এ ব্যাপারে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) এর পক্ষ হতে ৫ টি হাদীস পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৩টি সহীহ। এর একটিতে হযরত আয়িশা (রা.) রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে পেশাব করাকে অস্বীকার করেছেন। ২য়টিতে রাসূল (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে পেশাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ৩য়টিতে বসে পেশাব করার ঘটনা বিবৃত হয়েছে। আর ২টি হাদীস যঈফ। তার একটিতে দাঁড়িয়ে পেশাব করার নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। অপরটিতে দাঁড়িয়ে পেশাব করাকে অহমিকার সাথে বিশেষিত করা হয়েছে।
হাদীসগুলো নিম্নে বর্ণিত হলো:
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: مَنْ حَدَّثَكُمْ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ كَانَ يَبُولُ قَائِمًا فَلَا تُصَدِّقُوهُ، مَا كَانَ يَبُولُ إِلَّا قَاعِدًا
(১) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: তোমাদের মধ্যে যদি কেউ বলে যে, রাসূল (ﷺ) দাঁড়িয়ে পেশাব করেছেন, তাহলে তোমরা তা বিশ্বাস করো না।[1]
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: كُنْتُ مَعَ النَّبِيِّ ﷺ فَانْتَهَى إِلَى سُبَاطَةِ قَوْمٍ، فَبَالَ قَائِمًا فَتَنَحَّيْتُ فَقَالَ: ادْنُهْ فَدَنَوْتُ حَتَّى قُمْتُ عِنْدَ عَقِبَيْهِ فَتَوَضَّأَ فَمَسَحَ عَلَى خُفَّيْهِ
(২) হুযাইফাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: একদিন আমি নাবী (ﷺ) এর সঙ্গে ছিলাম। এক সময় তিনি লোকজনের আবর্জনা ফেলার স্থানে পৌঁছলেন এবং সেখানে দাঁড়িয়ে পেশাব করলেন। এ দেখে আমি কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালাম। কিন্তু তিনি আমাকে নিকটে আসতে বললেন। আমি তার কাছে এগিয়ে গেলাম। এমনকি একেবারে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তিনি প্রয়োজন সেরে ওযূ করলেন এবং মোজার উপর মাসাহ করলেন।[2]
عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ ابْنِ حَسَنَةَ قَالَ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَفِي يَدِهِ كَهَيْئَةِ الدَّرَقَةِ، فَوَضَعَهَا ثُمَّ جَلَسَ خَلْفَهَا، فَبَالَ إِلَيْهَا.
(৩) আব্দুর রহমান ইবনে হাসানাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূল (ﷺ) একদা আমাদের কাছে আগমন করলেন। তাঁর হাতে চামড়ার তৈরি ঢালের মত একটি বস্ত্ত ছিল। তিনি তা স্থাপন করলেন। এরপর তার পেছনে বসলেন এবং সেদিকে ফিরে পেশাব করলেন।[3]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنْ عُمَرَ، قَالَ: " رَآنِي رَسُولُ اللَّهِ ﷺ وَأَنَا أَبُولُ قَائِمًا، فَقَالَ: يَا عُمَرُ لَا تَبُلْ قَائِمًا فَمَا بُلْتُ قَائِمًا بَعْدُ
(৪) ইবনে উমার বর্ণনা করেন: উমার (রাঃ) বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) আমাকে দাঁড়িয়ে পেশাব করতে দেখলে তিনি আমাকে বললেন: হে উমার! দাঁড়িয়ে পেশাব করো না। উমার (রাঃ) বলেন, এর পর থেকে আমি আর কখনও দাঁড়িয়ে পেশাব করি নি।[4]
عن بريدة أن النبى ﷺ قال " ثلاثة من الجفاء: أن يبول الرجل قائما, أو يمسح جبهته قبل أن يفرغ من صلاته, أو ينفخ فى سجوده"
(৫) বুরাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: তিনটি কাজ অহমিকার অন্তর্ভর্ুক্ত। দাঁড়িয়ে পেশাব করা, সালাত সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই কপাল মুছা ও সাজদার সময় ফুঁক দেয়া।[5]
আমার বক্তব্য: এ সমস্ত হাদীসগুলোর কারণে বিদ্বানগণ দাঁড়িয়ে পেশাব করার হুকুমের ব্যাপারে মতভেদ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনটি অভিমত পাওয়া যায়[6]
১ম অভিমত: কোন ওযর ছাড়া দাঁড়িয়ে পেশাব করা মাকরূহ। এটা আয়িশা, ইবনে মাসউদ ও উমার এর দু’টি অভিমতের মধ্যে একটি অভিমত। আবূ মূসা, শা’বী, ইবনে উয়াইনা, হানাফী ও শাফেঈগণ এ অভিমত পোষণ করেছেন।
২য় অভিমত: এটা সাধারণভাবে জায়েয। উমার (রাঃ) অন্য এক বর্ণনা মতে এ অভিমত পোষণ করেছেন। আলী, যায়েদ বিন ছাবিত, ইবনে উমার, সাহল ইবনে সাদ, আনাস, আবূ হুরাইরা ও হুযাইফা (রাঃ) এ মতামত ব্যক্ত করেছেন। হাম্বলীগণ এ মতের অনুসারী।
৩য় অভিমত: যদি এমন নরম জায়গায় পেশাব করা হয় যেখান থেকে পেশাব শরীরে ছিটকে আসা সম্ভব নয় তাহলে দাঁড়িয়ে পেশাব করা যাবে। নচেৎ যাবে না। এটা ইমাম মালিকের অভিমত। ইবনে মুনযির এ মতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
আমার বক্তব্য: বিশুদ্ধ মতামত হলো, যদি পেশাব শরীরে ছিটকে এসে পড়ার সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে দাঁড়িয়ে পেশাব করা মাকরূহ নয়। এর কারণ নিম্নরূপ-
(১) এর নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে মহানাবী (ﷺ) থেকে কোন সহীহ বর্ণনা পাওয়া যায় না।
(২) মহানাবী (ﷺ) এর বসে পেশাব করাটা দাঁড়িয়ে পেশাব করা জায়েয হওয়াকে বাধা দেয় না। বরং উভয়টিই বৈধ হওয়াকেই সমর্থন করে।
(৩) মহানাবী (ﷺ) থেকে দাঁড়িয়ে পেশাব করার হাদীস সাব্যাস্ত হয়েছে।
(৪) মূলতঃ আয়িশা এর পক্ষ থেকে মহানাবী (ﷺ) এর দাঁড়িয়ে পেশাব করার ব্যাপারে যে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করা হয়েছে তা ছিল তাঁর বাড়িতে থাকা অবস্থায়। তাই তিনি শুধু দাঁড়িয়ে পেশাব না করার ব্যাপারেই জানতেন। সুতরাং তা বাইরে দাঁড়িয়ে পেশাব করার ঘটনাকে না বোধক করে না। এতে কোন সন্দেহ নেই যে, কোন বিষয়ে জ্ঞান না থাকাটা কোন জ্ঞানকে না বোধক করে না। এ বিষয়ে হুযাইফাসহ অন্যরা জানতেন। সুতরাং, এটা যারা জানতেন না তাদের উপর প্রমাণ। আর হাঁ বোধক বিষয় না- বোধকের উপর প্রধান্য পায়। আল্লাহ্ই ভাল জানেন!
