কুরবানীর বিধান আবদুল হামীদ ফাইযী ২০ টি
কুরবানীর বিধান আবদুল হামীদ ফাইযী ২০ টি

আল্লাহ তাআলার প্রত্যেক কাজ বা সৃষ্টি হিকমতে ভরপুর প্রত্যেক বস্তুতে তাঁর প্রতিপালকত্বের দলীল এবং একত্বের সাক্ষ্য বিদ্যমান। তাঁর সকল কর্মেই পরিস্ফুটিত হয় তাঁর প্রত্যেক মহামহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত গুণ। কিছু সৃষ্টিকে কিছু মর্যাদা ও বিশেষ গুণ দ্বারা নির্দিষ্ট করা, কিছু সময় ও স্থানকে অন্যান্যের উপর প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেওয়ার কর্মও তাঁর ঐ হিকমত ও মহত্বের অন্যতম।

আল্লাহ পাক কিছু মাস, দিন ও রাত্রিকে অপরাপর থেকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন; যাতে তা মুসলিমের আমল বৃদ্ধিতে সহযোগী হয়। তাঁর আনুগত্যে ও ইবাদতে মনোযোগ বৃদ্ধি পায় এবং কর্মঠ মনে নতুন কর্মোদ্যম পুনঃ পুনঃ জাগরিত হয়। অধিক সওয়াবের আশায় সেই কাজে মনের লোভ জেগে ওঠে এবং তার বড় অংশ হাসিলও করে থাকে বান্দা। যাতে মৃত্যু আসার পূর্বে যথা সময়ে তার প্রস্তুতি এবং পুনরুত্থানের জন্য যথেষ্ট পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে পারে।

শরীয়তে নির্দিষ্ট ইবাদতের মৌসম এই জন্যই করা হয়েছে যাতে ঐ সময়ে ইবাদতে অধিক মনোযোগ ও প্রয়াস লাভ হয় এবং অন্যান্য সময়ে অসম্পূর্ণ অথবা স্বল্প ইবাদতের পরিপূর্ণতা ও আধিক্য অর্জন এবং তাওবাহ করার সুযোগ লাভ হয়।

ঐ ধরনের প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ মৌসমেরই নির্দিষ্ট এক একটা ওযীফাহ ও করণীয় আছে; যার দ্বারায় আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা যায়। সেই সময়ে আল্লাহ পাকের বিশেষ অনুগ্রহ ও করুণা আছে; যার দ্বারায় আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা পুরস্কৃত করে থাকেন। অতএব সৌভাগ্যশালী সেই হবে, যে ঐ নির্দিষ্ট মাস বা কয়েক ঘণ্টার মৌসমে নির্দিষ্ট ওযীফাহ ও ইবাদতের মাধ্যমে নিজ মওলার সামীপ্য অর্জন করতে সক্ষম হবে। আর সম্ভবতঃ তাঁর অনুগ্রহের অধিকারী হয়ে পরকালে জাহান্নাম ও তাঁর ভীষণ অনলের কবল হতে নিষ্কৃতি পাবে।

আমল ও ইবাদতের নির্দিষ্ট মৌসমসমূহে আল্লাহর অনুগত ও দ্বীনদার বান্দা লাভবান হয় এবং অবাধ্য ও অলস বান্দা ক্ষতির শিকার হয়। তাই তো মুসলিমের উচিত, আয়ুর মর্যাদা ও জীবনের মূল্য সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত হওয়া এবং সেই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত অধিকরূপে করা ও মরণাবধি সৎকার্যে অবিচল প্রতিষ্ঠিত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(وَاعْبُدْ رَبَّكَ حَتّى يَأْتِيَكَ الْيَقِيْن)

অর্থাৎ, ‘‘তোমার ইয়াকীন উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত তুমি তোমার প্রতিপালকের উপাসনা কর।’’ (কুঃ ১৫/৯৯)

সালেম বিন আব্দুল্লাহ (রহ.) বলেন, ‘ইয়াকীন’ (সুনিশ্চয়তা) অর্থাৎ মৃত্যু। অনুরূপ বলেছেন মুজাহিদ, হাসান, কাতাদাহ প্রভৃতি মুফাসসিরগণও।[1]

আল্লাহ তাআলা যুলহাজ্জের প্রথম দশ দিনকে অন্যান্য দিনের উপর শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা দান করেছেন। আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন। ‘‘এই দশ দিনের মধ্যে কৃত নেক আমলের চেয়ে আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয় আর কোন আমল নেই।’’ (সাহাবাগণ) বললেন, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি (এর আমল) যে নিজের জান-মাল সহ বের হয় এবং তারপর কিছুও সঙ্গে নিয়ে আর ফিরে আসে না।[2]

তিনি আরো বলেন, ‘‘আযহার দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক পবিত্রতর ও প্রতিদানে অধিক বৃহত্তর আর কোন আমল আল্লাহ আয্যা অজাল্লার নিকট নেই।’’ বলা হল, ‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয় কি?!’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদও নয়। তবে এমন ব্যক্তির (আমল) যে নিজের জানমাল সহ বহির্গত হয়, অতঃপর তার কিছুও সঙ্গে নিয়ে আর ফিরে আসে না।’’[3]

আব্দুল্লাহ বিন আমর (রা.) বলেন, একদা আমি রসূলুল্লাহ (সা.)-এর নিকট ছিলাম। অতঃপর আমলসমূহের কথা উত্থাপন করলাম। তিনি বললেন, ‘‘এই দশ দিন ছাড়া কোন এমন দিন নেই যাতে আমল অধিক উত্তম হতে পারে।’’ তাঁরা বললেন, ‘হে রসূলুল্লাহ! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ?’ তিনি তার গুরুত্ব বর্ণনা করলেন, অতঃপর বললেন, ‘‘জিহাদও নয়। তবে এমন কোন ব্যক্তি যে নিজের জান-মাল সহ আল্লাহর রাস্তায় বের হয় এবং তাতেই তার জীবনাবসান ঘটে।’’[4]

অতএব এই দলীলসমূহ হতে প্রমাণিত হয় যে, সারা বছরের সমস্ত দিনগুলি অপেক্ষা যুল হাজ্জের ঐ দশ দিনই বিনা বিয়োজনে উত্তম। এমন কি রমযানের শেষ দশ দিনও ঐ দশ দিনের চেয়ে উত্তম নয়।

ইবনে কাসীর (রঃ) বলেন, ‘মোট কথা বলা হয়েছে যে, এই দশদিন সারা বছরের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম দিন; যেমনটি হাদীসের উক্তিতে প্রতীয়মান হয়। অনেকে রমযানের শেষ দশ দিনের উপরেও এই দিনগুলিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। কারণ, যে নামায, রোযা, সাদকাহ ইত্যাদি আমল এই দিনগুলিতে পালনীয় ঐ আমলসমূহই ঐ দিনগুলিতেও পালনীয়। কিন্তু (যুলহাজ্জের) ঐ দিনগুলিতে ফরজ হাজ্জ আদায় করার অতিরিক্ত বৈশিষ্ট্য রয়েছে।’

আবার অনেকে বলেছেন (রমযানের) ঐ দিনগুলিই শ্রেষ্ঠ। কারণ, তাতে রয়েছে শবেকদর, যা হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম।

কিন্তু এই দুয়ের মধ্যবর্তী কিছু উলামা বলেন, (যিলহাজ্জের) দিনগুলিই শ্রেষ্ঠ এবং রমযানের রাত্রিগুলি শ্রেষ্ঠ। অবশ্য এইভাবে সমস্ত দলীল সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। আর আল্লাহই বেশী জানেন।[5]

উক্ত দলীলসমূহ এই কথার প্রমাণ দেয় যে, প্রত্যেক নেক আমল (সৎকর্ম); যা এই দিনগুলিতে করা হয় তা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয়। অর্থাৎ, ঐ কাজই যদি অন্যান্য দিনে করা হয় তবে ততটা প্রিয় হয় না। আর যা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় তা তাঁর নিকট সর্বোত্তম। আবার এই দিনগুলিতে আমল ও ইবাদতকারী সেই মুজাহিদ থেকেও উত্তম, যে নিজের জান-মাল সহ জিহাদ করে বাড়ি ফিরে আসে।

অথচ বিদিত যে, আল্লাহর রাহে জিহাদ ঈমানের পর সর্বোৎকৃষ্ট আমল। যেহেতু আবূ হুরাইরাহ (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘হে আল্লাহর রসূল! কোন আমল সবচেয়ে উৎকৃষ্ট?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ ও তদীয় রসূলের প্রতি ঈমান।’’ সে বলল, ‘তারপর কি?’ তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহর পথে জিহাদ।’’ সে বলল, ‘তারপর কি?’ তিনি বললেন, ‘‘গৃহীত হাজ্জ।’’[6]

কিন্তু পূর্বোক্ত হাদীসসমূহ হতে প্রতিপাদিত হয়েছে যে, বৎসরের অন্যান্য দিনের সকল প্রকার আমল অপেক্ষা যুলহাজ্জের ঐ দশদিনের আমল আল্লাহর নিকট অধিক উত্তম ও প্রিয়তম। সুতরাং ঐ দশ দিনের আমল যদিও জিহাদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ নয়, তবুও অন্যান্য দিনের আমলের তুলনায় শ্রেষ্ঠতর; যদিও বা সেই আমল (অন্যান্য দিনে) শ্রেষ্ঠ। আর নবী (সা.) কোন আমলকে ব্যতিক্রান্ত করেননি। তবে এমন এক জিহাদের কথা উল্লেখ করেছেন যা সর্বোৎকৃষ্ট জিহাদ; যাতে মুজাহিদ শহীদ হয়ে যায় এবং আর ফিরে আসে না; যার ঐ আমল উক্ত দশ দিনের সমস্ত আমলের চেয়েও উত্তম।

কোন বস্তুকে যখন সাধারণভাবে শ্রেষ্ঠ বলা হয়, তখন তার এই অর্থ নয় যে, ঐ বস্তু সর্বাবস্থায় ও সকলের পক্ষেই শ্রেষ্ঠ। বরং অশ্রেষ্ঠও তার নির্দেশিত বিধিবদ্ধ স্থানে সাধারণ শ্রেষ্ঠ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর হতে পারে। যেমন, জিহাদ সাধারণভাবে শ্রেষ্ঠ আমল। কিন্তু অশ্রেষ্ঠ কোন নেক আমল তার নির্দেশিত নির্দিষ্ট ঐ দশ দিনে করা হলে তা জিহাদ থেকেও শ্রেষ্ঠতর।

অনুরূপভাবে, যেমন রুকু ও সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ কুরআন পাঠ হতেও উত্তম। (বরং ঐ অবস্থায় কুরআন পাঠ অবৈধ।) অথচ কুরআন পাঠ সাধারণ সর্ববিধ তাসবীহ ও যিকর হতে উত্তম।[7]

যুলহাজ্জের এই দশ দিনের ফযীলত ও শ্রেষ্ঠত্ব বিভিন্ন দিক দিয়ে প্রতিপন্ন হয়ঃ-

১। আল্লাহ তাআলা এই দিনগুলির শপথ করেছেন। আর কোন জিনিসের নামে শপথ তার শ্রেষ্ঠত্ব ও মাহাত্ম্যেরই প্রমাণ। আল্লাহ পাক বলেন, ‘‘শপথ ঊষার, শপথ দশ রজনীর----।’’

