আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি
আল-ফিকহুল আকবর ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৫৭ টি
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র ইউনুস ইবন আব্দুল আ’লা বলেন

ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র ইউনুস ইবন আব্দুল আ’লা বলেন:


سمعت أبا عبد الله الشافعي يقول- وقد سئل عن صفات الله تعالى وما يؤمن به - فقال: لله أسماء وصفات جاء بها كتابه، وأخبر بها نبيه ﷺ أمته، لا يسع أحدا قامت عليه الحجة ردها، لان القرآن نزل بها، وصح عن رسول الله ﷺ القول بها، فإن خالف ذلك بعد ثبوت الحجة عليه، فهو كافر، فأما قبل ثبوت الحجة، فمعذور بالجهل، لأن علم ذلك لا يدرك بالعقل، ولا بالروية والفكر، ولا نكفر بالجهل بها أحدا إلا بعد انتهاء الخبر إليه بها، ونثبت هذه الصفات، وننفي عنها التشبيه، كما نفاه عن نفسه، فقال: (ليس كمثله شئ وهو السميع البصير).


‘‘আবূ আব্দুল্লাহ শাফিয়ীকে মহান আল্লাহর বিশেষণ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলো। তখন তিনি বললেন: আল্লাহর নামসমূহ এবং বিশেষণসমূহ রয়েছে। কুরআনে সেগুলির উল্লেখ রয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) উম্মাতকে তা জানিয়েছেন। যার কাছে তা প্রমাণিত হয়েছে তার জন্য তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কারণ কুরআনে তা অবতীর্ণ হয়েছে এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এগুলি বলেছেন। যদি কেউ তার কাছে বিষয়গুলো প্রমাণিত হওয়ার পরেও বিরোধিতা করে তবে সে ব্যক্তি কাফির। তবে যদি কেউ তা তার নিকট প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে বিরোধিতা করে তবে সে ব্যক্তি অজ্ঞতার কারণে ওজর-অব্যাহতির যোগ্য (excusable, forgivable)। কারণ এ বিষয়ক জ্ঞান মানবীয় বুদ্ধি-বিবেক, যুক্তি, গবেষণা ও চিন্তাভাবনার মাধ্যমে অর্জন করা যায় না। কাজেই কারো নিকট এ বিষয়ক কুরআন-হাদীসের সংবাদ পৌঁছানোর আগে এ বিষয়ক অজ্ঞতার কারণে আমরা কাউকে কাফির বলে গণ্য করি না। আমরা এ সকল বিশেষণ প্রমাণ ও বিশ্বাস করি এবং এগুলি থেকে তুলনা বাতিল ও অস্বীকার করি। কারণ মহান আল্লাহ নিজেই নিজের তুলনীয় হওয়ার বিষয়টি বাতিল করে বলেছেন[1]: ‘‘কোনো কিছুই তাঁর সাথে তুলনীয় নয়; তিনি সর্বশ্রোতা সর্বদ্রষ্টা’’।[2]

[1] সূরা (৪২) শূরা: ১১ আয়াত।

[2] যাহাবী, সিয়ারু আলামিন নুবালা, ১০/৭৯-৮০; ইবনু কুদামা, যাম্মুত তাবীল, পৃষ্ঠা ২৩।
ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র আবূ সাওর বলেন

ইমাম শাফিয়ীর অন্য ছাত্র আবূ সাওর বলেন, ইমাম শাফিয়ী বলেন:


القول في السُّنّة التي وردت وأنا عليها، ورأيتُ أصحابنا عليها أهل الحديث الذين رأيتُهم وأخذتُ عنهم ـ مثل: سفيان الثّوريّ ومالك وغيرهما ـ : الإقرار بشهادة أن لا إله إلا الله وأنّ محمّدًا رسول الله، وأنّ الله ـ تعالى ـ على عرشه في سمائه، يقرب من خلقه كيف شاء، وأنّ الله تعالى ينزل إلى السّماء الدُّنيا كيف شاء.


‘‘সুফিয়ান সাওরী, মালিক ও অন্যান্য যে সকল মুহাদ্দিসকে আমরা দেখেছি এবং তাঁদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি, আমাদের সে সব সাথী এবং আমি যে সুন্নাত আকীদার উপর রয়েছি তা হলো এরূপ সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, এবং মুহাম্মাদ (ﷺ) আল্লাহর রাসূল, এবং মহান আল্লাহ তাঁর আরশের উপরে তাঁর আসমানের ঊর্ধ্বে, তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে বান্দার নিকটবর্তী হন এবং তিনি যেভাবে ইচ্ছা করেন সেভাবে প্রথম আসমানে অবতরণ করেন।’’[1]

[1] যাহাবী, আল-উলুওউ লিল-আলিয়্যিল গাফ্ফার, পৃষ্ঠা ২০৫; হিশাম আব্দুল কাদির, মুখতাসারু মাআরিজিল কুবুল, পৃষ্ঠা ২৬৬।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের মূলনীতি ও আকীদা ব্যাখ্যা করে তাঁর ছাত্র আবূ বাকর খাল্লাল বলেন

মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ে ইমাম আহমদ ইবন হাম্বালের মূলনীতি ও আকীদা ব্যাখ্যা করে তাঁর ছাত্র আবূ বাকর খাল্লাল বলেন:


ومذهب .. أحمد بن حنبل.. أن لله عز وجل وجها لا كالصور المصورة والأعيان المخططة بل وجهه وصفه ....وليس معنى وجه معنى جسد عنده ولا صورة ولا تخطيط ومن قال ذلك فقد ابتدع. وكان يقول إن لله تعالى يدان وهما صفة له في ذاته ليستا بجارحتين وليستا بمركبتين ولا جسم ولا جنس من الأجسام ولا من جنس المحدود والتركيب والأبعاض والجوارح ولا يقاس على ذلك لا مرفق ولا عضد ولا فيما يقتضي ذلك من إطلاق قولهم يد إلا ما نطق القرآن به أو صحت عن رسول الله صلى الله عليه وسلم السنة فيه ... وذهب أحمد بن حنبل رضي الله عنه إلى أن الله عز وجل يغضب ويرضى وأن له غضب ورضى ... والغضب والرضى صفتان له من صفات نفسه لم يزل الله تعالى غاضبا على ما سبق في علمه أنه يكون ممن يعصيه ولم يزل راضيا على ما سبق في علمه أنه يكون مما يرضيه. وأنكر على من يقول بالجسم وقال إن الأسماء مأخوذة بالشريعة واللغة وأهل اللغة وضعوا هذا الأسم على كل ذي طول وعرض وسمك وتركيب وصورة وتأليف والله تعالى خارج عن ذلك كله فلم يجز أن يسمى جسما لخروجه عن معنى الجسمية ولم يجئ في الشريعة ذلك فبطل


‘‘আহমদ ইবন হাম্বালের মাযহাব এই যে, মহান আল্লাহর একটি ‘ওয়াজহ’ বা মুখমণ্ডল আছে। তাঁর মুখমণ্ডল প্রতিচ্ছবি বা আকৃতি নয় এবং আঁকানো বস্ত্তর মতও নয়। বরং মুখমণ্ডল তাঁর একটি মহান বিশেষণ। ... তাঁর মতে মুখমণ্ডল অর্থ দেহ, ছবি বা আকৃতি নয়। যদি কেউ তা বলে তাহলে সে বিদআতী। তিনি বলতেন: মহান আল্লাহর দুটি হস্ত বিদ্যমান। এদুটি তাঁর সত্ত্বার বিশেষণ। হস্তদ্বয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নয়, দেহের অংশ নয়, দেহ নয়, দেহ জাতীয় কিছু নয়, সীমা, সংযোজন, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ জাতীয় কিছুই নয়। এ বিষয়ে কিয়াস-যুক্তি অচল। এতে কনুই, বাহু ইত্যাদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব কল্পনার সুযোগ নেই। কুরআন ও হাদীসে যতটুকু বলা হয়েছে তার অতিরিক্ত মানুষের ব্যবহার থেকে কিছু সংযোজন করা যাবে না। .... আহমদ (রাহ) বলতেন, আল্লাহ ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন। তাঁর ক্রোধ এবং সন্তুষ্টি আছে। ... তাঁর ক্রোধ ও সন্তুষ্টি তাঁর সত্তার বিশেষণগুলির মধ্যে দুটি বিশেষণ। তিনি অনাদিকাল থেকে তাঁর অনাদি-অনন্ত জ্ঞানে যাদেরকে অবাধ্য বলে জানেন তাদের প্রতি ক্রোধান্বিত রয়েছেন এবং তাঁর অনাদি অনন্ত জ্ঞানে যাদেরকে অনুগত বলে জানেন তাদের প্রতি তিনি সন্তুষ্ট রয়েছেন। মহান আল্লাহকে যারা দেহবিশিষ্ট বলে দাবি করেন তিনি তাদের কথা অস্বীকার ও প্রতিবাদ করেন। কারণ নাম তো শরীয়াহ এবং ভাষার ব্যবহার থেকে গ্রহণ করতে হবে। ভাষার ব্যবহারে দেহ বলতে গন্ডি, সীমা, দৈর্ঘ, প্রস্থ, গভীরতা, অংশ, আকৃতি ও সংযোজন ইত্যাদির সমাহার বুঝানো হয়। মহান আল্লাহ এর সবকিছুর ঊর্ধ্বে। শরীয়াতেও মহান আল্লাহকে এ বিশেষণে বিশেষিত করা হয় নি। কাজেই মহান আল্লাহর দেহ আছে বা তিনি দেহবিশিষ্ট এরূপ কথা বাতিল।’’[1]

