নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি
নবীদের কাহিনী ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ৯০০ টি

প্রথমে ছাফা পর্বতচূড়ার আহবান মক্কা নগরী ও তার আশপাশ এলাকার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার মধ্যে এক নতুনের শিহরণ জাগিয়ে তুলেছিল। অতঃপর সর্বত্র প্রকাশ্য দাওয়াতের প্রতিক্রিয়ায় সকলের মুখে মুখে একই কথার অনুবৃত্তি হ’তে থাকে, কি শুনছি আজ আব্দুল্লাহ্র পুত্রের মুখে। এ যে নির্যাতিত মানবতার প্রাণের কথা। এ যে মযলূমের হৃদয়ের ভাষা। যে ক্রীতদাস ভাবত এটাই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে স্বাধীন মানুষ ভাবতে লাগল। যে নারী ভাবত, সবলের শয্যাসঙ্গিনী হওয়াই তার নিয়তি, সে এখন নিজেকে অধিকার সচেতন সাহসী নারী হিসাবে ভাবতে লাগল। যে গরীব ভাবত সূদখোর মহাজনের করাল গ্রাস হ’তে মুক্তির কোন পথ নেই, সে এখন মুক্তির দিশা পেল। সর্বত্র একটা জাগরণের ঢেউ। একটা নতুনের শিহরণ। এ যেন নিদ্রাভঙ্গের পূর্বে জাগৃতির অনুরণন।

সমাজনেতাদের প্রতিক্রিয়া (رد عمل من القادة المجتمع)

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজনেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের মনগড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে নারীকে তারা কেবল ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘ভাই’ হিসাবে সমান ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তারা দিয়ে আসছিল, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা‘বাগৃহে বসে ইবাদত-বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হ’তে রাযী আছি। কিন্তু তাওহীদের সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীত ধারণা করেই তারা রাসূল (ছাঃ)-এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ বলেন,قَدْ نَعْلَمُ إِنَّهُ لَيَحْزُنُكَ الَّذِي يَقُولُوْنَ فَإِنَّهُمْ لاَ يُكَذِّبُونَكَ وَلَكِنَّ الظَّالِمِيْنَ بِآيَاتِ اللهِ يَجْحَدُوْنَ ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন‘আম ৬/৩৩)। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের একই অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং হবে।

সম্প্রদায়ের নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি হিংসা। যেমন অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীক্ব-এর প্রশ্নের উত্তরে আবু জাহ্ল বলেছিলেন,تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... قَالُوا: مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে’।... তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।[1]

উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ছিলেন ‘আব্দে মানাফের পুত্র হাশেম-এর বংশধর। পক্ষান্তরে আবু জাহল ছিলেন বনু মাখযূম গোত্রের। বনু হাশেম গোত্রে নবীর আবির্ভাব হওয়ায় বনু মাখযূম গোত্র তাদের প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল। যদিও সকলে ছিলেন কুরায়েশ বংশীয়।

উর্দূ কবি হালী এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করেননিম্নোক্ত ভাষায়-

وه بجلى كا كڑكا تها يا صوت ہادى + عرب كى زمين جس نے سارى ہلا دى

نئى اك لگن دل ميں سب كے لگا دى + اك آواز ميں سوتى بستى جگا دى

پڑا ہر طرف غل يہ پيغام حق سے + كہ گوبخ اوٹھے دشت وجبل نام حق سے

(১) এটি বজ্রের ধবনি ছিল, না পথ প্রদর্শকের কণ্ঠ ছিল, আরবের সমগ্র যমীন যা কাঁপিয়ে দিল। (২) নতুন এক বন্ধন সকলের অন্তরে লাগিয়ে দিল, এক আওয়াযেই ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিল। (৩) সত্যের এ আহবানে সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল, সত্যের নামে ময়দান ও পাহাড় সর্বত্র গুঞ্জরিত হ’ল’ (মুসাদ্দাসে হালী -উর্দূ ষষ্ঠপদী, ১৪ পৃঃ)

