হাদীসের নামে জালিয়াতি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৪৮৭ টি
হাদীসের নামে জালিয়াতি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ৪৮৭ টি

তাবিয়ী ও পরবর্তী যুগের বুযুর্গগণের বিষয়ে অগণিত বানোয়াট কথা প্রচলিত। তন্মধ্যে উয়াইস কারনী (রাহ) বিষয়ক গল্পগুলো প্রসিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ তাঁর জীবদ্দশায় ইয়ামানের ‘‘কার্ন’’ গোত্রের উয়াইস ইবনু আমির নামক এক ব্যক্তির কথা সাহাবীগণকে বলেন এবং তাঁর ওফাতের পরে উমারের (রা) সাথে তাঁর সাক্ষাতের কথা সহীহ হাদীসে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী যুগে উয়াইস (রাহ)- কে কেন্দ্র করে অনেক আজগুবি মিথ্যা কথা বানানো হয়েছে। অনেক বক্তা শ্রোতাগণকে বিমুগ্ধ করার জন্য আজগুবি কথা বানিয়েছেন। অনেক সরলপ্রাণ দরবেশ যা শুনেছেন তাই বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে কিছু আছে উয়াইস কেন্দ্রিক। আর কিছু কথা বানানো হয়েছে রাসূলুল্লাহর নামে। এগুলো নিঃসন্দেহে বেশি ভয়ঙ্কর ও কঠিনতম গোনাহ।

উয়াইস ইবনু আমির আল-কার্নী (রাহ) সম্পর্কে সহীহ মুসলিম ও অন্যান্য গ্রন্থে সংকলিত সহীহ হাদীসে যতটুকু বর্ণিত হয়েছে তার সার সংক্ষেপ হলো: উমার (রা) যখন খলীফা ছিলেন (১৩- ২৩ হি) তখন তাঁর কাছে ইয়ামানের সৈন্যদল আগমন করলে তিনি জিজ্ঞাসা করতেন? আপনাদের মধ্যে কি উয়াইস ইবনু আমির নামে কেউ আছেন? এভাবে একবার তিনি উয়াইসকে পেয়ে যান। তিনি বলেন: আপনি উয়াইস? উয়াইস বলেন: হাঁ, উমার বলেন: আপনি কারন গোত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ? তিনি বলেন: হাঁ। উমার বলেন: আপনার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল এবং শুধুমাত্র নাভীর কাছে একটি দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব আল্লাহ ভাল করে দিয়েছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তিনি বলেন: আপনার আম্মা আছেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উমার বলেন: আমি রাসূলুল্লাহ ()-কে বলতে শুনেছি,

يَأْتِي عَلَيْكُمْ أُوَيْسُ بْنُ عَامِرٍ مَعَ أَمْدَادِ أَهْلِ الْيَمَنِ مِنْ مُرَادٍ ثُمَّ مِنْ قَرَنٍ كَانَ بِهِ بَرَصٌ فَبَرَأَ مِنْهُ إِلاِّ مَوْضِعَ دِرْهَمٍ، لَهُ وَالِدَةٌ هُوَ بِهَا بَرٌّ لَوْ أَقْسَمَ عَلَى اللَّهِ لأَبَرَّهُ فَإِنْ اسْتَطَعْتَ أَنْ يَسْتَغْفِرَ لَكَ فَافْعَلْ. وفي رواية: إِنَّ خَيْرَ التَّابِعِينَ رَجُلٌ يُقَالُ لَهُ أُوَيْسٌ ..... فَمُرُوهُ فَلْيَسْتَغْفِرْ لَكُمْ

‘‘ইয়ামানের সৈন্যদলের সাথে উয়াইস ইবনু আমির তোমাদের কাছে আগমন করবে। সে কার্ন গেত্রের শাখা মুরাদ গোত্রের মানুষ। তার শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছিল। আল্লাহ এক দিরহাম পরিমাণ স্থান ছাড়া বাকী সব ভাল করে দিয়েছেন। তার আম্মা আছেন। সে তার আম্মার সেবা করে। সে যদি আল্লাহর কাছে কসম করে কিছু বলে তবে আল্লাহ তার কথা রাখবেন। যদি তুমি তার কাছে তোমার গোনাহ মাফের জন্য দুআ চাইতে পার তবে চাইবে।’’ অন্য বর্ণনায়: ‘‘তাবিয়ীগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ‘‘উয়াইস’’ নামক এক ব্যক্তি।... তোমরা তাকে বলবে তোমাদের জন্য ক্ষমা চাইতে।’’

একথা বলে উমার (রা) বলেন: আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তখন উয়াইস আল্লাহর কাছে উমারের গোনাহের ক্ষমার জন্য দোয়া করেন। উমার তাঁকে বলেন: আপনি কোথায় যাবেন? তিনি বলেন: আমি কুফায় যাব। উমার বলেন: তাহলে আমি আপনার জন্য কুফার গভর্নরের কাছে চিঠি লিখে দিই? উয়াইস বলেন: অতি সাধারণ মানুষদের মধ্যে মিশে থাকাই আমার বেশি পছন্দ। পরের বছর কুফার একজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি হজ্জে গমন করেন। তিনি খলীফা উমারের (রা) সাথে দেখা করলে তিনি তাকে উয়াইস সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলেন: তাকে তো একটি অতি ভগ্ন বাড়ীতে অতি দরিদ্র অবস্থায় দেখে এসেছি। তখন উমর (রা) রাসূলুল্লাহ ()-এর উপরের হাদীসটি তাকে বলেন। তখন ঐ সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি কুফায় ফিরে উয়াইসের কাছে গমন করে তার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনার অনুরোধ করেন। উয়াইস বলেন: আপনি তো হজ্জের নেক সফর থেকে ফিরে আসলেন, আপনি আমার জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করুন। আপনি কি উমারের (রা) সাথে দেখা করেছিলেন? তিনি বলেন: হাঁ। তখন উয়াইস তাঁর জন্য আল্লাহর কাছে গোনাহের ক্ষমা চান। এ ঘটনার পরে মানুষেরা উয়াইস সম্পর্কে জেনে যায়। ফলে তাঁর কাছে মানুষ আসা যাওয়া করতে থাকে। তখন উয়াইস লোকচক্ষুর আড়ালে কোথাও চলে যান।

