কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৪২ টি
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামী আকীদা ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.) ২৪২ টি
৫. ৫. ১. ৩. ১. কুরআন ও হাদীসের ভাষায় ওসীলা

‘ওসীলা’ শব্দটির অর্থের মধ্যে এরূপ বিবর্তন ঘটার কারণে এ বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে। ফলে সুন্নাত ও ইসলাম সম্মত ব্যবহার থেকে ওসীলা শব্দটি কখনো কখনো শিরকের পর্যায়ে চলে যায়। এজন্য এ বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা প্রয়োজন।

কুরআন ও হাদীসে ব্যবহৃত প্রাচীন আরবী ভাষায় ওসীলা শব্দের অর্থ নৈকট্য। পরবর্তীকালে আরবী ভাষাতেই ওসীলা শব্দটির অর্থ হয় ‘যদ্বারা নৈকট্য চাওয়া হয়’ বা ‘নৈকট্যের উপকরণ’। আধুনিক যুগে আরবীতে এবং বিশেষ করে বাংলায় ওসীলা শব্দটি ‘উপকরণ’, মধ্যস্থতা, যন্ত্র, হাতিয়ার, দূত ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থের পরিবর্তনের কারণে শব্দটির বিষয়ে অনেক বিভ্রান্তি জন্ম নিয়েছে।

প্রসিদ্ধ ভাষাবিদ ইবনু ফারিস (৩৯৫ হি) বলেন: ‘‘ওয়াও, সীন ও লাম: দুটি পরস্পর বিরোধী অর্থ প্রকাশ করে: প্রথম অর্থ: আগ্রহ ও তালাশ। ... দ্বিতীয় অর্থ চুরি করা।’’[1]

প্রসিদ্ধ মুফাস্সির ও ভাষাবিদ রাগিব ইসপাহানী (৫০৭) বলেন: ‘‘ওসীলা: অর্থ আগ্রহের সাথে কোনো কিছুর নিকটবর্তী হওয়া। আল্লাহ তা‘আলা বলেন: মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘তোমরা তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর’। আল্লাহর দিকে ওসীলার হাকীকাত হলো ইলম ও ইবাদতের মাধ্যমে এবং শরীয়তের মর্যাদাময় বিধিবিধান পালনের মাধ্যমে সর্বাত্মক চেষ্টার মাধ্যমে আল্লাহর রাস্তায় প্রতিষ্ঠিত থাকা। এ হলো নেক আমল বা নৈকট্য।’’[2]

আমরা ইতোপূর্বে তৃতীয় অধ্যায়ে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মর্যাদা বিষয়ক আলোচনায় দেখেছি যে, মহান আল্লাহ তাঁকে ‘ওসীলা’ প্রদান করবেন। স্বভাবতই এখানে ওসীলা অর্থ উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী নয়, বরং ওসীলা অর্থ নৈকট্য। মহান আল্লাহ তাঁকে সর্বোচ্চ নৈকট্য ও নিকটতম মর্তবা প্রদান করবেন।

‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআনে দু স্থানে ব্যবহৃত হয়েছে। এক স্থানে আল্লাহ বলেন:

قُلِ ادْعُوا الَّذِينَ زَعَمْتُمْ مِنْ دُونِهِ فَلا يَمْلِكُونَ كَشْفَ الضُّرِّ عَنْكُمْ وَلا تَحْوِيلا أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْعُونَ يَبْتَغُونَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُونَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ إِنَّ عَذَابَ رَبِّكَ كَانَ مَحْذُورًا

‘‘বল, ‘তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’[3]

এখানে আরবী জ্ঞাত পাঠক দেখতে পাচ্ছেন যে, ‘তারা ওসীলা সন্ধান করে কে কত নিকটতর’, এ কথটির মধ্যে প্রথমে ‘ওসীলা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এবং পরে ‘কুরবাহ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। এভাবে কুরআনের ব্যবহার থেকেই সুস্পষ্ট যে, ওসীলা ও ‘কুরবাহ’ শব্দদ্বয় সমার্থক এবং ওসীলা সন্ধানের অর্থ নৈকট্য লাভের চেষ্টা।

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا اتَّقُوا اللَّهَ وَابْتَغُوا إِلَيْهِ الْوَسِيلَةَ وَجَاهِدُوا فِي سَبِيلِهِ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ

‘‘হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর এবং তাঁর পথে সংগ্রাম কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’’[4]

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু জারীর আত-তাবারী (৩১০ হি) বলেন:

وابتغوا إليه الوسيلة  يقول واطلبوا القربة إليه ومعناه بما يرضيه والوسيلة هي الفعلية من قول القائل توسلت إلى فلان بكذا بمعنى تقربت إليه

‘‘তাঁর দিকে ওসীলা সন্ধান কর। এর অর্থ: তাঁর দিকে নৈকট্য সন্ধান কর,অর্থাৎ যে কর্ম করলে তিনি সন্তুষ্ট হন তা করে। ওসীলা শব্দটি ‘তাওয়াস্সালতু’ কথা থেকে ‘ফায়ীলাহ’ ওযনে গৃহীত ইসম। বলা হয় ‘তাওয়াস্সালতু ইলা ফুলান বি-কাযা, অর্থাৎ আমি অমুক কাজ করে অমুকে নিকটবর্তী হয়েছি।’’[5]

এরপর ইমাম তাবারী বিভিন্ন জাহিলী কবির কবিতা উদ্ধৃৃত করে প্রমাণ করেন যে, ওসীলা শব্দটির অর্থ নৈকট্য। অতঃপর তিনি সাহাবী ও তাবিয়ীগণ থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাদের মতামত সনদ সহ উদ্ধৃত করেন। সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ), তাবিয়ী আবূ ওয়ায়িল, আতা ইবনু আবি রাবাহ, কাতাদাহ ইবনু দি‘আমাহ, মুজাহিদ ইবনু জাবর, হাসান বাসরী, আব্দুল্লাহ ইবনু কাসীর, সুদ্দী আল-কাবীর, ইবনু যাইদ, প্রমুখ মুফাস্সির থেকে তিনি উদ্ধৃৃত করেছেন যে, সকলেই বলেছেন ‘তাঁর ওসীলা সন্ধান কর’ অর্থ তাঁর নৈকট্য সন্ধান কর, অর্থাৎ তাঁর আনুগত্য ও রেযামন্দিমূলক নেককর্ম করে তাঁর নৈকট্য ও মহববত লাভে সচেষ্ট হও।[6]

এ আয়াতটি মূলত মুমিনের সফলতার মূল কর্মগুলি বর্ণনা করেছে:  (১) ঈমান, (২) তাকওয়া, (৩) অতিরিক্ত নেককর্ম ও (৪) জিহাদ। নিজের প্রতি মুমিনের দায়িত্ব ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত অর্জন করা। তাকওয়া মূলত ফরয পালন ও হারাম বর্জনকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত। এরপর অতিরিক্ত নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে প্রতিযোগিতা করতে হবে। সর্বোপরি সমাজ, জাতি ও মানবতার জন্য দীন প্রচার, প্রসার, সংরক্ষন ও জিহাদ করতে হবে। ইতোপূর্বে আমরা বেলায়াত সংক্রান্ত হাদীসে বিষয়টি দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, ঈমান ও তাকওয়ার মাধ্যমে মূল বেলায়াত লাভ হয়। আর অনবরত নফল ইবাদত পালনের মাধ্যমে আল্লাহর বেলায়াত, নৈকট্য বা ওসীলা লাভের বা মাহবূবিয়্যাত অর্জনের ক্ষেত্রে মুমিনগণের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।

উপরের বিষয়গুলি খুবই স্পষ্ট এবং এ অর্থে বেশি বেশি নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য বা অসীলা সন্ধান করা মুমিনের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু পরবর্তীকালে, ওসীলা শব্দটি আরো কয়েকটি অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন মতভেদ বা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। সেগুলির অন্যতম: (১) দু‘আর মধ্যে ‘ওসীলা’, (২) পীর-মাশাইখের ‘ওসীলা’ ও (৩) উপকরণ বা মধ্যস্থতাকারী অর্থে ওসীলা।

[1] ইবনু ফারিস, মু’জামু মাকায়ীসুল লুগাত ৬/১১০।
[2] রাগিব ইসপাহানী, আল-মুফরাদাত পৃ. ৫২৩-৫২৪।
[3] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫৬-৫৭ আয়াত।
[4] সূরা (৫) মায়িদা: ৩৫ আয়াত।
[5] তাবারী, তাফসীর (জামিউল বায়ান) ৬/২২৬।
[6] তাবারী, তাফসীর ৬/২২৬-২২৭ ও ১৫/১০৪-১০৬।

মহান আল্লাহর কাছে দু‘আর সময় কোনো কিছুর ‘দোহাই’ দেওয়াকে ‘ওসীলা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। দু‘আর মধ্যে ‘বা’ (الباء) অব্যয়টি ব্যবহার করে দু‘আ চাওয়া বিভিন্ন হাদীসে রয়েছে। এ অব্যয়টির অর্থ দ্বারা, সাহায্যে বা কারণে। যেমন হাদীসে বর্ণিত বিভিন্ন দু‘আয় বলা হয়েছে: হে আল্লাহ, আপনার মহান নামগুলির দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন। আমি আপনার নামগুলি দ্বারা আপনার কাছে দু‘আ করছি। আমার অমুক কর্মের দ্বারা বা কারণে আমার দু‘আ কবুল করুন... ইত্যাদি। তবে এ অর্থে ‘‘হে আল্লাহ, অমুকের ওসীলায় (بوسيلة) কথাটি কোনো হাদীসে ব্যবহৃত হয় নি। এ অর্থে আরবীতে ‘বিহাক্কি’ (بِحق) অর্থাৎ ‘‘অমুক কর্ম বা ব্যক্তির অধিকারের কারণে বা দ্বারা’ এবং ‘বিহুরমাতি’ অর্থাৎ ‘‘অমুকের সম্মানে’ কথাও ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ হিসেবে এক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ শব্দটির ব্যবহার ব্যাপক।

আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করার সময় কোনো কিছুর দোহাই বা বা ওসীলা দেওয়া কয়েকভাবে হতে পারে:

(১) মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া।

(২) নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া।

(৩) কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া।

(৪) কারো ব্যক্তিগত মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া।

প্রথমত: মহান আল্লাহর পবিত্র নাম ও গুণাবলির দোহাই দেওয়া

যেমন বলা যে, হে আল্লাহ, আপনার রহমান নামের গুণে, বা গাফ্ফার নামের ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দোহাই দেওয়া কুরআন- হাদীসের নির্দেশ এবং দু‘আ কবুল হওয়ার কারণ। মহান আল্লাহ বলেন :

وَلِلَّهِ الأَسْمَاءُ الْحُسْنَى فَادْعُوهُ بِهَا

‘‘এবং আল্লাহর আছে সুন্দরতম নামসমূহ; কাজেই তোমরা তাঁকে সে সকল নামে ডাকবে।’’[1]

আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন :

إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ

‘‘আল্লাহর ৯৯টি নাম আছে, ১০০’র একটি কম, যে ব্যক্তি এই নামগুলি সংরক্ষিত রাখবে বা হিসাব রাখবে (মুখস্থ রাখবে) সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’’[2]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শেখানো মাসনূন দু‘আগুলি পাঠ করলে আমরা সেগুলির মধ্যে এরূপ অনেক দু‘আ পাই, যাতে আল্লাহর পবিত্র নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করতে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, এরূপ বিশেষ নাম বা গুণাবলির দোহাই দিয়ে দু‘আ করলে দু‘আ কবুল হবে বলে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন এরূপ একটি দু‘আয় রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শিখিয়েছেন:

أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ ....

আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আপনার সকল নাম ধরে বা নামের ওসীলা দিয়ে, যে নামে আপনি নিজেকে ভূষিত করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কিতাবে নাযিল করেছেন, অথবা যে নাম আপনি আপনার কোনো সৃষ্টিকে শিখিয়েছেন, অথবা যে নাম আপনি গাইবী জ্ঞানে আপনার একান্ত নিজের কাছে রেখে দিয়েছেন (সকল নামের ওসীলায় আমি আপনার কাছে চাচ্ছি যে,) ...। [3]

আমার লেখা ‘রাহে বেলায়ত’ পুস্তকে পাঠক এরূপ অনেক মাসনূন দু‘আ দেখতে পাবেন।

দ্বিতীয়ত, নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই দেওয়া

নিজের কোনো ভাল কর্মের দোহাই বা ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করলে কবুল হয় বলে হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে। একটি হাদীসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, অতীত যুগের তিনজন মানুষ বিজন পথে চলতে চলতে বৃষ্টির কারণে এক পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করে। প্রবল বর্ষণে একটি বিশাল পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে গুহাটি তাদের জীবন্ত কবরে পরিণত হয়। এ ভয়ানক বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তারা দু‘আ করতে মনস্থ করেন। তারা একে অপরকে বলেন:

ادْعُوا اللَّهَ بِأَفْضَلِ عَمَلٍ عَمِلْتُمُوهُ

‘‘জীবনে সর্বশ্রেষ্ট যে আমল করেছ তদ্বারা (তার ওসীলা দিয়ে) আল্লাহর কাছে দু‘আ কর বা তার দোহাই দিয়ে আল্লাহকে ডাক।’’

তখন তাদের একজন তার জীবনে সন্তানদের কষ্ট উপেক্ষা করে পিতামাতার খেদমতের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন:

اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً نَرَى مِنْهَا السَّمَاءَ

‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে আপনি পাথরটি একটু সরিয়ে দেন যেন আমরা আকাশ দেখতে পাই।’’

মহান আল্লাহ তৎক্ষণাৎ তার দু‘আ কবুল করে পাথরটি একটু সরিয়ে দেন। তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি তাঁর এক সুন্দরী প্রেমিকার সাথে ব্যভিচারের সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও আল্লাহর ভয়ে পাপ পরিত্যাগ করার একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন:

فَإِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا فُرْجَةً

‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি আরেকটু সরিয়ে দিন।’’

মহান আল্লাহ তার দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি দু-তৃতীয়াংশ সরে যায়। তখন তৃতীয় ব্যক্তি নিজের অসুবিধা ও স্বার্থ নষ্ট করে একজন শ্রমিকের বেতন ও আমানত পরিপূর্ণরূপে আদায়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করে বলেন,

اللَّهُمَّ إِنْ كُنْتَ تَعْلَمُ أَنِّي فَعَلْتُ ذَلِكَ ابْتِغَاءَ وَجْهِكَ فَافْرُجْ عَنَّا

‘‘হে আল্লাহ, আপনি যদি জেনে থাকেন যে, আমি এ কর্মটি আপনার রেযামন্দির জন্যই করেছিলাম, তবে এর কারণে (ওসীলায়) আপনি পাথরটি সরিয়ে দিন।’’

আল্লাহ তাদের দু‘আ কবুল করেন এবং পাথরটি একেবারে সরে যায়।[4]

নিজের ঈমান, মহববত ইত্যাদির ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়াও এ প্রকারের ওসীলা প্রদান। বুরাইদাহ আসলামী (রাঃ) বলেন, তিনি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মসজিদে প্রবেশ করে দেখেন এক ব্যক্তি সালাতরত অবস্থায় দু‘আ করছে নিম্নের কথা দিয়ে :

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ بِأَنِّي أَشْهَدُ أَنَّكَ أَنْتَ اللَّهُ لا إِلَهَ إِلا أَنْتَ الأَحَدُ الصَّمَدُ الَّذِي لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি, এ ওসীলায় (এদ্বারা)  যে, আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি, আপনিই আল্লাহ, আপনি ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই। আপনিই একক, অমুখাপেক্ষী, যিনি জন্মদান করেননি ও জন্মগ্রহণ করেননি এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’’

তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন :

وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لَقَدْ سَأَلَ اللَّهَ بِاسْمِهِ الأَعْظَمِ الَّذِي إِذَا دُعِيَ بِهِ أَجَابَ وَإِذَا سُئِلَ بِهِ أَعْطَى

‘‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর শপথ করে বলছি, নিশ্চয় এই ব্যক্তি আল্লাহর কাছে তাঁর ইসমু আ’যম ধরে প্রার্থনা করেছে, যে নাম ধরে ডাকলে তিনি সাড়া দেন এবং যে নাম ধরে চাইলে তিনি প্রদান করেন।’’[5]

এখানে আমরা দেখছি যে, ঈমান ও শাহাদতের ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া হয়েছে। বিভিনণ ভাবে এরূপ দু‘আ করা যায়, যেমন: ‘‘হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমি অমুক কর্মটি আপনার সন্তুষ্টির জন্য করেছিলাম, সেই ওসীলায় আমার প্রার্থনা কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি গোনাহগার, আমার কোনো উল্লেখযোগ্য নেক আমল নেই যে, যার ওসীলা দিয়ে আমি আপনার পবিত্র দরবারে দু‘আ চাইব। শুধুমাত্র আপনার হাবীব নবীয়ে মুসতাফা (ﷺ)-এর নামটি ঈমান নিয়ে মুখে নিয়েছি, এর ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমার কিছুই নেই, শুধুমাত্র আপনার নবীয়ে আকরাম (ﷺ)-এর সুন্নাতের মহববতটুকু হৃদয়ে আছে, সেই ওসীলায় আমাকে ক্ষমা করুন, আমার দু‘আ কবুল করুন। হে আল্লাহ, আমি কিছুই আমল করতে পারিনি, তবে আপনার পথে অগ্রসর ও আমলকারী নেককার বান্দাদেরকে আপনারই ওয়াস্তে মহববত করি, তাদের পথে চলতে চাই, আপনি সেই ওসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন ...।’’ ইত্যাদি।

তৃতীয়ত: কারো দু‘আর দোহাই দেওয়া

কারো দু‘আর ওসীলা দেওয়ার অর্থ এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, অমুক আমার জন্য দু‘আ করেছেন, আপনি আমার বিষয়ে তাঁর দু‘আ কবুল করে আমার হাজত পূরণ করে দিন। আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, নেককার মুত্তাকী মুমিনদের নিকট দু‘আ চাওয়া সুন্নাত সম্মত রীতি। এরূপ কারো নিকট দু‘আ চাওয়ার পরে মহান আল্লাহর দরবারে উক্ত নেককার ব্যক্তির দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার বিষয়টি একটি হাদীস থেকে জানা যায়। উসমান ইবনু হানীফ (রাঃ) বলেন,

أَنَّ رَجُلا ضَرِيرَ الْبَصَرِ أَتَى النَّبِيَّ (ﷺ) فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يُعَافِيَنِي قَالَ إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ وَإِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ قَالَ فَادْعُهْ قَالَ فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ فَيُحْسِنَ وُضُوءَهُ (فيحسن ركعتين) وَيَدْعُوَ بِهَذَا الدُّعَاءِ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ وَأَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ (ﷺ) نَبِيِّ الرَّحْمَةِ، (يا محمد) إِنِّي تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّي فِي حَاجَتِي هَذِهِ لِتُقْضَى لِيَ (يا محمد إني أَتَوَجَّهُ  بِكَ إلى اللهِ أَنْ يَقْضِيَ حَاجَتِيْ) (فَيُجْلِيْ لِيْ عَنْ بَصَرِي) اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ (وشَفِّعْنِي فِيْهِ) (اللهم شَفِّعْهُ فِيَّ وَشَفِّعْنِيْ فِيْ نَفْسِيْ)

