ধর্ম ও আল্লাহ সম্পর্কে ফ্রান্সের সুবিখ্যাত দার্শনিক ও বর্তমান যুগের খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ উইল ডুরান্ট বলেন :
‘‘এ কথা সত্য যে, প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো জাতির জীবনে বাহ্যত ধর্ম পরিলক্ষিত হয় না, আর কোনো আফ্রিকান বামন (Dwarf) জাতির সাধারণভাবে কোনো ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচার-আচরণ ছিল না, এ অবস্থা অত্যন্ত বিরল। প্রাচীনতম বিশ্বাস চিরকাল এই ছিল যে, ধর্ম সুস্থ বিশ্বাস হিসেবে সমগ্র মানবতার মধ্যে প্রকাশমান ছিল এবং সমাজ দার্শনিকদের অভিমত এটাই ছিল।’’[1]
তিনি এরপর লিখেছেন : ‘‘দার্শনিকগণ ধর্মীয় বিশ্বাসকে (একটি) প্রাচীনতম প্রকাশ ও চিরকালে অবস্থিত থাকার কথা বিশ্বাস করেন।’’[2]
মাওলানা আব্দুর রহীম এ প্রসংগে একটি চমৎকার কথা বলেছেন, তা হলো এই- ‘‘মানব জাতির বিগত হাজার হাজার বছরের ইতিহাস এবং সভ্যতার উত্থান ও পতনের ইতিবৃত্ত অধ্যয়ন করলে নিঃসন্দেহে জানা যেতে পারে যে, ধর্ম ও ধর্ম পালন মানুষের জীবন, সমাজ ও সভ্যতা গড়ার কাজে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং তা মানুষের মৌল স্বভাবগত প্রবণতা, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রয়োজনরূপে গণ্য হয়েছে। কালের আবর্তন ও অবস্থার পরিবর্তনে তাতে আজও একবিন্দু ব্যতিক্রম ঘটে নি।’’[3]
স্যামউল কোনিক নামের একজন খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানীও প্রাচীন মানুষের জীবনে ধর্ম দৃঢ়ভাবে থাকার কথা অকৃত্রিমভাবে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন :
‘‘প্রত্নতাত্ত্বিক খোদাই এর মাধ্যমে যে সব নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে জানা যায় যে, বর্তমান মানুষের পূর্বপুরুষরা ধর্ম পালনকারী ও ধার্মিক ছিল। এর প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় যে, তারা তাদের মৃত লাশ দাফন করত, সে জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান পালন করত, লাশের সাথে তারা তাদের কাজের যন্ত্রপাতিও দাফন করে দিত। এভাবে তারা তাদের এই জগতের পরে অবস্থিত আখেরাতের প্রতি বিশ্বাস প্রমাণ করত।’’[4]
এ প্রসঙ্গে তিনি আরো বলেন : ‘‘এ সব মানুষ ধর্ম পালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করত এবং প্রকৃতি ও উর্ধ্ব জগতের দিকে লক্ষ্যদানকে তাদের এক অপরিহার্য অংশরূপে মনে করত।’’[5]
দার্শনিক উইল ডুরান্ট ধর্ম প্রসঙ্গে আরো বলেন : ‘‘মানুষেরা প্রথম কাল থেকেই এই যে ‘তাকওয়া’ অবলম্বন করত- যাকে কোন জিনিষই মুছে ফেলে নি তার ভিত্তি কী ছিল? তিনি নিজেই এর জবাব দিয়ে বলেছেন : গণক নতুন করে ধর্মকে সৃষ্টি করে নি, বরং সে তা নিজের স্বার্থে ব্যবহার করেছে মাত্র, যেমন রাজনৈতিক ব্যক্তিরা মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা ও ঝোঁককে ব্যবহার করে। তা হলে বুঝা যায়, ধর্মীয় বিশ্বাস কৃত্রিমভাবে তৈরী হয়নি, তা পুরোহিতদেরও বানানো নয়, বরং তা মানুষের প্রকৃতি নিহিত তাকীদেই গড়ে উঠেছে।’’[6]আমার মনে হয় ধর্মের বাস্তবতা ও মৌলিকতা প্রমাণের জন্য সমাজবিজ্ঞানীদের উপর্যুক্ত বক্তব্যের উদ্ধৃতিই আমাদের জন্য যথেষ্ট। এর দ্বারাই আমরা বুঝে নিতে পারি যে, ধর্মযাজকগণ সাধারণ জনগণকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য ধর্মকে তৈরী করে নি, অথবা সাধারণ মানুষেরাও ধর্মকে নিজেদের জীবনের কল্যাণার্জনে বা অকল্যাণ দূরীকরণের স্বার্থে এমনিতেই মিছেমিছি তৈরী করেনি।
বরং ধর্ম ও আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস মানুষের একটি প্রকৃতিগত ব্যাপার। যে দিন থেকে মানুষ এ পৃথিবীতে বসবাস করতে শুরু করেছে, তখন থেকেই তারা এখানে ধর্ম পালন শুরু করেছে। মানব সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই মানুষের মাঝে আল্লাহর একত্ববাদ ও ধর্মের প্রতি যে বিশ্বাস বিরাজমান রয়েছে, তা অহী লব্ধ দলীল প্রমাণাদির দ্বারা প্রমাণ করা সম্ভব হলেও যেহেতু অবিশ্বাসীরা তা বিশ্বাস করে না, তাই উক্ত বিষয়টি প্রমাণের জন্য অহী লব্ধ দলীলের বদলে অস্বীকারকারীদের চেয়েও আরো অধিক খ্যাতিমান সমাজবিজ্ঞানীদের উক্তির মাধ্যমে তা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হলো।
>[2].তদেব।
[3]. তদেব।
[4]. তদেব।
[5]. তদেব।
[6]. প্রাগুক্ত; পৃ. ৩২, ৩৩।
সুদূর অতীতকাল থেকেই মানুষের মাঝে আল্লাহ ও ধর্মীয় বিশ্বাস বর্তমান থাকার সত্যতা ও বাস্তবতা প্রমাণের পর এবার নিম্নে কতিপয় দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের কথার উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে আমরা একথার প্রমাণ পেশ করবো যে, অনন্তকাল থেকেই মানুষের মাঝে আল্লাহর ব্যাপারে তাওহীদী চিন্তা ভাবনা বিরাজমান ছিল এবং এ বিষয়টি মানুষের মাঝে চিন্তার ক্ষেত্রে বিবর্তনের কোনো ফসল নয়।
প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ আল-গাযালী[1] এ প্রসঙ্গে বলেন : ‘‘মানুষের মধ্যে যে সকল নির্বোধরা এ ধারণা পোষণ করে যে, মেধা শক্তির আবদ্ধতা থেকেই নাকি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের জন্ম হয়েছে, অথবা যারা বলে যে, মানবিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে অধিক পারদর্শিতা আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের মৌলনীতিকে নড়বড়ে করে দেয় এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ককে অতীব দুর্বল করে দেয়, তাদের এ জাতীয় ধারণা তাদের মূঢ়তা ও নির্বুদ্ধিতারই ফসল। এদের বুদ্ধিহীনতা প্রমাণের জন্য তিনি অষ্টাদশ শতকের দার্শনিক ও আকাশবিদ স্যার উইলিয়াম হরসেল (Sir William Hershel)[2]-এর বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
হরসেল বলেছেন : ‘‘জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিধি যতই বিস্তৃত হবে ততই একজন অসীম শক্তিধর সৃজনশীল প্রজ্ঞাময়ের বর্তমান থাকার উপর প্রমাণাদি অধিক হতে থাকবে। ভূতত্ত্ববিদ, জ্যোতির্বিদ, পদার্থবিজ্ঞানী ও গণিত শাস্ত্রবিদগণ তাদের বিবিধ প্রচেষ্টা ও আবিষ্কারের দ্বারা সৃষ্টিকর্তার কথা সমুন্নত করার জন্য একটি বিজ্ঞানাগার প্রস্তুত করতে যা প্রয়োজন, তা সংগ্রহের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন’’।[3]
এর পর তিনি দার্শনিক সক্রেটিস[4] এর এ সম্পর্কিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন, যা সক্রেটিস তাঁর ছাত্র প্লেটোকে লিখে পাঠিয়েছিলেন। তাঁর সে পত্রের মধ্যে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব তাঁর একত্ববাদ এবং তিনিই যে এ জগত সৃষ্টি করেছেন, সে সবের স্বীকৃতি পাওয়া যায়।
সক্রেটিস লিখেছিলেন : ‘‘এ জগত আমাদেরকে প্রকাশ করে দিচ্ছে যে, এখানে হঠাৎ করে অপরিকল্পিতভাবে কিছুই হয়ে যায় নি; বরং এর প্রতিটি অংশই একটি লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। আর এই লক্ষ্য তার চেয়েও উচ্চতর লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলেছে। এ ভাবে পরিশেষে একটি চূড়ান্ত একক লক্ষ্যের দিকে পৌঁছোনো যায়। জগতের এই পূর্ণাঙ্গ বিধান তার খুঁটিনাটিসহ কোথা থেকে তৈরী হলো, যা প্রতিটি দিক থেকেই মহত্বের দ্বারা বেষ্টিত? হঠাৎ করে এমনিতেই হওয়াতো সম্ভবপর নয়। আমাদের পক্ষে যদি এ কথা বলা সম্ভব হয় যে, তা এমনিতেই তৈরী হয়েছে, তা হলে আমাদের পক্ষে এ কথাও বলা সঠিক হবে যে, নদীর বুকে ভাসমান নৌকার তক্তাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবেই অস্তিত্ব লাভ করেছে।
আমরা যখন জগত পরিবেষ্টিত উপাদানগুলোর দিকে তাকাই, তখন তা পরিমাণে এতো বেশী দেখতে পাই যা বুদ্ধির দ্বারা সীমাবদ্ধ করা সম্ভবপর নয়। এ সব কিছু এমনিতেই হয়ে গেছে বলে আমরা ধরে নিতে পারি না। এ জন্য একজন মহাজ্ঞানীর অস্তিত্ব মেনে নেয়া জরুরী হয়ে দাঁড়ায়...আর সে বুদ্ধিমান অস্তিত্বই হচ্ছে একক সৃষ্টিকর্তা। কারণ, প্রকৃতির সর্বত্রই এমন এক মহান সৃষ্টিকর্তার একত্ববাদের নিদর্শন বিরাজ করছে যিনি চিন্তা করার সাথে সাথেই তাঁর সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়ে যায়। তাতে ভুল-ভ্রান্তি হওয়ার কোনই অবকাশ নেই।
তিনি উপস্থিত, সর্বজ্ঞাত ও সামর্থ্যবান, তা সত্ত্বেও তাঁকে ইন্দ্রিয় দ্বারা অনুভব করা অসম্ভব...তাঁর দৃষ্টান্ত সূর্যের মত যা সমস্ত দৃষ্টিশক্তিকে স্পর্শ করে, অথচ সে কাউকে তার নিজেকে দেখার অধিকার দেয় না।’’[5]
আল্লামা ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ সক্রেটিস সম্পর্কে বলেন :
‘‘সৃষ্টিকর্তার গুণাবলী স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তাঁর মতামত আল্লাহ তা‘আলার গুণাবলী স্বীকৃতি দানকারীদের মতের কাছাকাছি ছিল। তিনি (সক্রেটিস) বলেছেন: ‘‘তিনি (সৃষ্টিকর্তা) সকল বস্তুর উপাস্য, সৃষ্টিকর্তা, নিরূপক ও পরাক্রমশালী। তাঁর উপর কেউ বিজয়ী হতে পারেনা। তিনি মহা বিজ্ঞানী। তাঁর জ্ঞান, শক্তি ও হিকমত এতই অসীম যে, তা বুদ্ধির দ্বারা ব্যক্ত করা যাবে না।
তিনি (সক্রেটিস) রাসূলগণকে স্বীকৃতি প্রদানের নিকটবর্তী ছিলেন। সৃষ্টির শুরু, পূনরুত্থান ও সৃষ্টিকর্তার গুণাবলীর ক্ষেত্রে তাঁর বক্তব্য নবীগণের বক্তব্যের নিকটতম ছিল।’’[6]
সক্রেটিসের শিষ্য দার্শনিক প্লেটোও (জন্ম খৃ.পূর্ব ৪৩০) একত্ববাদের স্বীকৃতি প্রদানের ব্যাপারে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন। তিনি বলতেন :
‘‘এ জগতের একজন সৃষ্টিকর্তা রয়েছেন। তিনি অনাদি ও অনন্তকাল থেকে নিজ থেকেই আছেন। তিনি সকল জ্ঞানের আধার।’’[7]
ইংরেজ বৈজ্ঞানিক স্পেন্সার (Spencer)[8]এ প্রসঙ্গে বলেন :
