আদর্শ মুসলিম পরিবার ইসলামহাউজ.কম ২৩ টি
আদর্শ মুসলিম পরিবার ইসলামহাউজ.কম ২৩ টি

সমাজে নারী এবং পুরুষ এক নয় এবং এক হতেও পারে না। তাদের প্রত্যেকের রয়েছে আলাদা স্বভাব, চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং প্রয়োজন। নারী-পুরুষ সমাজের একে অন্যের পরিপূরক। তেমনিভাবে নারী ও পুরুষের দায়িত্ব ও কর্তব্যও এক নয়। এক মনে করাও ঠিক নয়। বরং উভয়ের জন্য ক্ষতিকর। পুরুষের দায়িত্ব হচ্ছে পিতৃত্বের ভূমিকা পালন করা, পরিবারের, স্ত্রী-পুত্র, ছেলে-সন্তান ও অন্য সদস্যদের শান্তি ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা। আর নারী বা মায়ের দায়িত্ব হচ্ছে মাতৃত্বের ভূমিকা পালন করা, সন্তান লালন-পালন ও যথাযথ শান্তি, নিরাপত্তা ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করা। অতএব, নারী পুরুষের দায়িত্ব এক মনে করার মানেই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যে বিঘ্ন সৃষ্টি করা।

মুসলিম সমাজে একজন নারীর প্রধান দায়িত্ব

এ জন্য ইসলামী শরী‘আত ও মুসলিম সমাজে নারী এবং পুরুষের ভূমিকা নিয়ে মুসলিম বুদ্ধিজীবী গবেষক ও চিন্তাবিদগণ গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাতে উত্তম পন্থায় নারী ও পুরুষের শক্তি ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে ইসলামী শরী‘আতের লক্ষ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা যায় এবং সুশৃঙ্খলভাবে মুসলিম উম্মাহ ও সমাজের খেদমত করা যায়।

এর কারণেই মা ও মাতৃত্ব এবং পরিবারকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে এবং দিতে হবে। তাদেরকে সকল বিচ্ছেদ, ভাঙ্গন এবং বিভ্রান্তি থেকে সংরক্ষণ করতে হবে। পশ্চিমা চিন্তা-চেতনা ও প্রভাবমুক্ত করে সামাজিক উন্নয়নের জন্য মা ও পরিবারকে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দিতে হবে। কারণ, পশ্চিমা চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য এবং ইসলামী চিন্তা-চেতনা ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য সম্পূর্ণভাবে আলাদা ও ভিন্ন।

এ জন্যই আমাদের উচিৎ এবং কর্তব্য হচ্ছে নারী এবং পুরুষ উভয়ই সমাজের অংশীদার হিসেবে প্রত্যেকের জন্য আলাদা কর্মসংস্থান ও উপার্জনের যথাযথ ব্যবস্থা করা। যাতে সঠিকভাবে আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা যায়।

এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য আমাদেরকে অবশ্যই সামর্থ্য ও প্রয়োজন অনুযায়ী নারী পুরুষ এবং সমাজের সকল সদস্যের জন্য সহজ এবং সুশৃঙ্খলভাবে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থার জন্য গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে।

নারীর বেলায় মা ও মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন ও সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন হিসেবে মনে করা হয়। তাদের সে দায়িত্ব পালনের যথার্থ ব্যবস্থা করা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব।

নারী তার মাতৃত্ব-সুলভ দায়িত্ব পালনে এবং সন্তান-সন্ততির যথাযথ লালন পালন, আরাম-আয়েশ এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালনে তার ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদা, মাতৃত্বের সংরক্ষণ ও হিফাযত করার জন্য মানসিক-আত্মিক ও বৈষয়িকভাবে সমাজের ও পুরুষের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকে।

অতএব, আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এবং সামাজিক সম্পর্ক-প্রতিষ্ঠা ও কর্মসংস্থান তৈরির বেলায় এদিকগুলো বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন।

আদর্শ জাতি গঠনে নারীর ভূমিকা ও কর্ম সংস্থান

আদর্শ জাতি গঠনে নারীদের অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। নারীদেরকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আদর্শ ও সমৃদ্ধ জাতি সহায়তা নেয় আবশ্যক। কারণ, নারীরা জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। মুসলিম সমাজে নারীদের যথেষ্ট কর্মসংস্থান রয়েছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীদের অগ্রাধিকার প্রদান দেওয়া যেতে পারে। যেমন, কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি, প্লে-গ্রুপ এবং ইবতেদায়ী ও প্রাইমারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার পেশায় নারীদেরকে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, একজন নারী স্বভাবগতভাবে বাচ্চা ও শিশুদের পাঠদানে অধিক উপযুক্ত ও অধিক সামর্থবান। এ কাজ নারীদেরকে তাদের অন্যান্য দায়িত্ব পালনে বাধা প্রদানও করে না। এজন্য অনেক নারীই নিজেকে তাদের কাজের কিছু সময় বা অর্ধেক সময় স্বল্প মজুরীতে/বেতনে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। কারণ, শিক্ষকতা এমন একটি পেশা যা নারীদেরকে তাদের কাজে ও দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করে না। বরং নারীদের মাতৃত্ব ও পারিবারিক দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করে। এমনকি সমাজে এমন কিছু নারী রয়েছে, যারা পারিবারিক ও মাতৃত্বের দায়িত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত, তাদের জন্য এমন পেশা আরও অধিক উপযোগী। কিন্তু তারপরও কোনো মুসলিম বিশ্ব তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এ পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করে না। তারা এ শিক্ষকতার পেশাকে শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে রুটিন অনুযায়ী ভাগাভাগি করে খুব সহজেই কাজে লাগাতে পারতো। এমনকি এ ধরনের অন্যান্য যথেষ্ট পরিমাণ কর্মস্থল রয়েছে, যেগুলো সিস্টেম অনুযায়ী নারী-পুরুষের মধ্যে ভাগাভাগি করে কাজে লাগিয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন করতে পারত।

সাধারণত ২০ (বিশ) বছর বয়সেই একজন নারী তার শিক্ষা জীবনের অনার্স, মাস্টার্স, বা ডিপ্লোমা কোর্স শেষ করতে সক্ষম হয় বা শেষের পর্যায়ে চলে যায়। তেমিনভাবে এই বয়সেই একজন নারী তার মাতৃত্বমূলক দায়িত্ব পালনে এবং সুস্থ সবল সন্তান ভূমিষ্ঠ ও তার যথাযথ লালন-পালনের ব্যবস্থা গ্রহণে শারীরিক ও মানসিকভাবে সর্বাধিক উপযুক্ত হয়ে থাকে।

