রাহে বেলায়াত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১৪১ টি
রাহে বেলায়াত ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ১৪১ টি
তৃতীয় প্রকার যিকর : সকাল-বিকাল বা সকাল-সন্ধ্যার যিকর - (১৬) যিকর নং ১১৫ হইতে (১৭) যিকর নং ১১৬ পর্যন্ত

(১৬) যিকর নং ১১৫ : (সকাল-সন্ধ্যার দু‘আ : ১ বার)

اللهم عالم الغيب والشهادة فاطر السموات والأرض رب كل شيء ومليكه أشهد ألا إله إلا أنت أعوذ بك من شر نفسي ومن شر الشيطان وشركه وأن أقترف على نفسي سواء أو أجره إلى مسلم


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, ‘আ-লিমাল গাইবি ওয়াশ শাহা-দাতি, ফা-তিরাস সামা-ওয়া-তি ওয়াল আরদি, রাব্বা কুল্লি শাইয়িন ওয়া মালীকাহু, আশহাদু আল-লা ইলা-হা ইল্লা- আনতা, আ‘ঊযু বিকা মিন শার্রি নাফসী, ওয়া মিন শাররিশ শাইতা-নি ওয়া শিরকিহী, ওয়া আন আক্ব্তারিফা ‘আলা- নাফসী সূআন আও আজুররাহু ইলা- মুসলিম)


অর্থ: “হে আল্লাহ, গোপন (গায়েব) ও প্রকাশ্য সকল জ্ঞানের অধিকারী, আসমান ও জমিনের সৃষ্টিকর্তা, সকল কিছুর প্রভু ও মালিক, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আমি আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি আমার নিজের অকল্যাণ থেকে এবং শাইতানের অকল্যাণ ও তার শির্ক থেকে। আমি আপনার আশ্রয় চাচ্ছি, আমি এমন কোনো কর্ম না করি যাতে আমার নিজের কোনো ক্ষতি বা অমঙ্গল হয়, অথবা কোনো মুসলমানের জীবনে ক্ষতি বা অমঙ্গল বয়ে আনে।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, আবু বকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সা.) -কে বলেন, আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা আমি সকালে ও সন্ধ্যায় বলব। তখন তিনি তাঁকে উপরের দু‘আটি সকালে, সন্ধ্যায় ও বিছানায় শোয়ার পরে বলতে নির্দেশ দেন।[1]


(১৭) যিকর নং ১১৬ : (সকাল-সন্ধ্যার দু‘আ : ১ বার)

اللهم إني أسألك العفو والعافية في الدنيا والآخرة، اللهم إني أسألك العفو والعافية في ديني ودنياي، وأهلي ومالي، اللهم استر عوراتي وآمن روعاتي، اللهم احفظني من بين يدي ومن خلفي، وعن يميني وعن شمالي ومن فوقي، وأعوذ بعظمتك أن أُغتال من تحتي


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আস্আলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল ‘আ-ফিয়্যাতা ফিদ্ দুন্ইয়া- ওয়াল আ-খিরাহ। আল্লাহুম্মা, ইন্নী আস্আলুকাল ‘আফ্ওয়া ওয়াল ‘আ-ফিয়্যাতা ফী দীনী ওয়া দুন্ইয়াই-য়া, ওয়া আহলী ওয়া মালী। আল্লা-হুম্মাস- তুর ‘আউরা-তী ওয়া আ-মিন রাউ‘আ-তী। আল্লা-হুম্মাহ্ ফাযনী মিম বাইনি ইয়াদাইয়্যা ওয়া মিন খালফী, ওয়া ‘আন ইয়ামীনী ওয়া ‘আন শিমালী, ওয়া মিন ফাউক্বী। ওয়া আ‘ঊযু বি‘আযামাতিকা আন উগতা-লা মিন তাহতী।


অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট চাই ক্ষমা ও সার্বিক সুস্থতা- নিরাপত্তা দুনিয়াতে এবং আখেরাতে। হে আল্লাহ, আমি আপনার কাছে চাই ক্ষমা ও সার্বিক সুস্থতা-নিরাপত্তা আমার দ্বীনের মধ্যে, আমার দুনিয়াবী বিষয়ের মধ্যে, আমার পরিবার পরিজনের মধ্যে ও আমার সম্পদের মধ্যে। হে আল্লাহ, আমার দোষত্রুটিগুলি গোপন করুন এবং আমার ভয়ভীতিকে নিরাপত্তা দান করুন। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে হেফাযত করুন আমার সামনে থেকে, আমার পিছন থেকে, আমার ডান থেকে, আমার বাম থেকে, আমার উপর থেকে এবং আমি আপনার মহত্তেবর আশ্রয় গ্রহণ করছি যে, আমি আমার নিম্ন দিক থেকে আক্রান্ত হব।”


আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)কখনোই সকাল হলে ও সন্ধ্যা হলে উপরের এই কথাগুলি বলতে ছাড়তেন না (সর্বদা তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় এগুলি বলতেন)। হাদীসটি সহীহ।[2]

সকালে ও সন্ধ্যায় রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো অনেক দু‘আ করতেন এবং অনেক দু‘আ শিখিয়েছেন, যেগুলির ভাষা ও ভাব অত্যন্ত মর্মস্পর্শী, আবেগময় এবং নবুয়্যতের নূরে ভরা। এসকল দু‘আ মুমিনের কবলবে অবর্ণনীয় প্রভাব বিস্তার করে। মুমিন তাঁর হৃদয় ভরে অনুভব করেন বরকত, রহমত ও প্রশান্তি।

আরবী আমাদের জন্য বিদেশী ভাষা হওয়াতে আমাদের জন্য আরবী দোয়গুলি বিশুদ্ধভাবে অর্থসহ মুখস্থ করা একটু সময় ও শ্রম সাপেক্ষ বিষয়। আগ্রহ ও ভালবাসা থাকলে অবশ্য এতটুকু সময় ও শ্রম প্রদান করা কোনো সমস্যাই নয়। তবুও সাধারণ যাকির ও পাঠকগণের অসুবিধার কথা চিন্তা করে আমি বইয়ের কলেবর বৃদ্ধি না করে এখানেই এই পর্ব শেষ করছি। মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করি, উপরে যে সকল মাসনূন যিকর উল্লেখ করলাম, সেগুলি পালন করার তাওফীক আমাকে ও পাঠকদেরকে দান করুন এবং দয়া করে কবুল করে নিন; আমীন।[

1] হাদিসটির সনদ হাসান। সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৬৭, নং ৩৩৯২, ৫/৫৪২, নং ৩৫২৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/২৪২, মুসনাদ আহমাদ ২/১০, ১৯৬, বুখারী, খালকু আফ’আলিল ইবাদ, পৃ. ১১৩।

[2] মুসনাদ আহমাদ ২/২৫, সুনানু ইবনি মাজাহ ২/১২৭৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৬৯৮, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৮১-৩৮৩, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৩।
তৃতীয় প্রকার যিকর : সকাল-বিকাল বা সকাল-সন্ধ্যার যিকর - এ সময়ের অনির্ধারিত যিকর

তাসবীহ, তাহলীল ও ওয়ায

ফজরের ফরয সালাতের পরে পালনীয় তিন পর্যায়ের নির্ধারিত যিকর- আযকার উপরে আলোচনা করেছি। আমরা ফজরের পরে পালনের জন্য ৩ টি যিকর, পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে পালনীয় ২৯ প্রকার যিকর ও সকালে পালনীয় ১৭ প্রকার যিকর, মোট ৪৯ প্রকার যিকর উল্লেখ করেছি। আগ্রহী যাকির এগুলি সব বা আংশিক পালন করবেন। সংখ্যার চেয়ে আবেগ, মনোযোগ ও আন্তরিকতার মূল্য অনেক বেশি। এগুলি পালনের পরে মুমিন মনের আবেগ, আগ্রহ ও সুযোগ অনুসারের অনির্ধারিত যিকর যত বেশি সম্ভব পালন করবেন।

ফজরের পরে অনির্ধারিতভাবে যত বেশি সম্ভব তাসবীব, তাহলীল, তাহমীদ ও তাকবীরের যিকর আদায় করতে উৎসাহ দিয়েছেন রাসূলুল্লাহ (সা.)। এই অধ্যায়ের শুরুতে ফজরের পরে সূর্যোদয় পর্যন্ত যিকরে রত থাকার ফযীলতের আলোচনায় আমরা এ বিষয়ে একটি হাদীস উল্লেখ করেছি। আমরা দেখেছি, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “ফজরের সালাতের পরে সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে বসে মহান আল্লাহর যিকর, তাকবীর (আল্লাহু আকবার), তাহমীদ (আল-‘হামদলিল্লাহ), তাসবীহ (সুব‘হানাল্লাহ) ও তাহলীল (লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ) বলা আমার নিকট ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের দুইজন বা আরো বেশি ক্রীতদাসকে মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়। অনুরূপভাবে আসরের সালাতের পরে সূর্যাস্ত পযর্ন্ত এভাবে যিকর করা আমার নিকট ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশের চারজন ক্রীতদাসকে মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়।

অন্য হাদীসে আবু উমামাহ (রাঃ) বলেনঃ

خرج رسول الله صلى الله عليه وسلم على قاص يقص فأمسك، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم قص فلأن أقعد (أقعد هذا المقعد) غدوة إلى أن تشرق الشمس (من حين تصلي الغداة الى أن تشرق الشمس) أحب إلي من أعتق أربع رقاب وبعد العصر حتى تغرب الشمس أحب إلى من أن أعتق اربع رقاب


“একদিন রাসূলুল্লাহ (সা.) বেরিয়ে দেখেন একজন ওয়ায়েয ওয়ায করছেন। তাঁকে দেখে ওয়াযকারী থেমে গেলেন। তিনি বললেনঃ

তুমি বয়ান করতে থাক। ফজরের সালাতের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত এইরূপ একটি মাজলিসে বসা আমার নিকট চারজন ক্রীতদাস মুক্ত করার চেয়েও বেশি প্রিয়। এবং আসরের সালাতের পরে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এভাবে বসা আমার নিকট চারজন ক্রীতদাস মুক্ত করার চেয়ে বেশি প্রিয়। হাইসামীর আলোচনা অনুসারে হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[1]

উপরের হাদীস দু’টি থেকে আমরা ফজরের পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত অনির্ধারিত যিকরের বিবরণ পাচিছ। রাসূলুল্লাহ (সা.) এ সময়ে দুই প্রকারের যিকরে অংশ গ্রহণের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন :

(ক). তাসবীহ-তাহলীল বা চার প্রকার মূল জপমূলক যিকর, এবং
(খ). ওয়ায-আলোচনা।


(ক) যিকরের মূল চারটি বাক্য জপ করা

সুবাহানাল্লাহ, আল-হামদু লিল্লাহ, আল্লাহু আকবার, লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, আল্লাহর নাম জপ মূলক যিকরের মূল চার প্রকার বাক্য, যেগুলি দ্বারা আল্লাহর মহত্ব, মর্যাদা, একত্ব ও প্রশংসা জপ করা হয়। অন্য সকল প্রকার মাসনূন যিকরের বাক্য মূলত এগুলিকে কেন্দ্র করে আবর্তিত। এই চরটি বাক্য আল্লাহর নিকট প্রিয়তম বাক্য। পৃথকভাবে বা একত্রে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বা অনির্ধারিতভাবে যত বেশি সম্ভব এগুলি জপ করার অফুরন্ত মর্যাদা, সাওয়াব ও ফযীলত আমরা সেখানে জানতে পেরেছি।

ফজরের সালাতের পরে ‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের নামাযের প্রথম সময় পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টা সময়। এছাড়া ‘দোহা’ বা চাশতের সালাত দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায় বলে যাকির সুযোগ থাকলে এই সময় বাড়াতে পারেন।

যাকির প্রথমে উপরের তিন প্রকারের যিকর আদায় করবেন। এরপর চাশত বা দোহার সালাত আদায়ের পূর্ব পর্যন্ত বাকি সময়টুকু তিনি এই পর্যায়ের অনির্ধারিত যিকরে রত থাকবেন। যথাসম্ভব মনোযোগ, আবেগ, বিনয়ের সাথে মনেমনে বা যথাসম্ভব মৃদুস্বরে যতক্ষণ সম্ভব এই চার প্রকার বাক্য দ্বারা একত্রে, বা পৃথকভাবে যিকর করবেন। অন্তরকে সকল পার্থিব আকর্ষণ, জাগতিক চিন্তা ও ব্যস্ততা থেকে এই সময়টুকুর জন্য মুক্ত করে, আল্লাহর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে, যিকরের অথের্র দিকে লক্ষ্য রেখে হৃদয়কে অর্থের সাথে আলোড়িত করে তিনি বারবার যিকরের শব্দ উচ্চারণ করবেন: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ ...। এভাবেই ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘আল-হামদুলিল্লাহ।


হৃদয়কে অবশ্যই নাড়াতে হবে। ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ যিকরের সময় এর অর্থের দিকে সম্পূর্ণ মনোযোগ রাখতে হবে। হৃদয় থেকে আল্লাহ ছাড়া সকল অনুভূতি দূর করতে হবে। নেই, নেই, কেউ নেই, আমার ইবাদতের, প্রার্থনার, ভক্তির, ভয়ের, চাওয়ার, প্রার্থনার, আশার, ভয়ের জন্য কেউ নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।

এভাবে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ যিকরের সময় মনকে সকল না-বাচক চিন্তা থেকে মুক্ত করে, আল্লাহর নিয়ামতের কথা স্মরণ করে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতার অনুভূতিতে হৃদয়কে ভরে তুলে অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে বারবার বলতে হবে ‘আল-হামদু লিল্লাহ’। ‘সুবহানাল্লাহ’ যিকরের সময় আল্লাহর পবিত্রতা ও মহত্বের দিকে হৃদয়কে পরিপূর্ণরূপে ধাবিত করতে হবে। সবকিছুই অসম্পূর্ণ; পরিপূর্ণ পবিত্রতা শুধুমাত্র আল্লাহর। সকল মানবীয় চিন্তার ঊর্ধ্বে তিনি মহান। আমার হৃদয় তাঁরই মহত্ত্বের ঘোষণা দেয়, তাঁরই পবিত্রতার জয়গান গায়। এভাবেই ‘আল্লাহু আকবার’ যিকরের সময় মহান আল্লাহর শ্রেষ্ঠতব হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে হবে। আর সবকিছুকে হৃদয় থেকে বের করে দিতে হবে। হৃদয়কে আলোড়িত, কম্পিত ও উদ্বেলিত করতে হবে যিকরের অর্থের সাথে সাথে।


কখনো মনোযোগ পূর্ণ না হলে চিন্তিত না হয়ে যিকরে রত থাকতে হবে। মনোযোগ ও আবেগের কম-বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। তবে সর্বদা চেষ্টা করতে হবে পূর্ণতার জন্য।


