ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ:) তার ব্যাখ্যাগ্রন্থে বিদ‘আতকে পাঁচ ভাগে ভাগ করেছেন

প্রশ্ন: ইমাম নাওয়াওয়ী (রহ:) তার ব্যাখ্যাগ্রন্থে বিদ‘আতকে পাঁচ ভাগে ভাগ করে বলেছেন, “কোনো বিদ‘আত ওয়াজিব, এর উদাহরণ: নাস্তিক্যবাদের উপর ধর্মতত্ত্ববিদদের দলীলের পদ্ধতি। আবার কোনো কোনোটি মুস্তাহাব, এর উদাহরণ: ইলমি বিভিন্ন বিষয়ে পুস্তক লেখা। আবার কোনো কোনোটি বৈধ, এর উদাহরণ: খাবারের বিভিন্ন প্রকার বৃদ্ধি করা। আর কোনো কোনো বিদ‘আত হারাম ও মাকরুহ, এ দু’টো সকলের নিকট স্পষ্ট।”

অথচ রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন: (প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা) এর দ্বারা ইমাম নাওয়াওয়ীর উদ্দেশ্য কি? তা বর্ণনাসহ বিস্তারিত বলার জন্য আপনাকে অনুরোধ করছি, আল্লাহ আপনাকে বরকতময় করুন।

উত্তর: আপনি ইমাম নাওয়াওয়ী থেকে যে পাঁচ প্রকার বিদ‘আত তুলে ধরেছেন তা আলেমগণের একটি জামায়াতও উল্লেখ করেছেন। তারা বলেছেন: বিদ‘আত পাঁচ প্রকার: ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ (অনুমোদিত), হারাম ও মাকরুহ।

তবে অন্য আলেমগণ বলেছেন: সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা, এর মধ্যে কোনো প্রকারভেদ নেই বরং সবগুলোই ভ্রষ্টতা যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: ( সকল প্রকার বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা)। আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ।

এমনিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বহু সহীহ হাদীস এসেছে, তন্মধ্যে সহীহ সহীহ মুসলিমে জাবের ইবন আব্দুল্লাহ আল আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জুম‘আর দিন তাঁর খুৎবায় বলেন:

«أما بعد فإن خير الحديث كتاب الله وخير الهدي هدي محمد صلى الله عليه وسلم وشر الأمور محدثاتها وكل بدعة ضلالة»

“অতঃপর সর্বোত্তম বাণী হলো: আল্লাহর কিতাব এবং সর্বোত্তম হেদায়েত হলো: মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হেদায়েত, আর নিকৃষ্টতর কাজ হলো এর নব আবিষ্কৃত কাজ, এবং প্রতিটি বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।”[1]

এ অর্থে কয়েকটি আরও হাদীস এসেছে, আয়েশা ও ইরবাদ ইবন সারিয়ার হাদীসসহ বহু হাদীস।

আর এটাই সত্য যে, ইমাম নওয়াওয়ী ও অন্যান্যরা বিদ‘আতের যে প্রকার উল্লেখ করেছেন এ ধরনের কোনো প্রকার বাস্তবে নেই বরং সব বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা।

কারণ, বিদ‘আত হয় কেবল দ্বীনের ক্ষেত্রে, মুবাহ বা অনুমোদিত কোনো জিনিসের ক্ষেত্রে নয়। যেমন: নতুন কোনো খাবার তৈরী করা যা এর আগে কেউ তৈরী করেনি, শরীয়তের পরিভাষায় একে বিদ‘আত বলা হয় না যদিও শাব্দিক অর্থে তা বিদ‘আত। কেননা শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত বলা হয়: ‘পূর্ব নমুনা ব্যতীত নতুনভাবে কোনো জিনিস আবিষ্কার করা’কে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿ بَدِيعُ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ ﴾ [البقرة: ١١٧]

“আল্লাহ ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের নবউদ্ভাবক। [সূরা বাকারা ১১৭] অর্থাৎ “পূর্ব নমুনা ব্যতীত তিনি এর আবিষ্কারক ও উদ্ভাবক।”

কিন্তু শরীয়তের পরিভাষায় কোনো ব্যাপারটি তখনই বিদ‘আত বলা যাবে, যখন কেউ এমন কোনো জিনিস তৈরী করল যার প্রমাণ কুরআন ও হাদীসে নেই। আর এটিই সত্য যা আলেমগণের একটি দল মেনে নিয়ে এর স্বীকৃতি প্রদান করেছেন এবং যারা এর বিরোধিতা করছেন তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