‘‘একজন অন্ধ ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমনে করে বলে, আমার জন্য দু‘আ করুন, যেন আল্লাহ আমাকে সুস্থতা দান করেন। তিনি বলেন: তুমি যদি চাও আমি দু‘আ করব, আর যদি চাও তবে সবর কর, সেটাই তোমার জন্য উত্তম। লোকটি বলে: আপনি দু‘আ করুন। তখন তিনি তাকে নির্দেশ দেন, সে যেন সুন্দর করে ওযূ করে (অন্য বর্ণনায়: এবং দু রাকাত সালাত আদায় করে) এবং এই দু‘আ করে: ‘‘হে আল্লাহ, আমি আপনার নিকট প্রার্থনা করছি এবং আপনার দিকে মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার নবী মুহাম্মাদের দ্বারা, যিনি রহমতের নবী, হে মুহাম্মাদ, আমি মুখ ফিরাচ্ছি (মনোনিবেশ করছি) আপনার দ্বারা আমার প্রতিপালকের দিকে আমার এ প্রয়োজনটির বিষয়ে, যেন তা মেটানো হয়। (অন্য বর্ণনায়: যেন তিনি তা মিটিয়ে দেন, যেন তিনি আমার দৃষ্টি প্রদান করেন।) হে আল্লাহ আপনি আমার বিষয়ে তার সুপারিশ কবুল করুন (অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং তাঁর জন্য আমার সুপারিশ কবুল করুন। অন্য বর্ণনায়: আমার বিষয়ে তাঁর সুপারিশ কবুল করুন এবং আমার বিষয়ে আমার নিজের সুপারিশও কবুল করুন।)’’[6]

এ হাদীসে অন্ধ লোকটি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট দু‘আ চেয়েছে। তিনি দু‘আ করেছেন এবং তাকে শিখিয়ে দিয়েছেন তাঁর দু‘আর ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে নিজে দু‘আ করতে। লোকটি সেভাবে দু‘আ করেছে। তিরমিযীর বর্ণনায় দু‘আর ফলাফল উল্লেখ করা হয় নি। তবে অন্যন্য সকল বর্ণনায় রাবী বলেন যে, দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন এবং লোকটি তার দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ ফিরে পায়, যেন সে কখনোই অন্ধ ছিল না।

অন্য হাদীসে আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন:

إِنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ  كَانَ إِذَا قَحَطُوا اسْتَسْقَى بِالْعَبَّاسِ بْنِ عَبْدِ الْمُطَّلِبِ فَقَالَ اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا (ﷺ) فَتَسْقِينَا وَإِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا قَالَ فَيُسْقَوْنَ

‘‘উমার (রাঃ) যখন অনাবৃষ্টিতে আক্রান্ত হতেন তখন আববাস ইবনু আব্দুল মুত্তালিবকে (রাঃ) দিয়ে বৃষ্টির দু‘আ করাতেন, অতঃপর বলতেন: হে আল্লাহ আমরা আমাদের নবী (ﷺ)-এর ওসীলায় আপনার নিকট প্রার্থনা করতাম ফলে আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করতেন। এখন আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করছি আমাদের নবী (ﷺ)-এর চাচার ওসীলায়, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন। আনাস (রাঃ) বলেন, তখন বৃষ্টিপাত হতো।’’[7]

আববাস (রাঃ) নিম্নের বাক্যগুলি বলে দু‘আ করলে আল্লাহ বৃষ্টি দিতেন:

اللهم إنه لم ينزل  بلاء إلا بذنب  ولم يكشف إلا بتوبة وقد توجه القوم بي إليك لمكانى من نبيك وهذه أيدينا إليك بالذنوب ونواصينا إليك بالتوبة فاسقنا الغيث

‘‘হে আল্লাহ, পাপের কারণ ছাড়া বালা-মুসিবত নাযিল হয় না এবং তাওবা ছাড়া তা অপসারিত হয় না। আপনার নবীর সাথে আমার সম্পর্কের কারণে মানুষেরা আমার মাধ্যমে আপনার দিকে মুখ ফিরিয়েছে। এ আমাদের পাপময় হাতগুলি আপনার দিকে প্রসারিত এবং আমাদের ললাটগুলি তাওবায় আপনার নিকট সমর্পিত, অতএব আপনি আমাদেরকে বৃষ্টি দান করুন।’’[8]

এ হাদীসেও স্পষ্ট যে, আববাস (রাঃ) বৃষ্টির জন্য দু‘আ করেছেন উমার (রাঃ) আব্বাসের (রাঃ) দু‘আর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করেছেন। তাঁর কথা থেকে বুঝা যায় যে, যতদিন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) জীবিত ছিলেন, ততদিন খরা বা অনাবৃষ্টি হলে তাঁরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর কাছে দু‘আ চাইতেন এবং সে দু‘আর ওসীলায় আল্লাহ তাদের বৃষ্টি দান  করতেন। তাঁর ওফাতের পরে যেহেতু আর তাঁর কাছে দু‘আ চাওয়া যাচ্ছে না, সেহেতু তাঁর চাচা আববাসের (রাঃ) কাছে দু‘আ চাচ্ছেন এবং দু‘আর ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে বৃষ্টি প্রার্থনা করছেন।

চতুর্থত: কোনো ব্যক্তি, তাঁর মর্যাদা বা অধিকারের দোহাই দেওয়া

আল্লাহর কাছে দু‘আ করার ক্ষেত্রে ‘ওসীলা’ বা দোহাই দেওয়ার চতুর্ত পর্যায় হলো, কোনো ব্যক্তির, বা তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দেওয়া। যেমন জীবিত বা মৃত কোনো নবী-ওলীর নাম উল্লেখ করে বলা: হে আল্লাহ অমুকের ওসীলায়, বা অমুকের মর্যাদার ওসীলায় বা অমুকের অধিকারের অসীলায় আমার দু‘আ কবুল করুন। এরূপ দু‘আ করার বৈধতার বিষয়ে আলিমদের মধ্যে ব্যাপক মতভেদ রয়েছে। অনেক আলিম এরূপ দু‘আ করা বৈধ বলেছেন। তাঁরা সাধারণভাবে উপরের দুটি হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেন। বিশেষত তাবারানী ও বাইহাকী অন্ধ ব্যক্তির হাদীসটির প্রসঙ্গে একটি বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন। তাদের বর্ণনার সার-সংক্ষেপ যে, খলীফা উসমান (রাঃ)-এর সময়ে এক ব্যক্তি তাঁর দরবারে একটি প্রয়োজনে যায়। কিন্তু খলীফা তার প্রতি দৃকপাত করেন না। লোকটি উসমান ইবনু হানীফের (রাঃ) নিকট গমন করে তাকে খলীফা উসমানের নিকট তার জন্য সুপারিশ করতে অনুরোধ করে। তখন উসমান ইবনু হানীফ লোকটিকে অন্ধ লোকটিকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দু‘আটি শিখিয়েছিলেন সে দু‘আটি শিখিয়ে দেন। লোকটি এভাবে দু‘আ করার পরে খলীফা উসমান (রাঃ) তার প্রয়োজন মিটিয়ে দেন।[9]

এ থেকে বুঝা যায় যে, শুধু রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর দু‘আর ওসীলাই নয়, উপরন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া বৈধ। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ছাড়া অন্য কোনো ফিরিশতা, নবী, সাহাবী, তাবিয়ী বা ওলী-আল্লাহর ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনো কথা কোনো হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের বক্তব্যে পাওয়া যায় না। তবে এ মতের আলিমগণ সকলকেই রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর মত ও তাঁর সাথে তুলনীয় ধরে এরূপ যে কারো নামের ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া জায়েয বলেছেন।

কোনো কোনো আলিম কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা জায়েয বলেছেন। অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়া নাজায়েয বলেছেন। তাঁদের মতে, কারো মৃত্যুর পরেও তাঁর ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা জায়েয বলার পরে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে বাদ দিয়ে অন্য কারো ওসীলা দিয়ে দু‘আ করা তাঁর সাথে বেয়াদবী ছাড়া কিছুই নয়।

পক্ষান্তরে অন্য অনেক আলিম কোনো জীবিত বা মৃত ব্যক্তির, তাঁর মর্যাদার বা তাঁর অধিকারের দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা অবৈধ ও নাজায়েয বলে গণ্য করেছেন। তাঁরা বলেন যে, এরূপ কোনো জীবিত বা মৃত কারো ব্যক্তিসত্তার ওসীলা দিয়ে দু‘আ চাওয়ার কোনোরূপ নযির কোনো সহীহ ও প্রসিদ্ধ হাদীসে বা সাহাবী-তাবিয়ীগণের মধ্যে পাওয়া যায় না। এছাড়া নবীগণ ও যাদের নাম মহান আল্লাহ ওহীর মাধ্যমে জানিয়েছেন তাঁরা ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তির বিষয়ে সুনিশ্চিতভাবে কখনোই বলা যায় না যে, উক্ত ব্যক্তি আল্লাহর প্রিয় বা আল্লাহর কাছে তাঁর কোনো বিশেষ মর্যাদা বা অধিকার আছে। সর্বোপরি তাঁরা উপরে উল্লেখিত উমার (রাঃ) কর্তৃক আববাসের ওসীলা প্রদানকে দলীল হিসেবে পেশ করেন। যদি কারো দু‘আর ওসীলা না দিয়ে তাঁর সত্তার ওসীলা দেওয়া জায়েয হতো তবে উমার (রাঃ) ও সাহাবীগণ কখনোই রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে বাদ দিয়ে আববাস (রাঃ)-এর ওসীলা পেশ করতেন না।

শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গন্থে উমার (রাঃ)-এর হাদীসটি উদ্ধৃত করে বলেন: ‘‘এই ঘটনায় প্রতীয়মান হয় যে, মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা শরীয়ত বিরোধী। যদি শরীয়ত সিদ্ধ হইত হযরত ওমর (রাঃ) হুযুর (ﷺ)-কে অসিলা করিয়াই দোআ করিতেন। কারণ, মৃত বা জীবিত যে কোন ব্যক্তির চেয়েই হুযুর (ﷺ)-এর ফযীলত সীমাহীন-অনন্ত। তাহই হযরত ওমর (রাঃ) এই কথা বলেন নাই যে, হে আল্লাহ, ইতি পূর্বে তো আমরা তোমার নবীকে অসীলা করিয়া দোআ করিতাম। কিন্তু এখন তিনি আমাদের মধ্যে বিদ্যমান নাই তাই আমরা তাঁহার রুহু মোবারককে অসিলা করিয়া তোমার কাছে আরযী বেশ করিতেছি। তাই কোন মৃত ব্যক্তিকে অসিলা করা মোটেই বৈধ নহে।’’[10]

ইমাম আবূ হানীফা (রাহ), ইমাম আবূ ইউসূফ (রাহ) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রাহ) সকলেই একমত যে কারো অধিকার বা মর্যাদার দোহাই দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ চাওয়া মাকরূহ। আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য হানাফী বলেন:

قَالَ أَبُو حَنِيفَةَ وَصَاحِبَاهُ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ : يُكْرَهُ أَنْ يَقُولَ الدَّاعِي: أَسْأَلُكَ بِحَقِّ فُلانٍ، أَوْ بِحَقِّ أَنْبِيَائِكَ وَرُسُلِكَ ، وَبِحَقِّ الْبَيْتِ الْحَرَامِ ، وَالْمَشْعَرِ الْحَرَامِ ، وَنَحْوِ ذَلِكَ

‘‘ইমাম আবূ হানীফা (রাহ) ও তাঁর সঙ্গীদ্বয় বলেছেন: ‘আমি অমুকের অধিকার বা আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকার, বা বাইতুল হারামের অধিকার বা মাশ‘আরুল হারামের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বা প্রার্থনা করছি’ বলে দু‘আ করা মাকরূহ।’’[11]

আল্লামা আলাউদ্দীন কাসানী (৫৮৭ হি) বলেন:

وَيُكْرَهُ لِلرَّجُلِ أَنْ يَقُولَ فِي دُعَائِهِ أَسْأَلُك بِحَقِّ أَنْبِيَائِك وَرُسُلِك وَبِحَقِّ فُلانٍ لأنَّهُ لا حَقَّ لأحَدٍ عَلَى اللَّهِ...

‘‘‘আমি আপনার নবী-রাসূলগণের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি এবং অমুকের অধিকারের দোহাই দিয়ে চাচ্ছি বলে দু‘আ করা মাকরূহ; কারণ মহান আল্লাহর উপরে কারো কোনো অধিকার নেই।’’[12]

কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে দু‘আ করা শিরক নয়; কারণ, এতে আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকা হয় না বা দু‘আ করা হয় না; একমাত্র আল্লাহকেই ডাকা হয়। এ বিষয়ক বিতর্ক জায়েয-নাজায়েযের মধ্যে সীমিত। কাজেই শিরক প্রসঙ্গে আমরা এ বিষয়ক বিতর্কের বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই না।

পঞ্চমত: আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওসীলার কাছেই চাওয়া

ওসীলা বিষয়ক চূড়ান্ত শিরক হলো ওসীলার নামে ওসীলার কাছেই দু‘আ করা বা ত্রাণ, সাহায্য, বিপদমুক্তি ইত্যাদি প্রার্থনা করা। উপরে ওসীলা বলতে যা কিছু বলা হয়েছে তা হলো কারো ওসীলা দিয়ে মহান আল্লাহর কাছে দু‘আ করা। এর বিপরীতে আরেকটি কর্ম হলো, যাকে ওসীলা বলে মনে করা হচ্ছে আল্লাহকে বাদ দিয়ে সরাসরি তাকেই ডাকা। এ বিষয়টি সুস্পষ্ট শিরক। পরবর্তীতে আমরা তা আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ।

[1] সূরা আ’রাফ : ১৮০।
[2] বুখারী, আস-সহীহ ২/৯৮১; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৬৩।
[3] ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/২৫৩, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৯০, আহমদ, আল-মুসনাদ ১/৩৯১, ৪৫২, হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ১০/১৩৬, ১৮৬।
[4] বুখারী, আস-সহীহ ২/৮২১, ৩/১২৭৮, ৫/২২২৮; মুসলিম, আস-সহীহ ৪/২০৯৯।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫১৫; আবূ দাউদ, আস-সুনান ২/৭৯; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ২/১২৬৭; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৩/১৭৪, হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৬৮৩, ৬৮৪, আলবানী, সহীহ সুনানুত তিরমিযী ৩/১৬৩। হাদীসটি সহীহ।
[6] তিরমিযী, আস-সুনান ৫/৫৬৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ১/৭০০, ১/৭০৭; নাসাঈ, আস-সুনানুল কুবরা ৬/১৬৮-১৬৯। তিরমিযী বলেন: হাদীসটি হাসান সহীহ গরীব। হাকিম ও অন্যান্য মুহাদ্দিস হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
[7] বুখারী, আস-সহীহ ১/৩৪২, ৩/১৩৬০।
[8] ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৪৯৭।
[9] তাবারানী, আল-মু‘জামুল কাবীর ৯/৩০; আল-মু‘জামুস সাগীর ১/৩০৬; বাইহাকী, দালাইলুন নুবুওয়াত ৬/৩৫৪; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/২৭৯। এ বর্ণনাটির বিশুদ্ধতা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের মধ্যে আপত্তি ও মতপার্থক্য আছে।
[10] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩১।
[11] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদাহ আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ২৩৭।
[12] কাসানী, বাদাইউস সানাইয় ৫/১২৬।

আমরা উপরে দেখেছি যে, আল্লাহ তাঁর ওসীলা বা নৈকট্য সন্ধান করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সাহাবী, তাবিয়ী ও পরবর্তী সকল মুফাস্সির একমত যে, নেক আমল হলো ওসীলা, যার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়। প্রায় হাজার বৎসর যাবৎ এ বিষয়ে অন্য কোনো মতামত প্রচারিত হয় নি। এরপর কোনো কোনো আলিম উল্লেখ করেছেন যে, ‘পীর-মাশাইখ’-ও ওসীলা। মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এ কথার প্রেক্ষাপট বুঝা যায়। তাতার আক্রমনে মুসলিম বিশ্ব একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। এরপর মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্রীয় প্রশাসন, শিক্ষাদীক্ষার উন্নয়ন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে স্থবিরতা আসে। বিশাল মুসলিম বিশ্বের কয়েকটি রাজধানী বাদ দিলে সর্বত্র অজ্ঞতা, কুসংস্কার, পূর্ববর্তী বা পার্শবর্তী ধর্মের প্রভাব, বাতিনী শীয়াগণের প্রভাব ইত্যাদি কারণে শিরক-কুফর প্রবল হয়ে উঠে। উম্মাতের এ দুর্দিনে সরলপ্রাণ প্রচারবিমুখ সুফী, দরবেশ ও পীর-মাশাইখ আম-জনগনের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা বিস্তারে নিরলস চেষ্টা করে যান। তাঁদের সাহচার্যে যেয়ে মানুষ তাওহীদ, রিসালাত, ঈমান, ইসলাম ও ইসলামের হুকুম আহকাম কমবেশি শিক্ষা লাভ করত এবং আত্মশুদ্ধির চেষ্টা করত। সাধারণ মানুষদের ঈমান, ইসলাম ও আখলাক গঠনে তাদের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ দিকে লক্ষ্য করে কোনো কোনো আলিম মতামত পেশ করেন যে, পীর-মাশাইখের সাহচার্যও একটি বিশেষ নেক আমল যা মহান আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন।

কিন্তু অজ্ঞতার কারণে এবং স্বার্থান্বেষীদের মিথ্যা প্রচারণার কারণে একথাটি ক্রমান্বয়ে শিরকী অর্থে ব্যবহৃত হতে থাকে। আরবের মুশরিকগণ যেমন আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ফিরিশতা, নবী, ওলী ও অন্যান্য উপাস্যের ইবাদত করত, ঠিক তেমনি অনেকে পীর-মাশাইখের ইবাদত করাকে আল্লাহর নৈকট্য লাভের মাধ্যম বলে মনে করতে থাকে। কেউ বা ওসীলা বলতে ‘মধ্যস্থতাকারী’ বা উপকরণ বলে মনে করতে থাকে। তারা মনে করতে থাকে যে, পীর-মাশাইখ আল্লাহ ও তাঁর বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতা করেন। তাদের মধ্যস্থতা ছাড়া কেউ আল্লাহর সন্তুষ্টি বা রহমত পেতে পারে না। এরূপ অনেক শিরকী ধারণা মুসলিম সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিষয়ক ধারণাগুলি নিম্নরূপ:

(১) পীরের সাহচর্যকে আল্লাহর নৈকট্যের একটি ওসীলা মনে করা

এ ধারণাটি মূলত ইসলাম-সম্মত। কুরআন ও হাদীসে নেককার মুমিন-মুত্তাকীগণের সাহচার্য গ্রহণে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। আমরা দেখেছি যে, ওসীলা অর্থ নেক আমল। আর কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে এরূপ মুত্তাকীগণের সাহচার্য গ্রহণ, সাক্ষাত করা এবং আল্লাহর ওয়াস্তে তাদেরকে ভালবাসা এ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেক-আমল বা ওসীলা।

তবে এখানে দুটি বিষয় লক্ষণীয়। প্রথমত, ‘পীর’ বলে কোনো বিশেষ পদমর্যাদা কুরআন ও হাদীসে উল্লেখ করা হয় নি। বরং আলিম, সত্যবাদী, মুত্তাকী, নেককার, সৎকর্মশীল, ফরয ও নফল ইবাদত পালনকারী, সুন্নাতের অনুসারী ইত্যাদি বিশেষণ উল্লেখ করা হয়েছে। পীর নামধারী ব্যক্তির মধ্যে যদি এ সকল বাহ্যিক গুণ বিদ্যমান না থাকে তবে তার সাহচার্য গ্রহণ আল্লাহর নৈকট্য নয়, বরং শয়তানের নৈকট্যের অন্যতম ওসীলা, যদিও এরূপ ব্যক্তি পীর, মুরশিদ, ওলী, বা অনুরূপ কোনো নাম ধারণ করে। আর যদি কুরআন-হাদীসে উল্লেখিত উপর্যুক্ত বাহ্যিক গুণাবলি কারো মধ্যে বিদ্যমান থাকে তবে তিনি ‘পীর’ নাম ধারণ করুন আর নাই করুন তার সাহচর্য মহান আল্লাহর নৈকট্যলাভের ওসীলা বলে গণ্য।

