(ক) মুরাতালা :
আরবি مراطلة শব্দটি رطل থেকে উদ্গত। যা مفاعلة এর মাসদার। পরিভাষায় মুরাতালা বলা হয় ওজনে সোনার বিনিময়ে সোনা কিংবা রুপার বিনিময়ে রুপা বিক্রি করাকে।[1]
ইমাম মালেক রহ. বলেন, ‘আমাদের মতে তোলার হিসেবে স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করায় কোনো সমস্যা নেই। যেমন- কেউ নগদ মূল্যে দশ দিনারের বিনিময়ে দশ দিনার কিনল সেটাকে টাকা হিসেবে নয় স্বর্ণ হিসেবে পরিমাপ করে। এতে কোনো অসুবিধা নেই যদিও সংখ্যা কমবেশি হয়। এ ব্যাপারে দিরহামের হুকুমও অভিন্ন।[2]
এর ওপর ভিত্তি করে বলা যায়, স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ এবং রৌপ্যের বিনিময়ে রৌপ্য বিক্রি করার ক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় এর সংখ্যা নয় ; ওজন। অতএব কারো কাছে যদি সোনার দশটি টুকরো থাকে এবং সে তা বিক্রি করে পাঁচ টুকরো সোনার বিনিময়ে। আর দশ টুকরো সোনা যদি ওজনে পাঁচ টুকরোর সমান হয় তাহলে তা বৈধ। ইমাম মালেক রহ. মুরাতালা বলে এটাই উদ্দেশ্য নিয়েছেন।
(খ) সরফ :
মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে প্রচলিত একটি লেনদেন পদ্ধতি সরফ। এদিকে সময় দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে। বদলাচ্ছে মানুষের লেনদেন পদ্ধতি। ইসলাম এ ব্যাপারে একেবারে উদাসীন নয়। তাই সরফ কোনটা বৈধ কোনটা বৈধ নয়- ইসলাম সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা করেছে।
মালেক বিন আউস বিন হাদাসান রহ. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি বললাম, কে আমার সঙ্গে দিরহাম দিয়ে বাইয়ে সরফ করবে ? তালহা বিন উবাইদুল্লাহ বললেন, (তিনি তখন উমর বিন খাত্তাবের রা. কাছে ছিলেন)- আমাদেরকে তোমার স্বর্ণ দেখাও। তারপর আমাদের গোলাম যখন আসবে তোমাকে তোমার রৌপ্য দিয়ে দিব। উমর বিন খাত্তাব রা. বললেন, খোদার দোহায় এমন করো না কখনো। তাকে রৌপ্য দাও নয়তো তার স্বর্ণ তাকে ফেরত দিয়ে দাও। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, রুপা সোনার বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা যদি হাতে হাতে তথা নগদ বিক্রি করা হয়। গম গমের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ; হ্যা, যদি নগদ বিক্রি করা হয়, যব যবের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয় এবং খেজুর খেজুরের বিনিময়ে বিক্রি করা সুদ হ্যা যদি নগদ বিক্রি করা হয়।[3]
ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘উলামায়ে কিরাম বলেছেন, এ হাদিসের অর্থ- পণ্য এবং মূল্য হস্তগত হওয়া। সুতরাং এ হাদিস দ্বারা জানা গেল, সুদী পণ্যকে সুদী পণ্যের মোকাবেলায় বেচতে হলে শর্ত হলো, পণ্য এবং মূল্য উভয়টা নগদ হস্তগত হতে হবে- যখন উভয়ের ইল্লত অভিন্ন হবে। চাই উভয়ের জাত এক হোক যেমন- স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ কিংবা জাত ভিন্ন যেমন- রৌপ্যের বিনিময়ে স্বর্ণ সোনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইল্লত এক জাত ভিন্ন- এমন দুই সামগ্রীর লেনদেনের ব্যাপারেই উপরিউক্ত হাদিসে সতর্ক করেছেন।
আর তালহা বিন আব্দুল্লাহ রা. স্বর্ণ মালিকের সঙ্গে সরফ করতে চেয়েছিলেন। অভিপ্রায় ছিল তিনি স্বর্ণ নিবেন আর রৌপ্য দিবেন পরে খাদেম এলে। এমন করেছিলেন তিনি অন্যান্য বিক্রয় চুক্তির মতো এটাকে হালাল মনে করে। তখনো তিনি মাসআলা জানতেন না যে এটা অবৈধ। সেহেতু উমর রা. তাঁর কাছে হাদিসটি পৌঁছে দেন। ফলে তিনি সরফের এ চুক্তি বাতিল করে দেন।[4]
