হাদীসে এসেছে: আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ الرُّؤْيَا تَقَعُ عَلَى مَا تُعَبَّرُ، وَمَثَلُ ذَلِكَ مَثَلُ رَجُلٍ رَفَعَ رِجْلَهُ فَهُوَ يَنْتَظِرُ مَتَى يَضَعُهَا، فَإِذَا رَأَى أَحَدُكُمْ رُؤْيَا فَلَا يُحَدِّثْ بِهَا إِلَّا نَاصِحًا أَوْ عَالِمًا»
“স্বপ্নের যেভাবে ব্যাখ্যা করা হয় সেভাবে তা বাস্তবায়িত হয়। যখন তোমাদের কেউ স্বপ্ন দেখবে তখন আলেম অথবা কল্যাণকামী ব্যতীত কারো কাছে তা বর্ণনা করবে না”।[1]
আবূ দাউদ, তিরমিযী, ইবন মাজাহ আবূ রাযীন আল-উকাইলী থেকে বর্ণনা করেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«الرُّؤْيَا عَلَى رِجْلِ طَائِرٍ، مَا لَمْ تُعْبَرْ، فَإِذَا عُبِرَتْ وَقَعَتْ» .
“স্বপ্ন হলো, উড়ন্ত পায়ের মতো। (যা ভালো ও খারাপ উভয়ের সম্ভাবনা রাখে) যতক্ষণ না তার ব্যাখ্যা করা হয়। যখন একটি ব্যাখ্যা দেওয়া হয় তখন তা বাস্তবায়িত হয়”।[2]
হাদীসে আরো এসেছে: আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«كَانَتِ امْرَأَةٌ مِنْ أَهْلِ الْمَدِينَةِ لَهَا زَوْجٌ تَاجِرٌ يَخْتَلِفُ، فَكَانَتْ تَرَى رُؤْيَا كُلَّمَا غَابَ عَنْهَا زَوْجُهَا، وَقَلَّمَا يَغِيبُ إِلَّا تَرَكَهَا حَامِلًا، فَتَأْتِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَتَقُولُ: إِنَّ زَوْجِي خَرَجَ تَاجِرًا، فَتَرَكَنِي حَامِلًا، فَرَأَيْتُ فِيمَا يَرَى النَّائِمُ أَنَّ سَارِيَةَ بَيْتِي انْكَسَرَتْ، وَأَنِّي وَلَدْتُ غُلَامًا أَعْوَرَ، فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «خَيْرٌ، يَرْجِعُ زَوْجُكِ عَلَيْكِ إِنْ شَاءَ اللَّهُ تَعَالَى صَالِحًا، وَتَلِدِينَ غُلَامًا بَرًّا» فَكَانَتْ تَرَاهَا مَرَّتَيْنِ، أَوْ ثَلَاثًا كُلُّ ذَلِكَ، تَأْتِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَيَقُولُ: ذَلِكَ لَهَا، فَيَرْجِعُ زَوْجُهَا، وَتَلِدُ غُلَامًا، فَجَاءَتْ يَوْمًا كَمَا كَانَتْ تَأْتِيهِ، وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَائِبٌ، وَقَدْ رَأَتْ تِلْكَ الرُّؤْيَا، فَقُلْتُ لَهَا: عَمَّ تَسْأَلِينَ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَا أَمَةَ اللَّهِ؟ فَقَالَتْ: رُؤْيَا كُنْتُ أُرَاهَا، فَآتِي رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَسْأَلُهُ عَنْهَا؟ فَيَقُولُ: خَيْرًا، فَيَكُونُ كَمَا قَالَ: فَقُلْتُ: فَأَخْبِرِينِي مَا هِيَ؟ قَالَتْ: حَتَّى يَأْتِيَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَأَعْرِضَهَا عَلَيْهِ، كَمَا كُنْتُ أَعْرِضُ، فَوَاللَّهِ مَا تَرَكْتُهَا حَتَّى أَخْبَرَتْنِي، فَقُلْتُ: وَاللَّهِ لَئِنْ صَدَقَتْ رُؤْيَاكِ لَيَمُوتَنَّ زَوْجُكِ، وَتَلِدِينَ غُلَامًا فَاجِرًا، فَقَعَدَتْ تَبْكِي، وَقَالَتْ: مَا لِي حِينَ عَرَضْتُ عَلَيْكِ رُؤْيَايَ، فَدَخَلَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَهِيَ تَبْكِي، فَقَالَ لَهَا: مَا لَهَا يَا عَائِشَةُ؟ فَأَخْبَرْتُهُ الْخَبَرَ، وَمَا تَأَوَّلْتُ لَهَا، [ص:1382] فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: مَهْ يَا عَائِشَةُ «إِذَا عَبَرْتُمْ لِلْمُسْلِمِ الرُّؤْيَا فَاعْبُرُوهَا عَلَى الْخَيْرِ، فَإِنَّ الرُّؤْيَا تَكُونُ عَلَى مَا يَعْبُرُهَا صَاحِبُهَا، فَمَاتَ، وَاللَّهِ زَوْجُهَا، وَلَا أُرَاهَا إِلَّا وَلَدَتْ غُلَامًا فَاجِرًا»
“মদীনার অধিবাসী এক মহিলার স্বামী ছিল ব্যবসায়ী। ব্যবসায়িক কাজে বিভিন্ন দেশে আসা যাওয়া করত সে। যখনই তার স্বামী বিদেশে যেত তখনই সে নারী স্বপ্ন দেখত। আর তার স্বামী সর্বদা তাকে গর্ভবতী রেখে যেত। একদিন সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে বলল, আমার স্বামী সফরে গেছে। আমি গর্ভবতী। আমি স্বপ্ন দেখলাম, আমার ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে গেছে। আর আমি একটি এক চোখ কানা সন্তান প্রসব করেছি।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ভালো স্বপ্ন দেখেছো। ইনশাআল্লাহ তোমার স্বামী তোমার কাছে সহীহ-সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসবে আর তুমি একটি সুস্থ-সুন্দর সন্তান প্রসব করবে।