কুরআন, হাদীস ও সাহাবী-তাবিয়ীগণের কর্মধারার আলোকে পীর-মুরিদীর গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা, সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতি, ভুল-ধারণা ইত্যাদি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছি ‘এহইয়াউস সুনান’ ও ‘রাহে বেলায়াত’ গ্রন্থে। সম্মানিত পাঠককে পুস্তকদুটি পাঠ করতে সবিনয়ে অনুরোধ করছি।

দ্বিতীয়ত, মূলত মুমিনের নিজের কর্মই তাঁর অসীলা, অন্য কোনো মানুষ বা তার কর্ম নয়। এখানে আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নেককার মানুষদের সাহচর্য গ্রহণই নেককর্ম ও অসীলা। ইসলামী অর্থে কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির ‘ওসীলা’ হতে পারে না, কেবলমাত্র মুমিনের নিজের কর্মই তার ওসীলা। এমনকি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কোনো ব্যক্তির জন্য ওসীলা হবেন না যতক্ষণ না সে তাঁর উপর ঈমান গ্রহণ করবে এবং তাঁর শরীয়ত পালন করবে। এক্ষেত্রে মূলত মুমিনের ঈমান ও শরীয়ত পালনই ওসীলা। এর কারণে সে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করে এবং আল্লাহ তাঁর উপর সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর জন্য রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর শাফা‘আত, জান্নাতের সাহচার্য ইত্যাদি নসীব করে দিতে পারেন।

(২) পীরের সাহচর্যকে আল্লাহর নৈকট্যের একমাত্র ওসীলা মনে করা

অসীলা বিষয়ক বিভ্রান্তিকর ধারণার একটি হলো, পীরের সাহচার্যকে আল্লাহর নৈকট্যলাভের একমাত্র ওসীলা বলে মনে করা। অগণিত নফল মুস্তাহাব নেক কর্মের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ নেক-কর্ম হলো নেককার বান্দাদের সাহচার্য গ্রহণ করা। কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা অনুসারে ঈমান ও ইসলামের ফরয, ওয়াজিব, সুন্নাত ইত্যাদি আহকাম মেনে চলাই মূল দীন।  নেক-সাহচার্য এ সকল ইবাদত পালনে সহায়ক। সর্বদা কুরআন তিলাওয়া ও অধ্যয়ন করা, হাদীস, সীরাত, শামাইল পাঠ করা, সাহাবীগণের জীবনী পাঠ করার মাধ্যমেও প্রকৃত সাহচার্য গ্রহণ করা যায়।

(৩) পীরের কর্মকে নিজের ওসীলা বলে মনে করা

এ বিষয়ক অন্য বিভ্রান্তি হলো, পীরের বেলায়াতকে নিজের নাজাতের উপকরণ বলে বিশ্বাস করা। এরূপ বিশ্বাসের কারণে অনেকের ধারণা, আমার নিজের কর্ম যাই হোক না কেন, পীর সাহেব যেহেতু অনেক বড় ওলী, কাজেই তিনি আমাকে পার করিয়ে দিবেন। এরূপ বিশ্বাস কুরআন-হাদীসের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক। প্রথমত, কে বড় ওলী তা নিশ্চিত জানা তো দূরের কথা কে প্রকৃত ওলী বা কে জান্নাতী তাও নিশ্চিত জানার উপায় নেই। আমরা বাহ্যিক আমলের উপর নির্ভর করে ধারণা পোষণ করি এবং সাহচার্য গ্রহণ করি। দ্বিতীয়ত, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বারংবার বলেছেন যে, তাঁর সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, সাহাবী বা অন্য কাউকে তিনি আল্লাহর ইচ্ছার বাইরে ত্রাণ করতে পারবেন না। প্রত্যেককে তার নিজের নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নাজাত লাভ করতে হবে। মূলত মুমিনের নিজের কর্মই তার নাজাতের ওসীলা। পীরের সাহচর্য থেকে মুমিন আল্লাহর পথে চলার কর্ম শিক্ষা করবেন, প্রেরণা লাভ করবেন এবং নিজে আমল করে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করবেন।

এ বিশ্বাসের ভিত্তি হলো যে, মহান আল্লাহ কাউকে শাফা‘আত করার উন্মুক্ত অনুমতি বা অধিকার দিয়েছেন বা দিবেন, তিনি নিজের ইচ্ছামত কাফির-মুশরিক, ফাসিক-খোদদ্রোহী যাকে ইচ্ছা ত্রাণ করবেন। বস্ত্তত কারো সুপারিশ আল্লাহ শুনবেনই বা আল্লাহ তাকে ইচ্ছামত সুপারিশ করা অধিকার দিয়েছেন বলে বিশ্বাস করা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের ক্ষমতায় শিরক করা। এ বিশ্বাসটি মূলত আরবের মুশরিকদের ‘শাফা‘আত’ বিষয়ক বিশ্বাসের মত।

(৪) ওসীলা অর্থ উপকরণ বলে মনে করা

ওসীলা বিষয়ক আরেকটি বিভ্রান্তি হলো ওসীলা অর্থ উপকরণ বলে মনে করা। আমরা ইতোপূর্বে ওসীলা শব্দটির অর্থ ও তার বিবর্তন আলোচনা করেছি। কুরআনে মুমিনকে নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, আল্লাহর পথে কোনো অতিরিক্ত উপকরণ তালাশ করতে বলা হয় নি। উপকরণ দু প্রকারের: জাগতিক ও ধর্মীয়। জাগতিক উপকরণ সকলেই জাগতিক জ্ঞানের মাধ্যমে জানে। যেমন ভাত সিদ্ধ হওয়ার উপকরণ পানি ও আগুণ, বীজ অঙ্কুরিত হওয়ার উপকরণ মাটি, পানি ও আলো। আর ধর্মীয় উপকরণ একমাত্র ওহীর মাধ্যমে জানা যায়। যেমন ওযূ করা সালাত কবুল হওয়ার উপকরণ, ঈমান বিশুদ্ধ হওয়া নেক আমল কবুল হওয়ার উপকরণ, আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও মানুষের উপকার করা রিযক বৃদ্ধির উপকরণ। পীরের সাহচর্য লাভ, মুরীদ হওয়া ইত্যাদি কোনো নেক আমল কবুল হওয়া, দু‘আ কবুল হওয়ার উপকরণ নয়। কারণ কুরআন-হাদীসে কোথাও তা বলা হয় নি। এরূপ ধারণা আল্লাহর নামে মিথ্যা বলা এবং তা পরবর্তী শিরকী বিশ্বাসগুলি পথ উন্মুক্ত করে।

(৫) পীরকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী মনে করা

ওসীলা বিষয়ক শিরকী বিশ্বাসের অন্যতম হলো পীরকে আল্লাহ ও বান্দার মধ্যে মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করা। দুভাবে এ বিশ্বাস ‘প্রমাণ’ করা হয়: প্রথমত কুরআনের অর্থ বিকৃত করা এবং দ্বিতীয়ত আরবের মুশরিকদের মত ‘যুক্তি’ পেশ করা। প্রথম পর্যায়ে সরলপ্রাণ মুসলিমদের বিভ্রান্ত করতে এরা সাধারণত বলে থাকে ‘আল্লাহ কুরআনে বলেছেন ওসীলা ধরে তাঁর কাছে যেতে, কাজেই সরাসরি তাকে ডাকলে হবে না। আগে ওসীলা ধরো।’ এভাবে তারা কুরআনের আয়াতকে বিকৃত করেন। বিকৃতির মূল ভিত্তি ওসীলা শব্দের অর্থের পরিবর্তনের মধ্যে। কুরআনের ভাষায় ওসীলা অর্থ নৈকট্য এবং অসীলা সন্ধানের অর্থ মুমিনের নিজের নেক কর্মের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য সন্ধান। আর এরা বুঝান ওসীলা অর্থ মধ্যস্থতাকারী।

দ্বিতীয় পর্যায়ে এরা যুক্তি দেন যে, পৃথিবীতে যেমন রাজা-বাদশাহর দরবারে যেতে মন্ত্রী বা আমলাদের সুপারিশ, মধ্যস্থতা ও রিকমেন্ডেশন প্রয়োজন, তেমনিভাবে আল্লাহর দরবারেও পীর বা ওলীগণের রিকমেন্ডেশন প্রয়োজন। পীর, বা ওলীর সুপারিশ বা রিকমেন্ডেশন ছাড়া কোনো দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন না। বান্দা যতই আল্লাকে ডাকুক বা ইবাদত করুক, যতক্ষণ না তা ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে’ অর্থাৎ পীরের রিকমেন্ডেশন সহ তাঁর দরবারে যাবে ততক্ষণ তা গ্রহণ করা হবে না। অথবা পৃথিবীর বিচারালয়ে যেমন উকিল-ব্যারিষ্টারের প্রয়োজন হয়, তেমনি আল্লাহর দরবারে পীর ও ওলীগণ উকিল-ব্যরিষ্টারি করে মুরিদ-ভক্তদের পার করে দিবেন। এ জাতীয় ধারণাগুলি সবই আরবের মুশরিকদের বিশ্বাসের অনুরূপ এবং সুস্পষ্ট শিরক। এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা ইতোপূর্বে আলোচনা করেছি। এখানে সংক্ষেপে কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি:

(ক) আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, এগুলি সবই আরবের মুশরিকদের বিশ্বাস। এ বিশ্বাসই ছিল তাদের সকল শিরকের মূল।

(খ) এ সকল চিন্তা সবই মহান আল্লাহর নামে মিথ্যাচার। মহান আল্লাহ কোথাও ঘুনাক্ষরেও বলেন নি যে, তাঁর কাছে যেতে বা দু‘আ কবুল হতে কখনো কারো সুপারিশ বা রিকমেন্ডেশন লাগবে। বরং বারংবার বলেছেন যে, তিনি বান্দার সবচেয়ে কাছে এবং বান্দা ডাকলেই তিনি শুনেন ও সাড়া দেন।

(গ) জাগতিক রাজা-বাদশাহর দরবারে বাইরের অপরিচিত কেউ গেলে তার জন্য সুপারিশ দরকার হয়, তার নিজের দরবারের বা চাকরদের কেউ গেলে তার জন্য সুপারিশ বা অনুমতির দরকার হয় না, কারণ তিনি নিজেই তাকে ভালভাবে চেনেন। আল্লাহর সকল বান্দাই তাঁর দরবারের আপনজন। কাজেই এক চাকরকে দরবারে যেতে আরেক চাকরের অনুমতি বা সুপারিশ লাগবে কেন?

(ঘ) জাগতিক রাজা-বাদশাহ তার দেশের সবাইকে চেনেন না। যে ব্যক্তি তার দরবারে কিছু প্রার্থনা করতে গিয়েছে সে কি প্রতারক, মিথ্যবাদী না সত্যবাদী তা তিনি জানেন না। এজন্য তাকে আমলাদের সুপারিশের উপর নির্ভর করতে হয়। মহান আল্লাহ কি এরূপ? কোনো বান্দার বিষয়ে কোনো পীর, ওলী কি মহান আল্লাহর চেয়ে বেশি জানেন?

(ঙ) জাগতিক রাজা-বাদশাহ ক্রোধ-বশত হয়ত প্রজার উপর কঠোরতা করতে পারেন, এক্ষেত্রে মন্ত্রী-আমলাদের সুপারিশ তার ক্রোধ সম্বরণ করতে সাহায্য করে। মহান আল্লাহ কি তদ্রূপ? মহান আল্লাহর দয়া বেশি না পীর-ওলীগণের দয়া বেশি?

(চ) জাগতিক বিচারালয়ে বিচারক জানেন না যে, সম্পত্তিটি কার পাওনা। উকিল-ব্যারিষ্টার সত্য বা মিথ্যা যুক্তি-তর্ক ও আইনের ধারা দেখিয়ে বিচারককে বুঝাতে চেষ্টা করেন। মহান আল্লাহ কি তদ্রূপ? উকিল সাহেবরা কি মহান আল্লাহকে অজানা কিছু জানাবেন? নাকি তাকে ভুল বুঝিয়ে মামলা খারিজ করে আনবেন? কুরআন কারীমে আল্লাহ বারংবার বলেছেন যে, উকিল হিসেবে তিনিই যথেষ্ট (كفى بالله وكيلاً)[1] এবং তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে উকিল ধরতে নিষেধ করেছেন (ألا تتخذوا من دوني وكيلا)[2]। এরপরও কি তাঁর কাছে অন্য কাউকে উকিল ধরার দরকার আছে?

(ছ) মহান আল্লাহকে মানুষের সাথে বা মানবীয় রাজা-বাদশাদের সাথে তুলনা করা সকল শিরকের মূল। মহান আল্লাহর প্রতি কু-ধারণা ছাড়া এগুলি কিছুই নয়।

(৬) মধ্যস্ততাকারীকে উলূহিয়্যাতের হক্কদার মনে করা

আমরা দেখেছি যে, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের নামে ফিরিশতা ও নবী-ওলীগণের ইবাদত করা হলো আরবের মুশরিকদের অন্যতম শিরক যা কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। ইবাদত অর্থ চূড়ান্ত ও অলৌকিক ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ। এরূপ অনুভুতি নিয়ে পীর-ওলীকে সাজদা করা, তাঁর নাম যপ করা, বিপদে আপদে দূর থেকে তাঁকে ডাকা, তার কাছে ত্রাণ চাওয় ইত্যাদি এ পর্যায়ের শিরক।

[1] সূরা (৪) নিসা: ৮১, ২৩২, ১৭১; সূরা (৩৩) আহযাব: ৩, ৪৮।
[2] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ২ আয়াত।
৫. ৫. ১. ৪. আল্লাহর হুকুম প্রদানের ক্ষমতায় শিরক

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাতের একটি দিক যে, তিনি তাঁর প্রতিপালিতদের জন্য হুকুম, আহকাম বা বিধিবিধান প্রদান করেন। একমাত্র তাঁর নির্দেশই চূড়ান্ত এবং তাঁর নির্দেশই প্রকৃত হালাল বা হারাম অর্থাৎ বৈধতা ও অবৈধতা প্রদান করে। তাঁর বিধান অন্যান্য করার বৈধতায় বিশ্বাস, তাঁর কোনো বিধানের গ্রহণযোগ্যতায় অবিশ্বাস অথবা তিনি ছাড়া অন্য কেউ বিধান প্রদানের চূড়ান্ত ক্ষমতা রাখেন বলে বিশ্বাস করা ইত্যাদি তাঁর প্রতিপালনের তাওহীদের সাথে সাংঘর্ষিক কুফর ও শিরক। সমাজে প্রচলিত এ পর্যায়ের শিরকের বিভিন্ন দিক রয়েছে। সেগুলির অন্যতম:

৫. ৫. ১. ৪. ১. পাপকে বৈধ বলে বিশ্বাস করা

কোনো কর্ম যদি কুরআন-হাদীসের সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীত প্রমাণ দ্বারা পাপ হিসেবে প্রমাণিত হয় তবে সে পাপকে হালাল বা বৈধ বলে বিশ্বাস করা কুফর। অনুরূপভাবে শরীয়তের প্রমাণিত কোনো বিষয় নিয়ে উপহাস করা বা হাসি-মস্করা করাও কুফর। মোল্লা আলী কারী (রাহ) বলেন:

استحلال المعصية صغيرة كانت أو كبيرة إذا ثبت كونها معصية بدلالة قطعية، وكذا الاستهانة بها كفر... وكذا الاستهزاء بالشريعة الغراء كفر.

‘‘কোনো পাপ তা সগীরা হোক বা কবীরা হোক, তা যদি সুনিশ্চিত ও সন্দেহাতীতভাবে পাপ বলে প্রমাণিত হয় তবে তা বৈধ বা হালাল মনে করা কুফর। অনুরূপভাবে কোনো পাপকে হালকা বা গা-সওয়া বলে অবহেলা করাও কুফর। অনুরূপভাবে শরীয়তকে নিয়ে উপহাস বা মস্করা করাও কুফর।’’[1]

এখানে কুফর ও শিরক অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। কারণ বান্দা আল্লাহর বিধান দানের সার্বভৌম ক্ষমতা ও তাঁর বিধানের অলঙ্ঘনীয়তা অস্বীকার করেছে এবং সাথে সাথেই সে নিজেকে বা অন্য কাউকে বিধান বিচারের বা বিধান প্রদানের ক্ষমতার অধিকারী বলে মনে করেছে।

৫. ৫. ১. ৪. ২. আল্লাহর নির্দেশের সমালোচনা বা উপহাস

মহান আল্লাহর কোনো নাম বা নির্দেশ নিয়ে উপহাস করা বা তাঁর মর্যাদার অবমাননাকর কোনো বিশেষণ বা কর্ম তাঁর উপর আরোপ করা এই পর্যায়ের কুফর ও শিরক।[2] সমাজে প্রচলিত এ সকল কুফরের মধ্যে রয়েছে, পর্দা, সালাত, যাকাত, সিয়াম, হজ্জ, বিভিন্ন ইসলামী আইন, চুরির শাস্তি, ব্যভিচারের শাস্তি, মদপানের শাস্তি, মৃত্যুদন্ডের বিধান, তালাকের বিধান বা সুস্পষ্ট ও সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত শরীয়তের কোনো বিধানকে নিয়ে উপহাস করা, তামাশা করা, এরূপ কোনো বিধান অচল, অবৈজ্ঞানিক, অমানবিক বা অনুপযোগী বলে মনে করা, এগুলির প্রতি অন্তরের বিরক্তি বা আপত্তি অনুভব করা, বা এগুলি ইসলামের মধ্যে না থাকলে ইসলাম আরো উন্নত ধর্ম বলে প্রমাণিত হতো বলে মনে করা। এরূপ সকল বিশ্বাস ও ধারণাই উপরের বিশ্বাসের মত কুফর ও শিরক।

৫. ৫. ১. ৪. ৩. আল্লাহর নির্দেশ অমান্যের বৈধতায় বিশ্বাস

আমরা আলোচনা করেছি যে, আল্লাহর নির্দেশের বা ইসলামের বিধিবিধানের প্রতি বিশ্বাসসহ যদি কেউ তার ব্যতিক্রম করে বা অবাধ্যতায় লিপ্ত হয় তবে তা পাপ বলে গণ্য হয়, কুফর বলে গণ্য হয় না। কিন্তু এরূপ কর্মে লিপ্ত মানুষ যদি এরূপ ব্যতিক্রম করাকে বৈধ বলে মনে করে তবে তা কুফর ও শিরক বলে গণ্য হবে। কারণ এতে মহান আল্লাহর রুবূবিয়্যাত, বিধানদান ও তাঁর বিধানের অলঙ্ঘণীয়তা অস্বীকার করা হয় এবং অন্য কারো আল্লাহর বিধানের পর্যালোচনা বা বাতিল করার ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করা হয়।

সমাজে এ পর্যায়ের শিরক-কুফরের দুটি প্রকাশ আছে:

প্রথমত: কুসংস্কারাচ্ছন অজ্ঞ মানুষদের মধ্যে ফকিরী মত সংশ্লিষ্ট অতিভক্তি। এরূপ মানুষেরা বিশবাস করে যে, কোনো মানুষ মহান আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করতে করতে এমন পর্যায়ে যেতে পারে যে, তারপর আর তার শরীয়তের বিধিবিধান পালন করা জরুরী থাকে না এবং তার জন্য শরীয়ত লঙ্ঘন করা বৈধ হয়ে যায়। এরূপ বিশ্বাস সন্দেহাতীতভাবে কুফর ও শিরক। এরূপ বিশ্বাস পোষণকারী যদি নিজে শরীয়ত পালন করেন তবুও তিনি কাফির ও মুশরিক বলে গণ্য হবেন।