এজন্য নারীদেরকে এ বয়স থেকে অন্তত চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর পর্যন্ত মাতৃত্বমূলক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত রাখা উচিৎ ও কর্তব্য, যাতে অন্তত তাদের শেষ সন্তানটি পর্যন্ত মায়ের লালন-পালন আদর যত্ন ও তা‘লীম- তরবিয়তের ভেতর দিয়ে আত্মিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে আত্মনির্ভরশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে।

এরপর যখন একজন নারী তার মাতৃত্বমূলক দায়িত্ব পালনের ভেতর দিয়ে তা‘লীম-তরবিয়ত সভ্যতা-সংস্কৃতি ও সামাজিক সম্পর্ক ইত্যাদি বিষয়ে মমতাময় অভিজ্ঞতা অর্জন করে ফেলবে। তখন তাকে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সের পরে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত করতে হবে। তখন থেকে পঁয়ষট্টি থেকে সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত তাকে সামাজিক দায়িত্ব পালনে নিয়োজিত রাখা উচিৎ। কারণ, নারীদের সাধারণত পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে জীববিজ্ঞানের তত্ত্ব অনুযায়ী হরমোনজনিত কারণে স্বভাবগতভাবে নারীর মাসিক চক্র বন্ধ হয়ে যায়। নারী তার সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তখন হরমোন-জনিত কারণে পুরুষের তুলনায় নারী অধিক সবল ও শক্তিশালী হয়ে উঠে। তেমনিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় নারীর আয়ুষ্কাল বা বয়স পুরুষের তুলনায় দীর্ঘ হয়ে থাকে। এজন্য নারীকে ৬৫-৭০ বছর বয়স পর্যন্ত সামাজিক কাজে বা পেশাগত কাজে নিয়োজিত রাখা উচিৎ।

কিন্তু আমরা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাধারার আলোকে নারীদেরকে তাদের ফুটন্ত যৌবনে মাতৃত্বের ভূমিকা থেকে দূরে সরিয়ে সামাজিক ও আর্থিক দায়িত্ব পালনে নিয়ে আসি। আবার যখন মাতৃত্বের বয়স শেষ হয়ে যায়, তখন তাদের সামাজিক আর্থিক দায়িত্ব পালনের দরজা বন্ধ করে দেই অর্থাৎ তাদের অবসর জীবনে চলে যেতে হয়। এভাবে পশ্চিমাদের অনুসরণে আমরা নারীদের মান-সম্মান ভূলুণ্ঠিত করে মাতৃত্বের অপমান করছি।

অথচ আমাদের অবশ্যই উচিৎ ও কর্তব্য ছিল যে, নারীদের জন্য তাদের সঠিক বয়সে সম্পূর্ণ আলাদা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। কারণ, এতে একদিকে যেমন নারীদের জন্য আলাদা কর্মস্থল ও কাজের সেক্টর এবং ব্যবস্থা করাও সম্ভব, অন্যদিকে তেমনি নারীরা ছলে-বলে হোক আর কৌশলে হোক অথবা জোরপূর্বক হোক কোনো পরপুরুষের কাছে দুর্বলতার শিকার হয়ে মাথা নত না করে নিজেরাই আত্মিক, মানসিক ও মানবিক মূল্যবোধ ও ভারসাম্য রক্ষা করে দেশ ও জাতির সেবা করতে পারে। যদি নারী ও পুরুষের জন্য আলাদা কর্মস্থলের ব্যবস্থা না করে যৌথ কর্মস্থলের ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে সেখানে হয়তো জৈবিক দুর্বলতার কারণে না হয় বস বা মালিককে খুশি করার কারণে অথবা নিজের ক্যারিয়ার গঠন ও পদোন্নতিসহ নানা কারণে জৈবিক সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং মানবিক বিপর্যয় ঘটবে। ভেঙ্গে যাবে পারিবারিক সম্পর্ক ও স্বামী-স্ত্রীর বন্ধন। যার বাস্তব চিত্র আমাদের দৈনন্দিন জীবনে, পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। কারণ, স্বভাবগতভাবে নারী-পুরুষ একে অপরের প্রতি দুর্বল। তারপর একই স্থলে দীর্ঘ দিনের জন্য ব্যস্ততায় আরও দুর্বল হওয়াটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিযুক্ত। এটিই হচ্ছে আমাদের ইসলামী শরী‘আত ও পশ্চিমা জীবন ব্যবস্থা ও সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য ও বৈশিষ্ট্য।

সুতরাং আমাদেরকে অবশ্যই সামাজিক বিষয়ের সাথে সাথে অর্থনৈতিক বিষয়ে পরিকল্পনা গ্রহণে এমনভাবে গুরুত্ব দিতে হবে, যেন শুরু করার আগেই শেষ না হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রোডাকশন বা ফলাফল লাভ করা পর্যন্ত উৎপাদনের সকল উপকরণ যথাযথ ব্যবহারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। কারণ, অর্থনৈতিক বিষয়টি একেবারে সহজ বিষয় নয়, বরং এ বিষয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।

তেমনিভাবে আমাদেরকে নারী ও পরিবার কল্যাণে কাজ করে যেতে হবে। যাতে সঠিকভাবে ফলাফল লাভের মাধ্যমে সকল প্রকার প্রতিবন্ধকতার মোকাবিলা করে আমাদের লক্ষ্যস্থলে পৌঁছতে পারি।

তেমিনভাবে আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামী শরী‘আতের আলোকে নারীদের ইজ্জত, সম্মান, মর্যাদা ও মূল্যবোধ রক্ষা তাদের মাতৃত্বমূলক দায়িত্বে বিঘ্ন সৃষ্টি না করে দেশ ও জাতির অগ্রগতি ও উন্নতির লক্ষে নারীদের জন্য আলাদা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। সমাজে নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক ও সমাজের অংশ সে মনোভাব অবশ্যই তৈরি করতে হবে।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে মুসলিম বিশ্বের ইসলামী চিন্তাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, স্থপতি, সংস্কারকগণ শিশুর লালন-পালন, পরিচর্যা, শিশু বিষয়ক তা‘লীম-তরবিয়ত, ও তার কারিকুলাম উন্নয়ন এবং শিশু বিষয়ক সংস্কৃতির সংস্কার ইত্যাদি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেন নি, বরং তারা গুরুত্ব দিয়েছে উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত ইসলামী ঐতিহ্য ও মূল্যবোধকে, যার ফলে জাতির নতুন প্রজন্ম থেকে আমাদের আলো নির্বাপিত হয়ে গেছে, স্থবির হয়ে গেছে আশা আকাঙ্ক্ষা আর কল্পনা। জাতি পরিণত হয়েছে একটি প্রাণহীন দেহতে। অথচ উচিৎ ছিল বাল্য বয়সেই একটি শিশুর ভিতরে সে সকল মূল্যবোধ ও চিন্তা-চেতনা প্রতিষ্ঠিত করা।