এভাবে সে দুবার বা তিনবার স্বপ্ন দেখেছে। আর প্রতিবারই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসেছে। তিনি প্রতিবার এরকম ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। আর প্রতিবার সে রকমই বাস্তবায়িত হয়েছে।
একদিন মহিলা আগের মতই আসল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন অনুপস্থিত ছিলেন। সে স্বপ্ন দেখেই এসেছে। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর বান্দী! তুমি রাসুলুল্লাহর নিকট কী জিজ্ঞেস করবে? সে বলল, আমি একটি স্বপ্ন প্রায়ই দেখি। অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে আসি। তিনি সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়।
আমি বললাম, তুমি আমাকে বল, কী স্বপ্ন দেখেছো? সে বলল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসুক, তারপর বলব। আমি তাকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলাম স্বপ্নটি বলার জন্য- যেমনটি আমার অভ্যাস। অবশেষে সে আমাকে স্বপ্নের কথা বলতে বাধ্য হল। আমি বললাম, আল্লাহর কসম! তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার স্বামী মারা যাবে। আর তুমি একটি অপূর্ণাঙ্গ বা অসুস্থ ছেলে প্রসব করবে।
তখন মহিলাটি বসে কাঁদতে লাগল। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এসে বললেন: হে আয়েশা! এর কী হয়েছে? আমি পুরো ঘটনা ও স্বপ্ন সম্পর্কে আমার দেওয়া ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানালাম।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হে আয়েশা, এটা কী করলে? যখন কোনো মুসলমানের স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবে তখন সুন্দর ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা দেবে। মনে রাখবে স্বপ্নের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, বাস্তবে তাই সংঘটিত হয়। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, আল্লাহ তা‘আলার কী ইচ্ছা জানি না। মহিলাটির স্বামী মারা গেল আর দেখলাম সে একটি অসুস্থ অপূর্ণাঙ্গ ছেলে প্রসব করল”।[3]
[2] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ৩৯১৪; আবূ দাউদ, হাদীস নং ৫০২০
[3] দারামী, ইবন হাজার রহ. হাদীসটিকে হাসান বলে অভিহিত করেছেন।
এক. স্বপ্ন বর্ণনা করার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। যাকে তাকে স্বপ্নের কথা বলা উচিত নয়।
দুই. সর্বদা আলেম, শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে স্বপ্নের কথা বলবে। যে শুভাকাঙ্ক্ষী নয় তার কাছে কোনো ধরনের স্বপ্নের কথা বলবে না।
তিন. স্বপ্ন একটি উড়ন্ত পায়ের মতো। এ কথার অর্থ হল শূন্যে ঝুলিয়ে রাখা পা যেমন যে কোনো সময় মাটিতে রাখা যায় আবার নীচে আগুন থাকলে তাতেও রাখা যায়। স্বপ্ন এমনই, এর ব্যাখ্যা ভালো করা যায় আবার খারাপও করা যায়। যে ব্যাখ্যাই করা হোক, সেটিই সংঘটিত হবে।
চার. মদীনার এই মহিলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে আসতেন। স্বপ্নটি বাহ্যিক দৃষ্টিতে খারাপ হলেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভালো ও সুন্দর ব্যাখ্যা করে দিয়েছেন। তাই স্বপ্ন দ্রষ্টার পরিচিতদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে ভালো আলেম তার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া উচিত।
পাঁচ. প্রশ্ন হতে পারে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কেন এ ধরনের ব্যাখ্যা দিলেন? এর উত্তর হলো:
(ক) এ মহিলার স্বপ্নের ব্যাখ্যা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কীভাবে করেছেন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা তা জানতেন না। তাই তিনি নিজের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করেছেন।
(খ) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা স্বপ্নের বাহ্যিক দিক সামনে রেখে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ঘরের চৌকাঠ দ্বারা স্বামী বুঝেছেন। আর এক চোখ অন্ধ সন্তান দ্বারা অপূর্ণাঙ্গ সন্তান বুঝেছেন।
