ঈমানের হাকীকত বা পরিচয়এবং কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত ব্যক্তির হুকুম

حقيقة الإيمان وحكم مرتكب الكبيرة

ঈমানের হাকীকত বা পরিচয়এবং কবীরা গুনাহ্য়[1] লিপ্ত ব্যক্তির হুকুম:

وَمِنْ أُصُولِ أَهْلِ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ أَنَّ الدِّينَ وَالْإِيمَانَ قَوْلٌ وَعَمَلٌ قَوْلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَعَمَلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَالْجَوَارِحِ وَأَنَّ الْإِيمَانَ يَزِيدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَةِ هُمْ مَعَ ذَلِكَ لا يُكَفِّرُونَ أَهْلَ الْقِبْلَةِ بِمُطْلَقِ الْمَعَاصِي وَالْكَبَائِرِ؛ كَمَا يَفْعَلُهُ الْخَوَارَجُ؛ بَلِ الأُخُوَّةُ الإِيمَانِيَّةُ ثَابِتَةٌ مَعَ الْمَعَاصِي كَمَا قَالَ سُبْحَانَهُ ﴿فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ﴾ وَقَالَ تعالى ﴿وَإِنْ طَائِفَتَانِ مِنْ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِنْ بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَى فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّى تَفِيءَ إِلَى أَمْرِ اللَّهِ فَإِنْ فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ﴾ وَلاَ يَسْلُبُونَ الْفَاسِقَ الْمِلِّيَّ اسْمَ الإيمَانِ بِالْكُلِّيَّةِ، وَلاَ يُخَلِّدُونَهُ فِي النَّار؛ كَمَا تَقُولُ الْمُعْتَزِلَةُ بَلِ الْفَاسِقُ يَدْخُلُ فِي اسْمِ الإيمَان؛ كَمَا فِي قَوْلِهِ تعالى: ﴿فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُؤْمِنَةٍ﴾ وَقَدْ لاَ يَدْخُلُ فِي اسْمِ الإِيمَانِ الْمُطْلَقِ؛ كَمَا فِي قَوْلِهِ تَعَالَى: ﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آياتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًَا﴾ وَقَوْلُهُ صَلَّىْ اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمْ: "لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلا يَسْرِقُ السَّارِقُ حِينَ يَسْرِقُ وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَشْرِبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ، وَلاَ يَنْتَهِبُ نَهْبَةً ذَاتَ شَرَفٍ يَرْفَعُ النَّاسُ إِلَيْهِ فِيهَا أَبْصَارَهُمْ حِينَ يَنْتَهِبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَيَقُولُونَ: هُوَ مُؤْمِنٌ نَاقِصُ الإِيمَانِ، أَوْ مُؤْمِنٌ بِإِيمَانِهِ فَاسِقٌ بِكَبِيرَتِهِ، فَلاَ يُعْطَى الاسْمَ الْمُطْلَقَ، وَلاَ يُسْلَبُ مُطْلَقَ الاسْمِ.

আহ্লে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকদের অন্যতম মূলনীতি হলো দ্বীন ও ঈমান স্বীকারোক্তি এবং আমলের নাম। অন্তরের স্বীকারোক্তি, জবানের ঘোষণা, অন্তরের আমল, জবানের আমল এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমলকে ঈমান বলা হয়। সৎকাজের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপ কাজের কারণে তা কমে যায়।

উহা সত্তেও অর্থাৎ সাধারণ পাপকাজ এবং কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত হওয়ার কারণে ঈমান কমে গেলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত আহলে কিবলার কাউকে কাফের বলেন না। যেমন বলে থাকে খারেজী সম্প্রদায়ের লোকেরা। বরং পাপাচারে লিপ্ত হলেও ঈমানের বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ব ঠিকই থাকে। যেমন আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেনঃ

