লা-তাহযান [হতাশ হবেন না] ড. আয়িদ আল করনী ৩৪৫ টি
লা-তাহযান [হতাশ হবেন না] ড. আয়িদ আল করনী ৩৪৫ টি

আমাদের চিন্তাসমূহকে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে, বিপথে যেতে, মুক্ত হতে ও বন্য-হন্যে হতে না দিয়ে ওগুলোকে লাগাম পড়ানো ও নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ, যদি আপনি আপনার চিন্তাগুলোকে যথেচ্ছা ঘুরে বেড়াতে ছেড়ে দেন তবে ওগুলো বন্য হয়ে গিয়ে আপনাকেই নিয়ন্ত্রণ করবে। ওগুলো আপনার অতীত দুঃখ-দুর্বিপাকের সুবিন্যস্ত তালিকা খুলে বসবে। আপনার মা আপনাকে যেদিন জন্ম দিয়েছিলেন সেদিন থেকে শুরু করে আপনার দুঃখ দুর্দশার ইতিহাস এগুলো আপনাকে স্মরণ করিয়ে দিবে।

যদি আপনার চিন্তা-ভাবনাসমূহকে পায়চারী করার বা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানার জন্য ছেড়ে দেয়া হয় তবে এগুলো আপনার সামনে আপনার অতীত দুঃখ-কষ্টের চিত্র ও একটি ভয়ংকর ভবিষ্যতের চিত্র তুলে ধরবে। এসব চিন্তা-ভাবনা স্বয়ং আপনাকেই বিচলিত-শিহরিত করে তুলবে। আপনার অনুভূতিকে দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে বাধ্য করবে। অতএব, যে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তায় ফলপ্রদ ও উপকারী কাজ হয়, সে ধরনের কেন্দ্রীভূত চিন্তা-চর্চার দিকে অভিমুখী করে ওগুলোকে (আপনার চিন্তাসমূহকে) লাগাম পড়ান ও নিয়ন্ত্রণে রাখুন।

“এবং সে চিরঞ্জীবের উপর নির্ভর করুন, যিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।” (২৫-সূরা আল ফুরকান: আয়াত-৫৮)

সুখ-শাস্ত্রের একটি মূলনীতি হলো পার্থিব জীবনকে এর সত্যিকার গুণ ও মূল্যানুযায়ী মূল্যায়ন করা। এ জীবন তুচ্ছ এবং এটা আপনার নিকট শুধু এতটুকু দাবি রাখে যে, আপনি এর থেকে পালিয়ে যান। এ জীবন দুর্বিপাক, দুর্দশা, দুর্ঘটনা, ব্যথা-বেদনা ও আঘাতে ভরা, এই যদি হয় এ জীবনের বিবরণ তাহলে মানুষ কিভাবে এর নগণ্য দুর্ঘটনা-দুর্বিপাকে অযৌক্তিকভাবে বিচলিত হয় এবং কী করে তার ঘটে যাওয়া এমন সব পার্থিব বিষয়ের উপর দুঃখ করতে পারে? জীবনের সর্বোত্তম মুহুর্তগুলো কলঙ্কিত, এর ভবিষ্যৎ অঙ্গীকারসমূহ শুধু মরীচিকা, এর সফল ব্যক্তিদেরকে হিংসা করা হয়, ধন্যরা সদা হুমকিপ্রাপ্ত, আর প্রেমিকরা কোনও অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনায় ধরাশায়ী হয়।

হাদীসে আছে “নিশ্চয়, জ্ঞান-চর্চার মাধ্যমেই কেবল জ্ঞান অর্জিত হয় এবং ধৈর্য-চর্চার মাধ্যমেই সহনশীলতা অর্জিত হয়।”

আলোচ্য বিষয়ের এ হাদীসের অর্থের উপর কেউ যদি আমল করতে চায় বা এর অর্থকে বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেয় তবে তিনি আরেকটু অগ্রসর হয়ে বলতে পারেন যে, (সুখে থাকার) অনুমান করেই সুখ লাভ করা যায়। সদা হাসি-খুশি থেকে, যা আপনাকে সুখী করে তার সন্ধান করে এবং যতই অদ্ভুত মনে হোক না কেন, নিজের ভিতরে জোর করে সুখ-বোধ সঞ্চারিত করে সুখ অর্জন করা যায়। সুখ দ্বিতীয় প্রকৃতি বা স্বভাব না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে এ কাজগুলো করে যেতে হবে। আসল ব্যাপার হলো দুঃখ-বেদনার সকল স্মৃতি আপনার থেকে আপনি দূর করে ফেলতে পারবেন না। এর কারণ হলো জীবনকে পরীক্ষার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।

لَقَدْ خَلَقْنَا الْإِنسَانَ فِي كَبَدٍ

“অবশ্যই, আমি মানুষকে কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে (জীবন-যাপনকারী হিসেবে) সৃষ্টি করেছি।” (৯০-সূরা আল বালাদ: আয়াত-৪)

“যাতে তিনি পরীক্ষা করতে পারেন তোমাদের মধ্যে কে আমলে উত্তম।” (১১-সূরা হূদ: আয়াত-৭)

কিন্তু আমি আপনাদের নিকট যে সংবাদ পৌছে দিতে চাই, তা হলো আপনার উচিত আপনার দুঃখের পরিমাণ ও প্রাবল্য যথাসম্ভব কমিয়ে ফেলা। সম্পূর্ণরূপে দুঃখমুক্ত হওয়া তো পরকালে জান্নাতবাসীদের জন্য (নির্ধারিত)। এ কারণে জান্নাতবাসীরা বলবে-

“সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যিনি আমাদের থেকে সকল দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন।” (৩৫-সূরা ফাতির: আয়াত-৩৪)

সুতরাং, যখন কেউ এ দুনিয়ার প্রকৃতি ও গুণাগুণ জানতে পারে, তখন সে বুঝতে পারে, এ দুনিয়া নিরস, প্রবঞ্চণাময় ও মূল্যহীন এবং সে পুরোপুরি বুঝতে পারে, ওটাই হলো দুনিয়ার প্রকৃতি ও পরিচয়।

আরবের একজন কবি বলেন-

“তুমি তো আমাদের অঙ্গীকার পূর্ণ না করার শপথ করেছ।”

আমি যেমনটি বর্ণনা করেছি দুনিয়ার পরিচয় যদি তেমনই হয়, তবে বুদ্ধিমান লোকদের উচিত নয় এর আক্রমণে সাহায্য করা এবং হতাশা ও দুশ্চিন্তার কাছে আত্মসমর্পণ করা। আমাদের যা করা উচিত তা হলো, আমাদের জীবনকে ধ্বংস করে দিতে পারে এমন সব আবেগ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করা। (এভাবে আত্মরক্ষা করে) আমাদের সর্বশক্তি দ্বারা অবশ্যই আমাদেরকে এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।

“এবং তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ববাহিনী প্রস্তুত রাখ। এ দিয়ে তোমরা আল্লাহর শক্রকে ও তোমাদের শক্রকে ভীত করবে।” (৮-সূরা আনফাল: আয়াত-৬০)

“আল্লাহর পথে তাদের যা ঘটেছিল, তাতে তারা নিরুৎসাহিত হয়নি, দুর্বল এবং নতও হয়নি।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪৬)

দুঃখ করবেন না। আপনি যদি গরীব হয়ে থাকেন, তবে কেউ না কেউ ঋণে জর্জরিত হয়ে আছে (তার কথা ভেবে দেখুন)। আপনার যদি যাতায়াত ভাড়া না থাকে তবে অন্য কারো তো পা-ই নেই। রোগ-যন্ত্রণার অভিযোগ করার যুক্তি বা কারণ যদি আপনার থেকেও থাকে তবে অন্য কেউ তো বছরের পর বছর রোগ-শয্যায় পড়ে আছে। আপনি যদি একটি সন্তান হারিয়ে থাকেন তবে অন্য কেউ তো সামান্য গাড়ি দুর্ঘটনায় কয়েক সন্তান হারিয়েছে।

দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি তো এমন একজন মুসলমান, যিনি আল্লাহতে, তার নবী-রাসূলগণে, তার ফেরেশতাকুলে, আখেরাতে এবং তকদীরের ভালো-মন্দে বিশ্বাস করেন।

যখন নাকি আপনি সর্বোত্তম দৌলত ঈমানের বদৌলতে ধন্য, তখন অন্যরা আল্লাহতে অবিশ্বাস, নবী-রাসূলগণকে অস্বীকার, কিতাব সম্বন্ধে নিজেদের মাঝে মতভেদ ও আখেরাতকে অস্বীকার করেছে এবং ঐশী পূর্বনির্ধারণী বা এলাহী তকদীরকে ভুল বুঝেছে।

দুশ্চিন্তগ্রস্ত হবেন না, যদি হন, তবে আপনি আপনার মন-মানসিকতার ক্ষতি করবেন এবং আপনার ঘুম বিনষ্ট করবেন।

একজন আরব কবি বলেছেন-

ولرُبٌّ نازلةٍ يضيق بها الفتى * ذرعاً وعند الله منها المخرجُ
ضاقت فلما استحكمت حلقاتها * فُرجت وكان يظنها لا تُفرجُ

“যুবকরা কতইনা মসিবতে পড়ে নাজেহাল হয়, অথচ আল্লাহর নিকট এর পরিত্রাণের উপায় আছে।”

“অবস্থা অসহ্যকর হয়ে যায় তারপর যখন রশি শক্তভাবে কষে তখন রশি ছিড়ে যায়, অথচ তারা ভাবতো যে রশি ছিড়বে না।”

মনের আগুন জ্বলে উঠে দু'কারণে- হয়তো আনন্দে নয়তো অন্তর্যাতনায়। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক হাদীসে বলেন-

“অবশ্য আমাকে দুটি (তার একটি) বোকামীপ্রসূত (হায়! শব্দ) ও (অপরটি) পাপব্যঞ্জক (হুররে!) শব্দ উচ্চারণ করতে নিষেধ করা হয়েছে। তার একটি (পাপব্যঞ্জক-হুররে) শব্দ বলা হয় নেয়ামত পেলে আর অপরটি (বোকামীপ্রসূত হয়! শব্দ) উচ্চারণ করা বিপদের সময়।”

মহান আল্লাহ বলেন,

لِّكَيْلَا تَأْسَوْا عَلَىٰ مَا فَاتَكُمْ وَلَا تَفْرَحُوا بِمَا آتَاكُمْ

“যা আপনি পাননি, তার জন্য দুঃখ করবেন না। আর যা আপনাকে দেয়া হয়েছে তার জন্য ফুর্তি করবেন না।” (সূরা-৫৭ আল হাদীদ: আয়াত-২৩)

এ কারণেই নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন “অবশ্যই প্রথম আঘাতের সময়ই ধৈর্যের পরিচয় পাওয়া যায়।”

সুতরাং, আনন্দময় ও বিপদমুক্ত উভয় ঘটনার সময়ই যে লোক তার আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তারই শান্তি, প্রশান্তি, সুখ, আরাম ও নিজের উপর বিজয়ের স্বাদ অর্জন করার কথা। আল্লাহ তায়ালা মানুষের পরিচয় দিয়েছেন যে, তারা বিজয়োল্লাসিত, দাম্ভিক, খিটখিটে, ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা তাদের খারাপ কিছু হলে অসন্তুষ্ট এবং তাদের কোন কল্যাণ হলে তারা কৃপণোচিত হয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়েছেন, ব্যতিক্রম হলো সময়েই মধ্যপন্থী। তারা সচ্ছলতার সময় কৃতজ্ঞ এবং অসচ্ছলতার সময় ধৈর্যশীল।

লাগামহীন আবেগ মর্মবেদনা ও অনিদ্রা সৃষ্টি করে মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। কেউ যখন ক্রুব্ধ হয় তখন সে রাগে আগুন হয়ে যায়, আত্মনিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে এবং ধৈর্যহারা ও ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। অপরপক্ষে,

যদি সে সুখী হয়, তবে সে পরোল্লসিত ও বন্য হয়ে যায়। আনন্দের ঘোরে সে আত্মভোলা হয়ে শালীনতার সীমা লঙ্ঘন করে। সে যখন অন্যদের সঙ্গ ত্যাগ করে তখন সে তাদেরকে অবজ্ঞা করে, তাদের গুণাবলিকে ভুলে গিয়ে তাদের সৎগুণাবলিকে পদদলিত করে। অপরপক্ষে, সে অন্যদেরকে যখন ভালোবাসে তখন সে তাদেরকে পরম নিষ্কলঙ্ক কল্পনা করে। তাদেরকে সর্বপ্রকার সম্মান করতে কোনরূপ ক্রটি করে না।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

“যাকে তুমি ভালোবাস তাকে তুমি সংযত পরিমাণে ভালোবাস। কারণ, এমন দিন আসতে পারে যখন তুমি তাকে ঘৃণা করবে। আর যাকে তুমি ঘৃণা কর তাকে সংযত পরিমাণে ঘৃণা কর। কেননা, এমন দিন আসতে পারে তখন তুমি তাকে ভালোবাসবে।”

অন্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

“(হে আল্লাহ!) আমি আপনার নিকট ক্রুদ্ধ ও সন্তুষ্ট উভয়ই অবস্থায়ই মধ্যপন্থা কামনা করি।”

কেউ যখন তার আবেগের মুখে লাগাম পরিয়ে দেয়, তখন সে তার মনকে দমন করতে পারে এবং যখন সে প্রতিটি বিষয়কে এর গুরুত্বানুসারে মেনে নেয় তখন সে প্রজ্ঞা ও সঠিক বুঝের দিকে এক ধাপ এগিয়ে গেল।

মহান আল্লাহ বলেন-

“অবশ্যই আমি আমার নবী-রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সাথে কিতাব ও মীজান (ন্যায়নীতি) অবতীর্ণ করেছি যাতে মানুষেরা ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করতে পারে।” (সূরা-৫৭ আল হাদীদ: আয়াত-২৫)

বাস্তবিক, ইসলাম নীতি ও আচার-আচরণে এতটাই ভারসাম্যতা এনেছে, যতটা সে এনেছে জীবনের সরল, পবিত্র ও সত্য পথে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন-

وَكَذَٰلِكَ جَعَلْنَاكُمْ أُمَّةً وَسَطًا

“এভাবে আমি তোমাদেরকে মধ্যপন্থী জাতি বানিয়েছি। (সূরা-২ বাকারা: আয়াত-১৪৩)

আমাদের আচার-আচরণ ও বিচার-আচার উভয় ক্ষেত্রেই ন্যায়পরায়ণ হওয়া কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য। প্রকৃতপক্ষে, ইসলাম সকল বিষয়ে সত্য ও ন্যায়নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ন্যায়নীতি বিচারকার্যে, কথা-বার্তায়, কাজ-কর্মে ও আচার-আচরণে, যা আমরা অবতীর্ণ কিতাব (কুরআন) থেকে শিখতে পারি।

মহান আল্লাহ বলেন-

وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَعَدْلًا

“এবং তোমার প্রতিপালকের কথা সত্য ও ন্যায়নীতিতে ভরপুর।” (সূরা-৬ আল আন’আম: আয়াত-১১৫)

আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সকল মানুষের নিকট জান্নাতী পয়গাম নিয়ে আগমন করেছেন। তিনি পার্থিব আকাঙ্ক্ষা দ্বারা পরিচালিত হতেন না। ব্যয় করার জন্য তার কোন ধন-ভাণ্ডার ছিল না। খাবার জন্য চমৎকার কোন (খেজুর) বাগান ছিল না; আর বসবাস করার জন্য কোন সুন্দর প্রাসাদ ও ছিল না। এতসব সত্ত্বেও তার প্রিয় অনুসারীরা তার প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার দিয়েছেন, অবিচল থেকেছেন। সমস্যা-সঙ্কুল এক কঠিন জীবন সহ্য করেছেন। তারা ছিলেন গুটি কয়েকজন ও দুর্বল, তাদের প্রতিবেশীদের দ্বারা সমূলে বিনাশ হয়ে যাবার ভয়ে ভীত, তবুও তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে পুরোপুরি ভালোবাসতেন।

তাদেরকে গিরিপথে বন্দি করা হয়েছিল। আর সে সময়ে তাদের নিকট অল্প খাদ্য ছিল বা কোন খাদ্য ছিল না। তাদের সুখ্যাতি আক্রান্ত হয়েছিল; তাদের নিজেদের আত্মীয়রাই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়েছিল, তবুও নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি তাদের ভালোবাসা ছিল নিষ্কলুষ।

তাদের কাউকে মরুভূমির তপ্ত বালুর উপর ফেলে হেঁচড়ানো হয়েছিল, কিছু লোককে বন্দী করা হয়েছিল আর অন্যরা নতুন নতুন ও অদ্ভুত অদ্ভুত শাস্তির শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। এসব শাস্তিই তাদেরকে কাফেররা দিয়েছিল। তারা ঐসব শাস্তি সহ্য করতে বাধ্য হয়েও তাকে সর্বান্তঃকরণে মন খুলে ভালোবেসেছিলেন। তারা ঘর-বাড়ি, স্বদেশ, পরিবার ও সম্পদ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন। তারা তাদের বাল্যকালের খেলার মাঠ ও বসত বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। এসব ভোগান্তি সত্ত্বেও তাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে ভালোবেসেছেন তারা।

তার (নবুয়তের) সংবাদের কারণেই ঈমানদারগণ অগ্নিপরীক্ষার শিকার হয়েছিলেন। তাদের পদতলের ভূমি প্রচণ্ডভাবে কেঁপে উঠেছিল। তবুও তার প্রতি তাদের ভালোবাসা অনবরত বাড়ছিলই।

তাদের যৌবনের বসন্ত ঋতুর শিরোপরি সদা বিপজ্জনকভাবে তরবারি ঝুলন্ত ছিল। তারা শুধুমাত্র তাকে নিঃশর্তভাবে ভালোবাসত বলেই এমন মৃদুভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে (যুদ্ধের ময়দানে) মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন, যেন তারা প্রমোদ ভ্রমণে বা অবসর যাপনে ছিলেন।

একজন সাহাবীকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নবুওয়াতের সংবাদ বিদেশে এক রাজার নিকট নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব দেয়া হলো। অথচ তিনি জানতেন যে, এটা এমন এক কাজ যা থেকে তিনি ফিরে আসবেন না। আরেকজন সাহাবীকে এক কাজে পাঠানো হলো। তিনি জানতেন যে, এটা তার মৃত্যুর কারণ হবে, তবুও তিনি সন্তুষ্টচিত্তে সে কাজে গেলেন। কারণ, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে নিরঙ্কুশ ভালোবাসতেন। কিন্তু কেন তারা তাকে ভালবাসতেন এবং কেন তারা তার নবুওয়তে এত সন্তুষ্ট ও তার আদর্শে এত পরিতুষ্ট ছিলেন? কেন তারা তাকে অনুসরণ করাতে যে দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তি হয়েছে তা ভুলে গিয়েছেন? এক কথায় বা সহজভাবে এর কারণ বলতে হয় যে, তিনি বদান্যতার ও ধার্মিকতার সর্বোচ্চ শিখর অধিকার করেছিলেন। তারা তার মাঝে সত্য ও বিশুদ্ধতার সব লক্ষণ দেখতে পেয়েছিলেন। যারা মহত্তর জিনিসের সন্ধান মানুষের মনের হিংসা-বিদ্বেষ, ঘৃণা ও তিক্ততা শীতল করে দিয়েছিলেন। সত্য বাণী দিয়ে তিনি তাদের অন্তরকে শান্ত করে দিয়েছিলেন ও তার রিসালাত দ্বারা তিনি তাদের অন্তরসমূহকে শান্তিতে ভরে নিয়েছিলেন।

তিনি তাদের অন্তরে এত শান্তি ঢেলে দিয়েছিলেন যে, তারা তার পাশে থাকার কারণে যে যাতনা ভোগ করেছিলেন, তা তারা তুচ্ছ মনে করেছিলেন। তিনি তাদের অন্তরে এমন ঈমান বা বিশ্বাস সঞ্চার করেছিলেন যে, তারা যে আঘাত ও প্রতিকূল অবস্থা সহ্য করতে বাধ্য হয়েছিলেন, তা তারা ভুলে গিয়েছিল। তিনি তাদের ভিতরকে হিদায়াতের আলো দ্বারা ঘষেমেঝে চকচকে করে দিয়েছিলেন ও তাদের চক্ষুসমূহকে তার নূরে নূরান্বিত বা তার আলোতে আলোকিত করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের থেকে মূর্খতার বোঝা, মূর্তিপূজার বিকৃত রুচি এবং বহু-ঈশ্বরবাদের কুফল দূর করে দিয়েছিলেন। তিনি তাদের অন্তর থেকে হিংসা-বিদ্বেষের আগুন নিভিয়ে দিয়েছেন এবং তাদের অন্তরে ঈমানের পানি ঢেলে দিয়েছেন। এভাবে তাদের দেহমন প্রশান্ত হয়েছিল ও তাদের আত্মা শান্তি পেয়েছিল।

তারা নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে থেকে জীবনের স্বাদ উপলব্ধি করেছেন এবং তারা তার সাহচার্যে পুলক বোধ করেছিলেন বা আনন্দ পেয়েছিলেন।

তারা তার পাশে থেকে সুখ এবং তার অনুসরণে নিরাপত্তা, মুক্তি ও আত্মসমৃদ্ধি পেয়েছিলেন। মহান আল্লাহ বলেন-

“এবং আমি আপনাকে (হে মুহাম্মদ!) সারা বিশ্বের জন্য রহমত বা করুণাস্বরূপ প্রেরণ করেছি।” (২১-সূরা আল আম্বিয়া: আয়াত-১০৭)

“এবং অবশ্যই তুমি (মানবজাতিকে) সরল পথ দেখাচ্ছে।” (৪২-সূরা আশ শুরা: আয়াত-৫২)

“এবং তিনি (গ্রন্থকার তিনি বলতে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বুঝিয়েছেন; কিন্তু কুরআনের ঐ আয়াত দ্বারা তিনি বলতে স্পষ্টরূপে আল্লাহকেই বুঝা যায়। -অনুবাদক।) স্বেচ্ছায় তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে (নিয়ে যান)।” (৫-সূরা মায়িদা: আয়াত-১৬)

“তিনিই নিরক্ষরদের মাঝ থেকে তাদের মাঝে একজন রাসূল প্রেরণ (কুফুরি ও শিরক থেকে) পবিত্র করেন এবং তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন এবং নিশ্চয় তারা পূর্বে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে লিপ্ত ছিল। (৬২-সূরা আল জুমুআ: আয়াত-২)

“তাদের উপরে যে বোঝা ও শৃঙ্খল ছিল, তিনি তাদের থেকে তা সরিয়ে দেন।” (৭-সূরা আল আ'রাফ: আয়াত-১৫৭)