[1] আহমদ ইবনু হাম্বাল, আল-আকীদাহ, আবূ বাকর খাল্লালের বর্ণনা, পৃষ্ঠা ১০২-১১১।

ইমাম আহমদের পুত্র হাম্বাল বলেন:


سألت أبا عبدالله عن الأحاديث التي تروى: "إن الله تبارك وتعالى ينزل كل ليلة إلى السماء الدنيا"، و "أن الله يُرى"، و "إن الله يضع قدمه"، وما أشبهه؟ فقال أبو عبدالله: نؤمن بها ونصدق بها، ولا كيف ولا معنى


‘‘বিভিন্ন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, মহান আল্লাহ প্রত্যেক রাতে নিকটবর্তী আসমানে অবতরণ করেন, মহান আল্লাহকে দেখা যাবে, মহান আল্লাহ তাঁর পদ স্থাপন করেন, ইত্যাদি। এ ধরনের হাদীসগুলো সম্পর্কে আমি আমার পিতাকে প্রশ্ন করলাম। তিনি বলেন: আমরা এগুলো বিশ্বাস করি, সত্য বলে গ্রহণ করি, কোনো ‘কিভাবে’ নেই এবং কোনো অর্থ নেই (স্বরূপ সন্ধান বা অর্থ সন্ধান ব্যতিরেকে)।’’[1]

এ প্রসঙ্গে ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। একটি সহীহ হাদীসে রাসূলূল্লাহ ﷺ কিয়ামত দিবসের বর্ণনায় বিভিন্নভাবে মহান আল্লাহর দর্শন, জাহান্নামে তাঁর পদ স্থাপনের ফলে জাহান্নামের সংকুচিত হওয়া ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করেছেন। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন:


وقد روي عن النبي ﷺ روايات كثيرة مثل هذا ما يذكر فيه أمر الرؤية... وذكر القدم وما أشبه هذه الأشياء والمذهب في هذا عند أهل العلم من الأئمة مثل سفيان الثوري ومالك بن أنس وابن المبارك وابن عيينة ووكيع وغيرهم أنهم رووا هذه الأشياء ثم قالوا تروى هذه الأحاديث ونؤمن بها ولا يقال كيف؟ وهذا الذي اختاره أهل الحديث أن تروى هذه الأشياء كما جاءت ويؤمن بها ولا تفسر ولا تتوهم ولا يقال كيف وهذا أمر أهل العلم الذي أختاروه وذهبوا إليه


‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) থেকে এরূপ অনেক হাদীস বর্ণিত, যেগুলোতে বলা হয়েছে যে, মানুষেরা তাদের রবকে দেখবে, মহান আল্লাহর পায়ের কথা এবং এ জাতীয় বিষয়াদি উল্লেখ করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুফিয়ান সাওরী, মালিক ইবন আনাস, ইবনুল মুবারাক, ইবন উ‘আইনা, ওকী ও অন্যান্য ইমাম ও আলিমের মাযহাব এ-ই যে, তাঁরা এগুলো বর্ণনা করেছেন এরপর বলেছেন যে, এ সকল হাদীস এভাবে বর্ণনা করা হবে এবং আমরা এগুলো বিশ্বাস করি। এ বিষয়ে ‘কাইফা’: কিরূপে বা কিভাবে বলা যাবে না। এভাবে মুহাদ্দিসগণের মত এ-ই যে, এ সকল বিষয় যেভাবে এসেছে সেভাবেই বর্ণনা করতে হবে এবং এগুলোকে বিশ্বাস করতে হবে। এগুলোর কোনো ব্যাখ্যা করা যাবে না, কোনো কল্পনা করা যাবে না এবং একথাও বলা যাবে না যে, কিরূপে বা কিভাবে? আলিমগণ এ মতটিই গ্রহণ করেছেন এবং এটিই তাঁদের মাযহাব।’’[2]

এভাবে আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা, তুলনা ও স্বরূপসন্ধান ব্যতিরেকে বাহ্যিক অর্থে বিশ্বাস করা এবং এ অর্থের হাদীসগুলো আন্তরিকভাবে বর্ণনা করার বিষয়ে সালাফ সালিহীন ঐকমত্য পোষণ করেছেন। পাশাপাশি কখনো কখনো তাঁদের কেউ কেউ দু-একটি আয়াতের সহজবোধ্য ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন মহান আল্লাহ বলেন:


يَوْمَ يُكْشَفُ عَنْ سَاقٍ وَيُدْعَوْنَ إِلَى السُّجُودِ فَلا يَسْتَطِيعُونَ


স্মরণ করুন, সে দিনের কথা যেদিন পায়ের গোছা উন্মোচিত হবে, সেদিন তাদেরকে ডাকা হবে সাজ্দা করার জন্য, কিন্তু তারা সক্ষম হবে না।’’[3]

এখানে ‘পায়ের গোছা’র ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস (রা) বলেছেন যে, এ দ্বারা কাঠিন্য বুঝানো হয়েছে, অর্থাৎ যেদিন কাঠিন্য উন্মোচিত হবে। তিনি বলেন:


يريد القيامة والساعة لشدَّتها


‘‘কিয়ামত দিবস ও পুনরুত্থান বুঝানো হয়েছে, তার কাঠিন্যের কারণে।’’[4]

কিয়ামত দিবসের বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন:


وَجَاءَ رَبُّكَ وَالْمَلَكُ صَفًّا صَفًّا


‘‘এবং আগমন করলেন আপনার রব ও ফিরিশতাগণ কাতারে কাতারে।’’[5]

ইমাম ইবন কাসীর বলেন:


روى البيهقي ... عن حنبل أن أحمد بن حنبل تأول قول الله تعالى: (وجاء ربك) أنه جاء ثوابه. ثم قال البيهقي: وهذا إسناد لا غبار عليه.


