নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি
নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন (تأسيس المجةمع الإسلامى فى المدينة)

পূর্বোক্ত সামগ্রিক অবস্থা সম্মুখে রেখে এক্ষণে আমরা মদীনায় নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করব। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সংশোধন ও বাইরের অবস্থা সামাল দিয়ে চলতে হয়েছে। নতুন জাতি গঠনের প্রধান ভিত্তি হ’ল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র স্থাপন। সেজন্য তিনি ক্বোবায় প্রথম মসজিদ নির্মাণের পর এবার মদীনায় প্রধান মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।

মদীনায় প্রবেশ করে রাসূল (ছাঃ)-এর উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হ’ল পরবর্তীতে মসজিদে নববীর দরজার স্থান। স্থানটির মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক সাহল ও সোহায়েল বিন রাফে‘ বিন ‘আমর। এটি তখন তাদের খেজুর শুকানোর চাতাল ছিল (ইবনু হিশাম ১/৪৯৫)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন।[1] অতঃপর তার আশপাশের মুশরিকদের কবরগুলি উঠিয়ে ফেলা হয় এবং ভগ্নস্তূপগুলি সরিয়ে স্থানটি সমতল করা হয়। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলি উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়’ (বুখারী হা/৪২৮)। অতঃপর খেজুর গাছ ও তার পাতা দিয়ে মসজিদ তৈরী হয়। চার বছর পর এটি কাঁচা ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়।[2] ঐ সময় আল্লাহর হুকুমে ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুক্বাদ্দাস, যা ছিল ইহূদীদের ক্বিবলা এবং মদীনা থেকে উত্তর দিকে। মসজিদের ভিত ছিল প্রায় তিন হাত উঁচু। দরজা ছিল তিনটি। যার দু’বাহুর স্তম্ভগুলি ছিল পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলি খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর পাতার এবং বালু ও ছোট কংকর বিছানো মেঝে- এই নিয়ে তৈরী হ’ল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৫ হাত মোট ৪২০০ বর্গ হাত আয়তন বিশিষ্ট। যেখানে বর্ষায় বৃষ্টি পড়ত। ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হ’লে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। ফলে পিছনে একমাত্র দরজাটিই এখন ক্বিবলা হয়েছে।[3] কেননা মক্কা হ’ল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে।

‘উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন, আনছারগণ মাল জমা করে রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদিয়ে আপনি মসজিদটি আরও সুন্দরভাবে নির্মাণ করুন। কতদিন আমরা এই ছাপড়ার নীচে ছালাত আদায় করব? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَا بِيْ رَغْبَةٌ عن أخِي موسى، عَرِيْشٌ كَعَريشِ مُوسى ‘আমার ভাই মূসার ছাপড়ার ন্যায় ছাপড়া থেকে ফিরে আসতে আমার কোন আগ্রহ নেই’।[4]

[1]. আর-রাহীক্ব ১৮৪ পৃঃ; বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[2]. বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬ ও ৩৫৩৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।

[3]. মুহাম্মাদ ইলিয়াস আব্দুল গণী, তারীখুল মাসজিদিন নববী আশ-শারীফ (মদীনা : ১ম সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃ.) ৪১ পৃঃ।

[4]. বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/৪১৩; মুরসাল ছহীহ, ছহীহাহ হা/৬১৬।
নির্মাণ কাজে রাসূল (ছাঃ) (مشاركة الرسول صـ فى بناء المسجد النبوى)

মসজিদ নির্মাণে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সশরীরে অংশগ্রহণ করেন। তিনি নিজ হাতে ইট ও পাথর বহন করেন। এ সময় তিনি সাথীদের উৎসাহিত করে বলতেন, اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَه + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের আরাম ব্যতীত কোন আরাম নেই। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’ (বুখারী হা/৪২৮)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ لاَ خَيْرَ إِلاَّ خَيْرُ الْآخِرَهْ + فَانْصُرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَةَ ‘হে আল্লাহ! আখেরাতের কল্যাণ ব্যতীত কোন কল্যাণ নেই। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের সাহায্য কর’ (বুখারী হা/৩৯৩২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ إِنَّ الأَجْرَ أَجْرُ الآخِرَهْ + فَارْحَمِ الأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَهْ ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই পুরস্কার হ’ল আখেরাতের পুরস্কার। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের প্রতি অনুগ্রহ কর’ (বুখারী হা/৩৯০৬)