“যখন তিনি তোমাদেরকে এমন বিষয়ের দিকে আহবান করেন যা তোমাদের প্রাণ সঞ্চার করে তখন তোমরা আল্লাহ ও রাসূলের আহবান সাড়া দিও।” (৮-সূরা আনফাল: আয়াত-২৪)

তারা তাদের নেতার সাথে থেকে সত্যিই সুখী ছিলেন এবং তারা যথার্থই সুখী হওয়ার যোগ্য ছিলেন।

হে আল্লাহ! বিপথ গমনের শৃঙ্খল হতে আত্মার মুক্তিদাতা ও মিথ্যার অভিশাপ থেকে আত্মার উদ্ধারকারী মুহাম্মাদের উপর করুণা ও শান্তি বর্ষণ করুন এবং তার মহান সাহাবীদের সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার প্রতিদানস্বরূপ তাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে যান।

৪৫. আপনার জীবন থেকে ক্লান্তি ও বিরক্তি দূর করুন

একই কাজ বারবার করতে হয় এমন নিয়ম মাফিক বা রুটিন অনুসারে যারা জীবনযাপন করেন, তারা প্রায় অলঙ্ঘনীয়ভাবে বিরক্তি ও ক্লান্তির শিকার হয়ে পড়বেন। বিশেষ করে এ কারণে যে, পরিবর্তনের অভাবে স্বভাবতই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই সর্বশক্তিমান মহান আল্লাহ আমাদেরকে বিভিন্ন সাদা-কালো, ঠাণ্ডা-গরম, আলো-ছায়া ও টক-মিষ্টি দান করেছেন। আল্লাহ তার কিতাবে এই বৈচিত্র্যের কথা উল্লেখ করেন-

“তাদের (মৌমাছিদের) পেট থেকে বিভিন্ন রঙের (মধুর) পানীয় বেরোয়।” (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-৬৯)

“তারা একই মূলে একাধিক বা এক মাথাওয়ালা খেজুর গাছ।” (১৩-সূরা রাআদ: আয়াত-৪)

“আর বিভিন্ন স্বাদের শস্য, যয়তুন ও ডালিম (বর্ণে, আকারে ও স্বাদে) সদৃশ ও বিসদৃশ।” (৬-সূরা আল আন’আম: আয়াত-১৪১)

“আর পাহাড়ের মাঝে আছে সাদা-লাল বিচিত্র বর্ণের পথ।" (৩৫-সূরা ফাতির: আয়াত-২৭)

“আর আমি মানুষের মাঝে এদিনগুলোকে পর্যায়ক্রমে আবর্তন করি।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৪০)

বনী ইসরাঈলদেরকে যে খাদ্য দেয়া হয়েছিল তা সর্বোত্তম খাদ্য হওয়া সত্ত্বেও শুধু একমাত্র খাদ্য হওয়ার কারণেই তাদের তা খেতে ভালো লাগছিল না। (এবং তারা বলেছিল:)

“আমরা একই রকম খাদ্য সহ্য করতে পারব না।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-৬১)

আল-মামুন একবার দাঁড়িয়ে, একবার বসে ও একবার হাটতে হাটতে (আরবী ২২তম সংস্করণের মূল পুস্তক থেকে এ অংশটুকুর অনুবাদ করা হল।-অনুবাদক) এভাবে পালাবদল করে করে পাঠ করতেন এবং বলতেন: ‘আত্মা সদাই ক্লান্তিকর।’

“যারা (সর্বদা এবং সালাতে) দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে শুয়ে আল্লাহর জিকির করে...” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৯১)

ইসলামে যে সব ইবাদতের বিধান জারি বা প্রণয়ন করা হয়েছে তা নিয়ে আপনার গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিত। কলবের আমল, জিহ্বার আমল, ঠোটের আমল ও সৎ কাজে সম্পদ ব্যয় করার আমল বা সম্পদের আমল। সালাত, রোজা, হজ্জ, যাকাত ও জিহাদ কী সাবীলিল্লাহ বা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ হলো ইবাদতের কয়েকটি উদাহরণ। সালাতে দাঁড়ানো, রুকু, সিজদা ও বসা (ইত্যাদি অবস্থা) আছে। আপনি যদি বিশ্রাম, সজীবতা ও বিরামহীন উপাদানের আশা করেন তবে আপনার কাজের ধরন, পড়ার ধরন ও জীবন-যাপন প্রণালীতে পরিবর্তন আনুন।

উদাহরণস্বরূপ পড়ার ব্যাপারে বলছি- যখন পড়বেন তখন বিষয় পরিবর্তন করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়াশুনা করুন-যেমন একবার নবী (আঃ) এদের জীবনী, একবার সাহাবীদের জীবনী, একবার হাদীস, একবার ফিকহ, আরেকবার ইতিহাস, ক্ষণিক পরে সাহিত্য, তারপরে সাধারণ জ্ঞানের বই ও এভাবে পালাক্রমে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়ুন। এর সর্বোত্তম উদাহরণ ও ব্যাখ্যা হলো কুরআন মাজিদ। (কারণ, কুরআনে এভাবে এসব বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে-বঙ্গানুবাদক) আপনার সময়কে ইবাদত, বৈধ আমোদ-আহ্লাদ, বন্ধুদের দেখতে যাওয়া অতিথি আপ্যায়ন, খেলা-ধুলা বা প্রমোদ ভ্রমণের মাঝে ভাগ করে নিন; তবেই আপনি নিজেকে প্রাণবন্ত, সজীব ও উজ্জ্বল ব্যক্তিরূপে পাবেন; কেননা, আত্মা বিভিন্নতা ও নতুন নতুন জিনিসে আনন্দ পায়।

দুঃখিত হবেন না, কেননা আপনার প্রতিপালক বলেন-

أَلَمْ نَشْرَحْ لَكَ صَدْرَكَ

“(হে মুহাম্মদ!), আমি কি আপনার বক্ষ আপনার কল্যাণে প্রশস্ত করে দেইনি?” (৯৪-সূরা আল ইনশিরাহ: আয়াত-১)

এ আয়াতের সংবাদ যারা হকপন্থী, যারা নূরের পথে চলে এবং যারা হিদায়াতের পথে চলে তাদের সবার জন্য প্রযোজ্য।

“যার অন্তর আল্লাহ ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দিয়েছেন, ফলে সে তার প্রভুর নূরের পথে চলে তবে কি সে ব্যক্তি (কাফেরের মতো)? অতএব, সে সব কঠোর আত্মার লোকেরা অভিশপ্ত-যারা আল্লাহর জিকিরে বিমুখ।” (৩৯-সূরা আয যুমার: আয়াত-২২)

সুতরাং, এমন সত্য বিষয় আছে, যা অন্তরকে প্রশস্ত করে এবং এমন অসত্য বিষয় আছে, যা অন্তরকে কঠোর করে।

“আর আল্লাহ্‌ যাকে হিদায়াত করতে চান, তার অন্তরকে তিনি ইসলামের জন্য প্রশস্ত করে দেন।” (৬-সূরা আল আন’আম: আয়াত-১২৫)

অতএব, এ ধর্ম গ্রহণ করা ও এর উপর প্রতিষ্ঠিত থাকা এক কাজিত ও বাঞ্ছিত বিষয়, যা অনুগ্রহপ্রাপ্ত ও ধন্য লোক ছাড়া অন্য কেউ লাভ করতে পারে না।

“দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা ও ভয় করো না, নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।” (৯-সূরা তাওবা: আয়াত-৪০)