[2] বুখারী হা/ ২২৬; মুসলিম হা/২৭৩; প্রভৃতি।
[3] সহীহ; আবূ দাউদ হা/ ২২, নাসাঈ ১/২৭; ইবনে মাজাহ হা/ ৩৪৬; আহমাদ ৪/১৯৬।
[4] যঈফ: ইবনে মাজাহ ৩০৮; বায়হাক্বী ১/২০২; হাকেম ১/১৮৫;ইমাম তিরমিযী (রহঃ) মুয়ালস্নাক্ব সূত্রে বর্ণনা করেছেন এবং তাকে যঈফ বলেছেন (আহওয়াযী ১/৬৭)।
[5] মুনকার; ইমাম বুখারী তারীখে (৪৯৬) উল্লেখ করেছেন, বায্যার (১/৫৪৭), ইমাম বুখারী ও তিরমিযী (রহঃ) হাদীসটিকে মুনকার বলেছেন। মূলতঃ এটা ইবনে মাসউদের উক্তি হিসেবে সাব্যসত্ম।
[6] মাজমূ (২/৯৮), ওয়াসত (১/৩৩৩)।
স্বভাবজাত সুন্নাত হলো এমন রীতি যা সম্পাদন করলে এর সম্পাদনকারী এমন ফিতরাতের সাথে বিশেষিত হবেন যে ফিতরাতের উপর আল্লাহ্ তার বান্দাদের সৃষ্টি করেছেন এবং এর উপর ভিত্তি করে তার হাশর-নাশর হবে। আল্লাহ্ তাদেরকে এর জন্য ভালবাসবেন। যেন তারা এর মাধ্যমে পূর্ণগুণের অধিকারী হতে পারে এবং আকৃতিগতভাবে মর্যাদা পায়। এ ব্যাপারে ইসলামী শরীয়াত একমত যে, এটা একটি প্রাচীন সুন্নাত যা সকল নাবী পছন্দ করেছেন। এটি স্বভাবজাত বিষয়, যা সকল নাবী পছন্দ করেছেন।[1]
স্বভাবজাত রীতি অনুসরণের মাধ্যমে দ্বীনই ও দুনিয়াবী অনেক কল্যাণ রয়েছে। যেমন: এর ফলে সমুদয় দৈহিক গঠন সুন্দর থাকে এবং শরীর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নণ থাকে।[2]
অতঃপর কতিপয় স্বভাবজাত সুন্নাত নিম্নে আলোচিত হলো:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنْ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ قَالَ: الْفِطْرَةُ خَمْسٌ: الِاخْتِتَانُ، وَالِاسْتِحْدَادُ، وَقَصُّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمُ الْأَظْفَارِ، وَنَتْفُ الْإِبْطِ
(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: স্বভাবজাত বিষয় ৫ টি। খাতনা করা, নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার করা, গোঁফ খাটো করা, নখ কাটা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা।[3]
عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: " عَشْرٌ مِنَ الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، وَاسْتِنْشَاقُ الْمَاءِ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ، وَنَتْفُ الْإِبِطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ " قَالَ زَكَرِيَّا: قَالَ مُصْعَبٌ: وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ
(খ) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ১০ টি বিষয় স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত। গোঁফ খাটো করা, দাঁড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেয়া, নখ কাটা, অঙ্গের গিরাসমূহ ঘষে মেজে ধৌত করা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা, নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করা, মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা তথা ইসতিনজা করা। যাকারিয়া বলেন, মাস‘আব বলেছেন: আমি দশ নম্বরটি ভুলে গেছি। সম্ভবতঃ তা হলো কুলি করা।[4]
এ দু’টি হাদীস থেকে বুঝা যায় স্বভাবজাত ফিতরাতসমূহ শুধু এই দশটির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। নিম্নে তা থেকে উল্লেখ করা হলো:
(১) খাতনা করা বা সুন্নৎ দেয়া
(২) মলমূত্র ত্যাগের পর পানি ব্যবহার করা তথা ইসতিনজা করা
(৩) মিসওয়াক করা
(৪) নখ কাটা
(৫) গোঁফ খাটো করা
(৬) দাঁড়ি লম্বা করা
(৭) নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করা
(৮) বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা
(৯) বিভিন্ন অঙ্গের গিরাসমূহ ঘষে মেজে ধৌত করা। এর দ্বারা উদ্দেশ্য ঐ সমস্ত গিরা যেগুলোতে ময়লা জমা হয়। যেমন: আঙ্গুলের গিরাসমূহ, কানের গোড়াসমূহ ইত্যাদি।
(১০) কুলি করা ও নাকে পানি দেয়া।
[2] মানাভী প্রণীত ফাইযুল কাদীর (১/৩৮)।
[3] সহীহ; বুখারী হা/ ৫৮৯১; মুসলিম হা/২৫৭।
[4] হাসান; মুসলিম হা/ ২৬১ আবূ দাউদ হা/ ৫২, তিরমিযী ৬/২৯ নাসাঈ ৮/১২৬; ইবনে মাজাহ হা/ ২৯৩;
الختان বা খাতনার পরিচয় ও তার হকুম:
الختان শব্দটি মাসদার। এর মূলবর্ণ ختن -আভিধানিক অর্থ কর্তন করা।
পরিভাষায়: পুরুষাংগের অগ্রভাগ আবৃতকারী চামড়া ও নারীর যৌনাংগের পর্দা (ভৌগলিক কারণে পর্দা বা হাইমেন মেমব্রেন অনেক মোটা হয়) কেটে দেয়াকে খাতনা বলে।[1]
খাতনা করার হকুম: বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে তিনটি মতামত পেশ করেছেন।
(১) নারী পুরুষ সকলের খাতনা করা ওয়াজিব।
(২) উভয়ের জন্য খাতনা করা মুস্তাহাব।
(৩) পুরুষের জন্য ওয়াজিব ও নারীর জন্য মুস্তাহাব।
ইবনে কুদামা মুগনি গ্রন্থে (১/৮৫) বলেন: খাতনা করা পুরুষের জন্য ওয়াজিব। আর মহিলাদের জন্য সম্মানজনক কাজ। এটা তাদের প্রতি ওয়াজিব নয়। অনেক আলিম এ অভিমত পেশ করেছেন।
ইমাম নাববী মাজমু গ্রন্থে (১/৩০১) বলেন: সঠিক মতামত হলো- যা ইমাম শাফেঈ দলীলসহ বর্ণনা করেছেন এবং অধিকাংশ এ মতামতকে অকাট্য বলে প্রমাণ করেছেন যে, এটা নারী-পুরুষ সকলের উপর ওয়াজিব।
আমার বক্তব্য: পুরুষের খাতনা করা নিম্নোক্ত কারণে ওয়াজিব:
(১) কেননা এটা হযরত ইবরাহীম (ؑআঃ) এর রীতি। যেমন হাদীসে বর্ণিত হয়েছে:
عن أبي هريرة قال قال رسول الله ﷺ: اختتن إبراهيم خليل الرحمن بعد ما أتت عليه ثمانون سنة
আবূ হুরাইরা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: ইবরাহীম খলীলুর রহমান ৮০ বছর বয়সে তাঁর খাতনা করেছিলেন।[2]
মহান আল্লাহ্ তার রাসূল মুহাম্মাদ (ﷺ) কে লক্ষ্য করে বলেন:
﴿ثُمَّ أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ أَنِ اتَّبِعْ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ﴾
অর্থাৎ: তারপর আমি তোমার প্রতি ওহী পাঠিয়েছি যে, তুমি মিলস্নাতে ইবরাহীমের আনুগত্য কর, সে ছিল একনিষ্ঠ এবং মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না (সূরা নাহল-১২৩)।
(২) বর্ণিত আছে: একদা এক ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করলে রাসূল (ﷺ) তাকে বলেন:
« أَلْقِ عَنْكَ شَعْرَ الْكُفْرِ وَاخْتَتِنْ»
অর্থাৎ: তুমি তোমার দেহ থেকে কুফরীর চিহ্ন দূর কর এবং খাতনা কর।[3]
(৩) খাতনা করা মুসলমানদের নিদর্শন। এটা তাদের (মুসলমানদের) ইহুদি-খ্রিষ্টান থেকে পৃথককারী স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। সুতরাং অন্যান্য নিদর্শনের মত এটাও ওয়াজিব।
(৪) শরীরের কোন অংশ কাটা হারাম। আর হারাম জিনিস ওয়াজিব না হলে তা বৈধ হয় না। এটা ইমাম মালিক, শাফেঈ ও আহমাদ এর অভিমত। ইমাম মালিক এ ব্যাপারে কঠোর নীতি অবলম্বন করেছেন। এমন কি তিনি বলেছেন: যে ব্যক্তি খাতনা করে নি, তার ইমামতি করা বৈধ হবে না এবং তার সাক্ষ্যও গ্রহণ করা হবে না।
আবার অনেক ফক্বীহ্ ইমাম মালিক এর বরাত দিয়ে বর্ণনা করেছেন যে, এটা সুন্নাত। কিন্তু এটা তার কাছে সুন্নাত হলেও তা পরিত্যাগ করা গুনাহের কাজ।[4]
মহিলাদের খাতনা:
শরীয়াতে মহিলাদের খাতনা করার বিধান রয়েছে। মহানাবী (ﷺ) বলেন:
«إِذَا الْتَقَى الْخِتَانَانِ فَقَدْ وَجَبَ الْغُسْلُ»
অর্থাৎ: যখন নারী-পুরুষ উভয়ের গোপনাঙ্গ একত্রিত হবে, তখন তাদের উপর গোসল ওয়াজিব হবে।[5]
এখানে الختان শব্দটি দ্বারা নারী-পুরুষের যৌনাংগের কর্তিত স্থানকে বুঝানো হয়েছে। সুতরাং এ দ্বারা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, মহিলারা খাতনা করতেন।
