নাবী (ﷺ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন-
إِنَّمَا أَنَا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ أَنْسَى كَمَا تَنْسَوْنَ فَإِذَا نَسِيتُ فَذَكِّرُونِى
‘‘আমি তোমাদের মতই একজন মানুষ। তোমরা যেমন ভুলে যাও আমিও তেমনি ভুল করি। আমি ভুলে গেলে তোমরা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিয়ো’’।[1] সলাতে নাবী (ﷺ) কর্তৃক একাধিক বার ভুল করা উম্মাতের জন্য নেয়ামত স্বরূপ এবং দ্বীন পরিপূর্ণ হওয়ার প্রমাণ। যাতে তাঁর পরে উম্মাত ভুল করলে সংশোধনের ক্ষেত্রে সঠিক পন্থা অনুসরণ করতে পারে।
সুতরাং তিনি একবার চার রাকআত বিশিষ্ট সলাত পড়তে গিয়ে দুই রাকআত পড়ে (মাঝখানে না বসে ভুল বশতঃ) দাঁড়িয়ে গেছেন। সলাত শেষে করে সালামের পূর্বে তিনি দু’টি সাহু সিজদাহ করেছেন। সুতরাং এ থেকে একটি মাসআলা পাওয়া গেল যে, কোন ব্যক্তি সলাতের রুকন ব্যতীত অন্য কোন অংশ ভুল বশতঃ ছেড়ে দিলে তার জন্য সালামের পূর্বে দু’টি সাহু সিজদাহ করতে হবে। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, রুকন ছাড়া অন্য কোন অংশ (ওয়াজিব বিষয়) ছেড়ে দিয়ে পরবর্তী রুকন পালন করা শুরু করে দিলে স্মরণ হওয়ার পর ছুটে যাওয়া ওয়াজিব পালনের দিকে পুনরায় ফিরে আসবে না। (বরং পরবর্তী রুকন পালন করা অব্যাহত রাখবে এবং সালামের পূর্বে দু’টি সাহু সিজদাহ করবে)
তিনি একবার যোহর কিংবা আসরের সলাত দুই রাকআত পড়েই সালাম ফিরিয়ে দিয়েছেন। কথাও বলেছেন। অতঃপর তিনি বাকী সলাত পূর্ণ করে সালাম ফিরিয়েছেন। অতঃপর সাহু সিজদাহ করার পর পুনরায় সালাম ফিরিয়েছেন।
একবার তিনি কোন সলাতের এক রাকআত বাকী থাকতেই সালাম ফিরিয়ে চলে গেলেন। তালহা বিন উবাইদুল্লাহ্ (রাঃ) তাঁকে বললেন- আপনি সলাতের এক রাকআত ভুলে গেছেন। তিনি ফিরে এসে মসজিদে প্রবেশ করে বিলাল (রাঃ) কে ইকামাত দিতে বললেন । বেলাল (রাঃ) ইকামাত দিলেন আর তিনি লোকদেরকে নিয়ে বাকী রাকআত সলাত আদায় করলেন।[2]
একবার তিনি যোহরের সলাত পাঁচ রাকআত পড়ে সালাম ফিরালেন। সাহাবীগণ তাঁকে বললেন- সলাত কি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে? তিনি বললেন- কি হয়েছে? তারা বললেন- আপনি পাঁচ রাকআত সলাত পড়েছেন। তখন তিনি সালাম ফিরানোর পরে দু’টি সাহু সিজদা প্রদান করলেন। (অন্য বর্ণনায় আছে তিনি সাহু সিজদাহ করে পুনরায় সালাম ফিরিয়েছেন)
তিনি একবার আসরের সলাত তিন রাকআত পড়ে সালাম ফিরিয়ে বাড়িতে চলে গেলেন। লোকেরা তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি বের হয়ে এসে তাদেরকে নিয়ে বাকী এক রাকআত সলাত পড়লেন। অতঃপর তিনি সালাম ফেরালেন। অতঃপর দু’টি সাহু সিজদাহ প্রদান করলেন। পরিশেষে তিনি সালাম ফেরালেন।
উপরোক্ত পাঁচটি স্থানে রসূল (ﷺ) থেকে সলাতে ভুল হওয়া এবং সাহু সিজদাহ দেয়ার কথা সংরক্ষিত হয়েছে।
[2]. মুসনাদে ইমাম আহমাদ, ৬/৪০১, আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ কিতাবুস্ সালাত। ইমাম আলবানী রহঃ) এই হাদীছকে সহীহ বলেছেন, সহীহু আবী দাউদ, হা/ ৮৯৯।