(খ) কুরআন তিলাওয়াত, সালাত-সালাম ইত্যাদি

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, সাধারণ যিকরের মধ্যে অন্যতম কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ-সালাম, দু‘আ-ইস্তিগফার ইত্যাদি। এই সময়ে এ সকল যিকর সময় ও সুবিধা অনুসারে করা যেতে পারে। যাকির নিজের সুবিধা ও অবস্থা অনুসারে এই সময়ের জন্য নির্ধারিত পরিমাণে কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, ইস্তিগফার ইত্যাদি ওযীফা নির্ধারিত করে নেবেন বা সুযোগ থাকলে অনির্ধারিতভাবে তা পালন করবেন।

এখানে লক্ষণীয় যে, হাদীস শরীফে এই সময়ে তাসবীহ তাহলীল জাতীয় যিকরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। তিলাওয়াত, দরুদ ইত্যাদি যিকরের কথা বলা হয়নি। অপরদিকে রাতের ওযীফার মধ্যে বেশি বেশি তিলাওয়াত ও দরুদ সালামের উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য অনেক তাবেয়ী সকাল-বিকালের যিকরের সময়ে তাসবীহ তাহলীল জাতীয় যিকরকে তিলাওয়াতের চেয়ে উত্তম বলে মনে করতেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম মুহাদ্দিস ও ফকীহ তাবে-তাবেয়ী ইমাম আব্দুর রাহমান ইবনু আমর, আবু আমর আল-আউযায়ীকে (মৃ. ১৫৭ হি) প্রশ্ন করা হয় : ফজর ও আসরের পরে যিকরের সময়ে তাসবীহ-তাহলীল ইত্যাদি জপমূলক যিকর উত্তম না কুরআন তিলাওয়াত উত্তম? তিনি বলেনঃ তাঁদের (সাহাবী-তাবেয়ীগণের) রীতি ছিল এ সময়ে যিকরে রত থাকা। তবে তিলাওয়াত করাও ভালো।[2]

প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য প্রতিদিন কিছু পরিমাণ কুরআন তিলাওয়াত করা। অন্তত একমাসে একবার খতম করা অর্থাৎ পূর্ণ কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত। যদি মুমিন বুঝতে পারেন যে, তিনি রাত্রে কিছু সময় তিলাওয়াতে কাটাতে পারবেন তাহলে সকালের এ সময়ে যিকর করে রাতে তিলাওয়াত করা উচিত। না হলে এই সময়ের ওযীফার মধ্যে কিছু কুরআন তিলাওয়াত রাখা প্রয়োজন।


এখানে আরেকটি লক্ষণীয় বিষয়: কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে নিয়মিত তিলাওয়াত ও নিয়মিত খতম করার দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। আমাদের দেশে অধিকাংশ মুসলিম কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন না। বেশি সূরা মুখস্থও নেই। যাদের পক্ষে সম্ভব হবে তাঁরা কুরআন তিলাওয়াত শিখে নেবেন। না পারলে মুখস্থ সূরাগুলি বারবার তিলাওয়াত করতে পারেন।

আমাদের দেশে কুরআন কারীমের নির্দিষ্ট কতিপয় সূরার ফযীলতের কথা প্রসিদ্ধ। যেমন, - সূরা ইয়াসীন, সূরা রাহমান, সূরা মুলক, ইত্যাদি। এসকল ফযীলতের মধ্যে অল্প কিছু সহীহ হাদীস পাওয়া যায়, বাকি অধিকাংশই দুর্বল, অথবা বানোয়াট, মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত কথা। সর্বাবস্থায় কুরআন তিলাওয়াতের যে সকল মর্যাদা ও ফযীলত আমরা সহীহ হাদীসের আলোকে আলোচনা করেছি সেসকল ফযীলত ও সাওয়াব এসকল সূরা বা কুরআনের যে কোনো আয়াত পাঠে অর্জিত হবে। যেসকল যাকির এ ধরনের কিছু সূরা মুখস্থ করেছেন তাঁরা এ সময়ে, সকালে অথবা বিকালে অথবা যে কোনো অবসর সময়ে এ সকল মুখস্থ সূরা ওযীফা হিসাবে পাঠ করতে পারেন। তবে এর পাশাপাশি নিয়মিত কিছু পরিমাণ কুরআন দেখে তিলাওয়াত করা ও নিয়মিত কুরআন খতম করার দিকে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখতে হবে।


(গ) ওয়ায, আলোচনা, ইত্যাদি

উপরের দ্বিতীয় হাদীসে আমরা দেখেছি যে, সকালের এই সময়ে ওয়াজের যিকরকেও রাসূলুল্লাহ (সা.) উৎসাহ দিয়েছেন। যাকিরগণের জন্য সুযোগ থাকলে এই মুবারক সময়ে মাঝে মাঝে আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূলের (সা.) মহব্বত ও ঈমান বৃদ্ধিকারী, কুরআন সুন্নাহ নির্ভর ওয়ায ও আলোচনার ব্যবস্থা করতে পারেন। আল্লাহর জন্য ক্রন্দন, তাওবা ইত্যাদির জন্য এ সকল আলোচনার গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যিকরের মাজলিস অধ্যায়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।


‘সালাতুদ দোহা’ বা চাশতের সালাত

‘দোহা’ (ﺍﻟﻀـﺤﻰ) আরবী শব্দ। বাংলায় সাধারণত ‘যোহা’ উচ্চারণ করা হয়। এর অর্থ পূর্বাহ্ন বা দিনের প্রথম অংশ (forenoon)। ফারসী ভাষায় একে চাশত বলা হয়। সূর্যোদয়ের পর থেকে মধ্যাহ্ন বা দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত সময়কে আরবীতে দোহা বা যোহা বলা হয়।


সূর্য উদয়ের সময় সালাত আদায় করা নিষিদ্ধ। সূর্য পরিপূর্ণ রূপে উদিত হওয়ার পরে, অর্থাৎ সূর্যোদয়ের মুহূর্ত থেকে প্রায় ২৫ মিনিট পরে দোহা বা চাশতের সালাতের সময় শুরু। এই সময় থেকে শুরু করে দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সময়ের মধ্যে যে কোনো সময়ে এই সালাত আদায় করা যায়। ‘দোহা’র সালাত দুই রাক’আত থেকে বার রাক’আত পর্যন্ত আদায় করা যায়। তাহাজ্জুদ সালাতের পরে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাসনূন নফল সালাত দোহার সালাত। বিভিন্ন সহীহ হাদীসে এই সালাতকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বা ‘আল্লাহওয়ালাগণের সালাত’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। আমাদের দেশে এই সালাত ‘ইশরাকের সালাত’ বা ‘সূর্যোদয়ের সালাত’ বলে পরিচিত। অনেকে সূর্যোদয়ের পরের সালাতকে ‘ইশরাকের সালাত’ এবং পরবর্তী সময়ের সালাতকে ‘দোহা’ বা ‘চাশতের সালাত’ বলেন। হাদীস শরীফে ‘সালাতুদ দোহা’ বা ‘দোহার সালাত’ শব্দটিই ব্যবহার করা হয়েছে ; “ইশরাকের সালাত” শব্দটি হাদীসে পাওয়া যায় না। এছাড়া হাদীসে ইশরাক ও দোহার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য করা হয়নি। সূর্যোদয় থেকে দুপুরের পূর্ব পর্যন্ত যে কোনো সময় নফল সালাত আদায় করলে তা ‘সালাতুদ দোহা’ বা দোহার সালাত বলে গণ্য হবে।


যোহর, আসর, মাগরিব ও ইশা’র সালাতের মধ্যবর্তী সময় সীমিত। এক দুই ঘণ্টার বেশি নয়। কিন্তু ইশা ও ফজর এবং ফজর ও যোহর সালাতের মধ্যবর্তী সময় কিছুটা দীর্ঘ, প্রায় ৭/৮ ঘণ্টার ব্যবধান। এজন্য এই দুই সময়ে বিশেষভাবে নফল সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর যিকরের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যেন মুমিনের হৃদয় বেশি সময় যিকর থেকে দূরে না থাকে। এই দুই সময়ের সালাত- ‘দোহার সালাত’ ও ‘তাহাজ্জুদ বা রাতের সালাত’। এই দুই প্রকার সালাতের বিশেষ গুরুত্ব, মর্যাদা ও সাওয়াবের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[3]


আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

من صلى الصبح في جماعة ثم قعد يذكر الله حتي تطلع الشمس ثم صلى ركعتين كانت له كأجر حجة وعمرة ... تامة تامة تامة


“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামা’আতে আদায় করে বসে বসে আল্লাহর যিকর করবে সূর্যোদয় পর্যন্ত, এরপর দুই রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে একটি হজ্ব ও একটি ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে: পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ, পরিপূর্ণ (হজ্ব ও ওমরার সাওয়াব অর্জন করবে।)” হাদীসটি হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[4]


আবু উমামমাহ ও উতবাহ ইবনু আবদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:

من صلى صلاة الصبح في جماعة ثم ثبت حتى يسبح الله سبحة الضحى كان له كأجر حاج ومعتمر تاما له حجة وعمرته


“যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতে আদায় করে বসে থাকবে দোহার (চাশতের) সালাত আদায় করা পর্যন্ত, সে একটি পূর্ণ হজ্ব ও একটি পূর্ণ ওমরার মতো সাওয়াব পাবে।” হাদীসটিকে মুনযিরী ও আলবানী হাসান বলেছেন।[5]


এভাবে বসতে না পারলেও দোহার সালাত পৃথকভাবে আদায়ের জন্য হাদীসে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে এবং অশেষ সাওয়াবের সুসংবাদ প্রদান করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মাঝে মাঝে দোহার (চাশতের) সালাত আদায় করতেন। যে কোনো মুসলিম, ফজরের জামাতের পরে যিকর করুন বা না করুন, সূর্যোদয়ের পর থেকে দ্বি-প্রহরের মধ্যে দু্ই/চার রাক’আত দোহার সালাত আদায় করলেই বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত অশেষ সাওয়াব ও বরকতের আশা করতে পারবেন।

আমরা জানি যে, যাবতীয় সুন্নাত-নফল সালাত ঘরে আদায় করা উত্তম। তবে দোহার সালাতের ক্ষেত্রে একটি ব্যতিক্রম, তা মসজিদে আদায় করা ভালো বা ঘরে আদায় করার মতো একই ফযীলতের। যিনি ফজরের পরে যিকরে লিপ্ত থাকবেন তিনি মসজিদেই দোহার সালাত পরবেন।

দোহা বা চাশতের সালাতের ফযীলতের বিষয়ে অনেক সহীহ হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়া অনেক যয়ীফ হাদীসও এ বিষয়ে রয়েছে। এখানে কয়েকটি সহীহ হাদীস উল্লেখ করছি। এক হাদীসে আবূ যার গিফারী (রাঃ) বলেন,

أوصاني خليلي بثلاث لست بتاركهن أن لا أنام إلا على وتر، وأن لا أدع ركعتي الضحى فإنها صلاة الأوابين، وصيام ثلاثة أيام من كل شهر


আমার প্রিয়তম বন্ধু (রাসূলুল্লাহ (সা.)) আমাকে তিনটি বিষয়ের উপদেশ দিয়েছেন যেগুলি আমি কখনোই পরিত্যাগ করি না। (১) ঘুমানোর আগে বিতর-এর সালাত আদায় করতে, (২) দুই রাক‘আত যোহার বা চাশতের সালাত কখনো পরিত্যাগ না করতে; কারণ তা সালাতুল আওয়াবীন (আল্লাহওয়ালা তওবাকারীগণের সালাত) এবং (৩) প্রতি মাসে তিন দিন সিয়াম পালন করতে।[6]

আবু হুরাইরা (রাঃ) এবং আবু দারদা (রাঃ) একইভাবে বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদেরকে উপরের তিনটি কাজের জন্য পরামর্শ দিয়েছেন এবং তিনি জীবনে তা পরিত্যাগ করবেন না।[7]


আবু যার (রাঃ) বলেন, নবীয়ে আকরাম (সা.) বলেছেন, মানুষের দেহের প্রত্যেক জোড়া ও গিটের জন্য (শুকরিয়াস্বরূপ) প্রতিদিন সকালে দান করা তাঁর জন্য আবশ্যকীয় দায়িত্ব। ... দুই রাক’আত দোহার সালাত আদায় করলে এই দানের দায়িত্ব পালিত হয়ে যাবে।”[8]

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) একটি বাহিনী প্রেরণ করেন, তারা খুব দ্রুত অনেক যুদ্ধলব্ধ মালামাল নিয়ে ফিরে আসে। মানুষেরা এদের অতি অল্প সময়ে এত বেশি সম্পদ লাভের বিষয়ে আলোচনা করতে লাগল। তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেনঃ

أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى أَقْرَبَ مِنْهُ مَغْزًى ، وَأَكْثَرَ غَنِيمَةً ، وَأَوْشَكَ رَجْعَةً ؟ مَنْ تَوَضَّأَ ، ثُمَّ غَدَا إِلَى الْمَسْجِدِ لِسُبْحَةِ الضُّحَى ، فَهُوَ أَقْرَبُ مَغْزًى ، وَأَكْثَرُ غَنِيمَةً ، وَأَوْشَكُ رَجْعَةً


“আমি কি তোমাদেরকে এর চেয়েও নিকটবর্তী, বেশি সম্পদ লাভের ও দ্রুত প্রত্যাবর্তনের অভিযানের কথা জানিয়ে দেব না? যে ব্যক্তি ওযু করল, এরপর দোহার সালাত আদায় করতে মসজিদে গমণ করল সে ব্যক্তির অভিযান অধিকতর নিকটবর্তী, লব্ধ সম্পদ বেশি এবং ফিরেও আসল তাড়াতাড়ি।” হাদীসটি সহীহ।[9]


অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, অনুরূপ একটি ঘটনায় যখন মানুষেরা এত অল্প সময়ে ও এত সহজে এত বেশি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ লাভের বিষয়ে বলাবলি করতে লাগল, তখন রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন: “এর চেয়েও দ্রুত ও বেশি লাভ ঐ ব্যক্তির যে, সুন্দর ও পরিপূর্ণভাবে ওযু করল, এরপর মসজিদে যেয়ে ফজরের সালাত আদায় করল এবং তারপর দোহার সালাত আদায় করল, - সেই ব্যক্তি এই অভিযানকারীগণের চেয়ে কম সময়ে বেশি সম্পদ লাভ করে ফিরে আসল।২[10]

উকবা ইবনু আমির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, আল্লাহ বলেন:

يا ابن آدم اكفني أول النهار بأربع ركعات أكفك بهن آخر يومك


“হে আদম সন্তান, তুমি তোমার দিনের প্রথমভাগে চার রাক’আত সালাত আমাকে প্রদান কর, দিনের শেষভাগ পর্যন্ত তোমার জন্য আমার কাছে তাই যথেষ্ট বলে বিবেচিত হবে।” হাদীসটি সহীহ।[11]

এই একই অর্থে আরো তিনটি সহীহ হাদীস আবু দারদা, আবু যার ও মুররা তায়েফী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে।[12]


আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

من صلى الضحى ركعتين لم يكتب من الغافلين ومن صلى أربعا كتب من العابدين ومن صلى ستا كفى ذلك اليوم ومن صلى ثمانيا كتب من القانتين ومن صلى ثنتي عشرة بني الله له بيتا في الجنة وما من يوم ولا ليلة الا لله من يمن به على عباده وصدقة وما من الله على أحد من عباده أفضل من أن يلهمه ذكره


“যে ব্যক্তি দোহার সালাত দুই রাক’আত আদায় করল সে গাফিল বা অমনোযোগী বলে গণ্য হবে না। আর যে চার রাক’আত আদায় করল সে আবিদ বা বেশি বেশি ইবাদতকারী বলে গণ্য হলো। আর যে ছয় রাক’আত আদায় করল তার ঐ দিনের জন্য আর কিছু দরকার হবে না। আর যে ব্যক্তি আট রাক’আত আদায় করল, তাকে আল্লাহ ‘কানিতীন’ (উচ্চমর্যাদা সম্পন্ন ওলী) বান্দাগণের মধ্যে লিখে নিলেন। আর যে ১২ রাকা’আত আদায় করল আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে বাড়ি বানিয়ে রাখলেন। প্রতি দিন প্রতি রাতেই আল্লাহ তাঁর বান্দাগণকে কিছু বিশেষ দয়া এবং বিশেষ অনুদান প্রদান করেন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাগণকে যতপ্রকার দয়া ও অনুদান প্রদান করেছেন তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ যে, তিনি বান্দাকে তাঁর যিকর করার প্রেরণা ও তাওফীক প্রদান করবেন।” হাদীসটি হাসান বা গ্রহণযোগ্য।[13]


আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

لا يحافظ على صلاة الضحى إلا أواب قال وهي صلاة الأوابين

“একমাত্র ‘আউয়াব’ [আওয়াবীন] বা বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারী ও তাওবাকারী আল্লাহর বিশেষ ওলী ছাড়া কেউ দোহার সালাত নিয়মিত পালন করে না। এই সালাত ‘সালাতুল আউয়াবীন’ বা আউয়াবীনের সালাত।” হাদীসটি হাসান।আল্লাহ তাবারাকা ওতা‘আলা আমাদেরকে তাঁর সন্তুষ্টি প্রাপ্ত ‘আওয়াবীন’ বা প্রিয় যাকিরগণের অন্তর্ভুক্ত করে নিন। আমীন!

[1] মুসনাদ আহমাদ ২/২৬১, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ৮/২৬০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/১৯০।

[2] ইবনু রাজাব হাম্বালী, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৫৪৭।

[3] ইবনু রাজাব হাম্বালী, জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, পৃ. ৫৪৬।

[4] তিরমিযী ২/৪৮১, নং ৫৮৬, সহীহুত তারগীব ১/২৬০।

[5] সহীহুত তারগীব ১/২৬১।

[6] সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ২/২৩৭। দেখুনঃ সহীহ মুসলিম ১/৪৯৯।

[7] সহীহ বুখারী ১/৩৯৫, নং ১১২৪, ২/৬৯৯, নং ১৮৮০, সহীহ মুসলিম ১/৪৯৯, নং ৭২১, ৭২২, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৮।

[8] সহীহ মুসলিম ১/৪৯৮, নং ৭২০।

[9] মুসনাদে আহমাদ ২/১৭৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩৫, সহীহুত তারগীব ১/৩৪৯।

[10] হাদিসটি সহীহ। সহীহুত তারগীব ১/৩৪৯-৩৫০।

[11] মুসনাদে আহমাদ ৪/১৫৩, সহীহুত তারগীব ১/৩৫০।

[12] সহীহুত তারগীব ১/৩৫০।

[13] মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩৭, সহীহুত তারগীব ১/৩৫১।
তৃতীয় প্রকার যিকর - দ্বিতীয় পর্ব : দিবসের যিকর-ওযীফা - (১) কর্মব্যস্ত অবস্থার যিকর

উপরে আমরা সকালের যিকরের আলোচনা করেছি। একজন মুমিন এভাবে আল্লাহর যিকর ও দু‘আর মাধ্যমে তার দিনের শুভ সূচনা করবেন। এরপর স্বভাবতই তাকে কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়তে হবে। সারাদিন ও রাত্রের কিছু অংশ আমাদের বিভিন্ন কাজেকর্মে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নির্দেশ অনুসারে আমাদের চেষ্টা করতে হবে, সকল ব্যস্ততার মধ্যেও যেন আমাদের জিহ্বা আল্লাহর যিকরে ব্যস্ত থাকে।

পূর্ববর্তী অধ্যায়ে আমরা সর্বদা পালনের জন্য বিভিন্ন প্রকার মাসনূন যিকর আলোচনা করেছি, যে সকল যিকর বেশি বেশি পালনের জন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) উৎসাহ প্রদান করেছেন। যেমন,- ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, ‘সুব‘হানাল্লাহ’, ‘আল-‘হামদু লিল্লাহ’, ‘আল্লাহু আকবার’, ‘লা- হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ’, ‘আসতাগফিরুল্লাহ’, ‘আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদ’, ‘আল্লাহুম্মা আস’আলুকাল আফিয়্যাহ’ ইত্যাদি বাক্য।

সকল কাজের ফাঁকে, বিশেষত যখন মুখের কোনো কাজ থাকে না তখন যথাসম্ভব মনোযোগ দিয়ে চুপি চুপি এ সকল যিকরে আমাদের জিহ্বাগুলিকে আর্দ্র রাখা প্রয়োজন। এছাড়া নিজের জীবনে আল্লাহর অশেষ রহমতের ও নিয়ামতের কথা স্মরণ করা, মনের মধ্যে কৃতজ্ঞতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলা, মনকে আল্লাহর দিকে রুজু করে মনে মনে আল্লাহর কাছে নিজের দুনিয়া বা আখেরাতের জন্য প্রার্থনা করা, আল্লাহর বিধান, জান্নাত, জাহান্নাম, মৃত্যু, আখিরাত, আল্লাহর মহান রাসূল (সা.), তাঁর সাহাবীগণ ও অন্যান্য নেককার বুজুর্গগণের কথা মনে মনে চিন্তা করাও আল্লাহর যিকরের অন্তর্ভুক্ত। অযথা নীরবে বসে আকাশ-কুসুম কল্পনা করা, মনের বিরক্তি, কষ্ট বা ক্রোধ, হিংসা ইত্যাদি উদ্দীপক চিন্তা করা, অন্যান্য মানুষের দোষত্রুটি নিয়ে চিন্তা করে নিজের মন, আত্মা ও আখেরাত নষ্ট করার চেয়ে এগুলি অনেক ভালো।


প্রিয় পাঠক, আমাদের মুখ ও বিশেষ করে মন কখনই চুপ থাকে না। কোনো না কোনো কিছু নিয়ে মন ব্যস্ত থাকে। সাধারণত ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আমরা অবসর সময়ে, কখনো কখানো ঘণ্টার পর ঘণ্টা অলস চিন্তা করে থাকি। আর একটু সুযোগ পেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ সকল বিষয় নিয়ে গল্প, আলোচনা বা বিতর্ক করে সময় নষ্ট করি। আমরা একটু ভেবে দেখি না যে, আমাদের এই অলস চিন্তা বা অর্থহীন আলোচনা, বিতর্ক আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক বা জাতীয় জীবনে কোনো উপকারেই লাগছে না। বরং এগুলি আমাদের প্রভূত ক্ষতি করে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি অপ্রয়োজনীয় চিন্তা, ব্যথা, বিরক্তি, ক্রোধ, জিদ, হিংসা ইত্যাদি আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত ও কলুষিত করে। সাথে সাথে আমরা আল্লাহর যিকর করে অগণিত সাওয়াব ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হই।


একটু চেষ্টা করলেই আমরা এই ক্ষতি থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করতে পারি। মুখ বা মনের অবসর হলেই তাকে আল্লাহর যিকরে রত করি। অনেক সময় বেখেয়ালে মন বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে অলস চিন্তায় মেতে উঠে। যখনই খেয়াল হবে তখনই সেগুলিকে মন থেকে বের করে আল্লাহর যিকরে মুখ ও মনকে বা শুধু মনকে নিয়োজিত করুন। যেমন, আপনি সকালে সংবাদ শুনেছেন বা পড়েছেন - অমুক স্থানে বোমাবর্ষণ হয়েছে বা অমুক ব্যক্তির মৃত্যু, শাস্তি, পদোন্নতি বা পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আপনার চিন্তা বা আলোচনা উক্ত বিষয়ে কোনো পরিবর্তন আনবে না। তবুও ভাবতে ভালো লাগে। আপনি অফিসে, দোকানে, গাড়িতে, বাড়িতে বা পথে-ঘাটে নিজের অজান্তে ঐ বিষয়টির বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে থাকবেন। এক ভাবনা থেকে অন্য ভাবনায় সাঁতার কাটতে থাকবেন। অর্থহীন সময় নষ্ট করবেন। একটু অভ্যাস করুন। বারবার মনকে আল্লাহর যিকরের দিকে ফিরিয়ে আনুন। ইনশা আল্লাহ, এক সময় আপনি আল্লাহর প্রিয় যাকিরে পরিণত হবেন।


একটি উদাহারণ বিবেচনা করুন - এক ব্যক্তি ঢাকায় থাকেন। তার গ্রামের বাড়ি খুলনা। গ্রামের বাড়িতে তার কোনো নিকট আত্মীয়ের কঠিন অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে তিনি ব্যস্ত হয়ে দেশে ফিরছেন। ঢাকা থেকে খুলনা পৌঁছাতে তার ৮/৯ ঘণ্টা সময় লাগবে। এই দীর্ঘ সময় তিনি স্বভাবতই অত্যন্ত উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটাবেন। সারা সময় তার মনে বিভিন্ন অমঙ্গল-চিন্তা ঘুরপাক খাবে। কথা বললেও তিনি এই বিষয়ে বিভিন্ন উৎকণ্ঠা প্রকাশ করে কথা বলবেন।

কিন্তু তার এই উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, অমঙ্গল চিন্তা কি তার বা তার অসুস্থ আপনজনের কোনো উপকারে লাগবে? কখনোই না। তিনি মূলত পুরো সময়টি নেতিবাচক চিন্তা করে নষ্ট করছেন। তিনি নিজের মনকে নষ্ট করছেন। সর্বোপরি আল্লাহর যিকরের অমূল্য সুযোগ তিনি নষ্ট করছেন। এই সময় যদি তিনি সকল দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলে আল্লাহর যিকরে কাটাতেন, অথবা দু‘আর মধ্যে সময় অতিবাহিত করতেন, তাহলে তিনি সকলদিক থেকে লাভবান হতেন।


আসলে আমরা অধিকাংশ সময় অলস বা অপ্রয়োজনীয় চিন্তা অথবা ভিত্তিহীন দুশ্চিন্তা, উৎকণ্ঠা বা অমঙ্গল-চিন্তা করে সময় নষ্ট করি। একটু অভ্যাস করলে আমরা এসকল মূল্যবান সময় আল্লাহর যিকরে ব্যয় করে জাগতিক, মানসিক ও পারলৌকিকভাবে অশেষ লাভবান হতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক প্রদান করেন ; আমীন।


মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে বারংবার বেশি বেশি আল্লাহর যিকর করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (الذاكرين الله كثيرا والذكرات) বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারী পুরুষ ও নারীগণের জন্য বিশেষ মর্যাদা ও পুরস্কারের ঘোষণা প্রদান করেছেন। দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে সর্বাবস্থায় আল্লাহর যিকর করা মুমিনগণের বিশেষ পরিচয় হিসাবে উল্লেখ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) বেপরোয়াভাবে বেশি বেশি আল্লাহর যিকরকারীগণকে সবচেয়ে অগ্রগামী মুক্তিপ্রাপ্ত মানুষ বলে ঘোষণা করেছেন। আসুন আমরা সকলেই চেষ্টা করি এদের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার।

মহান আল্লাহর পবিত্র দরবারে আমাদের সকাতর আরজি যে, তিনি দয়া করে আমাদের অলসতা, অবহেলা ও দুর্বলতা ক্ষমা করেন এবং আমাদেরকে তাঁর নবীর (সা.) সুন্নাত অনুসারে বেশি বেশি যিকর করার তাওফীক দান করেন; আমীন।

তৃতীয় প্রকার যিকর - দ্বিতীয় পর্ব : দিবসের যিকর-ওযীফা - যিকর নং ১১৭ : সদা সর্বদা পালনের একটি বিশেষ দু’আ

اللهم اغفر لي وارحمني واهدني (وعافني) وارزقني


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মাগ্ ফিরলী, ওয়ার‘হামনী, ওয়াহদিনী, ওয়া ‘আ-ফিনী, ওয়ারযুকনী।

অর্থ: “হে আল্লাহ, আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে দয়া করুন, আমাকে সঠিক পথে পরিচালিত করুন, আমাকে সার্বিক নিরাপত্তা ও সুস্থতা দান করুন এবং আমাকে রিযিক দান করুন।”


সাহাবী আবু মালিক আশ’আরী (রাঃ) তাঁর পিতা সাহাবী আসিম (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাকে উপরের বাক্যগুলি দিয়ে বেশি বেশি দু‘আ করতে শেখাতেন।[1]

মুহতারাম পাঠক, এই দু‘আটি আমাদের জীবনের সকল চাওয়া পাওয়া মিটিয়ে দেয়। মুমিনের উচিত সকল ব্যস্ততার মধ্যে এই মুনাজাতটি বলতে থাকা।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৭৩, নং ২৬৯৭।
তৃতীয় প্রকার যিকর - দ্বিতীয় পর্ব : দিবসের যিকর-ওযীফা - যিকর নং ১১৮ : হাট, বাজার, শহর বা কর্মস্থলের বিশেষ যিকর

ﻻ ﺇﻟﻪ ﺇﻻ ﺍﷲ ﻭﺤﺩﻩ ﻻ ﺸﺭﻴﻙ ﻟﻪ ﻟﻪ ﺍﻟﻤﻠﻙ ﻭﻟﻪ ﺍﻟﺤﻤﺩ ﻴﺤﻴﻲ ﻭﻴﻤﻴﺕ ﻭﻫﻭ ﺤﻲ ﻻ ﻴﻤـﻭﺕ ﺒﻴـﺩﻩ ﺍﻟﺨﻴـﺭ ﻭﻫﻭ ﻋﻠﻰ ﻜل ﺸﻲﺀ ﻗﺩﻴﺭ


উচ্চারণ ও অর্থ : (পূর্বোক্ত ৩ নং ও ৬৯ নং যিকর দেখুন।)

আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি বাজারে (শহর, বন্দর বা কর্মস্থলে) প্রবেশ করে এই যিকরগুলি বলবে, আল্লাহ তাঁর জন্য এক লক্ষ সাওয়াব লিখবেন, তাঁর এক লক্ষ (সাধারণ ছোটখাট) গোনাহ মুছে দিবেন এবং তাঁর এক লক্ষ মর্যাদা বৃদ্ধি করবেন।”

হাদীসটির সনদ দুর্বল। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি সংকলন করে এর সনদের দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বিভিন্ন সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে হাদীসটির গ্রহণযোগ্যতা এসেছে বলে কোন কোন মুহাদ্দিস মতপ্রকাশ করেছেন।[1]


সাধারণত কোনো সহীহ হাদীসে কোনো যিকর বা নেক আমলের এত অপরিমেয় সাওয়াবের কথা উল্লেখ পাওয়া যায় না। এখানে পাঠক একটু চিন্তা করলেই এই অপরিমেয় সাওয়াবের কারণ বুঝতে পারবেন। যে স্থানে আল্লাহর স্মরণ ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি সেই স্থানে তাঁর যিকরের সাওয়াবও বেশি। বাজার, ঘাট, শহর, কর্মক্ষেত্র ইত্যাদি স্থানে মানুষের দেহ ও মন স্বভাবতই বিভিন্নমুখী কর্মে অত্যন্ত ব্যস্ত থাকে। এ সময়ে যে বান্দা নিজেকে আল্লাহর যিকরে নিয়োজিত রাখতে পারেন তিনি নিঃসনেদহে এই মহান পুরস্কারের অধিকারী হবেন।

প্রাচীন যুগে বাজারই ছিল সকল বাণিজ্যিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কর্মের কেন্দ্রস্থল। বর্তমানে বাজার বলতে বৃহদার্থে ‘শহর’ বা ‘কর্মক্ষেত্র’ বুঝানো যায়। সকল মুমিনের উচিত বাজারে, হাটে, দোকানে, শহরে, অফিসে, কর্মস্থলে বা যে কোনো জাগতিক বা সামাজিক ব্যস্ততার স্থানে গমন করলে প্রবেশের সময় এবং যতক্ষণ সেস্থলে অবস্থান করবে ততক্ষণ মাঝে মাঝে সুযোগমতো এই যিকরগুলি পাঠ করা।

যদি মুখে যিকর করতে না পরি তাহলে অন্তত মনে মনে আল্লাহর নিয়ামত, বিধান ইত্যাদি স্মরণ করা উচিত। তাবেয়ী আবু উবাইদাহ ইবনু আব্দুল্লাহ ইবন মাস’ঊদ বলেন: “কোনো ব্যক্তি বাজারে থাকে আর তাঁর মনের মধ্যে যদি আল্লাহর কথা স্মরণ করে, তাহলে সে সালাতে রত আছে বলে গণ্য হবে। যদি সে মনের স্মরণের সাথে সাথে ঠোঁট নাড়াতে (মুখে উচ্চারণ করতে) পারে তাহলে তা হবে উত্তম।”[2]


(২) যোহর ও আসরের সালাত

আল্লাহর স্মরণ মানব হৃদয়ের খাদ্য ও মানবাত্মার প্রাণের উৎস। কর্মময় ও সংঘাতময় দিনের ব্যস্ততায় ভারাক্রান্ত হয় মানব হৃদয়। হৃদয়ের মধ্যে জমতে থাকে উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, বিরক্তি, রাগ, হিংসা, ভয়, অনুরাগ, বেদনা, লোভ, কৃপণতা, হতাশা ইত্যাদি বিভিন্নমুখি অনুভুতি যা অত্যন্ত ক্ষতিকর কার্বনের মতো আমাদের হৃদয়কে ক্রমান্বয়ে অসুস্থ করে তোলে এবং বিভিন্ন প্রকার অন্যায়, অনৈতিক বা ক্ষতিকর কাজে আমাদের উদ্বুদ্ধ করে। এসকল ক্ষতিকর অনুভবে কঠিন ভার থেকে হৃদয়কে মুক্ত করার একমাত্র উপায় আল্লাহর স্মরণ ও প্রার্থনার মাধ্যমে মনের আবেগকে তাঁর পবিত্র দরবারে সমর্পণ করা। আর এজন্য মহান আল্লাহ বান্দার জন্য ফরয বা অত্যাবশ্যকীয় করেছেন যে, হৃদয়কে কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম ও আহার দেবে সে সালাতের মাধ্যমে।


আমরা দেখেছি যে, সালাতই সর্বোত্তম যিকর। পরিপূর্ণ আবেগ ও মনোযোগ সহকারে মুমিন তাঁর ব্যস্ততার ফাঁকে যোহর ও আসরের সালাত আদায় করবেন। এরপর সামান্য কিছু সময় আল্লাহর জপমূলক যিকর আদায় করবেন।


সাধারণত সালাত শেষ হওয়া মাত্র মুমিন হৃদয় ব্যস্ত হয়ে পড়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে কর্মে প্রবেশের জন্য। অনেক সময় সত্যিই কোনো জরুরি কাজ তাঁর থাকে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সালাতের পরেই সালাতের স্থান ত্যাগের এই অস্থিরতা শয়তানী প্রেরণা। অনেক সময় আমরা দ্রুত মসজিদ থেকে বেরিয়ে আসি, কিন্তু মসজিদের বাইরে এসে কোনো বন্ধুর সাথে দেখা হলে বা কোনো আকর্ষণীয় কথা বা দৃশ্য পেলে সেখানে অনেক সময় কাটিয়ে দিতে অসুবিধা হয় না। এজন্য মুমিনের উচিত সম্ভব হলে অস্থিরতা পরিত্যাগ করে প্রশান্ত হৃদয়ে কয়েক মিনিট আল্লাহর যিকরে রত থাকা।


যোহরের সালাতের পরের যিকর

উপরে ফজরের সালাতের পরের যিকরের দ্বিতীয় প্রকার নির্ধারিত যিকর হিসাবে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরের যিকর-সমূহের আলোচনা করেছি। সেখানে আমরা ২৯ প্রকার মাসনূন যিকর উল্লেখ করেছি। ৭১ নং থেকে ৯৯ নং যিকর। যাকির যোহরের পরেও এই যিকরগুলি পালন করবেন। সবগুলি যিকর পালন সম্ভব না হলে কিছু যিকর বেছে নিয়ে ওযীফা তৈরি করে নিতে হবে। প্রয়োজনে ওযীফা তৈরির জন্য কোনো নেককার আলিম বা মুরশিদের সাহায্য গ্রহণ করবেন।


আসরের সালাতের পরের যিকর

আসরের সালাতের পর থেকে মাগরিব পর্যন্ত সময় যিকরের বিশেষ সময়। ইতঃপূর্বে বিভিন্ন হাদীসে আসর থেকে মাগরিব পর্যন্ত যিকরে রত থাকার অভাবনীয় ফযীলত ও মর্যাদার কথা আমরা দেখেছি। এ সময়ে তিন প্রকার যিকর আদায় করতে হবে।

প্রথম প্রকার যিকর যা সকল সালাতের পরে পালনীয়। আসরের সালাতের পরেও মুমিন যোহরের সালাতের মতো উপরিউক্ত ৭১ নং থেকে ৯৯ নং পর্যন্ত ২৯ প্রকার যিকর বা সেগুলি থেকে বেছে কিছু যিকর পালন করবেন।

দ্বিতীয় প্রকার যিকর যা রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশেষ করে ফজরের পরে ও আসরের পরে নির্দিষ্ট সংখ্যায় পালনের জন্য উৎসাহ প্রদান করেছেন। উপরে সকাল-বিকাল ও সকাল-সন্ধ্যার যিকর আলোচনার সময় ১০০ নং যিকরে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফজরের ও আসরের পরে চারটি মূল তাসবীহ একশতবার করে মোট ৪০০ বার যিকর করার বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। ১০০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০০ বার ‘আল-হামদুলিল্ললাহ’, ১০০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ ও ১০০ বার ‘লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু’। ১০০ বার (লা-ইলাহা ইল্লল্লাহু)-র পরিবর্তে ১০০ বার ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকা লাহু, লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুআ আলা কুল্লি শাইয়্যিন ক্বাদীর’ পড়া যাবে। এগুলি পালনে আমাদের সকলেরই সচেষ্ট হওয়া দরকার।

তৃতীয় প্রকার যিকর যা রাসূলুল্লাহ (সা.) এই সময়ে গণনাহীনভাবে বেশি বেশি পালন করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। ফজরের সালাতের পরের অনির্ধারিত যিকরের আলোচনার সময় আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আসরের সালাতের পর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ‘সুবহানাল্লাহ’, ‘আল হামদু লিল্লাহ’, ‘লা-ইলাহা ইললল্লাহ’ ও ‘আল্লাহু আকবার’ - এই চার প্রকার যিকরে অবিরত রত থাকার উৎসাহ প্রদান করেছেন।

যাকির উপরের দুই প্রকার যিকর পালনের পরে নিজের সময়, সুযোগ ও ক্বালবী হালত অনুযায়ী যতক্ষণ ও যত বেশি সম্ভব, মনে মনে বা মৃদুস্বরে, অর্থের দিকে লক্ষ্য রেখে হৃদয়কে আলোড়িত করে এই চারটি বাক্য একত্রে বা পৃথকভাবে যিকর করবেন। সুযোগ থাকলে মাগরিব পর্যন্ত যিকর করবেন। বিশেষত শুক্রবারের দিন সূর্যাস্তের আগের সময়টুকু দু‘আ-মুনাজাতে কাটানোর চেষ্টা করবেন।

[1] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৯১, নং ৩৪২৮, সুনানু ইবনি ২/৭৫২, নং ২২৩৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৭২১-৭২৩, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ২/১০৭০, নং ৬২৩১।

[2] জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম পৃ. ৪৪৯।
তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (১) সালাতুল মাগরিব

আমরা সূর্যাস্ত থেকেই রাতের যিকরের আলোচনা শুরু করব। রাতের প্রথম অংশ মূলত কর্মময় দিবসেরই অংশ। সাধারণত আমরা মাগরিব ও ইশার সালাত কর্মব্যস্ততার মাঝেই আদায় করি। কর্মব্যস্ততার মধ্যে পালিত যিকর আযকারের দিকে আমাদের এ সময়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।


(১) সালাতুল মাগরিব

মাগরিবের সালাতের সময় মুমিন চার প্রকার যিকর আদায় করবেন :

প্রথম প্রকার : ফজর ও মাগরিবের পরে পালনীয় যিকরগুলি। এই পর্যায়ে উপরে উল্লেখিত ৬৯ নং ও ৭০ নং যিকর দু’টি পালন করতে হবে।

দ্বিতীয় প্রকার : পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে পালনীয়। পূর্বোক্ত ৭১ থেকে ৯৯ নং পর্যন্ত ২৯ প্রকার যিকর বা সেগুলি থেকে বেছে কিছু যিকর এই পর্যায়ে পালন করবেন।

তৃতীয় প্রকার : সকাল ও সন্ধ্যায় পালনীয় যিকর। উপরে আলোচিত ১০১ থেকে ১১৬ নং পর্যন্ত ১৬ প্রকার যিকর এই পর্যায়ে পালনীয়। এখানে উল্লেখ্য যে, ১১৪ নং যিকর (সকাল-বিকাল-সন্ধ্যার ১৫ নং) সন্ধ্যায় পাঠ করার সময় (আসবা‘হনা) বা (সকাল হলো)-র পরিবর্তে (আমসাইনা) বা (সন্ধ্যা হলো) বলতে হবে। এতে দু‘আটি হবে নিম্নরূপঃ

أَمْسَيْنَا وَأَمْسَى الْمُلْكُ لِلَّهِ، وَالْحَمْدُ لِلَّهِ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ، وَحْدَهُ لَا شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ، رَبِّ أَسْأَلُكَ خَيْرَ مَا فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ وَخَيْرَ مَا بَعْدَهَا، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا فِي هَذِهِ اللَّيْلَةِ وَشَرِّ مَا بَعْدَهَا، رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْكَسَلِ وَسُوءِ الْكِبَرِ، رَبِّ أَعُوذُ بِكَ مِنْ عَذَابٍ فِي النَّارِ وَعَذَابٍ فِي الْقَبْرِ


উচ্চারণঃ (আমসাইনা ওয়া আমসাল মুলকু ... ফী হা-যিহিল লাইলাতি, ...বা’দাহা, ... হা- যিহিল লাইলাতি, ... বা’দাহা, ...)।

অর্থ: সন্ধ্যা হলো, ... সন্ধ্যায় প্রবেশ করলাম। ... এই রাতের ... এই রাতের


চতুর্থ প্রকার : শুধুমাত্র সন্ধ্যায় পাঠের জন্য একটি যিকর।


যিকর নং ১১৯ : সাপ বিচ্ছুর ক্ষতি থেকে আত্মরক্ষার যিকর

أَعُوذُ بِكَلِمَاتِ اللهِ التَّامَّاتِ مِنْ شَرِّ مَا خَلَقَ


উচ্চারণঃ আ’ঊযু বিকালিমা-তিল্লা-হিত তা-ম্মা-তি, মিন শাররি মা- খালাক্বা।

অর্থঃ “আল্লাহর পরিপূর্ণ বাক্যসমূহের আশ্রয় গ্রহণ করছি, তিনি যা কিছু সৃষ্টি করেছেন তার অকল্যাণ থেকে।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট এসে বলে, হে আল্লাহর রাসূল, গত রাতে আমাকে একটি বিষাক্ত বিচ্ছু কামড় দিয়েছিল তাতে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছি। তিনি বলেন, “যদি তুমি সন্ধ্যার সময় এই কথা (উপরের দু’আটি) বলতে তাহলে তা (বিচ্ছু বা বিষধর প্রাণী) তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারত না।” অন্য বর্ণনায় তিনি বলেনঃ “যদি কেউ সন্ধ্যায় তিন বার এই বাক্যটি বলে সেই রাতে কোনো বিষ বা দংশন তাকে ক্ষতি করতে পারবে না।”[1]

এছাড়া খাওলা বিনত হাকীম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কেউ কোনো স্থানে গমন করতেন বা সফরে কোথাও থামে এবং উপরের দু‘আটি বলে, তাহলে ঐ স্থান পরিত্যাগের আগে (ঐ স্থানে অবস্থান রত অবস্থায়) কোনো কিছু তার ক্ষতি করতে পারবে না।[2]


মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ে নফল সালাত

সালাত মুমিনের অন্যতম ইবাদত ও যিকর। নফল সালাত যত বেশি সম্ভব পড়া দরকার। দিনে রাত্রে যে কোনো সময় নিষিদ্ধ সময় ছাড়া, মুমিনের উচিত সাধ্যমতো বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করা। সাওবান (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে প্রশ্ন করলাম, “কোন্ কর্ম করলে আল্লাহ আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন?” অথবা “আল্লাহর নিকট সবচেয়ে প্রিয় কর্ম কি ?” তিনি বললেনঃ (عليك بكثرة السجود) “তুমি বেশি বেশি সাজদা করবে (বেশি বেশি সালাত আদায় করবে)।”[3]

