মুখতাসারুল ফাওয়ায়েদ (ইবনুল কাইয়্যেম রহ.-এর আল-ফাওয়ায়েদ অবলম্বনে) ইসলামহাউজ.কম ৮১ টি
মুখতাসারুল ফাওয়ায়েদ (ইবনুল কাইয়্যেম রহ.-এর আল-ফাওয়ায়েদ অবলম্বনে) ইসলামহাউজ.কম ৮১ টি
গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা: কীভাবে কুরআনের দ্বারা উপকৃত হওয়া যায়?

তুমি কুরআনের দ্বারা উপকৃত হতে হলে কুরআন তিলাওয়াত ও শ্রবণের সময় মনোনিবেশ করো, নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করো এবং যিনি কুরআনে তোমাকে সম্বোধন করে তোমার সাথে কথা বলছেন সে মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিতি অনুভব করো। কেননা কুরআন তোমার জন্য রাসূলের জবানে আল্লাহর সম্বোধন ও বার্তা। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ وَهُوَ شَهِيدٞ٣٧﴾ [ق: ٣٧]

“নিশ্চয় এতে উপদেশ রয়েছে তার জন্য, যার রয়েছে অন্তর অথবা যে নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] কুরআনের পূর্ণ প্রভাব (উপকার বা উপদেশ) লাভ করা যেহেতু প্রভাবকারী, প্রভাব বিস্তারের স্থান, প্রভাব লাভের শর্ত ও উপকার লাভ থেকে বাধামুক্ত হওয়ার ওপর নির্ভরশীল, সেহেতু উপরোক্ত আয়াতে সংক্ষিপ্তসারে কিন্তু পূর্ণাঙ্গরূপে এসব কিছু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿إِنَّ فِي ذَٰلِكَ لَذِكۡرَىٰ﴾ [ق: ٣٧]

“নিশ্চয় এতে (কুরআনে) উপদেশ রয়েছে তার জন্য।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] সূরার শুরু থেকে এ পর্যন্ত অংশে কুরআনের প্রভাবের কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বাণী,

﴿لِمَن كَانَ لَهُۥ قَلۡبٌ﴾ [ق: ٣٧]

“যার রয়েছে অন্তর।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] এটি প্রভাব (উপকার) গ্রহণের স্থান। এখানে ক্বলব দ্বারা জীবন্ত অন্তরকে বুঝানো হয়েছে, যে অন্তর আল্লাহকে চেনে ও জানে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنۡ هُوَ إِلَّا ذِكۡرٞ وَقُرۡءَانٞ مُّبِينٞ ٦٩ لِّيُنذِرَ مَن كَانَ حَيّٗا٧٠﴾ [يس: ٦٩، ٧٠]

“এ তো কেবল এক উপদেশ ও স্পষ্ট কুরআন মাত্র। যাতে তা সতর্ক করতে পারে ঐ ব্যক্তিকে যে জীবিত।” [সূরা ইয়াসীন, আয়াত: ৬৯-৭০] অর্থাৎ যার অন্তর জীবিত।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿أَوۡ أَلۡقَى ٱلسَّمۡعَ ٣٧﴾ [ق: ٣٧]

“অথবা যে নিবিষ্টচিত্তে শ্রবণ করে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] অর্থাৎ সে শ্রবণে মনোনিবেশ করে এবং যা কিছু বলা হয় তা কান লাগিয়ে শোনে। কথা দ্বারা প্রভাবান্বিত হওয়ার এটি অন্যতম শর্ত।

আল্লাহ তা‘আলার বাণী,

﴿وَهُوَ شَهِيدٞ٣٧﴾ [ق: ٣٧]

“সে অন্তরসহ উপস্থিত।” [সূরা কাফ, আয়াত: ৩৭] অর্থাৎ তার অন্তর সেখানে উপস্থিত, সে মনের দিকে অনুপস্থিত নয়।

ইবন কুতাইবা রহ. বলেছেন, “আল্লাহর কিতাব নিবিষ্টচিত্তে ও বুঝে-শুনে শ্রবণ করো, গাফিল ও অন্যমনস্ক হয়ে নয়। এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, কেউ গাফিল ও অমনোযোগী হয়ে তিলাওয়াত করলে তা কুরআনের উপকার অর্জনে বাধাদানকারী হয়ে যায়। কুরআনে তাকে যা বলা হয়েছে তা না বুঝে, এতে চিন্তা-গবেষণা না করে ভুলোমন ও অমনোযোগী হয়ে পড়লে কুরআন উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকবে।

অতএব, প্রভাববিস্তারকারী (কুরআন) যখন প্রভাববিস্তারের স্থান (অর্থাৎ জীবন্ত অন্তর), প্রভাব বিস্তারের শর্ত (অর্থাৎ মনোযোগ সহকারে শ্রবণ), প্রভাববিস্তারে বাধামুক্ত (তথা অন্তরকে কুরআনের সম্বোধন অনুধাবনে ব্যস্ত রাখা ও অন্য কাজ থেকে বিরত থাকা) সবকিছু একত্রে অর্জিত হলে কুরআনের প্রভাব তথা উপকার ও উপদেশ অর্জিত হবে।

এ সূরাতে ঈমানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলনীতি সন্নিবেশিত হয়েছে যা ব্যক্তির জন্য যথেষ্ট এবং অন্য কিছু থেকে তাকে অমুখাপেক্ষী করে। কেননা এতে সৃষ্টির শুরু, পুনরুত্থান, তাওহীদ, নবুওয়াত, ফিরিশতাদের প্রতি ঈমান, মানুষকে সৌভাগ্যবান ও দুর্ভাগ্যবান দুদলে বিভক্ত করা এবং এ দু’দলের বিবরণ আলোচনা করা হয়েছে।

    এতে দু’টি কিয়ামত তথা কিয়ামতে সুগরা (ছোট কিয়ামত তথা মৃত্যু) ও কিয়ামতে কুবরা (বড় কিয়ামত বা মৃত্যুর পর পুনরুত্থান) এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
    দুটি আলাম (জগতের) তথা বড় জগত বা আখিরাত ও ছোট জগত বা দুনিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
    মানব সৃষ্টি, তাদের মৃত্যু, পুনরুত্থান, মৃত্যুর সময় তাদের অবস্থা, হাশরের দিনের অবস্থা, সবকিছু সবদিক থেকে আল্লাহর বেষ্টনীতে; এমনকি তাদের অন্তরের ওয়াসওয়াসা (কুমন্ত্রণা) পর্যন্ত তাঁর জ্ঞাত থাকা, মানুষের ওপর রক্ষণাবেক্ষণকারী নিযুক্ত করা, তারা যা কিছু বলে সব কিছুই সংরক্ষণ করে রাখা; আর কিয়ামতের দিন তিনি তাকে যথাযথ পুরস্কার প্রদান, সেদিন সে উপস্থিত হবে, তার সাথে থাকবে একজন চালক, যিনি তাকে আল্লাহর দিকে চালিয়ে নিয়ে যাবেন, আরও থাকবে একজন সাক্ষী, যিনি তার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিবেন। যখন তার চালক তাকে উপস্থিত করবে তখন সে বলবে,

﴿هَٰذَا مَا لَدَيَّ عَتِيدٌ٢٣﴾ [ق: ٢٣]

“এই তো আমার কাছে (আমল নামা) প্রস্তুত।” [সূরা কাফ, আয়াত: ২৩] অর্থাৎ এ আমলনামা প্রস্তুত করতে আমি আদিষ্ট ছিলাম, আজ আমি তা প্রস্তুত করেছি। আমলনামা উপস্থিত করলে তাকে বলা হবে,

﴿أَلۡقِيَا فِي جَهَنَّمَ كُلَّ كَفَّارٍ عَنِيدٖ٢٤﴾ [ق: ٢٤]

