পাঁচ. সমাজ ব্যবস্থার বিনাশ

আমরা আগেই বলে এসেছি, পরিবার হলো সমাজ ব্যবস্থার মৌলিক উপকরণ। সুতরাং পরিবারিক ব্যবস্থা ধ্বংসের ফলে সমাজ ব্যবস্থায়ও যে ধ্বংস ও বিলুপ্তি নেমে আসবে সেটা বলাই বাহুল্য। কেননা একটি পরিবার প্রতিনিয়ত সমাজকে নতুন নতুন সদস্য সরবরাহ করে। সুতরাং পরিবার যদি সমাজের কাছে নষ্ট ও বিপথগামী সদস্য সরবরাহ করে, তবে সন্দেহ নেই একসময় পুরো সমাজ নষ্ট ও বিপথগামী হয়ে পড়বে। একটি সামাজিক ব্যবস্থায় ব্যক্তিই হয়ে থাকেন কোনো অফিসের সবচেয়ে বড় কর্মকর্তা, হাসপাতালের চিকিৎসক, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কিংবা শিল্প-কারখানার কর্মচারী। আর তাই সর্বত্রই এই মানুষটিকে তার আশ-পাশের মানুষের সঙ্গে সেভাবেই আচার-আচরণ করতে হয় যা ছোটবেলা থেকে তার পরিবার তাকে শিক্ষা দিয়েছে। সুতরাং ছোট বেলা থেকে পরিবারে সে যদি কেবল ব্যক্তিচিন্তা আর স্বার্থপরতা শিখে থাকে তবে সমাজেও তো সে ঠিক একইরূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে। ফলে গোটা সমাজটাই হয়ে পড়বে স্বার্থপর ও আত্মপরায়ণ সমাজ। পরস্পরের ভালোবাসা ও সহমর্মিতার অনুভূতি, জনহিতৈষী মনোভাব, অপরের কল্যাণে নিজের স্বার্থকে কুরবান করে দেওয়ার মানসিকতা সেই পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে অবলুপ্ত হয়ে যাবে। সরকারি অফিস-আদালত, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো পরিণত হবে কেবল স্বার্থসিদ্ধি ও ব্যক্তিগত গরজ পূরণের বাহন হিসেবে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষই খুঁজতে থাকবে দুর্নীতি আর অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে উদ্দেশ্য হাসিলের নতুন নতুন পন্থা ও পদ্ধতি। আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে ঘুষ-উৎকোচ গ্রহণ আর রাষ্ট্রের সম্পদ নিজের বাপের রেখে যাওয়া মীরাস মনে করে চোখ বন্ধ করে গিলতে থাকবে।

নাস্তিক্যবাদের প্রভাবে আমাদের আধুনিক মানব সমাজ ‘পশু’ সমাজের সঙ্গেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে গেছে। যেখানের প্রত্যেকেই একে অপরকে শিকারের নেশায় সারাক্ষণ ওত পেতে থাকে। আর সে কারণে যেখানকার দুর্বলরা চায় সবলদের চোখ এড়িয়ে থাকতে। আর সবলরা চায় কলে-কৌশলে দুর্বলদের ঘাড় মটকাতে।

আজকের পাশ্চাত্য সমাজ ব্যবস্থা সম্পর্কে সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, অপরাধ সেখানে একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটা সেখানে মানুষের দৈনন্দিন গতানুগতিক আচারের অপরিহার্য অনুসঙ্গে রূপ নিয়েছে। সেকারণে, ব্যভিচার ও বিকৃত যৌনাচারের দরজা ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত থাকার পরেও সেখানে নারী অপহরণের হার রীতিমতো ভীতিকর। কর্মসংস্থানের প্রচুর সুযোগ-সুবিধা আর ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন বয়সের ও বিভিন্ন পেশার মানুষ কর্তৃক চুরি-ডাকাতি আর সশস্ত্র ছিনতাই অহরহই ঘটছে। শহরগুলোতে শত শত অপরাধ সংঘটন আজ নিতান্তই একটা স্বাভাবিক চিত্র হয়ে গেছে।

এভাবেই আল্লাহ তা‘আলার স্মরণ ও ভীতি থেকে উদাসীন নাস্তিক্যবাদী একটি সমাজ কখনো সুস্থ ও সবল সমাজ হিসেবে পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারে না; বরং সেটা পরিণত হয় একটি অন্যায়, অশ্লীলতা, পাপাচার আর নীতিহীনতার ভাঁগাড়ে। অন্যায়-অপরাধ, জুলুম-নির্যাতন, আইনের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি, অন্যায় প্রভাব খাটিয়ে কাঙিক্ষত বস্তু অর্জন ইত্যাদি তখন হয়ে পড়ে সেটার নিত্য-নৈমিত্তিক চিত্র। সেখানে সবলরা দুর্বলদের ওপর জুলুম করে। আর দুর্বলরা সবলদের জুলুম থেকে বাঁচার জন্য মুনাফেকির আশ্রয় নেয়। আর এগুলোই তখন পরিণত হয় সেই সমাজের মানুষের আচার-আচরণের মূলনীতি আর অলিখিত সংবিধানে।