‘‘এ জগতে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল,

নারী দিল তাহে রূপ-রস-মধু-গন্ধ সুনির্মল।

কোনো কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী,

প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয়-লক্ষমী নারী।’’

নারী পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী, সমাজের সচল জোড়া চাকার অন্যতম। পরিবারের ভিত্তি ও শিক্ষার প্রথম স্কুল এই নারী। প্রত্যেক মহান পুরুষের পশ্চাতে কোন না কোন নারী লুক্কায়িত থাকে অথবা পুরুষের মহত্বের পিছনে এই নারীর হাত অবশ্যই থাকে।

দাম্পত্য জীবনে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই উভয়ের মুখাপেক্ষী। প্রত্যেকের সব-সব অধিকার রয়েছে অপরের উপর। ইসলামে এই হল ভারসাম্যমূলক পারস্পরিক সহায়তাভিত্তিক প্রেম-প্রীতির সুন্দরতম জীবন ব্যবস্থা।

মানুষ হিসাবে সমান অধিকার সকলের। কিন্তু তাহলেও সমাজে সুশৃঙ্খলার জন্য নেতা ও মান্যব্যক্তির বিশেষ প্রয়োজন। নচেৎ স্বাই ‘মোড়ল’ হলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় থাকে না। নারী-পুরুষের ভূমিকা সমান হলেও নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্ব রয়েছে। নারী জাতিকে অপেক্ষাকৃত দুর্বলরূপে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর ঘোষণাঃ-

هُنَّ لِبَاسٌ لَّكُمْ وَأَنْتُمْ لِبَاسٌ لَّهُنَّ

অর্থাৎ, ‘‘তারা তোমাদের পোশাক এবং তোমরা তাদের পোশাক।’’[1]

﴿وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ وَلِلرِّجَالِ عَلَيْهِنَّ دَرَجَةٌ﴾

‘‘নারীদের তেমনি ন্যায়সংগত অধিকার আছে, যেমন আছে তাদের উপর পুরুষদের। কিন্তু নারীদের উপর পুরুষদের কিছু মর্যাদা আছে।’’[2]

﴿الرِّجَالُ قَوَّامُونَ عَلَى النِّسَاءِ بِمَا فَضَّلَ اللهُ بَعْضَهُمْ عَلَى بَعْضٍ وَبِمَا أَنْفَقُوا مِنْ أَمْوَالِهِمْ﴾

‘‘পুরুষ নারীর কর্তা। কারণ আল্লাহ তাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং এ শ্রেষ্ঠত্ব এজন্য যে, পুরুষ (তাদের জন্য) ধন ব্যয় করে থাকে।’’[3]

সুতরাং নারী পুরুষদের নেত্রী হতে পারে না। নেতার অর্ধাঙ্গিনী, রানী বা রাজমাতা হয়েই তো নারীর বিরাট গর্ব।

‘অতএব জাগো জাগো গো ভগিনী,

হও বীরজায়া বীর-প্রসবিনী।’

ইবাদতেও স্বামী স্ত্রীর ইমাম। স্বামী অশিক্ষিত এবং স্ত্রী পাকা হাফেয-কবারী হলেও ইমামতি স্বামীই করবে।[4]

পরন্তু স্ত্রী স্বামীর পশ্চাতে দাঁড়িয়ে (জামাআত করে) নামাজ পড়বে।[5]

স্বামীর উপর স্ত্রীর অনস্বীকার্য অধিকারঃ-

স্বামীর উপর স্ত্রীর বহু অধিকার আছে, যা পালন করা স্বামীর পক্ষে ওয়াজেব। সেই সমস্ত অধিকার নিম্নরূপঃ-

১- আর্থিক অধিকারঃ-

- স্বামী বিবাহ-বন্ধনের সময় বা পূর্বে যে মোহর স্ত্রীকে প্রদান করবে বলে অঙ্গীকার করেছে তা পূর্ণভাবে আদায় করা এবং তা হতে স্ত্রীকে বঞ্চিতা করার জন্য কোন প্রকার টাল-বাহানা না করা। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿فَآتُوهُنَّ أُجُورَهُنَّ فَرِيضَةً﴾

‘‘সুতরাং তাদেরকে তাদের ফরয মোহর অর্পণ কর।’’[6]