[1]. ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; সনদ মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ৩০৪)। বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/২০৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪।

কুরায়েশ নেতারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ঠেকানোর জন্য বিভিন্ন পথ-পন্থা উদ্ভাবন করলেন। যেমন-

(১) প্রথম পন্থা হিসাবে তারা বেছে নিলেন মুহাম্মাদের আশ্রয়দাতা আবু ত্বালেবকে দলে টানা। সেমতে নেতৃবৃন্দ সেখানে গেলেন এবং তাঁর নিকটে বাপ-দাদার ধর্মের দোহাই দিয়ে ও সামাজিক ঐক্যের কথা বলে মুহাম্মাদকে বিরত রাখার দাবী জানালেন। আবু ত্বালিব স্থিরভাবে তাদের সব কথা শুনলেন। অতঃপর ধীরকণ্ঠে নরম ভাষায় তাদেরকে বুঝিয়ে বিদায় করলেন।

(২) হজ্জের সময় দাওয়াতে বাধা দেওয়া। হারামের এ মাসে কোন ঝগড়া-ফাসাদ নেই। অতএব এই সুযোগে মুহাম্মাদ বহিরাগতদের নিকটে তার দ্বীনের দাওয়াত পেশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। সুতরাং তারা সিদ্ধান্ত নিল যে, এমন একটা অপবাদ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তৈরী করতে হবে এবং তা সকলের মধ্যে রটিয়ে দিতে হবে, যাতে কোন লোক তার কথায় কর্ণপাত না করে। অলীদ বিন মুগীরাহ্র গৃহে বৈঠক বসল। এক একজন এক এক প্রস্তাব পেশ করল। কেউ বলল, তাকে ‘গণৎকার’ (كَاهِنٌ) বলা হউক। কেউ বলল, ‘পাগল’ (مَجْنُوْنٌ) বলা হউক। কেউ বলল, ‘কবি’ (شَاعِرٌ) বলা হউক। সব শুনে অলীদ বললেন, আল্লাহর কসম! মুহাম্মাদ-এর কথাবার্তা বড়ই সুন্দর ও মিষ্ট-মধুর। তার কাছে কিছুক্ষণ বসলেই লোকেদের নিকট তোমাদের দেওয়া ঐসব অপবাদ মিথ্যা প্রতিপন্ন হবে। তারা বলল, তাহ’লে আপনিই বলুন, কী বলা যায়। অলীদ অনেকক্ষণ ভেবে-চিন্তে বললেন, তার সম্পর্কে যদি কিছু বলতেই হয়, তবে বেশীর বেশী তাকে ‘জাদুকর’ (سَاحِرٌ) বলা যায়। কেননা তার কথা যেই-ই মন দিয়ে শোনে তার মধ্যে জাদুর মত আছর করে (মুদ্দাছছির ৭৪/২৪) এবং লোকেরা তার দলে ভিড়ে যায়। ফলে আমাদের পিতা-পুত্রের মধ্যে, ভাই-ভাইয়ের মধ্যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে, আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে এমনকি গোত্রে-গোত্রে বিভক্তি সৃষ্টি হয়ে গেছে। আর এসবই হচ্ছে তার কথার জাদুকরী প্রভাবে। অতএব তাকে ‘জাদুকর’ বলাই যুক্তিযুক্ত। অতঃপর সবাই একমত হয়ে আসন্ন হজ্জের মৌসুমে শতমুখে তাঁকে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বৈঠক ভঙ্গ করল। অতঃপর মক্কার পথে পথে হাজীদের নিকট এই মিথ্যা অপবাদ প্রচার করার জন্য লোক নিয়োগ করল, যেন তারা রাসূল (ছাঃ)-এর ব্যাপারে সবাইকে সাবধান করে’ (ইবনু হিশাম ১/২৭০)

