৪৩৭২

পরিচ্ছেদঃ তৃতীয় অনুচ্ছেদ

৪৩৭২-[৬৯] ’আয়িশাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। একদিন আসমা বিনতু আবূ বকর (রাঃ) পাতলা কাপড় পরিহিত অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট গেলেন। তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন এবং বললেনঃ হে আসমা! মহিলা যখন বালেগা হয়, তখন তার শরীরের কোন অঙ্গ দৃষ্ট হওয়া উচিত নয়, তবে কেবলমাত্র এটা এবং এটা এ বলে তিনি তাঁর মুখ এবং তাঁর দু’ হাতের তালুর দিকে ইঙ্গিত করলেন। (আবূ দাঊদ)[1]

الْفَصْلُ الثَّالِثُ

وَعَنْ عَائِشَةَ أَنَّ أَسْمَاءَ بِنْتَ أَبِي بَكْرٍ دَخَلْتُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَعَلَيْهَا ثِيَاب رقاق فَأَعْرض عَنهُ وَقَالَ: «يَا أَسْمَاءُ إِنَّ الْمَرْأَةَ إِذَا بَلَغَتِ الْمَحِيضَ لَنْ يَصْلُحَ أَنْ يُرَى مِنْهَا إِلَّا هَذَا وَهَذَا» . وَأَشَارَ إِلَى وَجْهِهِ وَكَفَّيْهِ. رَوَاهُ أَبُو دَاوُد

ব্যাখ্যাঃ এ হাদীস দ্বারা অনেকে দলীল পেশ করেন যে, নারীর জন্য মাহরাম নন এমন পুরুষের সামনেও নারী তার চেহারা ও দুই হাত খোলা রাখতে পারবে। কিন্তু এ হাদীস সানাদগতভাবে এবং মাতানগতভাবে বিশুদ্ধ নয়। সনদের দিক থেকে সমস্যা হলো : এ সনদে ইনক্বিতা‘ বা বিচ্ছিন্নতা আছে। খালিদ ইবনু দুরায়ক ‘আয়িশাহ্ (রাঃ)-এর কাছ থেকে শুনেননি। তাছাড়া বর্ণনাকারী সা‘ঈদ ইবনু বাশীর দুর্বল (য‘ঈফ)। এ দুটি ছাড়া আরও সমস্যা আছে। মতনের দিক থেকে সমস্যা হলো : এ বর্ণনায় বলা হচ্ছে. আসমা (রাঃ) প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় পাতলা কাপড় পরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে এসেছেন। যা কখনোই সম্ভব নয়। এ ঘটনা যখন ঘটেছে তখন আসমা (রাঃ)-এর বয়স সাতাশ-এর উপরো ছিল। কারণ মদীনায় হিজরতের বছর তার বয়স ছিল সাতাশ। তিনি ছিলেন হিজরতের পর মদীনায় জন্মগ্রহণকারী প্রথম শিশু ‘আবদুল্লাহ ইবনুয্ যুবায়র -এর মা। এ বয়সের একজন মুসলিম মহিলা পাতলা কাপড় পরে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে আসবেন যা দেখে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখ ফিরিয়ে নিবেন তা কি সম্ভব? কখনো নয়। তাই মতনের দিকে গভীরভাবে তাকালেও বুঝা যায় যে, এ বর্ণনাটি গ্রহণযোগ্য নয়। তাই চেহারা ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত খোলা রাখার যে কথা এ হাদীসে বলা হয়েছে তা ‘আমলযোগ্য নয়।

উল্লেখ্য যে, মাহরাম নন এমন পুরুষের সামনে মুসলিম নারীদের মুখমণ্ডলে ও দুই হাতের কব্জি পর্যন্ত খোলা রাখার ব্যাপারে ইসলামের বিধান কী- তা জানা জরুরী। তাই নিম্নে কুরআন, হাদীস, সাহাবীগণ ও সালফে সলিহীন-এর উক্তির আলোকে নাতিদীর্ঘ আলোচনা উপস্থাপন করা হলো, যাতে করে এ বিষয়ে বিভ্রান্তির অপনোদন ঘটে।