সলাতে চোখ বন্ধ রাখা নাবী (ﷺ) এর সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামগণ সলাতে চোখ বন্ধ রাখাকে মাকরুহ বলেছেন। তারা বলেন- এটি হচ্ছে ইহুদীদের অভ্যাস। অন্যরা চোখ বন্ধ রাখাকে জায়েয বলেছেন। সঠিক কথা হচ্ছে চোখ খুললে যদি সলাতে খুশু-খুযুর (একাগ্রতা, মনোযোগ ও একনিষ্ঠতার) কোন ক্ষতি না হয় তাহলে চোখ খুলে রাখাই উত্তম।
তবে কিবলার দিকে যদি চাকচিক্যময় বস্ত্ত থাকে এবং চোখ খোলা রাখার কারণে দৃষ্টি ঐ সব বস্ত্তর দিকে চলে যাওয়ার কারণে সলাতে একাগ্রতার ক্ষতি হয় তাহলে চোখ বন্ধ রাখাতে কোন দোষ নেই।
সালামের পর তিনি তিন বার ইসেত্মগফার করতেন অর্থাৎ আস্তাগফিরুল্লাহ্ বলতেন। অতঃপর তিনি বলতেন-
اللّٰهُمَّ أَنْتَ السَّلَام وَمِنْك السَّلَام تَبَارَكْت يَا ذَا الْجَلَال وَالْإِكْرَام
উচ্চারণ: (আল্লা-হুম্মা আনতা সালা-মু ওয়া মিনকাস সালা-মু তাবা-রাকতা ইয়া-যাল জালা-লি ওয়াল ইকরা-ম) ‘‘হে আল্লাহ্! তুমিই সালাম (শান্তিময়)। তোমার পক্ষ হতেই শান্তি আগমণ করে। তুমি সুমহান, সম্মানিত এবং মর্যাদাবান।’’[1]
এই দু’আটি পড়তে যতটুকু সময় লাগে তিনি কেবল ততটুকু সময়ই কিবলামুখী হয়ে বসতেন। অতঃপর বিলম্ব না করে তিনি মুক্তাদীদের দিকে ফিরে বসতেন। সালামের পর তিনি কখনও ডান দিক থেকে আবার কখনও বাম দিক থেকে ঘুরে বসতেন। অতঃপর তিনি মুসল্লিদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসতেন। মুখ ফিরানোর বেলায় মুসল্লিদের এক দিক বাদ দিয়ে অন্য দিককে প্রাধান্য দিতেন না। ফজরের সলাতের পর সূর্য উঠার পূর্ব পর্যন্ত তিনি জায়সলাতে বসে থাকতেন। তিনি প্রত্যেক ফরজ সলাতের পর এই দু’আটি পাঠ করতেনঃ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ اللّٰهُمَّ لاَ مَانِعَ لِمَا أَعْطَيْتَ وَلاَ مُعْطِىَ لِمَا مَنَعْتَ وَلاَ يَنْفَعُ ذَا الْجَدِّ مِنْكَ الْجَدُّ لاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلاَّ بِاللهِ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَلاَ نَعْبُدُ إِلاَّ إِيَّاهُ لَهُ النِّعْمَةُ وَلَهُ الْفَضْلُ وَلَهُ الثَّنَاءُ الْحَسَنُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ
‘‘এক মাত্র আল্লাহ ছাড়া কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। সকল রাজত্ব তাঁরই। সকল প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান। হে আল্লাহ! তুমি যা দান করো, তা প্রতিহত করার কেউ নেই এবং তুমি যা রোধ কর, তা দান করারও কেউ নেই। আর কোন মর্যাদাবানের মর্যাদা ও সম্পদশালীর সম্পদ তোমার শাস্তি থেকে কাউকে রক্ষা করতে পারেনা’’।[2]
আল্লাহর সাহায্য ব্যতীত গুনাহ হতে বিরত থাকা সম্ভব নয় এবং আল্লাহর তাওফীক ব্যতীত আনুগত্য করার ক্ষমতা লাভ করা যায়না। আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। আর আমরা তাঁরই ইবাদত করি। সকল নিয়ামাত তাঁরই, সকল অনুগ্রহ তাঁরই এবং তাঁরই জন্য সকল উত্তম প্রশংসা।
