কারোর ব্যাপারে মদ অথবা মাদকদ্রব্য পান কিংবা সেবন করে নেশাগ্রস্ত হওয়া প্রমাণিত হয়ে গেলে তাকে আশিটি বেত্রাঘাত করা হবে। সে যতবারই পান করে ধরা পড়বে ততবারই তার ওপর উক্ত দণ্ডবিধি প্রয়োগ করা হবে। তবে তাকে এ জন্য কখনোই হত্যা করা হবে না। যা সকল গবেষক আলেমগণের ঐকমত্যে প্রমাণিত।
মু‘আওয়িয়া ও আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদখোর সম্পর্কে বলেন,
«إِذَا سَكِرَ وَفِيْ رِوَايَةٍ: إِذَا شَرِبَ الْـخَمْرَ فَاجْلِدُوْهُ، فَإِنْ عَادَ فَاجْلِدُوْهُ، فَإِنْ عَادَ فَاجْلِدُوْهُ، ثُمَّ قَالَ فِيْ الرَّابِعَةِ: فَإِنْ عَادَ فَاضْرِبُوْا عُنُقَهُ»
“যখন কেউ (কোনো নেশাকর দ্রব্য সেবন করে) নেশাগ্রস্ত হয়, অন্য বর্ণনায় রয়েছে, যখন কেউ মদ পান করে, তখন তোমরা তাকে বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। আবারো নেশাগ্রস্ত হলে আবারো বেত্রাঘাত করবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চতুর্থবার বললেন, আবারো নেশাগ্রস্ত হলে তার গর্দান উড়িয়ে দিবে”।[1]
ইমাম তিরমিযী রহ. জাবির ও কাবীসাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণনা করেন যে, একদা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট চতুর্থবার মদ পান করেছে এমন ব্যক্তিকে নিয়ে আসা হলে তিনি তাকে মেরেছেন, তবে হত্যা করেননি।
আনাস ইবন মালিক রাদিয়াল্লাহ আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أُتِيَ بِرَجُلٍ عِنْدَ النَّبِيِّ e قَدْ شَرِبَ الْـخَمْرَ، فَجَلَدَهُ بِجَرِيْدَتَيْنِ نَحْوَ أَرْبَعِيْنَ، وَفَعَلَهُ أَبُوْ بَكْرٍ، فَلَمَّا كَانَ عُمَرُ اسْتَشَارَ النَّاسَ، فَقَالَ عَبْدُ الرَّحْمَنُ بْنُ عَوْفٍ: أَخَفُّ الْـحُدُوْدِ ثَمَانُوْنَ، فَأَمَرَ بِهِ عُمَرُ»
“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট একদা জনৈক মদ্যপায়ীকে নিয়ে আসা হলে তিনি তাকে পাতা বিহীন দু’টি খেজুরের ডাল দিয়ে চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেন। আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও তার খিলাফতকালে তাই করেছিলেন। তবে উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু যখন খলীফা হলেন তখন তিনি সাহাবীগণের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। তখন আব্দুর রহমান ইবন আউফ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: সর্বনিম্ন দণ্ডবিধি হচ্ছে আশিটি বেত্রাঘাত। তখন উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তাই বাস্তবায়নের আদেশ করেন”।[2]
আনাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে এও বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَ رَسُوْلُ اللهِ e يَضْرِبُ فِيْ الْـخَمْرِ بِالنِّعَالِ وَالْـجَرِيْدِ»
“রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদ্যপানের শাস্তি স্বরূপ মদ্যপায়ীকে জুতো ও খেজুরের ডাল দিয়ে পেটাতেন”।[3]
আবু সাসান রহ. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর নিকট উপস্থিত হলাম। তখন ওয়ালীদ ইবন উক্ববাহকেও তার নিকট উপস্থিত করা হলো। সে মানুষকে ফজরের দু’রাকাত সালাত পড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলো: তোমাদেরকে আরো কয়েক রাকাত বেশি পড়িয়ে দেবো কি? তখন দু’জন ব্যক্তি তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দিলো। তাদের একজন তার ব্যাপারে এ বলে সাক্ষ্য দিলো যে, সে মদ পান করেছে। অপরজন এ বলে সাক্ষ্য দিলো যে, সে তাকে বমি করতে দেখেছে। তখন উসমান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন: সে মদ পান করেছে বলেই তো বমি করেছে? তখন তিনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন হে আলী! দাঁড়াও। ওকে বেত্রাঘাত করো। আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তার ছেলে হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন, হে হাসান! দাঁড়াও। ওকে বেত্রাঘাত করো। তখন হাসান রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাগাম্বিত