মসজিদ নির্মাণের বরকতমন্ডিত কাজের প্রতি উজ্জীবিত করার জন্য তিনি বলেন, هَذَا الْحِمَالُ لاَ حِمَالَ خَيْبَرْ + هَذَا أَبَرُّ رَبَّنَا وَأَطْهَرْ ‘এই বোঝা খায়বরের বোঝা নয়। হে আমাদের প্রভু! একাজ অতীব পুণ্যময় ও পবিত্র’ (বুখারী হা/৩৯০৬)। রাসূল (ছাঃ)-এর নিজ হাতে কাজ করায় উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ গেয়ে ওঠেন- لَئِنْ قَعَدْنَا وَالنَّبِيُّ يَعْمَلُ + لَذَاكَ مِنَّا الْعَمَلُ الْمُضَلَّلُ ‘যদি আমরা বসে থাকি, আর নবী কাজ করেন, তবে সেটা আমাদের পক্ষ থেকে হবে নিতান্তই ভ্রান্ত কাজ’ (বুখারী ফৎহসহ হা/৩৯০৬)

মসজিদ নির্মিত হওয়ার পর মুছল্লীদের পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আহবানের জন্য পরামর্শসভা বসে। ছাহাবীগণ বিভিন্ন পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। পরদিন আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহী (রাঃ) প্রথমে এসে রাসূল (ছাঃ)-কে বর্তমান আযানের শব্দ সমূহ সহ স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনালে তিনি তার সত্যায়ন করেন। অতঃপর উচ্চকণ্ঠের অধিকারী বেলালকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আযানের ধ্বনি শুনে কাপড় ঘেঁষতে ঘেঁষতে ওমর (রাঃ) দৌড়ে এসে বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ফালিল্লা-হিল হামদ’ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা’।[1] একটি বর্ণনা মতে ঐ রাতে ১১ জন ছাহাবী একই আযানের স্বপ্ন দেখেন’।[2] উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) ২০ দিন পূর্বে উক্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আগেই বলেছে দেখে লজ্জায় তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেননি।[3]

বলা বাহুল্য, এই আযান কেবল ধ্বনি মাত্র ছিল না। বরং এ ছিল শিরকের অমানিশা ভেদকারী আপোষহীন তাওহীদের এক দ্ব্যর্থহীন আহবান। যা কেবল সে যুগে মদীনার মুশরিক ও ইহূদী-নাছারাদের হৃদয়কে ভীত-কম্পিত করেনি, বরং যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত শিরকী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ বিপ্লবের উদাত্ত ঘোষণা। এ আযান যুগে যুগে প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমীর হৃদয়ে এনে দেয় এক অনন্য প্রেমের অনবদ্য মূর্ছনা। যার আহবানে সাড়া দিয়ে মুমিন পাগলপারা হয়ে ছুটে চলে মসজিদের পানে। লুটিয়ে পড়ে সিজদায় স্বীয় প্রভুর সকাশে। তনুমন ঢেলে দিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে। বাংলার কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১ খৃ.) তাই কত সুন্দরই না গেয়েছেন-

কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি

মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর

আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী

কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি’।-

ইহূদীদের বাঁশি, নাছারাদের ঘণ্টাধ্বনি ও পৌত্তলিকদের বাদ্য-বাজনার বিপরীতে মুসলমানদের আযান ধ্বনির মধ্যেকার পার্থক্য আসমান ও যমীনের পার্থক্যের ন্যায়। আযানের মধ্যে রয়েছে ধ্বনির সাথে বাণী, রয়েছে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, রয়েছে তাওহীদের বিচ্ছুরণ এবং রয়েছে আত্মনিবেদন ও আত্মকল্যাণের এক হৃদয়ভেদী অনুরণন। এমন বহুমুখী অর্থবহ মর্মস্পর্শী ও সুউচ্চ আহবানধ্বনি পৃথিবীর কোন ধর্মে বা কোন জাতির মধ্যে নেই। ১ম হিজরী সনে আযান চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তা প্রতি মুহূর্তে ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে অবিরামভাবে অপ্রতিহত গতিতে। আহ্নিক গতির কারণে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর প্রতি স্থানে সর্বদা ছালাতের সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আযানের সময়ের। ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা প্রতিটি মিনিটে ও সেকেন্ডে আযান উচ্চারিত হচ্ছে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হচ্ছে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যবাণী এবং উচ্চকিত হচ্ছে সর্বত্র আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বের অনন্য ধ্বনি। যার সাক্ষী হচ্ছে প্রতিটি সজীব ও নির্জীব বস্ত্ত ও প্রাণী। এমনকি পানির মধ্যে বিচরণকারী মৎস্যকুল। মানুষ যদি কখনো এ আহবানের মর্ম বুঝে এগিয়ে আসে, তবে পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাবে সকল প্রকার শিরকী জাহেলিয়াতের গাঢ় অমানিশা। টুটে যাবে মানুষের প্রতি মানুষের দাসত্ব নিগড়। প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর গোলামীর অধীনে সকল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। শৃংখলমুক্ত হবে সত্য, ন্যায় ও মানবতা। আযান তাই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিরংকুশ উলূহিয়াতের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। বিশ্বমানবতার একক চেতনা ও কল্যাণের হৃদয়স্রাবী দ্যোতনা।