সুফিয়ান বিন উয়ায়না আমর বিন মিনহাল থেকে বর্ণনা করেন, একদা আমার এক ভাগীদার আগামী মৌসুম বা হজ পর্যন্ত সময় দিয়ে বাকিতে রুপা বিক্রি করল। আমার কাছে আগমন করে সে এ কথা বললে আমি তাকে বললাম, এটা অবৈধ কাজ। সে বলল, আমি এটা বাজারে বিক্রি করলাম কেউ তো আমাকে বারণ করল না। এ কথা শুনে আমি বারা বিন আযেবের রা. কাছে গেলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মদিনায় তাশরিফ আনলেন, আমাদের মাঝে তখন এমন বিক্রয় চুক্তির প্রচলন ছিল। তিনি আমাদের বললেন, ‘যেটা নগদ হবে সেটায় সমস্যা নেই আর যা বাকিতে হবে সেটা সুদ।’ তুমি যায়েদ বিন আরকাম রা. এর কাছে যাও। কারণ তিনি আমার চেয়ে বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। (সুতরাং তিনি এ ব্যাপারে ভালো জানবেন।) আমি তাঁর কাছে গেলাম এবং এ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি একই উত্তর দিলেন।[5]
ইমাম বুখারি রহ. বলেন, (এ অধ্যায় নগদ মূল্যে সোনা দিয়ে রুপা কেনা সম্পর্কে) তারপর তিনি আবু বাকরা রা. এর হাদিস উল্লেখ করেছেন। হাদিসে বলা হয়েছে- নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রুপার বিনিময়ে রুপা এবং সোনার বিনিময়ে সোনা বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন। হ্যা যদি সমান সমান হয় তাহলে বৈধ। এবং তিনি আমাদেরকে যেভাবে ইচ্ছে সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা কেনার অনুমতি দিয়েছেন।[6]
ইমাম বুখারি বারা বিন আযেব এবং যায়েদ বিন আরকাম থেকে বর্ণনা করেন, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাকিতে স্বর্ণ দিয়ে রেŠপ্য কিনতে নিষেধ করেছেন।[7]
উপরের হাদিসগুলো দ্বারা আমরা বুঝলাম-
- সোনার বিনিময়ে সোনা বাইয়ে সরফ হিসেবে বিক্রি করা বৈধ। শর্ত হলো, সমান সমান এবং নগদ নগদ হতে হবে।
- সোনার বিনিময়ে রুপা এবং রুপার বিনিময়ে সোনা বেচা জায়িয। শর্ত হলো, তা হতে হবে নগদ। আর কমবেশি করা, যেমন ওজনে সোনা বেশি হওয়া বা রুপা বেশি হওয়া- তো এতে কোনো সমস্যা নেই। শর্ত শুধু এই যে, সেটা হতে হবে সরফ চলাকালেই একেবারে হাতে হাতে।
- সোনার বিনিময়ে সোনা বা সোনার বিনিময়ে রুপা কেনা বা বেচা বাকিতে কোনোটাই বৈধ নয়। সুতরাং কেউ যদি সোনার বিনিময়ে সোনা খরিদ করতে চায় আর একজন সোনা হস্তান্তর করে অন্যজন বাকি রাখে তাহলে তা কিছুতেই বৈধ হবে না। কারণ এ চুক্তিতে পণ্য এবং মূল্য হস্তান্তর করার শর্ত লঙ্ঘিত হয়েছে।
[2]. মুয়াত্তা ইমাম মালেক : ২/৬৩৮
[3]. বুখারি : ২১৭৪, মুসলিম : ১৫৮৬
[4]. শরহুন নাবাবি : ১১/১৩
[5]. বুখারি : ২১৮০, মুসলিম : ১৫৮৯
[6]. বুখারি : ২১৮২
[7]. বুখারি : ২১৮১, যারকানি, শরহুল মুয়াত্তা : ৩/২৮২
মুসলমান মাত্রেই চায় শরিয়তের বিষয়গুলো দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে। তাই সে ওয়াজিবগুলো পালন করে। হারাম এবং মাকরুহ বিষয়গুলো বর্জন করে। সচেষ্ট থাকে মুস্তাহাব কাজগুলো বেশি বেশি করতে। মুবাহ কাজগুলোর মধ্যে নিজ অবস্থা ও প্রয়োজন অনুপাতে কোনোটা করে আবার কোনোটা ছাড়ে। আর দূরে থাকে অস্পষ্ট এবং শংকাপূর্ণ কাজ থেকে। কারণ সে জানে অস্পষ্ট কাজগুলোই সুস্পষ্ট হারাম কাজে লিপ্ত করে।
নুমান বিন বাশির রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- কে বলতে শুনেছি (এ কথা বলে তিনি আঙ্গুল দিয়ে নিজ কানের দিকে ইঙ্গিত করেন; অর্থাৎ নিজ কানে শুনেছি।)- ‘নিশ্চয় হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট; এতদুভয়ের মাঝে রয়েছে অস্পষ্ট বিষয়াবলি- যা অধিকাংশ লোকই জানে না। সুতরাং যে অস্পষ্ট বিষয়াবলি থেকে দূরে থাকবে তা তার সম্মান ও দীনদারি উভয়ের জন্য কল্যাণকর সাব্যস্ত হবে। পক্ষান্তরে যে এতে পতিত হবে সে হারামে লিপ্ত হবে। যেমন- রাখাল সংরক্ষিত এলাকা থেকে সভয়ে দূরে থাকে যাতে সে এতে ঢুকে না পড়ে। মনে রেখ প্রত্যেক রাজারই কিছু সংরক্ষিত স্থান থাকে আরও মনে রেখ আল্লাহর সংরক্ষিত এলাকা (যার সীমানা অতিক্রম করা নিষিদ্ধ) হলো, তাঁর হারাম ঘোষিত বিষয়গুলি। তোমরা মনে রেখ, নিশ্চয় (মানুষের) শরীরে একটি মাংসপিন্ড আছে। সেটা যদি সুস্থ থাকে তাহলে সারা দেহ সুস্থ আর সেটা যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে তাহলে সারা শরীর অসুস্থ হয়ে যায়। মনে রেখ সেটা হলো কলব বা আত্মা।’[1]