- আর্থিক অবস্থানুযায়ী স্ত্রীর ভরণ-পোষণ করা। নিজে যা খাবে তাকে খাওয়াবে এবং যা পরিধান করবে ঠিক সেই সমমানের লেবাস তাকেও পরিধান করাবে।[7]

অবশ্য নেকীর নিয়তে এই ব্যয়িত অর্থ স্বামীর জন্য সদকার সমতুল্য হবে।[8]

অন্যান্য সকল ব্যয়ের চেয়ে স্ত্রীর পশ্চাতে ব্যয়ের নেকীই অধিক।[9]

এমন কি তাকে এক গ্লাস পানি পান করালেও তাতে নেকী লাভ হয় স্বামীর।[10]

২- ব্যবহারিক অধিকারঃ-

- স্ত্রীর সাথে সদ্ভাবে বাস করা ওয়াজেব। দুই-একটি গুণ অপছন্দ হলেও সদাচার ও সদ্ব্যবহার বন্ধ করা মোটেই উচিৎ নয়। মহান আল্লাহ বলেন,

﴿وَعَاشِرُوهُنَّ بِالْمَعْرُوفِ فَإِنْ كَرِهْتُمُوهُنَّ فَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئاً وَيَجْعَلَ اللهُ فِيهِ خَيْراً كَثِيراً﴾

‘‘আর তাদের সাথে সদ্ভাবে জীবন-যাপন কর। তোমরা যদি তাদেরকে ঘৃণা কর, তবে এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা ঘৃণা করছ, আল্লাহ তার মধ্যেই প্রভূত কল্যাণ নিহিত রেখেছেন।’’[11]

সুতরাং সদ্ভাব ফুটিয়ে তুলতে স্বামী সর্বদা নিজের প্রেমকে স্ত্রীর মনের সিংহাসনে আসীন করে রাখবে। তাকে সুন্দর প্রেমময় নামে ডাকবে, সে যা চায় তাই তাকে সাধ্যমত প্রদান করবে। হৃদয়ের বিনিময়ে হৃদয় এবং শক্তি নয় বরং ভক্তি দ্বারাই সাথীর মন জয় করা কর্তব্য।

স্ত্রীর মন পেতে হলে আগে প্রেম দিতে হবে। ‘একটি পাখীকে ধরতে হলে তাকে ভয় দেখানো চলে না। তাকে আদর ক’রে, ভালোবাসা দিয়ে কাছে আনতে হয়। অতঃপর একদিন সে আপনিই পোষ মেনে নেয়। কারণ, স্নেহ ও ভালোবাসা বড়ই পবিত্র জিনিস।’

স্ত্রীর নিকট তার মাতৃলয়ের প্রশংসা করবে। সময় মত তাকে সেখানে নিয়ে যাবে বা যেতে-আসতে দেবে।

কোন কারণে স্ত্রী রেগে গেলে ধৈর্য ধরবে। মুর্খামি করলে সহ্য করে নেবে। যেহেতু পুরুষ অপেক্ষা নারীর আবেগ ও প্রতিক্রিয়া-প্রবণতা অধিক এবং পুরুষের চেয়ে নারীর ধৈর্য বহুলাংশে কম। সুতরাং দয়া করেই হোক অথবা ভালোবাসার খাতিরেই হোক তার ভুল ক্ষমা করবে। ‘যত ভুল হবে ফুল ভালোবাসাতে।’ তার ছোটখাট ত্রুটির প্রতি ভ্রূক্ষেপ করবে না। অনিচ্ছাকৃত ভুলের উপর তাকে চোখ রাঙাবে না। অন্যায় করলে অবশ্য শাসন করার অধিকার তার আছে। তবে-

‘শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে,

ত্রুটির উপর প্রীতির সাথে সহন ধরে সে।’

তাছাড়া ভুল হওয়া মানুষের প্রকৃতিগত সবভাব। ভুল-ত্রুটি দিয়ে সকলেরই জীবন গড়া। কিন্তু সেই ভুলকে প্রাধান্য দিয়ে বাকী জীবনে অশান্তি ডেকে আনার কোন যুক্তি নেই।

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,

اسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ فَإِنَّ الْمَرْأَةَ خُلِقَتْ مِنْ ضِلَعٍ وَإِنَّ أَعْوَجَ شَيْءٍ فِي الضِّلَعِ أَعْلَاهُ فَإِنْ ذَهَبْتَ تُقِيمُهُ كَسَرْتَهُ وَإِنْ تَرَكْتَهُ لَمْ يَزَلْ أَعْوَجَ فَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ.