সুতরাং এ নিষ্প্রাণ জাতির মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করতে হলে এবং সমস্যার সমাধান করতে হলে, শিশু বিষয়ক তা‘লীম-তরবিয়ত-পরিচর্যা এবং নারী ও পরিবার সম্পর্কিত বিষয়াবলিকে গুরুত্ব দিতে হবে।

কিন্তু এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে, যে জাতি আজ সর্বস্তরে পশ্চিমা সভ্যতা সংস্কৃতির বেড়াজালে আবদ্ধ এবং উপনিবেশ ও রাজনৈতিক আগ্রাসনের শিকার, তেমনিভাবে ধাঁধা লাগানো অত্যাধুনিক নানা আবিষ্কারে আর বিজ্ঞাপনে দিশেহারা, সে জাতি কীভাবে তাদের শিশুর সেই হারানো অদৃশ্য শক্তিকে ফিরে পাবে এবং নতুন প্রজন্ম থেকে ভালো কিছু আশা করতে পারবে। এবং তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে পারবে?

এ সকল প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে একটিই। তা হচ্ছে, পারিবারিক ভূমিকাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। পারিবারিক ভূমিকার মাধ্যমে সঠিকভাবে শিশুর লালন-পালন ও তার পরিচর্যা করে শিশুর আত্মিক ও মানসিক বিকাশ ঘটাতে হবে। তাহলে এক পর্যায়ে জাতি এহেন পরিস্থিতি থেকে মুক্তির লক্ষ্যস্থলে পৌঁছুতে পারবে।

প্রকৃত পক্ষে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাসমূহ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির প্রাণকেন্দ্র। তারই হাতে রয়েছে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির শক্তি বৃদ্ধির চাবিকাঠি। তারাই জাতিকে সঠিক সংস্কার ও পরিশোধনের দিক নির্দেশনা দিতে পারে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রকৃতি এবং ইলমে অহীর দিক নির্দেশনার সাথে সমন্বয় সাধন করতে পারে। তবে তাদের এ সংস্কার এবং তা‘লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সংগঠন আর প্রতিষ্ঠান-নির্ভর হলে চলবে না। প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী সংস্কার ও পরিশোধন করতে পারবে না। কারণ, সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানসমূহ তাদের নিজেদের উপকার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য আধুনিক বিশ্বের অনুকরণ করে থাকে। তাদের স্বার্থ পরিপন্থী কোনো কিছু করতে তারা রাজি হয় না। তারা জাতির অনুসরণ করে মাত্র। তবে তার মানে এ নয় যে, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ছেড়ে দিতে হবে। বরং সংস্কার-পরিশোধন ও তা‘লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে গৌণ ভূমিকায় রাখতে হবে। বর্তমান প্রচার মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলো তাই প্রমাণ করে। সেখানে রয়েছে বিশেষ ধরনের সভ্যতা-সংস্কৃতি, তা‘লীম-তরবিয়ত। তারা কোনো সময়ই ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং ইসলামী তা‘লীম-তরবিয়তের বেলায় উৎসাহ প্রদান করে না। তবে তার মানে এ নয় যে, প্রচার মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়াগুলোকে পরিত্যাগ করব; বরং আধুনিক প্রচার মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়াগুলো মুসলিম উম্মাহ ও জাতির শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, গবেষক এবং চিন্তাবিদদের জন্য সংস্কার পরিশোধন এবং তা‘লীম-তরবিয়তের বিরাট একটি উপকরণ হতে পারে। যার মাধ্যমে তারা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহের জন্য বিশেষ ক্ষেত্র তৈরি করে দিতে পারে।

এর মাধ্যমে যদিও সকল সংগঠন এবং প্রতিষ্ঠানসমূহকে একই ধারাবাহিকতায় বা ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তদুপরি সার্বিকভাবে তাদের সামনে একটি দিক নির্দেশনা তুলে ধরতে পারবে। যেভাবে দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন মূসা আলাইহিস সালাম ও তার ভাই হারুন আলাইহিস সালাম আরব জাতিকে।

যদিও আমাদের পক্ষে বর্তমান আধুনিক প্রচার মাধ্যম এবং ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ও অত্যাধুনিক যন্ত্র সরঞ্জামাদির যুগকে মূসা আলাইহিস সালাম ও হারুন আলাইহিস সালামের যুগের সেই অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়; তদুপরি আমাদেরকে তথা মুসলিম উম্মাহ ও জাতিকে ইসলামী সভ্যতা-সংস্কৃতি, মূল্যবোধ এবং ইসলামী তা‘লীম-তরবিয়ত প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমা সভ্যতা, সংস্কৃতি, তা‘লীম-তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষাসহ প্রতিটি বিষয়ে প্রতিটি দিকের মোকাবেলা করতে হবে। প্রতিষ্ঠান এবং সংগঠনের নেতৃত্বে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন করতে হবে। গোটা সমাজ তথা পৃথিবীর অবস্থার পরিবর্তন সাধন করতে হবে। পশ্চিমা সভ্যতা-সংস্কৃতিসহ সকল প্রকার আগ্রাসনের মোকাবেলা করে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন করে গোটা সমাজ ও পৃথিবীর অবস্থা পরিবর্তন করার জন্য প্রয়োজন এমন প্রজন্মের, যাদেরকে তাদের আত্মাই তাদের কাজ কর্মে প্রেরণা প্রদান করবে। তাদের স্বভাবই (فطرة) সংস্কার ও পরিশোধনের প্রতি অনুপ্রেরণা যোগাবে। তারাই মুসলিম উম্মাহ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মের তা‘লীম-তরবিয়তের ব্যবস্থা করবে। তারাই তাদের সর্বশক্তি দিয়ে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির জাগরণের কাজ চালিয়ে যাবে। সমকালীন সকল প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করবে।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির মুক্তি-পরিত্রাণ লাভ এবং সামাজিক ইতিবাচক পরিবর্তন সাধন প্রতিটি মুসলিমের প্রাণের দাবি। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির এ প্রাণের দাবি আদায়ের জন্য প্রথমেই একমাত্র সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী আল্লাহর ওপর একান্ত ভরসা করতে হবে। তারপর সকল প্রকার নেতিবাচক প্রভাবের প্রতি নির্ভরশীল না হয়ে প্রতিটি মুসলিমকে অবশ্যই আত্মনির্ভর ও আত্মশক্তিতে বলিয়ান হতে হবে। এ আত্মনির্ভরতা এবং আত্মশক্তি অর্জিত হবে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির পারিবারিক জীবনে একটি মুসলিম মানব সন্তানকে আত্মিক ও মানসিকভাবে গঠন করার মাধ্যমে। আর এ কাজটি করতে পারে শিশুর পিতা কর্তৃক অনুপ্রেরণা প্রদানের মাধ্যমে। কারণ, একজন পিতা সর্বাবস্থায় তার সন্তান ও শিশুদের তরবিয়ত ও শাসন ইত্যাদি তাদের কল্যাণের জন্যই করে থাকে। এজন্য শিশুদের পিতার অনুপ্রেরণা প্রদানই মুসলিম উম্মাহর সামাজিক পরিবর্তনের চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে থাকে।