ইমাম নাববি রহ. বলেন, ‘এ হাদিসের সীমাহীন গুরুত্ব ও অপরিসীম তাৎপর্যের ব্যাপারে আলেমগণ একমত। এটি সে হাদিসসমূহের অন্যতম যেগুলোর ওপর শরিয়তের ভিত্তি। একদল আলেম বলেছেন, হাদিসটি ইসলামের এক তৃতীয়াংশ। অপর দুই তৃতীয়াংশের একটি ‘নিশ্চয় কাজের ফলাফল নিয়তের ওপর নির্ভরশীল’[2] এবং মানুষের ইসলামের সৌন্দর্য হলো, সে অনর্থক কাজ পরিহার করবে শীর্ষক হাদিস।[3]
ইমাম আবু দাউদ রহ. বলেন, পুরো ইসলাম চারটি হাদিসকে ঘিরে আবর্তিত। উল্লেখিত তিনটি এবং ‘তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য তাই পছন্দ করবে নিজের জন্য যা করে’[4] শীর্ষক হাদিস। কেউ বলেছেন, চতুর্থ হাদিসটি হলো, তুমি দুনিয়ার ব্যাপারে বিরাগ হও আল্লাহ তোমাকে ভালোবাসবেন আর মানুষের হাতে যা রয়েছে তা থেকে বিরাগ হও লোকে তোমাকে ভালোবাসবে।[5]
উলামায়ে কিরাম বলেন, (নুমান বিন বাশির রা. বর্ণিত) হাদিসটি অবর্ণনীয় গুরুত্বের দাবিদার এ জন্য যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এতে বস্ত্র, আহার্য ও পানীয়সহ মৌলিক সবকিছু সংশোধন করার কথা বলেছেন। তাগিদ দিয়েছেন অস্পষ্ট বিষয় থেকে সচেতনভাবে দূরে থাকার প্রতি। কারণ তা ধার্মিকতা ও সম্মান রক্ষায় সহায়ক। সতর্ক করেছেন সন্দেহে পতিত হওয়া থেকে। উপরন্তু বিষয়টাকে স্পষ্ট করেছেন সংরক্ষিত স্থানের চমৎকার এক দৃষ্টান্ত পেশ করে। অবশেষে সবচে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটিও উল্লেখ করেছেন। আর সেটা হলো, আত্মার প্রতি লক্ষ্য রাখা। তাঁর কথা, আত্মা শুদ্ধ থাকলে সারা দেহ ঠিক এর ব্যতিক্রম হলে পুরো দেহে সমস্যা দেখা দিবে।
তবে পয়গম্বর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর উক্তি ‘হালাল সুস্পষ্ট এবং হারাম সুস্পষ্ট’ এর অর্থ, - বিষয় মোট তিন প্রকার।
(ক) সুস্পষ্ট হালাল- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- রুটি, মধু ইত্যাদি।
(খ) সুস্পষ্ট হারাম- যা বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না; যে কেউ বুঝতে পারে। যেমন- মদ, শূকর ইত্যাদি।
(গ) মুশ্তাবিহাত অর্থাৎ যার হালাল হওয়া বা হারাম হওয়া কোনোটাই স্পষ্ট নয়। অধিকাংশ লোকই এর হুকুম বুঝতে পারে না। শুধু উলামায়ে কিরাম কিয়াস, নস বা অন্য কোনোভাবে তার হুকুম জানেন।[6]
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা তিনি যেন আমাদেরকে তাঁর প্রিয় কাজগুলো করার এবং অপ্রিয় কাজগুলো থেকে বিরত থাকার তাওফিক দেন। আমিন।
[2]. বুখারি : ০১, মুসলিম : ১৯০৭
[3]. মুয়াত্তা মালেক : ৩/৯০৩
[4]. বুখারি : ১৩, মুসলিম : ৪৫
[5]. ইবনে মাজাহ : ৪১০২, ইমাম নাববি বলেন, ইবনে মাজা র. এ হাদিসটি হাসান সনদে বর্ণনা করেছেন। শরহুন নাববি ১১/২৮
[6]. শরহুন নাববি : ১১/২৮
এ মাসআলা সম্পর্কে সৌদি মুফতি বোর্ডের লিখিত ফতোয়া প্রকাশ করা হয়েছে। নিম্নে হুবহু তার অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
হামদ ও সালাতের পর, সৌদি মুফতি বোর্ড বরাবর উপস্থাপিত ‘শরয়ি দৃষ্টিকোণে কাগজের টাকা ও তার বিধান’ শীর্ষক গবেষণাকর্মটি বোর্ডের সদস্যবৃন্দ যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে অধ্যয়ন করেছেন। তারা পরস্পর আলোচনা-পর্যালোচনা এবং বিচার-বিশ্লেষণ করে নিম্নোক্ত বিষয়গুলোয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন।
