হারাম ও কবিরা গুনাহ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ৩০১ টি
হারাম ও কবিরা গুনাহ মোস্তাফিজুর রহমান বিন আব্দুল আজিজ আল-মাদানী ৩০১ টি

সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য যিনি আমাদেরকে নিখাদ তাওহীদের দিশা এবং সুন্নাত ও বিদ‘আতের পার্থক্যজ্ঞান দিয়েছেন। অসংখ্য সালাত ও সালাম তাঁর জন্য যিনি আমাদেরকে তা-কিয়ামত সফল জীবন অতিবাহনের পথ বাতলিয়েছেন। তাঁর পরিবারবর্গ ও সাহাবাদের প্রতিও রইল অসংখ্য সালাম।

মানব সমাজে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্যতার দরুন অনেক ধরনের হঠকারিতাই বিরাজমান। তম্মধ্যে লঘু পাপকে গুরু মনে করা এবং গুরু পাপকে লঘু মনে করা অন্যতম। অনেক তো এমনো রয়েছেন যে, যে কাজ পাপের নয় সে কাজকেও মহাপাপ বলে গণ্য করেন। অন্য দিকে মহাপাপকে কিচ্ছুই জ্ঞান করেন না। ঠিক এরই বিপরীতে কেউ কেউ সামান্য সাওয়াবের ব্যাপারকে ফরযের চাইতেও বেশি মূল্য দিয়ে থাকেন; অথচ অন্য দিকে তিনি ফরযেরই কোন ধার ধারেন না। যদ্দরুন শরীয়তের দৃষ্টিকোণে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সাওয়াবের কাজ এমনো থেকে যাচ্ছে যে, আজো পর্যন্ত যা কোন না কোন মুসলিম সমাজে কারোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে নি। অনেক তো এমনো রয়েছেন যে, কোন কোন গুনাহ্’র কাজকে তিনি মহা সাওয়াবের কাজ মনে করছেন এবং সেগুলো সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য বিশেষভাবে কসরত চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ দয়াপরবশ হয়ে সেগুলোর সঠিক রূপ ধরিয়ে দিতে চাইলে সে উক্ত সমাজের শয়তান প্রকৃতির মানুষ কর্তৃক ইসলামের শত্রু, গাদ্দার, বেঈমান, কাফির, মুনাফিক, মতলববাজ, বেয়াদব, বুযুর্গদের খাঁটি দুশমন ইত্যাদি বিশেষণে আখ্যায়িত হন। সুতরাং সঠিক বিবেচনার জন্য গুনাহ্’র পর্যায় ও স্তরগুলো সঠিকভাবে অনুধাবন করা আমাদের জন্য একেবারেই অত্যাবশ্যক এবং উক্ত উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই আমাদের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।

অত্যন্ত আনন্দের বিষয় হচ্ছে, এ পুস্তিকাটিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পৃক্ত যতগুলো হাদীস উল্লিখিত হয়েছে সাধ্যমত উহার বিশুদ্ধতার প্রতি সযত্ন দায়িত্বশীল দৃষ্টি রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে নিদেনপক্ষে সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রখ্যাত হাদীস বিশারদ ‘আল্লামা নাসিরুদ্দীন আল্বানী সাহেবের হাদীস শুদ্ধাশুদ্ধনির্ণয়ন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এতদসত্ত্বেও সকল যোগ্য গবেষকদের পুনর্বিবেচনার সুবিধার্থে প্রতিটি হাদীসের সাথে তার প্রাপ্তিস্থাননির্দেশ সংযোজন করা হয়েছে। তবুও সম্পূর্ণরূপে নিরেট নির্ভুল হওয়ার জোর দাবি করার ধৃষ্টতা দেখাচ্ছি না।

শব্দ ও ভাষাগত প্রচুর ভুল-ভ্রান্তি বিজ্ঞ পাঠকবর্গের চক্ষুগোচরে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে ভুল গুরুসামান্য যতটুকুই হোক না কেন লেখকের দৃষ্টিগোচর করলে চরম কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ থাকবো। যে কোন কল্যাণকর পরামর্শ দিয়ে দাওয়াতী স্পৃহাকে আরো বর্ধিত করণে সর্বসাধারণের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করছি। আল্লাহ্ তা‘আলা সবার সহায় হোন।

এ পুস্তিকা প্রকাশে যে কোন জনের যে কোন ধরনের সহযোগিতার জন্য সমুচিত কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনে এতটুকুও কোতাহী করছিনে। ইহপরকালে আল্লাহ্ তা‘আলা প্রত্যেককে তার আকাঙ্খাতীত কামিয়াব করুন তাই হচ্ছে আমার সর্বোচ্চ আশা। আমীন সুম্মা আমীন ইয়া রাববাল ‘আলামীন।

সর্বশেষে জনাব আব্দুল হামীদ ফায়যী সাহেবের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ না করে পারছিনে। যিনি অনেক ব্যস্ততার মাঝেও আমার আবেদনক্রমে পান্ডুলিপিটি আদ্যপান্ত অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে দেখেছেন এবং তাঁর অতীব মূল্যবান মতামত ব্যক্ত করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে এর উত্তম প্রতিদান দিন, তাঁর জ্ঞান আরো বাড়িয়ে দিন এবং পরিশেষে তাঁকে জান্নাত দিয়ে দিন এ আশা রেখে এখানেই শেষ করলাম।

লেখক

إِنَّ الْـحَمْدَ للهِ، نَحْمَدُهُ وَنَسْتَعِيْنُهُ وَنَسْتَغْفِرُهُ، وَنَعُـوْذُ بِاللهِ مِنْ شُرُوْرِ أَنْفُسِنَا، وَمِنْ سَيِّئَاتِ أَعْمَالِنَا، مَنْ يَّهْدِهِ اللهُ فَلَا مُضِلَّ لَهُ، وَمَنْ يُّضْلِلِ اللهُ فَلَا هَادِيَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنْ لاَّ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لَا شَرِيْكَ لَهُ، وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ.

নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা আল্লাহ্ তা‘আলার জন্য। আমরা সবাই তাঁরই প্রশংসা করছি, তাঁরই নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি প্রবৃত্তির অনিষ্ট ও খারাপ আমল থেকে। যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা হিদায়াত দিবেন তাকে পথভ্রষ্ট করার আর কেউ নেই এবং যাকে আল্লাহ্ তা‘আলা পথভ্রষ্ট করবেন তাকে হিদায়াত দেয়ারও আর কেউ নেই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া সত্য কোন মা’বূদ নেই। তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই এবং আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা‘আলার বান্দাহ্ ও একমাত্র তাঁরই প্রেরিত রাসূল।

আল্লাহ্ তা‘আলা মানুষের উপর যা যা ফরয করে দিয়েছেন তা অবশ্যই করতে হবে এবং যা যা হারাম করে দিয়েছেন তা অবশ্যই ছাড়তে হবে।

আবূ সা’লাবাহ্ খুশানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِنَّ اللهَ فَرَضَ فَرَائِضَ فَلَا تُضَيِّعُوْهَا، وَحَرَّمَ حُرُمَاتٍ فَلَا تَنْتَهِكُوْهَا، وَحَدَّ حُدُوْدًا فَلَا تَعْتَدُوْهَا، وَسَكَتَ عَنْ أَشْيَاءَ مِنْ غَيْرِ نِسْيَانٍ، فَلَا تَبْحَثُوْا عَنْهَا.

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা কিছু কাজ ফরয তথা বাধ্যতামূলক করে দিয়েছেন যার প্রতি তোমরা কখনোই অবহেলা করবে না এবং আরো কিছু কাজ তিনি হারাম করে দিয়েছেন যা তোমরা কখনোই করতে যাবে না, আরো কিছু সীমা (তা ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ্ যাই হোক না কেন) তিনি তোমাদেরকে বাতলিয়ে দিয়েছেন যা তোমরা কখনোই অতিক্রম করতে যাবে না। তেমনিভাবে তিনি কিছু ব্যাপারে চুপ থেকেছেন (তা ইচ্ছে করেই) ভুলে নয়। সুতরাং তোমরা তা খুঁজতে যাবে না’’।

(দারাক্বুত্বনী/ আর্-রাযা’ ৪২; ত্বাবারানী/ কাবীর ৫৮৯; বায়হাক্বী ১৯৫০৯)

অনুরূপভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা যা যা হালাল করে দিয়েছেন তা হালাল বলে মনে করতেই হবে এবং যা যা তিনি হারাম করে দিয়েছেন তা হারাম মনে করে অবশ্যই বর্জন করতে হবে।

আবুদ্দারদা’ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

مَا أَحَلَّ اللهُ فِيْ كِتَابِهِ فَهُوَ حَلَالٌ، وَمَا حَرَّمَ فَهُوَ حَرَامٌ، وَمَا سَكَتَ عَنْهُ فَهُوَ عَافِيَةٌ فَاقْبَلُوْا مِنَ اللهِ الْعَافِيَةَ، فَإِنَّ اللهَ لَمْ يَكُنْ نَسِيًّا، ثُمَّ تَلَا هَذِهِ الْآيَةَ: «وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا».

