১৫- প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে মানুষ ব্যভিচারে লিপ্ত হয়। চোখ, কান, জিভ, হাত, পা এবং অনেক ক্ষেত্রে যৌনাঙ্গের ব্যভিচার সংঘটিত করে অবৈধ পিরীত। প্রিয়ার দিকে হেঁটে যাওয়া হল পায়ের ব্যভিচার। অতএব প্রেয়সীর প্রতি যে পথে ও পায়ে তুমি চলতে কুণ্ঠিত ও লজ্জিত নও, সেই পথের উপর তোমার পায়ের নিশানা ও দাগকে কোন দিন ভয় করেছ কি?
ভেবেছ কি যে, তোমার ছেড়ে যাওয়া প্রত্যেক নিশানা সযত্নে হিফাযত করে রাখা হচ্ছে। মহান আল্লাহ বলেন, “আমিই মৃতকে জীবিত করি এবং লিখে রাখি যা ওরা অগ্রে পাঠায় ও পশ্চাতে রেখে যায়। আমি প্রত্যেক জিনিসই স্পষ্ট কিতাবে সংরক্ষিত রেখেছি।” (সূরা ইয়াসীন ১২) প্রিয়তমার সাথে খোশালাপ হল জিভের ব্যভিচার। গোপন প্রিয়ার সাথে প্রেম-জীবনের সুমিষ্ট কথার রসালাপ তথা মিলনের স্বাদ বড় তৃপ্তিকর। কিন্তু বন্ধু! এমন সুখ তো ক্ষণিকের জন্য। তাছাড়া এমন সুখ ও স্বাদের কি মূল্য থাকতে পারে, যার পরবর্তীকালে অপেক্ষা করছে। দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি ও দুঃখ। যে জিভ নিয়ে তুমি তোমার প্রণয়িণীর সাথে কথা বল, সে জিভের সকল কথা রেকর্ড করে রাখা হচ্ছে, তা তুমি ভেবে দেখেছ কি? মহান সৃষ্টিকর্তা বলেন, “মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তাদের নিকটই আছে।” (সূরা ক্বাফ ৫০ আয়াত)
রসিক নাগর বন্ধু আমার! প্রেমে পড়ে তুমি প্রেমিকার সাথে মিলে যে পাপ করছ, সে পাপ কি ছোট ভেবেছ? ভেবে দেখ, হয়তো তোমাদের মাঝে এমন পাপও ঘটে যেতে পারে, যার। পার্থিব শাস্তি হল একশত কশাঘাত, নচেৎ প্রস্তরাঘাতে খুন। কিন্তু দুনিয়াতে এ শাস্তি থেকে কোন রকমে বেঁচে গেলেও আখেরাতে আছে জ্বলন্ত আগুনের চুল্লী। অতএব যে পুকুরের জল খাব না, সে পুকুরের পাড় দিয়ে যাব না’ -এটাই সুপুরুষের দৃঢ়সংকল্প হওয়া উচিত নয় কি? ভেবেছ কি যে, তুমি তোমার ভালোবাসার সাথে যে অবৈধ প্রেমকেলি, প্রমোদ-বিহার করছ, তা ভিডিও-রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। প্রীতির স্মৃতি রাখতে গিয়ে অনেক সময় যে ছবি তোমরা অবৈধ ও অশ্লীলভাবে তুলে রাখছ, তা একদিন ফাস হয়ে যাবে।
এ সব কিছুই মানুষের চোখে ফাকি দিয়ে করলেও কাল কিয়ামতে তুমি স্বচক্ষে দেখতে পাবে। “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভালো কাজ করবে, সে তা দেখতে পাবে। আর যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করবে, সে তা-ও দেখতে পাবে।” (সূরা যিলযাল ৭-৮ আয়াত) এবং তার যথার্থ প্রতিদানও পাবে। প্রেম-সুখী বন্ধু আমার! যে মাটির উপর তুমি ঐ অশ্লীলতা প্রেমের নামে করছ, সেই মাটি তোমার গোপন ভেদ গ্রামোফোন রেকর্ডের মত রেকর্ড করে রাখছে। কাল কিয়ামতে সে তা প্রকাশ করে দেবে। পৃথিবী তার বৃত্তান্ত বর্ণনা করবে। (ঐ ৪ আয়াত)
বন্ধু আমার। তুমি হয়তো তোমার ঐ প্রেমকেলিতে মানুষকে ভয় করছ, মা-বাপকে লজ্জা করছ। কিন্তু সদাজাগ্রত সেই সর্বস্রষ্টাকে লজ্জা ও ভয় করেছ কি? যে স্রষ্টা তোমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সহ তোমার দেহ সৃষ্টি করেছেন এবং তার তৈরী দেহকে তারই অবাধ্যাচরণে ব্যবহার করছ। এ কথা তো তুমি বিশ্বাস কর যে, আমাদের মাথার চুল থেকে নিয়ে পায়ের নখ পর্যন্ত সমস্ত দেহ সেই মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহরই দান। আমাদের ব্যবহারের জন্য তিনি আমাদের দেহের সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যথাস্থানে স্থাপন করে আমাদের প্রতি বড় অনুগ্রহ করেছেন। কিয়ামতে যখন আমরা আমাদের স্বকৃত পাপের কথা ভয়ে অস্বীকার করে বসব, তখন ঐ অঙ্গসমূহ কথা বলে আমাদের বিরুদ্ধে আল্লাহর কাছে সাক্ষি দেবে। (সূরা ইয়াসীন ৬৫ আয়াত)
সুতরাং এ দেহ আল্লাহর মালিকানায়, আমাদের মালিকানায় নয়। এ দেহ ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে যদি তার অবাধ্যাচরণ ও বিরোধিতায় প্রয়োগ করি তাহলে তার চেয়ে বড় ধৃষ্টতা ও নির্লজ্জতা আর কি হতে পারে? আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করে তার ইবাদত করার জন্য পাঠালেন দুনিয়াতে এবং তার মহা প্রতিদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন আখেরাতে। কিন্তু বান্দা যদি সেই প্রতিশ্রুতির কথা, আখেরাত ও মৃত্যুর কথা ভুলে গিয়ে দুনিয়াই সর্বশেষ মনে করে, তবে নিশ্চয়ই তা লজ্জার কথা। এ জন্যই মহানবী %ি বলেন, “তোমরা আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা কর।” সকলে বলল, হে আল্লাহর নবী! আমরা তো -আলহামদু লিল্লাহ- আল্লাহকে লজ্জা করে থাকি। তিনি বললেন, “না ঐরূপ নয়।
আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করার অর্থ এই যে, মাথা ও তার সংযুক্ত অন্যান্য অঙ্গ (জিভ, চোখ এবং কান)কে (অবৈধ প্রয়োগ হতে) হিফাযত করবে, পেট ও তার সংশ্লিষ্ট অঙ্গ (লিঙ্গ, হাত, পা ও হৃদয়)কে (তার অবাধ্যাচরণ ও হারাম হতে) হিফাযত করবে এবং মরণ ও তার পর হাড় মাটি হয়ে যাওয়ার কথা (সর্বদা) স্মরণে রাখবে। আর যে ব্যক্তি পরকাল (ও তার সুখময় জীবন) পাওয়ার ইচ্ছা রাখে, সে ইহকালের সৌন্দর্য পরিহার করবে। যে ব্যক্তি এ সব কিছু করে, সেই প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে যথাযথভাবে লজ্জা করে।” (সহীহ তিরমিযী ২০০০ নং)
ভেবেছ কি বন্ধু! তোমার চোখ, কান, হাত, পা এবং শরীরের চামড়া পর্যন্ত কাল কিয়ামত কোর্টে আল্লাহর সামনে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দান করবে? কুরআন বলে, “পরিশেষে যখন ওরা দোযখের নিকট পৌছবে, তখন ওদের চোখ, কান ও ত্বক ওদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সাক্ষ্য দেবে---” (সূরা ফুসিলাত ২০ আয়াত) “যেদিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে তাদের জিভ, তাদের হাত ও তাদের পা, তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে। সে দিন আল্লাহ তাদের প্রাপ্য প্রতিফল পুরোপুরি দেবেন এবং তারা জানবে যে, আল্লাহই সত্য, স্পষ্ট ব্যক্তকারী।” (সূর নুর ২৪ আয়াত)
মহান আল্লাহ আরো বলেন, “যেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে, সেদিন মিথ্যাশ্রয়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং প্রত্যেক সম্প্রদায়কে ভয়ে নতজান হতে দেখবে, প্রত্যেক সম্প্রদায়কে তার । আমলনামা (কর্মলিপি) দেখতে আহ্বান করা হবে। আর বলা হবে, তোমরা যা করতে আজ তোমাদেরকে তারই প্রতিফল দেওয়া হবে। আমার নিকট সংরক্ষিত এই আমলনামা, যা সত্যভাবে তোমাদের ব্যাপারে কথা বলবে। তোমরা যা করতে আমি তা লিপিবদ্ধ করতাম।” (সূরা জাসিয়াহ ২৭-২৯ আয়াত) “ওরা কি মনে করে যে, আমি ওদের গোপন বিষয় ও মন্ত্রণার খবর রাখি না? অবশ্যই রাখি। আমার ফিরিশ্তাগণ তো ওদের নিকট থেকে সব কিছু লিপিবদ্ধ করে।” (সূরা যুখরুফ ৮০ আয়াত)
গোপন-প্রেমিক বন্ধু আমার! ভালোবাসার নামে একজন উদাসীনা তরুণীকে গোপনে তার পিত্রালয় থেকে বের করে এনে কোন জায়গায় কোন মুন্সীকে ৫০/ ১০০ টাকা দিয়ে তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে পড়িয়ে নিয়ে ঘরের বউ করে তুলে আনলে, সে যে তোমার জন্য হালাল হবে না, তা তুমি জান কি? মহানবী ৪ বলেন, “যে নারী তার অভিভাবকের সম্মতি ছাড়াই নিজে নিজে বিবাহ করে, তার বিবাহ বাতিল, বাতিল, বাতিল।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, দারেমী, মিশকাত ৩১৩১নং)।
অর্থাৎ, ঐ বউ নিয়ে সংসার করলে চির জীবন ব্যভিচার করা হবে। যেমন ব্যভিচার হবে স্ত্রী থাকতে আপন শালীর প্রেম অনির্বাণ রাখতে গিয়ে তাকেও বউ করে ঘরে আনলে। যেমন দারুণ স্পর্শকাতর ঢাকঢাক গুড়গুড়’ পরিস্থিতিতে প্রিয়ার গর্ভে সন্তান ধারণ করা অবস্থায় গোপনে চটপট লজ্জা ঢাকার জন্য বিয়ে পড়িয়ে ফেলা হলেও তাকে নিয়ে সংসার বৈধ নয়। কারণ, বিবাহের পূর্বে বর-কনেকে ‘কোর্টশীপ বা হৃদয়ের আদান-প্রদানের কোন সুযোগ ইসলাম দেয়নি। আর সেক্সী কোন টেস্ট-পরীক্ষা তো নয়ই। অবশ্য উভয়ের জন্য একে অপরকে কেবল দেখে নেওয়ার অনুমতি আছে। তাছাড়া মহিলার গর্ভাবস্থায় বিবাহ-বন্ধন শুদ্ধ হয় না। সন্তান-প্রসবের পরই বিবাহ সম্ভব; যদিও সন্তান ঐ প্রেমিকেরই, যার সহিত প্রেমিকার বিবাহ হচ্ছে। বর্তমান পরিবেশে বিবাহ ও তালাককে এক প্রকার খেলা’ মনে করা হলেও, আসলে তা কিন্তু ঐ ধরনের কোন খেলা’ নয়।
সুতরাং নিজের খেয়াল-খুশী অনুযায়ী প্রয়োগ করতে চাইলে আল্লাহর বিধানে তা বাতিল গণ্য হবে। জেনে রাখা ভালো যে, জোরপূর্বক কোন তরুণীকে বিবাহ করলে বিবাহ শুদ্ধ হয় না। যেমন কারো বিবাহিত স্ত্রীকে ভালোবেসে তুলে এনে তার সম্মতিক্রমে হলেও পূর্ব স্বামী তালাক না। দেওয়া পর্যন্ত এবং তার অভিভাবক সম্মতি না দেওয়া পর্যন্ত বিবাহ শুদ্ধ হয় না। তাকে নিয়ে সংসার করলে ব্যভিচার করা হয়। এ ছাড়া ভাইঝি, বোনঝি, সৎ মা, শাশুড়ী প্রভৃতি এগানা নারীর সাথে প্রেম ও ব্যভিচার করা সবচেয়ে বড় পশুত্ব! ১৬- কুলকুল-তান যৌবনের যুবক বন্ধু আমার! যদি কাউকে ভালো লেগেই যায়, তাহলে হালাল ও বিধেয় উপায়ে তাকে পাওয়ার চেষ্টা কর। আর ভেবো না যে, প্রেম করে বিয়ে বেশী সুখময়। বরং বিয়ে করলেই দায়িত্ববোধের সাথে প্রেমের চেতনা অধিক বাড়ে। এ পবিত্র প্রেমে কোন প্রকার ধোকা থাকে না, থাকে না কোন প্রকার অভিনয় ও কপটতা। যে নির্মল প্রেমে থাকে দায়িত্বশীলতা ও কর্তব্যপরায়ণতা। আর এ জন্যই সমাজ-বিজ্ঞানী নবী # বলেন, “প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য বিবাহের মত অন্য কিছু (বিকল্প) নেই।” (ইবনে মাজাহ, হাকেম, সহীহুল জামে ৫২০০ নং)
অতএব প্রেম প্রকাশ ও বৃদ্ধি করা জন্য, প্রেমের ডালি খালি করার জন্য, প্রেম অনির্বাণ রাখার জন্য, প্রেম-রোগ উপশম করার জন্য, পবিত্র বিবাহ-বন্ধনের মত আর অন্য কোন বিকল্প গত্যন্তর নেই। তাই আল্লাহর কাছে দুআ করে গোপনে তোমার মানুষটিকে চেয়ে নাও এবং তাঁর নিকট হারামকারিতা থেকে শতবার পানাহ চাও। আর উপযুক্ত লোক লাগিয়ে বৈধ উপায়ে তাকে তোমার জীবন-সঙ্গিনী করে নাও। যে রতি হয়ে তোমার মনে এসেছিল, তাকে সতী হয়ে তোমার ঘরে আসতে দাও। যে প্রিয়া হয়ে প্রেমে ছিল, সে বধু হয়ে তোমার অধরে আসুক। যে তোমার দ্রাক্ষা-বুকে শিরীন-শারাব’ হয়ে এতদিন গোপনে লুকিয়ে ছিল, সে এবার প্রকাশ্যে তোমার পেয়ালায় এসে যাক।
কিন্তু একান্তই তোমার আশা যদি দুরাশা হয়ে থাকে, তুমি যেমন পাওয়ার যোগ্য, তার চাইতে বড় যদি চাওয়া হয়ে থাকে, অথবা অন্য কোন কারণে যদি তুমি তোমার গোপন প্রিয়াকে তোমার জীবন-তরীতে না-ই পেয়ে থাক, তাহলে দুঃখ করো না। নিশ্চয়ই তাতে তোমার কোন মঙ্গল আছেই আছে, তাই তুমি তাকে পাওনি৷ অতএব এ ক্ষেত্রে তাকে মনে চাপা দেওয়ার জন্য খোজ করে তার চেয়ে বা তারই মত একজন (দ্বীনদার) সুন্দরীকে তোমার হৃদয়ের সিংহাসনে বসিয়ে ফেল। এটাই তোমার দ্বীন-দুনিয়ার জন্য উত্তম। এতে তোমার পূর্ব নেশা কেটে যাবে, মন স্থির হয়ে সংসার সুখের হবে এবং ফাটা ও কাটা মনে
প্রলেপ পড়বে। আর বিবাহ যদি একান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে অবৈধ প্রণয় ও যৌনপ্রবৃত্তিকে দমন করতে আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর। ইনশাআল্লাহ, তোমার মনের সকল অঅসা’ দুর হয়ে যাবে, কারণ, রোযা হল তাকওয়া ও আল্লাহ-ভীতির কারখানা।