[1]. আবুদাঊদ হা/৪৯৯, সনদ হাসান ছহীহ; মিশকাত হা/৬৫০।

[2]. মিরক্বাত শরহ মিশকাত ‘আযান’ অনুচ্ছেদ ২/১৪৯ পৃঃ।

[3]. আবুদাঊদ (আওনুল মা‘বূদ সহ) হা/৪৯৪ ‘আযানের সূচনা’ অনুচ্ছেদ।

মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ মদীনায় এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। অতঃপর মসজিদে নববী নির্মাণ শেষে তার পিছনে একটি ছাপড়া দেওয়া হয়। যেখানে নিরাশ্রয় মুহাজিরগণ এসে বসবাস করতেন। ‘ছুফফাহ’ অর্থ ছাপড়া। যা দিয়ে ছায়া করা হয়। এভাবে মুহাজিরগণই ছিলেন আহলে ছুফফার প্রথম দল। যাঁদেরকেصُفَّةُ الْمُهَاجِرِينَ বলা হ’ত (আবুদাঊদ হা/৪০০৩)। এছাড়া অন্যান্য স্থান হ’তেও অসহায় মুসলমানরা এসে এখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন (আহমাদ হা/১৬০৩১)। পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা সেখানে চলে যেতেন। এখানে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আহলে ছুফফাহ’ বা ’আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত হাদীছবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এখানকার অন্যতম সদস্য ও দায়িত্বশীল ছিলেন। যিনি ওমর (রাঃ)-এর যুগে বাহরায়েন এবং মু‘আবিয়া (রাঃ) ও মারওয়ানের সময় একাধিকবার মদীনার গবর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ৫৭ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[1]

অনেক সময় মদীনার ছাহাবীগণও ‘যুহ্দ’ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন যাপনের জন্য তাদের মধ্যে এসে বসবাস করতেন। যেমন কা‘ব বিন মালেক আনছারী, হানযালা বিন আবু ‘আমের ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’, হারেছাহ বিন নু‘মান আনছারী প্রমুখ। চাতালটি যথেষ্ট বড় ছিল। কেননা এখানে যয়নব বিনতে জাহশের সাথে রাসূল (ছাঃ)-এর বিবাহের ওয়ালীমা খানায় প্রায় তিনশ’র মত মানুষ(كَانُوا زُهَاءَ ثَلاثِمِائَةٍ) জমা হয়েছিলেন।[2] তাদের সংখ্যা কম-বেশী হ’ত। তবে সাধারণতঃ সর্বদা ৭০ জনের মত থাকতেন। কখনো অনেক বেড়ে যেত। খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ) একবার তাদের মধ্যে থেকে একাই আশি জনকে মেহমানদারী করেছিলেন।