“তোমরা জাহান্নামে নিক্ষেপ করো প্রত্যেক উদ্ধত কাফিরকে।” [সূরা কাফ, আয়াত: ২৪] যেভাবে অপরাধীকে বাদশার সামনে উপস্থিত করে বলা হয়, অমুককে আমি তার কৃতকর্মসহ উপস্থিত করেছি, তখন বাদশা বলেন, তাকে জেলখানায় নিয়ে যাও এবং তার অপরাধ অনুযায়ী তাকে শাস্তি দাও।

গুরুত্বপূর্ণ ফায়েদা: আল্লাহ জমিনকে মানুষের উপকারার্থে নিয়োজিত করে দিয়েছেন

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿هُوَ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ ذَلُولٗا فَٱمۡشُواْ فِي مَنَاكِبِهَا وَكُلُواْ مِن رِّزۡقِهِۦۖ وَإِلَيۡهِ ٱلنُّشُورُ١٥﴾ [الملك: ١٥]

“তিনিই তো তোমাদের জন্য জমিনকে সুগম করে দিয়েছেন, কাজেই তোমরা এর পথে-প্রান্তরে বিচরণ করো এবং তাঁর রিযিক থেকে তোমরা আহার করো। আর তাঁর নিকটই পুনরুত্থান।” [সূরা আল-মুলক, আয়াত: ১৫]

আল্লাহ এ আয়াতে বলেছেন, তিনি জমিনকে মানুষের জন্য সুগম করে দিয়েছেন, তাদের জন্য নিয়োজিত করেছেন যাতে তারা তাতে হাঁটতে পারে, খনন করতে পারে, ফাটাতে পারেন ও এর উপর ঘর-বাড়ি বানাতে পারেন। তিনি জমিনকে এমন কঠিন ও অনুপযোগী করেন নি, যাতে কেউ এতে আবাদের কাজ করতে চাইলে তা বাধাগ্রস্ত হয়।

এ আয়াতের মূল উদ্দেশ্য হলো, আল্লাহ তা‘আলা জমিনকে অনুগত উটের ন্যায় অনুগত ও সুগম করে দিয়েছেন, যাতে জমিনকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে কাজে লাগানো করা যায়। মানাকিবিহা (مناكبها) বা জমিনের ঘাড় বলে, পথ-প্রান্তর ও সঙ্কীর্ণ উপত্যকাকে বুঝানো অতীব সুন্দর বলে বিবেচিত হয়েছে‍; কারণ এর আগে সেটাকে সুগম বলা হয়েছে। সুতরাং এসব পথ-প্রান্তর ও সঙ্কীর্ণ উপত্যকার ওপর পায়ে হেঁটে চলাচলকারী যেন এর ঘাঁড়ের উপর দিয়েই চলছে। কারণ মানুষের মানাকিব তথা ঘাঁড় হলো তার সর্বোচ্চ স্থান। আর তাই মানাকিব শব্দের ব্যাখ্যা কেউ কেউ পাহাড় করেছেন; যা মানুষের ঘাঁড়ের ন্যায়; যার অবস্থান তার সর্বোপরে।

কেউ কেউ বলেছেন, এতে এ কথার প্রতিও সতর্ক ইঙ্গিত রয়েছে যে, জমিনের সহজতর স্তরে (সমতলে) চলা মানাকিবে (পথ-প্রান্তর ও সঙ্কীর্ণ উপত্যকায়) চলার চেয়ে অধিকতর সহজ।

আরেকদল বলেছেন, মানাকিব (مناكب) হলো, পার্শ্ব ও কিনারা। যেমন (مناكبُ الإنسانِ لجوانبِهِ) মানুষের পার্শ্বদেশকে মানাকিব বলা হয়।

আমার মতে, মানাকিব দ্বারা উদ্দেশ্য হলো উপরিভাগ। এ হিসেবে জীব-জন্তু জমিনের উপরিভাগে চলাচল করে, এর নিম্নভাগে চলাচল করে না। কেননা ভূ-পৃষ্ঠের ছাদ হলো উপরিভাগ। আর চলাচল করে উপরিভাগে। মানাকিবকে ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগ বলে ব্যাখ্যা করা উত্তম, যেহেতু এর গুণ বর্ণনায় বলা হয়েছে এটি সুগম।

অতএব, এ আয়াতে কারীমা আল্লাহর রুবুবিয়্যাত, একত্ববাদ, কুদরত, হিকমত ও তাঁর সূক্ষ্ম সৃষ্টির প্রমাণ, তার নি‘আমত ও ইহসানের স্মরণ, দুনিয়ার দিকে ঝুঁকে যাওয়া ও একে স্থায়ী আবাস বানানো হতে সতর্কতা; বরং জান্নাতের দিকে এগিয়ে যেতে দুনিয়াতে অতিদ্রুত চলা ইত্যাদি শামিল করেছে। আল্লাহর জন্যই সব প্রশংসা, তিনি এ আয়াতে তাঁর পরিচয়, তাঁর তাওহীদ, তাঁর নি‘আমতের স্মরণ, তাঁরই দিকে প্রত্যাবর্তন, তাঁর সাথে সাক্ষাতের প্রস্তুতি, তাঁর কাছে ফিরে যাওয়া, তাঁর ঘোষণা তিনি এ দুনিয়াকে এমনভাবে গুটিয়ে নিবেন যেন তা আগে ছিলো না, এ দুনিয়ার অধিবাসীদেরকে মৃত্যুর পরে পুনঃজীবিত করবেন এবং তাঁরই কাছে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

ফায়েদা: মানুষের সৌভাগ্যের কারণসমূহ

মানুষের দু’ধরণের শক্তি রয়েছে। চিন্তা ও তত্ত্বগত জ্ঞান সম্বলিত শক্তি (قوَّةٌ علميَّةٌ نظريَّةٌ) এবং ইচ্ছা ও কর্মগত শক্তি (قوَّةٌ عَمليَّةٌ إراديَّةٌ)। মানুষের জ্ঞানগত ও ইচ্ছাগত শক্তির পূর্ণতার ওপরই তার পরিপূর্ণ সৌভাগ্য নির্ভর করে।

* আর মানুষ কর্তৃক তার সৃষ্টিকর্তাকে জানা, তাঁর নাম ও গুণাগুণসমূহ সর্ম্পকে অবগত হওয়া, যে পথে তাঁকে পাওয়া যায় সে পথ জানা, তার নিজের পরিচয় জানা ও নিজের দোষ-ত্রুটি সম্পর্কে অবগত হওয়া ইত্যাদির মাধ্যমে ইলমী শক্তি পরিপূর্ণ হয়। সুতরাং সর্বাধিক বিজ্ঞ ও জ্ঞানী লোক সে ব্যক্তি যে এগুলোর পরিচয় লাভ করে এবং এ গুলো সম্পর্কে অধিক জ্ঞান রাখে।

* আর মানুষ কর্তৃক তার ইচ্ছা ও কর্মগত শক্তি তখনই অর্জিন করবে, যখন সে তার রবের হকসমূহ যথার্থভাবে রক্ষা করবে, এ হকসমূহ ইখলাস, সততা, একনিষ্ঠতা, ইহসান ও অনুসরণের সাথে পালন করবে, তার ওপর তার রবেব অনুগ্রহসমূহের সাক্ষ্য দিবে, তাঁর হকসমূহ আদায়ে নিজের দুর্বলতা ও অক্ষমতা প্রকাশ করবে, তার দায়িত্ব পালনে অক্ষমতার জন্য সে অত্যন্ত লজ্জিত হবে। কেননা সে জানে যে, তার যতটুকু ইবাদত-বন্দেগী করা উচিৎ সে ততটুকু পালনে অক্ষম, নিতান্ত কম হকই সে আদায় করছে, অনেক অনেক কমই সে আদায় করছে।

