৩৩০৭

পরিচ্ছেদঃ ১৪. প্রথম অনুচ্ছেদ - লি‘আন

৩৩০৭-[৪] ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদিন হিলাল ইবনু উমাইয়্যাহ্ (রাঃ) তার স্বীয় স্ত্রীর ওপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অভিযোগ করেন যে, সে শরীক ইবনু সাহমাহ্-এর সাথে ব্যভিচারের লিপ্ত হয়েছে। এটা শুনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ কর, অন্যথায় তোমার পিঠে (মিথ্যা অপবাদের দরুন) শাস্তি দেয়া হবে। তিনি উত্তরে বললেন, হে আল্লাহর রসূল! যখন কোনো স্বামী স্বীয় স্ত্রীর সাথে কোনো পুরুষকে ব্যভিচারে লিপ্ত দেখতে পাবে, তখন কি সে (ত্বলাক (তালাক)ের জন্য) সাক্ষ্য-প্রমাণ সন্ধানে বের হবে? কিন্তু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতে থাকলেন, সাক্ষ্য-প্রমাণ নিয়ে এসো, অন্যথায় তোমার পিঠে (মিথ্যা অপবাদের) শাস্তি দেয়া হবে। হিলাল বললেন, শপথ সেই আল্লাহর! যিনি আপনাকে নবীরূপে সত্যায়িত করে পাঠিয়েছেন। আমার (অভিযোগে) আমি নিশ্চয় সত্যবাদী। অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা এমন বিধান নাযিল করবেন, যার দরুন আমার পিঠ (অপবাদের) কোড়া হতে রক্ষা করবেন। (রাবী বলেন) অতঃপর জিবরীল (আঃ) অবতরণ করে (নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর ওপর) আল্লাহর আয়াত নাযিল করলেন- অর্থাৎ- ’’এবং যারা নিজের স্ত্রীর প্রতি অপবাদ আরোপ করে ..... তার স্বামী সত্যবাদী হলে’’- (সূরা আন্ নূর ২৪ : ৬-৯ আয়াত) পর্যন্ত পৌঁছলেন।

এরপর হিলাল এসে (স্ত্রীসহ) লি’আনের জন্য প্রস্তুত হলো। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উভয়কে বলতে লাগলেন- জেনে রাখ, নিশ্চয় আল্লাহ অবগত আছেন যে, তোমাদের মধ্যে একজন মিথ্যাবাদী। অতএব তোমাদের মধ্যে কেউ কি তওবা্ করতে প্রস্তুত? (উভয়ের অনড় অবস্থানের দরুন) অতঃপর তার স্ত্রী উঠে দাঁড়াল এবং লি’আনের সাক্ষ্য দিল। কিন্তু যখন পঞ্চমবারে সে উদ্যত হলো, তখন উপস্থিত লোকেরা তাকে থামাতে চেষ্টা করে বলল, সাবধান! এবারের শপথে আল্লাহর গযব অবধারিত (তাই বিরত হও)। এতে স্ত্রীলোকটি থেমে গেল এবং স্থির হয়ে গেল। আমাদের ধারণা হতে লাগল যে, স্ত্রীলোকটি স্বীয় দাবি হতে সরে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই এই বলে লি’আন করল যে, চিরকালের জন্য আমি আমার বংশের মর্যাদাহানী করব না, এ কথা বলে সে পঞ্চমবারের শপথও শেষ করল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমরা দেখে রাখবে, যদি সে কালো ভ্রূযুক্ত ও বড় বড় নিতম্ব এবং মোটা নলাবিশিষ্ট সন্তান প্রসব করে, তবে সন্তানটি শরীক ইবনু সাহমাহ্-এর। পরিশেষে স্ত্রীলোকটি এরূপ বর্ণনার সন্তানই প্রসব করল। অতঃপর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যদি আল্লাহর কিতাবের হুকুম-আহকাম জারী না হতো, তবে আমি ঐ স্ত্রীলোকটিকে নিদারুণ শিক্ষা দিতাম। (বুখারী)[1]