[1]. তাহযীবুত তাহযীব, ক্রমিক সংখ্যা ১২১৬, ১২/২৮৮ পৃঃ; মুসলিম হা/৮৭৭; মিশকাত হা/৮৩৯। যে সকল বিদ্বান আবু হুরায়রা (রাঃ)-কে ‘গায়ের ফক্বীহ’ বলেন, তারা বিষয়টি লক্ষ্য করুন। কেননা ঐরূপ কোন ব্যক্তি গবর্ণরের মত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আসীন হ’তে পারেন না। যেমন হানাফী উছূলে ফিক্বহ বা ব্যবহারিক আইন সূত্রে বলা হয়েছে, الرَّاوِى إن عُرِفَ بالفقه والةَّقَدُّم فى الإجةهاد كالخلفاء الراشدين والعَبَادِلَة كان حديثُهُ حُجَّةً يُةْرَكُ به القياسُ... وإن عُرِفَ بالعَدَالَةِ والضَّبْطِ دُون الفقه كأنس وأبى هريرة، إِنْ وَافَقَ حديثُهُ القياسَ عُمِلَ به وإن خالفه لم يُةْرَكْ الا بالضَّرُورة- ‘রাবী যদি ফিক্বহ ও ইজতিহাদে অগ্রগামী হওয়ার ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন চার খলীফা ও চার আব্দুল্লাহ, তাহ’লে তাঁর হাদীছ দলীল হিসাবে গণ্য হবে এবং সে অবস্থায় ক্বিয়াস পরিত্যক্ত হবে।... আর যদি ফিক্বহ ব্যতীত কেবল ন্যায়নিষ্ঠা ও তীক্ষ্ণ স্মৃতির ব্যাপারে প্রসিদ্ধ হন, যেমন আনাস ও আবু হুরায়রা; যদি তাঁর হাদীছ ক্বিয়াসের অনুকূলে হয়, তাহ’লে তার উপরে আমল করা যাবে। আর যদি তার বিপরীত হয়, তাহ’লে তা পরিত্যাগ করা যাবে না বিশেষ প্রয়োজন ব্যতীত’ (আহমাদ মোল্লা জিয়ূন (মৃ. ১১৩০ হি.), নূরুল আনওয়ার (দেউবন্দ মাকতাবা থানবী, ইউপি, ভারত : এপ্রিল ১৯৮৩) ‘রাবীদের প্রকারভেদ’ অধ্যায়, ‘রাবীর অবস্থা সমূহ’ অনুচ্ছেদ ১৮২-৮৩ পৃঃ)। এ কথার প্রতিবাদ করেন হেদায়ার ভাষ্যকার প্রখ্যাত হানাফী ফক্বীহ কামাল ইবনুল হুমাম (৭৯০-৮৬১ হি.)। তিনি বলেন, كَيْفَ؟ وهو لا يَعْمَلُ بِفَتْوَى غيره وكان يُفْتِى فى زمان الصحابة رضوان الله تعالى عليهم وكان يُعَارِضُ أَجِلَّةَ الصحابة كإبن عباس... ‘এটা কিভাবে হ’তে পারে? অথচ তিনি অন্যের ফাৎওয়ার উপর আমল করতেন না। তিনি ছাহাবায়ে কেরামের যামানায় ফাৎওয়া দিতেন এবং তিনি ইবনু আববাসের ন্যায় বড় বড় ছাহাবীর ফাৎওয়ার বিরোধিতা করতেন... (ঐ, পৃঃ ১৮৩ টীকা -৪)।

উল্লেখ্য যে, আবু হুরায়রা (রাঃ) ছিলেন সর্বাধিক হাদীছবেত্তা ছাহাবী। অতএব ফাৎওয়া দেওয়ার অধিকার তাঁরই সবচেয়ে বেশী হওয়া উচিত। তিনি ছিলেন হাদীছ মুখস্থ করা বিষয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর বিশেষ দো‘আ প্রাপ্ত ছাহাবী (বুখারী হা/১১৯)। যাঁর মুখস্থকৃত হাদীছের সংখ্যা ছিল ৫৩৭৪। তিনি সহ ৭জন শ্রেষ্ঠ হাদীছ বর্ণনাকারী ছাহাবী হ’লেন যথাক্রমে আব্দুল্লাহ বিন ওমর ২৬৩০, আনাস বিন মালিক ২২৮৬, আয়েশা (রাঃ) ২২১০, আব্দুল্লাহ বিন আববাস ১৬৬০, জাবের বিন আব্দুল্লাহ ১৫৪০ এবং আবু সাঈদ খুদরী ১১৭০। বাকী ছাহাবীগণ এরপরের।

[2]. ইবনু আবী হাতেম হা/১৭৭৫৯, তাফসীর সূরা আহযাব ৫৩-৫৪ আয়াত; ইবনু কাছীর, তাফসীর ঐ।