(সূরা ফাজ্র১-২ আয়াত)

ইবনে আব্বাস (রা.) ইবনে যুবাইর (রা.) প্রভৃতি সলফগণ বলেন, ‘নিশ্চয় ঐ দশ রাত্রি বলতে যুলহাজ্জের দশ দিনকে বুঝানো হয়েছে।’ ইবনে কাসীর (রহ.) বলেন, ‘এটাই সঠিক।’ শাওকানী (রহ.) বলেন, ‘এই অভিমত অধিকাংশ ব্যাখ্যাদাতাগণের।’[8]

অবশ্য ঐ দশ রাত্রি বলতে এই দশ দিনকেই নির্দিষ্ট করে বুঝার ব্যাপারে কোনও ইঙ্গিত আল্লাহর রসূল (সা.)-এর নিকট হতে আসেনি; যা সুনিশ্চিতভাবে গ্রহণযোগ্য হবে। যার জন্যই এই ব্যাখ্যায় মতান্তর সৃষ্টি হয়েছে, আর আল্লাহই এ বিষয়ে অধিক জানেন।

২। নবী (সা.) সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, এই দিনগুলি দুনিয়ার সর্বোকৃৎষ্ট দিন। যেমন পূর্বে উল্লেখিত হয়েছে।

৩। তিনি এই দিনগুলিতে সৎকর্ম করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। যেহেতু এই দিনগুলি সকলের জন্য পবিত্র ও মর্যাদাপূর্ণ এবং হাজীদের জন্য পবিত্রস্থানে (মক্কায়) আরো গুরুত্বপূর্ণ।

৪। তিনি এই দিনগুলিতে অধিকাধিক তাসবীহ, তাহমীদ, তাহলীল ও তাকবীর পড়তে আদেশ করেছেন।[9]

৫। এই দিনগুলির মধ্যে আরাফাহ ও কুরবানীর দিন রয়েছে।

৬। এগুলির মধ্যেই কুরবানী ও হাজ্জ করার মত বড় আমল রয়েছে।

হাফিয ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, ‘একথা স্পষ্ট হয় যে, যুলহাজ্জের প্রথম দশ দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ; যেহেতু ঐ দিনগুলিতে মৌলিক ইবাদতসমূহ একত্রিত হয়েছে যেমন, নামায, রোযা, সদাকাহ এবং হাজ্জ। যা অন্যান্য দিনগুলিতে এইভাবে জমা হয় না।[10]

[1] (ইবনে কাসীর ৪/৩৭১)

[2] (বুখারী, আবূ দাঊদ)

[3] (দারেমী ১/৩৫৭)

[4] (আহমাদ, ইরওয়াউল গালীল ৩/৩৯৯)

[5] (তাফসীর ইবনে কাসীর ৫/৪১২)

[6] (বুখারী ১৬নং)

[7]

[8] (তাফসীর ইবনে কাসীর, ফাতহুল কাদীর ৫/৪৩২)

[9] (সহীহ তারগীব ১২৪৮নং)

[10] (ফাতহুল বারী ২/৪৬০)
কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা থাকলে কি করবে?

সুন্নাহতে এ কথা প্রমাণিত যে, যে ব্যক্তি কুরবানী দেওয়ার ইচ্ছা বা সংকল্প করেছে তার জন্য ওয়াজিব; যুলহাজ্জ মাস প্রবেশের সাথে সাথে কুরাবানীর পশু যবেহ না করা পর্যন্ত সে যেন তার দেহের কোন লোম বা চুল, নখ ও চর্মাদি না কাটে। এ বিষয়ে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘যখন তোমরা যুলহাজ্জ মাসের চাঁদ দেখবে এবং তোমাদের মধ্যে কেউ কুরবানী করার ইচ্ছা করবে, তখন সে যেন কুরবানী না করা পর্যন্ত তার চুল ও নখ (কাটা) হতে বিরত থাকে।’’ অন্য এক বর্ণনায় বলেন, ‘‘সে যেন তার (মরা বা ফাটা) চর্মাদির কিছুও স্পর্শ না করে।’’[1]

বলিষ্ঠ মতানুসারে এখানে এ নির্দেশ ওয়াজিবের অর্থে এবং নিষেধ হারামের অর্থে ব্যবহার হয়েছে। কারণ, তা ব্যাপক আদেশ এবং অনির্দিষ্ট নিষেধ, যার কোন প্রত্যাহতকারীও নেই। কিন্তু যদি কেউ জেনে-শুনে ইচ্ছা করেই চুল-নখ কাটে, তবে তার জন্য জরুরী যে, সে যেন আল্লাহর নিকট ইস্তিগফার (ক্ষমা প্রার্থনা) করে। আর তার জন্য কোন কাফফারা নেই। সে স্বাভাবিকভাবে কুরবানীই করবে। আবার প্রয়োজনে (যেমন নখ ফেটে বা ভেঙ্গে ঝুলতে থাকলে বা মাথায় জখমের উপর চুল থাকলে এবং ক্ষতির আশঙ্কা হলে) কেটে ফেলতে কোন দোষ নেই। কারণ, সে মুহরিম (যে হাজ্জ বা ওমরার জন্য ইহরাম বেঁধেছে তার) অপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ নয়, যার জন্য অসুবিধার ক্ষেত্রে মাথা মুন্ডিত করাও বৈধ করা হয়েছে।

এই নির্দেশের পশ্চাতে যুক্তি এই যে, কুরবানীদাতা কিছু আমলে মুহরিমের মতই। যেমন, কুরবানীর মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্যলাভ করা ইত্যাদি। তাই কুরবানীদাতাও মুহরিমের পালনীয় কিঞ্চিৎ কর্তব্য পালন করতে আদিষ্ট হয়েছে।

এমন কোন ব্যক্তি যার চাঁদ দেখার পর কুরবানী করার ইচ্ছা ছিল না, সে চুল বা নখ কেটে থাকলে এবং তারপর কুরবানী করার ইচ্ছা হলে তারপর থেকেই আর তা কাটবে না।

কুরবানী করার জন্য যদি কেউ কাউকে ভার দেয় অথবা অসীয়ত করে, তবে সেও নখ-চুল কাটবে না। অবশ্য ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা অসী এই নিষেধের শামিল হবে না। অর্থাৎ তাদের জন্য নখ-চুল কাটা দূষণীয় নয়।

অনুরূপভাবে পরিবারের অভিভাবক কুরবানী করলে এই নিষেধাজ্ঞা কেবল তার পক্ষে হবে; বাকী অন্যান্য স্ত্রী-পুত্র বা আত্মীয়দেরকে শামিল হবে না। তাদের জন্য নির্দিষ্ট কুরবানী না থাকলে তারা নিজেদের চুল-নখ কাটতে পারে। যেহেতু আল্লাহর রসূল (সা.) নিজ বংশধরের তরফ থেকে কুরবানী করতেন অথচ তিনি তাদেরকে নখচুল কাটতে নিষেধ করেছেন বলে কোন বর্ণনা পাওয়া যায় না।

যে ব্যক্তি কুরবানী করার ইচ্ছা করে পুনরায় হাজ্জ করার নিয়ত করে (অর্থাৎ হাজ্জও করে এবং পৃথকভাবে কুরবানীও করে) তবে ইহরাম বাঁধার পূর্বে (যুলহাজ্জের চাঁদ উঠে গেলে) চুল-নখাদি কাটা উচিত নয়। যেহেতু তা প্রয়োজনে সুন্নাত।

অবশ্য তামাত্তু হাজ্জকারী (হাজ্জের ওয়াজিব কুরবানী ছাড়া পৃথক কুরবানী দেওয়ার নিয়ত থাকলেও) উমরাহ শেষ করে চুল ছোট করবে। কারণ তা উমরাহর এক ওয়াজিব কর্ম। অনুরূপভাবে কুরবানীর দিনে পাথর মারার পর কুরবানী করার আগে মাথা নেড়া করতে পারে।

প্রকাশ যে, ‘যারা কুরবানী দিতে পারে না তারা কুরবানীর দিনে নখ-চুল ইত্যাদি কাটলে তাদের কুরবানী করার সওয়াব লাভ হয়’ এমন কথা এক হাদীসে থাকলেও তা সহীহ নয়।[2]

[1] (মুসলিম)

[2] (মিশকাত ১৪৭৯নং, যইফ আবূ দাঊদ ৫৯৫, যইফ নাসাঈ ২৯৪, যয়ীফুল জামে’ ১২৬৫নং)

এই দশ দিনকে সামনে পাওয়া বান্দার জন্য আল্লাহর তরফ হতে এক মহা অনুগ্রহ। মুত্তাকী ও নেক বান্দাগণই এই দিনগুলির যথার্থ কদর করে থাকেন। প্রতি মুসলিমের উচিত, এই সম্পদের কদর করা, এই সুবর্ণ সুযোগকে হেলায় হারিয়ে না দেওয়া এবং যত্নের সাথে বিভিন্ন ইবাদত ও আনুগত্যের মাধ্যমে এই দিনগুলিকে অতিবাহিত করা।

এই দিনগুলিতে পালনীয় বড় বড় নেক আমল রয়েছে। মুসলিম সেই আমলসমূহের সাহায্যে বড় পুণ্যের অধিকারী হতে পারে। যেমনঃ-

১। রোযা পালনঃ

যুল্ হাজ্জের প্রথম নয়দিনে রোযা পালন করা মুসলিমের জন্য উত্তম। কারণ, নাবী কারীম (সা.) এই দিনগুলিতে নেক আমল করার জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। আর রোযা উত্তম আমলসমূহের অন্যতম; যা আল্লাহ পাক নিজের জন্য মনোনীত করেছেন। যেমন হাদীসে কুদসীতে বলা হয়েছে, আল্লাহ বলেন, ‘‘আদম সন্তানের প্রত্যেক কাজ তার নিজের জন্য, কিন্তু রোযা আমারই জন্য এবং আমি নিজে তার প্রতিদান দেব।’’[1]

প্রিয় নবী (সা.)ও এই নয় দিনে রোযা পালন করতেন। তাঁর পত্নী (হাফসাহ রাঃ) বলেন, ‘‘নবী (সা.) যুল হাজ্জের নয় দিন, আশুরার দিন এবং প্রত্যেক মাসের তিন দিন; মাসের প্রথম সোমবার এবং দুই বৃহস্পতিবার রোযা রাখতেন।’’[2]

ইমাম বাইহাক্বী (রহ.) ‘ফাযায়েলুল আওক্বাত’ এ বলেন, এই হাদীসটি আয়েশা (রাঃ) এর ঐ হাদীস অপেক্ষা উত্তম যাতে তিনি বলেন, ‘আমি রসূল (সা.)-কে (যুলহাজ্জের) দশ দিনে কখনো রোযা রাখতে দেখিনি।’[3] কারণ, এ হাদীসটি ঘটনসূচক এবং তা আয়েশার ঐ অঘটনসূচক হাদীস হতে উত্তম। আর মুহাদ্দিসীনদের একটি নীতি এই যে, যখন ঘটনসূচক ও অঘটনসূচক দু’টি হাদীস পরস্পর-বিরোধী হয় তখন সমন্বয় সাধনের অন্যান্য উপায় না থাকলে ঘটনসূচক হাদীসটিকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কারণ কেউ যদি কিছু ঘটতে না দেখে তবে তার অর্থ এই নয় যে, তা ঘটেই নি। তাই যে ঘটতে দেখেছে তার কথাটিকে ঘটার প্রমাণ স্বরূপ গ্রহণ করা হয়।