بَابُ اللِّعَانِ

وَعَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ: أَنَّ هِلَالَ بْنَ أُمَيَّةَ قَذَفَ امْرَأَتَهُ عِنْدَ النَّبِيِّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشَرِيكِ بْنِ سَحْمَاءَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «الْبَيِّنَةَ أَوْ حَدًّا فِي ظَهْرِكَ» فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ إِذَا رَأَى أَحَدُنَا عَلَى امْرَأَتِهِ رَجُلًا يَنْطَلِقُ يَلْتَمِسُ الْبَيِّنَةَ؟ فَجَعَلَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «الْبَيِّنَةَ وَإِلَّا حَدٌّ فِي ظَهْرِكَ» فَقَالَ هِلَالٌ: وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ إِنِّي لَصَادِقٌ فَلْيُنْزِلَنَّ اللَّهُ مَا يُبَرِّئُ ظَهْرِي مِنَ الْحَدِّ فَنَزَلَ جِبْرِيلُ وَأنزل عَلَيْهِ: (وَالَّذين يرْمونَ أَزوَاجهم)
فَقَرَأَ حَتَّى بَلَغَ (إِنْ كَانَ مِنَ الصَّادِقِينَ)
فَجَاءَ هِلَالٌ فَشَهِدَ وَالنَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ: «إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ أَنَّ أَحَدَكُمَا كَاذِبٌ فَهَلْ مِنْكُمَا تَائِبٌ؟» ثُمَّ قَامَتْ فَشَهِدَتْ فَلَمَّا كَانَتْ عِنْدَ الْخَامِسَةِ وَقَفُوهَا وَقَالُوا: إِنَّهَا مُوجِبَةٌ فَقَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ: فَتَلَكَّأَتْ وَنَكَصَتْ حَتَّى ظَنَنَّا أَنَّهَا تَرْجِعُ ثُمَّ قَالَتْ: لَا أَفْضَحُ قَوْمِي سَائِرَ الْيَوْمِ فَمَضَتْ وَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «أَبْصِرُوهَا فَإِنْ جَاءَتْ بِهِ أَكْحَلَ الْعَيْنَيْنِ سَابِغَ الْأَلْيَتَيْنِ خَدَلَّجَ السَّاقِينَ فَهُوَ لِشَرِيكِ بْنِ سَحْمَاءَ» فَجَاءَتْ بِهِ كَذَلِكَ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «لَوْلَا مَا مَضَى مِنْ كِتَابِ اللَّهِ لَكَانَ لِي وَلَهَا شَأْن» . رَوَاهُ البُخَارِيّ

وعن ابن عباس ان هلال بن امية قذف امراته عند النبي صلى الله عليه وسلم بشريك بن سحماء فقال النبي صلى الله عليه وسلم البينة او حدا في ظهرك فقال يا رسول الله اذا راى احدنا على امراته رجلا ينطلق يلتمس البينة فجعل النبي صلى الله عليه وسلم يقول البينة والا حد في ظهرك فقال هلال والذي بعثك بالحق اني لصادق فلينزلن الله ما يبرى ظهري من الحد فنزل جبريل وانزل عليه والذين يرمون ازواجهمفقرا حتى بلغ ان كان من الصادقينفجاء هلال فشهد والنبي صلى الله عليه وسلم يقول ان الله يعلم ان احدكما كاذب فهل منكما تاىب ثم قامت فشهدت فلما كانت عند الخامسة وقفوها وقالوا انها موجبة فقال ابن عباس فتلكات ونكصت حتى ظننا انها ترجع ثم قالت لا افضح قومي ساىر اليوم فمضت وقال النبي صلى الله عليه وسلم ابصروها فان جاءت به اكحل العينين سابغ الاليتين خدلج الساقين فهو لشريك بن سحماء فجاءت به كذلك فقال النبي صلى الله عليه وسلم لولا ما مضى من كتاب الله لكان لي ولها شان رواه البخاري

ব্যাখ্যা: (إِنَّ اللّٰهَ يَعْلَمُ أَنَّ أَحَدَكُمَا كَاذِبٌ فَهَلْ مِنْكُمَا تَائِبٌ؟) অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘আল্লাহ জানেন নিশ্চয় তোমাদের একজন মিথ্যুক। তোমাদের মধ্যে কি কোনো একজন তাওবাকারী আছে?’’ অর্থাৎ তোমাদের উভয়ে জিদের উপর না থেকে প্রকৃত কথা স্বীকার করে নিলে হয়। দু’জনের একজন নিশ্চিত মিথ্যুক। বাহযত মনে হয় রসূলুল্লাহ এই কথা লি‘আন কার্যকর হওয়ার পর বলেছেন। উদ্দেশ্য হলো যে, মিথ্যুক যেন তাওবাহ্ করে নেয়। আবার লি‘আনের পূর্বেই তাদেরকে সতর্ক করার জন্যও বলতে পারেন। প্রকৃতপক্ষে যে মিথ্যুক সে যেন লি‘আন দ্বারা নিজের উপর অভিশাপ ডেকে না আনে। (মিরকাতুল মাফাতীহ)

(إِنَّهَا مُوجِبَةٌ) নিশ্চয় এটা সাব্যস্তকারী। অর্থাৎ এভাবে নিজের ওপর অভিশাপ দেয়া নিজের বিপদ ডেকে আনা। যে লি‘আনের মাধ্যমে নিজের ওপর অভিশাপের দু‘আ করে তা কার্যকর হয়ে যায়। তাই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাকে থামাও। কেননা সে এর পরিণতি লক্ষ্য না করে লি‘আন করেই যাচ্ছে।