‘‘আমরা এ কথার স্বীকৃতি দিতে বাধ্য যে, এ মহা বিশ্বের নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহ আমাদেরকে এমন এক মহাশক্তিমান সত্তার সন্ধান দেয়, যাঁকে অনুধাবন করা আমাদের পক্ষে অসম্ভব। ধর্মই সর্বপ্রথম এ সর্বশক্তিমান সত্তাকে গ্রহণ এবং মানব জাতিকে তাঁর সম্পর্কে জ্ঞান দান করে।’’[9]
স্পেন্সার আরো বলেন : ‘‘বিজ্ঞান কুসংস্কারের বিরোধী, তবে ধর্মের বিরোধী নয়, পদার্থ বিজ্ঞানের অনেক ক্ষেত্রে ধর্ম বিরোধী চেতনা পাওয়া যায়, তবে সঠিক বিজ্ঞান যা ভাসাভাসা জ্ঞানকে অতিক্রম করেছে এবং প্রকৃত জ্ঞানের গভীরে প্রবেশ করেছে, তা উপর্যুক্ত ধর্ম বিরোধী চেতনা থেকে মুক্ত। আর পদার্থ বিজ্ঞান ধর্ম বিরোধী নয়।’’[10]
যারা আল্লাহ ও ধর্মে বিশ্বাস করে না এবং জীব জগত এলোমেলোভাবে এমনিতেই সৃষ্টি ও উন্নতি লাভ করেছে বলে মনে করে, ইংরেজ বিজ্ঞানী লর্ড কেলভিন (Kelvin)[11] তাদের সংগে বিদ্রূপ করেন এবং আল্লাহর বর্তমান থাকা এবং তাঁর একত্ববাদের উপর হিকমত ও প্রকৃতির বিধানের মাঝে যে সব অকাট্য দলীল প্রমাণাদি রয়েছে, কোন কোন বিজ্ঞানীদের এ সবের প্রতি কোনো দৃষ্টি না দেয়াতে তিনি আশ্চর্য বোধ করে বলেন : ‘‘মানুষের পক্ষে এ কথা কল্পনা করাই কঠিন যে, কোন পরিকল্পনাকারী, সৃজনশীল শক্তির বর্তমান থাকা ছাড়াই জীবনের আরম্ভ বা তা চলমান থাকতে পারে। আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে, কোনো কোনো বৈজ্ঞানিক জীব সম্পর্কিত তাদের তাথ্যিক গবেষণার ক্ষেত্রে এ জগতের বিধানসমূহে (সৃষ্টিকর্তার পরিচয়ের) যে সব অকাট্য প্রমাণাদি রয়েছে, তা তারা অস্বাভাবিকভাবে এড়িয়ে গেছেন। কারণ, আমাদের চারপার্শ্বে হাজারো রকমের অকাট্য প্রমাণ উপস্থিত রয়েছে যা এক মহাশক্তিশালী ও কুশলী ব্যবস্থাপকের অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করছে। প্রকৃতির মাঝে বর্তমান এ সব দলীল আমাদেরকে এক স্বাধীন সার্বভৌম সত্তার সন্ধান দেয়। এই প্রমাণগুলো আমাদের বলে দিচ্ছে- প্রতিটি জীবই এক, অদ্বিতীয় এবং চিরস্থায়ী মহান স্রষ্টার সৃষ্টি এবং সবাই তাঁরই উপর নির্ভরশীর।’’[12]
বৈজ্ঞানিক নিউটন বলেনঃ ‘‘সৃষ্টিকর্তা বর্তমান থাকার ব্যাপারে কোনো সন্দেহ করো না; কারণ, আকস্মিক হওয়া একটি ঘটনা নিজ থেকেই এ সৃষ্টির মূল হওয়ার বিষয়টি কোনোভাবেই বুঝে আসার মত বিষয় নয়।’’[13]
আল্লাহকে অস্বীকারকারীদের সাথে বিদ্রূপ করে বিজ্ঞানী ফুলটির বলেন :
‘‘আল্লাহর ব্যাপারে সন্দেহ করছো কেন, তিনি যদি না থাকতেন, তবে আমার স্ত্রী আমার সাথে বেইমানী করতো, আমার খাদেম আমার সম্পদ চুরি করতো।’’[14]
বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা আব্দুর রহীম (মৃত ১৯৮৭ খ্রি.) এ প্রসঙ্গে বলেন :
‘‘বস্তুত দূর অতীতকাল থেকে মানব প্রকৃতির অধ্যয়ন চালালে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, ধর্মবিশ্বাস মানব প্রকৃতির গভীরে নিহিত রয়েছে। মূল আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাসেও বস্তুর্ধ্ব জগতের প্রতি লক্ষ্য আরোপে কোনো বিরোধ কোনো দিনই ছিল না। বিরোধ দেখা গেছে এ বিশ্বাসের বিশেষত্ব ও পদ্ধতি পর্যায়ে মাত্র। তার অর্থ, মূল বিশ্বাসে অতীত কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো পার্থক্য বা বিরোধ দেখা দেয় নি, তার খুঁটিনাটি বিস্তারিত ব্যাপারের মধ্যেই বিরোধ সীমাবদ্ধ রয়েছে। তার অর্থ আল্লাহর অস্তিত্ব বিশ্বাসের ব্যাপারে বিশ্ব মানবতার যে পরম ঐক্য অর্জিত হয়েছে, তা চিরকাল ইতিহাসের প্রত্যেকটি পর্যায়েই লক্ষ্য করা যায়।’’[15]
তিনি এ পর্যায়ে আরো বলেন : ‘‘বহু বিশেষজ্ঞই দাবী করেছেন যে, এই বিশ্বলোকে আল্লাহর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ স্বতঃস্ফুর্ত ব্যাপার। আর কুরআনের আয়াত থেকে এ সত্য উদঘাটন অতীব সুস্পষ্ট, সে জন্য কোনো যুক্তি-প্রমাণ অবতারণার আদৌ কোনো প্রয়োজন পড়ে না। বিশেষভাবে কোনো চিন্তা-ভাবনা গবেষণারও কোনো আবশ্যকতা নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি ইংরেজ দার্শনিক থমাস কাবেল এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেন। থমাস বলেছেন :
‘‘যাঁরা আল্লাহর অস্তিত্ব যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, তাদের অবস্থা এ থেকে ভিন্নতর নয় যে, তারা আকাশে দৃশ্যমান সূর্যকে প্রদীপ দিয়ে দেখতে চেষ্টা করে মাত্র।’’[16]
প্রকৃতকথা হচ্ছে, যারা আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তারা অপরিপক্ক জ্ঞানের অধিকারী। তারা এ ক্ষেত্রে যে সব ধারণার অনুসরণ করছে, পরিপক্ক জ্ঞানীদের নিকট সে সব ধারণার কোনই মূল্য নেই। তারা তাদের চিন্তা ও কথার দ্বারা আমাদেরকে আল্লাহর একথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে :
﴿ وَمِنَ ٱلنَّاسِ مَن يُجَٰدِلُ فِي ٱللَّهِ بِغَيۡرِ عِلۡمٖ وَلَا هُدٗى وَلَا كِتَٰبٖ مُّنِيرٖ ٨ ﴾ [الحج: ٨]
‘‘মানুষের মাঝে এমনও কতক লোক রয়েছে যারা কোন জ্ঞান, প্রমাণ, ও উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতর্ক করে।’’[17]
এ সব নাস্তিকদের ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে- কোনো একটি বস্তুর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা যায় বা তার অস্তিত্ব থাকার ব্যাপারে সন্দেহ পোষণ করা যায় যদি তা প্রমাণের জন্য কোনো দলীল প্রমাণাদি না থাকে। আল্লাহর বর্তমান থাকার বিষয়টি তো সে পর্যায়ে পড়ে না; কারণ, তাঁর অস্তিত্বের যাবতীয় প্রমাণাদি চক্ষুষ্মানদের জন্য পরিষ্কার হয়ে রয়েছে। আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী এবং এ দু’য়ের মধ্যে যা কিছু রয়েছে সবাই মিলে আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদেরই সাক্ষ্য প্রদান করছে। সে জন্য একজন কবি বলেছেন :
ألا كل شيء ما خلا الله باطل * وكل نعيم لا محالة زائل
و في كل شيء لــــــه آية * تدل على أنه الـــــــــواحد
‘‘আল্লাহ ব্যতীত সকল বস্তুই বাতিল, সকল নেয়ামত অবশ্যই বিলীন হয়ে যাবে, প্রত্যেক বস্তুতেই রয়েছে তাঁর নিদর্শন, যা তাঁর একত্ববাদের প্রতিই ইঙ্গিত বহন করছে।’’
আল্লাহর অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদের উপর অজস্র দলীল প্রমাণাদি থাকা সত্ত্বেও যখন কিছু সংখ্যক চেতনাহীন মানুষ তাঁর অস্তিত্বের ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, সে-জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ আচরণে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন :
﴿أَفِي ٱللَّهِ شَكّٞ فَاطِرِ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ﴾ [ابراهيم: ١٠]
‘‘যিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা সে আল্লাহর ব্যাপারে কি কোন সন্দেহ আছে।’’[18]
اللهم لا না, তাঁর ব্যাপারে সন্দেহ প্রকাশের কোনই অবকাশ নেই। সন্দেহ পোষণকারীরা তাঁকে স্বীকার করুক আর না-ই করুক, তিনি অনন্তকাল থেকে আছেন, চিরকাল ধরেই থাকবেন।
পরিশেষে আল্লাহকে অস্বীকারকারীদের বলবো : তারা যদি নিজেদের অস্তিত্বকে কোনো দিন সম্পূর্ণ অস্বীকার বা তাতে কোনো সন্দেহ পোষণ করতে পারে, তা হলে তারা আল্লাহর ব্যাপারেও তা করতে পারে- আর তা যদি না পারে এবং অবশ্যই তারা তা কস্মিনকালেও পারবে না- তা হলে তাদের পক্ষে আল্লাহকে শুধু স্বীকার করাই উচিত নয়, তাঁকে স্বীকার করে নেয়ার পাশাপাশি তাঁকে ভয় করাও উচিত। তারা যেন তাদের নিজেদের মধ্যে একটু লক্ষ্য করে; কারণ, তাদের নিজেদের অস্তিত্বের মধ্যেই তাঁর অস্তিত্বের প্রচুর প্রমাণপঞ্জী বিদ্যমান রয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন :
﴿ وَفِيٓ أَنفُسِكُمۡۚ أَفَلَا تُبۡصِرُونَ ٢١ ﴾ [الذاريات: ٢١]
‘‘তোমাদের নিজেদের মধ্যেও আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ রয়েছে, তবুও কি তোমরা তা লক্ষ্য করবে না।’’[19]
তারা যেন তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে নিহিত আল্লাহর অস্তিত্বের নিদর্শনাদির প্রতি লক্ষ্য করে অন্যান্যদের মত আল্লাহকে স্বীকার করে নেয়। এইতো পরমাণু বিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিদ, প্রাণী বিজ্ঞানী ও গণিতশাস্ত্রবিদগণ অত্যন্ত জোর দিয়ে বলেছেন যে, তাঁদের কাছে অনেক দলীল প্রমাণাদি রয়েছে যা এমন এক মহান অস্তিত্বের প্রমাণ করে, যিনি এই সৃষ্টি জগতকে নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তিনি তাঁর অসীম জ্ঞান ও করুণার দ্বারা অত্যন্ত যত্নের সাথে তা পরিচালনা করছেন।[20]
এ ছাড়া তাদের পূর্বে বিজ্ঞানের জনক সক্রেটিস ও প্লেটো যেখানে আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদের কথা অকপটে স্বীকার করে গেছেন, সেখানে তাদের অস্বীকৃতিতে অল্লাহর কিছুই যায় আসে না। বরং এতে তাঁকে অস্বীকারকারীদেরই মার্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
জগত শ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিকদের স্বীকৃতি দ্বারা আল্লাহ ও ধর্মের সত্যতা ও বাস্তবতা প্রমাণ করার পর এবার আমরা আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে যাবো। আর তা হলো-
সৃষ্টির সূচনালগ্নে মানুষেরা কোন্ চিন্তায় বিশ্বাসী ছিল?
এ প্রশ্নের জবাবে বলবো : হ্যাঁ, মানুষের মাঝে সর্বপ্রথম তাওহীদী চিন্তা-ভাবনাই বিরাজমান ছিল। এ বিষয়টি আমরা ঐশী বাণী ও যুক্তির দ্বারা প্রমাণ করতে পারি।
ঐশী প্রমাণাদি :
আমাদের নিকট কুরআন ও হাদীসের প্রচুর প্রমাণাদি রয়েছে যা এ কথারই সত্যতা প্রমাণ করে। আর কেমন করেই বা তা হবে না! কারণ; এ কথাতো কোনভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করবেন, অতঃপর তাদেরকে কোনো প্রকার হেদায়াত না দিয়েই লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেবেন। ফলে তারা যা ইচ্ছা চিন্তা করবে! কে তাদের সৃষ্টি করলো, কেনইবা করলো, কোথায় তাদের প্রস্থান? এ সব বিষয়ে তাদেরকে কিছুই না জানিয়ে এমনিতেই ছেড়ে দেয়া হবে?