“যে সব (ঈমানদার) লোকদেরকে (কাফের) লোকেরা বলেছিল, অবশ্যই (কাফের) লোকেরা তোমাদের (বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার) জন্য জমায়েত হয়েছে, অতএব, (তোমরা মু’মিনগণ) সেই (কাফের) লোকদেরকে ভয় কর। এতে তাদের ঈমান আরো বৃদ্ধি পেল এবং তারা বলল, আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতইনা উত্তম কর্মবিধায়ক!” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৭৩)

আল্লাহর রক্ষণাবেক্ষণ, অভিভাবকত্ব ও করুণাতে যাদের ঈমান বা বিশ্বাস আছে তারা (উপরোক্ত) এই আয়াতের এই কথা (আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি কতইনা উত্তম কর্মবিধায়ক!) বলে।

আমাদের পক্ষে তার যথেষ্ট হওয়া আমাদেরকে অন্যদের উপর নির্ভর করা থেকে মুক্তি দেয় এবং তার অভিভাবকত্ব আমাদেরকে রক্ষা করে।

"হে নবী (মুহাম্মদ), আপনার জন্য এবং যেসব মু’মিন আপনাকে অনুসরণ-অনুকরণ করে ও আপনাদের আনুগত্য করে তাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।” (৮-সূরা আনফাল : আয়াত-৬৪)

“এবং সেই চিরঞ্জীবের উপর নির্ভর (তাওাক্কুল) কর, যিনি মৃত্যুবরণ করবেন না।” (২৫-সূরা আল ফুরকান: আয়াত-৫৮)

“এবং (হে মুহাম্মদ!) ধৈর্য ধরুন, আর আল্লাহর সাহায্য ছাড়া আপনার ধৈর্য ধরা সম্ভব নয় এবং তাদের নিয়ে দুঃখ করবেন না। আর তারা যে চক্রান্ত করে তাতে কষ্ট পাবেন না। অবশ্যই আল্লাহ মুত্তাকী এবং সৎকর্মপরায়ণদের সাথে আছেন।” (১৬-সূরা আন নাহল: আয়াত-১২৭-১২৮)

এ আয়াতে আল্লাহ তাদের সাথে আছেন এ কথা দ্বারা তার অনুগত বান্দাদের রক্ষণাবেক্ষণ, যত্ন, সমর্থন ও অভিভাবকত্বের এক বিশেষ রহমতের কথা বুঝানো হয়েছে। আর তাদের ঈমান, আমল ও চেষ্টার পরিমাণ মাফিকই তারা এই কল্যাণ লাভ করবে।

“অতএব, তোমরা (শক্রদের বিরুদ্ধে) দুর্বল হয়ো না এবং দুশ্চিন্তগ্রস্তও হয়ো না। আর তোমরাই (বিজয়ী হয়ে) শ্রেষ্ঠ হবে- যদি তোমরা (সত্যিকার) মু’মিন হয়ে থাক।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১৩৯)

“সামান্য কষ্ট দেয়া ছাড়া তারা তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। আর যদি তারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করে তবে তারা তোমাদেরকে পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে। অতঃপর তাদেরকে কোনও সাহায্য করা হবে না।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১১১)

“আল্লাহ সিদ্ধান্ত করেছেন যে, অবশ্যই আমি এবং আমার রাসূলগণই বিজয়ী হবে। নিশ্চয় আল্লাহ সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশীল।” (৫৮-সূরা আল মুজাদালা: আয়াত-২১)

“নিশ্চয় আমি আমার রাসূলদেরকে আর মু’মিনদেরকে পার্থিব জীবনে এবং যে দিন সাক্ষীরা দণ্ডায়মান হবে সেদিন সাহায্য করব।” (৪০-সূরা আল মু’মিন: আয়াত-৫১)

“আর আমি আমার বিষয় আল্লাহর নিকট সমর্পণ করছি। নিশ্চয় আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি দৃষ্টি রাখেন। তাই আল্লাহ্ তাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করলেন।” (৪০-সূরা আল মু'মিন: আয়াত-৪৪-৪৫)

“এবং আল্লাহর উপরই যেন মু’মিনগণ নির্ভর করেন।” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত-১২২)

আজই যেন আপনার শেষ দিন এভাবে আজকের দিনটি কাটান। এ ধরনের মানসিকতা ও জীবন সম্বন্ধে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যদি থাকে তবে রাগ-দুঃখকে প্রশ্রয় দিয়ে আপনার সামান্য যে সময়টুকু আছে তা নষ্ট করার কোন যুক্তি নেই। এক হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

إذا أَصْبَحْتَ فَلا تَنْتَظِرِ المساءَ وإذا أمسيـْتَ فلا تَنْتَظِرِ الصَّباحَ

“সকাল বেলা সন্ধ্যাবেলা দেখার আশা করো না। আর সন্ধ্যাকালে সকাল বেলা দেখার আশা করো না।”

অন্য কথায় অতীত নিয়ে না ভেবে ও ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা না করে আত্মা-দেহ-মন নিয়ে জীবন শুধু আজকের জন্যই।

একজন আরব কবি বলেন-

“যা অতীত হয়ে গেছে তা চিরদিনের জন্য চলে গেছে আর যা আশা করা হয় তাতো অজানা –অজ্ঞাত।”

“আর তোমার যা আছে তা হলো বর্তমান মুহূর্তটি।”

অতীতের চিন্তায়-বিভোর হওয়া এবং অতীতের দুঃখ-কষ্টকে বর্তমানে টেনে আনা অস্থির ও অসুস্থ মনের লক্ষণ।

চীনা (চীন দেশীয়) প্রবাদে বলা হয় “সেতুতে পৌছার আগেই সেতু পার হয়ো না।” অন্য কথায়, ঘটনা ঘটার আগেই তা নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।

আমাদের একজন ধাৰ্মিক পূর্বসূরী বলেছেন-

“হে আদম সন্তান! নিশ্চয় তোমাদের দিন মাত্র তিনটি। গতকাল আর এটা তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আগামীকাল যা এখনও আসেনি এবং আজ। সুতরাং আজকের দিনে আল্লাহকে ভয় কর, তাকে মান্য কর।”

যে নাকি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের উদ্বেগ নিয়ে বেড়ায় সে কিভাবে বাচতে পারে? তা ইতোমধ্যে ঘটে গেছে সর্বদা তার কথা মনে করে করে মানুষ কিভাবে শান্তি পেতে পারে? যে অতীতের দুঃখজনক ঘটনার কথা মনে করে, সে শুধু ব্যথাই পায়, এতে তার কোন লাভ হয় না।

“সকালে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁচার আশা করো না ও সন্ধ্যায় সকাল পর্যন্ত বাঁচার আশা করো না।”

এ কথার অর্থ হল এ পৃথিবীর জন্য আমাদের বড় ধরনের ও দীর্ঘ-কালীন আশা থাকা উচিত নয়। মৃত্যুর জন্য প্রতীক্ষা করুন। নেক আমল করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করুন। আপনার উদ্বেগ ও আকাঙ্ক্ষাকে আজকের দিনের সীমা পেরিয়ে যেতে দেবেন না। এ নীতি আপনাকে মনোযোগী হতে এবং প্রতিদিন উৎপাদনশীল হওয়ার জন্য আপনার সমস্ত শক্তিকে ব্যয় করতে সাহায্য করবে। দক্ষতার সাথে সময়কে কাজে লাগান এবং আপনার আচার-আচরণ, চাল-চলনের উন্নতি করে, আপনার স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ে ও অন্যের সাথে আপনার সম্পর্ক দৃঢ় করে আজ কোন কিছু অর্জন করার জন্য আপনার সকল প্রচেষ্টাকে কাজে লাগান।

দুঃখিত হবেন না, কেননা যা তকদীরে আছে তা তো সিদ্ধান্ত করা হয়ে গেছে এবং আপনি পছন্দ না করলেও তা ঘটবে। কলমের কালি শুকিয়ে গেছে, কাগজ গুটিয়ে নেয়া হয়েছে এবং সবকিছু দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তাই আপনার দুঃখ বাস্তবতাকে একটুও পাল্টাতে পারবে না।