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে যা যা হালাল করে দিয়েছেন তাই হালাল এবং যা যা হারাম করে দিয়েছেন তাই হারাম। আর যে সম্পর্কে তিনি চুপ থেকেছেন তা মানুষের জন্য আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বিশেষ ছাড় (যা করাও যাবে ছাড়াও যাবে, তা নিয়ে তেমন কোন চিন্তাও করতে হবে না)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে সেগুলোকে সেভাবেই গ্রহণ করো। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলা ভুলে যাওয়ার নন। অতঃপর তিনি উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন যার অর্থ: তোমার প্রভু কখনো ভুলে যাওয়ার নন’’। (হা’কিম ২/৩৭৫)

হারাম কাজগুলোকেও কুর‘আনের ভাষায় ‘‘’হুদূদ’’ বলা হয় যা করা তো দূরের কথা বরং তার নিকটবর্তী হওয়াও নিষিদ্ধ।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلَا تَقْرَبُوْهَا»

‘‘এগুলো আল্লাহ্ তা‘আলার পক্ষ থেকে বাতলানো সীমা। অতএব তোমরা সেগুলোর নিকটেও যাবে না’’। (বাক্বারাহ : ১৮৭)

যারা আল্লাহ্ তা‘আলার বাতলানো সীমা অতিক্রম করবে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদেরকে জাহান্নামের হুমকি দিয়েছেন।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَمَنْ يَّعْصِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا، وَلَهُ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ».

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূলের বিরুদ্ধাচরণ করে এবং আল্লাহ্’র দেয়া সীমা অতিক্রম করে আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করবেন। তম্মধ্যে সে সদা সর্বদা অবস্থান করবে এবং তাতে তার জন্য লাঞ্ছনাকর শাস্তির ব্যবস্থাও রয়েছে’’।

(নিসা’ : ১৪)

এ কথা সবারই মনে রাখতে হবে যে, নিষিদ্ধ কাজগুলো একেবারেই বর্জনীয়। তাতে কোন ছাড় নেই। তবে আদেশগুলো যথাসাধ্য পালনীয়।

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِذَا أَمَرْتُكُمْ بِشَيْءٍ فَأْتُوْا مِنْهُ مَا اسْتَطَعْتُمْ، وَإِذَا نَهَيْتُكُمْ عَنْ شَيْءٍ فَدَعُوْهُ.

‘‘যখন আমি তোমাদেরকে কোন কাজের আদেশ করি তখন তোমরা তা সাধ্যানুযায়ী করতে চেষ্টা করবে। তবে যখন আমি তোমাদেরকে কোন কিছু বর্জন করতে বলি তখন তোমরা তা অবশ্যই বর্জন করবে’’।

(মুসলিম ১৩৩৭)

যারা কবীরা গুনাহ্ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের জন্য জান্নাতের ওয়াদা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنْ تَجْتَنِبُوْا كَبَآئِرَ مَا تُنْهَوْنَ عَنْهُ نُكَفِّرْ عَنْكُمْ سَيِّئٰتِكُمْ وَنُدْخِلْكُمْ مُّدْخَلًا كَرِيْمًا».

‘‘তোমরা যদি সকল মহাপাপ থেকে বিরত থাকো যা হতে তোমাদেরকে (কঠিনভাবে) বারণ করা হয়েছে তাহলে আমি তোমাদের সকল (ছোট) পাপ ক্ষমা করে দেবো এবং তোমাদেরকে প্রবেশ করাবো খুব সম্মানজনক স্থান তথা জান্নাতে’’। (নিসা’ : ৩১)

আর তা এ কারণেই যে, ছোট পাপগুলো পাঁচ ওয়াক্ত নামায, জুমার নামায এবং রামাযানের রোযার মাধ্যমেই ক্ষমা হয়ে যায়।

আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

الصَّلَوَاتُ الْـخَمْسُ، وَالْـجُمْعَةُ إِلَى الْـجُمْعَةِ، وَرَمَضَانُ إِلَى رَمَضَانَ، مُكَفِّرَاتٌ لِـمَا بَيْنَهُنَّ، إِذَا اجْتُنِبَتِ الْكَبَائِرُ.

‘‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায, এক জুমা থেকে অন্য জুমা, এক রামাযান থেকে অন্য রামাযান এগুলোর মধ্যকার সকল ছোট গুনাহ্’র ক্ষমা বা কাফ্ফারাহ্ হয়ে যায় যখন কবীরা গুনাহ্ থেকে কেউ সম্পূর্ণরূপে রক্ষা পায়’’। (মুসলিম ২৩৩)

সুতরাং কবীরা গুনাহ্ থেকে রক্ষা পাওয়া এবং এরই পাশাপাশি হারাম কাজগুলো থেকে বেঁচে থাকা প্রত্যেক মুসলিমের একান্ত কর্তব্য। তবে কবীরা গুনাহ্ ও হারাম সম্পর্কে পূর্বের কোন ধারণা না থাকলে তা থেকে বাঁচা কারোর পক্ষে কখনোই সম্ভবপর হবে না। তাই সর্বপ্রথম সে সম্পর্কে ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করতে হবে এবং তারপরই আমল। নতুবা আপনি না জেনেই তা করে ফেলবেন। অথচ সে কাজটি করার আপনার আদৌ ইচ্ছে ছিলো না।

এ কারণেই হুযাইফাহ্ (রাঃ) একদা বলেছিলেন:

كَانَ النَّاسُ يَسْأَلُوْنَ رَسُوْلَ اللهِ عَنِ الْـخَيْرِ، وَكُنْتُ أَسْأَلُهُ عَنِ الشَّرِّ مَخَافَةَ أَنْ يُّدْرِكَنِيْ.

‘‘সবাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে লাভজনক বস্ত্ত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতো। আর আমি তাঁকে শুধু ক্ষতিকর বস্ত্ত সম্পর্কেই জিজ্ঞাসা করতাম যাতে আমি না জেনেই সে ক্ষতিকর বস্ত্ততে লিপ্ত না হই’’।

(বুখারী ৩৬০৬; মুসলিম ১৮৪৭)

বাস্তবে দেখা যায়, কিছু সংখ্যক প্রবৃত্তিপ্রেমী জ্ঞানশূন্য ব্যক্তিরা যখন কোন নসীহতকারী ব্যক্তির মুখ থেকে এ কথা শুনে যে, অমুক কাজ কবীরা গুনাহ্ অথবা অমুক বস্ত্ত হারাম তখন সে বিরক্তির সুরে বলে থাকে: সবই তো হারাম। আপনারা আর আমাদের জন্য এমন কি রাখলেন যা হারাম করেননি। আপনারা তো আমাদেরকে বিরক্ত করেই ছাড়লেন। সকল স্বাদকে বিস্বাদ করে দিলেন। জীবনকে একটু মনের মতো করে উপভোগ করতে দিচ্ছেন না। আপনাদের কাছে শুধু হারামই হারাম। অথচ ইসলাম একেবারেই সহজ। আর আল্লাহ্ তা‘আলা অবশ্যই ক্ষমাশীল।

বান্দাহ্ হিসেবে আমাদের সকলকে এ কথা অবশ্যই মানতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যাই চান তাই বান্দাহ্’র জন্য বিধান করেন। তাতে কারোর কোন কিছু বলার নেই। তিনি ভালোমন্দ সব কিছুই জানেন। তিনি হলেন হিকমত ওয়ালা। কখন এবং কার জন্য তিনি কি বিধান করবেন তা তিনি ভালোভালেই জানেন। তিনি যা চান হালাল করেন আর যা চান হারাম করেন। বান্দাহ্ হিসেবে আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সন্তুষ্টচিত্তে সেগুলো মেনে চলা।

আল্লাহ্ তা‘আলার সকল বিধি-বিধান সত্য ও ইনসাফ ভিত্তিক। তাতে কারোর প্রতি কোন যুলুম নেই। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَتَمَّتْ كَلِمَةُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلًا، لَا مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ، وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ».

‘‘তোমার প্রতিপালকের বাণী সত্যতা ও ইনসাফে পরিপূর্ণ। তাঁর বাণী পরিবর্তনকারী কেউই নেই। তিনি সবকিছু শুনেন ও জানেন’’।

(আন্‘আম : ১১৫)

আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে হালাল ও হারামের একটি সহজ ও সরল সূত্র বাতলিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَيُحِلُّ لَـهُمُ الطَّيِّبَاتِ وَيُحَرِّمُ عَلَيْهِمُ الْـخَبَائِثَ».

‘‘সে (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তাদের জন্য সকল পবিত্র বস্ত্ত হালাল করে দেয় এবং সকল অপবিত্র ও খারাপ বস্ত্ত তাদের উপর হারাম করে দেয়’’।

(আ’রাফ : ১৫৭)

সুতরাং সকল পবিত্র বস্ত্ত হালাল এবং সকল অপবিত্র বস্ত্ত হারাম। আর হালাল ও হারাম নির্ধারণের অধিকার একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলারই। অতএব কেউ নিজের জন্য উক্ত অধিকার দাবি করলে অথবা সে অধিকার আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর জন্য রয়েছে বলে স্বীকার করলে সে কাফির ও মুশ্রিক হয়ে যাবে। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«أَمْ لَـهُمْ شُرَكَآءُ شَرَعُوْا لَـهُمْ مِّنَ الدِّيْنِ مَا لَـمْ يَأْذَنْ بِهِ اللهُ».

‘‘তাদের কি (আল্লাহ্ ভিন্ন) এমন কতেক শরীক বা দেবতা রয়েছে? যারা তাদের জন্য এমন কোন ধর্মীয় বিধান রচনা করেছে যার অনুমতি আল্লাহ্ তা‘আলা দেননি’’। (শূরা : ২১)

তেমনিভাবে কুর‘আন ও হাদীসের সঠিক জ্ঞান ছাড়া হালাল ও হারামের ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত দেয়া অথবা সে ব্যাপারে কোন আলোচনা করাও কারোর জন্য জায়িয নয়। বরং আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদে এ জাতীয় কর্মের বিশেষ নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَلَا تَقُوْلُوْا لِـمَا تَصِفُ أَلْسِنَتُكُمُ الْكَذِبَ هٰذَا حَلَالٌ وَّهٰذَا حَرَامٌ لِّتَفْتَرُوْا عَلَى اللهِ الْكَذِبَ إِنَّ الَّذِيْنَ يَفْتَرُوْنَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ لَا يُفْلِحُوْنَ».