প্রথমত. যেহেতু সোনা-রুপাই টাকার মূল এবং আলেমদের বিশুদ্ধ মতানুসারে সোনা-রুপায় তাদের মূল্যমানই সুদের ইল্লত আর ফকিহদের মতানুসারে উৎস এক হওয়া সত্ত্বেও সোনা-রুপাতেই মূল্যমানতা সীমাবদ্ধ নয় তাই। এবং যেহেতু টাকাই বর্তমানে মূল্য হিসেবে প্রচলন পেয়েছে, লেনদেনের বেলায় স্থান দখল করেছে সোনা-রুপার, এমনকি এ দিয়ে লেনদেন চলে, মানুষ এটা অর্জন ও সঞ্চয় করে তৃপ্তির ঢেকুর তোলে অথচ নিছক কাগজ হিসেবে তার কোনো মূল্য নেই; মূল্য তার অতিরিক্ত কারণে সেটা হলো, এর দ্বারা আস্থা অর্জন করা এবং লেনদেনের সময় বিনিময় মাধ্যম স্থির হওয়া আর এটাই মূল্যযোগ্য হওয়ার উদ্দেশ্য- এতসব কারণে মুফতি বোর্ড সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, কাগজের টাকা একধরনের স্বতন্ত্র মুদ্রা যার বিধান সোনা-রুপার বিধানের অনুরূপ। সুতরাং এতে জাকাত ওয়াজিব হবে এবং এর ওপর সোনা-রুপার মতো সুদের উভয় প্রকার তথা ফযল ও নাসিয়া খাটবে। এককথায় কাগজের টাকা শরিয়তের সকল লেনদেনের ক্ষেত্রে সোনা-রুপার অনুরূপ হবে।
দ্বিতীয়ত. সোনা-রুপা ও অন্যান্য মুদ্রার মতো কাগজকেও স্বতন্ত্র মুদ্রা হিসেবে ধরা হবে। তেমনি কাগজের নোটকেও বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করা হবে। এটা হবে দেশ ও প্রকাশ-প্রচলন স্থানের ভিন্নতা বিচার করে। অর্থাৎ সৌদি টাকা এক শ্রেণী আর মার্কিনি টাকা আরেক শ্রেণী। এভাবে প্রত্যেক দেশের টাকা মুদ্রার একেক স্বতন্ত্র শ্রেণী হিসেবে গণ্য হবে। আর সে অনুযায়ী সোনা-রুপা ও অন্যান্য মূল্যের মতো কাগজের মুদ্রা বা নোটের ওপরও সুদের বিধান খাটানো হবে।
আর এসবই নিম্নোক্ত বিষয়গুলো দাবি করে :
(ক) কেবল নগদ ছাড়া বাকিতে কোনোভাবে কাগজের নোট একটার বদলে একটা কিংবা মুদ্রার অন্য কোনো প্রকার যেমন- সোনা,রুপা ইত্যাদির মোকাবেলায় বিক্রি করা বৈধ নয়। অতএব উদারণত, সৌদি রিয়াল অন্য কোনো দেশের কাগজের টাকার মোকাবেলায় কমবেশি করে হস্তগত না করে বাকিতে বিক্রি করা বৈধ নয়।
(খ) একই (দেশের) ধরনের কাগজের মুদ্রার একটার মোকাবেলায় অন্যটা কমবেশি করে বিক্রি করা বৈধ নয়; চাই তা নগদে হোক বা বাকিতে। সুতরাং কাগজের সৌদি দশ রিয়াল কাগুজের এগারো রিয়ালের বিনিময়ে বিক্রি করা বাকিতে বা নগদে কোনোটাই বৈধ নয়।
(গ) দুই ধরনের দুই কাগজের মুদ্রা একটার বিনিময়ে আরেকটা বিক্রি করা বৈধ। যদি তা হয় হাতে হাতে। সুতরাং পাকিস্তানি রুপি দিয়ে সৌদি রিয়াল ক্রয় করা জায়িয। চাই তা সোনার হোক বা রুপার, কম হোক বা বেশি। তেমনি এক মার্কিন ডলার সৌদি তিন রিয়াল কিংবা তার কম বা বেশি দিয়ে বিক্রি করা এবং সৌদি রৌপ্য মুদ্রার বিনিময়ে সৌদি কাগুজে মুদ্রা কমবেশি করে বিক্রি করা জায়িয। যদি তা হয় নগদে। কারণ এটাকে এক জাতীয় মুদ্রার বিনিময়ে আরেক জাতীয় মুদ্রা বিক্রি হিসেবে গণ্য করা হবে। আর বাস্তবতা এবং মূল্য ভিন্ন হলে শুধু নাম এক হওয়ায় কোনো সমস্যা নেই।
তৃতীয়ত. সোনা-রুপার মতো কাগুজে মুদ্রার ওপরও জাকাত ফরজ হবে যখন স্বর্ণ বা রৌপ্য কোনোটার নেসাব পরিমাণ টাকা হবে। অথবা নেসাব পূর্ণ হবে অন্য কোনো মূল্য বা ব্যবসায়িক পণ্যের সঙ্গে মিলিয়ে।
চতুর্থত. কাগজের মুদ্রাকে বাইয়ে সলম এবং অংশীদারি কারবারগুলোতে মূলধন বানানো যাবে।[1]
প্রশ্ন: আমার কয়েক বস্তা চাল আছে সেটাকে আমরা গুদাম হিসেবে ধরি। আমার কাছে লোক এসে বাজার মূল্যে তা কিনল। তারপর সে আবার অন্য একজনের কাছে বাকিতে বিক্রি করল। চাল যখন ঋণগ্রহীতার হাতে পৌঁছল আমি তার কাছে গিয়ে আমার থেকে কেনা মূল্যের চেয়ে এক রিয়াল কমে কিনলাম। এবার আমার হাতে চাল আসার পর লোক এলো এবং আমার কাছ থেকে কিনল। এভাবে পণ্য একই স্থানে থাকল কিন্তু তা একেরপর এক বিক্রি হতে থাকল। এমন করলে কি গুনাহ হবে? জানিয়ে কৃতার্থ করবেন।