দুঃখ করবেন না, কারণ আপনার বিষন্নতার দ্বারা আপনি সময়ের গতিরোধ করতে চান, সূর্যকে তার উদয়স্থলে থামিয়ে দিতে চান, ঘড়ির কাঁটাকে স্থির-নিশ্চল করে দিতে চান, পেছনের দিকে হাঁটতে চান এবং নদীকে তার উৎসের দিকে উল্টো বহাতে বা প্রবাহিত করতে চান যা সবই অসম্ভব। (অর্থাৎ আপনার বিষণ্নতার কারণে এগুলোর পরিবর্তন যেমন সম্ভব নয়, তেমনই আপনার ভাগ্যের পরিবর্তনও সম্ভব নয়; সুতরাং বিষন্ন হয়ে কোন লাভ নেই-এ কথাই লেখক এখানে বুঝাতে চাচ্ছেন। -বঙ্গানুবাদক)

বিষন্ন হবেন না, কারণ বিষন্নতা ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঢেউগুলোকে ভয়ংকরভাবে আছড়ায়। পরিবেশকে নষ্ট করে বা বায়ুমণ্ডলকে পরিবর্তন করে এবং সমৃদ্ধ বাগানের ফুটন্ত ফুলগুলোকে ধ্বংস করে।

বিষন্ন হবেন না, কেননা বিষগ্ন ব্যক্তি তার মতো, যে নাকি তলায় ছিদ্রযুক্ত বালতিতে পানি ঢালে। যে লেখক নিজের আঙুল দিয়ে পানিতে লিখতে চায় সে (অর্থাৎ বিষন্ন ব্যক্তি) তার মতো।

দুঃখিত হবেন না, কারণ প্রকৃত জীবন কাল মাপা হয় দিনের সংখ্যা দিয়ে-যে দিন আপনি কাটাচ্ছেন। সুতরাং আপনার দিনগুলোকে দুঃখ করে করে শেষ করবেন না। আপনার রাতগুলোকে দুঃখ করে নষ্ট করবেন না এবং আপনার সময়ের অপচয় করবেন না। কারণ, সত্যসত্যই আল্লাহ অপচয়কারীদেরকে ভালোবাসেন না।

দুশ্চিন্তা করবেন না, কেননা সত্যিই আপনার প্রভু পাপ মার্জনা করেন ও অনুতাপ-অনুশোচনা গ্রহণ করেন (অর্থাৎ গুনাহ মাফ করেন ও তওবা কবুল করেন)।

“বলুন: “হে আমার সেসব বান্দারা যারা (গুনাহ করে) নিজেদের প্রতি অত্যাচার করেছ! তোমরা আল্লাহর রহমত হতে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি অতি ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।” (৩৯-সূরা আয যুমার: আয়াত-৫৩)

যখন আপনি এ আয়াতখানি পড়েন তখন কি আপনার আত্মা শান্তি পায় না? আপনার উদ্বিগ্নতা ও দুশ্চিন্তা কি দূর হয় না? এবং আপনার সমগ্র সত্তার মধ্য দিয়ে কি সুখের প্রবাহ বয়ে যায় না?

তাদের আত্মাকে পোষ মানাতে তিনি তাদেরকে ‘হে আমার বান্দারা!' বলে আহবান করেছেন। তিনি বিশেষ করে সীমালঙ্ঘনকারীদেরকে এ কারণে উল্লেখ করেছেন, কারণ তারা অন্যদের তুলনায় অনবরত গুনাহ করতে বেশি অভ্যস্ত। তাহলে অন্যদের জন্য আল্লাহর করুণা কতই না বেশি হবে! এভাবে তিনি তাদেরকে হতাশ হওয়া থেকে এবং ক্ষমা পাওয়ার আশাহত হওয়া থেকে বারণ করেছেন। এবং তিনি তাদেরকে জানিয়ে দিলেন যে, যে তওবা করবে তার ছোট-বড়, সাংঘাতিক বা তুচ্ছ সব গুনাহই তিনি ক্ষমা করে দিবেন

وَالَّذِينَ إِذَا فَعَلُوا فَاحِشَةً أَوْ ظَلَمُوا أَنفُسَهُمْ ذَكَرُوا اللَّهَ فَاسْتَغْفَرُوا لِذُنُوبِهِمْ وَمَن يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا اللَّهُ

“আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে অমনিই আল্লাহকে স্মরণ করে আল্লাহর নিকট তাদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং জেনে শুনে তারা যে (পাপ) করেছে তা করতে থাকেন না (তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন)। আর আল্লাহ ছাড়া কে আছে যে পাপ ক্ষমা করতে পারবে?” (৩-সূরা আলে ইমরান: আয়াত ১৩৫)

“আর যে মন্দ কাজ করে বা নিজের প্রতি অত্যাচার করে তারপর আল্লাহর নিকট ইসতিগফার করে বা গুনাহ মাফ চায়, সে আল্লাহকে মহা ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবে পাবে।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-১১০)

“তোমাদেরকে যা নিষেধ করা হয়েছে যদি তোমরা তার মধ্য হতে বড় বড় গুনাহ এড়িয়ে চল, তবে আমি তোমাদের (ছোট ছোট) পাপ ক্ষমা করে দিব এবং তোমাদেরকে সম্মানজনক স্থান বেহেশতে প্রবেশ করাব।” (৪-সূরা নিসা: আয়াত-৩১)

“আর যদি তারা নিজেদের প্রতি অবিচার করে আপনার নিকট এসে আল্লাহর কাছে পাপ ক্ষমা চায় এবং তাদের জন্য রাসূলও ক্ষমা চান তবে তারা আল্লাহকে অবশ্যই পরম ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু হিসেবে পাবে।” (৪-সূরা আন নিসা: আয়াত-৬৪)

“আর যে ব্যক্তি তওবা করে, ঈমান আনে ও আমলে সালেহ করে, অতঃপর হিদায়েতের পথে চলে সে ব্যক্তিকে অবশ্যই আমি ক্ষমা করে দিব।” (২০-সুরা ত্বাহা: আয়াত-৮২)

তবে কি আপনি এসব (উপরোক্ত পাঁচটি) আয়াতসমূহ পড়তে আনন্দ পান না?

মূসা (আঃ) যখন একজন লোককে (অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভুলক্রমে) হত্যা করে ফেলেছিলেন তখন তিনি বলেছিলেন-

হে আমার প্রভু! আমি অবশ্যই আমার প্রতি জুলুম করেছি, তাই আমাকে ক্ষমা করে দিন। তারপর তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন।” (২৮-সূরা আল কাছাছ: আয়াত-১৬)

দাউদ (আঃ) যখন অনুতপ্ত হলেন তখন আল্লাহ বলেন-

“অতঃপর আমি তার সে ভুল ক্ষমা করেছিলাম এবং তার জন্য আমার নিকট নৈকট্য ও শুভ পরিণাম রয়েছে।” (৩৮-সূরা ছোয়াদ: আয়াত-২৫)

আল্লাহ কতই না উৎকৃষ্ট, করুণাময় ও উদার! এমনকি যারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে তারাও যদি তওবা করে, তবে তিনি তাদেরকেও তার করুণা ও ক্ষমার প্রস্তাব করেছেন।

