বিদআত ও বিদআতীর পরিণাম - ২

(১২) বিদআতের অন্যতম প্রভাব এই যে, বিদআতী তার দ্বারা দ্বীনের সৌন্দর্য বিনষ্ট করে এবং তার অনাবিল রূপে আবিলতা আনে। বিদআতীদের বহুবিধ কুসংস্কার ও কু-আচরণ দেখে ইসলামের শত্রুরা দ্বীনের প্রতি কটাক্ষের সহিত বিদ্রুপ হানে। দরবেশীরূপ, বৈরাগী হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, নযর-নিয়ামের নামে অসদুপায়ে ভক্তদের অর্থহরণ, গাঁজা ইত্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন প্রভৃতি দেখে সকলের মনে। ইসলামের প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মে। ফলে দ্বীনের আসলরূপ চাপা পড়ে যায় এবং ইসলাম গ্রহণ করা হতে অনেক মানুষ দুরে সরে যায়। বরং বহু অজ্ঞ মুসলিমের মনেও ইসলামের প্রতি বিরাগ জন্মে। ফলে বিদআতীরা মানুষের হেদায়াতের পথে। বাধা হয়ে দাড়ায়।

(১৩) বিদআত মুসলিম জাতির সংহতি ও ঐক্য ধ্বংস করে। সুসংবদ্ধ সমাজের অভ্যন্তরে বিছিন্নতা সৃষ্টি করে, এক এক ধরনের অভিনব বিশ্বাস কর্ম বা কর্মপদ্ধতি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জামাআত বা দল গঠিত হয়। মতানৈক্যের কারণে এক দল অপর দলের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব রাখে। এক দল অপর দলকে ভ্রষ্ট, কাফের বা বিদআতী ভাবে। প্রতি দলের অনুসারী নিজের দলীয় নীতির পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং বিপক্ষের নীতির প্রতিবাদ করে। ভাবে তার দলই শ্রেষ্ঠ উম্মত, যাদেরকে আল্লাহ মানুষের জন্য নির্বাচিত করেছেন। অন্ধ পক্ষপাতিত্বের পরিণাম শেষে এই দাঁড়ায় যে, একদল অপর দলের জান মাল হালাল মনে করে! এই অবকাশে কোন। ইসলাম দুশমন সুবর্ণ-সুযোগ পায়। অগম্য ইসলাম দুর্গের উদ্দেশ্যে এই ছিদ্রপথ ব্যবহার করে এবং ইসলামের অপরাজেয় শক্তিকে ভিতর থেকে মুসলিমদের সাহায্যেই নিষ্ক্রিয় করে ফেলতে কৃতার্থ হয়ে যায়। যখন অনল্প অর্থ ও শক্তি থাকা সত্ত্বেও মুসলিমরা পরাভূত হয়ে পড়ে।

আল্লাহর রসূল ঐ সত্যই বলেছেন, “অনতি দূরে বিজাতিসমূহ তোমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে, যেমন ভোজনকারীগণ (একই) ভোজপাত্রের উপর একত্রিত হয়।” একজন বলল, 'আমরা কি তখন সংখ্যায় কম থাকব? হে আল্লাহর রসূল!’ তিনি বললেন,“বরং তখন তোমরা সংখ্যায় অনেক থাকবে। কিন্তু তোমরা হবে তরঙ্গতারিত আবর্জনার ন্যায়। আল্লাহ তোমাদের শত্রুর বক্ষ হতে (তোমাদের প্রতি) ভীতি ছিনিয়ে নেবেন এবং তোমাদের হৃদয়ে দুর্বলতা প্রক্ষিপ্ত করবেন।” একজন বলল, 'হে আল্লাহর রসূল! সে দুর্বলতা কি? তিনি বললেন, “দুনিয়াকে ভালবাসা এবং মরতে না চাওয়া।” (আবু দাউদ)।

সংখ্যায় বেশী থাকলেও অনৈক্যের ফলে দুর্বল রয়ে যাবে। ঘনঘটা মেঘের কোথাও কোথাও বিজলী এবং গর্জন থাকলেও কোন বর্ষণ থাকবে না।