নারী-পাগলা বন্ধু আমার! পুরুষের পক্ষে নারীর ফিতনার মত বড় ফিতনা আর অন্য কিছু নেই। মহানবী (সা.) বলেন, “আমার গত হওয়ার পরে পুরুষের পক্ষে নারীর চেয়ে অধিকতর ক্ষতিকর কোন ফিতনা অন্য কিছু ছেড়ে যাচ্ছি না।” (আহমাদ, বুখারী ৫০ ৯৬, মুসলিম ২৭৪০ নৎ, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ) নারী-ঘটিত ফিতনা অথবা নারীকে কেন্দ্র করে ঘটিত ফিতনার হার এ জগতে কম নয়। আর এই ফিতনায় পুরুষের ধন যায়, জ্ঞান হারায়, মান হারায়, দ্বীন হারায় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাণও হারায়। তাই তো মহানবী (সা.) পুরুষকে সাবধান করে বলেন, “অতএব তোমরা দুনিয়া ও নারীর ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন কর। আর জেনে রেখো যে, বনী ইসরাঈলের প্রথম ফিতনা যা ছিল, তা ছিল নারীকে কেন্দ্র করে।” (আহমাদ, মুসলিম ২৭৪২, তিরমিযী ২১৯১, ইবনে মাজাহ ৪০০০ নং)
শয়তানের যেমন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে, পুরুষের ব্যাপারে নারীরও বিভিন্ন কৌশল, চক্রান্ত ও ছলনা আছে। মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে উভয়ের চক্রান্তের কথা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু বিতাড়িত শয়তানের চক্রান্ত ও কৌশলের ব্যাপারে কুরআন বলেছে, “নিশ্চয় শয়তানের কৌশল দুর্বল।” (সূরা নিসা ৭৬ আয়াত) পক্ষান্তরে নারীর কৌশল ও ছলনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় তোমাদের ছলনা ভীষণ!” (সূরা ইউসুফ ২৮ আয়াত)
সুতরাং জ্ঞানী বন্ধু! সাবধান থেকো। শয়তান ও নারীর চক্রান্ত-জালে ফেঁসে গিয়ে নিজের দ্বীনদুনিয়া বরবাদ করে দিও না। কেউ যদি তোমার কাছে অযাচিতভাবে প্রেম নিবেদন করতে চায়, তবে সর্বপ্রকার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তার ছলনায় সাড়া দিও না। আর মনে রেখো যে, “আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না; (তারা হল,) ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ আযযা অজাল্লার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদ সমূহের সাথে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে।) সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালোবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালোবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়।
সেই ব্যক্তি যাকে কোন কুলকামিনী সুন্দরী (অবৈধ যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে) আহ্বান করে কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি। সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।” (বুখারী ৬৬০নং, মুসলিম ১০৩১নং) ছলনাময়ী নারীর চক্রান্তে যাতে না পড়, তার জন্য বাংলা প্রবাদেও সতর্কবাণী এসেছে, তা মনে রেখো, কখনো খেয়ো নাকো তালে আর ঘোলে, কখনো ভুলো নাকো ঢেমনের বোলে। ঠিকই তো বালির বাঁধ, শঠের প্রীতি, এ দুয়ের একই রীতি। আর তাছাড়া জলের রেখা, খলের পিরীত’ থাকেও না বেশীক্ষণ। এ ধরনের চক্রান্তময় প্রেমে থাকে এক প্রকার সুড়সুড়ি, এক ধরনের স্বার্থ। যা শেষ হলে সব শেষ। সুতরাং মনে রেখো বন্ধু আমার! ‘জল-জঙ্গলনারী, এ তিনে বিশ্বাস নাই, বড়ই মন্দকারী।
নারী শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও এবং অনেকে নারীকে সামান্য জ্ঞান করলেও আসলে মনের দিক দিয়ে নারী বিশাল। পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য হল নারীর মন। সুবিস্তৃত মেঘমালা এবং ক্ষিপ্রপামী বাতাসের গতিবেগ হয়তো নির্ণয় করা সহজ; কিন্তু নারীর মনের গতিবেগ নির্ণয় করা মোটেই সহজ নয়। তা মাপা বা অনুমান করা আদৌ আসান নয়। আর এ জন্যই অনেকে সরল মনে নারীর ছলনার গরল পান করে ধোকা খায়।
বুঝিনু না, ডাকিনীর ডাক এ যে,
এ যে মিথ্যা মায়া,
জল নহে, এ যে খল, এ যে ছল মরীচিকা-ছায়া।
অতএব বন্ধু আমার! এমন নারীর ছলনা থেকে বাঁচার জন্য, এমন নারীর ফিতনা থেকে দূরে থাকার জন্য তুমি হযরত ইউসুফ নবী (আঃ) এর মত দুআ কর,
رَبِّ السِّجْنُ أَحَبُّ إِلَيَّ مِمَّا يَدْعُونَنِي إِلَيْهِ ۖ وَإِلَّا تَصْرِفْ عَنِّي كَيْدَهُنَّ أَصْبُ إِلَيْهِنَّ وَأَكُن مِّنَ الْجَاهِلِينَ
অর্থাৎ, হে পরোয়ারদেগার! ওরা আমাকে যে বিষয়ের দিকে আহ্বান করছে, তা অপেক্ষা কারাগার আমার নিকট অধিক প্রিয়। তুমি যদি আমাকে ওদের ছলনা হতে রক্ষা না কর, তবে আমি ওদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ব এবং অজ্ঞ মানুষদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাব। (সূরা ইউসুফ ৩৩)।
মানুষের মন হল ফাকা ময়দানে পড়ে থাকা এক টুকরা হাল্কা পালকের মত। বাতাসের সামান্য দোলায় সে মন দুলতে থাকে, হিলতে থাকে, ছুটতে থাকে। মন হল পরিবর্তনশীল। সে মন থাকে আল্লাহর দুই আঙ্গুলের মাঝে। তিনি মানুষের মন ঘুরিয়ে ও ফিরিয়ে থাকেন। অতএব এ বলেও দুআ করো তার কাছে,
يَا مُقَلِّبَ الْقُلُوبِ ثَبِّتْ قَلْبِي عَلَى دِينِكَ
অর্থাৎ, হে মনের গতি পরিবর্তনকারী! আমার মনকে তোমার দ্বীনের উপর স্থির রাখ।
মনে মনে কাউকে ভালো লেগে যাওয়া, কাউকে ভালোবেসে ফেলা, কারো প্রতি প্রেম হয়ে যাওয়া কোন দোষের কিছু নয়। কারণ, এ হল মনের ব্যাপার। আর মন যদি পবিত্র ও নির্মল থাকে তবে পাপেরও ভয় থাকে না তখন।
পবিত্র প্রেম হল অন্তঃসলিলা ফগু নদীর মত, যা নিঃশব্দে ধীরে ধীরে হৃদয়ের অন্তরতম প্রদেশে লুকিয়ে বইতে থাকে, কিন্তু উদ্ধৃঙ্খল হতে পায় না। পবিত্র প্রেম সেই প্রেমকে বলে, যার মাঝে থাকে না কোন প্রকার পাপ-পঙ্কিলতা, থাকে না কপটতা ও কামচরিতার্থ করার লালসা ও বাসনা। পবিত্র প্রেম হল পবিত্র হৃদয়ের সেই ভালোবাসা ও আকর্ষণের নাম, যা হৃদয়ের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকে। (বিবাহের পূর্বেই) প্রেম হৃদয়ের বাইরে বের হয়ে এলেই অপবিত্র হয়ে যায়। দর্শন, আলাপন, পত্রালাপ, দুরালাপ, স্পর্শ প্রভৃতির আবর্জনা মিশেই প্রেম কলুষিত ও কলঙ্কিত হয়। পরন্তু বিবাহ এ সব থেকে পবিত্র করে প্রেমকে নির্মল করে দেয়। কিন্তু সমস্যা হল এই যে, লোকেরা স্ত্রীর সাথে হালাল প্রেমকে ‘প্রেম’ মনে করে না, ভাবে সেটা কোন বাপুত্তি অধিকার।
পক্ষান্তরে অপবিত্র ও অস্বাভাবিক প্রেমকেই লোকেরা ভালোবাসা’ নামে অভিহিত করে থাকে। প্রেম হয়ে যাওয়াটা মানুষের প্রকৃতিগত ব্যাপার এবং তা তার নির্মল ও সুকোমল হৃদয়েরই পরিচায়ক। কিন্তু প্রেম করাটা হল খারাপ। অর্থাৎ, প্রেমের অভিনয় করে কাউকে ধোকা। দেওয়া অথবা অবৈধভাবে প্রেমের বিভিন্ন মঞ্জিল অতিক্রম করা ভালো মানুষের কাজ নয়। যেমন ভালো নয় কারো প্রেমের জেলে বন্দী হয়ে পড়া, অতিরঞ্জিতভাবে প্রেমের পূজা করা। আসলে হৃদয়ের প্রেমকে যে নিয়ন্ত্রণে রেখে যথার্থরূপে বৈধভাবে যথাস্থানে প্রয়োগ করতে পারে, সেই হল জ্ঞানী মানুষ। যেমন ভালো নয় শুষ্ক হৃদয়, তেমনি উদ্ধৃঙ্খল মানসিকতাও ভালোর পরিচয় নয়।
পবিত্র প্রেমের সাথে কামনার কোন সম্পর্ক নেই। প্রেম ও কামনা হল সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। প্রেম হচ্ছে ধীর, প্রশান্ত ও চিরন্তন। আর কামনা হচ্ছে সাময়িক উত্তেজনা।
পবিত্র প্রেমের প্রেমিক বন্ধু আমার! প্রেমকে পবিত্র ও চিরন্তন রাখার জন্য বৈধ পথ ব্যবহার করে যাও। জেনে রেখো, কাউকে পছন্দ হওয়ার আগে, কোন কিছুকে পছন্দ করার পূর্বে, তোমার নিকট আল্লাহ ও তাঁর রসূলের পছন্দ অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। আর মহান আল্লাহ বলেন, “যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার পথ বের করে দেবেন এবং তাকে তার ধারণাতীত উৎস হতে রুযী দান করবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর নির্ভর করবে, তিনিই তার জন্য যথেষ্ট হবেন। আল্লাহ তার ইচ্ছা পূর্ণ করবেন। আল্লাহ সমস্ত কিছুর জন্য নির্দিষ্ট মাত্রা স্থির করে রেখেছেন।” (সূরা ত্বালাকৃ ২-৩ আয়াত) “যে আল্লাহকে ভয় করে, তিনি তার জন্য তার কাজকে সহজ করে দেন।” (ঐ ৪ আয়াত) অতএব এক আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভরসা রেখে তোমার পবিত্র প্রেমকে পবিত্র রেশমী রুমালের মত হৃদয়েই বেঁধে রেখো এবং পবিত্র অবস্থাতেই সেখান হতে খুলে নেওয়ার চেষ্টা।
করো। আর তার দরবার ছেড়ে প্রেমে সাফল্য লাভ করার জন্য কোন সৃষ্টির দরবারে গিয়ে আরো জঘন্য অপবিত্রতা শির্কে পড়ে যেও না। অর্থাৎ, তাকে পাওয়ার জন্য কোন তাবীয়ব্যবসায়ীর কাছে শিকী তাবীয নিতে খবরদার যেও না। যোগ-যাদু করে তাকে বশীভূত করার উদ্দেশ্যে কোন যাদুকরের প্রতি পা বাড়াও না, কোন দর্গা বা মাযারে গিয়ে প্রেম অনির্বাণ রাখার আবেদন জানিয়ে মানত মেনে বা ধুল-ফুল’ খেয়ে এস না। এ রকম করলে তুমি সব চাইতে বেশী অপবিত্র ও নীচ হয়ে যাবে।
পবিত্র প্রেমকে গোপনে অতিরঞ্জিত করে নিজেকে ধ্বংস করো না এবং এ কথা ভেবো না যে, “যে ব্যক্তি প্রেম করে এবং হারামে পতিত না হয়ে পবিত্র অবস্থায় মারা যায়, সে শহীদ।” এ। কথা লায়লা-মজনু ও শিল্পী-ফরহাদ’ জগতের বহু মানুষের নিকটেই প্রচলিত থাকলেও এবং অনেকে তা ‘হাদীস’ বলে জানলেও, আসলে তা কিন্তু প্রেমবাজদের দ্বীনের নবীর নামে মিথ্যা রচনা। (সিলসিলাহ যয়ীফাহ ৪০৯ নং)
তবে হ্যা, প্রেম হয়ে যাওয়ার পর যদি কেউ আল্লাহর ওয়াস্তে সবর করে এবং প্রেমিকার প্রতি দৃকপাত করে না ও তার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করে না। বরং আল্লাহর ভয়ে পবিত্রতা বজায় রাখে এবং তার নিকটবর্তী হওয়ারও চেষ্টা করে না। অথচ ইচ্ছা করলে সে এ সব কিছুই অনায়াসে করতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে তার মনের সকল আশা-আকাঙ্খকে গোপনে দমন করে রাখে এবং আল্লাহর প্রেম, ভয় ও সন্তুষ্টিকে এ সবের উপর অগ্রাধিকার দান করে, তাহলে সে আল্লাহ তাআলার এই প্রতিশ্রুতির আওতাভুক্ত হওয়ার আশা রাখতে পারে, যে প্রতিশ্রুতির কথা তিনি কুরআন মাজীদে বলেন, “যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় রাখে এবং খেয়াল-খুশী হতে মনকে বিরত রাখে, অবশ্যই জান্নাত হবে। তার আশ্রয়স্থল।” (সূরা নাযিআত ৪০-৪১ আয়াত) “আর যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের সামনে দন্ডায়মান হতে হবে -এই ভয় রাখে এবং সেই ভয়ে সকল পাপ-পঙ্কিলতা বর্জন করে) তার জন্য রয়েছে দু’টি বেহেশু।” (সূরা রাহমান ৪৬ আয়াত)
এ ছাড়া শহীদ’ হল আল্লাহর নিকট হতে প্রাপ্ত এক বিরাট মর্যাদা। সে মর্যাদা তার সন্তুষ্টির পথে নিজের জানকে কুরবানী দিলে তবেই লাভ হয়। নিজের কামনা-বাসনা ও মনের খেয়াল-খুশীর তাবেদারী করে একজন সুন্দরী লাভের পথে জীবন দিলে সে মর্যাদা অবশ্যই পাওয়া যায় না। তদনুরূপ বহু প্রেমবাজ ধৃষ্টরা এ কাজে আল্লাহর মনোনীত নবীদেরকেও শামিল করে নিজেদের দল ভারী করে ফেলেছে! আল্লাহর কুরআনকেও মিথ্যা বানিয়ে তারা গেয়েছে,
‘প্রেমের মড়া জলে ডোবে না
প্রেম করেছে ইউসুফ নবী,
তার প্রেমে জোলেখা বিবি গো---
এ বলে তারা তাদের কাজ যে খারাপ নয়, তা প্রমাণ করার মানসে সীমাহীন দৃষ্টতা প্রকাশ করেছে।
যেমন হযরত ঈসা (আঃ) এর সাধী মাতা মারয়্যামকেও তুলনা করা হয়েছে বারাঙ্গনার সাথে! কবি বলেন,
‘অহল্যা যদি মুক্তি লভে মা, মেরী হতে পারে দেবী,
তোমরাও কেন হবে না পূজ্যা বিমল সত্য সেবি?!
পাপী বানানো হয়েছে নির্বিচারে সকলকে। এ জন্য বলা হয়েছে,
এ পাপ-মুলুকে পাপ করেনিক কে আছে পুরুষ নারী,
আমরা তো ছার, পাপে পঙ্কিল পাপীদের কান্ডারী!
---আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে,
কম-বেশী করে পাপের ছুরীতে পুণ্যে করেছে জবেহ!’
