শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া মহাপ্রলয় এবং তাতে যা হবে ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
মহাপ্রলয় এবং তাতে যা হবে

القيامة الكبرى وما يجري فيها

মহাপ্রলয় এবং তাতে যা হবে:

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেন,

إِلَى أَنْ تَقُومَ الْقِيَامَةُ الْكُبْرَى فَتُعَادُ الْأَرْوَاحُ إِلَى الْأَجْسَادِ وَتَقُومُ الْقِيَامَةُ الَّتِي أَخْبَرَ اللَّهُ بِهَا فِي كِتَابِهِ وَعَلَى لِسَانِ رَسُولِهِ وَأَجْمَعَ عَلَيْهَا الْمُسْلِمُونَ فَيَقُومُ النَّاسُ مِنْ قُبُورِهِمْ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا

কবরের ফিতনার পর কারো শাস্তি বা নেয়ামত মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। তখন সমস্ত মানুষের রূহগুলোকে তাদের দেহে ফিরিয়ে দেয়া হবে। কিয়ামত সংঘটিত হবে, -এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদীছে সংবাদ দিয়েছেন। মুসলিমগণ এ বিষয়ে ইজমা পোষণ করেছেন। লোকেরা কিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির প্রভুর সামনে খালী পায়ে, উলঙ্গ এবং খাতনাবিহীন[1] অবস্থায় হাযির হবে।


ব্যাখ্যাঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এই অধ্যায়ে এবং তার পরবর্তী অধ্যায়সমূহে ঐসব বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা আখেরাতে সংঘটিত হবে। আর এ সব বিষয় কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই শুরু হবে।

মোট ঘর বা বাসস্থান হলো তিনটি। (১) দুনিয়ার ঘর। (২) বারযাখ তথা কবর জগতের ঘর। (৩) আখেরাতের ঘর। এই তিনটি ঘরের প্রত্যেকটির জন্য বিশেষ বিশেষ হুকুম-আহকাম রয়েছে এবং এগুলোর জন্য এমন এমন ঘটনা রয়েছে, যা তাতে সংঘটিত হবে। বারযাখের গৃহে যা হবে, শাইখ তা পূর্বের অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন।

এখানে তিনি ঐসব বিষয়ের আলোচনা শুরু করেছেন, যা আখেরাতের ঘরে সংঘটিত হবে। তিনি বলেনঃ কবরের ফিতনার পর কারো শাস্তি অথবা নেয়ামত মহাপ্রলয় সংঘটিত হওয়া পর্যন্ত চলতে থাকবে। কিয়ামত দু’টি। ছোট কিয়ামত ও বড় কিয়ামত। মৃত্যু হলো ছোট কিয়ামত। এই ছোট কিয়ামত প্রত্যেক মানুষের জন্য আলাদাভাবে কায়েম হবে। দুনিয়ার জীবন শেষ হওয়ার পর এবং দেহ থেকে রূহ বের হওয়ার দিনই তার উপর এই কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে।[2]

আর বড় কিয়ামত সমস্ত মানুষের উপর একসাথে কায়েম হবে এবং সব মানুষকে দুনিয়া থেকে একসাথেই উঠিয়ে নিবে। এই দিনকে কিয়ামত (দন্ডায়মান) দিবস হিসাবে নাম দেয়ার কারণ হলো তাতে শেষ ফুৎকারের সাথে সাথে সকল মানুষ তাদের কবর থেকে আল্লাহ রাববুল আলামীনের সামনে দন্ডায়মান হবে। তাই শাইখুল ইসলাম বলেছেন, তখন রূহগুলোকে দেহের মধ্যে ফিরিয়ে দেয়া হবে। আর এটি তখনই হবে, যখন ইসরাফীল সিঙ্গায় ফুঁ দিবে। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَإِذَا هُم مِّنَ الْأَجْدَاثِ إِلَىٰ رَبِّهِمْ يَنسِلُونَ قَالُوا يَا وَيْلَنَا مَن بَعَثَنَا مِن مَّرْقَدِنَا ۜ ۗ هَٰذَا مَا وَعَدَ الرَّحْمَٰنُ وَصَدَقَ الْمُرْسَلُونَ﴾