(গ) স্বপ্নের খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা করা অনুচিত। স্বপ্ন ব্যাখ্যার এ মূলনীতির কথা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা আগে থেকে জানতেন না। এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে জানিয়েছেন। ফলে তিনি বিষয়টি জানতে পেরেছেন।
(ঘ) এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা এভাবে করা যেত, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। তাহল ঘরের চৌকাঠ ভেঙ্গে যাওয়ার অর্থ হলো, ঘর প্রশস্ত হবে। প্রাচুর্য ও সচ্ছলতা আসবে। আর এক চোখ কানা সন্তানের অর্থ হল, সন্তানটি তার চোখ দিয়ে শুধু ভালো বিষয় দেখবে। এটা হলো দূরবর্তী ব্যাখ্যা। আর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা করেছেন নিকটবর্তী ব্যাখ্যা।
ছয়. যার কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা চাওয়া হবে, তিনি যদি জানেন, এর ব্যাখ্যা খারাপ তবে তিনি তা বলবেন না। যথাসম্ভব ভালো ব্যাখ্যা করে দেবেন। নয়তো চুপ থাকবেন। অথবা বলবেন, আল্লাহ ভালো জানেন।
সায়ীদ ইবন মানসূর বর্ণনা করেন, আতা রহ. সব সময় বলতেন: স্বপ্নের ব্যাখ্যা যা দেওয়া হয়, সেটাই সংঘটিত হয়।[1]
প্রশ্ন হতে পারে তাহলে তাকদীরের ব্যাপারটা কী হবে? উত্তর সোজা। তাকদীরে এভাবেই লেখা আছে যে, অমুক ব্যক্তি এভাবে ব্যাখ্যা করবে। আর তাই সংঘটিত হবে। কিন্তু আমাদের কর্তব্য হবে, কখনো খারাপ বা অশুভ ব্যাখ্যা না দেওয়া। তাকদীরে কী আছে আমরা তা জানি না। এ জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে কোনো মানুষের কাছে স্বপ্নের কথা বলতে নিষেধ করেছেন। স্বপ্নের কথা শুধু তাকে বলা যাবে যে আলেম, বন্ধু, শুভাকাঙ্ক্ষী ও কল্যাণকামী। এ ছাড়া অন্য কারো কাছে নয়।
আরেকটি ঘটনা:
এক মহিলা একটি দুগ্ধপোষ্য শিশুকে নিয়ে ইমাম ইবন সীরীন রহ.র শিক্ষার মজলিসে আসল। তিনি ইমামের ছাত্রদের কাছে জিজ্ঞেস করলেন, ইমাম সাহেব কোথায়? ইমাম সাহেবের একজন বোকা ছাত্র বলল, আপনি তার কাছে কেন এসেছেন?
মহিলাটি বলল, আমি এ ছেলেটির ব্যাপারে একটি স্বপ্ন দেখেছি, তার ব্যাখ্যা জানার জন্য এসেছি। ছাত্রটি বলল, কী স্বপ্ন দেখেছেন? মহিলাটি বলল, আমি দেখেছি আমার এ ছেলেটি সাগর থেকে পানি পান করছে।
ছাত্রটি তাড়াতাড়ি ব্যাখ্যা দিল, বলল, তাহলে তো সে পেট ফুলে মারা যাবে। তৎক্ষণাৎ শিশুটির পেট ফুলে উঠল। আর চিৎকার করে মারা গেল। মহিলাটি কাঁদা শুরু করল। এরই মধ্যে ইমাম সাহেব এসে পড়লেন। ঘটনা শুনে তিনি বললেন: যদি তুমি স্বপ্নের ব্যাখ্যা না করে ছেড়ে দিতে তাহলে ছেলেটি এ দেশের সবচেয়ে বড় আলেম ও বিদ্বান হত।
সাগরের অর্থ শুধু পানের অযোগ্য নোনা পানিই নয়। সাগরের ব্যাখ্যা হল, মনি-মুক্তা, হীরা, প্রবাল। কাজেই যিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা করবেন তিনি সব সময় ইতিবাচক ও কল্যাণকর ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবেন।[2]
[2] আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া: শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আস সাদহান
তাবীর মানে স্বপ্ন ব্যাখ্যা করা। যার মাধ্যমে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা হয় তার বিবেচনায় কয়েক প্রকার হয়ে থাকে।
ইমাম বগভী রহ. বলেন: ব্যাখ্যা করার দিক দিয়ে স্বপ্ন কয়েক প্রকার হতে পারে।
প্রথমত: আল-কুরআনের আয়াত দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা প্রদান করা।
দ্বিতীয়ত: হাদীসে রাসূল দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
তৃতীয়ত: মানুষে মাঝে প্রচলিত বিভিন্ন প্রসিদ্ধ উক্তি দিয়ে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
চতুর্থত: কখনো বিপরীত অর্থ-গ্রহণনীতির আলোকে স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা।
স্বপ্নে রশি দেখার অর্থ হলো, ওয়াদা, অঙ্গীকার, প্রতিশ্রুতি। এ ব্যাখ্যাটি আল-কুরআনের নিম্নোক্ত আয়াত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
﴿وَٱعۡتَصِمُواْ بِحَبۡلِ ٱللَّهِ جَمِيعٗا﴾ [ال عمران: ١٠٣]
“তোমরা আল্লাহ তা‘আলার রশিকে শক্তভাবে ধারণ করো”। [সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ১০৩]