‘‘তোমরা নিজেদের কথার উপর ভিত্তি করে মিথ্যা বলো না যে, এটি হালাল ও এটি হারাম। কারণ, তাতে আল্লাহ্ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করা হবে। নিশ্চয়ই যারা আল্লাহ্ তা‘আলার উপর মিথ্যারোপ করে তারা কখনোই সফলকাম হবে না’’।

(নাহ্ল : ১১৬)

আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের মাধ্যমে কিছু জিনিসকে হারাম করে দিয়েছেন। তেমনিভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও কিছু জিনিসকে হারাম করে দিয়েছেন তাঁর হাদীসের মাধ্যমে। যেমন:

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُوْا بِهِ شَيْئًا وَّبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا، وَلَا تَقْتُلُوْا أَوْلَادَكُمْ مِّنْ إِمْلَاقٍ، نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ، وَلَا تَقْرَبُوْا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ، وَلَا تَقْتُلُوْا النَّفْسَ الَّتِيْ حَرَّمَ اللهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ، ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُوْنَ، وَلَا تَقْرَبُوْا مَالَ الْيَتِيْمِ إِلاَّ بِالَّتِيْ هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ».

‘‘(হে মুহাম্মাদ!) তুমি সবাইকে বলো: আসো! তোমাদের প্রভু তোমাদের উপর যা যা হারাম করে দিয়েছেন তা তোমাদেরকে পড়ে শুনাবো। তা এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না, পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করবে, দরিদ্রতার ভয়ে নিজেদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না, কারণ, আমিই তোমাদেরকে ও তাদেরকে রিযিক দিচ্ছি, অশ্লীল কথা ও কাজের নিকটেও যেও না, চাই তা প্রকাশ্যই হোক অথবা গোপনীয়, আল্লাহ্ তা‘আলা যাকে হত্যা করতে নিষেধ করেছেন তাকে অবৈধভাবে হত্যা করো না, এ সব বিষয়ে আল্লাহ্ তা‘আলা তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা তা অনুধাবন করতে পারো। ইয়াতীমদের সম্পদের নিকটেও যেও না। তবে একান্ত সদুদ্দেশ্যে তা গ্রহণ করতে পারো যতক্ষণ না তারা বয়:প্রাপ্ত হয়’’। (আন‘আম : ১৫১-১৫২)

জাবির বিন্ আব্দুল্লাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِنَّ اللهَ حَرَّمَ بَيْعَ الْـخَمْرِ وَالْـمَيْتَةِ وَالْـخِنْزِيْرِ وَالْأَصْنَامِ.

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা হারাম করে দিয়েছেন মদ, মৃত পশু, শুকর ও মূর্তি বিক্রি’’। (আবূ দাউদ ৩৪৮৬)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন:

إِنَّ اللهَ إِذَا حَرَّمَ شَيْئًا حَرَّمَ ثَمَنَهُ.

‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা যখন কোন জিনিস হারাম করেন তখন উহার বিক্রি পয়সাও হারাম করে দেন’’। (দারাক্বুত্বনী ৩/৭; আবূ দাউদ ৩৪৮৮)

কখনো কখনো আল্লাহ্ তা‘আলা নির্দিষ্ট কোন বিষয়ের হারামসমূহ একত্রে বর্ণনা করেন। যেমন: তিনি খাদ্য সংক্রান্ত হারামসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

«حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْـمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَـحْمُ الْـخِنْزِيْرِ وَمَآ أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهٰوَالْـمُنْخَنِقَةُ وَالْـمَوْقُوْذَةُ وَالْـمُتَرَدِّيَةُ وَالنَّطِيْحَةُ وَمَآ أَكَلَ السَّبُعُ إِلَّا مَا ذَكَّيْتُمْ وَمَا ذُبِحَ عَلَى النُّصُبِ وَأَنْ تَسْتَقْسِمُوْا بِالْأَزْلَامِ ذٰلِكُمْ فِسْقٌ».

‘‘তোমাদের উপর হারাম করা হয়েছে মৃত পশু, (প্রবাহিত) রক্ত, শুকরের গোস্ত, আল্লাহ্ তা‘আলা ছাড়া অন্য কারোর নামে উৎসর্গীকৃত পশু, গলায় ফাঁস পড়ে তথা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মরা পশু, প্রহারে মৃত পশু, উপর থেকে পড়ে মরা পশু, শিংয়ের আঘাতে মরা ও হিংস্র জন্তুতে খাওয়া পশু। তবে এগুলোর কোনটিকে তোমরা মৃত্যুর পূর্বেই যবেহ করতে সক্ষম হলে তা অবশ্যই খেতে পারো। তোমাদের উপর আরো হারাম করা হয়েছে সে সকল পশু যা দেবীদের আস্তানায় যবেহ করা হয় এবং তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ণয় করাও তোমাদের উপর হারাম। এ সবগুলো পাপ কর্ম’’। (মা’য়িদাহ্ : ৩)

তেমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা বিবাহ্ সংক্রান্ত হারামসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন:

«حُرِّمَتْ عَلَيْكُمْ أُمَّهَاتُكُمْ وَبَنَاتُكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ وَعَمَّاتُكُمْ وَخَالَاتُكُمْ وَبَنَاتُ الْأَخِ وَبَنَاتُ الْأُخْتِ وَأُمَّهَاتُكُمْ اللاَّتِيْ أَرْضَعْنَكُمْ وَأَخَوَاتُكُمْ مِّنَ الرَّضَاعَةِ وَأُمَّهَاتُ نِسَائِكُمْ وَرَبَآئِبُكُمُ اللاَّتِيْ فِيْ حُجُوْرِكُمْ مِّنْ نِّسَآئِكُمُ اللاَّتِيْ دَخَلْتُمْ بِهِنَّ، فَإِنْ لَّمْ تَكُوْنُوْا دَخَلْتُمْ بِهِنَّ فَلَا جُنَاحَ عَلَيْكُمْ، وَحَلَآئِلُ أَبْنَآئِكُمْ الَّذِيْنَ مِنْ أَصْلَابِكُمْ، وَأَنْ تَجْمَعُوْا بَيْنَ الْأُخْتَيْنِ، إِلاَّ مَا قَدْ سَلَفَ، إِنَّ اللهَ كَانَ غَفُوْرًا رَّحِيْمًا، وَالْـمُحْصَنَاتُ مِنَ النِّسَآءِ».

‘‘তোমাদের উপর হারাম করে দেয়া হয়েছে তোমাদের মায়েদেরকে, মেয়েদেরকে, বোনদেরকে, ফুফুদেরকে, খালাদেরকে, ভাইয়ের মেয়েদেরকে, বোনের মেয়েদেরকে, সে মায়েদেরকে যারা তোমাদেরকে স্তন্য দান করেছেন, তোমাদের দুধবোনদেরকে, স্ত্রীদের মায়েদেরকে এবং সে মেয়েদেরকে যাদেরকে লালন-পালন তোমরাই করছো এবং যাদের মায়েদের সাথে তোমরা সহবাসে লিপ্ত হয়েছো, তবে যদি তোমরা তাদের মায়েদের সাথে সহবাস না করে থাকো তা হলে তাদের মেয়েদেরকে বিবাহ্ করতে কোন অসুবিধে নেই এবং তোমাদের ঔরসজাত সন্তানদের স্ত্রীদেরকেও হারাম করে দেয়া হয়েছে। তেমনিভাবে দু’ সহোদরা বোনকে একত্রে বিবাহ্ করাও হারাম। তবে ইতিপূর্বে যা ঘটে গিয়েছে তা আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা‘আলা ক্ষমাশীল করুণাময়। আরো হারাম করা হয়েছে তোমাদের উপর সধবা নারীগণ তথা অন্যের বিবাহিতা স্ত্রীদেরকে’’। (নিসা’ : ২৩-২৪)

তেমনিভাবে আল্লাহ্ তা‘আলা উপার্জন সংক্রান্ত হারামসমূহের বর্ণনায় বলেন:

«وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا».

‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা হালাল করেছেন ব্যবসা-বাণিজ্য এবং হারাম করেছেন সুদ’’। (বাক্বারাহ্ : ২৭৫)

ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহ্ তা‘আলা আমাদের জন্য খুব দয়া করে অসংখ্য অগণিত অনেক পবিত্র বস্ত্তকে হালাল করে দিয়েছেন এবং তা সামগ্রিকভাবে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«يَآ أَيُّهَا النَّاسُ كُلُوْا مِمَّا فِيْ الْأَرْضِ حَلَالًا طَيِّبًا».