আল্লাহ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই। তার নিমিত্তেই আমরা একনিষ্ঠভাবে দ্বীন পালন করি। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে।’’
তিনি তাঁর উম্মাতের জন্য প্রত্যেক সলাতের পর নিম্নের দু’আগুলো পাঠ করা মুস্তাহাব হিসেবে নির্ধারণ করে দিয়েছেনঃ
سُبْحَانَ اللهِ (সুব্হানাল্লাহ) ৩৩ বার اَلْحَمْدُ للهِ (আল্হামদুলিল্লাহ) ৩৩ বার
اَللهُ اَكْبَرُ (আল্লাহু আকবার) ৩৩ সাথে নিম্নের কালিমা পড়া-
এবং একশত বার পূর্ণ করার জন্য এই দু’আটি বলবে-
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণ: লা-ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ দাহু লা- শারীকালাহু লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হাম্দু ওয়া হুয়া আলা- কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর।
অর্থ: আল্লাহ ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোন মাবূদ নেই, তিনি একক, তাঁর কোন অংশীদার নেই, তাঁর জন্য রাজত্ব এবং তাঁর জন্যই সকল প্রশংসা। তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।[3]
(সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি অত্র দুয়াটি বলবে তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে। যদিও তা সমুদ্রের ফেনা রাশি পরিমান হয়।[4])
সহীহ ইবনে হিববানে হারেছ বিন মুসলিম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, নাবী (ﷺ) বলেছেন- যখন তুমি ফজরের সলাত আদায় করবে তখন কথা বলার পূর্বে সাতবার এই দু’আ পড়বেঃ
اللّٰهُمَّ أَجِرْنِى مِنَ النَّارِ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে জাহান্নামের আগুন হতে বাঁচাও’’।[5] অতঃপর তুমি যদি সেই দিন মারা যাও, তাহলে আল্লাহ্ তোমাকে জাহান্নামের আগুন হতে পরিত্রাণ দিবেন। (এছাড়া ফরয সলাতের পর পাঠ করার জন্য আরও অনেক দু’আসমূহ সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে)
[2]. অর্থাৎ কোন মর্যাদাবানের মর্যাদা আল্লাহর নিকট থেকে কারও জন্য কিছু আদায় করে দিতে পারেনা অথবা আল্লাহর পক্ষ হতে কোন বিপদ আসলে কোন বিত্তশালীর বিত্ত তা প্রতিহত করতে পারেনা। (আল্লাহই ভাল জানেন) বুখারী, তাও. হা/৮৪৪, ইফা. হা/৮০৪, আপ্র. হা/৭৯৬, মুসলিম, হাএ. হা/১২২৫, ইফা. হা/১২১৪, আবু দাউদ,আলএ. হা/১৫০৫, নাসায়ী, মাপ্র. হা/১৩৪১, মিশকাত, হা/৯৬২
[3]. মুসলিম, হাএ. হা/১২৩৯, ইফা. হা/১২২৮, ইসে. হা/১২৪০, আবু দাউদ, আলএ. হা/১১০৪, সহীহ আত-তিরমিযী, মাপ্র. হা/৩৪১৩, নাসায়ী, মাপ্র. হা/১৩৩৯, মিশকাত, হা/৯৬২, সহীহ, তাহক্বীক্ব: আলবানী।
[4] . মুসলিম, হাএ. হা/১২৩৯, মুসনাদে আহমাদ হা/৮৮২০, মিশকাত, হাএ. হা/৯৬৭
[5]. আল্লামা ইবনুল কায়্যিম রহঃ) হাদীসটি যাদুল মাআদে উল্লেখ করেছেন। অন্যান্য ইমামগণ হাদীসটিকে সহীহ বা হাসান বললেও ইমাম আলবানী রহঃ) এ ব্যাপারে বিশাল আলোচনা করেছেন। তাঁর মতে হাদীসটি যঈফ।