আবু নু‘আইম তাঁর ‘হিলইয়াতুল আউলিয়া’ গ্রন্থে আছহাবে ছুফফাহর একশ’র অধিক নাম লিপিবদ্ধ করেছেন। যাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন, হযরত আবু হুরায়রা দাওসী, আবু যার গিফারী আনছারী, যিনি স্বেচ্ছায় সেখানে অবস্থান করতেন। ওয়াছেলা বিন আসক্বা‘, কা‘ব বিন মালেক, সালমান ফারেসী, হানযালা বিন আবু ‘আমের, হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান, রিফা‘আহ আবু লুবাবাহ আনছারী, আব্দুল্লাহ যুল-বাজাদাইন, খাববাব ইবনুল আরাত, আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ, ছুহায়েব বিন সিনান রূমী, রাসূল (ছাঃ)-এর মুক্তদাস শুক্বরান, সাফীনাহ ও ছাওবান। বেলাল বিন রাবাহ, ইরবায বিন সারিয়াহ, আবু সাঈদ খুদরী প্রমুখ।

আছহাবে ছুফফাহর সদস্যগণ অধিকাংশ সময় ই‘তিকাফ, ইবাদত ও তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকতেন। একে অপরকে কুরআন শিক্ষা দিতেন ও লেখা-পড়া শিখাতেন। তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন বিষয়ে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন। যেমন আবু হুরায়রাহ (রাঃ) হাদীছ বর্ণনার ক্ষেত্রে এবং হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান ফিৎনা সম্পর্কিত হাদীছসমূহ বর্ণনার ক্ষেত্রে।

অধিকাংশ সময় সমাজ থেকে দূরে থাকলেও তাদের কেউ কেউ বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি শহীদ হয়েছেন। যেমন বদরে শহীদদের মধ্যে ছিলেন ছাফওয়ান বিন বায়যা, খুরাইম বিন ফাতেক আসাদী, খোবায়েব বিন ইয়াসাফ, সালেম বিন উমায়ের প্রমুখ। ওহোদের শহীদদের মধ্যে ছিলেন হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’। কেউ হোদায়বিয়ার সন্ধিকালে উপস্থিত ছিলেন। যেমন জারহাদ বিন খুওয়াইলিদ, আবু সারীহাহ গিফারী। তাদের মধ্যে কেউ খায়বরে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন ছাক্বফ বিন আমর। কেউ তাবূকে শহীদ হয়েছিলেন। যেমন আব্দুল্লাহ যুল বিজাদায়েন। কেউ ভন্ডনবীদের বিরুদ্ধে ইয়ামামাহর যুদ্ধে শহীদ হন। যেমন আবু হুযায়ফাহর মুক্তদাস সালেম ও যায়েদ ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। প্রকৃত প্রস্তাবে তারা ছিলেন রাতের বেলা ইবাদত গুযার ও দিনের বেলায় ঘোড় সওয়ার।

তাদের সম্পর্কে বিশেষভাবে কুরআনে কয়েকটি আয়াত নাযিল হয়। যেমন সূরা বাক্বারাহ ২৭৩ আয়াত ও সূরা তওবাহ ৯১ আয়াত। তাঁদের সম্পর্কে ওয়াক্বেদী, ইবনু সা‘দ, আবু নাঈম, তাক্বিউদ্দীন সুবকী, সামহূদী প্রমুখ বিদ্বানগণ পৃথক পৃথক গ্রন্থ সংকলন করেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৫৭-৭১)। আয়াত দু’টি নিম্নরূপ:

لِلْفُقَرَاءِ الَّذِينَ أُحْصِرُوا فِي سَبِيلِ اللهِ لاَ يَسْتَطِيعُونَ ضَرْبًا فِي الْأَرْضِ يَحْسَبُهُمُ الْجَاهِلُ أَغْنِيَاءَ مِنَ التَّعَفُّفِ تَعْرِفُهُمْ بِسِيمَاهُمْ لاَ يَسْأَلُونَ النَّاسَ إِلْحَافًا وَمَا تُنْفِقُوا مِنْ خَيْرٍ فَإِنَّ اللهَ بِهِ عَلِيمٌ

‘তোমরা ব্যয় কর ঐসব অভাবীদের জন্য, যারা আল্লাহর পথে আবদ্ধ হয়ে গেছে, যারা ভূ-পৃষ্ঠে বিচরণে সক্ষম নয়। না চাওয়ার কারণে অজ্ঞ লোকেরা তাদের অভাবমুক্ত মনে করে। তুমি তাদের চেহারা দেখে চিনতে পারবে। তারা মানুষের কাছে নাছোড়বান্দার মত প্রার্থী হয় না। আর তোমরা উত্তম মাল হ’তে যা কিছু ব্যয় কর, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা সম্যকভাবে অবহিত’ (বাক্বারাহ ২/২৭৩)