বস্তুত তাঁর সাহায্য ব্যতীত এ দু’শক্তি পরিপূর্ণ করা অসম্ভব, সে সিরাতুল মুস্তাকিম তথা সরল সঠিক পথের হিদায়াত প্রাপ্ত হতে একান্তভাবে নিরুপায় হয়ে তার সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল, যে পথ তিনি তাঁর অলী ও বিশেষ প্রিয়জনকে পরিচালিত করেছেন। অনুরূপভাবে সে সরল সঠিক পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হয় এমন কাজ থেকে তাকে যেন বাঁচতে পারে (এতেও তার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল)। হয় তার ইলমী বা জ্ঞানগত শক্তি নষ্ট হয়ে যাবে, ফলে সে পথভ্রষ্ট হবে অথবা তার আমলী বা কর্মগত শক্তি বিনষ্ট হবে, ফলে তার ওপর আল্লাহর রাগ অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যাবে।

বস্তুত উপরোক্ত জিনিসগুলো অর্জিত না হলে মানুষের পূর্ণতা ও তার সৌভাগ্য কখনও পরিপূর্ণ হবে না। সূরা ফাতিহায় এ সব কিছু খুব সুন্দরভাবে ও পরিপূর্ণ সুশৃঙ্খল-রূপে একত্রিত হয়েছে।

সূরা ফাতিহার শুরুতে আল্লাহর রহমত, মধ্যভাগে তাঁর হিদায়াত ও শেষভাগে তাঁর নি‘আমতের কথা আলোচিত হয়েছে। আল্লাহর হিদায়াত লাভের অংশ অনুযায়ী বান্দা তাঁর নি‘আমত লাভ করবে, আবার তাঁর রহমত লাভের অংশ অনুযায়ী সে তাঁর হিদায়াত লাভ করবে। সুতরাং সব কিছুই তাঁর নি‘আমত ও রহমতের মধ্যেই ঘূর্ণায়মান। আর রহমত ও নি‘আমত আল্লাহর রুবুবিয়্যাতের আবশ্যকীয় গুণ। অতএব, যিনি রব হবেন তিনি রহমতদানকারী ও নি‘আমতদানকারী না হয়ে পারেন না। আর এ গুণগুলো আল্লাহর উলুহিয়্যাত বা তাঁর ইলাহ হওয়াকে বাধ্য করে। সুতরাং তিনিই সত্য ইলাহ, যদিও অস্বীকারকারীরা অস্বীকার করে এবং মুশরিকরা তাঁর সাথে শির্ক করে।

অতএব, যার মধ্যে সূরা ফাতিহার সম্পূর্ণ অর্থ জ্ঞানগত, পরিচিতিগত, কর্মগত ও অবস্থাগতভাবে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে সে-ই পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করবে, তার উবুদিয়্যাত বা দাসত্ব হবে আল্লাহর নি‘আমতপ্রাপ্ত বিশেষ লোকদের দাসত্বের মতো, যাদের মর্যাদা সাধারণ ইবাদতকারীদের চেয়ে অনেক ঊর্ধ্বে। আল্লাহই সাহায্যকারী।

আল-কুরআনে মহান রব দু’টি উপায়ে তাঁকে চেনার জন্য বান্দাদেরকে আহ্বান করেছেন। সে পদ্ধতি দু’টি হলো:

প্রথমত: তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া ও গভীরভাবে তাকানো।

দ্বিতীয়ত: তাঁর আয়াতসমূহে চিন্তা ও সেগুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা; তন্মধ্যে প্রথম প্রকার হলো তাঁর দৃশ্যমান আয়াত বা নিদর্শন আর দ্বিতীয় প্রকার হলো বিবেকগ্রাহ্য শ্রবণযোগ্য আয়াত বা নিদর্শন।

প্রথম প্রকারের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ وَٱلۡفُلۡكِ ٱلَّتِي تَجۡرِي فِي ٱلۡبَحۡرِ بِمَا يَنفَعُ ٱلنَّاسَ١٦٤﴾ [البقرة: ١٦٤]

“নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের বিবর্তনে, সে নৌকায় যা সমুদ্রে মানুষের জন্য কল্যাণকর বস্তু নিয়ে চলে (রয়েছে নিদর্শনসমূহ এমন জাতির জন্য, যারা বিবেকবান)।” [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৬৪] এ আয়াতের শেষ পর্যন্ত।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿إِنَّ فِي خَلۡقِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِ وَٱخۡتِلَٰفِ ٱلَّيۡلِ وَٱلنَّهَارِ لَأٓيَٰتٖ لِّأُوْلِي ٱلۡأَلۡبَٰبِ١٩٠﴾ [ال عمران: ١٩٠]

“নিশ্চয় আসমানসমূহ ও জমিনের সৃষ্টি এবং রাত ও দিনের বিবর্তনের মধ্যে রয়েছে বিবেকসম্পন্নদের জন্য বহু নিদর্শন।” [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১৯০] এ জাতীয় আয়াত আল-কুরআনে অনেক রয়েছে।

দ্বিতীয় প্রকারের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ ٱلۡقُرۡءَانَ٢٤﴾ [محمد : ٢٤]

“তবে কি তারা কুরআন নিয়ে গভীর চিন্তা- ভাবনা করে না?” [সূরা মুহাম্মাদ, আয়াত: ২৪]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿ أَفَلَمۡ يَدَّبَّرُواْ ٱلۡقَوۡلَ٦٨﴾ [المؤمنون : ٦٨]

“তারা কি এ বাণী সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে না?” [সূরা আল-মুমিনূন, আয়াত: ৬৮]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿كِتَٰبٌ أَنزَلۡنَٰهُ إِلَيۡكَ مُبَٰرَكٞ لِّيَدَّبَّرُوٓاْ ءَايَٰتِهِ٢٩﴾ [ص : ٢٩]

“আমি আপনার প্রতি নাযিল করেছি এক বরকতময় কিতাব, যাতে তারা এর আয়াতসমূহ নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করে।” [সূরা সোয়াদ, আয়াত: ২৯] এ ধরণের অনেক আয়াত রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿سَنُرِيهِمۡ ءَايَٰتِنَا فِي ٱلۡأٓفَاقِ وَفِيٓ أَنفُسِهِمۡ حَتَّىٰ يَتَبَيَّنَ لَهُمۡ أَنَّهُ ٱلۡحَقُّ٥٣﴾ [فصلت: ٥٣]

“বিশ্বজগতে ও তাদের নিজদের মধ্যে আমি তাদেরকে আমার নিদর্শনাবলী দেখাব যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, এটি (কুরআন) সত্য।” [সূরা ফুসসিলাত, আয়াত: ৫৩] অর্থাৎ আল-কুরআন সত্য। এ আয়াতে আল্লাহ বলেছেন যে, তিনি অবশ্যই তাদেরকে তার দৃশ্যমান সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী দেখাবেন যাতে তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয় যে, তিলাওয়াতকৃত এ কুরআন সত্য।

তারপর তিনি তাঁর দেওয়া সাক্ষ্যকেই তার পক্ষ থেকে আগত সকল সংবাদের সত্যতার জন্য যথেষ্ট বলে ঘোষণা করেছেন, কারণ; তিনি তাঁর রাসূলগণের সত্যতার ওপর যাবতীয় দলীল-প্রমাণ প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