চেহারা পর্দার অংশ নয় মর্মে কিছু বক্তব্য আছে ঠিকই। কিন্তু নানা মত ও যুক্তি পর্যালোচনার পর অগ্রাধিকার প্রাপ্ত মত ও সকল ‘আলিমের সিদ্ধান্ত হলো, হিজাব যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমনি নিকাব তথা মুখ ঢাকাও অত্যাবশ্যক। দু’টিকে পৃথক ভাবার সুযোগ নেই। কারণ শারী‘আতে দু’টো পৃথক কোন বিষয় নয়। যখন হিজাব শব্দটি আসে তখন তার শার‘ঈ অর্থ এটাই বুঝা যায়, নারী মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢেকে রাখবে। কুরআনে মাজীদের সূরাহ্ আল-আহযাবে মুসলিম নারীদেরকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, ঘর থেকে বাইরে বের হবার সময় যেন তারা নিজেদের শরীরে লম্বা ও প্রশস্ত ঝুলিয়ে নেয়। আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন :

يٰاَيُّهَا النَّبِىُّ قُلْ لِأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِنْ جَلَابِيبِهِنَّ ذٰلِكَ أَدْنٰى أَنْ يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ

‘‘হে নবী! তুমি তোমার স্ত্রীগণকে, কন্যাগণকে ও মু’মিনদের নারীগণকে বল, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দংশ নিজেদের ওপর টেনে দেয়। এতে তাদেরকে চেনা সহজতর হবে, ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না।’’ (সূরাহ্ আল আহযাব ৩৩ : ৫৯)

পর্দা বিষয়ে এ আয়াত অত্যন্ত পরিষ্কার ও স্পষ্ট। কারণ, এ আয়াত থেকে জানা যায়, পর্দার নির্দেশের মধ্যে মুখমণ্ডলেও অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া এ আয়াতে রসূলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পুতঃপবিত্র সহধর্মিণীগণও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কন্যাগণের সঙ্গে মুসলিম মহিলাদেরও সম্বোধন করা হয়েছে। এ আয়াতে ‘জালাবীব’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, যা ‘জিলবাব’ শব্দের বহুবচন। ‘আরবী অভিধানের বিখ্যাত গ্রন্থ ‘‘লিসানুল ‘আরাব’’ এ লেখা হয়েছে, ‘জিলবাব’ ঐ চাদরকে বলা হয় যা মহিলারা নিজেদের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকার জন্য ব্যবহার করে। (লিসানুল ‘আরাব ১/২৭৩ পৃঃ)

মুফাসসিরগণের বক্তব্য দেখলেও জানা যায়, ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলে যা দ্বারা মহিলারা নিজেদের শরীর ঢাকেন। ‘জিলবাব’ অর্থ বড় চাদর, যা দ্বারা মুখমণ্ডলে ও পূর্ণ দেহ আবৃত করা যায়। (কুরতুবী, আল-জামি‘ লি আহকামিল কুরআন : ১৪/২৪৩)

‘আল্লামা আলূসী (রহিমাহুল্লাহ) ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রাঃ)-এর বরাত দিয়ে লিখেন, ‘জিলবাব’ সেই চাদরকে বলে যা মহিলারা দেহের ওপর থেকে নীচ পর্যন্ত উড়িয়ে ছেড়ে দেয়। (রুহুল মা‘আনী : ২২/৮৮)

‘আল্লামা ইবন হাযম (রহিমাহুল্লাহ) লিখেন : ‘আরবী ভাষায় ‘জিলবাব’ এমন কাপড়কে বলা হয় যা সারা শরীর আচ্ছাদন করে। যে কাপড় সমস্ত শরীর ঢাকে না, সে কাপড়ের ক্ষেত্রে ‘জিলবাব’ শব্দটির প্রয়োগ সঠিক ও শুদ্ধ নয়। (আল-মুহাল্লা : ৩/২১৭)

তাই শত শত বছর যাবৎ মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র যে দীনদার নারীগণ নিকাব ও হিজাব পরিধান করে আসছেন তাঁরা এই জিলবাব ধারণের বিধানই পালন করছেন।

