প্রথম পরিচ্ছেদ : অধিকাংশ মুসলিমদের শির্কে পতিত হওয়ার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ : ওলিগণ কি মানুষ ও আল্লাহর মাঝে ওসীলা বা মধ্যস্থতাকারী ?
তৃতীয় পরিচ্ছেদ : পার্থিব ও পরকালীন বিষয়ে অলিগণের শাফা‘আত
চতুর্থ পরিচ্ছেদ : সাধারণ মুসলিমদেরকে শির্কে পতিত করার ক্ষেত্রে শয়তানের বিভিন্ন অপকৌশল
নিম্নে তা বিস্তারিত উপস্থাপিত হলঃ
মানুষের প্রতিটি কাজের পিছনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কোনো না কোনো কারণ থাকে। সে অনুযায়ী আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশের যে সব মুসলিম বিভিন্ন শির্কী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন, তাদের সে সব বিশ্বাস ও কর্মের পিছনে কতিপয় পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে।
প্রথম পরোক্ষ কারণ : ইসলামের সঠিক আক্বীদা সম্পর্কে তারা অজ্ঞ
[السبب الأول غير المباشر لوقوع المسلمين في الشرك : جهالتهم عن العقيدة الإسلامية الصحيحة]
এ নিয়ে চিন্তা করলে পরোক্ষ কারণ হিসেবে যে বিষয়টিকে মৌলিকভাবে দায়ী করা যায় তা হলো : সঠিক ইসলামী আক্বীদা ও বিশ্বাস সম্পর্কে তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ ও মূর্খ। ইয়াহূদী, খ্রিস্টান ও দ্বীনে ইব্রাহীমের অনুসারী বলে দাবীদার আরব জনপদের লোকেরাও ঠিক এ পরোক্ষ কারণেই শির্কে নিমজ্জিত হয়েছিল বলে কুরআনুল কারীম ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়।
এ সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ وَيَوۡمَ يَحۡشُرُهُمۡ وَمَا يَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ فَيَقُولُ ءَأَنتُمۡ أَضۡلَلۡتُمۡ عِبَادِي هَٰٓؤُلَآءِ أَمۡ هُمۡ ضَلُّواْ ٱلسَّبِيلَ ١٧ قَالُواْ سُبۡحَٰنَكَ مَا كَانَ يَنۢبَغِي لَنَآ أَن نَّتَّخِذَ مِن دُونِكَ مِنۡ أَوۡلِيَآءَ وَلَٰكِن مَّتَّعۡتَهُمۡ وَءَابَآءَهُمۡ حَتَّىٰ نَسُواْ ٱلذِّكۡرَ وَكَانُواْ قَوۡمَۢا بُورٗا ١٨ ﴾ [الفرقان: ١٧، ١٨]
‘‘সে দিন আল্লাহ একত্রিত করবেন তাদেরকে এবং তারা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের এবাদত করত তাদেরকে, সে দিন তিনি উপাস্যদেরকে বলবেন: তোমরাই কি আমার এই বান্দাদেরকে পথভ্রষ্ট করেছিলে, না তারা নিজেরাই পথভ্রষ্ট হয়েছিল? তারা বলবে- আপনি পবিত্র, আমাদের পক্ষে আপনার পরিবর্তে অন্যকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করা সম্ভবপর ছিল না;কিন্তু আপনিই তো তাদেরকে এবং তাদের পিতৃপুরুষদেরকে ভোগসম্ভার দিয়েছিলেন, ফলে তারা আপনার স্মৃতি বিস্মৃত হয়েছিল এবং তারা ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতি।’’[1]
এখানে ‘‘তারা আপনার স্মৃতি বিস্মৃত হয়েছিল’’এ কথার দ্বারা এ দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহ প্রদত্ত শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণেই যুগে যুগে মানুষেরা শির্কে পতিত হয়েছিল। অতীতের মানুষেরা যেমন আল্লাহর শরী‘আত সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার কারণে বিভিন্ন প্রত্যক্ষ শির্কী বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসে লিপ্ত হয়েছিল, কালের পরিক্রমায় অনেক মুসলিমরাও ধীরে ধীরে ইসলাম থেকে অজ্ঞ হয়ে যাওয়া বা মূল থেকেই ইসলামী আক্বীদা ও বিশ্বাসের ব্যাপারে সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা না পাওয়ার কারণে নানাবিধ শির্কী বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসে লিপ্ত হয়েছে। বর্তমানে যারা জন্ম সূত্রে মুসলিম, তারা নিজেদেরকে মুসলিম বলে দাবী করে থাকলেও মহান আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাত সম্পর্কে যে চিন্তা ও চেতনা মনে প্রাণে লালন করে মু’মিন ও মুসলিম হতে হয়, সে সম্পর্কে তাঁদের অনেকেরই সঠিক ও স্বচ্ছ ধারণা নেই। তারা মুখে মুখে ‘আল্লাহ আমার রব ও উপাস্য’ এ কথা বিশ্বাসের স্বীকৃতি দিয়ে থাকলেও কার্যক্ষেত্রে তারা তাদের এ স্বীকৃতি বিনষ্টকারী বহু বিশ্বাস, কর্ম ও অভ্যাসে লিপ্ত রয়েছেন। মানব জাতির ইতিহাস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, নূহ আলাইহিস সালামের জাতি থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসীদের শির্কে লিপ্ত হওয়ার জন্য এ অজ্ঞতা ও মূর্খতাই হচ্ছে মূল ও প্রধানতম কারণ।
দ্বিতীয় পরোক্ষ কারণ : শয়তানের চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র
মুসলিমদের শির্কে লিপ্ত হওয়ার দ্বিতীয় পরোক্ষ কারণ হচ্ছে- তাদের চিরশত্রু শয়তানের চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র। শয়তান তাদেরকে পথভ্রষ্ট করার জন্য আল্লাহর সামনে যে প্রতিজ্ঞা করেছিল, তা সে অক্ষরে অক্ষরে পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে। তাদের অজ্ঞতার সুযোগে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে সে তাদেরকে এমন কিছু প্রত্যক্ষ কারণে জড়িয়ে ফেলেছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে তারা শির্কে নিমজ্জিত হয়। নিম্নে এর কয়েকটি কারণ বর্ণিত হলো।
মুসলিমদের শির্কে নিমজ্জিত হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণসমূহ :
প্রথম কারণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও অলিগণের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন :
আল্লাহর পরে নবী, রাসূল, তাঁদে যোগ্য উত্তরসূরী আলেম ও মাশায়েখগণ হলেন সাধারণ মানুষদের প্রশংসা ও সম্মান পাবার যোগ্য। তাই তাঁদের মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শনের বৈধ পন্থা হচ্ছে-ক্বুরআন ও হাদীসে যে সকল নবী ও রাসূলগণের বর্ণনা এসেছে, তাদের নবুওত ও রেসালতের প্রতি বিশ্বাস করা। আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সর্বশেষ নবী হিসেবে বিশ্বাস করা। নিজের আত্মা, পিতা-মাতা, সন্তানাদি, সকল মানুষ ও সম্পদের ভালবাসার উপর তাঁর ভালবাসাকে স্থান দেয়া। সব কিছুর অনুসরণ ও আনুগত্য বাদ দিয়ে নিঃশর্তভাবে কেবল তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন ও সহীহ হাদীসের অনুসরণ ও অনুকরণ করা। কর্ম জীবনে তাঁর সুন্নাতের একচ্ছত্র অনুসরণ করা।[2] নবী ও রাসূলগণকে অতিমানব হিসেবে মনে না করে এ বিশ্বাস পোষণ করা যে, তাঁরা আমাদের মতোই মানুষ ছিলেন। তাঁদের ও আমাদের মাঝে পার্থক্য শুধু এতটুকু যে, তাঁদের আত্মাসমূহ পবিত্র হওয়ায় মহান আল্লাহ তাঁদেরকে সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর বাণী পৌঁছে দেয়ার জন্য বাছাই করে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের নিকট তাঁর বাণী প্রদান করেছিলেন। নবুওত ও রেসালতের দায়িত্ব আদায়ের প্রয়োজনে আল্লাহ তাঁদেরকে যতটুকু অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞান দান করেছিলেন, এর বাইরে তাঁরা নিজ থেকে আর কোনো অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞাত হতে পারতেন না। তাঁরা তাঁদের সাধ্যের বাইরে অপ্রাকৃতিকভাবে কারো কোনো কল্যাণ করতে বা কোনো অকল্যাণ দূর করতে পারেন না।
তাঁদের সাথে আচরণগত সম্মান :
আচরণের দিক থেকে তাঁদেরকে যে সম্মান প্রদর্শন করতে হবে তা হলো তাঁদের জীবদ্দশায় বা মুত্যুর পরেও তাঁদেরকে উচ্চ স্বরে নাম ধরে আহ্বান না করা। তাঁদের নাম আলোচনা করলে বা শ্রবণ করলে তাঁদের উপর সালাত ও সালাম পাঠ করা। আমাদের নবীর জন্য বিশেষ করে সাধারণ সময়ে এমনিতেই এবং আজানের পর ও সালাতের মধ্যে দরূদ ও সালাম পাঠ করা। আজানের পর তাঁর উপর দরূদ পাঠ করা এবং আল্লাহর নিকট ‘ওসীলা’ নামের একটি বিশেষ মর্যাদার স্থানে তাঁকে অধিষ্ঠিত করার জন্য দো‘আ করা। মদীনায় বা তাঁর মসজিদ যিয়ারতে গেলে তাঁর কবর যিয়ারত করা। ইয়াহূদী ও খ্রিষ্টানরা যেমন তাঁদের নবী ও অলীদের কবরসমূহকে মসজিদ তথা গির্জায় রূপান্তরিত করেছিল তাঁদের কবরকে সেভাবে মসজিদে রূপান্তরিত না করা। মুশরিকরা যেমন কিছু সৎ মানুষের মূর্তির স্থানকে ঈদগাহ বা বার্ষিক ওরস ও মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করেছিল তাঁদের কবরকে সেরূপ ঈদ পালনের স্থানে পরিণত না করা। নিকট ও দূর থেকে তাঁদের নিকট কিছু না চাওয়া। অনুরূপভাবে শুধুমাত্র তাঁদের নাম বা তাঁদের মান ও মর্যাদার ওসীলায় আল্লাহর নিকট কিছু না চাওয়া। তাঁদের কবর বা তাঁদের কবরের দেয়ালে বরকত হাসিলের জন্য হাত না বুলানো। কবরের পার্শ্ব বা ভিতর থেকে মাটি বা অন্য কিছু বরকত বা ঔষধ হিসেবে ব্যবহারের জন্য সংগ্রহ না করা।
ওলি ও ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ যেহেতু নবী ও রাসূলগণের উত্তরাধিকারী, তাই তাঁরাও নবী-রাসূলগণের ন্যায় বৈধ সম্মান ও মর্যাদা পাবার অধিকার রাখেন; তবে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে, তাঁরা আর নবীগণ অবস্থানগত দিক থেকে সমান মর্যাদার অধিকারী নন। নবীদের মত তাঁরাও জীবিত বা মৃত কোনো অবস্থায়ই অদৃশ্য সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তাই নবীদের মত তাঁদেরকেও দূর বা নিকট থেকে কোনো প্রকার কল্যাণার্জন বা অকল্যাণ দূরীকরণের জন্যে আহ্বান না করা। মৃত্যুর পরে তাঁরাও অন্যান্য সাধারণ মৃতদের ন্যায় জীবিত মানুষদের দো‘আর প্রতি মুখাপেক্ষী থাকেন। সে কারণে তাঁদের জন্য দো‘আ করা।
তাঁদের সাথে আচরণগত সম্মান হচ্ছে- তাঁদের কবর কারো বাড়ীর নিকটে হলে আল্লাহর কাছে তাঁদের মাগফিরাত কামনার জন্য মাঝে মধ্যে তা যিয়ারত করতে যাওয়া। তাঁদের কবর অপর কোনো জেলায় হলে কোনো জায়েয উদ্দেশ্যে সেখানে গেলে তাঁদের মাগফিরাত কামনা করার জন্য তা যিয়ারত করা। তাঁদের কবর বা কবরের আঙ্গিণাকে কোনো মসজিদের ন্যায় পবিত্র ও দো‘আ কবূলের স্থান হিসেবে মনে না করা। তাঁদের নাম ও জাতের ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু না চাওয়া। তাঁদের কবরকে মসজিদে রূপান্তরিত না করা। তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে বার্ষিক ওরস পালন না করা। তাঁদের কবরে সেজদা না করা, বরকত হাসিলের জন্য কবর বা সেখানকার কোনো কিছুর উপর হাত না বুলানো এবং সেখান থেকে মাটি বা অন্য কিছু সংগ্রহ না করা। কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য সেখানকার কোনো গাছের গোড়ায় সুতা না বাধা। গাছের মূল কাণ্ডে তারকাটা না লাগানো। কাগজে কিছু লিখে গাছের ডালে তা ঝুলিয়ে না রাখা। রোগ মুক্তির উদ্দেশ্যে সেখানকার পানির কূপ, পুকুর ও জলাশয় থেকে পানি সংগ্রহ করে না আনা।
নবী-রাসূল ও ওলীদের মর্যাদা প্রদান প্রসঙ্গে এ কথা মনে রাখা যে, তাঁদের মর্যাদা প্রদানের উদ্দেশ্যে শরী‘আত আমাদেরকে যা করতে অনুমতি দেয়, কেবল তা করার মধ্যেই তাঁদের প্রকৃত সম্মান নিহিত রয়েছে। আর যা করতে নিষেধ করে তা করার মধ্যেই তাঁদের অসম্মান নিহিত রয়েছে। তাঁদের বা তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে যা করা নিষেধ তা তাঁদের জীবদ্দশায় তাঁদের সম্মুখে করলে এতে যেমন তাঁরা অসন্তুষ্ট হতেন, তাঁদের মৃত্যুর পরেও তাঁদের কবরকে কেন্দ্র করে তা করলে এতে তাঁদের রূহ অসন্তুষ্ট হয়ে থাকবে।
নবী-রাসূল ও সৎ লোকদের সম্মান প্রদর্শনের ব্যাপারে এ পর্যন্ত যা আলোচনা করা হলো, এটিই হচ্ছে তাঁদের সম্মান প্রদর্শনের বৈধ পন্থা। তাঁদের সম্মান প্রদর্শন করার সময় যারা তা লক্ষ্য করবে তারাই তাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করবে এবং শির্ক ও বেদ‘আতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিজেদেরকে নিরাপদে রাখবে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কবর নিজ গৃহে দেওয়ার কারণ :
ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানরা তাদের নবী ও সৎ মানুষদের কবর নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর জীবনের শেষ সময়ে এদের উপর আল্লাহর অভিসম্পাত করে বলেছেন :
«لَعْنَةُ اللهِ عَلَى الْيَهُوْدِ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ، يُحَذِّرُوْا مَا صَنَعُوْا، وَلَوْ لاَ ذَلِكَ أُبْرَزَ قَبْرُهُ غَيْرَ أَنَّهُ خَشِيَ أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدا».
