তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) ৮৫ টি
তাওহীদ পন্থীদের নয়নমণি শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান বিন মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রহঃ) ৮৫ টি

 الحمد لله رب العالمين والصلاة والسلام على أشرف الأنبياء والمرسلين نبينا محمد وعلى آله وصحبه ومن تبعهم بإحسان إلى يوم الدين أما بعد

আল্লাহ তাআলা পৃথিবীতে মানুষ ও জিন সৃষ্টি করেছেন একমাত্র তাঁর এবাদতের জন্য। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)। আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ فَتَعَالَى اللَّهُ الْمَلِكُ الْحَقُّ لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْكَرِيمِ

‘‘তোমরা কি ধারণা করো যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবেনা? অতএব প্রকৃত বাদশাহ আল্লাহ্ হচ্ছেন সুমহান। তিনি ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তিনিই সম্মানিত আরশের মালিক’’। (সূরা মুমিনুনঃ ১১৫-১১৬) সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করোনা’’। এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাই হচ্ছে সেই তাওহীদ, যার জ্ঞান অর্জন করা এবং যা মেনে চলা সকল আদম সন্তানের উপর সর্বপ্রথম ফরয। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করো তোমার গুনাহর জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ১৯)

আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আদম (আঃ) থেকে শুরু করে নূহ (আঃ)এর জাতি পর্যন্ত একহাজার বছরের ব্যবধান ছিল। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে সকল মানুষই তাওহীদের উপর ছিল। সকলেই এক আল্লাহর এবাদত করতো। তাদের মধ্যে শির্কের কোন অস্তিত্বই ছিলনা।

অতঃপর নূহ (আঃ)এর জাতির মধ্যে সর্বপ্রথম শির্কের আবির্ভাব হয়। কতিপয় সৎ লোককে নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই তাদের মধ্যে শির্ক প্রবেশ করে। মূলতঃ তাদের মাধ্যমেই পৃথিবীর মধ্যে শির্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সহীহ বুখারীতে আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آَلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا

‘‘কাফেররা বললঃ তোমরা নিজেদের মাবুদগুলোকে পরিত্যাগ করোনা। বিশেষ করে ওয়াদ, সুআ, ইয়াগুছ, ইয়াঊক এবং নাসরকে কখনও পরিত্যাগ করোনা’’-এর ব্যাখ্যায় বলেন, এগুলো হচ্ছে নূহ (আঃ)-এর গোত্রের কতিপয় সৎ ব্যক্তির নাম। তারা যখন মৃত্যু বরণ করল, তখন শয়তান তাদের কওমকে বুঝিয়ে বললঃ যেসব জায়গায় তাদের মজলিস বসত সেসব জায়গাতে তাদের মূর্তি স্থাপন করো এবং তাদের সম্মানার্থে তাদের নামেই মূর্তিগুলোর নামকরণ করো। তখন তারা তাই করল। তাদের জীবদ্দশায় মূর্তিগুলোর পূজা করা হয়নি ঠিকই; কিন্তু মূর্তি স্থাপনকারীরা যখন মৃত্যু বরণ করল এবং পরবর্তীরা মূর্তি স্থাপনের ইতিহাস ভুলে গেল, তখনই মূর্তিগুলোর এবাদত শুরু হল।

সুতরাং পৃথিবীতে শির্ক আসার সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলা নূহ (আঃ)-কে পাঠালেন। তিনি তাঁর জাতিকে শির্ক বর্জন করে এক আল্লাহর এবাদতের দিকে আহবান জানালেন। ৯৫০ বছর তিনি স্বীয় সম্প্রদায়কে শির্ক বর্জন ও তাওহীদের প্রতি দাওয়াত দিলেন। এ পথে সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালালেন। কিন্তু তাঁর জাতির অল্প সংখ্যক লোকই ঈমান আনয়ন করলো। তাদের সীমা লংঘন ও অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাআলা নূহ (আঃ)এর জাতিকে মহাপ্লাবনের মাধ্যমে ধ্বংস করলেন। নূহ (আঃ)এর পরও নবী-রাসূল আগমণের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলো। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘‘আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬) সূরা আরাফের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

‘‘নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোনো সত্য মাবুদ নেই। তা না করলে আমি তোমাদের উপর একটি মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি। একই সূরার ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদেরই ভাই হুদকে। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘আর সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদেরই ভাই সালেহকে। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই’’। (সূরা আরাফঃ ৭৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘আমি মাদায়েনের প্রতি তাদের ভাই শুআইবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই’’। (সূরা আরাফঃ ৮৫) সূরা হুদের আরো কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, নবীগণ সর্বপ্রথম তাওহীদ দিয়েই তাদের দাওয়াত শুরু করেছেন এবং এই তাওহীদের দিকেই নিজ নিজ উম্মতদেরকে আহবান জানিয়েছেন।

সবশেষে আল্লাহ তাআলা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ নবীকে এমন জাতির কাছে প্রেরণ করলেন, যারা নবী-রাসূলদের দ্বীনকে ভুলে গিয়ে নানা প্রকার শির্কে লিপ্ত হয়েছিল। এমনকি আল্লাহর সম্মানিত ঘর কাবা শরীফেও তারা মূর্তি ঢুকিয়েছিল। অতঃপর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মাঝে প্রেরিত হলেন। তিনি মক্কাবাসীদেরকে বললেনঃ

«يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُولُوا لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ تُفْلِحُوا»

‘‘হে লোক সকল! তোমরা বলোঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্। এতে তোমরা সফল হবে’’। সুতরাং সকল প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষের উপর এটিই সর্বপ্রথম ওয়াজিব। আরব, অনারব, জিন ইনসান, রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব নির্বিশেষে পৃথিবীর সকল অধিবাসীই এক আল্লাহর এবাদত করবে, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্র ঘোষণা দিবে, তাঁর সাথে অন্য কিছুর এবাদত করবেনা। কোন নবী, ফেরেশতা, পাথর, কবর, অলী বা অন্য কারো এবাদত করবেনা। কেননা সকল প্রকার এবাদতের হকদার একমাত্র আল্লাহ। এতে অন্য কারো কোন অংশ নেই।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মক্কায় ১৩ বছর অবস্থান করে মানুষকে এই পবিত্র কালেমার দাওয়াত দিলেন এবং এই পথে মক্কাবাসীদের পক্ষ হতে নানা রকম যুলুম-নির্যাতন সহ্য করলেন। অতঃপর মদীনায় হিজরত করে সেখানে ১০ বছর বসবাস করে মানুষকে আল্লাহর দ্বীনের দিকে দাওয়াত দিলেন এবং আল্লাহর রাস্তায় সর্বোত্তম জিহাদ করলেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দাওয়াতকে পূর্ণতা দান করলেন। মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে সেই দাওয়াত সাফল্য অর্জন করল। তাঁর জীবদ্দশাতেই মক্কা-মদীনাসহ আরবের বিশাল অংশে তাওহীদ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলো। লোকেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করল।

অতঃপর তিনি মৃত্যু বরণ করলেন। তাঁর পরে সাহাবীগণও এই তাওহীদের প্রচার ও প্রসারে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়লেন। সমগ্র আরব ভূমি শির্ক থেকে পবিত্র হল। ইরাক ও মিশর পর্যন্ত ইসলামের বিজয় সম্প্রসারিত হলো। এই তাওহীদের বদৌলতেই মুসলিমগণ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। তাদের জন্য আল্লাহর ওয়াদা বাস্তবায়িত হলো। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

﴿هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ﴾

‘‘তিনিই তাঁর রাসূলকে হেদায়াত ও সত্য দ্বীনসহ প্রেরণ করেছেন, যাতে একে অন্য সমস্ত ধর্মের উপর জয়যুক্ত করেন। যদিও এতে মুশরিকরা অসন্তুষ্ট হয়’’। (সূরা ফাতাহঃ ২৮)

ইসলামের গৌরবময় তিন যুগ অতিবাহিত হওয়ার পর মুসলিমদের মাঝে পুনরায় শির্কের অনুপ্রবেশ ঘটল। মুসলিমদের ঈমান ও আকীদাহ যখন দুর্বল হয়ে পড়ল তখন তাদের দুর্বলতার সুযোগে নূহ (আঃ)এর গোত্রের মধ্যে যেই পথ দিয়ে শির্ক প্রবেশ করেছিল, একই পথ দিয়েই এই উম্মতের মধ্যেও নতুনভাবে শির্ক প্রবেশ করল। অজ্ঞ মুসলিমরা সৎ লোকদেরকে নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করে এবং তাদের কবরের উপর গম্বুজ, মিনার, মসজিদ ইত্যাদি নির্মাণ করতে থাকে। মৃতদের কাছে দুআ করা, প্রয়োজন পূরণের জন্য তাদেরকে আহবান করা, তাদের জন্য পশু যবেহ করা, মানত করা এবং অন্যান্য সকল প্রকার এবাদত শুরু হয়ে যায়। মক্কা-মদীনাসহ সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে আইয়্যামে জাহেলীয়াতের শির্কের চর্চা শুরু হয়।

আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণীতে এই উম্মতকে শির্ক থেকে পবিত্র করার জন্য এবং তাদের মাঝে তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য যুগে যুগে অসংখ্য মর্দে মুজাহিদ প্রেরণ করেন। শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর সুযোগ্য শিষ্য ইমাম ইবনুল কাইয়িমের নাম এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তারা তাদের লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম জাতির মাঝে তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পথহারা অগণিত মানুষ তাওহীদের পথে ফিরে আসে।

এরই ধারাবাহিকতায় হিজরী ১২শতকে আগমণ করেন বিপ্লবী সংস্কারক শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব (রঃ)। তখন সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং এর আশপাশের অঞ্চলগুলো শির্কে ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। যৌবনে পদার্পন করে তিনি মুসলিমদের মাঝে এ সমস্ত শির্ক দেখে গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং শির্কের কবলে নিমজ্জিত মুসলিম জাতিকে তাওহীদের দিকে ফিরিয়ে আনার জন্য দাওয়াত ও সংস্কারের কাজ শুরু করেন। জোরালো ভাষণ-বক্তৃতা ও লেখনির মাধ্যমে মুসলিমদেরকে তাওহীদের দিকে আহবান জানান এবং শির্কের প্রতিবাদ করেন। তাওহীদের মাসআলাগুলোর বিস্তারিত বিবরণ এবং শির্ক-বিদআতের প্রতিবাদে অনেক মূল্যবান কিতাব রচনা করেন। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ হচ্ছে শাইখের রচিত কিতাবুত্ তাওহীদ। এতে তিনি তাওহীদে উলুহীয়াতের বিশদ বিবরণ দিয়েছেন এবং মুসলিম দেশসমূহে যে সমস্ত শির্ক-বিদআত ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়েছিল তার জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। শাইখের দাওয়াতের ফলাফল এখনো বিদ্যমান রয়েছে। তাঁর পথ ধরেই আলেমগণ যুগ যুগ ধরে মানুষকে তাওহীদের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই কিতাবটির অনুবাদ হয়েছে। হয়েছে বাংলা ভাষাতেও। কিন্তু এই কিতাবটি সংক্ষিপ্ত হওয়ার কারণে আলেমগণ এর ছোট বড় অনেক ব্যাখ্যাগ্রন্থ রচনা করেছেন। এতে লেখকের উদ্দেশ্য আরো সুস্পষ্ট হয়েছে।

যে সমস্ত মুসলিম অঞ্চল শির্ক-বিদআতের ঘোর অন্ধকারে নিমজ্জিত রয়েছে তার মধ্যে আমাদের দেশও অন্যতম। কবর ও মাজারকে কেন্দ্র করে সকল প্রকার শির্কের চর্চাই হচ্ছে এখানে। এ দেশের অধিকাংশ অধিবাসী মুসলিম হলেও তাওহীদ ও তার বিপরীত বিষয় শির্ক সম্পর্কে তাদের জ্ঞান একেবারেই নগণ্য। তাই বাংলা ভাষাতে কিতাবুত তাওহীদের পাশাপাশি ব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোরও অনুবাদ হওয়া এবং বাংলাভাষীদের মাঝে ব্যাপক প্রচার ও প্রসার হওয়া এখন সময়ের দাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।

তাই এ সব ব্যাখ্যাগ্রন্থ হতে বাংলায় অনুবাদের জন্য আমরা কিতাবুত তাওহীদের অন্যতম ব্যাখ্যাগ্রন্থ قرة عيون الموحدين নামক কিতাবটিকে বেছে নেই। এই ব্যাখ্যা গ্রন্থের লেখক হচ্ছেন শাইখেরই সুযোগ্য নাতি শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান রাহিমাহুল্লাহ।

অল্প সময়ের মধ্যে এর অনুবাদের কাজ শেষ হওয়ায় আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। পরকালে নাজাতের উপায় ও বাংলাভাষী মুসলিম ভাইদের লাইব্রেরীসমূহে সামান্য স্থান দখল করে নেয়াই এ কাজের পিছনে আমার একমাত্র লক্ষ্য।

হে আল্লাহ! তুমি এই কিতাবের লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক ও প্রকাশনার কাজে সহযোগিতাকারীদের সকলকে তোমার রহমত দ্বারা ঢেকে নাও এবং নবী, সিদ্দীক, শহীদ এবং সালেহীনদের সাথে জান্নাতুল ফিরদাউসে তাদের স্থান করে দাও। আমীন।

শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী
মোবাইল সৌদি আরবঃ +৯৬৬৫০৩০৭৬৩৯০
বাংলাদেশঃ +৮৮০১৭৩২৩২২১৫৯
ই-মেইলঃ ashahed1975@gmail.

শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী

পরিচয়, জন্ম ও প্রতিপালনঃ

তিনি হলেন শাইখুল ইসলাম ইমাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান বিন আলী বিন মুহাম্মাদ আত্ তামীমী (রঃ)। হিজরী ১১১৫ সালে তিনি নজদ অঞ্চলের উয়াইনা শহরে জন্ম গ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি স্বীয় পিতার নিকট প্রতিপালিত হন। তাঁর পিতা, চাচা এবং দাদাসহ পরিবারের অনেকেই বিজ্ঞ আলেম ছিলেন। সে হিসাবে তিনি একটি দ্বীনি পরিবেশে প্রতিপালিত হন। সে সময় শাইখের পরিবারের আলেমগণ শিক্ষকতা, ফতোয়া দান, বিচারকার্য পরিচালনা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দ্বীনি দায়িত্ব পালন করতেন। এ সমস্ত বিষয় দ্বারা সম্মানিত শাইখ শৈশব কালেই বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

শাইখের তীক্ষ্ণ মেধা ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ

তিনি উয়ায়নাতেই পিতাসহ স্বীয় পরিবারের আলেমদের থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শিশুকালেই তার মধ্যে বিরল ও অনুপম মেধার নিদর্শন পরিলক্ষিত হয়। তাঁর স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, বুঝশক্তি ছিল খুবই তীক্ষ্ণ এবং চিন্তাশক্তি ছিল খুবই গভীর। এ কারণেই তিনি অল্প বয়সেই ইলম অর্জনের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেন। শৈশব কালেই তিনি সুদৃঢ় ঈমান ও দ্বীন পালনের প্রতি বিশেষ যত্মবান ছিলেন। ছোট বেলাতেই তিনি তাফসীর, হাদীছ এবং বিজ্ঞ আলেমদের কিতাবগুলো প্রচুর অধ্যয়ন করতেন। আল্লাহর কিতাব, রাসূলের সুন্নাত এবং সালফে সালেহীনদের উক্তিসমূহই ছিল শাইখের জ্ঞান অর্জনের মূল উৎস। দর্শন, সুফীবাদ, মানতেক (ইত্যাদির সংস্পর্শ থেকে শাইখ ছিলেন সম্পূর্ণ দূরে। কারণ তিনি যেই পরিবার ও পরিবেশে প্রতিপালিত হন, তা ছিল বিকৃত শিক্ষা ব্যবস্থা, পাপাচার এবং কুসংস্কার থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত।

শাইখের যুগে আরব উপদ্বীপের অবস্থাঃ

শাইখের যুগে নজদ ও তার আশপাশের অঞ্চলে ব্যাপক আকারে শির্ক-বিদআত ও কুসংস্কার ছড়িয়ে পড়ে। আইয়্যামে জাহেলীয়াতের সকল প্রকার শির্ক যেন পুনরায় আরব উপদ্বীপে নতুন পোষাকে প্রবেশ করে। গাছ, পাথর, কবর এবং অলী-আওলীয়ার এবাদত শুরু হয়। এ দৃশ্য দেখে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন এবং এ অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সুদৃঢ় পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

শাইখের চারিত্রিক গুণাবলীঃ

আমানতদারী, সত্যবাদিতা, মানুষের প্রতি দয়া-অনুগ্রহ, দানশীলতা, ধৈর্যশীলতা, দূরদর্শিতা, দৃঢ়তাসহ তার মধ্যে আরো এমনসব চারিত্রিক উন্নত ও বিরল গুণাবলীর সমাহার ঘটেছিল, যা তাকে নেতৃত্বের আসনে আসীন করে। ইতিহাসে যে সব মহাপুরুষ স্বীয় কর্মের মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন তাদের খুব অল্প সংখ্যক লোকের মধ্যেই এসব চারিত্রিক গুণাবলী বিদ্যমান ছিল। শিক্ষার্থীদের জন্য তিনি খুব বিনয়ী ছিলেন, ভিক্ষুক ও অভাবীদের প্রয়োজন পূরণে বিশেষ তৎপর ছিলেন।

তাঁর বিরোধীরা তাঁর বিরুদ্ধে কঠোরতা, অজ্ঞতা এবং দ্বীন পালনে দুর্বলতা ইত্যাদি যেসব অভিযোগ করে থাকে, শাইখ ছিলেন তার সম্পূর্ণ বিপরীত।

উচ্চ শিক্ষা ও ভ্রমণঃ

উয়ায়নার আলেমদের কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ সমাপ্ত করার পর তিনি উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণের জন্য হিজায ও সিরিয়া ভ্রমণ করেন। যৌবনে পদার্পন করে তিনি হজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ গমণ করেন। হজ্জ শেষে মদীনায় গিয়ে তিনি শাইখ আব্দুল্লাহ বিন ইবরাহীম বিন সাইফ নামক প্রখ্যাত আলেমের নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ হায়াত সিন্ধির নিকট ইলমে হাদীছের জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি ইরাকের বসরায় গমণ করেন এবং সেখানকার শাইখ মাজমুয়ীর নিকট তাওহীদ ও অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে থাকেন। সেখানে থাকা অবস্থাতেই তিনি শির্ক ও বিদআত বিরোধী প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করেন। ফলে বসরার বিক্ষুদ্ধ বিদআতীরা তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেয়।

উয়াইনায় ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস এবং দাওয়াতী কাজে মনোনিবেশঃ

ইরাক থেকে ফিরে এসে শাইখ নিজ জন্মস্থান উয়ায়নায় বসবাস করতে থাকেন। তখন উয়ায়নার শাসক ছিলেন উছমান বিন মুহাম্মাদ বিন মুআম্মার। তিনি উছমানের নিকট গেলেন। উছমান শাইখকে স্বাগত জানিয়ে বললেনঃ আপনি আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিতে থাকুন। আমরা আপনার সাথে থাকবো এবং আপনাকে সাহায্য করবো। উছমান আরো বেশ কিছু ভালো কথা শুনালেন, শাইখের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করলেন এবং তাঁর দাওয়াতের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করলেন।

আমীর উছমানের আশ্বাস পেয়ে শাইখ মানুষকে আল্লাহর দ্বীন শিক্ষা দান, সৎ কাজের আদেশ, অসৎ কাজের নিষেধ করাসহ কল্যাণের দিকে আহবান করতে থাকলেন। শাইখের দাওয়াত উয়ায়নার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে পার্শ্ববর্তী সকল গ্রামের মানুষ শাইখের কাছে আসতে থাকলো এবং নিজেদের ভুল আকীদাহ বর্জন করে শাইখের দাওয়াত কবুল করতে লাগল।

ঐ সময় জুবাইলা নামক স্থানে যায়েদ বিন খাত্তাব নামে একটি মিনার ছিল। যায়েদ বিন খাত্তাব ছিলেন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুর ভাই। তিনি মিথ্যুক নবী মুসায়লামার বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযানে শাহাদাত বরণ করেছিলেন। পরবর্তীতে অজ্ঞাত পরিচয়ের লোকেরা তার কবরের উপর গম্বুজ তৈরী করে। কালক্রমে তা এক দেবতা মন্দিরে পরিণত হয়। এতে বিভিন্ন ধরণের মানত পেশ করা হতো এবং কাবা ঘরের ন্যায় তাওয়াফও করা হতো। সেখানে আরো অনেক কবর ছিল। আশপাশের গাছপালারও এবাদত হতো।

একদা শাইখ আমীর উছমানকে বললেনঃ চলুন আমরা যায়েদ বিন খাত্তাবের কবরের উপর নির্মিত গম্বুজটি ভেঙ্গে ফেলি। কেননা এটি অন্যায়ভাবে এবং বিনা দলীলে নির্মাণ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা এই কাজের প্রতি কখনই সন্তুষ্ট হবেন না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কবরের উপর কোন কিছু নির্মাণ করতে এবং কবরকে মসজিদে পরিণত করতে নিষেধ করেছেন। এই গম্বুজটি মানুষকে গোমরাহ করছে, মানুষের আকীদাহ পরিবর্তন করছে এবং এর মাধ্যমে নানা রকম শির্ক হচ্ছে। সুতরাং এটি ভেঙ্গে ফেলা আবশ্যক।

আমীর উছমান বললেনঃ এতে কোন অসুবিধা নেই। অতঃপর উছমান বিন মুআম্মার গম্বুজটি ভাঙ্গার জন্য ৬০০ সৈনিকের একটি বাহিনী নিয়ে বের হলেন। শাইখও তাদের সাথে ছিলেন।

উছমানের বাহিনী যখন জুবাইলিয়ার নিকটবর্তী হলো এবং জুবাইলিয়ার অধিবাসীরা জানতে পারলো যে, যায়েদ বিন খাত্তাবের মিনার ভাঙ্গার জন্য একদল লোক আগমণ করেছে তখন তারা গম্বুজটি রক্ষা করার জন্য বের হলো। কিন্তু আমীর উছমান এবং তাঁর সৈনিককে দেখে তারা ফিরে গেল। উছমানের সৈনিকরা গম্বুজটি গুড়িয়ে দিল। শাইখের প্রচেষ্টায় এই মিনারটি ভেঙ্গে ফেলা হয় এবং তিনি নিজেও ভাঙ্গার কাজে অংশ নেন।

আলহামদুলিল্লাহ। চিরতরে শির্কের একটি আস্তানা বিলুপ্ত হলো। এমনিভাবে শির্কের আরো অনেক আস্তানা আল্লাহ তাআলা সম্মানিত শাইখের মাধ্যমে বিলুপ্ত করলেন।

ব্যভিচারের শাস্তি কায়েমঃ

উয়ায়নাতে অবস্থানকালে এক মহিলা একদিন তাঁর কাছে এসে স্বেচ্ছায় ও স্বজ্ঞানে ব্যভিচারের অপরাধ স্বীকার করে বিচার প্রার্থনা করে। মহিলাটির অবস্থা স্বাভাবিক কি না, তা জানার জন্য তিনি লোকদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন, মহিলাটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং তার মাথায় কোন পাগলামী নেই, তখন মহিলাটিকে বললেনঃ সম্ভবতঃ জবরদস্তি করে তোমার সাথে এই অপকর্ম করা হয়েছে। সুতরাং তোমার বিচার প্রার্থনা করার দরকার নেই। অবশেষে মহিলাটি জোর দাবী জানালে এবং বার বার স্বীকার করতে থাকলে শায়েখের নির্দেশে লোকেরা পাথর মেরে মহিলাটিকে হত্যা করে ফেলে।

উয়ায়নাতে উছমান বিন মুআম্মারের সহযোগিতায় ও সমর্থনে শাইখের সংস্কার আন্দোলন যখন পুরোদমে চলতে থাকে, তখন আহসার শাসক সুলায়মান বিন আব্দুল আযীযের কাছে এই খবর পৌঁছে গেল। শাইখের বিরোধীরা সুলায়মানকে জানিয়ে দিল যে, শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নামে এক ব্যক্তি কবরের উপর নির্মিত গম্বুজগুলো ভেঙে ফেলছে এবং ব্যভিচারের শাস্তিও কায়েম করছে। আহসার আমীর এতে রাগান্বিত হলো এবং সে উয়ায়নার আমীর উছমানকে এই মর্মে পত্র লিখলো যে, আপনি অবশ্যই এই লোকটিকে হত্যা করবেন। অন্যথায় আমরা আপনাকে টেক্স দেয়া বন্ধ করে দিবো।

উল্লেখ্য যে, আহসার এই গ্রাম্য অশিক্ষিত শাসক উছমানকে বিরাট অংকের টেক্স প্রদান করতো। তাই উছমান পত্রের বিষয়টিকে খুব বড় মনে করলেন এবং এই আশঙ্কা করলেন যে, শাইখের দাওয়াতের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখলে আহসার খিরাজ বন্ধ হয়ে যাবে এবং তাদের পক্ষ হতে বিদ্রোহ ও যুদ্ধ ঘোষণারও ভয় রয়েছে।

তাই তিনি শাইখকে পত্রের বিষয় অবগত করলেন এবং বললেনঃ আহসার শাসকের পত্র মুতাবেক আমরা আপনাকে হত্যা করা সমীচিন মনে করছিনা। আপনাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করাও এখন থেকে আর সম্ভব হবেনা। কারণ আমরা আহসার শাসক সুলায়মানকে খুব ভয় করছি। আমরা তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও সক্ষম নই। সুতরাং আপনি যদি আমাদের কল্যাণ ও আপনার নিজের কল্যাণ চান, তাহলে আমাদের নিকট থেকে চলে যান।

শাইখ তখন বললেনঃ আমি যেই বিষয়ের দিকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা তো আল্লাহর দ্বীন। এটিই তো কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-এর দাবী। যে ব্যক্তি এই দ্বীনকে মজবুতভাবে ধারণ করবে, একে সাহায্য করবে এবং দৃঢ়তার সাথে এই দ্বীনের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকবে, আল্লাহ তাআলা তাকে সাহায্য করবেন এবং তাঁর শত্রুদের উপর তাকে বিজয় দান করবেন। সুতরাং আপনি যদি ধৈর্য ধারণ করেন এবং দ্বীনের উপর অটল থাকেন এবং এই দাওয়াতের প্রতি সাহায্য ও সমর্থন অব্যাহত রাখেন, তাহলে আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ আপনাকে অচিরেই বিজয় দান করবেন এবং এই গ্রাম্য যালেম শাসক ও তার বাহিনী থেকে আপনাকে রক্ষা করবেন। সেই সাথে আল্লাহ আপনাকে তার অঞ্চল ও তার গোত্রের শাসনভার আপনার হাতেই সোপর্দ করবেন।

এতে উছমান বললেনঃ হে সম্মানিত শাইখ! তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার শক্তি আমাদের নেই এবং তার বিরোধীতা করার মত ধৈর্যও আমাদের নেই।

দিরিয়ায় হিজরত এবং দিরিয়ার আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের সাথে সাক্ষাতঃ

পরিশেষে উছমান বিন মুআম্মারের অনুরোধে বাধ্য হয়ে শাইখ উয়ায়না থেকে বেরিয়ে পড়লেন। উয়ায়না ছেড়ে তিনি দিরিয়ায় হিজরত করলেন। বলা হয়ে থাকে যে, বের হওয়ার সময় শাইখ পায়ে হেঁটে বের হন। কারণ উছমান শাইখের জন্য কোন বাহনের ব্যবস্থা করেন নি। তাই সকাল বেলা বের হয়ে সারাদিন পায়ে হেঁটে বিকাল বেলা দিরিয়ায় গিয়ে পৌঁছেন। দিরিয়ায় পৌঁছে তিনি একজন ভাল মানুষের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তার নাম মুহাম্মাদ বিন সুয়াইলিম আল উরায়নী। এই লোকটি শাইখকে একদিকে যেমন আশ্রয় দিলেন, অন্যদিকে আমীর মুহাম্মাদের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্তও হয়ে পড়লেন। কিন্তু শাইখ তাকে এই বলে শান্ত করলেন যে, আমি যেদিকে মানুষকে দাওয়াত দিচ্ছি, তা হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। অচিরেই আল্লাহ তাআলা এই দ্বীনকে বিজয়ী করবেন। যাই হোক আমীর মুহাম্মাদের কাছে শাইখের খবর পৌঁছে গেল।

ইতিহাসে বলা হয় যে, একদল ভাল লোক প্রথমে আমীরের স্ত্রীর কাছে গিয়ে শাইখের দাওয়াতের বিষয়টি বুঝিয়ে বললেন। আমীরের স্ত্রী ছিলেন একজন ভাল ও দ্বীনদার মহিলা। তারা আমীরের স্ত্রীকে বললেনঃ আপনার স্বামী মুহাম্মাদকে বলুন, তিনি যেন শাইখের দাওয়াত কবুল করেন এবং তাকে সাহায্য ও সহযোগিতা করেন।

অতঃপর যখন আমীর মুহাম্মাদ বাড়িতে আসলেন, তখন আমীরের স্ত্রী তাকে বললেনঃ আপনার অঞ্চলে বিরাট এক গণীমত আগমণ করেছে। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন। আল্লাহ তাআলা নিজেই আপনার নিকট এই গণীমত পাঠিয়েছেন। আপনার এলাকায় এমন একজন লোক আগমণ করেছেন, যিনি আল্লাহর দ্বীনের দিকে মানুষকে আহবান করেন এবং আল্লাহর কিতাব ও রাসূলের সুন্নাতের দিকে দাওয়াত দেন। কত সুন্দর এই গণীমত! সুতরাং আপনি দ্রুত তাকে কবুল করে নিন এবং তাকে সাহায্য করুন। খবরদার! আপনি কখনই এ থেকে পিছপা হবেন না।

আমীর মুহাম্মাদ তাঁর স্ত্রীর এই মূল্যবান পরামর্শ গ্রহণ করলেন। অতঃপর তিনি ইতস্তঃবোধ করছিলেন এই ভেবে যে তিনি নিজেই শাইখের কাছে যাবেন? না শাইখকে নিজের কাছে ডেকে আনবেন? এবারও তাঁর স্ত্রী তাকে বুঝিয়ে দিলেন যে, শাইখকে আপনার কাছে ডেকে আনা ঠিক হবেনা। বরং শাইখ যেখানে অবস্থান করছেন, আপনারই সেখানে যাওয়া উচিৎ। কেননা ইলম এবং দ্বীনের দাঈর সম্মানকে সমুন্নত রাখার স্বার্থেই তা করা বাঞ্চনীয়। আমীর মুহাম্মাদ এবারও তার স্ত্রীর পরামর্শ কবুল করে নিলেন।

আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদ তাঁকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য মুহাম্মাদ বিন সুওয়াইলিমের বাড়িতে গেলেন। সেখানে গিয়ে শাইখকে সালাম দিলেন এবং তাঁর সাথে আলোচনা করলেন। পরিশেষে তিনি বললেনঃ হে শাইখ! আপনি সাহায্যের সুসংবাদ গ্রহণ করুন, নিরাপত্তার সুসংবাদ গ্রহণ করুন এবং সর্ব প্রকার সহযোগিতারও সুসংবাদ গ্রহণ করুন।

জবাবে শাইখও আমীরকে আল্লাহর সাহায্য, বিজয়, প্রতিষ্ঠা এবং শুভ পরিণামের সুসংবাদ প্রদান করলেন। শাইখ আরো বললেনঃ এটি হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। যে ব্যক্তি আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করবে, আল্লাহও তাকে সাহায্য করবেন, শক্তিশালী করবেন। অচিরেই আপনি এর ফল দেখতে পাবেন।

অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ বললেনঃ হে শাইখ! আমি আপনার হাতে আল্লাহ ও আল্লাহর দ্বীনের উপর অটুট থাকার এবং আল্লাহর পথে জিহাদ করার বায়আত করবো। তবে আমার আশঙ্কা হচ্ছে আমরা যখন আপনাকে সমর্থন করবো, আপনাকে সাহায্য করবো এবং আল্লাহ তাআলা যখন শত্রুদের উপর আপনাকে বিজয় দান করবেন, তখন আপনি আমাদের দেশ ছেড়ে অন্যত্র চলে যান কি না।

শাইখ জবাবে বললেনঃ এমনটি কখনই হবেনা। আপনাদের রক্ত আমারই রক্ত, আপনাদের ধ্বংস আমারই ধ্বংস। আপনার শহর ছেড়ে আমি কখনই অন্যত্র চলে যাবোনা।

অতঃপর আমীর মুহাম্মাদ শাইখকে সাহায্য করার বায়আত করলেন এবং শাইখও অঙ্গিকার করলেন যে, তিনি আমীরের দেশেই থাকবেন এবং আমীরের সহযোগী হিসাবেই কাজ করবেন ও আল্লাহর দ্বীনের বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করবেন। এভাবেই ঐতিহাসিক বায়আত সম্পন্ন হলো।

শাইখের দাওয়াতের নতুন যুগঃ

এভাবে শাইখের দাওয়াত এক নতুন যুগে প্রবেশ করল। দিরিয়ার আমীরের সর্বপ্রকার সাহায্য-সহযোগিতা করার অঙ্গিকার পেয়ে শাইখ নতুন গতিতে নির্ভয়ে দাওয়াতী কাজ শুরু করলেন। প্রত্যেক অঞ্চল থেকে দলে দলে লোকেরা দিরিয়ায় আসতে লাগল। শাইখ সম্মান ও ইজ্জতের সাথে এখানে বসবাস করতে লাগলেন এবং তাফসীর, হাদীছ, আকীদাহ, ফিক্হসহ দ্বীনের বিভিন্ন বিষয়ে দার্স দানে মশগুল হয়ে পড়লেন। নিয়মিত দারস্ দানের পাশাপশি সমর্থক ও সাথীদেরকে নিয়ে বিভিন্ন স্থান থেকে শির্কের আস্তানা গুড়িয়ে দিতে থাকেন এবং যেসব মাজারে মানত স্বরূপ হাদীয়া-তোহফা পেশ করা হতো তা একের পর এক উচ্ছেদ করতে থাকেন।

শাইখ যখন দিরিয়ায় আসলেন তখন জানতে পারলেন যে, সেখানে এমন একটি পুরুষ খেজুর গাছ রয়েছে, যাকে الفحل ফাহল বা ফাহ্হাল বলা হতো। এই খেজুর গাছের ব্যাপারে তাদের ধারণা ছিল, কোন মহিলার বিয়ে হতে দেরী হলে কিংবা তাকে বিয়ের জন্য কেউ প্রস্তাব না দিলে সে এই খেজুর গাছটিকে জড়িয়ে ধরত এবং বলতোঃ

يا أفحل الفحول أريد زوجا قبل الحول

হে সকল ষাঁড়ের সেরা ষাঁড়! বছর পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই তোমার কাছে একজন স্বামী চাই। তাদের ধারণা ছিল, এভাবে এ গাছকে জড়িয়ে ধরলে অবিবাহিত মহিলাদের দ্রুত বিবাহ সম্পন্ন হতো এবং বিয়ে হয়ে গেলে তারা এ গাছকেই বিয়ে হওয়ার কারণ মনে করতো। তাদের মুর্খতা এতদূর গিয়ে পৌঁছল যে, কোন মহিলা গাছটিকে জড়িয়ে ধরার পর যখন তার বিয়ের প্রস্তাব আসতো, তখন তারা বলতোঃ তোমাকে এই গাছটি সাহায্য করেছে। অতঃপর শাইখের আদেশে গাছটিকে কেটে ফেলা হয়। আল্লাহ তাআলা শির্কের এ মাধ্যমটিকে চিরতরে মিটিয়ে দিলেন।

এভাবেই আল্লাহ তাআলা শাইখের দাওয়াতকে দিরিয়াতে সফলতা দান করলেন। পরবর্তীতে সমগ্র আরব উপদ্বীপ এবং পার্শ্ববর্তী আরব দেশসমূহ এবং সারা বিশ্বে এ দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল।

আল্লাহ তাআলা তাঁর অন্তরকে তাওহীদের জ্ঞান অর্জন ও তা বাস্তবায়নের জন্য উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। সেই সাথে যেসব বিষয় তাওহীদের বিপরীত এবং যা মানুষের তাওহীদকে নষ্ট করে দেয় সেসব বিষয় সম্পর্কেও শাইখ গভীর পারদর্শিতা অর্জন করেন।

শাইখ তাওহীদের দাওয়াতকে পুনরুজ্জিবীত করার জন্য সুদৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং নবী-রাসূলদের দাওয়াতের মূল বিষয় তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের দাওয়াত শুরু করেন এবং শির্ক ও বিদআতের প্রতিবাদ করেন। তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার পাশাপাশি তাঁর একাধিক ইলমী মজলিস ছিল। প্রতিদিন তিনি তাওহীদ, তাফসীর, ফিকাহ এবং অন্যান্য বিষয়ে একাধিক দারস্ প্রদান করতেন। আল্লাহ তাআলা তাঁর দাওয়াতের মধ্যে বরকত দান করলেন। ফলে আরব উপদ্বীপের লোকেরা তাঁর দাওয়াত কবুল করে শির্ক, বিদআত ও কুসংস্কারের অন্ধকার পরিহার করে তাওহীদের আলোর দিকে ফিরে আসলো। তাঁর বরকতময় দাওয়াত অল্প সময়ের মধ্যেই আরব উপদ্বীপের সীমা পার হয়ে ইরাক, মিশর, সিরিয়া, মরোক্ক, ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর সকল অঞ্চলেই পৌঁছে যায়। ফলে তিনি ১২শ শতকের মুজাদ্দেদ উপাধিতে ভূষিত হন।

সে সময়ের দিরিয়ার শাসক সম্প্রদায়ও শাইখের দাওয়াতকে কবুল করে নেন এবং সাহায্য করেন। এতে শাইখের দাওয়াত নতুন গতি পেয়ে দ্রুত প্রসারিত হতে থাকে। বর্তমানে সৌদি আরবসহ সারা বিশ্বে তাওহীদের যেই দাওয়াত চলছে, তা শাইখের দাওয়াতের ফল ও হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আল্লাহ যেন এই দাওয়াকে কিয়ামত পর্যন্ত চালু রাখেন। আমীন।

শাইখের দাওয়াতের মূলনীতিঃ

পরিশুদ্ধ ইসলামী মানহাজ এবং দ্বীনের সঠিক মূলনীতির উপর শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত ছিল। এই দাওয়াতের মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, এবাদতকে একমাত্র আল্লাহর জন্য খালেস করা, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করা। এই লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে যে সমস্ত মূলনীতির ভিত্তিতে শাইখের দাওয়াতী কাজ পরিচালিত হতো, নিম্নে তা থেকে কয়েকটি মূলনীতি উল্লেখ করা হলোঃ

১) মানুষের অন্তরে তাওহীদের শিক্ষা বদ্ধমূল করা এবং শির্ক ও বিদআতের মূলোৎপাটন করা। মুসলিমদের অন্তরে এই মূলনীতিকে সুদৃঢ় করার জন্যই তিনি প্রয়োজন পূরণের আশায় কবর যিয়ারত করা, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, কিছু চাওয়া, রোগমুক্তি ও বিপদাপদ থেকে উদ্ধার লাভের আশায় তাবীজ ঝুলানো, গাছ ও পাথর থেকে বরকত গ্রহণ করা, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের সন্তুষ্টির জন্য পশু যবেহ করা, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের জন্য মানত করা, আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে আশ্রয় চাওয়া, কবর পূজা করা, আল্লাহ ও বান্দার মাঝে উসীলা নির্ধারণ করা এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়ার কাছে শাফাআত চাওয়াসহ যাবতীয় শির্ক বর্জন করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছেন।

২) নামায কায়েম করা, সৎকাজের আদেশ, অসৎকাজের নিষেধ, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করাসহ দ্বীনের অন্যান্য নিদর্শন এবং আচার-অনুষ্ঠানগুলো পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

৩) সমাজে ন্যায় বিচার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করা এবং আল্লাহর নির্ধারিত দন্ডবিধি কায়েম করা।

৪) তাওহীদ, সুন্নাহ, ঐক্য, সংহতি, সম্ভ্রম রক্ষা, নিরাপত্তা এবং ন্যায় বিচারকে মূলভিত্তি করে একটি ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।

যে সমস্ত অঞ্চলে শাইখের দাওয়াত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং আরব উপদ্বীপের যেই এলাকাগুলো এই দাওয়াতের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত হয়েছে, সেখানে উপরোক্ত মূলনীতিগুলোর সবই বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সংস্কার আন্দোলনের পতাকাবাহী সৌদি আরবের প্রতিটি অঞ্চলেই এর প্রভাব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হয়েছে। এই দাওয়াত যেখানেই প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ, ঈমান, সুন্নাত, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রবেশ করেছে। ফলে আল্লাহ তাআলার ওয়াদা ও অঙ্গিকার বাস্তবায়িত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَعَدَ اللَّهُ الَّذِينَ آَمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا يَعْبُدُونَنِي لَا يُشْرِكُونَ بِي شَيْئًا وَمَنْ كَفَرَ بَعْدَ ذَلِكَ فَأُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُون

‘‘তোমাদের মধ্যে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ্ তাদেরকে ওয়াদা দিয়েছেন যে, তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করবেন। যেমন তিনি প্রতিষ্ঠা দান করেছেন তাদের পূর্ববর্তীদেরকে এবং তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের সেই দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য পছন্দ করেছেন এবং তাদের ভয়-ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার এবাদত করবে এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারাই ফাসেক’’। (সূরা হজ্জঃ ৫৫)

وَلَيَنْصُرَنَّ اللَّهُ مَنْ يَنْصُرُهُ إِنَّ اللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ (40) الَّذِينَ إِنْ مَكَّنَّاهُمْ فِي الْأَرْضِ أَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآَتَوُا الزَّكَاةَ وَأَمَرُوا بِالْمَعْرُوفِ وَنَهَوْا عَنِ الْمُنْكَرِ وَلِلَّهِ عَاقِبَةُ الْأُمُورِ

‘‘যারা আল্লাহ্কে সাহায্য করে, আল্লাহ্ নিশ্চয়ই তাদেরকে সাহায্য করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী শক্তিধর। তারা এমন লোক যাদেরকে আমি পৃথিবীতে শক্তি-সামর্থ্য দান করলে নামায কায়েম করবে, যাকাত দেবে এবং সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ করবে। আর সমস্ত বিষয়ের পরিণাম আল্লাহ্‌র হাতে’’। (সূরা নূরঃ ৪০-৪১)

শাইখের বিরোধীতা ও তার উপর মিথ্যাচারঃ

সত্যের অনুসারী এবং সত্যের পথে যারা আহবান করেন, তারা কোন যুগেই বাতিলপন্থীদের হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা ও তাদের আক্রমণ থেকে রেহাই পান নি। যেমন রেহাই পান নি আল্লাহর সর্বশ্রেষ্ঠ বান্দা নবী-রাসূলগণ। আমাদের সম্মানিত শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) যখন সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন এবং সাহসিকতা ও বলিষ্ঠতার সাথে শির্ক, বিদআত ও দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক কুসংস্কারের প্রতিবাদ শুরু করেন, তখন বিদআতী আলেমগণ তাঁর ঘোর বিরোধীতা শুরু করে। তাঁর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ উত্থাপন করে। এমনকি এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী লোক সমসাময়িক শাসকদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতেও দ্বিধাবোধ করেনি। তাঁকে একাধিকবার হত্যা করারও ষড়যন্ত্র করা হয়। কিন্তু বিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়। আল্লাহর ইচ্ছা অতঃপর শাইখের সৎসাহস ও নিরলস কর্ম তৎপরতার মুকাবেলায় বিরোধীদের সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয় এবং আল্লাহর দ্বীন ও তাওহীদের দাওয়াতই বিজয় লাভ করে।

বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতই বাংলাদেশসহ ভারত বর্ষে যে সমস্ত আলেম ও দাঈ সহীহ আকীদাহ ও আমলের দাওয়াত দিয়ে যাচ্ছেন, অতীতের ন্যায় তারাও বিরোধীদের নানা রকম অপবাদ ও অভিযোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। এই বরকতময় দাওয়াত থেকে মানুষকে দূরে রাখার জন্য এক শ্রেণীর লোক সহীহ আকীদার অনুসারীদেরকে ওয়াহাবী এবং নির্ভেজাল তাওহীদের দাওয়াতকে ওয়াহাবী আন্দোলন বলে গালি দেয়াসহ নানা অপবাদ দিয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও আল্লাহ তাআলার অশেষ মেহেরবাণীতে এবং দ্বীনের মুখলিস আলেম ও দাঈদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ন্যায় বাংলাদেশসহ ভারত বর্ষের প্রত্যেক অঞ্চলেই এ দাওয়াতের প্রভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। আগামী দিনগুলোতে ব্যাপক হারে এই দাওয়াতের সাথে আমাদের দেশের লোকেরা সম্পৃক্ত হবে, আমাদের সামনে এই লক্ষণ অতি সুস্পষ্ট।

শাইখের বিরুদ্ধে কতিপয় অভিযোগ ও তার জবাবঃ

বিদআতীদের পক্ষ হতে শাইখের বিরুদ্ধে সেসময় অনেকগুলো অভিযোগ পেশ করা হতো। সম্ভবতঃ বর্তমান কালেও তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলো ছাড়া অন্য কোন অভিযোগ খুঁজে পাওয়া যাবেনা। শাইখের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো নিম্নরূপঃ

১) শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহাব অলী-আওলীয়াদের কবরে মানত পেশ করা ও কবরকে সম্মান করা এবং কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা বন্ধ করে দিয়েছেন।

২) আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে পশু যবেহ করা হারাম করেছেন।

৩) আল্লাহ ছাড়া অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়া, শাফাআত চাওয়া এবং অলী-আওলীয়াদের উসীলা ধরাকে হারাম করেছেন।

