কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৪২ টি
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৪২ টি

তবে সব কর্ম এক পর্যায়ের নয়। কিছু কর্ম আছে যা সাধারণভাবে মানুষ ‘ইবাদত’ হিসেবেই করে। যে সত্তার এরূপ অলৌকিক ক্ষমতা ও আধিপত্য আছে তাকেই তা প্রদান করে। সকল সমাজের সকল ভাষার মানুষই এগুলি জানেন। পূজা, অর্চনা, বলি, কুরবানী, মানত, প্রার্থনা ইত্যাদি এই জাতীয় কর্ম। পাশাপাশি কিছু কর্ম আছে যা মানুষ ইবাদত হিসেবে করে, আবার জাগতিকভাবেও করে। যেমন প্রশংসা করা, ভয় করা, আনুগত্য করা ইত্যাদি। এগুলি মানুষ মানুষ হিসেবে জাগতিকভাবে অন্য মানুষের জন্য করে। আবার ‘মা’বূদ’ বা পূজিত সত্তার জন্যও করে।

ইসলামের দৃষ্টিতে প্রথম প্রকারের কর্ম আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করাই শিরক। যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, বলি, উৎসর্গ, জবাই ইত্যাদি করা। এগুলি কেউ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য করলে তা শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ কারো ভিতরে ঈশ্বরত্ব (divinity, holiness, sacredness, sanctity) ঐশ্বরিক ক্ষমতা, চূড়ান্ত আধিপত্য, অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা, অলৌকিক শক্তি ইত্যাদি কল্পনা না করলে কেউ তার জন্য এরূপ কর্ম করে না। এ বিষয়ে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী (রাহ) বলেন:

اعلم أن العبادة هي التذلل الأقصى. وكون التذلل أقصى من غيره لا يخلو إما أن يكون بالصورة، مثل كون هذا قياماً وذلك سجوداً، أو بالنية بأن نوى بهذا الفعل تعظيم العباد لمولاهم، وبذلك تعظيم الرعية للملوك، أو التلامذة للأستاذ، لا ثالث لهما.

‘‘জেনে রাখ, ইবাদত হলো চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয়। কোন্ ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত এবং কোন্টি চূড়ান্ত নয় তা দুভাবে জানা যায়: (১) ভক্তি-বিনয়ের প্রকার থেকে, যেমন দাঁড়িয়ে ভক্তি করা চূড়ান্ত ভক্তি নয় তবে সাজদা করা চূড়ান্ত ভক্তি এবং (২) নিয়্যাত বা উদ্দেশ্য থেকে, যেমন বান্দা হিসেবে তার মাবূদকে ভক্তি করার উদ্দেশে যে ভক্তি বা বিনয় প্রকাশ করা হয় তা চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং প্রজা হিসেবে রাজার বা ছাত্র হিসেবে শিক্ষকের ভক্তির নিয়েতে যা করা হয় তা চূড়ান্ত ভক্তি নয় বলে গণ্য। ভক্তি-বিনয় চূড়ান্ত পর্যায়ের কি না তা জানার তৃতীয় কোনো পথ নেই।’’[1]

[1] শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৭৯।

তাওহীদুল ইবাদাতের অর্থ সকল প্রকার ইবাদাত, যেমন প্রার্থনা, সাজদা, জবাই, উৎসর্গ, মানত, তাওয়াক্কুল-নির্ভরতা ইত্যাদি- একমাত্র  আল্লাহর প্রাপ্য বলে বিশ্বাস করা।

কেউ যদি আল্লাহর ইবাদাত করেন এবং সাথে সাথে অন্য কারো ইবাদাত করেন তাহলে তিনি আল্লাহর ইবাদাতকারী বলে গণ্য হবেন না, কারণ তিনি ইবাদাতে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বা অংশীদার  করেছেন এবং শিরকে লিপ্ত  হয়েছেন। আল্লাহর ইবাদাতের অর্থ বিশুদ্ধভাবে, একনিষ্ঠভাবে, নিষ্কলুষভাবে বা শিরকের কলুষতা থেকে মুক্তভাবে আল্লাহর ইবাদত করা। অর্থাৎ একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করা এবং কোনো প্রকার ইবাদাত আল্লাহ ছাড়া  অন্য কারো জন্য না করা। কুরআন  কারীমে  অসংখ্য স্থানে আল্লাহ নির্দেশ দান করেছেন বিশুদ্ধভাবে ইবাদাত করতে এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করতে। এ হলো (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)-র অর্থ ও নির্দেশ। মহান আল্লাহ বলেন:

هُوَ الْحَيُّ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ

‘‘তিনি চিরঞ্জীব, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ (উপাস্য বা মাবুদ) নেই, সুতরাং সার্বিক আনুগত্য ও একনিষ্ঠার সাথে বিশুদ্ধভাবে তাঁকেই ডাক।’’[1]

وَمَا أُمِرُوا إِلا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ حُنَفَاءَ وَيُقِيمُوا الصَّلاةَ وَيُؤْتُوا الزَّكَاةَ وَذَلِكَ دِينُ الْقَيِّمَةِ

‘‘তাদেরকে তো কেবলমাত্র এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, তারা বিশুদ্ধ চিত্তে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদাত করবে এবং সালাত কায়েম করবে এবং যাকাত প্রদান করবে, আর এটাই সঠিক ধর্ম।’’[2]

মহান আল্লাহ অন্যত্র বলেছেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘‘হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার।’’[3]

অন্যত্র আল্লাহ একমাত্র আল্লাহর ইবাদাত করার এবং শিরক থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে বলেছেন:

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

‘‘এবং তোমরা আল্লাহর ইবাদাত কর এবং তাঁর সাথে  কোনো কিছুকে শরীক বানিও না।’’[4]

মহান আল্লাহ বলেন,

لا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ قَدْ تَبَيَّنَ الرُّشْدُ مِنَ الْغَيِّ فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘‘দীন সম্পর্কে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগূতকে অস্বীকার (অবিশ্বাস) করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক মযবুত হাতল ধরবে যা কখনো ভাঙ্গবে না। আল্লাহ সর্বশ্রোতা প্রজ্ঞাময়।’’[5]

অন্যত্র  বলা হয়েছে:

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولا أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘‘আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।’’[6]

এখানে তাগুতকে বর্জন করা বলতে তাগুতের ইবাদত বর্জন করা বুঝানো হয়েছে। এ বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

وَالَّذِينَ اجْتَنَبُوا الطَّاغُوتَ أَنْ يَعْبُدُوهَا وَأَنَابُوا إِلَى اللَّهِ لَهُمُ الْبُشْرَى فَبَشِّرْ عِبَادِ

‘‘যারা তাগূতের ইবাদত বর্জন করে এবং আল্লাহ অভিমুখী হয়, তাদের জন্য রয়েছে সুসংবাদ। অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে।’’[7]

তাগূত শব্দটি আরবী ‘তুগইয়ান’ শব্দ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে, যার অর্থ সীমা লঙ্ঘন করা। অবাধ্যতা, জুলুম বা অন্যায়ের ক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘনকারীকে ‘তাগী’ (الطاغي) বা সীমালঙ্ঘনকারী বলা হয়। অত্যধিক সীমলঙ্ঘনকারীকে ‘তাগিয়াহ’ (الطاغية) বলা হয়। কঠিনতম সীমালঙ্ঘণকারী বা মহা-অবাধ্যকে ‘তাগূত’ (الطاغوت) বলা হয়। এভাবে আমরা দেখছি যে, আভিধানিকভাবে ‘তাগূত’ অর্থ মহা-সীমালঙ্ঘনকারী।[8]

আভিধানিকভাবে সকল সীমা-লঙ্ঘনকারীকে তাগূত বলা যায়। তবে কুরআনের পরিভাষায় ‘তাগূত’ অর্থ শয়তান। এছাড়া আল্লাহকে ছাড়া যা কিছুর ইবাদত, পূজা বা উপাসনা করা হয় তাকে ‘তাগূত’ বলা হয়।[9]

এভাবে পবিত্র কুরআনে অসংখ্য স্থানে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, একমাত্র তাঁরই উপাসনা ইবাদাত করতে এবং অন্য কোনো ব্যক্তি বা বস্তুর ইবাদত-উপাসনা সর্বতোভাবে বর্জন করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।  আর এ হলো তাওহীদুল  ঊলুহীয়্যাহ্ অর্থাৎ ইবাদাতের একত্ব বা কর্ম পর্যায়ের তাওহীদ।

[1] সূরা (৪০) মুমিন (গাফির): ৬৫ আয়াত
[2] সূরা (৯৮) বাইয়েনা: ৫ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২১ আয়াত।
[4] সুরা (৪) নিসা: ৩৬ আয়াত।
[5] সূরা (২) বাকারা, ২৫৬ আয়াত।
[6] সূরা (১৬) নাহল, ৩৬ আয়াত।
[7] সূরা যুমার, ১৭ আয়াত।
[8] যাইনুদ্দীন রাযী, মুখতারুস সিহাহ, পৃ. ১৬৫।
[9] সূরা (২) বাকারা: ২৫৭ আয়াত; সূরা (৪) নিসা: ৭৬ আয়াত; বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৬৭৩; তাবারী, তাফসীর ৩/১৮-১৯।
২. ৪. ৩. উভয় পর্যায়ের তাওহীদ অবিচ্ছেদ্য

তাওহীদের এ দুটি পর্যায়  একে অপরের সম্পূরক ও পরস্পরে  অবিচ্ছিন্নভাবে জড়িত। এক পর্যায় থেকে অন্য পর্যায়কে  পৃথক করা যায় না বা একটিকে বাদ দিয়ে  অন্যটির  উপর  ঈমান  এনে মুসলিম হওয়া যায় না। তবে এখানে প্রণিধাণযোগ্য যে শাহাদাতাইন বা ঈমানের ঘোষনায় ‘লা ইলাহা  ইল্লাল্লাহ’ বলে শেষ পর্যায় বা ‘‘তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ্’’-র ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঈমানের ঘোষণায় প্রথম পর্যায়ের তাওহীদের সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয় নি। কালিমায়ে তাওহীদে ‘‘লা খালিকা  ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ছাড়া কোনো স্রষ্টা নেই’’, ‘‘লা রাযিকা ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ছাড়া কোনো রিয্কদাতা নেই’’, ‘‘লা মালিকা ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ছাড়া কোনো বাদশাহ বা মালিক নেই’’, ‘‘লা রাববা ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ছাড়া কোনো রাবব বা প্রতিপালক নেই’’, বা অনুরূপ বাক্য বলা হয় নি। বরং ‘আল্লাহ ছাড়া কোনো ইলাহ বা মাবুদ নেই বলে সাক্ষ্য প্রদানের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এর দ্বিবিধ কারণ রয়েছে: (১) তাওহীদুল ইবাদাত তাওহীদুর রুবূবিয়্যাতের ফসল ও দাবি এবং (২) তাওহীদুল ইবাদাতেই কাফিরদের বিরোধিতা ও অস্বীকৃতি।

২. ৪. ৪. তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহর দাবি তাওহীদুল ইবাদাত

প্রথম কারণ হলো দ্বিতীয় পর্যায়ের তাওহীদ, অর্থাৎ ইবাদতের তাওহীদ (তাওহীদুল উলূহিয়্যা) প্রথম পর্যায়ের তাওহীদ বা জ্ঞানের তাওহীদের ফসল ও ফলাফল। যেহেতু আল্লাহ একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা, রিয্কদাতা ও সর্বশক্তিমান কাজেই একমাত্র তাঁরই ইবাদাত উপসনা  করা দরকার। যেহেতু  সকল ক্ষমতাই তাঁর সেহেতু  তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে উপসনা করা নিতান্তুই  অর্থহীন ও জঘন্য অন্যায়। এজন্য পবিত্র কুরআনে  আল্লাহ তাআলা বারবার  আল্লাহর  সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের  (তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ্র) কথা  উল্লেখ করে একমাত্র তাঁরই ইবাদাতের আহবান জানিয়েছেন।

বস্ত্তত, ‘ইলাহ’ (উপাস্য) এবং ‘রাবব’ (প্রতিপালক)-এর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য সহজেই অনুমেয়। তাওহীদ পন্থী মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কারো ‘ইলাহ’ বলতে পারেন না; কারণ মহান আল্লাহ ছাড়া কেউ কোনোভাবে কোনো মুমিনের ‘ইলাহ’ বা উপাস্য হতে পারে না। পক্ষান্তরে মুমিন আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে কারো পালনকর্তা বা মালিক হিসেবে ‘রাবব’ বলতে পারে। প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইসমাঈল ইবনু হাম্মাদ জাওহারী (৩৯৫ হি) বলেন:

رَبُّ كلِّ شيءٍ: مالكُهُ. والربُّ: اسم من أسماء الله عَزَّ وجَلَّ، ولا يقال في غيره إلا بالإضافة

‘‘রাবব অর্থ মালিক বা স্বত্বাধিকারী, যে কোনো কিছুর রাবব অর্থ তার মালিক বা স্বত্বাাধিকারী। ‘আর-রাবব’ মহান আল্লাহর একটি নাম। মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো ক্ষেত্রে এ নামটি ব্যবহার করা যায় শুধু সম্পর্কের সাথে (অমুকের রাবব)।’’[1]

ইউসুফ (আঃ)-এর কারাবাসের ঘটনায় আল্লাহ বলেন:

وَقَالَ لِلَّذِي ظَنَّ أَنَّهُ نَاجٍ مِنْهُمَا اذْكُرْنِي عِنْدَ رَبِّكَ فَأَنْسَاهُ الشَّيْطَانُ ذِكْرَ رَبِّهِ

‘‘উভয়ের মধ্যে যে মুক্তি পাবে বলে ইউসুফ ধারণা করেছিল তাকে সে বলল, তোমার রবেবর (প্রভুর) নিকট আমার কথা বলো; কিন্তু শয়তান তাকে তার তার রবেবর (প্রভুর) নিকট তার বিষয় বলার কথা ভুলিয়ে দেয়।’’[2]

এখানে রাববুকা ও রাববুহু বলতে বাদশাহকে বুঝানো হয়েছে।

আরবের কাফিরগণ এবং অন্যান্য কাফির-মুশরিকগণ মহান আল্লাহকে মহাবিশ্বের একমাত্র প্রতিপালক ও সার্বভৌম সর্বশক্তিমান মালিক বা ‘রাবব’ বলে মানত, অথচ তাঁকে একমাত্র ‘ইলাহ’ হিসেবে মানত না। বিষয়টি ছিল একান্তই অযৌক্তিক ও মানবীয় জ্ঞানের সাথে সাংঘষিংক। কারণ যিনি একমাত্র প্রতিপালক তাকে বাদ দিয়ে অন্য কারো নিকট ‘চূড়ান্ত ভয় ও আশা-সহ চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করতে যাব কেন?