‘‘তোমরা নারীদের জন্য হিতাকাঙক্ষী হও। কারণ, নারী জাতি বঙ্কিম পঞ্জরাস্থি হতে সৃষ্ট। আর তার উপরের অংশ বেশী বঙ্কিম (সুতরাং তাদের প্রকৃতিই বঙ্কিম ও টেরা।) অতএব তুমি সোজা করতে গেলে হয়তো তা ভেঙ্গেই ফেলবে। আর নিজের অবস্থায় উপেক্ষা করলে বাঁকা থেকেই যাবে। অতএব তাদের জন্য মঙ্গলকামী হও।’’[12]

সুতরাং স্ত্রীর নিকট থেকে যত বড় আদর্শের ব্যবহারই আশা করা যাক না কেন, তার মধ্যে কিছু না কিছু টেরামি থাকবেই। সম্পূর্ণভাবে স্বামীর মনে অঙ্কিত সরল পথে সে চলতে চাইবে না। সোজা করে চালাতে গেলে হাড় ভাঙ্গার মত ভেঙ্গে যাবে; অর্থাৎ মন ভেঙ্গে দাম্পত্য ভেঙে (তালাক হয়ে) যাবে।[13]

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,

لاَ يَفْرَكْ مُؤْمِنٌ مُؤْمِنَةً إِنْ كَرِهَ مِنْهَا خُلُقًا رَضِىَ مِنْهَا آخَرَ.

‘‘কোন মু’মিন পুরুষ যেন কোন মু’মিন স্ত্রীকে ঘৃণা না বাসে। কারণ সে তার একটা গুণ অপছন্দ করলেও অপর আর একটা গুণে মুগ্ধ হবে।’’[14]

সুতরাং পূর্ণিমার সুদর্শন চন্দ্রিমারও কলঙ্ক আছে। সুদর্শন সৌরভময় গোলাপের সাথেও কণ্টক আছে। গুণবতীর মধ্যেও কিছু ত্রুটি থেকে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়।

কথিত আছে যে, একদা এক ব্যক্তি তার ঠোঁটকাটা স্ত্রীর অভিযোগ নিয়ে হযরত উমারের নিকট উপস্থিত হয়ে বাড়ির দরজায় তাঁকে ডাক দিয়ে অপেক্ষা করতেই শুনতে পেল হযরত ওমরের স্ত্রীও তাঁর সাথে কথা-কাটাকাটি করছেন এবং তিনি নীরব থেকে যাচ্ছেন। লোকটি আর কোন কথা না বলে প্রস্থান করতে করতে মনে মনে বলতে লাগল, ‘আমীরুল মু’মিনীনের যদি এই অবস্থা হয় অথচ তিনি খলীফা, কত কড়া মানুষ, তাহলে আমার আর কি হতে পারে?’ হযরত উমার দরজায় এসে লোকটিকে যেতে দেখে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার প্রয়োজন না বলেই তুমি চলে যাচ্ছ কেন?’ লোকটি বলল, ‘যার জন্য এসেছিলাম তার জবাব আমি পেয়ে গেছি হুজুর! আমার স্ত্রী আমার সাথে লম্বা জিভে কথা বলে। তারই অভিযোগ নিয়ে আপনার কাছে এসেছিলাম। কিন্তু দেখছি আপনারও আমার মতই অবস্থা?’ উমার বললেন, ‘আমি সহ্য করে নিই ভাই! কারণ, আমার উপর তার অনেক অধিকার আছে; সে আমার খানা পাক করে, রুটি তৈরী করে, কাপড় ধুয়ে দেয়, আমার সন্তানকে স্তনদুগ্ধ পান করিয়ে লালন-পালন করে, আমার হৃদয়ে শান্তি আনে, ইত্যাদি। তাই একটু সহ্য করে নিই।’ লোকটি বলল, ‘আমীরুল মু’মিনীন! আমার স্ত্রীও তো অনুরূপ।’ উমার বললেন, ‘তবে সহ্য করে নাও গে ভাই! সে তো সামান্যক্ষণই রাগান্বিতা থাকে।’