কুরআনুল কারীম আমাদেরকে এ কথার প্রমাণ দিচ্ছে যে, আল্লাহ তা‘আলা মানব সৃষ্টির সূচনাতেই তাদের প্রকৃতিতে তাঁর পরিচয়ের ব্যাপারটি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে প্রোথিত করে দিয়েছেন এবং তিনি তাঁর পরিচয়ের উপর তাদের নিকট থেকে শক্ত প্রতিশ্রুতিও নিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفٗاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيۡهَاۚ لَا تَبۡدِيلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ ذَٰلِكَ ٱلدِّينُ ٱلۡقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكۡثَرَ ٱلنَّاسِ لَا يَعۡلَمُونَ ٣٠ ﴾ [الروم: ٣٠]
‘‘তুমি নিজেকে একনিষ্ঠভাবে দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত রাখো, এটাই আল্লাহর নিকট গৃহীত প্রকৃতি, যার উপর তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন, আল্লাহর সৃষ্টির কোনো পরিবর্তন নেই, এটাই সরল দ্বীন; কিন্তু অধিকাংশ লোকেরা তা জানে না।’’[21]
এআয়াতে (فطر الناس عليها) এ বাক্যের দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা দ্বীন গ্রহণ ও তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদানের যোগ্য করে মানুষকে সৃষ্টি করার কথাই ব্যক্ত করেছেন। তাঁর তাওহীদের স্বীকৃতি দানের উপর তাদের নিকট থেকে গৃহীত প্রতিশ্রুতি প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿ وَإِذۡ أَخَذَ رَبُّكَ مِنۢ بَنِيٓ ءَادَمَ مِن ظُهُورِهِمۡ ذُرِّيَّتَهُمۡ وَأَشۡهَدَهُمۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ أَلَسۡتُ بِرَبِّكُمۡۖ قَالُواْ بَلَىٰ شَهِدۡنَآۚ أَن تَقُولُواْ يَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ إِنَّا كُنَّا عَنۡ هَٰذَا غَٰفِلِينَ ١٧٢ ﴾ [الاعراف: ١٧٢]
‘‘আর স্মরণ কর সেই সময়ের কথা যখন তোমার পালনকর্তা বনী আদমের পৃষ্ঠদেশ হতে তাদের সন্তানদের বের করলেন এবং তাদেরকে এ প্রতিজ্ঞা করালেন যে, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা সকলেই বললো : হ্যাঁ, আপনি আমাদের পালনকর্তা, আমি তোমাদের এ প্রতিশ্রুতির উপর সাক্ষ্য গ্রহণ করলাম যাতে কেয়ামতের দিন তোমরা এ কথা বলতে না পারো যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।’’[22]
অনুরূপভাবে কুরআনুল কারীম আমাদেরকে আরো বলে দিচ্ছে যে, প্রথম মানব আদম ও হাওয়া ‘আলাইহিস সালাম মানব প্রকৃতির সে বিধান মোতাবেক তাঁদের প্রতিপালকের তাওহীদের স্বীকৃতি প্রদান করতেন। সে জন্যেই তাঁরা দু’জনে জান্নাত থেকে বেরিয়ে পৃথিবীতে অবতরণ করার পর তাঁদের প্রতিপালকের নিকট তাঁদের অপরাধকে স্বীকার করেছিলেন এবং এককভাবে কেবল তাঁরই নিকট তাঁদের কৃত অপরাধের জন্য মার্জনা কামনা করেছিলেন। তাও আবার এমন কিছু বাক্য পাঠ করার মাধ্যমে, যা তাঁরা তাঁদের প্রতিপালকের নিকট থেকেই শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তাঁরা উভয়েই এই বলে দু‘আ করেছিলেন :
﴿رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ ٢٣ ﴾ [الاعراف: ٢٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের প্রতি জুলুম করেছি, যদি আপনি আমাদেরকে মার্জনা না করেন এবং আমাদের প্রতি দয়া না করেন, তা হলে আমরা অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে শামিল হয়ে যাবো।’’[23]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম যদি তাঁদের প্রতিপালক আল্লাহ তা‘আলা ও তাঁর তাওহীদ সম্পর্কে অবগত না হতেন, তা হলে তাঁরা ‘হে আমাদের প্রতিপালক’ (ربنا) বলে এ ভাবে এককভাবে তাঁরই নিকট তাঁদের অপরাধের স্বীকৃতি ও তা মার্জনার জন্য তাঁকে আহ্বান করতেন না।
আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালাম যখন তাঁদের একক প্রতিপালককে চিনতেন ও জানতেন, তখন স্বাভাবিক অবস্থার দাবী হচ্ছে তাঁরা এ বিষয়টি তাঁদের সন্তানদেরকেও অবহিত করে থাকবেন। এ ছাড়া আল্লাহ তা‘আলা যে সকল মানুষের রূহের নিকট থেকে তাঁর পরিচিতির ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন, তা তো আমরা একটু আগেই অবগত হয়েছি। মানুষকে যে আল্লাহ কর্তৃক গৃহীত সে প্রতিশ্রুতির উপরেই সৃষ্টি করা হয়ে থাকে সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الفِطْرَةِ، فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ، أَوْ يُنَصِّرَانِهِ، أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»
‘‘প্রত্যেক সন্তানই তাঁর প্রতিপালক আল্লাহর স্বীকৃতি দানের প্রকৃতির উপরেই জন্মলাভ করে, অতঃপর তার পিতা-মাতা তাকে ইয়াহূদী, খ্রিষ্টান বা অগ্নিপূজকে পরিণত করে।’’[24]
প্রথম মানুষ আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালাম যখন আল্লাহর তাওহীদে বিশ্বাসী ছিলেন, সে সময় যখন অপর কোনো ধর্ম ছিল না, কোনো কিছুতে বিকৃতিও যখন একদিনে হয় না, তখন সুদীর্ঘ সময় পর্যন্ত আদম সন্তানরা যে তাওহীদী বিশ্বাসের উপরেই থাকবে, এটাই যুক্তি ও বাস্তবতার দাবী। কুরআনুল কারীম থেকেও এ যুক্তি ও বাস্তবতার সত্যতা প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ
﴿ كَانَ ٱلنَّاسُ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَبَعَثَ ٱللَّهُ ٱلنَّبِيِّۧنَ مُبَشِّرِينَ وَمُنذِرِينَ﴾ [البقرة: ٢١٣]
‘‘মানুষেরা (প্রথমে একই চিন্তা লালনকারী) একই জাতির্ভুক্ত ছিল। অতঃপর (তারা বিভক্ত হয়ে গেলে) আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারী হিসেবে প্রেরণ করেন।’’[25]
এ-আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা বলেন :
«كَانَ بَيْنَ نُوْحٍ وَ آدَمَ عَشَرَةُ قُرُوْنٍ كُلُّهُمْ عَلَى شَرِيْعَةِ الْحَقِّ فَاخْتَلَفُوْا فَبَعَثَ اللهُ النَّبِيِّيْنَ مُبَشِّرِيْنَ وَ مُنْذِرِيْنَ»
‘‘আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যকার দশ যুগ বা প্রজন্মের সকলেই সত্য ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, অতঃপর তারা ধর্মীয় বিষয়ে মতবিরোধে লিপ্ত হয়, ফলে তাদেরকে সত্য ধর্মের উপর পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা নবীদেরকে সুসংবাদদাতা ও ভয় প্রদর্শনকারীস্বরূপ প্রেরণ করেন।’’[26]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা যা বলেছেন তার সত্যতা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর একটি হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত হয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«كَانَ بَيْنَ آَدَمَ وَ نُوْحٍ عَشَرَةُ قُرُوْنٍ كُلُّهُمْ عَلَى الإسْلاَمِ»
‘‘আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যবর্তী দশ যুগ বা প্রজন্ম পর্যন্ত সবাই ইসলামের উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল।’’[27]
মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যে একনিষ্ঠ তাওহীদের উপরেই সৃষ্টি করেছেন, তা নিম্নোক্ত হাদীসে কুদসীর দ্বারাও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
«إِنِّيْ خَلَقْتُ عِبَادِيْ حُنَفَاءَ كُلَّهُمْ، وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيْطَانُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِيْنِهِمْ، وَحَرَّمَتْ عَلَيْهِمْ مَا أَحْلَلْتُ لَهُمْ ، وَأَمَرَتْهُمْ أَنْ يُشْرِكُوْا بِيْ مَا لَمْ أَنْزِلْ بِه سُلْطَانًا»
‘‘আমি আমার বান্দাদের সকলকেই একনিষ্ঠ তাওহীদে বিশ্বাসী করেই সৃষ্টি করেছি, শয়তান এসে তাদেরকে তাদের ধর্ম থেকে বিচ্যুত করেছে, আমি তাদেরকে যা হালাল করেছিলাম সে তা তাদেরকে হারাম করেছে, আমি যে শির্ক করার ব্যাপারে কোনো দলীল অবতীর্ণ করি নি, আমার সাথে সে শির্ক করার জন্য তাদেরকে নির্দেশ করেছে’’।[28] উপর্যুক্ত এ সব আয়াত ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আদম আলাইহিস সালাম থেকে পরবর্তী দশ যুগ বা প্রজন্ম পর্যন্ত তাঁর সন্তানরা তাওহীদী চিন্তা চেতনার উপরেই প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং অংশীবাদী চিন্তা-ভাবনা তাদের মধ্যে প্রথম দশ যুগ বা প্রজন্মের পরের মানুষের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছে, যা সংশোধনের নিমিত্তে আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রথম রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।
যৌক্তিক প্রমাণ :
এটা কোনো যৌক্তিক কথা হতে পারে না যে, আল্লাহ তা‘আলা প্রথমে আদম আলাইহিস সালাম-কে সৃষ্টি করার পর কিছুকাল পর্যন্ত তাঁকে তাঁর সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান না দিয়েই ফেলে রাখবেন; ফলে আদম এ ব্যাপারে যা খুশী চিন্তা করতে থাকবে এবং যাকে মনে হয় তাকে তাঁর রব ও উপাস্য বানিয়ে নেবে। অনুরূপভাবে এ কথাও বিবেক সম্পন্ন হতে পারে না যে, আদম আলাইহিস সালাম নিজে তাঁর প্রতিপালককে চিনবেন ও জানবেন, অথচ তিনি তাঁর সন্তানদেরকে এ ব্যাপারে কিছুই বলবেন না; কারণ, পিতা সর্বদাই তার সন্তানকে সে উপদেশই দিয়ে থাকেন যা তার সন্তানদের জন্য একান্ত উপকারী। নিজের প্রতিপালকের পরিচয় জানা যেহেতু সকল উপকারের চেয়ে বড় উপকারের কথা; সেহেতু আদম আলাইহিস সালাম তাঁর সন্তানদেরকে যে এ বিষয়টি জানিয়ে থাকবেন, তা অন্তত নিশ্চিত করে বলা যায়।
প্রকৃতকথা হচ্ছে, যারা অংশীবাদের উপর একত্ববাদের প্রচলন হওয়ার দাবী উত্থাপন করে থাকেন, তারা তাদের ধারণানুযায়ী বিবর্তনবাদের নীতির বিশুদ্ধতার উপর নির্ভর করেই এ দাবী উত্থাপন করে থাকেন। তারা বলেন :
‘‘এক আল্লাহ সম্পর্কিত মতবাদটি মূলত একাধিক আল্লাহর চিন্তার বিবর্তিত একটি উন্নত রূপ, তবে এ বিবর্তনটি তার সরল পথ হারিয়ে একটি অজানা পথের দিকে অগ্রসর হওয়ার ফলে তা জ্ঞানীদেরকে হয়রানির মাঝে ফেলে দিয়েছে, যেমনভাবে তা একাধিক আল্লাহ এর চিন্তা থেকে এক আল্লাহর চিন্তায় ভ্রান্তভাবে বিবর্তিত হওয়ার কারণে নিজেকে একটি বিভ্রান্তির মাঝে ফেলে দিয়েছে। একাধিক আল্লাহর ধারণা একটি সামাজিক মূল্যবোধ বহন করতো, যার পরিণতি ছিল বিভিন্ন আল্লাহতে বিশ্বাসীগণ পারস্পরিক স্বীকৃতির মাধ্যমে তারা নিরাপদে ও শান্তিতে বসবাস করবে; কিন্তু এক আল্লাহর চিন্তা সর্বোচ্চ ধর্মের মতবাদ সৃষ্টি করার ফলে এ সম্ভাবনাকে সম্পূর্ণভাবে বাতিল করে দিয়েছে। এ মতবাদের ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির মাঝে এমন সব অকল্যাণকর যুদ্ধ বিগ্রহ শুরু হয়েছে, যার কোনো শেষ নেই। এক আল্লাহর ধারণাটি এভাবে উল্টো দিকে বিবর্তিত হওয়ার ফলে নিজেই নিজেকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। আর এ ধরনের বিবর্তনকেই বিবর্তনবাদ বলা হয়।’’[29]
আল্লামা ওয়াহীদ উদ্দিন খান[30] তাদের এ চিন্তাধারার প্রতিবাদ করে বলেন :
‘‘আমরা কিন্তু কার্যত এ ক্ষেত্রে মূল বাস্তবতাকে এড়িয়ে চলেছি। সর্বজনবিদিত ইতিহাস এ কথা প্রমাণ করছে যে, সকলেরই এ কথা জানা যে, প্রথম প্রেরিত পুরুষ [রাসূল] ছিলেন নূহ আলাইহিস সালাম, আর তিনি জনগণকে এক আল্লাহর দিকেই আহ্বান জানাতেন। অনুরূপভাবে আমরা আরো জানি যে, একাধিক আল্লাহর মধ্যে সকলেই এক পদমর্যাদার ছিলেন না, যার অর্থ দাড়ায়: মানুষেরা বড় ইলাহ এর সাথে অন্যান্য (ছোট) ইলাহদের শরীক করে নিয়েছিল এ উদ্দেশ্যে যে, তারা (ছোট ইলাহরা) তাদেরকে বড় ইলাহ এর নিকটতম করে দেবে, তাদের জন্য দু‘আ ও শাফা‘আত করবে। এ সকল মৌলিক বিষয়াদি বর্তমান থাকার ফলে বিবর্তনবাদের মতবাদটি একটি প্রমাণবিহীন দাবীতে পরিণত হয়ে যেতে বাধ্য।’’[31]
এর পর তিনি বিবর্তনবাদ সম্পর্কে স্যার আরসর কীস এর বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তিনি বলেছেন :
‘‘বিবর্তনবাদের মতবাদটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয় এবং দলীল প্রমাণাদি দ্বারা এর সত্যতা প্রমাণ করারও কোনো উপায় নেই। তা সত্ত্বেও আমরা এ মতবাদে বিশ্বাসী কেবল এ জন্যে যে, এতে বিশ্বাস না করলে আমাদের সামনে সরাসরি সৃষ্টিকর্তার প্রতি বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। অথচ আমাদের পক্ষে এ বিশ্বাসের ব্যাপারে কোন চিন্তা করাও সম্ভবপর নয়।’’[32]