‘‘বাইহাকী তাঁর সনদে হাম্বাল থেকে বর্ণনা করেছেন, ইমাম আহমদ ‘আগমন করলেন আপনার প্রতিপালক’ কথাটির ব্যাখ্যায় বলেছেন: ‘আগমন করল তাঁর পুরস্কার’। এরপর বাইহাকী বলেন: বর্ণনাটির সনদে কোনো আপত্তি নেই।’’[6]

মহান আল্লাহ বলেন:


كُلُّ شَيْءٍ هَالِكٌ إِلَّا وَجْهَهُ


‘‘সকল বস্ত্তই ধ্বংস হবে শুধু মহান আল্লাহর মুখমণ্ডল ব্যতীত।’’[7]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম বুখারী বলেন:


إلا ملكه ويقال إلا ما أريد به وجه الله


‘‘শুধু মহান আল্লাহর রাজত্ব ব্যতীত। বলা হয়: শুধু মহান আল্লাহর মুখম-লের (সন্তুষ্টির) জন্য পালিত কর্ম ব্যতীত।’’[8]

মহান আল্লাহর বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা ও তুলনামুক্তভাবে গ্রহণের বিষয়ে সালাফ সালিহীন থেকে বর্ণিত অসংখ্য নির্দেশনার পাশাপাশি এরূপ বিচ্ছিন্ন দু-একটি ব্যাখ্যা বর্ণিত হয়েছে। তাঁরাও অন্যত্র বিশেষণ ব্যাখ্যার কঠোর প্রতিবাদ করেছেন। এজন্য পরবর্তী প্রজন্মের আলিমগণ এ বক্তব্যগুলোকে বিশেষণের ব্যাখ্যার অনুমতি বলে গণ্য করেননি; বরং নির্দিষ্ট একটি আয়াতের ক্ষেত্রে তাঁদের ব্যাখ্যা বলে গণ্য করেছেন। পাশাপাশি বিশেষণ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসগুলো ব্যাখ্যামুক্ত, তুলনামুক্ত ও স্বরূপ অনুসন্ধানমুক্তভাবে সরল অর্থে বিশ্বাস ও বর্ণনা করার বিষয়ে তাঁদের ইজমা বা ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। আমরা দেখলাম যে, ইমাম আবূ হানীফার অন্যতম ছাত্র ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান শাইবানী, ইমাম তিরমিযী, ইমাম ইবন খুযাইমা ও অন্যান্য আলিম এ ইজমার কথা উল্লেখ করেছেন।

এ ইজমার কারণেই প্রসিদ্ধ আশআরী কালামবিদ ইমামুল হারামাইন আবুল মাআলী জুওয়াইনী (৪৭৮ হি) আশআরী মতবাদের প্রসিদ্ধ মত ত্যাগ করে সালাফ সালিহীনের মত গ্রহণ করেন। তিনি আর-রিসালাহ আন-নিযামিয়্যাহ গ্রন্থে বলেন:


والذي نرتضيه رأيا وندين الله به عقيدة اتباع سلف الأمة للدليل القاطع على ان إجماع الأمة حجة فلو كان تأويل هذه الظواهر حتما لأوشك أن يكون اهتمامهم به فوق اهتمامهم بفروع الشريعة وإذا انصرم عصر الصحابة والتابعين على الإضراب عن التأويل كان ذلك هو الوجه المتبع


‘‘আমরা যে মতটি গ্রহণ করছি এবং যে আকীদা গ্রহণ করে মহান আল্লাহর নিকট আত্মসমর্পন করছি তা হলো উম্মাতের সালফ সালিহীনের অনুসরণ। কারণ উম্মাতের ইজমা বা ঐকমত্য একটি সুনিশ্চিত দলীল। যদি এ সকল বাহ্যিক বিশেষণগুলোর ব্যাখ্যা করা জরুরী হতো তবে নিঃসন্দেহে শরীয়তের ফিকহী মাসআলাগুলো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার চেয়ে ঈমান-আকীদা বিষয়ক এ সকল আয়াত-হাদীসের ব্যাখ্যার বিষয়ে তাঁরা অনেক বেশি গুরুত্ব প্রদান করতেন। অথচ কোনোরূপ ব্যাখ্যা ছাড়াই সাহাবী ও তাবিয়ীগণের যুগ অতিক্রান্ত হয়ে গেল। এতে প্রমাণিত হলো যে, ব্যাখ্যামুক্ত বিশ্বাসের এ মতটিই অনুসরণযোগ্য আকীদা।’’[9]

ইমামুল হারামাইনের উপরের বক্তব্যটি উদ্ধৃত করে নবম হিজরী শতকের প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস ও শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা হাফিয ইবন হাজার আসকালানী বলেন:


فكيف لا يوثق بما اتفق عليه أهل القرون الثلاثة وهم خير القرون بشهادة صاحب الشريعة


‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাক্ষ্য অনুসারে প্রথম তিন প্রজন্মের মানুষেরাই উম্মতের সর্বোত্তম মানুষ। তাঁরা যে বিষয়ে একমত হয়েছেন সে বিষয়ের উপর নির্ভর না করার কোনোই কারণ নেই।’’[10]

সালফ সালিহীনের এ সকল বক্তব্য থেকে আরো স্পষ্ট যে, তাঁরা একমাত্র ওহী বা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকেই আকীদার উৎস ও ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। আকীদা বিষয়ে ওহীর বাইরে কিছু বলতেই তাঁরা রাজি ছিলেন না।

তৃতীয় হিজরী শতকের শুরুতে আববাসী খলীফা মামুন (রাজত্ব ১৯৮-২১৮ হি) মুতাযিলী ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ করেন এবং একে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। আমরা দেখেছি যে, মুতাযিলী আকীদার অন্যতম বিষয় ‘‘কুরআন সৃষ্ট বা মাখলূক’’ বলে বিশ্বাস করা এবং আখিরাতে আল্লাহর দর্শন অস্বীকার করা। দুটি বিষয়ই মহান আল্লাহর মর্যাদা ও অতুলনীয়ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তারা দাবি করেন। তাদের মতে কথা বলা, আরশে উপরে থাকা ইত্যাদি কর্মের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন হয়, মহান আল্লাহর ক্ষেত্রে এরূপ মানবীয় গুণ আরোপ করা কুফর। অনুরূপভাবে তাদের মতে মহান আল্লাহ নিরাকার। তাঁকে দেখা যাবে বলে বিশ্বাস করার অর্থই কোনো না কোনো ভাবে তাঁর আকৃতি দাবি করা। আর মহান আল্লাহর আকৃতি আছে বলে বিশ্বাস করা কুফরী। তাদের দাবিকৃত এ কুফরী থেকে মুসলিমদের বাঁচানোর জন্য খলীফা মামুন এবং পরবর্তী দুজন খলীফা মু’তাসিম (২১৮-২২৭ হি) ও ওয়াসিক (২২৮-২৩২ হি) এ আকীদা গ্রহণের জন্য সকল মুসলিমকে নির্দেশ দেন। এ মত গ্রহণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনকারী আলিমদেরকে গ্রেফতার করে অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়। কয়েকজনকে হত্যা করা হয়। প্রায় ৩০ বৎসরের এ কুফরী মতাদর্শের শাসন ও অত্যাচারের সময়ে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আলিমগণের অন্যতম নেতা ছিলেন ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল (১৬৪-২৪১ হি)।

ইমাম আহমদকে কারাগারের মধ্যে খলীফা মু’তাসিমের সম্মুখে নির্মমভাবে নির্যাতন করা হয়। বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুআদ ও অন্যান্য মুতাযিলী পণ্ডিত খলীফার সামনে ইমাম আহমদের সাথে বির্তক করেন। তিনি তাদেরকে বারবারই বলেন আপনারা যে আকীদা দাবি করছেন তার পক্ষে কুরআন বা হাদীস থেকে অন্তত একটি বক্তব্য প্রদান করুন। কুরআন, হাদীস বা সাহাবীগণের বক্তব্য থেকে একটি সুস্পষ্ট বক্তব্য প্রদান করুন যাতে বলা হয়ছে: কুরআন সৃষ্ট, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে না অথবা মহান আল্লাহর বিশেষণ বিষয়ক বক্তব্যগুলোকে প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না।

মুতাযিলীগণ বিভিন্ন আকলী প্রমাণ পেশ করেন। ইমাম আহমদ সেগুলো খণ্ডন করেন এবং কুরআন বা হাদীসের সুস্পষ্ট বক্তব্য পেশ করার দাবিতে অটল থাকেন। তখন বিচারপতি আহমদ ইবন আবী দুআদ বলেন: হে আমীরুল মুমিনীন, এ ব্যক্তি একজন মুশরিক। একে হত্যা করুন। এর রক্তের দায় আমি বহন করব। এ সময়ে তাঁকে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করা হয়। ÿত-বিÿত অর্ধমৃত ইমাম আহমদকে খলীফা বলেন, আপনাকে আমি শ্রদ্ধা করি, আপনি উম্মাতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলিম ও ফকীহ। আপনি রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং আমার আনুগত্যের জন্য জনগণকে নির্দেশনা দেন। আমি আমার পুত্র হারূন-এর জন্য যেরূপ মমতা অনুভব করি আপনার জন্যও অনুরূপ মমতা অনুভব করি। তবে কুরআন আল্লাহর অনাদি বাণী, আখিরাতে আল্লাহকে দেখা যাবে ইত্যাদি কুফরী মতবাদ পরিত্যাগ না করলে আপনাকে আমি হত্যা করতে বাধ্য হব। আপনি এমন কিছু বলুন যে, আমি আপনাকে ছেড়ে দিতে পারি। আমি নিজে হাতে আপনার বাঁধন খুলে দেব। অর্ধমৃত ইমাম আহমদ বারবার বলতে থাকেন:


أعطوني شيئا من كتاب الله وسنة رسوله.