সুতরাং সুন্দর সৌরভময় গোলাপ তুলে তার সুঘ্রাণ নিতে হলে দু-একটা কাঁটা হাতে-গায়ে ফুঁড়বে বৈ কি? কাঁটার জন্য কেউ কি প্রস্ফুটিত গোলাপকে ঘৃণা করে? নারী গোলাপের মত সুন্দর ও কোমল বলেই কাঁটার ন্যায় কথা দ্বারা নিজেকে রক্ষা করতে চায়।[15]

পক্ষান্তরে রাগের মাথায় একজন পুরুষকে ক্ষান্ত করতে হলে তার বিবেক-বুদ্ধির খেই ধরে, একজন নারীকে ক্ষান্ত করতে হলে তার হৃদয় ও আবেগের খেই ধরে এবং সমাজকে ক্ষান্ত করতে হলে তার প্রকৃতিকে জাগ্রত করে সফল হওয়া যায়। তাছাড়া ‘স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে কোন লাভও নেই; আঘাত করলেও কষ্ট, আর আঘাত পেলেও কষ্ট।’

স্ত্রী কোন ভাল কথা বললে উপেক্ষার কানে না শুনে খেয়ালের সাথে শোনা, কোন উত্তম রায়-পরামর্শ দিলে তা সাদরে গ্রহণ করাও সদ্ভাবে বাস করার শামিল।

যেমন, তার সাথে হাসি-তামাসা করা, সব সময় পৌরুষ মেজাজ না রেখে কোন কোন সময় তার সাথে বৈধ খেলা করা, শরীরচর্চা বা ব্যায়ামাদি করা ইত্যাদিও স্বামীর কর্তব্য। প্রিয় নবী (ﷺ) স্ত্রী আয়েশার সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করে একবার হেরেছিলেন ও পরে আর একবারে তিনি জিতেছিলেন।[16]

তদনুরূপ স্ত্রীকে কোন বৈধ খেলা দেখতে সুযোগ দেওয়াও দূষণীয় নয়।[17] তবে এসব কিছু হবে একান্ত নির্জনে, পর্দা-সীমার ভিতরে।

স্ত্রী ভালো খাবার তৈরী করলে, সাজগোজ করলে বা কোন ভালো কাজ করলে তার প্রশংসা করবে স্বামী। এমনকি স্ত্রীর হৃদয়কে লুটে নেওয়ার জন্য ইসলাম মিথ্যা বলাকেও বৈধ করেছে।[18] তবে যে মিথ্যা তার অধিকার হরণ করে ও তাকে ধোঁকা দেয়, সে মিথ্যা নয়।

সদ্ভাবে বাস করতে চাইলে স্বামী স্ত্রীর গৃহস্থালি কর্মেও সহায়তা করবে। এতে স্ত্রীর মন স্বামীর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেমে আরো পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রিয় নবী (ﷺ); যিনি দুজাহানের বাদশাহ তিনিও সংসারের কাজ করতেন। স্ত্রীদের সহায়তা করতেন, অতঃপর নামাযের সময় হলেই মসজিদের দিকে রওনা হতেন।[19]

তিনি অন্যান্য মানুষের মত একজন মানুষ ছিলেন; সবহস্তে কাপড় পরিষ্কার করতেন, দুধ দোয়াতেন এবং নিজের খিদমত নিজেই করতেন।[20]

স্বামী যেমন স্ত্রীকে সুন্দরী দেখতে পছন্দ করে তেমনি স্ত্রীও স্বামীকে সুন্দর ও সুসজ্জিত দেখতে ভালোবাসে। এটাই হল মানুষের প্রকৃতি। সুতরাং স্বামীরও উচিৎ, স্ত্রীকে খোশ করার জন্য সাজগোজ করা। যাতে তারও নজর অন্য পুরুষের ( স্বামীর কোন পরিচ্ছন্ন আত্মীয়ের) প্রতি আকৃষ্ট না হয়। ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘আমি আমার স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা করি, যেমন সে আমার জন্য সাজসজ্জা করে।’ আর আল্লাহ তাআ’লা বলেন,

﴿وَلَهُنَّ مِثْلُ الَّذِي عَلَيْهِنَّ بِالْمَعْرُوفِ﴾

‘‘নারীদের তেমনি ন্যায়সঙ্গত অধিকার আছে, যেমন তাদের উপর আছে পুরুষদের--।’’[21]

বলাই বাহুল্য যে, এই অবহেলার ফলেই বহু আধুনিকা স্বামী ত্যাগ করে অথবা অন্যাসক্তা হয়ে পড়ে।