‘‘হে মানব! পৃথিবীর অভ্যন্তরের সকল হালাল-পবিত্র বস্ত্ত তোমরা খাও’’। (বাক্বারাহ্ : ১৬৮)

সুতরাং দুনিয়ার যে কোন বস্ত্ত হালাল যতক্ষণ না হারামের কোন দলীল পাওয়া যায়। অতএব আমরা সবাই সদা সর্বদা তাঁরই আনুগত্য, প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবো।

উক্ত হালাল বস্ত্তসমূহ বেশি হওয়ার কারণেই আল্লাহ্ তা‘আলা তা
বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করেননি এবং হারাম বস্ত্তসমূহ তিনি বিস্তারিতভাবে এ কারণেই বর্ণনা করেছেন যে, সেগুলো অতীব সীমিত।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«وَمَا لَكُمْ أَلاَّ تَأْكُلُوْا مِمَّا ذُكِرَ اسْمُ اللهِ عَلَيْهِ، وَقَدْ فَصَّلَ لَكُمْ مَّا حَرَّمَ عَلَيْكُمْ إِلاَّ مَا اضْطُرِرْتُمْ إِلَيْهِ».

‘‘তোমাদের কি হয়েছে যে, তোমরা খাচ্ছো না সে পশুর গোস্ত যা যবাই করা হয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলার নাম নিয়ে। অথচ তিনি তোমাদের উপর যা কিছু হারাম করে দিয়েছেন তা সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। এমনকি তোমরা নিরুপায় অবস্থায় উক্ত হারাম বস্ত্তও খেতে পারো’’। (আন্‘আম : ১১৯)

ঈমানের দুর্বলতা ও ধর্মীয় জ্ঞানের স্বল্পতার কারণে যারা হারামের
বিস্তারিত বর্ণনা শুনলে মনে কষ্ট পান তারা কি এমন চান যে, আল্লাহ্ তা‘আলা যেন প্রতিটি হালাল বস্ত্ত বিস্তারিতভাবে আপনাদেরকে বলে দিক। তিনি বলুক যে, উট, গরু, ছাগল, হরিণ, মুরগি, কবুতর, হাঁস, পঙ্গপাল, মাছ সবই হালাল।

সকল ধরনের শাক-সবজি ও ফল-মূল হালাল।

পানি, দুধ, মধু, তেল ইত্যাদি সবই হালাল।

লবন, মসলা, কাঁচা মরিচ ইত্যাদি সবই হালাল।

প্রয়োজনে যে কোন কাজে কাঠ, লোহা, বালি, সিমেন্ট, কঙ্কর, প্লাস্টিক, কাঁচ, রবার ইত্যাদি সবই ব্যবহার করা জায়িয।

বাই সাইকেল, মোটর সাইকেল, গাড়ি, ট্রেন, নৌকা, উড়োজাহাজ ইত্যাদি সবগুলোতেই আরোহণ করা জায়িয।

এসি, ফ্রিজ, কাপড় ধোয়ার মেশিন, কোন কিছু পেষার মেশিন, কোন ফলের রস বের করার মেশিন ইত্যাদি সবই ব্যবহার করা জায়িয।

চিকিৎসা, প্রকৌশল, খনিজ ও হিসাব বিজ্ঞান, নির্মাণ, পানি বিশুদ্ধ করণ, নিষ্কাশন, মুদ্রণ ইত্যাদি সংক্রান্ত সকল আসবাবপত্রই ব্যবহার করা জায়িয।

সুতি, পলিস্টার, টেট্রন, নাইলন, পশম ইত্যাদি জাতীয় সকল পোশাক-পরিচ্ছদ পরা জায়িয।

মৌলিকভাবে যে কোন ব্যবসা-বাণিজ্য, ভাড়া, চাকুরি এবং যে কোন ধরনের পেশা অবলম্বন করা জায়িয। আরো কত্তো কী?

আপনার কি মনে হয় যে, কখনো কারোর পক্ষে এ জাতীয় সকল হালালের বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া সম্ভবপর হবে, না এ জাতীয় বর্ণনার আদৌ কোন প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তাদের আরেকটি কথা, ইসলাম একেবারেই সহজ। তাতে কোন কঠিনতা নেই। তাদের উক্ত কথা শুনতে খুবই সুমধুর। কিন্তু এতে তাদের উদ্দেশ্য একেবারেই ভালো নয়। তারা চায় সহজতার ছুতোয় সব কিছু একেবারেই হালাল করে নিতে। তা কখনোই ঠিক নয়। বরং আমাদের জানা উচিৎ যে, নিজস্ব গতিতে শরীয়ত একেবারেই সহজ। তবে তা কারোর রুচি নির্ভরশীল নয় এবং সাধারণভাবে শরীয়ত তো সহজই বটে। এরপরও শরীয়তের তুলনামূলক কঠিন বিধানগুলোকে প্রয়োজনের খাতিরে আরো সহজ করে দেয়া হয়। যেমন: সফরের সময় দু’ ওয়াক্ত নামায একত্রে পড়া, চার রাক্‘আত বিশিষ্ট নামাযকে দু’ রাক্‘আত করে পড়া এবং পরবর্তীতে আদায়ের শর্তে তখন রোযা না রাখার সুযোগও রয়েছে। তেমনিভাবে মুক্বীম (নিজ বাসস্থানে যিনি রয়েছেন) ও মুসাফির তথা ভ্রমণরত ব্যক্তির জন্য ২৪ ও ৭২ ঘন্টা মোজা মাস্হ করার বিধানও রয়েছে। পানি ব্যবহারে অক্ষম অথবা পানি না পাওয়ার সময় ওযুর পরিবর্তে তায়াম্মুমের ব্যবস্থাও রয়েছে। রোগাক্রান্ত ব্যক্তির জন্য এবং বৃষ্টি পড়ার সময় ফজরের নামায ছাড়া অন্য চার ওয়াক্ত নামায দু’ ওয়াক্ত করে একত্রে পড়া যায়। সত্যিকার বিবাহের নিয়্যাতে বেগানা মেয়েকে দেখা যায়। কসমের কাফ্ফারায় গোলাম আযাদ, খানা খাওয়ানো অথবা কাপড় পরানোর মধ্যে পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। এমনকি কঠিন মুহূর্তে মৃত পশু খাওয়াও জায়িয রাখা হয়েছে। আরো কত্তো কী?

বিশেষ কিছু জিনিসকে হারাম করার রহস্যসমূহের একটি এও যে, আল্লাহ্ তা‘আলা এরই মাধ্যমে তাঁর অনুগত ও অবাধ্যকে পৃথক করতে চান। সুতরাং ঈমানদারগণ আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টি ও সাওয়াবের আশায় বিধানগুলো পালন করে বলেই তাদের জন্য তা সহজ হয়ে যায়। আর মুনাফিকরা অসন্তুষ্ট চিত্তে বিধানগুলো পালন করে বিধায় তা তাদের জন্য অতি কঠিন।

একমাত্র আল্লাহ্ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য কেউ কোন হারাম পরিত্যাগ করলে সে তার অন্তরে বিশেষ এক ধরনের ঈমানের স্বাদ অনুভব করবে এবং আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে এরই পরিবর্তে আরেকটি ভালো জিনিস দান করবেন।

অনেকেই মনে করে থাকেন, গুনাহ্ করতেই থাকবো। আর সকাল-বিকাল ‘‘সুব্হানাল্লাহি ওয়া বিহাম্দিহী’’ ১০০ বার বলে দেবো। তখন সকল গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে অথবা এক বার হজ্জ করে ফেলবো তা হলে পূর্বের সকল গুনাহ্ মাফ হয়ে যাবে।

তাদেরকে আমরা জিজ্ঞাসা করবো, আপনি শুধু আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত ও দয়ার আয়াত এবং এ সংক্রান্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদীসগুলোই দেখছেন। কুর‘আন ও হাদীসে কি আল্লাহ্ তা‘আলার শাস্তির কোন উল্লেখ নেই? সুতরাং আপনি তাঁর শাস্তির ভয় না পেয়ে শুধু রহমতের আশা করছেন কেন?

কেউ কেউ মনে করেন যে, মানুষ গুনাহ্ করতে বাধ্য। সুতরাং গুনাহ্ করায় মানুষের কোন দোষ নেই। আমরা বলবো: মানুষ যদি গুনাহ্ করতেই বাধ্য হয় তা হলে আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুর‘আন ও হাদীসে গুনাহ্’র শাস্তির কথা উল্লেখ করলেনই বা কেন? আল্লাহ্ তা‘আলা কি (নাঊযু বিল্লাহ্) এতো বড় যালিম যে, কাউকে কোন কাজ করতে বাধ্য করবেন। আবার তাকে সে জন্য শাস্তিও দিবেন।

আপনি দয়া করে বাস্তবে একটুখানি পরীক্ষা করে দেখবেন কি? আপনার অন্তরে যখন কোন গুনাহ্’র ইচ্ছে জন্মে তখন আপনি উক্ত গুনাহ্ করার জন্য একটুও সামনে অগ্রসর হবেন না। তখন আপনি দেখবেন, কে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে কাজটি করিয়ে নেয়।

আপনি কি দেখছেন না যে, দুনিয়াতে এমনও কিছু লোক রয়েছেন যাঁরা গুনাহ্ না করেও শান্তিতে জীবন যাপন করছেন। সুতরাং আপনি একাই গুনাহ্ করতে বাধ্য হবেন কেন?

কেউ কেউ মনে করেন, গুনাহ্ করলে তো ঈমানের কোন ক্ষতি হয় না। কারণ, আমল ঈমানের কোন অংশ নয়। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? কারণ, জান্নাত তো একদিন না একদিন মিলবেই। তাদেরকে আমরা বলবো: আমল ঈমানের কোন অংশ না হয়ে থাকলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের শাখাসমূহ বর্ণনা করতে গিয়ে আমলের কথা কেনই বা উল্লেখ করলেন এবং আল্লাহ্ তা‘আলা ও তদীয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুর‘আন ও হাদীসে বান্দাহ্’র আমলের কারণেই ঈমান বাড়বে বলে অনেকগুলো প্রমাণ উল্লেখই বা করলেন কেন?