‘‘ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের উপর অল্লাহর অভিসম্পাত, তারা তাদের নবীগণের কবরসমূহকে মসজিদ বানিয়েছে, তারা যা করেছে তা করা থেকে তিনি তাঁর উম্মতকে সতর্ক করেছেন। (আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন:) অদূর ভবিষ্যতে তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে এ জাতীয় কাজের ভয় না হলে তাঁর কবর ঘরের বাইরেই দেয়া হতো। তাঁর কবরকে মসজিদ বানিয়ে নেয়ার ভয় হওয়ার কারণেই তিনি তাঁকে নিজ ঘরের ভিতরে দাফন করতে বলেছেন’’।[3] এ হাদীস দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে, রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-তাঁর পরবর্তী উম্মতদের দ্বারা তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে আহলে কিতাবদের অনুরূপ কর্ম করার ব্যাপারে আশঙ্কিত ছিলেন। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা
وَلَوْ لاَ ذَلِكَ أُبْرَزَ قَبْرُهُ غَيْرَ أَنَّهُ خَشِيَ أَنْ يُتَّخَذَ مَسْجِدا
এ কথা বলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সে আশঙ্খার কথাই ব্যাক্ত করেছেন। তাঁর কবরকে নিয়ে যাতে কোনো রকম বাড়াবাড়ি করা না হয় সে-জন্য তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে সরাসরি নির্দেশ করে বলেছেন :
«لاَ تَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْداً»
‘‘তোমরা আমার কবরকে বাৎসরিক ঈদ (ওরস) বা মেলা পালনের স্থানে পরিণত করো না।’’[4]
নবী বা সৎ মানুষদের কবরতো দূরের কথা তাঁদের কোনো নিদর্শন [آثار] নিয়ে কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করারও কোনো সুযোগ ইসলামী শরী‘আতে স্বীকৃত নয়। সে কারণেই আমরা দেখতে পাই হুদাইবিয়া নামক স্থানের যে গাছের নিচে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুদ্ধের জন্য তাঁর সাহাবীগণের বয়‘আত গ্রহণ করেছিলেন, আল্লাহ তা‘আলা তাঁর একান্ত করুণায় সে গাছ ও স্থানের পরিচিতিও মুসলিমদের অন্তর থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে দিয়েছিলেন। ইবন ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন : ‘‘আমরা সন্ধির শর্তানুযায়ী) পরবর্তী বছর (‘উমরা পালনের উদ্দেশ্যে মক্কায় যাওয়ার পথে) হুদায়বিয়া নামক স্থানের যে গাছের নিচে আমরা বায়‘আত গ্রহণ করেছিলাম, সে গাছটি নির্ধারণের ব্যাপারে (অনেক চেষ্টা করেও) আমাদের কোনো দু’জন ব্যক্তিও তা চিহ্নিত করার ব্যাপারে একমত হতে পারে নি। এ না পারাটি ছিল আল্লাহর একান্ত রহমতস্বরূপ।’’[5]
ইবনে হাজার আসকালানী বলেন: ‘‘এ গাছটি নির্ধারণ করতে না পারার মধ্যে যে হিকমত নিহিত রয়েছে তা হলো : এ গাছের নিচে যে কল্যাণের কাজ হয়েছিল সেটাকে কেন্দ্র করে যাতে ভবিষ্যতে সেখানে কোনো ফেৎনার জন্ম না হয়, সে জন্যেই এ গাছটি আল্লাহ নির্ধারণ করতে দেন নি। কারণ; যদি তা জনগণের নিকট পরিচিত থেকে যেতো, তা হলে এ গাছটি জাহিল ও অজ্ঞ লোকদের তা‘যীম ও সম্মান পাওয়া থেকে নিরাপদ থাকতো না। এমনকি জাহিলদের অজ্ঞতা তাদেরকে এ-গাছটি বিভিন্ন অসুখ-বিসুখ দূরীকরণে উপকারী হওয়ার ধারণায় পৌঁছে দিতো ...।’’[6] সে গাছটি তখনকার সময়ে চিহ্নিত করা সম্ভবপর না হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীতে খেলাফতে রাশেদার আমলেই আন্দাজ ও অনুমানের উপর নির্ভর করে লোকেরা সেখানকার একটি গাছকে কেন্দ্র করে অনেকটা বাড়াবাড়ি আরম্ভ করে দিয়েছিল। নাফে‘ থেকে বর্ণিত যে, ‘‘‘উমার এর নিকট এ মর্মে সংবাদ এসে পৌঁছলো যে, কিছু লোকজন সেই গাছের নিচে যাতায়াত করে যার নিচে বায়‘আত গ্রহণ করা হয়েছিল। এ সংবাদ শুনে তিনি তা কেটে দেয়ার নির্দেশ করেন। ফলে তা কেটে ফেলা হয়।’’[7] ইবন আবী শায়বাহ ও বুখারীর বর্ণনার মধ্যে বাহ্যিক কিছু বৈপরিত্য মনে হলেও আসলে দু’ বর্ণনার মধ্যে কোনো বৈপরিত্য নেই। কারণ, গাছটিতো আসলে পরবর্তী বছরই চিহ্নিত করা সম্ভবপর হয় নি; কিন্তু তা সত্ত্বেও পরবর্তীতে লোকেরা সেখানকার কোনো একটি গাছের ব্যাপারে অনুমানের ভিত্তিতে এ ধারণা করে নিয়েছিল যে, এটিই বোধ হয় সেই গাছ, যার নিচে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বায়‘আত গ্রহণ করেছিলেন। এ ধারণার ভিত্তিতেই তারা সে গাছের নিচে যেতে আরম্ভ করেছিল। তবে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু সে সম্ভাব্য গাছটিকেও কেটে দিয়ে ভবিষ্যতে এটাকে কেন্দ্র করে যে সব বেদ‘আতী ও শির্কী কর্মকাণ্ড হওয়ার আশঙ্কা ছিল, সে সবের মূলোৎপাটন করেন।
মানুষকে সম্মান করা নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ধরন:
সৎ মানুষদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ধরন ও প্রকৃতি প্রসঙ্গে ড. ইব্রাহীম বরীকান বলেন : ‘‘কথা ও কাজের মাধ্যমে কারো প্রশংসা ও স্তুতি বর্ণনা করার ক্ষেত্রে এর বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করাকেই সৎ মানুষদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করা (الغلو في الصالحين) বলা হয়’’।[8] তিনি এ বাড়াবাড়িকে মোট দু’ভাগে বিভক্ত করেছেন :
প্রথম প্রকার : কথার মাধ্যমে কারো প্রশংসা ও প্রস্তুতি বর্ণনার ক্ষেত্রে এর বৈধ সীমারেখা অতিক্রম করা। এ সীমাতিক্রমটি আবার তিন ভাবে হতে পারে :
(ক) কারো প্রশংসা করতে গিয়ে তাঁকে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের গুণাবলীর সাথে সম্পৃক্ত করে ফেলা। যেমন এ কথা বলা যে, তিনি বিপদ দূর করতে পারেন, কল্যাণ এনে দিতে পারেন, তিনি গায়েব সম্পর্কে জ্ঞাত ইত্যাদি। যারা আল্লাহ তা‘আলা ব্যতীত অপর কারো ব্যাপারে এ জাতীয় ধারণা পোষণ করে, তারা আল্লাহর (রুবূবিয়্যাতের) গুণাবলীতে একত্ববাদী বিশ্বাসী বলে বিবেচ্য হবে না। কারণ, এ জাতীয় ধারণা তাওহীদী বিশ্বাসের পরিপন্থী ও শির্কে আকবার এর অন্তর্গত।’’[9]
(খ) এমন সব কথা ও কাজ করা যা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী। যেমন কারো নামে শপথ করা, কথার মাধ্যমে কারো ইচ্ছা ও কামনাকে আল্লাহর ইচ্ছার সমতুল্য করে ‘আল্লাহ ও আপনি যা চান’ এমনটি বলা। এ জাতীয় কথা শির্কে আকবার এর পর্যায়ে না পড়লেও শির্কে আসগার এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা আল্লাহর একত্ববাদের পূর্ণতার পরিপন্থী।
(গ) এমন কোনো গুণে কাউকে গুণান্বিত করা যা শির্ক নয়, তবে তা সে গুণান্বিত ব্যাক্তির মধ্যেও নেই। যেমন কারো কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও তাকে একজন বড় দানশীল হওয়ার গুণে গুণান্বিত করা। (যেমন কাউকে সত্যিকারের ওলি না হওয়া সত্ত্বেও তাকে ‘অলিয়ে কামেল, অলিকুল শিরোমণি, পীরে কামেল, কিবলায়ে দু’জাহন ও হাদীয়ে জামান ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত করা)। মিথ্যা কথা বলা হারাম ও নিকৃষ্ট কবিরা গুনার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে কাউকে মিছেমিছি এরূপ গুণে গুণান্বিত করাও হারাম ও কবিরা গুনাহের অন্তর্গত কাজ।
দ্বিতীয় প্রকার : কর্মের মাধ্যমে কারো মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করা। এটি আবার চার ভাবে হতে পারে :
- মানুষসহ সৃষ্টির যে কোনো বস্তুর সামনে রুকু ও সেজদা করা, তাকে আল্লাহর ন্যায় ভালবাসা, গোপন ভয় করা, গুনাহের কাজ করে কারো নিকট ক্ষমা ভিক্ষা করা, কোনো বিষয়ে কারো উপর পূর্ণ ভরসা করা, নিঃশর্তভাবে কারো আনুগত্য ও অনুসরণ করা ইত্যাদি। এ জাতীয় কর্ম তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। কেননা, এ সব শির্কে আকবরের অন্তর্গত কাজ।
- আল্লাহর উপাসনার উদ্দেশ্যে কারো কবর বা কবরে নামায পড়া, সেজদা করা, কুরআন তেলাওত ইত্যাদি করা এ ধারণার ভিত্তিতে যে, সেখানে এ সব কাজ করা উত্তম। এ জাতীয় কর্ম শির্কে আসগার এর অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় তা তাওহীদের পূর্ণতার পরিপন্থী।
- কারো মর্যাদা বাড়ানোর জন্য এমন কোনো কাজ করা যা শির্ক গুনাহের অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে শর‘য়ী দৃষ্টিতে সে কাজটি হারাম। যেমন কারো কবর পাকা করা, তাতে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা ও নাম লেখা ইত্যাদি কর্ম। এ জাতীয় কাজ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাত বিরোধী হওয়ায় তা বেদ‘আতের অন্তর্গত।
- সৎ মানুষদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার প্রসংগ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আল্লামা নাসির উদ্দিন আলবানী (মৃত ১৯৯৯ খ্রি.) বলেন: ‘‘যে সকল মাধ্যম বিলম্বে হলেও জনগণের শির্কের মত অমার্জনীয় অপরাধে নিমজ্জিত করার কারণ হবার আশঙ্কা রয়েছে, হিকমত চায় যে, সে সকল মাধ্যমও নিষিদ্ধ করা হোক। আর সে-জন্যেই কবরের উপর মসজিদ নির্মাণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুরূপভাবে কবর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে দূর-দূরান্তে সফর করতে, কবরকে মেলার (ওরসের) স্থান বানাতে ও কবরবাসীদের নামে শপথ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ, এ সব কর্মই কবরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি ও কবরকে পূজা করার দিকে পৌঁছে দেয়। বিশেষ করে যখন মানুষের জ্ঞান লোপ পেয়ে অজ্ঞতা বেড়ে যায় এবং উপদেশ দানকারীদের সংখ্যা কমে যায়, তখনকার কথাতো বলা-ই বাহুল্য।’’[10]
[2]. ইবনু তাইমিয়াহ, একতেদাউস সিরাতিল মুসতাকীম; সম্পাদনা : হামিদ আল-ফক্বী, (বৈরুত : দারুল মারিফাহ, সংস্করণ বিহীন, সনবিহীন), পৃ. ৩৩৬।
[3].বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জানইয, বাব : ২২, হাদীস নং- ৪২৫; ১/১৬৮; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মাসাজিদ..., হাদীস নং- ৫৩১; ১/৩৭৭।
[4]. প্রথম অধ্যায়ের টীকা নং ১৬৩ দ্রষ্টাব্য।
[5]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল জিহাদ, বাব: ১০৯, হাদীস নং- ২৭৯৭;৩/১০৮০।
[6]. ইবনে হাজার আস-কালানী, ফতহুল বারী; ৬/১১৮।
[7]. শেখ আব্দুর রহমান ইবনে হাসান আলুস- শেখ, প্রাগুক্ত; পৃ. ২৪৬। মুসনাদে ইবনে আবী শায়বাহ থেকে উদ্ধৃত।
[8]. ড. ইব্রাহীম বরীকান, প্রাগুক্ত; পৃ. ১৭৪, ১৭৫।
[9]. তদেব।
[10]. মুহাম্মদ নাসির উদ্দিন আলবানী, তাহযিরুস সাজিদ ‘আন ইত্তেখা-যিল কুবূরি মাসাজিদা; (বৈরুত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৪র্থ সংস্করণ, ১৪০২হিজরী), পৃ. ১৫৪, ১৫৫।
বস্তুত সৎ মানুষদের সম্মান ও মর্যাদা দানের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষেরা তাদের বিশ্বাস, কথা ও কর্মের মাধ্যমে যে সব বাড়াবাড়ি করে, সে বাড়াবাড়িই হচ্ছে অতীত ও বর্তমান কালের সকল দেশের সাধারণ মানুষদের- বিশেষ করে আউলিয়া ও দরবেশগণের কবর ও কবরসমূহে যারা গমনাগমন করে এবং সেখানে যারা বার্ষিক ওরস পালন করে তাদের- পথভ্রষ্ট হওয়ার মূল কারণ। ধর্ম ও সৎ মানুষদের নিয়ে বাড়াবাড়ি করার ক্ষেত্রে শরী‘আতের সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা ও সতর্কবাণী থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মুসলিমদেরকে এ ক্ষেত্রে সীমালঙ্ঘন করতে দেখা যায়। মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-যা যা করতে নিষেধ করেছেন, এর কোনটিই করা থেকে তারা বিরত হয় নি। এটিই হচ্ছে সকল স্থান ও কালে মুশরিক ও বেদ‘আতীদের চিরাচরিত অভ্যাস। রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-সাধারণ মুসলিমদের ব্যাপারে এ ভয় করেছিলের যে, তারা তাঁর সম্মান ও মর্যাদা প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করবে, তাঁকে তাঁর উপযুক্ত মর্যাদায় সমাসীন না করে তাতে অতিরঞ্জিত করতে চাইবে, তাঁর কবরকে বার্ষিক ওরস ও মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করবে। এই আশঙ্কায় তিনি তাঁর সাথীদের এ-সব করা থেকে নিষেধ করে বলেছেন:
«لاَ تَطْرُوْنِيْ كَمَا أَطَرَتِ النَّصَارَى فِيْ عِيْسَى بْنِ مَرْيَمِ،وَلَكِنْ قُوْلُوْا عَبْدُ اللهِ وَرَسُوْلُهُ»
‘‘খ্রিস্টানরা ঈসা ইবন মারইয়াম আলাইহাস সালামকে নিয়ে যেরূপ বাড়াবাড়ি করেছে, তোমরা আমাকে নিয়ে সেরূপ বাড়াবাড়ি করো না, তোমরা বরং আমার ব্যাপারে বলো: আমি আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল।’’[11]
অনুরূপভাবে তিনি তাঁর সাহাবীদেরকে তাঁর কবরকে বার্ষিক ওরস বা মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করতেও নিষেধ করে বলেছেন:
«لاَ تَجْعَلُوْا قَبْرِيْ عِيْدًا»
‘‘তোমরা আমার কবরকে কোনো প্রকার ওরস বা মেলা বসানোর স্থানে পরিণত করো না’’।[12]
কিন্তু এ সব নিষেধের বাণীসমূহ থাকা সত্ত্বেও মুসলিম সমাজে এর ব্যতিক্রম দেখতে পাওয়া যায়।
বিভিন্ন ওলীদের কবর ও কবরকে কেন্দ্র করে মুসলিমরা যা করেন, তা দেখে মনে হয় যে, তারা যদি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর রওযা মুবারক আমাদের দেশে পেতো, তা হলে সেখানে তারা সেই সব কাজই করতো যা তাঁর কবরকে কেন্দ্র করে করা থেকে তিনি আমাদেরকে নিষেধ করেছেন। তাদেরকে এ সব কর্ম করা থেকে কেউ বারণ করলে নবী প্রেমের[13] মিথ্যা দাবীতে তারা এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতো। প্রয়োজনে এ জন্য তারা আত্মাহুতিও দিতো। তবে আল্লাহ তা‘আলার অপার রহমত যে, তিনি তাঁর নবীর কবরকে এ রকমের মিথ্যা প্রেমিক!দের নানাবিধ অপকর্মের হাত থেকে হেফাযত করেছেন।