স্বপ্নে নৌকা বা জাহাজ দেখার ব্যাখ্যা হল মুক্তি পাওয়া। এ অর্থটি আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে।
﴿فَأَنجَيۡنَٰهُ وَأَصۡحَٰبَ ٱلسَّفِينَةِ وَجَعَلۡنَٰهَآ ءَايَةٗ لِّلۡعَٰلَمِينَ ١٥﴾ [العنكبوت: ١٥]
“আমরা তাকে উদ্ধার করেছি এবং উদ্ধার করেছি জাহাজের আরোহীদের”। [সূরা আল-‘আনকাবূত, আয়াত: ১৫]
স্বপ্নে কাঠ দেখার ব্যাখ্যা হলো, মুনাফেকী বা কপটতা। এ ব্যাখ্যাটি আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে নেওয়া হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿كَأَنَّهُمۡ خُشُبٞ مُّسَنَّدَةٞۖ ﴾ [المنافقون: ٤]
“যেন তারা দেওয়ালে ঠেস দেওয়া কাঠের মতই”। [সূরা আল-মুনাফিকূন, আয়াত: ৪]
পাথর স্বপ্ন দেখলে তার ব্যাখ্যা হবে অন্তরের কঠোরতা ও পাষণ্ডতা। এ ব্যাখ্যাটি আল-কুরআনের এ আয়াত থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যেখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ثُمَّ قَسَتۡ قُلُوبُكُم مِّنۢ بَعۡدِ ذَٰلِكَ فَهِيَ كَٱلۡحِجَارَةِ أَوۡ أَشَدُّ قَسۡوَةٗۚ ﴾ [البقرة: ٧٤]
“অতঃপর তোমাদের অন্তরগুলো কঠিন হয়ে গেল, যেন তা পাথরের মতো কিংবা তার চেয়েও শক্ত”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৭৪]
যদি স্বপ্নে রোগ-ব্যধি দেখা হয়, তাহলে তার ব্যাখ্যা হবে মুনাফিক। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা মুনাফিকদের সম্পর্কে বলেছেন,
﴿فِي قُلُوبِهِم مَّرَضٞ ١٠﴾ [البقرة: ١٠]
“তাদের অন্তরে রয়েছে ব্যধি”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১০]
যদি স্বপ্নে গোশত খেতে দেখে তাহলে তার অর্থ হতে পারে গীবত বা পরনিন্দা। কেননা গীবত সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿أَيُحِبُّ أَحَدُكُمۡ أَن يَأۡكُلَ لَحۡمَ أَخِيهِ مَيۡتٗا ﴾ [الحجرات: ١٢]
“তোমাদের কেউ কি পছন্দ করবে তার মৃত ভাইয়ের গোশত খাবে?” [সূরা আল-হুজুরাত, আয়াত: ১৩]
এই যে ব্যাখ্যার কথাগুলো বলা হলো, এগুলো যে এমন হতেই হবে তা জরুরি নয়। আবার সকলের ব্যাপারে ব্যাখ্যা একটিই হবে, তাও ঠিক নয়। একজন রোগীর স্বপ্ন আর সুস্থ মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক রকম হবে না। যদিও স্বপ্ন এক রকম হয়। তেমনি একজন মুক্ত মানুষ ও একজন বন্দী মানুষের স্বপ্নের ব্যাখ্যা এক রকম হবে না। স্বপ্নের ব্যাখ্যায় যেমন স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা লক্ষ্য করা হবে তেমনি স্বপ্নে যা দেখেছে তার অবস্থাও দেখতে হবে। যেমন কেউ স্বপ্নে দড়ি বা রশি দেখল। একজন স্বপ্নে দেখল সে একটি মজবুত রশি পেয়েছে। যা ছেঁড়া যাচ্ছে না। আরেকজন দেখল, সে একটা রশি ধরেছে কিন্তু তা ছিল নরম। দুটো স্বপ্নের ব্যাখ্যার মধ্যে বিশাল পার্থক্য হবে।
এক ব্যক্তি ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ.র কাছে বলল, আমি স্বপ্ন দেখলাম যে আমি আযান দিচ্ছি। তিনি বললেন, এর ব্যাখ্যা হল, তুমি হজ করবে। আরেক ব্যক্তি এসে বলল, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি আযান দিচ্ছি। তিনি বললেন, এর অর্থ হল, চুরির অপরাধে তোমার হাত কাটা যাবে।
লোকেরা জিজ্ঞেস করল, আপনি একই স্বপ্নের দু’ধরনের ব্যাখ্যা করলেন? তিনি বললেন, প্রথম লোকটি নেক আমল প্রিয়। সে ভালো কাজ করে থাকে। সে জন্য তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা নেক আমল হতে পারে। আমি আল-কুরআনের আয়াত-
﴿وَأَذِّن فِي ٱلنَّاسِ بِٱلۡحَجِّ ﴾ [الحج: ٢٧]
“তুমি মানুষের মাঝে হজের জন্য আযান তথা এলান দাও”। [সূরা আল-হজ, আয়াত: ২৭]
আর দ্বিতীয় ব্যক্তি হচ্ছে পাপাচারী। তাই তার স্বপ্নের ব্যাখ্যা পাপের শাস্তিই মানায়। তাই আমি আল-কুরআনের আয়াত-
﴿ثُمَّ أَذَّنَ مُؤَذِّنٌ أَيَّتُهَا ٱلۡعِيرُ إِنَّكُمۡ لَسَٰرِقُونَ ٧٠﴾ [يوسف: ٧٠]
“অতঃপর এক মুয়াজ্জিন (ঘোষণাকারী) আযান (ঘোষণা) দিল, হে কাফেলা! তোমরা তো চোর”। [সূরা ইউসুফ, আয়াত: ৭০]
স্বপ্নে কাক দেখার ব্যাখ্যা হলো, পাপাচারী পুরুষ। কারণ, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাকের নাম রেখেছেন ফাসেক মানে, পাপী।
তেমনি ইঁদুর স্বপ্নে দেখার ব্যাখ্যা হল, পাপাচারী নারী। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইঁদুরের নাম রেখেছেন ফাসেকা। মানে পাপাচারী মহিলা।