কোন কোন সাহাবী সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাঁরা পর্দা হিসেবে ‘জিলবাব’ ব্যবহারের নিয়ম-পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন। ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রাঃ) মুখমন্ডলের উপর ‘জিলবাব’ ফেলার যে পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন তা হলো, ‘মুসলিম মহিলারা নিজেদের চাদর দ্বারা নিজ নিজ মাথা ও মুখমণ্ডলে ঢেকে বের হবে। তারা কেবল একটি চোখ খোলা রাখতে পারে’। (শাওকানী, ফাতহুল কদীর : ৭/৩০৭)

সূরাহ্ আল আহযাবের উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে সকল মুফাসসির মুখমণ্ডলে ঢাকা হিজাবের অত্যাবশ্যক অংশ গণ্য করেছেন। আবূ বকর আর্ রাযী ও আল জাস্‌সাস আল হানাফী (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়, যুবতী মহিলারা ঘর থেকে বাইরে বেরোনোর সময় বেগানা পুরুষের দৃষ্টি থেকে তাদের মুখমণ্ডলে আবশ্যিকভাবে ঢেকে রাখবে, যাতে দুষ্ট প্রকৃতির লোক তাদেরকে বিরক্ত করতে না পারে। (আহকামুল কুরআন : ৩/৩৭১)

ইমাম নাবাবী (রহিমাহুল্লাহ) স্বীয় গ্রন্থ ‘আল মিনহাজ’-এ লিখেছেন, যদি ফিতনার আশঙ্কা থাকে তাহলে কোন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের জন্য কোন প্রাপ্তবয়স্কা নারীর মুখমণ্ডলে ও হাত দেখা জায়িয নেই। ‘আল্লামা রামালী (রহিমাহুল্লাহ) ‘আল মিনহাজ’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায় এ মতের উপর ‘আলিমগণের ইজমা’র কথা বর্ণনা করেছেন। তিনি এও লিখেছেন, সঠিক মতানুযায়ী ফিতনার আশঙ্কা না থাকলেও প্রাপ্তবয়স্কা নারীকে দেখা হারাম। এর দ্বারা বুঝা যায়, মুখমণ্ডলে খোলা অবস্থায় মহিলাদের বাইরে বের হওয়া জায়িয নেই। কারণ, সে অবস্থায় পুরুষ তাদেরকে দেখবে এবং দেখার মাধ্যমে ফিতনা সৃষ্টি হবে। (নিহায়াতুল মিনহাজ ইলা শারহিল মিনহাজ : ৬/১৮৮)

শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ্ (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ পরপুরুষ দেখতে পারে এমনভাবে মহিলাদের মুখমণ্ডলে খোলা রাখা জায়িয নেই। স্বামী, পিতা, ভাই প্রমুখের উচিত ‘সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধে’র অংশ হিসেবে তাদেরকে এমন কাজ থেকে বিরত রাখতে সচেষ্ট হওয়া। অধীনস্থ নারীদের পর্দাহীনতা থেকে বিরত না রাখাও দায়িত্বশীল পুরুষদের জবাবদিহিতামূলক অপরাধ। এজন্য তাদেরকে শাস্তিও দেয়া যেতে পারে। (মাজমূ‘ ফাতাওয়া : ২৪/৩৮২)

হাফিয ইবনুল কইয়্যিম (রহিমাহুল্লাহ) লিখেন, স্বাধীন নারী মুখমণ্ডলে ও হাতের কব্জি পর্যন্ত খোলা রেখে সালাত আদায় করতে পারে (এই শর্তে যে, সেখানে কোন বেগানা পুরুষ থাকবে না)। তবে এ অবস্থায় সে বাজারে এবং পুরুষের ভীড়ের মধ্যে যেতে পারবে না। (ই‘লাম আল মুওয়াককিঈন : ২/৮০)