নারীদের খাতনা করার ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে, তবে একটিও ক্রটিমুক্ত নয়। তন্মধ্যে উম্মে আত্বীয়া বর্ণিত হাদীস:
أَنَّ امْرَأَةً كَانَتْ تَخْتِنُ بِالْمَدِينَةِ فَقَالَ لَهَا النَّبِيُّ ﷺ: «لَا تَنْهِكِي فَإِنَّ ذَلِكَ أَحْظَى لِلْمَرْأَةِ، وَأَحَبُّ إِلَى الْبَعْلِ
উম্মে আত্বীয়া হতে বর্ণিত, জনৈক মহিলা মদ্বীনায় (মেয়েদের) খাতনা করাতো। নাবী (ﷺ) তাকে বললেন, খাতনাস্থানের অংশ খুব বেশি কাটিও না। কেননা এটা (কম কাটার জন্য সঙ্গমের সময়) নারীর জন্য অধিক তৃপ্তিদায়ক এবং স্বামীর কাছে খুবই প্রিয়।[6]
অপর বর্ণনায় রয়েছে:
إذا خفضت فأشمى ولا تنهكى فإنه أضوأ للوجه وأحظى عند الزوج
অর্থাৎ: ‘‘যখন নারীদের খাতনা করবে, তখন একে বারে কেটে শেষ করে দিও না । কেননা এতে চেহারা উজ্জল থাকবে এবং স্বামীর জন্য তা তৃপ্তিদায়ক হবে’’।[7]
এ হাদীসগুলোর সনদ দুর্বল, যদিও আলবানী সিলসিলা সহীহাহ’’ গ্রন্থে (হাদীস নং ৭২২) সহীহ বলেছেন। ব্যাপারটি এরূপ হওয়ার ফলে এক দল বলেন: এসব হাদীস যঈফ হলেও পুরুষের ন্যায় মহিলাদের খাতনা করা ওয়াজিব। কেননা নারী-পুরুষ উভয়েই শরীয়াতের বিধান পালনে সমধিকারী, যতক্ষণ না বিধানগতভাবে উভয়কে পৃথক করার দলীল বর্ণিত হয়। অথচ এরূপ দলীল বর্ণিত হয় নি।
আর অপর একদল বলেন: এটা মহিলাদের জন্য মুস্তাহাব ও সম্মানজনক কাজ। এটা ওয়াজিব নয়।[8] আর নারী পুরুষের মাঝে পৃথক করার কারণ হলো, পুরুষদের খাতনা করায় অনেক কল্যাণ রয়েছে। এর ফলে সালাতের জন্য পবিত্র হওয়ার যে শর্ত রয়েছে তা রক্ষা পায়। কেননা পুরুষাঙ্গের অগ্রভাগের এ চামড়াটি যদি কাটা না হয়, তাহলে তাতে পেশাব অবশিষ্ট ও জমা হয়ে থাকে।
আর মহিলাদের খাতনা করার ফলে তাদের কামভাব হরাস পায়, অথচ এটা পরিপূর্ণ পাওয়াটা স্বাভাবিকতার দাবী। মূলতঃ তাদের কষ্ট দূর করার জন্য খাতনা করা হয় না।
আমার বক্তব্য: মহিলাদের খাতনার বিধান ওয়াজিব ও মুস্তাহাবের মাঝা-মাঝি। মহানাবী (ﷺ) থেকে একটি হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন, খাতনা করা পুরুষের জন্য সুন্নাত ও মহিলাদের জন্য সম্মানজনক কাজ।[9] কিন্তু হাদীসটি যঈফ। যদি তা সহীহ হতো তাহলে দ্বন্দ্ব নিরসন করা সম্ভব হতো। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
[2] বুখারী হা/ ৬২৯৮; মুসলিম হা/ ৩৭০
[3] শাহেদ থাকার কারণে আলবানী এ হাদীসকে হাসান বলেছেন। আবু দাউদ (৩৫৬), বাইহাক্বী (১/১৭২) এ হাদীসের সনদে দু’জন মাজহুল (অপরিচিত) রাবী ও বিচ্ছিন্নতা আছে। এসত্ত্বেও এর কতিপয় শাহেদ (সমর্থক) হাদীস থাকার কারণে আলবানী হাসান বলেছেন। যা তার সহীহ আবূ দাউদ (৩৮৩), ইরওয়াউল গালীল (৭৯) এ বর্ণনা করেছেন। কিন্তু আমি তা অবগত হতে পারি নি। ইমাম নাববী ও শাওকানী এ হাদীসকে যঈফ আখ্যা দিয়েছেন।
[4] তুহফাতুল মাউদুদ- ১১৩ পৃ.।
[5] সহীহ; আলোচ্য শব্দে ইবনে মাজাহ (৬১১) তে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। আর সহীহাইনে এসেছে "ومس الختان الختان فقد وجب الغسل" এ শব্দে।
[6] যঈফ; আবূ দাউদ (৫২৭১) এবং তিনি একে যঈফ বলেছেন।
[7] মুনকার; খতীব বাগদাদী প্রণীত আত তারিখ-(৫/৩২৭), জামি’ আহকামুন নিসা (১/১৯)।
[8] এ পদ্ধতিটি ইবনু উসাইমীন উল্লেখ করেছেন। যেমন এসেছে আল-মুমতি’ (১/১৪৩) তে।
[9] যঈফ; আহমাদ (৫/৭৫)।
السواك মিসওয়াক করা
السواك বা মিসওয়াকের পরিচয় এবং শরীয়াতে এর বিধান:
السواك শব্দটি ساك শব্দ থেকে গৃহীত। এর আভিধানিক অর্থ:دلك বা ঘষা, মাজা, মর্দন করা ইত্যাদি।
পরিভাষায়ঃ দাঁত থেকে হলুদ বর্ণ বা এ জাতীয় ময়লা দূর করার জন্য কাঠ বা গাছের ডাল ব্যবহার করাকে মিসওয়াক বলে।[1]
সবসময় মেসওয়াক করা মুস্তাহাব। যেমন আয়িশা বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছে:
عَن عَائِشَةَ، النَّبِيِّ ﷺ قَالَ: السِّوَاكُ مَطْهَرَةٌ لِلْفَمِ مَرْضَاةٌ لِلرَّبِّ
আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুলাহ (ﷺ) থেকে বর্ননা করেন : তিনি বলেছেন যে, মিসওয়াক মুখের পবিত্রতা অর্জনের উপকরণ ও আল্লাহ্র সমেত্মাষ লাভের উপায়।[2]
নিম্নোক্ত সময়গুলোতে মিসওয়াক করা উত্তম বলে তাকিদ দেয়া হয়েছে:
১। ওযূর সময়:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَال: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي، لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ مَعَ الْوضُوْءِ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যদি অমার উম্মতের জন্য কষ্ট মনে না করতাম তাহলে আমি ওযূর সময় তাদের মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম।[3]
২। সালাতের সময়:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَال: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: لَوْلا أَنْ أَشُقَّ عَلَى أُمَّتِي، لَأَمَرْتُهُمْ بِالسِّوَاكِ عِنْدَ كُلِّ صَلَاةٍ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যদি আমার উম্মতের জন্য কষ্ট মনে না করতাম তাহলে আমি প্রত্যেক সালাতের সময় তাদের মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম।[4]
৩। কুরআন পাঠের সময়:
عَنْ عَلِىٍّ رَضِىَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ : أُمِرْنَا بِالسِّوَاكِ وَقَالَ : إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا قَامَ يُصَلِّى أَتَاهُ الْمَلَكُ فَقَامَ خَلْفَهُ يَسْتَمِعُ الْقُرْآنَ وَيَدْنُو ، فَلاَ يَزَالُ يَسْتَمِعُ وَيَدْنُو حَتَّى يَضَعَ فَاهُ عَلَى فِيهِ ، فَلاَ يَقْرَأُ آيَةً إِلاَّ كَانَتْ فِى جَوْفِ الْمَلَكِ.
আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমাদের মিসওয়াক করার জন্য আদেশ দেয়া হয়েছে। কেননা যখন কোন বান্দা সালাতে দাঁড়ায় তখন তার কাছে ফেরেশতা এসে তার পিছনে দাঁড়ায় ও কুরআন পড়া শুনতে থাকে এবং তার নিকটবর্তী হতে থাকে, এমন কি ফেরেশতা তার মুখকে তেলাওয়াতকারীর মুখের সাথে লাগিয়ে দেয়। ফলে প্রত্যেক আয়াত ফেরেশতার পেটের ভিতর প্রবেশ করে।[5]
৪। গৃহে প্রবেশের সময়:
عَنِ الْمِقْدَامِ بْنِ شُرَيْحٍ عَنْ أَبِيهِ قَالَ سَأَلْتُ عَائِشَةَ قُلْتُ بِأَىِّ شَىْءٍ كَانَ يَبْدَأُ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا دَخَلَ بَيْتَهُ قَالَتْ بِالسِّوَاكِ.
আল মিকদাদ ইবন শুরাইহ থেকে তার পিতার সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন: আমি আয়িশা (রা.) কে জিজ্ঞেস করলাম, রাসূলুলাহ (ﷺ) ঘরে প্রবেশ করে সর্বপ্রথম কোন কাজ করতেন? তিনি বলেন, মিসওয়াক দিয়ে দাঁত মাজা।
৫। রাতের সালাত আদায়ের সময়:
عَنْ حُذَيْفَةَ، قَالَ: كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذَا قَامَ لِيَتَهَجَّدَ يَشُوصُ فَاهُ بِالسِّوَاكِ .
হুযাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন: রাসুলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য উঠতেন তখন মিসওয়াক দ্বারা ঘষে মুখ পরিষ্কার করতেন। তথা তার দাঁতগুলোকে মিসওয়াক দ্বারা ঘষতেন।[6]
মিসওয়াক করার জন্য ‘আরাক’ নামক গাছের ডাল ব্যবহার করা মুস্তাহাব। যদি তা না পাওয়া যায়, তাহলে দাঁত ও মুখ পরিষ্কার হয়ে যায় এমন কোন বস্ত্ত ব্যবহার করা যথেষ্ট হবে। যেমন নির্দিষ্ট কোন পেষ্ট দিয়ে দাঁত ব্রাশ করা। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
নখ কাটা, গোঁফ ছাঁটা, বগলের লোম উপড়ানো ও নাভীর নীচের লোম পরিষ্কার জন্য কি নির্দিষ্ট সময় সীমা রয়েছে?