পরবর্তী প্রায় দুই দশক উয়াইস কারনী লোকচক্ষুর আড়ালে সমাজের অতি সাধারণ মানুষ হিসেবে জীবন যাপন করেন। যে এলাকায় যখন বসবাস করতেন সেখানের মসজিদে সাধারণ মুসল্লী হিসাবে নিয়মিত নামাযে ও ওয়ায আলোচনায় বসতেন। কখনো নিজেও কিছু বলতেন। মসজিদে বসে কয়েকজনে কুরআন তিলাওয়াত করতেন বলেও জানা যায়। এভাবেই তিনি বিভিন্ন জিহাদে শরীক হতেন বলে বুঝা যায়। ৩৭ হিজরীতে আলী (রা) ও মু‘আবিয়ার (রা) মধ্যে সিফফীনের যুদ্ধ সংঘঠিত হয়। এ যুদ্ধে উয়াইস কারনী (রাহ) আলীর সেনাদলে ছিলেন। তিনি আলী (রা)-এর পক্ষে যুদ্ধ করতে করতে এক সময় শহীদ হয়ে যান।[1]

এ হলো তাঁর সম্পর্কে সহীহ বর্ণনা। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক বানোয়াট ও ভিত্তিহীন কথা আমাদের দেশে প্রচলিত। যেমন তিনি নাকি তাঁর আম্মাকে বহন করতেন, তিনি নাকি উহুদের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহ ()-এর পবিত্র দাঁত আহত হওয়ার সংবাদে নিজের সকল দাঁত ভেঙে ফেলেছিলেন, ইত্যাদি। এ সকল কথার কোন ভিত্তি পাওয়া যায় না। বলা হয়, উমার (রা) ও আলী (রা) নাকি তাঁর কাছে যেয়ে দেখা করেন বা দোয়া চান। এগুলো সবই মিথ্যা কথা। উপরের সহীহ হাদীসে আমরা দেখেছি যে, রাসূলুল্লাহ ()-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে উয়াইসই উমারের (রা) দরবারে এসেছিলেন।

তবে আরো মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন বলা হয় যে, রাসূলুল্লাহ তাঁর ওফাতের পূর্বে তাঁর মুবারক পিরহান উয়াইস কারনীর (রাহ) জন্য রেখে যান এবং উমার (রা) ও আলী (রা) তাঁকে সে পোশাক পৌঁছে দেন। কথাগুলো সবই বানোয়াট। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী ও অন্যান্য মুহাদ্দিস একমত যে, এগুলি সবই বাতিল ও বানোয়াট কথা।[2]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ৪/১৯৬৮-১৯৬৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৩/৪৮০, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৩/৪৫৫-৪৬১, আবু নুআইম, হিলয়াতুল আউলিয়া ২/৭৯, যাহাবী, সিয়ারু আ’লামিন নুবালা ৪/২০, যিরিকলী, আল-আ’লাম ২/৩২।

[2] ইবনু হিববান, আল-মাজরূহীন ২/২৯৭-২৯৮; ইবনুল জাওযী, আল-মাউদূ‘আত ১/৩৫০, সুয়ূতী, আল-লাআলী ১/৪৪৯, সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫, নং ৮৫২, ইবনু আর্রাক, তানযীহ ২/৩২-৩৬; মোল্লা আলী কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১, নং ৭০১, আল-মাসনূ‘য়, পৃ: ১১১, নং ২৩৫, আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১, নং ২০৩৫, যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬, নং ৭৮৮।

হাসান বসরী (২২-১০৯হি) একজন প্রসিদ্ধ তাবিয়ী ছিলেন। তাঁকে কেন্দ্র করে অনেক মিথ্যা ও বানোয়াট কথা সমাজে প্রচলিত। যেমন, ‘হাসান বসরী’ ও ‘রাবেয়া বসরী’ দুজনের কথাবার্তা, আলোচনা ইত্যাদি আমাদের সমাজে অতি পরিচিত। অথচ দুজন সমবয়সী বা সমসাময়িক ছিলেন না। রাবেয়া বসরী ১০০ হিজরী বা তার কাছাকাছি সময়ে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮০/১৮১ হিজরীতে ইন্তেকাল করেন। হাসান বসরী যখন ইন্তেকাল করেন তখন রাবেয়া বসরীর বয়স মাত্র ১০/১১ বছর। এ থেকে আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, এ দুজনকে নিয়ে প্রচলিত গল্পকাহিনীগুলো সবই বানোয়াট।

তবে সবচেয়ে মারাত্মক তাঁকে কেন্দ্র করে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে বানোয়াট কথা। যেমন, প্রচলিত আছে যে, হাসান বসরী আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ () থেকে ‘‘তরীকত’’ গ্রহণ করেন বা চিশতিয়া তরীকতের খিরকা, লাঠি ইত্যাদি গ্রহণ করেন। এ কথাটি ভিত্তিহীন।

হাসান বসরী (রাহ) তাবিয়ীগণের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস, ফকীহ, মুজাহিদ, ওয়ায়িয ও সংসারত্যগী বুযুর্গ ছিলেন। তিনি হাদীস ও ফিক্হ শিক্ষা দানের পাশাপাশি জাগতিক লোভ-লালসার বিরুদ্ধে এবং জীবনকে আল্লাহর ভালবাসা ও আখিরাত কেন্দ্রিক করার জন্য ওয়ায করতেন। সঙ্গীগণের সাথে বসে আখিরাতের কথা স্মরণ করে আল্লহর প্রেমে ও আল্লাহর ভয়ে কাঁদাকাটি করতেন। তাঁর এসকল মাজলিসের বিশেষ প্রভাব ছিল সে যুগের মানুষদের মধ্যে। পরবর্তী যুগের অধিকাংশ সূফী দরবেশ তাঁর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছেন এবং তাঁর থেকে শিক্ষা নিয়েছেন।

