২৭০৭

পরিচ্ছেদঃ ১৩. প্রথম অনুচ্ছেদ - বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং হজ্জ ছুটে যাওয়া

(الْإِحْصَارِ) ’’ইহসা-র’’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো আবদ্ধ রাখা ও বাধা দেয়া। ইসলামী শারী’আতের পরিভাষায় কাবা ঘরের তাওয়াফ ও ’আরাফাতে অবস্থান করতে বাধা প্রদানকে إِحْصَارِ বলে। যদি কোন ব্যক্তি তাওয়াফ এবং ’আরাফাতে অবস্থান এ দু’টি কাজের কোন একটি কাজ করতে সমর্থ হয় তবে তিনি মুহসার তথা বাধাপ্রাপ্ত নন।

(فوت الحج) হজ্জ/হজ ছুটে যাওয়া।

কোন ধরনের বাধাকে(إِحْصَارِ) বলা হবে- এ সম্পর্কে তিনটি অভিমত পাওয়া যায়।

(১) ’ইহসা-র’ দ্বারা উদ্দেশ্য শত্রু দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। এ মতের প্রবক্তা ইবনু ’আব্বাস, ইবনু ’উমার, আনাস, ইবনুয্ যুবায়র (রাঃ) সা’ঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, সা’ঈদ ইবনু জুবায়র (রহঃ) প্রমুখ এ অভিমত গ্রহণ করেছেন মারওয়ান, ইসহাক প্রসিদ্ধ মতানুযায়ী আহমাদ ইবনু হাম্বল। ইমাম মালিক ও ইমাম শাফি’ঈর মাযহাব এটাই। এ অভিমত অনুযায়ী কোন ব্যক্তি ইহরাম বাধার পর অসুস্থ হয়ে পড়লে তার জন্য হালাল হওয়া বৈধ নয়। এ মতের পক্ষে দলীলঃ

(ক) আল্লাহ তা’আলার বাণী-فَإِنْ أُحْصِرْتُمْ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ ’’কিন্তু যদি তোমরা বাধাগ্রস্ত হও, তবে যা সম্ভব কুরবানী দিবে’’- (সূরা আল বাক্বারাহ্ ২ : ১৯৬)। এ আয়াতটি তখন নাযিল হয়েছে যখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার সহচরবৃন্দ হুদায়বিয়াতে মুশরিকদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। আর উসূলবিদগণের নিকট এটি সর্বসম্মতিক্রমে সাব্যস্ত যে, যে কারণে আয়াত নাযিল হয়েছে ঐ বিষয়টি সন্দেহাতীতভাবে হুকুমের অন্তর্ভুক্ত, কোন বিশেষ কারণ দ্বারা ঐ বিষয়টি ঐ হুকুম থেকে বের করা যায় না।

(খ) বিভিন্ন আসার দ্বারা সাব্যস্ত আছে যে, অসুস্থতার কারণে তাওয়াফ ও সা’ঈ ব্যতীত হালাল হওয়া যায় না। অতএব বুঝা গেল যে, ইহসার দ্বারা শত্রু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হওয়াই উদ্দেশ্য।

(২) ইহসা-র দ্বারা উদ্দেশ্য যে কোন ধরনের বাধা, তা শত্রু কর্তৃক বাধাই হোক অথবা অসুস্থতার কারণে বা অনুরূপ কোন কারণে বাধাপ্রাপ্ত হোক। এ অভিমতের প্রবক্তা হলেন ইবনু মাস্’ঊদ, মুজাহিদ, ’আত্বা, কাতাদা ’উরওয়া ইবনুয্ যুবায়র ইব্রাহীম নাখ্’ঈ, আলক্বমাহ্, সাওরী, হাসান বাসরী, আবূ সাওর ও দাঊদ প্রমুখ ’উলামাগণ। ইমাম আবূ হানীফার অভিমত এটিই।

এ অভিমতের দলীলঃ

(ক) পূর্বে বর্ণিত আয়াত যা দ্বারা শত্রু কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত আছে।

(খ) অসুস্থতা একটি বাধা, তার দলীল- আহমাদ, সুনান আরবা’আহ্, ইবনু খুযায়মাহ্, হাকিম, বায়হাক্বী প্রভৃতি গ্রন্থে হাজ্জাজ ইবনু ’আমর আল আনসারী বর্ণিত হাদীস। তিনি বলেনঃ আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যার হাড় ভেঙ্গে যায় অথবা লেংড়া হয়ে যায় সে হালাল হয়ে যাবে এবং তাকে আবার পুনরায় হজ্জ/হজ করতে হবে। ’ইকরিমাহ্ (রহঃ) বলেনঃ বিষয়টি আমি ইবনু ’আব্বাস ও আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) এর নিকট উপস্থাপন করলে তারা উভয়ে বলেনঃ তিনি সত্য বলেছেন।

প্রথমপক্ষ হাজ্জাজ ইবনু ’আমর (রাঃ) বর্ণিত হাদীসের দু’টি জবাব দিয়েছেনঃ

(ক) অত্র হাদীসে হালাল হওয়া দ্বারা উদ্দেশ্য অসুস্থতা ব্যতীত অন্য কোন কারণে হজ্জ/হজ ছুটে গেলে যেভাবে হালাল হতে হয় এখানেও সেভাবেই হালাল হতে হবে।

(খ) কেউ যদি ইহরামের সময় শর্ত করে যে, যেখানেই সে বাধাপ্রাপ্ত সেখানেই সে হালাল হবে, অনুরূপ অত্র হাদীসে হালাল দ্বারা উদ্দেশ্য শর্তযুক্ত ইহরাম থেকে হালাল হওয়া।