এভাবে আমরা বুঝতে পারি যে, ইলাহ এবং রাবব-এর মধ্যে অর্থগত পার্থক্য থাকলেও, ব্যবহারে দুটি শব্দ একই সত্তার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হওয়া উচিৎ। যিনিই রাবব তিনিই ইলাহ হবেন। আর যিনি রাবব নন তার ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা থাকতে পারে না। এজন্য অনেক সময় ইলাহ অর্থে রাবব ও রাবব অর্থে ইলাহ ব্যবহার করা হয়।

এ কারণে কুরআন কারীমে বারংবার কাফিরদের কর্ম ও বিশ্বাসের এ অযৌক্তিকতা তুলে ধরে বারংবার মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁকে বারংবার রাবব হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, যেহেতু তিনিই একমাত্র রাবব বলে তোমরাও স্বীকার করছ, তবে কেন তাকে ছাড়া অন্যের ইবাদত করছ?

আমরা ইতিপূর্বে দেখেছি যে, আল্লাহ তা’আলা কুরআন কারীমের বিভিন্ন স্থানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন ‘তাওহীদুর রূবুবিয়্যাহ’ সম্পর্কে কাফিরদেরকে প্রশ্ন করতে। এ সকল প্রশ্নের উদ্দেশ্য জ্ঞানের তাওহীদ থেকে কর্মের তাওহীদের দাওয়াত দেওয়া। যেহেতু তোমরাই স্বীকার করছ যে, আল্লাহই একমাত্র স্র্ষ্টা, প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান, সেহেতু তাকে ছাড়া আর কারও উপাসনা করা, প্রার্থনা করা, সাহায্য চাওয়া,  জবাই, মানত বা উৎসর্গ করা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তি ছাড়া কিছুই নয়। এভাবে কাফিরদেরকে তাদের শির্কের অসারতা সুস্পষ্টভাবে বুঝানো হয়েছে এবং প্রকৃতপক্ষে তারা তাদের কর্মের অসারতা স্বীকার করে নিয়েছে।

এ ছাড়াও কুরআন করীমে বিভিন্ন স্থানে আল্লাহর সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্বের কথা উল্লেখ করে একমাত্র তারই ইবাদত করার নির্দেশ দেওয় হয়েছে। এখানে দুটি উদাহরণ উল্লেখ করছি। আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ. الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأَرْضَ فِرَاشًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَأَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَأَخْرَجَ بِهِ مِنَ الثَّمَرَاتِ رِزْقًا لَكُمْ فَلا تَجْعَلُوا لِلَّهِ أَنْدَادًا وَأَنْتُمْ تَعْلَمُونَ.

‘‘হে মানব জাতি, তোমরা তোমাদের সেই প্রতিপালকের ইবাদত কর যিনি তোমাদের ও তোমাদের পূর্ববর্তীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা মুত্তাকী হতে পার। যিনি পুথিবীকে তোমাদের জন্য বিছানা এবং আকাশকে ছাদ করে দিয়েছেন এবং আকাশ হতে পানি বর্ষণ করে তা দিয়ে তোমাদের জীবিকা হিসাবে বিভিন্ন প্রকারের ফল ফসল উৎপাদন করেছেন। অতএব তোমরা জেনেশুনে কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ বানাবে না।’’[3]

অন্যত্র বলা হয়েছে:

وَقَالَ رَبُّكُمُ ادْعُونِي أَسْتَجِبْ لَكُمْ إِنَّ الَّذِينَ يَسْتَكْبِرُونَ عَنْ عِبَادَتِي سَيَدْخُلُونَ جَهَنَّمَ دَاخِرِينَ. اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ اللَّيْلَ لِتَسْكُنُوا فِيهِ وَالنَّهَارَ مُبْصِرًا إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لا يَشْكُرُونَ. ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَأَنَّى تُؤْفَكُونَ. كَذَلِكَ يُؤْفَكُ الَّذِينَ كَانُوا بِآَيَاتِ اللَّهِ يَجْحَدُونَ. اللَّهُ الَّذِي جَعَلَ لَكُمُ الأَرْضَ قَرَارًا وَالسَّمَاءَ بِنَاءً وَصَوَّرَكُمْ فَأَحْسَنَ صُوَرَكُمْ وَرَزَقَكُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ ذَلِكُمُ اللَّهُ رَبُّكُمْ فَتَبَارَكَ اللَّهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ. هُوَ الْحَيُّ لا إِلَهَ إِلا هُوَ فَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ. قُلْ إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَعْبُدَ الَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَمَّا جَاءَنِيَ الْبَيِّنَاتُ مِنْ رَبِّي وَأُمِرْتُ أَنْ أُسْلِمَ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ.

তোমাদের প্রতিপালক বলেন, তোমরা আমাকে ডাক, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দিব। যারা অহঙ্কারে আমার ইবাদতে বিমুখ হয় তারা অবশ্যই লাঞ্ছিত হয়ে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। আল্লাহই তোমাদের বিশ্রামের জন্য রাত সৃষ্টি করেছেন এবং দিনকে আলোকজ্জ্বল করেছেন। নিশ্চয় আল্লাহ মানুষদের প্রতি অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ মানুষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক, সব কিছুর স্রষ্টা, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ (মাবুদ বা উপাস্য) নেই। তাহলে তোমরা কিভাবে বিপথে যাচ্ছ? এইভাবেই বিপথগামী হয় তারা যারা আল্লাহর নিদর্শনাবলিকে অস্বীকার করে। আল্লাহই তোমাদের জন্য পৃথিবীকে বসোপযোগী করেছেন এবং আকাশকে করেছেন ছাদ। তিনি তোমাদের আকৃতি গঠন করেছেন এবং তোমাদেরকে উত্তম আকৃতি দান করেছেন এবং তিনি তোমাদেরকে দান করেছেন উৎকৃষ্ট রিযক। এই তো আল্লাহ, তোমাদের প্রতিপালক। জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ, কত মহান তিনি! তিনি চিরজ্ঞীর, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ বা উপাস্য নেই, সুতরাং তোমরা তারই আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাকেই ডাক। জগৎসমুহের প্রতিপালক আল্লাহর নিমিত্ত সকল প্রশংসা। বল, আমার প্রতিপালকের নিকট থেকে  আমার কাছে সুষ্পষ্ট  নির্দশন  আসার পর আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে  তোমর ডাক তাদের ইবাদত করতে আমাকে নিষেধ করা হয়েছে এবং আমাকে জগৎসমূহের প্রতিপালকের কাছে আতণসমর্পণ করতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।’’[4]

আমরা দেখেছি যে, ‘ডাকা’ বা প্রার্থনা করাই ইবাদতের মূল। এখানে মহান আল্লাহ প্রথমে আল্লাহকে ডাকতে বা তাঁর কাছেই প্রার্থনা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এরপর ‘অহঙ্কারবশত’ যারা আল্লাহর ইবাদত করে না, অর্থাৎ আল্লাকে ছেড়ে অন্য কাউকে ডাকে তাদের পরিণতি উল্লেখ করেছেন। এরপর আল্লাহর রূবুবিয়্যাতের তাওহীদের বিভিন্ন দিক উল্লেখ করে তাদেরকে ইবাদতের তাওহীদের দিকে আহবান করেছেন।

এভাবে আমরা দেখছি যে, কর্ম পর্যায়ের বা ইবাদতের তাওহীদ জ্ঞান পর্যায়ের তাওহীদের স্বাভাবিক প্রকাশ ও ফলাফল। যিনি একমাত্র স্রষ্টা  ও প্রতিপালক একমাত্র তাঁরই ইবাদত উপাসনা করা উচিৎ। আর তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে যদি উপাসনা করা হয় তাহলে তাঁকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সব কিছুর মালিক বা সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করা অর্থহীন হয়ে যায়। এজন্যই ইসলামী বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কর্ম পর্যায়ের বা ইবাদতের তাওহীদের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:

إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللَّهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا فَلا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلا هُمْ يَحْزَنُونَ

‘‘যারা বলে, ‘আমাদের রাবব (প্রতিপালক) তো আল্লাহ’ এবং এতে অবিচলিত থাকে তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।’’[5]

কাফিরগণ স্বীকার ও বিশ্বাস করত এবং বলত যে ‘রাববুনাল্লাহ’ বা ‘আমাদের রবব তো আল্লাহ’। তারা মহান আল্লাহকে ‘আল্লাহ’ ও ‘আল্লাহুম্মা’ এবং ‘রাববানা’ বা ‘রাববী’ বলেই ডাকত। তবে তাদের এ ডাক ও বিশ্বাস ছিল অর্থহীন। কারণ আল্লাহকে রাবব হিসেবে বিশ্বাস করার পর আবার অন্য কারো ইবাদত করার অর্থ ‘রাববুনাল্লাহ’ বিশ্বাসে অবিচলিত না থেকে তা থেকে বিচ্যুত হওয়া। কাফিরদের এ বিচ্যুতির দিকে বারংবার ইঙ্গিত করে কুরআন কারীমে সর্বদা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

[1] জাওহারী, আস-সিহাহ ১/২৩৪।
[2] সূরা (১২) ইউসুফ: ৪২ আয়াত।
[3] সূরা (২) বাকারা: ২১-২২ আয়াত।
[4] সুরা (৪০) মুমিনূন (গফির) ৬০-৬৬ আয়াত
[5] সূরা (৪৬) আহকাফ: ১৩ আয়াত। পুনশ্চ: সূরা হজ্জ: ৪০ ও সূরা ফুস্সিলাত: ৩০ আয়াত।
২. ৪. ৫. তাওহীদুল ইবাদাতেই কাফিরদের আপত্তি

ইবাদতের তাওহীদের উপর গুরুত্ব দেয়ার দ্বিতীয় কারণ হলো, এ পর্যায়ের তাওহীদেই বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য নির্ধারিত হয়। যুগে যুগে ঈমান ও কুফ্রের মধ্যে মূলত এ ব্যাপারেই বিরোধ। প্রথম পর্যায়ের তাওহীদ বা আল্লাহর সৃষ্টি এবং  প্রতিপালনের একত্বে অধিকাংশ মানুষই বিশ্বাস করেন। এই  বিশ্বের একাধিক স্রষ্টা আছেন অথবা এই বিশ্বের কোনো স্রষ্টা নেই- এ ধরণের বিশ্বাস খুবই কম মানুষেই করেছে বা করে। সকল যুগে সকল দেশের প্রায় সব মানুষই মূলত বিশ্বাস করেছেন এবং করেন যে, এই বিশ্বের একজনই স্রষ্টা ও প্রতিপালক রয়েছেন। কিন্তু তারা উপাসনা বা ইবাদতের ক্ষেত্রে তাঁর সাথে ফিরিশতা, নবীগণ, নেককারগণ, জিন্নগণ, অন্যান্য দেবদেবী, পাথর, গাছপালা, মানুষ, মানুষের মুর্তি, স্মৃতিবিজড়িত স্থান, দ্রব্য বা স্মৃতিচিহ্নের পূজা, উপাসনা বা ‘ভক্তি’ করেছেন। আমরা যে কোনো শিরকে লিপ্ত অমুসলিম সমাজের দিকে তাকালেই বিষয়টি খুব সহজে উপলব্ধি করতে পারি। বিভিন্ন যুগের ও জাতির ধর্মীয়  বিশ্বাস নিয়ে যারা গবেষণা করেছেন তাঁরা সবাই এ বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন।[1]

কুরআন ও হাদীসে এ বিষয়ে বিশদভাবে বলা হয়েছে। পবিত্র কুরআনে আমরা দেখতে পাই যে, যুগে যুগে আল্লাহ যে সকল নবী ও রাসুল প্রেরণ করেছেন তাঁদের উম্মতেরা কখনই বলে নি যে, আল্লাহ ছাড়া এই বিশ্বের কোনো স্রষ্টা বা পালনকর্তা আছেন। বরং তারা সবাই আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক, সংহারক বলে বিশ্বাস করতেন। তবে তারা মনে করতেন যে, অনেক দেব-দেবী, গাছ-পাথর, ফিরিশতা, জিন্ন বা মানুষের ঐশ্বরিক শক্তি আছে বা তারা আল্লাহর প্রিয়, কাজেই তাদেরকে উপসনা করলে, তাদের নামে মানত, জবাই বা প্রার্থনা করলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়, তাই তারা আল্লাহর ইবাদতের সাথে সাথে তাদেরও ইবাদত করতেন। নবী রাসূলগণ তাদেরকে সকল দেবদেবী পাথর মূর্তি ও মানুষের উপাসনা ত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর উপাসনার জন্য আহবান জানান। কাফিরেরা  তা মানতে অস্বীকার করে।

আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় মক্কার কাফিরদের বিষয়ে কুরআনের বর্ণনা থেকে বিষয়টি ভালভাবে বুঝতে পেরেছি। আমরা দেখেছি যে, তারা প্রথম পর্যায়ের তাওহীদ বিশ্বাস করতো। কিন্তু তারা দ্বিতীয় পর্যায়ের তাওহীদ, অর্থাৎ ইবাদতের তাওহীদে বিশ্বাস করতো না।

তারা আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করত না, কিন্তু একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করত। কুরআনে কাফিরদের ‘দু‘আ’, মানত, উৎসর্গ ইত্যাদি ইবাদতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলি তারা আল্লাহর জন্য করত। তারা আল্লাহর নামে মানত-কুরবানি করত এবং সাথে সাথে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য উপাস্যদের জন্যও মানত-কুরবানি করত। ইরশাদ করা হয়েছে:

وَجَعَلُوا لِلَّهِ مِمَّا ذَرَأَ مِنَ الْحَرْثِ وَالأَنْعَامِ نَصِيبًا فَقَالُوا هَذَا لِلَّهِ بِزَعْمِهِمْ وَهَذَا لِشُرَكَائِنَا