অন্য হাদীসে আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

الصلاة خير موضوع فمن استطاع أن يستكثر فليستكثر


“সালাত সর্বশ্রেষ্ঠ বিষয়, কাজেই যার পক্ষে সম্ভব হবে সে যেন যত বেশি পারে সালাত আদায় করে।” হাদীসটি হাসান।[4]


নফল সালাত আদায়ের বিশেষ সময় রাত। মাগরিব থেকে ইশা পর্যন্ত সময় রাত্রের অংশ। এ সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে ও তাঁর সাহাবীগণ বেশি বেশি নফল সালাত আদায় করতেন বলে সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। কোনো কোনো যয়ীফ হাদীসে বলা হয়েছে, মাগরিবের পর থেকে ইশা’র সালাত পর্যন্ত যে সালাত আদায় করা হয় তা ‘সালাতুল আওয়াবীন’ অর্থাৎ ‘বেশি বেশি তাওবাকারীগণের সালাত’। আমরা উপরের সহীহ হাদীসগুলিতে দেখেছি যে, দোহা’র সালাতকে ‘সালাতুল আওয়াবীন’ বলা হয়েছে। অর্থের দিক থেকে দুটি নামকরণের মধ্যে কোনো বৈপরীত্য নেই। আওয়াব বা আল্লাহর বেশি বেশি যিকরকারী ও তাওবাকারী আবিদ বান্দাগণ শুধু দোহার সালাত পড়েন, মাগরিবের পরে সালাত পড়েন না, এরূপ নয়। উভয় সময়েই তাঁরা নফল সালাত আদায় করেন।

হুযাইফা (রাঃ) বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর কাছে এসে তাঁর সাথে মাগরিবের সালাত আদায় করলাম। তিনি মাগরিবের পরে ইশা’র সালাত পর্যন্ত নফল সালাতে রত থাকলেন।” হাদীসটি সহীহ।[5]

আনাস (রাঃ) বলেন, “সাহাবায়ে কেরাম মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ে সজাগ থেকে অপেক্ষা করতেন এবং নফল সালাত আদায় করতেন।”[6] হাদীসটি সহীহ।

হাসান বসরী বলতেন, মাগরিব ও ইশা’র মধ্যবর্তী সময়ের সালাতও রাত্রের সালাত বা তাহাজ্জুদের সালাত বলে গণ্য হবে।[7]

বিভিন্ন হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো কোনো সাহাবী তাবেয়ীগণকে এই সময়ে সালাত আদায়ের জন্য উৎসাহ প্রদান করতেন।[8]

এই সময়ে কত রাক’আত সালাত আদায় করতে হবে সে বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। উপরের সহীহ হাদীসগুলি থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, মুমিন নিজের সুবিধা ও সাধ্যমতো এই সময়ে নফল সালাত আদায় করবেন। সম্ভব হলে মাগরিব থেকে ইশা পর্যন্ত পুরো সময় সালাতে কাটাবেন। না হলে যত সময় এবং যত রাক’আত পারেন আদায় করবেন। ২, ৪, ৬, ৮ বা অনুরূপ নির্ধারিত রাক’আত ওযীফা হিসাবে নির্ধারিত করে নেওয়া উত্তম।


কিছু যয়ীফ বা দুর্বল সনদের হাদীসে এই সময়ে ৪ রাক’আত বা ৬ রাক’আত, ১০ বা ২০ রাক’আত সালাত আদায়ের বিশেষ ফযীলতের কথা বলা হয়েছে। যেমন, যে ব্যক্তি এ সময়ে ৪ রাক’আত সালাত আদায় করবে, সে এক যুদ্ধের পর আরেক যুদ্ধে জিহাদ করার সাওয়াব পাবে। যে ব্যক্তি মাগরিবের পরে কোনো কথা বলার আগে ৬ রাক’আত সালাত আদায় করবে তাঁর ৫০ বৎসরের গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অথবা তার সকল গোনাহ ক্ষমা করা হবে। অন্য বর্ণনায় - সে ১২ বৎসর ইবাদত করার সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে। যে ব্যক্তি এই সময়ে ১০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তার জন্য জান্নাতে বাড়ি তৈরি করা হবে। যে ব্যক্তি এ সময়ে ২০ রাক’আত সালাত আদায় করবে, তার জন্য আল্লাহ জান্নাতে বাড়ি তৈরি করবেন। এসকল হাদীস সবই বানোয়াট বা অত্যন্ত যয়ীফ সনদে বর্ণিত হয়েছে।[9]

মুহাদ্দিসগণ বলেছেন যে, যয়ীফ হাদীসকে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কথা হিসাবে বিশ্বাস না করে সাবধানতামূলকভাবে তা পালন করা যায়, যদি তা বেশি যয়ীফ না হয় এবং সাধারণ কোনো সহীহ হাদীসের আওতায় পড়ে। এখানে সহীহ হাদীসে প্রমাণিত যে, এই সময়ে নফল সালাত বেশি বেশি আদায় করা সুন্নাত। রাক’আত নির্ধারণের বিষয়ে কোনো সহীহ হাদীস নেই। এখন যাকির ৬ রাক’আত বা ১০ রাক’আত সালাত নিয়মিত আদায় করতে পারেন এই নিয়্যাতে যে, উপরিউক্ত যয়ীফ হাদীসের সাওয়াব না পেলেও এই সময়ে সালাত আদায়ের সাওয়াব তো পাব, ইনশা আল্লাহ।

[1] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮১, নং ২৭০৯, সহীহুত তারগীব ১/৩৪০, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১১৯।

[2] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮০-২০৮১, নং ২৭০৮।

[3] সহীহ মুসলিম ১/৩৫৩, নং ৪৮৮।

[4] তাবারানী, আল-মু’জামুল আউসাত ১/৮৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৪৯, সহীহুত তারগীব ১/২২৬।

[5] ইবনু আবী শাইবা, মুসান্নাফ ২/১৫, নাসাঈ, সুনানুল কুবরা ১/৫১, ৫/৮০, সহীহুত তারগীব ১/৩৪০, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১১৯।

[6] আবু দাউদ, আস-সুনান ২/৩৫; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।

[7] বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯, সুনানু আবু দাউদ ২/৩৫, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০, ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ২/১৫, সহীহুত তারগীব ১/৩১৩।

[8] মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা ২/১৪-১৬।

[9] তিরমিযী ২/২৯৮, নং ৪৩৫, ইবনু মাজাহ ১/৩৬৯, নং ১১৬৭, বাইহাকী, আস-সুনানুল কুবরা ৩/১৯, , ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ২/১৪-১৫, বাইহাকী, শু’আবুল ঈমান ৩/১৩৩, ইবনুল মুবারাক, আয-যুহদ, পৃ. ৪৪৫-৪৪৬, শাওকানী, নাইলুল আউতার ৩/৬৫-৬৭, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৩০।
তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (২) সালাতুল ইশা

ইশার সালাত থেকে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত সময়ে পালনীয় যিকরগুলি এই পর্যায়ে আলোচনা করব। প্রথমত, সালাতুল ইশার পরের ওযীফা এবং দ্বিতীয়ত, ইশার পর থেকে ঘুমানোর পূর্ব পর্যন্ত সময়ের ওযীফা।

সালাতুল ইশার পরের যিকর

ইশা’র সালাতের পরে পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের পরে আদায়কৃত ওযীফাগুলি পালন করতে হবে। পূর্বোক্ত ৭১ থেকে ৯৯ নং পর্যন্ত ২৯ প্রকার যিকর বা সেগুলি থেকে বেছে কিছু যিকর এই পর্যায়ে পালন করবেন।

ইশার পরে রাতের ওযীফা : দরুদ ও কুরআন

মুমিনের নফল ইবাদতের মূল সময় রাত। সাহাবী - তাবেয়ীগণ রাতে তাহাজ্জুদের সালাত, কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ, দু‘আ ইত্যাদির ওযীফা নির্ধারিত করে রাখতেন। এগুলি তাঁরা যত্নসহকারে নিয়মিত পালন করতেন।[1]

ইশা’র সালাতের পরেই রাতের প্রথম অংশ। এ সময়ে যে ইবাদত করা হয় তা রাতের ইবাদত বলে গণ্য। কোনো যাকির যদি শেষ রাতে বেশি সময় পাবেন না বলে মনে করেন তাহলে তার ওযীফার একটি অংশ এই সময়ে পালন করতে পারেন। এতেও রাতের ওযীফার সাওয়াব পাওয়া যাবে। এ সময়ে নির্ধারিত পরিমাণ কুরআন পাঠ, সালাত (দরুদ) পাঠ, দু‘আ ও মুনাজাত ওযীফা করে নিতে পারেন। উপরে আমরা বেশি বেশি পালন করার মতো যিকরগুলি উল্লেখ করেছি। এসময়ে সেগুলি থেকে কিছু নির্ধারিত করে ওযীফা হিসাবে পালন করা উচিত।


সালাতুল বিতর ও আনুষঙ্গিক যিকর

ইশা’র সালাত আদায়ের পর থেকে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত বিতির সালাতের সময়। বিতির সালাত আদায়ের সর্বোত্তম সময় শেষ রাত্র। শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদ সালাতের শেষে বিতির আদায় করা বেশি সাওয়াবের এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর আচরিত সুন্নাত। তবে কেউ শেষ রাতে উঠতে পারবেন না বলে সন্দেহ করলে তাঁর জন্য ঘুমানোর আগে বিতির আদায় করা ভালো।

আমরা সাধারণত ইশা’র সালাতের পরপরই বিতির আদায় করে নেই। এতে কোনো দোষ নেই, তবে আমরা দুটি উত্তম সময়ের কোনোটিরই বরকত অর্জন করতে পারলাম না। যারা শেষ রাতে উঠতে পারবেন না বলে ভয় পান তাদের উচিত রাত ১০ বা ১১ টা বা যখনই ঘুমাতে যাওয়ার সময় হবে, তখন ওযু করে সম্ভব হলে কয়েক রাক’আত নফল সালাত আদায় করে এরপর বিতির আদায় করে ঘুমাতে যাওয়া। এতে আমরা কয়েকটি অতিরিক্ত সাওয়াব ও ফযীলত অর্জন করতে পারি :


(ক) দ্বিতীয় উত্তম সময়ে বিতির আদায় : আমরা দেখেছি যে, ইশা’র পরে বিতির আদায় করা জায়েয, কোনো অসুবিধা নেই, তবে বিতিরের সর্বোত্তম সময় শেষ রাত্র এবং দ্বিতীয় উত্তম সময় ঘুমানোর পূর্বে।

(খ) তাহাজ্জুদের সালাতের আংশিক সাওয়াব : এ সময়ের সালাতও রাতের সালাত হিসাবে গণ্য। বিশেষত রাতের একতৃতীয়াংশ অতিবাহিত হওয়ার পরে সালাত ও দু‘আর বিশেষ ফযীলত আমরা পূর্বে আলোচনা করেছি।

(গ) ওযু অবস্থায় ঘুমানোর ফযীলত : ঘুমের জন্য ওযু অবস্থায় শয়ন করা একটি গুরুত্বপূর্ণ মাসনূন ইবাদত। রাসূলুল্লাহ (সা.) এজন্য বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করেছেন এবং এ জন্য বিশেষ দুটি পুরস্কারের সুসংবাদ প্রদান করেছেন। একটি হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু উমার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন :

طَهِّرُوا هَذِهِ الأَجْسَادَ طَهَّرَكُمُ اللَّهُ فَإِنَّهُ لَيْسَ مِنْ عَبْدٍ يَبِيتُ طَاهِرًا إِلا بَاتَ مَلَكٌ فِي شِعَارِهِ لا يَنْقَلِبُ سَاعَةً مِنَ اللَّيْلِ إِلا قَالَ اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِعَبْدِكَ فَإِنَّهُ بَاتَ طَاهِرًا


“তোমরা তোমাদের দেহগুলিকে পবিত্র রাখবে, আল্লাহ তোমাদের পবিত্র করুন। যদি কোনো বান্দা ওযু অবস্থায় ঘুমান, তাহলে তার পোশাকের মধ্যে একজন ফিরিশতা শুয়ে থাকেন। রাত্রে যখনই এই ব্যক্তি নড়াচড়া করে তখনই এই ফিরিশতা বলেনঃ হে আল্লাহ আপনি এই ব্যক্তিকে ক্ষমা করে দিন, কারণ সে ওযু অবস্থায় ঘুমিয়েছে।” হাদীসটি হাসান।[2] অন্য হাদীসে মু’আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

ما من امرئ مسلم يبيت طاهرا (على ذكر الله) فيتعار من الليل فيسأل الله من خير الدنيا والاخرة الا أعطاه اياه


“যে কোনো মুসলিম যদি ওযু অবস্থায় (আল্লাহর যিকরের উপর) ঘুমায় ; এরপর রাত্রে কোনো সময় হঠাৎ তাঁর ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং সে (ঐ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে) আল্লাহর কাছে তাঁর জাগতিক বা পারলৌকিক কোনো কল্যাণ কামনা করে, তাহলে আল্লাহ তাঁকে তাঁর প্রার্থিত বস্তু দিবেনই।”[3]


যিকর নং ১২০ : সালাতুল বিতরের পরের যিকর

উবাই ইবনু কা’ব বলেন , রাসূলুল্লাহ (সা.) ৩ রাক’আত বিতর আদায় করতেন, প্রথম রাক’আতে “সাবিবহিস্মা রাব্বিকাল আ’লা”, দ্বিতীয় রাক’আতে “কাফিরূন” ও তৃতীয় রাক’আতে “ইখলাস” পড়তেন এবং রুকুর আগে কুনূত পাঠ করতেন। বিতির সালাত শেষ হলে তিনি বার বলতেনঃ

سبحان الملك القدوس


উচ্চারণঃ সুব’হা-নাল মালিকিল কুদ্দূস।

অর্থঃ “ঘোষণা করছি পবিত্রতা মহান মহা পবিত্র সম্রাটের।” তিনি শেষবারে লম্বা (জোরে শব্দ) করে বলতেন। হাদীসটির সনদ সহীহ।[4]

[1] মুসান্নাফ ইবনু আবী শাইবা ৬/১৪৩, মুখতাসারু কিতাবিল বিতর ১/১৭৩।

[2] সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৩২৮, তাবারানী, আল-মু’জামুল কাবীর ১২/৪৬৬, সহীহুত তারগীব ১/৩১৭।

[3] হাদিসটি সহীহ। নাসাঈ, সুনানুল কুবরা ৬/২০২, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১০, নং ৫০৪২, মাজমাউয যাওয়াইদ ১/২২৩, ২২৬-২২৭, সহীহুত তারগীব ১/৩১৭।

[4] সুনানু আবী দাউদ ২/৬৫, নং ১৪৩০, সুনানুন নাসাঈ ৩/২৩৫, নং ১৬৯৯, সহীহ ইবনু হিব্বান ৬/২০৩, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪০৬, নাবাবী, আল-আযকার ১৩৪।
তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (৩) শয়নের যিকর