স্বরে বললেন, বেত্রাঘাত সেই করুক যে উক্ত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। তখন আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আব্দুল্লাহ ইবন জাফর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুকে বললেন, হে আব্দুল্লাহ! দাঁড়াও। তাকে বেত্রাঘাত করো। তখন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বেত্রাঘাত করছিলেন আর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু তা গণনা করছিলেন। চল্লিশটি বেত্রাঘাতের পর আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বললেন বেত্রাঘাত বন্ধ করো। অতঃপর তিনি বললেন,
«جَلَدَ النَّبِيُّ e أَرْبَعِيْنَ، وَجَلَدَ أَبُوْ بَكْرٍ أَرْبَعِيْنَ، وَعُمَرُ ثَمَانِيْنَ، وَكُلٌّ سُنَّةٌ، وَهَذَا أَحَبُّ إِلَيَّ»
“নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেন। আবু বকরও চল্লিশটি বেত্রাঘাত করেন; কিন্তু উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আশিটি বেত্রাঘাত করেন। তবে চল্লিশটি বেত্রাঘাতই আমার নিকট বেশি পছন্দনীয়”।[4]
[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৭৭৩; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭০৬; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৪৭৯
[3] আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৪৭৯; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৬১৮
[4] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৭০৭; আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৪৮১; ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৬১৯
ধূমপানও মাদকদ্রব্যের অধীন এবং তা প্রকাশ্য গুনাহসমূহের অন্যতম। ব্যাপারটি খুবই ভয়াবহ, তবে সে অনুযায়ী এর প্রতি কোনো গুরুত্বই দেওয়া হচ্ছে না; বরং তা বিশেষ অবহেলায় পতিত। তাই ভিন্ন করে সেটার অপকার ও হারাম হওয়ার কারণগুলো বিশেষভাবে উল্লেখ করার প্রয়াস পাচ্ছি। যা নিম্নরূপ:
১. ধূমপান খুবই নিকৃষ্ট কাজ এবং বিড়ি, সিগারেট ইত্যাদি অত্যন্ত নিকৃষ্ট বস্তু। আর সকল নিকৃষ্ট বস্তুই তো শরী‘আতের দৃষ্টিতে হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَيُحِلُّ لَهُمُ ٱلطَّيِّبَٰتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيۡهِمُ ٱلۡخَبَٰٓئِثَ﴾ [الاعراف: ١٥٧]
“আরো তিনি (রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্য পবিত্র ও উত্তম বস্তুসমূহ হালাল করে দেন এবং হারাম করেননিকৃষ্ট ও অপবিত্র বস্তুসমূহ”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ১৫৭]
খ. ধূমপানে সম্পদের বিশেষ অপচয় হয়। আর সম্পদের অপচয় তো হারাম।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ ٱلۡمُبَذِّرِينَ كَانُوٓاْ إِخۡوَٰنَ ٱلشَّيَٰطِينِۖ وَكَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لِرَبِّهِۦ كَفُورٗا ٢٧﴾ [الاسراء: ٢٧]
“কিছুতেই সম্পদের অপব্যয় করো না। কারণ, অপচয়কারীরা শয়তানের ভাই। আর শয়তান হচ্ছে তার প্রভুর অত্যন্ত অকৃতজ্ঞ”। [সূরা আল-ইসরা, আযাত: ২৬-২৭]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَا تُسۡرِفُوٓاْۚ إِنَّهُۥ لَا يُحِبُّ ٱلۡمُسۡرِفِينَ﴾ [الاعراف: ٣١]
“তবে তোমরা (পোশাক-পরিচ্ছদ ও পানাহারে) অপচয় ও অপব্যয় করো না। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা অপচয়কারীদেরকে পছন্দ করেন না”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ৩১]
একজন বিবেকশূন্যের হাতে নিজ সম্পদ উঠিয়ে দেওয়া যদি না জায়েয ও হারাম হতে পারে এ জন্য যে, সে উক্ত সম্পদগুলো অপচয় ও অপব্যয় করবে তা হলে আপনি নিজকে বিবেকবান মনে করে নিজেই নিজ টাকাগুলো কিভাবে ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিতে পারেন এবং তা কিভাবে জায়েয হতে পারে? আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تُؤۡتُواْ ٱلسُّفَهَآءَ أَمۡوَٰلَكُمُ ٱلَّتِي جَعَلَ ٱللَّهُ لَكُمۡ قِيَٰمٗا﴾ [النساء: ٥]
“আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের জীবন নির্বাহের জন্য তোমাদেরকে যে সম্পদ দিয়েছেন তা তোমরা বেউকুফদের হাতে উঠিয়ে দিও না”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ৫]
গ. ধূমপানের মাধ্যমে নিজ জীবনকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। আর আত্মহত্যা ও নিজ জীবনকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া মারাত্মক হারাম ও একান্ত কবীরা গুনাহ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا ٢٩ وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًا ٣٠﴾ [النساء: ٢٩، ٣٠]
“তোমরা নিজেদেরকে যে কোনো পন্থায় হত্যা করো না। নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত দয়াশীল। যে ব্যক্তি সীমাতিক্রম ও অত্যাচার বশত এমন কান্ড করে বসবে তাহলে অচিরেই আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবো। আর এ কাজটা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষে একেবারেই সহজ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯-৩০]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَلَا تُلۡقُواْ بِأَيۡدِيكُمۡ إِلَى ٱلتَّهۡلُكَةِ﴾ [البقرة: ١٩٥]
“তোমরা কখনো ধ্বংসের দিকে নিজ হস্ত সম্প্রসারিত করো না”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১৯৫]
ঘ. বিশ্বের সকল স্বাস্থ্যবিদদের ধারণামতে ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য একান্তই ক্ষতিকর। সুতরাং আপনি এরই মাধ্যমে আপনার স্বাস্থ্য বিনাশ করতে পারেন না। কারণ, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপনাকে এ ব্যাপারে নিষেধ করেছেন।
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস ও উবাদাহ ইবন সামিত রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম থেকে বর্ণিত, তারা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«لاَ ضَرَرَ وَلاَ ضِرَارَ»
“না তুমি নিজ বা অন্যের ক্ষতি করতে পারো। আর না তোমরা পরস্পর (প্রতিশোধের ভিত্তিতে) একে অপরের ক্ষতি করতে পারো”।[1]
ঙ. ধূমপানের মাধ্যমে মুমিন পুরুষ ও মহিলাদেরকে কষ্ট দেওয়া হয়। কারণ, ধূমপায়ী যখন ধূমপান করে তখন তার আশপাশের অধূমপায়ীরা বিড়ি ও সিগারেটের ধোঁয়ায় কষ্ট পান। এমনকি নিয়মিত ধূমপায়ীরা কথা বলার সময়ও তার আশপাশের অধূমপায়ীরা কষ্ট পেয়ে থাকেন। সালাত পড়ার সময় ধূমপায়ী ব্যক্তি যিকির ও দো’আ উচ্চারণ করতে গেলে অধূমপায়ীরা তার মুখের নিকৃষ্ট দুর্গন্ধে ভীষণ কষ্ট পেয়ে থাকেন। কখনো কখনো তার জামা-কাপড় থেকেও দুর্গন্ধ পাওয়া যায়। আর তাদেরকে কষ্ট দেওয়া তো অত্যন্ত পাপের কাজ।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ يُؤۡذُونَ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ وَٱلۡمُؤۡمِنَٰتِ بِغَيۡرِ مَا ٱكۡتَسَبُواْ فَقَدِ ٱحۡتَمَلُواْ بُهۡتَٰنٗا وَإِثۡمٗا مُّبِينٗا ٥٨﴾ [الاحزاب: ٥٨]
“যারা মু’মিন পুরুষ ও মহিলাদেরকে কষ্ট দেয় অথচ তারা কোনো অপরাধ করেনি এ জাতীয় মানুষরা নিশ্চয় অপবাদ ও স্পষ্ট গুনাহের বোঝা বহন করবে”। [সূরা আল-আহযাব, আয়াত: ৫৭]
চ. পিয়াজ ও রসুনের মতো হালাল জিনিস খেয়ে যখন সালাতের জন্য মসজিদে যাওয়া নিষেধ অথচ শরী‘আতে জামা‘আতে সালাত পড়ার বিশেষ ফযীলত রয়েছে। কারণ, ফিরিশতারা তাতে খুব কষ্ট পেয়ে থাকেন তখন ধূমপান করে কেউ মসজিদে কিভাবে যেতে পারে? অথচ তা একই সঙ্গে দুর্গন্ধ ও হারাম। তাতে কি ফিরিশতারা কষ্ট পান না? তাতে কি মুসল্লিরা কষ্ট পায় না?
জাবির ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَنْ أَكَلَ الْبَصَلَ وَالثُّوْمَ فَلاَ يَقْرَبَنَّ مَسْجِدَنَا، فَإِنَّ الْـمَلَآئِكَةَ تَتَأَذَّى مِمَّا يَتَأَذَّى مِنْهُ بَنُوْ آدَمَ»
“যে ব্যক্তি পিয়াজ ও রসুন খেলো সে যেন আমার মসজিদের নিকটবর্তী না হয়। কারণ, ফিরিশতারা এমন জিনিসে কষ্ট পায় যাতে কষ্ট পায় আদম সন্তান”।[2]