তিনি যখন দেয়াল সামনে রেখে সলাত পড়তেন তখন দেয়াল ও তাঁর মাঝখানে এতটুকু জায়গা ফাঁকা রাখতেন যাতে একটি ছাগল চলাচল করতে পারে। দেয়ালের অনেক দূরে দাঁড়াতেন না; বরং তিনি সুতরার নিকটবর্তী হওয়ার আদেশ দিতেন। তিনি যখন কাঠি বা খুঁটি কিংবা গাছ সামনে নিয়ে সলাত পড়তেন তখন তিনি সেগুলো ডানে অথবা বামে রেখে দাঁড়াতেন; সরসূরি সামনে রাখতেন না। সফর অবস্থায় এবং মরুভূমিতে অবস্থানকালে তিনি স্বীয় বর্শা পুঁতে সেই দিকে ফিরে সলাত পড়তেন।
এটিকে তিনি সুতরা বানাতেন। কখনও তিনি স্বীয় বাহনকে সামনে রেখে সলাত পড়তেন। কখনও তিনি হাওদার কাঠকে [1] সোজাভাবে সামনে স্থাপন করে সে দিকে ফিরে সলাত পড়তেন। তিনি একটি তীর বা লাঠি দিয়ে হলেও মুসল্লিকে সুতরা স্থাপন করার আদেশ দিয়েছেন। আর তাও যদি না পাওয়া যায় তাহলে মাটিতে একটি রেখা টেনে রেখাটিকেই সুতরা হিসাবে মনে করে সলাত আদায় করতে বলেছেন। সামনে সুতরা না রেখে যদি সলাত পড়া হয়, তাহলে সহীহ সূত্রে বর্ণিত আছে যে, মহিলা, গাধা এবং কালো কুকুর সামনে দিয়ে অতিক্রম করলে সলাত বাতিল হয়ে যায়। এই বর্ণনার বিপরীতে যা বর্ণিত হয়েছে তা সহীহ হলেও সুস্পষ্ট নয়। আর যে সমস্ত সুষ্পষ্ট বর্ণনায় আছে যে মহিলা, গাধা এবং কালো কুকুর বা অন্য যে কোন প্রাণী সামনে দিয়ে অতিক্রম করুক তাতে সলাত বাতিল হবে না, তা সহীহ নয়। নাবী (ﷺ) কখনও সলাত পড়তেন। তখন আয়িশা (রাঃ) তাঁর সামনে কিবলার দিকে ঘুমিয়ে থাকতেন। তবে এই অবস্থা সলাতীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করার মত নয়। কেননা সলাতীর সামনে দিয়ে অতিক্রম করা হারাম। কিন্তু সলাতীর সামনে অবস্থান করা (ঘুমিয়ে থাকা) দোষণীয় নয়।
নিজ দেশে (মদ্বীনায়) থাকা অবস্থায় তিনি সর্বদা দশ রাকআত সলাতের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। এই দশ রাকআতের ব্যাপারে ইবনে উমার (রাঃ) বলেছেন- আমি রসূল (ﷺ) হতে দশ রাকআত সলাত স্মরণ রেখেছি। যোহরের পূর্বে দুই রাকআত, তার পরে দুই রাকআত, মাগরিবের পরে দুই রাকআত, ইশার পরে দুই রাকআত, যা তিনি বাড়িতে পড়তেন এবং ফজরের পূর্বে দুই রাকআত। যোহরের পরের দুই রাকআত সলাত একবার ছুটে গেল তিনি তা আসরের পরে নিষিদ্ধ সময়ে আদায় করেছেন। তিনি কখনও যোহরের পূর্বে চার রাকআত আদায় করতেন।
মাগরিবের পূর্বের দুই রাকআত সম্পর্কে নাবী (ﷺ) হতে সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন-
صَلُّوا قَبْلَ صَلاَةِ الْمَغْرِبِ قَالَ فِى الثَّالِثَةِ لِمَنْ شَاءَ كَرَاهِيَةَ أَنْ يَتَّخِذَهَا النَّاسُ سُنَّةً
‘‘তোমরা মাগরিবের পূর্বে সলাত আদায় কর। তৃতীয়বার তিনি বললেন- তবে যে ব্যক্তি তা পড়তে চায়। যাতে করে লোকেরা এটিকে সুন্নাতে মুআক্কাদাহ হিসেবে গ্রহণ না করে’’।[1] এটিই সঠিক কথা। মাগরিবের পূর্বে দুই রাকআত পড়া মুস্তাহাব, সুন্নাতে রাতেবা (মুআক্কাদাহ) নয়।