‘‘আমাকে আল্লাহর কিতাব ও তাঁর রাসূলের সুন্নাত থেকে কিছু প্রদান করুন।’’[11]

এভাবে আমরা দেখছি যে, প্রসিদ্ধ চার ইমামসহ তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী যুগের সকল ইমাম একমত হয়েছেন যে, আকীদার মূল সূত্র, ভিত্তি ও দলীল ওহী। ওহীর বক্তব্য সরল ও প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা, ওহী যা বলেছে তা-ই বলা এবং ওহীতে যা বলা হয় নি তা আকীদার অন্তর্ভুক্ত না করাই ইসলামী আকীদার মূলসূত্র।

আর এখানেই আহলুস সুন্নাহ ও আহলুল বিদআতের পার্থক্য। আহলুস সুন্নাহ কুরআন ও হাদীসের বক্তব্যকে হুবহু বিশ্বাস ও মান্য করেন। তাঁরা ‘সুন্নাত’-এর সাথে কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজন করতে রাজি হন না। পক্ষান্তরে আহলুল বিদআত কুরআন বা হাদীসের বক্তব্যের সাথে সংযোজন, বিয়োজন বা ব্যাখ্যা করে উক্ত সংযোজন বা ব্যাখ্যাকেই দীনের মূল বানিয়ে দেন। উপরন্তু যারা ওহীর বক্তব্যকে হুবহু গ্রহণ করেন তাঁদেরকে কাফির, বিভ্রান্ত ইত্যাদি বলে শোরগোল করেন এবং সম্ভব হলে শক্তি প্রয়োগ করে তাঁদের কণ্ঠ স্তব্ধ করতে সচেষ্ট হন। প্রসিদ্ধ মুতাযিলী পণ্ডিত আল্লামা যামাখশারীর ‘কাশ্শাফ’ নামক তাফসীর গ্রন্থে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্যগুলো অধ্যয়ন করলেই পাঠক বিষয়টি বুঝতে পারবেন।

[1] ইবন কুদামা, আব্দুল্লাহ ইবন আহমদ, যাম্মুত তাবীল, পৃ. ২২।

[2] তিরমিযী, আস-সুনান ৪/৬৯১ (সিফাতুল জান্নাহ, খুলুদু আহলিল জান্নাত: হাদীস নং ২৫৫৭)

[3] সূরা (৬৮) কালাম: ৪২ আয়াত।

[4] ফার্রা, মাআনিল কুরআন ৫/১২৯; তাবারী, তাফসীর ২৩/৫৫৯; বাইহাকী, আল-আসমা ওয়াস সিফাত ২/১৮৪-১৮৬; সুয়ূতী, আদ-দুররুল মানসূর (দারুল ফিকর) ৮/২৫৫।

[5] সূরা (৮৯) ফাজর: ২২ আয়াত।

[6] ইবন কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ১০/৩৬১।

[7] সূরা (২৮) কাসাস: ৮৮ আয়াত।

[8] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৭৮৭।

[9] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭।

[10] ইবন হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১৩/৪০৭-৪০৮।

[11] যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ১১/২৪৬-২৪৮।
১০. আশ‘আরী, মাতুরিদী ও অন্যান্য মতবাদ / ১০. ১. কুল্লাবিয়া ও আশ‘আরী মতবাদ

১০. ১. কুল্লাবিয়া ও আশ‘আরী মতবাদ

ইমাম আবূ হানীফার প্রায় এক শতাব্দী পরে মূলধারার আলিমগণের মধ্যে চতুর্থ আরেকটি ধারা জন্মলাভ করে। তাঁরা ‘আহলুস সুন্নাহ’ বা সাহাবী-তাবিয়ীগণ ও ইমামগণের মতের ধারক ছিলেন। পাশাপাশি মুতাযিলীদের দর্শনভিত্তিক মতবাদ খন্ডন করতে যেয়ে তাঁরাও দর্শন-প্রভাবিত হয়ে পড়েন। তাঁরা আল্লাহর কিছু বিশেষণ স্বীকার করেন এবং কিছু বিশেষণ ব্যাখ্যা করেন। বাহ্যত দর্শনের প্রভাব এবং সাধারণ মানুষের মন থেকে তুলনার ধারণা অপসারণ করতেই তারা এরূপ ব্যাখ্যা করেন। উদ্দেশ্য মহৎ হলেও ক্রমান্বয়ে দর্শন নির্ভরতা ও ব্যাখ্যা প্রবণতা বাড়তে থাকে।

এ ধারার প্রবর্তকদের অন্যতম বসরার সুপ্রসিদ্ধ ‘ইলম কালাম’ বিশেষজ্ঞ ইমাম ইবন কুল্লাব: আবূ মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ ইবন সাঈদ আল-কাত্তান (২৪১ হি)। মুতাযিলীদের প্রতাপের যুগে মামুনের দরবারে তিনি আহলুস সুন্নাতের পক্ষে বিতর্কে মুতাযিলীদেরকে পরাস্ত করেন। তিনি মহান আল্লাহর ‘যাতী’ বা ‘সত্তীয়’ বিশেষণগুলো স্বীকার করতেন। তবে তিনি মহান আল্লাহর ‘ফিলী’ বা কর্ম বিষয়ক বিশেষণগুলো ব্যাখ্যা করতেন। ইবন কুল্লাবের ছাত্র ইমাম আবুল হাসান আলী ইবন ইসমাঈল আল-আশআরী (৩২৪ হি) তাঁর মত সমর্থন করেন এবং ‘‘আশআরী’’ মতবাদের জন্ম হয়।

আমরা দেখেছি যে, মুতাযিলীগণ ফিকহী বিষয়ে হানাফী ফিকহের অনুসারী ছিলেন এবং অনেক হানাফী ফকীহ স্বেচ্ছায় বা রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের জালে পড়ে মুতাযিলীগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন। এরপরও মূলধারার হানাফী ইমাম ও ফকীহগণ আকীদার বিষয়ে ইমাম আবূ হানীফা ব্যাখ্যাকৃত আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুসরণ করতেন। পাশাপাশি ক্রমান্বয়ে কুল্লাবিয়া ও আশআরী মতবাদের প্রভাবও তাদের মধ্যে প্রসারিত হয়। চতুর্থ হিজরী শতকের প্রথমার্ধে ইমাম আবুল হাসান আশআরীর সমসাময়িক দুজন হানাফী ইমাম আকীদার বিষয়ে প্রসিদ্ধি লাভ করেন:

(১) আবূ জাফর আহমদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন সালামাহ তাহাবী (৩২১হি)

(২) আবূ মানসূর মুহাম্মাদ ইবন মুহাম্মাদ ইবন মাহমূদ মাতুরিদী (৩৩৩ হি)

এরা দুজন সমসাময়িক হলেও দুজন মুসলিম বিশ্বের দু প্রান্তে বাস করেছেন। ইমাম তাহাবী মুসলিম বিশ্বের পশ্চিম প্রান্তে মিসরে এবং ইমাম মাতুরিদী মুসলিম বিশ্বের পূর্ব প্রান্ত সামারকান্দে বসবাস করেছেন। তাঁদের দুজনের মধ্যে কোনো প্রকারের সাক্ষাৎ হয়েছে বলে জানা যায় না। অনুরূপভাবে তাঁদের সমসাময়িক ইমাম আবুল হাসান আশআরী (৩২৪ হি)-এর সাথে তাঁদের দুজনের কারো সাক্ষাৎ হয়েছে বলে জানা যায় না। তবে আকীদা ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ইমাম মাতুরিদী ইমাম ইবন কুল্লাব ও ইমাম আশআরীর ইলম কালাম নির্ভর ধারা অনুসরণ করেছেন। পক্ষান্তরে ইমাম তাহাবী মূলত ইমাম আবূ হানীফা ও তাঁর দু সঙ্গীর আকীদা ব্যাখ্যা করেছেন।