কেউ কেউ মনে করে থাকেন, আমরা যতই গুনাহ্ করি না কেন আমরা তো পীর-ফকির ও বুযুর্গদেরকে খুবই ভালোবাসি। সুতরাং তাদের ভালোবাসা আমাদেরকে বেড়া পার করিয়ে দিবে এবং তাদের উসিলায় দো‘আ করলে কাজ হয়ে যাবে। আমরা বলবো: সাহাবারা কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ভালোবাসতেন না? সুতরাং তাঁরা কেন এ আশায় গুনাহ্ করতে থাকেননি। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির কোন অভাব ছিলো কি?

কেউ কেউ মনে করে থাকেন, আমার বংশে অনেক আলিম ও বুযুর্গ রয়েছেন। সুতরাং তাঁরা আমাদেরকে সঙ্গে না নিয়ে জান্নাতে যাবেন না। আমরা বলবো: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবাদের সন্তান ও আত্মীয়-স্বজনরা এ আশায় কেন গুনাহ্ করতে থাকেননি। তাদের জ্ঞান-বুদ্ধির কোন অভাব ছিলো কি?

কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলার এমন কি প্রয়োজন রয়েছে যে, আমাকে শাস্তি দিবেন। সুতরাং তিনি দয়া করেই সে দিন আমাকে জান্নাত দিয়ে দিবেন। আমরা বলবো: কাউকে জান্নাত দেয়ারও আল্লাহ্ তা‘আলার কোন প্রয়োজন নেই। সুতরাং তিনি তাঁর সাথে মারাত্মক দোষ করা সত্ত্বেও কাউকে জান্নাত দিবেন কেন?

কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের সূরাহ যুহার ৫ নং আয়াতে বলেছেন: তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ততক্ষণ পর্যন্ত দিবেন যতক্ষণ না তিনি রাজি হন। সুতরাং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো রাজি হবেন না আমাদেরকে জাহান্নামে ছেড়ে জান্নাতে যেতে। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা যখন যালিম ও ফাসিকদেরকে শাস্তি দিতে রাজি তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন সে ব্যাপারে রাজি হবেন না? তিনি কি আল্লাহ্ তা‘আলার একান্ত বন্ধু নন? তিনি কি তখন আল্লাহ্ তা‘আলার পছন্দের বিরুদ্ধাচরণ করবেন?

কেউ কেউ মনে করেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আনের সূরাহ যুমারের ৫৩ নং আয়াতে বলেছেন: তিনি সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? আল্লাহ্ তা‘আলা তো সকল গুনাহ্ ক্ষমাই করে দিবেন। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা কি কুর‘আন মাজীদের সূরাহ নিসা’র ৪৮ নং আয়াতে বলেননি যে, তিনি শির্ক ক্ষমা করবেন না। এ ছাড়া অন্য গুনাহ্ ক্ষমা করতেও পারেন ইচ্ছে করলে। সুতরাং সকল প্রকারের গুনাহ্ ক্ষমা করার ব্যাপারটি একান্ত তাওবা ও আল্লাহ্ তা‘আলার ইচ্ছার উপরই নির্ভরশীল।

কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ ইন্ফিত্বারের ৬ নং আয়াতে মানুষকে উযর শিক্ষা দিয়েছেন যে, মানুষ আল্লাহ্ তা‘আলার দয়ার কারণেই ধোকা খাচ্ছে বা খাবে। সুতরাং আমরা সবাই কিয়ামতের দিন আল্লাহ্ তা‘আলার সামনে তাঁরই শেখানো উক্ত উযরই পেশ করবো। আমরা বলবো: আপনার উক্ত ধারণা একেবারেই মূর্খতা বশত। বরং মানুষ ধোকা খাবে বা খাচ্ছে শয়তান, কুপ্রবৃত্তি ও মূর্খতার কারণে; আল্লাহ্ তা‘আলার দয়ার নয়। কারণ, কেউ অত্যন্ত দয়াশীল হলে তাঁর সাথে ভালো ব্যবহারই করা উচিৎ। খারাপ ব্যবহার নয়।

কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা কুর‘আন মাজীদের সূরাহ লাইলের ১৫ ও ১৬ নং আয়াতে বলেছেন যে, জাহান্নামে দগ্ধ হবে সেই ব্যক্তি যে নিতান্ত হতভাগ্য। যে (আল্লাহ্, রাসূল ও কুর‘আন এর প্রতি) মিথ্যারোপ করে এবং মুখ ফিরিয়ে নেয়। আর আমরা তো এমন নই। সুতরাং আমরা জান্নাতেই যাবো যত গুনাহ্ই করি না কেন। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা এরপরই ১৭ নং আয়াতে বলেছেন: উক্ত লেলিহান জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে পরম সংযমী তথা চরম আল্লাহ্ভীরুরাই। সুতরাং গুনাহ্গাররা সাধারণত জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাবে না। কারণ, তারা পরম সংযমী তথা চরম আল্লাহ্ভীরু নয়।

কেউ কেউ বলে থাকেন, আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ বাক্বারাহ্’র ২৪ নং আয়াতে বলেন: জাহান্নাম প্রস্ত্তত করা হয়েছে কাফিরদের জন্য। সুতরাং আমরা তো মুসলিম। আমাদের জন্য তো জাহান্নাম নয়। আমরা বলবো: আল্লাহ্ তা‘আলা সূরাহ আ’লি ইমরানের ১৩৩ নং আয়াতে বলেছেন: জান্নাত তৈরি করা হয়েছে আল্লাহ্ভীরুদের জন্য। সুতরাং পাপীরা তো খুব সহজেই সেখানে ঢুকতে পারবে না। কারণ, তারা তো আল্লাহ্ভীরু নয়।

কেউ কেউ মনে করেন, গুনাহ্ করতেই থাকবো। এক বছরের গুনাহ্ মাফের জন্য একটি আশুরার রোযাই যথেষ্ট। আরো বাড়তি সাওয়াব বা স্পেশাল দয়ার জন্য তো আরাফার রোযাই যথেষ্ট। সুতরাং তাও রেখে দেবো। অতঃপর জান্নাতে যাওয়ার জন্য আর কিছুই করতে হবে না। আমরা বলবো: রামাযানের রোযা এবং পাঁচ ওয়াক্ত নামায তো ফরয। আর এগুলো কবীরা গুনাহ্ থেকে বাঁচার শর্তে সগীরা গুনাহ্গুলো শুধু ক্ষমা করতে পারে। সুতরাং উক্ত নফল রোযা কি এর চাইতেও আরো মর্যাদাশীল যে, সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবে।

কেউ কেউ বলে থাকেন: আল্লাহ্ তা‘আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি তাঁর বান্দাহ্’র ধারণা অনুযায়ীই তার সাথে ব্যবহার করে থাকেন। সুতরাং আমরা তাঁর সম্পর্কে এ ধারণা করি যে, আমরা যতই গুনাহ্ করি না কেন তিনি আমাদের সকল গুনাহ্ ক্ষমা করে দিবেন। সুতরাং গুনাহ্ করতে কি? আমরা বলবো: কেউ কারোর উপর তাঁর সাথে তার ব্যবহারের ধরন অনুযায়ীই ধারণা করে থাকে। যদি সে উক্ত ব্যক্তির সাথে সর্বদা ভালো ব্যবহার করে থাকে তখন সে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর সম্পর্কে এমন ধারণা করতে পারে যে, তিনি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন। আর যদি সে তাঁর সাথে সর্বদাই দুর্ব্যবহার করে থাকে তা হলে সে কখনোই তাঁর ব্যাপারে এমন ধারণা করবে না যে, তিনি তার সাথে ভালো ব্যবহার করবেন।

এ কারণেই হাসান বসরী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন:

إِنَّ الْـمُؤْمِنَ أَحْسَنَ الظَّنَّ بِرَبِّهِ فَأَحْسَنَ الْعَمَلَ، وَإِنَّ الْفَاجِرَ أَسَآءَ الظَّنَّ بِرَبِّهِ فَأَسَآءَ الْعَمَلَ.

‘‘নিশ্চয়ই মু’মিন ব্যক্তি নিজ প্রভু সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখে বলেই সর্বদা সে ভালো আমল করে। আর পাপী ব্যক্তি নিজ প্রভু সম্পর্কে খারাপ ধারণা করে বলেই সে সর্বদা খারাপ আমল করে’’।

বান্দাহ্ তো আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে এমন ধারণা করবে যে, সে ভালো আমল করলে আল্লাহ্ তা‘আলা তা বিনষ্ট করে দিবেন না। বরং তিনি তা কবুল করে নিবেন এবং তিনি তাকে দয়া করে জান্নাত দিয়ে দিবেন। তার উপর একটুখানিও যুলুম করবেন না।

একদা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আন্হা) এর নিকট ছয় অথবা সাতটি দিনার রেখে তাঁকে তা গরিবদের মাঝে বন্টন করতে বললেন। কিন্তু তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অসুখের কারণে তা করতে ভুলে গেলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুস্থ হয়ে তাঁকে সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি তা জানালেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন সে দিনারগুলো হাতে রেখে বললেন:

مَا ظَنُّ مُحَمَّدٍ بِرَبِّهِ لَوْ لَقِيَ اللهَ وَهَذِهِ عِنْدَهُ.

