দাওয়াতের ক্ষেত্রে ধৈর্যধারণ করতে হবে।

 সে যে দিকে ডাকে সে ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করা, দাওয়াতী কাজে যে বাধা আসবে সে ব্যাপারে ধৈর্য ধরা এবং দুঃখ-কষ্ট ও জুলুম-নির্যাতনে ধৈর্যধারণ করা।

দাওয়াতের ব্যাপারে ধৈর্যধারণ করতে হবে, অবিরাম চালিয়ে যেতে হবে, দাওয়াত বন্ধ করা যাবে না এবং বিরক্ত হওয়া যাবে না। বরং সাধ্য অনুযায়ী আল্লাহর রাস্তায় দাওয়াত চালিয়ে যেতে হবে। যে সব ক্ষেত্রে দাওয়াত বেশি ফলদায়ক, অগ্রগণ্য ও বেশি স্পষ্ট সে সব ক্ষেত্রে দাওয়াত দেয়া। দাওয়াতের কাজে ধৈর্যধারণ করা এবং ধৈর্যহারা ও বিরক্ত না হওয়া। কেননা মানুষ যখন ধৈর্যহারা ও বিরক্ত হয়ে যায় তখন সে নিরাশ হয়ে যায় এবং কাজটি ছেড়ে দেয়। কিন্তু দাওয়াত অবিরাম চালিয়ে গেলে একদিকে ধৈর্যশীলদের প্রতিদান পাবে আর অন্যদিকে শেষ পরিণাম শুভ হবে। আল্লাহ তাঁর নবীকে উদ্দেশ্য করে যে বাণী দিয়েছেন তা মনোযোগ দিয়ে শুনুন:

﴿ تِلۡكَ مِنۡ أَنۢبَآءِ ٱلۡغَيۡبِ نُوحِيهَآ إِلَيۡكَۖ مَا كُنتَ تَعۡلَمُهَآ أَنتَ وَلَا قَوۡمُكَ مِن قَبۡلِ هَٰذَاۖ فَٱصۡبِرۡۖ إِنَّ ٱلۡعَٰقِبَةَ لِلۡمُتَّقِينَ ٤٩ ﴾ [هود: ٤٩]

“এগুলো গায়েবের সংবাদ, আমি তোমাকে ওহীর মাধ্যমে তা জানাচ্ছি। ইতঃপূর্বে তা না তুমি জানতে এবং না তোমার কওম। সুতরাং তুমি সবর কর। নিশ্চয় শুভ পরিণাম কেবল মুত্তাকীদের জন্য”। [সূরা: হূদ: ৪৯]

দাওয়াতী কাজে মানুষ বিরোধীদের থেকে যে সব অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয় সে ব্যাপারে ধৈর্যশীল হওয়া অত্যাবশ্যক। কেননা যারাই আল্লাহর পথে দাওয়াত দিবে তারা অবশ্যই নিন্মোক্ত আয়াত অনুযায়ী জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ وَكَذَٰلِكَ جَعَلۡنَا لِكُلِّ نَبِيٍّ عَدُوّٗا مِّنَ ٱلۡمُجۡرِمِينَۗ وَكَفَىٰ بِرَبِّكَ هَادِيٗا وَنَصِيرٗا ٣١ ﴾ [الفرقان: ٣٠]

“আর এভাবেই আমি প্রত্যেক নবীর জন্য অপরাধীদের মধ্য থেকে শত্রু বানিয়েছি। আর পথপ্রদর্শক ও সাহায্যকারী হিসেবে তোমার রবই যথেষ্ট।” [সূরা আল-ফুরকান: ৩০]

সুতরাং প্রত্যেক সত্যপন্থী দাওয়াতের বিরোধী দল থাকবেই। তারা নানা বাধা বিপত্তি, ঝগড়া ফ্যাসাদ ও সমস্যা সৃষ্টি করবে। কিন্তু দা‘য়ীর উপর কর্তব্য হলো তারা দাওয়াতী কাজে এ সব বিরোধিতার উপর ধৈর্যধারণ করবে, এমনকি তারা যদি এ কথাও বলে যে, এটা ভ্রান্ত ও বাতিল দাওয়াত, তথাপিও সে ধৈর্যধারণ করবে; কারণ সে নিশ্চিতভাবে জানে যে, এটা আল্লাহর কিতাব ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুন্নাহ মোতাবেক সত্য দাওয়াত। অতঃএব, সে এতে ধৈর্য ধরবে ।