অতএব, আল্লাহ তা‘আলার আয়াতসমূহ তাঁর সত্যতার প্রমাণ, আর আল্লাহ তা‘আলা স্বয়ং তাঁর রাসূলগণের আয়াতসমূহের সত্যতার ওপর প্রমাণ। তিনি নিজেই সাক্ষী ও সাক্ষ্য সাব্যস্তকৃত (সত্তা)। আর তিনি নিজেই প্রমাণ ও নিজের ওপর প্রমাণবহ। তিনি নিজেই নিজের জন্য দলীল। যেমন কোনো এক বিজ্ঞলোক বলেছেন, ‘কীভাবে আমি তাঁর (আল্লাহর) প্রমাণ তালাশ করবো যিনি নিজেই আমার কাছে সব কিছুর জন্য প্রমাণ? তাঁর ব্যাপারে যে দলীলই তালাশ করি, তাঁর অস্তিত্ব সে গুলোর চেয়ে অধিক স্পষ্ট।’

এ কারণেই রাসূলগণ তাদের জাতির কাছে বলেছিলেন,

﴿أَفِي ٱللَّهِ شَكّٞ﴾ [ابراهيم: ١٠]

“(তাদের রাসূলগণ বলেছিল), আল্লাহর ব্যাপারেও কি সন্দেহ?” [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১০] তিনি তো সব জ্ঞাত বিষয়ের চেয়ে অধিক জ্ঞাত, সব দলিলের চেয়ে অধিক স্পষ্ট। প্রকৃতপক্ষে সব বস্তু তাঁর (আল্লাহর) দ্বারাই চেনা যায়, যদিও তাঁর কাজসমূহ ও হুকুমের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা ও দলীল-প্রমাণ তালাশের মধ্যেও তাঁকে চেনা যায়।

ফায়েদা: উদ্বিগ্নতা ও দুঃখ-কষ্টের দো‘আ

মুসনাদে আহমাদ ও সহীহ ইবন হিব্বানে আব্দুল্লাহ ইবন মাস‘ঊদ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

«مَا أَصَابَ أَحَدًا قَطُّ هَمٌّ وَلَا حَزَنٌ، فَقَالَ: اللهُمَّ إِنِّي عَبْدُكَ، ابْنُ عَبْدِكَ، ابْنُ أَمَتِكَ، نَاصِيَتِي بِيَدِكَ، مَاضٍ فِيَّ حُكْمُكَ، عَدْلٌ فِيَّ قَضَاؤُكَ، أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ، أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ، أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ، أَوِ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ، أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي، وَنُورَ صَدْرِي، وَجِلَاءَ حُزْنِي، وَذَهَابَ هَمِّي، إِلَّا أَذْهَبَ اللهُ هَمَّهُ وَحُزْنَهُ، وَأَبْدَلَهُ مَكَانَهُ فَرَحًا، قَالَ: فَقِيلَ: يَا رَسُولَ اللهِ، أَلَا نَتَعَلَّمُهَا؟ فَقَالَ: بَلَى، يَنْبَغِي لِمَنْ سَمِعَهَا أَنْ يَتَعَلَّمَهَا».

কোনো বান্দা দুঃখ ও দুশ্চিন্তায় পতিত হলে নিম্নোক্ত দো‘আ বলবে, “হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি আপনার বান্দা, আপনার এক বান্দার পুত্র এবং আপনার এক বাঁদীর পুত্র। আমার কপাল আপনার হাতে (নিয়ন্ত্রণে), আমার ওপর আপনার হুকুম কার্যকর, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা ন্যায়পূর্ণ। আমি আপনার কাছে আপনার প্রতিটি নামের উসিলায় প্রার্থনা করছি, যে নাম আপনি নিজের জন্য নিজে রেখেছেন অথবা আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন অথবা আপনার সৃষ্টিজীবের কাউকে আপনি শিক্ষা দিয়েছেন অথবা আপনার নিজের কাছে নিজ গায়েবী জ্ঞানে গোপন রেখেছেন- আপনি কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের প্রশান্তি, আমার বক্ষের আলো, আমার দুঃখের অপসারণকারী এবং আমার দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতা দূরকারী- তাহলে আল্লাহ তার দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূর করে দেন এবং এর পরিবর্তে তিনি আনন্দ ও খুশি দান করেন। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমরা কি এটি শিখবো? তিনি বললেন, অবশ্যই শিখবে। যে ব্যক্তি এটি শুনবে তার ওপর অত্যাবশ্যকীয় হবে এটি শিখে নেওয়া।”[1]

উপরোক্ত এ গুরুত্বপূর্ণ হাদীসটি আল্লাহর পরিচিতি, তাঁর তাওহীদ ও ‘উবুদিয়্যাতের যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে তন্মধ্যে অন্যতম হচ্ছে:

  • দো‘আকারী তার প্রার্থনা এভাবে শুরু করেছে, (إِنِّي عبدُك ابنُ عبدِكَ ابنُ أَمتِكَ) এতে সে তার পূর্বপুরুষ পিতা, মাতা থেকে শুরু করে আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম পর্যন্ত সকলকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এভাবে আল্লাহর সামনে তার তোষামোদ, নম্রতা[2] ও বিনয় প্রকাশ পায়। এতে রয়েছে তার স্বীকৃতি যে, সে তাঁর গোলাম, তার পূর্বপুরুষরাও তাঁর গোলাম। আর দয়া, ইহসানের ক্ষেত্রে মনিবের দরজা ছাড়া গোলামের কোনো উপায় নেই। তার মনিব যদি তাকে উপেক্ষা করে এবং তাকে ছেড়ে দেয় তবে সে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, তাকে সাহায্য করার কেউ থাকবে না, কেউ তাকে দয়া করবে না; বরং সে সর্বপ্রকারের ধ্বংসের সম্মুখীন হবে।
  • সে এ স্বীকৃতির মাধ্যমে এটা বলছে যে, আপনার সাহায্য ব্যতীত এক মূহুর্তের জন্যেও আমার কোনো উপায় নেই, আমার এমন কেউ নেই যার কাছে আমি আশ্রয় প্রার্থনা করবো, আমি যার গোলাম তাকে ব্যতীত অন্যের কাছে আমি আশ্রয় চাইব কীভাবে?
  • এতে আরও অন্তর্ভুক্ত করে, ব্যক্তির এ স্বীকৃতি যে, সে তার রবের দ্বারা পরিচালিত, অধীনস্ত, তাঁর আদেশ পালনে আদিষ্ট ও নিষেধকৃত কাজ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য- তিনি তো তার ওপর দাস হিসেবে কর্তৃত্ব করেন, তার নিজের কোনো ইখতিয়ার (ইচ্ছা-স্বাধীনতা) সে চলতে পারে না। কেননা নিজের স্বাধীনতা থাকা দাসের অবস্থা নয়; বরং এটি মনিব ও স্বাধীনের অধিকার। দাসরা তো শুধু ‘উবুদিয়্যাত তথা দাসত্ব করবে। তারা আনুগত্যের দাস, আল্লাহর দিকেই সম্পৃক্ত। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿إِنَّ عِبَادِي لَيۡسَ لَكَ عَلَيۡهِمۡ سُلۡطَٰنٌ٤٢﴾ [الحجر: ٤٢]

“নিশ্চয় আমার বান্দাদের ওপর তোমার কোনো ক্ষমতা নেই।” [সূরা আল-হিজর, আয়াত: ৪২]

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿وَعِبَادُ ٱلرَّحۡمَٰنِ ٱلَّذِينَ يَمۡشُونَ عَلَى ٱلۡأَرۡضِ هَوۡنٗا٦٣﴾ [الفرقان: ٦٣]

“আর রহমানের বান্দা তারাই যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে।” [সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ৬৩]