হাসান বসরীর (রাহ) যুগে তাসাউফ, সূফী ইত্যাদি শব্দ অপরিচিত ছিল। এছাড়া প্রচলিত অর্থে তরীকতও অপরিচিত ছিল। তাঁরা মূলত কুরআন ও হাদীসের আলোকে আল্লাহর মহববত ও আখিরাতের আলোচনা করতেন এবং বেশি বেশি ইবাদত বন্দেগিতে লিপ্ত থাকতেন। তরীকতের জন্য নির্দিষ্ট কোন মানুষের কাছে গমনের রীতিও তখন ছিল না। বিভিন্ন সাহাবী ও তাবিয়ীর সামগ্রিক সাহচর্যে মানুষ হৃদয়ের পূর্ণতা লাভ করত। প্রায় ৫০০ বছর পরে, যখন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব বিচ্ছিন্নতা ও অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত ও তাতারদের ভয়াবহ হামলায় ছিন্নভিন্ন, তখন হিজরী ৬ষ্ঠ ও ৭ম শতকে প্রচলিত তরীকাগুলো প্রতিষ্ঠা ও প্রসার লাভ করে।

কাদিরীয়া তরীকার সম্পর্ক আব্দুল কাদির জীলানীর (মৃ ৫৬১হি/ ১১৬৬ খৃ) সাথে। তবে তিনি প্রচলিত কাদিরীয়া তরীকা প্রতিষ্ঠিত বা প্রচলিত করেননি। তাঁর অনেক পরে তা প্রচলিত হয়েছে। রিফায়ী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ ইবনু আলী রিফায়ী (মৃ ৫৭৮ হি)। সোহরাওয়ার্দী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা শিহাবুদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (মৃ. ৬৩২হি)। মুঈনউদ্দীন চিশতী চিশতিয়া তরীকার মূল প্রচারক। তিনি ৬৩৩হি/১২৩৬খৃ ইন্তেকাল করেন। আলী ইবনু আব্দুল্লাহ শাযলী (৬৫৬হি/১২৫৮খৃ) শাযলিয়া তরীকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ বুখারী বাহাউদ্দীন নকশবন্দ (মৃ ৭৯১হি/ ১৩৮৯খৃ) নকশাবন্দিয়া তরীকার প্রতিষ্ঠা করেন। রাহিমাহুমুল্লাহ- আল্লাহ তাঁদেরকে রহমত করুন। তাঁরা কুরআন ও হাদীসের আলোকে মাসনূন ইবাদতগুলো বেছে তার আলোকে মুসলিমগণের আধ্যাত্মিক উন্নতির চেষ্টা করেন। প্রকৃতপক্ষে সে অন্ধকার ও কষ্টকর দিনগুলোতে এঁরাই সাধারণ মুসলিমদের মধ্যে ইসলাম প্রচার ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করেন।

পরবর্তী যুগের একটি প্রচলিত কথা হলো, চিশতিয়া তরীকা ও অন্য কিছু তরীকা হাসান বসরী (রাহ) আলীর (রা) মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ থেকে লাভ করেছেন। তিনি আলী (রা) থেকে খিরকা বা খিলাফত লাভ করেছেন ও ‘তরীকতের ‘সাজ্জাদ-নশীন’ হয়েছেন। কথাটি ভিত্তিহীন।

হাসান বসরী (রাহ) ২২ হিজরীতে মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বয়স যখন ১৩ বছর তখন ৩৫ হিজরীতে আলী (রা) খলীফা নিযুক্ত হন এবং খিলাফতের রাজধানী মদীনা থেকে কুফায় স্থানান্তর করেন। এরপর আর হাসান বসরী (রাহ) আলীকে (রা) দেখেন নি। তিনি আলী (রা)-এর দরবারে বসে শিক্ষা গ্রহণেরই কোনো সুযোগ পান নি। ৪০ হিজরীতে আলী (রা) শহীদ হন। আমরা সহজেই বুঝতে পারি যে, আলী (রা) তাঁর যোগ্যতম সন্তানগণ, অগণিত নেতৃস্থানীয় ভক্ত, ছাত্র ও সহচরদের বাদ দিয়ে ১৩ বছরের কিশোরকে খিরকা ও খিলাফত দিয়ে যান নি বা সাজ্জাদ-নশীন করেননি। ইবনু দাহিয়া, ইবনুস সালাহ, যাহাবী, ইবনু হাজার, সাখাবী, মোল্লা আলী কারী প্রমুখ মুহাদ্দিস উল্লেখ করেছেন যে, এগুলো সব ভিত্তিহীন ও বাতিল কথা।[1]

[1] সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ: ৩৩৫; মোল্লা কারী, আল-আসরার, পৃ: ১৮১; আল-মাসনূ, পৃ: ১১১; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/১৮০-১৮১; যারকানী, মুখতাসারুল মাকাসিদ, পৃ: ১৫৬।
১৯. আখেরী যামানার উম্মাতের জন্য চিন্তা

আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ গ্রন্থের মধ্যে ঢুকানো অগণিত ভিত্তিহীন জাল হাদীসের একটি নিম্নরূপ:

غَمِّيْ لأَجْلِ أُمَّتِيْ فِيْ آخِرِ الزَّمَانِ

‘‘আমার শেষ যামানার উম্মতের জন্য আমার খুবই চিন্তা!’’[1]

সহীহ, যয়ীফ বা মাউযূ কোনো সনদেই কোনো গ্রন্থে এ কথা পাওয়া যায় না। আমরা আগেই বলেছি এ বইটি পুরোটিই জাল বলে প্রতীয়মান হয়।

[1] সিররুল আসরার, পৃ. ১৫।
১. ওলীদের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য