‘‘মুহাম্মাদের নিজ প্রভু সম্পর্কে কি ধারণা হতে পারে যদি সে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে সাক্ষাৎ করে অথচ তার নিকট এ দিনারগুলো রয়েছে’’।

(আহমাদ্ ৬/৮৬, ১৮২; ইব্নু হিববান ৬৮৬ ’হুমায়দী, হাদীস ২৮৩ ইব্নু সা’দ ২/২৩৮)

কেউ কেউ বলতে পারেন যে, আল্লাহ্ তা‘আলার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেও তাঁর রহমতের আশা করা যেতে পারে। কারণ, তাঁর রহমত অপার ও অপরিসীম। আমরা বলবো: আপনার কথা ঠিকই। কিন্তু তারই সাথে সাথে আপনাকে এ কথাও মনে রাখতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কখনো অপাত্রে দয়া করবেন না। কারণ, তিনি হিকমতওয়ালা এবং অত্যন্ত পরাক্রমশীল। যে দয়ার উপযুক্ত তাকেই দয়া করবেন। আর যে শাস্তি পাওয়ার উপযুক্ত তাকে তিনি অবশ্যই শাস্তি দিবেন। বরং সে ব্যক্তিই আল্লাহ্ তা‘আলা সম্পর্কে সুধারণা রাখতে পারে যে তাওবা করেছে, নিজ কৃতকর্মের উপর লজ্জিত হয়েছে, বাকি জীবন ভালো কাজে খরচ করবে বলে আল্লাহ্ তা‘আলার সাথে ওয়াদা করেছে।

আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:

«إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَالَّذِيْنَ هَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ، أُوْلٰٓئِكَ يَرْجُوْنَ رَحْمَةَ اللهِ».

‘‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা আল্লাহ্’র পথে জিহাদ ও হিজরত করেছে একমাত্র তারাই আল্লাহ্’র রহমতের আশা করতে পারে’’।

(বাক্বারাহ্ : ২১৮)

এ কথা সবারই মনে রাখতে হবে যে, একটি হচ্ছে আশা। আরেকটি হচ্ছে দুরাশা। কেউ কোন বস্ত্তর যৌক্তিক আশা করলে তাকে তিনটি কাজ করতে হয়। যা নিম্নরূপ:

ক. যে বস্ত্তর সে আশা করছে সে বস্ত্তটিকে খুব ভালোবাসতে হবে।

খ. সে বস্ত্তটি কোনভাবে হাত

ছাড়া হয়ে যায় কি না সে আশঙ্কা সদা সর্বদা মনে রেখে সে ব্যাপারে তাকে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।

গ. যথাসাধ্য উক্ত বস্ত্তটি হাসিলের প্রাণপণ চেষ্টা করতে হবে।

এর কোন একটি কারোর মধ্যে পাওয়া না গেলে তার আশা দুরাশা বৈ আর কি?

আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

مَنْ خَافَ أَدْلَجَ، وَمَنْ أَدْلَجَ بَلَغَ الْـمَنْزِلَ، أَلَا إِنَّ سِلْعَةَ اللهِ غَالِيَةٌ ؛ أَلَا إِنَّ سِلْعَةَ اللهِ الْـجَنَّةُ.

‘‘যার সময়মত গন্তব্যে পৌঁছার ভয় রয়েছে সে অবশ্যই প্রথম রাত্রে যাত্রা শুরু করবে। আর যে প্রথম রাত্রেই যাত্রা শুরু করলো সে অবশ্যই মঞ্জিলে (গন্তব্যে) পৌঁছুবে। তোমরা মনে রাখবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলার পণ্য খুবই দামি। আর আল্লাহ্ তা‘আলার পণ্য হচ্ছে জান্নাত’’।

(তিরমিযী ২৪৫০; হা’কিম ৪/৩০৭; ‘আব্দুব্নু ’হুমাইদ্ ১৪৬০)

সাহাবাদের জীবনী পড়ে দেখলে খুব সহজেই এ কথা বুঝে আসবে যে, আমাদের আশা সত্যিই দুরাশা যা কখনোই পূরণ হবার নয়। তাঁদের আশার পাশাপাশি ছিলো আল্লাহ্ তা‘আলার প্রতি অত্যন্ত ভয়।

একদা আবূ বকর (রাঃ) নিজকে উদ্দেশ্য করে বলেন:

وَدِدْتُ أَنِّيْ شَعْرَةٌ فِيْ جَنْبِ عَبْدٍ مُّؤْمِنٍ.

‘‘হায়! আমি যদি মু’মিন বান্দাহ্’র পার্শ্ব দেশের একটি লোম হতাম’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৮)

একদা তিনি নিজ জিহবাহ্ টেনে ধরে বলেন:

هَذَا الَّذِيْ أَوْرَدَنِيَ الْـمَوَارِدَ.

‘‘এটিই আমাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত করেছে’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৯)

তিনি বেশি বেশি কাঁদতেন এবং সবাইকে বলতেন:

اِبْكُوْا ؛ فَإِنْ لَمْ تَبْكُوْا فَتَبَاكُوْا.

‘‘কাঁদো; কাঁদতে না পারলে কাঁদার ভান করো’’। (আহমাদ/যুহ্দ, পৃষ্ঠা: ১০৮)

একদা ’উমর (রাঃ) সূরাহ ত্বূর পড়তে পড়তে যখন নিম্নোক্ত আয়াতে পৌঁছুলেন তখন কাঁদতে শুরু করলেন। এমনকি কাঁদতে কাঁদতে তিনি রুগ্ন হয়ে গেলেন এবং মানুষ তাঁর শুশ্রূষা করতে আসলো। আয়াতটি নিম্নরূপ:

«إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ لَوَاقِعٌ».

‘‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকের শাস্তি অবশ্যম্ভাবী’’। (ত্বূর : ৭)

বেশি কান্নার কারণে তাঁর চেহারায় কালো দু’টি দাগ পড়ে যায়। তাঁর মৃত্যুর সময় তিনি তাঁর ছেলেকে বললেন: আমার গন্ডদেশকে জমিনের সাথে লাগিয়ে দাও। তাতে হয়তো আল্লাহ্ তা‘আলা আমার উপর দয়া করবেন। আহ্! আল্লাহ্ তা‘আলা যদি আমাকে ক্ষমা না করেন। অতঃপর তিনি মৃত্যু বরণ করেন।

একদা ‘আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন: আপনার মাধ্যমেই দুনিয়ার অনেকগুলো শহর আবাদ হয়েছে এবং অনেকগুলো এলাকা বিজয় হয়েছে। আরো আরো। তখন তিনি বললেন: আমি শুধু জাহান্নাম থেকে মুক্তি চাই। না চাই কোন গুনাহ্ না চাই কোন পুণ্য।

’উস্মান (রাঃ) যে কোন কবরের পাশে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলতেন। এমন কি তাঁর সমস্ত দাড়ি কান্নার পানিতে ভিজে যেতো। তিনি বলতেন: আমাকে যদি জান্নাত ও জাহান্নামের মাঝে রাখা হয় এবং তখন আমি জানি না যে, আমাকে কোন দিকে যেতে বলা হবে। তখন আমি আমার গন্তব্য জানার আগেই চাবো ছাই হয়ে যেতে।

‘আলী (রাঃ) সর্বদা দু’টি বস্ত্তকে ভয় করতেন। দীর্ঘ আশা ও প্রবৃত্তির অনুসরণ। কারণ, দীর্ঘ আশা আখিরাতকে ভুলিয়ে দেয় এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ মানুষকে সত্য গ্রহণ থেকে দূরে রাখে।

তিনি আরো বলেন: দুনিয়া চলে যাচ্ছে, আখিরাত এগিয়ে আসছে এবং প্রত্যেকটিরই অনুগামী রয়েছে। সুতরাং তোমরা আখিরাতের অনুগামী হও। দুনিয়ার অনুগামী হয়ো না। কারণ, এখন কাজের সময়। হিসাব নেই। আর আখিরাতে হিসাব রয়েছে। কোন কাজ নেই।

আবুদ্দারদা’ (রাঃ) বলেন: আমি আখিরাতে যে ব্যাপারে ভয় পাচ্ছি তা হচ্ছে, আমাকে বলা হবে: হে আবুদ্দারদা’! তুমি অনেক কিছু জেনেছো। তবে সে মতে কতটুকু আমল করেছো?