উত্তর: এটি মূলত সুদের ওপর হিলা। এমন রিবা যার মধ্যে নাসিয়া এবং ফযল উভয়ই বিদ্যমান। এটা এভাবে যে ঋণদাতা এর মাধ্যমে উদাহরণ স্বরূপ দশ টাকা দিয়ে বারো টাকা উপার্জন করতে চাচ্ছে।
প্রশ্ন: পণ্য সস্থানে রেখে বাকিতে তার কেনা-বেচা অব্যাহত রাখার বিধান কী? বর্তমানকালে এ ধরনের বাকি লেনদেন ব্যাপক প্রচলন পেয়েছে।
উত্তর: মুমিনের জন্য কোনো পণ্য নগদে বা বাকিতে বিক্রি করা ততক্ষণ বৈধ নয়, যতক্ষণ না সে এর মালিক হয় এবং পণ্য তার হাতে আসে। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হাকিম বিন হাযাম রা. কে বলেছেন- ‘যা তোমার কাছে নেই তা বিক্রি করতে পার না।’[1] অন্যত্র বলেছেন- ‘যা তোমার হাতে নেই তা তুমি ঋণ হিসেবে কাউকে দিতে পারে না কিংবা বেচতেও পার না কারো কাছে।’[2] ঠিক তেমনি যে জিনিস কেনা হলো তাও সে বিক্রি করতে পারবে না, যতক্ষণ জিনিসটি তার হস্তগত হয়। কেননা ইমাম আহমদ ও আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন যে, যায়েদ বিন সাবেত রা. বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সদ্য কেনা পণ্য নিজ বাহনে ব্যক্তিগত হেফাজতে না নেয়া পর্যন্ত বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন।[3]
তেমনি ইমাম বুখারি তাঁর সহিহ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, আব্দুল্লাহ বিন উমর রা. বলেন, আমি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম- এর যুগে মানুষকে খাদ্যদ্রব্য বিক্রি করতে দেখেছি। দেখেছি তাদের শাস্তি দেয়া হতো যদি পণ্য নিজ বাহনে (সংরক্ষণে) না নিয়ে বিক্রি করত।[4] এ দু’টি ছাড়াও এ ব্যাপারে আরও অনেক হাদিস রয়েছে।[5]
[2] আবু দাউদ : ৩৫০৪, তিরমিযি : ১২৩৪, নাসায়ি : ৪৬১১
[3]. আবু দাউদ : ৩৪৯৯
[4]. বৃখারি : ২১৩১
[5]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৩-৩৮৪
প্রশ্ন: আমি এক নির্দিষ্ট ব্যক্তি থেকে চল্লিশ হাজার সৌদি রিয়ালের বিনিময়ে দশ হাজার আমেরিকান ডলার কিনেছি। এ চল্লিশ হাজার রিয়াল শোধ করব মাসিক কিস্তিতে। প্রতি কিস্তি এক হাজার রিয়াল। এখন আমি সে ডলারগুলো বাজারে নিয়ে সাইত্রিশ হাজার পাঁচশ রিয়াল দিয়ে বেচতে চাচ্ছি। এটা কি আমার জন্য বৈধ হবে? উল্লেখ্য যে, আমার এ টাকার খুব প্রয়োজন।
উত্তর: আপনার প্রশ্নের উত্তর, না। এমনটি করা হারাম। কেননা নোট বদলের সময় ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের বিনিময় হস্তগত না করা পর্যন্ত আলাদা হওয়া হারাম। আর প্রশ্নে বর্ণিত সুরতে দ্বিতীয় বিনিময় তথা ডলারের মূল্য পরিশোধ করা হয়নি। সুতরাং এ সুরত বাতিল ও প্রত্যাহারযোগ্য। এখন যা হবার তা যেহেতু হয়েই গেছে তাই যে ডলার নিয়েছে তার জন্য অত্যাবশ্যক হলো, ডলার ফেরত দেয়া এবং প্রথম চুক্তির ওপর নির্ভর না করা। কারণ তা অবশ্য বাতিলযোগ্য। আর এটা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন- প্রত্যেক শর্ত যা আল্লাহর কিতাবে নেই তা অবশ্য প্রত্যাহারযোগ্য যদিও তা একশ বার করা হোক না কেন। আল্লাহর ফয়সালাই সঠিক এবং আল্লাহর শর্তই অধিক মজবুত।[1]
প্রশ্ন: এক লোক অলঙ্কারাদি ক্রয়-বিক্রয় করে। একজন তার কাছে এলো কিছু ব্যবহৃত স্বর্ণ নিয়ে। সে ওই স্বর্ণ তার থেকে কিনে নিল। মূল্য নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। তারপর সে সময় ও সে স্থানে মূল্য পরিশোধের আগেই পুরাতন স্বর্ণ বিক্রেতার কাছে নতুন স্বর্ণ বিক্রি করল। এর দামও নির্ধারণ করল রিয়াল দিয়ে। এরপর যতটুকু বাকি থাকল তা পরিশোধ করবে টাকা দিয়ে। জানতে চাই- এটা কি জায়িয নাকি আগে প্রথম ক্রয়-চুক্তির টাকা বিক্রেতার কাছে পুরোটা দিয়ে দিতে হবে তারপর বিক্রেতা যে নতুন স্বর্ণ কিনেছে তার মূল্য ওই টাকা বা অন্য কোনো টাকা থেকে পরিশোধ করতে হবে?