দ্বিতীয় কারণ : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এবং ওলিগণ কে বৈশিষ্ট্য প্রদানের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
মহান আল্লাহর গুণগত যে নিরানববইটি নাম রয়েছে সে সব নামের সম্পর্ক হচ্ছে তাঁর রুবূবিয়্যাতের সাথে। আল্লাহর এ সব গুণ থাকার কারণেই তিনি আমাদের রব। সে সব বৈশিষ্ট্যের মাঝে রয়েছে তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ বা গায়েবের জ্ঞানী, সর্ব দ্রষ্টা, সকল কল্যাণ ও অকল্যাণকারী ...ইত্যাদি। এ সবের ক্ষেত্রে তাঁর কোনো শরীক না থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও ওলিদের অনুরূপ বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করে থাকেন। অথচ এ সব বিষয়াদি আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় কোনো সৃষ্টির বেলায় এমন ধারণা করা তাঁর রুবূবিয়্যাতে শির্ক করার শামিল। ওলীদের ব্যাপারে এ-জাতীয় অতিরঞ্জিত ধারণা করাই মুসলিমদের শির্কে পতিত হওয়ার জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী। সে জন্যে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী মুসলিমদের মাঝে শির্ক চালু হওয়ার জন্য এ ধারণাকেই মৌলিকভাবে দায়ী করেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
‘‘মুশরিকরা মনে করে ওলিগণ অধিক তপস্যা করার ফলে মহান আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর উলূহিয়্যাতের পর্দা উন্মোচন করে দেন অথবা অধিক তপস্যা করে তাঁরা তাঁর জাতসত্তার মধ্যে ফানা হয়ে যাওয়ার কারণে এমন সব কামালিয়াতের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হন, যা কেবলমাত্র মহান আল্লাহ ব্যতীত অপর কারো বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। তাঁরা এ ধরনের কামালিয়াতের অধিকারী হয়ে থাকেন বলেই তাঁদের দ্বারা বিভিন্ন রকমের কারামত বা আশ্চর্যজনক বিষয়াদি সম্পাদিত হয়।’’[14]
তৃতীয় কারণ : বস্তুর সাথে লাভ ও ক্ষতির সম্পর্ককরণ :
কোনো বস্তুকে আল্লাহর ইচ্ছায় উপকারী বা অপকারী এমনটি না বলে সরাসরি সে বস্তুকেই উপকারী বা অপকারী বলা। কেননা, উপকার বা অপকার করা তাঁর রুবুবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের অন্তর্গত বিষয়।
চতুর্থ কারণ : নিম্ন জগতের উপর উধর্বজগতের গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাবে বিশ্বাসী হওয়া :
মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণে মহাকাশের গ্রহ ও তারকার প্রভাবে বিশ্বাসী হওয়া।
পঞ্চম কারণ : আল্লাহর উপাসনায় ওলিগণকে শরীক করা :
মহান আল্লাহর বড়ত্ব, মহত্ব ও তা‘যীম প্রদর্শনের জন্য তিনি আমাদের মুখ, দেহ ও অন্তরের উপর যে সব প্রকাশ্য ও গোপন উপাসনা ফরয হওয়ার কথা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে, অনেক মুসলিমদের সে সব উপাসনায় ওলিগণ কে শরীক করতে দেখা যায়।
ষষ্ঠ কারণ : ওলিগণ কে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে মধ্যস্থতাকারী ও শাফা‘আতকারী হিসেবে মনে করা :
অলিগণের অনেক ভক্তরা মনে করে থাকেন যে, ওলিগণ আল্লাহর অধিক আরাধনা করার ফলে কামালিয়্যাতের উঁচু স্তরে পৌঁছে থাকেন। সে সময় প্রেসিডেন্ট যেমন সাধারণ মানুষদের কথা-বার্তা শ্রবণের জন্য মন্ত্রীদের মধ্যস্থতা অবলম্বন করেন, তেমনি আল্লাহও সাধারণ মানুষের কথা-বার্তা শ্রবণের জন্য ওলিগণ কে তাঁর ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ওসীলা বা মাধ্যম হিসেবে নিয়োগ করেন। তাঁদের শাফা‘আতের মাধ্যমে তাদের সমস্যাদি আল্লাহর নিকট উপস্থাপন করলে তিনি তাঁদের মর্যাদার খাতিরে দ্রুতগতিতে তা মঞ্জুর করেন। প্রথম অধ্যায়ে পরিচালনাগত শির্ক এর বর্ণনা প্রসঙ্গে আমরা এ-কথা প্রমাণ করে দেখিয়েছি যে, ওলিদের ব্যাপারে এ-জাতীয় ধারণা করা আল্লাহ তা‘আলার পরিচালনা কর্মে তাঁদেরকে শরীক বলে ধারণা করার শামিল।
উল্লেখ্য যে, শয়তান সাধারণ মুসলিম জনমনে উক্ত ধরনের ওসীলা ও শাফা‘আতের ধারণা সৃষ্টি করে দিয়ে এ দু’টিকে কেন্দ্র করেই তাদেরকে আল্লাহর উলূহিয়্যাতের ক্ষেত্রে নানা রকম প্রত্যক্ষ শির্কী কর্মে লিপ্ত করেছে। তাঁদের ওসীলা ও শাফা‘আতে দুনিয়াবী কল্যাণ অর্জিত হয় এবং অকল্যাণ দূরীভূত হয়- এমন ধারণা দিয়ে একদিকে যেমন ওলিগণ কে উপাস্যে পরিণত করেছে, অপর দিকে তেমনি তাঁদের কবর ও কবরসমূহকে মসজিদের বিকল্প একেকটি উপাসনালয় হিসেবে দাঁড় করেছে। তাই তাদের অনেকেই মসজিদের পরিবর্তে কবরে যেয়ে থাকেন এবং সরাসরি আল্লাহর কাছে তাদের প্রয়োজন পূরণের কথা না বলে কেউ বা কবরস্থ ওলির নিকটেই তা কামনা করে। আবার কেউবা তাঁর মাধ্যমে তা পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে আবেদন করে থাকেন। এভাবে তারা আরবের মুশরিকদের ন্যায় ওলিদেরকেই সাহায্যের জন্য নিকট ও দূর থেকে আহ্বান করে থাকেন। অথচ এ ধরনের আহ্বান করাকে মহান আল্লাহ শির্কী কর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:
﴿ إِن تَدۡعُوهُمۡ لَا يَسۡمَعُواْ دُعَآءَكُمۡ وَلَوۡ سَمِعُواْ مَا ٱسۡتَجَابُواْ لَكُمۡۖ وَيَوۡمَ ٱلۡقِيَٰمَةِ يَكۡفُرُونَ بِشِرۡكِكُمۡۚ وَلَا يُنَبِّئُكَ مِثۡلُ خَبِيرٖ ١٤ ﴾ [فاطر: ١٤]
‘‘তোমরা যদি তাদেরকে (সুপারিশের জন্য) আহ্বান কর, তা হলে তারা তোমাদের আহ্বান শুনবে না, আর শুনলেও তারা তোমাদের ডাকের কোনো জবাব দিবেনা।’’
কুরআনের তর্জমা খুলে দেখুন।[15] এ আয়াতে বর্ণিত সর্বশেষ কথার দ্বারা তাদের এ আহ্বানকে শির্কী কর্ম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, যারাই এভাবে কাউকে আহ্বান করবে, তারা মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।
সপ্তম কারণ : পীর ও মুরববীদের কথা-বার্তা ও নাসীহাতপূর্ণ বাণীসমূহের অন্ধ অনুসরণ ও অনুকরণ:
কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের নিঃশর্ত অনুসরণ করা হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার উপাসনা। যারা সাধারণ মানুষ তারা অবশ্য কোনো পীর, আলিম বা মুরববীর কথা সঠিক হওয়ার ধারণার ভিত্তিতে অনুসরণ করবে। তবে কোনভাবেই অন্ধভাবে তাঁদের অনুসরণ করবে না। যখনই তাঁদের কোনো নাসীহাতের কথা কুরআন ও সহীহ সুন্নাহের বিপরীতে রয়েছে বলে জানতে পারবে, তখনই তা পরিহার করে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর কথাই পালন করবে-এ মর্মের মানসিকতা অন্তরে লালন করেই তাঁদের অনুসরণ করবে। কিন্তু শয়তান অনেক সাধারণ মুসলিমদেরকে তা না করে নিজ নিজ পীর ও মুরববীদের হেদায়াতী কথা-বার্তা অন্ধভাবে অনুসরণ ও অনুকরণ করতে শিখিয়েছে। যার ফলে তাদের অনেকেই নিজে পড়াশুনা করে কোনো ভুল কর্মের সন্ধান পেলে বা কেউ তাদেরকে কোনো ভুলের সন্ধান দিলে তারা তা সংশোধন করেন না। অথচ কারো এ রকম অনুসরণ করা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপাসনা করার শামিল।
অষ্টম কারণ : ইমামগণের ইজতেহাদী উক্তিসমূহ পালনের ক্ষেত্রে শরী‘আতের সীমালঙ্ঘন করা :
কোন বিষয়ে মতবিরোধ হলে তা নিরসনের জন্য কারো ইজতেহাদী মতামতকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করে কুরআন ও সহীহ হাদীসের দিকে প্রত্যাবর্তন করাই হচ্ছে জ্ঞানীদের প্রতি শরী‘আতের নির্দেশ। কিন্তু অনেক আলেমগণ তা না করে মতবিরোধপূর্ণ বিষয়ে চোখ বন্ধ করে কোনো একজন মহামান্য ইমামের ইজতেহাদী মতামতকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। কোনো বিষয়ে ‘নস’ থাকা সত্ত্বেও তা কোনো ইমামের নিকট না পৌঁছার কারণে বা কোনো অনির্ভরযোগ্য সনদে তাঁর নিকট তা পৌঁছার কারণে তিনি হয়তো তা গ্রহণ না করে থাকতে পারেন।[16] কোনো বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতভেদের এ জাতীয় কারণ থাকা সত্ত্বেও তা বিচারে না এনে নির্দিষ্ট করে কোনো একজনের যাবতীয় ইজতেহাদী মতকে অন্ধভাবে গ্রহণ করা প্রকারান্তরে তা ইয়াহূদী ও খ্রিস্টানদের ন্যায় ইমামগণকে একাধিক রব বানিয়ে নেয়ার সমতুল্য।
নবম কারণ : দো‘আ করার সময় ওসীলা গ্রহণের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা:
কোন জীবিত মানুষকে দো‘আ করতে বলা বা কোনো জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করা বৈধ ওসীলার একটি প্রকার। তবে দো‘আর মাঝে কোনো নবী, ওলি বা জীবিত অথবা মৃত কোনো মানুষের নাম মুখে উচ্চারণ করে তাঁদের জাতসত্তা কিংবা মর্যাদা ও হুরমত এর ওসীলায় বা খাতিরে আল্লাহ তা‘আলার কাছে নিজের ইহ-পরকালীন কোনো কল্যাণ কামনা করে দো‘আ করার বিষয়টি কুরআন ও সহীহ সুন্নাহ দ্বারা স্বীকৃত নয়। এ জাতীয় ওসীলা অবৈধ। ওসীলাকারীর অন্তরের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা শির্ক হতে পারে। এ জাতীয় ওসীলা অবৈধ ও শির্কপূর্ণ হওয়ার কারণ নিম্নরূপ :
ক) কারো নিকট থেকে কোনো বস্তু চাওয়ার সময় তৃতীয় কোনো মানুষের নাম ও মর্যাদার ব্যবহার কেবল তখনই বৈধ হতে পারে যখন সে মানুষটি জীবিত থাকে এবং তার নাম ব্যবহারের জন্য লিখিত বা মৌখিকভাবে তার সম্মতি প্রদান করে। অন্যথায় এমনটি করা সাধারণত একটি অনৈতিক ও অবৈধ কর্ম হিসেবে বিবেচ্য হয়ে থাকে। নবী ও ওলিগণ মরে যাওয়ার কারণে যেহেতু কারো কোনো বিষয়ে তাঁরা তাঁদের সম্মতি প্রদান করতে পারেন না, তাই তাঁদের নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া বৈধ হতে পারে না।
(খ) মানুষেরা পরস্পরের প্রতি মুখাপেক্ষী থাকায় একে অন্যের জন্য ওসীলা হতে পারে; কিন্তু আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী না থাকায় তিনি কারো নাম, মর্যাদা ও হুরমতের কথা কারো মুখে শুনে কিছু করবেন, তা আশা করা যায় না।
(গ) নবী ও অলিগণের নাম ও মর্যাদার ওসীলায় আল্লাহর কাছে নিজের জন্য কিছু চাওয়া আর ‘অমুক ব্যক্তিকে অমুক বস্তু দিয়েছেন, তাই আমাকেও অমুক বস্তুটি দিন’ এমন কথা বলার শামিল। এমন আবদার একজন মানুষের কাছে করা যেমন অগ্রহণযোগ্য ও অসৌজন্যমূলক বিবেচিত হয়ে থাকে, তেমনি এমন আবদার আল্লাহ তা‘আলার কাছেও অগ্রহণযোগ্য ও অসৌজন্যমূলক আচরণ বলে বিবেচিত হবে।
(ঘ) আল্লাহর কাছে নবী ও অলিগণের যে মর্যাদা রয়েছে তা তাঁদের জন্যেই। এর সাথে অপর কারো মর্যাদা লাভের বা কারো কোনো প্রয়োজন পূরণের কোনই সম্পর্ক নেই। তাঁদের নাম ও মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় কিছু পেতে চাওয়া চুরি করে একজন সৎ ও ন্যায় বিচারকের নাম ব্যবহার করে চুরির দণ্ড থেকে রেহাই পাবার অপচেষ্টা করার শামিল।
(ঙ) আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে হলে কোনো সৎকর্মের ওসীলা করে বা কিছুর ওসীলা ছাড়াই তাৎক্ষণিক তা চাওয়া যেতে পারে। কিন্তু চাওয়ার সময় মুখে কারো নাম ও মর্যাদার কথা আল্লাহকে শুনানো কোনো সৎ কর্ম নয়। তাই তা কোনো ওসীলা হতে পারে না।
(চ) কারো কাছে কারো নাম ব্যবহার করে কিছু চাওয়ার অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তিকে তৃতীয় ব্যক্তির দ্বারা প্রভাবিত করা এবং তাকে প্রভাবিত করেই বৈধ বা অবৈধ কোনো কাজ আদায় করে নেয়া। মানুষ মানুষের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলেই মানুষের মাঝে এমন ওসীলার প্রচলন রয়েছে। তবে আল্লাহর ব্যাপারে এমন ধারণা করা তাঁর পরিচালনা কর্মে শির্ক করার শামিল। আরবের মুশরিকরা আল্লাহর কাছে তাদের দেবতাদের অনেক মর্যাদা রয়েছে বলে মনে করেই তারা তাদের দেবতাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার মাধ্যম বা ওসীলা বলে মন করতো। যে সকল মুসলিমরা অনুরূপ ধারণার বশবর্তী হয়ে দো‘আ করার সময় নবী ও অলিগণের নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় দো‘আ করেন, তারা প্রকারান্তরে আরবের মুশরিকদের ন্যায় আচরণ করেন এবং নবী ও অলিগণের মর্যাদার দ্বারা আল্লাহকে প্রভাবিত করে এর মাধ্যমে নিজেদের ইহ-পরকালীন কল্যাণ অর্জন করতে চান। ওসীলার বিষয়টিকে নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি হয়েছে বলেই এ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে এ সম্পর্কে আরো বিস্তারিত আলোচনা করবো ইন-শাআল্লাহ।
দশম কারণ : অলিগণের শাফা‘আত সম্পর্কে বাড়াবাড়ি :
মুশরিকরা যেমন তাদের কতিপয় সৎ মানুষ ও ফেরেশ্তাদের নামে নির্মিত মূর্তিসমূহকে আল্লাহর নিকট শাফা‘আতকারী মনে করে তাদেরকে ইহকালীন প্রয়োজন পূরণে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করতো, অনেক মুসলিমরাও তেমনি ওলি ও পীরগণকে অনুরূপ ধারণার ভিত্তিতে ইহ-পরকালীন প্রয়োজন পূরণের ক্ষেত্রে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করে থাকেন। তারা আরো মনে করেন যে, তাঁরা মরেও মরেন নি, বরং স্থান পরিবর্তন করেছেন মাত্র[17]। তাঁরা রূহানী শক্তিবলে অদৃশ্য সম্পর্কে অবগত হতে পারেন। দূর ও নিকট থেকে কেউ তাঁদেরকে শাফা‘আতের জন্য আহ্বান করলে তাঁরা তা শুনতে পান। আখেরাতে আল্লাহর কোনো অনুমতি ছাড়াই তাদেরকে তাঁরা শাফা‘আত করে জান্নাতে নিয়ে যেতে পারবেন বলেও তারা মনে করেন। অথচ তাঁদের ব্যাপারে এমন ধারণা পোষণ করা আল্লাহর উলূহিয়্যাত ও রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যে শির্কের শামিল। যেহেতু শাফা‘আত সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকার কারণে সাধারণ জনগণ শাফা‘আতকে কেন্দ্র করে শির্কে নিমজ্জিত হচ্ছে, সে-জন্য এ অধ্যায়ের তৃতীয় পরিচ্ছেদে শাফা‘আত সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
একাদশ কারণ : ওলিদের নিকট কল্যাণ কামনা করা এবং তাঁদের অকল্যাণের গোপন ভয় করা:
সকল কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক এককভাবে আল্লাহ তা‘আলা হওয়া সত্ত্বেও অনেকে মনে করেন যে, আল্লাহ তা‘আলা ওলিগণকে ছোট ছোট অনেক কল্যাণ ও অকল্যাণের মালিক বানিয়ে দিয়েছেন এবং সে অনুযায়ী তারা তাঁদের নিকট তা কামনা করেন। কবরস্থ গাছ, পুকুর ও কূপের পানি এবং জীব-জন্তুকে ওলি বা ওলির কবরের সাথে সংশ্লিষ্টতার কারণে সেগুলোকে বরকতপূর্ণ মনে করে এর দ্বারা বিভিন্ন প্রকার রোগ থেকে মুক্তি কামনা করেন। ওলিদের কবরকে গোপনে ভয় করেন। ওলির অকল্যাণের ভয়ে কবরের গাছ বা গাছের ডাল কাটলে সমূহ ক্ষতির আশঙ্কা করেন। দুর্ঘটনায় পতিত হওয়ার ভয়ে কবরের পার্শ্ব দিয়ে যাওয়ার সময় গাড়ি ধীর গতিতে পরিচালনা করেন।
দ্বাদশ কারণ : কবরের সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
একজন মুসলিমের কবরের সম্মান প্রদর্শনের শরী‘আত স্বীকৃত পন্থা হচ্ছে-শর‘য়ী কোনো ওজর ব্যতীত এর উপর দিয়ে বিচরণ না করা, এর উপরে না বসা, এর উপর প্রস্রাব-পায়খানা না করা, চতুষ্পদ জন্তু এর উপর বিচরণ করতে না দেয়া। কোনো কবর এককভাবে থাকলে ভবিষ্যতে যাতে তা কবর হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, সে জন্যে এর চার পার্শ্বে বেড়া বা দেয়াল নির্মাণ করা। কোনো অবস্থাতেই কবরকে দুনিয়াবী কল্যাণ ও বরকত গ্রহণের স্থান হিসেবে গণ্য না করা। এর উপর বা এর চারপার্শ্বে মসজিদ নির্মাণ না করা। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে সাধারণ মুসলিমগণ এর বিপরীতে ওলিদের কবরকে সম্মান দেখাতে যেয়ে তাকে প্রথমে বরকত গ্রহণের স্থানে পরিণত করেছে। পরে সেখানে মসজিদ বানিয়ে নামায, কুরআন তেলাওয়াত ও অবস্থান গ্রহণ করাসহ আরো বিভিন্ন রকমের উপাসনা করতে শিখিয়েছে। কবরের প্রাঙ্গণকে ওলির কারণে বরকত গ্রহণের স্থান হিসেবে মনে করে এর সংলগ্ন গাছ, মাটি, কূপ বা পুকুরের পানি, মাছ ও অন্যান্য জীব-জন্তুকে উপকারী মনে করে তাত্থেকে বরকত গ্রহণ করতে শিখিয়েছে। অথচ আল্লাহর উপাসনার জন্য কবর কোনো উপাসনালয় না হওয়াতে কোনো কবরের পার্শ্বে বসে কবরস্থ ওলির সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা প্রকারান্তরে সে অলিরই উপাসনার শামিল। আর কোনো বস্তুর দ্বারা উপকার পাবার বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর ইচ্ছাধীন হওয়া সত্ত্বেও সে বস্তুর দ্বারা উপকারের বিষয়কে কবরস্থ ওলির সাথে সম্পর্কযুক্ত করার কারণে তা আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্কের শামিল।
ত্রয়োদশ কারণ : রাজনৈতিক নেতাদের আনুগত্য করার ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করা :
শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে অনেক সাধারণ মুসলিম রাজনৈতিক নেতাদের অন্ধভাবে অনুসরণ ও আনুগত্য করে থাকেন। তাদের মধ্য থেকে কে তাদেরকে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠার দিকে আহ্বান করছে আর কে মানব রচিত বিধান প্রতিষ্ঠার দিকে আহ্বান করছে, তা বিচার না করেই তারা তাদের আনুগত্য করে থাকেন। অথচ এ ধরনের অন্ধ আনুগত্য আল্লাহর রুবূবিয়্যাতে শির্কের শামিল।
চতুর্দশ কারণ :
কোন কোনো রোগ ব্যাধি আল্লাহর ইচ্ছায় অন্যের দিকে সংক্রমিত হয়। সে সংক্রমণকে আল্লাহর ইচছার সাথে সম্পর্কিত না করে রোগকেই নিজ থেকে সংক্রমিত হয় বলে বিশ্বাস করা বা এমনটি বলা।উপর্যুক্ত এ সব কারণ ছাড়াও শির্ক সংঘটিত হওয়ার জন্য আরো কিছু প্রত্যক্ষ কারণ রয়েছে, যা মুসলিমদের মাঝে প্রচলিত শির্কসমূহ অধ্যয়ন করলে যে কেউই তা শির্কের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবে। এ সব কারণসমূহের প্রতি দৃষ্টি দিলে সহজেই প্রতীয়মান হয় যে, মুসলিমদের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার পিছনে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ যে সব কারণ রয়েছে সেগুলোর সাথে ইসলাম পূর্বযুগের ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে শির্ক সংঘটিত হওয়ার কারণসমূহের সাথে বহুলাংশে মিল রয়েছে।
[12]. প্রথম আধ্যায়ের ১৬৩ নং টীকা দ্রষ্টাব্য।
[13] প্রেম শব্দটি আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের জন্য মোটেই মানানসই শব্দ নয়। তাঁদের জন্য এটি ব্যবহার করা বেয়াদবী। কারণ, প্রেম শব্দটি বিপরীত লিঙ্গ অথবা জড় পদার্থের জন্য ব্যবহৃত হয়ে থাকে। [সম্পাদক]
[14]. শির্কের হাকীকত বর্ণনা প্রসঙ্গে শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী যা বলেছেন, উক্ত কথাগুলো তাঁর সে কথারই সারমর্ম। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
إن يعتقد إنسان في بعض المعظمين من الناس الأثار العجيبة الصادرة منه إنما صدرت لكونه متصفا بصفة من صفات الكمال ، مما لم يعهد في جنس الإنسان ، بل يختص بالواجب جل مجده ، لا يوجد في غيرة ، إلا أن يخلع هو خلعة الألوهية على غيره ، أو يفني غيره في ذاته و يبقى بذاته أو نحو ذلك ، مما يظنة هذا المعتقد من أنواع الخرافات ّ.
দেখুন : শাহ ওয়ালী উল্লাহ, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ; (বৈরুত : দারুল মা’রিফাহ, সংস্করণ বিহীন, তারিখ বিহীন), ১/৬৭।
[15]. আল-কুরআন, সূরা ফাত্বির : ১৪।
[16]. কোন বিষয়ে ইমামগণের মাঝে মতবিরোধ হওয়ার পিছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। তন্মধ্যে উক্ত দু’টি কারণ উল্লেখযোগ্য। এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার জন্য ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাঃ (রহ.) কর্তৃক রচিত ‘রফউল মালাম ‘আন আইম্মাতিল আ‘লাম’ ও শাহ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) কর্তৃক রচিত ‘আল-ইনসাফ ফী মাসাইলিল খিলাফ’ কিতাব দু’টি দেখা যেতে পারে। (উল্লেখ্য, প্রথম গ্রন্থটি আপনি এ ওয়েবসাইটেই পাবেন। [সম্পাদক])
[17]. সম্ভবত: তারা এ জন্যই মারা গেছেন না বলে ‘ইন্তেকাল করেছেন’ বলে থাকেন। সুতরাং আমাদেরকে এ বিদ‘আতী শব্দটি ত্যাগ করা উচিত। [সম্পাদক]
জাহেলী যুগে আরবের মুশরিকদেরকে শয়তান বিভিন্ন রকমের ধ্যান-ধারণা দেয়ার মাধ্যমে শির্কে লিপ্ত করেছিল। তাদেরকে যে সব ধ্যান-ধারণা দিয়েছিল তন্মধ্যে অন্যতম একটি ধারণা এমন দিয়েছিল যে, আল্লাহর ওলি ও ফেরেশ্তাদের নামে তাদের যে সব দেব-দেবী রয়েছে সেগুলো আল্লাহ ও সাধারণ মানুষের মাঝে মধ্যস্থতাকারী। এদের মধ্যস্থতা গ্রহণ করলে অতি সহজে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায়। আবার এদের মধ্যস্থতা পেতে হলে এদের সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। সে জন্যে তারা এদের উদ্দেশ্যে মানত করতো। এদের কাছে অবস্থান করতো। সাহায্যের জন্য এদেরকে আহ্বান করতো। তারা যে এদের মধ্যস্থতা পাওয়ার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই এ জাতীয় উপাসনা করতো সে সম্পর্কে তারা নিজেরাই বলতো :
﴿مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ ﴾ [الزمر: ٣]
‘‘আমরা তাদের উপাসনা করছি কেবল এ জন্য যে, তারা আমাদেরকে আল্লাহর অধিক নিকটবর্তী করে দেবে।’’[1]
মুশরিকদের এ কথার দ্বারা পরিষ্কারভাবেই বুঝা যাচ্ছে যে, তারা যে সব উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বিভিন্ন দেব-দেবীর উপাসনা করতো, তন্মধ্যে এদের ওসীলায় আল্লাহর নিকটবর্তী হতে চাওয়া তাদের একটি অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। কালের পরিক্রমায় ওলীদের ব্যাপারে শয়তান বহু মুসলিমদের অন্তরেও এ জাতীয় ধারণার জন্ম দিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, তাদেরকে আরো ধারণা দিয়েছে যে, তাঁদের মাধ্যমে মানুষেরা তাদের জীবনের ছোট ছোট বিষয়াদি প্রাপ্ত হয়ে থাকে। পৃথিবীর নিয়ম-শৃঙ্খলা তাঁদের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়ে থাকে। আল্লাহ তাঁদের মাঝ থেকে কতিপয় ব্যক্তিকে আবদাল, আওতাদ, আবরার, গাউছ ও কুতুব... ইত্যাদি প্রশাসনিক পদে নিয়োগ দিয়ে থাকেন।[2]
আব্দুল কাদির জীলানী (রহ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে গউছ খেতাব পেয়েছিলেন বলেই তাঁকে গউছুল আ‘জম বলা হয়ে থাকে। একই কারণে চট্রগ্রামের মাইজভাণ্ডারের আহমদুল্লাহ মাইজভাণ্ডারীকেও গউছুল আ‘জম বলা হয়। প্রেসিডেন্টের কাছে মন্ত্রীদের যেরূপ মর্যাদা থাকে, আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাঁদের সে রকম মর্যাদা রয়েছে। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে মন্ত্রীরা যেমন প্রেসিডেন্টের মাধ্যম হয়ে থাকেন, তেমনি আল্লাহর নিকট সাধারণ মানুষের সমস্যাদি উপস্থাপন করা, তাদের মনস্কামনা পূর্ণ করিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সুপারিশ করা এবং তাদেরকে আল্লাহর নিকটবর্তী করে দেয়ার ক্ষেত্রে ওলিগণ হলেন আল্লাহর মাধ্যম বা ওসীলা ! [নাউযুবিল্লাহ]
মানুষের জীবনের ইহলৌকিক সমস্যা ও তা সমাধানের মাধ্যম:
মানুষের জীবনের সমস্যাদি মোট দু’ভাগে বিভক্ত :
এক, জীবন ও জীবিকার সমস্যা। দুই, পরকালীন সমস্যা। প্রতিটি মানুষই পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা পেতে চায় এবং প্রতিটি মু’মিন মাত্রই আখেরাতে শান্তিময় জীবন লাভ করতে চায়। পৃথিবীতে ভাল জীবন ও জীবিকা লাভের বিষয়টি মানুষের ভাগ্যের সাথে সম্পর্কিত। ভাগ্য নির্ধারণ সম্পর্কে আমরা এ বই এর প্রথম অধ্যায়ে আল্লাহ তা‘আলার রুবূবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আলোচনা প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছি। তাই এখানে এ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে কিছু না বলে সংক্ষেপে শুধু এটুকু বলতে চাই যে, আল্লাহর ইনসাফ ও বিচারে যে মানুষকে যে জীবন ও জীবিকা প্রদান করা উচিত ও তার জন্য মঙ্গলজনক বলে তিনি মনে করেছেন, তাকে তিনি সে জীবন ও জীবিকা প্রদানের পরিকল্পনা পূর্ব থেকেই করে রেখেছেন। প্রতিটি মানুষের ভাগ্যে কী জীবন ও জীবিকা রয়েছে তা খতিয়ে দেখার মাধ্যম সে নিজেই।
সুস্থ জীবন ও উত্তম জীবিকা লাভ করার জন্য তাকে শরী‘আতসম্মত বৈধ উপায় ও পন্থায় প্রয়োজনীয় কর্ম করতে হবে। যে সকল কর্ম করার ক্ষেত্রে জীবিত মানুষেরা একে অন্যের স্বাভাবিকভাবে কর্ম বা দো‘আ করার মাধ্যমে সাহায্য করতে পারে, সে সকল ক্ষেত্রে অন্যের কর্ম বা দো‘আর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। এ ধরনের ক্ষেত্রে নিজে ও প্রয়োজনে অন্য জীবিত মানুষের সাহায্য নিয়ে কর্ম করে কর্মের ফল প্রাপ্তির জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছেই তাঁর দয়া কামনা করতে হবে। ধৈর্যের সাথে যাবতীয় সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনে বিলম্ব হচ্ছে দেখে কোনো অবস্থাতেই ধৈর্যহারা হয়ে কোনো বিকল্প পথে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো পীর, ফকীর ও ওলির কবরে এ জন্য কোনো আবেদন-নিবেদন করা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিরত থাকতে হবে।
মনে রাখতে হবে যে, ভাগ্যে সুস্থ জীবন, সন্তান ও উত্তম জীবিকা লেখা থাকলে বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে তা আজ হোক কাল হোক, পাওয়া যাবেই। কেউ হাজার ষড়যন্ত্র করেও তা ঠেকাতে পারবে না। আর ভাগ্যে তা লেখা না থাকলে সারা দুনিয়ার জীবিত ও মৃত মানুষেরা সাহায্য ও দো‘আ করলেও তা পাইয়ে দিতে পারবে না। বৈধ পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে ভাগ্য পরিবর্তিত হলে তা যেমন আল্লাহরই দান হয়ে থাকবে, তেমনি অবৈধ পন্থা অবলম্বনের পর তা পরিবর্তিত হলে তাও আল্লাহরই দ্বারা হয়ে থাকবে। দুয়ের মাঝে পার্থক্য এটুকু যে, যারা বৈধ পন্থা অবলম্বন করে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করে, তারাই হবে প্রকৃত মু’মিন ও আল্লাহর প্রিয়ভাজন বান্দা। আর যারা অধৈর্য হয়ে কবর ও কবরে যেয়ে রোগ মুক্তি, সন্তান দান ও উত্তম জীবিকা ইত্যাদি চাইবে, তারা হবে মুশরিক ও আল্লাহর বিরাগভাজন।
পরকালীন সমস্যা সমাধানের মাধ্যম:
এ ক্ষেত্রে শরী‘আতের একক শিক্ষা হলো : ঈমান ও সৎ ‘আমলই হচ্ছে মানুষের পরকালীন সমস্যা সমাধানের একক মাধ্যম বা ওসীলা। এ দু’টি গুণ ব্যতীত যারা অন্য কোনো উপায়ে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া যায় বলে মনে করে, তারা মূলত কল্পনার জগতেই বসবাস করে। মুহাজির, আনসার ও তাঁদের অনুসারী পরবর্তী মনীষীগণ এ বিষয়টি অনুধাবন করেই ঈমান ও ‘আমলে সালেহ এর ক্ষেত্রে অধিক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। যার ফলেই সাহাবীদের মধ্যকার দশজন ব্যক্তি আল্লাহর পক্ষ থেকে এ দুনিয়াতে থাকতেই জান্নাতের আগাম সনদ লাভ করেছিলেন। বাকিরা সনদ লাভ না করলেও তা লাভ করার যোগ্য হয়েছিলেন। এক কথায় আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য কুরআনুল কারীমে বর্ণিত-
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ وَٱبۡتَغُوٓاْ إِلَيۡهِ ٱلۡوَسِيلَةَ﴾ [المائدة: ٣٥]
‘‘হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর’’।[3]
এ আয়াতে ওসীলা অন্বেষণের যে নির্দেশ রয়েছে, এর দ্বারা তাঁরা ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার প্রতি নির্দেশ করার কথাই বুঝেছিলেন।