‘‘তারপর শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে এবং সহসা তারা নিজেদের রবের সামনে হাযির হবার জন্য নিজেদের কবর থেকে বের হবে৷ ভীত হয়ে বলবে, হায় আফসোস! কে আমাদেরকে আমাদের সমাধি থেকে উঠিয়ে দাঁড় করালো? এটা সে বিষয় যার প্রতিশ্রুতি দয়াময় আল্লাহ দিয়েছিলেন এবং রাসূলদের কথা সত্যে পরিণত হলো৷ (সূরা ইয়াসীনঃ ৫১-৫২) আল্লাহ তাআলা সূরা যুমারের ৬৮ নং আয়াতে আরো বলেন,

﴿وَنُفِخَ فِي الصُّورِ فَصَعِقَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَمَن فِي الْأَرْضِ إِلَّا مَن شَاءَ اللَّهُ ثُمَّ نُفِخَ فِيهِ أُخْرَىٰ فَإِذَا هُمْ قِيَامٌ يَنظُرُونَ﴾

‘‘সেদিন শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে৷ আর তৎক্ষণাৎ আসমান ও যমীনে যারা আছে তারা সবাই বেহুশ হয়ে পড়ে যাবে৷ তবে আল্লাহ যাদেরকে এর বাইরে রাখতে চান তাদের কথা ভিন্ন৷ অতঃপর আরেকবার শিংগায় ফুঁ দেয়া হবে তখন হঠাৎ সবাই দন্ডায়মান হয়ে দেখতে থাকবে’’।

الروح শব্দের বহুবচন হচ্ছে الأرواح অর্থাৎ রূহসমূহ। মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী যার বদৌলতে বেঁচে থাকে, তার নাম রূহ। আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ রূহের হাকীকত তথা আসল অবস্থা সম্পর্কে অবগত নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

﴿وَيَسْأَلُونَكَ عَنِ الرُّوحِ قُلِ الرُّوحُ مِنْ أَمْرِ رَبِّي وَمَا أُوتِيتُم مِّنَ الْعِلْمِ إِلَّا قَلِيلًا﴾

‘‘এরা তোমাকে রূহ সম্পর্কে প্রশ্ন করছে৷ বলে দাও, রূহ আমার রবের আদেশ মাত্র। কিন্তু তোমরা সামান্য জ্ঞানই লাভ করেছো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৮৫)

কিয়ামত সংঘটিত হবে, সে সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর হাদীছে সংবাদ দিয়েছেন। মুসলিমগণ এ বিষয়ে ইজমা পোষণ করেছেনঃ শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে কিয়ামতের দিন সৃষ্টির পুনরুত্থানের দলীলগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং মুসলিমদের ইজমা, মানুষের বোধশক্তি এবং ফিতরাত পরিশুদ্ধ সৃষ্টিগত স্বভাব দ্বারা পুনরুত্থান প্রমাণিত। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে পুনরুত্থান সম্পর্কে খবর দিয়েছেন, এর উপর দলীল কায়েম করেছেন এবং কুরআনের অধিকাংশ সূরাতেই পুনরুত্থানে অবিশ্বাসীদের প্রতিবাদ করেছেন।[3] আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যেহেতু সর্বশেষ নবী, তাই তিনি আখেরাতের বিষয়গুলোর এমন খোলাখুলি বিবরণ দিয়েছেন, যা অনেক নবীর কিতাবসমূহেই পাওয়া যাবেনা।

আমলের বিনিময় দেয়া মানুষের বিবেক ও বোধশক্তি দ্বারাই প্রমাণিত।[4] আর শরীয়ত এটিকে সুসাব্যস্ত করেছে। কেননা আল্লাহ তাআলা কুরআনের অনেক স্থানেই মানুষের বোধশক্তিকে পুনরুত্থানের প্রতি সতর্ক করেছেন। আল্লাহ তাআলা সেখানে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, মানুষ কি মনে করে, তাকে বিনা হিসাবে ছেড়ে দেয়া হবে? অথবা তারা কি মনে করে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছেন? তাদেরকে আদেশ-নিষেধ করা হবেনা? তাদেরকে পুরস্কার কিংবা শাস্তি দেয়া হবেনা? আল্লাহ তাআলার হিকমতের সাথে মোটেই শোভনীয় ও সঙ্গতিপূর্ণ নয় যে, তিনি মানুষকে অযথা সৃষ্টি করবেন, কোন দায়িত্ব না দিয়েই তাদেরকে ছেড়ে দিবেন, আদেশ-নিষেধ করবেন না এবং তাদের কর্ম অনুপাতে ছাওয়াব বা শাস্তি দিবেন না। আল্লাহ তাআলার হিকমত এটি সমর্থন করেনা।