তিনি আরো বলেন: মৃত্যুর পর তোমাদের কি হবে তা যদি তোমরা এখন জানতে পারতে তা হলে তোমরা খাদ্য-পানীয় গ্রহণ করতে পারতে না। এমনকি নিজ ঘরেও অবস্থান করতে পারতে না। বরং তোমরা খালি ময়দানে নেমে পড়তে, ভয়ে বুকে থাপড়াতে এবং শুধু কাঁদতেই থাকতে। তিনি আপসোস করে বলেন: আহ্! আমি যদি গাছ হতাম মানুষ আমাকে কেটে কাজে লাগাতো।

বেশি বেশি কান্না করার কারণে আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাসের উভয় চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে যায়।

আবূ যর (রাঃ) বলতেন: আহ্! আমি যদি গাছ হতাম মানুষ আমাকে কেটে কাজে লাগাতো। আহ্! আমি যদি জন্মই না নিতাম। একদা কেউ তাঁকে খরচ বাবত কিছু দিতে চাইলে তিনি বললেন: আমার নিকট একটি ছাগল আছে যার দুধ আমি পান করি। কয়েকটি গাধা আছে যার উপর চড়ে আমি এদিক ওদিক যেতে পারি। একটি আযাদ করা গোলাম আছে যে আমার খিদমত আঞ্জাম দেয় এবং গায়ে দেয়ার মতো একটি বাড়তি আলখাল্লাও রয়েছে। আমি এগুলোর ব্যাপারেই হিসাব-কিতাবের ভয় পাচ্ছি। আর বেশির আমার কোন প্রয়োজন নেই।

আবূ ’উবাইদাহ্ (রাঃ) বলেন: আহ্! আমি যদি একটি ভেড়া হতাম। আমার পরিবারবর্গ আমাকে যবেহ্ করে খেয়ে ফেলতো।

ইব্নু আবী মুলাইকাহ্ (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: আমি ত্রিশ জন সাহাবাকে এমন পেলাম যে, তাঁরা নিজের ব্যাপারে মুনাফিকির ভয় পেতো।

কেউ কেউ আল্লাহ্ তা‘আলার অবাধ্য হওয়ার পরও শান্তিতে জীবন যাপন করছে বিধায় এমন মনে করে থাকেন যে, যখন আল্লাহ্ তা‘আলা আমাকে এখানে শান্তিতে রাখছেন তখন তিনি পরকালেও আমাকে শান্তিতে রাখবেন। সুতরাং পরকাল নিয়ে চিন্তা করার এমন কি রয়েছে? মূলতঃ উক্ত চিন্তা-চেতনা একেবারেই ভুল।

’উক্ববাহ্ বিন্ ‘আমির (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِذَا رَأَيْتَ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُعْطِيْ الْعَبْدَ مِنَ الدُّنْيَا عَلَى مَعَاصِيْهِ مَا يُحِبُّ، فَإِنَّمَا هُوَ اسْتِدْرَاجٌ، ثُمَّ تَلَا قَوْلَهُ عَزَّ وَجَلَّ: «فَلَمَّا نَسُوْا مَا ذُكِّرُوْا بِهٰفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ أَبْوَابَ كُلِّ شَيْءٍ حَتّٰى إِذَا فَرِحُوْا بِمَآ أُوْتُوْآ أَخَذْنٰهُمْ بَغْتَةً فَإِذَا هُمْ مُّبْلِسُوْنَ».

‘‘তুমি যখন দেখবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা কোন বান্দাহ্কে তাঁর অবাধ্যতা সত্ত্বেও পার্থিব সম্পদ হতে সে যা চায় তাই দিচ্ছেন তা হলে এ কথা মনে করতে হবে যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তাকে ঢিল দিচ্ছেন। তিনি দেখছেন যে, সে এভাবে কতদূর যেতে পারে। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উক্ত আয়াত তিলাওয়াত করেন যার মর্মার্থ এই যে, আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: অতঃপর যখন তারা সকল নসীহত (অবহেলা বশত) ভুলে গেলো তখন আমি তাদের জন্য (রহমত ও নি’য়ামতের) সকল দরোজা খুলে দিলাম। পরিশেষে যখন তারা সেগুলো নিয়ে উল্লাসে মেতে উঠলো তখন আমি হঠাৎ তাদেরকে পাকড়াও করলাম। তখন তারা একেবারেই নিরাশ হয়ে পড়লো’’। (আন্‘আম : ৪৪) (আহমাদ্ ৪/১৪৫; ত্বাবারানী/কাবীর ৯১৩)

আল্লাহ্ তা‘আলা আরো বলেন:

«فَأَمَّا الْإِنْسَانُ إِذَا مَا ابْتَلَاهُ رَبُّهُ فَأَكْرَمَهُ وَنَعَّمَهُ، فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَكْرَمَنِ، وَأَمَّا إِذَا مَا ابْتَلَاهُ فَقَدَرَ عَلَيْهِ رِزْقَهُ، فَيَقُوْلُ رَبِّيْ أَهَانَنِ، كَلَّا».

‘‘মানুষ তো এমন যে, যখন তাকে পরীক্ষামূলক সম্মান ও সুখ-সম্পদ দেয়া হয় তখন সে বলে: আমার প্রভু আমাকে সম্মান করেছেন। আর যদি তাকে পরীক্ষামূলক রিযিকের সঙ্কটে ফেলা হয় তখন সে বলে: আমার প্রভু আমাকে অসম্মান করেছেন। আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন: না, কখনো ব্যাপারটি এমন নয়’’। (ফজর : ১৫-১৭)

কেউ কেউ মনে করেন, দুনিয়া নগদ আর আখিরাত বাকি। সুতরাং নগদ ছেড়ে বাকির চিন্তা করতে যাবো কেন? আমরা বলবো: বাকি থেকে নগদ ভালো তখন যখন নগদ ও বাকি লাভের দিক দিয়ে সমান। কিন্তু যখন বাকি নগদ চাইতে অনেক অনেক গুণ ভালো প্রমাণিত হয় তখন সত্যিকারার্থে নগদ চাইতে বাকিই বেশি ভালো। আর এ কথা সকল মু’মিন ব্যক্তি জানে যে, আখিরাত দুনিয়ার চাইতে অনেক অনেকগুণ ভালো এবং চিরস্থায়ী। সুতরাং আখিরাতের উপর দুনিয়াকে অগ্রাধিকার দেয়া বোকামি বৈ কি?

মুস্তাউরিদ্ (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

وَاللهِ مَا الدُّنْيَا فِيْ الْآخِرَةِ إِلاَّ مِثْلُ مَا يَجْعَلُ أَحَدُكُمْ إِصْبَعَهُ هَذِهِ فِيْ الْيَمِّ فَلْيَنْظُرْ بِمَ تَرْجِعُ ؟!

‘‘আল্লাহ্’র কসম! আখিরাতের তুলনায় দুনিয়া এমন যে, কেউ তার (তর্জনী) অঙ্গুলি সাগরে রাখলো। অতঃপর সে অঙ্গুলির সাথে যে পানিটুকু উঠে আসলো তার তুলনা যেমন পুরো সাগরের সাথে’’।

(মুসলিম ২৮৫৮; তিরমিযী ২৩২৩ আহমাদ্ ১/২২৯, ২৩০; ইব্নু মাজাহ্ ৪১৮৩)

এ যদি হয় দুনিয়ার তুলনা আখিরাতের সাথে তা হলে এক জন মানব জীবনের তুলনা আখিরাতের সাথে কতটুকু হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে না।

আবার কেউ কেউ মনে করেন, দুনিয়া হচ্ছে নিশ্চিত আর আখিরাত হচ্ছে অনিশ্চিত। সুতরাং নিশ্চিত রেখে অনিশ্চিতের পেছনে পড়বো কেন? আমরা বলবো: আপনি কি সত্যিই আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী, না কি নন? আপনি যদি আখিরাতকে সত্যিই বিশ্বাস করে থাকেন তা হলে এ জাতীয় কথাই আপনার মুখ থেকে বেরুতে পারে না। আর যদি আপনি আখিরাতের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাসী না হয়েই থাকেন তা হলে আপনার ঈমানকে প্রথমে শুদ্ধ করে নিন। অতঃপর জান্নাত অথবা জাহান্নামের কথা ভাবুন।

মুসলিম বলতেই সবারই এ কথা জানা উচিৎ যে, বিষ যেমন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর তেমনিভাবে গুনাহ্ও অন্তরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে তাতে ক্ষতির তারতম্য অবশ্যই রয়েছে। এমনকি দুনিয়া ও আখিরাতে যত অকল্যাণ অথবা ব্যাধি রয়েছে তার মূলে রয়েছে গুনাহ্ ও পাপাচার।

এরই কারণেই আদম ও হাউওয়া’ বা হাওয়া (আলাইহিমাস্ সালাম) একদা জান্নাত থেকে বের হতে বাধ্য হন।

এরই কারণে শয়তান ইব্লীস আল্লাহ্ তা‘আলার রহমত থেকে চিরতরে বঞ্চিত হয়।

এরই কারণে নূহ্ (আঃ) এর যুগে বিশ্বব্যাপী মহা প্লাবন দেখা দেয় এবং কিছু সংখ্যক ব্যক্তি ও বস্ত্ত ছাড়া সবই ধ্বংস হয়ে যায়।

এরই কারণে ’হূদ্ (আঃ) এর যুগে ধ্বংসাত্মক বায়ু প্রবাহিত হয় এবং সব কিছুই ধ্বংস হয়ে যায়।

এরই কারণে সা’লিহ্ (আঃ) এর যুগে ভয়ঙ্কর চিৎকার শুনে সবাই হৃদয় ফেটে অথবা হৃদয় ছিঁড়ে মারা যায়।

এরই কারণে লুত্ব (আঃ) এর যুগে তাঁরই আবাসভূমিকে উল্টিয়ে তাতে পাথর নিক্ষেপ করা হয় এবং শুধু একজন ছাড়া তাঁর পরিবারের সকলকেই রক্ষা করা হয়। আর অন্যরা সবাই দুনিয়া থেকে একেবারেই নির্মূল হয়ে যায়।

এরই কারণে শু‘আইব (আঃ) এর যুগে আকাশ থেকে আগুন বর্ষিত হয়।

এরই কারণে ফির‘আউন ও তার বংশধররা লোহিত সাগরে ডুবে মারা যায়।

এরই কারণে ক্বারূন তার ঘর, সম্পদ ও পরিবারসহ ভূমিতে ধসে যায়।

এরই কারণে আল্লাহ্ তা‘আলা বনী ইস্রাঈল তথা ইহুদিদের উপর এমন শত্রু পাঠিয়ে দেন যারা তাদের এলাকায় ঢুকে তাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেয়, তাদের পুরুষদেরকে হত্যা করে, তাদের মহিলা ও বাচ্চাদেরকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের সকল সম্পদ লুটে নেয়। এভাবে একবার নয়। বরং দু’ দু’ বার ঘটে। পরিশেষে আল্লাহ্ তা‘আলা তাদের সম্পর্কে কসম করে বলেন:

«وَإِذْ تَأَذَّنَ رَبُّكَ لَيَبْعَثَنَّ عَلَيْهِمْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ مَنْ يَّسُوْمُهُمْ سُوْءَ الْعَذَابِ».