যেহেতু একজন পিতা সার্বক্ষণিকভাবে তার সন্তানদের কল্যাণ কামনায় নিয়োজিত থাকেন, সামাজিক পরিবর্তনের জন্য তারাই শিশুদের অনুপ্রেরণা যোগাতে পারেন। বর্তমান যুগে ইসলামী শিক্ষা প্রশিক্ষণ, তা‘লীম-তরবিয়ত এবং ইসলামী সংস্কার-পরিশোধনের একমাত্র চাবিকাঠি তাদের হাতেই বলতে হয়। তবে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সামাজিক পরিবর্তন ও পরিশোধনের জন্য সন্তান ও শিশুদের গঠনের ক্ষেত্রে জাতির চিন্তাবিদ গবেষক, পরিশোধক ও সংস্কৃতিবিদদেরকে সহায়তা করতে হবে। তাদেরকে শিশুদের কল্যাণের বিষয়াবলীর প্রতি দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে হবে। তাদেরকে শিশুদের আত্মিক ও মানসিক গঠনের পথ ও পন্থা ইসলামের মূল্যবোধ ও মূলনীতির আলোকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে সকলেই ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ লাভ করতে পারে। এজন্য জাতির চিন্তাবিদ, গবেষক ও সংস্কৃতিবিদদের জাতির সামাজিক পরিবর্তনের কেন্দ্রবিন্দু বলা যেতে পারে।

এ বিষয়ে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির খেদমতে এবং জাতির নতুন প্রজন্মকে শক্তিশালী ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে মাদরাসা ও অন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা শিশুদের বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য বিশেষ সেমিনারের আয়োজন করতে পারে, যে সেমিনারের মাধ্যমে তারা বাবা-মা ও অভিভাবকদের সামনে সঠিক সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং শিশুদের সঠিক তা‘লীম-তরবিয়তের মৌলিক পদ্ধতিসমূহ তুলে ধরতে পারে।

তেমনিভাবে এ কাজে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও অংশ নিতে পারে। তারা যুবকদের জন্য এ প্রসঙ্গে বিশেষ ধরনের শিক্ষা এবং ইসলামিক বিধান অনুযায়ী সঠিকভাবে পরিবার গঠনের পদ্ধতি ও নিয়মাবলি ইত্যাদি শিক্ষা দিতে পারে, যাতে ঐ যুবকরা সঠিক পদ্ধতিতে দাম্পত্য জীবনের মাধ্যমে পরিবার গঠন করে তাদের সন্তান সন্ততিদেরকে ইসলামিক মূল্যবোধ ও মূলনীতি অনুযায়ী সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করতে পারে।

বিশেষভাবে ইসলামিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে। তারা জাতির সংকট নিরসনে এবং চ্যালেঞ্জের মোকাবেলায় ও সামাজিক পরিবর্তন সাধনের জন্য শিশুদের অভিভাবক বাবা-মাদের জন্য সেমিনার, সভা, আলোচনা পর্যালোচনা-সহ নানা রকম ব্যবস্থা নিতে পারে, তাদের সতর্ক ও সচেতন করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এমন একটি জাতি উপহার দিতে পারে, যারা মুসলিম উম্মাহ ও জাতির পরিবর্তন, পরিশোধন এবং সংস্কার সাধন করতে সক্ষম। কারণ, বাবা, মা ও অভিভাবকরাই হচ্ছে শিশু গঠনের প্রাথমিক মাদরাসা ও শিক্ষালয়। তাদের মাধ্যমেই সঠিক জাতি গঠন সম্ভব হবে।

শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা তা‘লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে স্কুল, মাদরাসা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করার বিষয়টি নির্ভর করে পারিবারিক শিক্ষা বা বাবা-মা ও অভিভাবকদের শিক্ষার ওপর। স্কুল, মাদরাসা, মক্তব তথা সামাজিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় একজন অভিভাবক, বাবা-মা তার সন্তান তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করতে অধিক সক্ষম। কারণ, বাবা-মা ও অভিভাবক তার একটি সন্তানের ইতিবাচক ও নেতিবাচক সার্বিক দিক খুব ভালোভাবে বিবেচনা করতে পারে। অনেকেই ইতিবাচক বিষয়গুলো প্রতিষ্ঠা করতে অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু একটি প্রতিষ্ঠানের সে সমস্ত দিকগুলো বিবেচনা করা সহজসাধ্য না হওয়ার কারণে তারা লাগামহীনভাবে তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করতে থাকে। আবার কোনো কোনো সময় সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা ধরনের সমস্যাও থাকতে পারে। এজন্য প্রত্যাশিত তা‘লীম-তরবিয়তের বেলায় বাবা-মা এবং অভিভাবকদের ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