বস্ত্ততঃ যুগে যুগে সমাজ সংস্কারক নেতাদের বিরুদ্ধে স্বার্থপর সমাজ ও রাজনৈতিক নেতারা এবং মিডিয়ার দুষ্টু লোকেরা পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করেছে, আজও করে যাচ্ছে। কেবল যুগের পরিবর্তন হয়েছে। মানসিকতার কোন পরিবর্তন হয়নি।

অলীদ বিন মুগীরা আল-মাখযূমী ছিলেন মক্কার অন্যতম সেরা ধনী। আল্লাহ তাকে ধনৈশ্বর্য ও সন্তান-সন্ততির প্রাচুর্য দান করেছিলেন। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তিনি নিজেকে বলতেন ‘অহীদ ইবনুল অহীদ’ (আমি অদ্বিতীয়ের পুত্র অদ্বিতীয়)। সারা আরবে আমার ও আমার পিতার কোন তুলনা নেই। তার এই ধারণা বিষয়ে আল্লাহ বলেন,ذَرْنِي وَمَنْ خَلَقْتُ وَحِيدًا ‘ছাড় আমাকে এবং যাকে আমি সৃষ্টি করেছি অদ্বিতীয় করে’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১১)। তার ফসলের ক্ষেত, পশু চারণ ক্ষেত্র ও বাগ-বাগিচা মক্কা হ’তে ত্বায়েফ পর্যন্ত (প্রায় ৯০ কি. মি.) বিস্তৃত ছিল (তাফসীর কুরতুবী)। শীত-গ্রীষ্ম উভয় মৌসুমে তার ক্ষেতের ফসল ও বাগানের আয়-আমদানী অব্যাহত থাকত। তার সন্তান-সন্ততি তার সাথেই থাকত। এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন,وَجَعَلْتُ لَهُ مَالاً مَمْدُودًا- وَبَنِينَ شُهُودًا- وَمَهَّدْتُ لَهُ تَمْهِيدًا ‘তাকে আমি দিয়েছিলাম প্রচুর ধন-সম্পদ’। ‘এবং সদাসঙ্গী পুত্রগণ’। ‘আর তাকে দিয়েছিলাম প্রচুর সচ্ছলতা’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১২-১৪)

একদিন তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন। তখন তিনি তাকে কুরআন শুনান। তাতে তার অন্তর গলে যায়। একথা আবু জাহ্লের কানে পৌঁছে যায়। তখন তিনি তার কাছে এসে বলেন, হে চাচা! আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা আপনার জন্য অনেক টাকা জমা করতে মনস্থ করেছে আপনাকে দেওয়ার জন্য। কেননা আপনি মুহাম্মাদের কাছে গিয়েছিলেন। জবাবে তিনি বললেন, কুরায়েশরা ভালো করেই জানে যে আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধনী। তখন আবু জাহ্ল বললেন, আপনি তার ব্যাপারে এমন কিছু কথা বলুন যাতে আপনার সম্প্রদায়ের লোকেরা বোঝে যে আপনি মুহাম্মাদ যা বলেছে, তা অস্বীকারকারী। জবাবে তিনি বললেন, আমি তার সম্পর্কে কি বলব? আল্লাহর কসম! তোমাদের মধ্যে কবিতা বিষয়ে আমার চাইতে বিজ্ঞ কেউ নেই। আল্লাহর কসম! তিনি যা বলেন, তা কোন কিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। ক্বাতাদাহ বলেন, লোকেরা ধারণা করত যে, তিনি বলেছিলেন,وَاللهِ لَقَدْ نَظَرْتُ فِيمَا قَالَ الرَّجُلُ فَإِذَا هُوَ لَيْسَ بِشِعْرٍ، وَإِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةٌ، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةٌ، وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَمَا يُعْلَى، وَمَا أَشُكُّ أَنَّهُ سِحْرٌ ‘আল্লাহর কসম! লোকটি যা বলেন সে বিষয়ে আমি গভীরভাবে চিন্তা করেছি। এটি কোন কবিতা নয়। নিশ্চয়ই এর রয়েছে বিশেষ মাধুর্য। এর উপরে রয়েছে বিশেষ অলংকার। নিশ্চয়ই এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর আমি যা সন্দেহ করি তা এই যে, এটি জাদু।[1]