৪) শাইখ নিজ মতের বিরোধীদের সাথে যুদ্ধ করেছেন এবং অন্যায়ভাবে তাদেরকে হত্যা করেছেন। এমনি আরো অনেক অভিযোগ শাইখের বিরুদ্ধে উত্থাপিত হয়ে থাকে।

আসলে এগুলো কোন অভিযোগের আওতায় পড়েনা। এগুলো এমন বিষয়, যা কুরআন ও হাদীছের সুস্পষ্ট দলীল দ্বারাই হারাম করা হয়েছে। তাঁর পূর্বে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং তাঁর ছাত্র ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম রাহিমাহুল্লাহ এ ধরণের শির্ক-বিদআতের জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। ইসলামের মৌলিক বিষয় সম্পর্কে যার সামান্য জ্ঞান রয়েছে সেও বুঝতে সক্ষম হবে যে, উপরোক্ত বিষয়গুলোর সাথে ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। দ্বীনের সঠিক শিক্ষা না থাকার কারণে, তাওহীদের আলো নিভে যাওয়ার সুযোগে এবং সর্বত্র মুর্খতা ও পাপাচার ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে মুসলিম সমাজে উক্ত কুসংস্কার গুলোও ঢুকে পড়েছিল। উক্ত কাজগুলো ইসলামী শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক হওয়ার কারণে এবং তাওহীদের সরাসরি বিরোধী হওয়ার কারণে শাইখ মুসলিমদেরকে সঠিক দ্বীনের দিকে ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। এটি শুধু তার একার দায়িত্ব ছিলনা; বরং সকল আলেমেরই এই দায়িত্ব ছিল। তাই শাইখের দাওয়াত ছিল সম্পূর্ণ তাওহীদ ও সুন্নাহ ভিত্তিক। এটি ছিল একটি সংস্কার আন্দোলন।

তাঁর বিরুদ্ধে ওয়াহাবী মাযহাব নামে পঞ্চম মাযহাব তৈরীর অভিযোগও পেশ করা হয়ে থাকে। এ অভিযোগটিও ভিত্তিহীন। শাইখ কোন মাযহাব তৈরী করেন নি; বরং মুসলিমদেরকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে আহবান জানিয়েছেন। তা ছাড়া তাঁর কিতাবাদি পড়লে বুঝা যায় দ্বীনের শাখা ও ফিকহী মাসায়েলের ক্ষেত্রে হান্বালী মাযহাবের প্রতি তাঁর ঝোঁক ছিল। তবে তিনি মাযহাবী গোঁড়ামির সম্পূর্ণ উর্ধ্বে ছিলেন।

শাইখের বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ করা হয় যে, তিনি বিরোধীদেরকে হত্যা করেছেন। এই অভিযোগটিও সঠিক নয়। কারণ যারা তার বিরুদ্ধে তথা তাওহীদের দাওয়াতের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছে, তিনি কেবল তাদের বিরুদ্ধেই জিহাদ করেছেন। তাঁর জিহাদ ছিল শরঈ জিহাদ। সুতরাং যারা সত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে নিহত হয়েছে, তাদেরকে তিনি অন্যায়ভাবে হত্যা করেছেন, -এই অভিযোগ সঠিক নয়।

অনেকে তাকে হাদিছে বর্ণিত ‘নাজদ’এর ফিতনা বলে আখ্যায়িত করে থাকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ হে আল্লাহ! তুমি আমাদের শাম এবং ইয়ামানে বরকত দান করো। সকলেই তখন বললঃ আর আমাদের নাজদে? তিনি বললেন, ওখান থেকে শয়তানের শিং উদিত হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

হাদীছের ভাষ্য জগতের বিরল প্রতিভা হাফেয ইবনে হাজার আস্কালানীসহ অন্যান্য আলেমগণ বলেনঃ হাদিছে উল্লেখিত নাজদ হল ইরাকের নাজদ শহর। আর ইরাকেই বড় বড় ফিতনা দেখা দিয়েছে। আলী এবং হুসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহুর যুগ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত ইরাক শান্ত হয়নি। সেখানকার ফিতনার কারণেই আলী রাযিয়াল্লাহু আনহু কুফায় এবং হোসাইন রাযিয়াল্লাহু আনহু কারবালায় শাহাদাত বরণ করেন। হেজাযের নাজদে কোন ফিতনাই দেখা যায়নি। যেমনটি ইরাকে দেখা দিয়েছে। সুতরাং হেজাযের নাজদ থেকে শাইখের যেই তাওহীদি দাওয়াত প্রকাশিত হয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে, তা ছিল নাবী-রাসূলদেরই দাওয়াত। সুতরাং সুস্পষ্ট বিদআতী আর অন্ধ ছাড়া কেউ এই দাওয়াতকে নাজদের ফিতনা বলতে পারেনা।

শাইখের দাওয়াতের ফলাফলঃ

শাইখের বরকতময় দাওয়াতের ফলে আরব উপদ্বীপসহ পৃথিবীর বহু অঞ্চল থেকে শির্ক-বিদআত ও দ্বীনের নামে নানা কুসংস্কার উচ্ছেদ হয়। যেখানেই এই দাওয়াত প্রবেশ করেছে, সেখানেই তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং হকপন্থীগণ সম্মানিত হয়েছেন। হাজীগণ সারা বিশ্ব হতে মক্কা ও মদীনায় আগমণ করে শাইখের দাওয়াত পেয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে গিয়ে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার করতে থাকেন। বাদশাহ আব্দুল আযীযের যুগে সুবিশাল সৌদি আরব তাওহীদের এ দাওয়াতের উপরই প্রতিষ্ঠিত হয়। আজ এই দাওয়াতের ফল ভোগ করছেন সৌদি রাজ পরিবার ও তার জনগণসহ মুসলিম বিশ্বের বহু সংখ্যক জ্ঞানী, গুণী বিপুল সংখ্যক জনসাধারণ। বিশ্বের যেখানেই কুরআন, সুন্নাহ এবং সহীহ আকীদার দাওয়াত ও শির্ক-বিদআতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চলছে, তা শাইখের এই বরকতময় দাওয়াতেরই ফসল। হে আল্লাহ! তুমি কিয়ামত পর্যন্ত তাওহীদের এই দাওয়াতকে সমুন্নত রাখো। আমীন।

শাইখের ছাত্রগণঃ

তাঁর নিকট থেকে অগণিত লোক তাওহীদ ও দ্বীনের অন্যান্য বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেছেন।

তাদের মধ্যেঃ

১) শাইখের চার ছেলে হাসান, আব্দুল্লাহ্, আলী এবং ইবরাহীম। তাদের প্রত্যেকেই ইসলামী শরীয়তের বিভিন্ন বিষয়ে গভীর পান্ডিত্য অর্জন করেছিলেন।

২) তাঁর নাতী শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান।

৩) শাইখ আহমাদ বিন নাসের বিন উছমান এবং আরো অনেকেই।

শাইখের ইলমী খেদমতঃ

শাইখের রয়েছে ছোট বড় অনেকগুলো সুপ্রসিদ্ধ কিতাব। তার মধ্যে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ ও আলোচিত হচ্ছে এই কিতাবুত্ তাওহীদ। শাইখের আরো যেসমস্ত গ্রন্থ রয়েছে, তার মধ্যেঃ

(১) কাশফুস শুবুহাত।

(২) আল উসূলুস ছালাছাহ ওয়া আদিল্লাতুহা।

(৩) উসূলুল ঈমান।

(৪) তাফসীরুল ফাতিহা।

(৫) মাসায়িলুল জাহেলিয়াহ।

(৬) মুখতাসার যাদুল মাআদ

(৭) মুখতাসার সিরাতুর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রভৃতি।

শাইখের মৃত্যুঃ

হিজরী ১২০৬ সালের যুল-কাদ মাসের শেষ তারিখে ৯১ বছর বয়সে শাইখ দিরিয়ায় মৃত্যু বরণ করেন। হে আল্লাহ! তুমি শাইখকে তোমার প্রশস্ত রহমত দ্বারা আচ্ছাদিত করে নাও। আমাদেরসহ তাঁকে নবী, সিদ্দীকীন, শহীদ এবং সালেহীনদের সাথে জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দাও। আমীন।

ব্যাখ্যাঃ ভাষ্যকার বলেনঃ গ্রন্থকার ‘বিস্মিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ দ্বারা কিতাবুত্ তাওহীদ লিখা শুরু করেছেন। তিনি আরো বলেনঃ কিতাবুত তাওহীদের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাতহুল মাজীদে’ আমি বিস্মিল্লাহ্-এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা করেছি। বিসমিল্লাহ্-এর মাধ্যমে সকল কাজ-কর্ম শুরু করা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পবিত্র সুন্নাতের অন্তর্ভূক্ত। সুন্নাতের অনুসরণ করেই ইমাম বুখারী এবং অন্যান্য আলেমগণ বিসমিল্লাহ্ দ্বারা তাদের কিতাব লিখা শুরু করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন দেশের রাজা-বাদশাহ এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নামে চিঠি লেখার সময় বিসমিল্লাহ লিখতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি প্রসিদ্ধ হাদীছে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ কাজ বিসমিল্লাহ দিয়ে শুরু করার আদেশ দিয়েছেন। ইমাম ইবনে মাজাহ হাদীছটি বর্ণনা করেছেন।[1]

গ্রন্থকার এখানে ‘তাওহীদ’ দ্বারা ‘তাওহীদুল ইবাদাহ’ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাকে বুঝিয়েছেন।[2] প্রত্যেক রাসূলই এ প্রকার তাওহীদের মাধ্যমে নিজ নিজ গোত্রের লোকদের সামনে দাওয়াতের সূচনা করেছেন। সূরা আরাফের ৫৯ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ إِنِّي أَخَافُ عَلَيْكُمْ عَذَابَ يَوْمٍ عَظِيمٍ

‘‘নিশ্চয়ই আমি নুহকে তার সম্প্রদায়ের প্রতি পাঠিয়েছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। তা না করলে আমি তোমাদের উপর একটি মহা দিবসের শাস্তির আশঙ্কা করছি। একই সূরার ৬৫ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘‘আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ هَذِهِ نَاقَةُ اللَّهِ لَكُمْ آَيَةً فَذَرُوهَا تَأْكُلْ فِي أَرْضِ اللَّهِ وَلَا تَمَسُّوهَا بِسُوءٍ فَيَأْخُذَكُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘আর সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে। তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য মাবুদ নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে একটি প্রমাণ এসে গেছে। এটি আল্লাহ্‌র উষ্ট্রী। তোমাদের জন্য এটি একটি নিদর্শন স্বরূপ। অতএব একে ছেড়ে দাও, আল্লাহ্‌র ভূমিতে এটি চরে বেড়াবে। একে অসৎ নিয়তে স্পর্শ করবেনা। অন্যথায় তোমাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি পাকড়াও করবে। (সূরা আরাফঃ ৭৩) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِلَى مَدْيَنَ أَخَاهُمْ شُعَيْبًا قَالَ يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ قَدْ جَاءَتْكُمْ بَيِّنَةٌ مِنْ رَبِّكُمْ فَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ وَلَا تَبْخَسُوا النَّاسَ أَشْيَاءَهُمْ وَلَا تُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ بَعْدَ إِصْلَاحِهَا ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ

‘‘আমি মাদায়েনের প্রতি তাদের ভাই শুআইবকে প্রেরণ করেছি। সে বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে প্রমাণ এসে গেছে। অতএব তোমরা মাপ ও ওজন পূর্ণ কর এবং মানুষকে তাদের দ্রব্যাদি কম দিয়োনা এবং ভূপৃষ্ঠের সংস্কার সাধন করার পর তাতে ফাসাদ সৃষ্টি করোনা। এটিই হল তোমাদের জন্য কল্যাণকর, যদি তোমরা বিশ্বাসী হও’’। (সূরা আরাফঃ ৮৫) সূরা হুদের আরো কয়েকটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেন যে, নবীগণ সর্বপ্রথম তাওহীদ দিয়েই তাদের দাওয়াতের কাজ শুরু করেছেন।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ‘‘আমি জিন এবং মানুষকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি।’’ (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।

..................................................................

ব্যাখ্যাঃ এ আয়াতটি প্রমাণ করে যে, আল্লাহ্ তাআলা একটি মহান উদ্দেশ্যে জিন ও মানুষ সৃষ্টি করেছেন। আর সেটি হচ্ছে আল্লাহ্ তাআলা তাদের উপর যা ওয়াজিব করেছেন, তারা তা বাস্তবায়ন করবে, তাঁরই এবাদত করবে, তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য বস্ত্তর এবাদত বর্জন করবে। সুতরাং এই আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা দু’টি কাজের উল্লেখ করেছেন। একটি হচ্ছে আল্লাহর কাজ। তথা আল্লাহ্ তাআলা জিন-ইনসান সৃষ্টি করেছেন। সুতরাং জিন-ইনসান সৃষ্টি করা আল্লাহর কাজ। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে বান্দার কাজ। তা হচ্ছে বান্দাগণ এককভাবে আল্লাহর এবাদত করবে। শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইবনে তাইমীয়া (রঃ) বলেনঃ

العبادة اسم جامع لكل ما يحبه الله ويرضاه من الأقوال والأعمال الظاهرة والباطنة

আল্লাহ্ তাআলা বান্দার যে সমস্ত প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কথা ও কাজকে ভালোবাসেন ও পছন্দ করেন, তার নামই এবাদত।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ এবাদত হচ্ছে এমন একটি নাম, যা আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ও সর্বোচ্চ ভালোবাসার অর্থ বহন করে এবং তাঁর সামনে পূর্ণ ও সর্বোচ্চ নতি স্বীকার করার কথা ঘোষণা করে। নতি স্বীকার করা ব্যতীত শুধু ভালোবাসা কিংবা ভালোবাসাহীন শুধু নতি স্বীকার কখনই এবাদত হতে পারে না। এবাদত ঐ বস্ত্তকে বলা হয়, যাতে উপরোক্ত দু’টি বিষয় পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকে।

শাইখুল ইসলাম আরো বলেনঃ বান্দাগণ আল্লাহ্ তাআলাকে ভালোবাসবে এবং তাঁরই সন্তুষ্টি অর্জন করবে, এ জন্য তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে। সুতরাং যারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির জন্য তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁকেই ভালোবাসবে ও ভয় করবে তাদের ক্ষেত্রে আল্লাহ্ তাআলার সেই ইচ্ছার বাস্তবায়ন হবে, যাকে দ্বীনি ইচ্ছা বা ইরাদায়ে শরঈয়া বলা হয়।[3] আর এটিই আল্লাহ্ তাআলা উপরোক্ত আয়াতে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ

‘‘আমি জিন এবং মানব জাতিকে একমাত্র আমার এবাদত করার জন্যই সৃষ্টি করেছি’’। (সূরা যারিয়াতঃ ৫৬)।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে, তোমরা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করো এবং তাগুত থেকে দূরে থাকো’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬)

......................................................