একটি আদর্শ পরিবারের হাতেই রয়েছে শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়তের সর্বাধিক ক্ষমতা ও শক্তি। এজন্য শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়তের ক্ষেত্রে পরিবারকে শিশুদের চোখে আয়না বা রঙ্গিন চশমার সাথে তুলনা করা হয়। রঙ্গিন চশমা যেমন চোখে লাগালে, প্রকৃতির দৃশ্যও রঙ্গিন দেখায় তেমনিভাবে পরিবার তার সন্তানকে যা বুঝাবে, যা শিক্ষা দিবে, তাই বুঝবে ও শিখবে। শিশু কি দেখল অথবা কি শুনল সেটি বড় কথা নয়, বরং শিশুদের ক্ষেত্রে বড় কথা হচ্ছে শিশুদের কি বুঝানো হচ্ছে। এজন্য দেখা যায়, একই প্রতিষ্ঠানের একই সিলেবাস একই শিক্ষকের তত্বাবধানে ছাত্র ও শিশুগুলো ভিন্ন প্রকৃতি ও ভিন্ন স্বভাবের হয়ে থাকে। অথচ কথা ছিল একই প্রকৃতি একই স্বভাবের হওয়ার। কিন্তু তারপরও ভিন্ন প্রকৃতি ও ভিন্ন স্বভাবের হওয়ার কারণ হচ্ছে পারিবারিক প্রভাব এবং বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশী পরিবেশের প্রভাব। এজন্য শিশুদের আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক গঠনের ক্ষেত্রে, শিক্ষা-দীক্ষায় বাবা-মা ও অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হয়।

মুসলিম উম্মাহ ও জাতির মধ্যে তা‘লীম-তরবিয়তের অভাব

বর্তমানে আমরা যদি মুসলিম উম্মাহ ও জাতির তা‘লীম-তরবিয়তের গুরুত্বের প্রতি অবলোকন করি, তাহলে আমাদেরকে প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। তারপর দ্বিতীয় স্তরে প্রচার মাধ্যমকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। আর তৃতীয় স্তরে রাখতে হবে পারিবারিক গুরুত্বকে। কারণ, বর্তমান সমাজে পারিবারিক ভূমিকা শুধুমাত্র শিশুদের আহার-বিহার পরিধান, ও বাসস্থানের আর চাহিদা পূরণেই সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। পারিবারিক তা‘লীম-তরবিয়তের গুরুত্ব নেই।

তেমনিভাবে আমরা যদি বর্তমান বিশ্বের দিকে তাকাই, তাহলে দেখব যে, বর্তমান মুসলিম বিশ্বে শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত ও শিক্ষা-দীক্ষার বেলায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, প্রচার-মিডিয়া এবং পারিবারিক ভূমিকা অত্যন্ত নগণ্য। পারিবারিক ভূমিকা শুধুমাত্র কিছু ওয়াজ নসিহত, উপদেশ আর বাণীর মাঝেই সীমাবদ্ধ। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক বিকাশ এবং আল্লাহ প্রদত্ত ফিতরাত বা স্বভাবের প্রতি কোনোও লক্ষ্য নেই। তারা জানেই না কীভাবে তাদের আত্মিক এবং মানসিক বিকাশ সাধন করতে হয়। কীভাবে তাদের তা‘লীম-তরবিয়ত এবং শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতে হয়। কীভাবে তাদের মধ্যে সভ্যতা-সংস্কৃতি আর মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হয়। এ সকল বিষয়ে তাদের কোনো লক্ষ্য নেই।

অত্যন্ত আফসোসের বিষয় যে, আজ পশ্চিমা বিশ্ব আমাদের ওপর উপনিবেশ সৃষ্টি করছে, আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধে আগ্রাসন চালাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তা-চেতনা ধ্বংস করে দিচ্ছে, তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতি হ্রাস পাচ্ছে। মুসলিম উম্মাহ ও জাতি সার্বিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ছে। পশ্চিমা সভ্যতার সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মুসলিম উম্মাহ জাতির ওপর মহামারীর আকার ধারণ করছে। এখন জাতির প্রত্যেকেই নিজ নিজ অর্থ নিয়েই ব্যস্ত। পার্থিব সম্পদ, আরাম-আয়েশ, সুখ-শান্তি আর অহমিকা নিয়েই জীবন-যাপন করছে। সাধারণ সমাজে আজ হিংসা, বিদ্বেষ, যুলুম, নির্যাতন, অন্যায় অবিচার, আর দুর্নীতি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। সামাজিক নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান, সামাজিক কল্যাণ, জনসাধারণের সামাজিক নিরাপত্তা, ইসলাম ও মানবতার মূল্যবোধ, ভ্রাতৃত্ব, ন্যায়-ইনসাফ, আদালত ইত্যাদি বিষয়ের আজ কোনো গুরুত্ব নেই। এমন কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠন পাওয়া যায় না, যারা এ সকল বিষয়ে সাধারণ সমাজ তথা মুসলিম উম্মাহ ও জাতিকে সচেতন করে তুলবে। তাদের শক্তি সামর্থ্য আর মনোবল দিয়ে এ কঠিন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করবে এবং অন্যায়ের দাঁত ভাঙ্গা জবাব দিবে।

আজকে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্কুল, মাদরাসা এবং প্রচার মাধ্যমগুলো এ বিষয়ে তাদের আশানুরূপ দায়িত্ব আদায় করছে না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সৎ ও সঠিক নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছে না।

তেমনিভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একই ধরনের। এ সকল বিষয়ে তাদেরও ভূমিকা একেবারে নগণ্য। তারাও মুসলিম উম্মাহ ও জাতির জন্য যোগ্য শিক্ষক এবং মেধাবী নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না, তাদের জন্য সভা, সেমিনার-আলোচনা, পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে পারছে না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির এহেন পরিস্থিতির মোকাবেলায় যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারছে না।

তেমনিভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি আমাদের সামাজিক ব্যবস্থা ও শিশুদের উন্নয়নে এবং তাদের মধ্যে লুকায়িত আত্মিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে পারছে না। জাতির সংস্কার ও পরিশোধনের জন্য তাদের কাজে স্পৃহা জাগাতে পারছে না।

আমরা যদি শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত আর শিক্ষা-দীক্ষার বেলায় মুসলিম বিশ্বকে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠী এবং সাধারণ বিশ্বের মাঝে তুলনা করি, তাহলে দেখতে পাব যে, মুসলিম বিশ্বের ত্যাগ-তিতিক্ষা, দান-অনুদান অত্যন্ত নগণ্য। মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাদরাসা, মক্তব, স্কুল এবং সামাজিক তা‘লীম-তরবিয়তী প্রতিষ্ঠানসমূহ সাধারণ জনগণের সাহায্য সহায়তায় অথবা গরীব-দিনমজুর অভিভাবকদের অনুদানে পরিচালিত হয়। যার কারণে মুসলিম বিশ্বের শিক্ষা-ব্যবস্থা, দুর্বল ও রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের মান-মর্যাদার অবনতি ঘটেছে। তাদের অগ্রগতি উন্নতির মনোবল ভেঙ্গে পড়েছে।