নাবী (ﷺ) সকল সুন্নাত ও যাবতীয় নফল সলাত বিশেষ কোন কারণ না থাকলে বাড়িতেই পড়তেন। বিশেষ করে মাগরিবের সুন্নাত তিনি বাড়িতেই আদায় করতেন। কখনও তিনি তা মসজিদে পড়েছেন বলে সহীহ সূত্রে প্রমাণিত নেই। তবে মসজিদে পড়লেও কোন অসুবিধা নেই। সমস্ত নফল সলাতের মধ্য হতে তিনি ফজরের সুন্নাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন। ফজরের সুন্নাত এবং বিতর সলাত তিনি সফরে বা নিজ বাসস্থানে থাকা অবস্থায় কখনও ছাড়েন নি। সফর অবস্থায় ফজরের সুন্নাত ও বিতর সলাত ব্যতীত অন্য কোন সুন্নাত পড়েছেন বলে কোন প্রমাণ পাওয়া যায়না।
ফিক্হবিদগণ বিতর ও ফজরের সুন্নাত- এদু’টির মধ্যে কোনটি বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী তা নিয়ে মতভেদ করেছেন। ফজরের সুন্নাতের মাধ্যমে দিবসের সলাত শুরু হয় এবং বিতর সলাতের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি হয়। এ জন্যই নাবী (ﷺ) এই দুইটি সলাত সূরা ইখলাস ও সূরা কাফিরুন দিয়ে পড়তেন। কেননা এই সূরা দু’টির মধ্যে তাওহীদে ইলমী ও তাওহীদে আমলী তথা তাওহীদুল আসমাও ওয়াস্ সিফাত এবং তাওহীদুল উলুহীয়াত সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং সূরা ইখলাসে আল্লাহর জন্য এমন পরিপূর্ণ একক ও অদ্বিতীয় হওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে, যা সকল প্রকার শির্কের পরিপন্থী। এই সূরায় আল্লাহর জন্য সন্তান ও পিতা হওয়ার ধারণাকে অস্বীকার করা হয়েছে। এটি তাঁর পরিপূর্ণরূপে অমূখাপেক্ষী, স্বয়ং সম্পূর্ণ এবং এক ও অদ্বিতীয় হওয়ার প্রমাণ বহন করে। আর এতে বলা হয়েছে, কেউ আল্লাহর সমকক্ষ হতে পারেনা। এ কথাটি আল্লাহর জন্য কোন উপমা, কোন দৃষ্টান্ত এবং তাঁর মত অন্য কেউ হওয়ার সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণরূপে দূর করে দিয়েছে।
সুতরাং সূরা ইখলাসে আল্লাহর জন্য সকল প্রকার কামালিয়াত তথা পরিপূর্ণ ও পবিত্র গুণ সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং ত্রুটিপূর্ণ সকল গুণ থেকে মুক্ত হওয়ার কথাটি জোর দিয়ে বলা হয়েছে। মূলতঃ এই সূরায় তাওহীদের মূলনীতিগুলো বর্ণনা করা হয়েছে, যা মেনে নিলে মানুষ সকল প্রকার গোমরাহ ও বাতিল ফির্কাহ থেকে দূরে থাকতে পারবে। তাই সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান।[1] কেননা কুরআনের বিষয় বস্ত্ত খবর ও হুকুম-আহকামের মাঝে সীমিত। হুকুম-আহকামের মধ্যে রয়েছে আদেশ, নিষেধ এবং মুবাহ বা বৈধ বিষয়সমূহ। আর তাতে রয়েছে দুই প্রকারের খবর। রয়েছে আল্লাহ্ তা‘আলার যাতে পাক এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে খবর আর রয়েছে মাখলুক তথা তাঁর সৃষ্টি সম্পর্কে বিভিন্ন সংবাদ। (যেমন অতীতের জাতিসমূহের খবরাদি, তাদের নিয়ামাত প্রাপ্তির খবর এবং আল্লাহর অবাধ্য জাতিসমূহের ধ্বংসের খবর কুরআন মজীদে বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে) সূরা ইখলাস বিশেষভাবে আল্লাহ্ সম্পর্কে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে খবর দিয়েছে বলেই এটি কুরআনের এক তৃতীয়াংশ।