এভাবে সবকিছু স্বীকার করার পরও অহংকার বশে ও কুরায়েশ নেতাদের চাপে তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নবুঅতকে স্বীকৃতি না দিয়ে বিরুদ্ধাচরণের পথ বেছে নিলেন। ওইদিন অলীদের গৃহে অনুষ্ঠিত বৈঠকে রাসূল (ছাঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে প্রচার করার সিদ্ধান্তের ঘটনা এবং অলীদের বাকভঙ্গী আল্লাহ নিজস্ব রীতিতে বর্ণনা করেননিম্নোক্ত ভাবে-

إِنَّهُ فَكَّرَ وَقَدَّرَ- فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ نَظَرَ- ثُمَّ عَبَسَ وَبَسَرَ- ثُمَّ أَدْبَرَ وَاسْتَكْبَرَ- فَقَالَ إِنْ هَذَا إِلاَّ سِحْرٌ يُّؤْثَرُ- إِنْ هَذَا إِلاَّ قَوْلُ الْبَشَرِ-

‘সে চিন্তা করল ও মনস্থির করল’। ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘অতঃপর সে তাকাল’। ‘অতঃপর ভ্রুকুঞ্চিত করল ও মুখ বিকৃত করল’। ‘অতঃপর পৃষ্ঠ প্রদর্শন করল ও অহংকার করল’। ‘তারপর বলল, অর্জিত জাদু বৈ কিছু নয়’। ‘এটা মানুষের উক্তি বৈ কিছু নয়’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১৮-২৫)

অত্র সূরায় ১১ হ’তে ২৬ পর্যন্ত ১৬টি আয়াত কেবল অলীদ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, অলীদ রাসূল (ছাঃ)-কে ‘মিথ্যাবাদী’ বলতে সাহস করেননি। তাই অবশেষে কালামে পাকের জাদুকরী প্রভাবের কথা চিন্তা করে তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে ‘জাদুকর’ বলে অপবাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। এতে আল্লাহ তাকে পরপর দু’বার অভিসম্পাৎ দিয়ে বলেন,فَقُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ- ثُمَّ قُتِلَ كَيْفَ قَدَّرَ ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? ‘ধ্বংস হৌক সে কিরূপ মনস্থির করল’? অতঃপর বললেন,سَأُصْلِيْهِ سَقَرَ ‘সত্বর আমি তাকে ‘সাক্বার’ নামক জাহান্নামে প্রবেশ করাবো’ (মুদ্দাছছির ৭৪/২৬)

অলীদ বিন মুগীরাহ হিজরতের তিনমাস পর ৯৫ বছর বয়সে কাফির অবস্থায় মক্কায় মৃত্যুবরণ করেন এবং হাজূনে সমাহিত হন।[2]

[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা মুদ্দাছছির ১৮-২৪ আয়াত; ইবনু হিশাম ১/২৭০-৭১।

[2]. ইবনুল আছীর, আল-কামিল ফিত তারীখ (বৈরূত : ১ম সংস্করণ ১৪১৭/১৯৯৭) ১/৬৬৯।
হজ্জের মৌসুমে রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত (دعوة الرسول صـ فى موسم الحج)