এ রীতিগুলোর জন্য কোন নির্দিষ্ট সময়সীমা বাঁধা নেই। বরং প্রয়োজন অনুযায়ী তা কাট ছাট করবে। সুতরাং যে সময় তা কাটছাট করার প্রয়োজন হবে, সেটাই তার সময়। তবে চল্লিশ দিনের বেশি তা রেখে দেয়া উচিৎ নয়।
যেমন আনাস (রাঃ) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন:
وُقِّتَ لَنَا فِي قَصِّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمِ الْأَظْفَارِ، وَنَتْفِ الْإِبِطِ، وَحَلْقِ الْعَانَةِ، أَنْ لَا نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ لَيْلَةً
রাসূল (ﷺ) আমাদের জন্য গোঁফ খাটো করা, নখ কাটা, বগলের পশম উপড়িয়ে ফেলা ও নাভীর নীচের পশম পরিষ্কার করার জন্য নির্দিষ্ট সীমারেখা বেঁধে দিয়েছেন, আমরা যেন তা চল্লিশ রাতের বেশি ছেড়ে না রাখি।[7]
[2] সহীহ; নাসাঈ (১/৫০), আহমাদ (৬/৪৭, ৬২) প্রভৃতি।
[3] আহমাদ; তা বর্ণিত হয়েছে, সহীহ আল-জামে’ (৫৩১৬)।
[4] সহীহ; বুখারী (৬৮১৩), মুসলিম (২৫২)।
[5] আলবানী একে সহীহ বলেছেন; বাইহাক্বী (১/৩৮), সহীহা (১২১৩)।
[6] সহীহ; বুখারী (২৪৬), মুসলিম (২৫৫)।
[7] সহীহ; মুসলিম (২৫৭ ) ও অন্যান্য।
দাড়ি লম্বা করার হুকুম:
পুরুষের জন্য দাড়ি লম্বা করা ওয়াজিব। এর কারণ নিম্নরূপ:
১। মহানবী (ﷺ) দাড়ি লম্বা করার নির্দেশ দিয়েছেন। নির্দেশটা ওয়াজিব অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। মানদূব (যা আমল করলে সাওয়াব পাওয়া যাবে আর পরিত্যাগ করলে শাস্তি হবে না) অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কোন ইঙ্গিত এখানে নেই।
এ ব্যাপারে মহানাবী (ﷺ)এর বাণী হলো:
خالفوا المشركين : وفروا اللحى وأحفوا الشوارب
(দাড়ি ও গোফের ব্যাপারে) তোমরা মুশরিকদের বিপরীত কর। দাড়ি লম্বা কর এবং গোঁফ ছোট কর।[1]
তিনি আরও বলেন:
جزوا الشوارب وأرخوا اللحى خالفوا المجوس
‘তোমরা গোঁফ কাট এবং দাড়ি লম্বা কর আর অগ্নি পুজকদের বিরোধিতা কর ’।[2]
২। দাড়ি মুণ্ডন করা কাফিরদের সাথে সাদৃশ্য রাখে। যেমনটি পূর্বোলেস্নখিত হাদীসদ্বয়ে বর্ণিত হয়েছে।
৩। দাড়ি কর্তন করলে আল্লাহ্র সৃষ্টির পরিবর্তন করা হয় এবং শয়তানের আনুগত্য করা হয়।
আল্লাহ্র বাণী:
﴿وَلَآمُرَنَّهُمْ فَلَيُغَيِّرُنَّ خَلْقَ اللَّهِ﴾
অবশ্যই তাদেরকে আদেশ করব, ফলে অবশ্যই তারা আল্লাহ্র সৃষ্টি বিকৃত করবে (সূরা নিসা-১১৯)।
৪। দাড়ি মুণ্ডন করলে নারীদের সাদৃশ্য হয়ে যায়। যে সব পুরুষেরা নারীর সাদৃশ্য গ্রহণ করে; আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ) তাদের প্রতি অভিশাপ করেছেন।[3]
এজন্য শাইখুল ইসলাম বলেন: দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম।[4] ইবনে হাযম ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন: দাড়ি মুণ্ডন করা হারাম, এ ব্যাপারে ইজমা রয়েছে।[5]
এক মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি ছাটা জায়েয আছে কি?
কতিপয় বিদ্বানের মতে: এক মুষ্টি দাড়ি রেখে বাকি অংশ কেটে ফেলা জায়েয আছে। তারা ইবনে উমার (রাঃ) এর হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করে থাকেন।
كَانَ ابْنُ عُمَرَ: «إِذَا حَجَّ أَوِ اعْتَمَرَ قَبَضَ عَلَى لِحْيَتِهِ، فَمَا فَضَلَ أَخَذَهُ»
ইবনে উমার (রাঃ) যখন হাজ্জ ও উমরা করতেন তখন তার দাড়ি ধরে অতিরিক্ত অংশ ছেঁটে ফেলতেন।[6]
তারা বলেন: তিনি (উমার) দাড়ি লম্বার নির্দেশ দেয়া হাদীসের রাবী। সুতরাং তিনিই তার বর্ণনা সম্পর্কে বেশি বুঝেন।
এই আসারের মাধ্যে তাদের কোন দলীল নেই।[7] কেননা-
(১) ইবনে উমার এটা হাজ্জ ও উমরা থেকে হালাল হওয়ার পর করেছিলেন। অথচ সেটাকে তারা সর্বাবস্থার জন্য বৈধ মনে করেন।
(২) ইবনে উমার (রাঃ) এ কাজটি আল্লাহ্র বাণী- مُحَلِّقِينَ رُءُوسَكُمْ وَمُقَصِّرِينَ অর্থাৎ: তোমাদের মাথা মুণ্ডন করে এবং চুল ছেঁটে (নির্ভয়ে মাসজিদুল হারামে অবশ্যই প্রবেশ করবে) (সূরা : ফাতাহ-২৭)। এ আয়াতটির উপর তা‘বীল করে করেছেন। অর্থাৎ: হাজ্জের সময় মাথা মুণ্ডন করতে হবে, আর দাড়ি ছোট করতে হবে।[8]
(৩) সাহাবাগণ যখন তাদের বর্ণনার বিপরীত কিছু বলেন বা করেন, তখন যা বর্ণনা করেছেন তাই গ্রহণ করতে হয়। তাদের বোধগম্যতা ও কর্ম ধর্তব্য নয়। বরং মহানাবী (ﷺ) এর দিকে সম্পৃক্ত বিষয়টিই ধর্তব্য।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, বিশুদ্ধ মতামত হলো, দাড়ি ছেড়ে দেয়া ওয়াজিব। অনেক সহীহ হাদীসে দাড়ি লম্বা করার ব্যাপারে সাধারণভাবে নির্দেশ দেয়ার ফলে তা কাট-ছাট করা যাবে না। হাদীসে বিভিন্ন শব্দে এ নির্দেশগুলো বর্ণিত হয়েছে। যেমন: أعفوا তথা লম্বা হতে দাও, أرخوا তথা ছেড়ে দাও, أرجوا তথা অবকাশ দাও, وفروا তথা পূর্ণ বা বেশি হতে দাও, أوفوا সম্পূর্ণ কর। অধিকাংশ বিদ্বানগণ এ মতামত পোষণ করেছেন। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
[2] সহীহ; মুসলিম (২৬০)।
[3] বুখারী (৫৮৮৫), তিরমিযী (২৯৩৫)।
[4] ইখতিয়ারাতুল ফিকহিয়্যাহ (পৃ. ১০) আলাউদ্দীন আলবা’লী প্রণীত। আল-ফুরু’ (১/২৯১) ‘ইবনু মুফালিহ’ প্রণীত।
[5] মারাতীবুল ইজম’, রাদ্দুল মুহতার-(২/১১৬)।
[6] সহীহ; বুখারী (৫৮৯২), মুসলিম (২৫৯)।
[7] ইহা শাইখ আল-হাবীহ ওয়াহিদ আঃ সালাম তাঁর আল ইকলিল (১/৯৬) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন।
[8] দেখুন! ‘শারহুল কিরমানী আলাল বুখারী (২১/১১১)।
পানি বিভিন্ন প্রকার হয়ে থাকে। তবে তা নিম্নোক্ত দু’প্রকারের বাইরে নয়। যথা:
১। সাধারণ পানি (পবিত্র পানি):
এ প্রকার পানি তার সৃষ্টিগত মৌলিকতার উপর বজায় থাকে। এটা ঐ সমস্ত পানি যা ভূমি থেকে উদ্ভূত হয় অথবা আকাশ থেকে বর্ষিত হয়। মহান আল্লাহ্ বলেন:
﴿وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُمْ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً لِيُطَهِّرَكُمْ بِهِ﴾
অর্থাৎ: তিনি আকাশ হতে তোমাদের উপর বৃষ্টি বর্ষণ করেন, আর যাতে এর মাধ্যমে তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করেন। (সূরা আনফাল-১১)
এ প্রকার পানির অন্তর্ভুক্ত হলো: নদীর পানি, বরফগলা পানি, তুষারের পানি ও কুপের পানি। এমনকি তাতে পানি দীর্ঘ সময় থাকার কারণে যদি তার পরিবর্তন ঘটে অথবা এমন পবিত্র বস্ত্ত মিশে যায় যা তা থেকে দূর করা সম্ভব নয় তবুও তা এ প্রকার পানির অন্তর্ভুক্ত হবে।
অনুরূপভাবে সাগরের পানি। মহানাবী (ﷺ) কে সাগরের পানি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: هُوَ الطَّهُورُ مَاؤُهُ الْحِلُّ مَيْتَتُهُ
অর্থাৎ: সাগরের পানি পবিত্র এবং এর মৃত প্রাণী (মাছ ইত্যাদি) খাওয়া হালাল।[1]
আলিমদের ঐকমত্যে: এ প্রকার পানি দ্বারা ওযূ, গোসল করা বৈধ। যদি তাতে পবিত্র বস্ত্ত মিশ্রিত হয়, তাহলে পানি পদবাচ্য থাকা পর্যন্ত তা দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ হবে। উম্মে হানী (রা.) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে-
عَنْ أُمِّ هَانِئٍ رَضِيَ اللَّهِ عَنْهَا: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ اغْتَسَلَ هُوَ وَمَيْمُونَةُ مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ فِي قَصْعَةٍ فِيهَا أَثَرُ الْعَجِينِ
উম্মে হানী (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (ﷺ) ও মায়মূনা (রা.) একই পাত্রে গোসল করতেন, তা এমন পাত্র ছিল যাতে আটার খামিরের চিহ্ন ছিল।[2]