﴿أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِصَاصُ فِي الْقَتْلَى الْحُرُّ بِالْحُرِّ وَالْعَبْدُ بِالْعَبْدِ وَالْأُنثَىٰ بِالْأُنثَىٰ فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ فَمَنِ اعْتَدَىٰ بَعْدَ ذَٰلِكَ فَلَهُ عَذَابٌ أَلِيمٌ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের জন্য হত্যার ব্যাপারে কিসাসের বিধান লিখে দেয়া হয়েছে৷ স্বাধীন ব্যক্তি হত্যা করে থাকলে তার বদলায় ঐ স্বাধীন ব্যক্তিকেই হত্যা করা হবে, দাস হত্যাকারী হলে ঐ দাসকেই হত্যা করা হবে, আর নারী এই অপরাধ করলে সেই নারীকে হত্যা করেই এর কিসাস নেয়া হবে৷ তবে কোন হত্যাকারীর জন্য যদি তার ভাইয়ের পক্ষ হতে কিছু মাফ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রক্তপণ দানের ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ এবং সততার সঙ্গে রক্তপণ পরিশোধ করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য৷ এই সহজকরণ ও অনুগ্রহ হচ্ছে তোমাদের রবের পক্ষ হতে। এরপরও যে ব্যক্তি বাড়াবাড়ি করবে তার জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি’’। (সূরা বাকারাঃ ১৭৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا فَإِن بَغَتْ إِحْدَاهُمَا عَلَى الْأُخْرَىٰ فَقَاتِلُوا الَّتِي تَبْغِي حَتَّىٰ تَفِيءَ إِلَىٰ أَمْرِ اللَّهِ فَإِن فَاءَتْ فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَا بِالْعَدْلِ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ وَاتَّقُوا اللَّهَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ﴾

‘‘ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াই করে, তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও৷ তারপরও যদি দু’দলের কোন একটি অপরটির বিরুদ্ধে বাড়াবাড়ি করে তাহলে যে দল বাড়াবাড়ি করে তার বিরুদ্ধে লড়াই করো৷ যতক্ষণ না তারা আল্লাহর নির্দেশের দিকে ফিরে আসে৷ তারা যদি ফিরে আসে তাহলে তাদের মাঝে ন্যায় বিচারের সাথে মীমাংসা করে দাও এবং ইনসাফ করো৷ আল্লাহ ইনসাফকারীদের ভালবাসেন। মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই। অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও এবং আল্লাহ্কে ভয় করো যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হও’’। (সূরা হুজুরাতঃ ৯)

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা মুসলিম মিল্লাতের কোন ফাসেক ব্যক্তিকে ইসলাম থেকে সম্পূর্ণরূপে বের করে দেয়না এবং মৃত্যুর পর তারা তাকে চিরস্থায়ী জাহান্নামীও মনে করেনা। যেমন বলে থাকে মুতাযেলারা। ফাসেকের মধ্যে মূল ঈমান বজায় থাকবে এবং তার জন্য ‘মুমিন’ নামও ঠিক থাকবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ أَن يَقْتُلَ مُؤْمِنًا إِلَّا خَطَأً وَمَن قَتَلَ مُؤْمِنًا خَطَأً فَتَحْرِيرُ رَقَبَةٍ مُّؤْمِنَة﴾

কোন মুমিনের কাজ নয় অন্য মুমিনকে হত্যা করা, তবে ভুলবশত হতে পারে৷ আর যে ব্যক্তি ভুলবশত কোন মুমিনকে হত্যা করে তার কাফ্ফারা হিসেবে একজন মুমিনকে গোলামী থেকে মুক্ত করতে হবে’’। (সূরা নিসাঃ ৯২)[2]

তবে কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত মুমিন পূর্ণ ঈমানদার বলে গণ্য হবেনা। পূর্ণ মুমিন হবে তারাই যাদের কথা আল্লাহ তাআলা নিম্নের আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা আনফালের ২ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾

‘‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় প্রভুর প্রতি ভরসা করে’’।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«لاَ يَزْنِي الزَّانِي حِينَ يَزْنِي وَهُوَ مُؤْمِنٌ ولايسرق السارق حين يسرق وهو مؤمن وَلاَ يَشْرَبُ الْخَمْرَ حِينَ يَشْرَبُهَا وَهُوَ مُؤْمِنٌ وَالتَّوْبَةُ مَعْرُوضَةٌ بَعْدُ ولاينتهب نهبة ذات شرف يرفع الناس إليه أبصارهم حين ينتهبها وهو مؤمن»