‘‘আল্লাহ যে শস্য ও গবাদি পশু সৃষ্টি করেছেন তন্মধ্যে থেকে তারা আল্লাহর জন্য এক অংশ নির্দিষ্ট করে এবং নিজেদের ধারণা অনুযায়ী বলে, ‘এটি আল্লাহর জন্য এবং এটি আমাদের উপাস্যদের জন্য’।’’[2]

কুরআন কারীমের বর্ণনা থেকে আমরা জানতে পারি যে, মুশরিকদের প্রধান ইবাদত ছিল ‘দু‘আ’ অর্থাৎ ডাকা বা ত্রাণ বা উদ্ধারের জন্য আবেদন বা প্রার্থনা করা। এজন্য কুরআন করীমে এদের শিরককে অধিকাংশ স্থানে ‘দু‘আ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। প্রায় ৭০ এরও অধিক স্থানে মুশরিকদের শিরককে ‘দু‘আ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে।

কুরআনে বিভিন্ন স্থানে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুশরিকগণ মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করত, তাঁকে ডাকত এবং তার কাছে সাহায্য, বিজয় ইত্যাদি প্রার্থনা করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন তাদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে আহবান করলেন তখন কাফিরগণ আল্লাহর কাছে দু্‘আ করে বলত,

اللَّهُمَّ إِنْ كَانَ هَذَا هُوَ الْحَقَّ مِنْ عِنْدِكَ فَأَمْطِرْ عَلَيْنَا حِجَارَةً مِنَ السَّمَاءِ أَوِ ائْتِنَا بِعَذَابٍ أَلِيمٍ

‘‘হে আল্লাহ, যদি (মুহম্মদ (ﷺ) যা প্রচার করছে) তা আপনার পাঠান সঠিক ও সত্য ধর্ম হয়, তবে আপনি  আমাদের উপর আসমান থেকে পাথর বর্ষণ করুন অথবা আমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দান করুন।’’[3]

বদরের যুদ্ধে যাত্রার  আগে মক্কার কাফিরগণ পবিত্র কা’বা গৃহের গিলাফ বা বহিরাবরণী ধরে আল্লাহর কাছে দু‘আ করেন এবং বলেন, ‘‘হে আল্লাহ আপনি  আমাদের এবং মুহাম্মাদের (ﷺ) দলের মধ্যে যে দল বেশি সম্মানিত ও বেশি ভাল তাদেরকে বিজয়ী করে দেন।’’ কাফিরদের নেতা আবু জাহল আল্লাহর কাছে দু‘আ করে বলে, ‘‘হে আল্লাহ আমাদের (কাফির ও মুসলিমদের) মধ্য থেকে যারা বেশি পাপী, যারা বেশী  আত্মীয়তার সম্পর্ক বিনষ্টকারী তাদেরকে আপনি এই যুদ্ধে পরাজিত করুন।’’[4]

এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন:

إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ

‘‘তোমরা যদি বিজয় প্রার্থনা করে থাক, তবে বিজয় এসে গিয়েছে’’[5]।

অর্থাৎ তোমরা ভাল দলের বিজয় প্রার্থনা করেছিলে, আল্লাহ ভাল দলকে বিজয়ী করেছেন।

আল্লাহর কাছে দু‘আ করার পাশাপাশি তারা তাদের অন্যান্য উপাস্যের কাছেও দু‘আ করত। সাধারণত দু‘আ কুবুল হওয়ার আশায় তারা দু‘আর পূর্বে মানত, উৎসর্গ, কুরবানী ইত্যাদি পেশ করত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাফিরগণ সাধারণ ও ছোটখাট বিপদ-আপদে আল্লাহকে ডাকত না, বরং এ সকল ক্ষেত্রে তারা তাদের অন্যান্য উপাস্যকে ডাকত এবং তার সাহায্য প্রার্থনা করত। আর কঠিন বিপদে পড়লে তারা আল্লাহকে ডাকত। কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন:

قُلْ أَرَأَيْتَكُمْ إِنْ أَتَاكُمْ عَذَابُ اللَّهِ أَوْ أَتَتْكُمُ السَّاعَةُ أَغَيْرَ اللَّهِ تَدْعُونَ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ بَلْ إِيَّاهُ تَدْعُونَ فَيَكْشِفُ مَا تَدْعُونَ إِلَيْهِ إِنْ شَاءَ وَتَنْسَوْنَ مَا تُشْرِكُونَ

‘‘বলুন, যদি তোমরা সত্যবাদী হও তবে তোমরা বলতো, আল্লাহর শাস্তি তোমাদের উপর আপতিত হলে, অথবা তোমাদের নিকট কিয়ামত উপস্থিত হলে তোমরা কি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে ডাকবে? বরং তোমরা শুধু তাকেই ডাকবে। তিনি ইচ্ছা করলে যে বিপদের জন্য তাকে ডাকবে তোমাদের সে বিপদ তিনি দূর করবেন এবং যাদেরকে তোমরা শরীক করতে তাদেরকে তোমরা ভুলে যাবে।’’[6]

মহান আল্লাহ আরো বলেন:

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

‘‘তারা যখন নৌযানে আরোহণ করে তখন তারা বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহকে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে ভিড়িয়ে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখন তারা শির্কে লিপ্ত হয়।’’[7]

অন্যত্র আল্লাহ বলেছেন:

وَإِذَا غَشِيَهُمْ مَوْجٌ كَالظُّلَلِ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ فَمِنْهُمْ مُقْتَصِدٌ وَمَا يَجْحَدُ بِآَيَاتِنَا إِلاَّ كُلُّ خَتَّارٍ كَفُورٍ

‘‘যখন তরঙ্গ তাদেরকে আচ্ছন্ন করে মেঘচ্ছায়ার মত তখন তারা আল্লাহকে ডাকে তাঁর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে। কিন্তু যখন তিনি তাদেরকে উদ্দার করে স্থলে পৌঁছান তখন তাদের কেউ কেউ সরল পথে থাকে; কেবল বিশ্বাসঘাতক, অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিই তার নিদর্শনাবলি অস্বীকার করে।’’[8]

কুরআন কারীমে বিভিন্ন স্থানে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।[9] কুরআনের বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, অধিকাংশ মুশরিকই এইভাবে চলত। সূরা হজ্বের একটি বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, কিছু মানুষ সাধারণভাবে আল্লাহর ইবাদত করত। কিন্তু আল্লাহর প্রতি তাদের আস্থা ও ঈমানের দৃঢ়তা খুবই কম। এজন্য কঠিন বিপদে পড়লে তারা ঈমান হারিয়ে ফেলত এবং শিরকে লিপ্ত হয়ে পড়ত। তখন আল্লাহ ছাড়া অন্য উপাস্যর কাছে চাওয়া শুরু করত।[10]

এভাবে তারা আল্লাহর ইবাদত করলেও, একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে ভয়ঙ্করভাবে অস্বীকার করত। মহান আল্লাহ বলেন:

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ. وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آَلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَجْنُونٍ

‘‘তাদের নিকট যখন বলা হয় ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ব্যতীত কোনো মাবূদ নেই’ তখন তারা অহঙ্কার করে। এবং বলে, আমরা কি এক উন্মাদ কবির জন্য আমাদের ইলাহগণকে বর্জন করব?’’[11]

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

وَعَجِبُوا أَنْ جَاءَهُمْ مُنْذِرٌ مِنْهُمْ وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ. أَجَعَلَ الآَلِهَةَ إِلَهًا وَاحِدًا إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ. وَانْطَلَقَ الْمَلأُ مِنْهُمْ أَنِ امْشُوا وَاصْبِرُوا عَلَى آَلِهَتِكُمْ إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ يُرَادُ. مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي الْمِلَّةِ الآَخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلا اخْتِلاقٌ.

‘‘এবং তারা বিস্ময় বোধ করছে যে, তাদের কাছে তাদের মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী (রাসূল) এসেছেন এবং কাফিররা বলে: এতো এক যাদুকর, মিথ্যাবাদী। সে কি বহু উপাস্যের (ইলাহের) স্থানে এক উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে? এ তো এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার। তাদের প্রধানেরা সরে পড়ে এই বলে যে, তোমরা চলে যাও এবং তোমাদের উপাস্যদের বিষয়ে অবিচল-স্থিরচিত্ত থাক। নিশ্চয় এ ব্যাপারটি উদ্দেশ্যমূলক। আমরা তো অন্য ধর্মাদর্শে এরূপ কথা শুনি নি; নিশ্চয় এ এক মনগড়া কথা।’’[12]

তারা তাদের মাবূদদের পাশাপাশি আল্লাহর ইবাদত করলেও, মূলত এককভাবে আল্লাহর কথা আলোচনা করা বা আল্লাহর একত্বের ও মহত্বের আলোচনা করায় তারা বিরক্ত হতো। মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِي الْقُرْآَنِ وَحْدَهُ وَلَّوْا عَلَى أَدْبَارِهِمْ نُفُورًا

‘‘যখন তুমি তোমার প্রতিপালককে উল্লেখ কর কুরআনের মধ্যে এককভাবে তখন পৃষ্ঠপ্রদর্শন করে তারা সরে পড়ে।’’[13]

মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لا يُؤْمِنُونَ بِالآَخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِنْ دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

‘‘একমাত্র আল্লাহর কথা বলা হলে যারা আখিরাতে বিশ্বাস করে না তাদের অন্তর বিতৃষ্ণায় সংকুচিত হয় এবং আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের উল্লেখ করা হয়ে তারা আনন্দে উল্লসিত হয়।’’[14]

ইসলাম ও মুসলিমদের সাথে তাদের চরম শত্রুতা এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর চরম বিরোধিতার কারণ ছিল এই তাওহীদুল ইবাদাতের বিশ্বাস।

[1] C. Jouco Bleeker And Geo Widengren, Historia Religionum: Handbook For The History Of Religions, Leiden 1969, Volume 1&2.
[2] সূরা (৬) আনয়াম: ১৩৬ আয়াত।
[3] সূরা (৮) আনফাল: ৩২ আয়াত।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ৪/১৭০৪-১৭০৫; তাবারী, জামিউল বায়ান ৯/২০৭-২০৮; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/৩০৮।
[5] সূরা (৮) আনফাল: ১৯ আয়াত।
[6] সূরা (৬) আনআম: ৪০-৪১ আয়াত।
[7] সূরা (২৯) আনকাবূত: ৬৫ আয়াত।
[8] সূরা (৩১) লুকমান: ৩২ আয়াত।
[9] দেখুন: আন’আম: ৬৩; আ’রাফ: ১৮৯; ইউনূস: ১২, ২২; নাহল: ৫৩-৫৪; ইসরা: ৬৭; আনকাবূত: ৬৫; রূম: ৩৩; লুকমান: ২৩; সূরা যুমার: ৮ ইত্যাদি।
[10] সূরা হাজ্ব : ১১-১৩।
[11] সূরা (৩৭) সাফ্ফাত: ৩৫-৩৬ আয়াত।
[12] সূরা (৩৮) সাদ ৪-৭ আয়াত।
[13] সূরা (১৭) ইসরা/বানী ইসরাঈল: ৪৬ আয়াত।
[14] সূরা (৩৯) যুমার: ৪৫ আয়াত।

উপরের আলোচনা থেকে একটি প্রশ্ন আমাদের মনে স্বভাবতই জাগ্রত হয়। তা হলো, মহান আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান বলে বিশ্বাস করার পরেও কেন তারা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এত কঠিনভাবে অস্বীকার করত? কেনই বা তারা এককভাবে আল্লাহর যিক্র বা আলোচনা হলে বিরক্ত হতো?

কুরআন ও হাদীসের বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, তারা মহান আল্লাহকে জাগতিক রাজা-মহারাজাদের মতই কল্পনা করত। তারা মনে করত যে, ফিরিশতাগণ, নবীগণ বা অনুরূপ পর্যায়ের আল্লাহর কিছু বান্দা আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগি করে আল্লাহর বিশেষ প্রেম ও ভালবাসা অর্জন করেছেন। ফলে মহান আল্লাহ এদেরকে বিশেষ মর্যাদা ও অধিকার প্রদান করেছেন, যে মর্যাদা ও অধিকারের ফলে এ সকল ‘প্রিয়পাত্র’ উলূহিয়্যাত’ অর্থাৎ ইবাদত বা চূড়ান্ত ও অলৌকিক ভক্তি ও বিনয় লাভের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। একজন জাগতিক মহারাজ যেমন তার প্রিয় দাস বা খাদিমকে খুশি হয়ে রাজত্বের কিছু অংশ প্রদান করেন, অনুরূপভাবে মহান আল্লাহ এদেরকে বিশ্ব পরিচালনার কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে কোনো ক্ষমতা এদের নেই, তবে মহারাজ যেমন সামন্ত রাজাদের রাজ্য পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করেন না, তেমনি আল্লাহও এদের কাজে কর্মে বাধা দেন না; কারণ তিনিই ভালবেসে এদেরকে উলূহিয়্যাত ও রবূবিয়্যাতে শরীক করেছেন। তাদের এ বিশ্বাস প্রকাশ করে হজ্জের তালবিয়া পাঠের সময় তারা বলত:

لَبَّيْكَ لا شَرِيكَ لَكَ إِلا شَرِيكًا هُوَ لَكَ تَمْلِكُهُ وَمَا مَلَكَ

লাববাইকা আল্লাহুম্মা লাববাইক...আপনার কোনো শরীক নেই, তবে আপনি নিজে যাকে আপনার শরীক বানিয়েছেন সে ছাড়া। এরূপ শরীকও আপনারই মালিকানাধীন, আপনারই বান্দা, উক্ত শরীক ও তার সকল কর্তৃত্ব ও রাজত্ব আপনারই অধীন ...।[1]

এজন্য তারা বিশ্বাস করত যে, সরাসরি আল্লাহর ডাকলে বা একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করলে আল্লাহর এ সকল প্রিয়পাত্রের অধিকার ও ক্ষমতা অস্বীকার করা হয় এবং বেয়াদবি হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে হলে এদের মাধ্যমেই যেতে হবে, যেমন মহারাজের নিকট আবেদন করতে ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষে’ মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। এদের মাধ্যম ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব না। তাদের এ বিশ্বাস সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

وَالَّذِينَ اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ مَا نَعْبُدُهُمْ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَا إِلَى اللَّهِ زُلْفَى

আর যারা আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য আউলিয়া (অভিভাবক বা বন্ধু ) গ্রহন করেছে তারা বলে, আমরা তো এদের শুধু এজন্যই ইবাদাত করি যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেবে।’’[2]

তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল ‘আউলিয়া’-র রয়েছে আল্লাহর কাছে বিশেষ অধিকার, ফলে এরা আল্লাহর নিকট সুপারিশ করে দ্রুত হাজত মিটিয়ে দিতে পারেন। কাজেই এদের ডাকলে যত দ্রুত সাড়া পাওয়া যায়, সরাসরি আল্লাহকে ডেকে তা পাওয়া যায় না। এবিষয়ে আল্লাহ বলে্ন:

وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لا يَضُرُّهُمْ وَلا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ

‘‘তারা আল্লাহ ব্যতীত যাদের ইবাদত করে তারা তাদের কোনো ক্ষতিও করতে পারে না উপকারও করতে পারে না। তারা বলে এরা আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী (শাফায়াতকারী)।’’[3]

এখানে লক্ষণীয় যে, তাদের এ সকল দাবি ও বিশ্বাস বিবেক ও যুক্তি বিরোধী। কারণ আল্লাহই যখ্ন একমাত্র স্রষ্টা, প্রতিপালক ও সর্বশক্তিমান তখন কেন মানুষ অন্য কারো কাছে নিজের চূড়ান্ত অসহায়ত্ব প্রকাশ করবে?