এ রকম কোন সম্ভাবনা নাই যে, আল্লাহ তাআলা সৎকর্মশীলকে অসৎকর্মীর সমান করবেন কিংবা মুসলিমদেরকে অপরাধীদের কাতারে শামিল করবেন। কেননা কতক সৎকর্মশীল ব্যক্তি তার সৎকর্মের বিনিময় পাওয়ার আগেই মৃত্যু বরণ করে এবং কতিপয় অপরাধী তার অপরাধের উপযুক্ত সাজা ভোগ করার আগেই মারা যায়। সুতরাং এমন একটি জগৎ অবশ্যই থাকা দরকার যেখানে উপরোক্ত উভয় শ্রেণীর লোকই ন্যায্য বিনিময় পেয়ে যাবে।

পুনরুত্থানে অবিশ্বাসী কাফের হিসাবে গণ্য হবে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿زَعَمَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَن لَّن يُبْعَثُوا قُلْ بَلَىٰ وَرَبِّي لَتُبْعَثُنَّ ثُمَّ لَتُنَبَّؤُنَّ بِمَا عَمِلْتُمْ وَذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ﴾

‘‘কাফেররা ধারণা করে বলেছে যে, মরার পরে আর কখনো তাদের জীবিত করে উঠানো হবেনা৷ তাদের বলে দাও, আমার রবের শপথ! তোমাদের অবশ্যই উঠানো হবে৷ অতঃপর দুনিয়ায় তোমরা যা করেছো তা অবশ্যই তোমাদেরকে অবহিত করা হবে৷ এরূপ করা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ’’। (সূরা তাগাবুনঃ ৭)

শাইখুল ইসলাম বলেনঃفَيَقُومُ النَّاسُ مِنْ قُبُورِهِمْ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর লোকেরা সমস্ত সৃষ্টির প্রভুর সামনে খালী পায়ে, উলঙ্গ এবং খাতনাবিহীন অবস্থায় দন্ডায়মান হবেঃ حفاة শব্দটি حاف এর বহুবচন। যার পায়ে জুতা কিংবা মোজা থাকেনা, তাকে حافٍ বলা হয়। عراة (উলঙ্গ, বস্ত্রহীন) عارٍ এর বহুবচন। যার শরীরে কোন কাপড় থাকেনা, সেই হচ্ছে عارٍ। আর غرلًا শব্দটি أغرل এর বহুবচন। খাতনাবিহীন লোককে আগরাল বলা হয়। যার পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া কেটে খাতনা করা হয়নি, সেই আগরাল। লোকেরা যখন কবর থেকে উঠে হাশরের মাঠে দন্ডায়মান হবে, তখন এই তিনটি বৈশিষ্ট তাদের মধ্যে বিদ্যমান থাকবে। আয়েশা (রাঃ) হতে বর্ণিত সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমের হাদীছে এই কথা পাওয়া যাচ্ছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

إنكم تُحْشَرُون إلى الله يَوْمَ الْقِيَامَةِ حُفَاةً عُرَاةً غُرْلًا

‘‘কিয়ামতের দিন নগ্নপদ, উলঙ্গ, এবং খাতনাবিহীন অবস্থায় তোমাদেরকে আল্লাহর নিকট উপস্থিত করা হবে’’।[5]

[1] - খাতনা করার সময় পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের যেই চামড়াটুকু কেটে ফেলা হয়, কিয়ামতের দিন তাও ফিরিয়ে দেয়া হবে এবং মানুষ যে অবস্থায় দুনিয়ায় এসেছিল, হুবহু সেই অবস্থায় পুনরুত্থিত হবে। (আল্লাহই অধিক অবগত)