আমরা পশ্চিমা এ চিন্তাবিদের বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে দেখতে পেলাম যে, তারা মূলত ধর্মের চিন্তা থেকে পলায়ন করার জন্যেই এ বিবর্তনবাদের মতবাদে বিশ্বাসী হয়েছে। এটি যে একটি প্রমাণিত সত্য মতবাদ, সে জন্যে নয়।
বিবর্তনবাদের মতবাদটি যখন স্বয়ং এর প্রবক্তাদের নিকটেই সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য নয়, তখন এ ভ্রান্ত মতবাদের উপর নির্ভর করে কী করে এ কথা বলা যায় যে, পৃথিবীতে মানুষের সূচনা লগ্নে তাওহীদের পূর্বে অংশীবাদ এর প্রচলন ছিল। না, কস্মিনকালেও তা বলা ও বিশ্বাস করা যায় না। প্রকৃত কথা হলো: এ মতবাদে বিশ্বাসীরা মূলত ধর্ম থেকে পলায়নের জন্যেই এ ধরনের দাবী উত্থাপন করেছে মাত্র, যেমনটি আমরা স্যার আরসর কীস এর বক্তব্যের দ্বারা সুস্পষ্টভাবেই বুঝতে পারলাম।
সর্বশেষে এ প্রসঙ্গে ইমাম আবু যাহরাহ[33] এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করে এ প্রসঙ্গের ইতি টানবো। তিনি এ প্রসঙ্গে বলছেন :
‘‘ব্রাহ্মণ (হিন্দু) ধর্ম অতি প্রাচীন হওয়ায় তা ইতিহাসের গভীর থেকে গভীর পরতে প্রবেশ করেছে। এ ধর্মের অনুসারীরা প্রারম্ভে জগত ও এর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী একটি শক্তির উপাসনা করতো, এর একত্ববাদেও তারা বিশবাস করতো, যদিও সে শক্তিকে তারা ইসলামী পরিভাষার ন্যায় আল্লাহ বলে নামকরণ করতো না এবং সেটাকে ঠিক সে ধরনের একক বলেও বিশ্বাস করতো না যেমনভাবে মুসলিমরা আল্লাহর ব্যাপারে বিশ্বাস করেন। অতঃপর তারা সে শক্তিকে দেহ সর্বস্ব করে নেয় এবং কোনো কোনো দেহে তা প্রবেশ করেছে বলেও বিশ্বাস করে। যার পরিণতিতে তারা মূর্তি পূজায় লিপ্ত হয়। এতে তাদের দেবতাদের সংখ্যা একাধিক হয়ে গিয়ে তেত্রিশটি দেবতায় পৌঁছায়। এরপর তাদের বিশ্বাসে আরো পরিবর্তন ও পরিবর্ধন সাধিত হয়ে পরিশেষে তাদের দেবতা তিন অংশের মাঝে সীমাবদ্ধ হয় :[34]
১. ব্রহ্মা (পরমেশ্বর) : তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী দেবতার ব্রহ্মা নামের এ অংশই হলো সৃষ্টিকর্তা ও জীবনদাতা। এটি এমন শক্তি যে, সকল বস্তু এত্থেকেই জন্ম লাভ করে, সকল জীব-জন্তু তারই দয়া কামনা করে থাকে। সূর্যের সম্পর্ক রয়েছে তারই সাথে যার ফলে তাপ অর্জিত হয়, দেহসমূহ জীবনী-শক্তি লাভ করে এবং তাদের ধারণামতে জীব ও তরুলতায় এর কারণেই জীবন প্রবাহিত হয়ে থাকে।
২. শিব : তাদের ধারণামতে দেবতার এ অংশের কাজ হলো সবকিছু ধ্বংস করা। এর কারণেই সবুজ পাতা হলুদ বর্ণ হয়, যৌবনের পর বার্ধক্য আসে।
৩. বিষ্ণু : তাদের বিশ্বাস মতে দেবতার এ অংশ সকল সৃষ্টির মধ্যে প্রবেশ করে থাকে। এরই কারণে জগত পূর্ণাঙ্গভাবে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায়।
তাদের ধারণামতে এ তিন দেবতা এক দেবতার অংশ বিশেষ, আর সেই এক দেবতা হলেন মহাত্মা (الروح الأعظم), তাদের ভাষায় যার নাম হলো ‘আতমা’ বা ‘আত্মা’।
পৃথিবীর বুকে বসবাসকারী একটি অতি প্রাচীনতম জাতির যদি আল্লাহ সম্পর্কে এ ধারণা হয়, তা হলে আমরা কী করে সে লোকদের দাবী সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারি যারা বলে যে, এক আল্লাহর বিশ্বাসের পূর্বে মানুষের মাঝে একাধিক আল্লাহর বিশ্বাসই প্রচলিত ছিল।’’[35]
অবশেষে বলবো : পৃথিবীতে মানুষের সূচনা লগ্নে আল্লাহ সম্পর্কিত তাদের চিন্তাধারায় তাওহীদী চিন্তা-ভাবনা থাকার পরিবর্তে তাদের মাঝে অংশীবাদী চিন্তা-ভাবনা থাকার এ ধারণাটি সঠিক নয়; কেননা, তা কোনো প্রামাণ্য দলীল প্রমাণাদির উপর নির্ভরশীল নয়। যারা এই ধারণার অনুসারী তারা মূলত আল্লাহ ও ধর্মকে অস্বীকার করার জন্যেই এ আওয়াজ উঠিয়েছেন। এ সব লোকদের আল্লাহ ও ধর্মকে অস্বীকার করার পিছনে যে কারণ রয়েছে, সেটিকে মোট তিনভাবে চিহ্নিত করা যায় :
১. ধর্মের প্রতি একপেশে দৃষ্টি দান করার ফলে তারা ধর্মকে বাঁকা দেখতে পেয়েছেন।
২. তারা প্রচলিত সকল ধর্মগুলোকে একপাত্রে রেখে মূল্যায়ন করেছেন, তাই সকল ধর্মই তাদের দৃষ্টিতে মিথ্যা বলে মনে হয়েছে। তারা যদি ইসলামকে নিয়ে পৃথকভাবে ভাবতেন, তা হলে এর সত্যতা তাদের কাছে প্রমাণিত হতো।
৩. তারা ধর্ম ও আল্লাহর অস্বীকৃতির এ-দাবী উত্থাপন করেছেন তাদের নিজ নিজ দেশে অবস্থিত গির্জাসমূহের কর্তৃত্ব ও এর জুলুমের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যে। এ অস্বীকৃতি মূলত কোনো সত্য প্রাপ্তি ও তা প্রচারের জন্যে নয়।অতএব এ কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে, পৃথিবীর বুকে প্রথম মানুষের সময় থেকেই মহাবিজ্ঞ ও পরাক্রমশালী এক আল্লাহর বিশ্বাসই মানুষের মাঝে বিরাজমান ছিল। বিভিন্ন কারণবশত পরবর্তী সময়ে মানুষের মাঝে তাওহীদী ধ্যান-ধারণার স্থলে অংশীবাদী ধ্যান-ধারণা অনুপ্রবেশ করেছে। তা সত্ত্বেও কারো পক্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বসবাসকারী জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে এ কথা প্রমাণ করা সম্ভব হবে না যে, মানুষেরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছিল, মর্যাদার দিক থেকে তারা তাদেরকে আল্লাহর চেয়ে অধিক মর্যাদাবান বা তাঁর সমতুল্য মনে করতো, বরং বাস্তব অবস্থা এ কথাই প্রমাণ করে যে, তারা তাদের ব্যাপারে এ ধারণা পোষণ করেছিল যে, এরা তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেওয়ার মাধ্যম ও শাফা‘আতকারী। সুদূর অতীত ও তৎপরবর্তী জাতিসমূহের ইতিহাস থেকে এ তথ্যই প্রমাণিত হয়েছে। তাই এ কথা বলা যায় যে, তাওহীদের পূর্বে মানুষের মাঝে অংশীবাদের প্রচলন ছিল বলে যারা দাবী করেন, তাদের এ দাবী সম্পূর্ণভাবে কল্পনাপ্রসূত।
[2]. হারসেল একজন ইংরেজ জ্যোতির্বিদ ছিলেন। ১৭৮১ সালে তিনি ইউরেনাস গ্রহ আবিষ্কার করেন। টেলিসকোপও তাঁরই আবিষ্কার। ১৭৩৮ থেকে ১৮২২ সাল পর্যন্ত ছিল তাঁর যুগ।- লেখক
[3]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, ‘আক্বীদাতুল মুসলিম; (কায়রো : দারুল কুতুবিল ইসলামিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, ১৯৮০ খ্রি.), পৃ. ২২; ইনসাক্লোপেডিয়া ‘‘আজাদী’’, ‘ইলাহ’ শব্দমূল, ১ম খন্ড, পৃ. ৫০৩।
[4]. তিনি একজন প্রখ্যাত গ্রীক বিজ্ঞানী ও দার্শনিক ছিলেন। খৃষ্টপূর্ব ৪৭১ সালে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর একত্ববাদ সম্পর্কে তিনি যে সব তাত্ত্বিক কথা-বার্তা বলেছেন, তা নবী ও রাসূলগণের কথার সাথে মিলে যায়। দেখুন : গংগোহী, মাওলানা মুহাম্মদ হানীফ, জাফারুল মুহাসসিলীন বি আহওয়ালিল মুআললিফীন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, ১ম সংস্করণ, সন বিহীন), পৃ. ১৪১।
[5]. প্রাগুক্ত।
[6]. ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান ফী মাকাইদিস শয়তান; ২/২০৯, ২১০।
[7]. প্রাগুক্ত।
[8]. স্পেন্সার (Spencert, Herber, ১৮২০-১৯০৩) একজন বৃটিশ দার্শনিক । তিনি মনস্তত্ত্বও সমাজতত্ত্বের উপর বই লেখেন।- লেখক
[9]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৩।
[10]. আস-সাইয়্যিদ আস-সাবেক, প্রাগুক্ত ; পৃ. ৫০।
[11]. Kelvin William Thomson Lord (১৮২৪-১৯০৭ খ্রি.), তিনি একজন প্রখ্যাত ইংরেজ পদার্থ বিজ্ঞানী ছিলেন। লেখক
[12]. মুহাম্মদ আল-গাযালী, প্রাগুক্ত; পৃ.২৪।
[13]. হাসানুল বান্না, মাজমূ‘আতু রাসাইলিল ইমাম আশ-শহীদ; (বৈরুত : আল-মুআছ্ছাছাতুল ইসলামিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ, ৩১৯।
[14]. ড. আমহদ শালাবী, মুক্বারানাতুল আদইয়ান; (কায়রো : মাকতাবাতুন নুহদাতিল মিসরীয়্যাহ, ৮ম সংস্করণ, ১৯৮৯ খ্রি.), পৃ. ৯৩।
[15]. মাওলানা মুহাম্মদ আব্দুর রহীম, শির্ক ও তাওহীদ; (ঢাকা : খায়রুন প্রকাশনী, ২৫তম সংস্করণ, ১৯৯৬ খ্রিষ্টাব্দ.) পৃ. ৩৩।
[16]. তদেব।
[17]. আল-কুরআন, সূরা হজ্জ : ৮।
[18]. আল-কুরআন, সূরা ইব্রাহীম : ১০।
[19]. আল-কুরআন, সূরা যা-রিয়াত : ২১।
[20]. মুহাম্মদ আল-গাযালী স্বীয় আক্বীদাতুল মুসলিম গ্রন্থের ২৮ পৃষ্ঠায় এ-তথ্যটি বর্ণনা করেছেন। যা রয়টার সংবাদ সংস্থার উদ্ধৃতি দিয়ে মিসরের কোনো এক পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
[21]. আল-কুরআন, সূরা রূম : ৩০।
[22]. আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৭২।
[23]. আল-কুরআন, সূরা আরাফ : ২৩।
[24]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কদর, বাব নং:৫, হাদীস নং ২৬৫৮; ৪/২০৪৭; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ২/২৫৩।
[25].আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ২১৩।
[26].আত-ত্ববারী, আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবন জারীর, জামিউল বয়ান ফী তাফছীরিল কুরআন; (বৈরুত : দ্বারুল ফিকর, সংস্করণ বিহীন, ১৪০৫হি:), ২/৩৩৪; আন-নীসাপুরী, আবু আব্দুল্লাহ আল-হাকিম, আল-মুসতাদরাক ‘আলাস সহীহাইন; (বৈরুত : দ্বারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৯০ খ্রিৃ.), ২/৫৯৬।
[27]. আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২/৩৩৪; আল-হাকিম, প্রাগুক্ত; ২/৫৯৬; ইমাম হাকিম বলেন : ইমাম বুখারীর শর্তানুযায়ী এ হাদীসটি সহীহ। ইমাম জাহাবীও তাঁর এ মতকে সমর্থন করেছেন। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে ‘ঊফী কর্তৃক বর্ণিত অপর একটি হাদীস রয়েছে। তাতে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা বলেছেন :
كان الناس أمة واحدة، يقول : كفارا...
‘মানুষেরা সকলেই এক জাতি ছিল। এ বাক্যের ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন : তারা সকলেই কাফির ছিল..., এ মর্মে বর্ণিত হাদীসটি বিশুদ্ধ নয়; কারণ, ‘ঊফী একজন দুর্বল বর্ণনাকারী, তার বর্ণনা দ্বারা দলীল গ্রহণ করা যায় না। ইমাম ইবন কাছীর বলেন : ইবন ‘আব্বাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুমা থেকে বর্ণিত প্রথম বক্তব্যটি সনদ ও অর্থের দিক থেকে বিশুদ্ধ কারণ, প্রতিমা পূজার পূর্ব পর্যন্ত মানুষেরা সকলেই আদম আলাইহিস সালামের ধর্মে বিশ্বাসী ছিল। মূর্তি পূজা শুরু হলে অতঃপর আল্লাহ তা‘আলা নূহ আলাইহিস সালামকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি পৃথিবীর জনগণের প্রতি আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক প্রেরিত প্রথম রাসূল ছিলেন। দেখুন : তাফছীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/২৫০; ইবন কাইয়্যিম আল জাওযিয়্যাহ ও ইবন কাছীর এর কথাটি সঠিক হওয়ার স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। দেখুন : ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬০।
[28]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জান্নাতি..., বাব নং ১৬, হাদীস নং ২৮৬৫, ৪/২১৯৭; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ৪/১৬২।
[29]. ওয়াহীদ উদ্দিন খাঁন, প্রাগুক্ত; পৃ. ৫১-৫২। তিনি এ কথাগুলো Man of the modern world বই এর ১১২ পৃষ্টা থেকে উদ্ধৃত করেছেন।
[30]. ঊনিশ শতকে ভারতের একজন বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ।
[31]. তদেব।
[32]. তদেব। এ বক্তব্যটি তিনি একটি প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃত করেছেন, যা Islamic thought পত্রিকায় ডিসেম্বর ১৯৬১ খ্রি. প্রকাশিত হয়েছে।
[33]. ইমাম আবু যাহরাহ বিংশ শতাব্দির শেষার্ধের একজন প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ ছিলেন। ইসলামের বিভিন্ন দিক ও বিভাগ নিয়ে বিশেষ করে ইসলামকে যুগোপযোগী করার ক্ষেত্রে তাঁর বহু লিখনী প্রকাশিত হয়েছে ।- লেখক।
[34]. তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন :
ومنشأ الوثنية في الديانة البرهمية أنهم كانوا يعبدون القوى المؤثرة في الكون وتقلباته في زعمهم، ثم لم يلبثوا أن جسدوا تلك القوى، بأن اعتقدوا حلولها في بعض الأجسام، فعبدوا والأصنام لحلولها فيها، و تعددت آلهتهم حتى وصلت إلى ثلاثة و ثلاثين إلها = ثم عرا عقائدهم التغيير والتبديل حتى انحصر الآلهة في ثلاثة أقانيم، وذلك أنهم توهموا أن للعالم ثلاثة آلهة...إلى آخر ما قال.