আল্লাহর ওলীগণের পরিচয়, কর্ম ও মর্যাদার বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। এহইয়াউস সুনানরাহে বেলায়াত পু্স্তকদ্বয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। এ বিষয়ে অনেক মিথ্যা কথা মুসলিম সমাজে প্রচার করেছে জালিয়াতগণ। অনেক সরলপ্রাণ নেককার বুযুর্গ সরল মনে এগুলো বিশ্বাস করেছেন। এখানে এ বিষয়ক কিছু কথা উল্লেখ করছি।

১. ওলীদের কারামত বা অলৌকিক ক্ষমতা সত্য

প্রচলিত একটি গ্রন্থে লেখা হয়েছে: ‘‘আল্লাহ তায়ালার বন্ধুদের শানে কোরান শরীফ ও হাদীস শরীফের কয়েকটি বাণী:.... কারামাতুল আউলিয়া হাক্কুন- আল-হাদীস। অর্থ আউলিয়া-এর অলৌকিক ক্ষমতা সত্য।’’[1]

এখানে এ বাক্যটি ‘আল-হাদীস’ বলে বা রাসূলুল্লাহ ()-এর বাণী বলে উল্লেখ করে রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়াও বাক্যটির বিকৃত ও ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। এখানে আমরা দুটি বিষয় আলোচনা করব: (১) এ বাক্যটির উৎস ও (২) এ বাক্যটির অর্থ।

প্রথমত: বাক্যটির উৎস

كَرَامَاتُ الأَوْلِيَاءِ حَقٌّ

‘‘ওলীগণের কারামত সত্য’’ এ বাক্যটি আলিমগণের কথা। এটি কোনো হাদীস নয়। রাসূলুল্লাহ () কখনোই এ কথা বলেন নি বা তাঁর থেকে কোনো সহীহ বা যয়ীফ সনদে তা বর্ণিত হয় নি। উপরন্তু ‘কারামত’ শব্দটিই কুরআন বা হাদীসের শব্দ নয়। নবী ও ওলীগণের অলৌকিক কর্মকে কুরআন ও হাদীসে ‘আয়াত’ বা চিহ্ন বলা হয়েছে। দ্বিতীয়-তৃতীয় শতাব্দী থেকে নবী-রাসূলগণের ‘আয়াত’কে ‘মুজিযা’ এবং ওলীগণের ‘আয়াত’কে ‘কারামাত’ বলা শুরু হয়।

দ্বিতীয় হিজরী শতক থেকে মু’তাযিলা ও অন্যান্য কিছু সম্প্রদায়ের মানুষেরা ওলীগণের দ্বারা অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার সম্ভাবনা অস্বীকার করেন। তাদের এ মতটি কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী। কুরআন কারীমের বিভিন্ন আয়াত ও বিভিন্ন হাদীস প্রমাণ করে যে, নবীগণ ছাড়াও আল্লাহ নেককার মানুষদেরকে কখনো কখনো অলৌকিক চিহ্ন বা ‘আয়াত’ প্রদান করেন। এজন্য সুন্নাত-পন্থী আলিমগণ বলেন: ‘‘কারামাতুল আউলিয়া হাক্ক।’’

দ্বিতীয়ত: বাক্যটির অর্থ

এভাবে আমরা দেখছি যে, এ বাক্যটি রাসূলুল্লাহ ()-এর বাণী নয়; বরং আলিমগণের বক্তব্য। কাজেই বাক্যটিকে ‘হাদীস’ বলে জালিয়াতি করা হয়েছে। এছাড়া উপরের উদ্ধৃতিতে বাক্যটির ভুল অনুবাদ করা হয়েছে। ফলে অনুবাদের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত জালিয়াতি ঘটেছে।

ক. ‘কারামত’ বনাম ‘অলৌকিক ক্ষমতা’

এ বাক্যে তিনটি শব্দ রয়েছে: কারামত, আউলিয়া, হক্ক। উপরের উদ্ধৃতিতে প্রথম শব্দ ‘কারামত’-এর অনুবাদ করা হয়েছে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’। এ অনুবাদটি শুধু ভুলই নয়, বরং ইসলামী বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক। কারামত অর্থ অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন, অলৌকিক ক্ষমতা নয়। আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কোনোরূপ ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ আছে বলে বিশ্বাস করা শির্ক।

‘কারামত’ শব্দটির মূল অর্থ ‘সম্মাননা’। ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামত’ অর্থ ‘নবী-রাসূলগণ ব্যতীত অন্যান্য নেককার মানুষের দ্বারা সংঘটিত অলৌকিক কর্ম।’ ‘অলৌকিক চিহ্ন’কে ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ মনে করা শির্কের অন্যতম কারণ। খৃস্টানগণ দাবি করেন, ‘মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা ঈশ্বর ছাড়া কারো নেই, যীশু মৃতকে জীবিত করেছেন, এতে প্রমাণিত হয় যে, যীশু ঈশ্বর বা তাঁর মধ্যে ঈশ্বরত্ব বা ঐশ্বরিক ক্ষমতা ছিল।

কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, কোনো অলৌকিক কর্ম বা চিহ্ন কোনো নবী-রাসূল বা কেউ নিজের ইচ্ছায় ঘটাতে বা দেখাতে পারেন না; শুধুমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাতেই ঘটতে পারে। কোনো ওলী বা নেককার ব্যক্তি কর্তৃক কোনো অলৌকিক কর্ম সংঘটিত হওয়ার অর্থ এ নয় যে, এ কর্মটি সম্পাদন করা সে ব্যক্তির ইচ্ছাধীন বা তার নিজের ক্ষমতা। এর অর্থ হলো একটি বিশেষ ঘটনায় আল্লাহ তাকে সম্মান করে একটি অলৌকিক চিহ্ন প্রদান করেছেন। অন্য কোনো সময়ে তা নাও দিতে পারেন।

