পরিচ্ছেদঃ ৯৭/১৫. আল্লাহর বাণীঃ আল্লাহ্ তাঁর নিজের সম্বন্ধে তোমাদেরকে সাবধান করছেন- (সূরাহ আলু ‘ইমরান ৩/২৮)। আল্লাহর বাণীঃ আমার অন্তরের কথা আপনি জানেন, কিন্তু আপনার অন্তরের কথা আমি জানি না- (সূরাহ আল-মায়িদাহ ৫/১১৬)।
৭৪০৫. আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ্ ঘোষণা করেন, আমি সে রকমই, যে রকম বান্দা আমার প্রতি ধারণা রাখে। আমি বান্দার সঙ্গে থাকি যখন সে আমাকে স্মরণ করে। যদি সে মনে মনে আমাকে স্মরণ করে; আমিও তাকে নিজে স্মরণ করি। আর যদি সে জন-সমাবেশে আমাকে স্মরণ করে, তবে আমিও তাদের চেয়ে উত্তম সমাবেশে তাকে স্মরণ করি। যদি সে আমার দিকে এক বিঘত এগিয়ে আসে, তবে আমি তার দিকে এক হাত এগিয়ে যাই, যদি সে আমার দিকে এক হাত অগ্রসর হয়; আমি তার দিকে দু’ হাত এগিয়ে যাই। আর সে যদি আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই। [৭৫০৫, ৭৫৩৭; মুসলিম ৪৮/১, হাঃ ১৬৭৫, আহমাদ ৭৪২৬] (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৮৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৯০১)
بَاب قَوْلِ اللهِ تَعَالَى: {وَيُحَذِّرُكُمْ اللهُ نَفْسَهُ} وَقَوْلِهِ جَلَّ ذِكْرُهُ {تَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِي وَلاَ أَعْلَمُ مَا فِي نَفْسِكَ}
عُمَرُ بْنُ حَفْصٍ حَدَّثَنَا أَبِي حَدَّثَنَا الأَعْمَشُ سَمِعْتُ أَبَا صَالِحٍ عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ اللهُ تَعَالَى أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِي بِي وَأَنَا مَعَهُ إِذَا ذَكَرَنِي فَإِنْ ذَكَرَنِي فِي نَفْسِهِ ذَكَرْتُهُ فِي نَفْسِي وَإِنْ ذَكَرَنِي فِي مَلاَ ذَكَرْتُهُ فِي مَلاَ خَيْرٍ مِنْهُمْ وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ بِشِبْرٍ تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ ذِرَاعًا وَإِنْ تَقَرَّبَ إِلَيَّ ذِرَاعًا تَقَرَّبْتُ إِلَيْهِ بَاعًا وَإِنْ أَتَانِي يَمْشِي أَتَيْتُهُ هَرْوَلَةً
হাদীস থেকে শিক্ষা:
১. আল্লাহ সম্পর্কে সু-ধারণা রাখা ফরজ এবং ঈমানের অংশ।
২. আল্লাহর জন্য “নফস” (সত্তা) প্রমাণিত।
৩. আল্লাহ কথা বলেন—এটিও তাঁর একটি গুণ।
৪. গোপনে ও প্রকাশ্যে আল্লাহর যিকরের ফযীলত রয়েছে।
৫. আল্লাহ বান্দাকে তার আমল অনুযায়ী প্রতিদান দেন।
৬. প্রতিদান কর্মের ধরন অনুযায়ী হয়।
Narrated Abu Huraira:
The Prophet (ﷺ) said, "Allah says: 'I am just as My slave thinks I am, (i.e. I am able to do for him what he thinks I can do for him) and I am with him if He remembers Me. If he remembers Me in himself, I too, remember him in Myself; and if he remembers Me in a group of people, I remember him in a group that is better than they; and if he comes one span nearer to Me, I go one cubit nearer to him; and if he comes one cubit nearer to Me, I go a distance of two outstretched arms nearer to him; and if he comes to Me walking, I go to him running.' "
আল্লাহর যিকর (স্মরণ) মুসলিমের জন্য অন্যতম মহৎ ইবাদত। এটি অন্তর্ভুক্ত করে আল্লাহকে মহিমান্বিত করা, প্রশংসা করা, তাঁর আদেশকৃত সকল ইবাদতে লিপ্ত হওয়া—মন, জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে। আল্লাহ বান্দাদেরকে তাঁর যিকরের আদেশ দিয়েছেন এবং এর উপর বিরাট প্রতিদান রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ ﷺ তাঁর প্রভুর পক্ষ থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আল্লাহ বলেন:
“আমি আমার বান্দার আমার ব্যাপারে যেমন ধারণা থাকে, তেমনই থাকি।”
অর্থাৎ, বান্দা যদি আল্লাহর ব্যাপারে ভালো ধারণা পোষণ করে তবে তার জন্য ভালোই হবে, আর যদি খারাপ ধারণা রাখে তবে তার জন্য তাই হবে। আল্লাহ সম্পর্কে সু-ধারণা রাখা মানে হলো—সৎকাজ করা, আল্লাহর করুণা ও অনুগ্রহের আশা রাখা এবং বিশ্বাস করা যে আল্লাহ তা গ্রহণ করবেন।