তবে এর অর্থ এটা নয় যে, তার কাছে সত্য স্পষ্ট হওয়ার পরেও সে যা বলে ও দাওয়াত দেয় সেটার উপর অটল ও গোঁ ধরে থাকবে। কেননা যার কাছে সত্য স্পষ্ট ও প্রকাশিত হওয়ার পরেও সে (ভুল) দাওয়াতী কাজে জিদ ধরে থাকে তারা আল্লাহ বর্ণনাকৃত সে সব লোকের ন্যায়:

﴿ يُجَٰدِلُونَكَ فِي ٱلۡحَقِّ بَعۡدَ مَا تَبَيَّنَ كَأَنَّمَا يُسَاقُونَ إِلَى ٱلۡمَوۡتِ وَهُمۡ يَنظُرُونَ ٦ ﴾ [الانفال: ٦]

“তারা তোমার সাথে সত্য সম্পর্কে বিতর্ক করছে তা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর। যেন তাদেরকে মৃত্যুর দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হচ্ছে, আর তারা তা দেখছে।” [সূরা : আল-আন্ফাল: ৬]

সত্যের ব্যাপারে বিতর্ক করা সম্পর্কে নিন্দা করা সত্বেও যারা বিতর্ক করে তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء: ١١٥]

“আর যে রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে তার জন্য হিদায়াত প্রকাশ পাওয়ার পর এবং মুমিনদের পথের বিপরীত পথ অনুসরণ করে, আমি তাকে ফেরাব যেদিকে সে ফিরে এবং তাকে প্রবেশ করাব জাহান্নামে। আর আবাস হিসেবে তা খুবই মন্দ”। [সূরা : আন্-নিসা: ১১৫]

অতঃএব, দাওয়াতী কাজে নিজের বিরোধীদের কথা সত্য হলে দা‘য়ীর উপর ফরয হলো সে নিজের মত থেকে সরে গিয়ে বিরোধীদের মত গ্রহণ করবে। আর যদি বিরোধীরা বাতিল হয় তবে দাওয়াতী কাজে নিজে অটল ও সুদৃঢ় থাকবে।

এমনিভাবে দা‘য়ী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলে ধৈর্যধারণ করবে। কেননা দা‘য়ী অবশ্যই শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হবেই। আল্লাহর প্রেরিত নবী রাসূল আলাইহিমুস সালামরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে নির্যাতিত হয়েছিলেন। মহান আল্লাহর নিন্মোক্ত বাণী পড়ুন:

﴿ كَذَٰلِكَ مَآ أَتَى ٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِهِم مِّن رَّسُولٍ إِلَّا قَالُواْ سَاحِرٌ أَوۡ مَجۡنُونٌ ٥٢ ﴾ [الذاريات: ٥٢]

“এভাবে তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্য থেকে যে রাসূলই এসেছে, তারা বলেছে, ‘এ তো একজন জাদুকর অথবা উন্মাদ’’। [সূরা : আয্-যারিয়াত: ৫২]

সুতরাং আপনার কি ধারণা যাদের উপর আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী নাযিল হত তাদেরকে জাদুকর অথবা উন্মাদ বলা হত?! রাসূলগণ অবশ্যই শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিনের শিকার হয়েছিলেন। তা সত্বেও তারা ধৈর্যধারণ করেছিলেন।

প্রথম রাসূল নূহ আলাহিস সালামের দিকে লক্ষ্য করুন। তিনি কিশতি (নৌকা) তৈরি করার সময় তার সম্প্রদায়ের লোকজন তার পাশ দিয়ে অতিক্রম করার সময় উপহাস করত আর বলত:

﴿ وَيَصۡنَعُ ٱلۡفُلۡكَ وَكُلَّمَا مَرَّ عَلَيۡهِ مَلَأٞ مِّن قَوۡمِهِۦ سَخِرُواْ مِنۡهُۚ قَالَ إِن تَسۡخَرُواْ مِنَّا فَإِنَّا نَسۡخَرُ مِنكُمۡ كَمَا تَسۡخَرُونَ ٣٨ فَسَوۡفَ تَعۡلَمُونَ مَن يَأۡتِيهِ عَذَابٞ يُخۡزِيهِ وَيَحِلُّ عَلَيۡهِ عَذَابٞ مُّقِيمٌ ٣٩ ﴾ [هود: ٣٨، ٣٩]