[2] - শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) কিয়ামত এবং তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের আলোচনার সাথে কিয়ামতের আলামতগুলো উল্লেখ করেন নি। কিয়ামতের আলামতগুলো যেহেতু কিয়ামতের মতই গায়েবী বিষয়সমূহের অন্তর্ভুক্ত, তাই অন্যান্য আলেমগণ আকীদাহর বিষয়গুলোর সাথে কিয়ামতের বড় বড় আলামতগুলোও উল্লেখ করেছেন। তাই আমরা বিশ্বাস করি যে, কুরআন ও সহীহ হাদীছে কিয়ামতের যেসমস্ত আলামতের কথা বর্ণিত হয়েছে তা প্রকাশ হওয়ার পূর্বে কিয়ামত সংঘটিত হবেনা। কিয়ামতের ছোট আলামতগুলোর অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছে। যা এখনও প্রকাশিত হয়নি তা অবশ্যই প্রকাশিত হবে। মুসলিম শরীফে হুযায়ফা (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেনঃ

اطَّلَعَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَيْنَا وَنَحْنُ نَتَذَاكَرُ فَقَالَ مَا تَذَاكَرُونَ قَالُوا نَذْكُرُ السَّاعَةَ قَالَ إِنَّهَا لَنْ تَقُومَ حَتَّى تَرَوْنَ قَبْلَهَا عَشْرَ آيَاتٍ فَذَكَرَ الدُّخَانَ وَالدَّجَّالَ وَالدَّابَّةَ وَطُلُوعَ الشَّمْسِ مِنْ مَغْرِبِهَا وَنُزُولَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَيَأَجُوجَ وَمَأْجُوجَ وَثَلَاثَةَ خُسُوفٍ خَسْفٌ بِالْمَشْرِقِ وَخَسْفٌ بِالْمَغْرِبِ وَخَسْفٌ بِجَزِيرَةِ الْعَرَبِ وَآخِرُ ذَلِكَ نَارٌ تَخْرُجُ مِنَ الْيَمَنِ تَطْرُدُ النَّاسَ إِلَى مَحْشَرِهِمْ

‘‘একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাদের নিকট আগমণ করলেন। আমরা তখন কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। তিনি বললেনঃ যতদিন তোমরা দশটি আলামত না দেখতে পাবে ততদিন কিয়ামত হবেনা। (১) ধোঁয়া (২) দাজ্জালের আগমণ (৩) ভূগর্ভ থেকে নির্গত দাববাতুল আরদ্ নামক অদ্ভুত এক জানোয়ারের আগমণ ৪) পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় (৫) ঈসা ইবনে মারইয়ামের আগমণ (৬) ইয়াজুয-মা’জুযের আবির্ভাব (৭) পূর্বে ভূমিধ্বস (৮) পশ্চিমে ভূমিধ্বস (৯) আরব উপদ্বীপে ভূমিধ্বস (১০) সর্বশেষে ইয়ামান থেকে একটি আগুন বের হয়ে মানুষকে সিরিয়ার দিকে হাঁকিয়ে নিবে’’।

আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হচ্ছে কিয়ামতের এ সমস্ত আলামতের একটিও এখনো প্রকাশিত হয়নি। কিয়ামতের পূর্বে এগুলো প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত তা সংঘটিত হবেনা।


[3] - পুনরুত্থানকে সত্য হিসাবে প্রমাণ করার জন্য কুরআন যেসব সুস্পষ্ট দলীল-প্রমাণ পেশ করেছে, তার মধ্যে নিম্নের দলীলগুলো অন্যতম। আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)এর উক্তি নকল করে আরো বলেনঃ

﴿وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّ أَرِنِي كَيْفَ تُحْيِي الْمَوْتَىٰ قَالَ أَوَلَمْ تُؤْمِن قَالَ بَلَىٰ وَلَٰكِن لِّيَطْمَئِنَّ قَلْبِي قَالَ فَخُذْ أَرْبَعَةً مِّنَ الطَّيْرِ فَصُرْهُنَّ إِلَيْكَ ثُمَّ اجْعَلْ عَلَىٰ كُلِّ جَبَلٍ مِّنْهُنَّ جُزْءًا ثُمَّ ادْعُهُنَّ يَأْتِينَكَ سَعْيًا ۚ وَاعْلَمْ أَنَّ اللَّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ﴾