স্বপ্নে পাঁজর বা পাঁজরের হাড় দেখলে এর ব্যাখ্যা হবে, নারী। কারণ, নারীকে পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে বলে হাদীসে এসেছে।
এমনিভাবে কাঁচের পানপাত্র স্বপ্ন দেখার ব্যাখ্যা হলো, নারী। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাঁচের পানপাত্রকে নারীর রূপক অর্থে ব্যবহার করেছেন। যেমন, তিনি বলেছেন,
«رُوَيْدَكَ يَا أَنْجَشَةُ، لاَ تَكْسِرِ القَوَارِيرَ»
“হে আনজাশা! আরে আস্তে চল, নয়তো কাঁচের পান-পাত্রগুলো ভেঙ্গে যাবে”।[1]
এখানে কাঁচের পান-পাত্র বলতে তিনি সফরসঙ্গী মেয়েদের বুঝিয়েছেন। মানে তাড়াতাড়ি হাঁটলে মেয়েরা পেছনে পড়ে যাবে। তাই তাদের জন্য তিনি ধীরে ধীরে পথ চলতে বললেন।
কোনো ব্যক্তি স্বপ্নে ভীতিকর কিছু দেখল বা ভয় পেল। তার অবস্থার বিবেচনায় এর ব্যাখ্যা হতে পারে শান্তি ও নিরাপত্তা। যেমন, আল্লাহর তা‘আলার বাণী:
﴿وَلَيُبَدِّلَنَّهُم مِّنۢ بَعۡدِ خَوۡفِهِمۡ أَمۡنٗا﴾ [النور: ٥٥]
“তিনি তাদের ভয়-ভীতিকে শান্তি ও নিরাপত্তায় পরিবর্তন করে দেবেন”। [সূরা আন-নূর, আয়াত: ৫৫]
এমনিভাবে স্বপ্নে কান্না দেখলে এর ব্যাখ্যা হতে পারে আনন্দ। স্বপ্নে হাসতে দেখলে এর ব্যাখ্যা হতে পারে দুঃখ-কষ্ট। এ বিপরীত অর্থ-গ্রহণনীতি স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার রহস্য হল, স্বপ্নের দায়িত্বশীল ফিরিশতা যখন স্বপ্নে ইঙ্গিত প্রদান করে তখন সে বিষয়টি উল্টো করে দেখায়। কারণ, নিদ্রা আর জাগ্রত অবস্থা একটা আরেকটার বিপরীত।
তাবীর বা স্বপ্ন ব্যাখ্যার ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ.র কাছে এক মহিলা আসল। তিনি তখন দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। মহিলা বলল, হে আবূ বকর! আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। ইবন সীরীন রহ. বললেন, তুমি এক্ষুণি বলবে না আমাকে খেতে দেবে? মহিলা বলল, ঠিক আছে, আপনি খাওয়া শেষ করুন। খাওয়া শেষ করার পর তিনি মহিলাকে বললেন: এখন বল, তোমার দেখা স্বপ্ন। মহিলা বলল: আমি দেখলাম, আকাশের চন্দ্র সাতটি তারা (সুরাইয়া)-এর মধ্যে ঢুকে গেল। এরপর স্বপ্নের মধ্যে লোকেরা আমাকে বলল, ইবন সীরীনের কাছে খবরটা তাড়াতাড়ি পৌঁছে দাও।
ইবন সীরীন বললেন, ধিক! তোমাকে। কী দেখলে? আবার বল। এভাবে কয়েকবার তিনি বললেন। আর তিনি খুব অস্থির হয়ে গেলেন। তার চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল। তার বোন তাকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে? তিনি বললেন, এ মহিলাটি বলছে আমি সাত দিন পর মারা যাব। বর্ণনাকারী আসআছ বলেন, ঠিক সাত দিনের মাথায় আমরা ইমাম ইবন সীরীনকে দাফন করলাম।[1]
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বপ্নের কথা শুনতে পছন্দ করতেন। তিনি একদিন জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ গত রাতে স্বপ্ন দেখেছ? আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন: আমি স্বপ্ন দেখেছি, আকাশ থেকে তিনটি চাঁদ আমার ঘরের মধ্যে পতিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: তোমার স্বপ্ন যদি সত্যি হয়, তাহলে তোমার ঘরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তিন জন মানুষকে দাফন করা হবে।
এরপরে তো পর্যায়ক্রমে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু ও উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তার ঘরে দাফন করা হয়েছে।[2]
ইরাকের শাসক হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ একদিন স্বপ্নে দেখলেন, আকাশ থেকে জান্নাতের হুর সাদৃশ দুটো দাসী অবতীর্ণ হলো। একজনকে তিনি ধরতে পারলেন অন্য জন আকাশে উঠে গেল। স্বপ্ন দেখে তিনি খুব খুশী হলেন। এর ব্যাখ্যা জানার জন্য ইমাম ইবন সীরীনকে ডাকলেন।
ইবন সীরীন রহ. বললেন: এর ব্যাখ্যা হল, দুটো বিদ্রোহ (ফিতনা) সংঘটিত হবে। আপনি একটির মোকাবেলা করবেন। অন্যটিকে আপনি পাবেন না। (হয়ত আপনার পরে আসবে)
পরে দেখা গেল হাজ্জাজ ইবন ইউসুফ, ইবনুল আসআছের বিদ্রোহ মোকাবেলা করলেন। আর ইবনুল মুলাহহাবের বিদ্রোহ তিনি দেখে যাননি।
কীভাবে এ ব্যাখ্যা দেওয়া হলো? এর রহস্য কী?