জ্ঞানী ও সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ :ঈমান কী এবং কিভাবে ‘আমলে সালেহ করতে হয়, তা তাঁদের কারো জানা না থাকলে সে জন্য তাঁরা জ্ঞানী ও সৎ জনের সাহচর্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করে সে অনুযায়ী ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাকেই তাঁরা আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার একক ওসীলা হিসেবে গণ্য করেছিলেন। ঈমান ও ‘আমলে সালেহ না করে কেবলমাত্র সৎ মানুষদের সাহচর্য গ্রহণ করা বা তাঁদের হাতে বায়‘আত[4] করাকেই তাঁরা আল্লাহর নৈকট্য লাভের মূল উপায় হিসেবে নির্ধারণ করেননি। অনুসরণের ক্ষেত্রে তাঁরাই ছিলেন আমাদের একমাত্র আদর্শ। তাই আমাদেরকেও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ করে আখেরাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে শান্তিময় জীবন লাভের আশা করতে হবে।
>[2]. লেখকের মূল কথার উদ্ধৃতি এ বই এর প্রথম অধ্যায়ের ২৫ নং টীকায় প্রদান করা হয়েছে। দেখুন : দৈনিক ইনকিলাব, ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ খ্রি., পৃ.৬।
[3]. আল-কুরআন, সূরাহ মা-ইদাহ : ৩৫।
[4]. যদিও এ ধরনের বাই‘আত গ্রহণ জঘন্য বিদ‘আত। এর অধিকার তাদের নেই। এ অধিকার শাসকদের জন্য নির্ধারিত। [সম্পাদক]
কিন্তু কালের পরিক্রমায় এক শ্রেণীর মানুষেরা তাঁদের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে যায়। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবের সুযোগে শয়তান তাদের মাঝে ওসীলা সম্পর্কে ভুল ধারণা দিতে সক্ষম হয়। একশ্রেণীর মানুষকে এ ধারণা দিতে সক্ষম হয় যে, সাধারণ মানুষের পক্ষে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়া ও আখেরাতে মুক্তি পাওয়ার জন্য শুধুমাত্র ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করাই যথেষ্ট নয়। এ জন্য প্রয়োজন রয়েছে একজন ওলির হাতে বায়‘আত ও তাঁর ওসীলা গ্রহণ। যেমন একজন পীর বায়‘আতের প্রয়োজনীয়তা বর্ণনা প্রসঙ্গে উক্ত আয়াতে বর্ণিত ওসীলা শব্দের অর্থ বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন :
‘‘আমরা দুনিয়াতে দেখি কোনো কাজই ওসীলা ব্যতীত হয় না, আর সে জন্যই আল্লাহ বলেছেন: (وابتغوا إليه الوسيلة) ‘‘আল্লাহ পাকের মহববত অর্জন করার জন্য অছিলা তালাশ কর।’’[1] এ আয়াতের সরল অর্থ বর্ণনা করার পর এর ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ওসীলা অন্বেষণ করা দ্বারা যে আল্লাহ তা‘আলা তাঁর উপর ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করার মাধ্যমেই তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ করতে বলেছেন, তিনি এ কথা না বলে বলেছেন : আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ‘‘একজন পীরের হাতে বায়‘আত কর।’’ ভাবটা যেন এমন যে, কোনো পীরের হাতে বায়‘আত করলেই যেন সাধারণ মানুষের জান্নাতে যাওয়ার পথ সুগম হয়ে গেল। একজন সাধারণ মানুষ একজন শরী‘আতী পীরের হাতে বায়‘আত করলে[2] এতে তার পক্ষে শরী‘আত সম্পর্কে জানা এবং সে অনুযায়ী ‘আমল করা সহজ হবে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
কিন্তু পীর সাহেব যদি নিজেকে সাধারণ মানুষের ত্রাণকর্তা ভাবতে শুরু করেন, আর মুরীদরা যদি পীর ব্যতীত মুক্তির কোনো পথ নেই বলে ভাবতে থাকে, তা হলেই তো সমস্যার সৃষ্টি হয়। অপরাধীরা যতই অপরাধ করুক না কেন, তাদের ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহর দরজা সব সময়ই উন্মুক্ত। তাওবায়ে নাসূহা তথা খাঁটি তাওবা করলেই তিনি তাদের অপরাধ মার্জনা করেন। এ সত্যটি কুরআনের বিভিন্ন আয়াত দ্বারা প্রমাণিত হয়ে থাকলেও পীর সাহেবগণ তা বেমালুম ভুলে যান। তারা বলেন-অনেক অপরাধ করলে না কি আল্লাহ অপরাধীদেরকে কোনো পীরের ওসীলা ব্যতীত মাফ করতে চান না। যেমন উক্ত পীর সাহেব এ সম্পর্কে বলেন :
‘‘বান্দার গুনাহ যখন অধিক হয়ে যায়, তখন কোনো মাধ্যম ব্যতীত সরাসরি আল্লাহর কাছে তাওবা করলে আল্লাহ তা মাফ করতে চান না, কিন্তু যখন তার পীর এখলাসের সাথে তার জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করেন, তখন তিনি তার তাওবা কবুল করেন অথবা পীরের দো‘আর বরকতে তার তাওবা কবুল হওয়ার আশা করা যায়।’’[3] পীরের হাতে বায়‘আত ও পীরের ওসীলা ব্যতীত কারো মুক্তি নেই, এ কথা প্রমাণ করার জন্য তিনি তাঁর কিতাবে ইমাম ফখরুদ্দীন রাযীর মৃত্যুকালীন সময়ে ঘটিত ঈমান হননকারী একটি অদ্ভুত ঘটনারও উল্লেখ করেছেন।[4]
শয়তান অপর এক শ্রেণীর লোকদেরকে ওসীলা সম্পর্কে এ ধারণা দিয়েছে যে, আল্লাহর নিকবর্তী হওয়া ও আখেরাতে মুক্তির জন্য শরী‘আত পালনের খুব একটা আবশ্যকতা নেই। এ-জন্য মূলত প্রয়োজন ওলিদের সাহচর্য, তাঁদের সন্তুষ্টি ও ভালবাসা। এ উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য ওলিদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করার বদলে সে তাদেরকে তাঁদের কবর ও কবরকে কেন্দ্র করে এমন সব কর্ম করতে লিপ্ত করেছে, যার কারণে তারা তাঁদেরকে উপাস্যে এবং নিজেদেরকে তাঁদের উপাসকে পরিণত করেছে। উদাহরণস্বরূপ কোনো ওলির কবর বা কবরের খেদমত করা, সেখানে নামায আদায় করা, কবরের পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করা, ও এর চারপার্শ্বে প্রদক্ষিণ করার কথা উল্লেখ করা যায়।
এগুলো কা‘বা শরীফকে কেন্দ্র করে করলে তা আল্লাহর উপাসনা হিসেবে গণ্য হয়ে থাকে। কিন্তু কোনো কবর বা কবর আল্লাহর উপাসনার স্থান না হওয়ায় সেখানে এ সব কাজ করলে তা সংশ্লিষ্ট কবর বা কবরবাসীর সান্নিধ্য অর্জন ও তাঁর উপাসনা হিসেবে গণ্য হবে। কেননা, কোনো উপাসনা খালিসভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ার জন্য পূর্ব শর্ত হচ্ছে তা শির্কমুক্ত স্থানে হতে হবে এবং তা এককভাবে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উদ্দেশ্যেই হতে হবে, তা না হলে হাদীস অনুযায়ী তা শির্কী কর্ম হিসেবে গণ্য হবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন : আল্লাহ তা‘আলা বলেন-
«مَنْ عَمِلَ عَمَلاَ أَشْرَكَ فِيْهِ مَعِيْ غَيْرِيْ تَرَكْتُهُ وَشِرْكَهُ وَجَعَلْتُ الْعَمَلَ لِلَّذِيْ أَشْرَكَهُ»
‘‘যে ব্যক্তি কোনো কাজে আমার সাথে অপরকে শরীক করে নিল, আমি তাকে ও তার কাজকে ছেড়ে দেই এবং সে কাজটি তার জন্যই দিয়ে দেই, যাকে সে উক্ত কাজে শরীক করেছে।’’[5]
>[2]. সম্ভবত: লেখক ‘শরীয়তী পীর’ বলে সত্যিকার আলেমদের বুঝিয়েছেন, নতুবা পীর শব্দটি ইসলামের কোনো গ্রহণযোগ্য শব্দ নয়। শরীয়তী পীর বলতে কিছু নেই। তাছাড়া আলেমের হাতেও বাই‘আত হওয়ার অধিকার নেই; কারণ বাই‘আত শরী‘য়তের পরিভাষা, শরী‘য়ত নির্ধারিত স্থানেই তা করতে হয়। শাসক ও যুদ্ধক্ষেত্রে সেনা পরিচালকের নিকট ব্যতীত আরও কারও নিকট তা হওয়া জায়েয প্রমাণিত হয় নি। [সম্পাদক]
[3]. তদেব; পৃ. ২৪।
[4]. ঘটনাটি নিম্নরূপ : একদা ইমাম ফখরুদ্দিন রাযী একজন পীরের হাতে বায়‘আত গ্রহণ করতে ইচ্ছা করে সে পীরের কাছে গমন করেন। পীর সাহেব বললেন : তোমার মধ্যে ইলমে মা‘রেফাত প্রবেশ করাবার কোনো স্থান নেই বিধায়, আমি তোমার বায়‘আত নিতে পারবো না। ফলে ইমাম রাযী হতাশ হয়ে ফিরে আসেন। পীর বিহীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যুর সময়ে শয়তান কুমন্ত্রণা দিতে আসলে পীর ছাড়া তাঁর কী অবস্থা হবে, এ নিয়ে তিনি খুব ভাবতে থাকলেন। অতঃপর তাঁর মৃত্যুকালীন সময়ে শয়তান এসে তাঁর নিকট আল্লাহর ব্যাপারে নানা প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে, যার ফলে ঈমান বিহীন অবস্থায়ই তাঁর মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার উপক্রম হয়ে দাঁড়ায়। ঠিক এমন সময় অযুরত অবস্থায় বহু দুর থেকে কশফের মাধ্যমে সে পীর সাহেব তাঁর এ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হন, তখন তিনি ইমাম রাযী যে দিকে সেদিকে পানি ছিটিয়ে দিলেন এবং ইমাম রাযীকে লক্ষ্য করে বলেন: শয়তানকে বল, বিনা দলীলে আল্লাহ একজন, আল্লাহর এক হওয়ার জন্য কোন দলীলের প্রয়োজন নেই। তদেব; পৃ. ৩১-৩২। (বস্তুত: এটি একটি গাঁজাখুরি গল্প, ইমাম রাযীর জীবনে বা অন্য কারও জীবনে এটা ঘটে নি। [সম্পাদক])
[5]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; ৪/২২৮৯; ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল আজীম; ২/৪৯৫।
‘ওসীলা’ (وَسِيْلَة) শব্দটি আভিধানিক দিক থেকে মাধ্যম (Media)[1] ও নৈকট্য এর অর্থ প্রকাশ করে থাকে।[2] উপরে বর্ণিত আয়াতে ‘ওসীলা’ শব্দেটিকে উভয় অর্থে ব্যবহার করা যেতে পারে। তবে সাহাবা, তাবেঈন ও বিশিষ্ট মনীষীগণ অত্র আয়াতে এ শব্দটিকে ‘মাধ্যম’ অন্বেষণের অর্থে ব্যবহার না করে ‘নৈকট্য’ অন্বেষণের অর্থে ব্যবহার করেছেন। ফলে তাঁদের মতে এ আয়াতের অর্থ হচ্ছে-‘‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং (ঈমান ও ‘আমলে সালেহ দ্বারা) তাঁর নৈকট্য অন্বেষণ কর।’’[3] বিশিষ্ট তাবেঈ ক্বাতাদাঃ (রহ.) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন :
«تقربوا إليه بطاعته و العمل بما يرضيه»
‘‘তাঁর আনুগত্য এবং যে-সব কাজ তাঁকে সন্তুষ্ট করে সে-সব কাজের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য ও সান্নিধ্য অন্বেষণ কর’’।[4] যদি ‘ওসীলা’ শব্দটিকে ‘মাধ্যম’ অর্থে ব্যবহার করা হয় তা হলে উক্ত আয়াতের অর্থ হবে: ‘‘তাঁর নিকটবর্তী হওয়ার জন্য মাধ্যম অন্বেষণ কর’’। যদি এই অর্থ করা হয় তা হলে প্রশ্ন দাঁড়াবে, মাধ্যম বলতে এখানে কী উদ্দেশ্য করা হয়েছে? এ প্রশ্নের স্বাভাবিক জবাব হচ্ছে- ঈমান ও ‘আমলে সালেহ করে এ দু’য়ের মাধ্যমে তাঁর নিকটবর্তী হতে চাও। ‘আমলে সালেহ এর মধ্যে জীবিত সৎ মানুষদের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করা, তাঁদের সান্নিধ্যে থাকা, নবী-রাসূল ও ওলিগণকে ভালবাসা, তাঁদের শিক্ষার অনুসরণ ও অনুকরণ করা ইত্যাদি বিষয়াদি থাকলেও মৃত বা জীবিত কোনো ওলিদের ব্যক্তিত্ব, তাঁদের মর্যাদা ও নামের মাধ্যম করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার অর্থটি এখানে একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জীবদ্দশায় বা তাঁর ওফাতের পরেও তাঁর সাহাবীদের মাঝে তাঁর মর্যাদা ও নাম নিয়ে এমন ওসীলার কোনো প্রচলন ছিল না।
যে সব সহীহ হাদীস দ্বারা বাহ্যত এমন কিছু বুঝা যায়, আসলে সে সবের দ্বারা তাঁর দো‘আর ওসীলাই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। ব্যক্তি রাসূল, তাঁর নাম ও মর্যাদার ওসীলা উদ্দেশ্য করা হয় নি। এ প্রসংগে কিছু মরফু‘ ও মাওকুফ হাদীস বর্ণিত হয়েছে ঠিকই, তবে হাদীস বিশেষজ্ঞদের মতে তা দুর্বল ও অগ্রহণযোগ্য।[5] কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু কিছু আলেম ও পীরদের মুখে এমনকি কোনো কোন তাফসীরকারকদের কলমেও এ আয়াতের ব্যাখ্যায় শয়তান এ অপ্রাসঙ্গিক অর্থটি জুড়ে দিতে সক্ষম হয়েছে। যেমন মাওলানা মুফতী শফী‘ এ আয়াতের ব্যাখ্যায় তাঁর তাফসীর গ্রন্থে এ অর্থটি জুড়ে দিয়ে লিখেছেন :
‘‘ওসীলা শব্দের আভিধানিক ব্যাখ্যা এবং ছাহাবী ও তাবেয়ীগণের তফসীর থেকে জানা গেল যে, যে বস্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের মাধ্যম হয়, তা-ই মানুষের জন্য আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার ওসীলা। ঈমান ও সৎ কর্ম যেমন এর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি পয়গম্বর ও সৎ কর্মীদের সংসর্গ এবং মহববতও এর অন্তর্ভুক্ত। কেননা, এগুলোও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভেরই উপায়। এ কারণেই তাঁদেরকে ওসীলা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা জায়েয।’’ [6]
এখানে তিনি ‘‘তাঁদেরকে ওসীলা করে আল্লাহর দরবারে দোয়া করা জায়েয’’ এ মর্মে যে কথাটি বলেছেন এর দ্বারা তিনি যদি এ উদ্দেশ্য করে থাকেন যে, জীবিত ওলিদেরকে সাথে নিয়ে তাঁদের দো‘আর ওসীলায় দো‘আ করা জায়েয, তা হলে তাতে আপত্তির কিছু নেই। তবে আল্লাহর নিকটবর্তী হওয়ার ওসীলা হিসেবে পয়গাম্বর ও সৎ কর্মীদের সংসর্গ ও মহববতের কথা বলার পর এ কথাটি পৃথক করে বলাতে প্রমাণিত হয় যে, আসলে তিনি তাঁর এ কথার দ্বারা তা উদ্দেশ্য করেননি। বরং মৃত নবী ও ওলিদের মর্যাদা এবং তাঁদের নামের ওসীলায় আল্লাহ তা‘আলার নিকট দো‘আ করার যে প্রচলন সমাজে রয়েছে, সে ওসীলার কথাই তিনি তাঁর এ কথার দ্বারা উদ্দেশ্য করেছেন। অথচ তা সম্পূর্ণ একটি ভ্রান্ত কথা।
যার সাথে এ আয়াতে বর্ণিত নির্দেশের আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। এমন কি ওসীলা সম্পর্কে তিনি এ কথার পর যা বলেছেন তার সাথেও তাঁর এ কথার আদৌ কোনো সম্পর্ক নেই। কেননা, নেক মৃত মানুষের মহববত করা এক জিনিষ আর তাঁদের নামের ওসীলায় দো‘আ করা একটি ভিন্ন জিনিষ। প্রথমটি মানুষের ঈমানের পরিচায়ক, আর অপরটি শরী‘আত বহির্ভুত একটি বেদ‘আতী কর্ম। কিন্তু তা সত্ত্বেও শয়তান তাঁর মত ব্যক্তি ও অন্যান্য পীরদের মুখ ও লেখনীতে এ কথাটিকে চালিয়ে দিয়ে অজ্ঞ ও মুর্খ মুসলিমদেরকে পথভ্রষ্ট করার একটি উত্তম সুযোগ করে নিয়েছে।
কুরআনে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দের অর্থ বর্ণনার ক্ষেত্রে তারা যদি তাদের সলফগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করতেন, তা হলে সমাজে ‘ওসীলা’ ধরা নিয়ে শয়তান এতো বিভ্রান্তি ছড়াতে পারতো না।
‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআনে করীমের মোট দু’স্থানে বর্ণিত হয়েছে। একটির কথা উপরে বর্ণিত হয়েছে। আর অপরটি বর্ণিত হয়েছে সূরা ইসরাতে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ أُوْلَٰٓئِكَ ٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ يَبۡتَغُونَ إِلَىٰ رَبِّهِمُ ٱلۡوَسِيلَةَ أَيُّهُمۡ أَقۡرَبُ وَيَرۡجُونَ رَحۡمَتَهُۥ وَيَخَافُونَ عَذَابَهُ﴾ [الاسراء: ٥٧]
‘‘মুশরিকরা যাদেরকে (হিত সাধন বা অনিষ্ট রোধের জন্য) আহ্বান করে তারা নিজেরাই (এখন) তাদের রবের অধিক নিকটবর্তী হওয়ার ক্ষেত্রে ওসীলা অন্বেষণে প্রতিযোগিতা করে, তাঁর রহমত কামনা করে এবং তাঁর আযাবকে ভয় করে’’।[7]
এ আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দটিকেও উপর্যুক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দের ন্যায় ওসীলার উভয় অর্থেই ব্যবহার করা যেতে পারে[8]। এ ছাড়া সহীহ হাদীসে আজানের পর পঠিত দো‘আর মধ্যেও ‘ওসীলা’ শব্দটি বর্ণিত হয়েছে। তবে সেখানে তা আভিধানিক অর্থে ব্যবহৃত না হয়ে একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থানের অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«سَلُوا اللَّه لِيَ الْوَسِيْلَةَ فَإِنَّهَا دَرَجَةٌ فِي الْجَنَّةِ لاَ تَنْبَغِيْ إِلاَّ لِعَبْدٍ مِنْ عِبَادِ اللَّهِ فَمَنْ سَأَلَ لِيْ الْوَسِيْلَةَ حَلَّتْ لَهُ الشَّفَاعَةُ»
‘‘তোমরা আজানের পর আমার জন্য আল্লাহর নিকট ওসীলা কামনা কর। কেননা, তা এমন একটি মর্যাদাপূর্ণ স্থান যা আল্লাহর বান্দাদের মধ্য থেকে কেবল একজন বান্দার জন্যেই শোভা পাবে। যে আমার জন্য ওসীলা কামনা করবে তার জন্য আমার শাফা‘আত হালাল হয়ে যাবে।’’[9]
উক্ত বর্ণনার দ্বারা প্রমাণিত হলো যে, ‘ওসীলা’ শব্দটি কুরআন ও হাদীসে মোট দু’টি অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। একটি হচ্ছে- নৈকট্য বা নৈকট্যের মাধ্যম অর্থে। আর অপরটি হচ্ছে মর্যাদাপূর্ণ স্থান এর অর্থে। আর নৈকট্যের মাধ্যম এর অর্থে এটিকে গ্রহণ করলে এর অর্থ দাঁড়ায়- ঈমান, সৎকর্ম, মৃত নবী ও নেক মানুষদের ভালবাসা, তাঁদের আদর্শ অনুসরণ, জীবিত নেক মানুষের সাহচর্য গ্রহণ, তাঁদের দো‘আ, ভালবাসা ও তাঁদের আদর্শ অনুসরণ ইত্যাদির ওসীলায় আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ করা। স্রেফ তাঁদের নাম ও মর্যাদার ওসীলায় বা তাঁদের কবরের পার্শ্বে বসে আল্লাহর নৈকট্য অন্বেষণ ও এর ওসীলায় ইহ-পরকালীন কিছু চাওয়া নয়।
আল্লাহর নিকট কোনো জীবিত বা মৃত মানুষের মর্যাদার ওসীলায় কিছু চাওয়া যায় না :
প্রকৃতকথা হচ্ছে- একজন মানুষ অপর কোনো মানুষের নিকট থেকে তার কোনো উদ্দেশ্য সহজে হাসিল করার জন্য তৃতীয় কোনো গণ্যমান্য ব্যক্তির নামের মাধ্যমে তার কাছে তা চাইতে পারে এবং দ্বিতীয় ব্যক্তিও তৃতীয় ব্যক্তির নাম শুনে তিনটি কারণে প্রথম ব্যক্তির চাহিদা ও আবদার পূর্ণ করতে পারেন। কারণগুলো হচ্ছে :
১. দ্বিতীয় ব্যক্তি তৃতীয় ব্যক্তির নাম শুনে তার মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তা করতে পারেন।
২. তৃতীয় ব্যক্তির সম্ভাব্য ক্ষতির আশঙ্কায় তিনি তা করে দিতে পারেন।
৩. তৃতীয় ব্যক্তির নিকট থেকে তার নিজের কোনো প্রয়োজন হাসিল করার জন্য তা করে দিতে পারেন।মানুষ মানুষের প্রতি মুখাপেক্ষী হয়, একে অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয় বলে তাদের মাঝে এ ধরনের ওসীলা চলতে পারে। মহান আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী না হওয়ায় এবং কারো দ্বারা তিনি প্রভাবিত না হওয়ায় তাঁর কাছে কারো নাম ও মর্যাদার ওসীলায় দো‘আ করা যেতে পারে না। নবী ও ওলিদের যে মর্যাদা রয়েছে তা তাঁরই দেয়া। সুতরাং তাঁদেরকে তাঁরই দেয়া জিনিষের ওসীলায় তাঁর কাছে কিছু আবদার করা তাঁর সাথে বেআদবী করারই নামান্তর। তিনি কারো কোনো উদ্দেশ্য পূর্ণ না করলে এতে তাঁর কোনো ক্ষতিরও আশঙ্কা নেই। এমতাবস্থায় তাঁর কাছে কারো নাম, মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলায় কিছু চাওয়া আল্লাহর সাথে মানবীয় আচরণ করারই শামিল।
>[2]. ইবনুল আছীর, আন-নেহায়াতু ফী গারীবিল হাদীসি ওয়াল আছার; (বৈরুত: আল-মাকতাবাতুল ইলমিয়্যাহ, সংস্করণ বিহীন, সন বিহীন), ৫/১৮৫; ইবনে মানযূর আল-আফরীক্বী, লেসানুল আরব; ১১/৭২৪।
[3]. বিশিষ্ট তাবেঈ আবু ওয়াইল, হাসান, মুজাহিদ, ক্বাতাদাহ, ’আত্বা ও সুদ্দি এ আয়াতে বর্ণিত ‘ওসীলা’ শব্দটিকে ‘ক্বুর্বাত’ তথা নৈকট্য অর্থে ব্যবহার করেছেন। দেখুন : কুরতবী, প্রাগুক্ত; ৬/১৫৯; ত্ববারী, প্রাগুক্ত; ৬/২২৫।
[4]. ইবনে কাছীর, তাফসীরুল কুরআনিল ‘আজীম; ২/৫৩।
[5] . ইবনে তাইমিয়্যাহ, আত-তাওয়াসসুলু ওয়াল ওয়াসীলাতু; পৃ.৪৭।
[6]. মাওলানা মুফতী শফী‘, প্রাগুক্ত; পৃ. ৩২৭।
[7] . আল-কুরআন, সূরা ইসরা বা বনী ইসরাঈল: ৫৭।
[8] . আমরা আগেই বলেছি যে, ওসীলা দ্বারা শুধু ‘মাধ্যম’ অর্থ নেওয়া কোনো গ্রহণযোগ্য অভিধানবিদের মত ছিল না। [সম্পাদক]
[9]. ইবনে খুযায়মাহ, মুহাম্মদ, সহীহ; সম্পাদনা : ড. মুহাম্মদ মুস্তফা আল-আ‘জমী, (বৈরুত : আল-মাকতবুল ইসলামী, সংস্করণ বিহীন, ১৯৭০ খ্রি.), ১/২১৮।
জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা দু’ভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে :
এক, কোনো জীবিত মানুষের কাছে গিয়ে এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমি অমুক সমস্যায় পতিত হয়েছি, আপনি আমার জন্য এ মুহূর্তে আল্লাহর কাছে একটু দো‘আ করুন। এ ধরনের দো‘আ কামনা করার বিষয়টি হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যা আমরা একটু পরে বর্ণনা করবো।
দুই, কোনো জীবিত মানুষের নিকট গিয়ে এ মর্মে দো‘আ কামনা করা যেতে পারে যে, আপনি আমার জন্য দো‘আ করবেন। দো‘আকারী যদি অসাক্ষাতে দো‘আ করেন, তা হলে তার দো‘আ আল্লাহ তা‘আলার নিকট মঞ্জুর হওয়ার অধিক সম্ভাবনার কথা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। উম্মুদ দরদা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
«دَعْوَةُ الْمَرْءِ الْمُسْلِمِ لاَخِيْهِ بِظَهْرِ الْغَيْبِ مُسْتَجَابَةٌ...»
‘‘একজন মুসলিম ভাইয়ের জন্য তার অসাক্ষাতে মুসলিম ব্যক্তির দো‘আ মকবূল হয়ে থাকে।’’[1]তবে এ ধরনের দো‘আ কামনা যে শুধু সাধারণ লোকেরাই কেবল সৎ লোকজনের নিকটেই চাইবে তা নয়, বরং একজন মর্যাদাবান ব্যক্তিও তাঁর চেয়ে কম মর্যাদাবান ব্যক্তির নিকটে তা চাইতে পারেন। এমন দো‘আ চাওয়ার প্রচলন স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকেই প্রমাণিত। একদা ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ‘উমরা পালন উপলক্ষে মক্কায় যাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট অনুমতি চাইলে তিনি তাঁকে অনুমতি দানপূর্বক বলেন : ‘‘ভাই! (সফরের অবস্থায় যখন তুমি দো‘আ করবে তখন) তোমার নেক দো‘আ থেকে আমাদের ভুলে যেও না।’’[2] এটি হচ্ছে জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণের একটি সঠিক পদ্ধতি। এতে প্রমাণিত হয় যে, একজন সাধারণ মানুষ যেমন একজন ওলি ও পীর সাহেবের নিকট দো‘আ কামনা করতে পারে, তেমনি একজন পীর সাহেবও একজন সাধারণ মানুষের নিকট দো‘আ চাইতে পারেন। কোনো পীর সাহেব যে মানুষের জন্য দো‘আ করার এজেন্সী নিয়ে বসে থাকবেন বিষয়টি এমন নয়।
>[2] . আবু দাউদ, প্রাগুক্ত; সালাত অধ্যায়, বাবুদ দু‘আ; ২/১৬৯; হাদীসটি ইবনে আববাস রাদিয়াল্লাহু আনহ থেকে বর্ণিত। কুরতুবী, প্রাগুক্ত; ১২/৩২১। (তবে হাদীসটির সনদ দুর্বল, [সম্পাদক])
কিন্তু দো‘আর সময় নবী ও ওলিদের নামের মাধ্যম ধরে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার কথা বা অনুমতি কুরআন ও হাদীসের দ্বারা সমর্থিত নয়। এর কারণ হলো, এভাবে কারো নামের কথা শুনিয়ে কিছু চাওয়া হচ্ছে মানবীয় ব্যাপার। আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়ার সময় এমনটি করা ঠিক নয়। কেননা, তিনি কারো মুখাপেক্ষী নন বলে তাঁর সাথে মানবীয় আচরণ করা প্রকারান্তরে তাঁকে মানুষের মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত করতে চাওয়ারই শামিল। তিনি কারো মর্যাদার দ্বারা প্রভাবিত হন না বলেই কেউ তাঁর নিকট নিজের মর্যাদার ওসীলায় আখেরাতে কারো জন্যে কোনো শাফা‘আত করতে পারবে না। যে মর্যাদার মূল্য আখেরাতে নেই সে মর্যাদার ওসীলায় দুনিয়াতে তাঁর কাছে কিছু চাওয়ারও কোনো মূল্য নেই। এছাড়া তিনি কোনো মানুষের নামের মাধ্যমে বা ওসীলায় তাঁর কাছে কিছু আবদার করতে আমাদেরকে শিক্ষাও দেন নি। বরং তিনি তাঁর নিকট তাঁর নিজের নামের ওসীলায় আমাদের অভাব ও অভিযোগের কথা তাঁর নিকট উপস্থাপন করতে আমাদেরকে শিক্ষা দিয়ে বলেছেন :
﴿ وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ﴾ [الاعراف: ١٨٠]
‘‘আল্লাহর রয়েছে উত্তম নামাবলী, সুতরাং তোমরা তাঁকে তাঁর নামের ওসীলায় আহ্বান কর।’’[1] আল্লাহ যেখানে আমাদেরকে তাঁর নামের ওসীলায় তাঁকে আহ্বান করতে নির্দেশ করেছেন, সেখানে আমরা তাঁকে তাঁর কোনো সৃষ্টির নামের ওসীলায় তাঁর নির্দেশ ব্যতীত আহ্বান করতে পারি না। যদিও সে সৃষ্টি তাঁর নিকট তাঁর সকল সৃষ্টির মধ্যে অধিক ভালবাসার পাত্রও হতে পারেন। আমরা আল্লাহর বান্দা। তাই আমাদের জীবনের যাবতীয় প্রয়োজনের কথা কোনো সৃষ্টির মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি তাঁর কাছে জানাবো, এটাই স্বাভাবিক কথা এবং যুক্তিরও দাবী। সে জন্যেই তিনি আমাদের সকলকে সৎ ও অসৎ নির্বিশেষে কোনো নবী বা ওলির মধ্যস্থতা ছাড়াই তাঁকে আহ্বান করার নির্দেশ করে বলেছেন :
﴿ ٱدۡعُونِيٓ أَسۡتَجِبۡ لَكُمۡۚ ﴾ [غافر: ٦٠]
‘‘তোমরা আমাকে আহ্বান কর, আমি তোমাদের ডাকে সাড়া দেব।’’[2] সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করার শিক্ষা দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমাকে বলেন :
«إِذَا سَأَلْتَ فَاسْاَلِ اللهَ، وَ إِذَا اسْتَعَنْتَ فَاسْتَعِنْ بِالله»
‘‘যখন তুমি কিছু চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে, আর যখন কিছু সাহায্য চাইবে তখন তা আল্লাহর কাছেই চাইবে।’’[3] এরপরও কি এ কথা বলা যায় যে, তিনি নবী ও অলিগণের নামের মাধ্যম ছাড়া পাপীদের কোনো কথা শ্রবণ করেন না বা করতে চান না বা তাঁদের নামের ওসীলা নিয়ে দো‘আ করলে তিনি দো‘আ দ্রুত কবুল করবেন, অন্যথায় বিলম্বে করবেন?
প্রকৃতপক্ষে যারা এমনটি বলে তারা আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে। তারা আল্লাহর প্রতি খারাপ ধারণা পোষণ করে। অথচ তিনি তাঁর পাপী বান্দাদের তাওবা ও দো‘আ কবুল করে তাদের অপরাধ মার্জনা করার জন্য অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকেন। তিনি তাঁর বান্দাদেরকে এ বিষয়ের সংবাদ দেয়ার জন্য তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে এ মর্মে নির্দেশ করেছেন :
﴿ ۞نَبِّئۡ عِبَادِيٓ أَنِّيٓ أَنَا ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٤٩ ﴾ [الحجر: ٤٩]
‘‘তুমি আমার বান্দাদেরকে সংবাদ দাও যে, আমি হলাম অধিক ক্ষমাশীল ও মেহেরবান।’’[4]
অপর স্থানে এ মর্মে আহ্বান করতে বলেছেন :
﴿ ۞قُلۡ يَٰعِبَادِيَ ٱلَّذِينَ أَسۡرَفُواْ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ لَا تَقۡنَطُواْ مِن رَّحۡمَةِ ٱللَّهِۚ إِنَّ ٱللَّهَ يَغۡفِرُ ٱلذُّنُوبَ جَمِيعًاۚ إِنَّهُۥ هُوَ ٱلۡغَفُورُ ٱلرَّحِيمُ ٥٣ ﴾ [الزمر: ٥٣]
‘‘বল : হে আমার বান্দারা! যারা নিজেদের নফছের উপর অত্যাচার করেছো তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ে যেওনা, নিশ্চয় আল্লাহ যাবতীয় গুনাহ ক্ষমা করেন, তিনিই হলেন অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও দয়ালু।’’[5]
যারা অপরাধ করে সরাসরি তাঁকে আহ্বান করে তিনি তাদের আহ্বান শ্রবণ করেন।
এ প্রসঙ্গে বলেছেন :
﴿ وَإِذَا سَأَلَكَ عِبَادِي عَنِّي فَإِنِّي قَرِيبٌۖ أُجِيبُ دَعۡوَةَ ٱلدَّاعِ إِذَا دَعَانِۖ﴾ [البقرة: ١٨٦]
‘‘আর আমার বান্দারা যখন তোমাকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে, (তখন তাদের বল) বস্তুত আমি নিকটেই রয়েছি, আহ্বানকারী যখন আমাকে আহ্বান করে, তখন আমি তার আহবানে সাড়া দিয়ে তা কবুল করি...।’’[6]
যারা অন্যায় করার পর দ্রুত তাঁর নিকট ক্ষমা চায়, তিনি তাদের তাওবা কবুল করেন। এ প্রসঙ্গে বলেন :
﴿ إِنَّمَا ٱلتَّوۡبَةُ عَلَى ٱللَّهِ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسُّوٓءَ بِجَهَٰلَةٖ ثُمَّ يَتُوبُونَ مِن قَرِيبٖ فَأُوْلَٰٓئِكَ يَتُوبُ ٱللَّهُ عَلَيۡهِمۡۗ وَكَانَ ٱللَّهُ عَلِيمًا حَكِيمٗا ١٧ ﴾ [النساء: ١٧]
‘‘আল্লাহ অবশ্যই তাদের তাওবা কবুল করেন যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অতঃপর অনতিবিলম্বে তাওবা করে, এরাই হলো সেই সব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, মহাবিজ্ঞ।’’[7]
অপরাধীরা সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করলে তিনি তাদের আহবানে সাড়া দেন এবং তাদের অপরাধ মার্জনা করেন, সে সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন :
«يَنْزِلُ رَبُّنَا تَبَارَكَ وَ تَعَالَى كُلَّ لَيْلَةٍ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا حِيْنَ يَبْقَى ثُلُثُ اللَّيْلِ الْأَخِيْرِ فَيَقُوْلُ : مَنْ يَدْعُوْنِيْ فَأَسْتَجِيْبَ لَهُ، وَ مَنْ يَسْأَلُنِيْ فَأُعْطِيَهُ ، وَمَنْ يَسْتَغْفِرُنِيْ فَأَغْفِرَ لَهُ...»