আমরা দেখেছি যে, সমাজে শিরক প্রসারের অন্যতম কারণ কুরআন, হাদীস ও সাহাবীগণের জীবনধারা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং পরবর্তী যুগের আওলিয়ায়ে কেরামের নামে প্রচলিত অগণিত সত্য-মিথ্যা বানোয়াট ও আজগুবি কাহিনীর প্রাদুর্ভাব। এ সকল গল্প কাহিনীকে ‘দলীল’ করে এজাতীয় শিরক বিশ্বাসকে সমর্থনের চেষ্টা করা হয়।

দ্বিতীয়ত: আধুনিক শিক্ষিত অথচ ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ মানুষদের ইসলামী আইন বিষয়ক অনুভূতি। অনেক শিক্ষিত মানুষ নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করা সত্ত্বেও এবং ইসলামের কিছু বিধান পালন করা সত্ত্বেও ইসলামী বিধিবিধান, এগুলির বৈজ্ঞানিক প্রেক্ষাপট ও সামাজিক ফলাফল সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং ইসলামের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য ক্রুসেডারদের গত হাজার বছরের মিথ্যা প্রচারণার কারণে অনেক সময় ইসলামের কোনো কোনো বিধানকে সময়ের জন্য অনুপোযোগী অথবা অপেক্ষাকৃত দুর্বল মনে করেন, অথবা অন্য ধর্মের বা সমাজের প্রচলিত বিধানকে উত্তম মনে করেন। এরা সজ্ঞানে বা অজ্ঞাতসারে আল্লাহর বিধানের ব্যতিক্রম বিচার ফয়সালা প্রদানকে বৈধ এবং কোনো অপরাধ নয় বলে মনে করেন। এরূপ ধারণা কুফর ও শিরক। কেউ যদি ব্যক্তিগত দুর্বলতা, লোভ, অসহায়ত্ব, অজ্ঞতা বা অনুরূপ কোনো কারণে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘন করেন বা আল্লাহর নির্দেশের বিপরীতে বিধান বা ফয়সালা প্রদান করেন তবে তা পাপ বলে গণ্য, কুফর বা শিরক নয়। কিন্তু যদি কেউ এরূপ করাকে বৈধ বলে মনে করেন বা আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ অমান্য করার মধ্যে কোনো অপরাধ আছে বলে মনে না করেন তবে তা কুফর ও শিরক বলে গণ্য।

মহান আল্লাহ বলেন:

وَمَنْ لَمْ يَحْكُمْ بِمَا أَنْزَلَ اللَّهُ فَأُولَئِكَ هُمُ الْكَافِرُونَ

‘‘আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই কাফির।’’[3]

এ আয়াত প্রসঙ্গে আল্লামা ইবনু আবিল ইয্য বলেন: ‘‘এখানে একটি বিষয়ের প্রতি বিশেষভাবে লক্ষ্য করতে হবে। তা হলো, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন তা ব্যতীত অন্য কিছু দ্বারা বিধান বা ফয়সালা প্রদান কুফর বলে গণ্য হতে পারে, যে কারণে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ধর্মচ্যুত বা মুরতাদ বলে গণ্য হবে, আবার তা কবীরা বা সগীরা গোনাহ বা পাপ বলে গণ্য হতে পারে, এক্ষেত্রে তা কুফর আসগার অর্থাৎ ক্ষুত্রতর কুফর বা রূপক কুফর বলে গণ্য হবে। বিষয়টি নির্ভর করবে বিচারক বা ফয়সালাকারীর অবস্থার উপরে। বিধানটি যে আল্লাহ প্রদান করেছেন সে বিষয়ে সুনিশ্চিত হওয়া সত্ত্বেও যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুসারে বিধান বা ফয়সালা প্রদান তার জন্য জরুরী নয়, অথবা সে আল্লাহর নির্দেশিত বিধানটিকে অবজ্ঞা করে বা অবহেলা করে তবে তা কুফর আকবার বা পারিভাষিক কুফর ও ধর্মত্যাগ বলে গণ্য হবে।

আর যদি সে বিশ্বাস করে যে, আল্লাহর নাযিলকৃত বিধান অনুসারে ফয়সালা প্রদান জরুরী এবং বিচার্য বিষয়ে আল্লাহর নাযিলকৃত বিধানও সে জানে, কিন্তু সে উক্ত বিধান পরিত্যাগ করে অন্য ভাবে ফয়সালা দান করে এবং স্বীকার করে যে এরূপ করার কারণে সে শাস্তি পাওয়ার যোগ্য, তবে সে পাপী। এরূপ পাপী ব্যক্তিকে রূপক অর্থে বা কুফর আসগরের অর্থে কাফির বলা হয়।

আর যদি সে উক্ত বিষয়ে আল্লাহর বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে, তার সাধ্যমত বিধান সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য চেষ্টা করা সত্ত্বেও অজ্ঞতার কারণে সে ভুল করে তবে সেক্ষেত্রে সে ভুলকারী বলে বিবেচিত। সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করার করণে সাওয়াব ও পুরস্কার লাভ করবে এবং তার ভুলের অপরাধ ক্ষমা করা হবে।’’[4]

[1] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৪।
[2] মোল্লা আলী কারী: শারহুল ফিকহিল আকবার, পৃ. ২৫৫।
[3] সূরা (৫) মায়িদা: ৪৪ আয়াত। তাওরাত বিষয়ে আরো দেখুন: সূরা বাকারা : ৫৩, ৮৭; আল ইমরান: ৩, ৪৮, ৬৫, ৯৩; নিসা: ১৫৩; মায়িদা: ৪৩, ৬৮, ১১০; আন’আম: ৯১, ১৫৪; আ’রাফ: ১৫৪, ১৫৭; তাওবা ১১১; হুদ: ১৭, ১১০; সূরা বনী ইসরাঈল: ২; আম্বিয়া: ৪৮; মুমিনুন: ৪৯; কাসাস: ৪৩; সাজদা: ২৩; গাফির/মুমিন: ৫৩; ফুস্সিলাত: ৪৫; আহকাফ: ১২; ফা্তহ: ২৯; সাফ্ফ: ৬; জুম’আ: ৫ আয়াত।
[4] ইবনু আবিল ইয্য, শারহুল আকীদা আত-তাহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩২৩-৩২৪।

আমরা দেখেছি যে, ইবাদত অর্থ প্রগাড় ভয় ও আশার সাথে কারো সামনে নিজের চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করা। আমরা জানি যে, ইসলামে নবীগণ, আলিমগণ, বয়স্কগণ, নেককার মানুষগণ, পিতামাতা বা শাসক-প্রশাসককে ভালবাসতে, শ্রদ্ধা করতে ও আনুগত্য করতে নির্দেশ দিয়েছে। এদের ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও আনুগত্য প্রকাশ করতে গেলে ভক্তি ও বিনয় আসবেই। পাশাপাশি চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া কারো সামনেই প্রকাশ করা যাবে না। এ দুটি বিষয়ের মধ্যে সীমারেখা রক্ষা করা না গেলে ইবাদতের শিরকের মধ্যে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। এজন্য এ বিষয়ক শিরক আলোচনা আগে এ বিষয়ে কয়েকটি মূলনীতি সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

(১) রুবূবিয়্যাতের শিরক থেকেই ইবাদতের শিরকের উৎপত্তি। কারো মধ্যে ‘অলৌকিক’ ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস করলেই তার প্রতি ‘অলৌকিক’ ভক্তি প্রদর্শনের প্রবণতা জন্ম নেয়। এজন্য কুরআন ও হাদীসে বারংবার উল্লেখ করা হয়েছে যে, মহান আল্লাহ ছাড়া কোনোরূপ কল্যাণ-অকল্যাণের ক্ষমতা আর কারো নেই এবং আল্লাহ কখনো কোনোভাবে কাউকে তা দেন না। শাফা‘আত, কারামাত, মুজিযা, দু‘আ কবুল সবই মহান আল্লাহর ক্ষমতা ও তাঁরই ইচ্ছাধীন। সর্বদা কুরআন ও হাদীস অর্থসহ অধ্যয়নের মাধ্যমে তাওহীদের এ বিশ্বস সুদৃঢ় করাই ইবাদতের শিরক থেকে বাঁচার উপায়।

(২) হাদীস থেকে আমরা জানি যে, মহান আল্লাহ পিতামাতার দু‘আ কবুল করেন এবং আরো জানি যে, তিনি তাঁর নেককার প্রিয় বান্দাদের বা ওলীদের দু‘আ কবুল করেন। দুটি বিষয়ই হাদীসে একইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু কখনোই আমরা দেখব না যে, কোনো মানুষ তার পিতামাতার কাছে দু‘আর জন্য চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। পক্ষান্তরে একজন ‘ওলী’-র সামনে বা তার মাজারের সামনে সে ‘চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত’ব প্রকাশ করছে। এর কারণ সে তার পিতামাতার বিষয়ে নিশ্চিতরূপে জানে যে, পিতামাতার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন, তবে করা না করা আল্লাহ ইচ্ছ। আর ‘ওলী’র ক্ষেত্রে তার ধারণা যে তাঁর দু‘আ কবুল করা আর সেভাবে আল্লাহর ইচ্ছাধীন নেই, বরং তাঁর দু‘আ কবুল হওয়ার বিষয়টি সুনিশ্চিত। মহান আল্লাহ তাঁকে এত ভালবাসেন যে, তাঁর দু‘আ তিনি ফেলতে পারবেন না.... ইত্যদি। আর এরূপ ধারণাই শিরকের উৎস।

(৩) কে কার পিতা ও মাতা তা সকলেই সুনিশ্চিতভাবে জানে। পক্ষান্তরে কে ওলী তা কেউই সুনিশ্চিতভাবে জানে না। আমরা ইতোপূর্বে এ বিষয়ে কুরআন ও হাদীসের নির্দেশনা আলোচনা করেছি এবং পরবর্তী অধ্যায়েও এ বিষয়ে আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত ও শীয়াদের মতামত আলোচনা করব, ইনশা আল্লাহ। তাহলে দেখুন! একজন নিশ্চিত জানেন যে, এ ব্যক্তি তার পিতা বা মাতা এবং নিশ্চিত জানেন যে, পিতা ও মাতার দু‘আ আল্লাহ কবুল করেন। অথচ তা সত্ত্বেও তিনি তাঁর কাছে নিজের চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন না। অথচ তিনিই একজন মানুষকে ‘ওলী’ বলে ধারণা করছেন, যদিও সে ব্যক্তি সত্যই আল্লাহর ওলী কিনা তা কোনোভাবেই তিনি বলতে পারেন না, তারপর তিনি তার বিশেষ অধিকারের ধারণা করছেন এবং এ দুটি ‘ধারণা’র ভিত্তিতে মহান আল্লাহকে বাদ দিয়ে উক্ত ব্যক্তির নিকট নিজের চূড়ান্ত ভক্তি ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছেন।

(৪) ভালবাসা ও ভক্তির ক্ষেত্রে ইসলামী অনুভূতি ও শিরকী অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য লক্ষ্য করুন। শিরকী বিশ্বাসে মানুষ মনে করে যে, এ ব্যক্তি ‘ওলী’, সাধু, ‘সাই বাবা’, ‘অবতার’ বা অনুরূপ কিছু। এ ব্যক্তি হাতে আমাদের কোনো অলৌকিক কল্যাণ বা অকল্যাণের সকল বা কিছু ক্ষমতা আছে। একে আল্লাহ ক্ষমতা দিয়ে দিয়েছেন অথবা তার একটি বিশেষ অধিকার রয়েছে, যাতে তার সুপারিশ তিনি ফেলতে পারবেন না। তাঁকে সম্মান ও ভক্তি করে তাঁর একটু সুনজর লাভ করতে পারলেই তাঁর অলৌকিক প্রভাবে  আমার বিপদ কেটে যাবে বা রোগ সেরে যাবে। আমি নেককর্ম করি বা না-করি তাঁকে ভক্তি করলে তিনি আমাকে পরকালে আমার কান্ডারী হবেন। কাজেই যেভাবে পারি, হাতে ধরে, পায়ে ধরে কোনোভাবে একে খুশি করতে পারলেই আমার উদ্দেশ্য হাসিল হবে।

পক্ষান্তরে ‘‘ওলী’’-র তা’যীমের ক্ষেত্রে একজন মুসলিমের চিন্তা হলো, এই ব্যক্তি আল্লাহর ভালো বান্দা। তিনি আমার মালিকের অনুগত গোলাম। আমার মালিকের গোলামিতে তিনি অগ্রসর বলেই আমি তাঁকে ভক্তি করি ও ভালবাসি, যেন আমার মালিক আল্লাহ খুশি হন। আমি আল্লাহর গোলামিকে ভালবাসি। আর তাঁর গোলামিতে যে ভালো তাকেও ভালবাসি। আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-কে ভালবাসি। তাঁর অনুসারীকেও আমি নিঃশর্তে ও নিস্বার্থে ভালবাসি। আমার এই ভক্তি ও ভালবাসা একান্তই আল্লাহর জন্য ও আল্লাহর উদ্দেশ্যে। এই ব্যক্তির কাছে আমার কোনো চাওয়া- পাওয়া নেই। কোনো ক্ষমতাও তাঁর নেই। তবে আমি জানি যে, আল্লাহর গোলামি ও রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণে লিপ্ত মানুষকে ভালবাসলে আল্লাহ খুশি হন, তাই ভালবাসি। এজন্য যে পদ্ধতিতে এ সকল মানুষকে ভালবাসতে ও সম্মান করতে আল্লাহ ও তাঁর মহান রাসূল (ﷺ)-কে নির্দেশ দিয়েছেন ঠিক সেই পদ্ধতিতে তাঁদের ভালবেসে ও সম্মান করে আল্লাহর রহমত ও সন্তুষ্টি অর্জন করে ধন্য হতে চাই।

(৫) ইতোপূর্বে কুরআন-হাদীসের আলোকে শিরকী কর্মগুলির বর্ণনায় আমরা ইবাদতের শিরকে প্রকারগুলি দেখেছি। আমরা দেখেছি যে, সাজদা, কুরবাণী, উৎসর্গ, জবাই, মানত, দু‘আ, ডাকা, ত্রাণ প্রার্থনা করা, তাওয়াক্কুল, ভয়, আশা, ভালবাসা, আনুগত্য, যিয়ারত, তাবাররুক ইত্যাদি বিষয় শিরকের মূল। আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সাজদা করা, উৎসর্গ, জবাই বা মানত করা, আল্লাহ ছাড়া কাউকে অলৌকিক ভাবে ডাকা বা অনুপস্থিত কাউকে ডাকা ও অলৌকিক সাহায্য প্রার্থনা করা শিরক। অনুরূপভাবে আল্লাহ ছাড়া কারো উপর হৃদয়ের প্রগাড় ভয় ও ভালবাসাসহ চূড়ান্ত ভক্তিময় তাওয়াক্কুল করা, আল্লাহ ছাড়া কারো নাম নিয়ে পথে বের হওয়া, নদীতে ঝাপ দেওয়া, যাত্রা শুরু করা, বাণিজ্য শুরু করা বা যে কোনোভাবে অলৌকিক নির্ভরতা ও তাওয়াক্কুল প্রকাশ করা শিরক। একইভাবে আল্লাহ ছাড়া কাউকে অলৌকিক ভয়, আশা ও ভালবাস শিরক। এছাড়া আল্লাহ ছাড়া কারো চূড়ান্ত ও প্রশ্নাতীত আনুগত্য করা শিরক। যদি কেউ মনে করেন যে, পোপ, পাদরি, পীর, গুরু, সাঁই বাবা, খাজা বাবা, পিতামাতা বা অন্য কেউ যদি কোনো পাপের নির্দেশ দেয় তবে কাজটি শরীয়তে পাপ হলেও আমার জন্য তা জায়েয হয়ে যাবে, অথবা এরূপ কোনো ব্যক্তি যদি কোনো নির্দেশ দেন তবে শরীয়ত বিচার না করে তা পালন করাকে জরুরী হবে, তিনি কোনো কিছুকে বৈধ বললে তা বৈধ হয়ে যাবে, তিনি যদি বলেন এখন থেকে তোমার আর অমুক ফরয ইবাদত করা লাগবে না তাহলে আমার জন্য উক্ত ইবাদতটি অনাবশ্যক হয়ে যাবে ... তাহলে নিঃসন্দেহে তা আনুগত্যের শিরক বলে গণ্য হবে।

(৬) আরবের কাফিরদের জন্য এবং ইহদূী-খৃস্টানদের জন্য যেমন তা শিরক, তেমনি মুসলিম নামধারী কেউ যদি কোনো নবী, ওলী, মাজার, কবর, স্মৃতিময় দ্রব্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে এরূপ কর্ম করে তবে তাও একইরূপ শিরক বলে গণ্য হবে। অজ্ঞতার কারণে কেউ হয়ত মনে করতে পারেন যে, আরবের মুশরিকগণ এ সকল ইবাদত মূতি বা প্রতিমার জন্য করত বলেই কুরআনে তাদের নিন্দা করা হয়েছে। নবীগণ ও ওলীগণ তো আর অক্ষম প্রতিমা নন, বরং তাঁর সক্ষম আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তারা সব শোনেন, দেখেন এবং সুপারিশ করেন, কাজেই তাদেরকে ডাকলে, তাদের উপর তাওয়াক্কুল করলে বা তাদের জন্য মানত করলে অসুবিধা কোথায়। কুরআন ও হাদীসের বর্ণনা সম্পর্কে পরিপূর্ণ অজ্ঞতার কারণেই এরূপ কথা বলা হয়। প্রথমত, যারা মূতিপূজা করেন তারা কখনোই মনে করেন না যে, মাটি বা পাথরের মুর্তিটি তাদের ডাক শোনে বা প্রয়োজন মেটায়। বরং তারা মনে করেন যে, এ মূর্তিটি যার, সে ব্যক্তির আত্মাই তাদের ডাক শোনে এবং প্রয়োজন মেটায়। শুধু তার স্মৃতি হিসেবে মূতিকে তারা সামনে রাখে। আমাদের দেশের যে কোনো হিন্দু পন্ডিতকে জিজ্ঞাসা করলেও তা জানতে পারবেন।

দ্বিতীয়ত, কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট বলা হয়েছে যে, মুর্তি ইত্যাদি জড় পদার্থের পূজা ছাড়াও আরবের মুশরিকগণ ফিরিশতাগণ, নবীগণ ও জিন্নগণেরও ইবাদত করত, খৃস্টানগণ ঈসা (আঃ) ও মরিয়ম (আঃ)-এর ইবাদত করত, ইহূদীগণ উযাইর (আঃ)-এর ইবাদত করত। কুরআন ও হাদীসে এদেরকে ডাকা, ত্রাণ চাওয়া, এদের জন্য মানত, জবাই, উৎসর্গ, তাওয়াক্কুল ইত্যাদি কর্মকে একইভবে শিরক বলে গণ্য করা হয়েছে। উপরে ওসীলা বিষয়ক কুরআনের আয়াতে আমারা দেখেছি যে, মহান আল্লাহ বলেছেন: ‘‘বল, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত যাদেরকে (ইলাহ) ধারণা কর তাদেরকে আহবান কর, তোমাদের দুঃখ-দৈন্য দূর করার অথবা পরিবর্তন করার শক্তি তাদের নেই।’ তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট (ওসীলা) সন্ধান করে, কে কত বেশি নিকটতর হতে পারে, তারা তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে এবং তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ।’’[1]

সাহাবীগণ উল্লেখ করেছেন যে, কাফিররা যে সকল ফিরিশতা ও জিন্নদের ইবাদত করত তাদের বিষয়ে এ কথা বলা হয়েছে। এ সকল ফিরিশতা বা জিন্ন জীবিত ছিলেন, তাঁরা আল্লাহর নেক বান্দা ছিলেন, কিন্তু কুরআনে তাদের ডাকাকে শিরক বলে গণ্য করা হয়েছে এবং স্পষ্টতই বলা হয়েছে যে, বিপদ কাটানোর বা ত্রাণ করার কোনো ক্ষমতা তাদের নেই।

উপরের আলোচনা থেকে সমাজে প্রচলিত ইবাদত বিষয়ক শিরকী কর্মগুলি আমরা সহজেই বুঝতে পারি। তারপরও সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপকভাবে প্রচলিত কিছু শিরকের বিষয়ে একটু বিস্তারিত আলোকপাত করা প্রয়োজন। নিম্নে এ জাতীয় কিছু কর্মের আলোচনা করছি।

[1] সূরা (১৭) ইসরা/ বানী ইসরাঈল: ৫৬-৫৭ আয়াত।

আমরা দেখেছি যে,  কুরআন কারীমে সুস্পষ্টত আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করতে নিষেধ করা হয়েছে। মুসলিম উম্মাহর প্রায় সকল আলিম একমত যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাজদা করাই শির্ক। কারণ, ইবাদত ছাড়া বা চূড়ান্ত ভক্তির প্রকাশ ছাড়া কেউ কাউকে সাজদা করে না। জাগতিক ভয়, ভীতি, সম্মান ইত্যাদির জন্য একজন আরেকজনের পা জড়িয়ে ধরতে পারে, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে একমাত্র অলৌকিক ও অপার্থিব ভক্তি ও বিনয়ের অর্ঘ্য ছাড়া কেউ কারো জন্য সাজদা করে না।

আল্লামা ইবনু আবেদীন বলেন:

والسجود أصل لانه شرع عبادة بلا قيام كسجدة التلاوة، والقيام لم يشرع عبادة وحده، حتى لو سجد لغير الله تعالى يكفر بخلاف القيام.