‘‘যেনাকারী যখন যেনা করে তখন সে মুমিন থাকেনা, চোর যখন চুরি করে তখন সে মুমিন থাকেনা। একই অবস্থা মদ পানকারীর। সে মদ পান করা অবস্থায় মুমিন থাকেনা। এর পরও তার জন্যে তাওবার দরজা উন্মুক্ত থাকে। এমন কোন ভদ্র লোক ছিনতাই করতে পারেনা, যার দিকে মানুষ দৃষ্টি উঁচু করে তাকিয়ে দেখে। সে যখন ছিনতাই করে, তখন সে ঈমানদার থাকেনা’’।[3]

উপরোক্ত গুনাহ্সমূহে লিপ্ত ব্যক্তিদের ব্যাপারে আমরা বলবো, তারা ত্রুটিপূর্ণ মুমিন অথবা বলবো, তার মধ্যে ঈমান থাকার কারণে সে মুমিন এবং কবীরা গুনাহ থাকার কারণে সে ফাসেক। সুতরাং তাদেরকে পূর্ণ ঈমানদার বলা যাবেনা এবং মুমিন পদবী তার কাছ থেকে একেবারে ছিনিয়েও নেয়া হবেনা।


ব্যাখ্যাঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূলনীতি বলতে এখানে ঐসব মূলনীতি উদ্দেশ্য, যার উপর তাদের আকীদাহ ভিত্তিশীল। الدين শব্দের আভিধানিক অর্থ অবনত হওয়া ও বশীভূত হওয়া। আর শরীয়তের পরিভাষায় আল্লাহ তাআলা যা আদেশ করেছেন, তাই দ্বীন।

الإيمان শব্দের আভিধানিক অর্থ التصديق (সত্যায়ন করা)। আর শরীয়তের পরিভাষায় ঈমানের সংজ্ঞা শাইখুল ইসলাম নিজেই উল্লেখ করেছেন। উহা হলোقَوْلٌ وَعَمَلٌ قَوْلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَعَمَلُ الْقَلْبِ وَاللِّسَانِ وَالْجَوَارِحِ ‘‘অন্তরের স্বীকারোক্তি, জবানের ঘোষণা, অন্তরের আমল (বিশ্বাস), জবানের আমল (স্বীকারোক্তি) এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমলকে ঈমান বলা হয়।

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আলেমদের নিকট এটিই হলো ঈমানের সংজ্ঞা। উহা হচ্ছে স্বীকারোক্তি ও আমলের সমষ্টিগত নাম। স্বীকারোক্তি দুই প্রকার। (১) অন্তরের স্বীকারোক্তি। উহা হলো অন্তরের বিশ্বাস। (২) জবানের স্বীকারোক্তি। আর উহা হচ্ছে জবান দিয়ে ইসলামের কালেমা উচ্চারণ করা।

আমল দুই প্রকার। (১) অন্তরের আমল। নিয়ত এবং ইখলাসকে অন্তরের আমল বলা হয়। (২) অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমল। যেমন নামায, হজ্জ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ ইত্যাদি।

অন্তরের স্বীকারোক্তি এবং অন্তরের আমলসমূহের মধ্যে পার্থক্য হলো, অন্তরের আমল বলতে সেই আকীদাহ উদ্দেশ্য, যা অন্তর স্বীকার করে নেয় এবং বিশ্বাস করে। আর অন্তরের আমলসমূহ দ্বারা অন্তরের সেই নড়াচড়া ও স্পন্দন উদ্দেশ্য, যা আল্লাহ তাআলা ও তাঁর রাসূলকে ভালবাসেন এবং পছন্দ করেন। অন্তরের নড়াচড়া ও স্পন্দন বলতে ভাল কাজের প্রতি হৃদয়ের টান, ঝোক, ভালবাসা, সুদৃঢ় ইচ্ছা, খারাপ কাজের প্রতি অন্তরের ঘৃণা এবং তা বর্জনের প্রতি দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করাকে বুঝায়। অন্তরের কাজ থেকেই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কাজ এবং জবানের উক্তিসমূহের উৎপত্তি হয়। এই কারণেই জবানের কথাসমূহ এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আমলসমূহকে ঈমানের মধ্যে গণ্য করা হয়।