‘ভিতরে দিতে যত মরিয়াছি বাহিরের দিকেও তত,

গুনতিতে মোরা বাড়িয়া চলেছি গরু-ছাগলের মত।

অথচ বিধানকর্তা এ জাতিকে সতর্ক করে বলেছেন,

وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا

অর্থাৎ, তোমরা সকলে আল্লাহর রশি (কুরআন ও দ্বীন)কে শক্ত করে ধারণ কর এবং পরস্পর বিছিন্ন হয়ো না। (সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত) তিনি অন্যত্র বলেন,

أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

অর্থাৎ, তোমরা দ্বীন প্রতিষ্ঠিত কর এবং ওতে (মতভেদ করে) বিছিন্ন হয়ো না।” (সূরা শুরা ১৩ আয়াত) তিনি আরো বলেন,

وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِن بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ ۚ وَأُولَٰئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ

অর্থাৎ, “তোমরা তাদের মতো হয়ো না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট নিদর্শন আসার পর (বিভিন্ন দলে) বিভক্ত হয়েছে ও নিজেদের মধ্যে মতান্তর সৃষ্টি করেছে। তাদের জন্য রয়েছে মহাশাস্তি। (সূরা আলে ইমরান ১০৫ আয়াত) মহান আল্লাহ আরো বলেন,

إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَّسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ ۚ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللَّهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُم بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ

অর্থাৎ, অবশ্যই যারা দ্বীন সম্বন্ধে নানা মতের সৃষ্টি করেছে এবং বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়েছে (হে নবী) তুমি কোন কিছুতে তাদের অন্তর্ভুক্ত নও (এবং তারাও তোমার দলভুক্ত নয়)। তাদের বিষয় আল্লাহর উপর ন্যস্ত, আল্লাহ তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে তাদেরকে অবহিত করবেন।” (সূরা আনআম ১৫৯ আয়াত)।

আল্লাহর রসুল ও উম্মতকে সাবধান করে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, “ইয়াহুদ একাত্তর দলে এবং নাসারা বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছে এবং আমার উম্মত তিয়াত্তর দলে বিভক্ত হবে। যার একটি মাত্র দল ছাড়া সবগুলিই জাহান্নামী হবে।”

সাহাবাগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেই একটি দল কোনটি, হে আল্লাহর রসুল?” তিনি। বললেন, “যে দল আজ আমি ও আমার সাহাবাগণ যার উপর প্রতিষ্ঠিত আছি, তার উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে।” (আবু দাউদ, তিরমিযী) কিন্তু মুখতা ও যুলুম সকল মন্দের মূল। এই উভয় হতেই শুরু হয় ভুল বুঝাবুঝি। ফলে অনেকে নিজেকে ত্রুটিহীন মনে করে অথবা নিজের মান্যবরকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ভুলমুক্ত জ্ঞানী মনে করে প্রকৃত হক ও সত্য চিনতে ভুল করে বসে এবং শুরু হয়। দ্বন্দ্ব ও বিছিন্নতা।

(১৪) সমাজকে সাবধান ও সতর্ক করার উদ্দেশ্যে বিদআতীর গীবত করা বৈধ; যেমন ফাসেক ও প্রকাশ্যে পাপে লিপ্ত ব্যক্তির সমালোচনা ও চর্চা করা হারাম নয়। বরং প্রয়োজন ক্ষেত্রে তা ওয়াজেব হয়ে পড়ে। যেমন যদি কেউ বিদআতী বা দুষ্কৃতীর সহিত অজান্তে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়তে, তার প্রতিবেশ গ্রহণ, ব্যবসা বা অন্য কোন ব্যবহারিক জীবনে অংশী হতে কারো নিকট পরামর্শ বা খোঁজ-খবর নেয়, তবে জানা থাকলে নসীহতের নিয়তে তার নিকট ঐ ব্যক্তির প্রকৃত অবস্থা খুলে বর্ণনা করা ওয়াজেব হবে।

