মানুষের মাঝে মর্যাদার আসন লাভ, আলোচনার পাত্র হওয়া, আর্থিক সুবিধা লাভ কিংবা শত্রুকে ভীতচকিত করার মানসে মিথ্যা স্বপ্ন বলার অভ্যাস কিছু মানুষের আছে। জনসাধারণের অনেকেই স্বপ্নে বিশ্বাসী। স্বপ্নের সাথে তাদের সম্পর্কে খুবই নিবিড়। তারা একে বাস্তাব মনে করে ও এ মিথ্যা স্বপ্ন দ্বারা প্রতারিত হয়। ফলে এসব মিথ্যা স্বপ্ন যে বলে বেড়ায় তার জন্য কঠোর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ مِنْ أَعْظَمِ الفِرَى أَنْ يَدَّعِيَ الرَّجُلُ إِلَى غَيْرِ أَبِيهِ، أَوْ يُرِيَ عَيْنَهُ مَا لَمْ تَرَ، أَوْ يَقُولُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا لَمْ يَقُلْ»
“সবচেয়ে বড় মনগড়া বা মিথ্যার মধ্যে রয়েছে ঐ ব্যক্তি, যে নিজেকে স্বীয় পিতা ব্যতীত অন্যের সন্তান হিসেবে আখ্যায়িত করে, যে স্বপ্ন সে দেখেনি তা দেখার দাবী করে এবং রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা বলেন নি তাঁর নামে তা বলে’।[1]
তিনি আরো বলেছেন,
«مَنْ تَحَلَّمَ بِحُلْمٍ لَمْ يَرَهُ كُلِّفَ أَنْ يَعْقِدَ بَيْنَ شَعِيرَتَيْنِ، وَلَنْ يَفْعَلَ»
“যে ব্যক্তি স্বপ্নে দেখে নি অথচ তা দেখার ভান বা দাবী করে তাকে দু’টি চুলে গিরা দিতে বাধ্য করা হবে; কিন্ত সে তা কখনই করতে পারবে না’।[2]দু’টি চুলে গিরা দেওয়া একটি অসাধ্য কাজ। সুতরাং কাজ যেমন হবে তার ফলও তেমন হবে।
>[2] সহীহ বুখারী; মিশকাত, হাদীস নং ৪৪৯৯।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَأَنْ يَجْلِسَ أَحَدُكُمْ عَلَى جَمْرَةٍ فَتُحْرِقَ ثِيَابَهُ، فَتَخْلُصَ إِلَى جِلْدِهِ، خَيْرٌ لَهُ مِنْ أَنْ يَجْلِسَ عَلَى قَبْرٍ»
“যদি তোমাদের কারো অঙ্গারের উপর বসার দরুন তার কাপড় পুড়ে দেহের চামড়া পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবুও তা তার জন্য কবরের উপর বসা থেকে উত্তম”। [1]
কবর পা দিয়ে মাড়ানোর কাজ অনেকেই করে থাকে। তারা যখন নিজেদের কাউকে কবরস্থানে দাফন করতে নিয়ে আসে, তখন দেখা যায় পার্শ্ববর্তী কবরগুলো মাড়াচ্ছে, কখনও আবার জুতা পায়ে মাড়াচ্ছে, কোনো পরোয়াই করছে না। অন্যান্য মৃতদের প্রতি যেন তাদের সম্মানবোধই নেই। অথচ এ সকল মৃত ব্যক্তির সম্মানে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَأَنْ أَمْشِيَ عَلَى جَمْرَةٍ، أَوْ سَيْفٍ، أَوْ أَخْصِفَ نَعْلِي بِرِجْلِي، أَحَبُّ إِلَيَّ مِنْ أَنْ أَمْشِيَ عَلَى قَبْرِ مُسْلِم»
“আগুনের অঙ্গার কিংবা তরবারির উপর দিয়ে আমার হেঁটে যাওয়া কিংবা আমার পায়ের চামড়া দ্বারা আমার চটি তৈরি করা একজন মুসলিমের কবরের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া থেকে আমার নিকট অধিক প্রিয়”।[2]