একটি উদাহরণ দেখুন। নির্ভরযোগ্য সনদে বর্ণিত, ২৩ হিজরীর প্রথম দিকে উমার (রা) মসজিদে নাবাবীতে জুমুআর খুতবা প্রদান কালে উচ্চস্বরে বলে উঠেন: (يا سارية، الجبلَ) ‘‘হে সারিয়া, পাহাড়।’’ সে সময়ে মুসলিম সেনাপতি সারিয়া ইবনু যুনাইম পারস্যের এক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ করছিলেন। তিনি যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার উপক্রম করছিলেন। এমতাবস্থায় তিনি উমারের এ বাক্যটি শুনতে পান এবং পাহাড়ের আশ্রয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন।[2]

এ ঘটনায় আমরা উমার (রা)-এর একটি মহান কারামত দেখতে পাই। তিনি হাজার মাইল দূরের যুদ্ধ ক্ষেত্রের অবস্থা ‘অবলোকন’ করেছেন, মুখে নির্দেশনা দিয়েছেন এবং সে নির্দেশনা সারিয়া শুনতে পেয়েছেন।

এ কারামতের অর্থ হলো, মহান আল্লাহ তাঁর এ মহান ওলীকে এ দিনের এ মুহূর্তে এ বিশেষ ‘সম্মাননা’ প্রদান করেন, তিনি দূরের দৃশ্যটি হৃদয়ে অনুভব করেন, নির্দেশনা দেন এবং তাঁর নির্দেশনা আল্লাহ সারিয়ার কাছে পৌঁছে দেন। এর অর্থ এ নয় যে, উমার (রা)-এর হাজার মাইল দূরের সব কিছু অবলোকন করার অলৌকিক ক্ষমতা ছিল, অথবা তিনি ইচছা করলেই এভাবে দূরের কিছু দেখতে পেতেন বা নিজের কথা দূরে প্রেরণ করতে পারতেন।

এ বছরেরই শেষে ২৩ হিজরীর যুলহাজ্জ মাসের ২৭ তারিখে ফজরের সালাত আদায়ের জন্য যখন উমার (রা) তাকবীরে তাহরীমা বলেন, তখন তাঁরই পিছেন চাদর গায়ে মুসল্লীরূপে দাঁড়ানো আল্লাহর শত্রু আবূ লু’লু লুকানো ছুরি দিয়ে তাঁকে বারংবার আঘাত করে। তিনি অচেতন হয়ে পড়ে যান। চেতনা ফিরে পেলে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, আমাকে কে আঘাত করল? তাঁকে বলা হয়, আবূ ল’লু। তিনি বলেন, আল-হামদু লিল্লাহ, আমাকে কোনো মুসলিমের হাতে শহীদ হতে হলো না। এর কয়েকদিন পর তিনি ইন্তিকাল করেন।[3]

এখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, মহান আল্লাহ প্রথম ঘটনায় হাজার মাইল দূরের অবস্থা উমারকে দেখিয়েছেন। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনায় পাশে দাঁড়ানো শত্রুর বিষয়ে তাঁকে জানতে দেন নি। কারণ ‘কারামত’ কখনোই ক্ষমতা নয়, কারমাত আললাহর পক্ষ থেকে দেয়া সম্মাননা মাত্র।

খ. ওলী ও আউলিয়া

ওলী ও বেলায়াতের অর্থ, পরিচয় ও বেলায়াত অর্জনের সুন্নাত পদ্ধতি জানতে পাঠককে আমরা লেখা ‘রাহে বেলায়াত’ বইটি পাঠ করতে অনুরোধ করছি। মূলত ‘বেলায়াত’ (الولاية) শব্দের অর্থ বন্ধুত্ব, নৈকট্য, অভিভাবকত্ব ইত্যাদি। ‘‘বেলায়েত’’ অর্জনকারীকে ‘‘ওলী’’ (الولي), অর্থাৎ বন্ধু, নিকটবর্তী বা অভিভাবক বলা হয়। ওলীদের পরিচয় প্রদান করে মহান আল্লাহ বলেন:

أَلا إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللَّهِ لا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ الَّذِينَ آَمَنُوا وَكَانُوا يَتَّقُونَ

‘‘জেনে রাখ! নিশ্চয় আল্লাহর ওলীগণের কোনো ভয় নেই এবং তাঁরা চিন্তাগ্রস্তও হবেন না- যারা ঈমান এনেছেন এবং তাকওয়া অবলম্বন করেন।’’[4]

‘‘ঈমান’’ অর্থ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি বিশুদ্ধ বিশ্বাস- যে বিশ্বাস শিরক, কুফর ও বিদআত থেকে মুক্ত। ‘‘তাকওয়া’’ শব্দের অর্থ আত্মরক্ষা করা। ফরয-ওয়াজিব পালন ও হারাম-পাপ বর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর অসন্তুষ্টি থেকে আত্মরক্ষার নাম-ই তাকওয়া। এ আয়াতের মাধ্যমে আমরা জানছি যে, দুটি গুণের মধ্যে ওলীর পরিচয় সীমাবদ্ধ। ঈমান ও তাকওয়া। এ দু’টি গুণ যার মধ্যে যত বেশি ও যত পরিপূর্ণ হবে তিনি বেলায়াতের পথে তত বেশি অগ্রসর ও আল্লাহর তত বেশি ওলী বা প্রিয় বলে বিবেচিত হবেন। রাসূলুল্লাহ () ওলীর বা বেলায়াতের পথের কর্মকে দু’ভাগে ভাগ করেছেন: ফরয ও নফল। সকল ফরয পালনের পরে অনবরত বেশি বেশি নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর নৈকট্যের পথে বেশি বেশি অগ্রসর হতে থাকে।

এথেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রত্যেক মুসলিমই আল্লাহর ওলী। ঈমান ও তাকওয়া যার মধ্যে যত বেশি থাকবে তিনি তত বেশি ওলী। ইমাম আবু জা’ফর তাহাবী (৩২১হি) ইমাম আবু হানীফা, মুহাম্মাদ, আবু ইউসূফ (রাহ) ও আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের আকীদা বর্ণনা করে বলেন:

اَلْمُؤْمِنُوْنَ كُلُّهُمْ أَوْلِيَاءُ الرَّحْمَنِ، وَأَكْرَمُهُمْ عِنْدَ اللهِ أَطْوَعُهُمْ وَأَتْبَعُهُمْ لِلْقُرْآنِ

‘‘সকল মুমিন করুণাময় আল্লাহর ওলী। তাঁদের মধ্য থেকে যে যত বেশি আল্লাহর অনুগত ও কুরআনের অনুসরণকারী সে ততবেশি আল্লাহর কাছে কারামত-প্রাপ্ত (ততবেশি ওলী বা ততবেশি সম্মানিত)।[5]

তাহলে ওলী ও বেলায়েতের মানদন্ড হচ্ছে: ঈমান ও তাকওয়া: সকল ফরয কাজ আদায় এবং বেশি বেশি নফল ইবাদত করা। যদি কোনো মুসলিম পরিপূর্ণ সুন্নাত অনুসারে সঠিক ঈমান সংরক্ষণ করেন, সকল প্রকারের হারাম ও নিষেধ বর্জনের মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করেন, তাঁর উপর ফরয যাবতীয় দায়িত্ব তিনি আদায় করেন এবং সর্বশেষে যথাসম্ভব বেশি বেশি নফল ইবাদত আদায় করেন তিনিই আল্লাহর ওলী বা প্রিয় মানুষ। এ সকল বিষয়ে যিনি যতুটুকু অগ্রসর হবেন তিনি ততটুকু আল্লাহর নৈকট্য বা বেলায়াত অর্জন করবেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ‘বেলায়াত’ কোনো পদ-পদবী নয় এবং ইসলামের ‘ওলী’ বলে কোনো বিশেষ পদ বা পর্যায় নেই। প্রত্যেক মুমিনই ওলী। যে যত বেশি ঈমান ও তাকওয়া অর্জন করবেন তিনি তত বেশি ওলী।

গ. হক্ক

‘কারমাতুল আউলিয়া হক্ক’ বা ‘ওলীগণের অলৌকিক কর্ম সত্য’ অর্থ ওলীগণ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশ পাওয়া সম্ভব। যদি কোনো বাহ্যত মুমিন মুত্তাকী মানুষ থেকে কোনো অলৌকিক কার্য প্রকাশ পায় বা এরূপ ঈমানদার-মুত্তাকী মানুষ থেকে অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়েছে বলে সহীহ সনদে জানা যায় তবে তাকে আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রদত্ত সম্মাননা বলে বুঝতে হবে। তা অস্বীকার করা বা অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেয়া মু‘তাযিলীদের আকীদা।

‘ওলীদের কারামত সত্য’ বলতে দু প্রকারে ভুল অর্থ করা হয়:

(১) কেউ মনে করেন, ওলীদের নামে যা কিছু কারামত বা অলৌকিক কথা বলা হবে সবই সত্য মনে করতে হবে। কথাটি জঘন্য ভুল। আমরা দেখেছি, যাচাই ছাড়া কোনো সংবাদ গ্রহণ করতে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল ﷺ নিষেধ করেছেন। কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কথাগুলি যাচাই ছাড়া গ্রহণ ও বর্ণনা করা হাদীসে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে এবং এরূপ ব্যক্তিকে মিথ্যাবাদী বলে গণ্য করা হয়েছে। এজন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামে যা কিছু কথিত বা বর্ণিত হয় তা যাচাই ছাড়া বিশ্বাস বা গ্রহণ করা যেমন হারাম, তেমনি ওলীগণের নামে কথিত, লিখিত বা বর্ণিত কোনো তথ্য সনদ যাচাই ছাড়া গ্রহণ, বর্ণনা বা বিশ্বাস করাও হারাম। প্রকৃত সত্য যে, জাল হাদীসের মত অগণিত ‘জাল’ কারামত ওলীদের নামে সমাজে ছড়ানো হয়েছে।

(২) কেউ মনে করেন যে, ‘ওলীগণের কারামত সত্য’ অর্থ ওলীগণের কারামত থাকতেই হবে বা কারামতই ওলীগণের আলামত বা চিহ্ন। এ ধারণাটি কঠিন ভুল। ঈমান ও তাকওয়া ছাড়া ওলীর আর কোনো পরিচয় নেই। ঈমান ও আমালের বাহ্যিক প্রকাশ ছাড়া ‘ওলী’-র পরিচয়ের জন্য কেনো চিহ্ন, মার্কা বা সার্টিফিকেট নেই। কোনো ‘কারামত’ কখনোই বেলায়াতের মাপকাঠি নয়। আল্লাহর প্রিয়তম ওলীর কোনো প্রকার কারামত নাও থাকতে পারে। আমরা জানি আল্লাহর প্রিয়তম ওলী সাহাবায়ে কেরামের অধিকাংশেরই কোনো কারামত বর্ণিত হয় নি। আবার পাপী বা কাফির মুশরিক থেকেও অলৌকিক কার্য প্রকাশিত হতে পারে। সর্বোপরি কারামতের অধিকারী ওলীও কোনো বিশেষ পদমর্যাদার ব্যক্তি নন বা পদস্খলন থেকে সংরক্ষিত নন। কর্মে ত্রুটি হলে তিনি শাস্তিভোগ করবেন। কুরআন উল্লেখ করেছে যে, কারামতের অধিকারী ওলীও গোমরাহ ও বিভ্রান্ত হয়েছেন।[6]

[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।

[2] তাবারী, তারীখ ২/৫৫৩-৫৫৪; বাইহাকী, আল-ই’তিকাদ,পৃ. ৩১৪; ইবনু হাজার, আল-ইসাবা ৩/৫-৬; সাখাবী, আল-মাকাসিদ, পৃ. ৪৬৮; আজলূনী, কাশফুল খাফা ২/৫১৪-৫১৫।