‘‘আমাদের বরকতময়, সুমহান প্রতিপালক প্রতি রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবী সংলগ্ন আকাশে আগমন করে বলতে থাকেন- কে আমাকে আহ্বান করবে, আমি তার আহবানে সাড়া দেব, কে আমার নিকট চাইবে, আমি তাকে দান করবো, কে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে, আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।’’[8]
মহান আল্লাহ কেবল সে সব লোকেরই তাওবা কবুল করেন না, যারা মৃত্যু মুখে পতিত হয়ে তাওবা করে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন :
﴿ وَلَيۡسَتِ ٱلتَّوۡبَةُ لِلَّذِينَ يَعۡمَلُونَ ٱلسَّئَِّاتِ حَتَّىٰٓ إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ ٱلۡمَوۡتُ قَالَ إِنِّي تُبۡتُ ٱلۡـَٰٔنَ وَلَا ٱلَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمۡ كُفَّارٌۚ ﴾ [النساء: ١٨]
‘‘আর সেই সব লোকদের জন্য কোনো ক্ষমা নেই, যারা মন্দ কাজ করতেই থাকে, এমন কি যখন তাদের কারো মাথার উপর মৃত্যু উপস্থিত হয়, তখন বলতে থাকে- আমি এখন তাওবা করছি, আরো তাওবা নেই তাদের জন্য যারা কুফরী অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।’’[9]আমরা দেখতে পেলাম যে, উক্ত আয়াতসমূহ ও হাদীসে কোথাও অপরাধীদের তাওবা কবুল ও গুনাহ মার্জনা করার জন্য মহান আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সৃষ্টির মধ্যকার কারো নাম ও মর্যাদার মাধ্যম ধরে আল্লাহ্র কাছে তাওবা করতে বলেন নি। কোনো মাধ্যমে তাঁর কাছে কথা না বললে তিনি কারো তাওবা কবুল করতে বিলম্ব করবেন, এমন কথাও বলেন নি। বরং এ সবের দ্বারা অপরাধীদের তাওবা কবুল করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার জন্য আল্লাহ তা‘আলার অধীর আগ্রহ থাকার কথাই আমরা জানতে পেলাম।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা গাফির : ৬০।
[3]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল কিয়ামাহ, বাব নং- ৫৯; ৪র্থ খন্ড, পৃ. ৬৬৭।
[4]. আল-কুরআন, সূরা হিজর : ৪৯।
[5]. আল-কুরআন, সূরা যুমার : ৫৩।
[6]. আল-কুরআন, সূরা বাক্বারাহ : ১৮৬।
[7]. আল-কুরআন, সুরা নিসা : ১৭।
[8]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুয যুহদ, বাব- শেষ রাতের নামাজে দু‘আ করা), ১/২১২১; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুল মুসাফিরীন, পরিচ্ছেদ : শেষ রাতে দু‘আ ও জিকির করার ক্ষেত্রে আগ্রহ প্রদান, এবং দু‘আ কবুল করা), ১/৫২১।
[9]. আল-কুরআন, সূরা নিসা : ১৮।
এখন শুধু প্রয়োজন হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলার নিকট বান্দার অনুতাপ ও অনুনয়-বিনয় প্রকাশ করার। আল্লাহ তা‘আলার নিকট বান্দা সার্বক্ষণিকই তার অনুতাপ প্রকাশ করতে পারে। তবে এ জন্য সম্ভাব্য কিছু সময় ও মুহূর্তও রয়েছে। সম্ভাব্য সময় যেমন- সেহরীর সময়, জুমু‘আর দিন, রমাযান মাস ও ‘আরাফার দিন। আর সম্ভাব্য মুহূর্ত যেমন- নামাযে সেজদা রত অবস্থায়, আযান ও ইকামতের মধ্যবর্তী সময়, নামাযের শেষে একাকী বসে ও বৃষ্টি বর্ষণের সময়ে।[1] বান্দা যদি দো‘আ কবুলের এ সব সম্ভাব্য সময় ও মুহূর্ত অন্বেষণ করে আল্লাহ তা‘আলার নিকট তার কৃত অপরাধের জন্য অনুতাপ করে এবং পুনরায় অপরাধ না করার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে তাঁর কাছে প্রার্থনা করে, তা হলে তিনি তাকে অবশ্যই ক্ষমা করবেন।
তিনি যদি তাঁর অবাধ্য অহংকারী শয়তানের দো‘আ কবুল করে তার আহবানে সাড়া দিয়ে তাকে অপকর্ম করার জন্য কেয়ামত পর্যন্ত আয়ু দিতে পারেন,[2] তা হলে সাধারণ অপরাধীরা তাঁর কাছে বিনয়ের সাথে সরাসরি কিছু চাইলে তিনি তাদের দো‘আ কবুল না করার কোনো কারণ থাকতে পারেনা। প্রকৃত কথা হচ্ছে- যারা তাঁর আনুগত্যকে স্থায়ীভাবে না হোক অন্তত সাময়িকভাবে হলেও স্বীকার করে নিয়ে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে বিনয়ের সাথে আহ্বান করে, তিনি তাদের আহবানেও সাড়া দেন। এ ক্ষেত্রে আহ্বানকারী কোনো মুশরিক না মুনাফিক না ফাসিক না মু’মিন, এ সবের প্রতি তিনি আদৌ কোনো লক্ষ্য করেন না। আর এ কারণেই মুশরিকরা যখন সমুদ্রে ঝড়ের কবলে পড়ে তাঁকে একনিষ্ঠভাবে আহ্বান করতো তখন তিনি তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে দিতেন।
যেমন আল্লাহ বলেন :
﴿ فَإِذَا رَكِبُواْ فِي ٱلۡفُلۡكِ دَعَوُاْ ٱللَّهَ مُخۡلِصِينَ لَهُ ٱلدِّينَ فَلَمَّا نَجَّىٰهُمۡ إِلَى ٱلۡبَرِّ إِذَا هُمۡ يُشۡرِكُونَ ٦٥ ﴾ [العنكبوت: ٦٥]
‘‘যখন মুশরিকরা (সমুদ্রে) নৌকা বা জাহাজে আরোহণ করে (ঝড়ের কবলে পড়ে, তখন তারা) তাদের সকল আনুগত্যকে আল্লাহর জন্য একনিষ্ট করে তাঁকে আহ্বান করে। অতঃপর তিনি যখন তাদেরকে স্থলে এনে উদ্ধার করে দিতেন, তখনই তারা (তাঁর সাথে) শরীক করতে থাকে।’’[3] মুশরিকরা যদি তাদের শির্কী ধ্যান-ধারণা পরিহার না করেও কোনো মধ্যস্থতা ছাড়াই একনিষ্ঠভাবে সরাসরি আল্লাহকে আহ্বান করার ফলে তিনি তাদেরকে ঝড়ের কবল থেকে উদ্ধার করতে পারেন, তা হলে আমাদের ডাক না শুনার তো কোনো কারণ থাকতে পারে না। অতএব যারা মৃত নবী ও ওলিদেরকে আল্লাহ ও সাধারণ মানুষদের মাঝে মাধ্যম হিসেবে দাঁড় করেন এবং তাঁদের নামের মাধ্যমে দো‘আ করলে আল্লাহ সে দো‘আ দ্রুত শ্রবণ করেন বলে মনে করেন, তারা আসলে আল্লার প্রতি মিথ্যারোপ করেন। তাদের জানা আবশ্যক যে, কোনো ওলি তো দূরের কথা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও যদি কারো ব্যাপারে আল্লাহর কাছে কোনো সুপারিশ করেন, তা হলে তাঁর সে সুপারিশ গ্রহণ করা আল্লাহ তা‘আলার উপর জরুরী হয়ে যায় না। যেমন তিনি মুনাফিকদের সরদার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এর জানাযার নামায পড়ে তার মাগফিরাতের জন্য সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু আল্লাহ তাঁর সুপারিশ গ্রহণ করাতো দূরের কথা, তিনি তাঁকে এ ধরনের কর্মের পুনরাবৃত্তি করার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেছিলেন :
﴿إِن تَسۡتَغۡفِرۡ لَهُمۡ سَبۡعِينَ مَرَّةٗ فَلَن يَغۡفِرَ ٱللَّهُ لَهُمۡۚ ﴾ [التوبة: ٨٠]
‘‘যদি তুমি তাদের (মুনাফিকদের) জন্য সত্তর বারও ক্ষমা ভিক্ষা কর, তবুও আল্লাহ কস্মিনকালেও তাদেরকে ক্ষমা করবেন না।’’[4]
অপর আয়াতে এদের জানাযা পড়তে নিষেধ করে দিয়ে বলেন :
﴿ وَلَا تُصَلِّ عَلَىٰٓ أَحَدٖ مِّنۡهُم مَّاتَ أَبَدٗا وَلَا تَقُمۡ عَلَىٰ قَبۡرِهِۦٓ﴾ [التوبة: ٨٤]
‘‘এদের কেউ মরলে তুমি তাদের জানাযার নামায পড়বে না, তার কবরের পাশেও দাঁড়াবে না।’’[5]
কাজেই দেখা যাচ্ছে যে, কেউ কিছু চাইলে তা নবী বা ওলিদের মধ্যমে আল্লাহর নিকট চেয়েছে কি না, মূলত সেটা দেখার কোনো বিষয় নয়। বরং আসল দেখার বিষয় হচ্ছে যার সমস্যা তার মানসিক অবস্থা কী। দো‘আকারীর মানসিক অবস্থা ঠিক হলে এবং এখলাসের সাথে সে নিজেই সরাসরি আল্লাহর কাছে চাইলে তিনি শুধু মু’মিন কেন মুশরিকেরও দো‘আ শুনেন এবং তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। এটাই হচ্ছে আল্লাহর সুন্নাত বা নিয়ম।উক্ত আলোচনার দ্বারা এ কথা প্রমাণিত হলো যে, দো‘আ করার সময় কোনো সৃষ্টির নামের বা তাঁর মর্যাদা ও হুরমতের ওসীলা গ্রহণের জন্য আল্লাহ আমাদেরকে কোনো শিক্ষা দান করেননি বা তাঁর সাধারণ বান্দাদের সমস্যাদি তাঁর নিকট উপস্থাপনের জন্য তিনি তাঁর সৃষ্টির মধ্যকার কাউকে তাঁর ও তাঁর বান্দাদের মধ্যে ওসীলা হওয়ার জন্যেও মনোনীত করেননি। বরং এটি কোনো কোন পীরদের মনগড়া বক্তব্য বৈ আর কিছুই নয়। এ বিষয়টি অবগতির পর এবার আমাদেরকে যে বিষয়টি জানতে হবে তা হলো : আল্লাহ তা‘আলার নিকট কিছু চাইতে হলে তা কীভাবে চাইতে হবে?