আল্লাহর এসব বান্দা ছাড়া বাকীরা (ইচ্ছাকৃত দাস না হয়ে) পরাক্রম ও প্রভুত্বের অধিন হিসেবে দাসত্ব করে। আল্লাহর সাথে এসব লোকের সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন বিশ্বের যাবতীয় ঘর আল্লাহর মালিকানার দিকে সম্বন্ধ করা হয়। পক্ষান্তরে আল্লাহর সত্যিকার বান্দাদের সাথে আল্লাহর সম্পর্ক ঠিক তেমন, যেমন বাইতুল্লাহিল হারাম কা‘বাকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে, (সালেহ আলাইহিস সালামের) উঁটকে আল্লাহর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। জান্নাতের গৃহকে তাঁর দিকে সম্বন্ধ করা হয়। তাঁর রাসূলের দাসত্বকে তাঁর দিকে সম্বন্ধ করা হয়েছে। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿ وَإِن كُنتُمۡ فِي رَيۡبٖ مِّمَّا نَزَّلۡنَا عَلَىٰ عَبۡدِنَا٢٣﴾ [البقرة: ٢٣]

“আর আমরা আমাদের বান্দার ওপর যা নাযিল করেছি, যদি তোমরা সে সম্পর্কে সন্দেহে থাক।” [সূরা আল-বাকারাহ, আয়াত: ২৩]

আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿ سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِ١﴾ [الاسراء: ١]

“পবিত্র মহান সে সত্তা, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে নিয়ে গিয়েছেন।” [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১] আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেছেন,

﴿ وَأَنَّهُۥ لَمَّا قَامَ عَبۡدُ ٱللَّهِ يَدۡعُوهُ١٩﴾ [الجن: ١٩]

“আর নিশ্চয় আল্লাহর বান্দা যখন তাঁকে ডাকার জন্য দাঁড়াল।” [সূরা আল-জিন, আয়াত: ১৯]

আর হাদীসের বাণী (إنِّي عبدُك) আমি আপনার বান্দা বা দাস এটি যথার্থভাবে বাস্তবায়িত হওয়ার অর্থ দাঁড়াবে: তার চরম দাসত্ব আবশ্যক করে নেওয়া; তার কাছে নতজানু হওয়া, বিনয়ের সাথে তার দাসত্ব করা, তার কাছে প্রত্যাবর্তন করা, তার আদেশ মান্য করা, নিষেধ থেকে বিরত থাকা, তার কাছে সর্বদা প্রার্থনা করা, তার কাছে আশ্রয় চাওয়া, তার কাছে সাহায্য চাওয়া, তার ওপর তাওয়াক্বুল করা, তার কাছেই অনিষ্ট থেকে পানাহ চাওয়া, ভালোবাসা, ভয় ও প্রত্যাশায় অন্যের সাথে অন্তরকে মিশ্রিত না করা ইত্যাদি।

অতঃপর রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, (ناصيتي بيدِك) আমার কপাল আপনার হাতে। বান্দা যখন এ সাক্ষ্য দিবে যে, তার কপাল আল্লাহর হাতে, অনুরূপ সকল বান্দার কপালও একমাত্র আল্লাহর হাতে, তিনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে পরিবর্তন করেন, তখন তারা এ ব্যাপারে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করবে না, তিনি ব্যতীত কারো কাছে কিছু আশা করবে না, তারা নিজেদেরকে মনিবের স্তরে নিয়ে যাবে না; বরং তারা নিজেদেরকে দাসের স্তরে নিয়ে যাবে, যে দাস একজনের অধীনে সীমাবদ্ধ, অক্ষম, পরিচালিত, যিনি তাদেরকে পরিবর্তন ও পরিচালনা করেন।

সুতরাং যে ব্যক্তি নিজের এ অবস্থানের সাক্ষ্য দিবে; তার অভাব-অভিযোগ, প্রয়োজন তার রবের কাছেই হওয়া অত্যাবশ্যকীয় হয়ে যাবে। আর যখন কোনো লোক এ ধরনের সাক্ষ্য দিবে তখন সে আর মানুষের মুখাপেক্ষী হবে না, তাদের কাছে কোনো আশা-প্রত্যাশাও করবে না; আর এভাবেই তার তাওহীদ, তাওয়াক্কুল ও ‘উবুদিয়্যাত সঠিক হবে।

এ কারণেই হূদ আলাইহিস সালাম তাঁর জাতিকে বলেছিলেন,

﴿إِنِّي تَوَكَّلۡتُ عَلَى ٱللَّهِ رَبِّي وَرَبِّكُمۚ مَّا مِن دَآبَّةٍ إِلَّا هُوَ ءَاخِذُۢ بِنَاصِيَتِهَآۚ إِنَّ رَبِّي عَلَىٰ صِرَٰطٖ مُّسۡتَقِيمٖ٥٦﴾ [هود: ٥٦]

“আমি অবশ্যই তাওয়াক্কুল করেছি আমার রব ও তোমাদের রব আল্লাহর ওপর, প্রতিটি বিচরণশীল প্রাণীরই তিনি নিয়ন্ত্রণকারী। নিশ্চয় আমার রব সরল পথে আছেন।” [সূরা হূদ, আয়াত: ৫৬]

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, (ماضٍ فيّ حُكمُك عدلٌ فيَّ قضاؤك) “আমার ওপর আপনার হুকুম কার্যকর, আমার ব্যাপারে আপনার ফয়সালা ন্যায়পূর্ণ।” রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে হুকুম ও কাযা বা ফয়সালার মধ্যে পার্থক্য করেছেন। হুকুমের জন্য তিনি (المضَاءَ) কার্যকার এবং (القضاءِ) ফয়সালা এর জন্য (العدلَ) ব্যবহার করেছেন। কেননা আল্লাহর হুকুম দীনি ও শর‘ঈ এবং বৈশ্বিক ও নিয়তি উভয় ধরণের হুকুম অন্তর্ভুক্ত করে। বান্দার ব্যাপারে এ দুধরণের বিধানই বাস্তবায়িত হয়। তার ব্যাপারে এ দুধরণের হুকুম কার্যকর ও বাস্তবায়ন হয়; চাই তা তার ইচ্ছাকৃত হোক অথবা অনিচ্ছাকৃত; কিন্তু সে বৈশ্বিক হুকুমের বিরোধিতা করতে পারে না। অন্যদিকে শরী‘আতের বিধানকে কখনো কখনো অমান্য করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী (أَسألُك بكلِّ اسمٍ) “আমি আপনার কাছে আপনার প্রতিটি নামের উসিলায় প্রার্থনা করছি”, এখান থেকে শেষ পর্যন্ত..... তিনি আল্লাহর সমস্ত নামের উসিলায় প্রার্থনা করছেন। সেসব নাম বান্দা জানুক বা না জানুক। আল্লাহর নামের উসিলা দেওয়া তাঁর কাছে অত্যন্ত প্রিয়। কেননা এভাবে উসিলা দেওয়ার অর্থ হচ্ছে তাঁর সিফাত ও কাজের মাধ্যমে উসিলা দেওয়া; যা তাঁর নামসমূহের অন্তর্নিহিত চাহিদা।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী (أَنْ تجعلَ القرآنَ ربيعَ قلبي ونورَ صدري) “আপনি কুরআনকে বানিয়ে দিন আমার হৃদয়ের প্রশান্তি (বৃষ্টি), আমার বক্ষের আলো”, এখানে (الرَّبيعُ) অর্থ জমিন উর্বরকারী বৃষ্টি। রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল-কুরআনকে উর্বরকারী বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। কেননা কুরআন মানুষের অন্তর জীবিত করে। এমনিভাবে আল্লাহ কুরআনকে বৃষ্টির সাথে তুলনা করেছেন। তিনি পানির সাথে তুলনা করেছেন যে পানি দ্বারা বস্তু জীবিত হয় এবং নূরের সাথে তুলনা করেছেন যে নূরের দ্বারা আলো ও উজ্জলতা প্রকাশ পায়। আল্লাহ এ দু’টিকে আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াতে একত্রিত করেছেন,

