খ. মানুষ যেসব স্তর অতিক্রম করে (المراحل والدُّور التي يمر بها الإنسان)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষ সৃষ্টি করে তার জন্য কতিপয় স্তর, কাল, স্থান ও অবস্থার বন্দোবস্ত করেছেন, যেগুলি তাকে অতিক্রম করতে হয়। শেষ পর্যন্ত সে জান্নাত বা জাহান্নামে স্থায়ী হয়ে যায়।

মানুষ যেসব স্তর অতিক্রম করে, সেগুলি চারটি:

প্রথম: মায়ের পেট: এটি প্রথম স্তর, যা মানুষকে অতিক্রম করতে হবে এবং প্রথম গৃহ, যেখানে সে বাস করে। এখানে মানুষ (সাধারণতঃ) নয় মাস বসবাস করে। মহাজ্ঞানী, ক্ষমতাবান আল্লাহ এ অন্ধকার ঘরে তার জন্য খাদ্য-পানীয় এবং তার উপযোগী বাসস্থান ও আশ্রয়স্থলসহ যা কিছু তার প্রয়োজন, তার সবই প্রস্ত্তত করে দিয়েছেন। এইঘরে অক্ষমতা ও দুর্বলতার কারণে সে কোন প্রকার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত নয়। এ ঘরে তার অস্তিত্ব লাভের দু’টি রহস্য আছে: ভিতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ হওয়া। আর বাহিরের অঙ্গ-প্রত্যেঙ্গ পরিপূর্ণ হওয়া। ভেতর ও বাইরে তার সৃষ্টিগত পরিপূর্ণতা লাভের পর সে দুনিয়ায় বেরিয়ে আসে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَلَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنْسَانَ مِنْ سُلَالَةٍ مِنْ طِينٍ (12) ثُمَّ جَعَلْنَاهُ نُطْفَةً فِي قَرَارٍ مَكِينٍ (13) ثُمَّ خَلَقْنَا النُّطْفَةَ عَلَقَةً فَخَلَقْنَا الْعَلَقَةَ مُضْغَةً فَخَلَقْنَا الْمُضْغَةَ عِظَامًا فَكَسَوْنَا الْعِظَامَ لَحْمًا ثُمَّ أَنْشَأْنَاهُ خَلْقًا آخَرَ فَتَبَارَكَ اللَّهُ أَحْسَنُ الْخَالِقِينَ (14)) [المؤمنون: 12 - 14]

‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে মাটির নির্যাস হতে সৃষ্টি করেছি। তারপর আমি তাকে শুক্রবিন্দুরূপে সংরক্ষিত আঁধারে স্থাপন করেছি। তারপর শুক্রবিন্দুকে আমি রক্তপিণ্ড পরিণত করি। তারপর রক্তপিণ্ডকে মাংসপিণ্ড পরিণত করি। তারপর মাংসপিণ্ডকে হাড়ে পরিণত করি। তারপর হাড়কে মাংস দিয়ে আবৃত করি। অতঃপর তা অন্য এক সৃষ্টরূপে গড়ে তুলি। অতএব সর্বোত্তম স্রষ্টা আল্লাহ কত বরকতময় (সূরা আল-মুমিনূন: ১২-১৪)।

দ্বিতীয়: দুনিয়া: মায়ের পেটের চেয়ে এ ঘরের প্রশস্ততা অনেক বেশি। পাহাড়ের সাথে অতি ক্ষুদ্র বস্ত্তর তুলনা যেমন, মায়ের পেটের সাথে দুনিয়ার তুলনা তেমন। মায়ের পেটের চেয়ে অধিক সময় দুনিয়ায় অবস্থান করে। আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য দুনিয়ায় সকল প্রকার প্রয়োজনীয় নেয়ামতের ব্যবস্থা করেছেন। তাকে বিবেক, শ্রবণ এবং দর্শন শক্তি দান করেছেন, রাসূল প্রেরণ করেন, আসমানী কিতাব নাযিল করে এর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। আর কুফরী ও সব ধরণের অবাধ্যতা থেকে তিনি নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা মুমিনদেরকে জান্নাতের এবং কাফেরদেরকে জাহান্নামের অঙ্গিকার করেছেন।

দুনিয়ায় মানুষের অস্তিত্ব লাভের রহস্য দু’টিঃ (ক) ঈমান পূর্ণ করা। (খ) সৎ আমল পূর্ণ করা। মানুষ আমলসহ দুনিয়া ছেড়ে কবরের জগতের দিকে যাত্রা করে।

১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللَّهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْنِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللَّهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ (20)) ... [لقمان: 20].

‘তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন আসমানসমূহ ও যমীনে যা কিছু আছে। আর তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নেয়ামত ব্যাপক করে দিয়েছেন; মানুষের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ সম্পর্কে তর্ক করে জ্ঞান, হেদায়াত ও আলো দানকারী কিতাব ছাড়া’ (সূরা লুকমান: ২০)।

২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ(21) الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الْأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلَا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ (22)) ... [البقرة: 21 - 22]

‘হে মানুষ! তোমরা তোমাদের রবের ইবাদত কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তাদেরকে, যাতে তোমরা তাক্বওয়া অবলম্বন করতে পারো। যিনি তোমাদের জন্য যমীনকে করেছেন বিছানা, আসমানকে ছাদ এবং আসমান থেকে নাযিল করেছেন বৃষ্টি। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে উৎপন্ন করেছেন ফল-ফলাদি তোমাদের জন্য রিযকস্বরূপ। সুতরাং তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহর জন্য সমকক্ষ নির্ধারণ করো না’ (সূরা আল-বাক্বারাহ: ২১-২২)।