আল্লাহ বান্দার আশা ও ধারণার সীমাতেই থাকেন। আল্লাহর প্রতিদান বান্দার ধারণা ও কর্ম অনুযায়ী হয়—ভালো বা মন্দ, কল্যাণ বা অকল্যাণ। যে আল্লাহর কাছে বড় কিছু আশা করে, আল্লাহ তাকে তাই দেন, কারণ আল্লাহর জন্য কোনো কিছুই কঠিন নয়। তবে, যদি কেউ আল্লাহর প্রতি ভালো ধারণা রাখে অথচ কোনো আমল না করে, তবে এটি কেবল কল্পনা ও অলস আশা মাত্র, যা আসলে অক্ষমতার লক্ষণ।
আল্লাহ বলেনঃ
“আমি তার সঙ্গে থাকি, যখন সে আমাকে স্মরণ করে।”
অর্থাৎ, বান্দা যখন আল্লাহকে তাসবীহ, তাহলীল বা অন্য কোনো ইবাদতের মাধ্যমে স্মরণ করে—
• একান্তে করলে, আল্লাহ তাঁকে তাঁর সত্তায় স্মরণ করেন।
• আর যদি জনসমক্ষে স্মরণ করে, আল্লাহ তাঁকে ফেরেশতাদের সম্মানিত সমাবেশে স্মরণ করেন।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এর আকীদা হলো—আল্লাহর জন্য “নফস” (সত্তা/নিজস্বতা) প্রমাণিত, যেমন কুরআনে এসেছে:
{وَيُحَذِّرُكُمُ اللَّهُ نَفْسَهُ} — “আল্লাহ তোমাদেরকে তাঁর সত্তা (নিজস্বতা) থেকে সতর্ক করেন।” (আলে ইমরান: ২৮, ৩০)
{كَتَبَ رَبُّكُمْ عَلَى نَفْسِهِ الرَّحْمَةَ} — “তোমাদের প্রতিপালক তাঁর সত্তার উপর রহমত লিখে দিয়েছেন।” (সূরা আল-আন‘আম: ৫৪)
এরপর আল্লাহ বলেনঃ
“যদি আমার নিকট এক বিঘত এগিয়ে আসে, আমি তার নিকট এক হাত এগিয়ে আসি; যদি এক হাত এগিয়ে আসে, আমি তার নিকট এক বাহু এগিয়ে আসি; আর যদি সে আমার দিকে হেঁটে আসে, আমি তার দিকে দৌড়ে যাই।”
অর্থাৎ, বান্দা যতটুকু আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়, আল্লাহ তার চেয়ে বহুগুণে বেশি অনুগ্রহ নিয়ে তার দিকে আসেন।
•“শিবর” (شِبْرٍ) মানে বিঘত।
•“যিরা‘” (ذراعًا) মানে হাতের কনুই পর্যন্ত দৈর্ঘ্য।
•“বাউ” (باعًا) মানে মানুষের দু’হাত মেলে ধরা দৈর্ঘ্য।•“হারওলা” (هرولة) মানে দ্রুতগতি হাঁটা, কিন্তু দৌড় নয়। আল্লাহর হারওলা তাঁর মাহাত্ম্যের উপযোগী, যা সৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয় নয়।
আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহর পদ্ধতি হলো—এ ধরনের হাদীস ও অনুরূপ বিষয়গুলোকে সেভাবেই গ্রহণ করা, যেমনটি এসেছে; সেগুলোর তাওয়ীল (অন্য অর্থে ঘুরিয়ে দেওয়া) করা নয়, তাকয়ীফ (কীভাবে ঘটে তা নির্ধারণ করা) করা নয়। এর অর্থ স্পষ্ট ও পরিষ্কার, আর তা হলো—আল্লাহ তা‘আলা তাঁর অনুগ্রহ ও দয়ার কারণে বান্দাদের প্রতি কল্যাণ ও উপকার পৌঁছাতে তাদের তুলনায় অনেক দ্রুত। এটাই হাদীসের মূল বিষয়বস্তু।
কিন্তু এর কীভাবে ঘটবে (কাইফিয়াত)—তা কেবল তিনিই জানেন। তিনি নিজেই তাঁর ব্যাপারে খবর দিয়েছেন যে, তিনি বান্দাদের নিকটবর্তী হন, এবং তাঁদের দিকে “দ্রুত গমন” করেন। সুতরাং এগুলোকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে না, যা কুরআন ও সুন্নাহর বিরোধী হয়। বরং এ ব্যাপারে বলা হবে, যেমন অন্যান্য বিষয়ে বলা হয়:
• “তাঁর মতো কিছুই নেই; আর তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।” (সূরা আশ-শূরা: ১১)
• “আর তাঁর সমকক্ষ কেউ নেই।” (সূরা আল-ইখলাস: ৪)
অতএব, আল্লাহর “বিঘত, হাতে কনুই দৈর্ঘ্যে নিকটবর্তী হওয়া”, “বাহু দৈর্ঘ্যে নিকটবর্তী হওয়া”, এবং “দ্রুত গমন (هرولة)”—এসব বিষয় তিনি নিজেই নিজের জন্য বর্ণনা করেছেন। তাই আমরা সেগুলো তাঁর জন্যই সাব্যস্ত করি এবং বলি: এর কাইফিয়াত (কীভাবে ঘটে) কেবল তিনিই জানেন। যেমন আমরা জানি না তাঁর আরশের উপরে ইস্তেওয়া উঠে কেমন, বা তিনি রাতের শেষ ভাগে অবতরণ করেন—তা কেমন, বা তিনি কিয়ামতের দিন আগমন করবেন—তা কেমন, কিংবা তাঁর গজব, সন্তুষ্টি, হাসি, নিকটবর্তী হওয়া, দ্রুত গমন—এসব কিভাবে হয়, তা কেবল তিনিই জানেন।
কিন্তু এই হাদীসের সারকথা হলো—আল্লাহ আমাদের জন্য কল্যাণে দ্রুত, আমাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদানে দ্রুত। আর এই অর্থের কাইফিয়াত ও প্রকৃতি কী—তা কেবল আল্লাহই জানেন। তাঁর অন্যান্য গুণাবলীর মতো এও তাঁরই ব্যাপার।
ব্যাখার উৎস জানতে এখানে দেখুন