পরবর্তী যুগে হানাফী ফকীহগণের মধ্যে, বিশেষত ইরাক, খুরাসান, সমরকন্দ, ভারত ও মুসলিম বিশ্বের পূর্বদিকের দেশগুলোর হানাফীগণের মধ্যে মাতুরিদী মতবাদ প্রসার লাভ করে। শাফিয়ী ফকীহগণের মধ্যে আশআরী মাযহাব প্রসার লাভ করে।

১০. ৩. পূর্ববর্তীদের সাথে পরবর্তীদের বৈপরীত্য

ইসলামী আকীদার বিভিন্ন দিকে আশআরী ও মাতুরিদী মতবাদ সাহাবী-তাবিয়ী ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা অনুসরণ ও প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট থেকেছে। তবে খুঁটিনাটি কিছু বিষয়ের পাশাপাশি দুটি বিষয়ে চার ইমাম ও সালাফ সালিহীনের মতের সাথে আশআরী-মাতুরিদী মতের বৈপরীত দেখা যায়: (১) ওহী-নির্ভরতা বনাম ‘আকল’-নির্ভরতা এবং (২) মহান আল্লাহর বিশেষণের ব্যাখ্যা।

১০. ৩. ১. ওহী-নির্ভরতা বনাম আকল-নির্ভরতা

আমরা দেখেছি যে, ‘সালাফ সালিহীন’ আকীদা বিষয়ে ওহী বা কুরআন-সুন্নাহের বক্তব্যের উপরে সার্বিকভাবে নির্ভর করতেন। পক্ষান্তরে আশআরী-মাতুরিদী মতের কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, আকীদা প্রমাণের ক্ষেত্রে ‘আকলী দলীল’ বা মানবীয় জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তিই মূল। আকলী দলীল একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে। পক্ষান্তরে ‘নকল’ বা কুরআন ও হাদীসের বক্তব্য একীন প্রদান করে না। বিশেষত আকীদা বিষয়ে তা একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এ প্রসঙ্গে আশআরী মতবাদের সুপ্রসিদ্ধ পণ্ডিত ও শাফিয়ী ফকীহ আল্লামা আব্দুর রাহমান ইবন আহমদ আযুদুদ্দীন ঈজী (৭৫৬) এবং সুপ্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ সাইয়িদ শরীফ আলী ইবন মুহাম্মাদ জুরজানী (৮১৬ হি) ‘আল-মাওয়াকিফ’ ও ‘শারহুল মাওয়াকিফ’ গ্রন্থে বলেন:


الدلائل النقلية هل تفيد اليقين بما يستدل بها عليه من المطالب أو لا؟ قيل: لا تفيد، وهو مذهب المعتزلة وجمهور الأشاعرة لتوقفه.... فقد تحقق أن دلالتها أي دلالة الأدلة النقلية على مدلولاتها يتوقف على أمور عشرة ظنية فتكون دلالتها أيضا ظنية .... وإذا كانت دلالتها ظنية لم تكن مفيدة لليقين بمدلولاتها هذا ما قيل والحق أنها أي الدلائل النقلية قد تفيد اليقين أي في الشرعيات بقرائن ....، نعم في إفادتها اليقين في العقليات نظر


‘‘নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্য যে অর্থে প্রমাণ হিসেবে পেশ করা হয় সে অর্থে তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা একীন প্রদান করে কি না? বলা হয় যে, তা নিশ্চিত বিশ্বাস বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। এটিই মুতাযিলীগণের মত এবং আশআরী মতবাদের অধিকাংশ আলিমের মত। কারণ নকলী দলীল বা কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের অর্থ অনুধাবন অনেকগুলো বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। .... এভাবে প্রমাণিত হয় যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য তার প্রকৃত অর্থে ব্যবহৃত কি না তা জানার আগে দশটি ধারণা-নির্ভর বিষয় জানতে হয়। এজন্য ওহীর বক্তব্য অনুমান বা ধারণা প্রদানকারী মাত্র। .... আর যেহেতু ওহীর বক্তব্য ধারণা প্রদানকারী কাজেই ওহী দ্বারা তার অর্থের বিষয়ে একীন বা নিশ্চিত বিশ্বাস অর্জন করা যায় না। এভাবেই এ বিষয়টি বলা হয়। তবে সঠিক বিষয় (আশআরী মতবাদের অল্পসংখ্যক আলিমের মত) হলো, কুরআন-হাদীসের বক্তব্য আনুষঙ্গিক প্রমাণাদির মাধ্যমে ফিকহী বিষয়ে কখনো কখনো নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করতেও পারে।... তবে আকীদার আকলী বিষয়ে কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদানের বিষয়ে আপত্তি আছে।’’[1]

আল্লামা মুহাম্মাদ আব্দুল আযীয ফারহারী (১২৩৯ হি) ‘নিবরাস’ গ্রন্থে বলেন:


قد ذهبت الأشاعرة إلى أن النص المخالف للدليل العقلي مصروف عن الظاهر: لأن صحة النص إنما تعرف بالدليل العقلي، وهو أنه كلام صاحب المعجزة المصدوق من عند الله تعالى. فالعقل هو أصل النقل فلا يدفع الأصل بالفرع. بل ذهب جمهورهم إلى أن النصوص لا تفيد القطع بمعانيها أصلاً؛ لأن اللغة والنحو والصرف إنما نقلها الآحاد كالأصمعي والخليل وسيبويه، ومع هذا فاحتمال المجاز والاشتراك قائم. ولكن الصحيح خلافه إذ من العربية ما نقل بالتواتر، وقد تقدم القرائن على أن المراد هذا المعنى دون ذلك، فلا يمتنع أن يفيد بعض النقليات القطع.


‘‘আশআরীগণের মাযহাব এই যে, আকলী (জ্ঞানবৃত্তিক) দলীলের বিপরীত ‘নস্স’ অর্থাৎ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যকে তার প্রকাশ্য অর্থে গ্রহণ করা যাবে না; বরং অন্য অর্থ গ্রহণ করতে হবে। কারণ কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের বিশুদ্ধতা তো কেবলমাত্র আকলী দলীল দ্বারাই প্রমাণিত হয়। আকলই নির্দেশ করে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে সত্যবাদী বলে প্রমাণিত মু’জিযার অধিকারী নবীর কথা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আকলই হলো নকল বা কুরআন-হাদীসের দলীলের মূল ভিত্তি। কাজেই কোনো শাখা বা দ্বিতীয় পর্যায়ের দলীলের কারণে মূল বা প্রথম পর্যায়ের দলীলকে বাদ দেওয়া যাবে না। উপরন্তু আশআরীগণের অধিকাংশের মত এই যে, কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলো মূলতই তাদের অর্থের বিষয়ে নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না। কারণ ভাষা, শব্দতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় তো আসমায়ী, খলীল, সিবাওয়াইহি প্রমুখ একক ব্যক্তির বর্ণনা। এছাড়া ভাষার মধ্যে রূপক অর্থ ও একাধিক অর্থ গ্রহণের সম্ভাবনা বিদ্যমান। তবে তাদের কথা পুরো সঠিক নয়। কারণ আরবী ভাষার মধ্যে কিছু বিষয় রয়েছে যা মুতাওয়াতিরভাবে বর্ণিত এবং পারিপার্শিক প্রমাণ দ্বারা নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এ শব্দের এটিই অর্থ। কাজেই কুরআন-হাদীসের কোনো কোনো বক্তব্য দ্বারা নিশ্চিত জ্ঞান লাভ অসম্ভব নয়।’’[2]