ঈমানের সংজ্ঞায় বিভিন্ন ফির্কার অভিমতঃ (১) আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে অন্তরের বিশ্বাস, জবানের স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমলকে ঈমান বলা হয়। (২) মুরজিয়াদের মতে শুধু অন্তরের বিশ্বাস এবং জবানের স্বীকারোক্তিকেই ঈমান বলা হয়। (৩) কাররামীয়াদের মতে শুধু জবানের স্বীকারোক্তিকেই ঈমান বলা হয়। (৪) জাবরীয়াদের মতে অন্তর দিয়ে শুধু স্বীকার করা কিংবা শুধু অন্তরের মারেফতকেই ঈমান বলা হয়। (৫) মুতাযেলাদের মতে অন্তরের বিশ্বাস, জবানের স্বীকারোক্তি এবং অঙ্গ-প্রতঙ্গের আমলকে ঈমান বলা হয়।

ঈমানের সংজ্ঞায় মুতাযেলা এবং আহলে সুন্নাতের মধ্যে পার্থক্য হলো মুতাযেলাদের মতে কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত ব্যক্তি থেকে ঈমানকে সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং সে জাহান্নামে চিরস্থায়ী হবে। কিন্তু আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মতে কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত ব্যক্তির নিকট থেকে ঈমানকে সম্পূর্ণরূপে ছিনিয়ে নেয়া হয়না; বরং তাকে ত্রুটিপূর্ণ মুমিন হিসাবে গণ্য করা হয়। মৃত্যুর পর সে জাহান্নামে গেলেও সে তথায় চিরকাল থাকবেনা।

ঈমানের সংজ্ঞায় উপরোক্ত সব কথাই বাতিল। একমাত্র আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের কথাই সঠিক। তাদের কথার স্বপক্ষে অনেক দলীল রয়েছে।

وَأَنَّ الإيمَانَ يَزِيدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَةِ সৎকাজের মাধ্যমে ঈমান বৃদ্ধি পায় এবং পাপাচারের কারণে ঈমান কমে যায়ঃ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আরেকটি মূলনীতি হলো ঈমানের তারতম্য হয়। কখনো বাড়ে আবার কখনো কমে যায়। আনুগত্যের আমল ঈমানকে বাড়িয়ে দেয় এবং পাপাচার ও গুনাহর কারণে ঈমান কমে। কুরআন ও সুন্নাহর অনেক দলীল এই কথাকে সমর্থন করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَإِذَا تُلِيَتْ عَلَيْهِمْ آَيَاتُهُ زَادَتْهُمْ إِيمَانًا وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ﴾

‘‘যারা ঈমানদার, তারা এমন যে, যখন আল্লাহর নাম নেয়া হয় তখন তাদের অন্তর ভীত হয়। আর যখন তাদের সামনে আল্লাহর আয়াত পাঠ করা হয়, তখন তাদের ঈমান বেড়ে যায় এবং তারা স্বীয় প্রভুর প্রতি ভরসা করে’’। (সূরা আনফালঃ ২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

﴿هُوَ الَّذِي أَنْزَلَ السَّكِينَةَ فِي قُلُوبِ الْمُؤْمِنِينَ لِيَزْدَادُوا إِيمَانًا مَعَ إِيمَانِهِمْ وَلِلَّهِ جُنُودُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَكَانَ اللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمًا﴾

‘‘তিনি মুমিনদের অন্তরে প্রশান্তি নাযিল করেন, যাতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পায়। নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের বাহিনীসমূহ আল্লাহরই এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা ফাতাহঃ ৪) এ ছাড়াও আরো অনেক দলীল রয়েছে।