খলীফা উমার <-এর নিকট একটি লোক উষ্কখুষ্ক ও লেলাখেপা বেশে উপস্থিত হল। সঙ্গে ছিল তার স্ত্রী। স্বামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তার নিকট থেকে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থনা করল। দূরদর্শী খলীফা সব কিছু বুঝতে পারলেন। তিনি তার স্বামীকে পরিচ্ছন্নতা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর সে তার চুল, নখ ইত্যাদি কেটে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে ফিরে এলে তিনি তাকে তার স্ত্রীর নিকট যেতে আদেশ করলেন। স্ত্রী পরপুরুষ ভেবে তাকে দেখে সরে যাচ্ছিল। পরক্ষণে তাকে চিনতে পেরে তালাকের আবেদন প্রত্যাহার করে নিল!

এ ঘটনার পর খলীফা উমার < বললেন, ‘তোমরা তোমাদের স্ত্রীর জন্য সাজসজ্জা কর। আল্লাহর কসম! তোমরা যেমন তোমাদের স্ত্রীগণের সাজসজ্জা পছন্দ কর; অনুরূপ তারাও তোমাদের সাজসজ্জা পছন্দ করে।[22]

স্ত্রীর এঁটো খাওয়া অনেক স্বামীর নিকট অপছন্দনীয়। কিন্তু শরীয়তে তা স্বীকৃত। রসূল (ﷺ) পান-পাত্রের ঠিক সেই স্থানে মুখ রেখে পানি পান করতেন, যে স্থানে হযরত আয়েশা (রাঃ) মুখ লাগিয়ে পূর্বে পান করতেন। যে হাড় থেকে হযরত আয়েশা গোশ্ত ছাড়িয়ে খেতেন, সেই হাড় নিয়েই ঠিক সেই জায়গাতেই মুখ রেখে আল্লাহর নবী (ﷺ) গোশ্ত ছাড়িয়ে খেতেন।[23]

তাছাড়া স্ত্রীর রসনা ও ওষ্ঠাধর চোষণের ইঙ্গিতও শরীয়তে বর্তমান।[24]

এমন প্রেমের প্রতিমার এঁটো এবং চুম্বন তারাই খেতে চায়না, যারা একান্ত প্রেমহীন নীরস পুরুষ অথবা যাদের স্ত্রী অপরিচ্ছন্ন ও নোংরা থাকে তারা অথবা যাদের নিকট কেবল লৈঙ্গিক যৌনসম্ভোগই মূল তৃপ্তি।

স্ত্রীকে বিভিন্ন উপলক্ষে (যেমন ঈদ, কুরবানী প্রভৃতিতে) ছোটখাট উপহার দেওয়াও সদ্ভাবে বাস করার পর্যায়ভুক্ত। এতেও স্ত্রীর হৃদয় চিরবন্দী হয় স্বামীর হৃদয় জেলে।

মোট কথা স্ত্রীর সাথে বাস তো প্রেমিকার সাথে বাস। সর্বতোভাবে তাকে খোশ রাখা মানুষের প্রকৃতিগত সবভাব। প্রেমিককে কষ্ট দেওয়া কোন মুসলিম, কোন মানুষের, বরং কোন পশুরও কাজ নয়।

প্রিয় নবী (ﷺ) বলেন,

خَيْرُكُمْ خَيْرُكُمْ لأَهْلِهِ وَأَنَا خَيْرُكُمْ لأَهْلِى.

‘‘তোমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তি সেই, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম। আর আমি নিজ স্ত্রীর নিকট তোমাদের সর্বোত্তম ব্যক্তি।’’[25]

أَكْمَلُ الْمُؤْمِنِينَ إِيمَانًا أَحْسَنُهُمْ خُلُقًا وَخِيَارُهُمْ خِيَارُهُمْ لِنِسَائِهِمْ.

‘‘সবার চেয়ে পূর্ণ ঈমানদার ব্যক্তি সে, যার চরিত্র স্বার চেয়ে সুন্দর এবং ওদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উত্তম ব্যক্তি সেই, যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।’’(আহমদ)

وَاسْتَوْصُوا بِالنِّسَاءِ خَيْرًا فَإِنَّمَا هُنَّ عَوَانٍ عِنْدَكُمْ.