অথচ এ কথা অন্যান্য ধর্মের দেবতাদের ক্ষেত্রে সত্য হলেও সত্যের কান্ডারী নবীগণের ক্ষেত্রে একেবারে মিথ্যা। সুতরাং কোন কিছু নিয়ে মন্তব্য করার পূর্বে বিবেচনা করে দেখা জরুরী যে, যাকে চাবুক লাগাচ্ছি, আদৌ সে চাবুক খাওয়ার যোগ্য কি না? শুধু নবীই নয়, বরং আল্লাহর ফিরিস্তাদেরকেও ছাড়া হয়নি এ ব্যাপারে! কবি বলেছেন,
--দু’দিনে আতশী (?) ফেরেস্তা প্রাণ ভিজিল মাটির রসে,
শফরী চোখের চটুল চাতুরী বুকে দাগ কেটে বসে।
ঘাঘরী ঝলকি’ গাগরী ছলকি’ নাগরী জোহরা যায়
স্বর্গের দূত মজিল সে রূপে, বিকাইল রাঙা পায়!
অধর আনার রসে ডুবে গেল দোজখের মার ভীতি,
মাটির সোরাহী মস্তানা হল আঙ্গুরি খুনে তিতি!
কোথা ভেসে গেল সংযম বাধ, বারণের বেড়া টুটে,
প্রাণ ভরে পিয়ে মাটির মদিরা ওষ্ঠ পুষ্প পুটে!!
এ ধরনের বহু মজার গল্প শুনিয়ে ঐ শ্রেণীর তথাকথিত মানবতাবাদী নৈতিকতার শত্রুরা নিজেদের পাপকে সুশোভিত করার জন্য বহু মানুষকে বিভ্রান্ত করে থাকে।
মহান আল্লাহ বলেন, “যে বিষয়ে তোমার জ্ঞান নেই, সেই বিষয়ে তুমি অনুমান দ্বারা পরিচালিত হয়ো না। নিশ্চয় কর্ণ, চক্ষু ও হৃদয় -ওদের প্রত্যেকটিকে (কাল কিয়ামতে) কৈফিয়ত দিতে হবে।” (সূরা ইসরা ৩৬ আয়াত)
বিবাহ-বন্ধনের পূর্বে মনের বন্ধন যথেষ্ট মনে করে নারী-পুরুষের অবৈধ সংসর্গ বা যৌনমিলন সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের এক বড় ব্যাধি। বিয়ে না করেই এ ধরনের যৌনক্রিয়া চরিত্রগত একটি জঘন্য অপরাধ। এ পথ ও আচরণ হল দুশ্চরিত্র, ভ্রষ্ট ও লম্পটদের। উভয়ের বিয়ে তো হবেই’ মনে করে কোন প্রকার স্পর্শ বা দেহ-মিলন বৈধ হতে পারে না। যতক্ষণ না আল্লাহর বিধান দ্বারা উভয়ের মাঝে বন্ধন প্রতিষ্ঠা হয়েছে, ততক্ষণ পর্যন্ত দেখাসাক্ষাৎও হারাম।
ব্যভিচার একটি কদর্য ও নোংরা আচরণ। ব্যভিচারে রয়েছে একাধিক বিঘ্ন ও বিপত্তি। ব্যভিচারে বংশ-পরিচয় হারিয়ে যায়, সম্ভ্রম নষ্ট হয়। ব্যভিচার-ঘটিত কারণে মানুষে-মানুষে শত্রুতা ছড়িয়ে পড়ে। এটি এমন অপরাধ, যে অন্যান্য আরো অপরাধ টেনে নিয়ে আসে। ব্যভিচার হল পশুর আচরণ। ব্যভিচারের ফলে নানান ব্যাধি ও মহামারী দেখা দেয় সমাজে। যার জন্য সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ মানুষকে সাবধান করে বলেন, “আর তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং নিকৃষ্ট আচরণ।” (সূরা ইসরা ৩২ আয়াত)
অপরাধ হিসাবে ব্যভিচার তুলনামূলকভাবে অধিকতর জঘন্য। ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল বলেন, হত্যার পর ব্যভিচারের চেয়ে বড় গোনাহর কাজ আর অন্য কিছুকে জানি না। বলা বাহুল্য এ কদাচার কোন মু'মিন নারী-পুরুষের হতে পারে না। মহান আল্লাহ নিজ বান্দার কিছু গুণ বর্ণনা করে বলেন, “এবং তারা আল্লাহর সাথে অন্য কোন উপাস্যকে আহ্বান (শির্ক) করে না, আল্লাহ যে প্রাণ-হত্যা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ব্যতীত তা হত্যা করে।
এবং ব্যভিচার করে না। যারা এ গুলো করে তারা শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন ওদের শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে ওরা হীন অবস্থায় স্থায়ী হবে।” (সূরা ফুরকান ৬৮-৬৯
মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করা হল যে, সবচেয়ে বড় পাপ কি? উত্তরে তিনি বললেন, “তোমার আল্লাহর সহিত কাউকে অংশী স্থাপন করা, অথচ তিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।” জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোন্ পাপ? তিনি বললেন, “তোমার সঙ্গে খাবে এই ভয়ে নিজ সন্তান হত্যা করা।” পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হল, তারপর কোন পাপ?' তিনি বললেন, “তোমার প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার করা।” (বুখারী ৪৭৬১, মুসলিম ৮৬ নং)
উক্ত আয়াত ও হাদীসে লক্ষণীয় যে, ব্যভিচারের পাপকে মানুষ খুন করার মত মহাপাপ। এবং শির্কের মত অতি মহাপাপের পাশাপাশি বর্ণনা করা হয়েছে। তাই এই জঘন্য কাজটি মুশরিকের জন্য শোভনীয়, কোন মুসলিমের জন্য নয়। আর এ জন্যই মহান আল্লাহ একটি বাস্তব পরিস্থিতি উল্লেখ করে বলেন, “ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক নারীকেই বিবাহ করে এবং ব্যভিচারিণীকে কেবল ব্যভিচারী অথবা মুশরিক পুরুষই বিবাহ করে। আর তা মু’মিনদের জন্য হারাম করা হয়েছে।” (সূরা নর ৩ আয়াত)।
মহান আল্লাহ তার মুমিন বান্দার গুণ বর্ণনা করে অন্যত্র বলেন, “মুমিন বান্দারা অবশ্যই সফলকাম। ---যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে সংযত রাখে। --- (অর্থাৎ, ব্যভিচার করে। ।) (সূরা মু'মিনুন ৫, সূরা মাআরিজ ২৯ আয়াত) মহানবী (সা.) বলেন, “মু’মিন থাকা অবস্থায় কোন ব্যভিচারী ব্যভিচার করে না।” (বুখারী, মুসলিম প্রমুখ) অর্থাৎ, এ অবস্থায় তার ঈমান তার হৃদয়ে অবস্থান করে না!
পক্ষান্তরে ব্যভিচার সে-ই করতে পারে, যার লজ্জা-শরম নেই। নির্লজ্জ নারী-পুরুষই এমন অবৈধ যৌন-মিলন ঘটাতে পারে। অথচ “লজ্জা হল ঈমানের একটি শাখা।” (মুসলিম, তিরমিযী প্রমুখ, সহীহুল জামে ৩১৯৭ নং) সুতরাং লজ্জা না থাকলে তথা নির্লজ্জ হয়ে ব্যভিচারের মত মহাপাপ করলে সে অবস্থায় মু’মিন থাকা যায় কি করে? ব্যভিচারী আল্লাহর কাছে দুআ করলেও তার দুআ কবুল হয় না। (সহীহুল জামে ২৯৭ ১নং)
ব্যভিচারী ইসলামী রাষ্ট্রে কঠিন শাস্তির উপযুক্ত। বিবাহিত নারী-পুরুষ ব্যভিচার করে থাকলে তাদেরকে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। অবশ্য ব্যভিচারী নারী-পুরুষ অবিবাহিত হলে তাদের শাস্তি হাল্কা। মহান আল্লাহ বলেন, “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী -ওদের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত কর; আল্লাহর বিধান কার্যকরী করতে ওদের প্রতি দয়া যেন তোমাদেরকে অভিভূত না করে যদি তোমরা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাসী হও। আর মু'মিনদের একটি দল যেন ওদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।” (সূরা নুর ২ আয়াত)
এ ছাড়া মহানবী (সা.) এর জবানী মতে উভয়কে বেত্রাঘাত সহ এক বছরের জন্য দেশ থেকে বহিষ্কার করার কথাও বলা হয়েছে।
সুতরাং উক্ত জঘন্যতম কাজ যে কেউ প্রেম ও ভালোবাসার মাধ্যমে করুক অথবা এমনিই করুক, ভদ্র করুক অথবা অভদ্র করুক, ধনী করুক অথবা গরীব করুক, প্রত্যেকের জন্য একই শাস্তি প্রযোজ্য এবং কারো ব্যাপারেই এ শাস্তি প্রয়োগে কোন প্রকার দয়া প্রকাশ করার অবকাশ নেই। কারণ, ব্যভিচারী হল সমাজের কলঙ্ক, কুলের কুলাঙ্গার, পবিত্র পরিবেশের ঘৃণ্য জীব। বিশেষ করে সেই নারী ও পুরুষ, যার স্বামী ও স্ত্রী থাকতেও অথবা যৌনক্ষুধা কিছু প্রশমিত হওয়া সত্ত্বেও ব্যভিচার করে, বেশ্যালয়ে যায় অথবা ফ্রেন্ড’ ব্যবহার করে, তারা এমন অপরাধী; যাদেরকে সমাজে বাঁচিয়ে রাখাই হল কলঙ্ক প্রতিপালিত করা, আর তা পবিত্র সমাজ ও পরিবেশের জন্য বড় অহিতকর।
পরন্তু কেউ যদি গোপনে এমন মহাপাপ করেও দুনিয়ার শাস্তি থেকে বেঁচে যায়, তাহলে সে যে রক্ষা পেল তা নয়। দুনিয়াতে তার শাস্তি প্রয়োগ না হলেও আখেরাতে মহাবিচারকের বিচারে সে মহাশাস্তি ভোগ করবে।
পাপ করে যাবে কোথায়? তোমার পাপের কথা তোমার অতন্দ্র-প্রহরী সঙ্গী ফিরিস্তা তোমার রোজনামচা আমলনামায় লিখে রাখছেন। একদিন এমন আসছে, যেদিন আল্লাহর নিকট ফিরে যেতে হবে। তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। মাটি সেদিন তার সকল খবর বলে দেবে। অণু পরিমাণ পাপ অথবা পুণ্য স্বচক্ষে দেখা যাবে।
মনে কর এক কক্ষে তুমি তোমার প্রিয়তমার সহিত অবৈধ দেহ-মিলনে বিভোল আছ। এমন সময় কক্ষের দরজা ঠেলে তোমার আব্বা, আম্মা, ভাই, বিশ্বস্ত বন্ধু অথবা কোন শত্রু তোমাকে ঐ অবস্থাতেই দেখে ফেলল। তখন তোমার অনুভূতি কি হবে? আর যদি তুমি এমনই চালাক হও যে, তোমার সে কাজ কেউই ধরতে ও বুঝতে পারে না, তাহলে “তুমি কখনো মনে করো না যে, অত্যাচারীরা যা করে, আল্লাহ সে বিষয়ে উদাসীন। অবশ্য তিনি ওদেরকে সেদিন পর্যন্ত ঢিল দেন, যেদিন চক্ষু স্থির হবে।” (সূরা ইবরাহীম ৪২ আয়াত)
সৃষ্টির নজর থেকে গোপনীয়তা অবলম্বন করলেও স্রষ্টার নজর থেকে তা কোন সময়ই পারবে না। ঘরের সকল দরজা বন্ধ করে পাপে লিপ্ত হলেও আল্লাহ ও তোমার মাঝে কোন দরজা বা পর্দার আড়াল আনতে পার না। রাতের গোপন গহীন অন্ধকারে সকলে ঘুমে ঢলে। পড়েছে, তুমি সে সময়কে প্রিয়ার সহিত মিলনের সুবর্ণ সুযোগ মনে করলেও, এ কথা ভুলে যেও না যে, একজন সদা জাগ্রত আছেন। যিনি সকল পর্দা ও অন্ধকারের আবরণ ভেদ করে তোমার প্রতি সুতীক্ষ দৃষ্টি রেখেছেন। সুতরাং পরকালের মহাশাস্তির জন্য প্রস্তুত থেকো।
মহানবী (সা.) বলেন, “অধিকাংশ যে অঙ্গ মানুষকে দোযখে নিয়ে যাবে, তা হল মুখ ও গুপ্তাঙ্গ।” (আহমাদ ২/২৯১, তিরমিযী ২০০৪, ইবনে মাজাহ ৪২৪৬, সিলসিলাহ সহীহাহ ৯৭৭ নং) তিনি স্বপ্নযোগে এক শ্রেণীর ব্যভিচারী নারী-পুরুষের আযাব দর্শন করেন; যারা উলঙ্গ অবস্থায় আগুনের চুল্লীতে আগুনের ক্ষিপ্ত প্রবাহে ওঠা-নামা করছে। (মুসলিম)
তিনি আরো দেখেন যে, এক সম্প্রদায় ফুলে-ফেঁপে ঢোল হয়ে আছে, তাদের নিকট হতে বিকট দুর্গন্ধ ছুটছে। মনে হচ্ছিল তাদের সে গন্ধ যেন পায়খানার ট্র্যাংকের মত। তারা ছিল ব্যভিচারী ও ব্যভিচারিনীর দল। (ইবনে খুযাইমাহ ১৯৮৬, ইবনে হিব্বান ৭৪৯ ১ নং, হাকেম ১/৪৩০)
ব্যভিচারে নায়ক-নায়িকার জন্য সাময়িক সুখ থাকলেও এর পরিণতি কিন্তু চরম ভয়ানক। পরকালের শাস্তি ছাড়াও ইহকালে রয়েছে তার অহিতকর বিভিন্ন কুফল।
আধুনিক যুগে ব্যভিচার ও জরায়ু-স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় উপহার হল এড়স। এড়স এমন। এক মহামারী, যার সঠিক ঔষধ ও চিকিৎসা-পদ্ধতি অদ্যাবধি আবিষ্কার হয়নি। যে রোগ নিয়ে বিশ্বের বড় বড় ডাক্তারদের সম্মিলন হচ্ছে, কিন্তু এর কোন প্রতিকার বা প্রতিরোধব্যবস্থা সার্বিকভাবে হয়ে উঠছে না।
এড়স এমন ভয়ানক ব্যাধি, যা ক্যান্সার অপেক্ষা অধিক বিপজ্জনক। যার শেষ পরিণাম হল, নানা ধরনের ব্যথা-বেদনার পর মৃত্যু। ক্যান্সারের মতই এডস শরীরের কোন নির্দিষ্ট স্থানে নির্ণয় করা সম্ভব হয় না। বরং সারা শরীরে ছড়িয়ে থাকে এ রোগের জীবাণু। ফলে নির্মূল করার মত কোন চিকিৎসার আশা বড় একটা অবশিষ্ট থাকে না। সুতরাং এমন ব্যাধিগ্রস্তের অধিকাংশ মানুষ মরণ-সাগরে গিয়ে মিলিত হয়।
জাতিসংঘের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ১৯৯৮ সালে এডস রোগের ফলে ২৩ লাখ। মানুষের মৃত্যু ঘটেছে! (মাজাল্লাতুল বায়ান ১৪০/৮৯)
বলাই বাহুল্য যে, এ রোগের প্রকোপ সেই উন্নত বিশ্বেই বেশী, যেখানে আছে প্রগতির রঙে চরম যৌন-স্বাধীনতা ও ব্যভিচারের ব্যাপক প্রচলন। যে সব দেশে কুমারী মা ও গর্ভিণীর সংখ্যা সীমাহীন এবং যে সব দেশের অভিধান থেকে ‘সতী ও সতীত্ব’ শব্দটুকুও মুছে ফেলা হয়েছে।