যিকরের একটি বিশেষ সময় ঘুমানের পূবে বিছানায় শুয়ে। আমরা ইতঃপূর্বে হাদীস শরীফে দেখেছি যে, কেউ যদি কখনো শয়ন করে সেই শয়নের মধ্যে আল্লাহর যিকর না করে তাহলে সেই শয়ন তার জন্য ক্ষতির কারণ হবে। অন্য হাদীসে জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

إن الرجل إذا آوى إلى فراشه ابتدره ملك وشيطان، فيقول الملك اللهم اختم بخير فقال الشيطان اختم بشر. فإن ذكر الله تعالى ثم نام بات الملك يكلؤه


যখন কোনো মানুষ বিছানায় শয়ন করে তখন একজন ফিরিশতা ও একজন শয়তান তার নিকট আসে। ফিরিশতা বলে, হে আল্লাহ, কল্যাণ ও মঙ্গল দিয়ে এর দিনের সমাপ্তি করুন। আর শয়তান বলে, অমঙ্গলের সাথে এর সমাপ্তি হোক। যদি ঐ ব্যক্তি আল্লাহর যিকর করে নিদ্রা যায় তাহলে সারারাত ঐ ফিরিশাত তাঁকে দেখাশুনা ও হেফাযত করেন।” হাদীসটি সহীহ।[1]

এই সময়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন প্রকারের যিকর করতেন এবং তিনি উম্মতকে বিভিন্ন যিকর ও দু‘আ শিক্ষা দিয়েছেন। দু‘আগুলি অত্যন্ত আকর্ষণীয়, কিন্তু আমাদের জন্য মুখস্থ করা বা পালন করা কষ্ট হবে মনে করে এখানে অল্প কয়েকটি দু‘আ উল্লেখ করছি। এছাড়া কিছু মাসনূন যিকর এখানে উল্লেখ করা হলো।


(১) যিকর নং ১২১ : ১০০ তাসবীহ

৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ , ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’, ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’:

ফাতেমা (রাঃ) নিজের হাতে যাতা ঘুরিয়ে ও সংসারের সকল কর্ম একা করতে কষ্ট পেতেন। আলী (রাঃ) তাঁকে পরামর্শ দেন যে, তোমার আব্বার নিকট যুদ্ধলব্ধ একটি দাসী চাও, যে তোমাকে সংসার কর্মে সাহায্য করবে। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর সাথে দেখা করতে এসে তাঁকে না পেয়ে ফিরে যান। রাত্রে তাঁরা বিছানায় শুয়ে পড়লে রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁদের কাছে আসেন। তিনি বলেন, “আমার আসহাবে সুফফার দরিদ্র সাহাবীগণকে বাদ দিয়ে তোমাকে কোনো দাসী দিতে পারব না। তবে দাসীর চেয়েও উত্তম বিষয় তোমাদেরকে শিখিয়ে দিচ্ছি। তোমরা যখন বিছানায় শুয়ে পড়বে তখন ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ , ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ এবং ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে।”[2]

অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “কোনো মুসলিম যদি দু’টি কাজ নিয়মিত করতে পারে তাহলে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। কাজ দু’টি খুবই সহজ কিন্তু করার মানুষ খুব কম। প্রথমত, প্রত্যেক সালাতের পরে ১০ বার ‘সুবহানাল্লাহ’, ১০ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ ও ১০ বার ‘আল্লাহু আকবার’ বলবে। এতে ১৫০ বার জিহ্বার যিকর হবে এবং আল্লাহর কাছে আমলনামায় বা মীযানে ১৫০০ সাওয়াব হবে। দ্বিতীয়ত, বিছানায় শয়ন করার পরে ৩৪ বার ‘আল্লাহু আকবার’, ৩৩ বার ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ ও ৩৩ বার ‘সুবহানাল্লাহ’ বলবে। এতে মুখে ১০০ বার ও মীযানে ১০০০ বার হবে।” রাসূলুল্লাহ (সা.) আঙ্গুলে

গুণে গুণে তা দেখান। সাহাবীগণ প্রশ্ন করেন, “এই দু’টি কর্ম সহজ হওয়া সত্ত্বেও পালনকারী কম কেন?” তিনি উত্তরে বলেনঃ “কেউ শুয়ে পড়লে শয়তান এসে এগুলি বলার আগেই ঘুম পাড়িয়ে দেয়। সালাতের পরে এগুলি বলার আগেই তাকে তার বিভিন্ন কথা মনে করিয়ে দেয়।” হাদীসটি সহীহ।[3]


(২) যিকর নং ১২২ : আয়াতুল কুরসী

আবু হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, কেউ রাতে বিছানায় শয়ন করার পরে আয়াতুল কুরসী পাঠ করলে সারারাত আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁকে হেফাযত করা হবে এবং কোনো শয়তান তাঁর নিকট আসতে পারবে না।[4]


(৩) যিকর নং ১২৩ : সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত

আবু মাস’ঊদ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যদি কেউ রাতে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পাঠ করে তাহলে তা তাঁর জন্য যথেষ্ট হবে।[5]


(৪) যিকর নং ১২৪ : সূরা কাফিরূন

নাওফাল আল-আশজায়ী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেছেন, তুমি সূরা ‘কাফিরূন’ পড়ে ঘুমাবে, এ শির্ক থেকে তোমার বিমুক্তি। হাদীসটি হাসান। এই অর্থে ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে আরেকটি হাদীস হাসান সনদে বর্ণিত হয়েছে।[6]


(৫) যিকর নং ১২৫ : সূরা ইখলাস

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নবীজী (সা.) তাঁর সাহাবীগণকে বললেন: তোমরা কি পারবে না রাতে কুরআনের একতৃতীয়াংশ তিলাওয়াত করতে? বিষয়টি তাঁদের কাছে কষ্টকর মনে হলো। তাঁরা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কে-ই বা তা পারবে? তখন তিনি বলেনঃ ‘কুল হুআল্লাহু আহাদ্’ সূরাটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ।’ আবু দারদা (রাঃ) থেকে একই অর্থে আরেকটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[7]


(৬) যিকর নং ১২৬ :

সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস একত্রে (তিন বার)

দুই হাত একত্র করে এই সূরাগুলি পাঠ করে হাতে ফুঁ দিয়ে হাত দু’টি যথাসম্ভব শরীরের সর্বত্র বুলানো। - এভাবে ৩ বার।

আয়েশা (রাঃ) বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রতি রাতে বিছানায় গমনের পরে তাঁর মুবারক দু’টি হাত একত্রিত করে তাতে ফুঁ দিতেন এবং তাতে উপরের তিনটি সূরা পাঠ করতেন। এরপর শরীরের যতটুকু সম্ভব স্থান দুই হাত দিয়ে মোছেহ করতেন। মাথা, মুখ ও শরীরের সামনের দিক থেকে শুরু করতেন। - এভাবে ৩ বার করতেন।”[8]


(৭) যিকর নং ১২৭ :

সূরা বনী ইসরাঈল (কুরআন কারীমের ১৭ নং সূরা)


(৮) যিকর নং ১২৮ :

সূরা সাজদা, (কুরআন কারীমের ৩২ নং সূরা)


(৯) যিকর নং ১২৯ :

সূরা যুমার (কুরআন কারীমের ৩৯ নং সূরা)


(১০) যিকর নং ১৩০ :

সূরা মুলক (কুরআন কারীমের ৬৭ নং সূরা)

জাবির (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা সাজদাহ ও সূরা মুলক তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) সূরা বানী ইসরাঈল ও সূরা যুমার তিলাওয়াত না করে ঘুমাতেন না। অন্য হাদীসে আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যেক রাতে সূরা সাজদাহ ও সূরা যুমার পাঠ করতেন। হাদীসগুলি সহীহ।[9]


(১১) ১৩১ নং যিকর : বিশেষ মুনাজাত

اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَوَاتِ وَرَبَّ الأَرْضِ وَرَبَّ الْعَرْشِ الْعَظِيمِ رَبَّنَا وَرَبَّ كُلِّ شَيْءٍ فَالِقَ الْحَبِّ وَالنَّوَى مُنْزِلَ التَّوْرَاةِ وَالإِنْجِيلِ وَالْفُرْقَانُ أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ كُلِّ شَيْءٍ أَنْتَ آخِذٌ بِنَاصِيَتِهِ اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الظَّاهِرُ فَلَيْسَ فَوْقَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الْبَاطِنُ فَلَيْسَ دُونَكَ شَيْءٌ اقْضِ عَنَّا الدَّيْنَ وَأَغْنِنَا مِنَ الْفَقْرِ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, রাব্বাস সামা-ওয়া-তি ওয়ারাব্বাল আরদ্বি ওয়ারাব্বাল ‘আরশিল ‘আযীম। রাব্বানা- ওয়ারাব্বা কুল্লি শাইয়িন, ফা-লিকিল হাবিব ওয়ান নাওয়া-। ওয়া মুনযিলাত তাওরা-তি ওয়াল ইনজীলি ওয়াল ফুরকা-ন। আ‘ঊযু বিকা মিন শার্রি কুল্লি শাইয়িন আনতা আ-খিযুম বিনা-সিয়্যাতিহী। আল্লা-হুম্মা, আনতাল আউআলু, ফালাইসা ক্বাবলাকা শাইউন। ওয়া আনতাল আ- খিরু ফালাইসা বা’দাকা শাইউন। ওয়া আনতায যা-হিরু ফালাইসা ফাউক্বাকা শাইউন। ওয়া আনতাল বা-তিনু ফালাইসা দূনাকা শাইউন। ইকদ্বি আন্নাদ দাইনা ওয়া আগনিনা- মিনাল ফাক্বর।


অর্থ: “হে আল্লাহ, আসমানসমূহ ও জমিনের প্রভু এবং মহান আরশের প্রভু, আমাদের প্রভু এবং সবকিছুর প্রভু, যিনি অঙ্কুরিত করেন শস্য বীজ ও আঁটি, যিনি নাযিল করেছেন তাওরাত, ইঞ্জিল ও ফুরকান; আমি আশ্রয় গ্রহণ করছি আপনার কাছে আপনার নিয়ন্ত্রণে যা কিছু রয়েছে সবকিছুর অকল্যাণ ও অমঙ্গল থেকে। হে আল্লাহ, আপনিই প্রথম, আপনার পূর্বে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই শেষ, আপনার পরে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই প্রকাশ্য, আপনার উপরে আর কিছুই নেই। এবং আপনিই গোপন, আপনার নিম্নে আর কিছুই নেই। আপনি আমাদের ঋণমুক্ত করুন এবং আমাদেরকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দিয়ে সচ্ছলতা প্রদান করুন।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে বিছানায় শয়ন করার পরে (ডান কাতে শুয়ে) এই মুনাজাতটি পাঠ করতে শিক্ষা দিতেন। অন্য বর্ণনায় তিনি বলেন, ফাতিমা (রাঃ) তাঁর কাছে খাদিমা চাইলে তিনি তাঁকে দু‘আটি শিখিয়ে দেন।[10]


(১২) যিকর নং ১৩২ :

باسمك ربي وضعت جنبي وبك أرفعه، إن أمسكت نفسي فأرحمها، وإن أرسلتها فاحفظها بما تحفظ به عبادك الصالحين


উচ্চারণঃ বিসমিকা রাব্বী ওয়াদ্বা‘তু জানবী ওয়াবিকা আরফা‘উহু। ইন আমসাকতা নাফসী ফার‘হামহা-। ওয়াইন আরসালতাহা- ফা‘হফাযহা বিমা- তা‘হফাযু বিহী ‘ইবা-দাকাস সালিহীন।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আপনার নাম নিয়ে আমার পার্শ (বিছানায়) রাখলাম এবং আপনার নামেই তাকে উঠাব। আপনি যদি আমার আত্মাকে রেখে দেন (মৃত্যু দান করেন) তাহলে তাকে রহমত করবেন। আর যদি তাকে ছেড়ে দেন (ঘুমের পরে আবার জেগে উঠি) তাহলে আপনি তাকে হেফাযত করবেন যেভাবে আপনার নেককার বান্দাগণকে হেফাযত করেন।”

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন বিছানায় শয়ন করতে যাবে তখন নিজের পোশাক দিয়ে হলেও বিছানাটি ঝেড়ে নেবে ... এরপর বলবে : (উপরের দু‘আ)।[11]


(১৩) যিকর নং ১৩৩ : পূর্বোক্ত ৭৮ নং যিকর (তিন বার)

اللهم قني عذابك يوم تبعث عبادك


উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ক্বিনী ‘আযা-বাকা ইয়াওমা তাব’আসু ইবা-দাকা।

অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমাকে রক্ষা করুন আপনার শাস্তি থেকে যেদিন আপনি পুনরুত্থিত করবেন আপনার বান্দাগণকে।”

উম্মুল মমিনীন হাফসা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানর ইচ্ছা করলে তাঁর ডান হাত গালের নিচে রাখতেন। এরপর দু’আটি ৩ বার বলতেন। বারা ইবনু আযিব (রাঃ) ও হুযাইফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) থেকে একই অর্থে আরো হাদীস বর্ণিত হয়েছে। হাদীসগুলির কোনোটি সহীহ কোনোটি হাসান।[12] ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ফরয সালাতের পরেও এই দু’আটি বলতেন।


(১৪) যিকর নং ১৩৪ :

باسمك ربي وضعت جنبي فاغفرلي ذنبي


উচ্চারণঃ বিসমিকা রাব্বী, ওয়াদ্বা‘অ্তু জানবী, ফাগফির লী যাম্বী।

অর্থঃ “হে আমার প্রভু, আপনারই নামে শয়ন করলাম। আপনি আমার গোনাহ ক্ষমা করে দিন।”

আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) বলেন, নবীজী (সা.) যখন বিছানায় ঘুমের জন্য শয়ন করতেন, তখন উপরোল্লেখিত দু‘আটি বলতেন। হাদীসটি হাসান।[13]


(১৫) যিকর নং ১৩৫ :

باسمك اللهم أموت وأحيا


উচ্চারণঃ বিসমিকা, আল্লা-হুম্মা, আমূতু ওয়া আ‘হইয়া-।

অর্থ: “আপনারই নামে, হে আল্লাহ, আমি মৃত্যু বরণ করি এবং জীবিত হই।”

হুযাইফা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘুমানোর এরাদা করলে এই যিকরটি বলতেন।[14]


(১৬) যিকর নং ১৩৬

الحمد لله الذي أطعمنا وسقانا وكفانا وآوانا فكم ممن لا كافي له ولا مؤوي


উচ্চারণঃ আল‘হামদু লিল্লা-হিল্লাযী আত্ব‘আমানা- ওয়া সাকা- না-, ওয়াকাফা-না- ওয়া আ-ওয়া- না-। ফাকাম মিম্মান লা- কা-ফিয়া লাহু ওয়ালা- মু‘ওয়ী।