[1] জুরজানী, আলী ইবন মুহাম্মাদ, শারহুল মাওয়াকিফ ২/৫১-৫৬।

[2] ফারহারী, আন-নিবরাস, পৃষ্ঠা ১১৯।
১০. ৩. ২. মহান আল্লাহর বিশেষণসমূহের ব্যাখ্যা

আমরা দেখেছি যে, আবূ হানীফা, মালিক, শাফিয়ী, আহমদ (রাহিমাহুমুল্লাহ) ও প্রথম তিন/চার প্রজন্মের মুহাদ্দিস, ফকীহ ও বুজৃর্গগণ কুরআন ও হাদীসে উল্লেখকৃত মহান আল্লাহর সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা ও তুলনা ব্যতিরেকে সরল অর্থে গ্রহণ করেছেন। ইমাম আবূ হানীফা ফিকহুল আকবার, ফিকহুল আবসাত, ওসিয়্যাহ ও অন্যান্য গ্রন্থে ২১টি যাতী (সত্তীয়) ও ফি’লী (কর্মীয়) সিফাত প্রমাণ করেছেন। পক্ষান্তরে আশআরী ও মাতুরীদী মতবাদে আল্লাহর ৭ বা ৮ টি বিশেষণকে স্বীকার করা হয়। সেগুলো নিম্নরূপ: (১) হায়াত (الحياة) বা জীবন, (২) কুদরত (القدرة) বা ক্ষমতা, (৩) ইলম (العلم) বা জ্ঞান, (৪) ইরাদা (الإرادة) বা ইচ্ছা, (৫) সামউ (السمع) বা শ্রবণ, (৬) বাসার (البصر) বা দর্শন, (৭) কালাম (الكلام) বা কথা, (৮) তাকবীন (التكوين) বা তৈরি করা।[1]

‘সুনিশ্চিত’, একীনী বা আকলী দলীলের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার যুক্তিতে এ বিশেষণগুলো ছাড়া সকল বিশেষণ ব্যাখ্যা করাকেই অধিকাংশ আশআরী-মাতুরিদী আলিম মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। মহান আল্লাহর মুখমণ্ডল, হাত, আরশের উপর অধিষ্ঠান, অবতরণ, ক্রোধ, সন্তুষ্টি, ভালবাসা, ইত্যাদি সকল বিশেষণই তারা রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। উদাহরণ হিসেবে আরশের উপর অধিষ্ঠান বিশেষণ বিষয়ে ‘আল-মাওয়াকিফ’ ও ‘শারহুল মাওয়াকিফ’ গ্রন্থের নিম্নের বক্তব্য উদ্ধৃত করা যায়:


لا بد من العلم بعدم المعارض العقلي الدال على نقيض ما دل عليه الدليل النقلي إذ لو وجد ذلك المعارض لقدم على الدليل النقلي قطعا بأن يؤول الدليل النقلي عن معناه إلى معنى آخر مثاله قوله تعالى الرحمن على العرش استوى فإنه يدل على الجلوس وقد عارضه الدليل العقلي الدال على استحالة الجلوس في حقه تعالى فيؤول الاستواء بالاستيلاء أو يجعل الجلوس على العرش كناية عن الملك وإنما قدم المعارض العقلي على الدليل النقلي إذ لا يمكن العمل بهما ... وتقديم النقل على العقل بأن يحكم بثبوت ما يقتضيه الدليل النقلي دون ما يقتضيه الدليل العقلي إبطال للأصل بالفرع فإن النقل لا يمكن إثباته إلا بالعقل ... ... فقد تحقق أن دلالتها أي دلالة الأدلة النقلية على مدلولاتها يتوقف على أمور عشرة ظنية فتكون دلالتها أيضا ظنية .... وإذا كانت دلالتها ظنية لم تكن مفيدة لليقين بمدلولاتها هذا ما قيل والحق أنها أي الدلائل النقلية قد تفيد اليقين أي في الشرعيات بقرائن ....، نعم في إفادتها اليقين في العقليات نظر


‘‘নকলী দলীল (কুরআন বা হাদীসের বক্তব্য) গ্রহণ করার পূর্বে জানতে হবে যে, ওহীর এ বক্তব্যটির বিপরীত অর্থ প্রকাশক কোনো আকলী দলীল বা জ্ঞানবৃত্তিক প্রমাণ বিদ্যমান নেই। কারণ যদি কুরআন-হাদীসের বক্তব্যের বিপরীতে কোনো জ্ঞানবৃত্তিক প্রমাণ বিদ্যমান থাকে তবে নিশ্চিতভাবে জ্ঞানবৃত্তিক দলীলটিকে ওহীর বক্তব্যের উপরে অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। এজন্য নকলী দলীল বা ওহীর বক্তব্যকে তার অর্থ থেকে অন্য অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে। এর উদাহরণ মহান আল্লাহর বক্তব্য: ‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন।’ এ বক্তব্য থেকে উপবেশন প্রমাণ হয়। আর জ্ঞানবৃত্তিক দলীল প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহর জন্য উপবেশন অসম্ভব। কাজেই এখানে ইসতিওয়া (অধিষ্ঠান) শব্দটির ব্যাখ্যা হবে অধিকার করা বা দখল করা। অথবা আরশের উপর উপবেশন বলতে রাজত্বের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। যেহেতু দুটি দলীল একত্রে গ্রহণ করা সম্ভব নয় সেহেতু ওহীর বক্তব্যের উপরে জ্ঞানবৃত্তিক দলীলকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। যদি জ্ঞান ও যুক্তির দাবিকে উপেক্ষা করে ওহীর বক্তব্য গ্রহণ করা হয় তবে তা শাখাকে গ্রহণ করার জন্য মূলকে বাতিল করা বলে গণ্য হবে। কারণ ওহীর বক্তব্যের গ্রহণযোগ্যতা জ্ঞানবৃত্তিক দলীল ছাড়া প্রমাণ করা যায় না। ....’’[2]

তাঁরা আল-মাওয়াকিফ ও শারহুল মাওয়াকিফ গ্রন্থে আরো বলেন:


أنه تعالى ليس في جهة ولا في مكان.... وخالف فيه المشبهة، وخصصوه بجهة الفوق ... الاستدلال بالظواهر الموهمة بالتجسم من الآيات والأحاديث نحو قوله تعالى الرحمن على العرش استوى وجاء ربك والملك صفا صفا... وحديث النزول، وقوله للخرساء أين الله فأشارت إلى السماء فقرر، ... والجواب أنها ظواهر ظنية لا تعارض اليقينيات ومهما تعارض دليلان وجب العمل بهما ما أمكن فتؤول الظواهر إما إجمالا ويفوض تفصيلها إلى الله كما هو رأي من يقف على إلا الله وعليه أكثر السلف كما روي عن أحمد الاستواء معلوم والكيفية مجهولة والبحث عنها بدعة وأما تفصيلا كما هو رأي طائفة فنقول الاستواء الاستيلاء نحو قد استوى عمرو على العراق... والنزول محمول على اللطف والرحمة ...


‘‘মহান আল্লাহ কোনো দিকে বা স্থানে নন। ... মুশাবিবহা বা তুলনাকারী ফিরকা এ বিষয়ে মতভেদ করেছেন। ঊর্ধ্ব দিক বা স্থানকে তারা তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করেছেন।... তাদের পক্ষে দলিল হিসেবে কুরআন ও হাদীসের কিছু বক্তব্য- আয়াত ও হাদীস- পেশ করা হয় যেগুলো থেকে বাহ্যত ধারণা হয় যে, মহান আল্লাহ দেহধারী। যেমন মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান গ্রহণ করেছেন’’, ‘‘আগমন করলেন আপনার রব এবং ফিরিশতাগণ কাতারে কাতারে’’[3], .... মহান আল্লাহর প্রথম আসমানে অবতরণ বিষয়ক হাদীস, অন্য হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বাকশক্তিহীন মহিলাকে বলেন: আল্লাহ কোথায়? তখন মহিলা আকাশের দিকে ইঙ্গিত করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তার ইঙ্গিত মেনে নেন।... এ সকল আয়াত ও হাদীসের উত্তর এই যে, এগুলো সবই ‘যান্নী’ বা ধারণা প্রদানকারী (অস্পষ্ট) বাহ্যিক বক্তব্য (এগুলো একীন বা নিশ্চিত জ্ঞান প্রদান করে না) কাজেই এগুলোকে একীনী প্রমাণগুলোর বিপরীতে পেশ করা যাবে না। আর যখন দুটো দলীল পরস্পর বিরোধী হয় তখন যথাসম্ভব উভয়ের মধ্যে সমন্বয় করে তা গ্রহণ করতে হয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসের এ সকল বাহ্যিক বক্তব্য এজমালিভাবে বা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে। যারা বিষয়টিকে আল্লাহর উপর ছেড়ে দেন তাদের মত হলো এজমালিভাবে এগুলোকে ব্যাখ্যা করা এবং বিস্তারিত আল্লাহর উপর সোপর্দ করা। অধিকাংশ সালফ সালিহীন (পূর্ববর্তী বুজুর্গ) এ মত গ্রহণ করেছেন। যেমন ইমাম আহমদ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন: অধিষ্ঠান জ্ঞাত, পদ্ধতি অজ্ঞাত এবং এ বিষয়ে গবেষণা বিদআত। বিস্তারিত ব্যাখ্যা এক দলের মত। এজন্য আমরা বলব: অধিষ্ঠান অর্থ দখল করা, যেমন বলা যায়: ‘উমার ইরাকের উপর অধিষ্ঠিত হয়েছে’- অর্থাৎ ইরাক দখল করেছে বা ইরাকের ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। ... অবতরণ বলতে মমতা ও রহমত বুঝানো হয়েছে। ....’’[4]

মাতুরিদী মতবাদের প্রসিদ্ধ ইমাম আল্লামা মাসঊদ ইবন উমার সা’দুদ্দীন তাফতাযানী (৭৯২ হি) এ প্রসঙ্গে বলেন:


الأدلة القطعية قائمة على التنزيهات، فيجب أن يفوض علم النصوص إلى الله تعالى على ما هو دأب السلف إيثارا للطريق الأسلم، أو يؤول بتأويلات صحيحة على ما اختاره المتأخرون....


