতের কথা উল্লেখ করে নয়টি বলার পর বর্ণনাকারী বলেনঃ আমি দশ নাম্বারটি ভুলে গেছি। তবে তা কুলি করা হতে পারে।

আমরা লক্ষ্য করলে দেখব যে, এ হাদীসে অতিরিক্ত যে ফিতরাতের কথা বলা হয়েছে যা উপরের হাদীসে নেই সেগুলো হলো : দাড়ি ছেড়ে দেয়া, মিসওয়াক করা, নাকে (উযূতে) পানি নেয়া, আঙ্গুলের জোড়া বা গাট ধৌত করা, ইসতিঞ্জা করা। বর্ণনাকারীর সন্দেহমূলক আরেকটি হলো কুলি করা। আবার উপরের হাদীসে খৎনা করার কথা বলা হয়েছে যা এ হাদীসে নেই। অতএব দুই হাদীস মিলিয়ে মোট এগারটি ফিতরাত বা স্বভাবজাত সুন্নাতের কথা বলা হলো। তবে একটি হাদীসে পাঁচটি, আবার অপর হাদীসে দশটি বলার কারণ বা উভয় হাদীসের মধ্যে বাহ্যিক বিরোধ নিরসন করার উপায় কি?

এর উত্তরে ‘উলামায়ে কিরাম বলেনঃ স্বভাবজাত সুন্নাত পাঁচটি বা দশটির ভিতর সীমাবদ্ধ নয়। বরং স্বভাবজাত বেশকিছু সুন্নাতের মধ্যে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে পাঁচটির কথা বলেছেন, আরেক হাদীসে দশটির কথা বলেছেন। আর সীমাবদ্ধ নয় বলেই বর্ণনায় (مِنَ الْفِطْرَةِ) শব্দটি এসেছে। যার অর্থ হলো, ফিতরাতের মধ্য থেকে এগুলো হলো উল্লেখযোগ্য। (শারহুন নাবাবী ৩য় খন্ড, হাঃ ২৫৭/৪৯)


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
বর্ণনাকারীঃ আবূ হুরায়রা (রাঃ)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-২২: পোশাক-পরিচ্ছদ (كتاب اللباس )