সত্য বলেছেন আল্লাহর নবী (সা.)। সত্য তাঁর নবুওয়াতের অহীলব্ধ ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলেছেন, “হে মুহাজিরদল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে (উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে)। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর। যখনই কোন জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারী ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল। না----” (বাইহাকী, ইবনে মাজাহ ৪০১৯নং, সহীহ তারগীব ৭৫৯নং) নবী ৯ বলেন, “যখনই কোন জাতি তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তখনই তাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যখনই কোন জাতির মাঝে অশ্লীলতা আত্মপ্রকাশ করে তখনই সে জাতির জন্য আল্লাহ মৃত্যুকে আধিপত্য প্রদান করেন। (তাদের মধ্যে মৃতের হার বেড়ে যায়।) আর যখনই কোন জাতি যাকাৎ-দানে বিরত হয় তখনই তাদের জন্য (আকাশের) বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়।” (হাকেম ২/১২৬, বাইহাকী ৩/ ৩৪৬ বাযযার ৩২৯৯ নং সিলসিলাহ সহীহাহ ১০ ৭নং)
অবৈধ যৌনাচারের ফলে প্রাদুর্ভূত বিভিন্ন পুরনো রোগ তো আছেই। গণােরিয়া, সিফিলিস, শুক্রক্ষরণ প্রভৃতি যৌনরোগ ব্যভিচারীদের মাঝেই আধিপত্য বিস্তার করে। গণােরিয়া বা প্রমেহ রোগে জননাঙ্গে ঘা ও জ্বালা সৃষ্টি হয় এবং সেখান হতে পুঁজ নিঃসরণ হয়। মূত্রনালী জ্বালা করে, সুড়সুড় করে। মূত্রত্যাগে কষ্ট হয়। পানির মত প্রস্রাবের পর হলুদ পুঁজযুক্ত পদার্থ বের হয়। সে সঙ্গে মাথা ধরা ও ঘোরা, জ্বর এবং নিমগ্রন্থি-স্ফীতি তো আছেই।
সিফিলিস বা উপদংশ রোগ শরীরে প্রবেশ করার পর সপ্তাহ মধ্যে লাল দাগ ও ফুস্কুড়ি প্রকাশ পায়। এরপর হতে শরীর অনবরত চুলকায় ও তার চারধারে প্রদাহযুক্ত পানি-ভরা ফোস্কা দেখা দেয় এবং ঐ সব ফুস্কুড়ি হতে পরে গলে ঘা হয় ও পুঁজ বের হয়। রোগ পুরনো হলে নখ খসে যায়, চুল ওঠে এবং সর্বাঙ্গে উদ্ভেদ প্রকাশ পায়।
আর শুক্রক্ষরণ রোগে তরল বীর্য যখন-তখন ঝরতে থাকে। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ধরে ও ঘোরে ইত্যাদি।
সুতরাং এমন সব রোগের কথা শুনে শঙ্কিত হওয়া উচিত ব্যভিচারীকে। ক্ষণস্থায়ী সে স্বাদে লাভ কি, যার পরে আছে দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী বিষাদ।
ব্যভিচার ব্যভিচারীর জন্য সাংসারিক ও পারিবারিক লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আত্মীয়স্বজনের সামনে হতে হয় অপমানিত। কারণ, ব্যভিচারী যতই সতর্কতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করুক না কেন, একদিন না একদিন তার সে পাপ-রহস্য মানুষের সমাজে প্রকাশ পেয়েই যায়। ফলে তার ব্যাপারে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে একটা এমন দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে, যার দরুন সে প্রায় সকলের কাছে নিন্দাহ্ ও ঘৃণার্থ হয়। সহজে কেউ তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অনেক সময় তার কারণে তার পুরো বংশ ও পরিবারেরই বদনাম হয়। শেষে পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, ভালো লোকেরা তাদের সহিত কোন সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অবশ্য কানা বেগুনের ডোগলা খদ্দের তো আছেই।
পক্ষান্তরে ব্যভিচারীর জীবনে লাঞ্ছনা যখন আসে, তখন তার হৃদয়ের জ্যোতি বিলীন হয়ে যায় এবং মন ভরে ওঠে অন্ধকারে। অপমানের পর এমনও হয়ে থাকে যে, শেষে সে একজন নির্লজ্জ ধৃষ্টতে পরিণত হয়ে যায়। সমাজে চলার পথে তার আর কোন প্রকার হায়া-শরম’ বলতে কিছু থাকে না। আর যার লজ্জা থাকে না, তার কিছু থাকে না। লজ্জাহীনের পূর্ণ ঈমানও থাকে না। যার ফলে মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়ে যায় এবং পশুর পশুত্ব এসে স্থান নেয় তার মনে ও আচরণে।
ব্যভিচারীর মনে সব সময় এক প্রকার ভয় থাকে। অন্তরে বাসা বাঁধে সার্বক্ষণিক লাঞ্ছনা। যেমন আল্লাহর আনুগত্যে থাকে সম্মান ও মনের প্রফুল্লতা। মহান আল্লাহ বলেন, “যারা মন্দ কাজ করে, তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে---।” (সূরা ইউনুস ২৭)
ব্যভিচারী সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। জারজ জন্ম নিলে তো আরো। এ ছাড়া ব্যভিচারের। ফলে তার সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদা যায়, স্ত্রী-কন্যার ব্যাপারে ঈর্ষা যায়। বরং ব্যভিচারী মিথ্যাবাদীও হয়, খেয়ানতকারী ও ধোকাবাজ হয়। সাধারণতঃ বন্ধুর বন্ধুত্বের মানও খেয়াল রাখে না। (রওযাতুল মুহিব্বীন দ্রঃ)
ব্যভিচারী দ্বীনী ইল্ম থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ইম হল আল্লাহর নুর। আর আল্লাহর নুর কোন পাপিষ্ঠকে দেওয়া হয় না, তথা পাপের কালিমা সে জ্যোতিকে নিষ্প্রভ করে ফেলে। ব্যভিচার এমন এক ফ্রি সার্ভিস’ চিত্তবিনোদনের সুন্দর উপায় যে, ব্যভিচারীকে বিবাহ করে ঘর-সংসার করতে বাধা দেয়। তাকে বিবাহে আগ্রহহীন ও নিস্পৃহ করে তোলে। বিনা খরচ ও পরম স্বাধীনতায় যদি কাম-চরিতার্থ করা সহজ হয় এবং স্বামীর কোন প্রকার দায়িত্ব ঘাড়ে না নিয়েই যদি মনের মত বউ’ পাওয়া যায়, তবে কে আর বিয়ে করবে? ব্রিটেনের প্রায়। ৯০ শতাংশ যুবক-যুবতী এই দায়-দায়িত্বহীন সম্পর্ককেই পছন্দ করে এবং বিবাহে জড়িয়ে পড়াকে বড় ঝামেলার কাজ মনে করে। (আল-ইফ্ফাহ ১৯ পৃঃ)।
ব্যভিচার স্বামী-স্ত্রীর সংসারে ফাটল ধরায়। কারণ, অন্যাসক্ত স্বামীর মন পড়ে থাকে অন্য যুবতীর প্রতি। অনুরূপ অন্যাসক্তা স্ত্রীর মন পড়ে থাকে কোন অন্য রসিক নাগরের যৌবনআসনে। আর এই উভয়ের মাঝে সন্দেহ বাসা বাঁধে। একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সন্দেহ হয় স্বামীর নিজের সন্তানের ব্যাপারেও। প্রতিবাদ ও কৈফিয়ত হলে কলহ বাধে। অতঃপর চলে মারধর। আর তারপরই তালাক অথবা খুন! ব্যভিচার পিতার পিতৃবোধ এবং মাতার মাতৃবোধ বিনষ্ট করে ফেলে। পিতৃ ও মাতৃবাৎসল্য সন্তানদের উপর থেকে উঠে যায়। যেমন অনেকের জানতে বা অজান্তে সমাজে পয়দা হয় হাজারো জারজ সন্তান।
ব্যভিচার সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনে। ধর্ষণের ভয়ে কিশোরী-যুবতীর নিরাপত্তা থাকে না। এমন কি নিরাপত্তা থাকে না কোন সুদর্শন কিশোরেরও! বাড়ির ভিতরে থেকেও মনের আতঙ্কে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পায় না তারা। অনেকে ঐ শ্রেণীর হিংস্র নেকড়ের পাল্লায় পড়ে জীবন পর্যন্তও হারিয়ে বসে। মানসিক বিপর্যয় ঘটিয়েই ব্যভিচার বহু সমাজ-বিরোধী অপরাধী সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে পিতা-মাতার স্নেহ ও মায়া-মমতা থেকে বঞ্চিত জারজ সন্তানরা মানসিক কঠোরতা ও সামাজিক ঘূণার মাঝে মানুষ হতে থাকে এবং পরিশেষে অপরাধ জগৎকেই মনের মত জগৎ বলে নিজের জন্য বেছে নয়।
ব্যভিচার চরিত্রহীনতার এক মহা অপরাধ। এ অপরাধ-রাজ্যে বাস করে মানুষ যে সব সময় আনন্দ পায় তা নয়। যেমন আল্লাহর আনুগত্য ও স্মরণে মন প্রশান্ত থাকে, তেমনি তার অবাধ্যাচরণ ও পাপ-পঙ্কিলতাময় জীবনে মন বিক্ষিপ্ত ও অশান্তিময় থাকে। আর মহান আল্লাহ বলেন, “তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ তা জেনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং ওর কর্ণ ও হৃদয় মোহর (সীল) করে দিয়েছেন। আর ওর চোখের উপর ফেলে দিয়েছেন পর্দা। অতএব আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত করার পর কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?” (সূরা জাসিয়াহ ২৩ আয়াত)
বলা বাহুল্য যে, প্রেম ও ব্যভিচারের মত ক্ষণিকের সুখ ও সম্ভােগের জগতে মন-পূজারী। বহু যুবক-যুবতী আপোসের মাঝে প্রেম ও মিলন কলহ নিয়ে কত শত মনের ধিক্কারে আত্মহত্যার শিকারে পরিণত হয়। ১৯৮৭ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, বৃটেনে প্রতি ২ ঘন্টায় একটি করে যুবক আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে থাকে! (আল-ইফ্ফাহ ২৫পৃঃ)
ব্যভিচার এমন এক অপরাধ যে, তার ফলে খুন হয় লাখো লাখো সদ্যপ্রসূত কচি-কাঁচা শিশু। নির্দয় পাষন্ড মা জন্মের পর তাকে ডাষ্টবিনে, নদীতে অথবা কোন ঝোপে-জঙ্গলে ফেলে আসে! লাখো লাখো সন্তানকে ভ্রুণ অবস্থায় পেটেই হত্যা করা হয়। কারণ, পিতামাতার উদ্দেশ্য ছিল, কেবল কামতৃষ্ণা নিবারণ করা, কোন অযাচিত সন্তান নেওয়া নয়।
ব্যভিচারের ফলে বংশে এমন এক সন্তান অনুপ্রবেশ করে, যে সে বংশের কেউ নয়। সে। মীরাস পায়, অথচ সে ওয়ারেস নয়। অনেক সময় এই সন্তান প্রকৃত ওয়ারেসীনকে বঞ্চিতও করে। পরিবারে অনেকের সে মাহরাম গণ্য হয়, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে গায়র মাহরাম ও বেগানা। আর এইভাবে একটি পাপের কারণে আরো বহু গুপ্ত ফাসাদ চলতে থাকে সংসারে। যে পাপের কথা কেবল মন জানে, যেমন আসল বাপের কথা কেবল মা জানে।
ব্যভিচার আল্লাহর গযব আনয়ন করে। সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।” (সূরা নুর ৬৩ আয়াত)
ব্যভিচার এক নিকৃষ্ট মহাপাপ। যে পাপের শাস্তি স্বরূপ অনুরূপ পাপ তার পরিবারে এসে যেতে পারে। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, “মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ।” (সূরা শুরা ৪০ আয়াত)
“যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং তাদেরকে লাঞ্ছনা আচ্ছন্ন করবে ---” (সূরা ইউনুস ২৭ আয়াত) সাধারণতঃ ব্যভিচারীদের স্ত্রী অথবা বোন অথবা কন্যাও ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে। কারণ, তারা তাদের ব্যাপারে ঈর্ষাহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া যে পরস্ত্রীকে অসতী করে বেড়ায়, তার স্ত্রীও অসতী হতে পারে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন, “দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য।” (সূরা নুর ২৬ আয়াত)।
অথচ কোন মানুষ, বরং স্বয়ং ব্যভিচারী ও লম্পটও চায় না যে, তার স্ত্রী ব্যভিচারিণী বা অসতী হোক।
নিজেদের নেই মনুষ্যত্ব, জানি না কেমনে তারা
নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব হায়রে শরম-হারা!
ব্যভিচারী হলেও সে কোন দিন চাইবে না যে, তার স্ত্রীও তারই মত ব্যভিচার করুক অথবা তার স্ত্রীকে কেউ ধর্ষণ করুক। স্ত্রী খুন হয়েছে শুনে মনে যতটা আঘাত লাগে, স্ত্রী ব্যভিচার। করেছে বা ধর্ষিতা হয়েছে শুনে মনে আঘাত লাগে তার থেকে অনেক গুণ বেশী। সা’দ বিন । উবাদাহ (রাঃ) বলেন, 'যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষকে দেখি, তাহলে তরবারি দ্বারা তার মাথা কেটে ফেলব।' এ কথা মহানবী # এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, “তোমরা কি সা’দের ঈর্ষায় আশ্চর্যবোধ করছ? আল্লাহর কসম! আমি ওর থেকেও বেশী ঈর্ষাবান এবং আল্লাহ আমার থেকেও বেশী ঈর্ষাবান। আর এ জন্যই তিনি গুপ্ত ও প্রকাশ্য সকল অশ্লীলতাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। (বুখারী ৭৪১৬ মুসলিম ১৪৯৯ নং)।
অনুরূপ কোন আত্মমর্যাদাবান পুরুষই চায় না যে, তার কোন নিকটাত্মীয় মহিলা ব্যভিচারিণী হোক। অতএব ব্যভিচারী কিরূপে অপরের নিকটাত্মীয় মহিলার সহিত সে কাজ পছন্দ করে?