ছ. ধূমপানের মাধ্যমে নিজ ছেলে-সন্তানকে অঙ্গহানি ও ত্রুটিপূর্ণ বৃদ্ধির প্রতি ঠেলে দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণানুযায়ী নিকুটিন পুরুষের বীর্যকে বিষাক্ত করে দেয়। যদ্দরুন সন্তান প্রজন্মে বিশেষ ব্যাঘাত ঘটে। এমনকি কখনো কখনো প্রজনন ক্ষমতা সম্পূর্ণরূপেই বিনষ্ট হয়ে যায়।
জ. ধূমপানের মাধ্যমে নিজ ছেলে-সন্তানকে চারিত্রিক অধঃপতনের দিকে বিশেষভাবে ঠেলে দেওয়া হয়। কারণ, তারা ভাগ্যক্রমে জন্মগত অঙ্গহানি থেকে বাঁচলেও পিতার ধূমপান দেখে তারা নিজেরাও ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে।
আরবী ভাষার প্রবাদে বলা হয়:
وَمَنْ شَابَهَ أَبَاهُ فَمَا ظَلَمَ
“যে নিজের বাপের মতো হয়েছে সে কোনো অপরাধ করেনি”।
আরেক প্রবাদে বলা হয়:
وَكُلُّ قَرِيْنٍ بِالْـمُقَارِنِ يَقْتَدِيْ
“প্রত্যেক সঙ্গী তার আরেক সঙ্গীরই অনুসরণ করে। আর পিতা তো তার বাচ্ছার দীর্ঘ সময়েরই সঙ্গী”।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَكَذَٰلِكَ مَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ فِي قَرۡيَةٖ مِّن نَّذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتۡرَفُوهَآ إِنَّا وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا عَلَىٰٓ أُمَّةٖ وَإِنَّا عَلَىٰٓ ءَاثَٰرِهِم مُّقۡتَدُونَ ٢٣﴾ [الزخرف: ٢٣]
“এভাবেই তোমার পূর্বে যখনই আমরা কোনো এলাকায় কোনো ভীতি প্রদর্শনকারী (নবী) পাঠিয়েছি, তখনই সে এলাকার ঐশ্বর্যশালীরা বলেছে, আমরা তো আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এই একই মতাদর্শের অনুসারী পেয়েছি। আর আমরা তো তাদেরই পদাঙ্ক অনুসারী”। [সূরা আয-যুখরুফ, আয়াত: ২৩]
তিনি আরো বলেন,
﴿وَإِذَا فَعَلُواْ فَٰحِشَةٗ قَالُواْ وَجَدۡنَا عَلَيۡهَآ ءَابَآءَنَا وَٱللَّهُ أَمَرَنَا بِهَاۗ قُلۡ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَأۡمُرُ بِٱلۡفَحۡشَآءِۖ أَتَقُولُونَ عَلَى ٱللَّهِ مَا لَا تَعۡلَمُونَ ٢٨﴾ [الاعراف: ٢٨]
“যখন তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে বসে তখন তারা বলে: আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এমনই করতে দেখেছি এবং আল্লাহ তা‘আলাও তো আমাদেরকে এমনই করতে আদেশ করেছেন। হে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! তুমি ঘোষণা করে দাও যে, নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা কখনো অশ্লীল কাজের আদেশ করেন না। তোমরা কি আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে এমন সব কথা বলছো যে বিষয়ে তোমাদের কোনো জ্ঞান নেই”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২৮]
ঝ. ধূমপানের মাধ্যমে নিজ স্ত্রীকেও বিশেষভাবে কষ্ট দেওয়া হয়। কারণ, সে তো আপনার জীবন সঙ্গী। আপনার সবকিছুই তো তার সঙ্গে জড়িত। তাই সে আপনার মুখের দুর্গন্ধে কষ্ট পাবে অবশ্যই। আবার কখনো কখনো তো কোনো কোনো স্ত্রী অসতর্কভাবে নিজেও ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তার ওপর যুলুম চরম পর্যায়ে পৌঁছায়।
ঞ. ধূমপান সন্তানকে মাতা-পিতার অবাধ্য হতে সহযোগিতা করে। কারণ, ধূমপায়ী স্বভাবত নিজ মাতা-পিতা থেকে দূরে থাকতে চায়। যাতে তারা তার অভ্যাসের ব্যাপারটি আঁচ করতে না পারে। আর এভাবেই সে ধীরে ধীরে তাদের অবাধ্য হয়ে পড়ে।
ট. ধূমপান ধূমপায়ীর নেককার সঙ্গী একেবারেই কমিয়ে দেয়। কারণ, তারা এ জাতীয় মানুষ থেকে দূরে থাকতে চায়। এমনকি কেউ কেউ তো এ জাতীয় মানুষকে সালামও দিতে চায় না।
ঠ. ধূমপানের মাধ্যমে ইসলামের শত্রুদেরকে বিশেষভাবে সহযোগিতা করা হয়। কারণ, এরই মাধ্যমে তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিন দিন বেড়ে যায় এবং তা ও তার কিয়দংশ পরবর্তীতে ইসলামেরই বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়।
ড. ধূমপান ধীরে ধীরে মেধাকে বিনষ্ট করে দেয়। যা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। কারণ, তা চিন্তা শক্তিকে একেবারেই দুর্বল করে দেয়। এমনকি ধীরে ধীরে তার মধ্যে মেধাশূন্যতা দেখা দেয়। স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের মাঝে একদা এক জরিপ চালিয়ে দেখা যায় যে, ধূমপায়ীরা অধূমপায়ীর তুলনায় খুবই কম মেধা সম্পন্ন এবং কোনো কিছু তাড়াতাড়ি বুঝতে অক্ষম।