‘‘সাজদাই হলো মূল; কারণ সাজদা কেবলমাত্র ইবাদত হিসেবেই শরীয়তে নির্ধারিত, কিয়াম বা দন্ডায়মান হওয়া তদ্রূপ নয়, দাঁড়ানো কেবলমাত্র ইবাদত হিসেবে শরীয়তে নির্ধারিত নয়। এজন্য যদি কেউ আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য সাজদা করে তবে সে কাফির বলে গণ্য হবে, দাঁড়ানোর বিষয়টি তদ্রূপ নয়।’’[1]

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ আল্লামা যাইলায়ী বলেন: ‘‘ইমাম মুহাম্মাদের ‘যিয়াদাত’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে যে, সালাতের মধ্যে সাজদাই মুল, কিয়াম বা দাঁড়ানো হলো দাঁড়ানো থেকে সাজদায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে। ... এর কারণ সাজদাই হলো মাটির উপর কপাল রেখে আল্লাহর জন্য চূড়ান্ত ভক্তি-বিনয় প্রকাশ করা। এজন্য যদি কেউ মাটিতে কপাল রেখে আল্লাহ ছাড়া কারো সাজদা করে তবে সে কাফির হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহ ছাড়া কারো জন্য দাঁড়ালে বা রুকু করলে কাফির বলে গণ্য হবে না।’’[2]

হানাফী ফিক্হের অন্যতম ইমাম আল্লামা সারাখসী তাঁর মাবসূত গ্রন্থে বলেন: ‘‘...এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে তাযীম বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য সাজদা করা কুফ্রী।’’[3]

মুসলিম উম্মাহর অনেক আলিম সাজদাকে দুভাগে ভাগ করেছেন: (১) সুজূদু তাহিয়্যাহ (سجود تحية) বা সালামের সাজদা এবং (২) সুজূদু ইবাদাত (سجود عبادة) বা ইবাদতের সাজদা। তাঁরা বলেছেন যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ইবাদতের সাজদা করা সরাসরি শির্ক। আর আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সালাম-জ্ঞাপক সাজদা করা হারাম ও কঠিন গোনাহের কাজ, তবে তা সরাসরি শির্ক বলে গণ্য হবে না। যদি কেউ এরূপ হারাম কাজকে বৈধ বলে বিশ্বাস করে তবে তা কুফর বলে গণ্য হবে।

কুরআন থেকে জানা যায় যে, ফিরিশতাগণ আদমকে সাজদা করেন এবং ইউসুফ (আঃ)-এর পিতামাতা ও ভ্রাতৃগণ তাঁকে সাজদা করেন। তাদের এ সাজদা কিরূপ ছিল তা নিয়ে মুফাস্সিরগণের মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন তারা মাটিতে মাথা রেখে পরিপূর্ণ সাজদা করেন এবং কেউ বলেছেন যে, তারা রুকুর মত মাথা ঝুকিয়ে সালাম করেন, আর রুকু করাকেও কুরআন কারীমে সাজদা বলা হয়েছে।[4] সর্বাবস্থায় এরূপ সালাম জ্ঞাপক সাজদা বা ‘প্রণাম’ করা পূর্ববর্তী শরীয়তে বৈধ ছিল, তবে ইসলামে তা হারাম করা হয়েছে, যেমন ভাইবোনে বিবাহ, দুবোনকে একত্রে বিবাহ, মদপান ইত্যাদি বিষয় পূর্ববর্তী কোনো কোনো শরীয়তে বৈধ ছিল কিন্তু ইসলামী শরীয়তে হারাম করা হয়েছে।

আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সম্মান জ্ঞাপক বা সালাম জ্ঞাপক সাজদা করার নিষেধাজ্ঞা বিষয়ক হাদীসগুলি মুতাওয়াতির পর্যায়ের। আবূ হুরাইরা, মু‘আয ইবনু জাবাল, সুহাইব, যাইদ ইবনু আরকাম, আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস, সুরাকা ইবনু মালিক, আয়েশা, ইসমাহ, আনাস ইবনু মালিক, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী আওফা, কাইস ইবনু সা’দ () প্রমুখ সাহাবী থেকে বিভিন্ন সনদে এ বিষয়ে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে।[5] এক হাদীসে আয়েশা (রাঃ) বলেন,

إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ (ﷺ) كَانَ فِي نَفَرٍ مِنْ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنْصَارِ فَجَاءَ بَعِيرٌ فَسَجَدَ لَهُ فَقَالَ أَصْحَابُهُ يَا رَسُولَ اللَّهِ تَسْجُدُ لَكَ الْبَهَائِمُ وَالشَّجَرُ فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَسْجُدَ لَكَ فَقَالَ اعْبُدُوا رَبَّكُمْ وَأَكْرِمُوا أَخَاكُمْ وَلَوْ كُنْتُ آمِرًا أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا, وفي حديث آخر: لاَ يَنْبَغِيْ لأَحَدٍ أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ ... وفي حديث آخر: لاَ يَصْلُحُ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ وَلَوْ صَلَحَ لِبَشَرٍ أَنْ يَسْجُدَ لِبَشَرٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا

‘‘রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর কতিপয় মুহাজির ও আনসার সাহাবীর সাথে অবস্থান করছিলেন। এমতাবস্থায় একটি উট এসে তাঁকে সাজদা করে। তখন সাহাবীগণ বলেন, হে আল্লাহর রাসূল, এ সকল অবলা জীব-জানোয়ার ও বৃক্ষলতা আপনাকে সাজদা করে, কাজেই আমাদেরই অধিকার বেশি যে আমরা আপনাকে সাজদা করব। তখন তিনি বলেন, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের ইবাদত কর এবং তোমাদের ভ্রাতাকে সম্মান কর। আমি যদি কাউকে অন্যের সাজদা করতে বলতাম তবে স্ত্রীকে বলতাম তার স্বামীকে সাজদা করতে। অন্য হাদীসের বর্ণনায় তিনি বলেন: ‘‘কারো জন্য বৈধ নয় অন্যকে সাজদা করা’’, অন্য হাদীসে: কোনো মানুষের জন্য বৈধ নয় অন্য মানুষকে সাজদা করা; যদি কোনো মানুষের জন্য অন্য মানুষকে সাজদা করা বৈধ হতো, তবে আমি স্ত্রীকে আদেশ করতাম তার স্বামীকে সাজদা করতে।[6]

অন্য হাদীসে মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) বলেন:

إِنَّهُ أَتَى الشَّامَ فَرَأَى النَّصَارَى يَسْجُدُونَ لأَحْبَارِهِمْ وَعُلَمَائِهِمْ وَفُقَهَائِهِمْ فَقَالَ لأَيِّ شَيْءٍ تَفْعَلُوْنَ هذا قَالُوا هذِه تَحِيَّةُ الأَنْبِيَاءِِ. قُلْنَا فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَصْنَعَ بِنَبِيِّنَا (ﷺ) فَلَمَّا قَدِمَ عَلَى النَّبِيِّ (ﷺ) سَجَدَ فَقَالَ: مَا هذا يَا مُعَاذُ؟ قَالَ: إِنِّي أَتَيْتُ الشَّامَ فَرَأَيْتُ النَّصَارَى يَسْجُدُونَ لأَسَاقِفَتِهِمْ وَقِسِّيْسِهِمْ وَرُهْبَانِهِمْ وَبَطَارِقَتِهِمْ وَرَأَيْتُ الْيَهُوْدَ يَسْجُدُونَ لأَحْبَارِهِمْ وَفُقَهَائِهِمْ وَعُلَمَائِهِمْ فَقُلْتُ لأَيِّ شَيْءٍ تَصْنَعُونَ هذا وَتَفْعَلُوْنَ هذا قَالُوا هذه تَحِيَّةُ الأنْبِيَاءِ قُلْتُ فَنَحْنُ أَحَقُّ أَنْ نَصْنَعَ بِنَبِيِّنَا فَقَالَ نَبِيُّ اللهِ (ﷺ): إنهم كَذَبُوا عَلَى أَنْبِيَائِهِمْ كَمَا حَرَّفُوا كِتَابَهُمْ، (في روياة ابن ماحه: لاَ تَفْعَلُوا) لَوْ أَمَرْتُ أَحَدًا أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ الْمَرْأَةَ أَنْ تَسْجُدَ لِزَوْجِهَا

‘‘তিনি সিরিয়া গমন করেন। তথায় তিনি দেখেন যে, খৃস্টানগণ তাদের নেককার বুজুর্গগণ ও আলিমদেরকে সাজদা করে। তিনি বলেন, তোমরা কেন এরূপ কর? তারা উত্তরে বলে: এ হলো নবীগণের তাহিয্যাহ বা সালাম। আমরা বললাম: আমাদের নবীকে এরূপ করার অধিকার আমাদের বেশি। তিনি যখন নবী (ﷺ)-এর নিকট প্রত্যাগমন করলেন তখন তিনি তাঁকে সাজদা করলেন। তিনি বলেন: হে মু‘আয, এ কি? তিনি বলেন, আমি সিরিয়ায় গমন করে দেখলাম যে, খৃস্টানগণ তাদের পাদরি, দরবেশ ও বিশপদের সাজদা করে এবং ইহূদীগণ তাদের আলিম ও বুজুর্গ ও ফকীহদের সাজদা করে। আমি বললাম, তোমরা এ কি কর? তারা বলে বলে, এ হলো নবীগণের সালাম। আমি বললাম: আমাদের নবীকে এরূপ করার অধিকার তো আমাদের বেশি। তখন নবীউল্লাহ (ﷺ) বলেন, ওরা ওদের নবীগণের নামে মিথ্যা বলেছে, যেমন ওরা নবীগণের কিতাব বিকৃত করেছে। তোমরা এরূপ করো না। আমি যদি কোনো মানুষকে অন্য মানুষের সাজদা করার নির্দেশ দিতাম তবে আমি স্ত্রীকে তার স্বামীর সাজদা করতে নির্দেশ দিতাম।’’[7]

অন্য হাদীসে কাইস ইবনু সা’দ (রাঃ) বলেন:

أَتَيْتُ الْحِيْرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ فَقُلْتُ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) أَحَقُّ أَنْ يُسْجَدَ لَهُ فَأَتَيْتُ رَسُولَ اللهِ (ﷺ) فَقُلْتُ أِنِّي أَتَيْتُ الْحِيْرَةَ فَرَأَيْتُهُمْ يَسْجُدُونَ لِمَرْزُبَانٍ لَهُمْ، فَأَنْتَ رَسُولُ اللهِ (ﷺ) أَحَقُّ أَنْ يُسْجَدَ لَكَ قَالَ أَرَأَيْتَ لَوْ مَرَرْتَ بِقَبْرِيْ أَكُنْتَ تَسْجُدَ لَهُ قُلْتُ لاَ قَالَ فَلاَ تَفْعَلُوا لَوْ كُنْتُ آمِراً أَحَداً أَنْ يَسْجُدَ لأَحَدٍ لأَمَرْتُ النِّسَاءَ أَنْ يَسْجُدْنَ لأَزْواجِهِنَّ

‘‘আমি (পারস্যের সীমান্তবর্তী) হীরা নামক স্থানে গমন করি। আমি দেখলাম যে, তারা তাদের একজন নেতাকে সাজদা করছে। তখন আমি বললাম, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অধিকার বেশি যে তাঁর জন্য সাজদা করা হবে। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নিকট আগমন করে বলি, ‘আমি হীরা গমন করে দেখলাম যে, তারা তাদের একজন নেতাকে সাজদা করছে। আপনি আল্লাহর রাসূল, আপনারই অধিকার বেশি যে আপনার জন্য সাজদা করা হবে। তিনি বলেন, তুমি বলতো, তুমি যদি আমার কবরের নিকট গমন কর, তখন কি তুমি কবরকে সাজদা করবে? আমি বললাম: না। তিনি বলেন, তোমরা এরূপ করবে না, আমি যদি কোনো মানুষকে অন্য মানুষের সাজদা করতে অনুমতি দিতাম তবে স্ত্রীগণকে অনুমতি দিতাম তাদের স্বামিগণকে সাজদা করতে।’’[8]

উপরের হাদীসগুলি আলোচনা করে আল্লামা কুরতুবী বলেন:

وهذا السجود المنهي عنه قد أتخذه جهال المتصوفة عادة في سماعهم وعند دخولهم على مشايخهم وأستغفارهم فيرى الواحد منهم إذا أخذه الحال بزعمه يسجد للأقدام لجهله سواء أكان للقبلة أم غيرها جهالة منه ضل سعيهم وخاب أملهم

‘‘এ সকল হাদীসে যে সাজদা নিষেধ করা হয়েছে সে সাজদা জাহিল সূফীগণ তাদের রীতিতে পরিণত করেছে তাদের সামার মাজলিসে এবং তাদেরর পীর-মাশাইখের নিকট প্রবেশের সময়ে এবং তাদের দু‘আ-ইসতিগফারের সময়ে। তাদেরকে আপনি দেখবেন যে, তাদের দাবিমত যখন তাদের কারো হাল এসে যায় তখন পায়ের কাছে সাজদায় পড়ে যায় কিবলামুখি অথবা অন্যমুখি হয়ে। তাদের মুর্খতার কারণেই তা তারা করে। তাদের কর্ম বিভ্রান্ত হয়েছে এবং তাদের আশা বিনষ্ট হয়েছে।’’[9]

ইবাদতের বা ‘তাযীমের’ সাজদা ও তাহিয়্যাহ বা সালাম-সম্ভাষণমূলক সাজদার মধ্যে পার্থক্য এই যে, তাহিয়্যা বা সালামের সাজদা জাগতিক, লৌকিক ও মানবীয় সাধারণ কর্মের অন্তর্ভুক্ত। তা চূড়ান্ত বা অলৌকিক ভক্তি নয়, বর সাধারণ ও লৌকিক ভক্তি। অলৌকিক ভয়, ভালবাসা বা ভক্তির কারণে মানুষ তা করে না, বরং লৌকিক শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে তা করে। এর প্রচলন যে সমাজে রয়েছে সে সমাজের বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী, সকল মানুষই তার পিতা, মাতা, শিক্ষক, সমাজপতি বা রাজাকে এভাবে সম্মান প্রদর্শন করে। যেমন অন্য সমাজে দাঁড়িয়ে, মাথা ঝুকিয়ে বা স্যালুট দিয়ে এরূপ শিষ্টাচার প্রদর্শন করা হয়। এরূপ সাজদা পূর্ববর্তী কোনো কোনো শরীয়তে বৈধ ছিল এবং ইসলামে তা সুস্পষ্টরূপে নিষিদ্ধ ও হারাম বলে ঘোষণা করা হয়েছে।

পক্ষান্তরে ইবাদতের সাজদা হলো চূড়ান্ত ও অলৌকিক ভক্তি। মানুষ যাকে অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বলে বিশ্বাস করে তার কাছে নিজের চূড়ান্ত সমর্পন, অসহায়ত্ব ও অলৌকিক ভক্তি প্রদর্শনের জন্য এরূপ সাজদা করে। পিতা, মাতা, সমাজপতি, রাজা বা সাধারণ মানবীয় ক্ষমতা বা মর্যাদার অধিকারীকে কেউ এরূপ সাজদা করে না, বরং স্রষ্টা, স্রষ্টার সাথে সম্পর্কিত কোনো অলৌকিক ক্ষমতা বা সম্পর্কযুক্ত দ্রব্য, ব্যক্তি বা ব্যক্তির স্মৃতিবিজড়িত স্থানেই সে এরূপ সাজদা করে। সকল শরীয়তেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে এরূপ সাজদা করা সরাসরি শির্ক ও কুফর।

আল্লামা শাইখ মুহাম্মাদ ইবনু হুসাইন ইবনু আলী আত-তূরী আল-কাদেরী আল-হানাফী (মৃ. ১১৩৮ হি) ‘তাকমিলাতুল বাহরির রায়িক’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘রাজা-বাদশার সামনে যে সাজদা করা হয় তা হারাম। যে করে এবং যে এরূপ কর্মে রাযি থাকে উভয়েই পাপী। কারণ এ কর্ম মুর্তিপূজকদের অনুকরণ। সাদর শহীদ উল্লেখ করেছেন যে, এরূপ সাজদার কারণে কাফির বলে গণ্য হবে না, কারণ সে শুধু সালাম বা সম্মান প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে এরূপ করেছে। শামসুল আয়িম্মা সারাখসী বলেন: তাযীম বা সম্মানপ্রদর্শনের জন্য আল্লাহ ছাড়া কারো সাজদা করা কুফ্রী।’’[10]

আল্লামা শামী তাঁর ‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার গ্রন্থে বলেন:

تَقْبِيلِ الأَرْضِ بَيْنَ يَدَيْ الْعُلَمَاءِ وَالْعُظَمَاءِ فَحَرَامٌ وَالْفَاعِلُ وَالرَّاضِي بِهِ آثِمَانِ لأَنَّهُ يُشْبِهُ عِبَادَةَ الْوَثَنِ وَهَلْ يَكْفُرَانِ: عَلَى وَجْهِ الْعِبَادَةِ وَالتَّعْظِيمِ كُفْرٌ وَإِنْ عَلَى وَجْهِ التَّحِيَّةِ لا وَصَارَ آثِمًا مُرْتَكِبًا لِلْكَبِيرَةِ

‘‘আলিম ও সম্মানিত ব্যক্তিদের সামনে ভূমি-চুম্বন বা জমিন-বুসী করা হারাম। যে ব্যক্তি তা করে এবং যে তাতে রাজি থাকে উভয়েই পাপী; কারণ তা মূর্তিপূজার অনুকরণ। এখন প্রশ্ন হলো: এরূপ ভূমি-চুম্বন-কারী এবং তাতে সন্তুষ্ট ব্যক্তি কাফির বলে গণ্য হবে কিনা? যদি ইবাদত ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য তা করে তবে তা কুফর বলে গণ্য। আর যদি সালাম বা সম্ভাষণ প্রদানের জন্য করে তাবে কুফর হবে না, তবে এরূপ ব্যক্তি কবীরা গোনাহে লিপ্ত বলে গণ্য হবে।’’[11]

