চতুর্থ মূলনীতি: কুরআন ও সুন্নাহর টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তা-ই যা টেক্সট বা ভাষ্যসমূহ সামনে আসার পর তৎক্ষণাৎ মাথায় আসে। এ বাহ্যিক অর্থ কনটেক্সট বা বাক্যের পূর্বাপর সম্পর্ক অনুযায়ী এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কথা অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

একই শব্দ এক কনটেক্সট-এ এক অর্থ দেয় আবার অন্য কনটেক্সট-এ অন্য অর্থ দেয়। শব্দমালার গাঁথুনি একভাবে হলে তার অর্থ হয় এক ধরনের আবার অন্যভাবে হলে তার অর্থ হয় অন্যধরনের।

যেমন আরবী القرية (আল কারইয়াহ) শব্দটির অর্থ কখনো হয় জাতি, আবার কখনো হয় বাড়িঘর যেখানে কোনো জাতির লোকেরা বসবাস করে।

প্রথম অর্থের উদাহরণ: আল্লাহ তা‘আলার বাণী:

﴿ وَإِن مِّن قَرۡيَةٍ إِلَّا نَحۡنُ مُهۡلِكُوهَا قَبۡلَ يَوۡمِ ٱلۡقِيَٰمَةِ أَوۡ مُعَذِّبُوهَا عَذَابٗا شَدِيدٗاۚ﴾ [الاسراء: ٥٨]

আর এমন কোনো জনপদ নেই, যা আমি কিয়ামতের দিনের পূর্বে ধ্বংস করব না অথবা যাকে কঠোর আযাব দেব না। (সূরা আল ইসরা: ১৭: ৫৮)

দ্বিতীয় অর্থের উদাহরণ আল্লাহ তা‘আলার বাণী, যা ইবরাহীমের মেহমান ফিরিশতাগণ বলেছিলেন:

﴿إِنَّا مُهۡلِكُوٓاْ أَهۡلِ هَٰذِهِ ٱلۡقَرۡيَةِۖ﴾ [العنكبوت: ٣١]

নিশ্চয় আমরা এ জনপদের অধিবাসীদের ধ্বংস করব। (সূরা আল আনকাবুত: ১৯: ৩১)

আরেকটি উদাহরণ: আপনি হয়তো বলবেন যে, ‘আমি এ জিনিসটি আমার দু‘হাত দিয়ে বানিয়েছি।’ এখানে আপনার দু‘হাত এবং আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে উল্লিখিত দু‘হাতের মধ্যে আদৌ কোনো সাদৃশ্য নেই। বাণীটি হলো এই:

﴿لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ﴾ [ص: ٧٥]

আমার দু’হাতে আমি যাকে সৃষ্টি করেছি। (সূরা সাদ: ৩৮: ৭৫)

আপনি যে বাক্যটি বলেছেন সেখানে ‘দু‘হাত’কে সৃষ্টিজীব মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব এখানে হাত বলতে তাই বুঝাবে যা সৃষ্টিজীবের জন্য উপযোগী। আর আল কুরআনের আয়াতে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করে দু‘হাতকে উল্লেখ করা হয়েছে। অতএব তা হবে এমন হাত যা সৃষ্টিকর্তার জন্য উপযোগী। সুতরাং স্বচ্ছ প্রকৃতি ও সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনো ব্যক্তিই এটা বলতে পারে না যে সৃষ্টিকর্তার হাত সৃষ্টিজীবের হাতের মতো অথবা এর উল্টো।