অনুরূপভাবে কোন তালেবে ইলমকে যদি কেউ কোন বিদআতীর নিকট বসতে বা ইলম শিক্ষা করতে দেখে তবে (হিংসা করে নয় বরং) নসীহতের নিয়তে ঐ তালেবকে সতর্ক করা তার জন্য ওয়াজেব। বিদআতীর প্রকাশ্য গীবত করা এবং জনসাধারণকে হুশিয়ার করা কেবল ইনসাফের সাথে তার বিদআতের উল্লেখ করতে হবে। অন্য কারণ না থাকলে তার অন্যান্য দোষ-ত্রুটি বয়ান করা বৈধ্য হবে না। যেমন ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটাবার উদ্দেশ্যে বা ঈর্ষায় কাতর হয়ে অথবা কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে অথবা ব্যক্তিগত কোন। প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে ঐ সুযোগের অপব্যবহার করা আদৌ বৈধ হবে না।

(১৫) বিদআতীদের সাধারণ স্বভাব এই যে, তারা পথ ও মত পরিবর্তনের সময় বিদআত থেকে অধিক নিকষ্টতর বিদআতের প্রতি ধাবমান হয়। আল্লাহ তাআলা তাদের বক্রতার প্রতিদান দেন। যেহেতু কৃতকর্মের প্রকাররানুরূপ প্রতিফলই স্বাভাবিক। মহান আল্লাহ বলেন,

فَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ

অর্থাৎ, অতঃপর যখন ওরা বক্রপথ অবলম্বন করল, তখন আল্লাহ ওদের হৃদয়কে বক্র করে দিলেন। (সূরা সাফফ ৫ আয়াত)।

ইয়াহয়্যাবিন আবী উমার শাইবানী বলেন, 'বলা হত যে, বিদআতীদের তওবা আল্লাহ অগ্রাহ্য করেন এবং বিদআতী অধিকতর মন্দ বিদআতের দিকে স্থানান্তরিত হয়।

এ প্রসঙ্গেই আওয়াম বিন হাওশাব তাঁর পুত্রের উদ্দেশ্যে বলতেন, হে (বৎস) ঈসা! তুমি তোমার চিত্ত বিশুদ্ধ কর ও ধন অল্প কর। আল্লাহর কসম! ঈসাকে বিরুদ্ধাচারী (বিদআতী)দের দলে বসতে দেখার চাইতে তাকে গানবাদ্য ও মদের মজলিসে বসতে দেখা আমার নিকট (তুলনামূলকভাবে) অধিকতর পছন্দনীয়।”

কারণ বিদআতী তার বিদআতকে দ্বীন মনে করে এবং দ্বীনকে ধারণ ও মান্য করার মতই বিদআতকে ধারণ ও মান্য করে চলে। আবার কোন কারণবশতঃ ঐ বিদআত থেকে বহির্গত হলে অন্য কোন বড় বিদআতে প্রবেশ করে। কিন্তু মহাপাপী যারা; যেমন গান-বাদ্যকারী ও শ্রবণকারী মদ্যপায়ী ইত্যাদি তারা নিজ কামবশীভূত। তারা জানে যে, তারা যা করে তা মহাপাপ। কিন্তু তাদের কামপ্রবৃত্তি এবং মন্দকর্মপ্রবণ আত্মার বশবর্তী হয়ে তা বর্জন করতে সহজে সক্ষম হয় না। সম্ভবতঃ তাদের অবৈধতা-জ্ঞানের ফলে কখনো তা পরিহার করতেও পারে। যেহেতু গোনাহগার মানুষের ক্ষেত্রে তওবা, অনুশোচনা এবং সমূলে মন্দ কাজ বর্জন করার অধিক সম্ভাবনা ও আশা থাকে; যতটা বিদআতকে ধর্ম জ্ঞানকারী বিদআতীর ক্ষেত্রে থাকে না।