এছাড়া তাদের এ দাবিগুলি সবই মহান আল্লাহ কেন্দ্রিক। মহান আল্লাহ অমুক ব্যক্তিকে ক্ষমতা প্রদান্ করেছেন, অথবা তিনি সাধারণভাবে ফিরিশতা বা নবীগণ বা বিশেষ শ্রেণীর মানুষদেরকে উলূহিয়্যাত বা রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতা, অধিকার বা শরিকানা প্রদান করেছেন, এবং এসকল ক্ষমতা ও অধিকার প্রাপ্ত ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সরাসরি আল্লাহকে ডাকলে তিনি অসন্তুষ্ট হবেন বলে দাবি করতে হলে তা আল্লাহর থেকে প্রাপ্ত ওহীর মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে। এজন্য কুরআন কারীমে বারংবার তাদের নিকট কিতাবের প্রমাণ চাওয়া হয়েছে। স্বভাবতই তারা কখনো কোনো প্রমাণ দিতে পারে নি। তারা শুধু ওহীর কয়েকটি পরিভাষার অপব্যাখ্যা ও অপব্যবহার করেছে। পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে মহান আল্লাহ নেককার বান্দাদের বা নবী ও ফিরিশতাদের ভালবাসার কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়া নেককার বান্দাদের সুপারিশ বা শাফা‘আতের বিষয়টিও ওহীর মাধ্যমে স্বীকৃত। অনুরূপভাবে মুজিযা ও কারামতের বিষয়টিও ওহীর মাধ্যমে স্বীকৃত। মুশরিকগণ এ বিষয়গুলি বিকৃত করে তাদের শিরক প্রমাণ করতে চেষ্টা করত।

তাদের যুক্তির ধারা অনেকটা নিম্নরূপ: (১) আল্লাহ অমুক বা তমুককে ভালবাসেন, (২) যেহেতু তিনি তাঁকে ভালবাসেন সেহেতু নিশ্চয় তিনি তাকে রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতে শরীক বানিয়েছেন বা বিশ্ব পরিচালনার কিছু দায়িত্ব ও ক্ষমতা তাকে দিয়েছেন, (৩) এ ক্ষমতার প্রমাণ তাদের মুজিযা-কারামত বা অলৌকিক কার্যাদি, (৪) যেহেতু তিনি তাদেরকে রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের কিছু ক্ষমতা ও সুযোগ দিয়েছেন সেহেতু তাদের বাদ দিয়ে সরাসরি আল্লাহর নৈকট্য পাওয়া যায় না, (৫) যেহেতু তাদের শাফা‘আতের অধিকার স্বীকৃত, কাজেই তাদের কাছেই হাজত পেশ করতে হবে এবং (৬) তাদের বাদ দিয়ে সরাসরি আল্লাহকে ডাকা হলে বা তাদের মহত্বের আলোচনা বাদ দিয়ে শুধু আল্লাহর মহত্ব ও মর্যাদা আলোচনা করলে তাদের সাথে বেয়াদবি হয় যা ক্ষমার অযোগ্য।

তাদের এ সকল যুক্তির ভিত্তিতে তারা তওহীদের প্রচারকদের ভয়-ভীতি দেখাত। তারা বলত, আল্লাহর প্রিয়পাত্র যাদের আমরা ইবাদত করি তোমরা এদের বিরুদ্ধে কথা বলা বন্ধ না করলে এরা তোমাদের ক্ষতি করে দেবে। তাওহীদের প্রচারকদের ভীতিপ্রদর্শনের ক্ষেত্রে তাদের চিন্তাধারা ছিল নিম্নরূপ:

(১) একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে বলার অর্থই আল্লাহর প্রিয়পাত্র ফিরিশতা, নবী, ওলী বা আল্লাহর সন্তানদের বিরুদ্ধে কথা বলা! আল্লাহ ছাড়া কারো ডাকা যাবে না, সাজদা করা যাবে না, মানত করা যাবে না ইত্যাদি বলার অর্থ এ আল্লাহর এ সকল প্রিয়পাত্রের সাথে বেয়াদবী করা!!

(২) এরূপ বেয়াদবীতে আল্লাহর এ সকল প্রিয়পাত্র বেজায় অখুশি ও নারায হন! ফলে এরূপ বেয়াদবদের তারা শাস্তি দেন!! মহান আল্লাহ তাদেরকে যে ক্ষমতা দিয়েছেন সে ক্ষমতাবলে তারা বেয়াদবদের শাস্তি দিতে পারেন!!!

মহান আল্লাহ ইবরাহীম (আঃ)-এর প্রসঙ্গে বলেন:

وَحَاجَّهُ قَوْمُهُ قَالَ أَتُحَاجُّونِّي فِي اللَّهِ وَقَدْ هَدَانِ وَلا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلا أَنْ يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا وَسِعَ رَبِّي كُلَّ شَيْءٍ عِلْمًا أَفَلا تَتَذَكَّرُونَ وَكَيْفَ أَخَافُ مَا أَشْرَكْتُمْ وَلا تَخَافُونَ أَنَّكُمْ أَشْرَكْتُمْ بِاللَّهِ مَا لَمْ يُنَزِّلْ بِهِ عَلَيْكُمْ سُلْطَانًا فَأَيُّ الْفَرِيقَيْنِ أَحَقُّ بِالأَمْنِ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ

‘‘তার সম্প্রদায় তার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো। সে বলল, তোমরা কি আল্লাহ সম্বন্ধে আমার সাথে বিতর্কে লিপ্ত হবে? তিনি তো আমাকে সৎপথে পরিচালিত করেছেন। তোমরা যাদেরকে তাঁর সাথে শরীক কর আমি তাদেরকে ভয় করি না, তবে আমার প্রতিপালক যদি কিছু ইচ্ছা করেন (অর্থাৎ এসকল উপাস্য আমার কোনো ক্ষতি করতে পারে বলে আমি ভয় পাই না, আমার যদি কোনো ক্ষতি বা বিপদ হয় তবে আল্লাহর ইচ্ছাতেই হবে, তোমাদের উপাস্যদের ইচ্ছাতে নয়)। সব কিছুই আমার প্রতিপালকের জ্ঞানায়ত্ব, তবে কি তোমরা অবধান কর না? তোমরা যাদেরকে আল্লাহর শরীক কর আমি তাদেরকে কিভাবে ভয় করব? অথচ আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার কোনোরূপ অনুমতি প্রদান না করা সত্ত্বেও তেমারা আল্লাহর সাথে শরীক করতে ভয় পাও না? তাহলে তোমাদের যদি জ্ঞান থাকে তবে বল তো কোন দল নিরাপত্তা লাভের যোগ্য?’’[4]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

أَلَيْسَ اللَّهُ بِكَافٍ عَبْدَهُ وَيُخَوِّفُونَكَ بِالَّذِينَ مِنْ دُونِهِ وَمَنْ يُضْلِلِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ هَادٍ وَمَنْ يَهْدِ اللَّهُ فَمَا لَهُ مِنْ مُضِلٍّ أَلَيْسَ اللَّهُ بِعَزِيزٍ ذِي انْتِقَامٍ وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ قُلْ أَفَرَأَيْتُمْ مَا تَدْعُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ إِنْ أَرَادَنِيَ اللَّهُ بِضُرٍّ هَلْ هُنَّ كَاشِفَاتُ ضُرِّهِ أَوْ أَرَادَنِي بِرَحْمَةٍ هَلْ هُنَّ مُمْسِكَاتُ رَحْمَتِهِ قُلْ حَسْبِيَ اللَّهُ عَلَيْهِ يَتَوَكَّلُ الْمُتَوَكِّلُونَ

‘‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট নন? অথচ তারা তোমাকে আল্লাহর পরিবর্তে যারা তাদের ভয় দেখায়। আল্লাহ যাকে বিভ্রান্ত করেন তার জন্য কোনো পথ-প্রদর্শক নেই। এবং আল্লাহ যাকে হিদায়াত করেন তার জন্য কোনো পথভ্রষ্টকারী নেই। আল্লাহ কি পরাক্রমশালী, দন্ডবিধায়ক নন? তুমি যদি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, ‘আল্লাহ।’ তুমি বল, তোমরা ভেবে দেখেছ কি, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সে অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সে অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? বল, ‘আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট।’ নির্ভরকারিগণ আল্লাহর উপরেই নির্ভর করে।’’[5]

এখানে কুরআন কারীমের যুক্তি প্রদান পদ্ধতি লক্ষ্য করুন। এ সকল মুশরিক রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে তাদের ভয় দেখাচ্ছে যে, তাদের বাদ দিয়ে একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের কথা বলার অর্থই তাদের সাথে বেয়াদবী করা এবং তাদের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা। এতে তারা নারাজ হয়ে তোমার অমঙ্গল ও ক্ষতি করবে। এখন প্রশ্ন হলো, মহান আল্লাহ যদি আমার ভাল চান তাহলে কি তারা তা ঠেকাতে পারে? যদি তিনি আমার অমঙ্গল চান তাহলে কি তারা তা রোধ করতে পারে? উভয় ক্ষেত্রে মুশরিকদের উত্তর হলো: না। আর তারা যেহেতু এতই অক্ষম তাহলে তাদের ডাকার দরকার কী? মহান আল্লাহকে ডাকলেই তো হলো। তিনিই তো তাঁর বান্দার জন্য যথেষ্ট।

এভাবে আমরা দেখছি যে, মুশরিকগণ একটি ভিত্তিহীন কল্পনার উপরেই শিরকে লিপ্ত হয়, যে মহান আল্লাহ যেহেতু এ সকল বান্দাকে ভালবাসেন, সেহেতু তিনি অবশ্যই এদেরকে কিছু ক্ষমতা দিয়েছেন এবং এদের না ডেকে সরাসরি আল্লাহকে ডাকলে এদের সাথে বেয়াদবী হয়। তাদের এ সকল যুক্তি সবই মিথ্যা ও ভিত্তিহীন কল্পনা এবং ওহীর কয়েকটি বিষয়ে বিকৃতি বৈ কিছুই নয়। শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী বলেন: ‘‘প্রত্যেক নবীই তাঁর উম্মাতকে সুনিশ্চিতরূপে শিরকের হাকীকত বুঝিয়ে গিয়েছেন। এরপর যখন নবীর প্রিয় সহযোগীগণ এবং তাঁর দীনের বাহকগণ গত হন, তাদের পরে নতুন একটি প্রজন্ম আগমন করে, যারা সালাত বিনষ্ট করে এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করে। তখন এরা ওহীর মধ্যে ব্যবহৃত দ্ব্যর্থবোধক শব্দাবলিকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রিয়ত্ব এবং শাফা‘আতের বিষয়দুটি সকল শরীয়তেই বিশেষ মানুষদের জন্য উল্লেখ করা হয়েছে। তারা এ দুটি বিষয়েরও বিকৃত অর্থ করে। এছাড়া তারা অলৌকিক কর্মাদি এবং কাশফ-ইলহামের বিষয়টিকে ক্ষমতা ও গাইবী ইলমের প্রমাণ হিসেবে পেশ করে। যার থেকে এরূপ অলৌকিক কর্ম বা কাশফ দেখা গিয়েছে তাকে অলৌকিক ক্ষমতা ও জ্ঞানের মালিক বলে তারা দাবি করে।’’[6]

[1] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮৪৩; তাবারী, তাফসীর ১৩/৭৮-৭৯।
[2] সূরা (৩৯) যুমার:২-৩ আয়াত।
[3] সূরা (১০) ইউনুস: ১৮ আয়াত।
[4] সূরা (৬) আন‘আম: ৮০-৮১।
[5] সূরা (৩৯) যুমার: ৩৬-৩৮ আয়াত।
[6] শাহ ওয়ালিউল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগা ১/১৮১-১৮২।
২. ৪. ৭. ইবাদতের তাওহীদই সকল নবী-রাসূলের দাও‘আত

ইবাদততের তাওহীদই ছিল যুগে যুগে সকল নবী-রাসূলের প্রথম ও মূল দাও‘আত। কুরআন কারীম থেকে আমরা জানতে পারি যে, সকল নবী ও রাসূল তাঁর উম্মাতকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে আহবান করেছেন। প্রথম রাসূল নূহ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘আমি তো নূহকে পাঠিয়েছিলাম তার সম্প্রদায়ের নিকট এবং সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়, আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীয়ত তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ (মাবূদ বা উপাস্য) নেই।’’[1]

হূদ (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহ বলেন:

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘‘আদ জাতির নিকট তাদের ভ্রাতা হূদকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই।’’[2]

সালিহ (আঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘সামূদ জাতির নিকট তাদের ভ্রাতা সালিহকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই।’’[3]

শু‘আইব (আঃ) সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘মাদ্য়ানবাসীদের নিকট তাদের ভ্রাতা শু‘আইবকে পাঠিয়েছিলাম। সে বলেছিল, ‘হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহর ‘ইবাদত কর, তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই।’’[4]

সকল নবীকেই এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল:

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘‘আমি তোমার পূর্বে কোনো রাসূলই প্রেরণ করি নি এই ওহী ব্যতীত যে, আমি ব্যতীত অন্য কোনো ইলাহ নেই, সুতরাং আমারই ইবাদত কর।’’[5]

আমরা দেখেছি যে, অন্য আয়াতে এ বিষয়ে বলা হয়েছে: ‘‘আল্লাহর ইবাদত করার এবং তাগূতকে বর্জন করার নির্দেশ দিয়ে আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি।’’

[1] সূরা (৭) আরাফ: ৫৯ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১১) হূদ: ২৫-২৬ আয়াত।
[2] সূরা (৭) আরাফ: ৬৫ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১১) হূদ: ৪৯ আয়াত।
[3] সূরা (৭) আরাফ: ৭৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১১) হূদ: ৬১ আয়াত।
[4] সূরা (৭) আরাফ: ৮৫ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (১১) হূদ: ৮৪ আয়াত।
[5] সূরা (২১) আম্বিয়া: ২৫ আয়াত।

তাওহীদই কুরআনের মূল আলোচ্য এবং সকল আলোচনার মূল বিষয়। ইমাম আবূ হানীফার (রা) ‘আল-ফিকহুল আকবার’ গ্রন্থের ব্যাখ্যায়, তাওহীদের আলোচনাকালে মোল্লা আলী কারী (১০১৪ হি) বলেন:

‘‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ বা ইবাদতের তাওহীদ স্বীকার করলে স্বতঃসিদ্ধভাবে তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ বা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের তাওহীদ স্বীকার করা হয়ে যায়। (তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ স্বীকার করার অর্থই তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ স্বীকার করা।) কিন্তু তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ স্বীকার করলে তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ স্বীকার করা হয় না।...