﴿أَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَسَالَتۡ أَوۡدِيَةُۢ بِقَدَرِهَا فَٱحۡتَمَلَ ٱلسَّيۡلُ زَبَدٗا رَّابِيٗاۖ وَمِمَّا يُوقِدُونَ عَلَيۡهِ فِي ٱلنَّارِ ٱبۡتِغَآءَ حِلۡيَةٍ أَوۡ مَتَٰعٖ زَبَدٞ مِّثۡلُهُ١٧﴾ [الرعد: ١٧]

“তিনি আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন, এতে উপত্যকাগুলো তাদের পরিমাণ অনুসারে প্লাবিত হয়, ফলে প্লাবন ওপরস্থিত ফেনা বহন করে নিয়ে যায়। আর অলংকার ও তৈজসপত্র তৈরীর উদ্দেশ্যে তারা আগুনে যা কিছু উত্তপ্ত করে তাতেও অনুরূপ ফেনা হয়।” [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ১৭]

সুতরাং উপরোক্ত দো‘আয় কুরআনের প্রশান্তির (উর্বরকারী বৃষ্টি) দ্বারা অন্তরকে উজ্জীবিত করা ও বক্ষকে আলোকিত করা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। সুতরাং এখানে জীবন ও আলো একত্রিত হয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿أَوَ مَن كَانَ مَيۡتٗا فَأَحۡيَيۡنَٰهُ وَجَعَلۡنَا لَهُۥ نُورٗا يَمۡشِي بِهِۦ فِي ٱلنَّاسِ كَمَن مَّثَلُهُۥ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ لَيۡسَ بِخَارِجٖ مِّنۡهَا١٢٢﴾ [الانعام: ١٢٢]

“যে ছিল মৃত, অতঃপর আমি তাকে জীবন দিয়েছি এবং তার জন্য নির্ধারণ করেছি আলো, যার মাধ্যমে সে মানুষের মধ্যে চলে, সে কি তার মতো যে ঘোর অন্ধকারে রয়েছে, যেখান থেকে সে বের হতে পারে না?” [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ১২২]

বক্ষ যেহেতু অন্তরের চেয়ে প্রশস্ত সেহেতু বক্ষের অর্জিত আলো অন্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কেননা বড় জিনিস থেকে ছোট জিনিসের মধ্যে প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। আবার যেহেতু শরীর ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জীবন পুরোটাই অন্তরের জীবন, সেহেতু সেখান থেকে জীবন বক্ষে ছড়িয়ে পড়ে, অতঃপর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে। তাই রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন জীবন প্রার্থনা করেছেন যে জীবনের রবী‘ তথা উর্বরকারী বৃষ্টি (প্রশান্তি) আছে, যে প্রশান্তিই জীবনের মূল।

অন্যদিকে দুঃখ, দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা যেহেতু অন্তরের জীবনকে প্রশান্তি দিতে ও একে আলোকিত করতে বাধা দেয়, তাই তিনি কুরআনের দ্বারা এসব দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূর করতে দো‘আ করেছেন। কেননা কুরআনের দ্বারা এসব দুঃখ ও দুশ্চিন্তা দূর হলে সেগুলো আর ফিরে আসে না। আর কুরআন ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা যেমন, সুস্বাস্থ্য, দুনিয়া, সুনাম-সুখ্যাতি ইত্যাদি দ্বারা সুখ লাভ করলে এগুলো চলে গেলে আবার তার দুঃখ, দুর্দশা ও দুশ্চিন্তা ফিরে আসে। অন্তরে আপতিত অপছন্দনীয় বিষয়গুলো যদি অতীতের হয় তখন তাকে ‘হুযন’ তথা দুঃখ বলে, আর ভবিষ্যতের বিষন্নতাকে ‘হাম্ম’ এবং বর্তমানের দুশ্চিন্তাকে ‘গাম’ বলে।

>
[1] মুসনাদ আহমাদ, ৬/২৪৬, হাদীস নং ৩৭১২; ইবন হিব্বান, ৩/২৫৩, হাদীস নং ৯৭২, মুহাক্বিক শু‘আইব আরনাঊত বলেছেন, হাদীসের সনদটি সহীহ, সনদের বর্ণনাকারীগণ সহীহ হাদীসের বর্ণনাকারী, আর আবু খাইসামা হলেন, যুহাইর ইবন হরব এবং আবু সালমাহ আল-জুহানী হলেন, মূসা ইবন আব্দুল্লাহ। আলবানী রহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদীস নং ১৯৯।

[2] استخذاءٌ অর্থ অবনত হওয়া, ভেঙ্গে পড়া।
ফায়েদা: আল-কুরআনে আগত বিবিধ সম্বোধনের ব্যাপারে চিন্তা-গবেষণা

তুমি আল-কুরআনের সম্বোধনের ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করলে এমন একজন রাজাধিরাজ পাবে যিনি সবকিছুর মালিক, তাঁর জন্যই সমস্ত প্রশংসা, সব কিছুর লাগাম (পরিচালনার রশি) তাঁরই হাতে, সবকিছুর মূল তাঁরই থেকে, তাঁর কাছেই সবকিছু ফিরে যাবে, তাঁর মালিকানায় কোনো কিছুই গোপন থাকে না, বান্দার অন্তরের খবর তিনি জ্ঞাত, তাদের গোপন ও প্রকাশ্য সব কিছুই তিনি অবগত, তাঁর সম্রাজ্য পরিচালনায় তিনি একক ও অদ্বিতীয়, তিনি সবকিছু শুনেন, দেখেন, দান করেন, আবার কাউকে দান করা থেকে বিরত থাকেন, সৎকাজের বিনিময় সাওয়াব দান করেন, অন্যায়ের কারণে শাস্তি প্রদান করেন, যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন, আবার যাকে খুশি অপমানিত করেন, তিনি সবকিছু সৃষ্টি করেন, রিযিক দান করেন, জীবিত করেন, মৃত্যু দান করেন, সবকিছু পরিমাণ মতো সৃষ্টি করেন, তাদের তিনি ফয়সালা দান করেন ও তিনিই সবকিছু সুষ্ঠভাবে পরিচালনা করেন।

ছোট-বড়, সূক্ষ্ম-অতিসূক্ষ্ম সবকিছুই তাঁর কাছ থেকেই আসে এবং তাঁর দিকেই ফিরে যায়, তাঁর অনুমতি ব্যতীত একটি অণুও নড়াচড়া করতে পারে না, গাছের একটি পাতাও তাঁর অবগতি ব্যতীত ঝরে পড়ে না।

তিনি তাঁর অলীদেরকে ভালো কাজ ও সুন্দর গুণাবলীর জন্য প্রশংসা করেছেন। অন্যদিকে তাঁর শত্রুদেরকে মন্দ কাজ ও অসৎ গুণের জন্য নিন্দা করেছেন। তিনি কুরআনে অনেক উপমা পেশ করেছেন, নানাভাবে দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করেছেন, তাঁর শত্রুর দ্বিধা-সংশয়ের ব্যাপারে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছেন, সত্যবাদীকে তিনি সত্যায়ন করেছেন ও মিথ্যাবাদীকে মিথ্যাপ্রতিপন্ন করেছেন। তিনি কুরআনে হক কথা বলেছেন, হিদায়াতের পথ দেখিয়েছেন, জান্নাতের দিকে আহ্বান করেছেন, জান্নাতের গুণাবলী, এর সৌন্দর্য ও নি‘আমত বর্ণনা করেছেন, অন্যদিকে জাহান্নাম থেকে সাবধান করেছেন, এর আযাব, ভয়ঙ্করতা ও দুঃখ কষ্টের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বান্দাকে সর্বদিক থেকে তাঁর প্রতি অভাবী, অসহয় ও মুখাপেক্ষীর কথা স্মরণ করে দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত এক মুহূর্তের জন্যও তাদের কোনো উপায় নেই, আবার তিনি একথাও স্মরণ করে দিয়েছেন যে, তিনি বান্দা ও সমস্ত সৃষ্টির অমুখাপেক্ষী, তিনি সবদিক থেকে নিজেই স্বয়ংসম্পূর্ণ, সবকিছুই তাঁর মুখাপেক্ষী, তাঁর দয়া ও রহমত ব্যতীত কেউ বিন্দু পরিমাণ বা তারচেয়ে কম কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, আবার তাঁর ন্যায়পরায়ণতা ও হিকমত ব্যতীত কেউ অণু পরিমাণ বা তারচেয়েও কম অকল্যাণ পাবে না।