‘‘সাবধান! তোমরা নারী (স্ত্রী)দের জন্য মঙ্গলকামী হও। যেহেতু তারা তো তোমাদের হাতে বন্দিনী।’’[26]

اتَّقُوا اللَّهَ فِى النِّسَاءِ فَإِنَّكُمْ أَخَذْتُمُوهُنَّ بِأَمَانَةِ اللَّهِ وَاسْتَحْلَلْتُمْ فُرُوجَهُنَّ بِكَلِمَةِ اللَّهِ.

‘‘তাদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। যেহেতু তাদেরকে তোমরা আল্লাহর অঙ্গীকারে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বরণ করেছ এবং আল্লাহর বাণীর মাধ্যমে তাদের লজ্জাস্থান হালাল করে নিয়েছ।’’[27]

অবশ্যই স্ত্রীর যথার্থ মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করার নাম ‘আঁচল ধরা’ বা ‘বউ পাগলামি’ নয়।

- স্বামীর উপর স্ত্রীর অন্যতম অধিকার এই যে, বিপদ আপদ থেকে স্বামী তাকে রক্ষা করবে। স্ত্রীকে রক্ষা করতে গিয়ে যদি স্বামী শত্রুর হাতে মারা পরে, তবে সে শহীদের দর্জা পায়।[28]

অনুরূপ স্ত্রীকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা করাও তার এক বড় দায়িত্ব। তাকে দ্বীন, আকীদা, পবিত্রতা, ইবাদত, হারাম, হালাল, অধিকার ও ব্যবহার প্রভৃতি শিক্ষা দিয়ে সৎকাজ করতে আদেশ ও অসৎকাজে বাধা দিয়ে আল্লাহর আযাব থেকে রেহাই দেবে।

মহান আল্লাহ বলেন,

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قُوا أَنْفُسَكُمْ وَأَهْلِيكُمْ نَاراً وَقُودُهَا النَّاسُ وَالْحِجَارَةُ﴾

‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা নিজেদেরকে এবং নিজ পরিবারকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও; যার ইন্ধন মানুষ ও পাথর --।’’[29]

- স্ত্রীর ধর্ম, দেহ, যৌবন ও মর্যাদায় ঈর্ষাবান হওয়া এবং এ সবে কোন প্রকার কলঙ্ক লাগতে না দেওয়া স্বামীর উপর তার এক অধিকার। সুতরাং স্ত্রী এক উত্তম সংরক্ষণীয় ও হিফাজতের জিনিস। লোকের মুখে-মুখে, পরপুরুষদের চোখে-চোখে ও যুবকদের মনে-মনে বিচরণ করতে না দেওয়া; যাকে দেখা দেওয়া তার স্ত্রীর পক্ষে হারাম তাকে সাধারণ অনুমতি দিয়ে বাড়ি আসতে-যেতে না দেওয়া সুপুরুষের কর্ম।

আর এর নাম রক্ষণশীলতা বা গোঁড়ামী নয়। বরং এটা হল সুপুরুষের রুচিশীলতা ও পবিত্রতা। নারী-স্বাধীনতার নামে যারা এই বল্গাহীনতা ও নগ্নতাকে ‘প্রগতি’ মনে ক’রে আল্লাহ-ভক্তদের ‘গোঁড়া’ বলে থাকে, শরীয়ত তাদেরকেই ‘ভেঁড়া’ বলে আখ্যায়ন করে। আর ‘ভেঁড়া’ বা স্ত্রী-কন্যার ব্যাপারে ঈর্ষাহীন পুরুষ জান্নাতে যাবে না।[30]