মোট কথা, যুলহাজ্জ মাসের এই নয় দিনে রোযা রাখা মুস্তাহাব। ইমাম নববী (রহ) বলেন, ‘ঐ দিনগুলিতে রোযা রাখা পাকা মুস্তাহাব।’[4]

যদি কেউ যুলহাজ্জের প্রথম তারীখ থেকে রোযা রাখতে সক্ষম না হয়, তাহলে অন্ততঃপক্ষে তাকে এ মাসের ৯ম তারীখে রোযা রাখতে অবশ্যই চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু রসূল (সা.) তার গুরুত্ব ও ফযীলতের উপর উম্মতকে বিশেষভাবে অবহিত ক’রে রোযা রাখতে অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘‘আরাফার দিন রোযা অতীত এক বছর ও আগামী এক বছরের পাপের প্রায়শ্চিত্ত করে।’’[5]

পূর্ব ও পশ্চিমের দেশগুলিতে আরাফার দিন ১/২ দিন পরে হয়। সুতরাং ঐ সকল দেশের লোকেরা কোন দিন আরাফার রোযা রাখবে? এ নিয়ে অবশ্য মতভেদ রয়েছে। অতএব তারা যদি উক্ত নয় দিনই রোযা পালন করে, তাহলে উত্তম হয়। নচেৎ রাত্রির শেষ তৃতীয়াংশ এবং আল্লাহর নিচের আকাশে অবতরণ যেমন একই সময় সম্ভব নয়, অনুরূপ ঈদ ও আরাফা ইত্যাদির দিন একই দিন হওয়া জরুরী নয়। সকলেই সওয়াবের অধিকারী হবে ইন শাআল্লাহ।

২। তাকবীর পাঠঃ-

এই দিনগুলিতে তাকবীর, তাহমীদ, তাহলীল ও তাসবীহ পাঠ করা সুন্নাত এবং তা উচ্চস্বরে মসজিদে, ঘরে, পথে ও বাজারে এবং সেই সকল স্থানে যেখানে আল্লাহর যিকর বৈধ - পাঠ করা মুস্তাহাব। এই তাকবীর পুরুষরা উচ্চস্বরে বলবে এবং মহিলারা চুপেচুপে। যার মাধ্যমে আল্লাহর ইবাদত প্রচারিত হবে এবং ঘোষিত হবে তাঁর অনুপম তা’যীম। এ বিষয়ে আল্লাহ তাআলা বলেন,

(لِيَشْهَدُوا مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَيْهِ فِيْ أَيَّامٍ مَّعْلُوْمَاتٍ عَلى مَا رَزَقَهُمْ مِّنْ بَهِيْمَةِ الأَنْعَام)

অর্থাৎ, ‘‘যাতে ওরা কল্যাণ লাভ করে এবং নির্দিষ্ট জানা দিনগুলিতে আল্লাহর নাম স্মরণ করে- পশু হতে তিনি তাদেরকে যে জীবনোপকরণ দান করেছেন তার উপর --।’’[6]

অধিকাংশ ব্যাখ্যাতার মতে ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ অর্থাৎ যুলহাজ্জের প্রথম দশ দিন। ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ হল (যুলহাজ্জের) দশ দিন এবং ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ হল তাশরীকের কয়েকটি দিন।’’[7] অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘নির্দিষ্ট জানা দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের পূর্বের দিনগুলি; তারবিয়ার দিন এবং আরাফার দিন। আর ‘নির্দিষ্ট সংখ্যক দিন’ অর্থাৎ তাশরীকের দিনগুলি।

আর এই মতই ইবনে কাসীর আবূ মূসা আশআরী, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ, আত্বা, সাঈদ বিন জুবাইর, হাসান, যাহহাক, আত্বা খুরাসানী, ইবরাহীম নাখয়ী হতে বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন যে, ‘এই মত ইমাম শাফেয়ীর। আর ইমাম আহমদ বিন হাম্বল হতে এটাই প্রসিদ্ধ।’[8]

সুতরাং এই কথার ভিত্তিতে আয়াতে উল্লেখিত আল্লাহর যিকর (স্মরণ) করার অর্থ হবে, আল্লাহ পাক যে গবাদি পশু মানুষের রুযীরূপে দান করেছেন তার উপর তাঁর প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা (শুকরিয়া আদায় করা) এবং এতে তাকবীর ও কুরবানী যবেহ করার সময় আল্লাহর নাম নেওয়া শামিল হবে। তাই আল্লাহর যিকর বলতে কেবল যবেহকালে আল্লাহর নাম স্মরণ করাই নয়। কারণ হজ্জে কুরবানী যবেহ করার দিন ঈদের দিন হতেই শুরু হয়।[9]

এই দিনগুলিতে পঠনীয় তাকবীর নিম্নরূপঃ-

اَللهُ أَكْبَر، اللهُ أَكْبَر، لاَ إِلهَ إِلاَّ اللهُ وَاللهُ أَكْبَر، اَللهُ أَكْبَر، وَللهِ الْحَمْد

‘আল্লা-হু আকবার, আল্লা-হু আকবার, লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াল্লা-হু আকবার, আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লা-হিল হাম

এ ছাড়া অন্যান্যরূপেও তাকবীর পাঠ করার কথা পাওয়া যায়। কিন্তু আমাদের জানা মতে রসূল (সা.) হতে কোন নির্দিষ্টরূপ তাকবীর সহীহভাবে বর্ণিত হয়নি। যা কিছু এ মর্মে বর্ণিত হয়েছে সবই সাহাবাগণের আমল।[10]

ইমাম সানআনী (রহ.) বলেন, ‘তাকবীরের বহু ধরন ও রূপ আছে, বহু ইমামগণও কিছু কিছুকে উত্তম মনে করেছেন। যা হতে বুঝা যায় যে, এ বিষয়ে প্রশস্ততা আছে। আর আয়াতের সাধারণ বর্ণনা এটাই সমর্থন করে।’[11]

কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, তাকবীর এ যুগে প্রত্যাখ্যাত সুন্নতের মধ্যে পরিগণিত হয়েছে। বিশেষ করে প্রথম দশ দিনে তো অল্প কিছু মানুষ ব্যতীত আর কারো নিকট হতে তাকবীর শুনাই যায় না। তাই উচ্চস্বরে তাকবীর পড়া উচিত; যাতে সুন্নাহ জীবিত হয় এবং উদাসীনদের মনে সতর্কতা আসে।

পক্ষান্তরে এ কথা প্রমাণিত যে, ইবনে উমার (রা.) এবং আবূ হুরাইরা (রা.) এই দশ দিন বাজারে বের হতেন এবং (উচ্চস্বরে) তাকবীর পড়তেন। আর লোকেরাও তাঁদের তকবীরের সাথে তাকবীর পাঠ করত।[12] অর্থাৎ, তাঁদের তাকবীর পড়া শুনে লোকেরা তাকবীর পড়তে হয় একথা স্মরণ করত এবং প্রত্যেকেই পৃথক পৃথক তাকবীর পাঠ করত। তাঁরা একত্রিতভাবে একই সুরে সমস্বরে তাকবীর পড়তেন না।

এই দিনগুলিতে সাধারণ তাকবীর ও তাসবীহ আদি যে কোন সময়ে দিনে বা রাতে অনির্দিষ্টভাবে ঈদের নামায পর্যন্ত পাঠ করতে হয়। আর নির্দিষ্ট তাকবীর যা ফরয নামাযের জামাআতের পর (একাকী) পাঠ করা হয় আর তা অহাজীদের জন্য আরাফার (৯ম যুলহাজ্জ) দিনের ফজর থেকে এবং মক্কা শরীফে হাজীদের জন্য কুরবানীর দিনের যোহর থেকে শুরু হয় এবং তাশরীকের শেষ দিনের (১৩ই যুল হাজ্জের) আসর পর্যন্ত চলতে থাকে।

উল্লেখ্য যে, বিলীন বা বিলীয়মান কোন সুন্নাহকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করায় আল্লাহর নিকট মহা প্রতিদান ও বৃহত্তর সওয়াব রয়েছে। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের মধ্যে কোন সুন্নাত জীবিত করে যা আমার পরবর্তীকালে মৃত হয়ে পড়েছিল, তার জন্য সেই ব্যক্তির সমপরিমাণ সওয়াব হবে, যে তার উপর আমল করে এবং তাদের কারো সওয়াব কিছুও কম করা হবে না।’’[13]

৩। হাজ্জ ও উমরাহ আদায় করাঃ-

এই দশ দিনের মধ্যে হাজ্জ আদায় করা সর্বোত্তম আমলসমূহের অন্যতম। অতএব যাকে আল্লাহপাক তাঁর গৃহের হাজ্জ করার তওফীক দান করেছেন এবং যে যথার্থরূপে হাজ্জ পালন করতে প্রয়াসী হয়, সে ইনশাআল্লাহ রসূলুল্লাহ (সা.) এর এই বাণীতে তার মহাভাগ থাকবে, ‘‘মঞ্জুরকৃত হাজ্জের প্রতিদান জান্নাত ব্যতীত আর কিছু নয়।’’

৪। কুরবানী করাঃ-

এই দশ দিনের করণীয় আল্লাহর নৈকট্যদানকারী আমলের মধ্যে কুরবানী করা অন্যতম। যার বিশদ বিবরণ পরে দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ।

৫। অন্যান্য নেক ও সৎকার্যে অধিক মনোযোগ দেওয়াঃ-

এই দিনগুলিতে নেক আমল আল্লাহর নিকট অধিকতর প্রিয়। আর তা হলে অবশ্যই এই দিনসমূহের কৃত আমলের মান ও মর্যাদা তাঁর নিকট অধিক। তাই মুসলিমের উচিত, যদি হাজ্জ করা তার সামর্থ্য ও সাধ্যে না কুলায় তবে এই মূল্যবান সময়গুলিকে যেন সৎকার্য, আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য; নফল নামায, তিলাওয়াত, যিকর, দুআ, দান, পিতামাতার অধিক খিদমত, আত্মীয়তা, সৎকার্যের আদেশ ও অসৎকার্যে বাধা দান, ইত্যাদি দ্বারা আবাদ করে। অন্ততঃপক্ষে ঐ দিনগুলিতে আল্লাহর রসূল (সা.)-এর এই কথা স্মরণ করা উচিত, ‘‘যে ব্যক্তি ফজরের নামায জামাআতে আদায় করে অতঃপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর যিকরে (তাসবীহ, তাহলীল, তিলাওয়াত, ইল্ম বা দ্বীনী আলোচনায়) বসে এবং তারপর দুই রাকআত নামায পড়ে তবে এক হাজ্জ ও উমরাহর সমপরিমাণ তার সওয়াব লাভ হবে।’’[14]