‘আল্লামা সুয়ূত্বী আশ্ শাফিঈ‘ (রহিমাহুল্লাহ) উল্লেখিত আয়াতের তাফসীর করতে গিয়ে লিখেন, হিজাবের আয়াত সব নারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মাথা ও মুখমণ্ডলে ঢাকা যে ওয়াজিব তা এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়। (‘আওনুল মা‘বুদ : ১১/১৫৪)

শুধু পবিত্র কুরআনের তাফসীর নয় চেহারা আবৃত রাখার বিধান সহীহ হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার  থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ

وَلَا تَنْتَقِبْ الْمَرْأَةُ الْمُحْرِمَةُ لَا تَلْبَسْ الْقُفَّازَيْنِ

‘‘ইহরাম গ্রহণকারী নারী যেন নিকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।’’ (সহীহুল বুখারী হাঃ ১৮৩৮)

এ হাদীস থেকে বোঝা যায়, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যুগে মেয়েরা তাদের হাত ও চেহারা ঢাকতেন। এ কারণে ইহরামের সময় নিকাব ও হাত মোজা না পরার আদেশ করতে হয়েছে।

‘আয়িশাহ্ (রাঃ) হজ্জ অবস্থায় মহিলা সাহাবীদের পর্দার যে ব্বিরণ দিয়েছেন তা থেকে অনুমান করা যায় পর্দা রক্ষায় তাঁরা কতটা আন্তরিক ছিলেন। তাঁরা স্বাভাবিক অবস্থায় তো বটেই ইহরাম অবস্থায় যখন মুখ ঢাকতে নিষেধ করা হয়েছে সেখানেও পরপুরুষের সামনে থেকে নিজেদের চেহারা আড়াল করেছেন। ‘আয়িশাহ্ (রাঃ) বলেন,

كَانَ الرُّكْبَانُ يَمُرُّونَ بِنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُولِ اللهِ -صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ- مُحْرِمَاتٌ فَإِذَا حَاذَوْا بِنَا سَدَلَتْ إِحْدَانَا جِلْبَابَهَا مِنْ رَأْسِهَا إِلٰى وَجْهِهَا فَإِذَا جَاوَزُونَا كَشَفْنَاهُ.

‘‘আমরা ইহরাম অবস্থায় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন আরোহীরা আমাদের সঙ্গে পথ চলছিলেন। যখন তারা আমাদের মুখোমুখি হতেন তখন আমাদের সঙ্গীনীরা তাদের বড় চাদর মাথা থেকে চেহারায় ঝুলিয়ে দিতেন। তারা আমাদের অতিক্রম করে চলে যাবার পরই আমরা তা উন্মুক্ত করতাম।’’ (সুনান আবূ দাঊদ হাঃ ৫৩৮১, বায়হাক্বী হাঃ ৩৩)

আসমা’ বিনতু আবী বকর (রাঃ) বলেনঃ আমরা পুরুষদের থেকে আমাদের চেহারা আবৃত রাখতাম। (মুস্তাদরাক হাকিম হাঃ ১৬৬৪)

ফাতিমা বিনতুল মুনযির (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘‘আমরা আসমা বিনতু আবূ বকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ইহরাম অবস্থায় থাকাকালে আমাদের চেহারা ঢেকে রাখতাম।’’ (ইমাম মালিক মুওয়াত্ত্বা হাঃ ১/৩২৮, হাকিম মুসতাদরাক : ১/৪৫৪)

এ ব্বিরণ থেকে জানা গেল, মুখমন্ডলের পর্দার বিষয়টি ইজমা’র ভিত্তিতে স্থির হয়েছে। কোন মাযহাবের কোন উল্লেখযোগ্য ‘আলিম এ ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করেননি। শায়খ ইবনু বায (রহিমাহুল্লাহ), শায়খ ইবনু উসায়মীন ও শায়খ ইবনু জিবরীনও একই ফাতাওয়া দিয়েছেন। (দেখুন- রিসালাতুন ফিল-হিজাবি ওয়াস-সুফূর : ১৯; ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম : ১১৬৯)