নিজের ইচ্ছামত এ ঘর-ও ঘর, এ পাড়া-ও পাড়া, এ মার্কেট সে মার্কেট যেতে স্বামী তার স্ত্রীকে বাধা দেবে। কোন প্রকার নোংরামী, অশ্লীলতা, গান-বাজনা, সিনেমা-থিয়েটারে নিজে যাবে না, স্ত্রীকেও যেতে দেবে না। নোংরা টেলিভিশন ও ভিডিও বাড়িতে রাখবে না। রেডিওতে গান-বাজনা শুনতে দেবে না। পর্যাপ্ত কারণ বিনা এবং আপোসের চুক্তি ও সম্মতি ছাড়া চার মাসের অধিক স্ত্রী ছেড়ে বাইরে থাকবে না। যেহেতু পুরুষের যৌনপ্রবৃত্তি যেমন, ঠিক তেমনি নারীরও। পুরুষের যেমন নারীদেহ সংসর্গলাভে পরমতৃপ্তি, অনুরূপ নারীও পুরুষের সংসর্গ পেয়ে চরম তৃপ্তি উপভোগ করে থাকে। অতএব প্রেমে অনাবিলতা বজায় রাখতে নারীকে হিফাযত করা পুরুষের জন্য ফরয এবং তা এক সুরুচিপূর্ণ কর্ম। পানি বা শরবতে সামান্য একটা পোকা বা মাছি পড়লে তা পান করতে কারো রুচি হয় না; আর নিজ স্ত্রীর সৌন্দর্য ও প্রেমে অপরের কাম বা কুদৃষ্টি, মন্তব্যের মুখ ও কামনার মন পড়লে তাতে কি করে রুচি হয় সুপুরুষের? সুতরাং যে পুরুষের অনুরূপ সুরুচি নেই সে কাপুরুষ বৈ কি?

হিজরী ২৮৬ সনে ‘রাই’এর কাযীর নিকট এক মহিলা মুকাদ্দামা দায়ের করল। তার অভিভাবকের সাথে মিলে স্বামীর বিরুদ্ধে সে তার মোহরানা বাবদ ৫০০ দিরহাম আদায় না দেওয়ার অভিযোগ করল। কাযী সাক্ষী তলব করলে সাক্ষী উপস্থিত করা হল। কিন্তু সাক্ষিদাতারা মহিলাটিকে চেনার জন্য তার চেহারা দেখাতে অনুরোধ জানালো। এ খবর স্বামীর কানে গেলে কাযীর সামনে বলল, ‘আমি স্বীকার করছি যে, ৫০০ দিরহাম আমার স্ত্রীর পাওনা। আমি যথাসময়ে তাকে তা আদায় করে দেব। সাক্ষীর দরকার নেই। ও যেন চেহারা না খোলে!’

এ খবর স্ত্রীর নিকট গেলে সেও আল্লাহ অতঃপর কাযীকে সাক্ষী রেখে বলল, ‘আমিও আমার স্বামীর নিকট থেকে প্রাপ্য উক্ত মোহরানার দাবী প্রত্যাহার করে নিচ্ছি এবং দুনিয়া ও আখেরাতের জন্য ওকে ক্ষমা করে দিচ্ছি!’

এ শুধু এ জন্য যে, পর্দার মান ও মূল্য আছে নারীর কাছে, আর স্বামীর আছে যথাযথ ঈর্ষা। তাই চেহারা খুলে বেআবরু করতে সকলেই নারাজ। এটাই তো সুরুচিপূর্ণ মুসলিম দম্পতির পরিচয়।

একটি সত্য কথা এই যে, মহিলা ঈর্ষাবান পুরুষকে অপছন্দ করে। কিন্তু যে তার ব্যাপারে ঈর্ষাবান নয়, তাকে সে আরো বেশী অপছন্দ করে।

স্ত্রীকে খামাখা সন্দেহ করাও স্বামীর উচিৎ নয়। বৈধ কর্মে, চিকিৎসার জন্য বা অন্যান্য জরুরী কাজের জন্য পর্দার সাথে যেতে না দিয়ে তাকে অর্গলবদ্ধ করে রাখাই হল অতিরঞ্জন ও গোঁড়ামী। তাছাড়া এমন অবরোধ প্রথায় ইসলামের কোন সমর্থন নেই।

পক্ষান্তরে স্ত্রীকে সন্দেহ করলে দাম্পত্য জীবন তিক্ত হয়ে উঠে। কারণ দাম্পত্য সুখের জন্য জরুরী; স্বামী-স্ত্রীর উভয়ের আমানতদারী, হিতৈষিতা, সত্যবাদিতা, অন্তরঙ্গতা, অনাবিল প্রেম, বিশ্বস্ততা, নম্রতা, সুস্মিত ব্যবহার ও বাক্যালাপ, একে অপরের গুণ স্বীকার। আর সন্দেহ এসব কিছুকে ধবংস করে ফেলে। কারণ সন্দেহ এমন জিনিস যার সূক্ষমতম শিকড় একবার মনের মাটিতে সঞ্চালিত হয়ে গেলে তাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না টেনে-ছিঁড়ে ফেলা হয়, ততক্ষণ সে প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করতে থাকে এবং সম্প্রীতি ও সুখের কথা ভাবতেই দেয় না।