এ স্বপ্নে দুটো ইঙ্গিত ছিল। প্রথমটি দাসী আর দ্বিতীয়টি হলো জান্নাতের হুর।
দুটো ইঙ্গিত পরস্পর বিরোধী। কারণ, হুর হল সুরক্ষিত। কিন্তু দাসী সুরক্ষিত নয়। অপর দিকে হুরের বিষয়টি দৃশ্যমান নয়, আর দাসীর বিষয়টি দৃশ্যমান। স্বপ্ন ব্যাখ্যার নিয়ম হল, এ রকম পরস্পর বিরোধী ইঙ্গিত দেখলে বাস্তব বা দৃশ্যমান ইঙ্গিত গ্রহণ করা হবে। এ বিবেচনায় এখানে দাসী দেখার বিষয়টি গ্রহণ করা হলো আর হুরের বিষয়টি গ্রহণ করা হল না।
আর দাসী হলো স্ত্রী নয়, এমন মেয়ে লোক। আর মেয়ে লোক হল ফিতনা-বিশৃংখলার উপকরণ। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার চলে যাওয়ার পর আমার উম্মতের ওপর সবচেয়ে ক্ষতিকর ফিতনা হিসেবে মেয়েদের রেখে গেলাম। তাই ইমাম ইবন সীরীন এ রকম ব্যাখ্যা করেছেন।[3]
এক ব্যক্তি ইমাম জাফর সাদিকের কাছে এসে বলল, আমি একটি স্বপ্ন দেখেছি। স্বপ্নটি হলো, একটি কাঁচের পেয়ালা আছে আমার। আমি তা থেকে পানাহার করি। কিন্তু তার মধ্যে একটি পিঁপড়া দেখলাম। সেও তা থেকে খাবার খায়। এর অর্থ কী?
ইমাম সাহেব বললেন, তোমার কি স্ত্রী আছে? সে বলল, হ্যাঁ। তিনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বাসায় কি কোনো পুরুষ কাজের লোক (দাস) আছে? সে বলল, হ্যাঁ আছে। তিনি বললেন, কাজের লোকটিকে বিদায় করে দাও। তাকে রাখায় তোমার কোনো কল্যাণ নেই।
লোকটি বাড়ী গিয়ে স্ত্রীকে স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যার কথা বলল। স্ত্রী বলল, এখন তোমার সিদ্ধান্ত কী? লোকটি বলল, আমি দাসটিকে বিক্রি করে বিদায় করে দেব। স্ত্রী বলল, যদি তাকে বিদায় করো তাহলে আমাকে তালাক দাও। লোকটি স্ত্রীকে তালাক দিল। স্ত্রী দাসটিকে কিনে নিল ও তাকে বিয়ে করল।
এ স্বপ্নের মধ্যে তিনটি বিষয়কে ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হয়েছে। প্রথম হলো, পুরুষ লোকটি। দ্বিতীয় হলো, পেয়ালা। আর তৃতীয়টি হলো, পিঁপড়া।
ইমাম জাফর সাদেক রহ. ব্যাখা করার আগে পুরুষ লোকটিকে জেনে নিলেন। আর এভাবেই কারো স্বপ্ন ব্যাখ্যা করার আগে তার সম্পর্কে জেনে নিতে হয়।
দ্বিতীয় ইঙ্গিত, কাঁচের পেয়ালা দ্বারা স্ত্রীকে বুঝায়। কারণ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নারীদের কাঁচের পাত্রের সাথে তুলনা করেছেন। যেমন, পূর্বোক্ত আলোচনায় তুলে ধরা হয়েছে।
তার থেকে পানাহার করার অর্থ হলো সহবাস। আর পিঁপড়া ও তার খাওয়ার অর্থ হলো সে তার স্ত্রীতে অংশগ্রহণ করে। পিঁপড়া দ্বারা দুর্বল সত্তা ও চোর বুঝায়। সে এমনভাবে খায়, কেউ দেখে না। এর মানে কাজের লোকটি পিঁপড়ার মতো চুপিসারে তার স্ত্রীকে ভোগ করে।[4]
[2] আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া: শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আস সাদহান। বর্ণনায়: মুস্তাদরাক হাকেম
[3] আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া: শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আস সাদহান
[4] আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া: শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আস সাদহান
ইমাম মুহাম্মাদ ইবন সীরীন রহ. বলেন: যদি স্বপ্নে কেউ মৃত ব্যক্তিকে দেখে তাহলে তাকে যে অবস্থায় দেখবে সেটাই বাস্তব বলে ধরা হবে। তাকে যা বলতে শুনবে, সেটা সত্যি বলে ধরা হবে। কারণ, সে এমন জগতে অবস্থান করছে যেখানে সত্য ছাড়া আর কিছু নেই।