আল্লাহর তরফ হতে বান্দার জন্য এটা এক সুবৃহৎ অনুগ্রহ এবং অতিশয় কল্যাণ। যার অনুগ্রহ ও করুণার শেষ নেই, যা চিন্তা ও ধারণায় কল্পনা করা যায় না। যাতে অনুমতিরও কোন স্থান নেই। যেহেতু তিনি পুরস্কর্তা ও অনুগ্রাহী। তাঁর ইচ্ছামত তিনি যা দিয়ে, যাকে ইচ্ছা, যে কোন আমলের মাধ্যমে ইচ্ছা পুরস্কৃত ও অনুগৃহীত করে থাকেন। তাঁর ইচ্ছা ও আদেশ রদ্দ করার কেউ নেই এবং কেউ তাঁর মঙ্গল ও অনুগ্রহকে রহিত করতে পারে না।

৬। বিশুদ্ধ তাওবাহ করাঃ-

এই দশ দিনে মুসলিমদের জরুরী কর্তব্যের মধ্যে আল্লাহর নিকট তাওবাহ করা, তাঁর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা, কৃতপাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং পাপ ও অবাধ্যতা থেকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিনিবৃত্ত হওয়াও উল্লেখ্য। তাওবাহ হল- আল্লাহর প্রতি প্রত্যাবর্তন করা; যে গুপ্ত অথবা প্রকাশ্য জিনিস আল্লাহ ঘৃণা করেন সেই জিনিস হতে, যা তিনি পছন্দ করেন ও ভালোবাসেন তার প্রতি, বিগত (পাপের) উপর লাঞ্ছনা ও অনুশোচনা প্রকাশ করে, বর্তমানে তা প্রত্যাখ্যান করে এবং পুনরপি তার প্রতি না ফেরার দৃঢ় সঙ্কল্প নিয়ে - ফিরে আসার নাম।

মুসলিমের জন্য ওয়াজিব; যখন সে পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে অথবা অকস্মাৎ কোন পাপ করে বসে তখন শীঘ্রতার সাথে তাওবাহর মাধ্যমে আল্লাহর নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করা এবং এ কাজে গয়ংগচ্ছ অথবা ঢিলেমি না করা। কারণ, প্রথমতঃ সে জানে না যে, তাকে কোন ঘড়িতে মরতে হবে। দ্বিতীয়তঃ এক পাপ অপর পাপকে আকর্ষণ করে। তাই সতক্ষর তাওবাহ না করলে হয়তো বা পাপের বোঝা নিয়েই মরতে হয় অথবা পাপের বোঝা আরো ভারি হতে থাকে।

গুরুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ সময়কালে তাওবাহর বড় গুণ থাকে। যেহেতু ঐ সময়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মন আনুগত্য-প্রবণ থাকে এবং সৎকাজের প্রতি হূদয় আকৃষ্যমাণ হয়। তখন হূদয় অন্যায় ও পাপকে সবীকার করতে চায় এবং কৃত পাপের উপর বড় অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়।

যদিও তাওবাহ করা এক প্রতিনিয়ত ওয়াজিব। তবুও যেহেতু তাওবাহ করা আমল কবুল হওয়ার এবং আল্লাহর ক্ষমা ও অনুগ্রহ লাভ করার হেতুসমূহের অন্যতম তথা পাপ দূরীকরণ ও মোচন হওয়ার কারণ; আবার ইবাদত আল্লাহর সান্নিধ্য ও ভালোবাসা লাভের হেতু সেহেতু মুসলিম যখন বিশুদ্ধ তাওবাহর সাথে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মর্যাদাপূর্ণ আমল করে থাকে, তখন তার উভয়বিদ অতিরিক্ত কল্যাণ লাভ হয়; যা সফলতার প্রতি ঈঙ্গিত করবে ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ পাক বলেন,

(فَأَمَّا مَن تَابَ وَآمَنَ وَعَمِلَ صَالِحًا فَعَسَى أَن يَكُونَ مِنَ الْمُفْلِحِينَ)

অর্থাৎ, যে ব্যক্তি তাওবাহ করে ও সৎকাজ করে, সে তো অচিরে সফলকাম হবে।’’ (সূরা ক্বাসাস ৬৭ আয়াত)

মুসলিম তাওবাহ করবে পুরুষের মত। সবামী সংসর্গ ত্যাগ করার উপর প্রসব বেদনাদগ্ধা নারীর মত তাওবাহ করবে না। বরং তাওবাহ করে তাতে প্রতিষ্ঠিত থাকবে। পক্ষান্তরে পাপ যদি সংসর্গ ও পরিবেশ-দোষে হয়, তাহলে সেই সংসর্গ ও পরিবেশ ত্যাগ করে সুন্দর নির্মল ইসলামী পরিবেশ গ্রহণ করবে এবং সৎলোকদের সংসর্গ গ্রহণ করে সৎকার্যে অবিচল থাকবে।

মুসলিমের উচিত, কল্যাণময় এই শ্রেণীর মৌসমের প্রতি প্রলুব্ধ হওয়া। কারণ, তা ক্ষণস্থায়ী। নিজের সংকট মুহূর্তে সাহায্য লাভের জন্য নেক আমলের পাথেয় সংগ্রহ করা প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য। যেহেতু পৃথিবীতে অবস্থান কাল অতি অল্প। কুচের সময় আসন্ন, পথ শঙ্কাপূর্ণ, যেথায় প্রবঞ্চনার আশঙ্কাই অধিক এবং বিপদের ভয় বড়। আর নিশ্চয় আল্লাহ পাক সূক্ষ্ণ ও সর্বদ্রষ্টা এবং তাঁরই নিকট সকলের প্রত্যাবর্তনস্থল। আর ‘‘যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ সৎকাজ করবে সে তা দর্শন করবে এবং যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ অসৎকাজ করবে সে তাও দর্শন করবে।’’[15]

[1] (বুখারী ১৮০৫, মুসলিম ১১৫১নং)

[2] (সহীহ আবূ দাঊদ ২১২৯নং, নাসাঈ)

[3] (মুসলিম ১১৭৬নং)

[4] (শারহুন নববী ৮/৩২০)

[5] (মুসলিম ১৬৬২নং)

[6] (সূরা হাজ্জ ২৮ আয়াত)

[7] (বুখারী ২/৪৫৭)

[8] (তাফসীর ইবনে কাসীর, আযওয়াউল বায়ান ৫/৪৯৭)

[9] (ফতোয়া ইবনে তাইমিয়াহ ২৪/২২৫)

[10] (ইরওয়াউল গালীল ৩/১২৫)

[11] (সুবুলুস সালাম ২/১২৫)

[12] (বুখারী)

[13] (তিরমিযী)

[14] (তিরমিযী)

[15] (সূরা যিলযাল ৭-৮আয়াত)

কুরবানীর ইতিহাস খুবই প্রাচীন। সেই আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর যুগ থেকেই কুরবানীর বিধান চলে আসছে। আদম (আলাইহিস সালাম)-এর দুই ছেলে হাবীল ও কাবীলের কুরবানী পেশ করার কথা আমরা মহাগ্রন্থ আল-কুরআন থেকে জানতে পারি। মহান আল্লাহ বলেন,

(وَاتْلُ عَلَيْهِمْ نَبَأَ ابْنَيْ آدَمَ بِالْحَقِّ إِذْ قَرَّبَا قُرْبَاناً فَتُقُبِّلَ مِنْ أَحَدِهِمَا وَلَمْ يُتَقَبَّلْ مِنْ الآخَرِ قَالَ لأَقْتُلَنَّكَ قَالَ إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنْ الْمُتَّقِينَ)

অর্থাৎ, আদমের দুই পুত্রের (হাবিল ও কাবিলের) বৃত্তান্ত তুমি তাদেরকে যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও, যখন তারা উভয়ে কুরবানী করেছিল, তখন একজনের কুরবানী কবুল হল এবং অন্য জনের কুরবানী কবুল হল না। তাদের একজন বলল, আমি তোমাকে অবশ্যই হত্যা করব। অপরজন বলল, আল্লাহ তো সংযমীদের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।[1]

কুরবানীর বিধান প্রত্যেক জাতির জন্যই ছিল।

মহান আল্লাহ বলেন,

(وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكاً لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الأَنْعَامِ فَإِلَهُكُمْ إِلَهٌ وَاحِدٌ فَلَهُ أَسْلِمُوا وَبَشِّرْ الْمُخْبِتِينَ - الَّذِينَ إِذَا ذُكِرَ اللهُ وَجِلَتْ قُلُوبُهُمْ وَالصَّابِرِينَ عَلَى مَا أَصَابَهُمْ وَالْمُقِيمِ الصَّلاةِ وَمِمَّا رَزَقْنَاهُمْ يُنْفِقُونَ)

অর্থাৎ, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্য কুরবানীর বিধান দিয়েছি; যাতে আমি তাদেরকে জীবনোপকরণ সবরূপ যে সব চতুষ্পদ জন্তু দিয়েছি সেগুলির উপর আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে। তোমাদের উপাস্য একমাত্র উপাস্য। সুতরাং তোমরা তাঁরই নিকট আত্মসমর্পণ কর। আর সুসংবাদ দাও বিনীতগণকে; যাদের হূদয় ভয়ে কম্পিত হয় আল্লাহর নাম স্মরণ করা হলে, যারা তাদের বিপদ-আপদে ধৈর্যধারণ করে, নামায কায়েম করে এবং আমি তাদেরকে যে রুযী দিয়েছি তা হতে ব্যয় করে।[2]

ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর কুরবানীর আদর্শ হওয়ার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِن شَاء اللهُ مِنَ الصَّابِرِينَ- فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ- وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ- قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلَاء الْمُبِينُ- وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ - وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ)

অর্থাৎ, অতঃপর সে (ইসমাঈল) যখন পিতা (ইবরাহীমের)র সাথে চলা-ফিরার (কাজ করার) বয়সে উপনীত হল, তখন ইবরাহীম তাকে বলল, ‘হে বেটা! আমি সবপ্নে দেখি যে, তোমাকে যবেহ করছি; এখন তোমার অভিমত কি দেখ।’ সে বলল, ‘আববা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে, আপনি তা পালন করুন। ইনশাআল্লাহ, আপনি আমাকে ধৈর্যশীলরূপে পাবেন।’ অনন্তর পিতা-পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করল এবং ইবরাহীম তাকে যবেহ করার জন্য অধোমুখে শায়িত করল, তখন আমি ডেকে বললাম, ‘হে ইবরাহীম! তুমি তো স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করে দেখালে। আমি এভাবেই সৎকর্মীদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয় এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আর আমি তার পরিবর্তে যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু দিয়ে তাকে মুক্ত করে নিলাম। আর তার জন্য এ বিষয়টি পরবর্তীদের জন্য স্মরণীয় করে রাখলাম।[3]

প্রকাশ যে, স্বপ্ন দেখে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর ৩ সকাল উঁট কুরবানী করার কথা শুদ্ধ নয়।

‘‘ওরে হত্যা নয় আজ ‘সত্য-গ্রহ’ শক্তির উদ্বোধন!

এই দিনই মিনা-ময়দানে

পুত্র-স্নেহের গর্দানে

ছুরি হেনে খুন ক্ষরিয়ে নে’

রেখেছে আববা ইবরাহীম সে আপনা রুদ্র পণ!’’