ব্যাখ্যাঃ আল্লাহ্ তাআলা এখানে সংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি প্রত্যেক যামানায় এবং প্রত্যেক জাতির কাছেই রাসূল পাঠিয়েছেন। যাতে করে প্রেরিত রাসূল একমাত্র আল্লাহর এবাদত করার আদেশ দেন এবং ঐ সমস্ত বস্ত্তর এবাদত করা হতে নিষেধ করেন, যা শয়তান মানুষের সামনে খুব চাকচিক্যময় করে প্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর এবাদত বাদ দিয়ে তাদেরকে ঐ সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদতে লিপ্ত করেছে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাদের কাউকে হেদায়াত করেছেন। তাই তারা এককভাবে আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করেছে এবং তাঁর রাসূলদের আনুগত্য করেছে। আর বনী আদমের কতক লোক পথহারা হয়ে আল্লাহর এবাদতে অন্যান্য বস্ত্তকে শরীক করেছে। রাসূলগণ যেই হেদায়াত নিয়ে আগমণ করেছেন, তারা তা গ্রহণ করেনি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَمَا أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ

‘‘তোমার পূর্বে আমি যে রাসূলই প্রেরণ করেছি, তাকে এ আদেশই প্রদান করেছি যে, আমি ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। সুতরাং আমারই এবাদত করো’’। (সূরা আম্বীয়াঃ ২৫) এই তাওহীদের জন্যই তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তা বাস্তবায়ন করার জন্যই তাদেরকে আহবান করা হয়েছে। এটিই হচ্ছে তাওহীদুল উলুহীয়াহ। একে توحيد القصد والطلب তাওহীদুল কাস্দ ওয়াত্ তালাবও বলা হয়।

আর তাওহীদে রুবুবীয়া, তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত এবং তাওহীদুল আফআল কিংবা ‘তাওহীদুল ইল্ম ওয়াল ইতিকাদ’ তথা জ্ঞান ও বিশ্বাসগত তাওহীদ বলা হয়। মানব জাতির অধিকাংশ লোকই আল্লাহ তাআলার এই তাওহীদকে স্বীকার করেছে।[4] তবে অধিকাংশ লোকই তাওহীদুল উলুহীয়াকে অস্বীকার করেছে। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী হুদ (আঃ)এর গোত্রের লোকদের অবস্থা বর্ণনা করেছেন। তিনি যখন তাঁর জাতির লোকদেরকে বললেনঃ

يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ

‘‘হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত করো। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোনো সত্য উপাস্য নেই’’। (সূরা আরাফঃ ৬৫) তখন তারা বললঃ তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছ যে, আমরা এক আল্লাহ্‌র এবাদত করি এবং আমাদের বাপ-দাদারা যাদের পূজা করত, তাদেরকে ছেড়ে দেই? (সূরা আরাফঃ ৭০) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন মক্কার মুশরিকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিলেন, তখন তারাও বলেছিলঃ

أَجَعَلَ الْآلِهَةَ إِلَهاً وَاحِداً إِنَّ هَذَا لَشَيْءٌ عُجَابٌ

‘‘সে কি বহু মাবুদকে এক মাবুদে পরিণত করে দিয়েছে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার! (সূরা সোয়াদঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ

وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ

‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো আর তাগুতকে বর্জন করো’’-এ আয়াতটি তার পূর্বের এবং পরের অন্যান্য আয়াতসমূহের ব্যাখ্যা করছে। আরো ব্যাখ্যা করছে যে, যেই এবাদতের জন্য বান্দাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে, তা হচ্ছে এমন খাঁটি ও নির্ভেজাল এবাদত, যার সাথে শির্ক এবং আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য বস্ত্তর এবাদতের মিশ্রন নেই। সেই অন্য বস্ত্ত যেই হোক না কেন। সুতরাং জানা গেল যে, আমল ততক্ষণ পর্যন্ত সঠিক হবেনা, যতক্ষণ না তা আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সমস্ত বাতিল মাবুদের এবাদত হতে মুক্ত হবে।[5] আল্লাহ্ তাআলার এবাদত করার জন্যই জিন-ইনসান সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের কেউ তাঁর এবাদত করছে। আবার কেউ তাঁর এবাদতে অন্যকে শরীক করছে এবং কুফুরী করছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নাহলের ৩৬ নং আয়াতে বলেনঃ

فَمِنْهُم مَّنْ هَدَى اللّهُ وَمِنْهُم مَّنْ حَقَّتْ عَلَيْهِ الضَّلالَةُ

‘‘অতঃপর তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোককে আল্লাহ্ হেদায়াত করেছেন এবং কিছু সংখ্যকের জন্যে গোমরাহী অবধারিত হয়ে গেছে’’। (সূরা নাহলঃ ৩৬) আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ৬৪ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللَّهِ

‘‘বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রাসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহ্‌র নির্দেশ অনুযায়ী তাদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়’’।

উপরের আয়াতগুলোর মাধ্যমে পরিস্কার বুঝা গেল যে, জিন-ইনসান সৃষ্টির ক্ষেত্রে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, তাদেরকে যে জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং যে বিষয়ের আহবান করার জন্য রাসূলদেরকে প্রেরণ করা হয়েছে, তারা তাই করবে। এ জন্যই যারা এককভাবে তাঁর এবাদত করেনি এবং তাঁর রাসূলগণের দাওয়াত গ্রহণ করেনি, তিনি তাদেরকে ধ্বংস করেছেন। তিনি নবী-রাসূলগণ এবং তাদের সাথীদের জন্য তাওহীদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা বৈধ করেছেন। তাদের কেউ কেউ নবী-রাসূলদের আনুগত্য করেছে। এদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। আবার তাদের মধ্য হতে অন্যরা নবী-রাসূলদের তাওহীদের দাওয়াতের বিরোধিতা করেছে। তাদের সংখ্যাই ছিল অধিক।

এই তাওহীদের নামই হচ্ছে ইসলাম। এই ইসলাম ছাড়া আল্লাহ্ তাআলা অন্য কোন দ্বীন কবুল করবেন না। সূরা ইউসুফের ৪০ নং আয়াতে ইউসুফ (আঃ)এর উক্তি নকল করে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

مَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِهِ إِلَّا أَسْمَاءً سَمَّيْتُمُوهَا أَنْتُمْ وَآَبَاؤُكُمْ مَا أَنْزَلَ اللَّهُ بِهَا مِنْ سُلْطَانٍ إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ

‘‘তোমরা আল্লাহ্কে ছেড়ে নিছক কতগুলো নামের এবাদত করে থাকো, সেগুলো তোমরা এবং তোমাদের বাপ-দাদারা সাব্যস্ত করে নিয়েছে। আল্লাহ্ এদের কোন প্রমাণ অবতীর্ণ করেন নি। আল্লাহ্ ছাড়া কারও হুকুম করার ক্ষমতা নেই। তিনি আদেশ দিয়েছেন যে, তিনি ব্যতীত অন্য কারো এবাদত করোনা। এটাই সরল পথ। কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানে না’’।

এককভাবে আল্লাহর এবাদত করাই হলো সেই সত্য দ্বীন, যা দিয়ে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল রাসূল প্রেরণ করেছেন, এই শিক্ষাই সকল আসমানী কিতাবে নাযিল করেছেন এবং এটি বাস্তবায়ন করার জন্যই রাসূলদেরকে আদেশ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

شَرَعَ لَكُم مِّنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحاً وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ

‘‘তিনি তোমাদের জন্যে দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারিত করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা’’। (সূরা শুরাঃ ১৩) আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ

‘‘হে নবী তুমি লোকদেরকে বলোঃ আমাকে আদেশ করা হয়েছে, আমি যেন একমাত্র আল্লাহ্‌র এবাদত করি এবং তার সাথে অংশীদার না করি। আমি তাঁর দিকেই দাওয়াত দেই এবং তাঁর কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে একমাত্র তাঁরই এবাদত করার আদেশ দিয়েছেন এবং উম্মতকে এদিকেই আহবান করার নির্দেশ দিয়েছেন। সমস্ত কুরআনই এ তাওহীদ এবং তাওহীদের ব্যাখ্যায় ভরপুর। এতে রয়েছে তাওহীদপন্থীদের পুরস্কার ও তাওহীদ অস্বীকারকারীদের তিরস্কার। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ قَدْ جَاءكُمْ رَسُولُنَا يُبَيِّنُ لَكُمْ كَثِيراً مِّمَّا كُنتُمْ تُخْفُونَ مِنَ الْكِتَابِ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ قَدْ جَاءكُم مِّنَ اللّهِ نُورٌ وَكِتَابٌ مُّبِينٌ، يَهْدِي بِهِ اللّهُ مَنِ اتَّبَعَ رِضْوَانَهُ سُبُلَ السَّلاَمِ وَيُخْرِجُهُم مِّنِ الظُّلُمَاتِ إِلَى النُّورِ بِإِذْنِهِ وَيَهْدِيهِمْ إِلَى صِرَاطٍ مُّسْتَقِيمٍ

‘‘হে আহ্লে কিতাবগণ! তোমাদের কাছে আমার রাসূল আগমণ করেছেন। কিতাবের যেসব বিষয় তোমরা গোপন করতে, তিনি তার মধ্য থেকে অনেক বিষয় প্রকাশ করেন এবং অনেক বিষয় মার্জনা করেন। তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি এসেছে এবং এসেছে একটি সমুজ্জ্বল গ্রন্থ। যারা আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করে এর দ্বারা তিনি তাদেরকে নিরাপত্তার পথ প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নির্দেশ দ্বারা অন্ধকার থেকে বের করে আলোর দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে পরিচালিত করেন’’। (সূরা মায়েদাঃ ১৫-১৬)

আবু দাউদ ও তিরমিজীতে বর্ণিত মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে এসেছে, মুআয বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন কিছু আমল দেখিয়ে দিন, যা আমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তুমি একটি বিরাট বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছ। তবে আল্লাহ্ তাআলা যার উপর সেই আমলটি সহজ করে দিয়েছেন, তার জন্য তা খুবই সহজ। আমলটি হচ্ছে, তুমি আল্লাহর এবাদত করবে, তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে এবং রামাযানের রোযা রাখবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হজ্জের কথাও বলেছেন। অতঃপর তিনি বলেনঃ আমি কি তোমাকে দ্বীনের মূল বিষয়, স্তম্ভ এবং এর সর্বোচ্চ চূড়া সম্পর্কে বলবোনা? মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেনঃ আমি বললামঃ হে আল্লাহর রাসূল! হ্যাঁ, বলুন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ দ্বীনের মূল হচ্ছে ইসলাম। এর স্তম্ভ হচ্ছে নামায এবং দ্বীনের সর্বোচ্চ চূড়া হচ্ছে জিহাদ।[6]

এই হাদীছ থেকে বুঝা যাচ্ছে ইসলাম হচ্ছে তাওহীদের অন্য একটি নাম। আর অন্যান্য হুকুম-আহকাম ও ফরয-ওয়াজিবগুলো হচ্ছে তাওহীদের হকসমূহের অন্তর্গত। সকল আলেম এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, তাওহীদ হচ্ছে নামায এবং অন্যান্য আমল সঠিক হওয়ার শর্ত। কালেমায়ে শাহাদাত لا إله إلا الله و أن محمداً رسول الله এর তাৎপর্য ও দাবী এটিই। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, এটি একদিকে যেমন শির্ককে প্রত্যাখ্যান করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের থেকে সম্পর্কচ্ছেদ ঘোষণা করে অন্যদিকে একমাত্র আল্লাহর জন্য এবাদতকে সাব্যস্ত করে, রাসূল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি ঈমান আনয়ন আবশ্যক হওয়া এবং তাঁর আনুগত্য করা জরুরী হওয়ার প্রমাণও বহন করে।

[1] - তবে হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুনঃ যাঈফু সুনানে আবী দাউদ। হাদীছ নং- ১৮৯৪, ইরাউল গালীল, হাদীছ নং- ২।

[2] - আলেমগণ কুরআন ও হাদীছের আলোকে তাওহীদকে তিনভাবে বিভক্ত করেছেনঃ

ক) তাওহীদে রুবুবীয়াহঃ

তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ হল দৃঢ়ভাবে এ বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ তাআলা সব কিছুর প্রতিপালক, তিনিই সব কিছুর মালিক, সৃষ্টি কর্তা, ব্যবস্থাপক ও পরিচালক। তার রাজত্বে কোন অংশীদার নেই। তিনি দুর্দশাগ্রস্ত হন না, যে কারণে তাঁর কোন সাহায্যকারীর প্রয়োজন হতে পারে। তাঁর ফয়সালাকে কেউ পরিবর্তন করতে পারে না, তার আদেশ প্রত্যাখ্যান করার মত কেউ নেই, তাঁর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, তাঁর অনুরূপ আর কেউ নেই, নেই তাঁর কোন সমতুল্য। তাঁর প্রতিপালনাধীন কোন বিষয়ের বিরোধী কেউ নেই এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতেও কোন শরীক নেই। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ مَنْ رَبُّ السَّمَوَاتِ وَالأَرْضِ قُلْ اللَّهُ قُلْ أَفَاتَّخَذْتُمْ مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ لاَ يَمْلِكُونَ لأَنفُسِهِمْ نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الأَعْمَى وَالْبَصِيرُ أَمْ هَلْ تَسْتَوِي الظُّلُمَاتُ وَالنُّورُ أَمْ جَعَلُوا لِلَّهِ شُرَكَاءَ خَلَقُوا كَخَلْقِهِ فَتَشَابَهَ الْخَلْقُ عَلَيْهِمْ قُل اللَّهُ خَالِقُ كُلِّ شَيْءٍ وَهُوَ الْوَاحِدُ الْقَهَّارُ

‘‘বলো! কে আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রতিপালক? বলোঃ আল্লাহ। বলোঃ তবে কি তোমরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে অন্যদেরকে অভিভাবকরূপে গ্রহণ করেছো, যারা নিজেদের লাভ ও ক্ষতি সাধনে সক্ষম নয়? তুমি বলোঃ অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি সমান? অথবা অন্ধকার ও আলো কি সমান? তবে কি তারা আল্লাহর এমন শরীক স্থাপন করেছে যারা তাঁর সৃষ্টির মত সৃষ্টি করেছে যে কারণে সৃষ্টি তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ঘটিয়েছে? বলোঃ আল্লাহ সকল বস্ত্তর স্রষ্টা; তিনি একক ও পরাক্রমশালী’’। (সূরা রা’দঃ ১৬)

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ * أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ

‘‘তারা কি কোন কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করেনা’’। (সূরা তুরঃ ৩৫-৩৬)

সর্বকালের অধিকাংশ বনী আদমই এই প্রকার তাওহীদ তথা তাওহীদে রুবুবীয়ার প্রতি বিশ্বাস করেছে এবং তা মেনে নিয়েছে। জাহেলী যুগের মক্কার মুশরিকরাও তা মেনে নিয়েছিল। কুরআন মজীদে এর অনেক প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবেঃ আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنْ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمَّنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنْ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنْ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘‘তুমি জিজ্ঞেস করো, কে রিযিক দান করে তোমাদেরকে আসমান ও যমীন থেকে? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তা ছাড়া কে জীবিতকে মৃত থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ্! তখন তুমি বলো, তারপরও কি ভয় করবেনা? (সূরা ইউনুসঃ ৩১)

মুসলিম হিসাবে গণ্য হওয়ার জন্য শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস যথেষ্ট নয়। তাওহীদে উলুহীয়াতে বিশ্বাস না করা পর্যন্ত কাউকে মুমিন হিসাবে গণ্য করা হবেনা। কারণ মক্কাবাসীরা তাওহীদে রুবুবীয়াতে বিশ্বাস করত। কিন্তু আল্লাহর এবাদতে তারা শরীক স্থাপন করত। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللَّهِ إِلَّا وَهُمْ مُشْرِكُونَ

