বিদআতের শাব্দিক অর্থ

দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার পর তাতে নতুন কিছু প্রবর্তিত হওয়া, অথবা রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ইনতিকালের পর দ্বীনের মধ্যে ইবাদতের নামে মনগড়া কিছু রসম-রেওয়াজ চালু করা। বিদআত শব্দের মূল ধাতু হল بدع এর অর্থ কোন উপমা ছাড়াই নতুন কিছু সৃষ্টি করা।[1]

 যেমন- কুরআনে এসেছে,  بَدِيْعُ السََّمَوتِ وَ اْلأَرْضِ

অর্থ : আসমান ও জমিন সৃষ্টিকারী।[2]

পারিভাষিক অর্থ

ওলামায়ে কেরাম বিদআতের বিভিন্ন সংজ্ঞা বর্ণনা করেছেন, যা একটি অপরটির পরিপূরক।

 ১. শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ দ্বীনের মধ্যে বিদআত হচ্ছে এমন আমল, যা আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ইসলামে প্রবর্তন করেননি এবং মুস্তাহাব বা ওয়াজিব হিসেবেও এর কোন অনুমোদন দেননি।[3]

বিদআত সাধারণত দু’ প্রকার

ক. কথা ও বিশ্বাসের মধ্যে বিদআত ও খ. ইবাদাত ও কাজের মধ্যে বিদআত।

এখানে প্রথম প্রকার দ্বিতীয় প্রকারের অন্তর্ভুক্ত। ইমাম আহমদ রহ. ও অন্যান্য আলিমগণ স্বীয় মাযহাবে ঘোষণা দিয়েছেন যে, স্বভাব ও ইবাদতের সমষ্টির নাম আমল।

ইবাদত হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর পক্ষ থেকে যা কিছু এসেছে সে অনুযায়ী বিনীত হয়ে আমল করা।

স্বভাবের মূল হচ্ছে আল্লাহ যা নিষিদ্ধ করেছেন একমাত্র তাই ক্ষতিকর মনে করা।[4]

আল্লামা ইবনে তাইমিয়া রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, ইবাদত এবং বিশ্বাসে কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে উম্মতের পরিপন্থী কাজ করা। যথা-খারেজী, রাফেজী, কাদরিয়া ও জাহমিয়াদের কার্যক্রম অথবা যারা মসজিদে জিকির আজকারের নামে নাচ-গানের অনুষ্ঠান করে তাদের অনুকরণ করা অথবা কুরআন ও হাদীস বিরোধী জীবন-যাপন করা।[5]

২. আল্লামা শাতবী রহ. বলেনঃ বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে নব আবিস্কৃত বিষয়াবলী যা ইবাদতের সাদৃশ কিন্তু প্রকৃত পক্ষে তা ইবাদত নয়। এর দ্বারা আল্লাহর  ইবাদত বেশি পরিমাণে করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে।[6]

যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত মনে করে না এ সংজ্ঞা তাদের মতামত অনুযায়ী । তারা শুধুমাত্র শরীয়ত বহির্ভূত কাজকেই ইবাদত হিসেবে পালন করাকে বিদআত বলে। যারা স্বভাবগত কাজকে বিদআতের অন্তর্ভুক্ত করে; তারা বলেনঃ বিদআত হল, দ্বীনের মাঝে নব আবিস্কৃত বিষয় যা শরীয়তের কার্যক্রমের সাদৃশ এবং বিদআতি কার্যকলাপকে সাওয়াবের কাজ মনে করা।[7]

অতঃপর তিনি আরও একটি সংজ্ঞা বর্ণনা করেনঃ স্বভাবগত কাজকে অভ্যাস হিসেবে আমল করলে তা বিদআত হবে না কিন্তু তা যদি ইবাদত হিসেবে করা হয় কিংবা ইবাদত হিসেবে নামকরণ করা হয় তাহলে বিদআত হবে। এখানে তিনি দু’টি সংজ্ঞাকে একত্রে এনেছেন। স্বভাবগত বিষয় যা করা ইবাদত। যেমন, ক্রয়-বিক্রয়, বিবাহ-তালাক ও ভাড়া দেয়া ইত্যাদি। কেননা এগুলোতে কিছু শর্ত ও নিয়মাবলী রয়েছে যে সম্পর্কে মানুষকে কোন স্বাধীনতা দেয়া হয়নি।[8]