কুরআনের অধিকাংশ সূরা ও আয়াত এই দুই প্রকারের তাওহীদের বর্ণনা সম্বলিত। বরং সত্যিকার বিষয় যে, কুরআনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কথাই এই দুই প্রকারের তাওহীদের বিবরণ।

কারণ কুরআনে কোথাও আল্লাহর সত্তা, নামসমূহ, গুণাবলি ও কার্যাদির বর্ণনা করা হয়েছে, আর এগুলি জ্ঞান ও সংবাদের তাওহীদ। আর কোথাও শির্ক-মুক্ত ভাবে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে এবং আল্লাহ ছাড়া যা কিছু ইবাদত করা হয় সব কিছু বর্জন করতে আহবান করা হয়েছে। এ হলো ‘আত-তাওহীদুল ইরাদী আত-তালাবী’ বা ‘ইচ্ছাধীন নির্দেশিত একত্ব’ (ইবাদতের তাওহীদ)।

আর কোথাও আদেশ, নিষেধ ও আল্লাহ আনুগত্য বজায় রাখার বর্ণনা রয়েছে। এগুলি তাওহীদের দাবি ও পরিপূরক। আর কোথাও তাওহীদের অনুসারীদের সম্মান-মর্যাদার কথা, দুনিয়াতে তাদের সাথে কিরূপ আচরণ করা হয়েছে এবং আখিরাতে তাদেরকে কিভাবে সম্মানিত করা হবে তা বলা হয়েছে। এ হলো তাওহীদের পুরস্কার। আর কোথাও শির্কে লিপ্ত ব্যক্তিদের কথা আলোচনা করা হয়েছে, পৃথিবীতে তাদেরকে কি লাঞ্ছনা প্রদান করা হয়েছে এবং আখিরাতে তাদের জন্য কি শাস্তি ও যন্ত্রণা অপেক্ষা করছে তা বলা হয়েছে। এ হলো তাওহীদ থেকে বাইরে যাওয়ার প্রতিফল। কাজেই কুরআনের সকল আলোচনাই তাওহীদ কেন্দ্রিক।[1]

[1] মোল্লা আলী কারী, শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৩।

ঈমানের অন্যতম বিষয় আল্লাহর রাসূলগণে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, আল্লাহ যুগে-যুগে মানব জাতির সঠিক পথের দিশা দানের জন্য মানুষদের মধ্য থেকে অসংখ্য মানুষকে মনোনীত করে তাঁদেরকে তাঁর বাণী দান করেন এবং মানুষদেরকে সত্য ও কল্যাণের পথে আহবানের দায়িত্ব তাঁদেরকে দান করেন। এরা সবাই মহান চরিত্রের অধিকারী ও কল্যাণময় মানুষ ছিলেন। এরা সবাই তাঁদের  দায়িত্ব যথাযত পালন করেন। এদের অধিকাংশের নাম বা বিবরণ আমরা জানিনা। শুধু যাদের নাম কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদেরকে আমরা নির্দিষ্টভাবে নবী বা রাসূলরূপে বিশ্বাস করি। অন্য কাউকে আমরা নিশ্চিতরূপে আল্লাহর রাসূল বলে মনে করতে পারিনা, যদিও আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল যুগে সকল দেশে আল্লাহ নবী রাসূল প্রেরণ করেছেন। আমরা এদের সবাইকে বিশ্বাস করি, শ্রদ্ধা করি এবং ভালবাসি। আর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ট নবী মুহাম্মদ (ﷺ)-এর আমরা অনুসরণ করি এবং তাঁর শরীয়ত মত জীবন পরিচালনা করি। আমরা এ অধ্যায়ে মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর রিসালাতের প্রতি ঈমানের অর্থ আলোচনা করব। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা ঈমানের অবশিষ্ট রুকনগুলি আলোচনা প্রসঙ্গে অন্যান্য নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমানের অর্থ আলোচনা করব।

৩. ১. রিসালাতের সাক্ষ্য

৩. ১. ১. শাহাদাতের তিনটি শব্দ

আমরা দেখেছি যে, শাহাদাতাইনের দ্বিতীয় অংশে (মুহাম্মাদান আব্দুল্লাহ ওয়ারাসূলুহু) বলে সাক্ষ্য দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এখানে তিনটি শব্দ আছে: মুহাম্মাদ, আবদ ও রাসূল। রিসালাতের বিশ্বাসের অর্থ আলোচনা করার আগে আমরা এই তিনটি শব্দের অর্থ ও ব্যাখ্যা অনুধাবনের চেষ্টা করব।

প্রথমে আমাদের জানা দরকার মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) কে ছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই কমবেশী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবন ও চরিত্র সম্পর্কে অবগত আছি। তা সত্ত্বেও তার জীবনী আলোচনার মধ্যে রয়েছে অনেক কল্যাণ। এখানে আমরা সংক্ষেপে তাঁর পরিচয় উল্লেখ করব।

৩. ১. ২. ১. দেশ ও বংশ

আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বৎসর আগে মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) আরব দেশের প্রাণ কেন্দ্র পবিত্র মক্কা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল আব্দুল্লাহ, আব্দুল্লাহর পিতা আব্দুল মুত্তালিব, তার পিতা হাশিম। হাশিম ছিলেন কুরাইশ বংশের, কুরাইশ একটি আরব গোত্র, যারা ইব্রাহীম (আঃ)-এর পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশধর।

কুরাইশ বংশ ছিল আরবের শ্রেষ্ঠ বংশ। এ বংশের মধ্যে হাশিমের পরিবার ছিল অত্যন্ত সম্মানিত পরিবার। মক্কাবাসীরা তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক নেতৃত্বের আসনে স্থান দেন। এই হাশিম পরিবারের অন্যতম নেতা ছিলেন আব্দুল মুত্তালিব। তিনি তার পুত্র আব্দুল্লাহকে মক্কার কুরাইশ বংশের অপর শাখা বানূ যুহ্রার নেতা ওয়াহ্ব ইবনু আব্দু মানাফ বিন যুহরার কন্যা আমিনার সাথে বিবাহ দেন। বিবাহের কয়েক মাস পরে, মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর জন্মের কয়েক মাস পূর্বে আব্দুল্লাহ খেজুর আনার জন্য মদীনায় (ইয়াসরিবে) তার মাতুলালয়লে গমন করেন। সেখানে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যু বরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বৎসর।

৩. ১. ২. ২. জন্ম

আব্দুল্লাহর মৃত্যুর কয়েক মাস পরে মহানবী মুহাম্মাদ (ﷺ) জন্মগ্রহণ করেন। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ‘আমুল ফীল’ (عام الفيل) বা হাতির বৎসরে জন্মগ্রহণ করেন।[1] হাতীর বছর অর্থাৎ যে বৎসর আবরাহা হাতি নিয়ে কাবা ঘর ধ্বংসের জন্য মক্কা শরীফ আক্রমণ করেছিল। ঐতিহাসিকদের মতে এ বছর ৫৭০ বা ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দ ছিল।[2]

সহীহ হাদীস থেকে স্পষ্টরূপে জান যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার জন্মগ্রহণ করেছেন।[3] হাদীসে নববী থেকে তাঁর জন্মমাস ও জন্মতারিখ সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। সাহাবীগণের মাঝেও এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মত প্রচলিত ছিল না। একারণে পরবর্তী যুগের আলিম ও ঐতিহাসিকগণ তাঁর জন্মতারিখ সম্পর্কে অনেক মতভেদ করেছেন। এ বিষয়ে ১২টিরও বেশি মত রয়েছে। ইবনু হিশাম, ইবনু সা’দ, ইবনু কাসীর,  কাসতালানী ও অন্যান্য ঐতিহাসিক এ বিষয়ে নিম্নলিখিত মতামত উল্লেখ করেছেন:

(১). কারো মতে তাঁর জন্মতারিখ অজ্ঞাত, তা জানা যায়নি এবং জানা সম্ভব নয়। তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছেন এটুকুই শুধু জানা যায়, জন্ম মাস বা তারিখ জানা যায় না। এ বিষয়ে কোনো আলোচনা তারা অবান্তর মনে করেন।

(২). কারো কারো মতে তিনি মুহাররাম মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

(৩). অন্য মতে তিনি সফর মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

(৪). কারো মতে তিনি রবিউল আউআল মাসের ২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। দ্বিতীয় হিজরী শতকের অন্যতম ঐতিহাসিক মুহাদ্দিস আবু মা’শার নাজীহ বিন আব্দুর রাহমান আস-সিনদী (১৭০ হি.) এই মতটি গ্রহণ করেছেন।

(৫). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ। আল্লামা কাসতালানী ও যারকানীর বর্ণনায় এই মতটিই অধিকাংশ মুহাদ্দিস গ্রহণ করেছেন। এই মতটি দুইজন সাহাবী ইবনু আববাস (রা) ও জুবাইর বিন মুতয়িম (রা) থেকে বর্ণিত। অধিকাংশ ঐতিহাসিক ও সীরাত বিশেষজ্ঞ এই মতটি গ্রহণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেছেন।

(৬). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১০-ই রবিউল আউয়াল। এ মতটি ইমাম হুসাইনের পৌত্র মুহাম্মাদ ইবনু আলী আল বাকের (১১৪ হি) থেকে বর্ণিত। প্রসিদ্ধ তাবিয়ী আমির ইবনু শারাহিল আশ শাবী (১০৪ হি.) থেকেও মতটি বর্ণিত। ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনু উমর আল-ওয়াকিদী (২০৭ হি) এই মত গ্রহণ করেছেন। ইবনু সা’দ তার বিখ্যাত ‘‘আত-তাবাকাতুল কুবরা’’-য় শুধু দুইটি মত উল্লেখ করেছেন, ২ তারিখ ও ১০ তারিখ।[4]

(৭). কারো মতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর জন্মতারিখ ১২ রবিউল আউয়াল। এই মতটি দ্বিতীয় হিজরী শতাব্দীর প্রখ্যাত ঐতিহাসিক মুহাম্মাদ ইবনু ইসহাক (১৫১ হি) গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেছেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাতির বছরে রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখে জন্মগ্রহণ করেন।’’[5] এখানে লক্ষণীয় যে, ইবনু ইসহাক সীরাতুন্নবীর সকল তথ্য সাধারণত সনদসহ বর্ণনা করেছেন, কিন্তু এই তথ্যটির জন্য কোনো সনদ উল্লেখ করেননি। কোথা থেকে তিনি এই তথ্যটি গ্রহণ করেছেন তাও জানাননি বা সনদসহ প্রথম শতাব্দীর কোনো সাহাবী বা তাবেয়ী থেকে মতটি বর্ণনা করেননি। এ জন্য অনেক গবেষক এই মতটিকে দুর্বল বলে উল্লেখ করেছেন[6]। তা সত্ত্বেও পরবর্তী যুগে এই মতটিই প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। ইবনু কাসীর উল্লেখ করেছেন যে ২ জন সাহাবী জাবির (রা) ও ইবনু আববাস (রা) থেকে এই মতটি বর্ণিত।

(৮). অন্য মতে তাঁর জন্মতারিখ ১৭-ই রবিউল আউয়াল।

(৯). অন্য মতে তাঁর জন্ম তারিখ ২২-শে রবিউল আউয়াল।

(১০). অন্য মতে তিনি রবিউস সানী মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

(১১). অন্য মতে তিনি রজব মাসে জন্মগ্রহণ করেছেন।

(১২). অন্য মতে তিনি রমযান মাসে জন্মগ্রহণ করেন। ৩য় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক যুবাইর ইবনু বাক্কার (২৫৬ হি) থেকে এ মতটি বর্ণিত। তাঁর মতের পক্ষে যুক্তি হলো যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সর্বসম্মতভাবে রমযান মাসে নুবুওয়াত পেয়েছেন। তিনি ৪০ বৎসর পূর্তিতে নুবুয়্যত পেয়েছেন। তাহলে তাঁর জন্ম অবশ্যই রমযানে হবে। এছাড়া কোনো কোনো হাদীসে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হজ্বের পবিত্র দিনগুলিতে মাতৃগর্ভে আসেন। সেক্ষেত্রেও তাঁর জন্ম রমযানেই হওয়া উচিত। এ মতের সমর্থনে আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা) থেকে একটি বর্ণনা আছে বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেছেন।[7]