সেই বিদআতীর তওবার কোন আশা থাকে না, যার হৃদয়ে বিদআত বদ্ধমূল হয়ে অন্তস্তলে বড় জায়গা জুড়ে স্থান গ্রহণ করেছে। যার জন্য বিদআতকেই প্রকৃত দ্বীন মনে করে এবং তার প্রতিকূল সব কিছুকে পার্শ্বে বর্জন করে। বিদআতে বিজ্ঞ হয়ে অন্ধভাবে তাই পছন্দ করে। যে তা পছন্দ ও গ্রহণ করে তাকে ভালোবাসে এবং যে অপছন্দ ও অগ্রহণযোগ্য মনে করে তাকে মন্দ বাসে ও ঘূণা করে। বরং অনেক ক্ষেত্রে শত্রু মনে করে। তা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা এবং তার বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বেপরোয়া লড়াই লড়ে। যেমন প্রাচীন খাওয়ারেজ বিদআতীরা; যারা বিশ্বাস রাখে যে, যে ব্যক্তি কাবীরাহ গোনাহ করবে সে কাফের হয়ে চিরস্থায়ী জাহান্নামবাসী হবে। যারা কখনো এই বিশ্বাস ও ধারণা হতে বিচ্যুত হয়নি। (অবশ্য কিছু মানুষ সঠিক পথে ফিরে এসেছিল।) অথচ তাদের ঐ ধারণার প্রতিকূলে কুরআনী আয়াতে এবং সহীহ হাদীসে স্পষ্ট দলীল রয়েছে। কিন্তু তারা তা পৃষ্ঠপিছে বর্জন করে শরীয়তের বিরোধিতায় অটল থেকেছে। পরন্তু মহান আল্লাহ বলেন,

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ

অর্থাৎ, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সহিত শির্কের অপরাধ ক্ষমা করেন না, এ ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দেন। (সূরা নিসা ৪৮ আয়াত)

প্রিয় নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তি তাওহীদের উপর মৃত্যুবরণ করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে; যদিও সে ব্যভিচার ও চুরি করে থাকে।” তিনি এইরূপ তিনবার পুনঃ পুনঃ বলেছেন।

অনুরূপ আরো বহু দলীলাদির উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে, মহাপাপী আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে, যদি তিনি চান তবে তাকে মার্জনা করবেন, নচেৎ তার পাপ অনুযায়ী পরিমাণ মত শাস্তি প্রদান করবেন এবং (তওহীদের গুণে) তার প্রত্যাবর্তন স্থান হবে জান্নাত। আল্লাহ পাক বলেন,

قُلْ إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُوحَىٰ إِلَيَّ أَنَّمَا إِلَٰهُكُمْ إِلَٰهٌ وَاحِدٌ

অর্থাৎ, বল, আমি তো তোমাদের মতই একজন মানুষ, আমার প্রতি প্রত্যাদেশ হয় যে, তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য--। (সূরা কাহাফ ১১০ আয়াত) অন্যত্র তিনি বলেন,

قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ

অর্থাৎ, বল, আল্লাহ ব্যতীত আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীতে কেউই গায়ব (অদৃশ্য) বিষয়ের জ্ঞান রাখে না। (সূরা নামল ৬৫ আয়াত)

তিনি আরো বলেন,

قُل لَّا أَقُولُ لَكُمْ عِندِي خَزَائِنُ اللَّهِ وَلَا أَعْلَمُ الْغَيْبَ

অর্থাৎ, (হে মুহাম্মাদ!) বল, আমি তোমাদেরকে এ কথা বলি নি যে, আমার নিকট আল্লাহর ধনভান্ডার আছে। আর গায়ব (অদৃশ্য) সম্বন্ধেও আমি অবগত নই--। (সূরা আনআম ৫০ আয়াত)।

এই আয়াতসমূহ এবং আরো অন্যান্য আয়াত ও হাদীস শরীফের উপর ভিত্তি করে আহলে সুন্নাহ বলে যে, আল্লাহর নবী মানুষ ছিলেন এবং তিনি গায়ব জানতেন না, গায়বী খবর তিনি ওহীর মাধ্যমে জানতেন ও জানাতেন। কিন্তু বিদআতীরা ঐ সমস্ত দলীলকে পশ্চাতে ফেলে ভুক্তির আতিশয্যে প্রিয় নবী ধ্রু-কে ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ (সৃষ্টির সেরা জীব) হতে বহিস্কৃত করে এবং তাঁর জন্য গায়বীর দাবী করে আল্লাহর আসনে তাঁকে বসাতে দ্বিধা করে না। কেউ বা তাঁর শরীয়তকে পদদলিত করে ফুর্তি মেরে মারেফতী’র দাবী করে অলী সেজে বসে। অথচ অলি হয়ে যে পরিমল আহরণ করে তার সবটাই গরল। হারামকে হালাল ও হালালকে হারাম করে ব্যবহার করে! এবং তারই মাধ্যমে অজ্ঞ সাদা মানুষদের মন ও হৃদয় লুটে ফায়দা উঠায়। মরণকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যে নয়, যেখানে আল্লাহর রসুল (সা.) তাঁর নিজের জন্য দুআ ও দরূদ পড়তে বলেছেন, সেখানে মওতাদের জন্য দুআর উদ্দেশ্যে নয়, পরকালকে স্মরণ করে হৃদয়ে ভয় আনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং মৃত্যের কাছে জীবন চাইতে নিঃস্বের কাছে সম্পদ চাইতে এবং পরকালের দুয়ারে ইহকাল চাইতে কবর যিয়ারত (পূজা) সিজদা, চুম্বন, তওয়াফ, তাবারুক, উরস। ইত্যাদি দ্বারা নতুন শরীয়ত রচিত করে।