তেমনিভাবে আমরা যদি মুসলিম বিশ্বের শিক্ষার কারিকুলাম এবং উপকরণাদির প্রতি তাকাই, তাহলে একই অবস্থা দেখতে পাবো। সেখানে পাবো দীর্ঘকাল যাবত দুর্বল, রুগ্ন ও ব্যর্থ শিক্ষা-কারিকুলাম ও সিলেবাস এবং শিক্ষার উপকরণ, যার কারণে শিশুরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, তাদের আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক বিকাশ হচ্ছে না। তাদের মধ্যে জাগরণের স্পৃহা আসছে না, বরং তাদের মধ্যে যুলুম, সন্ত্রাস, অসহায়তা আর হতাশা বিরাজ করছে। এজন্য মুসলিম বিশ্বকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। তাদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, সভ্যতা-সংস্কৃতি রক্ষায় দুর্বার চেষ্টা চালাতে হবে। তাহলে মুসলিম বিশ্ব তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারবে।

তেমনিভাবে আমরা যদি আমাদের পুর্বপুরুষদের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে, তাদের একদিকে যেমন ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের সভ্যতা- সংস্কৃতি, অপর দিকে ছিল না তাদের তা‘লীম-তরবিয়তের আদব-শিষ্টাচারের অগ্রগতি-উন্নতি। অন্ধ অনুকরণের ভিত্তিতে যুলুম-নির্যাতন, সন্ত্রাস আর শারীরিক নির্যাতনের অনুশীলনের মাধ্যমে তাদের তা‘লীম-তরবিয়তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। একইভাবে তাদের অজ্ঞতা আর মূর্খতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে তাদের পরিবার-ব্যবস্থা, যার কারণে তাদের মধ্যে চিন্তা-চেতনা গবেষণা হ্রাস পেয়েছে। শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম-তরবিয়তের রীতি-নীতি ও পদ্ধতি দুর্বল হয়ে পড়েছে। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক এবং জৈবিক বিকাশ কঠিন হয়ে পড়েছে। প্রতিবন্ধকতা আর চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এজন্য আমাদের এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে, যার মাধ্যমে তা‘লীম-তরবিয়ত আর সঠিক শিক্ষা-দীক্ষার মাধ্যমে সকল চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করে আবারও আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পারি।

তরবিয়তী পরিবারের শিষ্টাচারের গুরুত্ব

বর্তমান বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধনের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে তরবিয়তী পরিবারের আদব-শিষ্টাচার ও আচার ব্যবহার। কারণ, মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন এবং জাগরণ সৃষ্টিকরণ পারিবারিক আদব-শিষ্টাচারের মধ্যেই নিহিত। এজন্য বেশ কয়েকটি কারণে মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কৃতজ্ঞ, চিন্তাবিদ ও গবেষকদেরকে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে পারিবারিক আদব-শিষ্টাচারকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। কয়েকটি কারণ নিম্নে উল্লেখ করছি।

প্রথমত: পারিবারিক তত্ত্বাবধান:

শিশুর জ্ঞান-বিবেক-বুদ্ধিসহ আত্মিক, মানসিক ও জৈবিক গঠন ও উন্নয়ন সাধনে পারিবারিক ভূমিকা অনন্য। কারণ, একমাত্র ঘর বা পরিবারই হচ্ছে শিশুর উৎসস্থল, আরাম-আয়েশ, আশ্রয় ও বিনোদন, পারিবারিক ইতিবাচক-নেতিবাচক দিক-নির্দেশনা, আচার ব্যবহার আর আদব-শিষ্টাচারের মধ্য দিয়েই একটি শিশুর বিবেক বুদ্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠে। এজন্য শিশুদের ক্ষেত্রে পরিবারকে রঙ্গিন চশমার সাথে তুলনা করা হয়। রঙ্গিন চশমা যেমন চোখে লাগালে প্রকৃতির দৃশ্য ও রঙ্গিন দেখায় বা চশমার রং ধারণ করে; তেমনিভাবেই একটি শিশু তার পরিবারকে এমনি অনুসরণ করে। শিশুরা কী দেখল, কী শুনল? সেটি বড় বিষয় নয়, বরং পরিবার শিশুদেরকে কী বুঝালো, শিশু কী অনুধাবন করল? সেটি হচ্ছে বড় বিষয়। তাই পরিবার যেমন হয়ে থাকে শিশুর আত্মিক মানসিক তথা জ্ঞান অনুভূতিও সে রকম হয়ে থাকে।

দ্বিতীয়ত: পিতা-মাতার ভূমিকা:

পিতা-মাতা, অভিভাবক এবং পরিবার সার্বক্ষণিকভাবে তাদের সন্তান ও শিশুদের ফিতরাত ও স্বভাব অনুযায়ী তাদের কল্যাণ কামনা করে থাকে। তারা তাদের জীবনের মান-উন্নয়ন এবং দায়িত্ব পালনে সক্ষম করে গড়ে তোলা-সহ আরাম-আয়েশে ও সুখে-শান্তিতে জীবন-যাপন করার ব্যবস্থা করতে সচেষ্ট থাকেন। এজন্য একটি শিশুর ওপর তার পরিবার, বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে থাকে। তাই শিশু শিক্ষা, তা‘লীম- তরবিয়ত, আদব-শিষ্টাচার ইত্যাদি বিষয়ে অন্যান্য যে কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বাবা-মা, অভিভাবক তথা পরিবারের ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

তৃতীয়ত:

একজন সমাজ সংস্কারক পরিশোধক লেখক গবেষক ও চিন্তাবিদ মুসলিম উম্মাহ ও জাতির বাবা-মা, ও অভিভাবকদেরকে শিশু-পরিচর্যার বিষয়াবলী, শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম-তরবিয়ত ইত্যাদি হাতে নাতে শিক্ষা দিতে পারেন। তাদের সন্তানদের জন্য কল্যাণকর বিষয়গুলো সহজে বুঝিয়ে দিতে পারেন; কিন্তু একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন এ কাজটি সহজে করতে পারে না। তারা যথাযথভাবে বাবা-মা ও অভিভাবকদেরকে উন্মুক্ত বক্তব্য ও সম্বোধন করতে সক্ষম হয় না। কারণ, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনসমূহ সব সময়ই তাদের নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে এবং সার্বক্ষণিক কল্যাণ কামনা করে থাকে। তারা প্রয়োজনের আলোকে জাতির অনুসরণে সামাজিক পরিবর্তন, পরিশোধন ও সংস্কার সাধনে সাড়া দিয়ে থাকে।