লক্ষণীয় যে, পিতা, মাতা, সমাজপতি, রাজা ও অন্যান্য জাগতিক ব্যক্তিবর্গের ক্ষেত্রে তাহিয়্যার সাজদা বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য সালাম জ্ঞাপক সাজদার কল্পনা করা গেলেও নবী, ওলী বা অলৌকিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে পরিচিত কারো ক্ষেত্রে বা কারো কবর-মাযারের ক্ষেত্রে তাহিয়্যার সাজদা কল্পনা করা যায় না। কারণ মানুষ যখন তার মাতা, পিতা, শিক্ষক বা রাজাকে সাজদা করে তখন সে কোনো অলৌকিক বা অপার্থিব ভয় বা ভক্তি নিয়ে তা করে না, বরং একান্তই জাগতিক ভয়, ভক্তি বা শিষ্টাচার হিসেবে তা করে। পক্ষান্তরে অলৌকিক ব্যক্তিত্বদেরকে কখনোই কেউ লৌকিক শিষ্টাচার হিসেবে সাজদা করে না, বরং অলৌকিক ও চূড়ান্ত ভক্তি হিসেবেই সাজদা করে। এজন্য চাঁদ, সূর্য, কবর, স্মৃতিস্তম্ভ, স্মৃতিচিহ্ন, প্রতিকৃতি, মূর্তি, পূজনীয় ব্যক্তি বা দ্রব্যকে সাজদা করলে তা ব্যাখ্যতীতভাবে শিরক বলে গণ্য হবে।

আরো লক্ষণীয় যে, তাহিয়্যাহ বা শিষ্টাচারের সাজদার অস্তিত্ব মূলত ইসলামের আগমনের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায়। মুসলিম সমাজে ইবাদত হিসেবে আল্লাহকে সাজদা করা ছাড়া অন্য কোনোরূপ সাজদার প্রচলন থাকে না। অনুরূপভাবে অন্যান্য ধর্মে ও সমাজেও মূলত অলৌকিক ব্যক্তিত্ব, মূর্তি, বস্ত্ত ইত্যাদিরই সাজদা করা হয়ে থাকে। এজন্যই মুসলিম উম্মাহর অধিকাংশ আলিম উভয় প্রকারের সাজদার মধ্যে কোনোরূপ পার্থক্য না করেই আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সাজদা করা সরাসরি কুফর বা শিরক বলে গণ্য করেছেন। আর যারা পার্থক্য করেছেন তাঁরা একমত যে, আল্লাহ ছাড়া কাউকে তাহিয়্যার সাজদা করা হারাম এবং এরূপ হারাম কর্মকে বৈধ বলে মনে করা কুফর।

[1] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ১/৪৮০, ৬/৪২৬।
[2] যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকায়িক ২/৩২৫।
[3] সারাখসী, আল-মাবসূত ২৭/৪২২; যাইলায়ী, তাবয়ীনুল হাকাইক ১৬/৪০০।
[4] সূরা (২) বাকারা ৫৮; সূরা (৪) নিসা: ১৫৪; সূরা (৭) আ’রাফ: ১৬১ আয়াত।
[5] তিরমিযী, আস-সুনান ৩/৪৬৫; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৯৫; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৯/৪৭০, ৪৭৯; হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/২০৬, ৪/১৮৯-১৯০; যিয়া আল-মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৫/২৬৬, ৬/১৩১; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩০৬-৩১১, ৯/৪-৯।
[6] হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩১০; ইবনু হিববান, আস-সহীহ ৯/৪৭০-৪৭৯; মাকদিসী, আল-আহাদীসুল মুখতারাহ ৫/২৬৬। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[7] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ৪/১৯০; ইবনু মাজাহ, আস-সুনান ১/৫৯৫; হাইসামী, মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/৩০৯-৩১০। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[8] হাকিম, আল-মুসতাদরাক ২/২০৪। হাদীসটির সনদ সহীহ।
[9] কুরতুবী, জামি লি আহকামিল কুরআন ১/২৯৪।
[10] মুহাম্মাদ ইবনু হুসাইন তূরী, তাকমিলাতুল বাহরির রায়িক ৮/৩৬৪।
[11] ইবনু আবিদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ৬/৩৮৩।

কোনো কিছুর চারিদিকে আবর্তন করাকে তাওয়াফ বলা হয়। সাজদা ও সালাতের মতই তাওয়াফ একটি ইবাদত। সালাত-সাজদা ও তাওয়াফের মধ্যে পার্থক্য এই যে, বিশ্বের যে কোনো স্থানে থেকে কাবা ঘরের দিকে মুখ করে আল্লাহর জন্য সালাত ও সাজদার ইবাদত আদায় করা যায়। পক্ষান্তরে আবর্তন বা তাওয়াফের ইবাদত একমাত্র কাবা গৃহের চারিদিকে আবর্তনের মাধ্যমে আল্লাহর জন্য এ ইবাদত পালন করা যায়। মহান আল্লাহ বলেন:

وَلْيَطَّوَّفُوا بِالْبَيْتِ الْعَتِيقِ

‘‘এবং তারা তাওয়াফ করুক প্রাচীন গৃহের।’’[1]

কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাওয়াফ করা দুভাবে হতে পারে:

প্রথমত, মহান আল্লাহর প্রতি চূড়ান্ত ভালবাসা ও ভয়ের সাথে একমাত্র তাঁরই প্রতি চূড়ান্ত ভক্তি প্রকাশের জন্য, অর্থাৎ একমাত্র তাঁরই ইবাদতের উদ্দেশ্যে কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোথাও তাওয়াফ করা। এরূপ করা কঠিন হারাম ও নিষিদ্ধ, যেমন মহান আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্যে কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোনো কিছুর দিকে মুখ করে সালাত আদায় করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ও হারাম। কেউ যদি কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোনো দিকে মুখ করে সালাত আদায় অথবা কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোনো কিছুকে আল্লাহর ইবাদত হিসেবে তাওয়াফ করা  বৈধ মনে করে তবে তা শিরক ও কুফর বলে গণ্য।

দ্বিতীয়ত, আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো প্রতি ভক্তি প্রকাশের জন্য কোথাও তাওয়াফ করা। এরূপ করা সুস্পষ্টতই শিরক, যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো তা’যীম বা সম্মান প্রদর্শনের জন্য তাকে সামনে রেখে তার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করা। লক্ষণীয় যে, শুধু আল্লাহকে খুশি করতে এবং তাঁরই প্রতি ভক্তি জানাতে কাবা ঘর ছাড়া অন্য কোনো বস্ত্তকে কেউই তাওয়াফ করে না। যারা কোনো কবর, স্মৃতিবিজড়িত স্থান বা অন্য কিছুর তাওয়াফ করেন তারা আল্লাহর ইবাদতের কথা বললেও পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির প্রতি ভক্তি প্রদর্শন ও তাঁর নেক-নজর লাভেরও উদ্দেশ্য তাদের থাকে। নইলে কাবা ঘর বাদ দিয়ে অন্যত্র তাওয়াফ করবেন কেন?

[1] সূরা (২২) হাজ্জ: ২৮ আয়াত।
৫. ৫. ২. ৩. গাইরুল্লাহকে ডাকা বা অলৌকিক প্রার্থনা

আমরা ইতোপূর্বে দু‘আ, সাহায্য প্রার্থনা, ত্রাণ প্রার্থনা ইত্যাদির লৌকিক ও অলৌকিক পর্যায়গুলি আলোচনা করেছি। আমরা দেখেছি যে, দৃশ্যমান বা অদৃশ্য উপস্থিত কোনো মানুষ, জিন্ন বা ফিরিশতার কাছে লৌকিক ও জাগতিক সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনা করা যায়। কিন্তু অলৌকিক ত্রাণ একমাত্র মহান আল্লাহ ছাড়া কারো কাছে চাওয়া যায় না। দূরে অবস্থিত বা অনুপস্থিত কারো কাছে লৌকিক বা অলৌকিক সাহায্য চাওয়া এবং উপস্থিত বা অনুপস্থিত কারো কাছে অলৌকিক সাহায্য চাওয়া শিরক।

আমরা আরো দেখেছি যে, ইহূদী, খৃস্টান ও আরবের মুশরিকগণের অন্যতম শিরক ছিল সাধারণ বিপদে আপদে ফিরিশতাগণ, নবীগণ, জিন্নগণ, ওলীগণ বা অন্যান্য কাল্পনিক দেব দেবীদের ডাকা ও তাদের কাছে সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনা করা। তারা সকলেই বিশ^াস করত যে, একমাত্র আল্লাহই সর্বশক্তিমান প্রতিপালক এবং তাঁর ইচছার বাইরে কারো কিছু করার নেই। তবে তারা বিশ্বাস করত যে, এ সকল বান্দাকে আল্লাহ কিছু ক্ষমতা প্রদান করেছেন। আল্লাহ এদের সুপারিশ শুনেন এবং এদের ডাকলে তিনি খুশি হন। অবিকল একইরূপ বিভ্রান্তির কারণে মুসলিম সমাজেও এ ধরনের শিরক প্রসার লাভ করেছে। শাহ ওয়ালি উল্লাহর বক্তব্যে আমরা তা দেখেছি।

অগণিত মিথ্যা কল্প-কাহিনী, জনশ্রুতি ও শেষ যুগের কোনো কোনো আলিম নামধারী ব্যক্তির মতামতই এরূপ শিরকে লিপ্ত মানুষদের একমাত্র দলীল। এগুলির বিপরীতে একমাত্র আল্লাহকে ডাকার জন্য কুরআন ও হাদীসের অগণিত নির্দেশনার কোনো মূল্যই তারা দেন না। এ প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভী বলেন: ‘‘কবর পূজারিগণ যে সমস্ত কারণে কবর পূজা করিয়া থাকে উহাদের মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হইল নিজেদের কুকর্মের সমর্থনে মিথ্যা হাদীস সৃষ্টি করা নিজেদের মনগড়া এই জাতীয় হাদীস প্রচার করিয়া সরল প্রাণ মুসলমানদিগকে ধোকা দিয়া আল্লাহর পথ হইতে দূরে সরাইয়া লইয়া যায়। ..... কবর পূজারী সম্প্রদায় তাহাদের কুকর্মের সমর্থনে যে সমস্ত অলীক ও মনগড়া কাহিনীর অবতারণা করিয়া জনসাধারণকে বিভ্রান্ত ও পথভ্রষ্ট করিয়া থাকে উহা সত্যিই প্রণিধানযোগ্য। যেমন তাহারা বলিয়া থাকে যে, অমুক ব্যক্তি কঠিন বিপদে পড়িয়া একেবারে দিশাহারা হইয়া পড়ে। মুক্তির কোন পথ দেখিতে না পাইয়া অমুক দরবেশের মাজারে গিয়া বিপদমুক্ত হওয়ার জন্য প্রার্থনা জানায়। কি আশ্চর্য! সেই দরবেশ তাহাকে দুই-একদিনের মধ্যে সমস্ত বিপদাপদ দূর করিয়া দেয়। অমুক ব্যক্তি আসমানী বালায় নিপতিত হইলে অনোন্যপায় হইয়া অমুক কবরের দরবেশকে একাগ্রতার সাথে স্মরণ করিতে থাকে। দেখিতে দেখিতে আসমানী বালা দূর হইয়া যায়। এমনকি কেহ কেহ নিজের কথাও বলিয়া থাকে যে, আমি অমুক বিপদে পতিত হইয়া শেষ চেষ্টা স্বরূপ অমুক পীরের মাজারে নযর-নেওয়াজ লইয়া গিয়া তাহার সকল বিপদ দূর করিয়া দেয় .....

নাউযুবিল্লাহ! আল্লাহ আমদের সকলকে এই শিরক ও বিদআত হইতে নিরাপদ রাখুন।... ঘর হইতে পা বাড়াইলেই যে আল্লাহর খালেছ ইবাদতখানা মসজিদ সেখানে যাওয়ার কষ্টটুকু ইহারা স্বীকার করিতে চায় না। অথচ মাইলের পর মাইল, দিনের পর দিন হাঁটিয়া গিয়া কবরের নিকট ধর্ণা দিয়া পড়িয়া থাকাকেই শ্রেয় মনে করে।... ইহারা যদি কবরে না গিয়া রাস্তাঘাট, হাট-বাজর অথবা গোসলখানায় বসিয়াও এমন কাকুতি-মিনতি ও একাগ্রতার সাথে কান্নাকাটি করিয়া মুক্তি লাভের জন্য প্রার্থনা করিত তবুও আল্লাহ তাদের দোআ কবুল করিতেন, তাহাদের দু‘আ ব্যর্থ হইত না। সুতরাং এই অবস্থায় কবরের বুযর্গী ও প্রভাব মনে করা অজ্ঞতা ও কুসংস্কার ব্যতীত কিছই নহে। আল্লাহ বিপদাপন্নের দোআ যে সকল সময়ই কবুল করিয়া থাকেন ইহা এই অজ্ঞেরা বুঝিতে চায় না। এমন কি কাফেরও যদি আল্লাহর নিকট একাগ্রতার সাথে দোআ করে আল্লাহ তাহাও কবুল করিয়া থাকেন।... ।’’[1]

কেউ কেউ এরূপ শিরককে ‘ওসীলা ধরা’ বলে চালাতে চান। তারা বলেন যে, যারা বিপদে আপদে ওলীগণের নাম ধরে ডাকেন ও সাহায্য চান, তাঁরা মনে করেন না যে, ওলীগণের নিজস্ব ক্ষমতা আছে, বরং সকলেই জানে যে, একমাত্র আল্লাহই সর্বশক্তিমান। তবে তারা আল্লাহর কাছে ওসীলা হিসেবে এদের ডাকেন। আমরা দেখেছি যে আরবের মুশরিকগণও ঠিক একইরূপ যুক্তি পেশ করত। কারো ওসীলা দিয়ে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়া আর অনুপস্থিত কারো কাছে গাইবী বা অলৌকিক সাহায্য চাওয়ার মধ্যে আসমান ও যমীনের পার্থক্য। প্রথম কর্ম শিরক নয়, কিন্তু দ্বিতীয়টি সুস্পষ্ট শিরক।

প্রসিদ্ধ তাফসীর-গ্রন্থ ‘রূহুল মা‘আনী’র প্রণেতা আল্লামা শিহাব উদ্দীন মাহমূদ আল আলূসী আল-হানাফী (১২৭০ হি) তাঁর তাফসীরের বিভিন্ন স্থানে এ ধরনের শিরকের বিষয়টি আলোচনা করেছেন। আল্লাহ বলেন:

هُوَ الَّذِي يُسَيِّرُكُمْ فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ حَتَّى إِذَا كُنْتُمْ فِي الْفُلْكِ وَجَرَيْنَ بِهِمْ بِرِيحٍ طَيِّبَةٍ وَفَرِحُوا بِهَا جَاءَتْهَا رِيحٌ عَاصِفٌ وَجَاءَهُمُ الْمَوْجُ مِنْ كُلِّ مَكَانٍ وَظَنُّوا أَنَّهُمْ أُحِيطَ بِهِمْ دَعَوُا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ لَئِنْ أَنْجَيْتَنَا مِنْ هَذِهِ لَنَكُونَنَّ مِنَ الشَّاكِرِينَ

‘‘তিনিই তোমাদের জলে-স্থলে ভ্রমন করান এবং তোমরা যখন নৌকারোহী হও এবং এগুলি আরোহী লয়ে অনুকূল বাতাসে বয়ে যায় এবং তারা তাতে আনন্দিত হয়, অতঃপর এগুলি বাত্যাহত এবং সর্বদিক হতে তরংগাহত হয় এবং তারা তা দ্বারা পরিবেশিষ্টত হয়ে পড়েছে বলে মনে করে, তখন তারা আনুগত্যে বিশুদ্ধ-চিত্ত হয়ে আল্লাহকে ডেকে বলে: তুমি আমাদেরকে ত্রাণ করলে আমরা অবশ্য কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত হবো।’’[2]

এ আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী (রাহ) বলেন: ‘‘এ আয়াত প্রমাণ করে যে, এরূপ অবস্থায় মুশরিকগণ মহান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ডাকত না। আর আপনি ভালই অবগত আছেন যে, আজকাল মানুষেরা কি করে! জলে বা স্থলে যখন কোনো কঠিন বিপদ বা বড় কোনো সমস্যার মধ্যে তারা নিপতিত হয় তখন তারা এমন ব্যক্তিদেরকে ডাকে যারা কোনো ক্ষতি করেন না এবং উপকারও করেন না, যারা দেখেনও না এবং শুনেনও না। তাদের কেউ খিযির এবং ইলিয়াসকে ডাকে। আর কেউ আবুল খামীস এবং আববাস (আঃ)-কে ডাকে। কেউ বা কোনো একজন ইমামকে ডাকে। কেউ বা উম্মাতের বুজুর্গ-মাশাইখের মধ্য থেকে কারো কাছে আকুতি আবেদন পেশ করে। তাদের মধ্যে একজনকে দেখবেন না যে শুধু তার মালিক-মাওলাকে ডাকছে এবং শুধু তাঁর কাছেই আকুতি আবেদন পেশ করছে। সম্ভবত তার মনের কোনে একবারও এ চিন্তা উকি দেয় না যে, যদি সে একমাত্র আল্লাহকে ডাকত তবে এ সকল বিপদ থেকে রক্ষা পেত। হে পাঠক, আল্লাহর কসম দিয়ে আমি আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, বলুন তো, এ দিক থেকে মক্কার মুশরিকগণ এবং বর্তমানের মানুষদের মধ্যে কোন দল অধিকতর হেদায়াত প্রাপ্ত? উভয় প্রার্থনাকারী ও আহবানকারীর মধ্যে কার প্রার্থনা অধিকতর সত্য? আল্লাহর নিকটেই মনোবেদনা জ্ঞাপন করছি এমন এক যুগে, যে যুগে অজ্ঞতার প্রবল ঘুর্ণিঝড় সকলকে আচ্ছন্ন করেছে, বিভ্রান্তির প্রবল ঢেউ বিশাল আকৃতি নিয়ে আছড়ে পড়ছে, শরীয়তের নৌকার রশি ছিন্ন হয়েছে গাইরুল্লাহর নিকট সাহায্য ও ত্রাণ প্রার্থনাকেই মুক্তির ওসীলা রূপে গণ্য করা হয়েছে, জ্ঞানীদের জন্য সৎকাজে আদেশ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে এবং অন্যায় থেকে নিষেধ করার ক্ষেত্রে নানপ্রকারের বিপদ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’[3]

[1] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৪৪-৪৭।
[2] সূরা (১০) ইউনুস: ২২ আয়াত।
[3] আলূসী, রুহূল মাআনী ৭/৪৭৪।
৫. ৫. ২. ৪. গাইরুল্লাহর জন্য মানত-নযর বা উৎসর্গ

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, মহান আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য মানত, উৎসর্গ, জবাই, কুরবানী ইত্যাদি শিরক। জীবিত বা মৃত কোনো পীরের নামে, বাবার নামে, ওলীর নামে, তাঁর মাযারের নামে মানত করা, জবাই করা, মানত বা উৎসর্গের মাধ্যমে আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো সন্তুষ্টির উদ্দেশ্য পোষণ করা এ পর্যায়ের শিরক।

প্রসিদ্ধ হানাফী ফকীহ মুহাম্মাদ ইবনু আলী আলাউদ্দীন আল-হাসকাফী (১০৮৮ হি) আদ-দুর্রুল মুখতার গ্রন্থে বলেন:

وَاعْلَمْ أَنَّ النَّذْرَ الَّذِي يَقَعُ لِلأَمْوَاتِ مِنْ أَكْثَرِ الْعَوَّامِ وَمَا يُؤْخَذُ مِنْ الدَّرَاهِمِ وَالشَّمْعِ وَالزَّيْتِ وَنَحْوِهَا إلَى ضَرَائِحِ الأَوْلِيَاءِ الْكِرَامِ تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ فَهُوَ بِالإِجْمَاعِ بَاطِلٌ وَحَرَامٌ مَا لَمْ يَقْصِدُوا صَرْفَهَا لِفُقَرَاء الأَنَامِ وَقَدْ اُبْتُلِيَ النَّاسُ بِذَلِكَ ، وَلا سِيَّمَا فِي هَذِهِ الأَعْصَارِ

‘‘জেনে রাখ, মৃতদের জন্য নযর-মানত যা অধিকাংশ সাধারণ মানুষ করে থাকে এবং আওলিয়ায়ে কেরামের মাযার-কবরের জন্য যে সব টাকাপয়সা, মোমবাতি, তেল ও অনুরূপ দ্রব্য গ্রহণ করা হয় তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য তা সবই বাতিল ও হারাম বলে ইজমা হয়েছে। যদি না তারা দরিদ্র অসহায় মানুষদের জন্য তা ব্যয় করার মানত করে। মানুষেরা এরূপ নিষিদ্ধ নযর-মানতের মধে নিপতিত হয়েছে, বিশেষত বর্তমান যুগে।’’[1]

এর ব্যাখ্যায় আল্লমা ইবনু আবেদীন শামী (১২৫২ হি) ‘‘হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার’’ গ্রন্থে বলেন:

قَوْلُهُ (تَقَرُّبًا إلَيْهِمْ ) كَأَنْ يَقُولَ يَا سَيِّدِي فُلانٌ إنْ رُدَّ غَائِبِي أَوْ عُوفِيَ مَرِيضِي أَوْ قُضِيَتْ حَاجَتِي فَلَكَ مِنْ الذَّهَبِ أَوْ الْفِضَّةِ أَوْ مِنْ الطَّعَامِ أَوْ الشَّمْعِ أَوْ الزَّيْتِ ... ( قَوْلُهُ بَاطِلٌ وَحَرَامٌ ) لِوُجُوهٍ: مِنْهَا أَنَّهُ نَذَرَ لِمَخْلُوقٍ وَالنَّذْرُ لِلْمَخْلُوقِ لا يَجُوزُ لأَنَّهُ عِبَادَةٌ وَالْعِبَادَةُ لا تَكُونُ لِمَخْلُوقٍ. وَمِنْهَا أَنَّ الْمَنْذُورَ لَهُ مَيِّتٌ وَالْمَيِّتُ لا يَمْلِكُ. وَمِنْهُ أَنَّهُ إنْ ظَنَّ أَنَّ الْمَيِّتَ يَتَصَرَّفُ فِي الأُمُورِ دُونَ اللَّهِ تَعَالَى وَاعْتِقَادَهُ ذَلِكَ كُفْرٌ

‘‘আওলিয়া কেরামের মাযারে তাদের নৈকট্য বা নেক-নজর লাভের জন্য মানত করার ধরন এই যে, মানতকারী বলবে, হে অমুক হুজুর বা অমুক বাবা, যদি আমার হারানো ব্যক্তি ফিরে আসে বা আমার অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয় বা আমার হাজত পূর্ণ হয় তবে তোমার জন্য অমুক পরিমান স্বর্ণ, রৌপ্য, খাদ্য, মোমবাতি বা তেল দেব। এ প্রকারের মানত বাতিল ও হারাম হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে:

প্রথমত, তা মাখলূক বা সৃষ্টির জন্য নযর-মানত করা, আর কোনো সৃষ্টির জন্য মানত-নযর জায়েয নয়। কারণ মানত-নযর ইবাদত এবং কোনো মাখলুকের বা সৃষ্টির ইবাদত করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, যার জন্য মানত করা হয়েছে তিনি মৃত। আর মৃত ব্যক্তি কোনো মালিকানা লাভ করতে পারে না।

তৃতীয়ত, এরূপ মানতকারী ধারণা করেছে যে, আল্লাহ ছাড়া মৃত মানুষও কাজে কর্মে বা দুনিয়ার পরিচালনায় কিছু করতে পারেন, আর তার এ আকীদা কুফর।’’[2]

আল্লামা ইবনু নুজাইম (৯৭০ হি) ‘আল-বাহরুর রায়িক’ গ্রন্থেও একই কথা বলেছেন।[3]

যারা কবরে, মযারে আউলিয়ায়ে কেরামের নামে মানত বা জবাই করেন তাদের অনেকে মনে করেন যে, আমরা তো একমাত্র আল্লাহর নাম নিয়েই জবাই করছি এবং আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত করছি, কেবলমাত্র পশুটাকে বাবার বা ওলীর মাযারে এনে জবাই করছি, যেন তিনি সাওয়াব পান। এখানে প্রশ্ন হলো, যদি একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যেই মানত বা জবাই করা হয় তাহলে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে জবাই করেই তো নিয়্যাত করা যেত যে, আল্লাহ এ সাদকার সাওয়াবটি অমুককে পৌঁছে দিন, এত কষ্ট করে পশুটি মাযারে নিয়ে যাওয়া হলো কেন? মাজার ময়লা করতে?

বাহ্যত এ কষ্টের কারণ হলো, পৃথিবীর যে কোনো স্থানে জবাই করলে তো আল্লাহ পাবেন, কবরস্থ ওলী বা ‘বাবা’ সরাসরি পাবেন না, আল্লাহর মাধ্যমে পাবেন। আর মাযারে নিয়ে জবাই করলে এক ঢিলে দু পাখি মারা হবে, আল্লাহর প্রতি ভক্তিও প্রকাশ করা হবে এবং কবরস্থ ‘বাবার’ প্রতি ভক্তিও প্রকাশ করা হবে। যদিও দ্বিতীয়টিই মূল উদ্দেশ্য এবং সে জন্যই এত কষ্ট করা, তবে আল্লাহকে শরীক রাখলে অসুবিধা নেই, এতে ‘বাবা’ নারায হবেন না!!

এ প্রসঙ্গে আল্লামা আলূসী বলেন: ‘‘মহান্ আল্লাহ বলেছেন[4]: ‘‘তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা তো কখনো একটি মাছিও সৃষ্টি করতে পারবে না...।’’ যারা আল্লাহর ওলীগণের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করে এখানে তাদের নিন্দার প্রতি ইশারা করা হয়েছে; কারণ তারা বিপদে আপদে তাদের নিকট ত্রাণপ্রার্থনা করে এবং মহান আল্লাহর নিকট ত্রাণ প্রার্থনা করা থেকে গাফিল থাকে এবং এ সকল ওলীর জন্য তারা নযর-মানত করে। তাদের মধ্যে যারা বুদ্ধিমান তারা বলে, এ সকল ওলীরা হলেন আল্লাহর নিকট আমাদের ওসীলা। এবং বলে যে, আমরা আল্লাহর জন্যই নযর-মানত করি এবং এর সাওয়াব ওলীর জন্য প্রদান করি। এ কথা সুস্পষ্ট যে, তাদের প্রথম দাবির বিষয়ে তারা মূর্তিপূজকদের সবচেয়ে নিকটবর্তী ও মূর্তিপূজকদের মতই, যারা বলত[5]: আমরা এদের ইবাদত করি তো এজন্যই যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিয়ে দেবে।’

তাদের দ্বিতীয় দাবিটি আপত্তিকর হবে না, যদি তারা এরূপ মানতের মাধ্যমে ওলীগণের নিকট থেকে তাদের অসুস্থব্যক্তিদের সুস্থতা, তাদের হারানো মানুষের প্রত্যাবর্তন বা অনুরূপ কোনো হাজত প্রার্থনা না করে। কিন্তু তাদের বাহ্যিক অবস্থা প্রমাণ করে যে, তারা এদের নিকট মানতের দ্বারা এরূপ কিছুই প্রার্থনা করে। এর প্রমাণ এই যে, তাদেরকে যদি বলা হয় যে, তোমরা আল্লাহর জন্য মানত কর এবং এর সাওয়াব তোমাদের পিতামাতার জন্য দান কর, কারণ এ সকল ওলী-আওলিয়ার চেয়ে তোমাদের পিতামাতগণেরই সাওয়াবের প্রয়োজন বেশি, তবে তারা তা করবে না। আমি এদের অনেককে দেখেছি যে, তারা ওলীগণের কবরের পাথরের বেদিমূলে সাজদা করছে।

এদের অনেকে দাবি করে যে, সকল ওলীই তাদের কবরে বসে দুনিয়া পরিচালনায় অংশগ্রহণ করেন, তবে তাদের বেলায়াতের মর্তবা অনুসারে তাদের ক্ষমতার কমবেশি রয়েছে। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বিশ্ব পরিচালনা এরূপ ক্ষমতা ৪ বা ৫ জন কবরবাসীর জন্য সীমাবদ্ধ করেন। তাদের নিকট যদি প্রমাণ চাওয়া হয় তবে তারা বলেন, কাশফ দ্বারা তা প্রমাণিত। মহান আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন! এরা কত বড় জাহিল!! আর এদের মিথ্যাচার ও জালিয়াতি কত ব্যাপক!!!

তাদের মধ্যে অনেকে দাবি করে যে, এ সকল ওলী-আউলিয়া তাদের কবর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বিভিন্ন আকৃতি ধারণ করেন। তাদের মধ্যে যারা আলিম তারা বলে, এ সকল ওলীর রূহ প্রকাশিত হয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরে বেড়ায় এবং কখনো কখনো তারা বাঘ, সিংহ, হরিন বা অনুরূপ প্রাণীর আকৃতি ধারণ করে। এ সবই ভিত্তিহীন বাতিল কথা। কুরআন, সুন্নাহ এবং উম্মাতের প্রথম যুগে ইমামগণের কথার মধ্যে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। এ সকল মিথ্যাচারী মানুষে দীন-ধর্ম নষ্ট করে দিয়েছে। ইহূদী, খৃস্টান ও অন্যান্য বাতিল ও বিকৃত ধর্মের মানুষদের নিকটেও এরা হাসি-মস্করার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি বাতিল মতবাদ ও নাস্তিকতার অনুসারীরাও এদের নিয়ে হাস্যকৌতুক করে। আমরা আল্লার নিকট ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করি।’’[6]

শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী তাঁর ‘আল-বালাগুল মুবীন’ গ্রন্থে বলেন: ‘‘কবর পূজারীদেরকে পীর পুরস্ত বা পীর পূজারীও বলা হয়। কবর পূজারী সম্প্রদায় কবর পূজাকে ফরয ইবাদত তথা নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি হইতেও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। সুন্নত ইবাদত ও অযীফা করার চেয়ে কবর পূজাকে অধিক ফযীলতপূর্ণ ও সাওয়াবের কাজ মনে করে। তাই তাহারা কবর পূজাকে যে কোন প্রকার ইবাদতের পরিবর্তে করিয়া থাকে এবং ইহাকেই যথেষ্ট মনে করে। বস্ত্তত তারা কিন্তু কবর পূজার পরিবর্তে আল্লাহর কোন ইবাদতকে গুরুত্ব দেয় না এবং উহাকে যথেষ্ট মনে করে না। যখন কোন বুযর্গের উরশ বা মেলা ইত্যাদি হয় তখন সেখানে বহু দূর দূরান্ত হইতে বহু লোকের সমাগম হয়। এই ক্ষেত্রে কবর পূজারীরা সেই মেলায় উপস্থিত হওয়া ফরয ইবাদত মনে করে এবং অন্যান্য ফরয অর্জনকরার চেয়ে এটাকেই অধিক প্রয়োজন মনে করিয়া থাকে।

কবর পূজারীদের আমলের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জঘন্যময় কাজ হইল যাবতীয় পাথিব বিপদাপদ ও সঙ্কটময় কাজের সমাধান হওয়ার জন্য কবরের নিকট গিয়া এমন বিনয়তা, একাগ্রতা ও আন্তরিকতার সাথে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য কান্নাকাটি করে যে, মসজিদে বা অন্য কোথাও আল্লাহকে হাযির নাযির মনে করিয়া উহার শত ভাগের এক ভাগও করে না। কবরে শায়িত বুযর্গের নাম ধরিয়া তাহাকে ডাকে এবং দোআ করে এবং তাহার নিকট জীবিকা ও সন্তানাদি কামনা করে। অত্যন্ত বিনয় ও মনযোগের সহিত মাথানত (করিয়া) কাপড়ের গেলাফ এবং চাদর লাগায়; কবরের উপর সুগন্ধি ছড়ায়। পূণ্যের কাজ মনে করিয়া লোবান, আগর বাতি জ্বালায় এবং কবরকে সুন্দরভাবে সজ্জিত করে। এই অযথা কাজে পীরের আত্মাকে খুশী করার নিয়তে তাহার সানিধ্য লাভের চেষ্টা করে। আপাতঃদৃষ্টে দেখা যায় যে হিন্দু ও মুশরিক সম্প্রদায় তাহাদের প্রতিমার জন্য যেভাবে অর্চনা করিয়া থাকে ঠিক সেই ভাবেই এই কবর পূজারিগণও সেই সমস্ত কাজকে পুণ্যময় মনে করিয়া সম্পাদন করিয়া থাকে।’’[7]

[1] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯-৪৪০।
[2] ইবনু আবেদীন, হাশিয়াতু রাদ্দিল মুহতার ২/৪৩৯।
[3] ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রায়িক ২/৫২০।
[4] সূরা (২২) হাজ্জ: ৭৩ আয়াত।
[5] সূরা (৩৯) যুমারের ৩ আয়াতের প্রতি ইঙ্গিত করছেন।
[6] আলূসী, রুহুল মা‘আনী ১৩/১৫৫।
[7] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন (বঙ্গানুবাদ), পৃ. ১৮।

আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি যে, আরবের মুশরিকদের মধ্যে তাবাররুক বিষয়ক শিরক বিদ্যমান ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, কোনো নেককার মানুষের স্মৃতি বিজড়িত দ্রব্য বা স্থানকে স্বাভাবিক সম্মান দেখানো শিরক নয়। তবে যখন মানুষ উক্ত স্মৃতি বিজড়িত দ্রব্য বা স্থানকে বরকরতে উৎস বলে মনে করে, তার সামনে ‘চূড়ান্ত ভক্তি, বিনয় ও অসহায়ত্ব প্রকাশ করে’, উক্ত দ্রব্য বা দ্রব্যের মালিকের আত্মা থেকে কোনো নেক নযর আশা করে তখন তা শিরকে পরিণত হয়। তাবার্রুকের ক্ষেত্রে সুন্নাত পদ্ধতি পরিত্যাগ করে বিদ‘আত বা খেলাফে সুন্নাত পদ্ধতিতে তাবার্রুক করলে তা থেকে শিরকের মধ্যে নিপতিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

তাবার্রুকের সুন্নাত পদ্ধতি আমরা জানতে পারি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) ও তাঁর প্রিয় সাহাবীগণের কর্ম থেকে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে সবচেয়ে মূল্যবন ও বরকতময় স্মৃতি ছিল পবিত্র কাবা ঘর এবং তৎসংশ্লিষ্ট হাজার আসওয়াদ, রুকন ইয়ামানী, মাকাম ইবরাহীম ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) হাজার আসওয়াদে চুম্বন করেছেন। এ চুম্বন আল্লাহর নির্দেশ ও ইবরাহীম (আঃ)-এর অনুসরণ-অনুকরণের চুম্বন, পাথর থেকে, বা পাথরের কারণে ইবরাহীম (আঃ) থেকে কোনো বরকত, দু‘আ, কল্যাণ ইত্যাদি পাওয়ার জন্য নয়। সাহাবীগণও কেবলমাত্র রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর অনুসরণ ও সুন্নাত পালনের জন্যই তা চুম্বন করেছেন, পাথর থেকে কিছু পাওয়ার জন্য নয়। উমার (রাঃ) হাজার আসওয়াদ চুম্বন কালে বলেন:

إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لا تَضُرُّ وَلا تَنْفَعُ وَلَوْلا أَنِّي رَأَيْتُ النَّبِيَّ (ﷺ) يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ

‘‘আমি জানি যে, তুমি পাথর মাত্র, কোনো ক্ষতিও করতে পার না, উপকারও করতে পার না, যদি না আমি দেখতাম যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তোমাকে চুম্বন করছেন, আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না।’’[1]

‘মাকামে ইবরাহীম’ ইবরাহীম (আঃ)-এর স্মৃতি বিজড়িত বরকতময় পাথর। কুরআন কারীমে একে সুস্পষ্ট নিদর্শন বলা হয়েছে এবং এর পিছনে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং সাহাবীগণ কখনোই সালাত আদায় করা ছাড়া কোনো ভাবে এ পাথরকে সম্মান করেননি। কখনোই একে চুম্বন করেননি, পানি দিয়ে ধুয়ে তা পান করেননি বা অন্য কোনোভাবে একে সম্মান প্রদর্শন করেননি।

সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু যুবাইর দেখেন যে, তাবিয়ী যুগের কিছু নও মুসলিম মাকামে ইবরাহীমে হাত বুলাচ্ছেন। তাঁরা এভাবে বরকতময় স্মৃতি-বিজড়িত দ্রব্যটিকে সম্মান করছিলেন। তখন তিনি বলেন:

لَمْ تُؤْمَرُوا بِهذا إنما أُمِرْتُمْ بالصلاة

‘‘তোমাদেরকে এরূপ করতে নির্দেশ দেওয়া হয় নি, কেবলমাত্র সালাত আদায় করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’’[2]

সুন্নাত নির্দেশিত স্থানগুলি-হাজার আসওয়াদ ও রুকন ইয়ামানী ছাড়া পবিত্র কাবাগৃহের অন্য কোনো স্থান চুম্বন, হাত বুলানো বা অন্য কোনোভাবে তাঁরা ‘তাবাররুকের’ চেষ্টা তাঁরা কখনো করেননি।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর জীবদ্দশায় সাহাবায়ে কেরাম তাঁর ওযুর পানি, গায়ের ঘাম, কফ, থুতু, মাথার চুল, ঝুটা খাবার বা পানি অথবা তাঁর দেওয়া যেকোনো উপহার গভীরতম ভালবাসা ও প্রগাঢ় ভক্তির সাথে গ্রহণ করেছেন ও সংরক্ষণ করেছেন। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁদের এসকল কাজে বাধা দেননি, অনুমোদন করেছেন। পরবর্তী যুগের তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও অন্যান্য যুগের সকল বুজুর্গ ও রাসূল-প্রেমিক মুসলিম রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর স্মৃতি বিজড়িত যেকোনো দ্রব্যের প্রতি তাঁদের হৃদয়ের আবেগ ও ভালবাসা কখনো গোপন করেননি।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর পরে সাহাবীগণ কোনো সাহাবীর বা অন্য কোনো বুজুর্গের বা পূর্ববতী কোনো নবী-ওলীর স্মৃতি বিজড়িত কোনো দ্রব্যের প্রতি এধরনের আচরণ করেননি। তাবিয়ী বা তাবি-তাবিয়ীগণও কখনো কোনো সাহাবী, তাবিয়ী বা তাবি-তাবিয়ীর স্মৃতি বিজড়িত কোনো দ্রব্য বরকতের জন্য গ্রহণ ও সংরক্ষণ করেননি। আবু বকর, উমর, উসমান, আলী, আববাস, ফাতিমা, হাসান, হুসাইন, বেলাল, ইবনু মাসঊদ () বা অন্য কোনো সাহাবীর কোনো স্মৃতি বিজড়িত দ্রব্যকে কোনো সাহাবী, তাবিয়ী বা তাবি-তাবিয়ী তাবাররুক হিসাবে গ্রহণ করেননি। অনুরূপভাবে, তাবিয়ী ও তাবি-তাবিয়ী বুজুর্গগণের ক্ষেত্রেও তাঁরা এ ধরনের কোনো আচরণ করেননি।[3]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর স্মৃতি বিজড়িত দ্রব্য যেমন মু’মিনের ভালবাসা ও ভক্তির বিষয়, তেমনি তাঁর স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলিও মুমিনের ভক্তি ও ভালবাসার স্থান। এক্ষেত্রে সাহাবীগণের রীতি ছিল তিনি যে স্থানে নামায পড়েছেন সে স্থানে নামায পড়া, যে স্থানে তিনি বিশ্রাম করেছেন সেখানে বিশ্রাম করা, যেখানে তিনি কিছুক্ষণ শয়ন করেছিলেন সেখানে কিছুক্ষণ শয়ন করা, যেখানে তিনি ইস্তিঞ্জা করেছেন সেখানে ইস্তিঞ্জা করা। এমনি যেখানে তিনি ফরয সালাত আদায় করেছেন সেখানে তাঁরা নফল সালাত আদায় করতেন না, বরং তিনি যে ওয়াক্তের সালাত আদায় করেছেন তাই সেখানে আদায় করার চেষ্টা করতেন। এমনকি তিনি হজ্জ-উমরার সফরে যেখানে সালাত আদায় করেছেন, সেখানে তাঁরা হজ্জ-উমরার সফরেই শুধু সালাত আ্দায় করতেন, অন্য সময়ে শুধু সেখানে সালাত আদায় করার জন্য যেতেন না। অর্থাৎ সাহাবীগণ তাবার্রুক করতেন হুবহু অনুকরণের মাধ্যমে। এ বিষয়ক হাদীসগুলি আমি আমার এহইয়াউস সুনান গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

শুধু দ্রব্য বা স্থানকে ভক্তি করা বা তার প্রতি অলৌকিক ভক্তি প্রকাশের প্রবণতা তাঁরা কঠোরভাবে আপত্তি করতেন। এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, উমর ফারুক (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে এক সফরে কিছু মানুষকে দেখেন যে, তারা সবাই একটি স্থানের দিকে যাচ্ছে। তিনি প্রশ্ন করেন: এরা কোথায় যাচ্ছে? তাঁকে বলা হয়: ইয়া আমীরুল মু’মিনীন, এখানে একটি মসজিদ বা নামাযের স্থান আছে যেখানে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) নামায আদায় করেছিলেন, এজন্য এরা সেখানে যেয়ে নামায আদায় করছে। তখন তিনি বলেন :

إَنَّمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ بِمِثْلِ هَذَا، يَتَّبِعُوْنَ آثَارَ أَنْبِيَائِهِمْ فَيَتَّخِذُوْنَهَا كَنَائِسَ وَبِيَعاً. مَنْ أَدْرَكَتْهُ الصَّلاَةُ فِيْ هَذِهِ الْمَسَاجِدِ فَلْيُصَلِّ، وَمَنْ لاَ، فَلْيَمْضِ، وَلاَ يَتَعَمَّدُهَا.