[1] (সূরা মাইদাহ ২৭ আয়াত)

[2] (সূরা হাজ্জ ৩৪-৩৫)

[3] (সূরা সাফফাত ১০২-১০৮)

‘উযহিয়্যাহ’ কুরবানীর দিনসমূহে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যে যবেহ-যোগ্য উট, গরু, ছাগল বা ভেঁড়াকে বলা হয়। উক্ত শব্দটি ‘যুহা’ শব্দ থেকে গৃহীত যার অর্থ পূর্বাহ্ন। যেহেতু কুরবানী যবেহ করার উত্তম বা আফযল সময় হল ১০ই যুলহজ্জের (ঈদের দিনের) পূর্বাহ্নকাল। তাই ঐ সামঞ্জস্যের জন্য তাকে ‘উযহিয়্যাহ’ বলা হয়েছে। যাকে ‘যাহিয়্যাহ’ বা ‘আযহাহ’ও বলা হয়। আর ‘আযহাহ’ এর বহুবচন ‘আযহা’। যার সাথে সম্পর্ক জুড়ে ঈদের নাম হয়েছে ‘ঈদুল আযহা’। বলা বাহুল্য, ঈদুযযোহা কথাটি ঠিক নয়।

কুরবানী শব্দটিও ‘কুর্ব’ ধাতু থেকে গঠিত। যার অর্থ নৈকট্য। কুরবান হল, প্রত্যেক সেই বস্তু, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। আর সেখান থেকেই ফারসী বা উর্দু-বাংলাতে গৃহীত হয়েছে ‘কুরবানী’ শব্দটি।

কুরবানী করা কিতাব, সুন্নাহ ও সর্বাদিসম্মতিক্রমে বিধেয়।

আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ)

‘অতএব তুমি নামায পড় তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে এবং কুরবানী কর।[1]

এই আয়াত শরীফে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী (সা.)-কে নামায ও কুরবানী এই দু’টি ইবাদাতকে একত্রিত করে পালন করতে আদেশ করেছেন। যে দু’টি বৃহত্তম আনুগত্যের অন্যতম এবং মহত্তম সামীপ্যদানকারী ইবাদত। আল্লাহর রসূল (সা.) সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করেছেন। সুতরাং তিনি ছিলেন অধিক নামায কায়েমকারী ও অধিক কুরবানীদাতা। ইবনে উমার (রা.) বলেন, ‘‘নবী (সা.) দশ বছর মদীনায় অবস্থানকালে কুরবানী করেছেন।’’[2]

আনাস (রা.) বলেন, ‘রসূল (সা.) দীর্ঘ (ও সুন্দর) দু’শিংবিশিষ্ট সাদা-কালো মিশ্রিত (মেটে বা ছাই) রঙের দু’টি দুম্বা কুরবানী করেছেন।’[3]

তিনি কোন বছর কুরবানী ত্যাগ করতেন না।[4] যেমন তিনি তাঁর কর্ম দ্বারা কুরবানী করতে উম্মতকে অনুপ্রাণিত করেছেন, তেমনি তিনি তাঁর বাক্য দ্বারাও উদ্বুদ্ধ ও তাকীদ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, ‘‘যে ব্যক্তি (ঈদের) নামাযের পূর্বে যবেহ করে সে নিজের জন্য যবেহ করে। আর যে নামাযের পরে যবেহ করে তার কুরবানী সিদ্ধ হয় এবং সে মুসলমানদের তরীকার অনুসারী হয়।’’[5]

তিনি আরো বলেন, ‘‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানী করে না, সে যেন অবশ্যই আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’’[6]

সকল মুসলিমগণ কুরবানী বিধেয় হওয়ার ব্যাপারে একমত। এ ব্যাপারে কারো কোন দ্বিমত নেই।[7]

তবে কুরবানী করা ওয়াজিব না সুন্নাত -এ নিয়ে মতান্তর আছে। আর দুই মতেরই দলীল প্রায় সমানভাবে বলিষ্ঠ। যাতে কোন একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব সহজ নয়। যার জন্য কিছু সংস্কারক ও চিন্তাবিদ্ উলামা কুরবানী ওয়াজিব হওয়ার পক্ষ সমর্থন করেন। তাঁদের মধ্যে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রঃ) অন্যতম। কিন্তু অধিকাংশ সাহাবা, তাবেয়ীন এবং ফকীহগণের মতে কুরবানী সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ (তাকীদপ্রাপ্ত সুন্নাত)। অবশ্য মুসলিমের জন্য মধ্যপন্থা এই যে, সামর্থ্য থাকতে কুরবানী ত্যাগ না করাই উচিত। ([8]) উচিত নিজের ও পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে কুরবানী করা। যাতে আল্লাহর আদেশ পালনে এবং মহানবী (সা.)-এর অনুকরণে বিরাট সওয়াবের অধিকারী হতে পারে।

বস্তুতঃ কুরবানীতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে ইবাদতের খাতে অর্থব্যয় (ও স্বার্থত্যাগ) হয়। যাতে তাওহীদবাদীদের ইমাম ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম)-এর সুন্নাহ জীবিত হয়। ইসলামের একটি প্রতীকের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। পরিবার ও দরিদ্রজনের উপর খরচ করা হয় এবং আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের জন্য হাদিয়া ও উপঢৌকন পেশ করা হয়। এত কিছুর মাধ্যমে মুসলিম ঈদের খুশীর স্বাদ গ্রহণ করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর আনুগত্য করতে পেরেই মুসলিম আনন্দলাভ করতে পারে। সেই খুশীই তার আসল খুশী। রমযানের সারা দিন রোযা শেষে ইফতারের সময় তার খুশী হয়। পূর্ণ এক মাস রোযা করে সেই বিরাট আনুগত্যের মাধ্যমে ঈদের দিনে তারই আনন্দ অনুভব করে থাকে। এই খুশীই তার যথার্থ খুশী। বাকী অন্যান্য পার্থিব সুখ-বিলাসের খুশী খুশী নয়। বরং তা সর্বনাশের কদমবুসী। আল্লাহ তা‘আলা কিছু জাহান্নামবাসীদের উদ্দেশ্যে বলবেন, ‘‘এ এ কারণে যে, তোমরা পৃথিবীতে অযথা আনন্দ করতে ও দম্ভ প্রকাশ করতে।’’[9]

কারুনের পার্থিব উৎফুল্লতা স্মরণ করিয়ে তিনি বলেন,

(إِذْ قَالَ لَهُ قَوْمُهُ لاَ تَفْرَحْ إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْفَرِحِينَ)

‘‘স্মরণ কর, তার সম্প্রদায় তাকে বলেছিল, (দর্পময়) আনন্দ করো না। অবশ্যই আল্লাহ (দর্পময়) আনন্দকারীদেরকে পছন্দ করেন না।’’[10]

অতঃপর জ্ঞাতব্য যে, যেমন হাজ্জ না করে তার খরচ সদকাহ করলে ফরয আদায় হয় না, তেমনি কুরবানী না করে তার মূল্য সদকাহ করে অভীষ্ট সুন্নাত আদায় হয় না। যেহেতু যবেহ হল আল্লাহর তা’যীম-সম্বলিত একটি ইবাদত এবং তাঁর দ্বীনের এক নিদর্শন ও প্রতীক। আর মূল্য সদকাহ করলে তা বাতিল হয়ে যায়।

পক্ষান্তরে কুরবানী নবী (সা.)-এর সুন্নাহ এবং সমগ্র মুসলিম জাতির এক আমল। আর কোথাও কথিত নেই যে, তাঁদের কেউ কুরবানীর পরিবর্তে তার মূল্য সদকাহ করেছেন। আবার যদি তা উত্তম হত, তাহলে তাঁরা নিশ্চয় তার ব্যতিক্রম করতেন না।[11]

ইবনুল কাইয়্যেম (রঃ) বলেন, ‘যবেহ তার সবস্থানে কুরবানীর মূল্য সদকাহ করা অপেক্ষা উত্তম। যদিও সে মূল্য কুরবানীর চেয়ে পরিমাণে অধিক হয়। কারণ, আসল যবেহই উদ্দেশ্য ও অভীষ্ট। যেহেতু কুরবানী নামাযের সংযুক্ত ইবাদত।

যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, (فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ)

অর্থাৎ, অতএব তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে নামায পড় ও কুরবানী কর।[12]

তিনি অন্যত্র বলেন,

(قُلْ إِنَّ صَلاَتِيْ وَنُسُكِيْ وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِيْ للهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ)

অর্থাৎ, বল, অবশ্যই আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন, আমার মৃত্যু বিশ্বজগতের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যই।[13]

বলা বাহুল্য, প্রত্যেক ধর্মাদর্শে নামায ও কুরবানী আছে; যার বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। আর এই জন্যই যদি কোন হাজী তার তামাত্তু’ বা ক্বিরান হাজ্জের কুরবানীর বদলে তার তিনগুণ অথবা তার থেকে বেশী মূল্য সদকাহ করে তবে তার পরিবর্তে হবে না। অনুরূপভাবে কুরবানীও। আর আল্লাহই অধিক জানেন।[14]

আরো জ্ঞাতব্য বিষয় এই যে, মূলতঃ কুরবানী যথাসময়ে জীবিত ব্যক্তির তরফ থেকেই প্রার্থনীয়। অবশ্য সে ইচ্ছা করলে তার সওয়াবে জীবিত অথবা মৃত আত্মীয়-স্বজনকেও শরীক করতে পারে। যেহেতু নবী (সা.) তাঁর সাহাবাবৃন্দ (রা.) নিজেদের এবং পরিবার-পরিজনদের তরফ থেকে কুরবানী করতেন।

একাধিক মৃতব্যক্তিকে একটি মাত্র কুরবানীর সওয়াবে শরীক করাও বৈধ; যদি তাদের মধ্যে কারো উপর কুরবানী ওয়াজিব (নযর) না থাকে তবে। রসূল (সা.) নিজের তরফ থেকে, পরিবার-পরিজনের তরফ থেকে এবং সেই উম্মতের তরফ থেকে কুরবানী করেছেন; যারা আল্লাহর জন্য তাওহীদের সাক্ষ্য দিয়েছে এবং তাঁর জন্য রিসালাত বা প্রচারের সাক্ষ্য দিয়েছে।[15] আর বিদিত যে, ঐ সাক্ষ্য প্রদানকারী কিছু উম্মত তাঁর যুগেই মারা গিয়েছিল। অতএব একই কুরবানীতে কেউ নিজ মৃত পিতামাতা ও দাদা-দাদীকেও সওয়াবে শামিল করতে পারে।

মৃতব্যক্তির তরফ থেকে পৃথক কুরবানী করার কোন দলীল নেই। তবে করা যায়। যেহেতু কুরবানী করা এক প্রকার সদকাহ। আর মৃতের তরফ থেকে সদকাহ করা সিদ্ধ; যা যথা প্রমাণিত এবং মৃতব্যক্তি তার দ্বারা উপকৃতও হবে - ইনশাআল্লাহ। পরন্তু মৃতব্যক্তি এই শ্রেণীর পুণ্যকর্মের মুখাপেক্ষীও থাকে।