যে সমস্ত মহিলারা মহানাবী (ﷺ) এর কন্যা যায়নাব (রা.) কে গোসল করিয়েছিলেন, তাদেরকে তিনি নির্দেশ দিয়েছিলেন:
اغْسِلْنَهَا ثَلاَثًا، أَوْ خَمْسًا، أَوْ أَكْثَرَ مِنْ ذَلِكَ إِنْ رَأَيْتُنَّ ذَلِكَ، بِمَاءٍ وَسِدْرٍ، وَاجْعَلْنَ فِي الآخِرَةِ كَافُورًا
তোমরা তাকে তিনবার, পাঁচবার কিংবা চাইলে এরচেয়ে অধিকবার বরই পাতা দিয়ে গোসল দাও এবং শেষবার কর্পুর ব্যবহার করবে।[3]
আর পানিতে পবিত্র বস্ত্ত মিশ্রিত হওয়ার ফলে যদি পানি নাম থেকে অন্য কোন নামে পরিচিতি লাভ করে যেমন চা, তাহলে এ দ্বারা পবিত্রতা অর্জন বৈধ হবে না। অনুরূপভাবে অপবিত্রতা থেকে পবিত্রতা অর্জন বৈধ হবে না সে বস্ত্ত দ্বারা, যে বস্ত্ত অন্য কোন পবিত্র বস্ত্ত থেকে প্রস্ত্ততকৃত। যেমন: গোলাপের পানি, ইত্যাদি। কেননা এগুলো প্রকৃত পক্ষে পানি নয়। ইবনুল মুনযির বলেন,[4] আমি বিদ্বানগণের অভিমত তদন্ত করে দেখেছি যে, সর্বাধিক অভিমত হলো: গোলাপের পানি, গাছের পানি ও স্প্রে থেকে নির্গত সুগন্ধিযুক্ত তরল পানি দ্বারা ওযূ জায়েয নয়। সাধারণ পানি পদবাচ্য ছাড়া পবিত্রতা অর্জন বৈধ নয়।
২। নাপাক পানি:
এটা এমন পানি যাতে নাপাক জিনিসের মিশ্রণ ঘটে এবং তার কোন একটি বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায়, ফলে তার রং গন্ধ অথবা স্বাদের পরিবর্তন ঘটে এবং ব্যবহারকারী ধারণা করে যে, সে নাপাক পানি ব্যবহার করছে। এ প্রকার পানি দ্বারা ওযূ করা বৈধ নয়। কেননা এটা নিজেই নাপাক।
[2] সহীহ; নাসাঈ (২৪০), ইবনে মাজাহ (৩৭৮)।
[3] সহীহ; বুখারী (১২৫৩), মুসলিম (৯৩৯)।
[4] আল-মুগনী (১/১১), আল মুহালস্না (১/১৯৯)।
ওযূকারীর অঙ্গ থেকে ঝরে পড়া পানি বা অনুরূপ পানিকে الماء المستعمل বা ব্যবহৃত পানি বলে। এ প্রকার পানি প্রবিত্রতা দানকারী পানি থেকে ব্যতিক্রম, না ব্যতিক্রম নয়, এ ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন।
বিশুদ্ধ মতামত হলো: যতোক্ষণ পর্যন্ত তা সাধারণ পানি পদবাচ্য থাকে এবং এমন নাপাকী মিশ্রিত না হয় যাতে পানির বৈশিষ্ট্য সমূহে কোন প্রভাব পড়ে (অর্থাৎ: রং, গন্ধ ও স্বাদ অবিকৃত থাকে), ততক্ষণ তা পবিত্রকারী থাকবে। এটা আলী ইবনে আবি তালিব, ইবনে উমার, আবূ উমামা ও সালফে সালেহীনের একটি দলের অভিমত। ইমাম মালিক (রাহি.) এর প্রসিদ্ধ মতামত এটাই। ইমাম শাফেঈ ও আহমাদ (রাহি.) তাদের দু’টি রেওয়ায়াতের একটিতে এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইবনে হাযম ও ইবনুল মুনযিরও এ মতামতের প্রবক্তা। শায়খুল ইসলাম এ মতামতটি পছন্দ করেছেন।[1] নিম্নোক্ত বাণীগুলো এ মাতমতকে শক্তিশালী করে:
(১) মৌলিকভাবেই পানি পবিত্র। তাকে কোন জিনিস অপবিত্র করতে পারে না। মহনাবী (ﷺ) বলেন, الْمَاءُ طَهُورٌ لَا يُنَجِّسُهُ شَيْءٌ অর্থাৎ: পানি পবিত্র। তাকে কোন জিনিস অপবিত্র করতে পারে না।[2] তবে তার কোন একটি বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন হলে অথবা পবিত্র বস্ত্ত মিশ্রনের ফলে তা সাধারণ পানি পদবাচ্য থেকে বহির্ভূত হলে তা নাপাক হয়ে যাবে।
(২) সাহাবাগণ মহানাবী (ﷺ) এর ওযূর অতিরিক্ত পানি ব্যবহার করতেন বলে প্রমাণিত:
(الف) عن أَبى جُحَيْفَةَ، قالُ: خَرَجَ عَلَيْنَا رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بِالهَاجِرَةِ، فَأُتِيَ بِوَضُوءٍ فَتَوَضَّأَ، فَجَعَلَ النَّاسُ يَأْخُذُونَ مِنْ فَضْلِ وَضُوئِهِ فَيَتَمَسَّحُونَ بِهِ
(ক) আবূ যুহাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন: একবার দুপুরে নাবী (ﷺ) আমাদের সামনে বেরিয়ে এলেন। তাকে ওযূর পানি এনে দেয়া হলো। তখন তিনি ওযূ করলেন। লোকেরা তার ওযূর ব্যবহৃত পানি নিয়ে গায়ে মাখতে লাগল।[3]
হাফেয ফাতহ গ্রন্থে (১/৩৫৩) বলেন: সম্ভবতঃ সাহাবাগণ মহানাবী (ﷺ) এর ওযূর অঙ্গ থেকে ঝরে পড়া পানি গ্রহণ করতেন। এর মাধ্যমেই ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়ার সুস্পষ্ট দলীল পাওয়া যায়।
(খ) মিসওয়ার বিন মুখরামাহ এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে- وَإِذَا تَوَضَّأَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَادُوا يَقْتَتِلُونَ عَلَى وَضُوئِهِ-অর্থাৎ: নাবী যখন ওযূ করতেন তখন তার ব্যবহৃত পানির উপর তারা (সাহাবায়ে কেরাম) যেন হুমড়ি খেয়ে পড়তেন।[4]
عن أَبى مُوسَى: دَعَا النَّبِيُّ ﷺ بِقَدَحٍ فِيهِ مَاءٌ، فَغَسَلَ يَدَيْهِ وَوَجْهَهُ فِيهِ، وَمَجَّ فِيهِ، ثُمَّ قَالَ لَهُمَا: اشْرَبَا مِنْهُ، وَأَفْرِغَا عَلَى وُجُوهِكُمَا وَنُحُورِكُمَا
অর্থাৎ: আবূ মুসা আল-আশআরী (রাঃ) বলেনঃ নাবী (ﷺ) একটি পাত্র আনতে বললেন, যাতে পানি ছিল। তারপর তিনি তার মধ্যে উভয় হাত ও চেহারা মুবারাক ধৌত করলেন এবং তার মধ্যে কুলি করলেন। তারপর তাদের দু’জন (আবূ মুসা (রা.) ও বিলাল (রা.)) কে বললেন: তোমরা এ থেকে পান কর এবং তোমাদের মুখমণ্ডলে ও বুকে ঢাল।[5]
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ: كَانَ الرِّجَالُ وَالنِّسَاءُ يَتَوَضَّئُونَ فِي زَمَانِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ جَمِيعًا
(৩) ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুলাহ এর যামানায় পুরুষ এবং মহিলা একত্রে ওযূ করতেন।[6]
অপর বর্ণনায় রয়েছে-
كُنَّا نَتَوَضَّأُ نَحْنُ وَالنِّسَاءُ عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ، نُدْلِي فِيهِ أَيْدِيَنَا
অর্থাৎ: আমরা পুরুষ ও মহিলারা রাসূল (ﷺ) এর যামানায় একসাথে এক পাত্রে ওযূ করতাম এবং এ সময় কখনও কখনও একের হাত অপরের সাথে লেগে যেত।
عنابْنَ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ كَانَ يَغْتَسِلُ بِفَضْلِ مَيْمُونَةَ
(৪) আবদুলাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন: রাসূল (ﷺ) তার স্ত্রী মাইমূনাহ এর গোসলের পর অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করতেন।[7]
عَنِ الرُّبَيِّعِ، أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ مَسَحَ بِرَأْسِهِ مِنْ فَضْلِ مَاءٍ كَانَ فِي يَدِهِ
(৫) রুবাই বিনতে মুয়াবিবয (রা.) হতে বর্ণিত: নাবী কারীম (ﷺ) তার হাতের অতিরিক্ত পানি দ্বারা মাথা মাসাহ করেন।[8]
(৬) ইবনে মুনযির ‘আওসাত্ব’ গ্রন্থে (১/২৮৮) বলেন: বিদ্বানগণের ঐকমত্যে, ওযূকারী ও গোসলকারীর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ থেকে ও কাপড় থেকে ঝরে পড়া পানি পবিত্র। সুতরাং এ অভিমতটি ব্যবহৃত পানি পবিত্র হওয়া প্রমাণ করে। অতএব তা যেহেতু পবিত্র তাই তা দ্বারা ওযূ নাজায়েয বলা যাবে না। যারা এর বিপরীত মন্তব্য করেন, তাদের উপযুক্ত প্রমাণ থাকতে হবে।
অপর একদল আলিম বলেন: ব্যবহৃত পানি দ্বারা ওযূ বৈধ নয়। এটা ইমাম মালিক, আওয়ায়ী ও ইমাম শাফেঈ (রাহি.) এর দু’টি অভিমতের একটি অভিমত। ‘আসহাবে রায়’ এ অভিমতই পোষণ করেছেন।[9] কিন্তু তাদের উপযুক্ত এমন কোন প্রমাণ নেই যার উপর নিশ্চিত হওয়া যায়। সুতরাং প্রকৃত দাবীর দিকে ফিরে যাওয়াই উচিৎ।
[2] হাসান; আবূ দাউদ (২৬৬), তিরমিযী (৩৬), নাসঈ (১/১৭৪)।
[3] সহীহ; বুখারী (১৮৭)।
[4] সহীহ; বুখারী (১৮৯)।
[5] সহীহ; বুখারী (১৮৮)।
[6] সহীহ; বুখারী (১৯৩); আবূ দাউদ (৭৯), নাসাঈ (১/৫৭) ইবনে মাজাহ (৩৮১), এখানে পরের অংশটি আবু দাউদে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে।