(৩) তৃতীয় অভিমতঃ ইহসার দ্বারা উদ্দেশ্য শুধুমাত্র অসুস্থ হওয়ার কারণে বাধা প্রাপ্ত হওয়া, অন্য কোন ওযর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত উদ্দেশ্য নয়। অধিকাংশ ভাষাবিদগণের অভিমত এটাই।

এদের মতে শত্রু দ্বারা বাধাপ্রাপ্তের হুকুম অসুস্থতার দ্বারা বাধাপ্রাপ্তের হুকুমের সাথে সংযুক্ত।

’আল্লামা শানক্বীত্বী বলেনঃ আমাদের মতে দলীলের ভিত্তিতে ইমাম মালিক, শাফি’ঈ ও আহমাদ ইবনু হাম্বল-এর প্রসিদ্ধ বর্ণনাটিই সঠিক।


২৭০৭-[১] ’আবদুল্লাহ ইবনু ’আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (৬ষ্ঠ হিজরীতে কুরায়শদের দ্বারা ’উমরা করতে গিয়ে) বাধাপ্রাপ্ত হলেন। তখন তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মাথা মুণ্ডন করলেন, স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করলেন এবং কুরবানীর পশু যাবাহ করলেন। অতঃপর পরবর্তী বছর (কাযা হিসেবে) ’উমরা আদায় করলেন। (বুখারী)[1]

بَابُ الْإِحْصَارِ وَفَوْتِ الْحَجِّ

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: قَدْ أُحْصِرَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَحَلَقَ رَأَسَهُ وَجَامَعَ نِسَاءَهُ وَنَحَرَ هَدْيَهُ حَتَّى اعْتَمَرَ عَامًا قَابلا. رَوَاهُ البُخَارِيّ

عن ابن عباس قال قد احصر رسول الله صلى الله عليه وسلم فحلق راسه وجامع نساءه ونحر هديه حتى اعتمر عاما قابلا رواه البخاري

ব্যাখ্যা: (جَامَعَ نِسَاءَه) ‘‘তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার স্ত্রীদের সাথে সহবাস করলেন’’। অর্থাৎ- কুরবানীর পশু যাবাহ করা ও মাথা মুন্ডনের মাধ্যমে পূর্ণ হালাল হওয়ার পর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার স্ত্রীদের সাথে সহবাস করেছেন।

নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হুদায়বিয়ার বৎসর ‘উমরা পালনে বাধাগ্রস্থ হয়ে তাঁর কুরবানীর পশু হেরেমের মধ্যে যাবাহ করেছিলেন না-কি হেরেমের বাইরে যাবাহ করেছিলেন- এ নিয়ে ‘উলামাগণের মাঝে মতভেদ রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলার বাণীঃ ‘‘কুরবানীর পশু যাবাহ করার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছতে অপেক্ষমাণ’’- এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনি হেরেমের বাইরে কুরবানীর পশু যাবাহ করেছিলেন। বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তির কুরবানীর পশু যাবাহ করার স্থান কোনটি এ ব্যাপারে অনেক বক্তব্য রয়েছে।

(১) বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তি যেখানে হালাল হবে সেখানেই কুরবানীর পশু যাবাহ করবে। জমহূর ‘উলামাগণের অভিমত এটি।।

(২) হেরেমের বাইরে কুরবানীর পশু যাবাহ করা যাবে না। হানাফীদের অভিমত এটাই।

(৩) কুরবানীর পশু যদি হেরেমে পৌঁছানো সম্ভব হয় তাহলে তা সেখানে পৌঁছানো ওয়াজিব এবং তা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছাবার পূর্বে হালাল হওয়া বৈধ নয়। আর তা সম্ভব না হলে যেখানে বাধাপ্রাপ্ত হবে সেখানেই যাবাহ করে হালাল হয়ে যাবে।

(حَتّٰى اِعْتَمَرَ عَامًا قَابِلًا) ‘‘পরবর্তী বৎসর তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ‘উমরা করলেন।’’ অর্থাৎ- কুরায়শদের সাথে সন্ধি চুক্তি অনুযায়ী তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) পরবর্তী বৎসর ‘উমরা করলেন।

এ হাদীস দ্বারা দলীল প্রদান করা হয় যে, বাধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে কাযা ‘উমরা করতে হবে। কিন্তু এ হাদীসে কাযা ‘উমরা করার দলীল নেই। কেননা অত্র হাদীসে সংঘটিত ঘটনার বর্ণনা দেয়া হয়েছে। কেননা পরবর্তী বৎসর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ‘উমরা করেন তখন হুদায়বিয়ার বৎসর যে সকল সাহাবী নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হালাল হয়েছিলেন তাদের অনেকেই এ ‘উমরাতে অংশগ্রহণ করেননি। তাদের কোন ওযরও ছিল না। কাযা ‘উমরা করা যদি ওয়াজিব হত তাহলে অবশ্যই নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে তা পালন করতে আদেশ করতেন। অথচ তিনি তা করেননি। তবে যদি কোন ব্যক্তি ওয়াজিব হজ্জ/হজ ও ‘উমরা পালন করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন তাহলে তাকে অবশ্যই তা কাযা করতে হবে। এ বিষয়ে কোন মতভেদ নেই।

অতএব ‘উমরা পালনকারী ব্যক্তি বাধাপ্রাপ্ত হলে তিনি হালাল হয়ে যাবে। আর বাধাপ্রাপ্ত হয়ে হালাল হওয়া শুধুমাত্র হজ্জের জন্য খাস নয়। যেমনটি ইমাম মালিক মনে করে থাকেন।


হাদিসের মানঃ সহিহ (Sahih)
পুনঃনিরীক্ষণঃ
মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত)
পর্ব-১১: হজ্জ (كتاب المناسك)