একদা এক যুবক আল্লাহর রসূল (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, আপনি আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন!' তিনি বললেন, “তুমি কি তোমার মায়ের সাথে তা পছন্দ কর? তোমার বোন বা মেয়ের সাথে, তোমার ফুফু বা খালার সাথে তা পছন্দ কর?” যুবকটি প্রত্যেকের জন্য উত্তরে একই কথা বলল, না। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ হোক। (তাদের সঙ্গে আমি এ কাজ করতে চাই না।) তখন মহানবী (সা.) বললেন, “তাহলে লোকেরাও তো পছন্দ করে না যে, কেউ তাদের মা, মেয়ে, বোন, খালা বা ফুফুর সাথে ব্যভিচার করুক।” (আহমাদ ৫/২৫৬-২৫৭, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ ৩৭০ নং)
অতএব ব্যভিচারী যুবককে এ ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত। ব্যভিচার ও লাম্পট্য জগতের এ পাপ কিন্তু এক পর্যায়ের নয়। যেমন, ছোট ব্যভিচার হল, কাম নজরে দেখা চোখের ব্যভিচার। যৌন উত্তেজনামুলক কথা শোনা কানের ব্যভিচার এবং তা বলা জিভের ব্যভিচার। স্পর্শ করা হাতের এবং যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে চুলা পায়ের। ব্যভিচার। আর দুই যৌনাঙ্গের মিলনে হয় বড় ও আসল ব্যভিচার। (মিশকাত৮৬ নং) কোন অবিবাহিতা নারীর সহিত ব্যভিচার করার চাইতে বড় ব্যভিচার হল কোন বিবাহিতা নারীর সহিত ব্যভিচার। এর চাইতে বড় হল কোন আত্মীয় বা প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার। অতঃপর নিজের ভাইঝি-বোনঝি বা খালা-ফুফুর সাথে, অতঃপর নিজের বোনের সাথে, অতঃপর নিজের মেয়ের সাথে এবং সর্বোপরি বড় ব্যভিচার হল মায়ের সাথে ব্যভিচার। (নাউযু বিল্লাহি মিন যালিকা কুল্লিহ) অবশ্য একান্ত জানোয়ার ছাড়া নিজের নিকটাত্মীয় এগানা মহিলাদের সাথে কেউ একাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় না। আর এগানা মহিলা হল সেই সব মহিলা, যাদের সহিত কোন সময়ই বিবাহ বৈধ নয়।
পরিবেশে ব্যভিচার প্রসার লাভ করার বিভিন্ন কারণ রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান প্রধান কারণ নিম্নরূপঃ
১- যুবক-যুবতীর নির্জনতা অবলম্বন, একান্তে গমন-ভ্রমণ, কোন বাড়ি বা রুমে একাকী উভয়ের বসবাস, রিক্সা বা গাড়িতে চালকের সাথে একাকিনী যাতায়াত, দোকানে দোকানদারের কাছে একাকিনী মার্কেট করা, দর্জির কাছে একান্তে পোশাকের মাপ দেওয়া, ডাক্তারের সহিত নার্সের অথবা রোগিনীর একান্তে চিকিৎসা কাজ, প্রাইভেট টিউটরের কাছে একাকিনী পড়াশোনা করা ইত্যাদি। এগুলি ব্যভিচারের এক একটি সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ। মহানবী ৪৪ বলেন, “কোন মহিলার সাথে কোন পুরুষ যখন নির্জনতা অবলম্বন করে, তখন শয়তান তাদের তৃতীয় জন (কুটনা) হয়। (তিরমিযী, মিশকাত ৩১ ১৮নং) আর এই কারণেই মহিলার জন্য স্বামীর ভাই ইত্যাদি বেগানা আত্মীয়কে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে! (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩১০২নং)
২- অবাধ মিলামিশা। পর্দার সাথে হলেও পাশাপাশি নারী-পুরুষের অবস্থান ব্যভিচারের এক বিপজ্জনক ছিদ্রপথ। একই বাড়িতে চাচাতো প্রভৃতি ভাই-বোন, স্কুল-কলেজে ও চাকুরী-ক্ষেত্রে যুবক-যুবতীর অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ, অনুরূপ মার্কেটে, মেলা-খেলায়, বিয়েবাড়ি, মড়া-বাড়ি, হাসপাতাল প্রভৃতি জায়গায় নারী-পুরুষের বারবার সাক্ষাতের ফলে পরিচয় এবং প্রেম, আর তার পরই শুরু হয় ব্যভিচার।
আলী (রাঃ) বলেন, 'তোমাদের কি শরম নেই? তোমাদের কি ঈর্ষা নেই? তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে পর-পুরুষদের মাঝে যেতে ছেড়ে দাও এবং এরা ওদেরকে ও ওরা এদেরকে দেখাদেখি করে!' (হাকাযা তুদাম্মিরু জারীমাতুল জিনসিয়্যাতু আহলাহা ২২পৃঃ)
৩- বিবাহে বিলম্ব। সঠিক ও উপযুক্ত বয়সে বা প্রয়োজন-সময়ে বিয়ে না হলে যৌনক্ষুধা নিবারণের জন্য ব্যভিচার ঘটা স্বাভাবিক। অধ্যয়ন শেষ করার আশায় অথবা চাকুরী পাওয়ার অপেক্ষায় অথবা সামাজিক কোন বাধায় (বিধবা বিবাহ না হওয়ার ফলে ব্যভিচারের এক চোরা পথ খোলা যায়।
৪- অতিরিক্ত মোহর অথবা পণ ও যৌতুক-প্রথাও ব্যভিচারের একটি কারণ। কেন না, উভয় প্রথাই বিবাহের পথে বড় বাধা।
৫- মহিলাদের বেপর্দা চলন ও নগ্নতা। ব্যভিচার ও ধর্ষণের এটি একটি বড় কারণ। ছিলা কলাতে মাছি বসা স্বাভাবিক। ছিলা লেবু বা খোলা তেঁতুল দেখলে জিভে পানি আসা মানুষের প্রকৃতিগত ব্যাপার। অনুরূপ পর্দাহীনা, অর্ধনগ্না ও প্রায় পূর্ণ নগ্না যুবতী দেখলে যুবকের মনে। কাম উত্তেজিত হওয়াও স্বাভাবিক। আর এ জন্যই ইসলামে পর্দা-প্রথা মহিলার উপর ফরয করা হয়েছে। নারীকে তার সৌন্দর্য বেগানা পুরুষকে প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে। (সূরা নুর ৩১ আয়াত) আর মহানবী (সা.) বলেছেন যে, “নারী হল গোপনীয় জিনিস। তাই যখন সে (গোপনীয়তা থেকে) বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের চোখে শোভনীয়া ও লোভনীয়া করে তোলে।” (তিরমিযী, মিশকাত ৩ ১০৯ নং)।
৬- নোংরা ফিল্ম দেখা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা পড়া এবং গান শোনা। যৌবনের কামনায় যৌন-চেতনা বা উত্তেজনা বলে একটা জিনিস আছে। যার অর্থ এই যে, যৌন-কামনা ঘুমিয়ে থাকে বা তাকে সুপ্ত রাখা যায় এবং কখনো কখনো তা প্রশান্ত থাকে বা তাকে প্রশমিত রাখা। সম্ভব। বলা বাহুল্য নোংরা ফিল্ম, পত্র-পত্রিকা এবং গান হল এমন জিনিস, যা সুপ্ত যৌনকামনাকে জাগ্রত করে এবং প্রশান্ত যৌন-বাসনাকে উত্তেজিত করে। এ ছাড়া সলফগণ বলেন যে, 'গান হল ব্যভিচারের মন্ত্র।
৭- বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি ও সমাজে তাদের পেশাদারীর অনুমতি। তাদেরকে যৌনকর্মী বলে আখ্যায়িত করে তাদের বৃত্তিকে অর্থোপার্জনের এক পেশা বলে স্বীকার করে নেওয়া ব্যভিচার প্রসার লাভের অন্যতম কারণ।
৮- মদ ও মাদকদ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার। মদ, হিরোইন প্রভৃতির নেশায় নারীর নেশা ও চাহিদা সৃষ্টি হয় মাতাল মনে। ফলে এর কারণেও ব্যভিচার ব্যাপক হয়।
৯- আর সবচেয়ে বড় ও প্রধান কারণ হল, দ্বীন ও ঈমানের দুর্বলতা, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়। যার মাঝে ঈমান ও তাকওয়া নেই, সে ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারে না। এমন
ব্যক্তির মনের ডোর শয়তানের হাতে থাকে। অথবা নিজের খেয়াল-খুশী মত চালাতে থাকে। নিজের জীবন ও যৌবনকে।
বলা বাহুল্য, যুবক যদি উল্লেখিত ব্যভিচারের কারণসমূহ থেকে দুরে থাকতে পারে, তাহলে অবশ্যই সে ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারবে। পক্ষান্তরে উপরোক্ত কারণসমূহের কোন একটির কাছাকাছি গেলেই ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ে পড়বে। আর মহান আল্লাহর ঘোষণা হল, “তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কারণ তা হল অশ্লীল এবং নোংরা পথ।” (সূরা ইসরা ৩২ আয়াত)
ব্যভিচার ব্যাপক আকারে প্রসার লাভ করা এই কথার ইঙ্গিত যে, কিয়ামত অতি নিকটে আসছে। (বুখারী ৮১, মুসলিম ২৬৭ ১ নং) অতএব যত দিন যাবে, ব্যভিচার পৃথিবীময় তত আরো বৃদ্ধি পাবে। তবে ঈমানদাররা ঈমান নিয়ে অবশ্যই সর্বদা সে অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে। ব্যভিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে যৌথভাবে সামাজিক যে প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা হল নিম্নরূপঃ
(১) পর্দাহীনতা দূর করে, সমাজে পবিত্র পর্দা-আইন চালু করা। আর এ দায়িত্ব হল প্রত্যেক মুসলিমের, নারী ও পুরুষ, যুবক ও বৃদ্ধ, রাজা ও প্রজা সকলের। (২) ব্যভিচারের ‘হদ্দ’ দন্ডবিধি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চালু করা। এমন শাস্তি প্রয়োগ করা, যাতে কোন লম্পট তার লাম্পট্যে সুযোগ ও সাহস না পায়।
(৩) মহিলাকে কোন মাহরাম বা স্বামী ছাড়া একাকিনী বাড়ির বাইরে না ছাড়া।
(৪) কোন বেগানা (দেওর, বুনাই, নন্দাই, বন্ধু প্রভৃতি) পুরুষের সাথে নারীকে নির্জনতা অবলম্বন করার সুযোগ না দেওয়া। সে বেগানা পুরুষ ফিরিস্তাতুল্য হলেও তার সহিত মহিলাকে নির্জনবাস বা সফর করতে না দেওয়া।
(৫) সৎ-চরিত্র গঠন করার সামাজিক ভূমিকা পালন করা; অশ্লীল ছবি, পত্র-পত্রিকা, গানবাজনা, যাত্রা-থিয়েটার প্রভৃতি বন্ধ করা এবং রেডিও, টিভি ও পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমে সচ্চরিত্র গঠনের উপর তাকীদ প্রচার করা।
(৬) সর্বতোভাবে বিবাহের সকল উপায়-উপকরণ সহজ করা। সহজে বিবাহ হওয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তি দূর করা।
(৭) স্কুল-কলেজে সহশিক্ষা বন্ধ করে বালক ও বালিকাদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। অবিবাহিত তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীকে যৌন-শিক্ষা না দেওয়া। ৮- নারীর জন্য পৃথক চাকুরী-ক্ষেত্র তৈরী করা।
(৯) সকল প্রকার বেশ্যাবৃত্তি ও যৌনব্যবসা বন্ধ করা। কিন্তু বন্ধু! তুমি যদি কোন অমুসলিম রাষ্ট্রে বাস কর, তাহলে নোংরামির স্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে বাঁচানোর জন্য নিমের উপদেশমালা গ্রহণ করঃ
(১) তোমার পরিবার ও পরিবেশের মাঝে একটি স্বায়ত্তশাসনভুক্ত রাষ্ট্র গঠন কর এবং সেই রাষ্ট্রে যথাসম্ভব ইসলামী আইন চালু কর।
(২) অশ্লীলতার মোকাবিলা করার জন্য নিজের আত্মাকে ট্রেনিং দাও। আল্লাহ-ভীতি ও তাকওয়া’ মনের মাঝে সঞ্চিত রাখ। শয়তান ও খেয়াল-খুশীর দাসত্ব করা থেকে বহু ক্রোশ দুরে থাক। নাফসে আম্মারাহ’কে সর্বদা দমন করে রাখা মনে-প্রাণে আল্লাহর স্মরণ রাখ। মন প্রশান্ত থাকবে।
(৩) পরিপূর্ণ মুমিন হল সেই ব্যক্তি, যে তার চরিত্রে সবচেয়ে সুন্দর। অতএব তুমি তোমার চরিত্রকে সুন্দর ও পবিত্র কর।
(৪) নোংরা পরিবেশে ধৈর্যশীলতা অবলম্বন কর। ধৈর্যের ফল বড় মিঠা হয়। অতএব ধৈর্যের সাথে অশ্লীলতার মোকাবিলা কর। ৫- মন্দ পরিণামকে ভয় কর। দুনিয়া ও আখেরাতের লাঞ্চনা ও শাস্তির ভয় রাখা।
(৬) অশ্লীলতা ও ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারলে তাতে যে সওয়াব ও মর্যাদা লাভ হয়, তার লোভ ও আশা রাখ। কিয়ামতে ছায়াহীন মাঠে আরশের ছায়া লাভ এবং বেহেশ্যে হুরীদের সহিত ইচ্ছাসুখের সম্ভােগের কথা মনে রাখ।
(৭) মনে রেখো যে, তুমি যেমন চাও না, তোমার মা-বোন বা স্ত্রী ব্যভিচারিণী অথবা ধর্ষিতা হোক, তেমনি অন্য কেউই তা চায় না। অতএব সকলের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখা।
(৮) লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি অংশ ও শাখা। মু’মিন হিসাবে তুমি সে মহৎ গুণকে তোমার হৃদয় থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিও না। লজ্জাশীলতা তোমার মনের প্রতি অশ্লীলতার সকল ছিদ্রপথ বন্ধ করুক।
(৯) হিম্মত উঁচু রাখ। নিজের সচ্চরিত্রতা নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে কর। আর মনে রেখো যে, সচ্চরিত্র এক অমূল্য ধন; যা আর কারো না থাকলে তোমার আছে।
১০- সেই সকল অশ্লীল বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পড়া অবশ্যই ত্যাগ কর, যা পড়ে তোমার হৃদয়ে কামনার উদ্রেক হয়, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় দেহ-মনে। আর সেই সকল বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পড়, যাতে এ সব পাপ ও তার শাস্তির কথা আলোচিত হয়েছে, যাতে রয়েছে আল্লাহ-ভীতির কথা।