>[2]. শয়তান অপমানিত হয়ে বিতাড়িত হওয়ার প্রাক্কালে এই ব’লে দু‘আ করেছিল :
﴿ قَالَ أَنظِرۡنِيٓ إِلَىٰ يَوۡمِ يُبۡعَثُونَ ١٤ قَالَ إِنَّكَ مِنَ ٱلۡمُنظَرِينَ ١٥ ﴾ [الاعراف: ١٤، ١٥]
‘‘প্রভু! আমাকে কেয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দান করুন, আল্লাহ বলেন : তোমাকে অবকাশ দান করা হলো।” আল-কুরআন, সূরা আ‘রাফ : ১৪ ও ১৫।
[3]. আল-কুরআন, সূরা ‘আনকাবূত : ৬৫।
[4]. আল-কুরআন, সূরা তাওবাহ : ৮০।
[5]. আল-কুরআন, সূরা তাওবাহ : ৮৪।
আল্লাহর নিকট কিছু চাইতে হলে তা মোট দু’ভাবে চাওয়া যেতে পারে :
এক. কোনো কিছুর মাধ্যম ছাড়াই সরাসরি আল্লাহ তা‘আলার নিকট কিছু চাওয়া যেতে পারে। কোনো প্রয়োজনকে সামনে রেখে এ কথা বলা যেতে পারে যে, হে আল্লাহ আমার অমুক প্রয়োজনটি পূর্ণ করে দিন। আমার অসুখ হয়েছে তা দ্রুত নিবারণ করে দিন...ইত্যাদি।
দুই. কোনো কিছুর ওসীলা বা মাধ্যম করে আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া। কুরআন ও সহীহ হাদীস অধ্যয়ন করলে দেখা যায়, আল্লাহর কাছে মোট ছয় পন্থায় ওসীলা করে কিছু চাওয়া যেতে পারে:
প্রথম পন্থা : আল্লাহ তা‘আলার সুন্দর নামাবলী ও সুমহান গুণাবলীর ওসীলায় দো‘আ করা :
আল্লাহ তা‘আলার জানা বা অজানা পবিত্র ও উত্তম নামাবলীর মাধ্যমে তাঁর কাছে কিছু আবেদন করা। নিজের প্রয়োজনের কথা বলার পূর্বে মুখে তাঁর নাম নেয়া । যেমন এ কথা বলা :
«يَا حَيُّ يَا قَيُّومُ بِرَحْمَتِكَ أَسْتَغِيثُ»
‘‘হে চিরঞ্জীব হে সবকিছুর ধারক! আমি তোমার রহমতের অসীলায় উদ্ধার কামনা করছি[1]।’’
এ পন্থা যে আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত পন্থা তা আমরা ইতোপূর্বে অবগত হয়েছি। এটি ওসীলার সর্বোত্তম পন্থা হওয়ায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অধিকহারে এ পন্থা অবলম্বন করেই দো‘আ করতেন। হাদীসের গ্রন্থসমূহের দো‘আর অধ্যায় খুললেই এর জলন্ত প্রমাণ পাওয়া যায়।
দ্বিতীয় পন্থা : আল্লাহর তাওহীদ ও ঈমানের রূকনসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা :
নিম্নে বর্ণিত আয়াত দু’টি দ্বারা এ জাতীয় ওসীলার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইউনুস (আলাইহিস সালাম) কে যখন সমুদ্রের মাছ ভক্ষণ করেছিল, তখন তিনি সে বিপদ থেকে দ্রুত মুক্তি লাভের জন্য আল্লাহ তা‘আলার তাওহীদের ওসীলায় দো‘আ করে বলেছিলেন :
﴿فَنَادَىٰ فِي ٱلظُّلُمَٰتِ أَن لَّآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنتَ سُبۡحَٰنَكَ إِنِّي كُنتُ مِنَ ٱلظَّٰلِمِينَ﴾ [الانبياء: ٨٧]
‘‘অন্ধকারের মধ্যে তিনি এই বলে আহ্বান করেন যে, (হে আল্লাহ) তুমি ব্যতীত কোনো সঠিক ইপাস্য নেই, আমি তোমার পবিত্রতা বর্ণনা করছি, নিশ্চয় আমি যালিমদের অন্তর্গত হয়ে গেছি।’’[2]
আল্লাহ তা‘আলার প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা প্রসঙ্গে কুরআনুল কারীমে বর্ণিত হয়েছে :
﴿ رَّبَّنَآ إِنَّنَا سَمِعۡنَا مُنَادِيٗا يُنَادِي لِلۡإِيمَٰنِ أَنۡ ءَامِنُواْ بِرَبِّكُمۡ فََٔامَنَّاۚ رَبَّنَا فَٱغۡفِرۡ لَنَا ذُنُوبَنَا وَكَفِّرۡ عَنَّا سَئَِّاتِنَا وَتَوَفَّنَا مَعَ ٱلۡأَبۡرَارِ ١٩٣ ﴾ [ال عمران: ١٩٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা একজন আহ্বানকারীকে ঈমানের প্রতি এ মর্মে আহ্বান করতে শুনেছি যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের প্রতি ঈমান আনয়ন কর, ফলে আমরা ঈমান আনয়ন করেছি, হে আমাদের প্রতিপালক! অতএব, (তোমার প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায়) তুমি আমাদের অপরাধসমূহ মার্জনা কর, আমাদের অপকর্মসমূহ দূর করে দাও এবং আমাদেরকে নেক মানুষদের সাথে মৃত্যু দাও।’’[3]
ঈমানের রুকসমূহের প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায় দো‘আ করা প্রসঙ্গে বর্ণিত হয়েছে :
﴿ رَبَّنَآ ءَامَنَّا بِمَآ أَنزَلۡتَ وَٱتَّبَعۡنَا ٱلرَّسُولَ فَٱكۡتُبۡنَا مَعَ ٱلشَّٰهِدِينَ ٥٣ ﴾ [ال عمران: ٥٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা কিছু অবতীর্ণ করেছ আমরা তাতে ঈমান এনেছি এবং রাসূলের অনুসরণ করেছি, অতএব, তুমি আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে লিখে নাও।’’[4]
অত্র আয়াতে আল্লাহর কিতাবের প্রতি ঈমান এবং রাসূলের অনুসরণ এ দু’টি বিষয়কে ওসীলা করে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে লিখে নেয়ার কথা আল্লাহর কাছে চাওয়া হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, এ দু’টি বিষয়ের মত ঈমানের আরো যে সব রুকন রয়েছে সেগুলোর প্রতি ঈমান আনয়নের ওসীলায়ও দো‘আ করা যেতে পারে।
তৃতীয় পন্থা : আল্লাহর নিকট বিপদ ও দুঃখের কথা বলে নিজের অপারগতা ও দুর্বলতা প্রকাশের ওসীলায় দো‘আ করা :
যেমন আইউব (আলাইহিস সালাম) তাঁর অসুখের কথা বলে নিজের অপারগতা ও অসহায়ত্বের বিষয়টি আল্লাহর কাছে তুলে ধরে তাঁর দয়া কামনা করে বলেছিলেন :
﴿ أَنِّي مَسَّنِيَ ٱلضُّرُّ وَأَنتَ أَرۡحَمُ ٱلرَّٰحِمِينَ ﴾ [الانبياء: ٨٣]
‘‘প্রভু! আমাকে অকল্যাণ পেয়ে বসেছে, তুমি হলে অধিক দয়াবান।’’
চতুর্থ পন্থা : নিজের অপরাধ স্বীকার করার ওসীলায় দো‘আ করা :
যেমন আদম ও হাওয়া (‘আ.) শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে গম খাওয়ার পর যখন বুঝতে পারলেন যে, তারা অপরাধ করে ফেলেছেন, তখন তারা তাদের অপরাধ স্বীকার করার ওসীলায় আল্লাহর কাছে তা মার্জনার জন্য দো‘আ করে বলেছিলেন :
﴿رَبَّنَا ظَلَمۡنَآ أَنفُسَنَا وَإِن لَّمۡ تَغۡفِرۡ لَنَا وَتَرۡحَمۡنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ ٱلۡخَٰسِرِينَ﴾ [الاعراف: ٢٣]
‘‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর অত্যাচার করেছি, তুমি যদি ক্ষমা ও দয়া না কর, তা হলে আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব।’’[5]
পঞ্চম পন্থা : কোনো সৎকর্মের ওসীলায় দো‘আ করা:
সৎ কর্ম বিভিন্ন রকমের হতে পারে। তন্মধ্যে উত্তম দু’টি ‘আমল হচ্ছে নামায ও বিপদে ধৈর্য ধারণ করা। তাই মহান আল্লাহ এ দু’টির ওসীলায় দো‘আ করার প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেছেন :
﴿ وَٱسۡتَعِينُواْ بِٱلصَّبۡرِ وَٱلصَّلَوٰةِۚ ﴾ [البقرة: ٤٥]
‘‘তোমরা ধৈর্য ধারণ এবং নামাযের ওসীলায় আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা কর’’।[6] এ আয়াতের মর্মানুযায়ী প্রমাণিত হয় যে, ফরয ও নফল নামাযান্তে একাকী বসে নামাযের ওসীলায় আল্লাহর কাছে কিছু প্রাপ্তির জন্য দো‘আ করা যেতে পারে।
এছাড়াও সহীহ হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, বনী ইসরাঈলের তিন ব্যক্তি একদা রাত যাপনের জন্য একটি পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। রাতে পাহাড়ের চূড়া থেকে একটি পাথর গড়িয়ে পড়ে তাদের গুহার মুখ বন্ধ হয়ে গেলে তারা পরস্পরকে বললো :
«إِنَّهُ لاَ يُنْجِيكُمْ مِنْ هَذِهِ الصَّخْرَةِ إِلَّا أَنْ تَدْعُوا اللَّهَ بِصَالِحِ أَعْمَالِكُمْ»
‘‘তোমাদের সৎ ‘আমলের ওসীলায় আল্লাহকে আহ্বান না করা ব্যতীত এ পাথর থেকে তোমাদের মুক্তির কোনো উপায় নেই...।’’[7] এরপর তাদের একজন তার পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করার ওসীলায় দো‘আ করলো, আরেকজন আল্লাহর ভয়ে ব্যভিচার করা থেকে বিরত থাকার ওসীলায় দো‘আ করলো, তৃতীয়জন মজুরকে তার প্রাপ্যসহ আরো অধিক সম্পদ দেয়ার ওসীলায় আল্লাহ তা‘আলাকে আহ্বান করার পর আল্লাহ তাদেরকে সে বিপদ থেকে মুক্ত করেছিলেন।[8]
এতে প্রমাণিত হয় যে, শরী‘আত কর্তৃক নির্দেশিত যাবতীয় করণীয় ও বর্জনীয় কর্ম করে এর ওসীলায় ইহ-পরকালীন কল্যাণার্জন ও অকল্যাণ দূরীকরণের জন্য আল্লাহর কাছে দো‘আ করা যেতে পারে।
ষষ্ঠ পন্থা : জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলায় আল্লাহর নিকট কিছু কামনা করা :
জীবিত মানুষের দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করেও আল্লাহর কাছে কিছু চাওয়া যেতে পারে। এ ওসীলা আবার দু’ভাবে হতে পারে :
এক. নিজের এবং নিজের সন্তানাদি ও পরিবারের ইহ-পরকালীন কল্যাণের জন্য কোনো মানুষের নিকট গিয়ে তাকে এ কথা বলা যেতে পারে যে, আমাদের জন্য একটু দো‘আ করুন বা আমাদের জন্য দো‘আ করবেন[9]। দো‘আকারী ব্যক্তি তাৎক্ষণিক আমাদের জন্য দো‘আ করতে পারেন। ইচ্ছা করলে পরবর্তী সময়ে আমাদের অনুপস্থিতিতেও তা করতে পারেন। তবে অনুপস্থিত অবস্থার দো‘আই সবচেয়ে উত্তম। কেননা, তা আল্লাহর কাছে গৃহীত হওয়ার অধিক সম্ভাবনা রয়েছে বলে ইতোপূর্বে বর্ণিত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে।
নবজাত শিশু ও রোগীদেরকে কারো কাছে নিয়ে যেয়ে তার নিকট তাদের জন্য দো‘আ কামনা করাও এ জাতীয় ওসীলারই অন্তর্ভুক্ত। এ জাতীয় কর্ম রাসূলের সাহাবীদের মাঝে প্রচলিত ছিল। উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে সন্তানদের নিয়ে আসা হতো, তিনি (দো‘আ পাঠ করে তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে ঝাড়ফুঁক করে) তাদের উপর বরকত দিতেন এবং খুরমা চিবিয়ে তাদের মুখের তালুতে লাগিয়ে দিতেন।’’[10]
দুই. কারো নিকট নিজের কল্যাণের জন্য দো‘আ চাওয়া এবং তিনি তাৎক্ষণিক দো‘আ করলে নিজেও সে দো‘আয় শরীক হয়ে আল্লাহর কাছে নিজের জন্য দো‘আকারীর দো‘আ কবুল হওয়ার জন্য আল্লাহুম্মা আ-মীন বলা। অথবা তার দো‘আর সাথে শরীক না হয়ে পরবর্তী কোনো সময়ে নিজে নিজের জন্য দো‘আ করার সময় তাঁর দো‘আর ওসীলা গ্রহণ করে এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ! অমুক ব্যক্তি আমার জন্য যে দো‘আ করেছেন, তাঁর সে দো‘আ এর ওসীলা করে বলছি- আমার ব্যাপারে তাঁর দো‘আ কবুল করুন। এ জাতীয় ওসীলা করার বৈধতা নিম্নে বর্ণিত হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয়:
প্রথম হাদীস
‘উছমান ইবনে হানীফ (রহ.) থেকে বর্ণিত। একজন অন্ধ মানুষ এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললো :
«أُدْعُ اللهَ أَنْ يُعافِيْنِيْ . فَقَالَ لَهُ:"إِنْ شِئْتَ دَعَوْتُ لَكَ ، وَ إِنْ شِئْتَ صَبَرْتَ فَهُوَ خَيْرٌ لَكَ". فقال:اُدْعُ. "فَأَمَرَهُ أَنْ يَتَوَضَّأَ ، فَيُحْسِنَ وُضُوْءَهُ ، فَيُصَلِّيْ رَكْعَتَيْنِ ، وَ يَدْعُوْ بِهَذَا الدُّعَاءِ : اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَسْأَلُكَ وَ أَتَوَجَّهُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّكَ مُحَمَّدٍ نَبِيَّ الرَّحْمَةِ يَا مُحَمَّدُ إِنِّيْ تَوَجَّهْتُ بِكَ إِلَى رَبِّيْ فِيْ حَاجَتِيْ هَذِهِ فَتَقَضِيْ لِيْ ، اللَّهُمَّ فَشَفِّعْهُ فِيَّ". و في رواية "وَ شَفِّعْنِيْ فِيْهِ. قال الراوي : فَبَرِأَ الرَّجُلُ»
‘‘হে রাসূল! আল্লাহর কাছে দো‘আ করুন তিনি যেন আমার চক্ষু ফিরিয়ে দেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন : তুমি চাইলে আমি তোমার জন্য দো‘আ করবো, আর তুমি চাইলে ধৈর্য ধারণ করতে পারো, তা হলে তোমার জন্য তা মঙ্গল হবে। লোকটি বললো: দো‘আ করুন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে উত্তমভাবে ওয়াযু করে দু’রাক‘আত নামায আদায় করে নিম্নোক্ত দো‘আর মাধ্যমে দো‘আ করতে বললেন:হে আল্লাহ ! আমি তোমার কাছে সওয়াল করছি এবং তোমার রহমতের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (এর দো‘আ)-এর ওসীলায় তোমার দিকে মুখ ফিরালাম, হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমি তোমার (দো‘আ এর) ওসীলায় আমার এই প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তোমার রবের প্রতি মুখ ফিরালাম, অতএব আমার এই প্রয়োজন পূর্ণ করুন। হে আল্লাহ! আমার ব্যাপারে তুমি তাঁর দো‘আকে কবুল কর’’। অপর বর্ণনায় রয়েছে : আমার সে ব্যাপারে আমার দো‘আ কবুল কর।’’ এ হাদীসের বর্ণনাকারী বলেন : লোকটি এভাবে দো‘আ করার পর সে সুস্থ হয়ে যায়।’’[11]
এ হাদীসে বর্ণিত লোকটির দো‘আর জন্য আবেদন করা অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পক্ষ থেকে তার জন্য দো‘আ করা বা না করার ব্যাপারে এখতিয়ার দেয়া, পরিশেষে রাসূলের পক্ষ থেকে তাকে উক্ত দো‘আ শিখিয়ে দেয়ার দ্বারা এ জাতীয় ওসীলার বৈধতা প্রমাণিত হয়।
দ্বিতীয় হাদীস
আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘উমার ইবনুল খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহুর যুগে যখন অনাবৃষ্টিজনিত কারণে তাঁরা অভাবে পতিত হতেন তখন তারা আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুর দো‘আর ওসীলায় বৃষ্টি চাইতেন এবং ‘উমার তাঁর দো‘আয় বলতেন :
«اللَّهُمَّ إِنَّا كُنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِنَبِيِّنَا فَتَسْقِيْنَا، وَ إِنَّا نَتَوَسَّلُ إِلَيْكَ بِعَمِّ نَبِيِّنَا فَاسْقِنَا ، قَالَ : فَيَسْقَوْنَ»
‘‘হে আল্লাহ! আমরা আমাদের নবীর মাধ্যমে আপনার নিকট বৃষ্টির জন্য দো‘আ চাইতাম, ফলে তুমি আমাদের বৃষ্টি দিতে, আমরা (এখন) আমাদের নবীর চাচার (দো‘আর) মাধ্যমে আপনার নিকট বৃষ্টি কামনা করছি.অতএব, আপনি আমাদের বৃষ্টি দান করুন। আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন : এ ভাবে দো‘আ করার পর তাঁদের বৃষ্টি দান করা হতো।’’[12] এ হাদীস দ্বারাও অন্যের দো‘আর ওসীলায় দো‘আ করার বৈধতা প্রমাণিত হয়।
>[2]. আল-কুরআন, সূরা : আম্বিয়া : ৮৭।
[3]. আল-কুরআন, সূরা : আলে ইমরা্ন : ১৯৩।
[4]. আল-কুরআন, সূরা আলে ইমরান : ৫৩।
[5]. আল-কুরআন, সূরা : আ‘রাফ : ২৩।
[6]. আল-কুরআন, সূরা : বাক্বারাহ : ৪৫।
[7]. বুখারী, প্রাগুক্ত; কিতাবুল ইজারাহ, বাব নং- ১২ ; ৩/৭৯৩; মুসলিম, প্রাগুক্ত; কিতাবুয যিক্র, বাব : ক্বিস্যাতু আসহাবিল গারিস সালাসাতি, হাদীস নং- ১০০; ৪/২০৯৯।
[8]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুয যিকির ওয়াদ দু’আ, বাব: তিন গুহাবাসীর ঘটনা...); ৪/২০৯৯।
[9]. যদিও কারও কাছে দো‘আ চেয়ে বেড়ানো কুরআন ও রাসূলের সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় নি; কারণ এতে দু’টি সমস্যা রয়েছে, এক. বান্দা তার রব থেকে দূরে সরে যেতে পারে। দুই. শুধু শুধু কারও কাছে ছেয়ে বেড়ানোর মাধ্যমে নিজেকে হেয় করছে এবং অন্যের প্রতি মুখাপেক্ষী হচ্ছে। যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। সুতরাং বান্দা নিজেই এ কাজটি নিজের জন্য করা উচিত। যদি অন্যের কাছে দো‘আ চায়, তখন তার উদ্দেশ্যে থাকতে হবে যে যার কাছে দো‘আ চেয়েছি সে ব্যক্তি নিজেও আমার জন্য দো‘আ করা দ্বারা উপকৃত হতে পারে; কারণ, যে কেউ কারও জন্য তার অনুপস্থিতিতে দো‘আ করে ফেরেশতা বলতে থাকে, “তোমার জন্যও অনুরূপ হোক”। সুতরাং এর মাধ্যমে দো‘আপ্রার্থী ও দো‘আকারী উভয়েই সমভাবে উপকৃত হতে পারে। তাই কারও কাছে দো‘আ চাওয়ার সময় উভয়ে উপকৃত হওয়ার এ নিয়ত থাকা আবশ্যক, নিছক নিজের জন্য কারও কাছে যাচ্ঞা করে বেড়ানো ইসলামের মূল শিক্ষার বিরোধী। এ বিষয়টি আরও জানার জন্য শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ লিখিত, ‘আল-ওয়াসেতা-বাইনাল হাক্কি ওয়াল খালক’ বা স্রষ্টাকে পেতে মাধ্যম গ্রহণ গ্রন্থটি (কামিয়াব প্রকাশনী কর্তৃক আমার দ্বারা অনুবাদ ও সম্পাদিত) দেখা যেতে পারে। [সম্পাদক]
[10]. মুসলিম, প্রাগুক্ত; (কিতাবুত ত্বাহারত, পরিচ্ছদ : দুগ্ধপানকারী শিশুদের বরকত দানের হুকুম); ১/২৩৭।
[11]. তিরমিযী, প্রাগুক্ত; ৪/৫৬৯; আব্দুর রহমান আল-মুবারকপুরী, প্রাগুক্ত; ৪/২৮১-২৮২।
[12]. বুখারী, প্রাগুক্ত; (কিতাবুল ইস্তেসকা, পরিচ্ছদ : অনাবৃষ্টির সময় জনগণ কর্তৃক ইমামকে বৃষ্টি জন্য দু‘আ করতে বলা); ১/২/৭৫।