‘‘তোমাদের পূর্ববর্তী উম্মতেরা তো এই ধরনের কাজ করেই ধ্বংস হয়েছে। তারা তাদের নবীগণের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলি খুঁজে বেড়াত এবং সেখানে গীর্জা ও ইবাদতখানা তৈরি করে নিত। যদি কেউ  যাত্রা পথে (রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর স্মৃতি বিজড়িত) এসব মসজিদে নামাযের সময়ে উপস্থিত হয় তাহলে সে সেখানে নামায আদায় করবে। আর যদি কেউ যাত্রাপথে অন্য সময়ে সেখানে উপস্থিত হয়, তাহলে সে না থেমে চলে যাবে। বিশেষ করে এসকল মসজিদে নামায আদায়ের উদ্দেশ্য করবে না।’’[4]

শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলবী (রাহ) উমার (রাঃ)-এর এ বক্তব্য উল্লেখ করে বলেন: ‘‘হযরত ওমার (রাঃ)-এর বর্ণনা মতে প্রমাণিত হয় যে, এই যুগে মানুষ যে সমস্ত নক্শাকৃত পাদুকা এবং হাতের ছাপ মারা পাথর বা এই জাতীয় কিছু কোন একস্থানে পুতিয়া প্রচার করে যে, ইহা অমুক বুযর্গের হাত বা পদচিহ্ন সম্বলিত বরকতময় পাথর। ফলে অজ্ঞ জনসাধারণ সেই পাথর যিয়ারত করার জন্য বহু দূর দূরান্ত হইতে আসে এবং সেখানে নযর নিয়ায করিয়া মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য নিবেদন পেশ করে। নিঃসন্দেহে ইহা বিদ‘আত ও সুন্নাতের বরখেলাফ। শরীয়ত মোতাবেক যখন এই সমস্ত বস্ত্তগুলি যিয়ারত করা এবং উহার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা সুন্নাতের পরিপন্থী তখন উহার নিকট দোআ করা, কাকুতি মিনতি করিয়া কান্নাকাটি করা এবং মনোবঞ্ছা পূর্ণ হওয়ার জন্য প্রার্থনা করা কোনমতেই তো জায়েয হইতে পারে না। বরং ইহা পরকালে মুক্তির ও নাজাতের পথকে বন্ধ করিয়া দেয়। .....

উল্লেখিত বস্ত্তসমূহ এবং উহা ছাড়া ইবাদতের আশায় সেখানে যাহা কিছু স্থাপিত করা হয়, উহা ভাঙ্গিয়া (ফেলা) ও উহার মূলোৎপাটন করা প্রতিটি মুসলমানের পক্ষে অপরিহার্য কতর্ব্য।’’[5]

তিনি আরো বলেন: ‘‘আমাদের বর্তমান যুগের মুসলমানদের ধর্মীয় অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করিলে হৃদয় ব্যথিত ও বিগলিত না হইয়া পারে না। আমরা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের (ﷺ) নির্দেশিত সহজ সরল পথ পরিত্যাগ করিয়া নিয়ত গোমরাহীর পথে চলিতেছি। যে সমস্ত পাথর ও স্থানসমূহ বুযর্গগণের সাথে সম্পর্কিত উহাদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন ও তাযীম তাকরীমে আত্মনিয়োগ করিয়াছি। শিরক ও বিদয়াতে লিপ্ত হইতে আমাদের অন্তর কোন সময় ভয়ভীতি অনুভব করে না। এই সমস্ত স্থান ও বস্ত্তসমূহকে নিজেদের কিবলাহ, মাকসুদ ও মনের আশা আকাঙ্খা পূরর্ণ হওয়ার একমাত্র উৎস মনে করিয়অ বহুদূর দূরান্ত হইতে বহু কষ্ট স্বীকার করিয়া সেইখানে আসিয়া লোকজন উপস্থিত হয়। নযর নেওয়া দিয়া মিষ্টান্ন বিতরণ করিয়া, সুগন্ধি ছড়াইয়া, আলো জ্বালাইয়া বুযর্গদের আত্মার সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করিতে থাকে। তেমনিভাবে এই সমস্ত লোক বুযর্গদের তাসববীহ, লাঠি, পাদুকা এবং অন্যান্য ব্যবহৃত জিনিসকেও ঐ বুযর্গের স্থলাভিষিক্ত মনে করে। ....

এই যুগে যদি কোন পীরের লাঠি, পাগড়ী, পাদুকা বা জামা কাপড় কিছু পায় তবে উহা অতি সম্মানের সাথে কোন উঁচুস্থানে সংস্থাপন করিয়া সেই স্থানটিকে যিয়ারত করার জন্য লোকজনকে আমন্ত্রণ জানাইয়া উহাকে দরগাহ শরীফে পরিণত করে। এই সমস্ত বস্ত্ত সম্বন্ধে কোন কোন  লোক প্রপাগান্ডা করিয়া বলিয়া থাকে, আমি অমুক বুযর্গের ব্যবহৃত পাদুকা দ্বারা এমন উপকার পাইয়াছি যাহা বর্তমান যুগের জীবিত বুযর্গদের নিকটও পাওয়া যায় না। ......

এই কপটতা এমন এক স্তরে দাঁড়ায় যে, বুযর্গগণ যখন তাহাকে এই জাতীয় শরীয়ত বিরোধী অন্যায় কাজ করা হইতে নিবৃত্ত থাকিতে বলেন তখন তাহারা নানা প্রকার ওযর-আপত্তি, টাল-বাহান ও বুযর্গদের প্রতি মহববত পোষণের বাহানা অনুসন্ধান করিয়া বলিয়া থাকে- এই জাতীয় কথা আমরা তাহাদের প্রতি মহববতের দরুনই বলিয়া থাকি। পরে যখন এই কপটতার রোগ সীমা অতিক্রম করিয়া যায় তখন এই জাতীয় লোকেরা প্রকাশ্য শিরকের মধ্যে নিমজ্জিত হইয়া যায়। যাহারা তাহাদের এই সমস্ত কাজে তাহাদিগকে বাধাদান করে তখন তাহারা বাধাদানকারীদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করিয়া বলিতে থাকে- ইহারা আল্লাহর অলীদের মত ও পথের বিরোধী তাহাদের কাশফ কেরামত অস্বীকার করে। যেমন ইহূদীগণ হযরত ঈসা (আঃ)-কে হযরত ওযায়ের (আঃ)-এর অস্বীকারকারী ও বিরোধী এবং মুসলমানদেরকে হযরত ঈসা (আঃ)-এর শত্রু ও বিরোধী বলিয়া প্রচার করিয়া থাকে। এই পথভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের লোকদের নিকট হযরত ঈসা (আঃ) এতটা অপরাধীই ছিলেন যে, তিনি হযরত ওযায়ের (আঃ)-কে আল্লাহর পুত্র বলিয়া বিশ্বাস করিতেন না। মুসলমানদের অপরাধ- তাহারা হযরত ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহর সন্তান বলিয়া মানে না।

মোট কথা প্রতিটি গোমরাহ সম্প্রদায়ই হিদায়াত প্রাপ্ত শরীয়তের অনুসারী লোকদিগকে পদে পদে অপমানিত ও লাঞ্ছিত করার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকে। এই প্রকার অপমান করার জন্যই তাহাদের বিরুদ্ধে জন সমাজে বলিয়া বেড়ায় যে, এই সমস্ত লোক অমুক অলীর বিরোধী ও শত্রু, তাহার মত ও পথকে ইহারা বিশ্বাস করে না। মক্কার মুশরিকগণও হুযূর (ﷺ) এবং সাহাবা কিরামদের সম্বন্ধে এমন সব কথা বলিত। তাহারা নবীবরকে (ﷺ) সাবী অর্থাৎ বেদ্বীন এবং মিল্লাতে ইবরাহীমের বিরোধী ও শত্রু বলিয়া লোক সমাজে বলিয়া বেড়াইত।’’[6]

শাহ ওয়ালি উল্লাহ আরো বলেন: ‘‘শয়তান আদম সন্তানদের আদিম ও অকৃত্রিম শত্রু। সে প্রতি যুগে প্রতি স্থানে প্রথমে কোন আল্লাহর বন্ধুর কবরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনের জন্য সুনির্দিষ্ট করিয়া লয়। তারপর একমাত্র উপাস্য আল্লাহকে বাদ দিয়া পূজা-পার্বনের জন্য ঐ কবরটিকে প্রতিমা বা মূর্তিতে পরিণত করে। ইহার পর শয়তান তাহার সঙ্গী-সাথী ও অনুসারীদের মধ্যে জোর গলায় প্রচার করিতে আরম্ভ করে যে, যাহারা এই কবরের পূজা পার্বন, উহার পাশে ওরস ও মেলা করিতে বারণ করে তাহারা প্রকৃতপক্ষে এই বুযর্গের শত্রু। তাহারা এই বুযর্গকে অসম্মান করার এবং তাহার প্রাপ্য হক তাহাকে না দেওয়ার জন্যই এইরূপ করিতেছে। শয়তানের এই অপপ্রচারে উত্তেজিত হইয়া একদল অজ্ঞ ও ইলম বিবর্জিত লোক এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞাকারীদের বিরুদ্ধে কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া যায়। এমনকি তাহাকে হত্যা করিতেও দ্বিধাবোধ করে না। তাহাদের প্রতি কুফরী ফতওয়া দেয়, তাহাকে নানা প্রকার দুঃখ-কষ্ট জ্বালা-যন্ত্রণা দিতে বদ্ধপরিকর হয়। বাধা প্রদানকারীদের দোষ কি? তাহাদের দোষ হইল আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল (ﷺ) যে কাজ করার নির্দেশ দিয়াচেন তাহারা জন সাধারণকে সেই কাজ করার জ্ন্য আহবান করেন। আর যে কাজ করা হইতে বিরত থাকিতে বলিয়াছেন- উহা করা হইতে তাহাদিগকে নিষেধ করেন।’’[7]

৬ষ্ঠ হিজরীতে হুদাইবিয়ার সন্ধির সময় একটি বৃক্ষের নিচে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর সাহাবীগণের বাইয়াত গ্রহণ করেন, যে বৃক্ষের কথা কুরআন কারীমে উল্লেখ করা হয়েছে[8]। এ বৃক্ষ প্রসঙ্গে ইবনু উমর (রাঃ) বলেন: হুদাইবিয়ার সন্ধির বাইয়াতে রেদওয়ানের পরের বৎসর আমরা যখন উমরা পালনের জন্য আবার ফিরে আসলাম তখন আমাদের মধ্য থেকে দু’জন সাহাবীও ঐ গাছটির নিচে একত্রিত হয়নি। তা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমত ছিল।[9]

অন্য হাদীসে নাফে’ (রাহ) বলেন: কিছু মানুষ হুদাইবিয়ায় ‘বাইয়াতে রেদওয়ানের গাছ’ নামে কথিত গাছটির নিকট আসত এবং সেখানে সালাত আদায় করত। খলীফা উমর (রাঃ) এ কথা জানতে পারেন। তখন তিনি তাদেরকে কঠিন শাস্তির ভয় দেখান। পরে তিনি ঐ গাছটিকে কেটে ফেলতে নির্দেশ দেন। তাঁর নির্দেশ মতো গাছটি কেটে ফেলা হয়।[10]

এ হাদীসটি উল্লেখ করে শাহ ওয়ালি উল্লাহ দেহলবী বলেন: ‘‘ভবিষ্যতে যাহাতে শিরকের পথ চিরতরে বন্ধ হইয়া যায় তজ্জন্যই হযরত ওমর সেই গাছটি কাটিয়অ ফেলার নির্দেশ দিয়াছিলেন। এই বৃক্ষটির ন্যায় যাহা কিছু মূতি ও প্রতীমার শ্রেণীভুক্ত যাহার কারণে অসংখ্য ফেতনা ফাসাদ এবং বিদ‘আতের প্রচলন হইয়া রহিয়াছে এবং যাহার দরুন কঠিনতম বিপদাপদ প্রকাশ লাভ করিয়াছে উহার বেলায় হুকুম কি হইতে পারে?

হযরত ওমর (রাঃ)-এর কাজের তুলনায় অন্যতম কৃতিত্বপূর্ণ কাজ হইল হুযূরে আকরাম (ﷺ)-এর মসজিদে দেরার, যে মসজিদ আব্দুল্লাহ ইবনু উবাই ইসলামের ক্ষতি সাধন করার পরামর্শ গৃহরূপে নির্মান করিয়াছিল- উহা জ্বালাইয়া দেওয়া। তিনি শিরক ও বিদআতের পথ রুদ্ধ করার মানসেই এই কাজ করিয়াছিলেন। সেই সমস্ত মসজিদ, মন্দির কবরের উপরে তৈয়ার করা হয় অথবা স্মৃতিসৌধরূপে নির্মাণ করা হয় এবং যাহাকে কেন্দ্র করিয়া অহরহ শিরক ও বিদআতের স্রোত বহিয়া চলিতেছে উহা ধ্বংস করিয়া দেওয়া মসজিদে দেরার ধ্বংসের তুলনায় কোন অংশেই কম পুণ্যের কাজ নহে। ইসলাম এই সমস্ত মাটির সাথে মিশাইয়া নিশ্চিহ্ন করিয়া দেওয়ার নির্দেশ দিয়াছে।

যে সমস্ত মিনার ও গম্বুজ মৃত বা শহীদ লোকের কবরের উপর স্থাপিত তাহাও ধ্বংস করিয়া দেওয়া আমাদের পক্ষে ওয়াজিব। কারণ হুযূর (ﷺ)-এর বিরোধিতা ও ইসলামের নাফরমানী করার উপর ভিত্তি করিয়াই উহার অস্তিত্ব এইগুলিতে বিরাজ করিতেছে। .... এই সৌধসমূহ ধুলিস্যাত করিয় দেওয়ার অকাট্য প্রমাণ হইল হুযুর (ﷺ)-এর পবিত্র বাণী। তিনি কবরের উপর সৌধ বা গম্বুজ নির্মাণ করিতে কঠোরভাবে নিষেধ করিয়াছেন। যাহারা এই সমস্ত করে তাহাদের প্রতি লানত বর্ষণ করিয়াছেন। যে সমস্ত বিষয়বস্ত্তর প্রতি হুযুর (ﷺ) নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছেন এবং যাহাদের নির্মাতাকে তিনি অভিশপ্ত বলিয়াছেন- উহা দ্বিধাহীন চিত্তে যত শীঘ্র সম্ভব ধ্বংস করিয়া ফেলাই মুসলমানদের এক অপরিহার্য কর্তব্য। আবার যাহারা কবরের উপর বাতি জ্বালায়, আলোক সজ্জায় সজ্জিত করে, ঝাড় বাতি লটকায়, সুগন্ধি ছিটায়, আগরবাতি জ্বালায়- তাহাদের প্রতিও নবীয়ে আকরাম (ﷺ) অভিসম্পাত করিয়াছেন।

অতএব যে কাজ করায় হুযূর (ﷺ) অসন্তুষ্ট হইয়া লানত করিয়াছেন উহা কবীরা গোনাহ। ইহার উপর কেয়াস করিয়াই ওলামায়ে কিরাম ফতওয়া দিয়াছেন কবরের জন্য মোমবাতি বা প্রদীপের তৈল মানত করাও হারাম। কারণ এই জাতীয় মানত করাই পাপের কাজে মানত করা। কেহ যদি এই জাতীয় মানত করিয়া আদায় না করে তবে তাহার পাপ হইবে না। এই জাতীয় কবরের জন্য ওয়াকফ করাও জায়েয নহে। শরীয়ত মতে এতদপ্রকার মানত করা না জায়েয। এই সমস্ত বস্ত্তকে স্থায়িত্ব দেওয়া এবং উহার প্রচলন জারি রাখাও শরীয়ত বিরুদ্ধ কাজ হিসেবে গণ্য।’’[11]

[1] বুখারী, আস-সহীহ ২/৫৭৯; মুসলিম, আস-সহীহ ২/৯২৫।
[2] ইবনু আবী শাইবা, আল-মুসান্নাফ ৩/৪১৬।
[3] দেখুন: শাতেবী, আল-ই’তিসাম ১/৪৮১-৪৮৫।
[4] ইবনু ওয়াদ্দাহ, আল-বিদাউ, ৪১-৪২, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ১/৫৬৯, শাতেবী, ইতিসাম ১/৪৪৮-৪৪৯।
[5] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩২-৩৩।
[6] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩৭-৪০।
[7] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৪৩।
[8] সূরা (৪৮) ফাত্হ: ১৮ আয়াত।
[9] বুখারী, আস-সহীহ ৩/১০৮০; ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৬/১১৭-১১৮।
[10] ইবনু সা’দ, আত-তাবাকাতুল কুবরা ২/৭৬, ইবনু হাজার, ফাতহুল বারী ৭/৪৪৮।
[11] শাহ ওয়ালি উল্লাহ, আল-বালাগুল মুবীন, পৃ. ৩৪-৩৫।
দেখানো হচ্ছেঃ ১৮১ থেকে ১৯০ পর্যন্ত, সর্বমোট ২৪২ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 16 17 18 19 20 · · · 22 23 24 25 পরের পাতা »