আরেকটি উদাহরণ এই যে, আপনি যদি বলেন: ‘আপনার কাছে তো শুধু যায়েদ।’ এবং ‘যায়েদ তো শুধু আপনার কাছে।’ তাহলে উভয় বাক্যের শব্দমালা অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও অর্থের দিক থেকে আলাদা। প্রথম বাক্যের অর্থ হলো যে আপনার কাছে যায়েদ ছাড়া অন্যকোনো মানুষ নেই। আর দ্বিতীয় বাক্যের অর্থ হলো, যায়েদ কোথাও নেই তবে আপনার কাছে। যায়েদের সঙ্গে আপনার কাছে অন্যান্য লোকজনও থাকতে পারে। অতএব শব্দের ঘটন-কাঠামোর কারণে অর্থের ভিন্নতা আসে এ বিষয়টি স্পষ্ট।

এ আলোচনার পর বলব যে, সিফাত-কেন্দ্রিক টেক্সট বা ভাষ্যসমূহের বাহ্যিক অর্থ তাই যা এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো দেখামাত্র মস্তিষ্কে আসে। আর এ ক্ষেত্রে মানুষ তিন দলে বিভক্ত হয়েছে:

প্রথম দল: এ টেক্সট বা ভাষ্যগুলো থেকে যে বাহ্যিক অর্থ বুঝা যায় সে অর্থকেই আল্লাহর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতিতে আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করেছে এবং এ টেক্সটগুলোর অর্থনির্দেশ এখানেই সীমিত রেখেছে। এই দলটি হলো সালাফে সালেহীনদের দল; যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ যার ওপর ছিলেন তার ওপর একত্র হয়েছেন। যারা প্রকৃত অর্থে আহলে সুন্নত ওয়াল জামা‘আত খেতাবে ভূষিত এবং এ খেতাবটি কেবল তাদের জন্যই।

তাঁরা উল্লিখিত বক্তব্যের ওপর ঐকমত্য পোষণ করেছেন। যেমন ইবনে আবদিল বার র. বলেন, ‘আহলে সুন্নাত আল কুরআন ও সুন্নায় যেসব সিফাত উল্লিখিত হয়েছে তা স্বীকার করে নেওয়া ও তার ওপর ঈমান আনার ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করেছেন। তারা উক্ত সিফাতগুলোকে রূপক অর্থে নয় বরং প্রকৃত অর্থে বহন করার ব্যাপারেও একমত হয়েছেন। তবে তারা কোনো অর্থেরই আকার-প্রকৃতি নির্ধারণ করেন না।

কাজী আবু ইয়া‘লা তার কিতাব ‘ইবতালুত তাবিল’ এ উল্লেখ করেন, ‘এই সংবাদগুলো [অর্থাৎ সিফাত-বিষয়ক টেক্সটগুলো] প্রত্যাখ্যান করা বৈধ নয়। এ ব্যাপারে তাবিল প্রক্রিয়ায় মশগুল হওয়াও বৈধ নয়। বরং এ টেক্সটগুলোকে তার বাহ্যিক অর্থে বহন করা ওয়াজিব এবং এটাও বিশ্বাস করা ওয়াজিব যে তা আল্লাহ তা‘আলার সিফাত; যা সৃষ্টিবস্তুর সিফাততুল্য নয়। আর এ ক্ষেত্রে ‘তাশবীহ’তেও বিশ্বাস করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে ইমাম আহমদ র. ও অন্যান্য ইমামগণ যেভাবে বলেছেন সেভাবেই বিশ্বাস করতে হবে। [ ইমাম ইবনে তাইমিয়াহ ইবনে আবদুল বার ও কাজী আবু ইয়ালা থেকে উক্ত বক্তব্য তার ‘আল ফাতওয়া আল হামুবিয়া’-এ উল্লেখ করেছেন। (দ্র: মাজমুউল ফাতাওয়া, খণ্ড ৫,পৃষ্ঠা ৮৭ -৮৯ )

এটাই হলো বিশুদ্ধ মাযহাব এবং প্রজ্ঞাপূর্ণ সোজা পথ। আর তা দু‘কারণে:

প্রথম কারণ: আল্লাহ তা‘আলার নাম ও সিফাত সম্পর্কে কুরআন-সুন্নাহয় যা এসেছে তার যথার্থ ও পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন এ পথেই সম্ভব। বস্তুনিষ্ঠ ও ইনসাফপূর্ণভাবে যে ব্যক্তি কুরআন-সুন্নায় এ বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান করবে তার সামনে এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্টাকারে ধরা পড়বে।

দ্বিতীয় কারণ: আমরা হয়তো বলব যে, সালাফগণ যা বলেছেন তাই হক ও সত্য অথবা বলব যে সালাফগণ ছাড়া অন্যান্যরা যা বলেছেন তা সত্য। বলার অপেক্ষা রাখে না যে দ্বিতীয় কথাটি বাতিল। কেননা দ্বিতীয় কথাটিকে বাতিল না বললে এর যুক্তিগত দাবি এটা দাঁড়ায় যে, সালাফগণ অর্থাৎ সাহাবী ও তাবে‘ঈগণ সরাসরি অথবা বাহ্যিকভাবে বাতিল কথা বলেছেন এবং একবারের জন্যও তারা সরাসরি ও বাহ্যিকভাবে যা বিশ্বাস করা ওয়াজিব এমন হক কথা বলেননি। এর অর্থ দাঁড়ায়, সালাফগণ হয়তো সত্য সম্পর্কে জাহেল ছিলেন অথবা সত্য তাদের জানা ছিল কিন্তু তারা তা গোপন করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে সালাফগণ উভয় বিষয় থেকেই পবিত্র ছিলেন। অতএব সত্য যে কেবল সালাফগণের সঙ্গেই এতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকল না।

দ্বিতীয় দল: যারা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থকে বাতিল করে দিয়েছেন এই ভেবে যে তা আল্লাহর জন্য উপযোগী নয়। আর এটাই হলো তাশবীহ তথা সাদৃশ্যকরণ। তারা তাশবীহনির্ভর অর্থকেই বহাল রেখেছেন। এ দলটিই হলো মুশাব্বিহাদের দল। এদের মতামত কয়েক কারণে বাতিল ও হারাম:

প্রথমত: এটা সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহের বিরুদ্ধে অন্যায় এবং তার যে অর্থ রয়েছে সেটাকে নাকচ করে দেওয়া। এটা কি করে বলা সঙ্গত যে এ টেক্সটসমূহকে বাহ্যিক অর্থের ওপর বহন করলে তা তাশবীহ হয়ে যায়, অথচ আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন:

﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ﴾ [الشورى: ١١]

তাঁর মত কিছু নেই। (সূরা আশ-শূরা: ৪২: ১১)

অর্থাৎ যারা এ টেক্সটসমূহের বাহ্যিক অর্থ বাতিল করে দেন তারা এই মনে করে বাতিল করে দেন যে বাহ্যিক অর্থগুলো সৃষ্টিজীবের সিফাতের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ। তাদের এ ধারণাটিই হলো মূলত তাশবীহ; কেননা আল্লাহর সিফাতের সঙ্গে সৃষ্টিজীবের সিফাতের আদৌ কোনো তুলনা হয় না। তারাই বরং এ ধরণের অযাচিত তুলনার আশ্রয় নেয়।

দ্বিতীয়ত: আকল-বুদ্ধি দ্বারা এটি স্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে সৃষ্টিকর্তা সত্তাগত এবং গুণগতভাবে সর্বদিক থেকেই সৃষ্টিজীব হতে সম্পূর্ণ আলাদা। অতএব সৃষ্টিকর্তার সিফাত সৃষ্টিজীবের সিফাতের সমতুল্য হবে এটা কিভাবে কল্পনা করা যায়?

তৃতীয়ত: মুশাব্বিহ বা ‘সাদৃশ্য স্থাপনকারী ব্যক্তি’ সিফাত-বিষয়ক টেক্সটসমূহ থেকে যা বুঝেছে তা সালাফ তথা উত্তম পূর্বপুরুষদের বুঝ থেকে ভিন্ন। অতএব তা বাতিল।