অর্থ: “সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদেরকে খাদ্য দান করেছেন, পানীয় দান করেছেন, সকল অভাব মিটিয়েছেন এবং আশ্রয় প্রদান করেছেন। কত মানুষ আছে, যাদের অভাব মেটানোর বা আশ্রয় প্রদানের কেউ নেই।”

আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন বিছানায় শয়ন করতেন তখন এই দু‘আটি বলতেন।[15]


(১৭) যিকর নং ১৩৭ :

(পূর্বোক্ত ১১৫ নং যিকর, সকাল-সন্ধ্যা ১৬ নং)

اللهم عالم الغيب والشهادة فاطر السموات والأرض


আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) আবু বকরকে (রাঃ) উপরের মুনাজাতটি সকালে, সন্ধ্যায় ও বিছানয় শোয়ার পরে পাঠের জন্য শিক্ষা দিয়েছিলেন।


(১৮) যিকর নং ১৩৮ :

اللَّهُمَّ امتِعْنِي بِسَمْعِي، وَبَصَرِي، وَاجْعَلْهُمَا الْوَارِثَ مِنِّي، اللَّهُمَّ انْصُرْنِي عَلَى مَنْ يَظْلِمُنِي، وَخُذْ مِنْهُ بِثَأْرِي اللَّهُمَّ إنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنْ غَلَبَةِ الدَّيْنِ وَمِن الْجُوعِ فَإنَّهُ بِئسَ الضَّجيع


উচ্চারণ : আল্লা-হুম্মা, আমতি‘অ্নী বিসমা‘ঈ, ওয়াবাসারী, ওয়াজ্-‘আলহুমাল ওয়া-রিসা মিন্নী। আল্লা-হুমান্-সুরনী ‘আলা- ‘আদুও্ঈ, ওয়া আরিনী ফীহি সা’রী। আল্লা-হুম্মা, ইন্নী আ‘ঊযু বিকা মিন গালাবাতিদ দাইনি, ওয়া মিনাল জূ’ই, ফাইন্নাহু বি‘সাদ্দ্বাজী‘য়।


অর্থঃ “হে আল্লাহ, আমরণ আমার শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণ্ণ ও নিরাপদ রাখুন। হে আল্লাহ, আমাকে আমার শত্রুর বিরুদ্ধে সাহায্য করুন এবং তার জুলুমের প্রতিশোধ গ্রহণ করে আমাকে দেখান। হে আল্লাহ, আমি ঋণের বোঝা থেকে আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি এবং ক্ষুধা থেকে ; নিশ্চয় ক্ষুধা অত্যন্ত বাজে সঙ্গী।”

এই দু’আর বাক্যগুলি বলে রাসূলুল্লাহ (সা.) বিভিন্ন সময়ে মুনাজাত করতেন বলে বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম নববী একটি বর্ণনায় উল্লেখ করেছেন যে, তিনি বিছানায় শয়ন করার পরেও এই মুনাজাতটি বলতেন।[16]


(১৯) যিকর নং ১৩৯ : (পূর্বোক্ত ১৮ নং যিকর): ৩ বার

استغفر الله العظيم الذي لا إله إلا هو الحي القيوم وأتوب إليه


উচ্চারণঃ আসতাগফিরুল্লা-হাল্ ‘আযীম, আল্লাযী লা ইলা-হা ইল্লা- হুআল ‘হাইউল কাইঊমু ওয়া আতূবু ইলাইহি।

অর্থঃ “আমি মহান আল্লাহর ক্ষমা প্রার্থনা করছি, যিনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই, তিনি চিরঞ্জীব ও সর্ব সংরক্ষক, এবং তাঁর কাছে তাওবা করছি।”


আমরা এই বাক্যটির সাধারণ মর্যাদা ও গুরুত্ব আগেই জেনেছি। সাধারণভাবে সর্বদা এই যিকরটি পালনীয়। ইমাম তিরমিযী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি বিছানায় শয়ন করার সময় এই কথাগুলি ৩ বার বলবে আল্লাহ তাঁর গোনাহসমূহকে ক্ষমা করবেন, যদিও তা সমুদ্রের ফেনা সমতুল্য হয়।” আল্লামা ইরাকীর বিবরণ অনুযায়ী হাদীসটির সনদ গ্রহণযোগ্য।[17]


(২০) যিকর নং ১৪০ : ঘুমের আগে সর্বশেষ মুনাজাত :

اللَّهُمَّ أَسْلَمْتُ نَفْسِي إِلَيْكَ وَفَوَّضْتُ أَمْرِي إِلَيْكَ وَأَلْجَأْتُ ظَهْرِي إِلَيْكَ رَغْبَةً وَرَهْبَةً إِلَيْكَ لا مَلْجَأَ وَلا مَنْجَا مِنْكَ إِلا إِلَيْكَ آمَنْتُ بِكِتَابِكَ الَّذِي أَنْزَلْتَ وَبِنَبِيِّكَ الَّذِي أَرْسَلْتَ


উচ্চারণ: আল্লা-হুম্মা, আসলামতু নাফসী ইলাইকা, ওয়াফাওআদ্বতু আমরী ইলাইকা,ওয়া আলজা’তু যাহরী ইলাইকা, রাগবাতান ওয়ারাহবাতান ইলাইকা, লা- মালজাআ ওয়ালা- মানজা- মিনকা ইল্লা- ইলাইকা। আ-মানতু বিকিতা-বিকাল্লাযী আনযালতা, ওয়াবি নাবিয়্যিকাল্লাযী আরসালতা।


অর্থ: “হে আল্লাহ, আমি সমর্পণ করলাম আমাকে আপনার নিকট, দায়িত্বার্পণ করলাম আপনাকে আমার যাবতীয় কর্মের, আমার পৃষ্ঠকে আপনার আশ্রয়ে সমর্পিত করলাম, আপনার প্রতি আশা ও ভয়ের সাথে। আপনার নিকট থেকে আপনি ছাড়া কোনো আশ্রয়স্থল নেই ও কোনো মুক্তির স্থান নেই। আমি ঈমান এনেছি আপনি যে কিতাব নাযিল করেছেন তার উপর এবং আপনি যে নবী (সা.) প্রেরণ করেছেন তার উপর।”


বারা ইবনুল আযিব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে বলেন, “যখন তুমি বিছানায় যাবে তখন সালাতের ওযুর মতো ওযু করবে। এরপর ডান কাতে শুয়ে বলবেঃ (উপরের বাক্যগুলি)। এই বাক্যগুলি তোমার শেষ কথা হবে (এর পরে আর কোনো কথাবার্তা বলবে না)। যে ব্যক্তি এই দু‘আ পাঠের পরে সেই রাত্রিতে মৃত্যুবরণ করবে সেই ব্যক্তি ফিতরাতের উপরে (নিষ্পাপভাবে) মৃত্যু বরণ করবে। আর যদি বেঁচে থাকে তাহলে কল্যাণময় দিবস শুরু করবে।”[18]


তাহাজ্জুদের নিয়্যাতসহ ঘুমাতে যাওয়া

ঘুমানোর সময় রাত্রে উঠে তাহাজ্জুদ আদায়ের দৃঢ় ইচ্ছা নিয়ে ঘুমাতে হবে। বিভিন্ন হাদীসে বলা হয়েছে যে, যদি কেউ তাহাজ্জুদ আদায়ের নিয়্যাতসহ ঘুমায় কিন্তু রাত্রে ঘুম থেকে উঠতে না পারে, তাহলেও সে তাহাজ্জুদের সাওয়াব লাভ করবে। এসকল হাদীসের একটি হাদীসে আবু দারদা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেনঃ

مَنْ أَتَى فِرَاشَهُ، وَهُوَ يَنْوِي أَنْ يَقُومَ فَيُصَلِّيَ مِنَ اللَّيْلِ، فَغَلَبَتْهُ عَيْنُهُ حَتَّى يُصْبِحَ، كُتِبَ لَهُ مَا نَوَى، وَكَانَ نَوْمُهُ صَدَقَةً عَلَيْهِ مِنْ رَبِّهِ


“যদি কেউ রাতে উঠে তাহাজ্জুদ আদায় করবে বলে নিয়্যাত করে ঘুমায়, কিন্তু তার ঘুমের আধিক্যের কারণে ভোরের আগে (ফজরের আগে) উঠতে না পারে, তাহলে তাঁর নিয়্যাত অনুসারে সাওয়াব তাঁর জন্য লিখা হবে, আর তাঁর ঘুম আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর জন্য দান হিসাবে গণ্য হবে।” হাদীসটি সহীহ।[19]


রাত্রে ঘুম না হলে বা ঘুম ভেঙ্গে গেলে যিকর

রাত্রে যে কোনো সময় ঘুম ভাঙ্গলে তাহাজ্জুদ আদায় করা যায়, তবে শেষ রাত্রে তাহাজ্জুদ আদায় উত্তম। রাতে ঘুম ভাঙ্গলে শোয়া অবস্থায় উপরে উল্লেখিত ৩৫ নং যিকরটি (সকালের প্রথম যিকর) পাঠ করতে হবে এবং আল্লাহর কাছে নিজের জাগতিক, পারিবারিক ও ধর্মীয় সকল বিষয়ে প্রার্থনা করতে হবে। এভাবে শুয়ে শুয়ে যিকর ও মুনাজাত করতে করতে আবার ঘুম এসে যাবে। আর তাহাজ্জুদের ইচ্ছা হলে তাহলে নিম্নলিখিতভাবে তাহাজ্জুদ আদায় করতে হবে।

1] সহীহ ইবনু হিব্বান ২/৩৪৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২০, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৮০-৩৯০, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৪১।

[2] সহীহ বুখারী ৩/১১৩৩, ৩/১৩৫৮, ৫/২০৫১, ৫/২৩২৯, নং ২৯৪৫, ৩৫০২, ৫০৪৬, ৫৯৫৯, সহীহ মুসলিম ৪/২০৯১, নং ২৭২৭, ফাতহুল বারী ১১/১২০।

[3] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১৬, নং ৫০৬৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৫/৩৫৪, সহীহুত তারগীব ১/৩২১-৩২২।

[4] সহীহ বুখারী ২/৮১২, ৩/১১৯৪, ৪/১৯১৪, নং ২১৮৭, ৩১০১, ৪৭২৩।

[5] সহীহ বুখারী ৪/১৪৭২, ১৯১৪, ১৯২৩, ১৯২৬, নং ৩৭৮৬, ৪৭২২, ৪৭৫৩, ৪৭৬৪, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৪-৫৫৫, নং ৮০৭।

[6] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭৪, নং ৩৪০৩, সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১৩, নং ৫০৫৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ৩/৭০, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২১, নাবাবী আল-আযকার, পৃ. ১৩৯।

[7] সহীহ বুখারী ৪/১৯১৬, ৪৭২৭, সহীহ মুসলিম ১/৫৫৬, নং ৮১১।

[8] সহীহ বুখারী ৪/১৯১৬, নং ৪৭২৯, ৫/২১৬৫, ২১৬৯, ২১৭০।

[9] সুনানুত তিরমিযী ৫/১৮১, নং ২৯২০, নাসাঈ, আমালুল ইয়াওম, পৃ. ৪৩১, মুসনাদ আহমাদ ৩/৩৪০, মুসনাদ আবী ইয়ালা ৮/১০৬, ২০৩, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ২/৮৭৯, নং ৪৮৭৩, ৪৮৭৪।

[10] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৩।

[11] সহীহ বুখারী ৫/২৩২৯, নং. ৫৯৬১, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৪, নং ২৭১৪।

[12] সুনানু আবী দাউদ ৪/৩১০, নং ৫০৪৫, সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭১, নং ৩৩৯৮, মাওয়ারিদুয যামআন ৭/৩৭০-৩৭১, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৩৭।

[13] মুসনাদ আহমাদ ২/১৭৩, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১২৩।

[14] সহীহ বুখারী ৫/২৩৩০, নং ৫৯৬৫।

[15] সহীহ মুসলিম ৪/২০৮৫, নং ২৭১৫।

[16] মুসতাদরাক হাকিম ২/১৫৪, সহীহুল জামিয়িস সাগীর ১/২৭২, নাবাবী, আল-আযকার, পৃ. ১৪২।

[17] সুনানুত তিরমিযী ৫/৪৭০, নং ৩৩৯৭, আল-আযকার, পৃ. ১৩৯-১৪০, ইমাম গাযালী, এহইয়াউ উলূমুদ্দিন ২/৩৬৯।

[18] সহীহ বুখারী ১/৯৭, নং ২৪৪, ৫/২৩২৬, নং ৫৯৫২, ৫/২৩২৭, নং ৫৯৫৬, সহীহ মুসলিম ৪/২০৮২, নং ২৭১০।

[19] সুনানুন নাসাঈ ৩/২৫৮, নং ১৭৮৭, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪২৬, নং ১৩৪৪, সহীহ ইবনু খুযাইমাহ ২/১৯৫, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪৫৫, সহীহুত তারগীব ১/৩১৮।
তৃতীয় প্রকার যিকর - তৃতীয় পর্ব: রাতের যিকর-ওযীফা - (৪) শেষ রাতের যিকর

কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদ ও দরুদ পাঠ, দু‘আ

হাদীস শরীফে ও সাহাবী-তাবেয়ীগণের জীবনে আমরা দেখতে পাই যে, নফল ইবাদত ও ওযীফা পালনের অন্যতম সময় রাত। বিশেষত কুরআন তিলাওয়াত, নফল সালাত, দরুদ পাঠ ও দু’আর অন্যতম সময় রাত। সাহাবী ও তাবেয়ীগণ এসকল ইবাদত রাত্রেই পালন করতেন, বিশেষত শেষ রাত্রে। আমাদের প্রত্যেকেরই উচিত রাতের কিছু সময়, বিশেষত শেষ রাতের কিছু সময় এ সকল ইবাদতে কাটানোর জন্য। প্রত্যেক যাকির নিজের সুবিধা ও অবস্থা অনুসারে কিছু সময় তাহাজ্জুদ আদায় করবেন। কুরআন কারীম সম্পূর্ণ বা আংশিক মুখস্থ থাকলে তাহাজ্জুদের মধ্যেই বেশি বেশি তিলাওয়াত করে তাহাজ্জুদ আদায় করবেন। অন্যথায় তাহাজ্জুদের পরে কিছু সময় কুরআন তিলাওয়াত, দরুদ পাঠ ও দু‘আ করা উচিত। আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, দু‘আ কবুল হওয়ার অন্যতম সময় রাত, বিশেষত রাতের শেষভাগ। এই সময়ে তাহাজ্জুদ ও দু‘আর জন্য বিশেষ লক্ষ্য রাখা উচিত।