وَهُمْ مَعَ ذَلِكَ لا يُكَفِّرُونَ أَهْلَ الْقِبْلَةِ بِمُطْلَقِ الْمَعَاصِي وَالْكَبَائِرِ كَمَا يَفْعَلُهُ الْخَوَارَجُ উহা সত্ত্বেও অর্থাৎ সাধারণ পাপকাজ এবং কবীরা গুনাহতে লিপ্ত হওয়ার কারণে ঈমান কমে গেলেও আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা কবীরা গুনাহয় লিপ্ত আহলে কিবলার কাউকে কাফের বলেনা। যেমন করে থাকে খারেজীরাঃ অর্থাৎ আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা যদিও মনে করে যে, আমল ঈমানের মধ্যে শামিল এবং তা সৎ আমলের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং পাপাচারে লিপ্ত হওয়ার কারণে কমে যায়, তথাপিও তারা শির্ক ও কুফরী ব্যতীত অন্যান্য পাপাচারে লিপ্ত এমন কোন মানুষকে কাফের বলেনা, যে ইসলামের দাবী করে এবং কিবলামুখী হয়ে নামায পড়ে। যেমন বলে থাকে খারেজীরা। তারা বলে, যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কবীরা গুনাহ্য় লিপ্ত হবে সে কাফের এবং আখেরাতে সে চিরস্থায়ী জাহান্নামী হবে। জাহান্নাম থেকে সে কখনো বের হবেনা।

সুতরাং আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের লোকেরা মনে করে পাপাচারে লিপ্ত হলেও ঈমানী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ঠিক থাকে। সুতরাং কবীরা গুনাহয় লিপ্ত ব্যক্তি আমাদেরই ঈমানী ভাই। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) কিসাসের আয়াতে আল্লাহ তাআলার বাণী দ্বারা উক্ত কথার উপর দলীল গ্রহণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿فَمَنْ عُفِيَ لَهُ مِنْ أَخِيهِ شَيْءٌ فَاتِّبَاعٌ بِالْمَعْرُوفِ وَأَدَاءٌ إِلَيْهِ بِإِحْسَانٍ ذَٰلِكَ تَخْفِيفٌ مِّن رَّبِّكُمْ وَرَحْمَةٌ﴾

তবে কোন হত্যাকারীর জন্য যদি তার ভাইয়ের পক্ষ হতে কিছু মাফ করে দেয়া হয়, তাহলে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী রক্তপণ আদায়ের ব্যবস্থা করা উচিত এবং সততার সঙ্গে রক্তপণ আদায় করা হত্যাকারীর জন্য অপরিহার্য৷ এই সহজকরণ ও অনুগ্রহ হচ্ছে তোমাদের রবের পক্ষ হতে। (সূরা বাকারাঃ ১৭৮) আয়াতের তাৎপর্য হলো আঘাতকারীকে যদি আহত ব্যক্তি মাফ করে দেয় কিংবা নিহত ব্যক্তির ওয়ারিছগণ ক্ষমা করে দেয় এবং কিসাসের বদলে রক্তপন নিতে রাজী হয়, তাহলে মালের হকদারের উচিৎ কঠোরতা পরিহার করে ন্যায়ভাবে উহা তলব করা। অর্থ পরিশোধের দায়ভার যাদের উপর বর্তাবে তাদেরও উচিৎ হবে কোন প্রকার বাহানা ব্যতীত হকদারদের নিকট হক বুঝিয়ে দেয়া। উক্ত আয়াত থেকে এভাবে দলীল গ্রহণ করা যেতে পারে যে, হত্যা করা কবীরা গুনাহ হওয়া সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা হত্যাকারীকে নিহত ব্যক্তির ভাই বলে উল্লেখ করেছেন। এতে বুঝা গেল, হত্যা করার পরও হত্যাকারীর সাথে ঈমানের ভিত্তিতে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অবশিষ্ট থাকে।

শাইখুল ইসলাম আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারা আরো দলীল গ্রহণ করেছেন যে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ﴾ وَإِن طَائِفَتَانِ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ اقْتَتَلُوا فَأَصْلِحُوا بَيْنَهُمَ ﴿ ‘‘ঈমানদারদের মধ্যকার দু’টি দল যদি পরস্পর লড়াই করে, তাহলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। উপরোক্ত আয়াতে কারীমা দু’টি দ্বারা এভাবে দলীল গ্রহণ করা যেতে পারে যে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সীমালংঘন বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাদেরকে মুমিন হিসাবেই নামকরণ করেছেন। সেই সাথে তাদেরকে আল্লাহ তাআলা মুমিনদের ভাই হিসাবেই উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ﴾ ﴿فَأَصْلِحُوا بَيْنَ أَخَوَيْكُمْ ‘‘অতএব, তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও’’।