এজন্য মুসলিম উম্মাহ ও জাতির শিক্ষাবিদ, সংস্কৃতিবিদ, চিন্তাবিদ, পরিশোধক ও গবেষকদেরকে পরিবার এবং শিশুদের জন্য পারিবারিক তা‘লীম-তরবিয়ত শিক্ষা দীক্ষার বিষয়গুলোকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। বিশেষ করে বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য তা‘লীম-তরবিয়ত সংক্রান্ত আদব-শিষ্টাচার, সাহিত্য সংস্কৃতি ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। বাবা-মা ও অভিভাবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে তারা সঠিকভাবে যোগ্য ও উপযুক্ত বাবা-মা হিসেবে সন্তানদের তারবিয়তে যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা নানা ধরনের অভিজ্ঞতার আলোকে সঠিকভাবে তাদের সন্তানদের ও শিশুদের আত্মিক-মানসিক, জৈবিক এবং শারীরিকসহ সার্বিক বিষয়াবলী বিবেচনা করে তাদেরকে আদব-শিষ্টাচার, তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা, দীক্ষা ইত্যাদি প্রদান করতে সক্ষম হতে পারে এবং তাদের সন্তানদের ইসলামের মূল্যবোধ অনুযায়ী যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে।

এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই বাবা-মা পরিবার এবং অভিভাবকদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, তারাই হচ্ছে যুগ ও জাতির পরিশোধনের শুভ-যাত্রা। তাই ইসলামী সংস্কৃতি-বিদ, সমাজ সেবক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ ও গবেষকদেরকে সাধ্যানুযায়ী তাদের বিদ্যা বুদ্ধি, যোগ্যতা অভিজ্ঞতার আলোকে বিশুদ্ধ নিয়ত ও এখলাছের সাথে বাবা-মা ও অভিভাবকদের জন্য সার্বিক ব্যবস্থাপনা করতে হবে। কারণ, সন্তানদের ওপর তাদের বাবা-মা ও অভিভাবক এবং পরিবারের ভূমিকাই সরাসরি বিনা বাধায় সহজেই প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তারাই তাদের সন্তানদের সার্বিক দিক বিবেচনা করে, আচার-আচরণ ও পরিচর্যার ব্যবস্থা করতে পারে। সন্তানেরাও সহজে তাদের বাবা-মা অভিভাবক এবং পরিবারের আচার-আচরণ, বক্তব্য, আদব-শিষ্টাচার ও উপদেশাবলি মান্য করতে ও বাস্তবায়ন করতে চেষ্টা করে। এ সম্পর্কে আমাদের কাছে অনেক ভুরি ভুরি নজির, বাস্তব উদাহরণ রয়েছে।

একজন বাবা-মা বা অভিভাবক এবং পরিবার যদি সঠিকভাবে তাদের সন্তানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করতে পারে, তাহলে সামাজিক প্রতিষ্ঠান, সংগঠন, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি খুব সহজেই তাদের সন্তানদেরকে তা‘লীম-তরবিয়তের যথাযথ ব্যবস্থা করে দিতে পারবে। শিশুদের তারবিয়াতী শিক্ষা, আদব-শিষ্টাচার ও পরিশোধন স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন থেকেই শুরু হয়ে যায়। স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন যদি সঠিকভাবে গড়ে ওঠে তাহলে তার প্রভাব যেমন সন্তানদের ওপর পড়ে, তেমিনভাবে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি কলহ-বিবাদ লেগেই থাকে, তাহলে তার প্রভাবও সন্তানদের ওপর পড়ে, সন্তানদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, আদব-শিষ্টাচার ইত্যাদির বিঘ্ন সৃষ্টি করে।

এজন্য স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন এবং পারিবারিক জীবনে ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ইত্যাদি অবশ্যই থাকতে হবে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত একটি পরিবারে এ গুণগুলো প্রতিষ্ঠিত না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত পরিবারে আরাম-আয়েশ, শান্তি বিরাজ করতে পারবে না। সে পরিবার তাদের সন্তান সন্ততিদের তা‘লীম-তরবিয়ত, আদব-শিষ্টাচার, আত্মিক ও মানসিক বিকাশে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারবে না। শিশুরা সার্বিকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন হয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারবে না।

অতএব, শিশুদের তা‘লীম-তরবিয়ত, শিক্ষা-দীক্ষা, শিষ্টাচার ইত্যাদির ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক, পারিবারিক ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা দয়া অনুগ্রহ এবং নিরাপত্তা ইত্যাদি পূর্বশর্ত। বাবা-মায়ের বা পরিবারের সুসম্পর্ক ভালোবাসা ইত্যাদি শিশুদের হৃদয়ে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, শান্তি, নিরাপত্তার ও আনুগত্যের প্রবণতার জন্ম দেয়। শিশুরা সর্বাবস্থায় তাদের বাবা-মা ও পরিবারের ডাকে সাড়া দেয়, তারা তাদের অনুগত স্বীকার করে, তাদের কল্যাণকর বিষয়গুলো বাস্তবায়নে চেষ্টা করে। বাবা-মায়ের সঠিক ভালোবাসা আর স্নেহ মমতার মাধ্যমে শিশুদের অন্তর থেকে অহেতুক ভয়-ভীতি আর নেতিবাচক প্রভাব দূরীভূত হয়ে যায়। তারা নিজেদেরকে আত্মিক ও মানসিকভাবে যোগ্যতাসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে পারে।

প্রকৃত প্রেমিক, আগ্রহী, সচেতন ও বিশ্বস্ত সেই ব্যক্তি, যে সঠিক কল্যাণের পথে নিজের সর্বস্ব বিলীন করে দিতে পারে, বিপদে সংকটে ধৈর্য ধারণ করতে পারে। দুঃখ কষ্ট ইত্যাদিতে বিচলিত না হয়ে ধৈর্যের সাথে মোকাবেলা করতে পারে। আর অপারগ, দুর্বল, কাপুরুষ ঐ ব্যক্তি, যে প্রয়োজনের সময় তার শক্তি-সমর্থ ব্যয় করতে পারে না। দুঃখ কষ্ট আর আপদে বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে না। আর এ বিষয়টিই আমাদের মুসলিম উম্মাহ ও জাতির মধ্যে সর্বস্তরে বিরাজ করছে। যেখানে ভালোবাসা, ত্যাগ-তিতিক্ষা তার ধৈর্য, সাহসিকতা নেই, সেখানে সঠিক তা‘লীম-তরবিয়ত আর শিক্ষা-দীক্ষার আশা করা যায় না। মুসলিম উম্মাহ ও জাতির সংস্কার ও পরিশোধন কল্পনা করা অনুচিত।