‘‘নিশ্চিত জ্ঞান প্রদানকারী দলীলগুলো প্রমাণ করে যে, মহান আল্লাহ মানবীয় বিশেষণাদি থেকে পবিত্র। কাজেই কুরআন-হাদীসের বক্তব্যগুলোর জ্ঞান আল্লাহর কাছে সমর্পন করতে হবে। প্রথম যুগগুলোর সালাফ সালিহীন-এর এটিই রীতি এবং এটিই নিরাপদ পথ। অথবা এগুলোকে সঠিক ব্যাখ্যায় ব্যাখ্যায়িত করতে হবে। পরবর্তী যুগের আলিমগণ এ মত গ্রহণ করেছেন....।’’[5]

উলেস্নখ্য যে, আশআরী মতবাদের প্রতিষ্ঠাতা ইমাম আবুল হাসান আশআরী নিজে অধিকাংশ বিশেষণ স্বীকার ও প্রমাণ করতেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন:


قولنا الذي نقول به وديانتنا التي ندين بها التمسك بكتاب الله ربنا عز و جل وبسنة نبينا محمد ﷺ وما روى عن السادة الصحابة والتابعين وأئمة الحديث ... وأن الله تعالى استوى على العرش على الوجه الذي قاله وبالمعنى الذي أراده استواء منزها عن الممارسة والاستقرار والتمكن والحلول والانتقال لا يحمله العرش بل العرش وحملته محمولون بلطف قدرته ومقهورون في قبضته وهو فوق العرش وفوق كل شيء إلى تخوم الثرى، فوقية لا تزيده قربا إلى العرش والسماء بل هو رفيع الدرجات عن العرش كما أنه رفيع الدرجات عن الثرى وهو مع ذلك قريب من كل موجود وهو أقرب إلى العبد من حبل الوريد وهو على كل شيء شهيد. وأن له سبحانه وجها بلا كيف كما قال: "ويبقى وجه ربك ذو الجلال والإكرام". وأن له سبحانه يدين بلا كيف كما قال سبحانه: "خلقت بيدي"، وكما قال: "بل يداه مبسوطتان"، وأن له سبحانه عينين بلا كيف كما قال سبحانه: "تجري بأعيننا".


‘‘আমাদের মত, দীন ও ধর্ম এই যে, আমরা মহান আল্লাহর কিতাব এবং আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাত এবং উম্মাতের পুরোধাগণ: সাহাবীগণ, তাবিয়ীগণ এবং হাদীসের ইমামগণ থেকে যা বর্ণিত হয়েছে তা সুদৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরি...। আরো বলি যে, মহান আল্লাহ আরশের উপরে অধিষ্ঠান করেছেন, তিনি যেভাবে বলেছেন সেভাবেই এবং যে অর্থ তিনি উদ্দেশ্য করেছেন সে অর্থেই। এ অধিষ্ঠান স্পর্শ ও স্থিতি, উপবেশন, সংমিশ্রণ ও স্থানান্তর থেকে পবিত্র। আরশ তাঁকে বহন করে না; বরং আরশ ও আরশের বাহকগণ তাঁর সুক্ষ্ম ক্ষমতায় নিয়ন্ত্রিত এবং তাঁর কবজার অধীন। তিনি আরশের ঊর্ধ্বে এবং মহাবিশ্বের সর্বনিম্ন স্তর থেকে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে। তাঁর এ ঊর্ধ্বত্ব তাঁকে আরশের ও আসমানের অধিক নিকটবর্তী করে না। বরং তিনি আরশ থেকে যেমন সুউচ্চ মর্যাদায় তেমনি যমিন থেকেও সুউচ্চ মর্যাদায়। একই সাথে তিনি সকল সৃষ্টির নিকটবর্তী। তিনি কণ্ঠের শিরার চেয়েও বান্দার নিকটবর্তী। এবং তিনি সকল কিছুর প্রত্যÿকারী। আমরা আরো বলি যে, মহান আল্লাহর একটি মুখমণ্ডল আছে, কোনোরূপ স্বরূপ বা প্রকৃতি ছাড়াই; কারণ তিনি বলেছেন[6]: ‘‘এবং অবিনশ্বর শুধু আপনার প্রতিপালকের মহিমাময় মহানুভব মুখমণ্ডল’’। এবং মহান আল্লাহর দুটি হাত আছে, কোনোরূপ স্বরূপ-প্রকৃতি ব্যতিরেকে; কারণ তিনি বলেছেন[7]: ‘‘আমি সৃষ্টি করেছি আমার হস্তদ্বয় দ্বারা’’। তিনি আরো বলেছেন[8]: ‘‘বরং তাঁর উভয় হাতই প্রসারিত’’। এবং মহান আল্লাহর দুটি চোখ আছে কোনোরূপ স্বরূপ বা প্রকৃতি ব্যতিরেকে। কারণ আল্লাহ বলেছেন[9]: ‘‘যা চলছিল আমার অক্ষির সম্মুখে..।’’[10]

ইমাম আবূ হানীফার ‘‘আল-ফিকহুল আবসাত’’ নামে পরিচিত ‘আল-ফিকহুল আকবার’-এর দ্বিতীয় ভাষ্যটির একটি ব্যাখ্যাগ্রন্থ ইমাম আবূ মানসূর মাতুরিদীর নামে মুদ্রিত। তবে গবেষকগণ নিশ্চিত করেছেন যে, গ্রন্থটি মূলত মাতুরিদীর ছাত্র পর্যায়ের প্রসিদ্ধ ফকীহ ইমাম আবুল লাইস সামারকান্দী নাসর ইবন মুহাম্মাদ (৩৭৩ হি)-এর রচিত। গ্রন্থটিতে বারবার ইমাম মাতুরিদীর বক্তব্য উদ্ধৃত করা হয়েছে এবং মাতুরিদী মাযহাবের ভিত্তিতেই গ্রন্থটি রচিত। এ গ্রন্থে গ্রন্থকার একস্থানে বলেন:


وقالت القدرية والمعتزلة إن الله تعالى في كل مكان، واحتجتا بقوله تعالى: "وهو الذي في السماء إله وفي الأرض إله"، أخبر أنه في السماء وفي الأرض، إلا أنا نقول: لا حجة لكم في الآية... المراد به نفوذ الإلهية في السماء وفي الأرض، وبه نقول. وقول المعتزلة والقدرية في هذا أقبح من قول المشبهة؛ لأن قولهم يؤدي إلى أن الله تعالى في أجواف السباع والهوام والحشرات، تعالى الله عن ذلك علوا كبيرا. وأما مذهب أهل السنة والجماعة أن الله على العرش علو عظمة وربوبية، لا علو ارتفاع مكان ومسافة