তবুও একটি কুরবানীকে নিজের তরফ থেকে না দিয়ে কেবলমাত্র মৃতের জন্য নির্দিষ্ট করা ঠিক নয় এবং এতে আল্লাহ তাআলার সীমাহীন করুণা থেকে বঞ্চিত হওয়া উচিত নয়। বরং উচিত এই যে, নিজের নামের সাথে জীবিত-মৃত অন্যান্য আত্মীয়-পরিজনকে কুরবানীর নিয়তে শামিল করা। যেমন আল্লাহর নবী (সা.) কুরবানী যবেহ করার সময় বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! এ (কুরবানী) মুহাম্মদের তরফ থেকে এবং মুহাম্মদের বংশধরের তরফ থেকে।’ সুতরাং তিনি নিজের নাম প্রথমে নিয়েছেন এবং সেই সঙ্গে বংশধরদেরকেও তার সওয়াবে শরীক করেছেন।

পক্ষান্তরে মৃতব্যক্তি যদি তার এক তৃতীয়াংশ সম্পদ থেকে কাউকে কুরবানী করতে অসীয়ত করে যায়, অথবা কিছু ওয়াকফ করে তার অর্জিত অর্থ থেকে কুরবানীর অসীয়ত করে যায়, তবে অসীর জন্য তা কার্যকর করা ওয়াজিব। কুরবানী না করে ঐ অর্থ সদকাহ খাতে ব্যয় করা বৈধ নয়। কারণ, তা সুন্নাহর পরিপন্থী এবং অসিয়তের রূপান্তর। অন্যথা যদি কুরবানীর জন্য অসিয়তকৃত অর্থ সংকুলান না হয়, তাহলে দুই অথবা ততোধিক বছরের অর্থ একত্রিত করে কুরবানী দিতে হবে। অবশ্য নিজের তরফ থেকে বাকী অর্থ পূরণ করে কুরবানী করলে তা সর্বোত্তম। মোটকথা অসীর উচিত, সূক্ষ্ণভাবে অসীয়ত কার্যকর করা এবং যাতে মৃত অসিয়তকারীর উপকার ও লাভ হয় তারই যথার্থ প্রয়াস করা।

জ্ঞাতব্য যে, রসূল (সা.) কর্তৃক আলী (রা.)-কে কুরবানীর অসিয়ত করার হাদীসটি যইফ।[16] পরন্তু নবীর নামে কুরবানী করা আমাদের জন্য বিধেয় নয়। তিনি ঈসালে-সওয়াবের মুখাপেক্ষীও নন।

উল্লেখ্য যে, মুসাফির হলেও তার জন্য কুরবানী করা বিধেয়। আল্লাহর রসূল (রা.) মিনায় থাকাকালে নিজ স্ত্রীগণের তরফ থেকে গরু কুরবানী করেছেন।[17]

[1] (সূরা আল কাউসার ২ আয়াত)

[2] (মুসনাদ আহমাদ, তিরমিযী)

[3] (বুখারী, মুসলিম)

[4] (যাদুল মাআদ ২/৩১৭)

[5] (বুখারী ৫২২৬নং)

[6] (মুসনাদ আহমাদ ২/৩২১, ইবনে মাজাহ ২/১০৪৪, হাকেম ২/৩৮৯)

[7] (মুগনী ১৩/৩৬০, ফাতহুল বারী ১০/৩)

([8]) অপরের দান বা সহযোগিতা নিয়ে হজ্জ বা কুরবানী করলে তা পালন হয়ে যাবে এবং দাতা ও কর্তা উভয়েই সওয়াবের অধিকারী হবে। ঋণ করে কুরবানী দেওয়া জরুরী নয়। যেমন সামর্থ্যবান কোন অসী বা মুআক্কেলের কুরবানী যবেহ করলে, তার নিজের তরফ থেকে কুরবানী মাফ হয়ে যাবে না।

[9] (সূরা মু’মিন ৭৫ আয়াত)

[10] (সূরা কাসাস ৭৬ আয়াত)

[11] (ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়্যাহ ২৬/৩০৪)

[12] (সূরা আল কাউসার ২)

[13] (সূরা আনআম ১৬২ আয়াত)

[14] (তুহফাতুল মাওদূদ ৩৬পৃঃ)

[15] (মুসনাদ আহমাদ ৬/৩৯১-৩৯২, বাইহাকী ৯/২৬৮)

[16] (যইফ আবু দাউদঃ ৫৯৬নং, যইফ তিরমিযীঃ ২৫৫নং, যইফ ইবনু মাজাহঃ ৬৭২নং, মিশকাতঃ ১৪৬২নং হাদীসের টীকা দ্রঃ)

[17] (বুখারী ২৯৪, ৫৫৪৮, মুসলিম ১৯৭৫নং, বাইহাকী ৯/২৯৫)
কুরবানীর মাহাত্ম্য সংক্রান্ত প্রচলিত কতিপয় অচল হাদীস
  • কুরবানীর জানোয়ার কিয়ামতের দিন তার শিং ও পশম এবং খুরসহ অবশ্যই হাজির হবে---।[1]
  • কুরবানী তোমাদের পিতা ইবরাহীমের সুন্নত। তার প্রত্যেকটি লোমের পরিবর্তে রয়েছে একটি করে নেকী।[2]
  • কুরবানীর প্রথম বিন্দু রক্তের সাথে পূর্বেকার সমস্ত গোনাহ মাফ হয়ে যায়। পশুটিকে তার রক্ত ও মাংসসহ দাঁড়িপাল্লাতে ৭০ গুণ ভারী করে দেওয়া হবে।[3]
  • ভালো মনে সওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করলে তা জাহান্নাম থেকে পর্দার মত হবে[4]
  • তোমরা তোমাদের কুরবানীকে মোটা-তাজা কর। কারণ তা তোমাদের পুলসিরাত পারের সওয়ারী।[5]
[1] (যয়ীফ, যয়ীফ তারগীব ৬৭১নং)

[2] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭২নং)

[3] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭৪-৬৭৫নং)

[4] (হাদীসটি জাল, যয়ীফ তারগীব ৬৭৭নং)

[5] (অতি দুর্বল, সিলসিলাহ যয়ীফাহ ১২৫৫নং)

কুরবানী করা আল্লাহর এক ইবাদত। আর কিতাব ও সুন্নাহয় এ কথা প্রমাণিত যে, কোন আমল নেক, সালেহ বা ভালো হয় না, কিংবা গৃহীত ও নৈকট্যদানকারী হয় না; যতক্ষণ না তাতে দু’টি শর্ত পূরণ হয়েছে;

প্রথমতঃ ইখলাস। অর্থাৎ, তা যেন খাঁটি আল্লাহরই উদ্দেশ্যে হয়। তা না হলে তা আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না। যেমন কাবীলের নিকট থেকে কুরবানী কবুল করা হয়নি এবং তার কারণ স্বরূপ হাবীল বলেছিলেন,

(إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ)

অর্থাৎ, আল্লাহ তো মুত্তাক্বী (পরহেযগার ও সংযমী)দের কুরবানীই কবুল করে থাকেন।[1]

এ ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন,

(لَن يَنَالَ اللهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ كَذَلِكَ سَخَّرَهَا لَكُمْ لِتُكَبِّرُوا اللهَ عَلَى مَا هَدَاكُمْ وَبَشِّرِ الْمُحْسِنِينَ)

অর্থাৎ, আল্লাহর কাছে কখনোও ওগুলির মাংস পৌঁছে না এবং রক্তও না; বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া (সংযমশীলতা); এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এই জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। আর তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।[2]

দ্বিতীয়তঃ তা যেন আল্লাহ ও তদীয় রসূলের নির্দেশিত বিধি-বিধান অনুযায়ী হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(فَمَنْ كَانَ يَرْجُوا لِقَاءَ رَبِّهِ فَلْيَعْمَلْ عَمَلاً صَالِحاً وَّلاَ يُشْرِكْ بِعِبَادَةِ رَبِّهِ أَحَدا)

অর্থাৎ, যে তার প্রতিপালকের সাক্ষাৎ কামনা করে, সে যেন সৎকর্ম করে এবং তার প্রতিপালকের ইবাদতে কাউকে শরীক না করে।[3]

সুতরাং যারা কেবল বেশী করে মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে কুরবানী দেয় অথবা লোক সমাজে নাম কুড়াবার উদ্দেশ্যে মোটা-তাজা অতিরিক্ত মূল্যের পশু ক্রয় করে এবং তা প্রদর্শন ও প্রচার করে থাকে তাদের কুরবানী যে ইবাদত নয় -তা বলাই বাহুল্য।

মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্য থাকে বলেই লোকে একই মূল্যের একটি গোটা কুরবানী না দিয়ে একটি ভাগ দিয়ে থাকে। বলে, একটি ছাগল দিলে দু’দিনেই শেষ হয়ে যাবে। লোকের ছেলেরা খাবে, আর আমার ছেলেরা তাকিয়ে দেখবে? উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট।

[1] (সূরা মায়িদাহ ২৭ আয়াত)
[2] (সূরা হাজ্জ ৩৭ আয়াত)
[3](সূরা কাহফ ১১০ আয়াত)

কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছেঃ-

১। কুরবানীর পশু যেন সেই শ্রেণী বা বয়সের হয় যে শ্রেণী ও বয়স শরীয়ত নির্ধারিত করেছে। আর নির্ধারিত শ্রেণীর পশু চারটি; উঁট, গরু, ভেঁড়া ও ছাগল। অধিকাংশ উলামাদের মতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট কুরবানী হল উঁট, অতঃপর গরু, তারপর মেষ (ভেঁড়া), তারপর ছাগল। আবার নর মেষ মাদা মেষ অপেক্ষা উত্তম। যেহেতু এ প্রসঙ্গে দলীল বর্ণিত হয়েছে।[1]

একটি উঁট অথবা গরুতে সাত ব্যক্তি কুরবানীর জন্য শরীক হতে পারে।[2] অন্য এক বর্ণনা মতে উঁট কুরবানীতেও দশ ব্যক্তি শরীক হতে পারে। ইমাম শাওকানী (রহ.) বলেন, হাজ্জের কুরবানীতে দশ এবং সাধারণ কুরবানীতে সাত ব্যক্তি শরীক হওয়াটাই সঠিক।[3]

কিন্তু মেষ বা ছাগে ভাগাভাগি বৈধ নয়। তবে তার সওয়াবে একাধিক ব্যক্তিকে শরীক করা যাবে। সুতরাং একটি পরিবারের তরফ থেকে মাত্র একটি মেষ বা ছাগ যথেষ্ট হবে। তাতে সেই পরিবারের লোক-সংখ্যা যতই হোক না কেন।

কিন্তু উঁট বা গরুর এক সপ্তাংশ একটি পরিবারের তরফ থেকে যথেষ্ট হবে কি? এ নিয়ে উলামাগণের মাঝে মতান্তর রয়েছে। কেউ বলেন, যথেষ্ট নয়। কারণ, তাতে ৭ জনের অধিক ব্যক্তির শরীক হওয়া বৈধ নয়। তা ছাড়া পরিবারের তরফ থেকে একটি পূর্ণ ‘দম’ (জান) যথেষ্ট হবে। আর ৭ ভাগের ১ ভাগ পূর্ণ দম নয়।[4]

অনেকের মতে একটি মেষ বা ছাগের মতই এক সপ্তাংশ উঁট বা গরু যথেষ্ট হবে।[5]

বলা বাহুল্য, একটি পরিবারের তরফ থেকে এক বা দুই ভাগ গরু কুরবানী দেওয়ার চাইতে ১টি ছাগল বা ভেঁড়া দেওয়াটাই অধিক উত্তম।