যদি কেউ মৃত ব্যক্তিকে ভালো পোশাক পরা অবস্থায় বা সুস্বাস্থের অধিকারী দেখে, তাহলে বুঝতে হবে সে ভালো অবস্থায় আছে। আর যদি জীর্ণ, শীর্ণ স্বাস্থ্য বা খারাপ পোশাকে দেখে তাহলে বুঝতে হবে, ভালো নেই। তার জন্য তখন বেশি করে মাগফিরাত কামনা ও দো‘আ-প্রার্থনা করতে হবে।
কয়েকটি উদাহরণ:
ইবন উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, বিদ্রোহীরা যখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহুর বাসভবন ঘেরাও করল। তখন উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি গত রাতে স্বপ্ন দেখলাম, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, উসমান আমাদের সাথে তুমি ইফতার করবে। ঠিক ঐ দিনই উসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হলেন।[1]
আনাস ইবন মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, আবূ মূসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি স্বপ্নে দেখলাম, আমি একটি পাহাড়ের কাছে গেলাম। দেখি, পাহাড়ের উপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রয়েছেন আর পাশে আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু তাঁর হাত দিয়ে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুর দিকে ইশারা করছেন।
আমি আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহুর এ স্বপ্নের কথা শুনে বললাম, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেউন। আল্লাহর শপথ! উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তো মারা যাবেন! আচ্ছা আপনি কি বিষয়টি উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে লিখে জানাবেন? আবূ মূসা রাদিয়াল্লাহু আনহু বললেন, আমি উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে তাঁর জীবদ্দশায় তাঁর নিজের মৃত্যু সংবাদ জানাব, এটা কী করে হয়? এর কয়েকদিন পরই স্বপ্নটা সত্যে পরিণত হলো। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু শহীদ হয়ে গেলেন। কারণ, মৃত্যু পরবর্তী সত্য জগত থেকে যা আসে, তা মিথ্যা হতে পারে না। সেখানে অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার সুযোগ নেই।[2]
[2] আল কাওয়ায়েদুল হুসনা ফী তাবীলির রুইয়া: শাইখ আব্দুল্লাহ ইবন মুহাম্মাদ আস সাদহান
বাস্তব জীবনে ঘটবে এমন কিছু আকৃতি-প্রকৃতি আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তার বান্দাদের দেখিয়ে থাকেন। এ দেখানোটা স্বপ্নে কখনো সরাসরি আবার কখনো ইঙ্গিত বা প্রতীকী বার্তায় হয়ে থাকে। যেমন আমরা বলে থাকি, স্বপ্নে কাপড় বা জামা দেখার মানে হল দীন-ধর্ম। যদি কাপড় ভালো ও বড় দেখা হয়, তবে তা দীন-ধর্ম, তাকওয়া-পরহেজগারীর উন্নতি নির্দেশ করে। আর তা যদি মলিন, সংকীর্ণ, ছেঁড়া-ফাটা দেখা হয় তবে তা দীন-ধর্মের অবনতি বলে মনে করা হয়ে থাকে।
দীন-ধর্ম যেমন মানুষের আত্মাকে রক্ষা করে, পোশাক তেমনি মানুষের শরীর-স্বাস্থ্যকে হিফাযত করে। এ জন্য পোশাক আর ধর্ম একে অপরের ইঙ্গিত বহন করে।
স্বপ্নে আগুন দেখা মানে ফিতনা বা বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতা নির্দেশ করে। কারণ, আগুন দৃশ্যমান ধন-সম্পদ জ্বালিয়ে দেয় আর ফিতনা-অরাজকতা মানুষের অন্তর জ্বালায়। মানুষকে অস্থির করে তোলে।
নক্ষত্র বা তারকা স্বপ্নে দেখলে তার অর্থ হয় আলেম-উলামা, জ্ঞানী-গুণি। কারণ, আলেম-উলামা ও জ্ঞানীরা মানুষকে পথ প্রদর্শন করেন। আলোর সন্ধান দেন।
স্বপ্নে ইয়াহূদী দেখার অর্থ হলো দীন-ধর্মের বিষয়ে অবাধ্যতা আর খৃষ্টান দেখার অর্থ হলো, দীন-ধর্মে বিদ‘আত প্রবর্তন ও ধর্মীয় বিষয়ে পথভ্রষ্টতা।