দ্বিতীয় আয়াতটি হ’ল,

لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ ঈমান রাখে। বস্ত্ততঃ সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ৯/৯১)

আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন (المؤاخاة بين الأنصار والمهاجرين)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন। যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন’।[1] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের পরস্পর দু’জনের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের (الْمَؤَاخَاةُ الْإِسْلاَمِيَّةُ) বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা একে অপরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়, وَأُوْلُوا الْأَرْحَامِ بَعْضُهُمْ أَوْلَى بِبَعْضٍ فِيْ كِتَابِ اللهِ إِنَّ اللهَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيْمٌ ‘রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ আল্লাহর কিতাবে পরস্পরের অধিক হকদার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’ (আনফাল ৮/৭৫)। এর ফলে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হ’লেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে যার কোন তুলনা নেই। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এই ঘটনা ১ম হিজরী সনেই ঘটেছিল মসজিদে নববী নির্মাণকালে অথবা নির্মাণ শেষে। তবে ঠিক কোন তারিখে ঘটেছিল, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। ইবনু আব্দিল বার্র এটিকে হিজরতের ৫ মাস পরে বলেছেন। ইবনু সা‘দ এটিকে হিজরতের পরে এবং বদর যুদ্ধের পূর্বে বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৩)। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।-

[1]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬; বুখারী হা/৭৩৪০; সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৪।

(১) আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মুহাজির আব্দুর রহমান বিন ‘আওফকে আনছার সা‘দ বিন রবী‘-এর সাথে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন স্থাপন করে দেন। অতঃপর সা‘দ তার মুহাজির ভাইকে বললেন, ‘আনছারদের মধ্যে আমি সর্বাপেক্ষা ধনী। আপনি আমার সম্পদের অর্ধেক গ্রহণ করুন এবং আমার দু’জন স্ত্রীর মধ্যে যাকে আপনি পসন্দ করেন, তাকে আমি তালাক দিয়ে দিব। ইদ্দত শেষে আপনি তাকে বিবাহ করবেন’। আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ তার আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ لَكَ فِى أَهْلِكَ وَمَالِكَ ‘আল্লাহ আপনার পরিবারে ও সম্পদে বরকত দান করুন’! আপনি আমাকে আপনাদের বাজার দেখিয়ে দিন। অতঃপর তাঁকে বনু ক্বায়নুক্বা-র বাজার দেখিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি সেখানে গিয়ে পনীর ও ঘি-এর ব্যবসা শুরু করলেন এবং কিছুদিনের মধ্যে সচ্ছলতা লাভ করলেন। এক সময় তিনি বিয়ে-শাদীও করলেন।[1]

(২) খেজুর বাগান ভাগ করে দেবার প্রস্তাব : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, আনছারগণ একদিন রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে এসে আবেদন করলেন যে, আপনি আমাদের খেজুর বাগানগুলি আমাদের ও মুহাজির ভাইগণের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করে দিন’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে অসম্মতি জ্ঞাপন করলেন। তখন তারা বললেন, তবে এমন করুন যে, মুহাজির ভাইগণ আমাদের কাজ করে দিবেন এবং আমরা তাদের ফলের অংশ দিব’। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এতে সম্মত হ’লেন (বুখারী হা/৩৭৮২)

(৩) জমি বণ্টনের প্রস্তাব : বাহরায়েন এলাকা বিজিত হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেখানকার পতিত জমিগুলি আনছারদের অনুকূলে বরাদ্দ দিতে চাইলে তারা আপত্তি করে বললেন, আমাদের মুহাজির ভাইদের উক্ত পরিমাণ জমি দেওয়ার পরে আমাদের দিবেন। তার পূর্বে নয়।[2] আনছারদের এই অসাধারণ ত্যাগ ও মহত্ত্বের প্রশংসা করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেন (হাশর ৫৯/৯)। যা ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে।

[1]. বুখারী হা/৩৭৮০-৮১ ‘ছাহাবীগণের মর্যাদা’ অধ্যায়, ৩৩ অনুচ্ছেদ ও হা/২৬৩০ ‘হেবা’ অধ্যায়, ৩৫ অনুচ্ছেদ।