ওরা মহব্বতে রসুলের নামে সেই কাজ করে যাতে ওদের খুশীর ভরপুর সমাগম ঘটে। ভিন্ন জাতির অনুকরণে দ্বীনকে কেবল নিজেদের স্বার্থ, আনন্দ ও সুস্বাদ আস্বাদনের উদ্দেশ্যে আংশিক ধারণ করে থাকে। আর নিরানন্দে একটু স্বার্থ ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকারে ওরা আদৌ মহব্বতের পরিচয় দেয় না। আর ভাবে ঐ অনুষ্ঠানগত মহব্বতই জরুরী ও যথেষ্ট। বাকী তাঁর আদর্শে চরিত্র গড়া, তাঁর নির্দেশ পালন করা, তিনি যা পছন্দ করেছেন তা পছন্দ করা ইত্যাদিকে অজরুরী ও ফালতু ভাবে। পক্ষান্তরে, পার্থিব জীবনে প্রেমের কোন নির্দিষ্ট ধারা নেই, নিয়ন্ত্রিত গতি নেই। হাবীব তার মাহবুবকে যে কোন প্রকারে যে কোন উপায়ে এবং যে কোন মাধ্যমে তার মহব্বত জানাতে পারে। তাতে কোন বাধা নেই, নিয়ন্ত্রণ নেই এবং সুশৃঙ্খলতা নেই।

কিন্তু বান্দার জন্য আল্লাহ এবং উম্মতের জন্য রসুল এমন মাহবুব, যিনি কেবল নিয়ন্ত্রিত প্রেমই পছন্দ করেন। কপট, হীন উচ্ছঙ্খল বা স্বার্থের প্রেম আদৌ পছন্দ করেন না। নিয়ন্ত্রণ ও পরিমাণের বাইরে কোন প্রেমের অতিরঞ্জন তাঁর নিকট প্রীত নয়। যেহেতু পার্থিব প্রেমে প্রায়শঃ ক্ষেত্রে হাবীব-মাহবুব উভয়ের মান-মর্যাদা অথবা কোন না কোন দিক সমপরিমাণ থাকে; যাতে উভয়ের মনের উচ্ছ্বাস গতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। ফলে একে অপরকে ইচ্ছামত বলে এবং ইচ্ছামত উপহার দেয়। কিন্তু সেই মাহবুব যিনি সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা, জীবনদাতা, প্রতিটি জীব যাঁর দয়ার মুক্ষাপেক্ষী; তিনি একমাত্র মাবুদ এবং সেই মাহবুব যিনি অনুসৃত, যাঁর আদেশ কেউ অমান্য করলে, যাঁর নির্দেশ কেউ লংঘন করলে জাহান্নামের মহাগ্নি তার উপযুক্ত শাস্তি হয়, যে মাহবুব তাকে ভালোবাসার উপায় শিক্ষা দিয়েছেন, প্রেমের ধরন বলে