‘‘আর অধিকাংশ মানুষই আল্লাহ্‌র প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে, কিন্তু সাথে সাথে শির্কেও লিপ্ত হয়’’। (সূরা ইউসুফঃ ১০৬) এখানে ঈমান বলতে তাওহীদে রুবুবীয়া উদ্দেশ্য। শুধু তাওহীদে রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাকে মুসলিম হওয়ার জন্য যথেষ্ট গণ্য করা হয়নি। এ জন্যই মক্কাবাসীরা এতে ঈমান আনয়ন করা সত্ত্বেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের বিরুদ্ধে বদর, উহুদ ও খন্দকসহ বহু যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। মুসলিম হওয়ার জন্য যদি শুধু আল্লাহ্ তাআলা রুবুবীয়াতের প্রতি ঈমান আনয়ন করাই যথেষ্ট হত, তাহলে তিনি কখনই তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন না এবং তাদের জান ও মালকে হালাল মনে করতেন না।

তাওহীদুল উলুহীয়াহঃ

প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল কথা ও কাজ তথা সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্দিষ্ট করা এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য যে কোন বস্ত্তর এবাদতকে অস্বীকার করার নাম তাওহীদে উলূহিয়্যাহ। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَقَضَى رَبُّكَ أَلاَّ تَعْبُدُوا إِلاَّ إِيَّاهُ

‘‘তোমার প্রতিপালক নির্দেশ দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া তোমরা অন্য কারো এবাদত করবে না’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلاَ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো এবং তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা’’। (সূরা নিসাঃ ৩৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

نَّنِي أَنَا اللَّهُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ أَنَا فَاعْبُدْنِي وَأَقِمْ الصَّلاَةَ لِذِكْرِي

‘‘আমিই আল্লাহ, আমি ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই। অতএব আমার এবাদত করো এবং আমার স্মরণার্থে নামায কায়েম করো’’। (সূরা তোহাঃ ১৪) এটিই (لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ-লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ)এর সরল ও সঠিক ব্যাখ্যা।

সুতরাং নামায আদায় করা, প্রার্থনা করা, যবেহ্ করা, নযর বা মানত করা, সাহায্য চাওয়া, বিপদে আশ্রয় প্রার্থনা করা, ইত্যাদি সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই করতে হবে। তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করা যাবেনা। এই প্রকার তাওহীদকেই কাফেরগণ অমান্য করেছিল এবং নূহ (আঃ) থেকে শুরু করে আমাদের নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পর্যন্ত সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের উম্মতের মাঝে মূল বিরোধ ছিল এই তাওহীদকে কেন্দ্র করেই।

তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাতঃ

তাওহীদুল্ আসমা ওয়াস্ সিফাতের অর্থ হলো, আল্লাহ নিজেকে যে সমস্ত নামে নামকরণ করেছেন এবং তাঁর কিতাবে নিজেকে যে সমস্ত সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন ও তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁকে যে সমস্ত অতি সুন্দর নামে এবং সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করেছেন, তাতে বিশ্বাস স্থাপন করা। তার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত যেভাবে বর্ণিত হয়েছে ঠিক সেভাবেই আল্লাহ তাআলার জন্য তা সাব্যস্ত করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবের অনেক স্থানে কোন প্রকার ধরণ বর্ণনা করা ব্যতীত স্বীয় সুউচ্চ গুণাবলী উল্লেখ করেছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ وَلاَ يُحِيطُونَ بِهِ عِلْمًا

‘‘তাদের সম্মুখের ও পশ্চাতের সবই তিনি অবগত আছেন। কিন্তু তারা জ্ঞান দ্বারা তাঁকে আয়ত্ত করতে পারেনা’’। (সূরা তোহাঃ ১১০) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ

‘‘ তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ (সূরা শুরাঃ ১১)

তিরমিযী শরীফে উবাই বিন কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, একদা মুশরিকরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ আমাদের সামনে আপনার রবের বংশ পরিচয় বর্ণনা করুন। তখন আল্লাহ তাআলা এই সূরাটি নাযিল করেনঃ

قُلْ هُوَ اللَّهُ أَحَدٌ اللَّهُ الصَّمَدُ لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُنْ لَهُ كُفُوًا أَحَدٌ

‘‘হে রাসূল তুমি বলোঃ তিনি আল্লাহ্ একক। আল্লাহ্ অমূখাপেক্ষী। তিনি কাউকে জন্ম দেন নি এবং তাঁকে জন্ম দেয়া হয়নি এবং তাঁর সমতুল্য অন্য কেউ নেই’’। ‘সামাদ’ হচ্ছে যিনি কাউকে জন্ম দেন নি বা যাকে কেউ জন্ম দেয়নি। কারণ জন্মগ্রহণকারী সকলেই মরণশীল। আর মরণশীল প্রতিটি বস্ত্তই উত্তরাধিকারী রেখে যায়। আর আল্লাহ তাআলা মরণশীল নন, তিনি কারো উত্তরাধিকারী নির্ধারণকারী নন। ‘আর তাঁর সমতুল্য কেউ নেই’ অর্থাৎ কেউ তাঁর সমকক্ষ, সম মর্যাদা সম্পন্ন এবং তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই।

আল্লাহ্ তাআলার অনেকগুলো অতি সুন্দর নাম এবং সুউচ্চ গুণাবলী রয়েছে যা তাঁর পরিপূর্ণতা এবং মহত্ত্বের প্রমাণ বহন করে, এ কথার প্রতি ঠিক সেভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা যেভাবে পবিত্র কুরআন এবং হাদীছে উল্লেখ হয়েছে। কোন প্রকার বিকৃতি, অস্বীকৃতি, ধরণ-গঠন বা সাদৃশ্য আরোপ না করেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

لَيْسَ كَمِثْلِهِ شَيْءٌ وَهُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ

‘‘তাঁর সদৃশ কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’ এই আয়াতে কোন বস্ত্ত তাঁর অনুরূপ না হওয়ার কথা বলা হয়েছে। আর তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা- এই দু’টি সিফাত তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা হয়েছে। এটাই হলো সালাফে সালেহীন তথা সাহাবায়ে কেরাম, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীগণের মূলনীতি। তারা সকলেই আল্লাহর অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলীর ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামএর শিখানো মূলনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিলো। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা নিজের জন্য যে অতি সুন্দর নাম ও সুউচ্চ গুণাবলী পছন্দ করেছেন বা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যে নাম ও গুণাবলী তাঁর হাদীছে উল্লেখ করেছেন উহা ব্যতীত অন্য কোন নাম বা গুণাবলী আল্লাহ্ তাআলার জন্য নির্দিষ্ট করা যাবেনা। কেননা আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তিনি ব্যতীত অন্য কেউ অধিক অবগত নয়। আল্লাহ্‌র পর তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছাড়া আল্লাহ্ সম্পর্কে অধিক অবগত আর কেউ নেই।


[3] - শাইখুল ইসলাম আল্লামা ইমাম ইবনে তাইমীয়া (রঃ) এখানে বুঝাতে চেয়েছেন যে, কুরআন ও হাদীছে আল্লাহর যে ইরাদাহ বা ইচ্ছার কথা উল্লেখিত হয়েছে তা দুই প্রকার। যথাঃ

(১) ইরাদাহ কাওনীয়া কাদ্রীয়া (সৃষ্টি ও নির্ধারণ করার ইচ্ছা)। এটি আল্লাহর এমন ইচ্ছা, যা তাঁর ভালোবাসা এবং পছন্দকে আবশ্যক করেনা। কুফরী, ঈমান, আনুগত্য, পাপাচার, সন্তুষ্টি, ভালবাসা, পছন্দনীয় এবং অপছন্দনীয় সবই এ প্রকার ইচ্ছার অন্তর্ভূক্ত। কোন ব্যক্তিই আল্লাহর এ প্রকার ইচ্ছার বাইরে কিছু করতে পারে না এবং তা হতে পালানোর কোন সুযোগ নেই। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يَهدِيَهُ يَشْرَحْ صَدْرَهُ لِلإسْلاَمِ وَمَنْ يُرِدْ أَنْ يُضِلَّهُ يَجْعَلْ صَدْرَهُ ضَيِّقًا حَرَجًا

‘‘অতএব আল্লাহ্ যাকে হিদায়াত করতে চান, ইসলামের জন্যে তার অন্তকরণ খুলে দেন। আর যাকে পথভ্রষ্ট করার ইচ্ছা করেন, তার অন্তকরণ খুব সংকুচিত করে দেন’’। (সূরা আন-আমঃ ১২৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَنْ يُرِدِ اللَّهُ فِتْنَتَهُ فَلَنْ تَمْلِكَ لَهُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا أُولَئِكَ الَّذِينَ لَمْ يُرِدِ اللَّهُ أَنْ يُطَهِّرَ قُلُوبَهُمْ

‘‘আল্লাহ্ যাকে ফিতনায় ফেলতে চান, তার জন্য আল্লাহর কাছে কিছুই করার নেই। ওরা হল সেই লোক, যাদের অন্তরসমূহকে আল্লাহ্ পবিত্র করার ইচ্ছা পোষণ করেন নি’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৪১) এছাড়াও আরো আয়াত রয়েছে।

(২) ইরাদা শারঈয়া ও দ্বীনিয়া (শরীয়তগত ইচ্ছা)। আল্লাহর যে ইচ্ছা সন্তুষ্টি ও ভালবাসার সাথে সম্পৃক্ত, তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা কোন জিনিষকে ভালবেসে যে ইচ্ছা পোষণ করেন তাকে ইরাদাহ শরঈয়া বলা হয়। এ ইচ্ছার কারণেই আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদেরকে আদেশ ও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يُرِيدُ اللَّهُ بِكُمُ الْيُسْرَ وَلاَ يُرِيدُ بِكُمُ الْعُسْرَ

‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করার ইচ্ছা করেন, তোমাদের পক্ষে যা কঠিন, তা তিনি চান না’’। (সূরা বাকারাঃ ১৮৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

يُرِيدُ اللَّهُ لِيُبَيِّنَ لَكُمْ وَيَهْدِيَكُمْ سُنَنَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ وَيَتُوبَ عَلَيْكُمْ وَاللَّهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

‘‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্যে বর্ণনা করতে, তোমাদেরকে তোমাদের পূর্ববর্তীগণের আদর্শসমূহ প্রদর্শন করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে ইচ্ছা করেন। আল্লাহ্ মহাজ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা নিসাঃ ২৬) এ ছাড়া আরো আয়াত রয়েছে। আল্লাহ তাআলার এ প্রকার ইচ্ছা তথা শরীয়ত গত ইচ্ছা শুধু তার ক্ষেত্রেই বাস্তবায়িত হবে, যার ক্ষেত্রে সৃষ্টিগত ইচ্ছা বাস্তবায়িত হয়েছে। আনুগত্যকারী মুমিনের মধ্যে ইরাদাহ কাওনীয়া ও শরঈয়া উভয়ই একত্রিত হয়ে থাকে। আর কাফেরের ক্ষেত্রে শুধু আল্লাহর সৃষ্টিগত ইচ্ছাই বাস্তবায়িত হয়ে থাকে। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর সকল বান্দাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের আহবান জানিয়েছেন। তাদের মধ্য হতে যাকে ইচ্ছা তাকেই আহবানে সাড়া দেয়ার পথ দেখিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَاللَّهُ يَدْعُو إِلَى دَارِ السَّلاَمِ وَيَهْدِي مَنْ يَشَاءُ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ

‘‘আর আল্লাহ্ তোমাদেরকে শান্তির আবাসস্থল তথা জান্নাতের দিকে আহবান করেন এবং যাকে ইচ্ছা সরল পথে চলার ক্ষমতা দান করেন’’। (সূরা ইউনুসঃ ২৫) সুতরাং তিনি সকলকে আহবান জানিয়েছেন, কিন্তু যাকে ইচ্ছা কেবল তাকেই হেদায়াত নসীব করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ رَبَّكَ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ ضَلَّ عَنْ سَبِيلِهِ وَهُوَ أَعْلَمُ بِمَنْ اهْتَدَى

‘‘নিশ্চয়ই তোমার প্রতিপালকই ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষভাবে জ্ঞাত রয়েছেন, যে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়েছে এবং তিনিই ভাল জানেন তাদেরকে, যারা সঠিক পথের উপর রয়েছে’’। (সূরা নাজ্ম ৩০)

আল্লাহ তাআলার ইরাদাহ তথা ইচ্ছার বিষয়টি ভালভাবে বুঝার জন্য আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যার প্রয়োজন রয়েছে। আল্লাহর আদেশ, ফয়সালা এবং তাঁর ইচ্ছার মধ্যে এমন কিছু ইচ্ছা ও আদেশ রয়েছে, যা শরীয়তের হুকুম-আহকামের সাথে সংশ্লিষ্ট। আরেক প্রকার আদেশ, ইচ্ছা ও ফয়সালা রয়েছে, যা সৃষ্টি ও নির্ধারণের সাথে সম্পৃক্ত। আল্লাহ তাআলার যেই আদেশ সৃষ্টি ও নির্ধারনের সাথে সম্পৃক্ত, তা অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। অর্থাৎ আল্লাহ তাআলা যা সৃষ্টি এবং নির্ধারণ করার ইচ্ছা করেন, তার সাথে সম্পৃক্ত আদেশ হুবহু বাস্তবায়িত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ

‘‘আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি করার নিয়ম এই যে, যখন তিনি কোন কিছুর ইচ্ছা করেন তখন তিনি কেবল তাকে এতটুকু বলেন যে, হয়ে যাও। অতঃপর তা হয়ে যায়’’। (সূরা ইয়াসীনঃ ৮২) আললাহ তাআলা আরো বলেনঃ وَاللَّهُ غَالِبٌ عَلَىٰ أَمْرِهِ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পন্ন করেই থাকেন, কিন্তু অধিকাংশ লোক তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ২১) অর্থাৎ আল্লাহর বিধানগত আদেশ অবশ্যই বাস্তবায়িত হয়। এতে কোন সন্দেহ নেই। যেমন আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ

وَقَضَيْنَا إِلَيْهِ ذَٰلِكَ الْأَمْرَ أَنَّ دَابِرَ هَٰؤُلَاءِ مَقْطُوعٌ مُّصْبِحِينَ

‘‘আর তাকে আমি এ ফায়সালা পৌঁছিয়ে দিলাম যে, সকাল হতে হতেই এদেরকে সমূলে ধ্বংস করে দেয়া হবে’’। (সূরা হিজরঃ ৬৬) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَقَضَيْنَا إِلَىٰ بَنِي إِسْرَائِيلَ فِي الْكِتَابِ لَتُفْسِدُنَّ فِي الْأَرْضِ مَرَّتَيْنِ وَلَتَعْلُنَّ عُلُوًّا كَبِيرًا

‘‘তারপর আমি নিজের কিতাবে বনী ইসরাঈলকে এ মর্মে ফয়সালা দিয়েছিলাম যে, তোমরা দুবার পৃথিবীতে বিরাট বিপর্যয় সৃষ্টি করবে এবং ভীষণ বাড়াবাড়ি করবে’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪) সুতরাং আল্লাহর ফয়সালা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে শরীয়তগত ফয়সালা বান্দাদের মানা না মানার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তাআলার বাণীঃ وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩) এটি আল্লাহর শরীয়তের ফয়সালার (আদেশের) অন্তর্ভূক্ত। তাই আপনি দেখবেন যে, অনেক মানুষ আল্লাহর সাথে শির্কও করে এবং কেউ কেউ তার পিতা-মাতার অবাধ্যও হয়।