সুতরাং যে ব্যক্তি কোনো কবরস্থানের মালিক হয়ে সেখানে ব্যবসা কেন্দ্র কিংবা বাড়ী ঘর গড়ে তোলে তার অবস্থা কী দাঁড়াবে? কিছু লোকের কবরস্থানে পেশাব-পায়খানা করার অভ্যাস আছে। তাদের যখন পেশাব-পায়খানার প্রয়োজন দেখা দেয় তখন তারা কবর স্থানের প্রাচীর টপকিয়ে কিংবা খোলাস্থান দিয়ে ঢুকে পড়ে এবং মল-মূত্রের নাপাকী ও গন্ধ দ্বারা মৃতদের কষ্ট দেয়। কবরের উপর পেশাব-পায়খানা করা প্রসঙ্গে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«وَمَا أُبَالِي أَوَسْطَ الْقُبُورِ قَضَيْتُ حَاجَتِي، أَوْ وَسْطَ السُّوقِ»
‘কবরস্থানের মাঝে মল-মূত্র ত্যাগ করতে পারলে বাজারের মধ্যস্থলে মল-মূত্র ত্যাগের কোনো পরোয়া করি না”।[3]
অর্থাৎ কবরস্থানে মল-মূত্র ত্যাগের কদর্যতা আর বাজারের মধ্যে জনগণের সামনে সতর খোলা ও মল-মূত্র ত্যাগের কদর্যতা একই সমান। সুতরাং কবরস্থানে মল-মূত্র ত্যাগ গুনাহ তো বটেই এমনকি তা লোকালয়ে মল-মূত্র ত্যাগের ন্যায় লজ্জাকরও বটে।
আর যারা ইচ্ছে করে কবরস্থানে ময়লা-আবর্জনা ইত্যাকার জিনিস ফেলে তারাও এ ভৎর্সনায় শামিল হবে। এছাড়া কবর যিয়ারতকালে কবরসমূহের মাঝ দিয়ে যাতায়াতের সময় জুতা খুলে রাখাই আদবের পরিচয়।
>[2] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৫৭৬, সনদ সহীহ।
[3] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ১৫৬৭; সহীহুল জামে‘, হাদীস নং ৫০৩৮।
মানব প্রকৃতিকে পরিশুদ্ধ করার যত উপায়-উপকরণ আছে ইসলামী শরী‘আত তার সবই উপস্থাপন করেছে। এটি ইসলামের একটি বড় সৌন্দর্য। নাপাকী দূর করা এসব উপায়ের একটি। এ কারণেই ‘ইসতিনজা’ বা শৌচকার্য বিধিবদ্ধ করা হয়েছে এবং কীভাবে পাক-পবিত্রতা অর্জিত হবে তার নিয়ম বাতলে দেওয়া হয়েছে।
অনেকে নাপাকী দূরীকরণে অলসতা করে থাকে। যার ফলে তাদের কাপড় ও দেহ অপবিত্র হয়ে যায় এবং ফলশ্রুতিতে তাদের সালাত হয় না। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেটাকে কবর ‘আযাবের অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনার একটি খেজুর বাগানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন। সেখানে তিনি দু’জন (মৃত) ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শুনতে পান। কবরে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছিল। তা শুনে তিনি বললেন, এ দু’টো লোককে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বড় কোনো কারণে নয়। অবশ্য গুনাহ হিসেবে এগুলো কবীরা। তাদের একজন পেশাব শেষে পবিত্র হত না। আর অন্যজন চোগলখুরী করে বেড়াত”।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বরং এতদূর বলেছেন যে,
«أَكْثَرُ عَذَابِ الْقَبْرِ فِي الْبَوْلِ»
“বেশিরভাগ কবরের ‘আযাব পেশাবের কারণে হয়”।[2]
পেশাবের ফোঁটা বন্ধ না হতেই যে দ্রুত পেশাব থেকে উঠে পড়ে কিংবা এমন কায়দায় বা স্থানে পেশাব করে যেখান থেকে পেশাবের ছিঁটা এসে গায়ে বা কাপড়ে লাগে সেও এ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হবে।
কাফেরদের দেখাদেখি আমাদের মধ্যে অনেকস্থানেই দেওয়ালের সঙ্গে সেঁটে টয়লেট তৈরি করা হয়। এগুলো খোলামেলাও হয়। মানুষ কোনো লজ্জা-শরম না করেই চলাচলকারী মানুষের সামনে সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে শুরু করে। তারপর পেশাবের নাপাকী সমেতই কাপড় পরে নেয়। এতে দু’টি বিশ্রী হারাম একত্রিত হয়।