মুফতী মুহাম্মদ শাফী ‘উসমানী (রহিমাহুল্লাহ) লিখেছেন, ‘‘ইমাম চতুষ্টয়ের মধ্য থেকে ইমাম মালিক, ইমাম শাফি’ঈ ও ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (রহিমাহুমুল্লাহ) তিনজনই মুখমণ্ডলে ও হাতের কব্জি খোলা রাখার মোটেই অনুমতি দেননি ফিতনার আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক। ইমাম আবূ হানীফাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) ফিতনার আশঙ্কা যদি না না থাকলে খোলা রাখার অনুমতি দিয়েছেন। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এই শর্ত পূরণ হবার নয়, তাই হানাফী ফকীহগণ পরপুরুষের সামনে মুখমণ্ডলে ও হাতের কব্জি খোলা রাখার অনুমতি দেননি।’’ (মা‘আরিফুল কুরআন : ৭/২১৪)

তেমনি এটাও সঙ্গত নয় যে, মহিলাদের সারা শরীর ঢাকা থাকবে আর মুখমণ্ডলে থাকবে খোলা। অথচ মানুষের প্রথম দৃষ্টিটিই পড়ে মুখের উপর। তারপর সেখান থেকেই অন্তরে খারাপ বাসনার সৃষ্টি হয়। পবিত্র কুরআনে নারীদের হিজাব এবং তদসংক্রান্ত প্রায় আটটি আয়াত আছে। সেগুলো থেকেও এ কথা জানা যায়, শারী‘আতের দাবী কেবল শরীর ঢাকা নয়, বরং মুখমণ্ডলে ঢাকাও জরুরী।

আধুনিককালের প্রখ্যাত ‘আলিম ও ফকীহগণও একই মত পোষণ করেন। আরব বিশ্বের সমকালীন সকল ‘আলিম ও মুফতীদের মতও এই যে, মহিলাদের জন্য মুখমণ্ডলে ঢাকা একান্ত আবশ্যক। তাদের মধ্যে শায়খ ‘আবদুর রহমান ইবন সা‘দী, মুহাম্মাদ ইবনু ইবরাহীম আল আশ্ শায়খ, মুহাম্মাদ আল আমীন আশ্ শানকীতী, শায়খ ‘আবদুল ‘আযীয বিন ‘আবদুল্লাহ ইবনু বায, শায়খ আবূ বকর জাবির আল জাযায়িরী, শায়খ মুহাম্মাদ ইবনু গুনায়মীন, শায়খ ‘আবদুল্লাহ ইবনু জিবরীন, শায়খ সালিহ আল ফাওযান, শায়খ বকর ইবনু ‘আবদুল্লাহ আবূ যায়দ, মুহাম্মাদ ইবনু আহমাদ ইসমা‘ঈল আল মাকদাম, আবূ ইসহক আল হুওয়ায়তী, মুসতাফা আল ‘আদাবী, মুহাম্মাদ হাসসান ও আরো অনেকের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। স্পষ্ট ব্যাখ্যা এবং ফকীহগণের চূড়ান্ত ফাতাওয়াসমূহ থাকার পরও কোন ‘আলিম নিকাবকে অস্বীকার করতে পারেন না।

পরপুরুষের সামনে নারীর মুখমণ্ডলে প্রদর্শন বৈধতার পক্ষের প্রবক্তাগণ প্রমাণের জন্য পূর্বোক্ত সূরাহ্ নূরের ৩১ নং আয়াত তুলে ধরেন। তাদের বক্তব্য, ‘সাধারণত প্রকাশমান সৌন্দর্য’ এর ব্যাখ্যায় ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস ও ‘আবদুল্লাহ ইবন মাস্‘ঊদ  থেকে বর্ণনা করা হয় যে, এ দ্বারা করতল ও চেহারা উদ্দেশ্য। অথচ ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ -এর ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ আলাদা। আর ‘আবদুল্লাহ ইবন ‘আব্বাস (রাঃ)-এর উদ্ধৃত উক্তি আলোচ্য দাবীর ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক। কেননা একাধিক সহীহ সনদে ইবন মাস্‘ঊদ  থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, আয়াতের আলোচ্য অংশ ‘ইল্লা মা যাহারা মিনহা’-এর অর্থ ‘কাপড়’। (দেখুন- ত্ববারী, জামি‘উল বায়ান : ১৭/২৫৬-২৫৮; ইবন আবী শায়বাহ্, আল-মুসান্নাফ : ৯/২৮০)