কিয়ামুল্লাইল ও তাহাজ্জুদের গুরুত্ব ও মর্যাদা

‘কিয়ামুল্লাইল’ অর্থ রাতের কিয়াম বা রাত্রিকালীন দাঁড়ানো। সালাতুল ইশার পর থেকে ফজরের ওয়াক্তের উন্মেষ পর্যন্ত সময়ে যে কোনো নফল সালাত আদায় করলে তা ‘কিয়ামুল্লাইল’ বা ‘সালাতুল্লাইল’ অর্থাৎ রাতের দাঁড়ানো বা রাতের সালাত বলে গণ্য। ‘তাহাজ্জুদ’ অর্থ ঘুম থেকে উঠা। রাতে ঘুম থেকে উঠে আদায় করা সালাতকে তাহাজ্জুদ বলা হয়। কেউ যদি ইশার সালাত আদায় করে রাত ৯টা বা ১০টায় ঘুময়ে পড়েন এবং ১১/১২টায় উঠে নফল সালাত আদায় করেন তবে তা ‘কিয়ামুল্লাইল’ ও ‘তাহাজ্জুদ’ বলে গণ্য হবে। পক্ষান্তরে কেউ যদি ইশার পরে না ঘুমিয়ে রাত ১১/১২ টার দিকে কিছু নফল সালাত আদায় করেন তবে তা ‘কিয়ামুল্লাইল’ বলে গণ্য হলেও ‘তাহাজ্জুদ’ বলে গণ্য নয়।


ইসলামের অন্যতম নফল ইবাদত কিয়ামুল্লাইল। প্রথম রাতে বা শেষ রাতে, ঘুমানোর আগে বা ঘুম থেকে উঠে অন্তত কিছু নফল সালাত আদায় করা মুমিনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। একটু ঘুমিয়ে উঠে ‘তাহাজ্জুদ’-রূপে কিয়ামুল্লাইল আদায় করলে তার সাওয়াব ও মর্যাদা বেশি। রাতের শেষভাগে তা আদায় করা সর্বোত্তম। তৃতীয় অধ্যায়ে আমরা দেখেছি যে, রাতের শেষভাগ রহমত, বরকত ও ইবাদত কবুলের জন্য সর্বোত্তম সময়। রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবীগণ সাধারণত এ সময়েই কিয়ামুল্লাইল আদায় করতেন।


কুরআন কারীমে কোনো নফল সালাতের উল্লেখ করা হয়নি, এমনকি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতেরও বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু তাহাজ্জুদের সালাতের কথা বারংবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে ও মুমিন জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পারি যে, রাতের একাকী মুহূর্তে কিছু সময় আল্লাহর যিকরে, তার সাথে মুনাজাতে এবং তাঁরই (আল্লাহর) ইবাদতে ব্যয় করা মুমিনের জীবনের অবিচেছদ্য অংশ।


কিয়ামুল্লাইল বা সালাতুল্লাইলের বিষয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.) এত বেশি নির্দেশনা দিয়েছেন যে, এ বিষয়ে বর্ণিত সহীহ হাদীসগুলি একত্রিত করলে একটি বৃহদাকৃতি পুস্তকে পরিণত হবে। এ বিষয়ে কয়েকটি হাদীস ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে দু‘আ কবুলের সময়ের আলোচনায় আমরা দেখেছি যে, আমর ইবনু আমবাসাহ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, “মহান প্রতিপালক তাঁর বান্দার সবচেয়ে নিকটবর্তী হন রাতের শেষ অংশে। কাজেই তুমি যদি সে সময়ে আল্লাহর যিকরকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে পার তবে তা হবে।”

এক হাদীসে আবূ হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,

أفضل الصلاة بعد الصلاة المكتوبة (صلاة الليل) الصلاة في جوف الليل


“ফরয সালাতের পরে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে ফযীলতপূর্ণ সালাত রাতের সালাত বা রাতের গভীরে আদায়কৃত সালাত।”[1]


অন্য হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু সালাম (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

أَيُّهَا النَّاسُ أَفْشوا السَّلامَ، وَأَطْعِمُوا الطَّعَامَ، وَصَلُّوا باللَّيْل وَالنَّاسُ نِيامٌ، تَدخُلُوا الجَنَّةَ بِسَلامٍ


“হে মানুষেরা তোমরা সালামের প্রচলন কর, খাদ্য প্রদান কর, আত্মীয়তা রক্ষা কর এবং মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন সালাত আদায় কর, তাহলে তোমরা শান্তিতে নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে।” হাদীসটি সহীহ।[2]


আবূ উমামা বাহিলী (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,

عليكم بقيام الليل؛ فإنه دأب الصالحين قبلكم، وقربة إلى ربكم ومكفرة للسيئات، ومنهاة عن الإثم ومطردة للداء عن الجسدز


“তোমরা অবশ্যই কিয়ামুল্লাইল পালন করবে। কারণ তা তোমাদের পূর্ববর্তী নেককার মানুষদের অভ্যাস, তোমাদের জন্য তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য, পাপের ক্ষমা, পাপ থেকে আত্মরক্ষার পথ এবং দেহ থেকে রোগব্যধির বিতাড়ন।” হাদীসটি সহীহ।[3]


সাহাবীগণ কিয়ামুল্লাইল পরিত্যাগ পছনদ করতেন না। আয়েশা (রাঃ) বলেছেন:

لَا تَدَعْ قِيَامَ اللَّيْلِ فَإِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ لَا يَدَعُهُ وَكَانَ إِذَا مَرِضَ أَوْ كَسِلَ صَلَّى قَاعِدًا


কখনো কিয়ামুল্লাইল ত্যাগ করবে না; কারণ রাসূলুল্লাহ (সা.) কখনো তা ত্যাগ করতেন না। যদি কখনো অসুস্থ থাকতেন অথবা কিছুটা ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করতেন তাহলে তিনি বসে তা আদায় করতেন।”[4]


অনেক হাদীসে আমরা দেখতে পাই যে, কোনো সাহাবী তাহাজ্জুদ পালনে সামান্য অবহেলা করলে রাসূলুল্লাহ (সা.) আপত্তি করেছেন। রাসূলুল্লাহ (সা.) সাধারণত ‘বিতর’-সহ মোট এগার রাক’আত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। তিনি অধিকাংশ সময় শেষ রাতে তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। তিনি তাহাজ্জুদের আগে অনেক সময় কুর’আনের কিছু আয়াত তিলাওয়াত করতেন। কখনো কিছু তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি যিকর করার পর তাহাজ্জুদ শুরু করতেন। তিনি তাহাজ্জুদের সালাতের তিলাওয়াত খুব লম্বা করতেন। এক রাক’আতে অনেক সময় ৪/৫ পারা কুরআন তিলাওয়াত করতেন। রুকু ও সাজদাও অনুরূপভাবে দীর্ঘ করতেন। যতক্ষণ তিনি তিলাওয়াত করতেন প্রায় ততক্ষণ রুকুতে ও সাজদায় থাকতেন। আর তিলাওয়াতের সময় তিনি কুরআনের আয়াতের অর্থ অনুসারে থেমে থেমে দু’আ করতেন। তাহাজ্জুদের সালাতের মধ্যে তিনি ক্রন্দন করতেন। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদ আদায় করার কারণে অনেক সময় তাঁর মুবারক পদযুগল ফুলে যেত। আল্লাহর দরবারে সকাতরে প্রার্থনা করি, তিনি যেন গোনাহগার লেখককে ও সকল পাঠককে তাঁর মহান রাসূল (সা.)-এর সুন্নাত অনুসারে তাহাজ্জুদ আদায়ের তাওফীক দান করেন; আমীন।

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮২১।

[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৫২।

[3] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৫২; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/৩২৮, সহীহুল জামি ২/৭৫২।

[4] হাদিসটি সহীহ। সুনানু আবী দাউদ ২/৩২, নং ১৩০৭, সহীহুত তারগীব ১/৩৩১।

পূর্ববর্তী অধ্যায়গুলি আমরা দেখেছি যে, তাসবীহ, তাহলীল ইত্যাদি অধিকাংশ যিকর উন্মুক্তভাবে সদা সর্বদা পালন করা যায়। এছাড়া বিশেষ কিছু সময় নিরপেক্ষ যিকর, সালাত বা দু‘আ হাদীস শরীফে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যা যে-কোন সময়ে পালন করা যায়। এছাড়া রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর উম্মতকে বিভিন্ন কর্ম ও ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্য বিভিন্ন রকম বিশেষ যিকর শিক্ষা দিয়েছেন। এ অধ্যায়ে এরূপ কিছু যিকর, দু‘আ ও সালাতের আলোচনা করতে চাই। আল্লাহই তাওফীক-দাতা।

প্রথমত, অতিরিক্ত কিছু নফল সালাত :

(ক). সালাতুত তাসবীহ :

আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, যিকরের মূল চারটি বাক্য হলে তাসবীহ ‘সুবহানাল্লাহ’ , তাহমীদ ‘আল-হামদু লিল্লাহ’ , তাহলীল ‘লা- ইলাহা ইল্লল্লাহ’ এবং তাকবীর ‘আল্লাহু আকবার’। যাকির এই বাক্যগুলি জপ করে বা যিকর করে মহান প্রভুর নামের পবিত্রতা, প্রশংসা, একত্ব ও মহত্ব প্রকাশ করে। সালাতের মধ্যে এই যিকরগুলি বিশেষ পদ্ধতিতে পালন করা হয় “সালাতুত তাসবীহ” নামাক সালাতে। চার রাক’আত সালাতে প্রতি রাক’আতে ৭৫ বার করে চার রাক’আতে মোট ৩০০ বার উক্ত যিকরগুলি আদায় করতে হবে। এ বিষয়ে সহীহ ও যয়ীফ অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।

সহীহ হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর চাচা আব্বাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে (রাঃ) বলেনঃ ”চাচাজি, আমি আপনাকে একটি বিশেষ উপহার ও বিশেষ অনুদান প্রদান করব, যা পালন করলে আল্লাহ আপনার ছোট, বড়, ইচ্ছাকৃত, অনিচ্ছাকৃত, প্রকাশ্য, গোপন সকল গোনাহ ক্ষমা করবেন। - তা এই যে, আপনি চার রাক’আত সালাত আদায় করবেন। প্রত্যেক রাক’আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোনো একটি সূরা পাঠ করবেন। প্রথম রাক’আতে সূরা ফাতিহা ও অন্য যে কোনো সূরা পাঠের পর দাঁড়ানো অবস্থায় ১৫ বার বলবেন:

سبحان الله والحمد لله ولا إله إلا الله والله أكبر


উচ্চারণঃ ‘সুব‘হা-নাল্লাহ, ওয়াল‘হামদুলিল্লাহ, ওয়ালা- ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আল্লা-হু আকবার।’ (পূর্বে উল্লেখিত ৪, ৯, ১ ও ১০ নং যিকর একত্রে)।


এরপর রুকুতে যেয়ে রুকু অবস্থায় উপরের যিকরগুলি ১০ বার, রুকু থেকে উঠে দাঁড়ানো অবস্থায় ১০ বার, সাজদা রত অবস্থায় ১০ বার, প্রথম সাজদা থেকে উঠে বসা অবস্থায় ১০ বার, দ্বিতীয় সাজদায় ১০ বার এবং দ্বিতীয় সাজদা থেকে উঠে (বসা অবস্থায়) ১০ বার। এই মোট এক রাক’আতে ৭৫ বার (চার রাক’আতে মোট ৩০০ বার)। সম্ভব হলে আপনি প্রতিদিন একবার এই সালাত আদায় করবেন, না হলে প্রতি সপ্তাহে একবার, না হলে প্রতি মাসে একবার, না হলে প্রতি বৎসর একবার, না হলে অন্তত সারা জীবনে একবার এই সালাত আপনি আদায় করবেন।”


“সালাতুস তাসবীহ” সংক্রান্ত অধিকাংশ হাদীসই অত্যন্ত যয়ীফ সনদে বর্ণিত। একমাত্র এই হাদীসটিকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ হিসাবে গ্রহণ করেছেন।[1]


ইমাম তিরমিযী প্রখ্যাত তাবে-তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারাক (১৮১ হি) থেকে “সালাতুত তাসবীহ” আদায়ের আরেকটি নিয়ম উল্লেখ করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারকের মতে এই অতিরিক্ত যিকর আদায়ের নিয়ম: নাময শুরু করে শুরুর দু‘আ বা সানা পাঠের পরে ১৫ বার, সূরা ফাতেহা ও অন্য কোনো সূরা শেষ করার পরে ১০ বার, রুকুতে ১০ বার, রুকু থেকে উঠে ১০ বার, প্রথম সাজদায় ১০ বার, দুই সাজাদার মাঝে ১০ বার ও দ্বিতীয় সাজদায় ১০ বার মোট ৭৫ বার প্রতি রাক’আতে।

অর্থাৎ, এই নিয়মে কিরাআতের পূর্বে ও পরে দাঁড়ানো অবস্থায় ২৫ বার তাসবীহ পাঠ করা হয় আর দ্বিতীয় সাজাদার পরে বসা অবস্থায় কোনো তাসবীহ পড়া হয় না। পূর্বের হাদীসে বর্ণিত নিয়মে কিরাআতের পূর্বে কোনো তাসবীহ নেই। দাঁড়ানো অবস্থায় শুধু কিরাআতের পরে ১৫ বার তাসবীহ পড়তে হবে। প্রত্যেক রাক’আতে দ্বিতীয় সাজদার পরে বসে ১০ বার তাসবীহ পড়তে হবে।


আব্দুল্লাহ ইবনু মুবারক বলেন, যদি এই সালাত রাত্রে আদায় করে তাহলে দুই রাক’আত করে পৃথকভাবে তা আদায় করবে। অর্থাৎ, দুই রাক’আত শেষে সালাম ফিরিয়ে আবার দুই রাক’আত পৃথকভাবে আদায় করবে। আর দিনের বেলায় এই সালাত পালন করতে ইচ্ছা করলে একত্রে চার রাক’আত আদায় করতে পারে, অথবা ইচ্ছা করলে পৃথকভাবে দুই রাক’আত করেও আদায় করতে পারে।

“সালাতুত তাসবীহ” আদায়ের সময় রুকু ও সাজদায় প্রথমে রুকু ও সাজদার মাসনূন তাসবীহ ‘সুবহানার রাব্বিয়্যাল আযীম’ ও ‘সুবহানা রাব্বিয়্যাল আ’লা’ নূন্যতম তিন বার করে পাঠ করার পরে অতিরিক্ত তাসবীহগুলি পাঠ করতে হবে।[2]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৩৪৭-৩৫০, নং ৪৮১, সুনানু আবূ দাউদ ২/২৯, নং ১২৯৭, সুনানু ইবনি মাজাহ ১/৪৪২, নং ১৩৮৬, ১৩৮৭, মুসতাদরাক হাকিম ১/৪৬৩-৪৬৪, সহীহ ইবনু খুযাইমা ২/২৩-২৪, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৮১-২৮৩, সহীহুত তারগীব ১/৩৫৩-৩৫৫।

[2] তিরমিযী, আস-সুনান ২/৩৪৭।
দেখানো হচ্ছেঃ ১০১ থেকে ১১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ১৪১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 8 9 10 11 12 13 14 15 পরের পাতা »