যথাসময়ে হজ্জের মৌসুম এসে গেল। হজ্জের মাসের আগে-পিছে দু’মাস হ’ল হারামের মাস। এ তিন মাস মারামারি-কাটাকাটি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হজ্জে আগত মেহমানদের তাঁবুতে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। ওদিকে অলীদের পরামর্শ মতে আবু লাহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত গীবতকারী দল সবার কাছে গিয়ে রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং শেষে বলে আসে যে, সে একজন জাদুকর। তার কথা শুনলেই জাদুগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে। অতএব কেউ যেন তার ধারে-কাছে না যায়। খোদ আবু লাহাব নির্লজ্জের মত রাসূল (ছাঃ)-এর পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। রাসূল (ছাঃ) যেখানেই যান, সেখানেই সে গিয়ে বলেيَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এর কথা শুনো না। সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যুক’।[1] শুধু তাই নয়, সে উপরোক্ত গালি দিয়ে হজ্জ মৌসুমের বাইরে যুল-মাজায বাজারে রাসূল (ছাঃ)-এর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। যাতে তাঁর দু’গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।[2]

যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবে হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে। আজও করে যাচ্ছে। যাতে লোকেরা হক কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।

[1]. ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১৫৯, সনদ ছহীহ; আহমাদ হা/১৬০৬৬, ১৬০৬৯, সনদ হাসান।

[2]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫৬২; হাকেম ২/৬১১; দারাকুৎনী হা/২৯৫৭, ১৮৬ ‘ক্রয়-বিক্রয়’ অধ্যায়, সনদ হাসান।

এই ব্যাপক অপপ্রচারের ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য লাভ ও ক্ষতি দু’টিই হ’ল। লাভ হ’ল এই যে, তাঁর নবুঅত দাবীর কথা সর্বত্র প্রচারিত হ’ল। যা সুদূর ইয়াছরিবের কিতাবধারী ইহূদী-নাছারাদের কানে পৌঁছে গেল। এতে তারা বুঝে নিল যে, তাওরাত-ইনজীলের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী আখেরী নবীর আগমন ঘটেছে। ফলে দ্বীনদার লোকদের মধ্যে তাঁর প্রতি ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হ’ল।

পক্ষান্তরে ক্ষতি হ’ল এই যে, কেউ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিল না। বরং অনেকের মধ্যে তাঁর সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবের সৃষ্টি হ’ল। সবচেয়ে ক্ষতিকর দিক ছিল আবু লাহাবের কুৎসা রটনা ও নোংরা প্রচারণা। কেননা তিনি ছিলেন রাসূল (ছাঃ)-এর আপন চাচা, নিকটতম প্রতিবেশী, তাঁর দুই মেয়ের সাবেক শ্বশুর এবং সুপরিচিত নেতা ও বড় ব্যবসায়ী। তার কথা সবাই বিশ্বাস করে নিল। যে কারণে দীর্ঘ প্রায় তিন মাসব্যাপী দিন-রাতের দাওয়াত বাহ্যতঃ নিষ্ফল হ’ল।

(১) ইসলাম বিশ্বধর্ম। অতএব বিশ্ব মানবতার কল্যাণে তার প্রকাশ্য দাওয়াত অপরিহার্য ছিল। ক্বিয়ামত অবধি এর প্রকাশ্য দাওয়াত অব্যাহত থাকবে। কেননা এর অকল্যাণকর কোন দিক নেই, যা গোপন রাখতে হবে। বরং যত সুন্দরভাবে ইসলামের প্রতিটি দিক জগত সমক্ষে তুলে ধরা যাবে, মানবজাতি তা থেকে তত দ্রুত কল্যাণ লাভে ধন্য হবে।

(২) কল্যাণময় কোন দাওয়াত প্রকাশিত হ’লে অকল্যাণের অভিসারীরা তার বিরোধিতায় উঠে পড়ে লাগবে এটাই স্বাভাবিক। রাসূল (ছাঃ)-এর জীবনে সেটাই ঘটেছিল।

(৩) বাধা সত্ত্বেও দাওয়াত দানকারীকে প্রচারের সকল সুযোগ গ্রহণ করতে হবে। কেননা বহু অচেনা মানব সন্তান রয়েছে, যারা দাওয়াত পেলেই গ্রহণ করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সেকারণ রাসূল (ছাঃ) দাওয়াত প্রসারের সামান্যতম সুযোগকেও হাতছাড়া করেননি।