কুরবানীর সাথে একটি ভাগ আকীকার উদ্দেশ্যে দেওয়া যথেষ্ট নয়। যেমন যথেষ্ট নয় একটি পশু কুরবানী ও আকীকার নিয়তে যবেহ করা। কুরবানী ও আকীকার জন্য পৃথক পৃথক পশু হতে হবে। অবশ্য যদি কোন শিশুর আকীকার দিন কুরবানীর দিনেই পরে এবং আকীকা যবেহ করে, তাহলে আর কুরবানী না দিলেও চলে। যেমন, দুটি গোসলের কারণ উপস্থিত হলে একটি গোসল করলেই যথেষ্ট, জুমআর দিনে ঈদের নামায পড়লে আর জুমআহ না পড়লেও চলে, বিদায়ের সময় হাজ্জের তওয়াফ করলে আর বিদায়ী তওয়াফ না করলেও চলে, যোহরের সময় মসজিদে প্রবেশ করে যোহরের সুন্নাত পড়লে পৃথক করে আর তাহিয়্যাতুল মাসজিদ পড়তে হয় না এবং তামাত্তু হাজ্জের কুরবানী দিলে আর পৃথকভাবে কুরবানী না দিলেও চলে।[6]

বয়সের দিক দিয়ে উঁটের পাঁচ বছর, গরুর দুই বছর এবং মেষ ও ছাগের এক বছর হওয়া জরুরী। অবশ্য অসুবিধার ক্ষেত্রে ছয় মাস বয়সী মেষ কুরবানী করা যায়। প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘‘দাঁতালো ছাড়া যবেহ করো না। তবে তা দুর্লভ হলে ছয় মাসের মেষ যবেহ কর।’’[7]

কিন্তু উলামাগণ এ বিষয়ে একমত যে, ছ’মাস বয়সী মেষের কুরবানী সিদ্ধ হবে; তা ছাড়া অন্য পশু পাওয়া যাক অথবা না যাক। অধিকাংশ উলামাগণ ঐ হাদীসের আদেশকে ‘ইস্তিহবাব’ (উত্তম) বলে গ্রহণ করেছেন এবং বলেছেন যে, ঐ হাদীসের মর্মার্থ এ নয় যে, অন্য কুরবানীর পশু না পাওয়া গেলে তবেই ছ’মাস বয়সের মেষ শাবকের কুরবানী বৈধ। যেহেতু এমন অন্যান্য দলীলও রয়েছে যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঐ বয়সী মেষেরও কুরবানী বৈধ; প্রকাশতঃ যদিও কুরবানীদাতা অন্য দাঁতালো পশু পেয়েও থাকে। যেমন রসূল (সা.) বলেন, ‘‘ছ’মাস বয়সী মেষশাবক উত্তম কুরবানী।’’[8]

উক্ববাহ বিন আমের (রা.) বলেন, (একদা) নবী (সা.) কুরবানীর পশু বিতরণ করলেন। উকবার ভাগে পড়ল এক ছয় মাসের মেষ। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রসূল! আমার ভাগে ছয় মাসের মেষ হল?’ প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘‘এটা দিয়েই তুমি কুরবানী কর।’’[9]

 

২। পশু যেন নিম্নোক্ত ত্রুটিসমূহ থেকে মুক্ত হয়;

(ক) এক চোখে স্পষ্ট অন্ধত্ব। (খ) স্পষ্ট ব্যাধি। (গ) স্পষ্ট খঞ্জতা। (ঘ) অন্তিম বার্ধক্য। এ ব্যাপারে আল্লাহর রসূল (সা.) বলেন, ‘‘চার রকমের পশু কুরবানী বৈধ বা সিদ্ধ হবে না; (এক চক্ষে) স্পষ্ট অন্ধত্বে অন্ধ, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খঞ্জতায় খঞ্জ এবং দুরারোগ্য ভগ্নপদ।’’[10]

অতত্রব এই চারের কোন এক ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারা কুরবানী সিদ্ধ হয় না। ইবনে কুদামাহ (রহ.) বলেন, ‘এ বিষয়ে কোন মতভেদ আমরা জানি না।’[11]

[1] (আযওয়াউল বায়ান ৫/৬৩৪)

[2] (মুসলিম ১৩১৮নং)

[3] (নাইলুল আওত্বার ৮/১২৬)

[4] (ফাতাওয়া শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম ৬/১৪৯)

[5] (মাজালিসু আশরি যিলহাজ্জাহ, শুমাইমিরী, ২৬পৃঃ আল-মুমতে’ ইবনে উসাইমীন ৭/৪৬২-৪৬৩)

[6] (মানারুস সাবীল ১/২৮০)

[7] (মুসলিম ১৯৬৩নং)

[8] (মুসনাদে আহমাদ ২/৪৪৫, তিরমিযী)

[9] (বুখারী ২১৭৮, মুসলিম ১৯৬৫নং)

[10] (আবূ দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ)

[11] (মুগনী ১৩/৩৬৯)
ত্রুটিগুলির বিস্তারিত ব্যাখ্যা নিম্নরূপ

(ক) স্পষ্ট কানা (এক চক্ষের অন্ধ) যার একটি চক্ষু ধক্ষসে গেছে অথবা বেরিয়ে আছে। দৃষ্টিহীন হলে তো অধিক ত্রুটি হবে। তবে যার চক্ষু সাদা হয়ে গেছে, কিন্তু নষ্ট হয়নি তার কুরবানী সিদ্ধ হবে। কারণ, তা স্পষ্ট কানা নয়।

(খ) স্পষ্ট রোগের রোগা; যার উপর রোগের চিহ্ন প্রকাশিত। যে চরতে অথবা খেতে পারে না; যার দরুন দুর্বলতা ও মাংসবিকৃতি হয়ে থাকে। তদনুরূপ চর্মরোগও একটি ত্রুটি; যার কারণে চর্বি ও মাংস খারাপ হয়ে থাকে। তেমনি স্পষ্ট ক্ষত একটি ত্রুটি; যদি তার ফলে পশুর উপর কোন প্রভাব পড়ে থাকে।

গর্ভধারণ কোন ত্রুটি নয়। তবে গর্ভপাত বা প্রসবের নিকটবর্তী পশু একপ্রকার রোগগ্রস্ত এবং তা একটি ক্রটি। যেহেতু গাভীন পশুর মাংস অনেকের নিকট অরুচিকর, সেহেতু জেনেশুনে তা ক্রয় করা উচিত নয়। অবশ্য কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট বা ক্রয় করার পর গর্ভের কথা জানা গেলে তা কুরবানীরূপে যথেষ্ট হবে। তার পেটের বাচ্চা খাওয়া যাবে। জীবিত থাকলে তাকে যবেহ করতে হবে। মৃত হলে যবেহ না করেই খাওয়া যাবে। কেননা, মায়ের যবেহতে সেও হালাল হয়ে যায়।[1] কারো রুচি না হলে সে কথা ভিন্ন।

(গ) দুরারোগ্য ভগ্নপদ। (ঘ) দুর্বলতা ও বার্ধক্যের কারণে যার চর্বি ও মজ্জা নষ্ট অথবা শুষ্ক হয়ে গেছে।

উল্লেখিত হাদীস শরীফটিতে উপরোক্ত ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয় বলে বিবৃত হয়েছে এবং বাকী অন্যান্য ত্রুটির কথা বর্ণনা হয়নি। কিন্তু অধিকাংশ উলামাগণের মতে, যদি ঐ ত্রুটিসমূহের অনুরূপ বা ততোধিক মন্দ ত্রুটি কোন পশুতে পাওয়া যায় তাহলে তাতেও কুরবানী সিদ্ধ হবে না; যেমন, দুই চক্ষের অন্ধ বা পা কাটা প্রভৃতি।[2]

খাত্তক্ষাবী (রঃ) বলেন, হাদীসে এ কথার দলীল রয়েছে যে, কুরবানীর পশুতে সামান্য ত্রুটি মার্জনীয়। যেহেতু হাদীসের বক্তব্য, ‘‘স্পষ্ট কানা, স্পষ্ট রোগা, স্পষ্ট খঞ্জ’’ অতএব ঐ ত্রুটির সামান্য অংশ অস্পষ্ট হবে এবং তা মার্জনীয় ও অধর্তব্য হবে।[3]

পক্ষান্তরে আরো কতকগুলি ত্রুটি রয়েছে যাতে কুরবানী সিদ্ধ হয়ে যায়; কিন্তু তা মকরূহ বলে বিবেচিত হয়। তাই এ জাতীয় ত্রুটি থেকেও কুরবানীর পশুকে মুক্ত করা উত্তম।

[1] (আহমাদ, আবূ দাঊদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, ইবনে হিববান, হাকেম, দারাকুত্বনী, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে ৩৪৩১নং)

[2] (শারহুন নওবী ১৩/২৮)

[3] (মাআলিমুস সুনান ৪/১০৬)
যে ত্রুটিযুক্ত পশুর কুরবানী মকরূহ তা নিম্নরূপ

 ১। কান কাটা বা শিং ভাঙ্গা। এর দ্বারা কুরবানী মকরূহ। তবে সিদ্ধ হয়ে যাবে। কারণ, এতে মাংসের কোন ক্ষতি বা কমি হয় না এবং সাধারণতঃ এমন ত্রুটি পশুর মধ্যে বেশী পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কিন্তু যে পশুর জন্ম থেকেই শিং বা কান নেই তার দ্বারা কুরবানী মকরূহ নয়। যেহেতু ভাঙ্গা বা কাটাতে পশু রক্তাক্ত ও ক্লিষ্ট হয়; যা এক রোগের মত। কিন্তু জন্ম থেকে না থাকাটা এ ধরনের কোন রোগ নয়। অবশ্য পূর্ণাঙ্গ পশুই আফযল।

২। লেজ কাটা - যার পূর্ণ অথবা কিছু অংশ লেজ কাটা গেছে তার কুরবানী মকরূহ। ভেড়ার পুচ্ছে মাংসপিন্ড কাটা থাকলে তার কুরবানী সিদ্ধ নয়। যেহেতু তা এক স্পষ্ট কমি এবং ইস্ফিত অংশ। অবশ্য এমন জাতের ভেঁড়া যার পশ্চাতে মাংস পিন্ড হয় না তার দ্বারা কুরবানী শুদ্ধ।

৩। কান চিরা, দৈর্ঘ্যে চিরা, পশ্চাৎ থেকে চিরা, সম্মুখ থেকে প্রস্থে চিরা, কান ফাটা ইত্যাদি।

৪। লিঙ্গ কাটা। অবশ্য মুষ্ক কাটা মকরূহ নয়। যেহেতু খাসীর দেহ হূষ্টপুষ্ট ও মাংস উৎকৃষ্ট হয়।