‘‘(হে নবী!) তুমি স্মরণ করো সে সময়ের কথা যখন তোমার প্রভু ঘোষণা করলেন, তিনি অবশ্যই কিয়ামত পর্যন্ত ইহুদিদের প্রতি এমন লোক পাঠাবেন যারা ওদেরকে কঠিন শাস্তি দিতে থাকবে’’। (আ’রাফ : ১৬৭)

ইব্নু ‘আববাস্ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) গুনাহ্’র অপকার সম্পর্কে বলেন: হে গুনাহ্গার! তুমি গুনাহ্’র কঠিন পরিণাম থেকে নিশ্চিন্ত হয়ো না। তেমনিভাবে গুনাহ্’র সঙ্গে যা সংশ্লিষ্ট তার ভয়াবহতা থেকেও। গুনাহ্’র চাইতেও মারাত্মক এই যে, তুমি গুনাহ্’র সময় ডানে-বামের লেখক ফিরিশ্তাদের লজ্জা পাচ্ছো না। তুমি গুনাহ্ করে এখনো হাসছো অথচ তুমি জানো না যে, আল্লাহ্ তা‘আলা তোমার সাথে কিয়ামতের দিন কি ব্যবহার করবেন। তুমি গুনাহ্ করতে পেরে খুশি হচ্ছো। গুনাহ্ না করতে পেরে ব্যথিত হচ্ছো। গুনাহ্’র সময় বাতাস তোমার ঘরের দরোজা খুলে ফেললে মানুষ দেখে ফেলবে বলে ভয় পাচ্ছো অথচ আল্লাহ্ তা‘আলা যে তোমাকে দেখছেন তা ভয় করছো না। তুমি কি জানো আইয়ূব (আঃ) কি দোষ করেছেন যার দরুন আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে কঠিন রোগে আক্রান্ত করেন এবং তাঁর সকল সম্পদ ধ্বংস হয়ে যায়। তাঁর দোষ এতটুকুই ছিলো যে, একদা এক মযলুম তথা অত্যাচারিত ব্যক্তি যালিমের বিরুদ্ধে তাঁর সহযোগিতা চেয়েছিলো। তখন তিনি তার সহযোগিতা করেননি এবং অত্যাচারীর অত্যাচার তিনি প্রতিহত করেননি। তাই আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁকে উক্ত শাস্তি দিয়েছেন।

এ কারণেই ইমাম আওযায়ী (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: গুনাহ্ যে ছোট তা দেখো না বরং কার শানে তুমি গুনাহ্ করছো তাই ভেবে দেখো।

ফুযাইল বিন্ ’ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ্) বলেন: তুমি গুনাহ্কে যতই ছোট মনে করবে আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট তা ততই বড় হয়ে দেখা দিবে। আর যতই তুমি তা বড় মনে করবে ততই তা আল্লাহ্ তা‘আলার নিকট ছোট হয়ে দেখা দিবে।

কখনো কখনো গুনাহ্’র প্রতিক্রিয়া দ্রুত দেখা যায় না। তখন গুনাহ্গার মনে করে থাকে যে, এর প্রতিক্রিয়া আর দেখা যাবে না। তখন সে উক্ত গুনাহ্’র কথা একেবারেই ভুলে যায়। অথচ এটি একটি মারাত্মক ভুল চিন্তা-চেতনা।

আবুদ্দারদা’ (রাঃ) বলেন: তোমরা আল্লাহ্ তা‘আলার ইবাদত এমনভাবে করো যে, তোমরা তাঁকে দেখতে পাচ্ছো। নিজকে সর্বদা মৃত বলে মনে করো। এ কথা সর্বদা মনে রাখবে যে, যথেষ্ট পরিমাণ স্বল্প সম্পদ অনেক ভালো এমন বেশি সম্পদ থেকে যা মানুষকে বেপরোয়া করে তোলে। নেকী কখনো পুরাতন হয় না এবং গুনাহ্ কখনো ভুলা যায় না। বরং উহার প্রতিক্রিয়া অনিবার্য।

জনৈক বুযুর্গ ব্যক্তি একদা এক অল্প বয়স্ক ছেলের প্রতি দৃষ্টিপাত করে তার সৌন্দর্য সম্পর্কে ভাবতেছিলেন। তখন তাকে স্বপ্নে বলা হলো যে, তুমি এর পরিণতি চল্লিশ বছর পরও দেখতে পাবে।

১. গুনাহ্গার ব্যক্তি ধর্মীয় জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ধর্মীয় জ্ঞান হচ্ছে নূর বা আলো যা আল্লাহ্ তা‘আলা তাঁর ইচ্ছানুযায়ী যে কারোর অন্তরে ঢেলে দেন। আর গুনাহ্ সে নূরকে নিভিয়ে দেয়।

২. গুনাহ্গার ব্যক্তি গুনাহ্’র কারণে রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়।

সাওবান (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:

إِنَّ الرَّجُلَ لَيُحْرَمُ الرِّزْقَ بِالذَّنْبِ يُصِيْبُهُ.

‘‘নিশ্চয়ই কোন ব্যক্তি গুনাহ্’র কারণেই রিযিক থেকে বঞ্চিত হয়’’।

(হা’কিম ১৮১৪, ৬০৩৮; আহমাদ ২২৪৪০, ২২৪৬৬, ২২৪৯১; আবূ ইয়া’লা ২৮২; ইব্নু মাজাহ্ ৮৯, ৪০৯৪)

ঠিক এরই বিপরীতে আল্লাহ্ভীরুতাই রিযিক বর্ধনের কারণ হয়। সুতরাং রিযিক পেতে হলে গুনাহ্ অবশ্যই ছাড়তে হবে। উল্লেখ্য যে, কারো কারোর নিকটে উক্ত হাদীস শুদ্ধ নয়।

গুনাহ্গারের অন্তরে এক ধরনের বিক্ষিপ্ত ভাব সৃষ্টি

৩. গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের অন্তরে এক ধরনের বিক্ষিপ্ত ভাব সৃষ্টি হয়। যার দরুন আল্লাহ্ তা‘আলা ও তার অন্তরের মাঝে এমন এক দূরত্ব জন্ম নেয় যার ক্ষতিপূরণ আল্লাহ্ তা‘আলা না চায় তো কখনোই সম্ভব নয়।

সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নেককার লোকদের মাঝে ও গুনাহ্গারের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি

৪. গুনাহ্’র কারণে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে নেককার লোকদের মাঝে ও গুনাহ্গারের মাঝে বিরাট এক দূরত্ব জন্ম নেয়। যার দরুন সে কখনো তাদের নিকটবর্তী হতে চায় না। বরং সর্বদা সে শয়তান প্রকৃতির লোকদের সাথেই উঠা-বসা করা পছন্দ করে। কখনো এ দূরত্ব এমন পর্যায়ে পৌঁছোয় যে, তার স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন কিছুই তার ভালো লাগে না। বরং পরিশেষে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে, ধীরে ধীরে নিজের উপরও তার এক ধরনের বিরক্তি ভাব জন্ম নেয়। যার পরিণতি কখনোই কারোর জন্য সুখকর নয়।

তাই তো কোন এক বুযুর্গ বলেছিলেন: আমি যখন গুনাহ্ করি তখন এর প্রতিক্রিয়া আমার আরোহণ এমনকি আমার স্ত্রীর মধ্যেও দেখতে পাই।

৫. গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের সকল কাজকর্ম তার জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ঠিক এরই বিপরীতে কেউ আল্লাহ্ তা‘আলাকে সত্যিকারার্থে ভয় করলে আল্লাহ্ তা‘আলা তার সকল কাজ সহজ করে দেন।

অন্তর ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে

৬. সত্যিকারার্থেই গুনাহ্’র কারণে গুনাহ্গারের অন্তর ধীরে ধীরে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। কারণ, আল্লাহ্ তা‘আলার আনুগত্য হচ্ছে এক ধরনের নূর। আর গুনাহ্ হচ্ছে এক ধরনের অন্ধকার। উক্ত অন্ধকার যতই বাড়বে তার অস্থিরতাও ততই বাড়বে। তখন সে বিদ্‘আত, শির্ক, কুফর সবই করে ফেলবে অথচ সে তা একটুও টের পাবে না। কখনো কখনো উক্ত অন্ধকার তার চোখেও ছড়িয়ে পড়ে। তখন তা কালো হতে থাকে এবং তার চেহারাও।

এ কারণেই আব্দুল্লাহ্ বিন্ ‘আববাস্ (রা.) বলেন: কোন নেক কাজ করলে চেহারায় উজ্জলতা ফুটে উঠে। অন্তরে আলো জন্ম নেয়। রিযিকে সচ্ছলতা, শরীরে শক্তি ও মানুষের ভালোবাসা অর্জন করা যায়। আর গুনাহ্ করলে চেহারা কালো, অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। রিযিকে ঘাটতি আসে এবং মানুষের অন্তরে তার প্রতি এক ধরনের বিদ্বেষভাব জন্ম নেয়।

দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৩০১ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 · · · 28 29 30 31 পরের পাতা »