আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে, একদিন রাসূলুল্লাহ (স) দুটি কবরের পাশ দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। এমন সময় সেখানে দাঁড়িয়ে রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন, এখানে দুজন কবরবাসীকে আযাব দেওয়া হচ্ছে। তবে তাদের এ আযাব কোন বড় ধরনের অপরাধের কারণে নয়; তাদের একজন সতর্কতার সাথে (অর্থাৎ আদবের সাতে) পেশাব করত না। অপরজন পরনিন্দা করে বেড়াত, (এতটুকুই ছিল তাদের অপরাধ । এ কথাটি বলার পর) তিনি একটি তাজা খেজুরের ডাল নিলেন এবং তা দুভাগে ভাগ করে দু’টা দুই কবরের মধ্যে পুঁতে দিলেন। এ ঘটনার পর সাহাবায়ে কিরাম তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! এ কাজটি কেন করলেন? উত্তরে তিনি বললেন, আশা করা যায়, এতে তাদের শাস্তি লাঘব করে দেওয়া হবে; যতদিন পর্যন্ত এগুলো শুকিয়ে না যায় । (বুখারী: ১৩৬১)
এ হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, পেশাব-পায়খানায় যত্নবান ও সতর্ক হওয়া সকলেরই অবশ্য কর্তব্য।
পানি বা ঢিলা কুলুখ এ দুটোর যেকোন একটি দিয়ে পবিত্র হওয়া যায় । পানি দিয়ে ধৌত করে পবিত্র হওয়াকে বলা হয় ইস্তিঞ্জা । আর ঢিলাকুলুখ দিয়ে পবিত্র হওয়াকে বলা হয় ইস্তিজমার। শুধু ঢিলাকুলুখ ব্যবহার করেও পবিত্র হওয়া জায়েয ।
১. টয়লেটে প্রবেশের সময় বাম পা আগে দিয়ে বলবে - “হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট নাপাক জিন ও মহিলার অনিষ্ট হতে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।” (বুখারী: ১৪২) আর বের হওয়ার সময় ডান পা আগে দিয়ে বলবে, গুফ্রানাকা “(হে আল্লাহ!) আমি তোমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।” (আবু দাউদ: ৩০)
২. মাটিতে বসার আগে কাপড় না উঠানো, (আবু দাউদ: ১৪)।
৩. জায়গাটি খোলামেলা হলে একটু দূরে চলে যাওয়া এবং পর্দা করে বসা। (আবু দাউদ: ২)
৪. বসে পেশাব করা, একান্ত অপরাগতায় দাঁড়িয়ে প্রস্রাব জায়েয। বসার জায়গা না পাওয়ায় রাসূলুল্লাহ (স) জীবনে একবার মাত্র দাঁড়িয়ে পেশাব করেছিলেন । (তিরমিযী: ১৩)
৫. প্রথমে ঢিলাকুলুখ ও পরে পানি ব্যবহার করা। এ বিষয়ে ৩টি স্তর রয়েছে:
(ক) কেউ যদি পানি ছাড়া শুধু ঢিলাকুলুখ ব্যবহার করে তাতেই পবিত্র হয়ে যাবে।
(খ) অথবা যদি কুলুখ ছাড়া শুধুমাত্র পানি দিয়ে পরিষ্কার করে তাও জায়েয। তবে পানির ব্যবহার কুলুখ ব্যবহারের চেয়ে উত্তম।
(গ) তৃতীয় স্তর হলো প্রথমে চিলাকুলুখ ও পরে পানি ব্যবহার করা । এটি হলো সর্বোত্তম পন্থা। (বুখারী: ১৫০ ও মুসলিম: ২৭১ নং হাদীস থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়।)
৬. বেজোড় সংখ্যক ঢিলা ব্যবহার করা। (বুখারী: ১৬২) ৭. কমপক্ষে ৩টি ঢিলা ব্যবহার করা। (মুসলিম: ২৬২)| প্রয়োজন হলে ৫ বা ৭টি ঢিলাও ব্যবহার করা যেতে পারে ।
৮. নরম মাটি ও নিচু ভূমিতে ইস্তিঞ্জা করা (ফাতহুল বারী- ১/৩১৮)। শক্ত মাটিতে পেশাব না করা, এতে গায়ে ছিটাফুটা এসে যেতে পারে।
৯. টয়লেটে লম্বা সময় না থাকা (শরহে মুমতি- ১/১০১)। যেহেতু ঐ সময় আল্লাহর নাম নেওয়া যায় না, তাই ঐখানে বেশি সময় কাটানো উচিত নয়।
১০. ইস্তিঞ্জা শেষে বাম হাত প্রথমে মাটিতে ঘষে পরে ধুয়ে ফেলা । (আবূ দাউদ: ৪৫)