[7] সহীহ; মুসলিম (৩২৩) এ হাদীসটি সহীহাইনে এসেছে "كانا يغتسلان من إناء واحد" এ শব্দে।
[8] হাসান; আবূ দাউদ (১৩০), আদ-দারাকুতবী (১/৮৭)।
[9] আল-ইসিত্মযকার (১/২৫৩), আত-তামহীদ (৪/৪৩), আলমুগনী (১/১৯), আল-আউসাত (১/২৮৫)।
মহিলাদের ওযূ বা গোসলের অতিরিক্ত পানি দ্বারা পুরুষের পবিত্রতা অর্জনের বিধানের ব্যাপারে আলিমগণের মাঝে দু’টি অভিমত লক্ষ্য করা যায়:
১ম মতামত: মহিলাদের ব্যবহৃত অতিরিক্ত পানি দ্বারা পুরুষের পবিত্রতা অর্জন করা বৈধ নয়। এটা ইবনে উমার, আবদুল্লাহ ইবনে সারজাস, উম্মুল মুমিনীন জুয়ায়রিয়্যাহ বিনতে হারেস, হাসান, আহমাদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক্ব, শাবী ও দাউদ জাহেরী এর মতামত।[1]
তাদের দলীল হলো:
عَنِ الْحَكَمِ بْنِ عَمْرٍو وَهُوَ الْأَقْرَعُ، أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ نَهَى أَنْ يَتَوَضَّأَ الرَّجُلُ بِفَضْلِ طَهُورِ الْمَرْأَةِ
(১) হাকাম হতে বর্ণিত: নাবী কারীম (ﷺ) মহিলাদের ব্যবহারের অতিরিক্ত পানি দ্বারা পুরুষদের ওযূ করতে নিষেধ করেছেন।[2]
عَنْ حُمَيْدٍ الْحِمْيَرِيِّ، قَالَ: لَقِيتُ رَجُلًا صَحِبَ النَّبِيَّ ﷺ أَرْبَعَ سِنِينَ، كَمَا صَحِبَهُ أَبُو هُرَيْرَةَ، قَالَ: نَهَى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ تَغْتَسِلَ الْمَرْأَةُ بِفَضْلِ الرَّجُلِ، أَوْ يَغْتَسِلَ الرَّجُلُ بِفَضْلِ الْمَرْأَةِ ، زَادَ مُسَدَّدٌ: «وَلْيَغْتَرِفَا جَمِيعًا»
(২) হুমায়েদ আল-হিময়ারী হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: আমি এমন এক ব্যক্তির সাথে সাক্ষাৎ করি, যিনি চার বছর যাবৎ রাসূলুলাহ (ﷺ) এর খেদমতে ছিলেন- যে ভাবে আবূ হুরাইরা রাসূলের খেদমত করতেন। তিনি বলেন: রাসূল (ﷺ) মহিলাদেরকে পুরুষদের অতিরিক্ত পানি দ্বারা গোসল করতে নিষেধ করেছেন এবং একইভাবে পুরুষদেরকে মহিলাদের ব্যবহারের অতিরিক্ত পানি দ্বারা গোসল করতে নিষেধ করেছেন। মুসাদ্দাদ এর সঙ্গে যোগ করেছেন যে, নারী-পুরুষ একসাথে একই পাত্র হতে হাত দিয়ে পানি উঠানো নিষেধ।[3]
عَنْ عَلِيٍّ، قَالَ: كَانَ النَّبِيُّ ﷺ وَأَهْلُهُ يَغْتَسِلُونَ مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ، وَلَا يَغْتَسِلُ أَحَدُهُمَا بِفَضْلِ صَاحِبِهِ
(৩) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত: রাসূল (ﷺ) এবং তার পরিজন একই পাত্রে গোসল করতেন। তবে তাদের একজন অপরজনের উদ্বৃত্ত পানি দিয়ে গোসল করতেন না।[4]
২য় অভিমত: মহিলাদের ব্যবহৃত, অতিরিক্ত পানি দ্বারা পুরুষের পবিত্রতা অর্জন বৈধ। এটা উমার, আবূ হুরাইরা, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ইবনে উমার, সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাহসহ সালফে সালেহীনের একটি দলের অভিমত। আবূ ওবাইদ ও ইবনুল মুনযিরও এ মতামত ব্যক্ত করেছেন। এটা ইমাম আবূ হানীফা, মালিক ও শাফেঈ (রাহি.) এর মাযহাব। একটি বর্ণনা মতে আহমাদও এ মতামত ব্যক্ত করেছেন।[5] তাদের দলীল হলো:
عنابْنَ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ كَانَ يَغْتَسِلُ بِفَضْلِ مَيْمُونَةَ
(১) আবদুলাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেছেন, রাসূল (ﷺ) তার স্ত্রী মাইমূনাহ এর গোসলের পর অবশিষ্ট পানি দিয়ে গোসল করতেন।[6]
عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: اغْتَسَلَ بَعْضُ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ ﷺ فِي جَفْنَةٍ، فَجَاءَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لِيَتَوَضَّأَ مِنْهَا أَوْ يَغْتَسِلَ، فَقَالَتْ: لَهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ، إِنِّي كُنْتُ جُنُبًا؟ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: إِنَّ الْمَاءَ لَا يُجْنِبُ
(২) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন: একদা নাবী কারীম (ﷺ) এর কোন এক স্ত্রী বড় একটি পাত্রের পানি দ্বারা গোসল করছিলেন। এমতাবস্থায় নাবী করীম (ﷺ) সেখানে ওযূ অথবা গোসল করার জন্য আগমন করলেন। তখন তিনি (পত্নী) বললেন: ইয়া রাসূলুলাহ! আমি অপবিত্র ছিলাম। জবাবে রাসূল (ﷺ) বললেন: নিশ্চয়ই পানি অপবিত্র হয় না।[7]
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: «كُنْتُ أَغْتَسِلُ أَنَا وَالنَّبِيُّ ﷺ مِنْ إِنَاءٍ وَاحِدٍ كِلاَنَا جُنُبٌ وفى رواية نَغْتَرِفُ مِنْهُ جَمِيعًا
(৩) আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: আমি ও নাবী জানাবাত অবস্থায় একই পাত্র থেকে পানি নিয়ে গোসল করতাম । অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, আমরা অঞ্জলিপূর্ণ করে তা থেকে একই সাথে পানি নিতাম।[8]
বিশুদ্ধ মতামত:
যারা ১ম মতামত অনুযায়ী মহানাবী (ﷺ) এর সাথে চার বছর অবস্থান করা ব্যক্তির হাদীসকে সঠিক মনে করেন, তাদের সে হাদীসের ব্যাপারে ইমাম বাইহাক্কী নেতি বাচক দৃষ্টি ভঙ্গি প্রকাশ করেছেন এবং ২য় অভিমতটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। দু’ভাবে এ দলীলগুলোর মাঝে সমতা আনয়ন করা সম্ভব:[9]
(১) নিষেধাজ্ঞার হাদীসগুলোকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থেকে ঝড়ে পড়া পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করবে। আর জায়েযের হাদীসগুলোকে পাত্রে অবশিষ্ট থাকা পানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মনে করবে। ইমাম খাত্ত্বাবী এ ভাবেই সমাধান দিয়েছেন।
(২) দু’টি বৈধ হওয়া সত্ত্বেও সতর্কতার জন্য নিষেধাজ্ঞার বিধান দেয়া হয়েছে।
আমার বক্তব্য: সম্ভবতঃ ২য় অভিমতটিই উত্তম। আল্লাহ্ই সর্বাধিক অবগত।
[2] আইম্মায়ে কেরাম এর ত্রম্নটি বর্ণনা করেছেন; আবূ দাউদ (৮২) তিরমিযী (৬৪), নাসাঈ (১/১৭৯), ইবনে মাজাহ (৩৭৩), আহমাদ (৫/৬৬) ইমাম বুখারী, দারাকুত্বনী ও নববী এর ত্রম্নটি বর্ণনা করেছেন। কিন্তু ইবনে হাজার আসকালানী ও আলবানী একে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। আল-ইরওয়া (১/৪৩)।
[3] এ হাদীসের সনদ সহীহ; আবূ দাউদ (৮০), নাসাঈ (১/১৩০) বাইহাকী (১/১৯০)।
[4] যঈফ; ইবনে মাজাহ (১/১৩৩)।
[5] মুসান্নাফ আঃ রাযযাক (১/১১০), ইবনে আবী শায়েবাহ (১/৩৮) আল-আউসাত্ব (১/২৯৭), আবু উবাইদ এর আত্ম-ত্বাহুর (২৩৬) আল মাসবূত্ব (১/৬১), আল-উম্ম (১/৮), আল-মুগনী (১/২৮৩)।
[6] সহীহ; এর তাহক্বীক পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে।
[7] আবূ দাউদ (৬৮), তিরমিযী (৬৫), নাসাঈ (১/১৭৩) ইবনে মাজাহ (৩৭০), কতিপয় উলামা সিমাক এর ইকরামার সূত্রে বর্ণিত বেওয়ায়াত এর ত্রম্নটি বর্ণনা করে। এ রেওয়ায়াতটিকে ‘মুযতারিব’ আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু হাফেয ইবনে হাজার আসকালানী তাঁর ফাতহুলবারী গ্রন্থে এ মমত্মব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেননা শু’বা তার থেকে রেওয়ায়াত করেছেন। এছাড়া তিনি তার ওসত্মাদদের বর্ণিত হাদীসকে সহীহ মনে করেন। (আলস্নাহই অধিক অবগত)।
[8] সহীহ; বুখারী (২৯৯), মুসলিম (৩২১)।
[9] ফতহুল বারী (১/৩০০), সুবুলস সালাম (১/২৮), নাসলুল আওতার (১/২৬)।