এক. সে তার লজ্জাস্থানকে মানুষের দৃষ্টি থেকে হিফাযত করে না। দুই. সে পেশাব থেকে পবিত্রতা অর্জন করে না।
>[2] মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ৮৩১৩; সহীহ তারগীব, হাদীস নং ১৫৮।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَ لَا تَجَسَّسُواْ ﴾ [الحجرات: ١٢]
“তোমরা গোয়েন্দাগিরি করো না”। [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১২]
অনুরূপ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنِ اسْتَمَعَ إِلَى حَدِيثِ قَوْمٍ، وَهُمْ لَهُ كَارِهُونَ، أَوْ يَفِرُّونَ مِنْهُ، صُبَّ فِي أُذُنِهِ الآنُكُ يَوْمَ القِيَامَةِ»
“যে ব্যক্তি লোকদের অনীহা বা তার কাছ থেকে পালানো সত্ত্বেও তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে ক্বিয়ামতের দিন তার দু’কানে গলিত সীসা ঢেলে দেওয়া হবে”।[1]
আর যদি ক্ষতি করার মানসে তাদের থেকে শোনা কথা তাদের অগোচরে মানুষের নিকট বলে বড়োয়, তাহলে গোয়েন্দাগিরি পাপের সাথে কুটনামির পাপও জড়িত হবে। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَا يَدْخُلُ الجَنَّةَ قَتَّاتٌ»
“ক্বাত্তাত বা চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না”।[2]
>[2] সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস নং ৪৮২৩।
প্রতিবেশীদের সাথে সদ্ব্যবহারের প্রতি জোর তাকীদ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗا وَبِذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡيَتَٰمَىٰ وَٱلۡمَسَٰكِينِ وَٱلۡجَارِ ذِي ٱلۡقُرۡبَىٰ وَٱلۡجَارِ ٱلۡجُنُبِ وَٱلصَّاحِبِ بِٱلۡجَنۢبِ وَٱبۡنِ ٱلسَّبِيلِ وَمَا مَلَكَتۡ أَيۡمَٰنُكُمۡۗ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يُحِبُّ مَن كَانَ مُخۡتَالٗا فَخُورًا ٣٦﴾ [النساء: ٣٦]
“তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কাউকে শরীক করো না এবং মাতা-পিতার সঙ্গে সদাচরণ কর। আর সদাচরণ কর নিকটাত্মীয়, অনাথ, নিঃস্ব, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, পার্শ্বস্থিত সঙ্গী, পথিক ও তোমাদের অধিকারভূক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাদের ভালোবাসেন না যারা গর্বে স্ফীত অহংকারী”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৩৬]
প্রতিবেশীর হক অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিধায় তাকে কষ্ট দেওয়া হারাম। আবু শুরাইহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, একদা রাসুলু্ল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«واللهِ لا يُؤْمِنُ، واللهِ لا يُؤْمِنُ، وَاللهِ لا يُؤْمِنُ".قيلَ: وَمَنْ يا رَسولَ اللهِ؟ قالَ: "الَّذِي لا يأْمَنُ جارُهُ بَوائِقَهُ».
“আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়, আল্লাহর শপথ সে মুমিন নয়। জিজ্ঞেস করা হল, কে সে জন ইয়া রাসুলুল্লাহ? তিনি বললেন, যার প্রতিবেশী তার অত্যাচার থেকে নিরাপদে থাকতে পারে না”।[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামএক প্রতিবেশী কর্তৃক অন্য প্রতিবেশীর প্রশংসা ও নিন্দা করাকে ভালো ও মন্দ আচরণের মাপকাঠি গণ্য করেছেন। এ প্রসঙ্গে ইবন মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এক ব্যক্তি বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ভালো আচরণ করলাম না মন্দ আচরণ করলাম -তা কী করে বুঝব? তিনি বললেন,
«إِذَا سَمِعْتَ جِيرَانَكَ يَقُولُونَ: أَنْ قَدْ أَحْسَنْتَ، فَقَدْ أَحْسَنْتَ، وَإِذَا سَمِعْتَهُمْ يَقُولُونَ: قَدْ أَسَأْتَ، فَقَدْ أَسَأْتَ»
“যখন তুমি তোমার প্রতিবেশীদেরকে বলতে শুনবে যে, তারা তোমার সম্পর্কে বলাবলি করছে, ‘তুমি ভালো আচরণ করে থাক’ তখন বুঝবে, তুমি নিশ্চয় ভালো আচরণ করছ। আর যখন তাদেরকে বলাবলি করতে শুনবে যে, ‘তুমি মন্দ আচরণ করে থাক’, তখন বুঝবে, তুমি নিশ্চয় মন্দ আচরণ করছ”।[2]
প্রতিবেশীর সঙ্গে মন্দ আচরণ নানাভাবে হতে পারে। যেমন, প্রতিবেশীর সাথে যৌথভাবে নির্মিত বাড়ীর প্রাচীরের উপর কাঠ কিংবা বাঁশ পুঁততে বাধা দেওয়া, প্রতিবেশীর অনুমতি না নিয়ে তার বাড়ী থেকে নিজ বাড়ীকে উঁচু বা বহুতল করে তার বাড়ীতে লোকদের সতর দেখতে চেষ্টা করা, বিরক্তিকর শব্দ দ্বারা তাকে কষ্ট দেওয়া, বিশেষ করে ঘুম ও আরামের সময়ে চেঁচামেচি ও খটখট আওয়াজ করা, প্রতিবেশীর সন্তানদের মারধোর করা কিংবা তার বাড়ীর দরজায় ময়লা-আবর্জনা ফেলা ইত্যাদি।
তাছাড়া প্রতিবেশীর হকের ওপর চড়াও হলে পাপের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«لَأَنْ يَزْنِيَ الرَّجُلُ بِعَشْرَةِ نِسْوَةٍ، أَيْسَرُ عَلَيْهِ مِنْ أَنْ يَزْنِيَ بِامْرَأَةِ جَارِهِ "، ... لَأَنْ يَسْرِقَ الرَّجُلُ مِنْ عَشْرَةِ أَبْيَاتٍ، أَيْسَرُ عَلَيْهِ مِنْ أَنْ يَسْرِقَ مِنْ جَارِهِ»
“কোনো ব্যক্তির পক্ষে অন্য দশজন মহিলার সঙ্গে ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া স্বীয় প্রতিবেশীর স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচারের তুলনায় অনেক সহজ। অনুরূপভাবে অন্য দশ বাড়ীতে চুরি করা কোনো ব্যক্তির স্বীয় প্রতিবেশীর বাড়ীতে চুরি করা অপেক্ষা অনেক সহজ”।[3]অনেক অসাধূ ব্যক্তি আছে, যারা প্রতিবেশীর অনুপস্থিতির সুযোগে রাতে তাদের গৃহে প্রবেশ করে এবং অপকর্মে লিপ্ত হয়। এসব লোকের জন্য এক বিভীষিকাময় দিনের শাস্তি অপেক্ষা করছে।
>[2] ইবন মাজাহ; মিশকাত, হাদীস নং ৪৯৮৮।
[3] মুসনাদে আহমদ, হাদীস নং ২৩৯০৫; সিলসিলা সহীহাহ, হাদীস নং ৬৫।
শরী‘আতের একটি অন্যতম নীতি হচ্ছে, «لا ضرر ولا ضرار» ‘নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হব না’ অন্যের ক্ষতি করব না’।[1] এ জাতীয় ক্ষতি করার একটি উপমা হলো, শরী‘আত স্বীকৃত ওয়ারিসগণের সবাইকে অথবা বিশেষ কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা। কেউ এমন করলে সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রদত্ত কঠিন সাবধান বাণীর আওতায় পড়বে। তিনি বলেছেন,
«مَنْ ضَارَّ أَضَرَّ اللَّهُ بِهِ، وَمَنْ شَاقَّ شَاقَّ اللَّهُ عَلَيْهِ»
“যে কারো ক্ষতি করবে আল্লাহ তা‘আলা তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেন। আর যে শত্রুতা ও কষ্টে ফেলবে আল্লাহ তাকে দুঃখ-কষ্টে নিপতিত করবেন”।[2]
অসিয়তের মাধ্যমে নানাভাবে ক্ষতি হতে পারে। যেমন, কোনো ওয়ারিসকে তার ন্যায্য অংশ থেকে বঞ্চিত করা অথবা একজন ওয়ারিসকে শরী‘আত যেটুকু দিয়েছে তার বিপরীতে তার জন্য অসিয়ত করা কিংবা এক তৃতীয়াংশের বেশি অসিয়ত করা ইত্যাদি। যে সব দেশে ইসলামী বিচার ব্যবস্থা চালু নেই সেখানে একজন পাওনাদার অনেক ক্ষেত্রেই মানব রচিত বিধানের কারণে তার শরী‘আত প্রদত্ত অধিকার লাভে সমর্থ হয় না। মানব রচিত বিচার ব্যবস্থা তাকে উকিলের মাধমে লিখিত অন্যায় অসীয়ত কার্যকর করতে আদেশ দেয় এবং সে তা কার্যকর করতে বাধ্য হয়। সুতরাং বড়ই পরিতাপ তাদের স্বহস্তে রচিত আইনের জন্য এবং বড়ই পরিতাপ তারা যে পাপ কামাই করছে তার জন্য!