৩. হাফেয ইবনে রজব রহ. বলেন : বিদআত হচ্ছে, দ্বীনের মধ্যে এমন কিছু বিষয় প্রচলন করা শরীয়তে যার কোন ভিত্তি নেই। শরীয়তে যার ভিত্তি আছে তা বিদআত হবে না।[9]

এমন প্রত্যেক বস্তু যা দ্বীনের অংশ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হয় অথচ ইসলামে এর কোন ভিত্তি নেই, তা স্পষ্ট ভ্রষ্টতা। দ্বীন ইসলাম এ সকল ভ্রষ্টতা থেকে সম্পূর্ণ পবিত্র। চাই সেটা বিশ্বাসগত হোক বা বক্তব্যধর্মী অথবা কর্মমূলক। মোট কথা দ্বীন নব আবিস্কৃত বিদআত থেকে মুক্ত ও পবিত্র।

সালফে সালেহীনের উক্তি মতে কতিপয় নব আবিস্কৃত বিষয়কে উত্তম বলা হয়েছে। এর দ্বারা আভিধানিক বিদআত বুঝানো হয়েছে, শরীয়তে নিষিদ্ধ বিদআত বুঝানো হয়নি।

যেমন- ক. উমর (রা) এর যুগে যখন রমযান মাসে লোকজন মসজিদে একজন ইমামের পিছনে তারাবীহর সালাত পড়ার জন্য একত্রিত হল, তখন তিনি বের হলেন এবং লোকজনকে এ অবস্থায় দেখে বললেন, এটা কতই না উৎকৃষ্ট বিদআত![10]

উমর (রা) এর এ কথার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ইতিপূর্বে এ ধরণের কাজ আর কখনো সংঘটিত হয়নি, অথচ এটা শরীয়তের অন্তর্ভুক্ত।

 খ. রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রমযান মাসে কিয়ামুল-লাইলের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। তাঁর জীবদ্দশায় লোকজন মসজিদে এসে কেউ জামাতে, কেউ একা কিয়ামুল লাইল তথা নফল সালাত আদায় করতেন। রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ও সাহাবীদের নিয়ে মাঝে মাঝে জামাতে সালাত আদায় করতেন। তিনি ভবিষ্যত উম্মতের অক্ষমতার বিষয় ও পরে তা ফরজ করে দেয়ার আশংকায় তা আদায় করতে নিষেধ করেছিলেন।[11]    

গ. অনুরূপ রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) উম্মতকে খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাতের অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আর কিয়ামুল লাইল খোলাফায়ে রাশেদার সুন্নাত।[12]

বিদআত সাধারণত দু‘ধরণের :

১। কুফরী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে।

২। ফাসেকী : যার মাধ্যমে উক্ত বিদআতপন্থী ইসলাম থেকে বের হবে না কিন্তু গুনাহগার হবে।[13]

[1] আল-ইতিসাম - শাতেবী (র) : ১/৪৯
[2] আনআমঃ ১০১
[3] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ৪/১০৭
[4] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া :৪/১৯৬
[5] ফতোয়া ইবনে তাইমিয়া : ১৮/৩৪৬
[6] আল-ইতিসাম - শাতেবী (র) : ১/৫৩
[7] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ১/৫০-৫৬
[8] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) :২/৫৬৮
[9] জামিউল উলুম ওয়াল হিকাম : ২/১২৭
[10] বুখারী : ২০১০
[11] বুখারী : ২০১২
[12] জামেউল উলূম ওয়াল হিকাম : ২/১২৯
[13] আল-ইতিসাম, লেখক শাতেবী (র) : ২/৫১৬