৩. ১. ২. ৩. শৈশব ও কৈশর

জন্মের পরে তাঁর মাতা তাঁর নাম রাখেন ‘‘আহমাদ’’, আর তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব তার নাম রাখেন ‘‘মুহাম্মদ’’। মক্কার আধিবাসীরা তাদের নবজাতক সন্তানদেরকে সাধারণত শহরের বাইরে বেদুইন গোত্রদের মধ্যে কিছুদিন লালান পালন করতেন, যেন তারা শহরের মিশ্র পরিবেশের বাইরে বেদুইনদের মাঝে পরিপূর্ণ মানসিক ও দৈহিক পূর্ণতা ও স্বাবলম্বিতা নিয়ে গড়ে ওঠে এবং তাদের ভাষা বিশুদ্ধ হয়। এ নিয়মে জন্মের কিছুদিন পরে মক্কার বাইরে, মক্কা ও তায়েফের মধ্যবর্তী এলাকার বেদূইন গোত্র বনু সা’দের হালীমা বিনতু আবু যু‘আইব নামক এক মহিলা শিশু মুহাম্মদ (ﷺ)-এর লালন পালনের ভার গ্রহণ করেন। তিনি সেখানে ৫ বৎসর কাটান।

এরপর তিনি মক্কায় তাঁর মাতার কাছে ফিরে আসেন। প্রায় এক বৎসর পর তাঁর মাতা মৃত্যুবরণ করেন। তখন তাঁর দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাঁর লালন পালনের ভার গ্রহন করেন। আব্দুল মুত্তালিব তার এই এতিম পৌত্রকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ২ বৎসর পরে, ৮ বৎসর বয়সে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর দাদাকেও হারান। মৃত্যুর সময় আব্দুল মুত্তালিব তার পুত্র আবূ তালিবের উপর দায়িত্ব দেন এতিম বালক মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর লালন পালনের। পরবর্তী প্রায় ১৭ বৎসর তিনি তাঁর চাচা আবু তালিবের পরিবারেই অবস্থান করেন।

এসময়ে তিনি মাঝেমাঝে তার চাচার ও অন্যান্য মক্কাবাসীদের ছাগল- ভেড়া চরাতেন মক্কার প্রান্তরে। কখনো চাচার সাথে ব্যবসায়ের ভ্রমণে অংশ নিয়েছেন। তিনি সাধারণ যুবকদের মত গল্পগুজব পছন্দ করতেন না। তিনি কখন কোনো মূর্তিকে স্পর্শ করেননি । মক্কায় প্রচলিত বিাভন্ন কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। ৫৯১ খৃষ্টাব্দের দিকে, যখন তার বয়স প্রায় ২০ বৎসর, মক্কার কিছু সৎ ও সাহসী যুবক একত্রিত হয়ে শপথ গ্রহণ করেন যে, তারা সমাজের অত্যাচার রোধ করবেন। শক্তের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা করবেন এবং দুর্বলের অধিকার আদায় করে দেবেন। যুবক মুহাম্মদ (ﷺ) এই শপথে অংশ গ্রহণ করেন।

৩. ১. ২. ৪. বিবাহ ও নুবুওয়াত-পূর্ব জীবন

২৫ বৎসর বয়সে তিনি খাদীজা বিনতু খুয়াইলিদ নামক মক্কার একজন ধনী ব্যবসায়ী মহিলার ব্যবসায়ের সামগ্রী নিয়ে সিরিয়ায় গমন করেন। খাদীজা তার সততা ও চারিত্রিক পবিত্রতায় খুবই মুগ্ধ হন। তিনি তার সাথে বিবাহের আগ্রহ প্রকাশ করেন। উভয়পক্ষের অভিভাবকদের সম্মতি ও মধ্যস্থতায় বিবাহ সম্পন্ন হয়। এসময়ে খাদিজার বয়স ছিল প্রায় ৪০ বৎসর, এবং মহানবীর বয়স ছিল ২৫ বৎসর।

বিবাহের পরে খাদিজা তার সকল সম্পদ স্বামীর হাতে সমর্পন করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সম্পদ বিভিন্ন জনহিতকর কাজে ব্যয় করতেন। তিনি অনাথদের লালন পালন, অসহায ও দুস্থদের সেবা, মুসাফিরদের আতিথেয়তা, আত্মীয়-স্বজনের দেখাশুনা, বিপদগ্রস্তদের সাহায্য ইত্যাদি কর্মে ব্যস্ত থাকতেন। এ সময়ে তিনি তাঁর সেবা, সততা, অমায়িক ব্যবহার ও চারিত্রিক পবিত্রতার জন্য সমাজে এতই প্রসিদ্ধ হন যে, সমাজের লোকেরা তাঁকে আল আমীন (বিশ্বস্ত) ও আস সাদিক (সত্যবাদী) ইত্যাদী বিশেষণে আখ্যায়িত করত। বিভিন্ন সামাজিক বিরোধিতায় তারা তাঁর সিদ্ধান্ত ও মধ্যস্থতা মেনে নিত।

এ বিষয়ে কাবাঘর নির্মাণকালে হাজার আসওয়াদ বা কাল পাথর পুনস্থাপন বিষয়ক ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য। কাবাঘরের সংস্কার ও পুনর্নিমাণের পরে পবিত্র হাজ্র আসওয়াদকে কাবাগৃহের দেওয়ালে নির্দিষ্ট স্থানে পুনস্থাপন করার বিষয়ে মক্কার প্রতিটি গোত্র নিজেদের অগ্রাধিকার দাবি করে। প্রত্যেকে তার দাবিতে অনড় থাকে এবং অধিকার রক্ষার্থে যুদ্ধের প্রতিজ্ঞা করে। মক্কাবাসীরা এক ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়। একপর্যায়ে নেতৃবৃন্দ একমত হন যে, প্রথম যে ব্যক্তি গিরিপথের মধ্য থেকে তাদের সামনে আগমন করবেন সকলেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন। এ সময়ে মুহাম্মাদ (ﷺ) তথায় উপস্থিত হন। তারা সকলেই আনন্দিত হয়ে বলে উঠেন, আল-আমিন এসেছেন! তখন তিনি নিজের চাদরটি বিছিয়ে নিজ হাতে পাথরটি তুলে চাদরের উপর রাখেন। এরপর বিবাদমান সকল গোত্রকে আহবান করেন চাদরটি চারিদিক থেকে ধরে পাথরটি কাবাগৃহের নিকটে নিয়ে যাওয়ার। এরপর তিনি নিজ হাতে পাথরটি কাবার প্রাচীরে পুনস্থাপন করেন। এভাবে মক্কাবাসী ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা পায়। এ ঘটনায় নবুয়তের পূর্বেই মক্কাবাসীর মধ্যে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর গ্রহণযোগ্যতা, বিশ্বস্ততা ও তাঁর তীক্ষ্ণ বুদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। অধিকাংশ ঐতিহাসিক একমত যে, এ ঘটনাটি ঘটেছিল নুবুওয়াতের ৫ বৎসর পূবে, যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বয়স ছিল ৩৫ বৎসর। কোনো কোনো ঐতিহাসিক উল্লেখ করেছেন যে, এ ঘটনার সময় তাঁর বয়স ছিল ২৫ বৎসর। কেউ কেউ বলেছেন যে, তাঁর কিশোর বয়সে এ ঘটনাটি ঘটেছিল।[8]

৩. ১. ২. ৫. নুবুওয়াত ও মাক্কী জীবন

  ৪০ বৎসর বয়সে তিনি ক্রমান্বয়ে আল্লাহর ইবাদত ও ধ্যানে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি মক্কার বাইরে হেরা পাহাড়ের গুহায় বসে রাতদিন আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন। এ বছরেই, অর্থাৎ ৬১০ খৃষ্টাব্দে রমযান মাসে সোমবার (ইংরেজী আগস্ট মাসে), ৪০ বৎসর বয়সে তিনি নবুয়ত প্রাপ্ত হন। আল্লাহর পক্ষ থেকে ফিরিশতাগনের নেতা জিবরীল আল- আমীন (আঃ) ওহী নিয়ে হেরা পাহাড়ের গুহায় আসেন এবং তাকে কুরআন কারীমের সূরা ইকরার প্রথম কয়েক আয়াত শিক্ষা দান করেন।

এর পরে তিনি আল্লাহর নির্দেশে গোপনে মানুষদেরকে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করার জন্য এবং আল্লাহ ছাড়া সকল উপাস্যকে পরিত্যাগ করার জন্য আহবান জানাতে থাকেন। এভাবে তিন বৎসর তিনি গোপনে ইসলাম প্রচার করেন। এ সময়ে মক্কার কিছু সৎ ও নীতিবান যুবক ইসলাম গ্রহণ করেন।

এর পর আল্লাহ তাকে প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচারের নির্দেশ দেন। তার নবুয়ত প্রাপ্তির ৪র্থ বৎসর থেকে তিনি প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। পরবর্তী প্রায় দশ বৎসর তিনি মক্কায় ইসলাম প্রচারে রত থাকেন।

এসময়ে মূলত তিনি মুলত তাওহীদুল ইবাদাত বা ইবাদতের তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করেন। পাশাপাশি সততা, নৈতিকতা, মানবতা, মানবসেবা ইত্যাদি মৌলিক বিষয় পালনের এবং শির্ক, হত্যা, হানাহানি অত্যাচার ইত্যাদি অমানবিক কর্ম বর্জনের জন্য আহবান করতেন। ইসলামের অন্যান্য বিধান যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত, রমযানের সিয়াম, হজ্জ, যাকাত ইত্যাদি তখনো প্রবর্তিত হয়নি। এগুলি কিছু মক্কী জীবনের একেবারে শেষে এবং বাকি সকল বিধান মদীনায় হিজরতের পরে অবতীর্ণ হয়।

কুরাইশ নেতৃবৃন্দ কঠোরভাবে তাঁর এ আহবান প্রত্যাখ্যান করে। আমরা দেখেছি যে, তারা আল্লাহকে একমাত্র স্রষ্টা, সর্বশক্তিমান ও প্রতিপালক হিসাবে বিশ্বাস করতেন এবং আল্লাহর ইবাদত করত। পাশাপাশি তারা আল্লাহর প্রিয় ও আল্লাহর সাথে বিশেষ সম্পর্কযুক্ত বান্দা হিসেবে ফিরিশতা, কোনো কোনো নবী, কোনো কোনো কল্পিত ব্যক্তিত্ব ও অন্যান্য দেবদেবীর ইবাদত করত। তারা এদের ইবাদত করাকে পিতাপিতামহদের মাধ্যমে প্রাপ্ত ইবরাহীম-ইসামাঈল (আঃ)-এর সঠিক ধর্ম বলে বিশ্বাস করত। এজন্য এদের ইবাদত পরিত্যাগ করে একমাত্র আল্লাহর ইবাদত করতে অস্বীকার করে। আল্লাহ ছাড়া কেউই ইবাদতের যোগ্য নন এ কথাকে তারা উদ্ভট ও অবন্তর কথা এবং যুগযুগ ধরে প্রচলিত পিতা পিতামহের আচরিত ধর্মের অবমাননা বলে মনে করে। তারা বিভিন্ন ভাবে মহানবী মুহাম্মদ (ﷺ)-কে অপমান ও অত্যাচার করতে থাকেন। তাঁর দাওয়াতের যৌক্তিকতা খন্ডন করার কোনো ক্ষমতা তাদের ছিল না। তারা বুঝতে পারে যে, তাঁর বক্তব্য শুনলে যে কোনো বিবেকবান মানুষ তার বক্তব্য গ্রহণ করবেই। এজন্য তারা মানুষদেরকে তার থেকে দূরের রাখার জন্য চেষ্টা করে। তাকে ধর্মত্যাগী, ধর্মের অবমাননাকারী, যাদুকর, কবি ইত্যাদি বলে মানুষদের মনে তাঁর প্রতি ঘৃণা সৃষ্টির জন্য তারা সর্বতোভাবে চেষ্টা করে।

তাদের শত অপপ্রচার ও বাধা সত্ত্বেও ক্রমে  ইসলামের বাণী মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। তখন কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ডাকে সাড়া দানকারী নও মুসলিমদের উপর অকথ্য অত্যচার নির্যাতন শুরু করে। কোনো অত্যাচার নির্যাতন বা অপমান-লাঞ্ছনাই মহানবীকে সত্যের আহবান থেকে সরাতে পারে না। তিনি তার সকল অত্যচারের মধ্যেও একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের দিকে মানুষদেরকে আহবান করতে থাকেন এবং মুসলিমদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কাফিরদের সীমাহীন অত্যাচারের কারণে শতাধিক মুসলিম নারী ও পুরুষ আফ্রিকার ইথিওপিয়ায় হিজরত করেন। অবশিষ্ট অধিকাংশ মুসলিম তাওহীদ আকড়ে ধরে মক্কাবাসীদের অত্যাচার নীরবে সহ্য করতে থাকেন।

এত অত্যাচারের মাধ্যমেও ইসলামের অগ্রযাত্রা রোধ করতে অক্ষম হয়ে মক্কার সকল গোত্র একত্রিত হয়ে সকল মুসলিম এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর বংশের মানুষদের সামাজিকভাবে বয়কট ও অবরুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। নুবুয়তের ৭ম থেকে ১০ম সন পর্যন্ত দীর্ঘ তিন বৎসর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর বংশের মানুষদের এবং মুসলিমদের নিয়ে পাহাড়ের উপত্যাকায় অবরুদ্ধ হয়ে অবর্ণনীয় কষ্টে অবস্থান করেন। এ সময়েও তিনি সাধ্যমত দীনের দাওয়াত অব্যাহত রাখেন।

নবুয়তের ১০ম বৎসরে অবরোধ থেকে মুক্তির কিছু দিন পরে, তাঁর চাচা আবু তালিব ও তার প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা কিছু দিনের ব্যবধানে ইন্তেকাল করেন। তাঁর জন্য এ ছিল খুবই বেদনাময় বৎসর। স্ত্রীর মৃত্যুতে তিনি তাঁর ব্যাথ্যা-বেদনার প্রিয়তম সাথীকে হারান। অপর দিকে চাচার মৃত্যুতে তিনি সামাজিকভাবে অসহায় হয়ে পড়েন। কারণ আবু তালিব ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে বিশেষ সম্মানিত নেতা। তিনি নিজে ইসলাম গ্রহণ না করলেও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন এবং কুরাইশদের অত্যাচার থেকে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। তার কারণে অনেক সময় কুরাইশ নেতারা মহানবীকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করতে সাহস পেত না। আবু তালিবের মৃত্যুর পরে কুরাইশদের অত্যাচার শতগুণে বৃদ্ধি পায়। তারা তাকে কোনোভাবেই কথা বলতে দিত না। তেমনিভাবে তার ডাকে সাড়া দিয়ে যারা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তাদের প্রতিও অত্যাচর শতগুণে বৃদ্ধি পায়।