আর সূরা ইখলাস পাঠকারী যেমন শির্কে এতেকাদী তথা আকীদায় শিরক হওয়া থেকে পরিত্রাণ পায় তেমনি সূরা কাফিরুন বান্দাকে তার আমলে শিরক সংঘটিত হওয়া থেকে মুক্ত রাখে। কথা ও কাজের পূর্বে যেহেতু ইলম (সঠিক আকীদাহ) জরুরী, ইলমই যেহেতু মানুষকে আমলের দিকে নিয়ে যায় এবং তা নিয়ন্ত্রণ করে তাই সূরা ইখলাস কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান আর সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান।[2]
কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করার কারণেই যেহেতু মানুষ শির্কে আমলীতে লিপ্ত হয় এবং এতে লিপ্ত অধিকাংশ মানুষই যেহেতু এর ক্ষতি সম্পর্কে অবগত হয়েই লিপ্ত হয় এবং এটিকে দূর করা শির্কে এতেকাদী তথা বিশ্বাসের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী শিরক দূর করার চেয়ে অধিক কঠিন, কারণ আকীদায় প্রবেশকারী শিরক দলীল-প্রমাণ পেশ করলে যেহেতু দূর হয়ে যেতে পারে আর যার আকীদায় শিরক আছে সে যখন ভালভাবে তা জানতে পারবে তখন তার পক্ষে জেনেবুঝে শির্কের উপর অবিচল থাকা যেহেতু সম্ভব নয়, তাই সূরা কাফিরুনে জোর দিয়ে বারবার শির্কে আমলীর প্রতিবাদ করা হয়েছে। এ জন্যই নাবী (ﷺ) কাবা ঘরের তাওয়াফের পর দুই রাকআত সলাতে উক্ত সূরা দু’টি পাঠ করতেন। কেননা হাজ্জ হচ্ছে তাওহীদের বিরাট একটি নিদর্শন।
এই সূরা দু’টি ফজরের সুন্নাতে পড়ার মাধ্যমে তিনি দিবসের আমল শুরু করতেন এবং বিতর সলাতে পড়ার মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটাতেন।
[2]. সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুথাংশের সমান। এর ব্যাখ্যায় আলেমগণের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে। কেউ কেউ বলেছেনঃ কুরআনের বিষয় বস্ত্ত মূলত চারটি বিষয়ের মধ্যে সীমিত। এতে এককভাবে আল্লাহর ইবাদতের আদেশ, শিরক ও পাপ কাজ থেকে নিষেধ, সৎ কাজের বিনিময়ে পুরস্কারের ওয়াদা এবং নাফরমানির ফলাফল হিসাবে শাস্তি দেয়ার ভয় দেখানো হয়েছে। উপরোক্ত চারটি বিষয় থেকে সূরা কাফিরুনে যেহেতু আল্লাহর ইবাদতের আদেশ দেয়া হয়েছে তাই এটি কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান।
আল্লামা আব্দুর রাহমান মুবারকপুরী তিরমিযীর ব্যাখ্যা তুহফাতুল আহওয়াযীতে বলেনঃ সূরা কাফিরুন কুরআনের এক চতুর্থাংশের সমান হওয়ার ব্যাখ্যা এই যে, কুরআন মজীদে তাওহীদ, নবুওয়াত, পার্থিব জীবনের হুকুম-আহকাম এবং পরকালের অবস্থা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। এই সূরাতে যেহেতু শির্কের সাথে সম্পূর্ণরূপে সম্পর্কচ্ছেদ করার মাধ্যমে তাওহীদকে সাব্যস্ত করা হয়েছে তাই এটি কুরআনের চারভাগের এক ভাগের সমান। আল্লাহই ভাল জানেন।