ওযূ এর আভিধানিক অর্থ : وضوء শব্দটি الوضائة শব্দ থেকে গৃহীত। এর আভিধানিক অর্থ: পরিছন্নতা ও উজ্জ্বলতা وضوء শব্দের واو বর্ণে পেশ পড়লে, তখন তা فعل (ত্রিয়া) এর অর্থ দিবে। আর واو বর্ণে যবর পড়লে, এর অর্থ হবে: ওযূর পানি এবং সেটা مصدر(ক্রিয়ামূল)ও হবে অথবা এ দু’টি আলাদা শব্দও হতে পারে।[1]
পরিভাষায়: সালাত অথবা অনুরূপ ইবাদাত থেকে বাধা প্রদান করে, এমন অপবিত্রতা হতে পবিত্রতা অর্জনের জন্য নির্দিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তথা মুখ, দু’হাত, মাথা ও দু’পায়ে পানি ব্যবহার করার নাম ওযূ।
কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমা দ্বারা ওযূ শারঈভাবে প্রমাণিত। যথা:
(ক) কুরআনে আল্লাহ্ তা‘আলা বলেন:
﴿ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا إِذَا قُمْتُمْ إِلَى الصَّلَاةِ فَاغْسِلُوا وُجُوهَكُمْ وَأَيْدِيَكُمْ إِلَى الْمَرَافِقِ وَامْسَحُوا بِرُءُوسِكُمْ وَأَرْجُلَكُمْ إِلَى الْكَعْبَيْنِ ﴾
অর্থাৎ: হে মুমিনগণ! যখন তোমরা সালাতে দ-ায়মান হতে চাও, তখন তোমাদের মুখ ও কনুই পর্যন্ত হাত ধৌত কর, মাথা মাসাহ কর এবং টাখনু পর্যন্ত পা ধৌত কর (সূরা মায়েদা-৬)
(খ) হাদীসে বলা হয়েছে-
عَنْ أَبى هُرَيْرَةَ قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: لَا تُقْبَلُ صَلَاةُ أَحَدِكُمْ إِذَا أَحْدَثَ حَتَّى يَتَوَضَّأَ
(১) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুলাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তির বায়ু নির্গত হয় তার সালাত কবুল হবে না, যতক্ষণ না সে ওযূ করে।[2]
عَنْ ابْنَ عُمَرَ قَالَ: إِنِّي سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ ﷺ يَقُولُ: لَا تُقْبَلُ صَلَاةٌ بِغَيْرِ طُهُورٍ وَلَا صَدَقَةٌ مِنْ غُلُولٍ
(২) ইবনে উমার (রাঃ) বললেন: আমি রাসূলুলাহ (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: পবিত্রতা ছাড়া সালাত কবুল হয় না এবং আত্নসাৎ বা খেয়ানতের সম্পদ থেকে সাদকা কবুল হয় না।[3]
عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ قَالَ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ: إِنَّمَا أُمِرْتُ بِالْوُضُوءِ إِذَا قُمْتُ إِلَى الصَّلَاةِ
(৩) ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আমাকে তো সালাত আদায়ের সময় ওযূ করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।[4]
عَنْ أَبِي سَعِيدٍ، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: مِفْتَاحُ الصَّلَاةِ الطُّهُورُ، وَتَحْرِيمُهَا التَّكْبِيرُ، وَتَحْلِيلُهَا التَّسْلِيمُ
আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেন: সালাতের চাবি হলো পবিত্রতা (অর্থাৎ ওযূ বা গোসল) এর তাকবীর পার্থিব যাবতীয় কাজকে হারাম করে এবং সালাম (অর্থাৎ সালাম ফিরানো) যাবতীয় ক্রিয়া কর্মকে হালাল করে দেয়।[5]
(গ) আর এ ব্যাপারে ইজমা হলো: উম্মতের সকল আলিম এ বিষয়ে ঐক্যমত যে, পবিত্রতা অর্জনে সক্ষম হলে পবিত্রতা ব্যতীত সালাত কবুল হবে না।[6]
[2] সহীহ; বুখারী (১৩৫), মুসলিম (২২৫) প্রভৃতি।
[3] সহীহ; মুসলিম (২২৪)।
[4] সহীহ; তিরমিযী (১৮৪৮), আবূ দাউদ (৩৭৬০), নাসাঈ (১/৭৩) সহীহুল জামে’ (২৩৩৩)।
[5] হাসান লিগাইরহী; তিরমিযী (৩), আবূ দাউদ (৬০), ইবনে মাজাহ (২৭৫), আলবানী তার সহীহুল জামে’ (৫৭৬১) গ্রন্থে সহীহ বলেছেন।
[6] ‘‘আল আউসাত’’ (১/১০৭) ইবনু মুনযির প্রণীত।
১। এটাকে ঈমানের অর্ধেক হিসাবে গণ্য করা হয়:
عَنْ أَبِي مَالِكٍ الْأَشْعَرِيِّ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ: الطُّهُورُ شَطْرُ الْإِيمَانِ
আবূ মালিক আশআ'রী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: পবিত্রতা ঈমানের অর্ধেক।[1]
২। ওযূ ছোট-ছোট পাপগুলো মোচন করে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ: إِذَا تَوَضَّأَ الْعَبْدُ الْمُسْلِمُ - أَوِ الْمُؤْمِنُ - فَغَسَلَ وَجْهَهُ خَرَجَ مِنْ وَجْهِهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ نَظَرَ إِلَيْهَا بِعَيْنَيْهِ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ يَدَيْهِ خَرَجَ مِنْ يَدَيْهِ كُلُّ خَطِيئَةٍ كَانَ بَطَشَتْهَا يَدَاهُ مَعَ الْمَاءِ أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ -، فَإِذَا غَسَلَ رِجْلَيْهِ خَرَجَتْ كُلُّ خَطِيئَةٍ مَشَتْهَا رِجْلَاهُ مَعَ الْمَاءِ - أَوْ مَعَ آخِرِ قَطْرِ الْمَاءِ - حَتَّى يَخْرُجَ نَقِيًّا مِنَ الذُّنُوبِ
(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেছেন: কোন মুসলিম বান্দা ওযূর সময় যখন মুখম-ল ধৌত তখন তার চোখ দিয়ে অর্জিত গুনাহ পানির সাথে অথবা (তিনি বলেছেন) পানির শেষ বিনদুর সাথে বের হয়ে যায়। যখন সে দু‘খানা হাত ধৌত করে তখন তার দু’হাতের স্পর্শের মাধ্যমে সব গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিনদুর সাথে ঝরে যায়। অতঃপর যখন সে পা দু‘খানা ধৌত করে, তখন তার দু‘পা দিয়ে হাঁটার মাধ্যমে অর্জিত সব গুনাহ পানির সাথে অথবা পানির শেষ বিনদুর সাথে ঝরে যায়, এভাবে সে যাবতীয় গুনাহ থেকে মুক্ত ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নণ হয়ে যায়।[2]
عَنْ عُثْمَانَ،: إِنَّ رَسُول اللهِ ﷺ قَالَ: مَنْ تَوَضَّأَ هَكَذَا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ، وَكَانَتْ صَلَاتُهُ وَمَشْيُهُ إِلَى الْمَسْجِدِ نَافِلَةً
(খ) উসমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি আমার এই ওযূর ন্যায় ওযূ করবে তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে। ফলে তার সালাত ও মাসজিদে যাওয়া অতিরিক্ত আমল হিসেবে গণ্য হবে।[3]
যে ব্যক্তি এ ওযূ করার পর ফরয ও নফল সালাত আদায় করবে তার জন্য এ ফযীলত ও সাওয়াবের তা‘কীদ দেয়া হয়েছে। যেমন
(গ) উসমান (রাঃ) এর হাদীসে আছে, তিনি রাসূল (ﷺ) এর ওযূর বিবরণের হাদীসে বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন:
مَنْ تَوَضَّأَ مِثْلَ وُضُوئِي هَذَا ثُمَّ قَامَ فَصَلَّى رَكْعَتَيْنِ لَا يُحَدِّثُ فِيهِمَا نَفْسَهُ غُِفرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ: যে ব্যক্তি আমার এই ওযূর ন্যায় ওযূু করার পর একাগ্র চিত্তে দু‘রাকআত সালাত পড়বে এবং এ সময় অন্য কোন ধারণা তার অন্তরে উদয় হবে না। তাহলে তার পূর্বকৃত সব গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে।[4]
৩। ওযূর দ্বারা বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ قَالَ: أَلَا أَدُلُّكُمْ عَلَى مَا يَمْحُو اللهُ بِهِ الْخَطَايَا، وَيَرْفَعُ بِهِ الدَّرَجَاتِ؟ قَالُوا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: إِسْبَاغُ الْوُضُوءِ عَلَى الْمَكَارِهِ، وَكَثْرَةُ الْخُطَا إِلَى الْمَسَاجِدِ، وَانْتِظَارُ الصَّلَاةِ بَعْدَ الصَّلَاةِ، فَذَلِكُمُ الرِّبَاطُ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাসূল (ﷺ) বলেছেন: আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ্ (বান্দাহর) গুনাহসমূহ মাফ করেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেন? লোকেরা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল আপনি বলুন। তিনি বললেন: কষ্টকর অবস্থায়ও পূর্ণাঙ্গরূপে ওযূ করা, সালাতের জন্য মাসজিদে বারবার যাওয়া এবং এক সালাতের পর আর এক সালাতের জন্য প্রতীক্ষা করা; আর এ কাজগুলোই হলো সীমান্ত প্রহরা।[5]