ইমাম আবু যাহরাহ, মুকারানাতুল আদইয়ান; (কায়রো : দারুল ফিকরিল ‘আরাবী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৯১ খ্রি.), পৃ. ২৩।
[35]. তদেব; পৃ. ১৯-২৪।
এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, আদম আলাইহিস সালাম স্বীয় প্রভুর সান্নিধ্যে চলে যাওয়ার প্রক্কালে তাঁর সন্তানদেরকে তিনি সঠিক ধর্মের উপরেই একই মুসলিম জাতিভুক্ত রেখে গেছেন। তখন তাদের ধর্ম ছিল এক ও অভিন্ন এবং মহান আল্লাহই ছিলেন তাদের একক রব ও উপাস্য। তাদের মাঝে এ অবস্থা পরবর্তী কয়েক প্রজন্ম পর্যন্ত বিরাজমান ছিল। কালের পরিক্রমায় যখন তাদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার অবনতি ঘটে, তখন তাদের চির শত্রু শয়তান তাদের পিতা-মাতার বিরুদ্ধে যেভাবে ষড়যন্ত্র করেছিল ঠিক সেভাবেই সে তাদের বিরুদ্ধেও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল এবং অবশেষে তাদেরকে মু’মিন ও মুশরিক দু’টি দলে বিভক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ বলেন:
﴿وَمَا كَانَ ٱلنَّاسُ إِلَّآ أُمَّةٗ وَٰحِدَةٗ فَٱخۡتَلَفُواْۚ﴾ [يونس: ١٩]
‘‘মানুষেরাতো (ধর্মের দিক থেকে প্রারম্ভে) একই জাতিভুক্ত ছিল, অতঃপর তারা (এ ক্ষেত্রে) মতবিরোধে লিপ্ত হয়।’’[1]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মানুষেরা দীর্ঘ এক সময় পর্যন্ত একই ধর্ম ও একই বিশ্বাসের উপরে প্রতিষ্ঠিত ছিল। পরবর্তীতে তাদের মাঝে এ বিষয়ে মতভেদের সূত্রপাত হয়। এতে কিছু লোক পূর্বের ন্যায় তাওহীদী বিশ্বাসের উপরেই বহাল থাকে, আর কিছু লোক সে বিশ্বাসের পরিপন্থী কর্মে লিপ্ত হয়। আমরা হাদীস দ্বারা অবগত হয়েছি যে, আদম আলাইহিস সালাম থেকে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশ যুগ বা প্রজন্মের সকল লোক ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল।
উক্ত হাদীসে বর্ণিত ‘আশারাতু ক্বুরুন’ এর অর্থ এক হাজার বছরও হতে পারে, আবার দশ প্রজন্মের লোকও হতে পারে। তবে ‘আল-ইসলাম’ শব্দের দ্বারা এ যুগকে সীমাবদ্ধ করাতে প্রথম অর্থই অগ্রগণ্য বলে মনে হয়। কারণ, এতে মনে হয় যে, মানুষেরা এ সময়সীমা পর্যন্ত ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এবং আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মাঝে পরবর্তী আরো অনেক যুগ রয়েছে যাতে সকল লোকেরা ইসলামের উপর একমত ছিল না; বরং পরবর্তীতে তারা মু’মিন ও কাফির এ দু’দলে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে তাদেরকে সংশোধনের জন্যে প্রথমে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন[2]। এরপর প্রথম রাসূল হিসেবে শরী‘আত দিয়ে নূহ আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট প্রেরণ করেছিলেন।
‘কুরুন’ ‘قرون’ শব্দটিকে কুরআন ও হাদীসে প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমন আল্লাহ বলেন :
﴿ وَكَمۡ أَهۡلَكۡنَا مِنَ ٱلۡقُرُونِ مِنۢ بَعۡدِ نُوحٖۗ ﴾ [الاسراء: ١٧]
‘‘আর আমি অনেক প্রজন্মের মানুষদেরকে ধ্বংস করেছি নূহ এর পরে।’’[3]
এ আয়াতে ‘قرون’ শব্দ দ্বারা প্রজন্মই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। অনুরূপভাবে (خَيْرُ النَّاسِ قَرْنِيْ) ‘‘আমার যুগের মানুষেরা সর্বোত্তম মানুষ’’[4] এ-হাদীসেও ‘ক্বরন’ (قرن) শব্দটি প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর হাদীসে বর্ণিত ‘ক্বুরুন’ (قرون) শব্দটি প্রজন্মের অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে ‘সময়’ এর অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। হাদীসের বাহ্যিক অর্থের দ্বারা যদিও এ কথা মনে হয় যে, আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যে মোট এক হাজার বছর অতিবাহিত হয়েছে এবং এ সময়ের সকল লোকেরা মুসলিম ছিল; কিন্তু এ বাহ্যিক অর্থটি ইতিহাস ও বাস্তবতার সাথে খাপ খায় না। কেননা, বাস্তবতা এ কথার সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, একটি জাতির মধ্যে বিভ্রান্তি হঠাৎ করে এসে যায় না, বরং তা ধীরে ধীরে হয়ে থাকে এবং আল্লাহ তা‘আলাও কোনো জাতির বিভ্রান্তির প্রথম অবস্থাতেই নবী ও রাসূল প্রেরণ করেন না। এমতাবস্থায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করলে বলতে হবে যে, মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি শুরু হয়েছে নূহ আলাইহিস সালাম-এর যুগ থেকেই এবং আল্লাহ তাঁকে তাঁর জাতির বিভ্রান্তির প্রারম্ভেই রাসূল করে পাঠিয়েছেন, যদিও তা বাস্তবতা বহির্ভূত।
এ দিকে ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, আদম আলাইহিস সালামের সন্তানদের দ্বারা মূর্তিপূজার কারণে যখন তাদের কুফরী কার্যকলাপ চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন আল্লাহ তা‘আলা তাদের নিকট ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে নূহ আলাইহিস সালাম-এর পূর্বে নবী হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন। তিনি এসে তাদেরকে তাওহীদের দিকে আহ্বান জানালে তারা তাঁকে অস্বীকার করে, ফলে আল্লাহ তা‘আলা তাঁকে (ইদ্রীস আলাইহিস সালাম) মর্যাদাপূর্ণ স্থানে উঠিয়ে নেন।[5] এ ইতিহাসও ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এর হাদীসের বাহ্যিক অর্থের সম্পূর্ণ বিপরীত। এ কারণে আমরা এ কথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদীস দ্বারা আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম এর মধ্যকার মোট সময় নির্ধারণ করার উদ্দেশ্য করা হয় নি;বরং এর উদ্দেশ্য সে সময়সীমা বর্ণনা করা যে সময়ের মধ্যে সকল লোকেরা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, যদিও তাঁদের উভয়ের মাঝে এ সময়সীমার বাইরে আরো অনেক সময় ছিল, যাতে লোকেরা ইসলাম তথা তাওহীদের উপর একমত ছিল না।
তবে ইমাম ইবন হিববান তাঁর সহীহ গ্রন্থে আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন, যার দ্বারা ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীসের বাহ্যিক অর্থ গৃহীত হওয়ার সমর্থন পাওয়া যায়। হাদীসটি নিম্নরূপ:
«أَنَّ رَجُلًا قَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ ! أَ نَبِيٌّ كَانَ آدَمُ ؟ قَالَ : نَعَمْ مُكَلَّمٌ . قَالَ: فَكَمْ كَانَ بَيْنَهُ وَ بَيْنَ نُوْحٍ؟ قَالَ : عَشَرَةُ قُرُوْنٍ»
‘‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকটে এসে এক ব্যক্তি বললো : হে আল্লাহর রাসূল! আদম কি নবী ছিলেন? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন : ‘‘হ্যাঁ, তিনি এমন একজন নবী ছিলেন যার সাথে আল্লাহ তা‘আলা কথা বলেছেন।’’ লোকটি আবার বললো : তিনি এবং নূহ এর মধ্যে কত বছরের ব্যবধান ছিল? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-বললেন : ‘‘দশ যুগ’’ অর্থাৎ এক হাজার বছর।’’[6]
এ হাদীসে বর্ণিত ‘عشرة قرون’ শব্দের দ্বারা উভয়ের মধ্যবর্তী সময় এক হাজার বছরের মধ্যে সীমিত বলে প্রমাণিত হয়।
উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান:
ইমাম ইবন কাছীর রহেমাহুল্লাহ ইবন আব্বাস ও আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমার হাদীস দু’টি বর্ণনা করার পর উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান কল্পে যা বলেছেন, সংক্ষেপে তা নিম্নে বর্ণিত হলো :
তিনি বলেন : ‘‘যেহেতু ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসে ‘عشرة قرون’ দশ যুগ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ইসলামী ধ্যান-ধারণা প্রচলিত থাকার কথা বর্ণিত হয়েছে, সেহেতু ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসকে আবু উমামাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর হাদীসের পরিপূরক হিসেবে গণ্য করতে হবে। এবার ‘قرن’ শব্দের অর্থ যদি যুগ ধরা হয়, তা হলে উভয় হাদীসের অর্থ দাঁড়াবে : আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যকার প্রথম দশ যুগ অর্থাৎ এক হাজার বছর আদম সন্তানদের মাঝে ইসলাম ছিল। তাঁদের মধ্যকার পরবর্তী যুগসমূহে মানুষেরা ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে গিয়েছিল। ক্বরন (قرن) শব্দ দ্বারা যদি ‘প্রজন্ম’ এর অর্থ গ্রহণ করা হয়, যেমন কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে তা এ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে,[7] তা হলে হাদীস দু’টির অর্থ হবে : আদম ও নূহ এর মাঝে দশ প্রজন্মের মানুষ অতিবাহিত হয়েছে, যারা সকলেই ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। নূহ পূর্ববর্তী মানুষেরা সাধারণত দীর্ঘজীবী হতেন বিধায়, আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালাম-এর মাঝে এক হাজার বছর অতিবাহিত না হয়ে হাজার হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ারই কথা। এ কথাটি সত্য হওয়ার পাশাপাশি যেহেতু ক্বরন (قرن) দ্বারা প্রজন্মের অর্থ গ্রহণ করলে তা বাস্তবতা ও ইতিহাসের নিরিখে সঠিক বলে মনে হয় না, তাই ক্বরন (قرن) শব্দ দ্বারা ‘যুগ’ এর অর্থই গ্রহণ করতে হবে’’[8]
আমার মতে ইমাম ইবন কাছীর (রহ.) কর্তৃক উপরে বর্ণিত উভয় হাদীসের সমাধান গ্রহণ করার পাশাপাশি নিম্নরূপভাবেও উভয় হাদীসের মধ্যে সমাধান করা যেতে পারে। আর তা হলো- আবু উমামাহ এর হাদীসে ইসলাম শব্দটি না থাকায় হতে পারে সে হাদীসে ‘قرن’ দ্বারা আদম ও নূহ এর মাঝে দশ প্রজন্মের মানুষ অতিবাহিত হওয়ার কথাই বর্ণিত হয়েছে। সে সময়ের মানুষেরা অধিক আয়ু লাভ করতেন বিধায়, দশ প্রজন্ম অতিবাহিত হতে কয়েক হাজার বছর সময় লেগেছে। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে কতকাল তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এ বিষয়ের বর্ণনা আবু উমামাঃ এর হাদীসে বর্ণিত হয় নি। অন্যদিকে ইবন আব্বাসের হাদীসে ‘عشرة قرون’ দশ যুগ বা প্রজন্মের ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকার বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে। এখন যদি এ হাদীসে বর্ণিত ‘ عشرة قرون’ দ্বারা আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যে দশ যুগ অতিবাহিত হয়েছে বলে মনে করা হয়, তা হলে তা বাস্তবতা ও ইতিহাসের সাথে খাপ খায় না।
তাই বাধ্য হয়ে এ-কথা বলতে হবে যে, ইবন আব্বাসের হাদীস দ্বারা উভয়ের মধ্যকার মোট সময়ের বর্ণনা করার উদ্দেশ্য করা হয়নি; বরং কত সময় তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল, তা বর্ণনা করাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মূল উদ্দেশ্য ছিল এবং এ উদ্দেশ্যেই বোধ হয় তিনি তাতে ‘ইসলাম’ শব্দটি অতিরিক্ত যোগ করেছিলেন। অতএব, প্রমাণিত হলো যে, আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মাঝে দশ প্রজন্মের লোক অতিবাহিত হয়েছে। তবে আদম আলাইহিস সালাম-এর তিরোধানের পর তাঁর বংশধররা এক হাজার বছর পর্যন্ত ইসলামের উপর কায়েম ছিল। পরবর্তী সময়ের প্রজন্মের লোকেরা পথভ্রষ্ট হয়ে যায়। সে জন্য তাদের হেদায়াতের উদ্দেশ্যে প্রথমত আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে নবী হিসেবে প্রেরণ করেন এবং তিনি খুব একটা সফলকাম হতে না পারলে পরবর্তীতে আদম আলাইহিস সালাম থেকে নিয়ে নূহ আলাইহিস সালাম পর্যন্ত দশ প্রজন্ম অতিক্রান্ত হওয়ার প্রাক্কালে নূহ আলাইহিস সালাম-কে প্রথম রাসূল হিসেবে তাদের নিকট প্রেরণ করা হয়।
والله أعلم
[2] ইদ্রিস আলাইহিস সালাম এর প্রেরণকাল, তিনি নবী কিংবা রাসূল ছিলেন, এ সম্পর্কে কুরআন বা হাদীস থেকে বিস্তারিত পওয়া যায় না। যদিও ঐতিহাসিকগণ তাকে ‘আখনূখ’ বলেছেন এবং আদম ও নূহ আলাইহিমাস সালামের মধ্যবর্তী সময়ে প্রেরিত হয়েছিলেন বলেছেন, কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন তিনি এবং ইলিয়াস আলাইহিস সালাম একই ব্যক্তি। সে হিসেবে তিনি বনী ইসরাইলের একজন নবী। আদম ও নূহ এর মাঝখানে তিনি প্রেরিত হন নি। এর আরও একটি যৌক্তিক কারণ হচ্ছে, তিনি যদি আদম ও নূহ এর মাঝখানে এসে থাকবেন তবে নিশ্চয় সেখানে শির্ক হয়ে থাকবে, যা উপরোক্ত হাদীসের বিপরীত। কারণ, রাসূল প্রেরিত হওয়ার জন্য সর্বজন গৃহীত শর্ত হচ্ছে, তাদের উম্মতের মধ্যে ঈমানদার ও কাফের উভয় শ্রেণি থাকবেন। তবে যদি তাঁকে কেবল নবী বলা হয়, সেটা ভিন্ন কথা। [সম্পাদক]