[3] ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ৭/১৩০-১৩৮।

[4] সূরা (১০) ইউনূস: ৬২-৬৩ আয়াত।

[5] ইমাম তাহাবী, আল-আকীদাহ (শারহ সহ), পৃ: ৩৫৭-৩৬২।

[6] সূরা (৭) আ’রাফ: ১৭৫-১৭৭ আয়াত। দেখুন: তাবারী, তাফসীর ৯/১১৯-১৩০, ইবনু কাসির, তাফসীর ২/২৬৫-২৬৮।

আমাদের মধ্যে বহুল প্রচলিত একটি বাক্য:

إِنَّ أَوْلِيَاءَ اللهِ لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ إِلَى دَارِ الْبَقَاءِ

প্রচলিত একটি পুস্তকে এ বাক্যটির অনুবাদ লেখা হয়েছে: ‘‘নিশ্চয় আল্লাহর বন্ধুদের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহ জগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে’’-আল হাদীস।[1]

এখানে উল্লেখ্য যে, আব্দুল কাদির জীলানীর (রাহ) নামে প্রচলিত ‘সিররুল আসরার’ পুস্তকে এ হাদীসটি অন্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে:

اَلْمُؤْمِنُوْنَ لاَ يَمُوْتُوْنَ، بَلْ يَنْتَقِلُوْنَ مِنْ دَارِ الْفَنَاءِ إِلَى دَارِ الْبَقَاءِ

‘‘মুমিনগণের কোন মৃত্যু নেই বরং তাঁরা স্থানান্তরিত হয় ধ্বংসশীল ইহজগৎ হতে স্থায়ী পরজগতে।’’

দুটি কথাই রাসূলুল্লাহ ()-এর নামে জঘন্য মিথ্যা, বানোয়াট ও জাল কথা। কোনো সহীহ, যয়ীফ বা বানোয়াট সনদেও তা বর্ণিত হয় নি।

আমরা জানি যে, মুমিন-কাফির প্রতিটি মানুষই মৃত্যুর মাধ্যমে ‘‘ধ্বংসশীল ইহ জগৎ থেকে স্থায়ী পরজগতে স্থানান্তরিত হয়।’’ এখানে কারো কোনো বিশেষত্ব নেই। কুরআন ও হাদীস দ্বারা শহীদগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। সহীহ হাদীসের আলোকে নবীগণের পারলৌকিক বিশেষ জীবন প্রমাণিত। এছাড়া অন্য কোনো নেককার মানুষের পারলৌকিক বিশেষ কোনো জীবন প্রমাণিত নয়। আলিমগণ, ওলীগণ, মুআযযিনগণ... ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার নেককার মানুষের মৃত্যু পরবর্তী ‘হায়াত’ বা জীবন সম্পর্কে যা কিছু বলা হয় সবই সনদ বিহীন, ভিত্তিহীন কথা।[2]

[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।

[2] দরবেশ হূত, আসনাল মাতালিব, পৃ. ২৯৫-২৯৬; দাইলামী, আল-ফিরদাউস ৩/৩৫।

ওলীগণের পারলৌকিক জীবন বিষয়ক আরেকটি জাল কথা

اَلأَنْبِيَاءُ وَالأَوْلِيَاءُ يُصَلُّوْنَ فِيْ قُبُوْرِهِمْ كَمَا يُصَلُّوْنَ فِيْ بُيُوْتِهِمْ

‘‘নবীগণ ও ওলীগণ তাঁদের কবরের মধ্যে সালাত আদায় করেন, যেমন তাঁরা তাঁদের বাড়িতে সালাত আদায় করেন।’’ [1]

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নবীগণের ক্ষেত্রে হাদীসটি সহীহ। তবে এখানে ‘ওলীগণ’ শব্দটির সংযোগ বানোয়াট।

[1] সিররুল আসরার, পৃ. ৫৫।

প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘আল-আউলিয়াও রায়হানুল্লাহ- আল হাদীস। অর্থ আউলিয়া আল্লাহর সুবাস।’’[1]

কথাটি কোনো কোনো বুজুর্গ বলেছেন, হাদীস হিসেবে এটি জাল। ওলীগণকে আল্লাহর সুবাস বলায় কোনো অসুবিধা নেই। আল্লাহর রিযককে আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে, সন্তানকেও আল্লাহর সুবাস বলা হয়েছে।[2] কিন্তু এ কথাটিকে রাসূলুল্লাহ -এর নামে বলতে হলে সহীহ সনদে তা বর্ণিত হতে হবে। কিন্তু এ কথাটির কোনো জাল সনদও নেই।

[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।

[2] তাবারী, তাফসীর ২৭/১২৩; হাকীম তিরমিযী, নাওয়াদিরুল উসূল ২/৫৯; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৬২১।

প্রচলিত একটি পুস্তকে লিখিত হয়েছে: ‘‘ইন্না আউলিয়াই তাহ্তা কাবাই লা ইয়ারিফুহুম গাইরী ইল্লা আউলিয়াই।- হাদীসে কুদসী। অর্থ: নিশ্চয়ই আমার বন্ধুগণ আমার জুববার অন্তরালে অবস্থান করেন, আমি ভিন্ন তাঁদের পরিচিতি সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে, আমার আউলিয়াগণ ব্যতীত।’’[1]

এটিও একটি ভিত্তিহীন ও জাল কথা। সহীহ, যয়ীফ বা জাল কোনো সনদে এ কথাটি বর্ণিত হয়েছে বলে জানা যায় নি। সনদবিহীন অন্যান্য জাল হাদীসের মত এ কথাটিও সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে। আর নবম-দশম হিজরী শতকের কোনো কোনো আলিম ভিত্তিহীন জনশ্রুতির উপর নির্ভর করে সনদ বিহীন ভাবে এ কথাটি তাদের পুস্তকে উল্লেখ করেছেন।[2]