৪। জান্নাত যাওয়ার পথ সুগম করে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ قَالَ لِبِلاَلٍ: عِنْدَ صَلاَةِ الفَجْرِ يَا بِلاَلُ حَدِّثْنِي بِأَرْجَى عَمَلٍ عَمِلْتَهُ فِي الإِسْلاَمِ، فَإِنِّي سَمِعْتُ دَفَّ نَعْلَيْكَ بَيْنَ يَدَيَّ فِي الجَنَّةِ» قَالَ: مَا عَمِلْتُ عَمَلًا أَرْجَى عِنْدِي: أَنِّي لَمْ أَتَطَهَّرْ طَهُورًا، فِي سَاعَةِ لَيْلٍ أَوْ نَهَارٍ، إِلَّا صَلَّيْتُ بِذَلِكَ الطُّهُورِ مَا كُتِبَ لِي أَنْ أُصَلِّيَ
(ক) আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) একদিন ফযরের সালাতের সময় বেলাল (রাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, হে বিলাল তুমি ইসলাম গ্রহণের পর সর্বাধিক আশাব্যঞ্জক কি আমল করেছে, তার কথা আমার নিকট ব্যক্ত কর। কেননা জান্নাতে আমি আমার সামনে তোমার পাদুকার আওয়াজ শুনতে পেয়েছি। বিলাল (রাঃ) বলেন, দিন রাতের যে কোন প্রহরে আমি ত্বহারাত ও পবিত্রতা অর্জন করেছি, তখনই সে ত্বহারাত দ্বারা আমি সালাত আদায় করেছি, যে পরিমাণ সালাত আদায় করা আমার তক্দিরে লেখা ছিল। আমার কাছে এর চাইতে (অধিক) আশাব্যঞ্জক, এমন কোন বিশেষ আমল আমি করি নি।[6]
عَنْ عُقْبَةَ بْنِ عَامِرٍ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ: مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ، ثُمَّ صَلَّى رَكْعَتَيْنِ يُقْبِلُ عَلَيْهِمَا بِقَلْبِهِ وَوَجْهِهِ وَجَبَتْ لَهُ الْجَنَّةُ
(খ) উকবা ইবন আমীর জুহানী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: রাসূলুলাহ (ﷺ) বলেছেন: যে ব্যক্তি উত্তমরূপে ওযূ করে তারপর দু‘রাকআত সালাত নিষ্ঠার সাথে আদায় করে, তার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যায়।[7]
৫। এটা এমন একটা নিদর্শন যার দ্বারা হাওযে কাওসারের নিকট উপস্থিত হওয়ার সময় উম্মতকে পৃথক করা হবে:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ ﷺ أَتَى الْمَقْبُرَةَ، فَقَالَ: السَّلَامُ عَلَيْكُمْ دَارَ قَوْمٍ مُؤْمِنِينَ، وَإِنَّا إِنْ شَاءَ اللهُ بِكُمْ لَاحِقُونَ، وَدِدْتُ أَنَّا قَدْ رَأَيْنَا إِخْوَانَنَا قَالُوا: أَوَلَسْنَا إِخْوَانَكَ؟ يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: أَنْتُمْ أَصْحَابِي وَإِخْوَانُنَا الَّذِينَ لَمْ يَأْتُوا بَعْدُ فَقَالُوا: كَيْفَ تَعْرِفُ مَنْ لَمْ يَأْتِ بَعْدُ مِنْ أُمَّتِكَ؟ يَا رَسُولَ اللهِ فَقَالَ: أَرَأَيْتَ لَوْ أَنَّ رَجُلًا لَهُ خَيْلٌ غُرٌّ مُحَجَّلَةٌ بَيْنَ ظَهْرَيْ خَيْلٍ دُهْمٍ بُهْمٍ أَلَا يَعْرِفُ خَيْلَهُ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ قَالَ: " فَإِنَّهُمْ يَأْتُونَ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنَ الْوُضُوءِ، وَأَنَا فَرَطُهُمْ عَلَى الْحَوْضِ أَلَا لَيُذَادَنَّ رِجَالٌ عَنْ حَوْضِي كَمَا يُذَادُ الْبَعِيرُ الضَّالُّ أُنَادِيهِمْ أَلَا هَلُمَّ فَيُقَالُ: إِنَّهُمْ قَدْ بَدَّلُوا بَعْدَكَ فَأَقُولُ سُحْقًا سُحْقًا "
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা রাসূল (ﷺ) কবরস্থানে গিয়ে বললেন: তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, এটা তো ঈমানদারদের কবর স্থান। ইনশা আল্লাহ্ আমরাও তোমাদের সাথে মিলিত হবো। আমার মনে আমাদের ভাইদের দেখার আকাংখা জাগে। যদি আমরা তাদেরকে দেখতে পেতাম। সাহাবাগণ বললেন: হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! আমরা কি আপনার ভাই নই? জবাবে তিনি বললেন: তোমরা হচ্ছো আমার সঙ্গী সাথী! আর যেসব ঈমানদার এখনও (দুনিয়াতে) আগমন করে নি তারা হচ্ছে আমার ভাই। তারা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! আপনার উম্মাতের যারা এখনও (দুনিয়াতে) আসে নি, আপনি তাদেরকে কিভাবে চিনতে পারবেন? তিনি বললেন: অনেকগুলো কালো ঘোড়ার মধ্যে যদি কোন ব্যক্তির একটি কপাল চিত্রা ঘোড়া থাকে, তবে কি সে উক্ত ঘোড়াটিকে চিনতে পারবে না? তারা বললো, হে আল্লাহ্র রাসূল (ﷺ)! তা অবশ্যই পারবো। তখন তিনি বললেন: তারা (আমার উম্মতরা) ওযূর প্রভাবে জ্যোর্তিময় চেহারা ও হাত পা নিয়ে উপস্থিত হবে। আর আমি আগেই হাওযে কাওসারের কিনারে উপস্থিত থাকবো। সাবধান! কিছু সংখ্যক লোককে আমার হাওয থেকে এমন ভাবে তাড়িয়ে দেয়া হবে যেমন বেওয়ারিশ উটকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। আমি তাদেরকে ডেকে ডেকে বলবো: আরে এদিকে এসো, এদিকে এসো। তখন বলা হবে, এরা আপনার ইমিত্মকালের পর (নিজেদের দ্বীন) পরিবর্তন করে ফেলেছে। তখন আমি তাদেরকে বলবো: (আমার নিকট থেকে) দূর হও, দূর হও।[8]
الغرةএর অর্থ উজ্জ্বল শুভ্রতা, যা ঘোড়ার কপালে দেখা যায়। এর দ্বারা উদ্দেশ্য নূর বা উজ্জ্বলতা, যা উম্মতে মুহাম্মাদীর চেহারায় দেখা দিবে। আরالتحجيل -অর্থ এমন শুভ্রতা, যা ঘোড়ার তিন পায়ে দেখা যায়। এর দ্বারাও নূর বা উজ্জ্বলতা উদ্দেশ্য।[9]
৬। এটা ক্বিয়ামতের দিন বান্দার জন্য জ্যোতি স্বরূপ:
عن أَبِي هُرَيْرَةَ، قال سَمِعْتُ خَلِيلِي ﷺ يَقُولُ: تَبْلُغُ الْحِلْيَةُ مِنَ الْمُؤْمِنِ، حَيْثُ يَبْلُغُ الْوَضُوءُ
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন: আমি আমার বন্ধু রাসূল (ﷺ) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন: যে স্থান পর্যন্ত ওযূর পানি পৌঁছবে সে স্থান পর্যন্ত মু‘মিন ব্যক্তির চাকচিক্য অথবা সৌন্দর্যও পৌঁছবে।[10] الْحِلْيَةُ অর্থ: ক্বিয়ামত দিবসের জ্যোতি।
৭। ওযূ শয়তানের গ্রন্থি খুলে দেয়:
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ قَالَ: «يَعْقِدُ الشَّيْطَانُ عَلَى قَافِيَةِ رَأْسِ أَحَدِكُمْ إِذَا هُوَ نَامَ ثَلاَثَ عُقَدٍ يَضْرِبُ كُلَّ عُقْدَةٍ عَلَيْكَ لَيْلٌ طَوِيلٌ، فَارْقُدْ فَإِنِ اسْتَيْقَظَ فَذَكَرَ اللَّهَ، انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ تَوَضَّأَ انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَإِنْ صَلَّى انْحَلَّتْ عُقْدَةٌ، فَأَصْبَحَ نَشِيطًا طَيِّبَ النَّفْسِ وَإِلَّا أَصْبَحَ خَبِيثَ النَّفْسِ كَسْلاَنَ»
আবূ হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল (ﷺ) বলেছেন: তোমাদের কেউ যখন ঘুমিয়ে পড়ে তখন শয়তান তার গ্রীবাদেশে তিনটি গিট দেয়। প্রতি গিটে সে এ বলে চাপড়ায়, তোমার সামনে রয়েছে দীর্ঘ রাত। অতএব তুমি ঘুমাও। তার পর সে যদি জাগ্রত হয়ে আল্লাহ্কে স্বরণ করে তখন একটি গিট খুলে যায়, পরে ওযূ করলে আর একটি গিট খুলে যায়, তার পর সালাত আদায় করলে আরও একটি গিট খুলে যায়। তখন তার প্রভাত হয় প্রফুলস্ন মনে ও নির্মল চিত্তে। অন্যথায় সে সকালে উঠে কলুষিত মনে ও অলস চিত্তে।[11]
[2] সহীহ; মুসলিম (২৪৪) প্রভৃতি।
[3] সহীহ; মুসলিম (২২৯) প্রভৃতি।
[4] সহীহ; বুখারী (৬৪৩৩), মুসলিম (২২৬) প্রভৃতি।
[5] সহীহ; মুসলিম (২৫১) প্রভৃতি।
[6] বুখারী (১১৪৯), মুসলিম (২৪৫৮)।
[7] সহীহ; মুসলিম (২৩৪), নাসাঈ (১/৮০) প্রভৃতি।
[8] সহীহ; মুসলিম (২৩৪), নাসাঈ (১/৮০) প্রভৃতি।
[9] ইমাম নববী প্রণীত ‘সারহু মুসলিম’ (৩/১০০)।
[10] সহীহ; মুসলিম (২৫০), নাসাঈ (১/৮০)।
[11] সহীহ; বুখারী (১১৪২), মুসলিম (৭৭৬)।