[3]. আল-কুরআন, সূরা ইসরা : ১৭।
[4]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মানাক্বিব, বাবু ফাদাইলিস সাহাবাহ; ৩/৫/১৬৩; ইমাম আহমদ, প্রাগুক্ত; ১/৩৭৮।
[5]. ইবনুল জাওযী, আবুল ফরজ আব্দুর রহমান, তলবীসে ইবলীস; (বৈরুত : দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ৬৩-৬৪।
[6]. ইবন কাছীর, ইসমাঈল, আবুল ফেদা, ক্বাছাছুল আম্বিয়া; সম্পাদনা ও টীকা : ‘আব্দুল কাদির আহমদ আত্বা, (কায়রো : মাত্ববায়াতু হেসান, ১ম সংস্করণ, ১৯৮১ খ্রি.), পৃ. ১০৪। ইবনে হিববানের বর্ণনা মতে এ হাদীসটি ইমাম মুসলিমের শর্তানুযায়ী সহীহ, তবে তিনি তাঁর সহীহ মুসলিমে তা বর্ণনা করেননি।
[7].আল-কুরআন, সূরা ইসরা এর ১৭ নং আয়াত, এবং সূরা মু’মিনুন এর ৩১ নং আয়াত দ্রষ্টব্য।
[8].ইবনে কাছীর, কাসাসুল আম্বিয়া; পৃ.১০৪, ১০৫।
আদম সন্তানদের তাওহীদ থেকে অংশীবাদের দিকে চলে যাওয়ার সূত্রপাত হয় প্রথমত তাদের মধ্যকার সৎমানুষদের বৈঠকশালা ও কবরসমূহের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ এবং তাঁদের মূর্তি তৈরী করার মধ্য দিয়ে। প্রথমে মূর্তি তৈরীর উদ্দেশ্য ছিল সৎ মানুষদের স্মরণ করা এবং এর মধ্য দিয়ে তাঁদের সৎকর্মসমূহের অনুসরণ করা। শয়তানের প্ররোচনায় পড়েই মূলত তারা এ কাজটি করেছিল বলে তিনটি ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায় :
প্রথম বর্ণনা :
ইমাম ইবন আল-জাওযী ঐতিহাসিক হিশাম ইবন মুহাম্মদ ইবন আস-সা-ইব আল-ক্বালবী থেকে বর্ণনা করেছেন। হিশাম বলেন : আমার পিতা বলেছেন : সর্বপ্রথম মূর্তি পূজা করা হয় আদম আলাইহিস সালাম-এর তিরোধানের পর। শীশ এর সন্তানরা আদম আলাইহিস সালাম-কে ভারতের (বর্তমান শ্রীলংকার) ‘ইয়াজ’ নামক পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বরতম সেই পর্বতের গুহায় দাফন করে যেখানে তাঁকে বেহেশত্ থেকে অবতরণ করানো হয়েছিল। হিশাম বলেন : আমার পিতা আমাকে বলেছেন, তিনি আবূ সালেহ থেকে এবং তিনি ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণনা করেছেন : ‘‘আদম আলাইহিস সালাম এর ছেলে শীশ এর সন্তানরা সে গুহাতে আদম আলাইহিস সালাম-এর শরীরের পার্শ্বে আগমন করে এর সম্মান করতো এবং তাঁর জন্য আল্লাহ তা‘আলার রহমত কামনা করতো। এদের এ অবস্থা দেখে কাবিলের সন্তানদের একজন বললো : হে কাবিলের সন্তানগণ! বনী শীশদের একটি ত্বওয়াফ করার স্থান রয়েছে যার চার পার্শ্বে তারা ত্বওয়াফ করে এবং এটাকে তারা সম্মান করে, অথচ তোমাদের এ ধরনের কিছু নেই। তাই সে তাদের জন্য একটি মূর্তি তৈরী করলো এবং সে-ই হলো প্রথম মানুষ যে মূর্তি তৈরী করলো।’’[1]
দ্বিতীয় বর্ণনা :
এ বর্ণনাটিও ইমাম ইবন আল-জাওযী হিশাম থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, ‘ওয়াদ্দ’ ‘সুয়া‘’ ‘য়াগুছ’ ‘য়াউক’ ও নসর’ এরা সকলেই সৎ মানুষ ছিলেন। তারা সকলেই এক মাসের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন। ফলে তাঁদের স্বজনরা তাঁদের জন্য খুবই বেদনার্ত হয়। তাদের এ অবস্থা দেখে কাবিল গোত্রের এক ব্যক্তি বললো: আমি কি তোমাদের জন্য তাঁদের আকৃতিতে আত্মাবিহীন পাঁচটি মূর্তি তৈরী করে দেব? তারা সবাই এতে সম্মত হলে সে তাদের জন্য তাঁদের আকৃতিতে পাঁচটি মূর্তি নির্মাণ করে দিল। এর পর লোকেরা তাদের রক্তের সম্পর্কানুযায়ী এ মূর্তিগুলোর নিকটে এসে এগুলোকে নিজের ভাই, চাচা ও চাচাতো ভাই এর মত মনে করে এগুলোকে সম্মান ও এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতে থাকলো।
এ অবস্থার উপর এ যুগ অথবা এ প্রজন্ম অতিবাহিত হয়ে যায়। এ মূর্তি নির্মাণ করা হয় ইয়াজাজ ইবন মাহলাইল ইবন কাইনান ইবন আনূশ ইবন শীশ ইবন আদম আলাইহিস সালাম-এর যুগে। এরপর দ্বিতীয় যুগ বা প্রজন্ম আসলে তারা এ মূর্তিগুলোকে প্রথম প্রজন্মের বা যুগের চেয়ে আরো অধিক পরিমাণে সম্মান প্রদর্শন করে। এরপর আসে তৃতীয় যুগ বা প্রজন্মের লোকেরা, তারা বললো : প্রথম যুগের জনগণ আল্লাহ তা‘আলার নিকট এ পাঁচটি মূর্তির শাফা‘আত প্রাপ্তির আশায় এঁদের সম্মান করেছে। এ মনে করে এ মূর্তিগুলোর উপাসনা করার ফলে তারা এগুলোর মান-মর্যাদা অনেক বৃদ্ধি করে। এভাবে তাদের কুফরী কার্যকলাপ মারাত্মক আকার ধারণ করলে অবশেষে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট সর্বপ্রথম নবী হিসেবে প্রেরণ করে তাদেরকে তাওহীদের প্রতি আহ্বান জানান, কিন্তু তারা তাঁকে অস্বীকার করে। ফলে আল্লাহ তা‘আলা ইদ্রীস আলাইহিস সালাম-কে সমুন্নত স্থানে উঠিয়ে নেন। কলবী আবূ সালেহ থেকে এবং আবূ সালেহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে যে বর্ণনা করেছেন, সে অনুযায়ী বনী আদমের অবস্থা নূহ পর্যন্ত এভাবে গুরুতর থেকে গুরুতর হতে থাকে, অবশেষে আল্লাহ নূহ আলাইহিস সালাম-কে তাদের নিকট রাসূল হিসেবে প্রেরণ করেন।’’[2]
উপর্যুক্ত এ দু’টি বর্ণনার দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, মূর্তি নির্মাণের কাজটি তাদের অনেকটা স্বেচ্ছা প্রনোদিতভাবেই হয়েছিল। তবে প্রকৃতপক্ষে তা শয়তানের প্ররোচনার ফলেই হয়েছিল; কারণ শয়তানই বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল এবং এ সব যে শয়তানের প্ররোচনায়ই হয়েছে তাও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। সূরা নূহ এ বর্ণিত হয়েছে :
﴿ وَقَالُواْ لَا تَذَرُنَّ ءَالِهَتَكُمۡ وَلَا تَذَرُنَّ وَدّٗا وَلَا سُوَاعٗا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسۡرٗا ٢٣ ﴾ [نوح: ٢٣]
‘‘তারা বললো: তোমরা তোমাদের দেবতাদের পরিত্যাগ করো না, আরো পরিত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুয়া‘, য়াগুছ, য়া‘উক ও নছরকে’’[3]
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, এগুলো হচ্ছে নূহ আলাইহিস সালাম-এর জাতির পূর্ব পুরুষদের মধ্যকার পাঁচজন সৎ মানুষের নাম। তাঁরা মৃত্যুবরণ করার পর শয়তান তাঁদের জাতির নিকট এসে এ মর্মে প্ররোচনা দান করে যে, তোমরা তাঁদের বৈঠকশালাতে তাঁদের মূর্তি দাঁড় করো এবং তাঁদের নামে এগুলোর নামকরণ করো। শয়তানের নির্দেশে তারা তা করে। ধীরে ধীরে এ প্রজন্মের লোকদের বিদায়ের পর পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের নিকট এ মূর্তিগুলোর প্রকৃত ইতিহাস বিলুপ্ত হয়ে গেলে এগুলোর উপাসনা করা হয়।’’[4]
ইমাম ইবন জারীর আত-ত্ববারী (২২৪-৩১০) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন : ‘‘এরা পাঁচজন আদম ও নূহ আলাইহিস সালাম-এর মধ্যবর্তী সময়ের সৎ মানুষ ছিলেন। তাঁদের পদাঙ্ক অনুসরণকারী অনেক মানুষ ছিল। তাঁরা মৃত্যুবরণ করার পর তাঁদের অনুসারীরা বললো : আমরা যদি তাঁদের প্রতিকৃতি নির্মাণ করি, তা হলে তা দেখে আমরা আল্লাহর উপাসনার প্রতি অধিক আগ্রহী ও মনোযোগী হতে পারবো। এ মনে করে তারা তাঁদের প্রতিকৃতি তৈরী করলো। এদের মৃত্যুর পর দ্বিতীয় প্রজন্মের জনগণের নিকট ইবলীস (শয়তান) এসে বললো : তোমাদের পূর্বপুরুষগণ এঁদের উপাসনা করতো, এঁদের ওসীলায় তারা বৃষ্টি কামনা করতো। এভাবে শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে তারা তাঁদের উপাসনা করতে আরম্ভ করে।’’[5]
উপর্যুক্ত এ সব বর্ণনার দ্বারা বুঝা যায় যে, এ পাঁচ জন সৎ মানুষের মূর্তি নির্মাণ মূলত শয়তানের প্ররোচনায়ই হয়েছিল। এটি শয়তানের সে প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নেরই প্রারম্ভিক কাজ ছিল, যা সে জান্নাত হতে বিতাড়িত হওয়ার সময় আদম সন্তানদেরকে বিভ্রান্ত করার জন্য করেছিল।
তৃতীয় বর্ণনা :
ইমাম ইবন কাছীর আবু জা‘ফর আল-বাক্বির থেকে ‘ওয়াদ্দ’ সম্পর্কে একটি বর্ণনা দিয়েছেন। সংক্ষেপে তা নিম্নরূপ : ইমাম আবু জা‘ফর আল-বাক্বির এর নিকট ইয়াযীদ ইবন আল-মুহাল্লাব সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বলেন : ইয়াযীদ ইবন আল-মুহাল্লাব এমন এক স্থানে নিহত হয়েছিলেন যেখানে সর্বপ্রথম গায়রুল্লাহর উপাসনা করা হয়েছিল। ‘ওয়াদ্দ’ নামের একজন সৎ মানুষ ছিলেন, তিনি তাঁর জাতির কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর ব্যাবিলনের মানুষেরা তাঁর কবরের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে তাঁর জন্য খুবই আহাজারী করতো। ইবলীস তাদের এ অবস্থা দেখে একজন মানুষের আকৃতি ধরে আগমন করে তাদেরকে বললো : এ ব্যক্তির জন্য তোমাদের যে কী দুঃখ ও বেদনা, আমি তা লক্ষ্য করেছি। আমি কি তোমাদের জন্য তাঁর প্রতিকৃতি নির্মাণ করে দেব? যা তোমরা তোমাদের যৌথ মিলন কেন্দ্রসমূহে রেখে এর মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করবে?
তারা এতে সম্মত হলে সে তাঁর অনুরূপ একটি মূর্তি তৈরী করে দিল। তারা এটিকে তাদের যৌথ মিলনকেন্দ্রে রেখে তাঁকে স্মরণ করতে থাকে। তাদের স্মরণের এ অবস্থা দেখে শয়তান পুনরায় এসে বললো : আমি কি তোমাদের প্রত্যেকের গৃহে রাখার জন্য অনুরূপ মূর্তি তৈরী করে দেব? তারা এতেও সম্মত হলে সে প্রত্যেক গৃহবাসীর জন্য এর অনুরূপ মূর্তি তৈরী করে দেয়। তারা তা গ্রহণ করে এর মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করতে থাকে। তাদের সন্তানরা তাদের এ সকল কার্যকলাপ দেখতে থাকে। বংশ বৃদ্ধি হয়ে যখন নতুন প্রজন্ম তাদের স্থান দখল করে নিল এবং তাঁকে স্মরণ করার মূল কারণ সম্পর্কে পরবর্তী প্রজন্মের লোকেরা অজ্ঞ রয়ে গেল, তখন তাদের সন্তানের সন্তানেরা আল্লাহকে ব্যতীত এ মূর্তিরই উপাসনা করতে লাগলো। ফলে ‘ওয়াদ্দ’ই হলেন প্রথম দেবতা যাকে আল্লাহর সাথে উপাসনা করা হয়।’’[6]
এ তিনটি ঐতিহাসিক বর্ণনা আমাদেরকে মোটামুটিভাবে এ প্রমাণ দিচ্ছে যে, তাওহীদ থেকে অংশীবাদের দিকে মানুষের পথভ্রষ্টতার সূত্রপাত হয় সৎমানুষদের (যারা সাধারণ মানুষদের পরিভাষায় আউলিয়া) কবরসমূহে প্রারম্ভে অবস্থান গ্রহণ এবং পরবর্তীতে তাঁদেরকে স্মরণ ও আল্লাহ তা‘আলার উপাসনায় আগ্রহ লাভের উদ্দেশ্যে তাঁদের মূর্তি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে পরবর্তী প্রজন্মের লোকদের কাছে সেই সৎ মানুষদের মূর্তি নির্মাণের পিছনে তাদের পূর্বপুরুষদের কী উদ্দেশ্য ছিল, তা হারিয়ে যায়। এর সাথে সংযোজিত হয় আল্লাহর রুবূবিয়্যাত সম্পর্কিত ধর্মীয় জ্ঞানের অভাব। সে কারণে তারা পথভ্রষ্টতার দিকে অনেক দূর এগিয়ে যায়।
তারা এ সব মূর্তির সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কী কী কর্মপন্থা অবলম্বন করেছিল, এর বিশদ কোন বর্ণনা কুরআন ও হাদীসে পাওয়া না গেলেও এ কথা অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা যায় যে, আউলিয়াদেরকে কেন্দ্র করে আজকের সাধারণ মানুষেরা যে সব অলীক ধ্যান-ধারণা পোষণ করে, তারাও তাঁদের অলিদের ব্যাপারে সে ধরনের ধ্যান-ধারণা পোষণ করতে শুরু করেছিল। তাঁদেরকে তাদের দুনিয়া-আখেরাতের জীবনের কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের ক্ষেত্রে আল্লাহর সাথে শরীক করে নিয়েছিল। তাঁদেরকে আল্লাহর দরবারে তাদের অভাব অভিযোগ উপস্থাপনের মাধ্যম ও সুপারিশকারী হিসেবে গণ্য করেছিল। সে সময়ে কোনো শরী‘আত না থাকাতে[7] তারা তাদের অলিদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য এমন সব কর্ম করতে আরম্ভ করেছিল যা প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ তা‘আলার উপাসনার শামিল ছিল। এভাবে তারা শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে শির্কী কর্মে নিমজ্জিত হয়েছিল।
আদম সন্তানদেরকে এভাবে পথভ্রষ্ট করার মাধ্যমে শয়তান প্রত্যেক যুগে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে অবগত হয়ে যায় এবং পরবর্তী প্রতিটি জাতিকে শির্কে নিমজ্জিত করার ক্ষেত্রে সে তার পরিচিত এই পদ্ধতি ও কৌশল প্রয়োগ করতে থাকে। যদিও যুগের চাহিদানুযায়ী প্রয়োজনের নিরিখে এ পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে সে নিত্য নতুন পন্থা অবলম্বন করেছে। কুরআনুল কারীম আমাদের জন্য এ কথার উত্তম সাক্ষ্য যে, শয়তান এ পদ্ধতি প্রয়োগ করেই অতীতে হূদ, সালেহ, ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসা আলাইহিস সালাম-এর জাতিসমূহকে পথভ্রষ্ট করেছিল। তাদেরকে নিজ হাতে তৈরী মুর্তিসমূহের ব্যাপারে একই ধরনের ধারণা ও উপাসনায় লিপ্ত করেছিল। শয়তান এভাবে যুগের পর যুগ ধরে বনী আদমকে পথভ্রষ্ট করার জন্য তার সেই পূর্ব প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্য বিরামহীনভাবে কাজ করে চলেছে।