তিনি ফজরের সুন্নাতের পর ডান কাতে শয়ন করতেন। এই শয়নের ব্যাপারে দু’টি দল মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করেছে। যাহেরী মাজহাবের লোকেরা এই শয়নকে ওয়াজিব বলেছে। আরেক দল এটিকে মাকরুহ বলেছে। ইমাম মালেক (রহঃ) এবং অন্যান্য আলেমগণ এ ব্যাপারে মধ্যম পন্থা অবলম্বন করেছেন। তারা বলেছেন- একটু আরাম গ্রহণ করার জন্য এবং সামান্য সময়ের জন্য শয়ন করলে দোষের কিছু নয়। আর কেউ শয়নকে সুন্নাত মনে করে পালন করলে ইমাম মালেক (রহঃ) এবং অন্যান্য ইমামগণ মাকরুহ বলেছেন। আল্লাহই ভাল জানেন।
নাবী (ﷺ) বাড়িতে কিংবা সফরে থাকা অবস্থায় কখনও রাতের তাহাজ্জুদ সলাত বর্জন করেননি। রাতে যখন তাঁর ঘুম এসে যেত বা অসুস্থতা অনুভব করতেন তখন তিনি দিনের বেলায় বার রাকআত সলাত আদায় করতেন। আমি শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমীয়া (রহঃ) কে বলতে শুনেছি, এতে দলীল রয়েছে যে, তাহিয়াতুল মসজিদ, সূর্য গ্রহণের সলাত এবং বৃষ্টির প্রার্থনার সলাতের ন্যায়ই বিতর সলাতের সময় চলে গেলে তা কাযা করা যাবেনা। কেননা বিতর সলাতের উদ্দেশ্য হচ্ছে তা যেন রাতের শেষ সলাত হয় (সুতরাং রাত চলে যাওয়ার কারণে তা আদায় ও কাযা করার সময় শেষ হয়ে গেছে)[1]। তিনি রাতে এগার অথবা তের রাকআত সলাত আদায় করতেন। এগার রাকআতের ব্যাপারে কোন মতভেদ নেই। শেষ দুই রাকআতের ব্যাপারে মতভেদ রয়েছে। তা কি ফজরের দুই রাকআত ছিল? না অন্য কোন সলাত?
ফরয সলাতের রাকআত সংখ্যার সাথে রাতের সলাতের রাকআত সংখ্যা এবং সুন্নাতে রাতেবার (মুআক্কাদার) রাকআত সংখ্যা যদি মিলানো হয় তাহলে দেখা যায় যে, রাত ও দিনের সলাত সব মিলে চল্লিশ রাকআত হয়। এই মোট চল্লিশ রাকআত সলাত তিনি যত্নসহকারে আদায় করতেন। এর বাইরে তিনি যে সমস্ত সলাত পড়েছেন তা নিয়মিত পড়েন নি। সুতরাং মুসলিম বান্দার উচিৎ মৃত্যু পর্যন্ত এই সলাতগুলো আদায় করা। যে ব্যক্তি দিনে ও রাতে আল্লাহর দরজায় চল্লিশবার করাঘাত করবে আশা করা যায় যে, তার জন্য দ্রুত সেই দরজা খুলে দেয়া হবে এবং তার কথা শ্রবণ করা হবে। রাতে যখন তিনি জাগ্রত হতেন তখন এই দু’আ পাঠ করতেনঃ
لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ سُبْحَانَكَ اللّٰهُمَّ إِنِّي أَسْتَغْفِرُكَ لِذَنْبِي وَأَسْأَلُكَ رَحْمَتَكَ اللّٰهُمَّ زِدْنِي عِلْمًا وَلا تُزِغْ قَلْبِي بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنِي وَهَبْ لِي مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً إِنَّكَ أَنْتَ الْوَهَّابُ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই। তুমি পবিত্র। হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আমার গুনাহ থেকে ক্ষমা চাচ্ছি। আমি তোমার রহমত কামনা করছি। হে আল্লাহ! তুমি আমার জ্ঞান বৃদ্ধি করে দাও। আমাকে সঠিক পথ দেখানোর পর আমার অন্তরকে বক্র করে দিওনা। তোমার পক্ষ হতে আমাকে রহমত দান করো। নিশ্চয়ই তুমি মহান দাতা’’।[2]
[2] . আবু দাউদ, আলএ. হা/১১০৪, শাইখ আলবানী এই হাদীছকে যঈফ বলেছেন।