ইসলামের শত্রু এবং নাস্তিকদের প্রতিউত্তর দেওয়ার ব্যাপারে দলীল প্রস্তুত করা এবং বই লেখাকে বিদ‘আত বলা যাবে না, কারণ তা আল্লাহ ও তার রাসূলের নির্দেশের অন্তর্ভুক্ত বিধায় তা বিদ‘আত নয়। কেননা কুরআনুল কারীম স্পষ্ট আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহর শত্রুদের প্রতিউত্তর দিয়েছে এবং তাদের সন্দেহের মুখোশ উদ্ঘাটন করে দিয়েছে এবং রাসূলের সুন্নাতও ইসলামের শত্রুদের প্রতিউত্তর দিয়েছে। এমনিভাবে সাহাবাদের যুগ থেকে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মুসলিমগণ তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিচ্ছে।

এর কোনটিই বিদ‘আত নয় বরং ওয়াজিব পালিত হচ্ছে এবং আল্লাহর পথে জিহাদ হচ্ছে, তাই এগুলো কোনোভাবেই বিদ‘আত নয়। তদ্রূপ মাদরাসা, সেতু ইত্যাদি নির্মাণ করা যা মুসলিমদের উপকার হয় তাকে শরীয়তে বিদ‘আত বলা হবে না, কেননা শরীয়তই শিক্ষা গ্রহণ করার নির্দেশ দিয়েছে। আর মাদরাসা তৈরী শিক্ষা গ্রহণ করতে সাহায্য করছে, এমনিভাবে গরীবদের সাথে সম্পর্ক রাখা, কারণ আল্লাহ তা‘আলা গরীব ও অসহায়দের প্রতি অনুগ্রহ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কেউ যদি তাদের জন্য কোনো ঘর তৈরী করে তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তবে এটিই আল্লাহর নির্দেশ, তদ্রূপ নদীর উপর কোনো সেতু তৈরী করা, এসব কিছুই মানুষের উপকারের জন্য, তা বিদ‘আত নয় বরং তা ইসলামেরই নির্দেশ। তা কেবল শাব্দিক অর্থেই বিদ‘আত হবে। যেমন উমর রা: তারাবীহ এর সালাতের জন্য যখন লোকদেরকে এক ইমামের পিছনে জমা করেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন: نعمت البدعة هذه “এটি কতইনা ভালো বিদ‘আত”! অথচ তারাবীর সালাত সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়েছেন এবং সাহাবাদেরকে তা পড়ার জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন, কাজেই তা বিদ‘আত নয় বরং তা সুন্নাত। কিন্তু উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু একে শাব্দিক অর্থে বিদ‘আত বলেছেন; কারণ পূর্বে এভাবে এক ইমামের পেছনে সালাত পড়া হত না বরং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময় এবং তাঁর পরে দুইজন বা তিনজন করে ছোট ছোট জামাতে পড়া হত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন দিন জামাতে পড়েছেন, তার পর ছেড়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন:

«إني أخشى أن تفرض عليكم صلاة الليل»

“রাত্রির সালাত তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার ভয় করছি।”

অতঃপর তিনি তাঁর উম্মতের উপর এ সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার ভয়ে জামাতে পড়া ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি যখন মৃত্যুবরণ করলেন তখন এ ভয় দূর হয়ে গেল, অতঃপর উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা জামাতে পড়ার নির্দেশ দেন।মোটকথা রমাযানের রাত্রির (তারাবীর) সালাত পড়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদা, শরীয়তের দৃষ্টিতে তা বিদ‘আত নয়। এর দ্বারা জানা যায় যে, আল্লাহর বিধানের বাইরে দ্বীনের মধ্যে মানুষ নতুন যা সৃষ্টি করবে তা-ই বিদ‘আত, যা ভ্রষ্টতা হিসেবে স্বীকৃত, আর তাই তা করা জায়েয নেই এবং একে ওয়াজিব, সুন্নাত , মুবাহ .. ইত্যাদি হিসাবে ভাগ করাও জায়েয নেই। কারণ তা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সাব্যস্ত শর‘ঈ দলীলের পরিপন্থী, যেমনটি পূর্বে আলোচিত হয়েছে।

[1] মুসলিম শরীফ, জুম‘আ অধ্যায়, খুৎবা ও সালাত হালকাকরণ অনুচ্ছেদ, হাদীস নং ৮৬৭।