‘‘আর স্মরণ করো সেই সময়ের কথা, যখন ইবরাহীম বলেছিলঃ হে আমার প্রভু! আমাকে দেখিয়ে দাও কিভাবে তুমি মৃতদের পুনর্জীবিত করো৷ আল্লাহ বললেনঃ তুমি কি বিশ্বাস করোনা? ইবরাহীম জবাব দিলঃ বিশ্বাস তো করি, তবে মানসিক প্রশান্তি লাভ করতে চাই। আল্লাহ বললেনঃ ঠিক আছে, তুমি চারটি পাখি ধরে নাও এবং তাদেরকে নিজের পোষ মানিয়ে নাও৷ তারপর তাদের এক একটি অংশ এক একটি পাহাড়ের উপর রাখো৷ এরপর তাদেরকে ডাকো৷ তারা তোমার কাছে দৌড়ে চলে আসবে৷ ভালভাবে জেনে রাখো, আল্লাহ প্রবল পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা বাকারাঃ ২৬০) গুহাবাসীদেরকে তিনশ নয় বছর পর্যন্ত ঘুমপাড়ানো এবং তাদেরকে জাগ্রত করার মধ্যে রয়েছে পুনরুত্থানের সুস্পষ্ট দলীল। মৃত যমীনকে বৃষ্টির মাধ্যমে সতেজ, সজীব এবং শস্য-শ্যামল করার দৃষ্টান্ত পেশ করে আল্লাহ তাআলা মৃত্যুর পর মানুষের পুনরুত্থান সাব্যস্ত করেছেন।

মানুষ সৃষ্টির উপাদান উল্লেখ করার মাধ্যমেও তাদের পুনরুত্থান সাব্যস্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿أَوَلَمْ يَرَ الْإِنسَانُ أَنَّا خَلَقْنَاهُ مِن نُّطْفَةٍ فَإِذَا هُوَ خَصِيمٌ مُّبِينٌ وَضَرَبَ لَنَا مَثَلًا وَنَسِيَ خَلْقَهُ قَالَ مَن يُحْيِي الْعِظَامَ وَهِيَ رَمِيمٌ قُلْ يُحْيِيهَا الَّذِي أَنشَأَهَا أَوَّلَ مَرَّةٍ وَهُوَ بِكُلِّ خَلْقٍ عَلِيمٌ الَّذِي جَعَلَ لَكُم مِّنَ الشَّجَرِ الْأَخْضَرِ نَارًا فَإِذَا أَنتُم مِّنْهُ تُوقِدُونَ أَوَلَيْسَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ بِقَادِرٍ عَلَىٰ أَن يَخْلُقَ مِثْلَهُم بَلَىٰ وَهُوَ الْخَلَّاقُ الْعَلِيمُ إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ فَسُبْحَانَ الَّذِي بِيَدِهِ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيْءٍ وَإِلَيْهِ تُرْجَعُونَ﴾

‘‘মানুষ কি দেখেনা, তাকে আমি সৃষ্টি করেছি শুক্রবিন্দু থেকে এবং তারপর সে দাঁড়িয়ে গেছে স্পষ্ট ঝগড়াটে হয়ে? এখন সে আমার উপর উপমা প্রয়োগ করে এবং নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, এ হাড়গুলো যখন পচে গলে গেছে এতে আবার প্রাণ সঞ্চার করবে কে? তাকে বলো, এদেরকে তিনি জীবিত করবেন যিনি প্রথমে সৃষ্টি করেছিলেন এবং তিনি সৃষ্টির প্রত্যেকটি কাজ ও অবস্থা জানেন৷ তিনিই তোমাদের জন্য সবুজ বৃক্ষ থেকে আগুন সৃষ্টি করেছেন এবং তোমরা তা থেকে নিজেদের চুলা জ্বালিয়ে থাকো৷ যিনি আকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন তিনি তাদের অনুরূপ সৃষ্টি করার ক্ষমতা রাখেন না? অবশ্যই রাখেন। তিনি মহান স্রষ্টা, মহাজ্ঞানী৷ তিনি যখন কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তাঁর কাজ হয় কেবল এতটুকু যে, তিনি তাকে হুকুম দেন, হয়ে যাও এবং তা হয়ে যায়। পবিত্র তিনি যার হাতে রয়েছে প্রত্যেকটি জিনিষের পূর্ণ কর্তৃত্ব এবং তাঁরই দিকে তোমাদের ফিরে যেতে হবে’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৭৭-৮৩)

আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলের এক ব্যক্তির ঘটনা উল্লেখ করে বলেনঃ