এমতবস্থায় তিনি মক্কার বাইরে ইসলাম প্রচারের কথা চিন্তা করেন। তিনি এ বছরের শেষ দিকে (শাওয়াল মাসে, ৬১৯ খৃষ্টাব্দে মে/জুন মাসে) মক্কার প্রায় ১০০ কিলোমিটার পূর্বে তায়েফ শহরে গমণ করেন। তিনি তাঁর প্রিয় খাদিম যায়িদ বিন হারিসাকে সঙ্গে নিয়ে পায়ে হেঁটে তায়েফে গমণ করেণ। পথিমধ্যে যে সকল বেদুইন গোত্রকে তিনি দেখতে পান, তাদেরকে তিনি তাওহীদের আহবান জানান। তারা কেউই তার আহবানে কর্ণপাত করে না। তিনি তায়েফে প্রায় দশদিন যাবৎ তাওহীদের আহবান জানান। তিনি তায়েফের সকল গোত্রপ্রধান ও সাধারণ মানুষের কাছে ইসলামের আহবান জানান। তারা কেউই তার ডাকে সাড়া দেয় না। বরং তারা তায়েফের দুষ্টু ছেলেদেরকে তার পিছনে লেলিয়ে দেয়। ছেলেরা তায়েফের পথে পথে গালাগালি করে তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। উপরন্তু তারা তাঁকে পাথর ছুড়ে মারতে থাকে। তিনি রক্তাক্ত দেহে তায়েফ থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ভগ্নহৃদয়ে মক্কায় ফিরে আসেন। সকল কষ্ট ও ব্যথা মেনে নিয়ে তিনি ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতে থাকেন, যদিও মক্কায় তাঁর অবস্থান বা ইসলাম প্রচার প্রায় অসম্ভব ছিল।

ইব্রাহিম (আঃ)-এর সময় থেকে মক্কায় কাবাঘরের হজ্জ প্রচলিত হয়। তখন থেকে আরবের বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষেরা যুলহাজ্জ মাসে মক্কায় এসে হজ্জ আদায় করত। যদিও পরবর্তীকালে তাদের মধ্যে শিরক, মূর্তিপূজা ও বিভিন্ন সামাজিক অন্যায় অনাচার ছড়িয়ে পড়ে, তবুও হজ্জ ও হাজীদের সম্মান ছিল তাদের বিশ্বাসের অংশ। তারা হজ্জের সময়ে সকল প্রকার মারামারি, দৈহিক অত্যাচারকে নিষিদ্ধ মনে করত। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হজ্জের এই সুযোগে গোপনে মক্কায় আগত বিভিন্ন এলাকার হাজীদের মধ্যে ইসলাম প্রচারের চেষ্টা করতে থাকেন। নবুয়তের ১১শ বৎসরের হজ্জ মাওসুমে (৬২০ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে) মক্কার প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার উত্তরের ইয়াসরীব (মদীনা) শহরে থেকে আগত ৬ জন যুবক হাজী রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ডাকে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। তাঁরা হজ্জের পরে দেশে ফিরে গিয়ে সেখানে ইসলাম প্রচার করতে থাকেন।

পরবর্তী বৎসরে, নবুয়তের ১২শ বৎসরের হজ্জ মওসুমে (৬২১ খৃষ্টাব্দের জুলাই মাসে) মদীনার আরো কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের সাথে তার প্রিয় সাহাবী মুস‘আাব বিন উমাইরকে মদীনায় প্রচারক হিসেবে প্রেরণ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় মদীনার অধিকাংশ মানুষ ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তী হজ্জ মওসুমে (নবুয়তের ১৩শ বৎসরে, ৬২২ খৃষ্টাব্দে জুন মাসে) মদীনা থেকে হাজীদের যে কাফেলা আসে তার মধ্যে ৭০ জনেরও বেশি ছিলেন মুসলিম। তাঁরা গোপনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মিলিত হয়ে তাঁকে মক্কা ত্যাগ করে মদীনায় গিয়ে অবস্থান করার আহবান জানান। তাঁরা তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা ও প্রাণের বিনিময়ে হলেও তাঁকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেন।

৩. ১. ২. ৬. মদীনায় হিজরত ও মাদানী জীবন

এ ঘটনার পর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মক্কার নির্যাতিত মুসলিমদেরকে মদীনায় গমন করার (হিজরত করার) অনুমতি দেন। মক্কার কুরাইশ নেতাগণ মদীনায় ইসলামের সাফল্যে বিচলিত হন। তারা যে কোনো মূল্যে ইসলামের অগ্রগতি রোধ করার জন্য এক আলোচনায় মিলিত হন। আলেচনায় তারা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন।

এসময়ে মহান আল্লাহ তার রাসূল (ﷺ)-কে মদীনায় হিজরতের নির্দেশ দেন। কুরাইশদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে তিনি মক্কা থেকে বেরিয়ে পড়েন। কাফিররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে তাকে খুজে বের করে হত্যা করার জন্য, কিন্তু তার ব্যর্থ হয়। তিনি তাঁর সঙ্গী আবু বকরের সাথে তিন দিন সাওর পাহাড়ের চূড়ার গুহার মধ্যে লুকিয়ে থাকার পর মদীনায় রওয়ানা দেন। নুবুওয়তের ১৪শ বৎসরের সফর মাসের ২৭ তারিখে (১৩ই সেপ্টেম্বর ৬২২ খৃষ্টাব্দে) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও আবু বকর মক্কা ত্যাগ করেন। প্রায় দশ দিন পথ চলার পরে রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখে (২৩শে সেপ্টেম্বর, ৬২২ খৃষ্টাব্দে) তিনি মদীনায় পৌঁছান।

তিনি মদীনার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমদের সিদ্ধান্তে মদীনার প্রশাসনিক নেতৃত্ব বা মদীনা রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মদীনার সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম জনগণ এবং অমুসলিম ও ইহূদীদের সাথে নাগরিক চুক্তির মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের শান্তি, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করেন। তিনি মদীনায় তিনি অত্যন্ত শান্তির সাথে মুসলমানদের ইসলাম শিক্ষা দিয়ে থকেন। এ সময় থেকে মহান আল্লাহ ইসলামের বিভিন্ন বিধিবিধান নাযিল করেন।

মক্কার কাফিররা তাঁর সাফল্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। তারা বিভিন্ন ভাবে মদীনার মুসলমানদের ধ্বংসের চেষ্টা করতে থাকে এবং মুসলিমদের উপর বিভিন্নভাবে আক্রমন করতে থাকে। ফলে আল্লাহ মুুসলমানদেরকে জিহাদের বা যুদ্ধ করার অনুমতি দান করেন। কাফিরদের তুলনায় সংখ্যায়, অস্ত্রে ও ক্ষমতায় নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও মহানবী তার প্রিয় সাহাবীদেরকে নিয়ে কাফিরদের মুকাবিলা করেন। পরবর্তী ৮ বৎসরে উভয় পক্ষের মধ্যে কয়েকটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কাফিররা পরাজিত হতে থাকে। সর্বশেষে ৮ম হিজরী সালে (৬৩০ খৃ) রামাদান মাসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মুসলিম বাহিনী নিয়ে বিনা রক্তপাতে মক্কা বিজয় করেন। মক্কার কাফিরদেরকে তিনি ক্ষমা করে দেন। এরপর আরব উপদ্বীপের মানুষেরা দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করতে থাকে। তিনি আরদেশের বাইরে পারস্য, রোম, মিসর, আবিসিনিয়া ইত্যাদি দেশের শাসকদেরকে ইসলাম গ্রহণের আহবান জানিয়ে চিঠি লেখেন।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মদীনায় হিজরতের ১০ বৎসরের মধ্যে সমস্ত আরব উপদ্বীপ ইসলামের ছায়াতলে স্থানলাভ করে। আরবের বাইরেও ইসলামের আলো ছড়িয়ে পড়ে। এই বৎসরে (৬৩২ খৃ) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) লক্ষাধিক সঙ্গীকে নিয়ে হজ্জ আদায় করেন, যা বিদায় হজ্জ নামে পরিচিত।

৩. ১. ২. ৭. সর্বশেষ ওসীয়ত ও ওফাত

হজ্জ থেকে ফেরার পরে ১১শ হিজরীর (৬৩২ খৃ) প্রথম দিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি জ্বর ও মাথা ব্যথায় আক্রান্ত হন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। বস্ত্তত, সাহাবায়ে কেরাম ও তাবিয়ীগণ তারিখের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করতেন না। এজন্য তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জীবনের অত্যন্ত ছোটখাট ঘটনাও গুরুত্বের সাথে বর্ণনা ও সংরক্ষণ করেছেন, কিন্তু এ সকল ঘটনার তারিখ কোনো হাদীসে উল্লেখ করেননি। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, অসুস্থতা- কালীন অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তিকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোনো ভাবে কোনো দিন, তারিখ বা সময় বলা হয় নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তিকাল করেন সে বিষয়ে কোনো হাদীসেই কিছু উল্লেখ করা হয় নি।

২য় হিজরী শতক থেকে তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী আলিমগণ রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর জীবনের ঘটনাবলি ঐতিহাসিকভাবে দিন তারিখ সহকারে সাজাতে চেষ্টা করেন। তখন থেকে মুসলিম আলিমগণ এ বিষয়ে বিভিন্ন মত পেশ করেছেন।

তাঁর অসুস্থতার শুরু সম্পর্কে অনেক মত রয়েছে। কেউ বলেছেন সফর মাসের শেষ দিকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। কেউ বলেছেন রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু। দ্বিতীয় হিজরী শতকের প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ইবনু ইসহাক (১৫১ হি/৭৬৮ খৃ) বলেন: ‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে অসুস্থতায় ইন্তিকাল করেন, সেই অসুস্থতার শুরু হয়েছিল সফর মাসের শেষে কয়েক রাত থাকতে, অথবা রবিউল আউয়াল মাসের শুরু থেকে।’’[9]

কি বার থেকে তাঁর অসুস্থতার শুরু হয়েছিল, সে বিষয়েও মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন শনিবার, কেউ বলেছেন বুধবার এবং কেউ বলেছেন সোমবার তার অসুস্থতার শুরু হয়।[10]

কয়দিনের অসুস্থতার পরে তিনি ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ১০ দিন, কেউ বলেছেন, ১২ দিন, কেউ বলেছেন ১৩ দিন, কেউ বলেছেন, ১৪ দিন অসুস্থ থাকার পরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকাল করেন।[11]

তাঁর ওফাতের তারিখ সম্পর্কেও অনুরূপ মতভেদ রয়েছে। বিভিন্ন সহীহ হাদীস থেকে জানা যায় যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সোমবার ইন্তিকাল করেন।[12] কিন্তু এই সোমবারটি কোন্ মাসের কোন্ তারিখ ছিল তা কোনো হাদীসে বলা হয় নি। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রামাদান মাসের ১১ তারিখে ইন্তিকাল করেন।[13] এই একক বর্ণনাটি ছাড়া মুসলিম উম্মাহর সকল ঐতিহাসিক ও মুহাদ্দিস একমত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রবিউল আউয়াল মাসে ইন্তিকাল করেন। কিন্তু কোন্ তারিখে তিনি ইন্তিকাল করেছেন তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। ইন্তিকালের তারিখ সম্পর্কে দ্বিতীয় হিজরীর তাবেয়ী ঐতিহাসিকগণ এবং পরবর্তী ঐতিহাসিকগণের ৪টি মত রয়েছে: ১লা রবিউল আউয়াল, ২রা রবিউল আউয়াল, ১২ই রবিউল আউয়াল ও ১৩ই রাবিউল আউয়াল।[14]

আমরা ১২ই রবিউল আউয়ালকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ওফাত দিবস ধরে নিয়ে তাঁর ওফাতের পূর্ববর্তী ঘটনাবলি সহীহ হাদীসের আলোকে উল্লেখ করছি। হাদীস শরীফে সাহাবীগণ তারিখ উল্লেখ না করলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা বার ও প্রাসঙ্গিক পূর্বাপর ঘটনাদি উল্লেখ করেছেন। আমরা এ সকল বর্ণনার ভিত্তিতেই ঘটনাবলি উল্লেখ করব।

অসুস্থতা বৃদ্ধি পেলে তিনি মসজিদ-সংলগ্ন আয়েশা (রা)-র ঘরে অবস্থান করতে থাকেন। ওফাতের ৫ দিন আগে (রবিউল আউয়াল মাসের ৮ তারিখ) বৃহস্পতিবার[15] তিনি গোসল করেন এবং কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। তখন তিনি মসজিদে গিয়ে মিম্বরে বসেন এবং সাহাবীদেরকে অন্তিম উপদেশ নসীহত দান করেন। এছাড়াও তিনি অসুস্থ অবস্থায় বারংবার বিভিন্ন বিষয়ে ওসীয়ত করেন। এ সকল ওসীয়তে তিনি তাওহীদ, সালাত ও বান্দার হক্ক সম্পর্কে সতর্ক করেন। আয়েশা (রা), আবূ হুরাইরা (রা) জুনদুব (রা), আবূ উবাইদাহ ইবনুল জার্রাহ (রা) প্রমুখ সাহাবী বিভিন্ন হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ইন্তেকালের ৫ দিন পূর্বে এবং সর্বশেষ ওসীয়তের বর্ণনায় বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:

أَلا وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوا يَتَّخِذُونَ قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيهِمْ مَسَاجِدَ أَلا فَلا تَتَّخِذُوا الْقُبُورَ مَسَاجِدَ إِنِّي أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ. ... لَعَنَ اللَّهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا. ... يُحَذِّرُ مَا صَنَعُوا ... وَاعْلَمُوا أَنَّ شِرَارَ النَّاسِ الَّذِينَ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ. ... لا تَتَّخِذُوا قَبْرِي عِيدًا وَلا تَجْعَلُوا بُيُوتَكُمْ قُبُورًا وَحَيْثُمَا كُنْتُمْ فَصَلُّوا عَلَيَّ فَإِنَّ صَلاتَكُمْ تَبْلُغُنِي... اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ اشْتَدَّ غَضَبُ اللَّهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ

‘‘তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন! তোমাদের পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মানুষেরা তাদের নবীগণ ও ওলীগণের কবরকে মসজিদ (ইবাদতগাহ) বানিয়ে নিত। তোমরা সাবধান! তোমরা কখনো কবরকে মসজিদ বানিয়ে নেবে না, নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে নিষেধ করছি এই কাজ থেকে।’’ ...

