শির্ক কী ও কেন? চতুর্থ পরিচ্ছেদ ড. মুহাম্মদ মুয্‌যাম্মিল আলী
আল্লাহই সকল কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক

আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক কর্ম সম্পাদিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় বৈধ কাজকর্ম করা হচ্ছে শরী‘আতের নির্দেশ। যে ব্যক্তি তা গ্রহণ করে আল্লাহর উপর ভরসা করলো এবং এর সাথে সাথে আল্লাহর রহমত ও দয়া কামনা করলো, আল্লাহ সে ব্যক্তির কামনা কখনও দ্রুত পূর্ণ করেন, কখনও সে ব্যক্তির ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তা পূর্ণ করতে বিলম্ব করেন। যাকে ইচ্ছা দ্রুত রোগ থেকে আরোগ্য দান করেন, যাকে ইচ্ছা দ্রুত সন্তান দেন, যাকে ইচ্ছা তা দিতে বিলম্ব করেন।

এ ক্ষেত্রে নবী, রাসূল আর সৎ ও অসৎ বলে কোনো পার্থক্য নেই। এইতো নবীবর আইউব এর বিষয়ই লক্ষ্য করা যায়। তিনি দীর্ঘ দিন যাবৎ মহামারীতে আক্রান্ত ছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর ঈমান ও ধৈর্যের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁর রোগ মুক্তিতে বিলম্ব করেন। অবশেষে তাঁকে যে অনিষ্টতা পেয়ে বসেছে সে অনিষ্টের কথা আল্লাহকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে এর ওসীলায় তাঁর রহমতের প্রত্যাশী হয়ে সে রোগ থেকে আরোগ্য লাভের জন্য এ মর্মে দো‘আ করেন :

﴿ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ٨٣ ﴾ [الانبياء: ٨٣]

‘‘আমাকে অনিষ্টতা পেয়ে বসেছে, অথচ তুমি দয়ার সাগর’’।[1]

এই দো‘আ করার পর আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মনস্কামনা পূর্ণ করেন। ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর অবস্থা দেখুন, জীবনের শেষ প্রহরে পৌঁছার পরও তাঁর কোনো সন্তান হচ্ছিল না। দেখতে দেখতে তাঁর স্ত্রীও বৃদ্ধা এবং বন্ধা হয়ে গেছেন। দীর্ঘ পরীক্ষা গ্রহণের পর যখন আল্লাহ তাঁদেরকে সন্তান প্রদানের সংবাদ দিলেন, তখন তাঁর স্ত্রী হতবাক হয়ে বলেন :

﴿ءَأَلِدُ وَأَنَا۠ عَجُوزٞ وَهَٰذَا بَعۡلِي شَيۡخًاۖ إِنَّ هَٰذَا لَشَيۡءٌ عَجِيبٞ ٧٢ ﴾ [هود: ٧٢]

‘‘আমি সন্তান প্রসব করবো অথচ আমি একজন বৃদ্ধা ও বন্ধা এবং আমার স্বামী একজন বৃদ্ধ মানুষ ! নিশ্চয় এ ঘটনাটি একটি অদ্ভূত ব্যাপার।’’[2]

অনুরূপভাবে নবীবর যাকারিয়া আলাইহিস সালাম-এর বিষয়টিও লক্ষ্য করা যায়। তিনিও সন্তান প্রাপ্তির আশায় থাকতে থাকতে বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। পরিশেষে আল্লাহর কাছে এই বলে দো‘আ করেন :

﴿رَبِّ إِنِّي وَهَنَ ٱلۡعَظۡمُ مِنِّي وَٱشۡتَعَلَ ٱلرَّأۡسُ شَيۡبٗا وَلَمۡ أَكُنۢ بِدُعَآئِكَ رَبِّ شَقِيّٗا ٤ وَإِنِّي خِفۡتُ ٱلۡمَوَٰلِيَ مِن وَرَآءِي وَكَانَتِ ٱمۡرَأَتِي عَاقِرٗا فَهَبۡ لِي مِن لَّدُنكَ وَلِيّٗا ٥ يَرِثُنِي وَيَرِثُ مِنۡ ءَالِ يَعۡقُوبَۖ ﴾ [مريم: ٤، ٦]

‘‘হে আমার পালনকর্তা! আমার অস্থি বয়স-ভারাবনত হয়েছে, বার্ধ্যক্যের ফলে মাথার চুল শুভ্র হয়ে গেছে, প্রভু হে! তোমাকে আহ্বান করে আমি তো কখনও হতভাগা হইনি। আমার পর আমার স্বগোত্রের লোকদের (অবস্থা) নিয়ে আমি আতঙ্কিত আছি, আমার স্ত্রী বন্ধা হয়ে গেছে, কাজেই আপনি আপনার পক্ষ থেকে আমাকে এমন একজন কর্তব্য পালনকারী দান করুন, যে আমার ও ইয়া‘কুবের উত্তরাধিকারী হবে।’’[3]