“আর সে নৌকা তৈরী করতে লাগল এবং যখনই তার কওমের নেতৃস্থানীয় কোন ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে যেত, তাকে নিয়ে উপহাস করত। সে বলল, ‘যদি তোমরা আমাদের নিয়ে উপহাস কর, তবে আমরাও তোমাদের নিয়ে উপহাস করব, যেমন তোমরা উপহাস করছ’। অতএব, শীঘ্রই তোমরা জানতে পারবে, কার উপর সে আযাব আসবে যা তাকে লাঞ্ছিত করবে এবং কার উপর আপতিত হবে স্থায়ী আযাব।” [সূরা: হূদ: ৩৮-৩৯]

তারা শুধু উপহাস করেই ক্ষান্ত হয় নি, বরং তাকে হত্যার হুমকি দেন।

﴿ قَالُواْ لَئِن لَّمۡ تَنتَهِ يَٰنُوحُ لَتَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡمَرۡجُومِينَ ١١٦ ﴾ [الشعراء: ١١٦]

“তারা বলল, হে নূহ, তুমি যদি বিরত না হও তবে অবশ্যই তুমি প্রস্তরাঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে।” [সূরা : আশ-শু‘আরা: ১১৬]

অর্থাৎ পাথরের আঘাতে নিহতদের অন্তর্ভুক্ত হবে। এখানে হুমকির সাথে হত্যার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে যে, আমাদের প্রতাপের কারণে তোমার মত অন্যান্যদেরকে প্রস্তরাঘাতে আমরা হত্যা করেছি। তুমিও তাদের মত নিহত হবে। কিন্তু তাদের এ হুমকি ধমকি নূহ আলাইহিস সালামকে তার দাওয়াত থেকে বিরত রাখতে পারে নি। তিনি তার দাওয়াত চালিয়ে গেছেন। পরিশেষে আল্লাহ তা‘আলা তাকে বিজয় দান করেছেন।

ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার সম্প্রদায়ের লোকেরা প্রত্যাখ্যান করেছিল। এমনকি হত্যার জন্য তাকে মানুষের সামনে হাজির করেছিল।

﴿ قَالُواْ فَأۡتُواْ بِهِۦ عَلَىٰٓ أَعۡيُنِ ٱلنَّاسِ لَعَلَّهُمۡ يَشۡهَدُونَ ٦١ ﴾ [الانبياء: ٦١]

“তারা বলল, তাহলে তাকে লোকজনের সামনে নিয়ে এসো, যাতে তারা দেখতে পারে।’’ [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬১]

অতঃপর তাকে আগুনে পুড়ে হত্যার অঙ্গিকার করে।

﴿ قَالُواْ حَرِّقُوهُ وَٱنصُرُوٓاْ ءَالِهَتَكُمۡ إِن كُنتُمۡ فَٰعِلِينَ ٦٨ ﴾ [الانبياء: ٦٨]

“তারা বলল, তাকে আগুনে পুড়িয়ে দাও এবং তোমাদের দেবদেবীদেরকে সাহায্য কর, যদি তোমরা কিছু করতে চাও।’’ [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬৮]

ফলে তারা আগুন প্রজ্বলিত করল এবং তাকে আগুনের কুন্ডলীর মধ্যে নিক্ষেপ করল যাতে আগুনের লেলিহানে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿ قُلۡنَا يَٰنَارُ كُونِي بَرۡدٗا وَسَلَٰمًا عَلَىٰٓ إِبۡرَٰهِيمَ ٦٩ ﴾ [الانبياء: ٦٩]

“আমি বললাম, হে আগুন, তুমি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও ইবরাহীমের জন্য।’’ [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৬৯]

ফলে আগুন শীতল ও শান্তিময় হয়ে গেল এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সেখান থেকে নিরাপদে রক্ষা পেলেন। পরিশেষে উত্তম পরিণাম ইবরাহীম আলাইহিস সালামেরই ছিল।

﴿ وَأَرَادُواْ بِهِۦ كَيۡدٗا فَجَعَلۡنَٰهُمُ ٱلۡأَخۡسَرِينَ ٧٠ ﴾ [الانبياء: ٧٠]

“আর তারা তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিল, কিন্তু আমি তাদেরকে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করে দিলাম।” [সূরা : আল-আম্বিয়া: ৭০]