১১- ইসলাম ও তার শরীয়তকে তোমার জীবনের সকল ক্ষেত্রে জীবন-বিধান বলে জানো ও মানো। দেখবে, সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে ইসলামে।
১২- সম্ভব হলে সত্বর বিবাহ করে ফেল। কারণ, বিবাহই হল এ সমস্যার সবচেয়ে উত্তম সমাধান। বিবাহ হল অর্ধেক দ্বীন৷ বিবাহ হল শান্তির মলম। বিবাহিতকে আল্লাহ সাহায্য করে থাকেন। সুতরাং চাকুরী না হলেও, নিজের পায়ে না দাঁড়ালেও, পড়া শেষ না হলেও তুমি বিবাহ কর। তোমার জন্য আল্লাহর সাহায্য আছে। আর জেনে রেখো যে, ব্যভিচারে পড়ার ভয় থাকলে তোমার জন্য বিবাহ করা ফরয।
১৩- মনের খেয়াল-খুশী ও প্রবৃত্তির ডোর নিজের হাতে ধরে থেকো এবং শয়তানের হাতে ছেড়ে দিও না। তোমার মনকে পবিত্র রেখো। কারণ, “যে তার মনকে পবিত্র করবে, সে হবে সফলকাম এবং যে তা কলুষিত করবে, সেই হবে অসফল।” (সূরা শামস ৯-১০ আয়াত) অতএব দিল হ্যায় কে মানতা নেহী’ বলে মনের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলো না।
১৪- মনকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করার জন্য রোযা রাখ। এই রোযা তোমার যৌন-কামনাও দমন করবে।
১৫- ব্যভিচার থেকে বাঁচার জন্য চোখের ব্যভিচার থেকে দুরে থাক। আল্লাহর হারামকৃত বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করো না। হারামের সামনে নজর ঝুঁকিয়ে চল।
১৬- সকল প্রকার যৌন-চিন্তা মন থেকে তুলে ফেল। আর এর জন্য ইসলামী ক্যাসেট শোন, বই পড়। নেক বন্ধুর কাছে গিয়ে বস এবং আল্লাহ ও তাঁর রসুলের কথা আলোচনা কর। একা থাকলে কুরআন ও তার অর্থ পড়।
১৭- যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সকল উপায় ও উপকরণ থেকে দুরে থাক। ভাবী ও চাচাতো-খালাতো-মামাতো-ফুফাতো বোনরা বেপর্দা হলে তাদেরকে নিজের বোনের মত দেখো। বন্ধুর বউ বেপর্দা হলে তার সাথে বন্ধুত্ব বর্জন করে। প্রয়োজন ছাড়া বেড়াবার । উদ্দেশ্যে এমন স্থানে (হাটে-বাজারে) বেড়াতে যেও না, যেখানে নেংটা মহিলা নজরে আসে। টিভি-সিনেমা, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার দেখা বন্ধ করা ব্যভিচারের মন্ত্র গান শোনা বর্জন কর। স্কুল-কলেজে সহপাঠিনী থেকে দূরে থাক এবং ধৈর্যের সাথে দৃষ্টি সংযত রাখ।
১৮- সংশীল বন্ধু গ্রহণ কর এবং এমন বন্ধুর সংসর্গ ত্যাগ কর, যে যৌন ও নারীর কথা আলোচনা করে মজা নেয় ও আসর জমায়।
১৯- নির্জনতা ত্যাগ কর। বেকারত্ব দুর কর। কোন একটা কাজ ধরে নাও এবং সে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাক।
২০- যদি তুমি এমন দেশে থাক, যে দেশে ব্যভিচার কোন পাপ বা অপরাধ নয় অথবা এমন জায়গায় চাকুরী কর, যেখানে মহিলা সহকর্মীরা অযাচিতভাবে তোমার গায়ে পড়তে আসে, তাহলে সম্ভব হলে তুমি সে দেশ, পরিবেশ ও চাকুরী ত্যাগ করে বিকল্প ব্যবস্থা নাও। অর্থের জন্য নিজের চরিত্র ও ঈমান হারায়ো না। বাকী আল্লাহ তোমার সহায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে বিনিময়ে তার চেয়ে উত্তম জিনিস দান করেন।
২১- তওবা ও ইস্তিগফার করতে থাক। নারীর ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। আল্লাহ তোমাকে নোংরামি থেকে রক্ষা করবেন।
“অবশ্যই যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদেরকে শয়তান কুমন্ত্রণা দেওয়ার সাথে সাথে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা-শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। (তারা হয় আত্মসচেতন মানুষ।) (সূরা আরাফ ২০১ আয়াত)।
যৌবনের জ্বালা মিটাবার জন্য এক শ্রেণীর যুবক তারই মত একজন যুবক অথবা কিশোরকে ব্যবহার করে থাকে, যেমন যুবতী করে থাকে তারই মত কোন যুবতী অথবা কিশোরীকে ব্যবহার! এ কাজও বড় অশ্লীল এবং রুচিবিরুদ্ধ নোংরা। যৌবনের উন্মাদনায় অথবা নিছক খেয়াল-খুশী ও কুপ্রবৃত্তির বশবর্তী হয়ে নীচরা এমন নীচতা অবলম্বন করে থাকে। অথচ তা হল ব্যভিচারের মত একটি কাবীরা গোনাহ।
এই পাপের জন্য হযরত লুত (আঃ) এর সম্প্রদায়কে চার প্রকার আযাব ও শাস্তি দিয়ে ধংস করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রথমতঃ তাদেরকে কানা করে দেওয়া হয়েছিল। (সূরা ক্বামার ৩৭ আয়াত)
দ্বিতীয়তঃ তাদের মাঝে ভীষণ এক শব্দ প্রেরণ করা হয়েছিল। (সূরা হিজর ৭৩ আয়াত)
তৃতীয়তঃ তাদের গ্রাম-শহরকে উল্টে দিয়ে উধৃভাগকে নিয়ে করে দেওয়া হয়েছিল।
চতুর্থতঃ তাদের উপর ক্রমাগত কাকর-পাথর বর্ষণ করে তাদেরকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছিল। “যার প্রতিটি তোমার প্রতিপালকের নিকট চিহ্নিত ছিল। আর তা সীমালংঘনকারীদের থেকে দুরেও নয়।” (সূরা হুদ ৮২-৮৩ আয়াত)
আল্লাহ তাআলা উক্ত নোংরা জাতিকে ফাসেক ও সীমালংঘনকারী বলে অভিহিত করেছেন। তিনি নবী লুত (আঃ) এর উক্তি উল্লেখ করে বলেন, “তোমরা সারা জাহানের মানুষের মধ্যে কেবল পুরুষদের সাথে যৌন-মিলন কর এবং তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের জন্য যে স্ত্রীগণকে সৃষ্টি করেছেন- তা বর্জন কর? বরং তোমরা হলে সীমালংঘনকারী সম্প্রদায়।” (সূরা শুআরা ১৬৫-১৬৬ আয়াত) তিনি আরো বলেন, “লুতকে আমি প্রজ্ঞা ও জ্ঞান দান করেছিলাম এবং তাকে এমন এক জনপদ থেকে উদ্ধার করেছিলাম, যার অধিবাসীরা অশ্লীল কাজে লিপ্ত ছিল। ওরা ছিল মন্দ ও ফাসেক সম্প্রদায়।” (সূরা আম্বিয়া ৭৪ আয়াত)
আর মহানবী (সা.) বলেন, “সে ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে ব্যক্তি লুত (আঃ) এর সম্প্রদায়ের মত সমকাম করে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৫৮৯১ নং) তিনি আরো বলেন, “তোমরা যে ব্যক্তিকে লুত নবীর উম্মতের মত সমকামে লিপ্ত পাবে সে ব্যক্তি ও তার সহকর্মীকে হত্যা করে ফেলো।” (আহমদ, আবু দাউদ ৪৪৬২, তিরমিযী, ইবনে মাজাহ ২৫৬১, বাইহাকীর শুআবুল ঈমান, সহীহুল জামে ৬৫৮৯নং)।
তিনি আরো বলেন, “আল্লাহ আয্যা অজাল্ল (কিয়ামতের দিন) সেই ব্যক্তির দিকে চেয়েও দেখবেন না, যে ব্যক্তি কোন পুরুষের মলদ্বারে অথবা কোন স্ত্রীর পায়খানা-দ্বারে সঙ্গম করে।” (তিরমিযী, ইবনে হিব্বান, নাসাঈ, সহীহুল জামে ৭৮০ ১নং)
পায়ু-মৈথুন বা সমকামগ্রস্ত যুবক এমন নিকৃষ্ট ও বিকৃত-চরিত্রের যে, সে হালাল যৌনমিলনে তৃপ্তি পায় না, হারাম ছাড়া তার আশা মিটে না, নোংরামি না করে তার মনে শান্তি আসে না, স্বস্তি আসে না। এই জন্য এর অভ্যাসী বিয়ের পরেও স্ত্রীর পায়ুমৈথুন ছাড়া সাধারণ সহবাসে ততটা তৃপ্তি পায় না। অথচ স্ত্রীর পায়ুমৈথুন হল এক প্রকার কুফরী কাজ।
বাস্তবপক্ষে এমন অতৃপ্তিবোধ হল তার জন্য এক প্রকার শাস্তি। এ ছাড়া এডস প্রভৃতি যৌনরোগ তো আছেই। সুতরাং জ্ঞানী যুবককে সতর্ক হওয়া উচিত, যাতে সে অনুরূপ কোন হতভাগ্যদের দলভুক্ত হয়ে পড়ে।
এক শ্রেণীর নীচমনা মানুষ আছে, যাদের পশুবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে উন্মাদনায় ফেটে পড়ে কাম-চরিতার্থ করার জন্য কোন এক প্রকার পশু ব্যবহার করে থাকে। পশুর মত মনে পশু নিয়েই যৌনতৃপ্তি উপভোগ করে এমন পশু-মার্কা যুবকরা!!
মহানবী (সা.) বলেন, “সে ব্যক্তি অভিশপ্ত, যে ব্যক্তি পশুর সাথে যৌন-মিলন করে।” (আহমাদ, সহীহুল জামে ৫৮৯১নং) তিনি আরো বলেন, “যে ব্যক্তিকে কোন পশু-সঙ্গমে লিপ্ত পাবে সে ব্যক্তি ও সে পশুকে তোমরা হত্যা করে ফেলবে।” (তিরমিযী, হাকেম, সহীহুল জামে’ ৬৫৮৮নং)
উল্লেখ্য যে, যৌন-ক্ষুধা উপশমের জন্য পুতুল বা অন্য কোন জড়-বস্তুর মাধ্যমে যৌন-মিলন ঘটিয়ে বীর্যপাত করাও অশ্লীলতার পর্যায়ভুক্ত। যে সকল অশ্লীলতা থেকে মুসলিম যুবককে পবিত্র থাকা একান্ত জরুরী।
মিলনের স্বাদ উপভোগ করার জন্য কোন উপযুক্ত উপকরণ না পাওয়া গেলে অথবা তা ব্যবহার করার সুযোগ না থাকলে, দুধের সাধ ঘোলে মিটাবার উদ্দেশ্যে প্রায় অধিকাংশ যুবক। নিজের হাতকেই কৃত্রিম বিবি বানিয়ে থাকে। আর এ কাজ যেহেতু নিজের দেহ ও দেহাঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, সেহেতু অনেকেই তা খারাপ বা অশ্লীল ভাবে না, বিধায় হালাল বা বৈধ মনে করে।
পক্ষান্তরে এ কাজও এক প্রকার নৈতিকতা ও রুচি-বিরুদ্ধ গুপ্ত অশ্লীল কাজ; যা ইসলামে অবৈধ। কোন মুসলিম নিজের বিবাহিতা স্ত্রী এবং অধিকারভুক্ত (ক্রীত বা কাফের যুদ্ধবন্দিনী) দাসী ছাড়া অন্য কারো বা কিছুর মাধ্যমে কাম-তৃষ্ণা নিবারণ করতে পারে না। মহান আল্লাহ বলেন, “বিশ্বাসীরা অবশ্যই সফলকাম হবে---- যারা নিজেদের যৌন-অঙ্গকে সংযত রাখে। তবে নিজেদের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণের ক্ষেত্রে অন্যথা কামনা করলে তারা নিন্দনীয় হবে না। আর কেউ এদের ব্যতীত অন্যকে কামনা করলে, তারাই হবে সীমালংঘনকারী।” (সূরা মু'মিনুন ৫-৭, সূরা মাআরিজ ২৯-৩১ আয়াত)
সুতরাং সকল প্রকার যৌনক্রিয়া স্ত্রীর মাঝে সীমাবদ্ধ। স্ত্রী না থাকলে তা হারাম ও অবৈধ। সে ক্ষেত্রে আল্লাহর নির্দেশ পালন করা মুসলিম যুবকের জন্য অবধার্য। তিনি বলেন, “যাদের বিবাহের সামর্থ্য নেই, আল্লাহ তাদেরকে নিজ অনুগ্রহে অভাবমুক্ত না করা পর্যন্ত তারা যেন সংযম অবলম্বন করে।” (সূরা নুর ৩৩ আয়াত)।
আর মহানবী (সা.) বিবাহে অসমর্থ যুবকদলকে রোযা রাখার মাধ্যমে সংযম অবলম্বন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। (বুখারী, মুসলিম) পরন্তু হস্তমৈথুন বৈধ হলে নিশ্চয় তার কোন ইঙ্গিত তিনি দিয়ে যেতেন।
‘হ্যান্ড-প্র্যাক্টিস্ বা হাত দ্বারা বীর্যপাত করা এক প্রকার নেশা ও কুঅভ্যাস, যা সত্বর ত্যাগ করে নিজের কাম-শক্তিকে নিয়ন্ত্রিত না করতে পারলে ঐ ক্ষণিকের সুখের বদলায় অপেক্ষা করছে বিরাট লাঞ্ছনা ও স্বাস্থ্যহানির ধংসকারিতা।
যৌবন যুবকের এক অমূল্য সম্পদ। এ সম্পদের অপচয় ঘটালে, অপচয়কারী অবশ্যই একদিন পস্তাবে। উঠতি যৌবনেই যৌন-স্বাদের অপূর্ব তৃপ্তির কথা আবিষ্কৃত হওয়ার সাথে সাথেই যদি তার অপব্যবহার করে, তবে নিশ্চয় সে তার জীবনে অকাল-বার্ধক্য ডেকে আনবে। হাতের কাছে পেয়ে কোন জিনিসই যাচ্ছেতাই করে খেয়ে শেষ করা জ্ঞানীর কাজ নয়। রয়ে-বসে ধৈর্যের সাথে যথাসময়ে খেলে, তবেই তার প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়।
সুতরাং যুবকের উচিত নয়, নিজের হাতে অমুল্য যৌবনকে ধ্বংস করা। এমনিতেই ধনজন-যৌবন জোয়ারের পানি, আজ আছে কাল নেই, জানে সব জ্ঞানী। তার উপর কৃত্রিম মৈথুনের মাধ্যমে বীর্যক্ষয় করে যৌবন ফুরিয়ে যাওয়ার বহু পূর্বেই তা হারিয়ে ফেলা নির্বোধদের কাজ। আজ এসব কথায় হয়তো কেউ কর্ণপাত না করলেও কাল অবশ্যই বুঝতে পারবে, যখন বিবাহের পর বাসর রাতেই ফুলশয্যায় সুসজ্জিতা সুরভিতা দিলরুবা স্ত্রীর পাশে মাথায় হাত রেখে বসে পস্তাতে হবে! যখন ধ্বজভঙ্গ হয়ে পুরুষাঙ্গ শিথিল থাকলে অথবা সঞ্চালন মাত্র দ্রুতপতন ঘটলে ঐ অতিরিক্ত যৌন-পাগলামির জন্য বারবার আক্ষেপ করবে। কিন্তু তখন কি আর আক্ষেপ কাজে দেবে? সময়ে সোনা চেন নাই, খুঁটে বাধ নাই। তখন ‘সোনা ফেলে আঁচলে গিড়ে দিয়ে লাভ কি? হাত দ্বারা কৃত কৃত্রিম মৈথুনের ফলে পুরুষাঙ্গের কোষবৃদ্ধি (হাইড্রোসিল) রোগ হয়। শুক্রক্ষরণ রোগেরও সূত্রপাত হয় এই অতিরিক্ত হস্ত-সঙ্গমের ফলে। এতে বীর্য পাতলা হয়ে যায়। ফলে স্ত্রী-সহবাসের সময় দ্রুত বীর্যস্খলন ঘটে যায়।