১১. সবশেষে লজ্জাস্থানে কাপড়ের উপরিভাগে অল্প করে কিছু পানি ছিটিয়ে দেওয়া। (আবূ দাউদ: ১৬৬)
১. কিবলার দিকে মুখ বা পিঠ দিয়ে বসা। (বুখারী: ৩৯৪)
২. ডান হাতে লজ্জাস্থান স্পর্শ করা এবং ডান হাত দিয়ে ইস্তিঞ্জা করা (বুখারী: ১৫৩) এবং ডান হাতে ঢিলাকুলুখ ব্যবহার করা। এসব কাজে ডান হাত ব্যবহার করতে আল্লাহর রাসূল (স) নিষেধ করেছেন। তাছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে এবং পোশাক ও জুতা খোলার সময়ও রাসূলুল্লাহ (স) বাম পা আগে ব্যবহার করতে উপদেশ দিয়েছেন ।
৩. জমাটবদ্ধ পানিতে প্রস্রাব করা ও ফরয গোসল করা। প্রবাহমান নয় এমন জমে থাকা পানিতে প্রস্রাব ও ফরয গোসল করতে রাসূলুল্লাহ (স) নিষেধ করেছেন । (বুখারী: ২৩৯, মুসলিম: ২৮৩)
৪. যেসব স্থানে পেশাব-পায়খানা করা নিষেধ তা হলো: মুসলমানদের কবরস্থানে, গাছের ছায়ায়, ফলবান বৃক্ষের নিচে, বাগানে, পথে-ঘাটে, মানুষের চলাচলের রাস্তায়, পানির উৎসস্থলে ও মসজিদে। (মুসলিম: ২৬৯, আবু দাউদ: ২৬)
৫. সে অবস্থায় কুরআন পড়া ও কুরআন সাথে রাখা।
১. আল্লাহর নাম সম্বলিত লেখা বা অন্যকিছু সাথে রাখা। (আবু দাউদ: ১৯)।
২. কথা বলা, সালাম দেওয়া, সালামের জবাব দেওয়া । (মুসলিম: ৩৭০)
৩. হাচি আসলে ‘আল-হামদুলিল্লাহ' বলা এবং অন্য কেউ আল-হামদুলিল্লাহ' বললে এরও জবাব দেওয়া।
৪. প্রবাহমান বাতাসের মুখোমুখী হয়ে বসা। এতে পেশাবের ছিটাফোটা গায়ে এসে পড়তে পারে।
৫. কোন গর্তের মধ্যে পেশাব করা (আবু দাউদ)। কেননা, গর্তে সাপ, বিচ্ছু ও জিন থাকে।
৬. যেখানে গোসল করবে সে একই জায়গায় প্রস্রাব করা । (আবু দাউদ: ২৭)।
৭. স্রোতস্বিনী পানিতে প্রস্রাব করা ।
৮. ঘুম থেকে উঠে হাত ধোয়ার আগে পানির পাত্রে হাত ঢুকানো। (বুখারী: ১৬২)।
৯. পেশাব শেষে পুরুষাঙ্গ ধরে জনসমক্ষে ৪০ কদম হাঁটা। এমন হাঁটাহাঁটির কথা নবীজী (স) কখনো বলেননি, নিজেও করেননি। এটা কোন সুন্নাত কাজ নয়, বরং এটি একটি নির্লজ্জ কাজ। মক্কা-মদীনার উলামায়ে কিলাম কেউই এমন ধরনের গর্হিত কাজ করেন না।
১০. ঘরে কোন পাত্রে পেশাব জমিয়ে রাখা।
মানুষের কয়েকটি স্বভাবজাত সুন্নাত রয়েছে, যেগুলো পূর্ববর্তী নবীগণেরও ছিল। এখানে স্বভাবজাত সুন্নাতসমূহ অর্থাৎ সুনানুল ফিত্রাত-এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা পেশ করা হলো: আবু হোরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
ফিতরাত (অর্থাৎ স্বভাব) পাঁচটি অথবা বলেছেন, পাঁচটি কাজ (মানুষের) ফিতরাতের অন্তর্ভুক্ত, আর তা হলো:
১. খাতনা করা,
২. নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা,
৩. নখ কাটা,
৪. বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা এবং
৫ মোচ খাটো করা।' (বুখারী: ৫৮৮৯, মুসলিম: ২৫৭)
সহীহ মুসলিমের অন্য এক হাদীসে এসেছে, সুনানুল ফিতরা হলো ১০টি:
১. মোচ খাটো করা
২. দাড়ি লম্বা করা
৩. মিসওয়াক করা
৪. নাকে পানি টেনে নিয়ে ঝাড়া দেওয়া
৫. নখ কাটা
৬. আঙ্গুলের গিরাসমূহ ধোয়া
৭. বগলের পশম উপড়ে ফেলা
৮. নাভির নিচের পশম মুণ্ডন করা
৯. পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা
১০. হাদীস বর্ণনাকারী মুসআব (রা) বলেন, দশমটি আমি ভুলে গেছি। তবে সম্ভবত এটি ‘কুলি’ করা (মুসলিম: ২৬১, পবিত্রতা পর্ব)।
২৬. উপরের কাজগুলোর হুকুম কী?