উত্তর: এসব ক্ষেত্রে ওয়াজিব হলো প্রথমে ব্যবহৃত স্বর্ণ হস্তান্তর করা। তারপর বিক্রেতা যখন মূল্য হাতে পাবে তখন তার ইচ্ছা। চাইলে যার কাছে পুরাতন স্বর্ণ বিক্রি করেছে তার কাছ থেকে অথবা চাইলে অন্যের কাছ থেকে নতুন স্বর্ণ কিনবে। এখন সে যদি তার কাছ থেকেই নতুন স্বর্ণ কেনে তাহলে তার জন্য উভয় সুযোগ রয়েছে। চাইলে নতুন স্বর্ণের মূল্য হিসেবে তার টাকাই তাকে ফেরত দিবে অথবা অন্য টাকা দিবে। এমন করার উদ্দেশ্য যাতে মুসলমান সুদী দ্রব্যের ভালোর বদলে কমবেশি করে মন্দটা বিক্রি করার মতো হারাম কাজে লিপ্ত না হয়।
ইমাম বুখারি রহ. বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে খায়বরের গভর্নর বানিয়ে পাঠিয়েছিলেন। একবার তিনি তাঁর দরবারে জানিব নামক উৎকৃষ্ট জাতের খেজুর নিয়ে আসেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জিজ্ঞেস করেন খায়বরের সব খেজুরই এমন কি-না। তিনি উত্তর দেন, না। আমরা এ খেজুরের এক সা’ কিনি সাধারণ খেজুর দুই সা’ দিয়ে আর এর দুই সা’ নেই সাধারণ খেজুরের তিন সা’ দিয়ে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এমন করো না; বরং সাধারণ (জানিব) খেজুর কেনো দিরহাম দিয়ে তারপর সে দিরহামের বিনিময়ে জানিব কেনো।[1]
কারণ এ ধরনের ক্রয়-চুক্তিতে লেন-দেন ক্লিয়ার করণ যদিও একই সময়ে একই স্থানে হয় কিন্তু তা শেষ পর্যন্ত ‘সোনার বদলে কমবেশি করে সোনা বিক্রি’রই রূপ পরিগ্রহ করে। যা সুস্পষ্ট হারাম।
ইমাম মুসলিম রহ. উবাদা বিন সাবেত রা. থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন- সোনার বদলে সোনা, রুপার বদলে রুপা, গমের বদলে গম, যবের বদলে যব, খেজুরের বদলে খেজুর এবং লবণের বদলে লবণ বিক্রি করো নগদ নগদ এবং সমান সমান। তবে যখন এসব জিনিসের প্রকার পরিবর্তন করা হবে তো যেভাবে ইচ্ছে বিক্রি করো অবশ্য যখন সেটা হতে হবে নগদ নগদ। আবু সাইদ খুদরির এক রেওয়াতে আছে, যে বেশি দিবে অথবা বেশি নিবে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। দাতা -গ্রহীতা এক্ষেত্রে সমান অপরাধী।[2]
প্রশ্ন: আমি স্বর্ণ-বিক্রেতার কাছে কিছু পুরাতন স্বর্ণ নিয়ে গেলাম। স্বর্ণ-বিক্রেতা সেসব ওজন করে বললেন, এর দাম হবে ১৫০০ রিয়াল। তার কাছে ১৫০০ রিয়াল মূল্যে স্বর্ণগুলো বিক্রি করে আমি একই ব্যক্তির কাছ থেকে কিছু নুতন স্বর্ণ কিনলাম- যার দাম ১৮০০ রিয়াল। এখন জানতে চাচ্ছি, আমার জন্য কি জায়িয হবে যে আমি তাকে শুধু ৩০০ রিয়াল দিয়ে দিব? নাকি প্রথমে ১৫০০ রিয়াল হস্তগত করব তারপর একসাথে ১৮০০ রিয়াল তাকে দিব?