(৪) ইসলামের দাওয়াত হবে উদার ও বিশ্বধর্মী। এখানে রং, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল ও গোষ্ঠীগত সংকীর্ণতার কোন অবকাশ থাকবে না।

(৫) তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অধীনে সকল মানুষের সমানাধিকার নিশ্চিত করা, রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত পথের অনুসরণ করা এবং আখেরাতে জওয়াবদিহিতার তীব্র অনুভূতি, এই মৌলিক তিনটি বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করা ব্যতীত ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রকৃত কল্যাণ ও উন্নয়ন সম্ভব নয়। ইসলামের এই দাওয়াত সেযুগের ন্যায় এযুগেও মযলূম মানবতার মুক্তিদূত হিসাবে গ্রহণীয়।

অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ (تكثير عدد الافتراء ومكائد أخري) ১. নানাবিধ অপবাদ রটনা (الإفةراءاة المخةلفة)

হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেলেন। দেখা গেল যে, অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় ও প্রতিবেশী। অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। ফলে রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন-

তিনি (১) পাগল (২) কবি وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ ‘তারা বলল, আমরা কি একজন কবি ও পাগলের জন্য আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব? (ছাফফাত ৩৭/৩৬)। (৩) জাদুকর (৪) মহা মিথ্যাবাদী وَقَالَ الْكَافِرُونَ هَذَا سَاحِرٌ كَذَّابٌ ‘কাফেররা বলল, এ লোকটি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/৪)। (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী إِنْ هَـذَا إِلاَّ أَسَاطِيْرُ الأوَّلِيْنَ ‘এটা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা উপাখ্যান ব্যতীত কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)। (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী يَقُولُونَ إِنَّمَا يُعَلِّمُهُ بَشَرٌ ‘তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ’ (নাহল ১৬/১০৩), (৭) মিথ্যা রটনাকারী وَقَالَ الَّذِينَ كَفَرُوا إِنْ هَذَا إِلاَّ إِفْكٌ افْتَرَاهُ وَأَعَانَهُ عَلَيْهِ قَوْمٌ آخَرُونَ ‘কাফেররা বলে, এটা বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয় যা সে উদ্ভাবন করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)। (৮) গণৎকার فَذَكِّرْ فَمَا أَنتَ بِنِعْمَتِ رَبِّكَ بِكَاهِنٍ وَلاَ مَجْنُونٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উন্মাদও নও’ (তূর ৫২/২৯)। (৯) ইনি তো সাধারণ মানুষ, ফেরেশতা নন وَقَالُوا مَالِ هَذَا الرَّسُولِ يَأْكُلُ الطَّعَامَ وَيَمْشِي فِي الْأَسْوَاقِ لَوْلاَ أُنزِلَ إِلَيْهِ مَلَكٌ فَيَكُونَ مَعَهُ نَذِيراً ‘তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার প্রতি কেন ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তার সাথে থাকতো সদা সতর্ককারী রূপে? (ফুরক্বান ২৫/৭)। (১০) পথভ্রষ্ট وَإِذَا رَأَوْهُمْ قَالُوا إِنَّ هَؤُلاَء لَضَالُّونَ ‘যখন তারা ঈমানদারগণকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৩২)। (১১) ধর্মত্যাগী قَالَ ابو لهب: لاَتُطِيْعُوْهُ فَإِنَّهُ صَابِىءٌ كَذَّابٌ ‘আবু লাহাব বলত, তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যাবাদী’ (আহমাদ)। (১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী (১৩) জামা‘আত বিভক্তকারী (ইবনু হিশাম ১/২৯৫) (১৪) জাদুগ্রস্ত يَقُوْلُ الظَّالِمُوْنَ إِنْ تَتَّبِعُوْنَ إِلاَّ رَجُلاً مَّسْحُوْراً ‘যালেমরা বলে, তোমরা তো কেবল একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৭)। (১৫) ‘মুযাম্মাম’। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামের বিপরীতে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে ব্যঙ্গ কবিতা বলত (ইবনু হিশাম ১/৩৫৬)। (১৬) রা‘এনা। মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহূদীরা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘রা‘এনা’ (رَاعِنَا) বলে ডাকত (বাক্বারাহ ২/১০৪)। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ছিল شَرِيْرُنَا ‘আমাদের মন্দ লোকটি’।[1]

এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন, اُنْظُرْ كَيْفَ ضَرَبُوْا لَكَ الأَمْثَالَ فَضَلُّوْا فَلاَ يَسْتَطِيْعْوْنَ سَبِيْلاً ‘দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরক্বান ২৫/৯)। কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে এটাই হ’ল সর্বোত্তম জবাব।

[1]. মুজাম্মা‘ লুগাতুল ‘আরাবিইয়াহ (মিসর : ১৪০৯/১৯৮৮) ১/৫০৬; আরবী ভাষায় رَاعِنَا অর্থ ‘আমাদের তত্ত্বাবধায়ক’। মাদ্দাহ الرعاية والحفظ এই লকবে ডেকে তারা বাহ্যতঃ মুসলমানদের খুশী করত। কিন্তু এর দ্বারা তারা নিজেদের ভাষা অনুযায়ী গালি (الرُّعُونَةُ) অর্থ নিত। সেকারণ আল্লাহ এটাকে নিষিদ্ধ করে انظُرْنَا (‘আমাদের দেখাশুনা করুন’) লকবে ডাকার নির্দেশ দিলেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ১০৪ আয়াত)।

গল্পের আসর জমানো এবং গান-বাজনা ও নৃত্য-গীতের অনুষ্ঠান করা, যাতে মানুষ মুহাম্মাদের কথা না শোনে। এজন্য অন্যতম কুরায়েশ নেতা ও বিত্তশালী ব্যবসায়ী নযর বিন হারেছ তৎকালীন সমৃদ্ধ শহর ইরাকের ‘হীরা’ নগরীতে চলে যান এবং সেখান থেকে পারস্যের প্রাচীন রাজা-বাদশাদের কাহিনী, রুস্তম ও ইস্ফিনদিয়ারের বীরত্বের কাহিনী শিখে এসে মক্কায় বিভিন্ন স্থানে গল্পের আসর বসাতে শুরু করেন। যেখানেই রাসূল (ছাঃ) মানুষকে জাহান্নামের ভয় ও জান্নাতের সুখ-শান্তির কথা শুনিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতেন, সেখানেই নযর বিন হারেছ গিয়ে উক্ত সব কল্প-কাহিনী শুনিয়ে বলতেন, এগুলো কি মুহাম্মাদের কাহিনীর চেয়ে উত্তম নয়? এতেও তিনি ক্ষান্ত না হয়ে অনেকগুলি সুন্দরী দাসী খরিদ করেন, যারা নৃত্য-গীতে পারদর্শী ছিল। তিনি তাদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে নাচ-গানের আসর বসাতেন এবং মানুষকে সেখানে আকৃষ্ট করতেন। এমনকি কোন লোক মুহাম্মাদের অনুসারী হয়েছে জানতে পারলে তিনি ঐসব সুন্দরীদের তার পিছনে লাগিয়ে দিতেন এবং তাকে ফিরিয়ে আনার যেকোন পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দিতেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩০০)।

উপরোক্ত ঘৃণ্য ক্রিয়া-কলাপের প্রেক্ষিতেই নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَشْتَرِي لَهْوَ الْحَدِيْثِ لِيُضِلَّ عَنْ سَبِيْلِ اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَّيَتَّخِذَهَا هُزُواً أُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ مُّهِيْنٌ- (لقمان ৬)-