মূসা আলাহিস সালামকে ফিরাউন হত্যার হুমকি দিয়েছে।

﴿ وَقَالَ فِرۡعَوۡنُ ذَرُونِيٓ أَقۡتُلۡ مُوسَىٰ وَلۡيَدۡعُ رَبَّهُۥٓۖ إِنِّيٓ أَخَافُ أَن يُبَدِّلَ دِينَكُمۡ أَوۡ أَن يُظۡهِرَ فِي ٱلۡأَرۡضِ ٱلۡفَسَادَ ٢٦ ﴾ [غافر: ٢٦]

“আর ফির‘আউন বলল, ‘আমাকে ছেড়ে দাও, আমি মূসাকে হত্যা করি এবং সে তার রবকে ডাকুক; নিশ্চয় আমি আশঙ্কা করি, সে তোমাদের দীন পাল্টে দেবে অথবা সে যমীনে বিপর্যয় ছড়িয়ে দেবে।” [সূরা : গাফের: ২৬]

ফলে সে মূসা আলাইহিস সালামকে হত্যার হুমকি দেয়, কিন্তু পরিশেষে উত্তম পরিণাম মূসা আলাইহিস সালামেরই ছিল।

﴿ وَحَاقَ بِ‍َٔالِ فِرۡعَوۡنَ سُوٓءُ ٱلۡعَذَابِ ٤٥ ﴾ [غافر: ٤٥]

“আর ফির‘আউনের অনুসারীদেরকে ঘিরে ফেলল কঠিন আযাব”। [সূরা : গাফের: ৪৫]

ঈসা আলাইহিস সালামকে মানসিক নানা জুলুম নির্যাতন করা হয়েছে, এমনকি ইয়াহুদিরা তাকে জারজ সন্তান হিসেবে অপবাদ দিয়েছিল, তাদের ভ্রান্ত ধারণা মতে তারা তাকে হত্যা করেছে ও শূলে চড়িয়েছে।

কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَٰكِن شُبِّهَ لَهُمۡۚ وَإِنَّ ٱلَّذِينَ ٱخۡتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكّٖ مِّنۡهُۚ مَا لَهُم بِهِۦ مِنۡ عِلۡمٍ إِلَّا ٱتِّبَاعَ ٱلظَّنِّۚ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينَۢا ١٥٧ بَل رَّفَعَهُ ٱللَّهُ إِلَيۡهِۚ وَكَانَ ٱللَّهُ عَزِيزًا حَكِيمٗا ١٥٨ ﴾ [النساء: ١٥٧، ١٥٨]

“আর তারা তাকে হত্যা করেনি এবং তাকে শূলেও চড়ায়নি। বরং তাদেরকে ধাঁধায় ফেলা হয়েছিল। আর নিশ্চয় যারা তাতে মতবিরোধ করেছিল, অবশ্যই তারা তার ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে ছিল। ধারণার অনুসরণ ছাড়া এ ব্যাপারে তাদের কোন জ্ঞান নেই। আর এটা নিশ্চিত যে, তারা তাকে হত্যা করেনি। বরং আল্লাহ তাঁর কাছে তাকে তুলে নিয়েছেন এবং আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।” [সূরা : আন্-নিসা: ১৫৭-১৫৮]

ফলে তিনি তাদের থেকে রক্ষা পেলেন।

সর্বশেষ রাসূল, রাসূলগণের ইমাম ও আদম সন্তানের সর্দার মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নানা জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্পর্কে বলেন,

﴿ وَإِذۡ يَمۡكُرُ بِكَ ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ لِيُثۡبِتُوكَ أَوۡ يَقۡتُلُوكَ أَوۡ يُخۡرِجُوكَۚ وَيَمۡكُرُونَ وَيَمۡكُرُ ٱللَّهُۖ وَٱللَّهُ خَيۡرُ ٱلۡمَٰكِرِينَ ٣٠ ﴾ [الانفال: ٣٠]

“আর যখন কাফিররা তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করছিল, তোমাকে বন্দী করতে অথবা তোমাকে হত্যা করতে কিংবা তোমাকে বের করে দিতে। আর তারা ষড়যন্ত্র করে এবং আল্লাহও ষড়যন্ত্র করেন। আর আল্লাহ হচ্ছেন ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে উত্তম।” [সূরা : আল-আন্ফাল: ৩০]

আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সম্পর্কে আরো বলেন,

﴿ وَقَالُواْ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِي نُزِّلَ عَلَيۡهِ ٱلذِّكۡرُ إِنَّكَ لَمَجۡنُونٞ ٦ ﴾ [الحجر: ٦]

“আর তারা বলল, ‘হে ঐ ব্যক্তি, যার উপর কুরআন নাযিল করা হয়েছে, তুমি তো নিশ্চিত পাগল’’। [সূরা: আল-হিজর: ৬]

﴿ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوٓاْ ءَالِهَتِنَا لِشَاعِرٖ مَّجۡنُونِۢ ٣٦ ﴾ [الصافات: ٣٦]

“আর বলত, ‘আমরা কি এক পাগল কবির জন্য আমাদের উপাস্যদের ছেড়ে দেব?’’ [সূরা : আস্-সাফ্ফাত: ৩৬]

তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ইতিহাসবিদদের নিকট স্পষ্ট। তা সত্বেও তিনি ধৈর্যধারণ করেছেন। ফলে শেষ পরিণাম তাঁরই ছিল।

তাহলে দেখা গেল, সব দা‘য়ীরাই জুলুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু তারা সবাই ধৈর্যধারণ করেছেন। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা যখন তার রাসূলকে বলেছেন,

﴿ إِنَّا نَحۡنُ نَزَّلۡنَا عَلَيۡكَ ٱلۡقُرۡءَانَ تَنزِيلٗا ٢٣ ﴾ [الانسان: ٢٣]

“নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি পর্যায়ক্রমে আল-কুরআন নাযিল করেছি।” [সূরা : আল্-ইনসান: ২৩]

এর পরে এ কথাই প্রত্যাশা করা হয় যে, আল্লাহ বলবেন: তাই আপনি এ কুরআন নাযিলের কারণে আল্লাহর নি‘আমতের শুকরিয়া আদায় করুন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলেছেন,

﴿ فَٱصۡبِرۡ لِحُكۡمِ رَبِّكَ وَلَا تُطِعۡ مِنۡهُمۡ ءَاثِمًا أَوۡ كَفُورٗا ٢٤ ﴾ [الانسان: ٢٤]

“অতএব তোমার রবের হুকুমের জন্য ধৈর্য ধারণ কর এবং তাদের মধ্য থেকে কোন পাপিষ্ঠ বা অস্বীকারকারীর আনুগত্য করো না।” [সূরা : আল্-ইনসান: ২৪]

এর দ্বারা একথাই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, যারাই এ কুরআনের খিদমত করবে তারা সবাই এমন সব জুলুম নির্যাতনের শিকার হবে যাতে মহা ধৈর্যধারণ করতে হবে। তাই দা‘য়ীকে মহাধৈর্যশীল হতে হবে এবং দাওয়াতী কার্যক্রম চালিয়ে যেতে হবে। পরিশেষে আল্লাহ তাকে বিজয় দান করবেন। এটা জরুরী নয় যে, আল্লাহ তাকে তার জীবদ্দশায়ই বিজয় দিবেন, বরং মূলকথা হলো মানুষের মাঝে যুগে যুগে দাওয়াত চালু থাকা। এখানে ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, বরং দাওয়াতই মূখ্য উদ্দেশ্য। তার মৃত্যুর পরেও যদি দাওয়াত অবশিষ্ট থাকে এটাই সফলতা। কেননা আল্লাহ তা‘য়ালা চিরঞ্জীব। তিনি বলেন,

﴿ أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُۥ نُورٗا يَمۡشِي بِهِۦ فِي ٱلنَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُۥ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ لَيۡسَ بِخَارِجٖ مِّنۡهَاۚ كَذَٰلِكَ زُيِّنَ لِلۡكَٰفِرِينَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٢٢ ﴾ [الانعام: ١٢٢]

“যে ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছি আলো, যার মাধ্যমে সে মানুষের মধ্যে চলে, সে কি তার মত যে ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না? এভাবেই কাফিরদের জন্য তাদের কৃতকর্ম সুশোভিত করা হয়”। [সূরা : আল-আন‘আম: ১২২]

প্রকৃতপক্ষে দা‘য়ীর জীবন স্বশরীরে জীবিত থাকা মূল লক্ষ্য নয়, বরং তার প্রচেষ্টা ও কথাবার্তা মানুষের মাঝে অবশিষ্ট্য থাকাটাই লক্ষ্য।