হস্তমৈথুনের ফলে কোষ্টবদ্ধতা রোগ সৃষ্টি হয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়, অল্প কথায় রাগ ধরে বেশী, ধৈর্যশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে, স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দেয়, দেহ-মন থেকে স্ফুর্তি চলে যায়, মন দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়, শারীরিক দুর্বলতা প্রকাশ পায়, সুন্দর স্বাস্থ্য ধ্বংস হয়ে যায়, দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়, পিঠ কুঁজিয়ে যায়, পিঠে এক প্রকার ব্যথা অনুভূত হয়। হস্তমৈথুনের ফলে স্মৃতিশক্তি হ্রাস পায়, পড়াশোনায় প্রচন্ড প্রভাব ফেলে এই গুপ্ত যৌনাচার। হস্তমৈথুনের ফলে খাদ্য হজমে গোলযোগ দেখা দেয়। কর্তব্যে ক্রটি প্রকাশ পায়, আল্লাহর ইবাদতে ঔদাস্য সৃষ্টি হয়, রোযা নষ্ট হয়ে যায়।
হস্তমৈথুনের ফলে মনের কাছে সব সময় নিজেকে একজন অপরাধী বলে অনুভূত হলে লোক-সমাজেও তার আচরণে সে ভাব ফুটে ওঠে। সর্বদা নির্জনে থাকতে ইচ্ছা হয়।
অনেক সময় এ কু-অভ্যাসের প্রভাব অভ্যাসীর চেহারায় পরিস্ফুট হয়। বলা বাহুল্য, এমন কুপ্রবৃত্তির কাছে পরাজয় স্বীকার করা এবং অতিশয় কামাসক্ত হয়ে পড়া মানুষের বিশেষ করে কোন মুসলিমের উচিত নয়। যথাসম্ভব এমন উত্তেজনা ও কুঅভ্যাসকে দমন করা অবশ্যকর্তব্য। মন্দ-প্রবণ মন ও শয়তানের বিরুদ্ধে জিহাদ করা এবং তাতে জয়লাভ করা মু'মিনের কর্তব্য।
দুর্বল মনের বন্ধু আমার! এমন কু-অভ্যাসের ফাদ থেকে রক্ষা পেতে নিমোক্ত উপদেশমালার অনুসরণ করঃ
১- হস্তমৈথুনে অভ্যাসী যুবক ঈমান ও দ্বীনদারী তথা আল্লাহ-ভীতির ব্যাপারে বড় দুর্বল হয়। তাই তো সে মনের খাহেশ ও চাহিদার কাছে পরাজয় স্বীকার করে। অথচ তার উচিত, ঈমান সবল ও তাজা করা, আল্লাহর ভয় মনে-প্রাণে সর্বদা জীবিত রাখা। এমন হলে নিশ্চয় সে কু-অভ্যাসের দাসত্ব থেকে মুক্তি পেতে পারে।
২- এ কাজ তুমি যদি অভ্যাসগতভাবে করে থাক, তাহলে এমনও হতে পারে যে, বিবাহের পর স্ত্রী-মিলনে কোন তৃপ্তি পাবে না। বরং তার চাইতে ঐ কুকাজে তৃপ্তি পাবে অধিক। তখন দুইভাবে বীর্যক্ষয় হবে এবং যার ফলে তুমি নিজের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। যখন সামান্য যৌন-চিন্তায় অভ্যাসগতভাবে যখন-তখন বীর্য নষ্ট করবে এবং ক্ষণিকের তৃপ্তি লাভের আশায় নিজের হাতে নিজের যৌবন-মধুকে গেলে সত্বর নষ্ট করে ফেলবে। সুতরাং কুঅভ্যাসের আঁধার কারাগার থেকে মুক্তি পেতে তোমার দরকার হল দৃঢ়-সংকল্পের। সুদৃঢ় মনোবল এবং যথােচিত ধৈর্য ছাড়া এমন দলদল থেকে বের হওয়ার কোন অন্য উপায় নেই। অতএব মনকে শক্ত কর এবং কাম অনুভূতির সময় ধৈর্য ধর।
৩- এমন গুপ্ত অভ্যাসের একটি কারণ হল চোখের দর্শন-তৃপ্তি উপভোগ। যে জিনিস। দেখলে যৌন-উত্তেজনা আসে বা বাড়ে, সে জিনিস দেখার ফলে লৈঙ্গিক ভোগের নেশা মাথায় চড়ে বসে। অতএব তুমি কোন বেপর্দা নারীর দিকে সকাম দৃকপাত করো না। অর্ধনগ্ন নারীর প্রতি দৃষ্টি তুলো না। সিনেমা, ভিডিও বা টিভিতেও ফিল্ম দেখা অবশ্যই বন্ধ কর। নোংরা পত্র-পত্রিকায় নগ্ন ও অর্ধনগ্ন রূপসীদের, হিরোইন ও মডেল কন্যাদের ছবি দেখা ত্যাগ কর। নচেৎ কুঁয়োতে বিড়াল রেখে বালতি-বালতি পানি তুলে ফেললেও পানি পাক হবে না। আর তুমিও তোমার ঐ কু-অভ্যাস ছাড়তে পারবে না।
৪- এমন স্থানে বেড়াতে বা অপ্রয়োজনে যেও না, যেখানে অধিকাধিক মহিলা নজরে পড়ে। অতএব মেলা-খেলা, সৌখিন বাজার, পার্ক ও সমুদ্র-সৈকতে বেড়াতে যাবে না। নচেৎ এ অভ্যাস তোমার জন্য ছাড়া দায় হবে।
৫- নারী অথবা যৌবন নিয়ে সর্বপ্রকার কুচিন্তাকে তোমার মন থেকে সমুলে তুলে ফেল।
৬- আর এর পরিবর্তে তুমি তোমার সুচিন্তাকে যত্নের সাথে মনে স্থান দাও মন এমন এক চলন্ত আটা-চাকির মত যে, তা সব সময় ঘুরে কিছু না কিছু পিষতেই থাকে। যে চাকিতে গম দিলে গম পিষে এবং ইট-পাথর দিলে, তাও পিষে। ভালো-মন্দ যাই হোক, মনের চাকিতে কোন না কোন রকমের চিন্তা পিষাই হতেই থাকে। আর এ চাকির কোন বিরতি নেই। অতএব মনকে চিন্তাশূন্য করা অসম্ভব। তাই তাকে পিষার জন্য সুচিন্তা দিতে হবে। আর শয়তান কুচিন্তার ইট-পাথর পিষার জন্য নিয়ে এলেও তোমাকে সজাগ থেকে তোমার আটাচাকি থেকে তাকে অর্ধচন্দ্র দিয়ে বিদায় করতে হবে। অতঃপর কোন ভালো জিনিস নিয়ে গবেষণা করতে হবে।
৭- মনকে ব্যস্ত রাখার জন্য কোন এক ব্যস্ততাময় কাজ বেছে নাও। কিছু একটা কর। একটা বই পড়। অর্থসহ কুরআন পড়। কুরআন অথবা ইসলামী বক্তৃতার ক্যাসেট শোনা কোন একটা বৈধ খেলা খেল। পরের উপকার কর। ইত্যাদি।
৮- গান শোনা অবশ্যই ত্যাগ কর। গান হল ব্যভিচারের মন্ত্র। অতএব তা তোমাকে ঐ কাজে আরো উদ্বুদ্ধ করবে। মনকে ‘ফ্রি’ করতে গিয়ে আরো ‘জ্যাম’ হয়ে যাবে।
৯- নোংরা পত্র-পত্রিকা, প্রেম-কাহিনীমূলক উপন্যাস, রতিশাস্ত্র খবরদার পড়ো না। ঐ সকল পত্রিকা বা বই-পুস্তকে কিছু ভাষাজ্ঞান বা অন্যান্য সাধারণ জ্ঞান থাকলেও তা হল জুয়া ও মদের মত। যার ব্যাপারে মহান আল্লাহ বলেন, “বল, উভয়ের মাঝে মহাপাপ এবং মানুষের জন্য উপকারও আছে। কিন্তু উভয়ের পাপ উপকার অপেক্ষা অধিক।” (সূরা বংহ্বারাহ ২ ১৯
পক্ষান্তরে উল্লেখিত জ্ঞান অর্জন করার জন্য উপযুক্ত পত্র-পত্রিকা ও বই-পুস্তক ভূরিভূরি বিদ্যমান। তা বেছে নিয়ে পড়া।
১০- একাকী থেকো না। বিশেষ করে পুর্বে কোন যৌন-উত্তেজক কিছু নজরে পড়ে থাকলে নির্জনে বসো না। কারণ, শয়তান তোমাকে সেই দেখা জিনিস বারবার মনে করিয়ে দিবে। সুতরাং নেক বন্ধু বা দ্বীনী ভাই-এর নিকটে গিয়ে বসে একাকীত্ব দুর কর এবং সম্ভব হলে রাত্রেও তারই নিকট কবর, পরকাল, মুসলিমদের বর্তমান দুরবস্থা প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করতে করতে ঘুমিয়ে যাও।
১১- হ্যা, তবে একাকীত্ব দূর করতে কোন খারাপ বন্ধুর কাছে বসো না বা রাত্রি যাপন করো । নচেৎ সে বন্ধু তোমার ব্রণ গেলে বিষ-ফেঁড়াতে পরিণত করে দেবে।
১২- সম্ভব হলে সত্বর বিবাহ করে মনের মত সঙ্গিনী নিয়ে এসে জীবন ও যৌবন ঠান্ডা করে ফেল। তখন হালাল উপায়ে যৌনসুখ প্রাণ ভরে লুটতে কোন বাধা থাকবে না।
১৩- বিবাহ করার সামর্থ্য না থাকলে অথবা বিবাহে কোন প্রতিবন্ধকতা থাকলে পূর্ণ সমর্থ হওয়া পর্যন্ত তোমার যৌবনের গুপ্ত জ্বালাকে প্রশমিত করার জন্য আল্লাহর ওয়াস্তে রোযা পালন কর।
১৪- যে খাদ্য গ্রহণ করলে শরীরে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় বা শরীরকে গরম করে, সে খাদ্য বর্জন করে বেছে বেছে ঠান্ডা খাদ্য গ্রহণ কর।
১৫- প্রত্যহ স্বাভাবিক ঠান্ডা পানিতে গোসল কর। শরীরকে ঠান্ডা রাখতে চেষ্টা কর। হ্যা, আর কোন বধু-সরোবরে গোসল করতে যেও না।
১৬- রাত্রে শোবার সময় ওযু করে শোও। ডান কাতে শুয়ে বিভিন্ন দুআ পাঠ কর। যতক্ষণ ঘুম এসেছে ততক্ষণ কুরআন মুখস্থ পড়তে থাক। স্কুল-কলেজে বা মাদ্রাসায় পড়লে মনে মনে পাঠ্যালোচনা কর। আর কোন সময় উবুড় হয়ে শুয়ো না। এতে যৌন-উত্তেজনা বাড়ে। তাছাড়া “এমন ঢঙের শয়নকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।” (আহমাদ ২/২৮৭, হাকেম ৪/২৭ ১, সহীহুল জামে ২২৭০ নং)
১৭- এ কুকাজ ও পাপ থেকে বাঁচার জন্য আল্লাহর কাছে দুআ কর। যুবক বন্ধু! এ কাজ এমন যে, তা একবার করে তৃপ্তি পায় না কামুকরা। উত্তেজনা কমলেও তা সাময়িকভাবে কমে। পরক্ষণেই অভ্যাসের নেশা আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। সুতরাং ব্যভিচার বা সমকামের ভয় থাকলে এ কাজ করা বৈধ বলে যে ফতোয়া পড়ে বা শুনে থাক, তা গ্রহণ করে ধোকা খেও না। নচেৎ অভ্যাস ধরে গেলে অপ্রয়োজনে করেও দ্বীন ও দুনিয়া বরবাদ করে বসবে।
হ্যাঁ, আর এই সর্বনাশী অভ্যাস থেকে বাঁচার জন্য খবরদার নযর অথবা কসম ব্যবহার করো না। কারণ, তা কিছু দিনের জন্য ফলদায়ক হলেও, হয়তো এমন সময় আসবে যখন কাম-উত্তেজনায় ফেটে পড়ে ন্যর ও কসমের কথা ভুলে বসবে অথবা হাল্কা মনে করবে। আর তাতে ক্ষতি হবে দ্বিগুণ। ন্যর বা কসম ভাঙ্গা যাবে এবং কাফফারা তো লাগবেই। পক্ষান্তরে সবল মনের ভিতর দৃঢ় সংকল্প থাকলে, সেটাই হল সবচাইতে বড় ওষুধ। এ ছাড়া কাম-উত্তেজনা রোধ বা হ্রাস করার জন্য কোন ড্রাগ (ভেষজ পদার্থ) ব্যবহার করো । কেন না, এতে হিতে বিপরীত হয়ে যৌনক্ষমতাই চিরদিনের জন্য ক্ষীণ হয়ে যেতেও পারে। অতএব ধৈর্যের হাতুড়ি দিয়ে কাম’-এর মাথায় ঘা মেরে তা দমিত রাখ। এ ছাড়া বিবাহ না হওয়া পর্যন্ত আর অন্য কোন উপায় নেই।
স্থলনের দিক থেকে মানুষের দেহে বীর্য হল পেশাবের মত; যা প্রয়োজন মত তৈরী হয় এবং সময় মত বের হয়ে যায়। বীর্য মানবদেহে একটি অমূল্য বস্তু। কিন্তু তা দেহের ভিতরেই থেকে গেলে ক্ষতিকর। তাই কুদরতের নিয়ম হল, অবিবাহিত যুবকেরও বীর্য স্বাভাবিক ও প্রকৃতিগতভাবে দেহ থেকে যথা সময়ে নির্গত হয়ে যায়। বিশেষ করে স্বপ্নের মাধ্যমে যৌনউত্তেজনামুলক কিছু দেখলে বা করলে বীর্যপাত হয়। আর তাকেই বলে স্বপ্নদোষ। যদিও তা দূষনীয় নয়, যদি তা বেশী আকারে না হয়। দোষের হয় তখনি, যখন মাসে ৪ থেকে ৫ বারের অধিক হতে থাকে। আর তখনই প্রয়োজন হয় চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক প্রতিব্যবস্থার। অতএব স্বাভাবিকভাবে স্বপ্নদোষ হওয়াতে যুবকের ঘাবড়াবার কিছু নেই। এতে কোন ক্ষতি আছে, এমন ধারণা করে চিন্তিত হওয়ারও কোন কারণ নেই। বীর্য বেশী হলে তা তরল হয়ে। স্থলন হবে এটাই প্রকৃতির নিয়ম। অতএব স্বপ্নদোষে বীর্যক্ষয় হয়ে সে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, এমন দুশ্চিন্তা মনে এনে নিজেকে দুর্বল করা ঠিক নয়। অবশ্য অতিরিক্ত মাত্রায় হলে চিন্তার কারণ বটে।
তোমার স্বপ্নদোষ যদি বেশী হয়ে থাকে, তাহলে নিম্নলিখিত উপদেশমালা গ্রহণ কর; ইনশাআল্লাহ তা কম হয়ে যাবেঃ
১- যৌন-উত্তেজনামূলক কিছু দেখা, শোনা ও পড়া থেকে দুরে থাক।
২- মন থেকে সকল যৌন ও বিবাহ-চিন্তা দূর করে দাও। আর তার জন্য ব্যস্ততাময় কাজ খুঁজে নাও, দ্বীন ও আখেরাতমূলক বক্তৃতা শুনে, আলোচনা করে অথবা পড়ে অবসর সময়কে কাজে লাগাও।
৩- নির্জন বা একাকী বাস ও কুসংসর্গ ত্যাগ কর। পরহেজগার বন্ধুর সাথে সময় কাটাও।
৪- গুরুপাক ও উত্তেজক খাদ্য গ্রহণ করো না। বিশেষ করে রাত্রে এমন খাদ্য অবশ্যই খাবে না।
৫- নিয়মিত ঠান্ডা পানিতে গোসল কর।
মনে রাখবে যে, সিনেমা, ভিডিও, টিভি বা নোংরা পত্র-পত্রিকায় নারীর অর্ধনগ্ন দেহের ছবি অথবা মেলা-খেলা ও হাটে-বাজারে বেপর্দা মহিলা দেখে তা মানসপট থেকে দূর করতে না পারলে তুমি রাত্রে স্বপ্নদোষ থেকে বাঁচতে পারবে না। কারণ, বুঝতেই তো পারছ, উঠতি বয়সের তরঙ্গায়িত এমন যৌবন-জ্বালাকে দমন করতে প্রয়োজন হল পরহেযগারীর। আল্লাহ-ভীতির শীতল পানি দিয়ে সে আগুন যদি না নিভাতে পার, তাহলে স্বাস্থ্যহানি অবধার্য।
হ্যাঁ, আর স্বপ্নদোষের জ্বালাতন থেকে বাঁচতে গিয়ে কোন প্রকার শির্কে পতিত হয়ো না। যেমন, কোন প্রকার তাবীয বা অষ্টধাতুর মাদুলী ইত্যাদি হাতে বা কোমরে বেঁধে স্বপ্নদোষ বন্ধ করার বেকার অপচেষ্টা করো না। এতে লাভ তো হবে না। উল্টে ডবল ক্ষতি; পয়সাও যাবে এবং শির্কও হবে। তবে শয়নের বিভিন্ন শরয়ী আদব পালন করে স্বপ্নদোষ বন্ধ করতে পার। অতএব শোবার সময় আগে ওযু করে নেবে। অতঃপর ডান কাতে শুবে। উবুড় হয়ে শুবে না। ঘুমাবার পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে।
সূরা ইখলাস, ফালাক ও নাস পড়ে দুই হাতে ফুক দিয়ে সমস্ত শরীরে বুলিয়ে নেবে এবং এরূপ ৩ বার করবে। যতক্ষণ না ঘুম এসেছে ততক্ষণ দুআ, কুরআন অথবা মুখস্থ পাঠ পড়তে থাকবে। আর ভুলেও এ সময়ে যৌন বা বিবাহের চিন্তা মনেও আনবে না। খারাপ স্বপ্ন দেখে জেগে উঠলে বাম দিকে তিনবার থুথু মার, শয়তানের অনিষ্ট থেকে আল্লাহর নিকট পানাহ চাও এবং পার্শ্ব পরিবর্তন করে শোও।