আল-কুরআনে মানুষের অন্তর যখন এমন একজন মালিক- রাজাধিরাজের সন্ধান পাবে যিনি একাধারে মহান মালিক, রহীম, দানশীল, সুন্দর- তখন কীভাবে তাঁকে ভালোবাসবে না? তাঁর নৈকট্য লাভে কেন প্রতিযোগিতা করবে না? তাঁর হৃদ্যতা ও কোমলতা লাভে স্বীয় জীবন উৎসর্গ করবে না? কেনই-বা তিনি তার কাছে সর্বাধিক প্রিয়জন হবে না? সবকিছুর সন্তুষ্টি বাদে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টিই কেন একমাত্র লক্ষ্য হবে না? কেন সে তাঁর স্মরণে অনুরক্ত হবে না? তখন কেনই-বা তাঁর ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব তার খাদ্য, শক্তি ও নিরাময় হবে না? কেননা সে তাঁর ভালোবাসা, আবেগঘনতা ও ঘনিষ্ঠতা হারালে ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে, মহাক্ষতিগ্রস্ত হবে। তখন তার জীবনের কোন মূল্যই থাকবে না।

ফায়েদা: সূরা আত-তাকাসুরে গভীর দৃষ্টিপাত ও চিন্তা-গবেষণা

আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿أَلۡهَىٰكُمُ ٱلتَّكَاثُرُ١ حَتَّىٰ زُرۡتُمُ ٱلۡمَقَابِرَ٢ كَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ٣ ثُمَّ كَلَّا سَوۡفَ تَعۡلَمُونَ٤ كَلَّا لَوۡ تَعۡلَمُونَ عِلۡمَ ٱلۡيَقِينِ٥ لَتَرَوُنَّ ٱلۡجَحِيمَ٦ ثُمَّ لَتَرَوُنَّهَا عَيۡنَ ٱلۡيَقِينِ٧ ثُمَّ لَتُسۡ‍َٔلُنَّ يَوۡمَئِذٍ عَنِ ٱلنَّعِيمِ٨﴾ [التكاثر: ١، ٩]

“প্রাচুর্যের প্রতিযোগিতা তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে। যতক্ষণ না তোমরা কবরের সাক্ষাৎ করবে। কখনো নয়, শীঘ্রই তোমরা জানবে, তারপর কখনো নয়, তোমরা শীঘ্রই জানতে পারবে। কখনো নয়, তোমরা যদি নিশ্চিত জ্ঞানে জানতে! তোমরা অবশ্যই জাহান্নাম দেখবে; তারপর তোমরা তা নিশ্চিত চাক্ষুষ দেখবে। তারপর সেদিন অবশ্যই তোমরা নি‘আমত সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।” [সূরা আত-তাকাসুর, আয়াত: ১-৯]

এ সূরা আল্লাহর অঙ্গিকার, ভীতিপ্রদর্শন ও হুমকিপ্রদানের জন্য নির্দিষ্ট করা হয়েছে। জ্ঞানীর জন্য উপদেশ গ্রহণের জন্য এগুলোই যথেষ্ট। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, (أَلۡهَىٰكُمُ) তোমাদেরকে এমনভাবে ব্যস্ত রেখেছে যে সে ব্যাপারে তোমাদের কোনো ওযর গ্রহণ করা হবে না; কেননা (ألهى عن الشيء) এর অর্থ কোনো কিছু থেকে অমনোযোগী থাকা। আর এটি ইচ্ছাকৃত করলে অন্যায় বলে বিবেচিত হবে, কেননা মূল বস্তু থেকে অমনোযোগী না থাকতে আল্লাহর পক্ষ থেকে আদিষ্ট। আর যদি অনিচ্ছাকৃত হয়ে যায় তবে তার ওযর গ্রহণযোগ্য হবে, যেমন রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (الخميصة) তথা কারুকার্য খচিত চাদরের ব্যাপারে বলেছিলেন,

«فَإِنَّهَا أَلْهَتْنِي آنِفًا عَنْ صَلاَتِي».

“এটা তো আমাকে সালাত থেকে অমনোযোগী করে দিচ্ছিল।”[1] এটি একধরণের বিস্মৃতি।

অনুরূপ অন্য হাদীসে এসেছে, মুনযির ইবন আবূ উসাইদ জন্মগ্রহণ করলে তাকে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে আসলে তাকে তাঁর উরুর ওপর রাখা হয়। তখন নবী রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

«فَلَهَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بِشَيْءٍ بَيْنَ يَدَيْهِ».

“এ সময় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাচ্চা ব্যতীত তার সামনের কোনো জরুরী কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।”[2]

অর্থাৎ অমনোযোগী হওয়া। যেমন বলা হয় (لَـهَا بالشيءِ، أي: اشتغلَ به) যখন কোনো নিয়ে ভীষণভাবে ব্যস্ত হয়। আবার বলা হয় (لَـهَا عنه: إذا انصرفَ عنه) যখন কোনো বিষয় মারাত্মকভাবে উপেক্ষা করা হয়।

অন্তরের বিনোদনের জন্য (اللهوُ) ‘লাহও’ ব্যবহার হয় আর অঙ্গ-প্রতঙ্গের বিনোদনের জন্য (اللعب) ‘লা‘ব’ ব্যবহার হয়। এ কারণেই এ দু’টি শব্দ একত্রে ব্যবহার হয়। আর তাই আল্লাহর বাণী, (أَلۡهَىٰكُمُ) এটি (شغلكم) (তোমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছে) এ কথার চেয়ে বেশি নিন্দাসূচক; কেননা কাজ সম্পন্নকারী অনেক সময় অঙ্গের দ্বারা কাজ করে; কিন্তু তার অন্তর অমনোযোগী নয়। অতএব, (اللهوُ) হলো অমনোযোগী হওয়া, উপেক্ষা করা। আর (التكاثر) হলো বেশি অধিক। অর্থাৎ পরস্পর প্রাচুর্য লাভের জন্য বেশি বেশি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকা।

ধন-সম্পদ, সুনাম-সুখ্যাতি, যশ-ক্ষমতা, নারী, কথা, জ্ঞান ইত্যাদি সব কিছুতেই আধিক্য হতে পারে। বিশেষ করে যখন এগুলোর প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বেশি পরিমাণে জমা করা হয়। অধিক বই-পুস্তক, অধিক গ্রন্থ রচনা, অধিক মাস’আলা ও এর শাখা-প্রশাখা বের করা ইত্যাদি সব কিছুতেই আধিক্য হতে পারে।

অন্যের তুলনায় অধিক ধন-সম্পদের প্রত্যাশা করাও (التكاثر)। এ ধরণের করা নিন্দনীয়; তবে কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়তে অধিক সম্পদের অধিকারী হওয়াতে দোষ নেই। অতএব, (التكاثر) হলো অধিক ধন-সম্পদ ও কল্যাণের অধিকারী হতে প্রতিযোগিতা করা। সহীহ মুসলিমে আব্দুল্লাহ ইবন শিখখীর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে মারফু‘ সূত্রে বর্ণনা করেন,

﴿أَلۡهَىٰكُمُ ٱلتَّكَاثُرُ١﴾ [التكاثر: ١] «يَقُولُ ابْنُ آدَمَ: مَالِي مَالِي، وَهَلْ لَكَ مِنْ مَالِكَ إِلَّا مَا تَصَدَّقْتَ فَأَمْضَيْتَ، أَوْ أَكَلْتَ فَأَفْنَيْتَ، أَوْ لَبِسْتَ فَأَبْلَيْت».