হাদীস থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিশ্চয় বুঝে নিয়েছিলেন যে, প্রকৃত মিথ্যাবাদী হিলাল নয়, বরং তার স্ত্রীই মিথ্যাবাদী। বিভিন্ন আলামত থেকে বিষয়টি মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে। বিশেষ করে হিলালের দাবীর উপর আয়াত নাযিল হওয়া তার একটি প্রমাণ। সত্য কথা বলে সাক্ষী নিয়ে আসতে না পারার অপরাধে তিনি যেন অপরাধী হয়ে শাস্তি ভোগ না করেন, তাই আল্লাহ তার কথার পর পরই এ সংক্রান্ত বিধান নাযিল করেন। বিভিন্ন নিদর্শন থেকে হিলালের স্ত্রী মিথ্যাবাদী হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও যিনা সাব্যসেত্মর শারী‘আত দলীল না থাকায় তার ওপর যিনার বিধান আরোপ করা হয়নি। এ থেকে বুঝা যায়, বিচারককে সর্বদা দলীলের উপর নির্ভর করতে হবে। যে বস্তু প্রমাণের জন্য যে দলীল শারী‘আত কর্তৃক নির্ধারিত সেই দলীল ছাড়া অন্য কোনা আকার ইঙ্গিতে কোনো কিছু বুঝা গেলে এর উপর নির্ভর করে কোনো ফায়সালা করা যাবে না।

(لَا أَفْضَحُ قَوْمِىْ سَائِرَ الْيَوْمِ) অর্থাৎ এখন যিনার স্বীকারোক্তি করে আমার গোত্রকে সর্বদার জন্য লাঞ্ছিত করব না। অর্থাৎ যিনা স্বীকার করলে আমাকে ও আমার গোত্রকে লাঞ্ছনার কালিমা লেপন করতে হবে। এখান থেকে জানা যায় যে, হিলালের দাবীর ভিত্তিতে যিনার স্বীকার না করা কেবল তার দুনিয়াবী লাঞ্ছনা থেকে বাঁচার কারণে ছিল। দুনিয়ার স্বার্থ আখিরাতের তুলনায় বড় করে দেখার কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নাসীহাত তার কাছে কাজে আসেনি।

(فَإِنْ جَاءَتْ بِه أَكْحَلَ الْعَيْنَيْنِ) ‘‘যদি সে জন্ম দেয় কাজলকালো চোখওয়ালা.....।’’ হাদীসের এই অংশ থেকে বাহযত বুঝা যায় যে, সাদৃশ্য থেকে কারো বংশ নির্বাচন করা যেতে পারে। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু নিশ্চিত নয়, তাই কেবল সাদৃশ্যের মাধ্যমে কারো বংশ সাব্যস্ত হবে না। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাদৃশ্যের ভিত্তিতে বাচ্চাকে একজনের দিকে সম্পৃক্ত করলেও বিষয়টিকে একটি অনুমানমূলক হিসেবে ধরা হয়েছে। কেননা সাদৃশ্য বংশের চূড়ান্ত ফায়সালা হলে রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে বাচ্চা প্রসবের অপেক্ষা করে বাচ্চা দেখে লি‘আন না করেই হিলালের স্ত্রীকে যিনাকারিণী সাব্যস্ত করে যিনার বিধান জারী করতে পারতেন। রসূলের এমনটি না করাই প্রমাণ করে, তাঁর এ কথাটি একটি ধারণার উপর ছিল। যদিও রসূলের ধারণা সঠিক। এছাড়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওয়াহীর মাধ্যমে বিষয়টি জানার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু শারী‘আত দলীল না থাকায় যিনার বিধান কার্যকর করা যায়নি। তাই এ হাদীসের আলোকে বাচ্চার সাদৃশ্যতা দেখে কাউকে তার দিকে সম্পৃক্ত করা যাবে না এবং কোনো মেয়েকে যিনাকারিণী সাব্যস্ত করা যাবে না।

(لَوْلَا مَا مَضٰى مِنْ كِتَابِ اللّٰهِ) যদি আল্লাহর কিতাবে এর হুকুম না যেত, অর্থাৎ যদি আল্লাহ তা‘আলার কিতাবে যিনার বিধান ও তা সাব্যসেত্মর নির্ধারিত নীতি না থাকত তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটা ব্যবস্থা নিতেন। কারণ বিভিন্ন আলামত দ্বারা রসূলের কাছে হিলালের স্ত্রী যিনাকারিণী বলে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যিনার দণ্ডবিধি প্রয়োগের জন্য আল্লাহ তা‘আলার নির্ধারিত হুকুম রয়েছে। তিনি এর বাহিরে যাওয়ার ক্ষমতা রাখেন না। (ফাতহুল বারী ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৭৪৭)

সতর্কতাঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত নাবী ও রসূল। আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে ইজতিহাদ গবেষণা করে মাসআলাহ্ দেয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। কিন্তু ইজতিহাদ বা গবেষণার আলোকে যে হুকুম তিনি দিবেন তা কুরআনের হুকুমের বাহিরে চলে যায় কিনা এ ক্ষেত্রে তার এত ভয় হলে আমরা যারা বিভিন্ন ওজুহাত ও যুক্তির আলোকে কুরআনের ব্যাখ্যার নামে অপব্যাখ্যা করি এবং কুরআনের খেলাফ বিধান দেই তাদের চিন্তা করা উচিত এবং আল্লাহ ও আখিরাতের হিসাবের ভয় করে এমন কর্ম থেকে বিরত থাকা অপরিহার্য।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১৩: বিবাহ (كتاب النكاح)