>[2] সুনান আবু দাউদ, ইবন মাজাহ; মিশকাত, হাদীস নং ৫০৪২।
লোকসমাজে প্রচলিত অনেক খেলাধুলার সাথেই হারাম জড়িত আছে। দাবা এমনই একটি খেলা। দাবা থেকে আরো অনেক রকম খেলার প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয়। যেমন, পাশা খেলা প্রভৃতি। জুয়া ও বাজির দ্বার উন্মোচনকারী এ দাবা সম্পর্কে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন,
«مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدَشِيرِ، فَكَأَنَّمَا صَبَغَ يَدَهُ فِي لَحْمِ خِنْزِيرٍ وَدَمِهِ»
“যে ব্যক্তি দাবা খেলে সে যেন শুকরের রক্ত-মাংসে স্বীয় হাত রঞ্জিত করে”।[1]
আবু মূসা আশ‘আরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«مَنْ لَعِبَ بِالنَّرْدِ فَقَدْ عَصَى اللَّهَ وَرَسُولَهُ»
“যে ব্যক্তি দাবা খেলে, সে আল্লাহ ও তার রাসূলের বিধানকে অমান্য করে”।[2]
সুতরাং দাবা ও তার আনুসঙ্গিক খেলা যেমন তাস, পাশা, ফ্লাশ ইত্যাদি সম্বন্ধে অবশ্যই শরী‘আতের আদেশ মানতে হবে।
[2] মুসনাদে আহমদ; সুনান আবু দাউদ; মিশকাত, হাদীস নং ৪৫০৫।
অনেকেই রাগের সময় জিহবাকে সংযত রাখতে পারে না। ফলে বেদিশা হয়ে লা‘নত করে বসে। তাদের লা‘নতের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মানুষ, পশু, জড় পদার্থ, দিন-ক্ষণ এমনকি নিজের সন্তান-সন্ততিদেরও তারা লা‘নত করে বসে। দেখা যায়, স্বামী স্বীয় স্ত্রীকে লা‘নত করে, আবার স্ত্রীও স্বামীকে লা‘নত করে। এটি একটি মারাত্মক অন্যায়। আবু যায়েদ সাবিত ইবন দাহহাক আনসারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
وَمَنْ لَعَنَ مُؤْمِنًا فَهُوَ كَقَتْلِهِ، وَمَنْ قَذَفَ مُؤْمِنًا بِكُفْرٍ فَهُوَ كَقَتْلِهِ»
“যে ব্যক্তি কোনো মুমিনকে লা‘নত করল বা কাফের বলে গালি দিল, সে যেন তাকে হত্যা করল’।[1]
মহিলাদেরকে বেশি বেশি লা‘নত করতে দেখা যায়। এজন্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদের জাহান্নামী হওয়ার নানা কারণের মধ্যে এটি একটি বলে উল্লেখ করেছেন।[2]
এমনিভাবে লা‘নতকারীরা কিয়ামত দিবসে সুপারিশকারীও হতে পারবে না।সবচেয়ে ভয়াবহ ব্যাপার এ যে, অন্যায়ভাবে লা‘নত করলে তা লা‘নতকারীর ওপর বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। তাতে লা‘নতকারী মূলতঃ নিজকেই আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত করার জন্য প্রার্থনাকারী হয়ে দাঁড়ায়।
>[2] সহীহ বুখারী; সহীহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস নং ১৯।
অনেক মহিলা আছে যারা চেঁচিয়ে কাঁদে, মৃতের গুণাবলী উল্লেখ করে মাতম করে, গালে-মুখে থাপ্পড় মারে -এগুলো বড় অন্যায়। অনুরূপভাবে কাপড় ও পকেট ছিঁড়ে, চুল উপড়িয়ে, বেনী বেঁধে বা জড়িয়ে ধরে বিলাপ করাও মহা অন্যায়। এতে আল্লাহর ফায়ছালার প্রতি অসন্তোষ ও বিপদে অধৈর্যের পরিচয় মেলে। যে এমন করবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার প্রতি লা‘নত করেছেন। এ সম্পর্কে আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، «لَعَنَ الْخَامِشَةَ وَجْهَهَا، وَالشَّاقَّةَ جَيْبَهَا، وَالدَّاعِيَةَ بِالْوَيْلِ وَالثُّبُورِ»
“রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখমণ্ডল ক্ষত-বিক্ষতকারিণী, পকেট বিদীর্ণকারী এবং দুর্ভোগ ও ধ্বংস প্রার্থনাকারিণীর ওপর লা‘নত করেছেন”।[1]
ইবন মাস’উদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন,
«لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَطَمَ الخُدُودَ، وَشَقَّ الجُيُوبَ، وَدَعَا بِدَعْوَى الجَاهِلِيَّةِ»
“যে গালে থাপ্পড় মারে, পকেট ছিঁড়ে ফেলে ও জাহেলিয়াতের রীতি-নীতির প্রতি আহ্বান জানায় সে আমাদের দলভুক্ত নয়”।[2]
তিনি আরো বলেছেন,
«النَّائِحَةُ إِذَا لَمْ تَتُبْ قَبْلَ مَوْتِهَا، تُقَامُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَعَلَيْهَا سِرْبَالٌ مِنْ قَطِرَانٍ، وَدِرْعٌ مِنْ جَرَبٍ»
“মাতমকারিণী মৃত্যুর পূর্বে তাওবা না করলে কিয়ামত দিবসে তাকে আলকাতরার পাজামা ও খোস-পেঁচড়াযুক্ত বর্ম পরিহিতা অবস্থায় তোলা হবে”।[3]সুতরাং কারো মৃত্যু বা বিপদে বিলাপ-মাতম ও আহাজারী করা বড়ই অন্যায়।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১২৯৪।
[3] সহীহ মুসলিম; মিশকাত, হাদীস নং ১৭২৭।
জাবির রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«نَهَى رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، عَنِ الضَّرْبِ فِي الْوَجْهِ، وَعَنِ الْوَسْمِ فِي الْوَجْهِ»
“রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখমণ্ডলে আঘাত করতে এবং মুখমণ্ডলে দাগ দিতে নিষেধ করেছেন”।[1]
মুখমণ্ডলে আঘাতের বিষয়টি কিছু মাতা-পিতা ও শিক্ষকদের থেকে বেশি প্রত্যক্ষ করা যায়। তারা সন্তানদের বা ছাত্রদের শাসন করার জন্য হাত কিংবা অন্য কিছু দ্বারা মুখমণ্ডলে মেরে থাকে। অনেকে বাড়ীর চাকরদের সাথে এরূপ করে থাকে। এতে আল্লাহ তা”আলা যে চেহারার বদৌলতে মানুষকে সম্মানিত করেছেন তাকে অমর্যাদা করার সাথে সাথে অনেক সময় মুখমণ্ডলের কোনো একটি ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে পড়তে পারে। ফলে অনুশোচনা ছাড়াও ক্ষেত্রবিশেষে কিসাস দেওয়া লাগতে পারে।পশুর মুখমণ্ডলে দাগ দেওয়া কাজটি পশু মালিকদের সাথে জড়িত। তারা স্ব স্ব পশু চেনা ও হারিয়ে গেলে ফিরে পাওয়ার জন্য পশুগুলোর মুখে দাগ দিয়ে থাকে। এটা হারাম। এতে পশুর চেহারা ক্ষত করা ছাড়াও তাকে কষ্ট দেওয়া হয়। কেউ যদি দাবী করে যে, এরূপ দাগ দেওয়া তাদের গোত্রের একটি রীতি এবং গোত্রের বিশেষ চিহ্ন, তাহলে এটুকু করার অবকাশ থাকতে পারে যে শরীরের অন্য কোথাও দাগ বা কোনো চিহ্ন দিবে; মুখমণ্ডলে নয়।
>