অধিকাংশ ফকীহদের মতে, এ কাজগুলো সুন্নাত । যদিও অল্পসংখ্যক ফকীহ এগুলোকে ওয়াজিব বলেছেন । চুল ও হাত-পায়ের নখসহ পুরুষ মহিলা সকলের জন্য এ একই হুকুম।
এ কাজগুলো ডানদিকে শুরু করবে। বুখারীর ১৬৮ নং হাদীসে আছে যে, রাসূলুল্লাহ (স) প্রায় প্রত্যেক কাজই ডানদিক থেকে শুরু করতে পছন্দ করতেন। যেমন- কাপড় ও জুতা পরিধান, মসজিদে প্রবেশ, দাঁত মাজা, চুল আঁচড়ানো, মাথা মুণ্ডন, সালাতের সালাম ফেরানো, শরীরের অঙ্গ ধৌত করা, টয়লেট থেকে বের হওয়া, খাবার ও পানীয় গ্রহণ, মুসাফাহা করা, কাবা ঘরের হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করা, শয়ন ও পথচলা ইত্যাদি যাবতীয় কাজ ডানদিক থেকে শুরু করা সুন্নাত। তবে কেবল পরিচ্ছন্নতার কাজগুলো বামদিকে করবে। যেমন টয়লেটে প্রবেশ, ইস্তিনজা করা, নাক পরিষ্কার, জুতা ও কাপড় খোলা, থুথু নিক্ষেপ ইত্যাদি।
সর্বনিম্ন কতদিন অন্তর অন্তর নখ চুল কাটা উত্তম এ বিষয়ে কোন হাদীস খোঁজে পাওয়া যায়নি। তবে কোন কোন ফকীহর মতে, প্রতি জুমু'আ বারে কাটা মুস্তাহাব। আবার কেউ বলেছেন, শুক্রবার জুমু'আর ওয়াক্ত শুরু হওয়ার পূর্বে। আবার কেউ কেউ বলেছেন, প্রতি বৃহস্পতিবার। এর মধ্যে যে কোন একটি মত গ্রহণ করা যেতে পারে। অপরদিকে এ সুন্নাতটি আদায়ে সর্বঊর্ধ্ব কতদিন পর্যন্ত পেছাতে পারবে এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট হাদীস রয়েছে। আর তাহলো ৪০ রাত। আনাস (রা) বলেছেন,
“গোঁফ ছোট করা, নখ কাটা, বগল এবং নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করার কাজগুলোকে ৪০ রাতের বেশি সময় অতিক্রম না করার জন্য আমাদেরকে সময় নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।” (মুসলিম: ২৫৮)।
অতএব এগুলো না কেটে পরিষ্কার না করে ৪০ রাতের বেশি সময় পার করে দেওয়া জায়েয নেই।
মোচ খাটো করা, নখ কাটা ও বগলের লোম পরিষ্কার অন্য যে কোন নাপিতকে দিয়ে করা জায়েয আছে, কেবল নাভির নিচের লোম ছাড়া । তবে অপারগ হলে এটাও শুধুমাত্র নিজ স্ত্রীকে দিয়ে পরিষ্কার করাতে পারবে ।