[2]. বুখারী হা/২৩৭৬ ‘জমি সেচ করা’ অধ্যায়, ১৪ অনুচ্ছেদ।

মুহাজির ভাইদের জন্য আনছারগণের সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বন্ধন ছিল তাক্বওয়া বা আল্লাহভীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত। যার মাধ্যমে বংশ, বর্ণ, অঞ্চল, ভাষা প্রভৃতি আরবের চিরাচরিত বন্ধন সমূহের উপরে তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত ভিত্তিক নবতর এক জাতীয়তার বন্ধন স্থাপিত হয়। যা পরবর্তীতে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম দেয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার ভিত্তিক ইসলামী খেলাফতের দৃঢ় ভিত্তি। উপ্ত হয় প্রকৃত অর্থে এক অসাম্প্রদায়িক ও উদারনৈতিক ইসলামী সমাজের বীজ।

‘আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান’- এই মহান সাম্যের বাণী ও তার বাস্তব প্রতিফলন দেখে আজীবন মানুষের দাসত্বের নিগড়ে আবদ্ধ মযলূম জনতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত ও শোষিত মানবতা যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। জান্নাত লাভের প্রতিযোগিতায় সর্বোত্তমরূপে বিকশিত মানবতা মদীনার আদি বাসিন্দাদের চমকিত করল। যা তাদের স্বার্থান্ধ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। নোংরা দুনিয়াপূজা হ’তে মুখ ফিরিয়ে আখেরাতমুখী মানুষের বিজয় মিছিল এগিয়ে চলল। কাফির-মুশরিক, ইহূদী-নাছারা ও মুনাফিকদের যাবতীয় অপচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করল বিশ্বজয়ী ইসলামী খেলাফত। যা কয়েক বছরের মধ্যেই তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তিকে দমিত করে অপরাজেয় বিশ্বশক্তিরূপে আবির্ভূত হ’ল। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।

বস্ত্ততঃ আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে যদি এইরূপ নিখাদ ভালবাসা ও ঐক্যের বন্ধন সৃষ্টি না হ’ত এবং স্থানীয় ও বহিরাগত দ্বন্দ্বের ফাটল দেখা দিত, তাহ’লে মদীনায় মুসলমানদের উঠতি শক্তি অংকুরেই বিনাশ হয়ে যেত। পরিণামে তাদেরকে চিরকাল ইহূদীদের শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পিষ্ট হ’তে হ’ত। যেভাবে ইতিপূর্বে মক্কায় কুরায়েশ নেতাদের হাতে তারা পর্যুদস্ত হয়েছিল।

(১) সুনির্দিষ্ট অঙ্গীকার ও আল্লাহকে সাক্ষী রেখে বায়‘আত গ্রহণের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে কর্মীদল সৃষ্টি হ’লেও তাদের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করা এবং অন্যান্য বিশ্বস্ত কর্মীদের পাঠিয়ে বাস্তবতা যাচাই শেষে পদক্ষেপ নেওয়াই দূরদর্শী নেতার কর্তব্য। ১ম বায়‘আতের পর মুছ‘আবকে পাঠিয়ে হিজরতের জন্য দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করার মধ্যে রাসূল (ছাঃ)-এর সেই কর্মনীতি আমরা দেখতে পাই।

(২) নেতৃবৃন্দের অকপট আশ্বাস ও সাধারণ জনমত পক্ষে থাকলেও নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে সর্বদা কিছু শত্রু ও দ্বিমুখী চরিত্রের লোক অবশ্যই থাকবে, সংস্কারবাদী নেতাকে সর্বদা সে চিন্তা মাথায় রাখতে হবে এবং সে হিসাবেই পদক্ষেপ নিতে হবে। মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই কিছু ইহূদী নেতার বিরুদ্ধাচরণ এবং আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দ্বি-মুখী আচরণ তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

(৩) সমাজদরদী নেতা সাধ্যমত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাজ গঠনে সচেষ্ট থাকবেন। সাথে সাথে শত্রুপক্ষের চক্রান্ত সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকবেন ও যথাযোগ্য ব্যবস্থা নিবেন।

দেখানো হচ্ছেঃ ৪৬১ থেকে ৪৭০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯০০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 44 45 46 47 48 · · · 87 88 89 90 পরের পাতা »