তৃতীয়: দারুল বারযাখ বা কবরের জগত। কবর আখেরাতের প্রথম মঞ্জিল বা ঘর। সকল সৃষ্টির মৃত্যু সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত মানুষ এখানে অবস্থান করতে থাকবে। তারপর ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে। দুনিয়ায় অবস্থানের চেয়ে এখানের স্থায়ীত্ব বেশি। এখানে দুনিয়ার চেয়ে ঘনিষ্ঠতা ও দুঃখ-দুর্দশা বেশি ও পরিপূর্ণ। দুনিয়ার আমলানুযায়ী এখানে প্রতিদান দেয়া হয়। সেটা হয়তো জান্নাতের বাগান অথবা জাহান্নামের গর্ত হবে।এখানেই প্রতিদান দেওয়া শুরু হবে এবং এখান থেকেই চিরস্থায়ী গৃহ জান্নাত বা জাহান্নামে স্থানান্তরিত করা হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ (30) نَحْنُ أَوْلِيَاؤُكُمْ فِي الْحَيَاةِ الدُّنْيَا وَفِي الْآخِرَةِ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَشْتَهِي أَنْفُسُكُمْ وَلَكُمْ فِيهَا مَا تَدَّعُونَ (31) نُزُلًا مِنْ غَفُورٍ رَحِيمٍ (32)) [فصلت: 30 - 32].

‘নিশ্চয় যারা বলে, ‘আল্লাহই আমাদের রব’ অতঃপর অবিচল থাকে, ফেরেশতামণ্ডলী তাদের কাছে অবতীর্ণ হন এবং বলেন, ‘তোমরা ভয় পেয়ো না, দুশ্চিন্তা করো না এবং সেই জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর, যার ওয়াদাপ্রাপ্ত তোমরা হয়েছিলে। আমরা দুনিয়ার জীবনে তোমাদের বন্ধু ও আখেরাতেও। সেখানে তোমাদের জন্য থাকবে, যা তোমাদের মন চাইবে এবং সেখানে তোমাদের জন্য আরও থাকবে, যা তোমরা দাবী করবে পরম ক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু আল্লাহর পক্ষ থেকে আপ্যায়নস্বরূপ’ (সূরা হামীম সাজদা: ৩০-৩২)।

চতুর্থ: আখেরাত। এখানে চিরকাল অবস্থান করতে হবে। এটা স্থায়ী ঘর। যারা দুনিয়ায় আল্লাহ তা‘আলা যে ঈমান, আমল এবং আখলাক্বকে ভালবাসেন, তা সম্পন্ন করবে, ক্বিয়ামতের দিন সে যে স্থায়ীত্ব ও নেয়ামত পেতে চায়, আল্লাহ তার জন্য তা পূর্ণ করবেন, যা কোন দিন কোন চোখ দেখেনি, যার কথা কান শুনেনি এবং যা কোন মানুষের কল্পনায়ও কখনও আসেনি। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধের কারণ কুফর, শিরক এবং পাপ নিয়ে ব্যস্ত থাকবে, তার প্রতিফল হলো জাহান্নাম, সেখানে সে চিরকাল থাকবে।

প্রথম দু’টি ঘর (মায়ের পেট ও দুনিয়া) প্রত্যক্ষ বা দৃশ্য। আর পরবর্তী দু’টি ঘর (কবর ও আখেরাত) পরোক্ষ বা অদৃশ্য। তবে, সবগুলোই সত্য। প্রতিটি ঘরই মানুষ দেখবে এবং জানবে। মুমিন ব্যক্তি যখনই কোন পর্যায় ত্যাগ করবেন, তখনই পূর্ববর্তী পর্যায়কে তুচ্ছ জ্ঞান করবেন, অবশেষেজান্নাতে স্থায়ী হবেন।

১। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

(وَيَوْمَ تَقُومُ السَّاعَةُ يَوْمَئِذٍ يَتَفَرَّقُونَ (14) فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَهُمْ فِي رَوْضَةٍ يُحْبَرُونَ (15) وَأَمَّا الَّذِينَ كَفَرُوا وَكَذَّبُوا بِآيَاتِنَا وَلِقَاءِ الْآخِرَةِ فَأُولَئِكَ فِي الْعَذَابِ مُحْضَرُونَ (16)) [الروم: 14 - 16].

‘আর যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে সেদিন তারা বিভক্ত হয়ে পড়বে। অতএব, যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকাজ করেছে, তাদেরকে জান্নাতে পরিতুষ্ট করা হবে। আর যারা কুফরী করেছে এবং আমার আয়াত ও আখেরাতের সাক্ষাতকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছে, তাদেরকে আযাবের মধ্যে উপস্থিত করা হবে’(সুরা আর-রূম: ১৪-১৬)।

২। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন:

(وَعَدَ اللَّهُ الْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ جَنَّاتٍ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا
وَمَسَاكِنَ طَيِّبَةً فِي جَنَّاتِ عَدْنٍ وَرِضْوَانٌ مِنَ اللَّهِ أَكْبَرُ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ (72)) ... [التوبة: 72].

‘আল্লাহ মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীদেরকে জান্নাতের ওয়াদা দিয়েছেন, যার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হবে নহরসমূহ, তাতে তারা চিরদিন থাকবে এবং (ওয়াদা দিয়েছেন) স্থায়ী জান্নাতসমূহে পবিত্র বাসস্থান সমূহের। আর আল্লাহর পক্ষ হতে সন্তুষ্টি সবচেয়ে বড়। এটাই মহা সফলতা’ (সূরা আত-তাওবা: ৭২)।