আর আল্লাহ তাআলার বাণীঃ ﴾أَمَرَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ ۚ ذَٰلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ وَلَٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ﴿ ‘‘আল্লাহ আদেশ করেছেন যে, তোমরা তাঁর এবাদত ব্যতীত অন্য কারোর এবাদত করবেনা৷ এটিই সরল সঠিক দ্বীন, কিন্তু অধিকাংশ লোকই তা জানেনা’’। (সূরা ইউসুফঃ ৪০) এটি হচ্ছে শরীয়ত ও দ্বীনি আদেশ। কিছু লোক এই আদেশের বিরোধীতাও করে। তাই আপনি দেখবেন যে, এক শ্রেণীর মানুষ আল্লাহর সাথে এমন কিছুকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ কোন দলীল প্রমাণ নাযিল করেন নি।

[4]- যেসব জাতি আল্লাহ তাআলার রুবুবীয়াতকে অস্বীকার করেছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে ইবরাহীম (আঃ)এর সাথে বিতর্ককারী (নমরুদ) অন্যতম। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِي حَاجَّ إِبْرَاهِيمَ فِي رَبِّهِ أَنْ آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ إِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ قَالَ أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ قَالَ إِبْرَاهِيمُ فَإِنَّ اللَّهَ يَأْتِي بِالشَّمْسِ مِنَ الْمَشْرِقِ فَأْتِ بِهَا مِنَ الْمَغْرِبِ فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

‘‘তুমি কি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে জাননা, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন৷ যখন ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ যার হাতে জীবন ও মৃত্যু তিনিই আমার রব৷ জবাবে সে বললোঃ আমিও তো জীবন ও মৃত্যু দিতে পারি৷ ইবরাহীম (আঃ) বললেনঃ তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে, আল্লাহ তো পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠান। তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও তো দেখি৷ একথা শুনে সেই কাফের হতবুদ্ধি হয়ে গেলো কিন্তু আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৮)

আল্লাহ তাআলা যখন মূসা (আঃ)কে ফেরাউনের কাছে পাঠালেন তখন তিনি নিজেকে রাববুল আলামীনের রাসূল হিসেবে পেশ করলেন। ফেরাউন তখন বলেছিলঃ وَمَا رَبُّ الْعَالَمِينَ রাববুল আলামীন আবার কে? ফেরাউন আরো বলেছিল, أَنَا رَبُّكُمُ الْأَعْلَىٰ আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় রব (সূরা নাযিআতঃ ২৪) সে আরো বলেছিল,

يَا أَيُّهَا الْمَلَأُ مَا عَلِمْتُ لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرِي فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ فَاجْعَل لِّي صَرْحًا لَّعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَىٰ إِلَٰهِ مُوسَىٰ وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ

‘‘হে সভাসদবর্গ! আমি তো নিজেকে ছাড়া তোমাদের আর কোন প্রভু আছে বলে জানি না৷ ওহে হামান! আমার জন্য ইঁট পুড়িয়ে একটি উঁচু প্রাসাদ তৈরি করো, হয়তো তাতে উঠে আমি মূসার প্রভুকে দেখতে পাবো, আমিতো তাকে মিথ্যুক মনে করি’’ (সূরা কাসাসঃ ৩৮)

এখন প্রশ্ন হলো সে কি আসমান ও যমীনের রবের উপর বিশ্বাস করতো এবং তা গোপন রেখেছিল? না কি সে মোটেই বিশ্বাস করতো না? আল্লাহর নবী মুসা (আঃ)এর কথা থেকে বুঝা যায় ফেরাউন আল্লাহর উপর ঈমান রাখতো। আল্লাহ তাআলা মুসা (আঃ)এর উক্তি উদ্বৃত করে বলেনঃ

قَالَ لَقَدْ عَلِمْتَ مَا أَنزَلَ هَٰؤُلَاءِ إِلَّا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ بَصَائِرَ وَإِنِّي لَأَظُنُّكَ يَا فِرْعَوْنُ مَثْبُورًا

‘‘তুমি খুব ভাল করেই জান এ প্রজ্ঞাময় নিদর্শনগুলো আকাশ ও পৃথিবীর রব ছাড়া আর কেউ নাযিল করেন নি। হে ফেরাউন! আমার মনে হয় তুমি নিশ্চয়ই একজন হতভাগ্য ব্যক্তি’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ১০২) অর্থাৎ হে ফেরাউন তুমি ভাল করেই জান যে, এই নিদর্শন ও মুজিযাগুলো যিনি নাযিল করেছেন, তিনি হলেন আসমান ও যমীনের প্রভু আল্লাহ তাআলা। কিন্তু তুমি অযথা ঝগড়া করছো এবং বিতর্ক করছো। ফেরাউনের গোত্রের লোকেরা ফেরাউনকে বলেছিলঃ

وَقَالَ الْمَلَأُ مِن قَوْمِ فِرْعَوْنَ أَتَذَرُ مُوسَىٰ وَقَوْمَهُ لِيُفْسِدُوا فِي الْأَرْضِ وَيَذَرَكَ وَآلِهَتَكَ قَالَ سَنُقَتِّلُ أَبْنَاءَهُمْ وَنَسْتَحْيِي نِسَاءَهُمْ وَإِنَّا فَوْقَهُمْ قَاهِرُونَ

‘‘ফেরাউনকে তার জাতির প্রধানরা বললঃ ‘‘তুমি কি মূসা ও তার জাতিকে এমনিই ছেড়ে দেবে যে, তারা দেশে বিপর্যয় সৃষ্টি করে বেড়াবে এবং তোমার ও তোমার মাবুদের এবাদত পরিত্যাগ করবে? ’’ফেরাউন জবাব দিলঃ ‘‘আমি তাদের পুত্রদের হত্যা করবো এবং তাদের কন্যাদের জীবিত রাখবো৷ আমরা তাদের উপর প্রবল কর্তৃত্বের অধিকারী’’। (সূরা আরাফঃ ১২৭) ফেরাউনের রাজ দরবারের উচ্চ পদস্থ লোকদের এই কথা থেকে বুঝা যায় যে, ফেরাউনের একজন মাবুদ ছিল। সে গোপনে এই মাবুদের এবাদত করতো।

কেউ কেউ আবার তাদের কথার ব্যাখ্যা এভাবে করেছেন যে, এখানে তাদের কথার অর্থ হলো, মুসা তোমাকে পরিত্যাগ করবে এবং তোমার জন্য তার এবাদতকেও পরিত্যাগ করবে। (আল্লাহই অধিক জানেন)

তবে কিছু কিছু কাফের আল্লাহর রুবুবীয়াতকেও অস্বীকার করে থাকে। তার প্রমাণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

وَيُرْسِلُ الصَّوَاعِقَ فَيُصِيبُ بِهَا مَن يَشَاءُ وَهُمْ يُجَادِلُونَ فِي اللَّهِ وَهُوَ شَدِيدُ الْمِحَالِ

‘‘তিনি বজ্র প্রেরণ করেন। অতঃপর যার উপর ইচ্ছা উহা নিক্ষেপ করেন৷ তারা আল্লাহর ব্যাপারে বাদানুবাদ করছে। আসলে তাঁর কৌশল বড়ই কঠোর। (সূরা রা’দঃ ১৩)

কোন কোন আলেমের নিকট হাসান সনদে এই আয়াতের ব্যাখ্যায় একটি হাদীছ বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) থেকে ইমাম বাযযার (রঃ) কাশফুল আসতারে (৩/৫৪) হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। আনাস (রাঃ) বলেনঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাওহীদের দাওয়াত দেয়ার জন্য একজন সাহাবীকে জাহেলী যামানার কাফেরদের জনৈক নেতার নিকট পাঠালেন। সেই কাফের বললঃ তুমি যেই রবের দিকে আমাকে ডাকছ, সে কিসের তৈরী? সেকি লোহার তৈরী? না কি পিতলের? রৌপ্যের? না কি স্বর্ণের?

সাহাবী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে ফেরত এসে ঘটনা জানালেন। তিনি তাঁকে দ্বিতীয়বার পাঠালেন। সেই কাফের একই কথা বলল। তাঁকে তৃতীয়বার পাঠানো হলে সে একই কথা বলল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ আল্লাহ তাআলা একটি বজ্র প্রেরণ করে তোমার সেই সাথীকে জ্বালিয়ে দিয়েছেন। তখন উপরোক্ত আয়াত নাযিল করেন।

উপরোক্ত আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে, (১) কোন কোন কাফের সৃষ্টিজগতের রবকে অস্বীকার করে এবং সৃষ্টির জন্য কোন ইলাহ (মাবুদ) থাকার কথাকেও অস্বীকার করে। (২) কোন কোন কাফের স্বীকার করে যে, আল্লাহই একমাত্র স্রষ্টা, তিনিই একমাত্র রিযিক দাতা ও সৃষ্টিজগতের সকল বিষয়ের তদবীরকারী। তবে আল্লাহ তাআলার সাথে তারা অন্যান্য মাবুদের এবাদত করে এবং আল্লাহর সাথে এমন বস্ত্তকে শরীক করে, যার পক্ষে আল্লাহ তাআলা কোন দলীল-প্রমাণ নাযিল করেন নি। কতিপয় কাফের-মুশরেক যে আল্লাহর রুবুবীয়াতকে স্বীকার করতো, তার দলীল হচ্ছে, যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ

‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তারা অবশ্যই বলবে আল্লাহ্। (সূরা লুকমানঃ ২৫)

(৩) কোন কোন কাফের আল্লাহতে বিশ্বাস করে, কিন্তু তারা দাবী করে যে, আল্লাহর পুত্র সন্তান রয়েছে। আল্লাহ তাআলা তাদের জবাবে বলেনঃ

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ ۖ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ

‘‘ইহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খৃষ্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র৷এগুলো একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা৷ তাদের পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে উচ্চারণ করে থাকে৷ আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের উপর, তারা কোথা থেকে ধোকা খাচ্ছে! (সূরা তাওবাঃ ৩০) আল্লাহ তাআলা সূরা মায়েদার ১৮ নং আয়াতে আরো বলেনঃ

وَقَالَتِ الْيَهُودُ وَالنَّصَارَىٰ نَحْنُ أَبْنَاءُ اللَّهِ وَأَحِبَّاؤُهُ قُلْ فَلِمَ يُعَذِّبُكُم بِذُنُوبِكُم ۖ بَلْ أَنتُم بَشَرٌ مِّمَّنْ خَلَقَ ۚ يَغْفِرُ لِمَن يَشَاءُ وَيُعَذِّبُ مَن يَشَاءُ ۚ وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا ۖ وَإِلَيْهِ الْمَصِيرُ

‘‘ইহুদী ও খৃষ্টানরা বলে, আমরা আল্লাহর সন্তান এবং তাঁর প্রিয়পাত্র৷ তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, তাহলে তোমাদের গুনাহের জন্য তিনি তোমাদের শাস্তি দেন কেন? আসলে তোমরাও ঠিক তেমনি মানুষ যেমন আল্লাহ অন্যান্য মানুষ সৃষ্টি করেছেন৷ তিনি যাকে চান মাফ করে দেন এবং যাকে চান শাস্তি দেন৷ পৃথিবী ও আকাশসমূহ এবং এ দুয়ের মধ্যকার যাবতীয় সৃষ্টি আল্লাহর মালিকানাধীন এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে’’।

(৪) কিছু মানুষ রয়েছে, যারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে, কিন্তু তাঁকে এমন বিশেষণে বিশেষিত করে, যা তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য অশোভনীয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالَتْ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ

‘‘আর ইহুদীরা বলেঃ আল্লাহর হাত বাঁধা রয়েছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের প্রতি অভিসম্পাত; বরং তাঁর উভয় হস্ত সদা উন্মুক্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা ব্যয় করেন’’। (সূরা মায়িদাঃ ৬৪) আল্লাহ তাআলা ইহুদীদের প্রতিবাদ করে বলেনঃ

لَقَدْ سَمِعَ اللَّهُ قَوْلَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ فَقِيرٌ وَنَحْنُ أَغْنِيَاءُ سَنَكْتُبُ مَا قَالُوا وَقَتْلَهُمْ الْأَنْبِيَاءَ بِغَيْرِ حَقٍّ وَنَقُولُ ذُوقُوا عَذَابَ الْحَرِيقِ

‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাদের কথা শুনেছেন, যারা বলেছে, আল্লাহ হচ্ছেন অভাবগ্রস্ত আর আমরা বিত্তবান। এখন আমি তাদের কথা এবং যেসব নবীকে তারা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে, তা লিখে রাখবো, অতঃপর বলবোঃ ‘আস্বাদন করো জ্বলন্ত আগুনের আযাব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮১)

(৫) আল্লাহ তাআলার উপর বিশ্বাসী কিছু মানুষ আল্লাহর অনেক সিফাতকে অস্বীকার করে। মুতাযেলা ও জাহমীয়া সম্প্রদায়ের লোকেরা এদের অন্তুর্ভূক্ত। আল্লাহ তাআলা তাঁর নবীদের সাথে কথা বলেছেন, তিনি কথা বলেন, কিয়ামতের দিন মানুষের সাথে কথা বলবেন, আল্লাহ তাআলার হাত ও চক্ষু রয়েছে। তিনি দৃশ্য-অদৃশ্য ইত্যাদি সকল বিষয়ের খবর রাখেন। কোন কোন ফির্কা আল্লাহ তাআলার এসব সিফাত (বিশেষণ) অস্বীকার করে থাকে। এমনি আরো অসংখ্য গোমরাহ দল রয়েছে, যা বলে শেষ করা যাবেনা। আমরা এগুলো থেকে আল্লাহর আশ্রয় কামনা করছি।

অপর পক্ষে তাওহীদ ও সঠিক পথের অনুসারী মুসলিমগণ সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ তাআলা ব্যতীত অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তারা আল্লাহ তাআলাকে এমনসব সুউচ্চ গুণে গুণান্বিত করে, যদ্বারা আল্লাহ তাআলা তাঁর নিজের সত্তাকে গুণান্বিত করেছেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পবিত্র সুন্নাতে আল্লাহ তাআলার যেসব গুণাবলী বর্ণনা করেছেন, তারা কোন প্রকার পরিবর্তন ও পরিবর্ধন ছাড়া তাতেও বিশ্বাস করে। এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত ব্যাখ্যা রয়েছে। যথাস্থানে তা আলোচনা করা হবে ইনশা-আল্লাহ।

[5] - এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে, মুসলিমগণ মুশরেকদের বাতিল মাবুদ ও শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে এবং তারা সর্বদা এমন আমল করবে, যা তাদেরকে শির্ক থেকে দূরে রাখে। এরই অংশ হিসাবে আমরা ফজরের সুন্নত দুই রাকআত নামাযের মাধ্যমে দিবসের আমল শুরু করি এবং বিতর নামাযের মাধ্যমে রাতের আমলের পরিসমাপ্তি ঘটাই। শির্ক ও মুশরেকদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন ঘোষণা করার জন্যই উপরোক্ত নামায দু’টিতে এমন দু’টি সূরা পাঠ করি, যাতে রয়েছে শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ ও আপোসহীনতার জোরালো ঘোষণা। সুতরাং এই আমলটির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া বাঞ্চনীয়।

[6] - হাদীছটি ইমাম তিরমিজী, নং- ২৬১৯ এবং ইবনে মাজাহ, নং-৪০৪৪-এ বর্ণনা করেছেন। ইমাম তিরমিযী বলেনঃ এই হাদীছটি হাসান সহীহ। দেখুনঃ ইরওয়াউল গালীল, হাদীছ নং- ৪১৩।

আল্লাহ তাআলা অন্যত্র বলেনঃ

وَقَضَى رَبُّكَ أَلَّا تَعْبُدُوا إِلَّا إِيَّاهُ وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا

‘‘তোমার রব এ ফয়সালা দিয়েছেন যে তাঁকে ছাড়া তোমরা আর কারো এবাদত করোনা। আর মাতা-পিতার সাথে সদ্ব্যবহার করো’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৩)

......................................................