[1] খাজা নিযামুদ্দিন আউলিয়া (রাহ), রাহাতুল মুহিববীন, শেষ প্রচ্ছদ।

[2] জুরজানী, আলী ইবনু মুহাম্মাদ (৮১৬হি), তা’রীফাত, পৃ. ২৯৫; মুনাবী, মুহাম্মাদ আব্দুর রাঊফ (১০৩১হি); তা’আরীফ, পৃ. ৬৭৬; মোল্লা আলী কারী, মিরকাত (শামিলা) ১৫/২৫৬।

আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে যে, আল্লাহর খাস ওলীগণ জান্নাতের নেয়ামতের জন্য ইবাদত করেন না, বরং শুধুই ‘মহববত’ বা ‘দীদারের’ জন্য। এ অবস্থাকে ‘সর্বোচ্চ’ অবস্থা বলে মনে করা হয়। এ মর্মে একটি জাল হাদীস:

إِنَّ للهِ جَنَّةً لاَ فِيْهَا حُوْرٌ وَلاَ قَصْرٌ وَلاَ عَسَلٌ وَلاَ لَبَنٌ

‘‘আল্লাহর এমন একটি জান্নাত আছে যেখানে হুর, অট্টালিকা, মধু এবং দুগ্ধ নেই। (বরং শুধু দীদারে ইলাহী-মাওলার দর্শন)।’’ কথাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন, সনদবিহীন একটি জাল কথা।[1]

[1] সিররুল আসরার, পৃ. ১৯-২০।
৭. ওলী-আল্লাহদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত সবই হারাম!

উপরের অর্থেই আরেকটি বানোয়াট কথা:

اَلدُّنْيَا حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الآخِرَةِ، وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ الدُّنْيَا، وَالدُّنْيَا وَالآخِرَةُ حَرَامٌ عَلَى أَهْلِ اللهِ

‘‘আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম আর দুনিয়া-ওয়ালাদের জন্য আখিরাত হারাম। আর আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাত উভয়ই হারাম।’’ (অর্থাৎ উভয়কে হারাম না করে আল্লাহওয়ালা হওয়া যায় না)

দাইলামী (৫০৯ হি) ‘ফিরদাউস’-এ হাদীসটি উল্লেখ করেছেন। তাঁর পুত্র আবূ মানসূর দাইলামী (৫৫৮হি) তার ‘মুসনাদুল ফিরদাউস’ গ্রন্থে এর একটি সনদ উল্লেখ করেছেন। সনদের অধিকাংশ রাবীই একেবারে অজ্ঞাত পরিচয়। অন্যরা দুর্বল। এজন্য হাদীসটিকে জাল বলে গণ্য করা হয়েছে।[1]

এ হাদীসে বলা হয়েছে যে, (১) আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া হারাম এবং (২) আল্লাহ-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া আখিরাত উভয়ই হারাম। এ কথা দুটি কুরআন কারীম ও অগণিত সহীহ হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক। মহান আল্লাহ ঠিক এর বিপরীত কথা বলেছেন। তিনি তাঁর প্রিয়তম রাসূল ও শ্রেষ্ঠতম আল্লাহ-ওয়ালা সাহাবীগণসহ সকল আল্লাহওয়ালা ও আখিরাত-ওয়ালাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতের সৌন্দর্য ও আনন্দ হারাম করেননি বলে ঘোষণা করেছেন: ‘‘আপনি বলুন: আল্লাহ তাঁর বান্দাদের জন্য যে সৌন্দর্য ও পবিত্র আনন্দ ও মজার বস্তগুলো বের (উদ্ভাবন) করেছেন তা হারাম বা নিষিদ্ধ করলো কে? আপনি বলুন: সেগুলো মুমিনদের জন্য পার্থিব জীবনে এবং কিয়ামতে শুধুমাত্র তাদের জন্যই।’’[2]

এরূপ একটি জাল কথা: ‘‘ঐ ব্যক্তি আমার প্রিয়তম যে আমাকেই চায় শাস্তির ভয়ে কিংবা পুরস্কারের আশায় নহে।... তাহা অপেক্ষা অপরাধী কে, যে দোজখের ভয়ে কিংবা বেহেশতের আশায় আমাকে অর্চ্চনা করে..।’’[3]

কুরআনে ‘আল্লাহওয়ালা’ ও ‘আখেরাতওয়ালা’দিগকে দুনিয়া ও আখিরাতের নেয়ামত প্রার্থনা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সর্বদা এভাবে দোয়া করতেন। আর আখিরাতের নেয়ামত তো আল্লাহওয়ালা ও আখেরাতওয়ালাদের মূল কাম্য। আল্লাহওয়ালা হতে হলে, জান্নাতের নিয়ামতের আশা আকাঙ্খা বর্জন করতে হবে, এ ধারণাটি কুরআন ও হাদীসের সুষ্পষ্ট বিরোধী। কোনো কোনো নেককার মানুষের মনে এরূপ ধারণা আসতে পারে। তবে রাসূলুল্লাহ ও সাহাবীগণ সর্বদা জান্নাতের নিয়ামত চেয়েছেন, সাহাবীগণকে বিভিন্ন নিয়ামতের সুসংবাদ দিয়েছেন। সর্বোপরি মহান আল্লাহ কুরআন কারীমে সর্বোচ্চ মর্যাদার নবী-ওলীগণ এবং সাধারণ ওলীগণ সকলের জন্য জান্নাতের নিয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন।

[1] দাইলামী, আল-ফিরদাউস ২/২৩০; আজলূনী, কাশফুল খাফা ১/৪৯৩; আলবানী, যায়ীফাহ ১/১০৫-১০৬।

[2] সূরা (৭) আ’রাফ: ৩১-৩২ আয়াত।

[3] আলহাজ্জ খান বাহাদুর আহছানউল্লা (ই. ফা. বা. ২য় সংস্করণ ২০১১) পৃষ্ঠা ৬৯।
দেখানো হচ্ছেঃ ২৯১ থেকে ৩০০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৪৮৭ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 27 28 29 30 31 · · · 46 47 48 49 পরের পাতা »