উত্তর: নগদ মূল্যে হাতে হাতে সমান দামে ছাড়া স্বর্ণের বিনিময়ে স্বর্ণ বিক্রি করা জায়িয নেই যদিও ভালো-মন্দ হিসেবে তার প্রকার বদলানো হোক না কেন- এ কথা হাদিসে বারবার বলা হয়েছে দ্ব্যর্থহীনভাবে। বৈধ উপায় হলো- যে স্বর্ণ দিয়ে স্বর্ণ কিনতে ইচ্ছুক সে প্রথমে তার কাছে যে স্বর্ণ আছে তা রুপা বা কাগজের মুদ্রা দিয়ে সে বিক্রি করবে তারপর সে মুদ্রা বা রুপা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বর্ণ কিনবে। তবে যদি সোনা-রুপা বিক্রি করা হয় কাগজের মুদ্রা বৈ অন্য কিছু দিয়ে যেমন- পরিবহন সামগ্রী কিংবা চিনি ইত্যাদির বিনিময়ে তবে চুক্তির উভয় মাধ্যম তথা পণ্য ও মূল্য হস্তগত করার আগেই ক্রেতা-বিক্রেতা মজলিস ত্যাগ করায় কোনো সমস্যা নেই। কারণ স্বর্ণ, রৌপ্য ও কাগজের মুদ্রা এবং এসব এবং এ ধরনের বস্ত্তর মাঝে রিবা বা সুদের বিধান প্রযোজ্য নয়। উল্লেখ্য যে, বিক্রি চুক্তি যখন বাকিতে হবে তখন পরিশোধের তারিখ নির্ধারণ করা জরুরি। কেননা আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, যখন তোমরা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পরস্পর ঋণের লেনদেন করবে, তখন তা লিখে রাখবে।’[3]
[2]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৮৯ আর হাদিসদ্বয়ের প্রাগুক্ত।
[3]. বাকারা : ২৮২, ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫২
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে একটি সোনার গহনা নিয়েছে। অলঙ্কারটির দাম এক হাজার রিয়াল। আমি তাকে বললাম, এটা নগদ ছাড়া বিক্রি করা বৈধ হবে না। সে বলল, তুমি আমাকে এক হাজার রিয়াল কর্জ দাও। আমি তাকে কর্জ দিলাম আর সে ওই রিয়ালই আমাকে গহনার মূল্য হিসেবে দিল। এমন করা বৈধ হবে কি?
উত্তর: না বৈধ হবে না। কারণ এটিও সুকৌশলে সুদী কারবার। উপরন্তু এতে দুই আকদ একত্রিত হচ্ছে। একটি বাকির আকদ অপরটি বিক্রির আকদ। আর এমনটিও নিষিদ্ধ।[1]
প্রশ্ন: আমার কাছে এক ব্যক্তি স্বর্ণালঙ্কার কিনতে আসল। তার পছন্দকৃত অলঙ্কারটি ওজন করে দেখা গেল তার কাছে যত টাকা আছে তা এর মূল্য হিসেবে যথেষ্ট নয়। এখন জানা কথা যে, তার কাছে স্বর্ণালঙ্কারটি বিক্রি করা এবং সেটা তার হাতে তুলে দেয়া বৈধ হবে না। কিন্তু সে যদি ধরুন প্রভাতে আমার কাছে এসে থাকে এবং বলে, অলঙ্কারটি আপনার কাছেই রাখুন আমি আসরের সময় এসে পুরা টাকা নিয়ে উপস্থিত হয়ে তবেই আপনার কাছ থেকে নিব।
জিজ্ঞাস্য হলো, এমতাবস্থায় আমার জন্য কি বিকালে তার টাকা পাবার এমন নিশ্চয়তার ওপর ভিত্তি করে এ অলঙ্কার তার ব্যাগে দিয়ে দেয়া বৈধ হবে? নাকি আমার কর্তব্য তার এ চুক্তিকে নিরর্থক মনে করা। তারপর সে যদি উপস্থিত হয় তখন সে অন্যান্য ক্রেতার মতো তার সঙ্গে নতুন ক্রয় চুক্তি কার্যকর করা? নয়তো আমাদের মাঝে কোনো চুক্তি নেই বলে মনে করব।
উত্তর: তার কথা মতো এ বিক্রয় চুক্তি কার্যকর করার সুযোগ নেই। যাবৎ না সে সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে উপস্থিত হয়। এভাবেই আপরি রিবায়ে নাসিয়া বা বাকি বিক্রির সুদ থেকে মুক্ত থাকতে পারেন। সুতরাং আপনি স্বর্ণালঙ্কারটি নিজের কাছেই রাখবেন। অতপর সে যখন সম্পূর্ণ মূল্য নিয়ে আপনার কাছে আসবে তখন আপনার উভয়ে নতুন এক ক্রয় চুক্তি করবেন যে চুক্তিতে উভয় মাধ্যম উপস্থিত বৈঠকেই সম্পন্ন হবে।[2]
[2]. ইসলামি ফতোয়া সংকলন : ২/৩৫৩
প্রশ্ন: আমি একজন কুয়েতি নাগরিক। আমাদের দেশে বিভিন্ন কৃষি ও বাণিজ্যিক কোম্পানি রয়েছে। রয়েছে ব্যাংক, বীমা ও পেট্রোল কোম্পানি। এ দেশের প্রতিটি নাগরিকের জন্য এসব কোম্পানির পার্টনার হওয়ার অনুমতি রয়েছে। জানতে ইচ্ছুক এসব কোম্পানিতে শেয়ার হোল্ডার হওয়া যাবে কি-না।
উত্তর: সবার জন্য এসব কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করা বৈধ যদি সে কোম্পানি সুদী কারবার না করে। যদি সুদী লেনদেন করে তাহলে জায়িয হবে না। কারণ কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমার মাধ্যমে সুদের হারাম হওয়া প্রমাণিত। তেমনিভাবে মানুষের জন্য বাণিজ্যিক বীমা কোম্পানিতে অংশগ্রহণ করাও বৈধ নয়। কারণ বীমা চুক্তিগুলো প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে পরিপূর্ণ। আর যেসব চুক্তি প্রতারণা, অজ্ঞতা এবং সুদে ভরা ইসলামের দৃষ্টিতে তার সবই হারাম।[1]