ঢ. ধূমপানের মাধ্যমে হৃদয়, চোখ ও দাঁতকে ক্ষতির সম্মুখীন করা হয়। অথচ অন্তর মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রাজা। চোখ হচ্ছে জীবনের প্রতি একটি জানালা। দাঁত হচ্ছে মানুষের বিশেষ এক সৌন্দর্য। ধূমপানের কারণে হৃদয়ের শিরা-উপশিরাগুলো শক্ত হয়ে যায় এবং হঠাৎ রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চোখ দিয়ে এক ধরনের পানি বের হয়। চোখের পাতাগুলো জ্বলতে থাকে। কখনো কখনো চোখ ঝাপসা ও অন্ধ হয়ে যায়। দাঁতে পোকা ধরে। দাঁত হলুদবর্ণ হয়ে যায়। দাঁতের মাড়ি জ্বলতে থাকে। জিহবা ও মুখে ঘা ও ক্ষত সৃষ্টি হয়। ঠোঁট বিবর্ণ হয়ে যায় ইত্যাদি ইত্যাদি।
ণ. ধূমপান ধূমপায়ীকে তার বাধ্য গোলাম বানিয়ে রাখে। নেশা ধরলেই তার আয়োজন করতেই হবে। নতুবা সে অন্তরে এক ধরনের সঙ্কীর্ণতা ও অস্থিরতা অনুভব করবে। পুরো দুনিয়াই তার নিকট অন্ধকার মনে হবে। আর এ কথা সবারই জানা যে, একজনের গোলামীতেই শান্তি; অনেকের গোলামীতে নয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّارُ﴾ [يوسف: ٣٩]
“অনেকগুলো প্রভু ভালো না কি এমন আল্লাহ যিনি একক পরাক্রমশালী”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৩৯]
ত. ধূমপায়ীর নিকট যে কোনো ইবাদাত ভারী মনে হয়। বিশেষ করে রোযা। কারণ, সে সাওম থাকাবস্থায় আর ধূমপান করতে পারে না। গরম মৌসুমে তো দিন বড় হয়ে যায়। তখন তার অস্থিরতার আর কোনো সীমা থাকে না। তেমনিভাবে হজও তাকে বিশেষভাবে বিব্রত করে।
থ. এ ছাড়াও ধূমপানের কারণে অনেক ধরনের ক্যান্সার জন্ম নেয়। তম্মধ্যে ফুসফুস, গলা, ঠোঁট, খাদ্য নালী, শ্বাস নালী, জিহ্বা, মুখ, মূত্রথলি, কিডনী ইত্যাদির ক্যান্সার অন্যতম। এ ছাড়াও ধূমপানের সমস্যাগুলোর মধ্যে আরো রয়েছে খাদ্য-পানীয়ে রুচিহীনতা, শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্ট, মাথা ব্যথা, শ্রবণ শক্তিতে দুর্বলতা, হঠাৎ মৃত্যু, যক্ষ্মা, বদ্হজমী, পাকস্থলীতে ঘা, কলিজায় ছিদ্র ও সম্পূর্ণরূপে তার বিনাশ, শারীরিক শীর্ণতা, বক্ষব্যাধি, অত্যাধিক কফ ও কাশি, স্নায়ুর দুর্বলতা, চেহারার লাবণ্য বিনষ্ট হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি।
>[2] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৫৪ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৬৪
# আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৮৩ সনের রিপোর্টে বলা হয়, বর্তমান বিশ্বে সিগারেট কেনার পেছনে যে অর্থ ব্যয় করা হয় তার দুই-তৃতীয়াংশ স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় করা হলে বিশ্বের প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যগত প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা অবশ্যই সম্ভবপর হবে।
# আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংস্থার আরেকটি রিপোর্টে বলা হয়, ধূমপানের অপকারিতায় বছরে শুধুমাত্র আমেরিকাতেই ৩ লাখ ৪৬ হাজার ব্যক্তি মারা যায়। তেমনিভাবে চীনে ১ লাখ ৪০ হাজার, ব্রিটেনে ৫৫ হাজার, সুইডেনে আট হাজার এবং পুরো বিশ্বে ২৫ লাখ ব্যক্তি প্রতি বছর মারা যায়।
# চীনের সাঙ্গাহাই শহরের এক মেডিকেল রিপোর্টে বলা হয়, সেখানকার ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত ৬৬০ জনের ৯০ ভাগই ধূমপায়ী।
# আরেক রিপোর্টে বলা হয়, ধূমপানের অপকারিতায় মৃত্যুর হার দুর্ঘটনা ও যুদ্ধ ক্ষেত্রের মৃত্যুর হারের চাইতেও অনেক বেশি।
# ৪৬ বছর ও ততোধিক বয়সের লোকদের মধ্যে ধূমপায়ীদের মৃত্যুর হার অধূমপায়ীদের তুলনায় পঁচিশ গুণ বেশি।
# ধূমপান হচ্ছে পদস্খলনের প্রথম কারণ।
# কেউ দৈনিক ২০ টি সিগারেট পান করলে তার শরীরে শতকরা পনেরো ভাগ হিমোগ্লোবিনের ঘাটতি দেখা দেয়।
# ধূমপানের অপকারিতায় ব্রিটেনে দৈনিক ৪৪ ব্যক্তি মারা যায়।
# বিড়ি ও সিগারেটের শেষাংশ প্রথমাংশের তুলনায় আরো বেশি ক্ষতিকর।
# লজ্জাজনক বিষয় হচ্ছে এই যে, চতুষ্পাদ জন্তুর সামনে তামাক রাখা হলে ওরা তা খেতে চায় না; অথচ মানুষ খুব সহজভাবেই তা দৈনিক প্রচুর পরিমাণে গলাধঃকরণ করে যাচ্ছে।
ধূমপায়ীরা নিজেদের দোষকে ঢাকা দেওয়ার জন্য অধূমপায়ীদেরকে ধূমপানের কিছু কাল্পনিক উপকার বুঝাতে চায় যা নিম্নরূপ:
ক. তারা বলে, মনের অশান্তি দূর করার জন্যই ধূমপান করা হয়। তাদের এ কথা নিশ্চিতভাবেই জানা উচিৎ যে, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার যিকিরের মাধ্যমেই মানুষের অন্তরে শান্তির সঞ্চার হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ﴾ [الرعد: ٢٨]
“জেনে রাখো, আল্লাহ তা‘আলার স্মরণেই অন্তর শান্তি পায়”। [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮]
খ. তারা বলে, ধূমপান কোনো ব্যাপারে গভীর চিন্তা করতে সহযোগিতা করে। মূলতঃ ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এর উল্টো, বরং ধূমপান শ্বাসকষ্ট ও গলা শুকিয়ে যাওয়ার দরুন মানুষের চিন্তাশক্তিকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়।
গ. তারা বলে, ধূমপান মানুষের স্নায়ুগুলোকে সতেজ করে তোলে। মূলত ব্যাপারটা সম্পূর্ণ এর বিপরীত। বরং ধূমপান মানুষের স্নায়ুগুলোকে দুর্বল করে দেয় এবং এরই প্রভাবে দ্রুত হৃদকম্পন শুরু হয়ে যায়।
ঘ. তারা বলে, ধূমপানে বন্ধু বাড়ে। এ কথা একাংশে ঠিক। তবে ধূমপানে ধূমপায়ী বন্ধু বাড়ে, ভালো বন্ধু নয়।
ঙ. তারা বলে, ধূমপানে ক্লান্তি দূর হয়। এ কথা একেবারেই ঠিক নয়; বরং ধূমপানে ক্লান্তি আরো বেড়ে যায়। কারণ, ধূমপানে স্নায়ু দৌর্বল্য ও রক্ত চলাচলে সমস্যা সৃষ্টি করে।
আবার কেউ কেউ তো অন্যের অনুকরণে ধূমপান করে থাকে। কাউকে ধূমপান করতে দেখে তার খুব ভালো লেগেছে তাই সেও ধূমপান করে। কিয়ামতের দিন তার এ অনুসরণ কোনো কাজেই আসবে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَبَرَزُواْ لِلَّهِ جَمِيعٗا فَقَالَ ٱلضُّعَفَٰٓؤُاْ لِلَّذِينَ ٱسۡتَكۡبَرُوٓاْ إِنَّا كُنَّا لَكُمۡ تَبَعٗا فَهَلۡ أَنتُم مُّغۡنُونَ عَنَّا مِنۡ عَذَابِ ٱللَّهِ مِن شَيۡءٖۚ قَالُواْ لَوۡ هَدَىٰنَا ٱللَّهُ لَهَدَيۡنَٰكُمۡۖ سَوَآءٌ عَلَيۡنَآ أَجَزِعۡنَآ أَمۡ صَبَرۡنَا مَا لَنَا مِن مَّحِيصٖ ٢١﴾ [ابراهيم: ٢١]
“সবাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট উপস্থিত হলে দুর্বলরা অহঙ্কারীদেরকে বলবে, আমরা তো তোমাদের অনুসারীই ছিলাম। অতএব তোমরা কি আমাদেরকে আল্লাহ তা‘আলার শাস্তি থেকে এতটুকুও রক্ষা করতে পারবে? তারা বলবে: আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সঠিক পথ দেখালে অবশ্যই আমরা তোমাদেরকে তা দেখাতাম। এখন আমরা ধৈর্যচ্যুত হই অথবা ধৈর্যশীল হই তাতে কিছুই আসে যায় না। এখন আমাদের জন্য আল্লাহ তা‘আলার আযাব থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার আর কোনো পথ নেই”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ২১]
আবার কেউ কেউ তো দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলেন, আমি বুঝে শুনেই ধূমপান করছি। এতে তোমাদের কি যায় আসে? এ জাতীয় ব্যক্তিদেরকে এখন থেকেই পরকালের পরিণতির কথা চিন্তা করা উচিৎ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَخَابَ كُلُّ جَبَّارٍ عَنِيدٖ ١٥ مِّن وَرَآئِهِۦ جَهَنَّمُ وَيُسۡقَىٰ مِن مَّآءٖ صَدِيدٖ ١٦ يَتَجَرَّعُهُۥ وَلَا يَكَادُ يُسِيغُهُۥ وَيَأۡتِيهِ ٱلۡمَوۡتُ مِن كُلِّ مَكَانٖ وَمَا هُوَ بِمَيِّتٖۖ وَمِن وَرَآئِهِۦ عَذَابٌ غَلِيظٞ ١٧﴾ [ابراهيم: ١٥، ١٧]
“প্রত্যেক উদ্ধত স্বৈরাচারী ব্যর্থকাম হলো। পরিণামে তাদের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে জাহান্নাম এবং তাদেরকে পান করানো হবে গলিত পুঁজ। অতি কষ্টেই তারা তা গলাধঃকরণ করবে; সহজে নয়। সর্বদিক থেকে মৃত্যু তার দিকে ধেয়ে আসবে, অথচ সে মরবে না এবং এর পরেও তার জন্য রয়েছে কঠিন শাস্তি”। [সূরা ইবরাহীম, আয়াত: ১৫-১৭]
ধূমপানের উপরোক্ত ব্যক্তিগত ও সামাজিক অপকার জানার পর আশা তো আপনি এখনি ধূমপান থেকে তাওবা করতে প্রস্তুত। তবে এ ক্ষেত্রে কয়েকটি ব্যাপার আপনাকে বিশেষ সহযোগিতা করবে যা নিম্নরূপ:
ক. আল্লাহ তা‘আলার ওপর পূর্ণ ভরসা রেখে ধূমপান ত্যাগের ব্যাপারে কঠিন প্রতিজ্ঞা তথা তাওবা করতে হবে এবং এ ব্যাপারে পূর্ণ নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ তা‘আলার সহযোগিতা চেয়ে তাঁর কাছে বিশেষভাবে ফরিয়াদ করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَتُوبُوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ جَمِيعًا أَيُّهَ ٱلۡمُؤۡمِنُونَ لَعَلَّكُمۡ تُفۡلِحُونَ﴾ [النور: ٣١]
“হে ঈমানদারগণ! তোমরা সবাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট প্রত্যাবর্তন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো”। [সুরা আন-নূর, আয়াত: ৩১]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿أَمَّن يُجِيبُ ٱلۡمُضۡطَرَّ إِذَا دَعَاهُ وَيَكۡشِفُ ٱلسُّوٓءَ وَيَجۡعَلُكُمۡ خُلَفَآءَ ٱلۡأَرۡضِۗ أَءِلَٰهٞ مَّعَ ٱللَّهِۚ قَلِيلٗا مَّا تَذَكَّرُونَ ٦٢﴾ [النمل: ٦٢]
“তিনিই তো উত্তম যিনি আর্তের আহ্বানে সাড়া দেন যখন সে তাঁকে ডাকে, বিপদ-আপদ দূরীভূত করেন এবং তোমাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধি করেন। আল্লাহ তা‘আলার পাশাপাশি অন্য কোনো মা‘বূদ আছে কি? তোমরা তো অতি সামান্যই উপদেশ গ্রহণ করে থাকো”। [সুরা আন-নামল, আয়াত: ৬২]
খ. ধূমপানের অপকারগুলো দৈনিক নিজে ভাবুন এবং নিজ বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও স্ত্রী-সন্তানদের সামনে এগুলো নিয়ে আলোচনা করুন।
গ. ধূমপায়ীদের সঙ্গ ছেড়ে দিন। অন্ততপক্ষে ধূমপানের মজলিস থেকে বহু দূরে এবং কল্যাণকর কাজে সর্বদা ব্যস্ত থাকুন।
ঘ. ধূমপানকে ঘৃণা করতে চেষ্টা করুন এবং সর্বদা এ কথা ভাবুন যে, কেউ একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কোনো হারাম বস্তু পরিত্যাগ করলে আল্লাহ তা‘আলা এর প্রতিদান হিসেবে তাকে এর চাইতে আরো উন্নত ও কল্যাণকর বস্তু দান করবেন।
আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কেউ কোনো হারাম বস্তু পরিত্যাগ করলে তা সহজেই পরিত্যাগ করা সম্ভব। তবে আল্লাহ তা‘আলা সর্ব প্রথম আপনাকে অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখবেন যে, আপনি উক্ত হারাম বস্তু পরিত্যাগে কতটুকু সত্যবাদী। তখন আপনি এ ব্যাপারে ধৈর্য ধরতে পারলে তা পরিশেষে সত্যিই মজায় রূপান্তরিত হবে।
ধূমপান পরিত্যাগ করলে প্রথমতঃ আপনার গভীর ঘুম নাও আসতে পারে। রক্তে ঘাটতি দেখা দিবে। দীর্ঘ সময় কোনো কিছু নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারবেন না। রাগ ও অস্থিরতা বেড়ে যাবে। নাড়ির সাধারণ গতি কমে যাবে। ব্রেইন কেন যেন হালকা নিস্তেজ হয়ে পড়বে। ধূমপানের জন্য অন্তর কিলবিল করতে থাকবে। তবে তা কিছু দিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
ঙ. কখনো মনের ভেতর ধূমপানের ইচ্ছে জন্মিলে সাথে সাথে মিসওয়াক করুন অথবা চুইঙ্গাম খেতে থাকুন।
চ. চা ও কপি খুব কমই পান করুন, বরং এরই পরিবর্তে সাধ্যমত ফল-ফলাদি খেতে চেষ্টা করুন।
ছ. প্রতিদিন নাস্তার পর এক গ্লাস লেবু বা আঙ্গুরের শরবত পান করুন। তা হলে ধূমপানের চাহিদা একটু করে হলেও হ্রাস পাবে।
জ. যত্ন সহকারে নিয়মিত ফরয সালাতগুলো আদায় করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَأَقِمِ ٱلصَّلَوٰةَۖ إِنَّ ٱلصَّلَوٰةَ تَنۡهَىٰ عَنِ ٱلۡفَحۡشَآءِ وَٱلۡمُنكَرِۗ وَلَذِكۡرُ ٱللَّهِ أَكۡبَرُۗ وَٱللَّهُ يَعۡلَمُ مَا تَصۡنَعُونَ﴾ [العنكبوت: ٤٥]
“আর নামায কায়েম করো। কারণ, নামাযই তো তোমাকে অশ্লীল ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখবে। আল্লাহ তা‘আলার স্মরণই তো সর্বশ্রেষ্ঠ। তোমরা যাই করছো আল্লাহ তা‘আলা তা সবই জানেন”। [সুরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ৪৫]
ঝ. বেশি বেশি সাওম পালন করার চেষ্টা করুন। কারণ, তা মনোবলকে শক্তিশালী করা ও কুপ্রবৃত্তি মোকাবিলায় বিশেষ সহযোগিতা করবে।
ঞ. বেশি বেশি কুরআন তিলাওয়াত করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿إِنَّ هَٰذَا ٱلۡقُرۡءَانَ يَهۡدِي لِلَّتِي هِيَ أَقۡوَم﴾ [الاسراء: ٩]