দিয়েছেন, যাতে ভালোবাসতে গিয়ে কেউ বেআদবী করে না বসে। এমন মাহবুবের জন্য হাবীবের হৃদয়ে সদা ভয় থাকে; যাতে প্রেম নিয়ন্ত্রণ-হারা, নিয়ম-ছাড়া, বন্ধনহারা ও বেয়াড়া না হয়ে যায়। পার্থিব প্রেমে অতিরঞ্জন চলে, কখনো বা উপহাসছলে। বেআদবী চলে কিন্তু আল্লাহ ও রসুলের প্রেমে নিছক আদব, তা'যীম ও আনুগত্য থাকে। তাইতো ওযুর অঙ্গ তিন বারের পরিবর্তে চার অথবা তার অধিক বার ধৌত করা বৈধ নয়। যদিও অধিকবার ধৌত করায় অধিক অপবিত্রতা ও পরিচ্ছন্নতা লাভ হয়। তাইতো আল্লাহর প্রেমে তন্ময় হয়ে ফজরে দুয়ের স্থানে চার রাকআত ফরয। পড়া প্রেমিক বান্দার জন্য বৈধ নয়। যেহেতু তাঁর প্রেমের পথ নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত। এই নির্দিষ্ট সীমা দ্বারাই তাঁর প্রকৃত প্রেমের অগ্নিপরীক্ষা হয়। তাই নির্দেশিত সরল পথ ব্যতীত অন্যান্য বঙ্কিম পথে তাঁর মহব্বত হাসিল হয় না।

পক্ষান্তরে প্রেমিকা কেবল শাড়ীর আবেদন জানালে তার সঙ্গে বাড়তি ব্লাউজ ও চুড়ি নিবেদন করলে সে নারাজ হয় না বরং আরো অধিক খুশী হয় এবং প্রেমের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। ভূত্য সারা দিনের কর্তব্য পালন করেও যদি রাত্রে প্রভুর গা-পা দাবায় তবে প্রভু খুশী হয়ে তার বেতন বৃদ্ধি করে; নারাজ হয় না।।

হাঁ ব্লাউজ ও চুড়ি যদি প্রেমিকার দেহাঙ্গের মাপ ও তার পছন্দমত হয় এবং ভূতের ঐ বাড়তি খিদমত যদি প্রভুর সময় ও প্রয়োজন মত হয় তবেই তা সম্ভব। নচেৎ ভালোবাসার ঝুলিতে ভৎসনাই স্থান পাবে। আবার শাড়ী ব্যতীত অন্য কিছু বাড়তি আনলে এবং কাজ ছেড়ে প্রভুর পা দাবালে কি হবে তা বলাই বাহুল্য।

অনুরূপভাবে শরীয়তের পছন্দমত যে সব নফল (বাড়তি) কাজের নির্দেশ আছে। তা করলে তো আল্লাহ খুশীই হন। কিন্তু তাঁর নির্দেশ ও পছন্দের বাইরে নিজের মনগড়া কিছু করতে চাইলে অবশ্যই বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা ছাড়া কিছুই লাভ হয় না। আবার তাঁর নির্দেশ অমান্য করে অতিরিক্ত অন্য কিছু করে মহব্বত প্রকাশ করতে চাইলে জাহেল হাবীব এটাই বুঝে যে, সে তার মাহবুব ও শরীয়ত অপেক্ষা অনেক বেশী বুঝে। আবার এতটা বলতে দুঃসাহস করে যে, শরীয়ত তো একটা পিয়াজের মত যার সবটাই খোসা (ছাল)! অর্থাৎ যার সার ও আসল কিছুই নেই !! শরীয়তের আলেম ও অনুগামীরা তো কেবল পানারী পাতার মত; যা পানির গভীরতার উপরেই ভেসে বেড়ায় ইত্যাদি!!! এ ধরনের ছন্নছাড়া, বাঁধনহারা মহব্বতের দাবীদারদের অবস্থা যে কি হবে, তা জ্ঞানীদের নিকট সহজেই প্রতীয়মান। বিদআতীদের এমন অনেক মানুষ আছে যারা বিদআতকে অন্তর্মুলে স্থান দেয় না, তবে তা ভালো জেনে এবং তাতে আল্লাহ খুশী হবেন এই মনে করে লোকের দেখাদেখি সাধারণভাবে তা করে থাকে। কিন্তু তার বিপরীত কোন দলীল বা নীতিকথা শুনলে উদার মনে তা পরিত্যাগ করে প্রকৃত দ্বীনকে হীন সেবকরূপে ধরার চেষ্টা করে এবং বিদআত হতে তওবা করে। অবশ্যই তারা পথপ্রাপ্ত এবং তাদের জন্যই মুক্তি।