﴿أَوْ كَالَّذِي مَرَّ عَلَى قَرْيَةٍ وَهِيَ خَاوِيَةٌ عَلَى عُرُوشِهَا قَالَ أَنَّى يُحْيِي هَذِهِ اللَّهُ بَعْدَ مَوْتِهَا فَأَمَاتَهُ اللَّهُ مِئَةَ عَامٍ ثُمَّ بَعَثَهُ قَالَ كَمْ لَبِثْتَ قَالَ لَبِثْتُ يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالَ بَلْ لَبِثْتَ مِئَةَ عَامٍ فَانْظُرْ إِلَى طَعَامِكَ وَشَرَابِكَ لَمْ يَتَسَنَّهْ وَانْظُرْ إِلَى حِمَارِكَ وَلِنَجْعَلَكَ آَيَةً لِلنَّاسِ وَانْظُرْ إِلَى الْعِظَامِ كَيْفَ نُنْشِزُهَا ثُمَّ نَكْسُوهَا لَحْمًا فَلَمَّا تَبَيَّنَ لَهُ قَالَ أَعْلَمُ أَنَّ اللَّهَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ﴾

‘‘অথবা (পুনরুত্থানের দৃষ্টান্ত স্বরূপ) সেই ব্যক্তির কথা স্মরণ করো, যে এমন একটি গ্রাম অতিক্রম করেছিল, যার গৃহের ছাদগুলো উপুড় হয়ে পড়েছিল৷ সে বললঃ এই ধ্বংসপ্রাপ্ত জন বসতিকে আল্লাহ আবার কিভাবে জীবিত করবেন? এ কথায় আল্লাহ তার প্রাণ হরণ করলেন এবং সে একশ বছর পর্যন্ত মৃত অবস্থায় পড়ে রইলো৷ তারপর আল্লাহ পুনর্বার তাকে জীবন দান করলেন, এবং তাকে জিজ্ঞেস করলেনঃ তুমি কত বছর ঘুমিয়েছো? সে বললঃ এই তো মাত্র একদিন বা তার চেয়েও কম সময় ঘুমিয়েছি। আল্লাহ বললেনঃ বরং তুমি একশ বছর ঘুমিয়েছো৷ এবার নিজের খাবার ও পানীয়ের উপর নজর বুলাও, দেখো তার মধ্যে সামান্য পরিবর্তনও আসেনি৷ অন্যদিকে তোমার গাধাটিকে দেখো৷ আর এটা আমি এ জন্য করেছি যে, মানুষের জন্য তোমাকে আমি একটি নিদর্শন হিসেবে দাঁড় করাতে চাই৷ তুমি গাধার অস্থিগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখো। লক্ষ্য করোঃ আমি কিভাবে একে উঠিয়ে এর গায়ে গোশত ও চামড়া লাগিয়ে দিই। এভাবে সত্য যখন তার সামনে সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো, তখন সে বলে উঠলোঃ আমি অবগত আছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছুর উপর শক্তিশালী’’৷ (সূরা বাকারাঃ ২৫৯)

[4] - আমাদের এই বর্তমান পৃথিবীতে আমরা দেখছি যে, প্রত্যেক রাষ্ট্রেই অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার জন্য আইন তৈরী করে রাখা হয়েছে। শান্তি প্রিয় মানুষের জান-মালের নিরাপত্তার জন্য প্রত্যেক দেশেই মানুষ বেশ কিছু আইন-কানুন তৈরী করেছে। যারা মানুষের জান-মালের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ করে তাদের জন্য রয়েছে বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা। এই শাস্তি ক্ষেত্রে বিশেষে মৃত্যুদন্ড পর্যন্ত পৌঁছে যায়। অপরাধীকে শাস্তি দেয়া মানুষের সুস্থ বিবেক ও বোধশক্তি কেবল সমর্থনই করেনা; বরং রাষ্ট্রে শান্তি-শৃংখলা রক্ষা করা এবং ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য শাস্তি দেয়া জরুরী মনে করে। অন্যথায় পৃথিবীর শান্তি-শৃংখলা ব্যাপকভাবে বিঘ্নিত হবে। সুতরাং যেই মহান রাববুল আলামীন যুলুম করাকে মোটেই পছন্দ করেন না, যিনি ন্যায় ও ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করাকে ভালবাসেন এবং সেই জন্য বিচার দিবস নামে একটি দিবসও নির্ধারণ করেছেন, তার জন্য অপরাধীকে পরকালে শাস্তি দেয়া অযৌক্তিক হয় কিভাবে?

[5] - বুখারী ও মুসলিম, অধ্যায়ঃ কিতাবু সিফাতিল জান্নাত।