এই সন্দেহের ফলশ্রুতিতেই বহু হতভাগা স্বামী তাদের স্ত্রীদেরকে ভাতের চাল পর্যন্ত তালাবদ্ধ রেখে রান্নার সময় মেপে রাঁধতে দেয়! বলাই বাহুল্য যে, কথায় কথায় এবং কাজে কাজে স্ত্রীকে সন্দেহ করলে সে স্বামীর সংসার নিশ্চয় এক প্রকার জাহান্নাম।

পরিশেষে, মহান আল্লাহর এই বাণী প্রত্যেক স্বামীর মনে রাখা উচিৎ; তিনি বলেন,

[يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ مِنْ أَزْوَاجِكُمْ وَأَوْلادِكُمْ عَدُوّاً لَكُمْ فَاحْذَرُوهُمْ وَإِنْ تَعْفُوا وَتَصْفَحُوا وَتَغْفِرُوا فَإِنَّ اللهَ غَفُورٌ رَحِيمٌ]

‘‘হে মুমিনগণ! নিশ্চয় তোমাদের স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের (পার্থিব ও পারলৌকিক বিষয়ের) শত্রু। অতএব তাদের ব্যাপারে তোমরা সতর্ক থেকো। অবশ্য (দ্বীনী বিষয়ে অন্যায় থেকে তওবা করলে ও পার্থিব বিষয়ক অন্যায়ে) তোমরা যদি ওদেরকে মার্জনা কর, ওদের দোষ-ত্রুটি উপেক্ষা কর এবং ওদেরকে ক্ষমা করে দাও তাহলে জেনে রাখ যে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’’[31]

[1] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ১৮৭)

[2] (সূরা আল-বাক্বারা (২) : ২২৮)

[3] (সূরা আন-নিসা (৪) : ৩৪)

[4] (মাজাল্লাতুল বহুসিল ইসলামিয়্যাহ ১/৩৮২)

[5] (জামিউ আহকামিন নিসা, ১/৪১৬)

[6] (সূরা আন-নিসা (৪) : ২৪)

[7] (আবু দাঊদ, তিরমিযী, ইনাঃ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৪৭পৃঃ)

[8] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ১৯৩০নং)

[9] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ১৯৩১নং)

[10] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ২৭৩৬নং, ইরওয়াউল গালীল ৮৯৯ নং)

[11] (সূরা আন-নিসা (৪) : ১৯)

[12] (বুখারী, মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৩৮নং)

[13] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৩৯নং)

[14] (মুসলিম, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩২৪০নং)

[15] (হুক্বূক্বুল মারআতিল মুসলিমাহ, কওসর আল-মীনাবী ৫২ পৃঃ)

[16] (মুসনাদে আহমদ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৫০পৃঃ)

[17] (বুখারী, নাসাঈ, আদাবুয যিফাফ ২৭৫পৃঃ)

[18] (বুখারী, মুসলিম, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৫৪৫নং)

[19] (বুখারী, তিরমিযী, আদাবুয যিফাফ ২৯০পৃঃ)

[20] (আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬৭০নং, আদাবুয যিফাফ ২৯১পৃঃ)

[21] (সূরা আল-বাক্বারাহ (২) : ২২৮)

[22] (তুহফাতুল আরূস, ১০৩-১০৪পৃঃ)

[23] (মুসলিম, মুসনাদে আহমদ, প্রভৃতি, আদাবুয যিফাফ ২৭৭পৃঃ)

[24] (বুখারী ৫০৮০নং, আস-সিলসিলাতুস সহীহাহ ৬২৩নং)

[25] (ত্বাহাবী , হাকেম , দাঃ, আদাবুয যিফাফ ২৬৯পৃঃ)

[26] (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, আদাবুয যিফাফ ২৭০পৃঃ)

[27] (মুসলিম)

[28] (তিরমিযী, আবু দাঊদ, নাসাঈ, মিশকাতুল মাসাবীহ ৩৫২৯নং)

[29] (সূরা আত্তাহরীম (৬৬) : ৬)

[30] (নাসাঈ, দাঃ, আল মারআতুল মুসলিমাহ, ওয়াহ্বী সুলাইমান আল-আলবানী ১৫৫পৃঃ)

[31] (সূরা তাগাবুন (৬৪) : ১৪ আয়াত)