আর তোমার জানা আছে যে, বীর্যপাত হলে গোসল ফরয। অবশ্য খারাপ স্বপ্ন দেখলে এবং জেগে উঠে কাপড় ভিজে না দেখলে গোসল ফরয নয়। তবে কাপড় ভিজে দেখলে এবং স্বপ্ন মনে না থাকলেও গোসল ফরয। রাত্রে হলে ফজরের আগেই গোসল সেরে জামাআতে ফজরের নামায পড়বে। আর জেনে রেখো যে, আল্লাহর ফরয আদায়ে লজ্জা করা হারাম।
উত্তেজনার পর পুরুষাঙ্গে পাতলা আঠালো পানি দেখা দিলে তা ধুয়ে কেবল ওযু যথেষ্ট। তাতে গোসল ফরয হয় না। আর সব সময়ের জন্য ধাতু ঝরার রোগ থাকলে প্রত্যেক নামাযের জন্য (কাপড় বদলে) ওযু জরুরী।
যুবক বন্ধু! যৌবনের যৌন-জ্বালার অন্ধকারে বিভ্রান্ত না হয়ে ধৈর্য ধর। অতঃপর যথাসময়ে একটি মনের মত সঙ্গিনী খুঁজে বিবাহ করে নাও। যত তাড়াতাড়ি বিবাহ করবে, তত তাড়াতাড়ি তোমার মন ও জীবন আলোকিত হবে। তারপর নিয়মিত যৌন-মিলন কর, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হবে। মনের সকল দুশ্চিন্তা দূরীভূত হবে। এমন নৈতিকতাপূর্ণ জীবনে তুমি অবশ্যই বেহেস্তের ছায়া পাবে।
যুব-সমাজের চরিত্রহীনতা ও ভ্রষ্টতার অন্যতম কারণ হল বিবাহ-সমস্যা। বিবাহের বয়স হওয়া সত্ত্বেও বিবাহ না হলে, চাহিদা থাকা সত্ত্বেও বিবাহ না করলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ পেতে বাধ্য। প্রত্যেক জিনিসের নির্দিষ্ট সীমা আছে; ধৈর্যেরও একটা সীমা আছে। সে সীমা অতিক্রান্ত হলে বিপদ অনিবার্য। পক্ষান্তরে বিবাহে আছে জীবনের পবিত্রতা ও সচ্চরিত্রতা। বিবাহে আছে চরিত্রহীনতার বিভ্রান্তি-জাল থেকে মুক্তির উপায়। আর এ জন্যই সমাজবিজ্ঞানী নবী ও যুব-সমাজকে নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে যুবকের দল! তোমাদের মধ্যে যার সঙ্গম ও ভরণপোষণ করার ক্ষমতা রয়েছে, সে যেন বিবাহ করে নেয়। কারণ, বিবাহ অধিকরূপে দৃষ্টিকে (হারাম থেকে) সংযত করে এবং লজ্জাস্থানকে অধিকরূপে (হারাম। থেকে রক্ষা করে। আর যার এ সামর্থ্য নেই, সে যেন রোযা পালন করে। কারণ, তা হল যৌন উত্তেজনা দমনকারী। (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত ৩০৮০ নং)
মহানবী (সা.) বলেন, “বান্দা যখন বিবাহ করে তখন সে তার অর্ধেক দ্বীন পূর্ণ করে নেয়। অতএব তাকে তার অবশিষ্ট অর্ধেক দ্বীনের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করা উচিত।” (বাইহাকীর শুল ঈমান সহীহুল জামে’ ৪৩০ নং) বলা বাহুল্য, যুবক যথাসময়ে বিবাহ করলে তার দ্বারা অপকর্ম ঘটার আশঙ্কা থাকে না। হালাল পেয়ে হারামের পথে পা বাড়ায় না। জীবন-সঙ্গিনী পেয়ে তার চক্ষু শীতল হয়। ফলে। অবৈধ সৌন্দর্যের প্রতি আর দৃকপাত করে না। আল্লাহ তার ঐ দাম্পত্যে তাকে স্থিরচিত্ত করে দেন। বিবাহে রয়েছে জ্বালাময়তার স্থলে মানসিক শান্তি এবং চিত্তচাঞ্চল্যের স্থলে হৃদয়ের স্থিরতা। সৃষ্টিকর্তা নারীকে পুরুষের জন্য শান্তিদায়িনীরূপে সৃষ্টি করেছেন। তিনি বলেন, “তার নিদর্শনাবলীর মধ্যে আর একটি নিদর্শন এই যে, তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য হতেই তোমাদের সঙ্গিনীদেরকে সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা ওদের নিকট শান্তি পাও এবং তোমাদের মাঝে পারস্পরিক বন্ধুত্ব ও স্নেহ সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা রূম ২১ আয়াত)
অতএব আল্লাহর চিরন্তন এ বিধানের কাছে কোন সমস্যাকে সমস্যা মনে করা উচিত নয়। প্রথম যৌবনে বিবাহ করলে অধ্যয়ন ও বিদ্যার্জনের পথে বাধা পড়ে –এ কথা যুক্তিযুক্ত নয়। বরং এর বিপরীতটাই সঠিক। যেহেতু বিবাহের পর যৌনক্ষুধা নিবৃত্ত হলে, চক্ষুদ্বয় শীতল হলে, মানসিক শান্তি ও প্রবোধ লাভ হলে তো তাতে শিক্ষার্থী শিক্ষায় অধিক সহায়তা পাবে। কারণ, মস্তিষ্ক যখন প্রশান্ত থাকবে, কুচিন্তা থেকে মন যখন পরিষ্কার থাকবে, তখন তো অতি সহজভাবে পাঠ উপলব্ধ হবে, কঠিন পড়া অনায়াসে বুঝে আসবে এবং অধ্যয়নে অধিক। অভিনিবেশ করা সম্ভবপর হবে। বৈষয়িক কোন কাজকর্মে মনে ব্যাকুলতা সৃষ্টি হলে স্ত্রী তা দুরীকরণে সহায়িকা হবে, শোকে-দুঃখে সান্ত্বনা দান করবে এবং অধিক উত্তমরূপে অধ্যয়নরত হওয়ার ব্যাপারে স্বামীকে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করবে।
‘পুরুষে এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,
কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বারিবাহ।
দিবসে দিয়াছে শক্তি-সাহস, নিশীথে হয়েছে বধু,
পুরুষ এসেছে মরুতৃষা লয়ে -নারী যোগায়েছে মধু।
তবে দুর্ভাগ্যক্রমে যদি স্ত্রী তেমন না হয়, অথবা স্বামীর মনে যদি অঞ্চল-প্রভাব পড়ে, অথবা উভয়ের মধ্যে কেউ যদি ইন্দ্রিয়পরায়ণ হয়, তবে নিশ্চয় সে আশা করা যায় না। এমন যুবক সত্যই যে দুর্বল, তাতে সন্দেহ নেই। আর আল্লাহর নিকট দুর্বল অপেক্ষা সবল মু’মিনই অধিকতর পছন্দনীয়া যুবকের মনে স্বামীত্ব ও কর্তব্য-জ্ঞান না জন্মালে পদস্থলনের আশঙ্কাই বেশী থাকে। স্ত্রী ও সংসারের ভারসাম্য রক্ষা করে পড়াশোনা করা কোন কর্তব্যপরায়ণ ও উন্নয়নাভিলাষী যুবকের নিকট কঠিন নয়।
চরিত্রহীন দেশে চরিত্রহীনরা ইচ্ছামত অবৈধ প্রেম করে তারই জোয়ার-ভাটার মাঝে দোটানায় পড়েও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। অথচ তুমি বৈধভাবে একজন পবিত্রা নারীকে ভালোবেসে তার নির্মল প্রেম-নিঝরে নিমজ্জিত থেকে তা পারবে না কেন? অবশ্য সংসারের দায়িত্ব ও বোঝা এসে যাওয়ার যদি ভয় কর, তাহলে ভেবে দেখ, পাপের ভয় তদপেক্ষা অধিক কি না? ‘চাকরী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ে করব না, বাড়ি না করে বিয়ে করব না, নিজের পায়ে না দাড়িয়ে বিয়ে করব না, বিয়ে করলে খাওয়াব কি? ইত্যাদি ওজরও খোড়া ওজর। ভেবে দেখ, তুমি কি খাও? তাছাড়া তুমি যে পজিশনের ঠিক সেই পজিশনের মেয়ে বিয়ে কর।
পরন্তু রুযীর ভার আল্লাহর উপর ছেড়ে দাও তদবীর করে যাওয়া তোমার কাজ, রযী দান করা। তার কাজ। আর বিশেষ করে বিবাহ মঙ্গল বয়ে আনে। কারণ, তা হল আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য। এ আনুগত্যে আছে তোমার বহু সমস্যার সমাধানের পথ। মহান আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা অবিবাহিত (নরনারী), তাদের বিবাহ সম্পাদন কর এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ -তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ তো প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সূরা নুর ৩২ আয়াত)।
আর মহানবী (সা.) বলেন, “তিন ব্যক্তিকে সাহায্য করা আল্লাহর দায়িত্ব; আল্লাহর রাস্তায় জিহাদকারী মুজাহিদ, সেই ক্রীতদাস যে নিজেকে স্বাধীন করার জন্য তার প্রভুকে কিস্তিতে নির্দিষ্ট অর্থ দেওয়ার চুক্তি লিখে সেই অর্থ আদায় করার ইচ্ছা করে এবং সেই বিবাহকারী যে বিবাহের মাধ্যমে (অবৈধ যৌনাচার হতে) নিজের চরিত্রের পবিত্রতা কামনা করে।” (আহমদ, তিরমিযী, নাসাঈ, বাইহাকী, হাকেম, সহীহুল জামে ৩০৫০ নং)।
বিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল পিতামাতার অসম্মতি যুবকের বিবাহ-সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উপর ভরসা আছে, রযীর যথেষ্ট ব্যবস্থা আছে এবং তার সঙ্গিনীর একান্ত প্রয়োজন আছে, তা সত্ত্বেও কোন স্বার্থবশে অভিভাবক বিবাহ দিতে রাজী নয়। অথবা মন মত পণ না পাওয়ার ফলে বিবাহে দেরী করে। অথবা ছেলের বিয়ে দিলে সংসারের কাজ ঠিক মত দেখবে
অথবা সংসার থেকে পৃথক হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চায় না। এ সব ক্ষেত্রে অভিভাবকের উচিত, আল্লাহকে ভয় করা এবং ছেলের নৈতিকতা ও সৎ পথে প্রতিবন্ধক তথা তার পাপকাজের কারণ না হয়ে বসা। আর জেনে রাখা উচিত যে, তাদের এ বাধার ফলে ছেলে যদি পাপ করে বসে, তাহলে ঐ পাপের জন্য তারাও পাপী হবে এবং আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাছাড়া বিবাহ-কার্যে এইভাবে বাধ সাধলে সমাজ, পরিবেশ ও পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে। ফাসাদ ও চরিত্রহীনতা ছড়িয়ে পড়বে।
সমাজ-বিজ্ঞানী নবী (সা.) বলেন, “যে ব্যক্তির দ্বীন ও চরিত্রে তোমরা সন্তুষ্ট, সে ব্যক্তি তোমাদের কাছে বিবাহের পয়গাম দিলে, তার বিবাহ দাও। এমন না করলে পৃথিবীর বুকে ফিতনা ও ব্যাপক ফাসাদ ছড়িয়ে পড়বে।” (তিরমিযী, মিশকাত ৩০৯০ নং) কিন্তু যুবকের সকল সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এবং পছন্দ মত দ্বীনদার পাত্রী পাওয়া সত্ত্বেও যদি অভিভাবক বিবাহে খামাখা বাধা দেয় এবং সে বিবাহ না করলে ব্যভিচার বা অন্য পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ার সত্যই আশঙ্কা করে, তাহলে সে ক্ষেত্রে অভিভাবকের মনমত চলা বৈধ নয়। এমন সংকট মহর্তে আল্লাহর উপর ভরসা করে বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে বিবাহ করে ফেলা একান্ত জরুরী।
পরন্তু তোমার মন যদি খোদ লোভাতুর হয় এবং মোহর দিয়ে বিয়ে করার বদলে মোটা টাকা নিয়ে বিয়ে করার পরিকল্পনা থাকে, অথবা কোন এমন ঘরের খোজে থাক, যেখানে ফারাযী অংশ বেশী পাবে বলে নিশ্চয়তা আছে, আর এর কারণে বিয়ে করতে দেরীও কর, আবার পাপ থেকেও বাঁচতে পার না, তাহলে জেনে রেখো যে, এ ডবল পাপের সাজা তোমার। জন্য অপেক্ষা করছে। আখেরাতে তো আছেই, পরন্তু দুনিয়াতেও তুমি তার কিছু প্রত্যক্ষ করতে পার। অর্থলালসার এ পাপ হল কুরআন-বিরোধী মহাপাপ। এমন পণ বা যৌতুক নেওয়ার মত পাপ ও যুলুম অন্ততঃ একজন ন্যায়পরায়ণ মুসলিম যুবক করতে পারে না। ইসলাম যে মর্যাদা একজন নারীকে দিয়েছে, সে মর্যাদা যৌতুক দাবী করে, বধুনির্যাতন, বিবাহ-বিচ্ছেদ, এমন কি পিটিয়ে খুন পর্যন্ত করে কোন মুসলিম ক্ষুন্ন করতে পারে না।
সমাজে প্রচলিত আরো একটি বিবাহ-সমস্যা হল, বড় থাকতে ছোটর বিয়ে, অথবা বোন থাকতে ভায়ের বিয়ে। বড়র বিয়ে করতে যদি কোন অসুবিধা বা বাধা থাকে, অথবা বোনের বিবাহ-প্রস্তাব আসতে যদি দেরী হয়, অথবা তার জন্য উপযুক্ত ঘর-বর না পাওয়া যায়, তাহলে যার বিবাহের প্রয়োজন আছে এবং উপযুক্ত পাত্রীও আছে, তার বিবাহে অভিভাবক বা অন্য কারো বাধা দেওয়ার অধিকার নেই। বোনের যদি পাঁচ বছর বিবাহ ঠিক না হয়ে ওঠে, তা বলে কি তার থেকে বয়সে বড় ভাইকে।
তারই জন্য অপেক্ষা করতে হবে? তাছাড়া এ আশঙ্কাও উচিত নয় যে, ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলে ছেলে হয়তো পৃথক হয়ে যাবে, অথবা তার মতিগতি ভিন্ন হয়ে যাবে এবং তখন সে আর মেয়ের বিয়েতে সহায়তা করবে না। কিন্তু মেয়ে যদি বয়সে আরো ছোট হয়, তাহলে কি এ আশঙ্কা থাকে না? আর তা যদি সঙ্গত হয় তাহলে পাঁচ বছরের মেয়েটি বড় হয়ে বিয়ে না দেওয়া পর্যন্ত কোন অভিভাবকের ২০/২৫ বছর বয়সী ছেলের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু কৈ, তা তো কেউ করে না। তা করলে তো, মেয়ের বিয়ের সময় হতে হতে ছেলে বুড়িয়ে যাবে!
অতএব এমন ওজর একটি খোঁড়া ওজর। এ ওজুহাতে উপযুক্ত ছেলের বিয়ে পিছিয়ে দিয়ে তাকে পাপের পথে ঠেলে দেওয়া অভিভাবকের জন্য আদৌ উচিত ও বৈধ নয়। যুবক বন্ধু আমার বয়স হলে বিবাহ কর এবং স্ত্রীর সাথে প্রেম কর। তাকে দাও। ভালোবাসার ডালি খালি করে প্রণয়ের রাশিরাশি ফুল। তাকেই লিখ ভাবের আবেগে লিখা প্রেমপত্র। বিবাহের প্রেম-বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে উভয়ে চিরসুখী হও। আর হ্যা, বউ-পাগলা’ বা ‘আঁচল-ধরা’ স্ত্রৈণ হয়ে পড়ো না। নচেৎ বহু কল্যাণ থেকে তুমি চিরবঞ্চিত রয়ে যাবে।