‘‘আল্লাহ লানত-অভিশাপ প্রদান করেন ইহুদী ও খৃস্টানদের উপর, তারা তাদের নবীগণের কবরকে মসজিদ বানিয়ে নিয়েছিল।’’ একথা বলে তিনি তাঁর উম্মতকে অনুরূপ কর্ম থেকে সাবধান করছিলেন। .... ‘‘তোমরা জেনে রাখ, নিশ্চয় সবচেয়ে খারাপ মানুষ তারাই যারা তাদের নবীদের কবর মসজিদ বানিয়ে নেয়।’’ ... ‘‘তোমরা আমার কবরকে ইদ (ইদগাহ বা নিয়মিত সমাবেশের স্থান) বানিও না, আর তোমাদের আবাসস্থলকে কবর বানিয়ে নিওনা। তোমরা যেখানেই থাক না কেন আমার উপর সালাত (দরুদ) পাঠ করবে, কারণ তোমাদের সালাত আমার কাছে পৌঁছে যাবে।’’ ‘‘হে আল্লাহ, আমার কবরকে পূজিত দ্রব্য বা পূজ্য-স্থানের মত বানিয়ে দিবেন না যার ইবাদত করা হবে, আল্লাহর ক্রোধ কঠিনতর হোক সে সকল মানুষের উপর যারা তাদের নবীগণের কবরগুলিকে মসজিদ বানায়।’’[16]

এতদিন পর্যন্ত অসুস্থতা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত জামাতে সালাতের ইমামতি করছিলেন। বৃহস্পতিবার (৮ই রবি. আউয়াল) মাগরিবের সালাতেও তিনি ইমামতি করেন। এরপর তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়। তিনি মসজিদে যেতে সক্ষম হন না। তখন তিনি আবু বকর (রা)-কে ইমামতি করার নির্দেশ দেন।

তাঁর অসুস্থতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি এ সময়ে বারবার বলছিলেন:

الصَّلاةَ (الصَّلاةَ) وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ

‘‘সালাত! সালাতের বিষয়ে সাবধান! (কোনোরূপ অবহেলা করবে না) এবং তোমাদের দাস-দাসীদের (অধীনস্থগণের) বিষয়ে সাবধান!’’[17]

সোমবার দিন (১২ই রবিউল আউয়াল, ৬৩২ খৃস্টাব্দের জুন মাসের ৫/৬ তারিখ) দিবসের প্রথম দিকে- দিপ্রহরের পূর্বে- তিনি তাঁর স্ত্রী আয়েশার (রা) কোলে মাথা রেখে শুয়ে ছিলেন। এ সময়ে তিনি মেসওয়াক করেন এবং মৃদুস্বরে কিছু বলতে থাকেন। আয়েশা তার মুখের কাছে কান নিয়ে শুনতে পান তিনি বলছেন: ‘‘তাদের সাথে, যাদেরকে আপনি নেয়ামত দান করেছেন, নবী-রাসূলগণ, সিদ্দিকগণ, শহীদগণ, সৎকর্মশীলগণ। হে আল্লাহ, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন, আমাকে রহমত করুন, সর্বোচ্চ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিলিত করে দিন। হে আল্লাহ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিলিত করে দিন। হে আল্লাহ সুমহান সঙ্গীদের সাথে আমাকে মিরিত করে দিন।’’ এরপর তিনি ইন্তেকাল করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৩ বৎসর।

তার মৃত্যুর সংবাদে শোকে বিহবল হয়ে পড়েন সাহাবীরা। প্রচন্ড শোকে স্বাভাবিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন কেউ কেউ। তাঁর ওফাত হতে পারে- এ কথা মানতে কেউ কেউ অস্বীকার করেন। এ বিষয়ে আয়েশা (রা) বলেন:

إنَّ رَسُولَ اللَّهِ (ﷺ) مَاتَ وَأَبُو بَكْرٍ بِالسُّنْحِ فَقَامَ عُمَرُ يَقُولُ: وَاللَّهِ مَا مَاتَ رَسُولُ اللَّهِ (ﷺ)، قَالَتْ: وَقَالَ عُمَرُ: وَاللَّهِ مَا كَانَ يَقَعُ فِي نَفْسِي إِلا ذَاكَ وَلَيَبْعَثَنَّهُ اللَّهُ فَلَيَقْطَعَنَّ أَيْدِيَ رِجَالٍ وَأَرْجُلَهُمْ فَجَاءَ أَبُو بَكْرٍ فَكَشَفَ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ (ﷺ) فَقَبَّلَهُ قَالَ بِأَبِي أَنْتَ وَأُمِّي طِبْتَ حَيًّا وَمَيِّتًا وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لا يُذِيقُكَ اللَّهُ الْمَوْتَتَيْنِ أَبَدًا ثُمَّ خَرَجَ فَقَالَ أَيُّهَا الْحَالِفُ عَلَى رِسْلِكَ فَلَمَّا تَكَلَّمَ أَبُو بَكْرٍ جَلَسَ عُمَرُ فَحَمِدَ اللَّهَ أَبُو بَكْرٍ وَأَثْنَى عَلَيْهِ وَقَالَ أَلا مَنْ كَانَ يَعْبُدُ مُحَمَّدًا (ﷺ) فَإِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ مَاتَ وَمَنْ كَانَ يَعْبُدُ اللَّهَ فَإِنَّ اللَّهَ حَيٌّ لا يَمُوتُ وَقَالَ: (إِنَّكَ مَيِّتٌ وَإِنَّهُمْ مَيِّتُونَ)، وَقَالَ: (وَمَا مُحَمَّدٌ إِلا رَسُولٌ قَدْ خَلَتْ مِنْ قَبْلِهِ الرُّسُلُ أَفَإِنْ مَاتَ أَوْ قُتِلَ انْقَلَبْتُمْ عَلَى أَعْقَابِكُمْ وَمَنْ يَنْقَلِبْ عَلَى عَقِبَيْهِ فَلَنْ يَضُرَّ اللَّهَ شَيْئًا وَسَيَجْزِي اللَّهُ الشَّاكِرِينَ). قَالَ فَنَشَجَ النَّاسُ يَبْكُونَ

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যখন মৃত্যুবরণ করেন তখন আবূ বাক্র (রা) (মদীনার প্রান্তরে) সুন্হ নামক স্থানে ছিলেন। তখন উমার (রা) দাঁড়িয়ে বলেন: আল্লাহর কসম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেননি।, আয়েশা (রা) বলেন, উমার (রা) বলেন, আল্লাহর কসম, আমার মনে এ ছাড়া অন্য কিছুই আসে নি। নিশ্চিয় আল্লাহ তাকে উঠাবেন এবং তিনি (যারা তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করছে) সে সকল মানুষের হস্তপদ কর্তন করবেন। তখন আবূ বাক্র (রা) আগমন করেন। তিনি (আয়েশার ঘরের মধ্যে রক্ষিত) রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মুবারক দেহের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে তাঁকে চুমু খান এবং বলেন: আমার পিতামাতা আপনার জন্য কুরবানি হোন, আপনি জীবিত ও মৃত উভয় অবস্থায় পবিত্র ও মহান। যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম, আল্লাহ আপনাকে কখনোই দু বার মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করাবেন না। এরপর তিনি বাইরে বেরিয়ে এসে (উমারকে সম্বোধন করে) বলেন, হে কসমকারী, একটু শান্ত হও! যখন আবূ বাক্র (রা) কথা বলতে শুরু করলেন, তখন উমার (রা) বসে পড়লেন। তখন আবূ বাক্র আল্লাহর প্রশংসা এবং গুণবর্ণনা করলেন এবং বললেন, শুনে রাখ! যারা মুহাম্মাদের (ﷺ) ইবাদত করত (তারা জানুক যে,) মুহাম্মাদ (ﷺ) মৃত্যুবরণ করেছেন। আর যারা আল্লাহর ইবাদত করত (তারা জানুক যে,) আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি মৃত্যুবরণ করেন না। এবং তিনি (কুরআনের আয়াত উদ্ধৃত করে) বলেন[18]:  ‘‘তুমি তো মরণশীল এবং তারাও মরণশীল’’, এবং বলেন[19]: ‘‘মুহাম্মাদ একজন রাসূল মাত্র; তার পূর্বে বহু রাসূল গত হয়েছে। সুতরাং যদি সে মারা যায় অথবা নিহত হয় তবে কি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করবে? এবং কেউ পৃষ্ঠ প্রদর্শন করলে সে কখনো আল্লাহর ক্ষতি করবে না, বরং আল্লাহ শীঘ্রই কৃতজ্ঞদিগকে পুরস্কৃত করবেন।’’ তখন মানুষেরা আবেগাপ্লুত হয়ে কেঁদে উঠেন।’’[20]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নির্দেশনা অনুসারে আয়েশা (রা)-এর ঘরের মধ্যে যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ইন্তেকাল করেন সেখানেই তাঁকে দাফন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। পরদিন মঙ্গলবার (১৩ই রবিউল আউয়াল) উক্ত ঘরের মধ্যে তাঁকে গোসল করান হয় এবং কাফন পরান হয়। এরপর সাহাবীগণ তাঁর জানাযার নামায আদায় করেন। একক বৃহৎ জামাতে জানাযা হয় নি। সাহাবীগণ ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে উক্ত গৃহের মধ্যে প্রবেশ করে জানাযার সালাত আদায় করে বেরিয়ে যান। এভাবে মঙ্গলবার সারাদিন কেটে যায়। মঙ্গলবার দিনগত রাতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে দাফন করা হয়।আয়েশার (রা) এই বাড়িটির আয়তন ছিল কমবেশি ১৬ হাত X ৮ হাত। অর্থাৎ ,তাঁর পুরো বাড়িটি ছিল ৩০০ বর্গফুটেরও কম জায়গা। উচ্চতা ছিল প্রায় ৪/৫ হাত। বাড়িটি দুই অংশে বিভক্ত ছিল। মসজিদ সংলগ্ন ৬/৭ হাত প্রশস্ত অংশটুকু বসার স্থান হিসাবে ব্যবহৃত হতো। পিছনের অংশটুকু (১০ হাত X  ৮ হাত) শয়ন ও অবস্থানের ঘর বা বেডরুম। এই ঘরের মধ্যে (১০ হাত লম্বা ও ৮ হাত চওড়া) রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে দাফন করা হয়। দাফনের পরেও আয়েশা (রা.) সেখানে বসবাস করতেন। আর কোনো বসতবাড়ি তাঁর ছিল-না। পরবর্তী কালে আবূ বাকর (রা) ও উমার (রা)-কেও এই ঘরের মধ্যেই দাফন করা হয়। এই ঘরের মধ্যে কবরগুলির পাশেই আয়েশা (রা.) প্রায় ৫০ বৎসর জীবনযাপনের পর ৫৮ হিজরীতে মুয়াবিয়ার (রা.) শাসনামলে ইন্তেকাল করেন।[21]

[1] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৫০, নং ৩৬১৯। তিরমিযী বলেছেন: হাদীসটি হাসান গরীব।
[2] আকরাম যিয়া আর-উমারী, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ আস-সহীহা ১/৯৬-৯৮, মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, ১০৯-১১০ পৃ।
[3] মুসলিম, আস-সহীহ ২/৮১৯; আহমাদ, আল-মুসনাদ ৪/১৭২-১৭৩, নং ২৫০৬।
[4] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/৮০-৮১।
[5] ইবনু হিশাম, আস-সীরাতুন নাবাবীয়্যাহ ১/১৮৩।
[6] মাহদী রেজকুল্লাহ আহমদ, আস-সীরাতুন নাবাবীয়াহ, ১০৯ পৃ।
[7] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ১/১০০-১০১, ইবনু কাসীর, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া ২/২১৫, আল-কাসতালানী, আহমদ বিন মুহাম্মাদ, আল-মাওয়াহিবুল লাদুন্নিয়্যা ১/৭৪-৭৫, আল-যারকানী, শরহুল মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়্যা ১/২৪৫-২৪৮, ইবনু রাজাব, লাতায়েফুল মায়ারেফ ১/১৫০।
[8] ড. মাহদী রিযকুল্লাহ, আস-সীরাতুন্নাবাবীয়্যাহ ফী দাওইল মাসাদিরিল আসলিয়্যাহ, পৃ. ১৩৮-১৩৯।
[9] ইবনু হিশাম, আস-সীরাহ আন-নববিয়্যাহ ৪/২৮৯।
[10] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[11] কাসতালানী, আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্নিয়া ৩/৩৭৩; যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ১২/৮৩।
[12] বুখারী, আস-সহীহ ১/২৬২, ৪/১৬১৬; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩১৫; আবূ নুআইম ইসপাহানী, আল-মুসনাদ আল-মুসতাখরাজ আলা সাহীহ মুসলিম ২/৪৩-৪৪।
[13] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯।
[14] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১২৯।
[15] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৮/১৪২।
[16] বিস্তারিত বর্ণনাগুলির জন্য দেখুন: বুখারী, আস-সহীহ ১/১৬৫, ১৬৮, ৪৪৬, ৪৬৮, ৩/১২৭৩, ৪/১৬১৪, ৪/১৬১৫, ৫/২১৯০; মুসলিম, আস-সহীহ ১/৩৭৫-৩৭৮; মালিক, আল-মুআত্তা ১/১৭২; আহমদ, আল-মুসনাদ ১/১৯৫, ২/২৪৬, ৩৭৬; ইবনু হাজার আসকালানী, ফাতহুল বারী ১/৫২৩-৫২৪, ৫৩১, ৩/২০০, ২০৮, ২৫৫।
[17] ইবনু মাযাহ, আস-সুনান ১/৫১৮; আলবানী, সহীহ সুনান ইবনি মাজাহ ১/২৭১।
[18] সূরা (৩৯) যুমার: ৩০ আয়াত।
[19] সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৪৪ আয়াত।
[20] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১৩৪১; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/২৯-৩০। আরো দেখুন, বুখারী, আস-সহীহ ১/৪১৮, ৪/১৬১৮; ফাতহুল বারী ৩/১১৩; ৭/১৪, ৮/১৪৫।
[21] বিস্তারিত দেখুন, খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, এহইয়াউস সুনান, পৃ. ৩৭৪-৩৭৮।
দেখানো হচ্ছেঃ ৪১ থেকে ৫০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৪২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 5 6 · · · 22 23 24 25 পরের পাতা »