তার এ প্রচেষ্টার ফলে যে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-একনিষ্ঠ তাওহীদের অনুসারী ও ঘোষণাকারী ছিলেন, এক সময় সে ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর বংশধরদেরকেও সে পথভ্রষ্টতার অতলতলে নিক্ষেপ করেছিল। মহান আল্লাহ একান্ত অনুগ্রহে শেষ নবী ও রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে প্রেরণ করার ফলে দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদার অনুসারীদের মধ্যে পুনরায় তাওহীদের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল; কিন্তু শয়তানের নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টার ফলে সেই তাওহীদী বিশ্বাসের মাঝেও সুদূর অতীতকাল থেকেই শয়তান পুনরায় শির্কী চিন্তা-ভাবনা ও কর্মের অনুপ্রবেশ ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে বর্তমানে মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য মুসলিমদের অবস্থা সেই দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদারদের অনুরূপ হয়ে গেছে, যাদের ব্যাপারে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন :
﴿ وَمَا يُؤۡمِنُ أَكۡثَرُهُم بِٱللَّهِ إِلَّا وَهُم مُّشۡرِكُونَ ١٠٦ ﴾ [يوسف: ١٠٦]
‘‘এদের অধিকাংশরাই মুশরিক অবস্থায় আল্লাহর উপর বিশ্বাস করে’’।[8]
>[2]. তদেব।
[3]. আল-কুরআন, সূরা নূহ : ২৩।
[4]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফছীর, সূরা নূহ, ৩/৬/২৮১।
[5]. ইবনে কাছীর, জামিউল বয়ান ফী তাফছীরিল ক্বুরআন; ১২/২৯/৬২; ইবনু কাইয়্যিম আল-জাওযীয়্যাহ. এগাছাতুল লহফান; ২/১৬১।
[6]. ইবনু কাছীর, ক্বাসাসুল আম্বিয়া; পৃ. ১১৫; জালালুদ্দীন আস-সুয়ূতী, আদ-দুররুল মানছূর; ৬/২৬৯।
[7] শরী‘আত ছিল না, এটা স্বাভাবিক অর্থে নয়, অর্থাৎ শরী‘আত সম্পর্কে মানুষ অজ্ঞ হয়ে গিয়েছিল। [সম্পাদক]
[8].আল-কুরআন, সূরা ইউসুফ : ১০৬।
ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রাসূল হয়ে প্রেরিত হওয়ার প্রাক্কালে আরব দ্বীপের অধিবাসীদের অধিকাংশ লোকেরাই ‘আরবুল ‘আরিবাহ ও ‘আরবুল মুসতা‘রিবাঃ[1] এর অধঃস্তন বংশধর ছিল। মক্কা নগরী ও এর পার্শ্ববর্তী স্থানসমূহে আল- ‘আরাবুল মুসতা‘রিবাঃদের বসবাস ছিল। তবে আল-‘আরাবুল ‘আরিবাহ বলে পরিচিত লোকেরাই হলো আরব দ্বীপের আদি অধিবাসী এবং ‘আরাবুল মুসতা‘রিবাহ বলে পরিচিতরা হলো সেখানে অভিবাসনকারী। এদের প্রথম পুরুষ যিনি এ দ্বীপে অভিবাসন গ্রহণ করেন, তিনি হলেন ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। তাঁকে আমাদের আদি পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর মাতাসহ ছোট বেলায় কা‘বা শরীফের পার্শ্বে আল্লাহর আদেশে রেখে গিয়েছিলেন।
ইসমাঈল আলাইহিস সালাম বড় হয়ে জনগণকে তাঁর পিতা ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর দ্বীনের প্রতি আহ্বান জানান। ফলে সে সময়ের অধিকাংশ লোকেরাই তাঁর অনুসারী হয়ে যেয়ে মহান আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতে সম্পূর্ণরূপে তাওহীদে বিশ্বাসী হয়ে যায়।[2] যুগের আবর্তনে যখন তাদের মধ্যে কয়েক প্রজন্ম অতিক্রান্ত হয়ে যায় এবং দীর্ঘদিন যাবৎ ধর্ম সম্পর্কে তারা নতুন করে কোনো শিক্ষা পায়নি, তখন তারা ধর্মের অনেক বিষয়াদি ধীরে ধীরে ভুলতে থাকে। এক পর্যায়ে তাদের মাঝে শুধু তাওহীদী বিশ্বাস এবং ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম-এর স্মৃতি বিজড়িত কিছু ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও নিদর্শনাদি ব্যতীত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে নি।
অবশেষে তারা তাওহীদী বিশ্বাস থেকেও বিচ্যুত হয়ে মূর্তি পূজা করার ফলে মুশরিকে পরিণত হয়। তাদের মাঝে প্রতিমা পূজার মাধ্যমে শির্কী কর্মকাণ্ডের সূচনা হয় কা‘বা শরীফের সম্মানে এর পার্শ্ব থেকে সংগৃহীত পাথরের চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করার মাধ্যমে, যা তারা মক্কা থেকে দূর-দূরান্তে হিজরত করার সময় সাথে করে নিয়ে অবতরণ স্থলের এক পার্শ্বে স্থাপন করতো।[3] তাদের মাঝে ইব্রাহীম ও ইসমাঈল আলাইহিস সালাম-এর ধর্মের কিছু বিষয়াদি যেমন : কা‘বা শরীফের সম্মান করা, এর ত্বওয়াফ, হজ্জ ও ‘উমরা করা, সাফা ও মারওয়াহ পর্বতদ্বয়ে সা‘য়ী করা, আরাফা ও মুযদলিফায় অবস্থান গ্রহণ করা, আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উট ও বকরী কুরবানী বা উৎসর্গ করা...ইত্যাদি কর্ম প্রচলিত ছিল। যদিও এ সব ক্ষেত্রে তারা নিজ থেকে কিছু বিষয়াদি সংযোজন ও বিয়োজন করেছিল যা মূল ধর্মীয় কর্মের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।[4]
>[2]. তদেব; পৃ. ৩৫।
[3]. ইবন কাছীর, আল-বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াহ; (বৈরুত : মাকতাবাতুল মা‘আ-রিফ, ৬ষ্ঠ সংস্করণ, ১৯৮৫ খ্রি.), ১/১৮৮।
[4]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৫-১৬৬। (সংক্ষিপ্তাকারে)
এরপর তাদের ধর্মীয় অবস্থার আরো অবনতি ঘটে। তাদের মাঝে মূর্তিপূজার মাধ্যমে শির্কী কর্মকাণ্ড শুরু হয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রেসালত লাভের প্রায় ৩০০ বছর পূর্বে[1] খুযা-‘আহ গোত্র প্রধান ও মান্যবর ব্যক্তিত্ব ‘আমর ইবন লুহাই এর মাধ্যমে। ঐতিহাসিক ইবন হেশামের বর্ণনামতে ‘আমর ইবন লুহাই কোনো উপলক্ষে মক্কা থেকে সিরিয়া গমন করে সেখানকার লোকদেরকে কতিপয় মূর্তির পূজা করতে দেখে বলে : এ মূর্তিগুলো কী, যাদের আপনারা উপাসনা করছেন?
উত্তরে লোকেরা বললো : এদের কাছে বৃষ্টি চাইলে এরা আমাদেরকে বৃষ্টি দান করে, সাহায্য চাইলে তারা আমাদের সাহায্য করে। এ কথা শুনে ‘আমর ইবন লুহাই বললো : এদের মধ্য থেকে একটি মূর্তি আমাকে দান করুন, আমি সেটিকে আরব দেশে নিয়ে যাব, ফলে আরবরা এর উপাসনা করবে। এতে লোকেরা তাকে ‘হুবল’ নামের একটি মূর্তি দান করে। অতঃপর সে তা নিয়ে মক্কায় আগমন করে এবং তা কা‘বা শরীফের নিকটতম এক স্থানে সম্মানের সাথে স্থাপন করার পর আরব জনগণকে এর উপাসনা ও সম্মান করার জন্য নির্দেশ করে।[2]
এ ‘আমর ইবন লুহাই ছিল জিন সাধক। সে তার অনুগত জিন এর পরামর্শ অনুযায়ী নূহ আলাইহিস সালাম-এর জাতির উপাস্য সেই মূর্তিগুলো জিদ্দা এলাকা থেকে মাটি খনন করে বের করে নিয়ে আসে। সেগুলোকে নূহ আলাইহিস সালাম-এর সময়কার প্রলয়ঙ্করী বন্যা ও তুফান এতদঅঞ্চলে বহন করে নিয়ে এসেছিল। ধীরে ধীরে বন্যার পানি নেমে যাবার সময় এগুলো জিদ্দা এলাকার চরাঞ্চলে আটকা পড়েছিল এবং পরবর্তিতে তা বালুর নিচে চাপা পড়ে গিয়েছিল।
‘আমর ইবন লুহাই তার অনুগত জিনের পরামর্শে এগুলোকে বের করে নিয়ে এসে হজ্জের মৌসুমে ‘আরব জনগণকে এগুলোর উপাসনা করার প্রতি আহ্বান জানায়। লোকেরা এতে তার আনুগত্য করলে সে বিভিন্ন গোত্রের মাঝে তা বন্টন করে দেয়।[3] সে অনুযায়ী ‘ওয়াদ’ (وَدْ) নামের মূর্তিটি ছিল দাওমাতুল জানদাল এলাকার ‘কালব’ গোত্রের নিকট, সুয়া‘ (سُوَاع) নামের মূর্তিটি ছিল ‘হুজায়েল’ গোত্রের নিকট, ‘য়াগুছ’ (يغوث) নামের মূর্তিটি ছিল ‘মুরাদ’ গোত্রের নিকট, ‘ইয়াউক’ (يعوق) নামের মূর্তিটি ছিল হামাদন গোত্রের নিকট, আর ‘নাছর’ (نسر) নামের মূর্তিটি ছিল ইয়ামনের ‘হিময়ার’ গোত্রের নিকট।[4] এ পাঁচটি মূর্তির পাশাপাশি ‘আরব জনপদে আরো অসংখ্য মূর্তি ছিল।
>[2]. ইমাম বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুত তাফসীর, বাব নং- ৩৯৮, ওয়ালা তাজারুন্না ওয়াদ্দান... হাদীস নং ৪৬৩৬, ৪/১৮৭৩; ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৭৬; ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৫;ইবনে কাছীর, আল-বেদায়াতু ওয়ান নেহায়াহ; ১/১৮৮।
[3]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৩-১৬৪ ।
[4]. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৭; ইবনে কাছীর, তাফছীরুল ক্বুরআনিল ‘আযীম; ৪/৪৫৪-৪৫৫; ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬২-১৬৪।
আরবের লোকেরা ছোট এবং বড় বিভিন্ন রকমের মূর্তিদেরকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাত ও উলূহিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছিল। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি মূর্তি নিম্নরূপ :
লাত :
এটি ‘ত্বায়েফ’ নামক স্থানের ‘ছক্বীফ’ গোত্রের প্রসিদ্ধ এক দেবী মূর্তির নাম। এর মাধ্যমে তারা কুরায়েশ গোত্রের উপর গর্ব করতো। ইমাম ইবনে কাছীর এর বর্ণনা মতে এটি ছিল একটি সাদা পাথরের মূর্তি। এর মধ্যে একটি ঘরের চিত্র অংকিত ছিল। কা‘বা ঘরের ন্যায় এটিকে তারা পর্দা দ্বারা আবৃত করে রেখেছিল। অনুরূপভাবে তারা কা‘বা শরীফের প্রাঙ্গণের ন্যায় এর প্রাঙ্গণকেও পবিত্র জ্ঞান করতো। ছক্বীফ গোত্র থেকেই এর খাদেম নিয়োগ করা হতো। ইমাম ইবনে জারীর এর বর্ণনা মতে তারা ‘আল্লাহ’ শব্দের স্ত্রী লিঙ্গ হিসেবে এর নাম ‘লাত’ রেখেছিল।[1] ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, সেখানে সুদূর অতীতে একটি চারকোণা বিশিষ্ট পাথরে বসে একজন ইয়াহূদী ব্যক্তি হাজীদের জন্য ‘সাতু’ তৈরী করে খেতে দিত। লোকটি সেখানে মৃত্যুবরণ করলে তার সততা ও ভাল কর্মের জন্য লোকেরা এ-পাথরকে সম্মান করে এর পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করতে আরম্ভ করে।[2] কুরায়েশ এবং সমগ্র আরব গোত্রের লোকেরাও একে পূজা ও সম্মান করতো।[3]
উযযা :
‘উয্যা’ নামের এ দেবীটি মক্কার নিকটবর্তী ‘নাখলাহ’ নামক স্থানে স্থাপিত ছিল। এটা কুরায়েশ গোত্রের দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়মাপের দেবতা ছিল।[4] কুরায়েশরা কা‘বা শরীফের হরমের ন্যায় এর জন্যও একটি হরম (পবিত্র এলাকা) নির্ধারণ করেছিল। সম্ভবত এটি ছিল কুরায়েশদের যুদ্ধের দেবী। তাদের সাথে কারো যুদ্ধ হলে তারা এ দেবীর কাছে যুদ্ধে জয় কামনা করতো। সে জন্যই উহুদ যুদ্ধের সময় আবূ সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহু মুসলিমদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন : ‘‘আমাদের উয্যা দেবতা আছে, তোমাদের কোনো উয্যা নেই।’’[5] মূলত এ দেবতাটি ছিল বত্নে নাখলাহ নামক স্থানের তিনটি ছোট বাবলা গাছের সমষ্টি।[6] এ গাছগুলোতে একটি মহিলা জিন থাকতো। এর উপাসকরা তা বুঝতে না পারলেও এ জিনই এর উপাসকদেরকে এ গাছের মধ্য থেকে অলৌকিকভাবে শব্দ শুনাতো।[7] মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খালিদ ইবন আল-ওয়ালীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু-কে তা ধ্বংস করার জন্য প্রেরণ করেছিলেন। তিনি পর পর তৃতীয় গাছটি কাটতে উদ্যত হলে আকস্মিকভাবে সে জিনটি ঘাড়ে হাত রেখে, দাঁত কটমট করে, এলোমেলো কেশে কুৎসিত হাবশী মহিলার আকৃতিতে আত্ম প্রকাশ করে। খালেদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তরবারী দিয়ে তার ঘাড়ে আঘাত করলে তা দ্বিখণ্ডিত হয়ে হঠাৎ একটি কবুতরে রূপান্তরিত হয়ে মরে যায়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট ফিরে এসে সর্বশেষ গাছ কাটতে গিয়ে তিনি যা দেখলেন তা তাঁকে জানালেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তা শুনে বললেন :
«تِلْكَ الْعُزَّى وَ لاَ عُزَّى بَعْدَهَا لِلْعَرَبِ»
‘‘এ হাবশী মহিলাই মূলত ‘উয্যা’ ছিল, আরবদের জন্য এরপর আর কোন উয্যা থাকবে না।’’[8] অপর এক বর্ণনামতে উয্যা নামের এ দেবীটি একটি সাদা পাথর ছিল।[9]