“নিশ্চয় এ কুরআন সঠিক পথ প্রদর্শন করে”। [সুরা আল-ইসরা, আয়াত: ৯]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ قَدۡ جَآءَتۡكُم مَّوۡعِظَةٞ مِّن رَّبِّكُمۡ وَشِفَآءٞ لِّمَا فِي ٱلصُّدُورِ وَهُدٗى وَرَحۡمَةٞ لِّلۡمُؤۡمِنِينَ ٥٧﴾ [يونس: ٥٧]
“হে মানব সকল! তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের নিকট উপদেশ, অন্তরের চিকিৎসা এবং মুমিনদের জন্য হিদায়াত ও রহমত এসেছে”। [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৭]
চ. বেশি বেশি যিকির করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَلَا بِذِكۡرِ ٱللَّهِ تَطۡمَئِنُّ ٱلۡقُلُوبُ﴾ [الرعد: ٢٨]
“জেনে রাখো, একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার যিকির বা স্মরণেই মানব অন্তর প্রশান্তি লাভ করে”। [সূরা আর-রা‘দ, আয়াত: ২৮]
ছ. সর্বদা আল্লাহ তা‘আলার নিকট শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করুন। কারণ, শয়তানই তো গুনাহসমূহকে মানব সম্মুখে সুশোভিত করে দেখায়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿تَٱللَّهِ لَقَدۡ أَرۡسَلۡنَآ إِلَىٰٓ أُمَمٖ مِّن قَبۡلِكَ فَزَيَّنَ لَهُمُ ٱلشَّيۡطَٰنُ أَعۡمَٰلَهُمۡ فَهُوَ وَلِيُّهُمُ ٱلۡيَوۡمَ وَلَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٞ ٦٣﴾ [النحل: ٦٣]
“আল্লাহর কসম! আমরা তোমার পূর্বেও বহু জাতির নিকট রাসূল প্রেরণ করেছি; কিন্তু শয়তান তাদের অশোভনীয় কর্মকান্ডকে তাদের নিকট সুশোভিত করে দেখিয়েছে। সুতরাং শয়তান তো আজ তাদের বন্ধু অভিভাবক এবং তাদেরই জন্য (কিয়ামতের দিন) যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে”। [সূরা আন-নাহল, আয়াত: ৬৩]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿وَإِمَّا يَنزَغَنَّكَ مِنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ نَزۡغٞ فَٱسۡتَعِذۡ بِٱللَّهِۚ إِنَّهُۥ سَمِيعٌ عَلِيمٌ ٢٠٠﴾ [الاعراف: ٢٠٠]
“শয়তানের কুমন্ত্রণা যদি তোমাকে প্ররোচিত করে তা হলে তুমি আল্লাহ তা‘আলার আশ্রয় কামনা করো। তিনিই তো সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ”। [সূরা আল-আ‘রাফ, আয়াত: ২০০]
জ. নেককার লোকদের সাথে চলুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَٱصۡبِرۡ نَفۡسَكَ مَعَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ رَبَّهُم بِٱلۡغَدَوٰةِ وَٱلۡعَشِيِّ يُرِيدُونَ وَجۡهَهُۥۖ وَلَا تَعۡدُ عَيۡنَاكَ عَنۡهُمۡ تُرِيدُ زِينَةَ ٱلۡحَيَوٰةِ ٱلدُّنۡيَاۖ وَلَا تُطِعۡ مَنۡ أَغۡفَلۡنَا قَلۡبَهُۥ عَن ذِكۡرِنَا وَٱتَّبَعَ هَوَىٰهُ وَكَانَ أَمۡرُهُۥ فُرُطٗا ٢٨﴾ [الكهف: ٢٨]
“তুমি সর্বদা নিজকে ওদের সংস্রবেই রাখবে যারা সকাল-সন্ধ্যায় নিজ প্রভুকে ডাকে একমাত্র তাঁরই সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে। কখনো তাদের থেকে নিজ দৃষ্টি ফিরিয়ে নিবে না পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনায়। তবে ওদের অনুসরণ কখনোই করো না যাদের অন্তর আমি আমার স্মরণ থেকে গাফিল করে দিয়েছি এবং যারা নিজ খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে নিজ কর্মকান্ডে সীমাতিক্রম করে”। [সূরা আল-কাহাফ, আয়াত: ২৮]
একবার দু’বার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও কখনো নিরাশ হবেন না। কারণ, নিরাশ হওয়া কাফিরের পরিচয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿وَلَا تَاْيَۡٔسُواْ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِۖ إِنَّهُۥ لَا يَاْيَۡٔسُ مِن رَّوۡحِ ٱللَّهِ إِلَّا ٱلۡقَوۡمُ ٱلۡكَٰفِرُونَ﴾ [يوسف: ٨٧]
“আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে তোমরা কখনো নিরাশ হয়ো না। কারণ, একমাত্র কাফিররাই তো আল্লাহ তা‘আলার রহমত থেকে নিরাশ হয়ে থাকে”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৮৭]
আপনি দ্রুত ধূমপান ছাড়তে না পারলেও অন্ততপক্ষে তা কমাতে চেষ্টা করুন এবং তা প্রকাশ্য পান করবেন না তা হলে কোনো এক দিন আপনি তা সম্পূর্ণরূপে ছাড়তে পারবেন।