এ ব্যাপারে ইসলামি ফিকাহ বোর্ডের সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হয়েছে নিম্নে যা হুবহু তুলে দেয়া হলো- ইসলামি ফিকাহ বোর্ড পবিত্র মক্কাস্থ রাবেতা আলমে ইসলামি’র বিল্ডিংয়ে সাত দিনব্যাপী (১২-২৯ রজব ১৪০৬ হিঃ) অনুষ্ঠিত তার নবম বৈঠকে ভেবে দেখেছে যে, সুদী ব্যাংক ক্রমশ বেড়েই চলেছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে এসব ব্যাংকে মানুষের লেনদেন। অথচ তাদের কাছে এসব ব্যাংকের বিকল্প নেই বললেই চলে।
বৈঠকে এই ভয়ঙ্কর সমস্যা নিয়ে সম্মানিত সদস্যবৃন্দের সারগর্ভ আলোচনা যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে শোনা হয়। তাদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়, আধুনিক অর্থনীতির গবেষণা এ কথা সপ্রমাণ করেছে যে, সুদই বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি এবং শান্তি-সমৃদ্ধির পথে সবচে’ বড় হুমকি। বিশ্বের অনেক সমস্যার আড়ালেই রয়েছে এর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। চৌদ্দশ বছর আগেই ইসলামে হারাম ঘোষিত এই বিষাক্ত জীবাণু সমাজ থেকে নির্মূল করা ছাড়া বিশ্বশান্তি অধরাই থেকে যাবে চিরদিন। আর সুদ নির্মূলে সবচে’ কার্যকর পদক্ষেপ হলো, সুদ ও শরিয়ত অননুমোদিত লেনদেন মুক্ত ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা। নিম্নে বৈঠকের উলেখযোগ্য কয়েকটি সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হলো।
প্রথমত. প্রতিটি মুসলমানের কর্তব্য আল্লাহ কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত সুদী লেনদেন সর্বোতভাবে পরিহার করা। এবং সুদী কারবারে যে কোনো রকম সহযোগিতা থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয়ত. সুদী ব্যাংকগুলোর উত্তম বিকল্প হিসেবে ইসলামি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। প্রতিটি মুসলিম দেশ এবং বিশ্বের সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট এলাকায় ইসলামি ব্যাংকের প্রসার ঘটাতে হবে। এভাবে পূর্ণাঙ্গ ইসলামি অর্থনীতির বাস্তব রূপায়নে এসব ব্যাংক এক শক্তিশালী নেটওয়ার্কে পরিণত হবে।
তৃতীয়ত. প্রতিটি মুসলমানের জন্য দেশে-বিদেশে যেখানেই ইসলামি ব্যাংক বিদ্যমান সেখানে সুদী ব্যাংকে লেনদেন করা হারাম। কারণ ইসলামি ব্যাংকের মতো বিকল্পের বর্তমানে তার জন্য সুদী ব্যাংকে কারবার করার কোনো অজুহাত বাকি থাকে না। তার ওপর ওয়াজিব অপবিত্র পথ বর্জন করে পবিত্র পথে আসা এবং হারামের স্থলে হালাল নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা।
চতুর্থত. এ বৈঠক মুসলিম রাষ্ট্র প্রধান ও সুদী ব্যাংকসমূহের কর্ণধারদের প্রতি সুদের মতো পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য উদাত্ত আহবান জানাচ্ছে।
পঞ্চমত. সুদের লাভের পথে আহরিত সকল সম্পদই শরিয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কোনো মুসলিমের (আমানতকারী) জন্যই তা নিজের বা পরিবারস্থ লোকদের প্রতি এ টাকা ব্যয় করা বৈধ নয়। বরং উটিৎ হলো, এ টাকা সাধারণ জনকল্যাণ মূলক কাজে যেমন- মাদরাসা, হাসপাতাল ইত্যাদি নির্মাণে ব্যয় করা। তবে এ টাকা খরচ করার সময় দান-সদকার নিয়ত করা যাবে না। বরং নাপাকি থেকে পবিত্র হওয়ার নিয়ত করতে হবে।
আবার কোনো অবস্থাতেই সুদী ব্যাংক কর্তৃক প্রদত্ত লভ্যাংশ বিদেশি ব্যাংকগুলোর জন্য ফেলে রাখা যাবে না। এতে গুনাহ বা অপরাধ বাড়বে বৈ কমবে না। কারণ বিদেশি ব্যাংকগুলো এ টাকা খৃস্টান মিশনারি বা ইহুদি প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যয় করে। এবং শেষ পর্যন্ত মুসলমানদের এসব টাকা মুসলমানদেরই বিরুদ্ধে যুদ্ধ এবং তাদের সন্তানদের ঈমান হরণের পেছনে ব্যয় হয়।