এ অংশের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত মুফাস্সির ইবন কাসীর (রহিমাহুল্লাহ) বলেনঃ ‘আয়াতের অর্থ, পরপুরুষের সামনে নারী তার কোন ধরনের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না। তবে যা আবৃত রাখা সম্ভব নয় তার কথা আলাদা। এর দৃষ্টান্ত দিয়ে ইবনু মাস্‘ঊদ  বলেছেন,

كَالرِّدَاءِ وَالثِّيَابِ يَعْنِي عَلٰى مَا كان يتعاطاه نِسَاءُ الْعَرَبِ مِنَ الْمِقْنَعَةِ الَّتِي تُجَلِّلُ ثِيَابَهَا وَمَا يَبْدُو مِنْ أَسَافِلِ الثِّيَابِ. فَلَا حَرَجَ عليها فيه لأن هذا لا يمكنها إخفاؤ.

আরবের নারীগণ যে বড় চাদরে তাদের পরনের কাপড় ঢেকে বের হতেন এবং কাপড়ের নীচের অংশ, যা চলার সময় চাদরের নীচ দিয়ে প্রকাশিত হয়ে যেত তা যেহেতু ঢেকে রাখা সম্ভব নয় তাই এতে কোন দোষ নেই। (তাফসীরে ইবন কাসীর : ৬/৪১)

‘হাসান বসরী, মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, ইবনুল জাওযী, ইবরাহীম নাখ‘ঈ (রহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ মনীষীও অনুরূপ ব্যাখ্যা করেছেন।’ (তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম : ৩/৩১২)

পবিত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্য, আলোচ্য বিষয়ের হাদীস ও আসার এবং উসূলে ফিকহের নীতি ও বিধান ইত্যাদি বিবেচনায় ইবন মাস্‘ঊদ (রাঃ)-এর ব্যাখ্যাই অগ্রগণ্য। কারণ সূরাহ্ আল আহযাব-এর ৫৯ নম্বর আয়াতে জিলবাবের একাংশ চেহারার উপর নামিয়ে মুখমণ্ডলে আবৃত রাখার আদেশ করা হয়েছে। তা সূরাহ্ আন্ নূর-এর আলোচ্য আয়াতে ইবনু মাস্‘ঊদ -এর ব্যাখ্যাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। তাছাড়া সহীহ হাদীসসমূহে নারীদের চেহারা ঢেকে রাখার যে নির্দেশ ও ব্বিরণ দেখা যায় তাও তাঁর ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে।

তদুপরি যারা মুখ খোলার পক্ষে বলেছেন প্রথমত তাদের মতটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত মত নয় আর দ্বিতীয়ত তাঁরা সবাই এর জন্য নিরাপদ ও ফিতনামুক্ত হওয়ার শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। আর বলাবাহুল্য যে, বর্তমান যুগে ফিতনার বিস্তার সর্বত্র। মানুষের মধ্যে দীনদারী ও আল্লাহভীতি হ্রাস পেয়েছে। লজ্জা ও লজ্জাবনত মানুষের সংখ্যা কমে গেছে। ফিতনার প্রতি আহবানকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাজসজ্জার নানা উপায় ও উপকরণ আবিষ্কৃত হওয়ায় ফিতনার মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। তাই মুসলিম নারীর উচিত মাহরাম ছাড়া অন্য কারও সামনে চেহারা ও দুই হাত উন্মুক্ত না রাখা। আল্লাহই অধিক জানেন।

(‘ইসলাম হাউজ’ থেকে প্রকাশিত আলী হাসান তৈয়ব লিখিত ও ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী সম্পাদিত ‘‘মুখমণ্ডলে ঢাকা কি হিজাবের অংশ নয়?’’ শীর্ষক প্রবন্ধ দ্রষ্টব্য।)