মানাত :এটি প্রাচীন দেব-দেবীদের মাঝে অন্যতম একটি দেবীর নাম। সম্ভবত এটি ছিল কুরবানীর দেবী। এর নামে পশুর রক্ত প্রবাহিত করা হতো।[10] এটাকে ভাগ্যদাতা ও মৃত্যুদানকারী বলে মনে করা হতো।[11] মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী ‘কুদায়েদ’ নামক স্থানে এটি স্থাপিত ছিল। হজ্জ উপলক্ষে ‘ইয়াসরিব’ তথা মদিনার আওস এবং খযরজ গোত্রদ্বয়ের লোকেরা এসে এর চার পার্শ্বে ত্বওয়াফ করতো।[12] এতে (শয়তানের পক্ষ থেকে নিযুক্ত) একটি মহিলা জিন থাকতো এবং এ জিনই এর পূজারীদেরকে নানা রকম অলৌকিক কর্মকাণ্ড করে দেখাতো। মক্কা বিজয়ের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশে সা‘য়ীদ ইবন যায়দ আল-আশহালী রাদিয়াল্লাহু আনহু এ মূর্তিটি ধ্বংস করতে যান। এ সময় সে জিনটি কালো বর্ণের একটি মহিলা আকৃতিতে উলঙ্গ অবস্থায় এলোমেলো কেশে আত্মপ্রকাশ করে নিজের জন্য ধ্বংসের আহ্বান করে বুক চাপড়াতে ছিল। সা‘য়ীদ রাদিয়াল্লাহু আনহু তাকে এ অবস্থাতেই হত্যা করেন।[13]
>[2]. তদেব।
[3]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।
[4]. ইবনে হিশাম, প্রাগুক্ত; ১/৮৪; ড. ফারুক হামাদাহ, আল-ওয়াসিয়্যাতুন নববীয়্যাহ; (আল-মাগরিব : দারুছ ছেক্বাফাহ, ১ম সংস্করণ, ১৯৮৩ খ্রি.), পৃ. ১৬।
[5]. মাওলানা সয়ৈদ সুলায়মান নদভী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১৮।
[6]. ড. হাসান ইব্রাহীম হাসান, তারীখুল ইসলাম; (কায়রো : মাকতাবাতুন নাহদাতিল মিশরিয়্যাঃ, ১৪ সংস্করণ, ১৯৯৬ খিষ্টাব্দ.), পৃ. ৬১; মাওলানা সৈযদ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল ক্বুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, ১ম সংস্করণ, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪২০; ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।
[7]. ইবনুল জাওযী, প্রাগুক্ত ; পৃ. ৬৮।
[8]. ইবনে কাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ, এগাছাতুল লহফান; ২/১৬৮-১৬৯; আল-মুবারক পূরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪০৯-৪১০।
[9]. وقال آخرون كانت العزى حجرا أبيض وقال آخرون كان بيتا بالطائف تعبده ثقيف -দেখুন : ইবনে জারীর আত-ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ২৭/৫৯।
[10]. মাওলানা সৈয়দ সুলায়মান নদভী, তারীখু আরদিল কুরআন; (করাচী : দারুল এশা‘আত, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), পৃ. ৪১৮।
[11] . তদেব।
[12] . তদেব।
[13]. সফিয়্যুর রহমান মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; পৃ. ৪১০; -আত-ত্ববারী, আবু জা‘ফর মুহাম্মদ ইবনে জারীর, প্রাগুক্ত ; ২৭/৫৯।
লাত, উয্যা ও মানাত এগুলো তিনটি নারী দেবীর নাম। এগুলো মুশরিকদের কল্যাণ ও অকল্যাণ করতে পারে এ ধারণার ভিত্তিতে তারা এদেরকে সব সময় কল্যাণার্জন এবং অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আহ্বান করতো। তাদের এ আহ্বান সম্পর্কে আল্লাহ বলেন :
﴿ إِن يَدۡعُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ إِنَٰثٗا وَإِن يَدۡعُونَ إِلَّا شَيۡطَٰنٗا مَّرِيدٗا ١١٧ ﴾ [النساء: ١١٧]
‘‘তারাতো আল্লাহকে ব্যতীত শুধু নারীদের আহ্বান করে, আসলে তারা কেবল অবাধ্য শয়তানকেই আহ্বান করে’’।[1]
এখানে ‘ইনাসান’ বলে লাত, উয্যা, মানাত ও অন্যান্য নারী নামের সকল দেবীদেরকে উদ্দেশ্য করা হয়েছে।[2] এগুলোকে ‘ইনাস’ বলার পিছনে মোট তিনটি কারণ থাকতে পারে :
এক. ‘ইনাসান’ শব্দটি ‘উন্সা’ শব্দের বহুবচন। এর অর্থ নারী। লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটিকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণে এদেরকে ‘ইনাসান’ বলা হয়ে থাকতে পারে। মূলত কোনো নারীদের সাথে এদের ঐতিহাসিক কোনো সম্পর্ক থাকার কারণে নয়।[3]
দুই. আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার মতে ‘ইনাস’ অর্থ ‘আওছান’ তথা প্রতিমাসমূহ। ‘আওছান’ শব্দটি ‘ওয়াসান’ শব্দের বহুবচন। আরবীতে বহুবচন জাতীয় শব্দগুলো স্ত্রীলিঙ্গ হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। যেহেতু মুশরিকরা একাধিক ‘ওয়াছান’ তথা প্রতিমাকে আহ্বান করতো, সে জন্য এগুলোকে ‘ইনাছান’ বলা হয়েছে।[4]
তিন. মুশরিকরা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করে এদের মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য এদের উপাসনা করতো। তারা এগুলোর নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী করে এদের পূজা-অর্চনার জন্য কিছু নিয়ম নীতি তৈরী করেছিল, এদের গলায় অলংকার ঝুলিয়ে দিয়ে বলেছিল: এরা আল্লাহর মেয়ে যাদের আমরা উপাসনা করি। বিশিষ্ট তাবেঈ দাহহাক (রহ.) থেকে এ ব্যাখ্যাটি বর্ণিত হয়েছে।[5] ‘তারা এ সব মূর্তিকে আহ্বান করে মূলত অবাধ্য শয়তানকেই সাহায্যের জন্য আহ্বান করতো’ উক্ত আয়াতে এ কথা বলার কারণ হলো : শয়তানই মূলত তাদেরকে এ সবের আহ্বান করতে প্ররোচিত করতো। উবাই ইবনে কা‘ব রাদিয়াল্লাহু আনহু এর বর্ণনা মতে এ সব মূর্তির সাথে একটি করে মহিলা জিন থাকতো।[6]
আর এ জিনরাই অদৃশ্যে থেকে তাদের আহ্বানকারীদের উপকার করে দিত। ফলে মুশরিকরা এ উপকারকে এ সব মূর্তির কাজ বলেই মনে করতো। তাদের ধারণা মতে ফেরেশ্তারা আল্লাহর মেয়ে হওয়ার কারণে তারা আল্লাহর অতীব নিকটতম ও প্রিয়ভাজন। তাদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারলে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া সম্ভব। সে জন্যেই তারা তাদের উপাসনা করতো এবং বলতো: ‘‘তারা আমাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেবে, এ উদ্দেশ্যেই আমরা তাদের উপাসনা করছি’’।[7] আরো বলতো : ‘‘এরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফা‘আতকারী।’’[8]
লাত, উয্যা ও মানাত এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করার কারণ হিসেবে যে তিনটি কারণ বর্ণনা করা হয়েছে, এর যে কোনটির কারণে এগুলোর উপর্যুক্ত নামকরণ হয়ে থাকতে পারে। তৃতীয় সম্ভাবনাটির কথা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত না হলেও মুশরিকরা যে ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো এবং ফেরেশ্তাদেরকে উদ্দেশ্য করেই যে তারা এ তিনটি দেবীকে উপর্যুক্ত নামে নামকরণ করেছিল, তা স্বয়ং কুরআন দ্বারাই প্রমাণিত। তারা যে ফেরেশ্তাদেরকে নারী মনে করতো সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿وَجَعَلُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ ٱلَّذِينَ هُمۡ عِبَٰدُ ٱلرَّحۡمَٰنِ إِنَٰثًاۚ﴾ [الزخرف: ١٩]
‘‘তারা ফেরেশ্তাদেরকে, যারা আল্লাহর বান্দা, তাদেরকে নারী বলে স্থির করেছে’’।[9] আবার ফেরেশ্তাদেরকে যে তারা আল্লাহর মেয়ে মনে করতো, সে সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ أَلَكُمُ ٱلذَّكَرُ وَلَهُ ٱلۡأُنثَىٰ ٢١ تِلۡكَ إِذٗا قِسۡمَةٞ ضِيزَىٰٓ ٢٢ إِنۡ هِيَ إِلَّآ أَسۡمَآءٞ سَمَّيۡتُمُوهَآ أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ﴾ [النجم: ١٩، ٢٣]
‘‘তোমরা কি ভেবে দেখেছ লাত, উয্যা ও তৃতীয় আরেকটি মানাত সম্পর্কে? পুত্র-সন্তান কি তোমাদের জন্যে আর কন্যা-সন্তান আল্লাহর জন্যে। এটা হবে খুব অন্যায় বন্টন। এগুলো কতকগুলো নাম বৈ আর কিছুই নয়, যা তোমরা ও তোমাদের পূর্বপুরুষেরা রেখেছো, এসবের কোনো প্রমাণ আল্লাহ অবতীর্ণ করেননি।’’[10]উক্ত আয়াত দু’টির দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করেই তাদের উপাসনার মাধ্যমে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার উদ্দেশ্যে লাত, উয্যা ও মানাত নামের এ তিনটি দেবীকে নারীর নামে নামকরণ করেছিল। সে জন্যে ইমাম ইবনে কাছীরও তাঁর তাফসীরে দাহহাক কর্তৃক বর্ণিত ব্যাখ্যাকে أَفَرَأَيْتُمُ اللاَّتَ...الآية এর সাথে সামঞ্জস্যশীল বলে মন্তব্য করেছেন।[11]
>[2]. আল-কুরত্বুবী, আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আহমদ আল-আনসারী, আহকামুল কুরআন; (মিশর : আল-হাইআতুল মিশরিয়্যাতু লিল কুত্তাব, ৩য় সংস্করণ, ১৯৮৭ খ্রি.), ১০/৭৮।
[3]. তদেব।
[4]. ইবনে কাছীর, তাফছীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।
[5]. ইবনে জারীর ত্ববারী দাহহাক থেকে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
قال جرير عن الضحاك في الآية : قال المشركون للملائكة بنات الله وإنما نعبدهم ليقربونا إلى الله زلفى .قال فاتخذوهن أربابا وصوروهن جواري ، فحكموا وقلدوا وقالوا هؤلاء بنات الله الذي نعبده يعنون الملائكة .قال ابن كثير : هذا التفسير شبيه بقول الله تعالى :[ أفرأيتم اللات والعزى ] الآيات. –
দেখুন : ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।
[6]. তদেব।
[7].আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৩।
[8]. আল-কুরআন, সূরা ইউনুস : ১৮।
[9].আল-কুরআন, সূরা যুখরূফ : ১৯।
[10]. আল-কুরআন, সূরা নাজম : ১৯।
[11].ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আযীম; ১/৫৬৮।
মুশরিকরা লাত, উয্যা ও মানাতের নামে কোনো নারী আকৃতির মূর্তি তৈরী না করলেও তারা যে ফেরেশ্তাদেরকে উদ্দেশ্যে করেই এ সব নাম রেখে এগুলোর উপাসনা করতো, তা নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারাও প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ جَمِيعٗا ثُمَّ يَقُولُ لِلۡمَلَٰٓئِكَةِ أَهَٰٓؤُلَآءِ إِيَّاكُمۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٤٠ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ أَنتَ وَلِيُّنَا مِن دُونِهِمۖ بَلۡ كَانُواْ يَعۡبُدُونَ ٱلۡجِنَّۖ أَكۡثَرُهُم بِهِم مُّؤۡمِنُونَ ٤١ ﴾ [سبا: ٤٠، ٤١]
‘‘আর যেদিন তিনি সবাইকে একত্রিত করবেন, অতঃপর ফেরেশ্তাদের বলবেন: এরা কি তোমাদেরই উপাসনা করতো? তারা বলবে : আপনি পবিত্র, আপনিই আমাদের অভিভাবক, ওরা নয়; বরং তারা জিনেরই উপাসনা করতো এবং তাদের অধিকাংশরাই এদের উপর ঈমান আনয়ন করতো।’’[1]
এ আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মুশরিকরা কোনো কোনো ফেরেশ্তাদের উপাসনা করতো। আর এ দেবীগুলোর নাম নারীর নামে রাখাতে মনে হয় যেন তারা তিনজন ফেরেশ্তাকে উদ্দেশ্য করেই এ তিনটি দেবীর নাম এভাবে রেখেছিল। যদিও সে সব দেবীর স্থানে নারীর আকৃতির কোনো মূর্তি ছিল বলে কোন নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় না। তা পাওয়া না গেলেও তৎকালীন সময়ে আরব উপদ্বীপের বনী ইসমাঈল এবং অন্যান্য ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা ফেরেশ্তা ও নবীদেরকে ইলাহ ও রবের আসনে সমাসীন করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ وَلَا يَأۡمُرَكُمۡ أَن تَتَّخِذُواْ ٱلۡمَلَٰٓئِكَةَ وَٱلنَّبِيِّۧنَ أَرۡبَابًاۗ ﴾ [ال عمران: ٨٠]
‘‘কোন নবী তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিতে পারেন না যে, তোমরা ফেরেশ্তা ও নবীদেরকে অসংখ্য রব হিসেবে গ্রহণ করবে।’’[2]এ আয়াত দ্বারাও এ কথা প্রমাণিত হয় যে, কুরাইশরা কোনো কোনো ফেরেশ্তাকে আল্লাহ্র রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বানিয়ে নিয়েছিল এবং সে ধারণার ভিত্তিতে তারা তাদের নিকট নিজেদের জীবনের কল্যাণ কামনা করতো ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য তাদেরকে আহ্বান করতো। লাত, উয্যা ও মানাত নামের দেবীগুলোকে নারীর নামে নামকরণ করাতে বুঝা যায় যে, তারা তিনজন ফেরেশতাদের উদ্দেশ্য করেই এ তিনটি দেবীর নামকরণ করেছিল; কারণ, তারা ফেরেশ্তাদেরকে আল্লাহর মেয়ে মনে করতো।
والله أعلم بالصواب
>[2]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ৮০।
ঐতিহাসিক বর্ণনামতে এ দেবতা দু’টি মূলত ‘জুরহাম’ গোত্রের দু’জন মানুষ ছিল। য়াসাফ না-য়েলাহকে ভালবাসতো। একদা কা‘বা শরীফের অভ্যন্তরে তারা অবৈধভাবে যৌনকর্মে লিপ্ত হলে আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে তাৎক্ষণিক শাস্তিস্বরূপ দু’টি পাথরে রূপান্তরিত করেন। সাধারণ লোকেরা যাতে এদের থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে পারে সে জন্য লোকেরা এ পাথর দু’টির একটিকে কা‘বা শরীফের পার্শ্বে এবং অপরটিতে যমযম কূপের পার্শ্বে স্থাপন করেছিল। দীর্ঘদিন যাবত এ পাথর দু’টি এভাবেই ছিল। যুগের পরিক্রমায় এ পাথর দু’টির বাস্তব ইতিহাসও পরবর্তী লোকেরা ভুলে যায়। এরই মধ্যে তাদের মাঝে মূর্তি পূজার প্রচলন হয়, তখন অন্যান্য মূর্তির সাথে এ-গুলোকেও তারা পূজা করতে থাকে। কুরায়েশরা পরবর্তিতে কা‘বা শরীফের পাশেরটিকে অপরটির নিকটে স্থানান্তরিত করেছিল এবং এ দু’টির নিকট তারা পশু যবাই ও কুরবানী করতো।[1]
>