এজন্য আমাদেরকে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী এবং পরিবারকে সজাগ ও সচেতন করতে হবে। শিশুদের আত্মিক ও মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সঠিক অনুধাবনের অনুপ্রেরণা জাগাতে হবে। পরস্পরের মধ্যে দয়া-অনুগ্রহ, স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসার উৎসাহ প্রদান করতে হবে। যাতে করে প্রথমে স্বামী-স্ত্রী ও পরিবারের মধ্যে সে সকল গুণাবলি প্রতিষ্ঠিত করে, তারপর তাদের সন্তানদেরকে সেগুলোর মাধ্যমে শিক্ষা-দীক্ষা ও তা‘লীম-তরবিয়ত প্রদান করতে পারে। কারণ, হারিয়ে যাওয়া বা অস্তিত্বহীন বস্তু কোনো কিছু দিতে পারে না। তেমনিভাবে যে সংস্কার বা পরিবার হিংসা-বিদ্বেষ আর ঝগড়া-বিবাদের কারণে ভেঙ্গে গেছে বা ধ্বংস হয়ে গেছে, সে পরিবার থেকে শিশুদের শিক্ষা-দীক্ষা তা‘লীম-তরবিয়তসহ ভালো কিছুর আশা করা যায় না। বরং সে সব পরিবারে ফিতনা-ফ্যাসাদ, অ-শৃঙ্খলা-বিশৃঙ্খলা আর অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বাড়তেই থাকে।

এজন্য ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি, মূল্যবোধ ও মূলনীতি অনুযায়ী একটি পরিবারের আদব-শিষ্টাচার, আচার-আচরণ, সামাজিক, অর্থনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, তা‘লীম তরবিয়তসহ আত্মিক ও মানসিক বিষয়গুলোর প্রতি মনোনিবেশ করা একান্ত প্রয়োজন। কারণ, একটি পরিবার হচ্ছে সঠিক ও শক্তিশালী জাতি গঠনের প্রথম ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিপ্রস্তর। একটি জাতির অগ্রগতি উন্নতি, সংস্কার পরিশোধন ইত্যাদি সার্বিক বিষয়াবলী নির্ভর করে পরিবারের ওপর। সুতরাং মুসলিম উম্মাহ ও জাতির চিন্তাবিদ গবেষক, সংস্কৃতি-বিদ ও পরিশোধকদের পারিবারিক দায়-দায়িত্ব ও বিষয়াবলীর প্রতি গুরুত্ব সহকারে মনোনিবেশ করতে হবে। তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষণীয় সভা, সেমিনার ও আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে পারিবারিক বিষয়াবলীকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় এবং উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পারিবারিক শিক্ষার বিশেষ ব্যবস্থা করতে হবে। পারিবারিক দায়িত্ব কর্তব্য নিয়ে বিশেষ প্রোগাম ও সেমিনারের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে করে সমাজের কোনোও মানুষ বা সদস্যই পারিবারিক বিষয়াবলি সম্পর্কে অজ্ঞ আর মূর্খ না থাকে। সমাজের প্রতিটি সদস্য যেন সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠে। তাদের দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়।

তেমনিভাবে সমাজের যুবক-যুবতীদের মধ্যে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পথ ও পন্থাকে সহজসাধ্য করবে হবে এবং যুবক-যুবতীদেরকে বিবাহ বন্ধন ও পরিবার গঠনের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। তাদের জন্য সঠিক পরিবার গঠনের উপযোগী বিশেষ সভা সেমিনার আলোচনা পর্যালোচনার ব্যবস্থা করতে হবে।

তেমনিভাবে পরিবারের সদস্যবৃন্দ এবং বিশেষ করে যুবক যুবতীদেরকে সঠিকভাবে সন্তান উৎপাদন, লালন-পালন, তা‘লীম-তরবিয়তের বিষয়াবলী সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাদের সে বিষয়াবলীর প্রতি সচেতন করে তুলতে হবে। যুবক-যুবতী, পরিবার এবং শিশুদের জন্য বিশেষ বিশেষ বই পুস্তক ইত্যাদি রচনা করতে হবে। তাদের সার্বিক বিষয়ের সকল সমস্যার কারণ নির্ণয় করে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে।

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে, সাধারণত শিশুদের আত্মিক মানসিক ও জৈবিক দিকগুলো অনুধাবন না করে, তাদের বয়সের স্তর অনুযায়ী তা‘লীম-তরবিয়তের ব্যবস্থা না করে, শুধুমাত্র ভালোবাসা আর স্নেহ-মমতা দিলেই চলবে না। এতে তাদের আত্মিক ও মানসিক গঠন পূর্ণ হবে না। বরং কোনো কোনো সময় হিতে বিপরীত হতে পারে। এ অযৌক্তিক ভালোবাসাই সন্তানদের ক্ষতি সাধনের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। তাদেরকে ফিতনা-ফ্যাসাদ, পাপ-পঙ্কিলতা আর অপরাধ-প্রবণতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাদের অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনায় বিঘ্ন সৃষ্টি করতে পারে।

এজন্য সঠিক ফলপ্রসূ দয়া-অনুগ্রহ, স্নেহ-মমতা আর ভালোবাসা হচ্ছে সন্তান ও শিশুদের বয়সের স্তর অনুযায়ী তাদের আত্মিক মানসিক, জৈবিক এবং শারীরিক অবস্থা ও যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের প্রতি দয়া অনুগ্রহ, স্নেহ-মমতা ও ভালোবাসা প্রদান করা। তাদের পর্যায়ক্রমে স্তরে স্তরে উন্নতি ও অগ্রগতি সাধনের চেষ্টা করা। তাহলেই তাদের প্রতি সঠিক ভালোবাসা হবে এবং সে ভালোবাসা ফলপ্রসূ হবে।

দেখানো হচ্ছেঃ ১১ থেকে ২০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৩ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 পরের পাতা »