আয়াতের সংক্ষিপ্ত অর্থ হলো যখন মুসলিমদের দুই দল পরস্পর লড়াই শুরু করবে, তখন অন্যান্য মুসলিমদের উচিৎ তাদের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করা এবং আল্লাহ তাআলার হুকুম মেনে নেয়ার আহবান জানানো। মীমাংসার উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও যদি দুইদলের একদল অন্যদলের উপর যুলুম করে এবং মীমাংসার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে মুসলিমদের উপর আবশ্যক হলো এই বিদ্রোহী দলের বিরুদ্ধে লড়াই করে আল্লাহর হুকুম ও ফয়সালা মানতে বাধ্য করা। অতঃপর বিদ্রোহী দল যদি সীমালংঘন ও বিদ্রোহ পরিহার করে আল্লাহর হুকুমের দিকে চলে আসে এবং আল্লাহর কিতাব ও ফয়সালা মেনে নিতে রাজী হয়, তাহলে মুসলিমদের উচিৎ, মীমাংসা ও ফয়সালা করার সময় উভয় দলের মধ্যে ইনসাফ করা। তারা আল্লাহ তাআলার হুকুম মোতাবেক ফয়সালা করার জন্য সঠিক রায়ের অনুসন্ধান করবে এবং বল প্রয়োগ করে সীমালংঘনকারী যালেম দলকে ফিরিয়ে আনবে। যাতে যুলুম থেকে তারা ফিরে আসে এবং অন্য দলের জন্য যেই হক তাদের উপর রয়েছে, তা পরিশোধ করে।

অতঃপর আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিশেষভাবে বিবাদরত দুই দলের মধ্যে ইনসাফের ভিত্তিতে মীমাংসা করার আদেশ দেয়ার পর সমস্ত মুসলিমকেই তাদের সকল বিষয়ে ন্যায়নীতি অবলম্বন করার আদেশ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَأَقْسِطُوا إِنَّ اللَّهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِينَ﴾ ﴿ ‘‘তোমরা ইনসাফ করো। কেননা আল্লাহ তাআলা ইনসাফকারীদেরকে ভালবাসেন’’।إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাইঃ এটি একটি স্বতন্ত্র বাক্য। পূর্বের বাক্যে বিবাদরত দুই দলের মধ্যে মীমাংসা করার যেই আদেশ দেয়া হয়েছে, এই বাক্যে উহাকেই সাব্যস্ত করা হয়েছে। এই আয়াতের অর্থ হলো মুসলিমগণ মাত্র একটি বিষয়ের দিকেই ফিরে যাবে। সেটি হচ্ছে ঈমান। সুতরাং তারা সকলেই দ্বীনী ভাই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তোমরা তোমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। অর্থাৎ বিবাদ ও সংগ্রামরত প্রত্যেক দুই মুসলিমের মধ্যে মীমাংসা করে দাও। এখানে দুইজনকে খাস করার মাধ্যমে সাব্যস্ত করা হয়েছে যে, দুইয়ের অধিক মুসলিম লড়াইয়ে লিপ্ত হলে তাদের মধ্যে মীমাংসা করার আরো বেশী প্রয়োজন পড়বে। আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ তোমরা তোমাদের সকল বিষয়েই আল্লাহকে ভয় করো। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করার কারণে আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হতে পারো।

[1] - গুনাহ দুই প্রকার। কবীরা ও সগীরা। কবীরা ঐ গুনাহকে বলা হয়, যার জন্য দুনিয়াতে শাস্তি নির্ধারিত রয়েছে। যেমন চোরের হাত কাটা, ব্যভিচারের শাস্তি কায়েম করা ইত্যাদি অথবা যার কারণে আখেরাতে শাস্তির ধমক দেয়া হয়েছে। যেমন সুদখোরের শাস্তি, গীবত করার শাস্তি টাখনুর নীচে কাপড় ঝুলিয়ে পরার শাস্তি, ইত্যাদি। দুনিয়াতে এই কাজগুলোর শাস্তি নির্ধারিত না থাকলেও আখেরাতে শাস্তির ভয় দেখানো হয়েছে। তাই এগুলোও কবীরা গুনাহ। আর যেসব গুনাহর কারণে দুনিয়া ও আখেরাতে সুনির্দিষ্ট কোন শাস্তির কথা বলা হয়নি, সেগুলোই সগীরা গুনাহ। কিন্তু আল্লাহ তাআলা এবং তাঁর রাসূল উহাও হারাম করেছেন এবং তাতে লিপ্ত হতে নিষেধ করেছেন।