“তারা অবশ্যই কুফুরি করে যারা বলে যে, আল্লাহ তিনজনের মধ্যে তৃতীয় (একজন); অথচ একমাত্র ইলাহ (আল্লাহ) ছাড়া অন্য কোন ইলাহ নেই। তারা যা বলে তা হতে তারা বিরত না হলে তাদের মধ্য হতে যারা কুফুরি করেছে তাদের উপর অবশ্যই অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি আপতিত হবে। তবে কি তারা আল্লাহর নিকট তওবা ও ইসতিগফার করবে না? আল্লাহ তো অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম মেহেরবান।” (৫-সূরা মায়িদা: আয়াত-৭৩-৭৪)

একখানি নির্ভরযোগ্য (সহীহ) হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

“আল্লাহ তা'আলা বলেন, “হে আদম সন্তান! তুমি যখন আমার নিকট প্রার্থনা করবে ও আমার নিকট আশা করবে তখন তোমার আশা, একনিষ্ঠতা ও বিশ্বাস অনুসারে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব আর এতে আমি কিছু মনে করব না (বা কারো পরওয়া করব না); হে বনী আদম! যদি তোমার গুনাহের পরিমাণ আকাশের চূড়ার সমানও হয়, তারপর তুমি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কর তবে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিব। এবং তাতে আমি কিছু মনে করব না (বা এতে আমি কারো পরওয়া করব না)। হে বনী আদম সন্তান। যদি তুমি আমার সাথে কোন কিছুকে শরীক না করে পৃথিবীর সমপরিমাণ পাপ নিয়ে আমার নিকট আস তারপর আমার সাথে সাক্ষাৎ কর, তবে আমিও তোমার নিকট পৃথিবীর সমপরিমাণ ক্ষমা নিয়ে আসব।”

ইমাম বুখারী (রহঃ) বর্ণনা করেছেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“দিনের বেলা যারা পাপ করেছে তাদেরকে মাফ করার জন্য নিশ্চয় আল্লাহ রাত্রিবেলা তার হাত প্রসারিত করেন। এবং রাত্রিবেলা যারা গুনাহ করেছে তাদেরকে ক্ষমা করার জন্য দিনের বেলা তার হাতকে প্রসারিত করে দেন। এবং সূর্য পশ্চিম দিকে উদিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি এরূপ করতে থাকবেন।”

আরেকটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ বলেন-

“হে আমার বান্দারা! তোমরা অবশ্যই দিন-রাত গুনাহ কর, আর আমি সব পাপ মাফ করে দেই। অতএব, তোমরা আমার নিকট ক্ষমা চাও। তাহলেই আমি তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিব।”

আরেকটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন-

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَوْ لَمْ تُذْنِبُوا لَذَهَبَ اللهُ بِكُمْ، وَلَجَاءَ بِقَوْمٍ يُذْنِبُونَ، فَيَسْتَغْفِرُونَ اللهَ فَيَغْفِرُ لَهُمْ

“যার হাতে আমার প্রাণ তার কসম, যদি তোমরা গুনাহ না করতে (এবং এর কারণে অহংকার বশত: ক্ষমা না চাইতে) তবে আল্লাহ তোমাদেরকে দূর করে অবশ্যই অন্য জাতিকে আনতেন যারা পাপ করে পরে আল্লাহর নিকট ক্ষমা চাইতো ফলে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন।” (এ হাদীস থেকে বুঝা যায় যে, আল্লাহ ক্ষমা চাওয়াকে পছন্দ করেন। -বঙ্গানুবাদক)

এবং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন-

“যে সত্তার হাতে আমার জীবন, তার শপথ; যদি তোমরা পাপ না করতে তবে আমি তোমাদের ব্যাপারে এমন কিছুর ভয় করতাম যা গুনাহের চেয়েও বেশি ভয়ংকর আর তা হলো আত্মগরিমা।”

অন্য একটি নির্ভরযোগ্য বর্ণনায় আছে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

كلكم خطاء وخير الخطائين التوابون

“তোমরা সবাই পাপী আর সর্বোত্তম পাপী তারাই যারা তওবাকারী।”

নিম্নের এই নির্ভরযোগ্য হাদীসখানিতে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন-

“আল্লাহ তার বান্দার তওবাতে তোমাদের সে ব্যক্তির চেয়েও বেশি খুশি হন, যে নাকি তার সওয়ারী বা বাহনের উপর ছিল, এর উপর তার খাদ্য-পানীয়ও ছিল তারপর বাহনটি তার কাছ থেকে মরুভূমিতে হারিয়ে গেল, তারপর সে এটাকে খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে হতাশ হয়ে গেল, এরপর ঘুমিয়ে পড়ল। তারপর ঘুম থেকে জেগেই দেখে বাহনখানি তার মাথার কাছে। ফলে সে খুশিতে আত্মহারা হয়ে ভুলে বলে ফেলল, 'হে আল্লাহ! তুমি আমার বান্দা আর আমি তোমার প্রভু, ভীষণ খুশির চোটেই সে ভুল করে ফেলল।”

নির্ভরযোগ্যভাবে আরেক হাদীসে বর্ণিত আছে যে, তিনি (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:

“নিশ্চয় এক বান্দা গুনাহ করে বলল, “হে আল্লাহ! আমার পাপ ক্ষমা করে দিন, কেননা, আপনি ছাড়া কেউ পাপ মার্জনা করতে পারে না।’ তারপর আবারও পাপ করে বলল, 'হে আল্লাহ! আমার গুনাহ মাফ করে দিন, কেননা, আপনি ছাড়া কেউ পাপ ক্ষমা করতে পারে না। এরপর আবারও গুনাহ করে বলল, হে আল্লাহ! আমার গুনাহ ক্ষমা করে দিন। কারণ, আপনি ব্যতীত কেউই গুনাহ মার্জনা করতে পারবে না। অতপর মহান আল্লাহ বলেন, আমার বান্দা জানে যে, তার একজন প্রভু আছেন যিনি কাউকে পাপের কারণে পাকড়াও করবেন এবং কাউকে ক্ষমা করে দিবেন। অতএব আমার বান্দা যা ইচ্ছা করুক। অর্থাৎ (এভাবে গুনাহ হয়ে গেলে তওবা করতে থাক এবং) যতক্ষণ পর্যন্ত সে অনুতপ্ত হতে থাকবে, অনুশোচনা ও তওবা করতে থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমি তাকে ক্ষমা করতে থাকব।”

৪৯. দুঃখিত হবেন না- সব কিছুই ভাগ্যানুসারে ঘটবে

তকদীর অনুপাতে ও যা সিদ্ধান্ত করা হয়েছে সে অনুসারেই সব কিছু ঘটে। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মত মুসলিমদের ধর্ম-বিশ্বাস এমনই। আল্লাহর ইলমের বাইরে, তার অনুমতি ছাড়া এবং ঐশী পরিকল্পনা ছাড়া এ বিশ্ব জগতে কোন কিছুই ঘটে না।

مَا أَصَابَ مِن مُّصِيبَةٍ فِي الْأَرْضِ وَلَا فِي أَنفُسِكُمْ إِلَّا فِي كِتَابٍ مِّن قَبْلِ أَن نَّبْرَأَهَا إِنَّ ذَٰلِكَ عَلَى اللَّهِ يَسِيرٌ

“পৃথিবীতে এবং তোমাদের মাঝে যে বিপর্যয় আসে তা আমি ঘটানোর পূর্বেই কিতাবে লিপিবদ্ধ আছে, নিশ্চয় সে কাজ আল্লাহর পক্ষে সহজ।” (৫৭-সূরা আল হাদীদ: আয়াত-২২)

إِنَّا كُلَّ شَيْءٍ خَلَقْنَاهُ بِقَدَرٍ

“নিশ্চয় আমি প্রতিটি জিনিসকেই তার পূর্বনির্ধারণী অনুসারেই সৃষ্টি করি।” (৫৪-সূরা আল ক্বামারঃ আয়াত-৪৯)