স্বপ্নে লৌহ দেখার অর্থ হলো, শক্তি।
আর দাড়ি-পাল্লা দেখার অর্থ হলো, ন্যায়পরায়ণতা।
স্বপ্নে সাপ দেখার অর্থ হলো, শত্রু।
স্বপ্নে নিচে পড়ে যেতে দেখার অর্থ হলো, অবনতি আর উর্ধ্বে উঠতে দেখার অর্থ হলো, উন্নতি।
কোনো অসুস্থ ব্যক্তি যদি স্বপ্নে দেখে সে চুপচাপ ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাহলে এর অর্থ হবে মৃত্যু। আর যদি সে স্বপ্ন দেখে কথা বলতে বলতে সে ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছে, তাহলে এর অর্থ হবে জীবন ও সুস্থতা।
যদি কোনো ব্যক্তি স্বপ্ন দেখে যে, তার মৃত্যু হচ্ছে, তাহলে এর অর্থ হবে সে পাপাচার থেকে তাওবা করবে। কেননা মৃত্যু মানে হলো, আল্লাহর দিকে ফিরে যাওয়া। যেমন, আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ ثُمَّ رُدُّوٓاْ إِلَى ٱللَّهِ مَوۡلَىٰهُمُ ٱلۡحَقِّۚ ﴾ [الانعام: ٦٢]
“অতঃপর তাদেরকে ফিরিয়ে নেওয়া হবে তাদের সত্যিকার প্রভু আল্লাহর কাছে”। [সূরা আল-আন‘আম, আয়াত: ৬২]
এখানে ফিরিয়ে নেওয়া মানে মৃত্যু। আর তাওবা অর্থ ফিরে আসা।
উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু হাবেছ ইবন সাআদ আত-তাঈকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ দিলেন। একদিন হাবেছ উমার রাদিয়াল্লাহু আনহুকে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আমি স্বপ্নে দেখলাম, চাঁদ আর সূর্য যুদ্ধ করছে। আর নক্ষত্রগুলো দু’পক্ষে বিভক্ত হয়ে গেছে। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু এ কথা শুনে জিজ্ঞেস করলেন, তখন তুমি কার পক্ষে ছিলে? চাঁদের পক্ষে না সূর্যের?
তিনি উত্তরে বললেন, আমি চাঁদের পক্ষে ছিলাম। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে বললেন, তাহলে আমি তোমার নিয়োগ প্রত্যাহার করে নিলাম। কারণ, তুমি একটি মুছে যাওয়া শক্তির পক্ষে ছিলে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَجَعَلۡنَا ٱلَّيۡلَ وَٱلنَّهَارَ ءَايَتَيۡنِۖ فَمَحَوۡنَآ ءَايَةَ ٱلَّيۡلِ وَجَعَلۡنَآ ءَايَةَ ٱلنَّهَارِ مُبۡصِرَةٗ﴾ [الاسراء: ١٢]
“আর আমরা রাত ও দিনকে করেছি দুটো নিদর্শন। অতঃপর মুছে দিয়েছি রাতের নিদর্শন (চাঁদকে) আর দিনের নিদর্শন (সূর্য) কে করেছি আলোকময়”। [সূরা আল-ইসরা, আয়াত: ১২]
আর তুমি একটি বিভ্রান্তিতে নিহত হবে। পরে দেখা গেল সত্যিই সে সিফফীনের যুদ্ধে সিরিয়াবাসীদের দলে থেকে নিহত হলো।[1]
স্বপ্নে বাগান দেখার অর্থ হলো, কাজ ও চাকুরী। আর বাগান পুড়ে যাওয়া দেখলে অর্থ হবে বেকারত্ব ও পতন।
যে স্বপ্নের ফলাফল ভালো তা বাস্তবায়নে দেরী হয়। আর যার ফলাফল খারাপ তার বাস্তবায়নে কোন দেরী হয় না। দেখুন, ইউসুফ আলাইহিস সালাম স্বপ্নে দেখেছিলেন, চন্দ্র, সূর্য আর এগারটি নক্ষত্র তাকে সাজদাহ করেছে। তার এ স্বপ্নটার বাস্তবায়ন অনেক বছর পর হয়েছে।
ইবন সীরীন রহ.র দরবারে একটি শিশুর মৃত্যুর কাহিনীতে আমরা দেখলাম, খারাপ স্বপ্নের বাস্তবায়ন তাড়াতাড়ি হয়ে গেল।
মক্কী জীবনে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার স্বপ্ন দেখলেন, আবূ জাহল জান্নাতে ঘোরাফেরা করছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাবলেন, তাহলে আবূ জাহল ইসলাম গ্রহণ করবে। কিন্তু করল না। মক্কা বিজয়ের পর যখন আবূ জাহলের ছেলে ইকরামা ইসলাম গ্রহণ করলেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এটাই ছিল তার সেই স্বপ্নেরই বাস্তবায়ন।[1]