৫। দাঁত ভাঙ্গা ও চামড়ার কোন অংশ অগভীর কাটা বা চিরা ইত্যাদি।

কুরবানী সিদ্ধ হওয়ার তৃতীয় শর্ত হল মালিকানা। অর্থাৎ, কুরবানীদাতা যেন বৈধভাবে ঐ পশুর মালিক হয়। সুতরাং চুরিকৃত, আত্মসাৎকৃত অথবা অবৈধ ক্রয়-বিক্রয়ে ক্রীত পশুর কুরবানী সিদ্ধ নয়। তদনুরূপ অবৈধ মূল্য (যেমন সূদ, ঘুস, প্রবঞ্চনা প্রভৃতির অর্থ) দ্বারা ক্রীত পশুর কুরবানীও জায়েয নয়। যেহেতু কুরবানী এক ইবাদত যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা হয়। আর কুরবানীর পশুর মালিক হওয়ার ঐ সমস্ত পদ্ধতি হল পাপময়। আর পাপ দ্বারা কোন প্রকার নৈকট্য লাভ সম্ভব নয়। বরং তাতে দূরতক্ষ সৃষ্টি হয়। রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘আল্লাহ পবিত্র, তিনি পবিত্র ব্যতীত কিছু গ্রহণ করেন না।[1]

কুরবানীর পশু নির্ধারণে মুসলিমকে সবিশেষ যত্নবান হওয়া উচিত, যাতে পশু সর্বগুণে সম্পূর্ণ হয়। যেহেতু এটা আল্লাহর নিদর্শন ও তা’যীমযোগ্য দ্বীনী প্রতীকসমূহের অন্যতম। যা আত্মসংযম ও তাকওয়ার পরিচায়ক। আল্লাহ তাআলা বলেন,

(ذلِكَ وَمَنْ يُعَظِّمْ شَعَائِرَ اللهِ فَإِنَّهَا مَنْ تَقْوَى الْقُلُوْبِ)

অর্থাৎ, এটিই আল্লাহর বিধান এবং কেউ আল্লাহর নিদর্শনাবলীর সম্মান করলে এতো তার হূদয়ের তাকওয়া (ধর্মনিষ্ঠা)। (সূরা হজ্জ্ ৩২ আয়াত)

এ তো সাধারণ দ্বীনী প্রতীকসমূহের কথা। নির্দিষ্টভাবে কুরবানীর পশু যে এক দ্বীনী প্রতীক এবং তার যত্ন করা যে আল্লাহর সম্মান ও তা’যীম করার শামিল, সে কথা অন্য এক আয়াত আমাদেরকে নির্দেশ করে। মহান আল্লাহ বলেন,

(وَالبُدْنَ جَعَلْنَاهَا لَكُمْ مِنْ شَعَائِرِ الله)

অর্থাৎ, (কুরবানীর) উঁটকে তোমাদের জন্য আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্যতম করেছি। (সূরা হজ্জ ৩৬ আয়াত)

এখানে কুরবানী পশুর তা’যীম হবে তা উত্তম নির্বাচনের মাধ্যমে। ইবনে আববাস (রা.) প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন, ‘কুরবানী পশুর সম্মান করার অর্থ হল, পুষ্ট মাংসবহুল, সুন্দর ও বড় পশু নির্বাচন করা।’[2]

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর যুগে মুসলিমগণ দামী পশু কুরবানীর জন্য ক্রয় করতেন, মোটা-তাজা এবং উত্তম পশু বাছাই করতেন; যার দ্বারা আল্লাহর নিদর্শনাবলীর তা’যীম ঘোষণা করতেন। যা একমাত্র তাঁদের তাক্বওয়া, আল্লাহর প্রতি ভীতি ও ভালবাসা থেকে উদ্গত হত।[3]

অবশ্য মুসলিমকে এই স্থানে খেয়াল রাখা উচিত যে, মোটা-তাজা পশু কুরবানী করার উদ্দেশ্য কেবল উত্তম মাংস খাওয়া এবং আপোসে প্রতিযোগিতা করা না হয়। বরং উদ্দেশ্য আল্লাহর নিদর্শন ও ধর্মীয় এক প্রতীকের তা’যীম এবং তার মাধ্যমে আল্লাহর সামীপ্যলাভ হয়।

কালো রঙ অপেক্ষা ধূসর রঙের পশু কুরবানীর জন্য উত্তম। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘কালো রঙের দুটি কুরবানী অপেক্ষা ধূসর রঙের একটি কুরবানী আল্লাহর নিকট অধিক পছন্দনীয়।’’[4]

এ পশু ক্রয়ের সময় ত্রুটিমুক্ত দেখা ও তার বয়সের খেয়াল রাখা উচিত। যেহেতু পশু যত নিখুঁত হবে তত আল্লাহর নিকট প্রিয় হবে, সওয়াবেও খুব বড় হবে এবং কুরবানীদাতার আন্তরিক তাক্বওয়ার পরিচায়ক হবে। কারণ, ‘‘আল্লাহর কাছে ওদের (কুরবানীর পশুর) মাংস এবং রক্ত পৌঁছে না, বরং তোমাদের তাক্বওয়া (পরহেযগারী) পৌঁছে থাকে। এভাবে তিনি এদেরকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন, যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর; এ জন্য যে তিনি তোমাদেরকে পথপ্রদর্শন করেছেন। সুতরাং (হে নবী!) তুমি সৎকর্মপরায়ণদেরকে সুসংবাদ দাও।’’ (সূরা হজ্জ ৩৭ আয়াত)

কুরবানীদাতা কুরবানীর পশু ক্রয়ের পর তাকে কথা দ্বারা (মুখে বলে) কুরবানীর জন্য নির্দিষ্ট করবে এবং কুরবানীর দিন তাকে কুরবানীর নিয়তে যবেহ করবে।

যখন কোন পশু কুরবানীর বলে নির্ণীত হয়ে যাবে, তখন তার জন্য কতক আহকাম বিষয়ীভূত হবে। যেমনঃ-

১। ঐ পশুর সবতক্ষ কুরবানীদাতার হাতছাড়া হবে। ফলে তা বিক্রয় করা, হেবা করা, উৎকৃষ্টতর বিনিময়ে ছাড়া পরিবর্তন করা বৈধ হবে না। যেহেতু যা আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট হয়েছে তার ক্রয়-বিক্রয় বৈধ নয়। তবে যেহেতু ওর চেয়ে উৎকৃষ্টতর পশুর বিনিময়ে পরিবর্তন করাতে কুরবানীর মান অধিক বর্ধিত হয়, তাই তা বৈধ। আর ওর চেয়ে মন্দতর পশু দ্বারা পরিবর্তন অবৈধ। কারণ, তাতে কুরবানীর আংশিক পরিমাণ হাতছাড়া হয়।

কুরবানীর পশু নির্দিষ্টকারী ব্যক্তি যদি মারা যায় তাহলেও তা বিক্রয় করা বৈধ নয়। বরং তার উত্তরাধিকারীগণ তা যবেহ করে ভক্ষণ করবে, দান করবে ও উপঢৌকন দিবে।

২। যদি তার কোন ত্রুটি দেখা দেয়, তাহলে ঐ ত্রুটি বড় না হলে (যাতে কুরবানী মকরূহ হলেও সিদ্ধ হবে। যেমন, কান কাটা, শিং ভাঙ্গা ইত্যাদি) তাই কুরবানী করবে। কিন্তু ত্রুটি বড় হলে (যাতে কুরবানী সিদ্ধ হয় না, যেমন স্পষ্ট খঞ্জতা ইত্যাদি) যদি তা নিজ কর্মদোষে হয়, তাহলে তার পরিবর্তে ত্রুটিহীন পশু কুরবানী করা জরুরী হবে। আর ঐ ত্রুটিযুক্ত পশুটি তার অধিকারভুক্ত হবে। তবে ঐ ত্রুটি যদি কুরবানীদাতার কর্মদোষে বা অবহেলায় না হয়, তাহলে ওটাই কুরবানী করা তার জন্য সিদ্ধ হবে।

কিন্তু নির্ণয়ের পূর্বে যদি কুরবানী তার উপর ওয়াজেব থাকে, যেমন কেউ কুরবানীর নযর মেনে থাকে এবং তারপর কোন ছাগল তার জন্য নির্ণীত করে এবং তারপর তার নিজ দোষে তা ত্রুটিযুক্ত না হয়ে অন্য কারণে হয়ে থাকে, তা হলেও ত্রুটিহীন পশু দ্বারা তার পরিবর্তন জরুরী হবে।

৩। কুরবানীর পশু হারিয়ে বা চুরি হয়ে গেলে, যদি তা কুরবানী দাতার অবহেলার ফলে না হয়, তাহলে তার পক্ষে অন্য কুরবানী জরুরী নয়। কারণ, তা তার হাতে এক প্রকার আমানত, যা যত্ন সত্ত্বেও বিনষ্ট হলে তার যামানত নেই। তবে ভবিষ্যতে ঐ পশু যদি ফিরে পায়, তবে কুরবানীর সময় পার হয়ে গেলেও ঐ সময়েই তা যবেহ করবে। কিন্তু যদি কুরবানী দাতার অবহেলা ও অযত্নের কারণে রক্ষা না করার ফলে হারিয়ে বা চুরি হয়ে যায়, তাহলে তার পরিবর্তে অন্য একটি পশু কুরবানী করা জরুরী হবে।

৪। কুরবানীর পশুর কোন অংশ (মাংস, চর্বি, চামড়া, দড়ি ইত্যাদি) বিক্রয় করা বৈধ হবে না। কারণ, তা আল্লাহর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত বস্তু, তাই কোনও প্রকারে পুনরায় তা নিজের ব্যবহারে ফিরিয়ে আনা বৈধ নয়। তদনুরূপ ওর কোনও অংশ দ্বারা কসাইকে পারিশ্রমিক দেওয়া বৈধ নয়। যেহেতু সেটাও এক প্রকার বিনিময় যা ক্রয়-বিক্রয়ের মত[5]

অবশ্য কসাই গরীব হলে দান সবরূপ অথবা গরীব না হলে হাদিয়া সবরূপ তাকে কুরবানীর মাংস ইত্যাদি দেওয়া দূষণীয় নয়। যেহেতু তখন তাকে অন্যান্য হকদারদের শামিল মনে করা হবে; বরং সেই অধিক হকদার হবে। কারণ সে ঐ কুরবানীতে কর্মযোগে শরীক হয়েছে এবং তার মন ওর প্রতি আশানিক্ষত হয়েছে। তবে উত্তম এই যে, তার মজুরী আগে মিটিয়ে দেবে এবং পরে কিছু দান বা হাদিয়া দেবে। যাতে কোন সন্দেহ ও গোলযোগই অবশিষ্ট না থাকে।[6]

৫। পশু ক্রয় করার পর যদি তার বাচ্চা হয়, তাহলে মায়ের সাথে তাকেও কুরবানী করতে হবে।[7] এর পূর্বে ঐ পশুর দুধ খাওয়া যাবে; তবে শর্ত হল, যেন ঐ বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং তার প্রয়োজনের অতিরিক্ত হয়[8]

[1] (মুসলিম ১০১৫নং)

[2] (তফসীর ইবনে কাষীর ৩/২২৯)

[3] (ফাতহুল বারী ১০/৯)

[4] (আহমাদ, হাকেম, প্রমুখ, সিলসিলাহ সহীহাহ ১৮৬১নং)

[5] (বুখারী ১৬৩০, মুসলিম ১৩১৭নং)

[6] (ফাতহুল বারী ৩/৫৫৬)

[7] (তিঃ ১৫০৩নং)

[8] (বাইহাকী ৯/২৮৮, আল-মুমতে ৭/৫১০)
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 পরের পাতা »