“প্রাচুর্যের (সম্পদের) আধিক্য মোহ তোমাদেরকে ভুলিয়ে রেখেছে।” [সূরা আত-তাকাসুর, আয়াত: ১] আদম সন্তান বলে, আমার মাল আমার মাল। অথচ তুমি যা সাদকা করে আল্লাহর কাছে জমা করে রাখলে বা খেয়ে শেষ করে দিলে বা পরিধান করে পুরান করে দিলে তাছাড়া তোমার মাল বলতে কিছু আছে কী?”[3]

>
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৫৬।

[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬১৯১।

[3] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ২৯৫৮।

দুনিয়া হলো, পতিতা নারীর মতো যে একজন স্বামীর সাথে স্থির থাকে না; বরং একাধিক স্বামী তালাশ করে, তাদের সাথে আরো বেশি ভালো থাকার আশায়। ফলে সে বহুচারিনী হওয়া ব্যতীত সন্তুষ্ট থাকে না।

কবি দুনিয়ার উপমা দিয়ে বলেছেন,

আমি দুনিয়ার সৌন্দর্য ও তার কাজের মাঝে পার্থক্য করেছি। কেননা সৌন্দর্য অসৌন্দর্যের সাথে পূর্ণ হয় না।

দুনিয়া আমাদের সাথে শপথ করেছিল যে, সে কখনও আমাদের অঙ্গিকারের খিয়ানত করবে না।। কিন্তু আমাদের সাথে তার শপথ এমনই যেন সে কখনই তার ওয়াদা পূরণ করবে না।

দুনিয়ার পিছনে ঘোরা হলো হিংস্র জানোয়ারের[1] চরণভূমিতে বিচরণ করা, এতে সাঁতার কাটা মানে কুমিরের পুকুরে সাঁতার কাটা, দুনিয়ার দ্বারা আনন্দিত হওয়া মানে নিশ্চিত দুশ্চিন্তায় পতিত হওয়া, এর ব্যথা-বেদনাগুলো এর স্বাদ থেকেই সৃষ্টি হয়, এর দুঃখ-কষ্টগুলো এর আনন্দ থেকে জন্ম নেয়।

আল্লাহর অনুগ্রহপ্রাপ্তরা যখন দুনিয়ার জীবনের সঠিক মূল্য ও এর ক্ষণস্থায়িত্বতা বুঝতে সক্ষম হলো তখন তারা পরকালের চিরস্থায়ী জীবনের জন্য তাদের প্রবৃত্তিকে নিঃশেষ করে দিল। যখন তারা গাফেলতির নিদ্রা থেকে জেগে উঠতে সক্ষম হলো তখন বেকার অবস্থায় শত্রু তাদের থেকে যেটুকু লুটে কেড়ে নিয়েছিল অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে তারা সেগুলো পুনরুদ্ধার করে নিল। যখনই তাদের চলার পথ দীর্ঘ মনে হতে লাগতো তখনই তারা উদ্দিষ্ট গন্তব্যের সঠিক মূল্যমানের কথা স্মরণ করতো ফলে দূরবর্তী সবকিছু তাদের কাছে নিকটবর্তী মনে হতো। আবার যখন দুনিয়ার জীবন তাদেরকে তেতো করে ফেলতো তখনই তাদের কাছে মধুময় হয়ে দেখা দিত পরকালের স্মরণ; যার সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,

﴿هَٰذَا يَوۡمُكُمُ ٱلَّذِي كُنتُمۡ تُوعَدُونَ١٠٣﴾ [الانبياء: ١٠٣]

“এটাই তোমাদের সেই দিন, যার ওয়াদা তোমাদেরকে দেওয়া হয়েছিল।” [সূরা আল-আম্বিয়া, আয়াত: ১০৩]

কবি বলেছেন, এমন বহু কাফেলা রয়েছে যারা সফর করতে শুরু করেছে, আর রাত তার আধাঁর বিছিয়ে দিয়েছে ধুলায় ধূসরিত অবস্থায়, ওদিকে প্রভাত দরজায় দণ্ডায়মান।

>
[1] (مَسْبَعة) হলো যেখানে অনেক হিংস্র জানোয়ার থাকে। দেখুন, লিসানুল আরব, মাদ্দাহ (سبع)।

সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো তুমি তাঁকে চিনো; তারপরও তাঁকে ভালোবাসো না। তাঁর আহ্বান শোনো; কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দিতে বিলম্ব করছ। তাঁর সাথে লেনদেন করলে অনেক মুনাফা হবে একথা জানো; অথচ তুমি অন্যের সাথে লেনদেন করছ। তাঁর রাগের পরিমাণ তুমি জানো; অথচ তাঁর থেকে বিমুখ থাকছ। তাঁর অবাধ্যতার চরম শাস্তি ভোগ করছ; অথচ তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে তাঁর ভালোবাসা তালাশ করছ না। তুমি অন্যের ব্যাপারে আলোচনা করে অন্তরের রস আস্বাদন করো; অথচ তাঁর যিকর ও মুনাজাতের মাধ্যমে অন্তরকে প্রশান্ত করতে তুমি পাগলপনা হচ্ছ না। তিনি ব্যতীত অন্যের সাথে তোমার অন্তর সম্পৃক্ত করে আযাবের স্বাদ আস্বাদন পাচ্ছ; কিন্তু অন্যের কাছ থেকে পালায়ন করে তাঁর নি‘আমতের দিকে এগিয়ে আসছ না এবং তাঁরই দিকে ফিরে আসছ না।

এর চেয়েও বেশি আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তুমি অবশ্যই জানো যে তাঁকে তোমার লাগবেই, তুমি তাঁর প্রতি মুখাপেক্ষী, অসহায়; অথচ তুমি তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে আছো। আর যা তোমাকে তাঁর থেকে দূরে রাখবে তুমি তারই অভিমুখী!

ফায়েদা: হারাম কাজে পতিত হওয়ার কারণসমূহ

বান্দা দু’টি কারণে হারাম কাজে লিপ্ত হয়। সে কারণ দু’টি হচ্ছে:

প্রথমত: আল্লাহর ব্যাপারে তার মন্দ ধারণা এবং তার এ রূপ ধারণা যে, সে যদি তাঁর যথাযথ আনুগত্য করে, তাঁর অনুকরণ-অনুসরণ করে তাহলে তিনি এর চেয়ে উত্তম জিনিস হালাল হিসেবে তাকে দিবেন না।

দ্বিতীয়ত: সে এ সম্পর্কে জানে এবং একথাও জানে, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হারাম বস্তু বর্জন করবে আল্লাহর এর বিনিময় উত্তম জিনিস তাকে দান করবেন; কিন্তু তার প্রবৃত্তি তার ধৈর্যের ওপর বিজয় লাভ করেছে এবং তার বিবেকের ওপর তার প্রবৃত্তি প্রাধান্য লাভ করেছে। ফলে সে হারামে পতিত হয়েছে।

প্রথম প্রকারে তারাই পতিত হয় যারা জ্ঞানে দুর্বল আর দ্বিতীয় প্রকারে তারাই পতিত হয় যারা বিবেক ও দূরদৃষ্টিতে দুর্বল।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 8 9 পরের পাতা »