ব্যাখ্যা: ইয়াহুদী, খ্রিষ্টান, মূর্তিপূজক ও অন্যান্য কাফির গোষ্ঠির জাহিলী নীতি হচ্ছে হক্ব জানা সত্ত্বেও তা গোপন করা। আহলে কিতাবদের (ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান) মাঝে এ সমস্যা প্রবল। তারা হক্ব জানে অথচ তা গোপন করে। আর পার্থিব স্বার্থ লাভ অথবা মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে তারা তা প্রচার করে না। সর্বত্তোম হক্ব গোপনের বিষয় হচ্ছে তাওরাত ও ইনজিলে বর্ণিত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গুণাবলী যা তারা জানে, তার রিসালাতের বিশুদ্ধতা এবং তিনি যা নিয়ে এসেছেন সেটাও জানে, এ সত্ত্বেও তারা তা গোপন করে এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রিসালাত অস্বীকার করে।

আল-কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা এ ব্যাপারে তাদের সম্পর্কে উল্লেখ করেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(الَّذِينَ آتَيْنَاهُمُ الْكِتَابَ يَعْرِفُونَهُ كَمَا يَعْرِفُونَ أَبْنَاءَهُمْ وَإِنَّ فَرِيقاً مِنْهُمْ لَيَكْتُمُونَ الْحَقَّ وَهُمْ يَعْلَمُونَ الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ) [البقرة: 146، 147]

যাদেরকে আমি কিতাব দিয়েছি, তারা তাকে চিনে, যেমন চিনে তাদের সন্তানদেরকে। আর নিশ্চয় তাদের মধ্য হতে একটি দল সত্যকে অবশ্যই গোপন করে, অথচ তারা জানে। সত্য তোমার রবের পক্ষ থেকে। সুতরাং তুমি কখনো সন্দেহ পোষণকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না (সূরা আল-বাক্বারাহ ২:১৫৬-১৫৭)।

এ আয়াতটি বাইতুল মুকাদ্দাস হতে কেবলা পরিবর্তন করে কাবা শরীফকে কেবলা নির্ধারণ প্রসঙ্গে নাযিল হয়। তারা জানতো, অচিরেই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম এর কেবলা কাবা শরীফই হবে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কেবলা। এটা তাদের কিতাব থেকে জানার পরও তারা কাবা শরীফকে কেবলা মেনে নিতে অস্বীকার করে। আর এ প্রসঙ্গে তাদের জানা ইলম-জ্ঞান তারা গোপন করে। অনুরূপভাবে ইয়াহুদী-খ্রিষ্টান ছাড়াও মুসলিমদের মধ্যে যারা জেনে-বুঝে হক্ব গোপন করে, মানুষের মাঝে তা বর্ণনা করে না, তারাও ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের রীতির উপরই বহাল আছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(وَإِذْ أَخَذَ اللَّهُ مِيثَاقَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلا تَكْتُمُونَهُ فَنَبَذُوهُ وَرَاءَ ظُهُورِهِمْ وَاشْتَرَوْا بِهِ ثَمَناً قَلِيلاً) [آل عمران: 187]

আর স্মরণ কর, যখন আল্লাহ কিতাবপ্রাপ্তদের অঙ্গীকার নিয়েছিলেন যে, অবশ্যই তোমরা তা মানুষের নিকট স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে এবং তা গোপন করবে না। কিন্তু তারা তা তাদের পেছনে ফেলে দেয় এবং তা বিক্রি করে তুচ্ছ মূল্যে (সূরা আলে-ইমরান ৩:১৮৭)। তিনি আরোও বলেন,

(إِنَّ الَّذِينَ يَكْتُمُونَ مَا أَنْزَلْنَا مِنَ الْبَيِّنَاتِ وَالْهُدَى مِنْ بَعْدِ مَا بَيَّنَّاهُ لِلنَّاسِ فِي الْكِتَابِ أُولَئِكَ يَلْعَنُهُمُ اللَّهُ وَيَلْعَنُهُمُ اللَّاعِنُونَ إِلَّا الَّذِينَ تَابُوا وَأَصْلَحُوا وَبَيَّنُوا فَأُولَئِكَ أَتُوبُ عَلَيْهِمْ وَأَنَا التَّوَّابُ الرَّحِيمُ) [البقرة: 159، 160]

নিশ্চয় যারা গোপন করে সু-স্পষ্ট নিদর্শনসমূহ ও হেদায়াত যা আমি অবতীর্ণ করেছি, কিতাবে মানুষের জন্য তা স্পষ্টভাবে বর্ণনা করার পর, তাদেরকে আল্লাহ লা‘নত করেন এবং লা‘নতকারীগণও তাদেরকে লা‘নত করে। তারা ব্যতীত, যারা তাওবা করেছে, শুধরে নিয়েছে এবং স্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছে। অতএব, আমি তাদের তাওবা কবুল করব। আর আমি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু (সূরা আল-বাক্বারাহ ২:১৫৯, ১৬০)।

তাদের তাওবাহ কবুলের শর্ত হচ্ছে তারা যা কিছু গোপন করেছে তা বর্ণনা করা। সংক্ষিপ্ত তাওবাহ যথেষ্ট নয়। তাই হক্ব বর্ণনা করা আবশ্যক। যে হক্ব জানে তা মানুষের নিকট বর্ণনা করা তার উপর ওয়াজীব। আর তুচ্ছমূল্যে সে তা বিক্রয় করবে না। অতঃপর পার্থিব স্বার্থ লাভ অথবা মানুষের সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে সে তা গোপন করবে না। আল্লাহ আ‘আলাকে ভয় করা এবং তার সন্তুষ্টি অর্জনই অধিক যুক্তিযুক্ত। সুতরাং হক্ব বর্ণনা ও তা প্রচারে সক্ষম ব্যক্তির উপর তা গোপন করা বৈধ নয়।

পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি হক্ব প্রচারে অক্ষম অথবা তা বর্ণনা করতে মারাত্নক ফিতনার আশঙ্কা করে; তা ওজর-কৈফিয়ত হিসাবে গণ্য হবে। কিন্তু হক্ব প্রচারে যার কোন প্রতিবন্ধকতা নেই, বরং উৎসাহিত হয়ে এবং কোন স্বার্থ লাভের উদ্দেশ্যে তা গোপন করে, আল্লাহ তা‘আলা এবং অভিশম্পাতকারীরা তাকে অভিশাপ দেন। এটাই হলো ইয়াহুদীদের বৈশিষ্ট্য। আর যারা কু-প্রবৃত্তির অনুসরণে হক্ব গোপন করে, মানুষের নিকট তা প্রচার করে না; এ বৈশিষ্ট্য তাদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। তাদের নিকট কোন বিষয়ের বিধান জানতে চাওয়া হলে হক্ব ছাড়াই তারা জবাব দেয়। অথচ তারা সঠিক জবাব জানে। এটাকেই বলে হক্ব গোপন করা। আল্লাহ তা‘আলা হক্ব বলার আদেশ দেন যদিও তা নিজের ক্ষেত্রেও হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

(كُونُوا قَوَّامِينَ بِالْقِسْطِ شُهَدَاءَ لِلَّهِ وَلَوْ عَلَى أَنْفُسِكُمْ أَوِ الْوَالِدَيْنِ وَالْأَقْرَبِينَ) [النساء: 135]

হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর জন্য সাক্ষীরূপে। যদিও তা তোমাদের নিজদের কিংবা পিতা-মাতার অথবা কাছে আত্মীয়দের বিরূদ্ধে হয় (সূরা আন নিসা ৪:১৩৫)।

তাই প্রকাশ্যে ও যে কোন অবস্থায় হক্ব-সত্য প্রচার করা ওয়াজীব। সত্য সাক্ষ্য গোপন করা মারাত্নক অপরাধ। মানুষের জীবন পরিচালনা ও সঠিক পথ নির্দেশনার জন্য ওয়াজীব ইলম-বিদ্যা গোপন করাও অপরাধ। সুতরাং কোন তোষামদ ছাড়াই হক্ব-সত্য প্রচার করা ওয়াজীব-আবশ্যক।

তাই মানুষ যখন কোন বাতিল, কুসংস্কার ও শিরক দেখতে পাবে তখন নিরব থাকবে না; বরং তা প্রকাশ করে দেয়া তার উপর ওয়াজীব। আর কবর ও প্রতিমাপূজা এবং ভ্রান্ত বিদ‘আত চালু করতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করবে না। যে নিরব থেকে বলে যে, মানুষের প্রতি আমার করার কিছুই নেই অথবা মানুষকে হারামে লিপ্ত হতে দেখেও চুপ থাকে, তাহলে এটাই হবে তার বিদ্যা গোপন করা এবং নসিহতের (কল্যাণ কামনা) খেয়ানত করা। নিরব থাকার জন্য আল্লাহ মানুষকে ইলম-জ্ঞান দান করেননি।

মানুষকে সতর্ক করা, প্রমাণসহ আল্লাহর দিকে আহবান করা এবং অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যই মানুষকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

সুতরাং হক্বের ব্যাপারে আলেমদের নিরব থাকা বৈধ নয়। যেহেতু তারা হক্ব প্রচারে সক্ষম, বিশেষত ভ্রষ্টতা, শিরক, বিদ‘আত ও কুসংস্কারে যখন মানুষকে লিপ্ত দেখবে তখন তারা নিরব থাকবে না। যদি তারা এক্ষেত্রে নিরব থাকে তাহলে এটাই হবে ইলম-বিদ্যা গোপন করা, যে বিষয়ে আল্লাহ তা‘আলা ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদেরকে দোষারোপ করেছেন। তাই জানা সত্ত্বেও আলেম কিভাবে হক্বের বিরোধিতা করতে পারেন এবং মানুষের সন্তুষ্টি অর্জন অথবা হক্ব বিরোধী কর্ম-কান্ড চলতে দেয়া অথবা মানুষ যে রীতির উপর বহাল আছে সেক্ষেত্রে তালমিলানোর জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে হক্বের বিরূদ্ধে ফাতওয়া দিতে পারেন কি?!

সুতরাং হক্বের অনুসরণই বাঞ্ছনীয়। আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি অর্জন করতে হবে; অধিকাংশ মানুষ বাতিলের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাই তাদের সন্তুষ্টি অর্জন কাম্য নয়। হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

من التمس رضا الله بسخط الناس رضي الله عنه وأرضى عنه الناس، ومن التمس رضا الناس بسخط الله، سخط الله عليه وأسخط عليه الناس

মানুষের ক্রোধেও যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তা‘আলা তার প্রতি সন্তুষ্ট হন এবং মানুষকে তার উপর তুষ্ট রাখেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর ক্রোধে মানুষের সন্তুষ্টি অনুসন্ধান করে, আল্লাহ তা‘আলা তার উপর রগান্বিত হন এবং মানুষকে তার উপর ক্রোধান্বিত করেন।[1]

>
[1]. ছহীহ: তিরমিযী ২৪১৯, ছহীহ জামে ৬০৯৭।