“এবং অবশ্যই আমি তোমাদেরকে ভয়, ক্ষুধা এবং ধন-সম্পদ, জীবন ও ফসলের ক্ষতি ইত্যাদি কতিপয় জিনিস দ্বারা পরীক্ষা করব এবং (হে নবী মুহাম্মাদ) আপনি ধৈর্যশীলদেরকে (জান্নাতের) সুসংবাদ দিন।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-১৫৫)

একটি হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“মুমিনের কাজ বড়ই আশ্চর্যজনক! নিশ্চয় তার সব কাজই তার জন্য কল্যাণকর। যখন তার কোন কল্যাণ হয় তখন শুকরিয়া আদায় করে, ফলে তা তার আরো কল্যাণকর হয়ে যায়। আর যখন তার কোন ক্ষতি হয় তখন সে ধৈর্য ধারণ করে, ফলে সে ক্ষতিও তার জন্য কল্যাণকর হয়ে যায়। আর এমনটি মু’মিন ছাড়া অন্য কারো জন্যই হয় না।”

একটি বিশুদ্ধ হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“যখন তুমি কোন কিছু চাইবে, তখন তুমি তা আল্লাহর নিকটে চাও, আর যখন তুমি সাহায্য চাইবে তখন তুমি আল্লাহর নিকটই সাহায্য চাও। আর জেনে রাখ যে, সব মানুষও যদি কোন বিষয়ে তোমার উপকার করার জন্য একত্রিত হয় তবুও তারা তা করতে পারবে না। তবে আল্লাহ তোমার ভাগ্যলিপিতে যেটুকু লিখে রেখেছেন ততটুকু উপকার করতে পারবে। আর যদি তারা তোমার ক্ষতি করার জন্যও একত্রিত হয় তবুও তারা তা করতে পারবে না, তবে তোমার ভাগ্যলিপিতে আল্লাহ যেটুকু লিখে রেখেছেন-সেটুকু ক্ষতি তারা করতে পারবে। কলম উঠিয়ে রাখা হয়েছে এবং (কালিতে লিখিত) পৃষ্ঠাসমূহ শুকিয়ে গেছে।”

নবী করীম (তার উপর করুণা ও শান্তি বর্ষিত হোক) আরো বলেছেন-

“এবং জেনে রাখ যে, যা তোমার নিকট এসেছে তা তোমার নিকট না আসার ছিল না এবং যা তোমার নিকট আসেনি তা তোমার নিকট আসার ছিল না।”

অন্য একটি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“যা তোমার উপকার করবে তার জন্য চেষ্টা কর, আল্লাহর নিকট সাহায্য চাও, দুর্বল হয়ো না ও এ কথা বলো না যে, আমি অমুক অমুক কাজ করলে অবস্থা এমন এমন হতো। বরং একথা বল যে, আল্লাহ সিদ্ধান্ত করে ফেলেছেন এবং তিনি যা চান তা তিনি করেন।”

আরো একখানি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“বান্দার জন্য আল্লাহ যে ফয়সালা করেন তা তার জন্য কল্যাণকর।”

শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমিয়াকে পাপ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করা হলো, এটা কি কারো জন্য উপকারী? তিনি বললেন “হ্যাঁ, তবে এ শর্তে যে, পাপের পর লজ্জিত, অনুতপ্ত, ক্ষমা প্রার্থনাকারী ও মানসিকভাবে চরম অনুতপ্ত হতে হবে।”

মহান আল্লাহ বলেন-

“এবং এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা অপছন্দ কর তা তোমাদের জন্য কল্যাণকর আর এমনও হতে পারে যে, তোমরা যা পছন্দ কর তা তোমাদের জন্য ক্ষতিকর এবং আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না।” (২-সূরা বাকারা: আয়াত-২১৬)

৫০. দুঃখিত হবেন না- একটি সুখদায়ক পরিণতির জন্য ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করুন

নিচের হাদীসখানি তিরমিযী শরীফে পাওয়া যায়-

“সর্বোত্তম ইবাদত হলো (ধৈর্য সহকারে) স্বস্তির জন্য অপেক্ষা করা।”

أَلَيْسَ الصُّبْحُ بِقَرِيبٍ

“প্রভাত কি নিকটবর্তী নয়?”

দুর্দশাগ্রস্তদের প্রভাত আবির্ভূত হচ্ছে, সুতরাং এর জন্য অপেক্ষা করুন। একটি আরবী প্রবাদ আছে, “রশি যদি বেশি কষে তবে তা ছিড়ে যায়।”

অন্য কথায়, যদি কোন অবস্থা সংকটজনক স্তরে পৌছে যায় তবে আলো ও খোলা পথের প্রত্যাশা কর। আল্লাহ তা'আলা বলেন-

“আর যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে তবে আল্লাহ তার পাপসমূহ ক্ষমা করে দিবেন এবং তাকে মহাপুরস্কার দিবেন।” (৬৫-সূরা আত তালাক্ব: আয়াত-৫)

“আর যে ব্যক্তি আল্লাহকে ভয় করে- আল্লাহ তার কাজ সহজ করে দেন।" (৬৫-সূরা আত তালাক্ব : আয়াত-৪)

একখানি নির্ভরযোগ্য হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর এ কথা বলেন-

“আমার বান্দা আমার প্রতি যেরূপ ধারণা পোষণ করে আমি (তার প্রতি) সেরূপই (আচরণ করি); সুতরাং, সে যেরূপ ইচ্ছা আমার প্রতি সেরূপই ধারণা পোষণ করুক।”

সর্বশক্তিমান আল্লাহ বলেন-

“অবশেষে যখন রাসূলগণ হতাশ হয়ে গেলেন আর মানুষেরা ধারণা করল, তাদেরকে (অর্থাৎ রাসূলদেরকে) মিথ্যা আশ্বাস দেয়া হয়েছে বা (নবীগণ ভাবলেন,) মানুষেরা তাদেরকে মিথ্যুক ভাবছে, তখন তাদের নিকট আমার সাহায্য আসল। অতএব, আমি যাকে ইচ্ছা করি সে মুক্তি পায়।” (১২-সূরা ইউসুফ : আয়াত-১১০)

জেনে রাখুন যে, কষ্টের সাথে অবশ্যই স্বস্তি আছে। কোন কোন মুফাচ্ছির বা কুরআনের ব্যাখ্যাকার বলেন, “একটি সঙ্কট দু'টি আরামকে ছাড়িয়ে যেতে পারে না।” এবং এ কথাকে তারা হাদীস মনে করেন।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

“জেনে রাখ যে ধৈর্যের মাধ্যমে বিজয় আসে এবং কষ্টের মাধ্যমে আরাম আসে।”

একজন আরবী কবি বলেছেন-

“যখন নাকি কিছু চোখ ঘুমিয়ে আছে তখন কিছু আঁখি আছে বিশ্রামহীন,

কী ঘটবে আর কী ঘটবে না তা নিয়ে গভীর ধ্যানেমগ্ন;

অতএব, যথাসম্ভব দুশ্চিন্তা ত্যাগ কর;

কেননা, দুশ্চিন্তার বোঝা বহন করা পাগলামি।

তোমার প্রভু আছেন, যিনি তোমার গতকালের সমস্যা সমাধান করেছেন,

তিনিই আগামীকালও তোমার যা সমস্যা হবে তা সমাধান করবেন।”

আরেক আরবী কবি বলেছেন-

১. “ঘটনা প্রবাহকে তার পূর্বনির্ধারিত পথে চলতে দাও, আর দুশ্চিন্তামুক্ত মন নিয়ে ঘুমাও।

২. কেননা, আল্লাহ এক পলকের মধ্যে অবস্থার পরিবর্তন করে দেন।

দেখানো হচ্ছেঃ ৪১ থেকে ৫০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩৪৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 · · · 32 33 34 35 পরের পাতা »