‘লোকেদের মধ্যে একটা শ্রেণী আছে, যারা মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য অজ্ঞতাবশে অলীক কল্প-কাহিনী খরীদ করে এবং আল্লাহর পথকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে। এদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (লোকমান ৩১/৬)

আধুনিক যুগের মিথ্যাচার ও খেল-তামাশার বাহন স্বরূপ ইসলাম বিরোধী প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া সমূহ এ আয়াতের আওতাভুক্ত। সেযুগের চেয়ে এ যুগে এসবের ক্ষতি শতগুণ বেশী। কেননা সে যুগে এসব যে স্থানে প্রদর্শিত হ’ত, সে স্থানের দর্শক ও শ্রোতারাই কেবল সংক্রমিত হ’ত। কিন্তু আধুনিক যুগে এর মন্দ প্রতিক্রিয়া হয় সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী কোটি কোটি দর্শক ও শ্রোতার মধ্যে। সেকারণ জাহান্নামের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিডিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের এবং পরিবারপ্রধান ও সমাজ ও প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের এ বিষয়ে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করা আবশ্যক।

আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল রাসূল (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন। যাতে রাসূল (ছাঃ) কষ্ট পান। এর মাধ্যমে তিনি লোকদের ক্ষেপিয়ে তুলতেন। সূরা লাহাব নাযিল হ’লে রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তিনি হাতে প্রস্তরখন্ড নিয়ে রাসূল (ছাঃ)-কে মারার উদ্দেশ্যে কা‘বা চত্বরে গমন করেন এবং নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন।-

مُذَمَّمًا عَصَيْنَا + وَأَمْرَهُ أَبَيْنَا + وَدِيْنَهُ قَلَيْنَا

‘নিন্দিতের আমরা অবাধ্যতা করি’। ‘তার নির্দেশ আমরা অমান্য করি’। ‘তার দ্বীনকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করি’।[1] উক্ত কবিতায় তিনি ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামকে বিকৃত করে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলেন। কুরায়েশরাও রাসূল (ছাঃ)-কে গালি দিয়ে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) বলত। জবাবে রাসূল (ছাঃ) কত সুন্দরই না বলতেন, أَلاَ تَعْجَبُوْنَ كَيْفَ يَصْرِفُ اللهُ عَنِّى شَتْمَ قُرَيْشٍ وَلَعْنَهُمْ يَشْتِمُوْنَ مُذَمَّمًا وَيَلْعَنُوْنَ مُذَمَّمًا وَأَنَا مُحَمَّدٌ ‘তোমরা কি বিস্মিত হও না কিভাবে আল্লাহ আমার থেকে কুরাইশদের গালি ও লা‘নতকে ফিরিয়ে দিয়েছেন? তারা আমাকে ‘মুযাম্মাম’ (مُذَمَّمٌ) ‘নিন্দিত’ বলে গালি দিয়েছে ও লা‘নত করেছে, অথচ আমি হ’লাম ‘মুহাম্মাদ’ (مُحَمَّدٌ) ‘প্রশংসিত’।[2] যুগে যুগে সংস্কারপন্থী আলেম ও সংগঠনের বিরুদ্ধে কটূক্তিকারীদের জন্য এটাই হবে সর্বোত্তম জওয়াব।

[1]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; হাকেম হা/৩৩৭৬, ২/৩৬১ সনদ ছহীহ; আলবানী, ছহীহ সীরাহ নববিইয়াহ ১৩৭ পৃঃ; তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর; সীরাহ ছহীহাহ ১/১৪৭।

[2]. ইবনু হিশাম ১/৩৫৬; বুখারী হা/৩৫৩৩; মিশকাত হা/৫৭৭৮।
দেখানো হচ্ছেঃ ৩৪১ থেকে ৩৫০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৯০০ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ « আগের পাতা 1 2 3 4 · · · 32 33 34 35 36 · · · 87 88 89 90 পরের পাতা »