কবীরা গুনাহর জন্য তাওবা করা আবশ্যক। তাওবা ছাড়া কবীরা গুনাহ ক্ষমা করা হয়না। সগীরা গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য তাওবা জরুরী কিনা আলেমদের থেকে এই মর্মে দু’টি মত পাওয়া যায়। কোন কোন আলেম বলেছেনঃ কবীরা ও সগীরা উভয় প্রকার গুনাহর জন্য তাওবা আবশ্যক। তবে অধিকাংশ আলেমের মতে সগীরা গুনাহ থেকে ক্ষমা পাওয়ার জন্য তাওবা জরুরী নয়। সৎকাজ দ্বারা উহা এমনিতেই মাফ হয়ে যায়। এই মর্মে অনেক দলীল রয়েছে, আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿إِن تَجْتَنِبُوا كَبَائِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنكُمْ سَيِّئَاتِكُمْ وَنُدْخِلْكُم مُّدْخَلًا كَرِيمًا﴾

‘‘তোমরা যদি বড় বড় গোনাহ থেকে দূরে থাকো, যা থেকে তোমাদেরকে নিষেধ করা হয়েছে, তাহলে তোমাদের ছোট-খাটো খারাপ কাজগুলো আমি তোমাদের হিসেব থেকে বাদ দিয়ে দেবো এবং তোমাদের সম্মান ও মর্যাদার জায়গায় প্রবেশ করিয়ে দেবো’’। (সূরা নিসাঃ ৩১)

উপরোক্ত মত পোষণকারীদের সর্বাধিক শক্তিশালী দলীল হলো এই হাদীছটি, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, ‘‘পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এক জুমআ থেকে অপর জুমআ এবং এক রামাযান থেকে অন্য রামাযানের মধ্যে কৃত পাপ মোচন হয়ে যায় যদি ব্যক্তি কবীরা গুনাহ থেকে বিরত থাকে’’। (সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ৩৪৪)

অধিকাংশ বিদ্বানদের অভিমত এটাই যে, ছোট পাপ মোচনের জন্য বড় পাপ থেকে বিরত থাকা শর্ত। কাতাদাহ (রঃ) বলেন, আল্লাহ তো ক্ষমার অঙ্গিকার সেই ব্যক্তিদের জন্যই করেছেন যারা কবীরা বা বড় গুনাহ থেকে বিরত থাকে। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, ছোট ছোট পাপ একত্রিত হয়ে কবীরাতে পরিণত হয়। তাই সতর্ক থাকা জরুরী এবং সবগুলো থেকে তাওবা করা উচিৎ।

[2] - উপরোক্ত আয়াত দ্বয়ে পরস্পর সংগ্রাম ও লড়াইরত উভয় দলকেই এবং হত্যা করার পরও হত্যাকারীকে আল্লাহ তাআলা মুমিন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাতে বুঝা গেল অন্যায় কাজ করলেই কেউ ঈমান থেকে বের হয়ে যায়না। যতক্ষণ না তার ভিতরে ইসলাম ও ঈমান ভঙ্গকারী বিষয়গুলো পাওয়া না যাবে।

[3] - বুখারী, অধ্যায়ঃ কিতাবুল আশরিবাহ। অন্য বর্ণনায় আছে, ‘‘যখন কোন হত্যাকারী কাউকে হত্যা করে, হত্যা করার সময় সে মুমিন থাকে না’’। অন্য বর্ণনায় আছে, ছিনতাইকারী যখন কোন মূল্যবান জিনিষ ছিনতাই করে নেয়, যার দিকে লোকেরা দৃষ্টি উঁচু করে দেখে তখন সে মুমিন থাকে না’’।