‘‘মুতাযিলী ও কাদারিয়াগণ বলেন, আল্লাহ সকল স্থানে। আল্লাহ বলেছেন: ‘‘আসমানে তিনি মাবূদ এবং পৃথিবীতে তিনি মাবূদ’’। এ আয়াত দিয়ে তারা বলে: তিনি তো বললেন যে, তিনি আসমানের মধ্যে এবং পৃথিবীর মধ্যে। আমরা বলি, এ আয়াত তোমাদের দাবি প্রমাণ করে না। ... এ আয়াতের অর্থ আসমান-যমীন সর্বত্র একমাত্র তাঁর ইবাদতই কার্যকর। ... মুতাযিলী ও কাদারিয়াদের কথা মুশাবিবহা বা তুলনাকারীদের কথার চেয়েও জঘন্যতর। কারণ তাদের দাবি অনুসারে মহান আল্লাহ বন্যপ্রাণী, পশুপাখী ও কীটপতঙ্গের দেহের মধ্যে রয়েছেন। এরূপ অবস্থা থেকে আল্লাহ অনেক ঊর্ধ্বে। আহলূস সুন্নাতের (মাতুরিদী) মত এই যে, আল্লাহ আরশের উপরে। তাঁর এ ঊর্ধ্বত্ব স্থান ও দূরত্বের ঊর্ধ্বত্ব নয়, বরং মর্যাদা ও প্রতিপালনের ঊর্ধ্বত্ব।’’[11]

ইমাম আশআরী ও ইমাম সামারকান্দীর বক্তব্যে আমরা দেখেছি যে, তাঁরা মহান আল্লাহর ‘বাহ্যত মানবীয়’ বিশেষণগুলো কিছুটা ব্যাখ্যা সাপেক্ষে গ্রহণ করেছেন। ‘আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান’ মতটিকে ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বলে গণ্য করেছেন। অথচ বর্তমানে অনেক মুসলিম এ বিভ্রান্ত মতটিকেই ইসলামী আকীদা বলে গণ্য করেন। ওহীর বর্ণনা অনুসারে মহান আল্লাহ বান্দার সাথে ও নিকটে এবং তাঁর জ্ঞান সর্বত্র বিরাজমান, তাঁর মহান সত্তা নয়। এ প্রসঙ্গে ইমাম আবূ ইউসুফের মত দেখুন। বাশ্শার ইবন মূসা খাফ্ফাফ বলেন:


جاء بشر بن الوليد الكندي إلى القاضي أبي يوسف فقال له تنهاني عن الكلام وبشر المريسي وعلي الأحول وفلان يتكلمون قال وما يقولون قال يقولون الله في كل مكان فقال أبو يوسف علي بهم فانتهوا إليهم وقد قام بشر فجيء بعلي الأحول وبالآخر شيخ فقال أبو يوسف ونظر إلى الشيخ لو أن فيك موضع أدب لأوجعتك فأمر به إلى الحبس وضرب الأحول وطوف به


‘‘বিশর ইবন ওলীদ কিন্দী কাযী আবূ ইউসুফের নিকট আগমন করে বলেন: আপনি তো আমাকে ইলমুল কালাম থেকে নিষেধ করেন, কিন্তু বিশর আল-মারীসী, আলী আল-আহওয়াল এবং অমুক ব্যক্তি কালাম নিয়ে আলোচনা করছে। আবূ ইউসুফ বলেন: তারা কী বলছে? তিনি বলেন: তারা বলছে যে, আল্লাহ সকল স্থানে বিরাজমান। তখন আবূ ইউসুফ বলেন: তাদেরকে ধরে আমার কাছে নিয়ে এস। তখন তারা তাদের নিকট গমন করে। ইত্যবসরে বিশর আল-মারীসী উক্ত স্থান পরিত্যাগ করেছিলেন। এজন্য আলী আহওয়াল এবং অন্য একজন বৃদ্ধ ব্যক্তিকে ধরে আনা হয়। আবূ ইউসুফ বৃদ্ধ ব্যক্তিটির দিকে দৃষ্টিপাত করে বলেন: আপনার দেহে শাস্তি দেওয়ার মত স্থান থাকলে আমি আপনাকে বেত্রাঘাতের নির্দেশ দিতাম। তিনি উক্ত বৃদ্ধকে কারারুদ্ধ করার নির্দেশ দেন এবং আলী আহওয়ালকে বেত্রাঘাত করা হয় এবং রাসত্মায় ঘুরানো হয়।’’[12]

[1] তাফতাযানী, শারহুল আকাইদিন নাসাফিয়্যাহ (এমদাদিয়া, দেওবন্দ), পৃষ্ঠা ৫১-৬৫।

[2] জুরজানী, শারহুল মাওয়াকিফ ২/৫১-৫৬।

[3] সূরা (৮৯) ফাজর, আয়াত: ২২।

[4] জুরজানী, শারহুল মাওয়াকিফ ৮/২২-২৮।

[5] তাফতাযানী, শারহুল আকায়িদিন নাসাফিয়্যাহ (এমদাদিয়া: দেওবন্দ), পৃষ্ঠা ৪২।

[6] সূরা (৫৫) রাহমান: ২৭ আয়াত।

[7] সূরা (৩৮) স্বাদ: ৭৫ আয়াত।

[8] সূরা (৫) মায়িদা: ৬৪ আয়াত।

[9] সূরা (৫৪) কামার: ১৪ আয়াত।

[10] আশআরী, আল-ইবানাহ আন উসূলিদ্দিয়ানাহ, পৃষ্ঠা ২০।

[11] আবূ মানসূর মাতুরিদী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃষ্ঠা ১৯।

[12] যাহাবী, আল-উলুওউ লিল আলিয়্যিল গাফ্ফার, পৃষ্ঠা ১৫১।

আশআরী-মাতুরিদী আলিমগণের মধ্যে অনেকেই ব্যাখ্যমুক্তভাবে বিশেষণগুলো বিশ্বাস করা উত্তম বলেছেন। কেউ ব্যাখ্যার পক্ষে কঠোরতা অবলম্বন করেছেন। মহান আল্লাহর হাত, চক্ষু, আরশের উপর অধিষ্ঠান, অবতরণ ইত্যাদি বিশেষণ তুলনামুক্তভাবে বিশ্বাসকারীদেরকে তাঁরা ঢালাওভাবে ‘মুশাবিবহা’ (তুলনাকারী), ‘মুজাস্সিমা (দেহে বিশ্বাসী) বা কাফির বলে গালি দিয়েছেন। এমনকি এ বিষয়ক আয়াত ও হাদীসের ব্যাখ্যামুক্ত, তুলনামুক্ত ও ‘কাইফ’ বা স্বরূপ সন্ধানমুক্ত অনুবাদ করাকেও তারা একইরূপ বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেছেন। এর বিপরীতে সালফ সালিহীনের মত অনুধাবন ও ব্যাখ্যায়ও নানাবিধ প্রান্তিকতা বিদ্যমান। সালাফের অনুসরণের দাবিতে অনেকে আশআরী-মাতুরিদীগণকে ঢালাওভাবে ‘জাহমী’ বলেন। বিশেষণকে ব্যাখ্যামুক্তভাবে গ্রহণ করার পর অতুলনীয়ত্ব ব্যাখ্যায় কিছু বললেও তারা তা বিভ্রান্তি বলে গণ্য করেন।

প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ ও মুহাদ্দিস ইবনুল জাওযী (৫৯৭ হি) উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম হাসান ইবন হামিদ (৪০৩ হি), কাযী আবূ ইয়ালা মুহাম্মাদ ইবনুল হুসাইন (৪৫৮ হি), ইবনুয যাগওয়ানী আলী ইবন উবাইদুল্লাহ (৫২৭ হি) প্রমুখ প্রসিদ্ধ হাম্বালী ফকীহ মহান আল্লাহর মুখগহবর, দাঁত, বক্ষ, উরু... ইত্যাদি আছে বলে বিশ্বাস করতেন। ইবনুল জাওযীর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, কুরআন, সহীহ হাদীস, যয়ীফ হাদীস, তাবিয়ী যুগের কোনো কোনো আলিমের বক্তব্য সবকিছুকে একইভাবে ‘ওহীর’ মান প্রদানের ফলে তাঁরা এরূপ প্রান্তিকতায় নিপতিত হন। ব্যাখ্যাবিহীন গ্রহণের নামে তাঁরা ওহীর সাথে সংযোজনের মধ্যে নিপতিত হতেন।[1]

[1] বিস্তারিত দেখুন: ইবনুল জাওযী, দাফউ শুবাহিত তাশবীহ।
দেখানো হচ্ছেঃ ১৩১ থেকে ১৪০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৫৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 11 12 13 14 15 · · · 23 24 25 26 পরের পাতা »