হিরাক্লিয়াসের সাথে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর ঘটনার প্রতি লক্ষ্য করুন। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আবির্ভাবের কথা আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে জানলেন। তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ব্যক্তিত্ব, বংশ, দাওয়াতী কার্যক্রম ও তাঁর সাহাবীদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাকে এসব সম্পর্কে অবগত করালে হিরাক্লিয়াস তাকে বললেন,

فَإِنْ كَانَ مَا تَقُولُ حَقًّا فَسَيَمْلِكُ مَوْضِعَ قَدَمَيَّ هَاتَيْنِ

“তুমি যা বলেছ তা যদি সত্য হয় তবে সে একদিন আমার পায়ের তলার এ দেশ পর্যন্ত বিজয় ও অধিকার করবেন”। [1]

সুবহানাল্লাহ! কে ভাববে যে, একজন মহাসম্রাট মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে এ ধরনের কথা বলেছে অথচ তিনি তখনও আরব উপদ্বীপকে শয়তান ও খারাপ মনোবৃত্তি থেকে মুক্ত করেন নি। কেউ কি কখনও চিন্তা করেছে এ ব্যক্তি এ ধরনের উক্তি করেছে? এজন্যই আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন সেখান থেকে বের হলেন তখন তিনি তাঁর সাথীদেরকে বললেন,

لَقَدْ أَمِرَ أَمْرُ ابْنِ أَبِي كَبْشَةَ، إِنَّهُ يَخَافُهُ مَلِكُ بَنِي الأَصْفَرِ.

“আমার মনে হয় আবু কাবশার পুত্রের মনোবাঞ্ছা যেন পুরা হয়ে যাবে। তাঁর মিশন এত শক্তিশালী হয়েছে যে, শ্বেতাঙ্গদের রাজা রোম সম্রাট পর্যন্ত তাঁকে ভয় করে”! এখানে «أمِر» অর্থ অনেক বড় হওয়া। যেমন আল্লাহর বাণীঃ

﴿ لَقَدۡ جِئۡتَ شَيۡ‍ًٔا إِمۡرٗا ٧١ ﴾ [الكهف: ٧١]

“আপনি অবশ্যই মন্দ কাজ করলেন’’। [সূরা : আল-কাহফ: ৭১]

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত হিরাক্লিয়াসের পায়ের তলার দেশ বিজয় ও অধিকার করেছিল, তিনি স্বশরীরে সে দেশ বিজয় করেন নি। কেননা তাঁর দাওয়াত সে দেশে পৌঁছেছিল এবং পৌত্তলিকতা, শিরক ও এর অনুসারীদেরকে ধুয়ে মুছে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করেছে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরে খোলাফায়ে রাশেদিনগণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দাওয়াত ও তাঁর শরি‘য়াতের দ্বারা সেদেশ বিজয় করেছেন। সুতরাং দা‘য়ীকে ধৈর্যধারণ করতে হবে এবং সে যদি আল্লাহর পথে সত্যিকারে দাওয়াত দেয় তবে তার জীবদ্ধশায় বা মৃত্যুর পরে হলেও শেষ পরিণতি তারই হবে।

﴿ إِنَّ ٱلۡأَرۡضَ لِلَّهِ يُورِثُهَا مَن يَشَآءُ مِنۡ عِبَادِهِۦۖ وَٱلۡعَٰقِبَةُ لِلۡمُتَّقِينَ ١٢٨ ﴾ [الاعراف: ١٢٨]

“নিশ্চয় যমীন আল্লাহর। তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে তিনি চান তাকে তার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেন। আর পরিণাম মুত্তাকীদের জন্য”। [সূরা : আল-আ‘রাফ: ১২৮]

﴿ إِنَّهُۥ مَن يَتَّقِ وَيَصۡبِرۡ فَإِنَّ ٱللَّهَ لَا يُضِيعُ أَجۡرَ ٱلۡمُحۡسِنِينَ ٩٠ ﴾ [يوسف: ٩٠]

“নিশ্চয় যে ব্যক্তি তাকওয়া অবলম্বন করে এবং সবর করে, তবে অবশ্যই আল্লাহ সৎকর্মশীলদের প্রতিদান বিনষ্ট করেন না”। [সূরা: ইউসুফ: ৯০]

[1] বুখারী, হাদীস নং ৭।