এবার লক্ষ্য করে দেখুন : রোগ মুক্তি আর সন্তান দান যদি ওলি ও দরবেশগণের আয়ত্বে বা সামর্থ্যের মধ্যে থাকতো, তা হলে নবীগণ আল্লাহর বড় ওলি হওয়ার সুবাদে অন্যান্যদের চেয়ে অধিক সুবিধাভোগ করতেন। তাঁদের কোনো রোগই হতো না, বা হলেও তা দ্রুত আরোগ্য করে নিতেন। সন্তানাদি যথা সময়ে পেয়ে যেতেন; কিন্তু বাস্তবতা এর সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই আমরা দেখতে পাই। তাঁদেরকে রোগ মুক্তি ও সন্তান লাভের জন্য হতাশ না হয়ে অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে দেখা যায় এবং অপর কোনো বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তা না করে শুধুমাত্র আল্লাহ তা‘আলার কাছেই বিনয়ের সাথে তা কামনা করতে দেখা যায়।

এ ক্ষেত্রে আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনেও আমাদের জন্য শিক্ষার বিষয় রয়েছে। তিনি আল্লাহর এতো প্রিয়ভাজন হয়েও একজন ইয়াহূদীর জাদু মন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন, অথচ তিনি বুঝতেও পারেন নি যে তাঁর কী হয়েছে, কী ভাবেই বা তিনি এত্থেকে পরিত্রাণ পাবেন? অবশেষে আল্লাহই তাঁকে এ ব্যাপারে সংবাদ দিলেন এবং সূরায়ে নাস ও ফালাক্ব অবতীর্ণ করে এর দ্বারা ঝাড়ফুঁকের মাধ্যমে তা নষ্ট করার ব্যবস্থা করেন। যদি বিপদ দূর করার ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিজস্ব কোনো উপায় থাকতো, তা হলে তিনি জাদুতে আক্রান্তই হতেন না, বা হলেও মুহূর্তের মধ্যেই তাত্থেকে আরোগ্য লাভ করতে সক্ষম হতেন; কিন্তু তাঁর পক্ষে তা করা সম্ভব হয় নি।

এতে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যদি তাঁর উপরে পতিত বিপদ নিজ থেকে দূর করতে না পারেন, তবে এ জগতে এমন কোনো ওলি ও দরবেশ থাকতে পারেন না, যিনি নিজের বা অপর কোনো মানুষের বিপদ দূর করতে পারেন। বা যার কোনো সন্তান হবার নয় তাকে সন্তান দেবার ব্যবস্থা করতে পারেন। সে জন্য মাওলানা ক্বাযী সানাউল্লাহ পানিপথী বলেন:

‘‘যে বস্তুর কোনো অস্তিত্ব নেই সে বস্তুর অস্তিত্ব দান করা বা যে বস্তুর অস্তিত্ব রয়েছে সেটাকে অস্তিত্বহীন করার মত সামর্থ্য ওলীদের নেই। অতএব কারো প্রতি এ ধারণা পোষণ করা যে, তিনি কোনো বস্তুকে অস্তিত্ব দিতে পারেন, বা সেটাকে অস্তিত্বহীন করতে পারেন, কাউকে জীবিকা দিতে পারেন, রোগ থেকে মুক্তি দিতে পারেন, কিংবা বিপদাপদ ও অকল্যাণ দূর করতে পারেন, তবে তা কুফরী বিশ্বাসে পরিণত হবে।’’[4]কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, আমাদের দেশের সাধারণ মুসলিমগণ ওলীদের কবরে শয়তানের পাতানো কিছু অদ্ভূত কর্মকাণ্ড দেখে, বা অদ্ভূত কোনো ঘটনার কথা লোক মুখে শুনে শয়তানের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন।

যার ফলে তারা আল্লাহর ক্ষমতাকে ওলীদের হাতে ন্যস্ত করে দিয়েছেন। সে জন্যই তারা তাদের জীবনের যাবতীয় অভাব ও অভিযোগের কথা আল্লাহর পরিবর্তে ওলীদের কাছেই জানিয়ে থাকেন, বিপদে পড়লে তাঁদেরকেই স্মরণ করে থাকেন, তাঁদের কবরের নিকতম গাছ-পালা, কূপ ও পুকুরের পানি এবং জীব-জন্তু থেকেও কল্যাণ ও বরকত গ্রহণ করে থাকেন। এগুলোর সম্মান ও তা‘যীম করে থাকেন। এতে তারা নিজেদের অজান্তেই আরবের মুশরিকদের ন্যায় শির্কে নিমজ্জিত হচ্ছেন; কেননা ওরাও তাদের অলি, দেবতা, গাছ-পালা ও পাথরের ব্যাপারে এ জাতীয় ধারণা করার ফলেই শির্কে নিমজ্জিত হয়েছিল।

>
[1]. আল-কুরআন, সূরা আম্বিয়া : ৮৩।

[2]. আল-কুরআন, সূরা হূদ : ৭২।

[3]. আল-কুরআন, সূরা মারয়াম : ৪-৭।

[4]. মাওলানা মুহাম্মদ আরিফ সম্বহলী, প্রাগুক্ত; ৯৩।