ব্যাখ্যাঃ এখানে قضى (ফয়সালা প্রদান করেছেন) শব্দটি আদেশ দিয়েছেন অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহর বাণীঃ أن لاتعبدوا -এর মধ্যে রয়েছে لاإله -এর অর্থ। আর إلاإياه -এর মধ্যে রয়েছে إلا الله এর অর্থ। কালেমায়ে ইখলাস (لاإله إلاالله )-এর অর্থ এটিই। সুবহানাল্লাহ্! সুতরাং এই বিষয়টির (তাওহীদের) বিশদ বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আসার পরও উম্মতের পরবর্তী যুগের লোকদের কাছে কিভাবে তা অস্পষ্ট থাকতে পারে?[7]

সূরা নিসার ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلَا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا

‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো। আর তাঁর সাথে অন্য কিছুকে শরিক করো না’’।

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ এই আয়াতে ঐ এবাদতের কথাই বর্ণনা করা হয়েছে, যার জন্য জিন ও মানুষ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে বান্দাদের উপর ফরযকৃত এবাদতের আদেশ দেয়ার সাথে সাথে এবাদতের মধ্যে শির্ক করা থেকে নিষেধ করেছেন। যেই শির্ককে তিনি হারাম করেছেন, তা হচ্ছে ঐ শির্ক, যা এবাদতের মধ্যে হয়ে থাকে। সুতরাং আয়াতটি প্রমাণ করে যে, শির্ক থেকে দূরে থাকাই বান্দার এবাদত সঠিক হওয়ার প্রধান ও মূল শর্ত। শির্ক থেকে দূরে না থাকলে এবাদত সঠিক হবে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَلَوْ أَشْرَكُوا لَحَبِطَ عَنْهُمْ مَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘তারা যদি শির্ক করত, তাহলে তাদের আমলসমূহ বরবাদ হয়ে যেত’’। (সূরা আনআমঃ ৮৮) আল্লাহ্ তাআলা আরে বলেনঃ

وَلَقَدْ أُوحِيَ إِلَيْكَ وَإِلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكَ لَئِنْ أَشْرَكْتَ لَيَحْبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ، بَلِ اللَّهَ فَاعْبُدْ وَكُن مِّنْ الشَّاكِرِينَ

‘‘তোমার প্রতি এবং তোমার পূর্বের নবীদের প্রতি প্রত্যাদেশ করা হয়েছে, যদি আল্লাহ্‌র শরীক স্থির করো, তাহলে তোমার কর্ম নিস্ফল হবে এবং তুমি ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে। বরং আল্লাহ্‌রই এবাদত করো এবং কৃতজ্ঞদের অন্তর্ভুক্ত থাকো’’। (সূরা যুমারঃ ৬৫-৬৬) এ আয়াতদ্বয়ে مفعول মাফউলকে فاعبد শব্দের পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। আরবী ব্যাকরণের একটি সাধারণ নিয়ম হচ্ছে প্রথম فعل (ক্রিয়া) অতঃপর فاعل (কর্তা), তারপর مفعول তথা ক্রিয়া পতিত হওয়ার স্থলকে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু এই সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রমে প্রথমেই যদি মাফউল উল্লেখ করা হয়, তখন ফেল বা ক্রিয়াকে মাফউলের উপর সীমিত করা হয়। অর্থাৎ কেবল আল্লাহরই এবাদত কর, অন্যের নয়। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِيَّاكَ نَعْبُدُ وإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ

‘‘আমরা একমাত্র তোমারই এবাদত করি এবং শুধু তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি’’। (সূরা ফাতিহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা এই তাওহীদকেই সূরা যুমারের ১১ নং আয়াতে জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنِّي أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ

‘‘বলোঃ আমি একমাত্র আল্লাহ্‌র এবাদত করতে আদিষ্ট হয়েছি, দ্বীনকে তাঁর জন্য নিবেদিত করে’’। মূলতঃ দ্বীন ও এবাদত একই বিষয়। যে সমস্ত কাজ করার আদেশ দেয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করা এবং যে সকল বিষয় হতে নিষেধ করা হয়েছে, তা বর্জন করার নামই হচ্ছে এবাদত। আল্লামা ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ

والأمر والنهي الذي هو دينه + وجزاؤه يوم المعاد الثاني

আদেশ ও নিষেধই হচ্ছে আল্লাহর দ্বীন। আর এগুলো পালন করার পুরস্কার পাওয়া যাবে কিয়ামতের দিন। ইতিপূর্বে আলোচনা করা হয়েছে যে, দ্বীনের মূল বুনিয়াদ হচ্ছে তাওহীদুল ইবাদাহ তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা। সুতরাং এ কথাটি সবসময় মনে রাখা জরুরী।

সূরা আনআমের ১৫১ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

‘‘তুমি বলোঃ এসো! আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন, তাকে হত্যা করোনা; তবে ন্যায়ভাবে হত্যা করার কথা ভিন্ন। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১)

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ আল্লাহ্ তাআলা তোমাদের উপর শির্ক হারাম করেছেন এবং আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরিক করবেনা এর মাধ্যমে তিনি শির্ক থেকে নিষেধও করেছেন।

সুতরাং জানা যাচ্ছে যে, বান্দা ছোট-বড় যত গুনাহ্-এর মাধ্যমে আল্লাহর নাফরমানী করে থাকে, তার মধ্যে শির্কই হচ্ছে সর্বাধিক বড় ও ভয়াবহ।

এই উম্মতের পরবর্তী যামানার অধিকাংশ লোক জাহেলিয়াতের লোকদের মতই এই সর্বাধিক ভয়াবহ হারাম কাজটিতে তথা শির্কে লিপ্ত হয়েছে। এরা কবর, গম্বুজ, বৃক্ষ, পাথর, শয়তান, জিন এবং মানুষের এবাদত করছে। যেমন জাহেলিয়াতের লোকেরা লাত, মানাত, উজ্জা, হুবল এবং অন্যান্য দেব-দেবীর পূজা করত। এই শির্ককেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছিল। তাদেরকে যখন তাওহীদের দিকে আহবান করা হল, তখন তারা ঘৃণাভরে তা প্রত্যাখ্যান করল এবং তাদের কল্পিত মাবুদগুলোর পক্ষ অবলম্বন করে মুসলিমদের প্রতি ক্রোধান্বিত হল। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থা বর্ণনা করেছেনঃ

وَإِذَا ذُكِرَ اللَّهُ وَحْدَهُ اشْمَأَزَّتْ قُلُوبُ الَّذِينَ لَا يُؤْمِنُونَ بِالْآخِرَةِ وَإِذَا ذُكِرَ الَّذِينَ مِن دُونِهِ إِذَا هُمْ يَسْتَبْشِرُونَ

‘‘যখন এককভাবে আল্লাহ্‌র নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন পরকালে অবিশ্বাসীদের অন্তর সংকুচিত হয়ে যায়, আর যখন আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য উপাস্যদের নাম উচ্চারণ করা হয়, তখন তারা আনন্দে উল্লাসিত হয়ে উঠে’’। (সূরা যুমারঃ ৪৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَإِذَا ذَكَرْتَ رَبَّكَ فِي الْقُرْآنِ وَحْدَهُ وَلَّوْاْ عَلَى أَدْبَارِهِمْ نُفُوراً

‘‘আর যখন তুমি কুরআনে একমাত্র তোমার পালনকর্তার কথা উল্লেখ করো, তখন অনীহা বশতঃ ওরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করে চলে যায়’’। (সূরা বানী ইসরাঈলঃ ৪৬) আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ

‘‘তাদের যখন বলা হতো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করতো এবং বলতোঃ আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)

মক্কার মুশরিকরা ভাল করেই জানত যে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলার অর্থই হচ্ছে, তাদের ঐ শির্ককে প্রত্যাখ্যান করা, যাতে তারা লিপ্ত হয়েছিল এবং তারা ঐ তাওহীদকেই গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল, যার প্রতি কালেমায়ে তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ প্রমাণ বহন করে।

সুতরাং ঐ যামানার মুশরিকরাই এই উম্মতের বর্তমান সময়ের অধিকাংশ মুসলিমের চেয়ে কালেমায়ে তায়্যেবার অর্থ সম্পর্কে অধিক অবগত ছিল। বিশেষ করে মক্কার মুশরিকরা এই উম্মতের ঐ সমস্ত আলেমদের চেয়ে কালেমা তায়্যেবার অর্থ অধিক অবগত ছিল, যাদের কাছে শরীয়তের কতক বিষয়ে পর্যাপ্ত জ্ঞান রয়েছে এবং তর্ক শাস্ত্রেও রয়েছে তাদের যথেষ্ট পান্ডিত্য। কিন্তু ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’-এর বিষয়ে জ্ঞান না থাকার কারণে তারা শির্কে লিপ্ত হয়েছে, যা তাওহীদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। আর ‘তাওহীদুল আসমা ওয়াস্ সিফাত’ সম্পর্কেও তাদের কোন জ্ঞান না থাকার কারণে তারা তা অস্বীকার করেছিল। শুধু তাই নয়; বরং নিজেদের মতের সমর্থনে এবং তা প্রচারে তারা কিতাবও রচনা করেছে। তাদের ধারণা ছিল, তাদের মতই সঠিক। অথচ তাদের সে ধারণা প্রসূত মতটিই সম্পূর্ণ বাতিল। দুঃখ জনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে সঠিক ইসলাম লোকদের কাছে এমনই অপরিচিত হয়ে গেছে যে, ভাল বিষয় মন্দে পরিণত হয়েছে আর মন্দ বিষয় ভাল রূপ ধারণ করেছে। এ অবস্থাতেই পরবর্তী প্রজন্মের ছোটরা বড় হয়েছে এবং যুবকরা বৃদ্ধ হয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

«بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاء»

‘‘অপরিচিত অবস্থায় তথা অল্প সংখ্যক লোকের মাধ্যমে সঠিক ইসলামের সূচনা হয়েছে। অচিরেই তা সূচনার অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং এই গরীব তথা অল্পসংখ্যক লোকদের জন্য সুখবর।[8] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেনঃ

«افْتَرَقَتِ الْيَهُودُ عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفَرَّقَتِ النَّصَارَى عَلَى إِحْدَى أَوْ ثِنْتَيْنِ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً وَتَفْتَرِقُ أُمَّتِى عَلَى ثَلاَثٍ وَسَبْعِينَ فِرْقَةً كُلُّهَا فِى النَّارِ إِلاَّ وَاحِدَةً قَالُوا وَمَنْ هِىَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ مَا أَنَا عَلَيْهِ وَأَصْحَابِى»

‘‘ইহুদীরা বিভক্ত হয়েছিল ৭১ দলে। খৃষ্টানরা বিভক্ত হয়েছিল ৭২ দলে। আর আমার উম্মত বিভক্ত হবে ৭৩ দলে। মাত্র একটি দল ব্যতীত বাকীদের সকলেই জাহান্নামে যাবে। সাহাবীগণ জিজ্ঞাসা করলেন, সেটি কোন্ দল? তিনি বললেন, আমি এবং আমার সাহাবীগণ যেই পথে আছি, সেই পথে যারা থাকবে, তারাই হবে নাজাতপ্রাপ্ত দল’’।[9]

এই উম্মতের সম্মানিত তিন যুগ চলে যাওয়ার পর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভবিষ্যৎ বাণী বাস্তবে পরিণত হয়েছে। দ্বীন ইসলামের মূল ভিত্তি তাওহীদ সম্পর্কে অজ্ঞতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। তাওহীদের মূল শিক্ষা হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো এবাদত করা যাবেনা। সেই সঙ্গে আল্লাহ্ তাআলা ও তাঁর রাসূল যে সমস্ত এবাদত ইসলামী শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করেছেন এবং যে পদ্ধতিতে করার আদেশ দিয়েছেন তা ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধদিতে আল্লাহর এবাদত করা যাবেনা। এ বিষয়টি বর্তমানে অবহেলিত। অধিকাংশ মুসলিমের এবাদতে শির্ক-বিদআতের মিশ্রণ ঘটেছে। তারপরও আল্লাহর অশেষ অনুগ্রহে পৃথিবী এমন লোক থেকে খালী হয়নি, যারা দলীল-প্রমাণসহ তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে এবং জ্ঞান ও প্রজ্ঞার সাথে তাওহীদের দিকে আহবান করছে। আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদের মাধ্যমে মানুষের কাছে হেদায়াতের এমন দলীল নাযিল করেছেন, যাতে তাওহীদের মূলমর্ম পরিত্যাগ না হয়। এ বিরাট অনুগ্রহের জন্য আল্লাহ্ তাআলার যথাযোগ্য প্রশংসা করা ও শুকরিয়া আদায় করা জরুরী।

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেছেনঃ

«من أراد ان ينظر إلى وصية محمد صلى الله عليه وسلم التى عليها خاتمه فليقرأ قوله تعالى قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا..... وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيْمًا»

‘‘যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর মোহরাঙ্কিত অসিয়ত দেখতে চায়, সে যেন আল্লাহ তাআলার এ বাণী পড়ে নেয়, হে মুহাম্মদ বলঃ এসো! তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন তা পড়ে শুনাই। আর তা হলো, তোমরা তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না . . . . আর এটাই হচ্ছে আমার সরল-সোজা পথ’’।[10] (সূরা আনআমঃ ৫২-৫৩)

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ উপদেশকে সেই অসীয়তের সাথে তুলনা করা হয়েছে, যা লিখে মোহর লাগানো হয়েছে। তা আর পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করা হয়নি। উদ্দেশ্য হচ্ছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নবুওয়াত পাওয়া থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত উম্মতকে একটি বিষয়েরই (তাওহীদের) দাওয়াত দিয়েছেন। এতে তিনি কোন পরিবর্তন সাধন করেন নি। তাঁর উপর বর্ষিত হোক আল্লাহর পক্ষ হতে অফুরন্ত দুরূদ ও সালাম। বনী শায়বান গোত্রের নেতা মাফরুক যখন দেখল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদ, মেলা ও হজ্জের মৌসুমে আরব গোত্রসমূহকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছেন, তখন সে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললঃ হে কুরাইশী লোক! তুমি আর কিসের দাওয়াত দিচ্ছ? তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কুরআনের এই আয়াত তেলাওয়াত করলেনঃ

قُلْ تَعَالَوْا أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلَّا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلَا تَقْتُلُوا أَوْلَادَكُمْ مِنْ إِمْلَاقٍ نَحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلَا تَقْرَبُوا الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلَا تَقْتُلُوا النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللَّهُ إِلَّا بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ (১৫১) وَلَا تَقْرَبُوا مَالَ الْيَتِيمِ إِلَّا بِالَّتِي هِيَ أَحْسَنُ حَتَّى يَبْلُغَ أَشُدَّهُ وَأَوْفُوا الْكَيْلَ وَالْمِيزَانَ بِالْقِسْطِ لَا نُكَلِّفُ نَفْسًا إِلَّا وُسْعَهَا وَإِذَا قُلْتُمْ فَاعْدِلُوا وَلَوْ كَانَ ذَا قُرْبَى وَبِعَهْدِ اللَّهِ أَوْفُوا ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ (১৫২) وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

‘‘তুমি বলোঃ এসো, আমি তোমাদেরকে ঐসব বিষয় পাঠ করে শুনাই, যেগুলো তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য হারাম করেছেন। তা এই যে, আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কিছুকে অংশীদার করোনা, পিতা-মাতার সাথে সদয় ব্যবহার করো, স্বীয় সন্তানদেরকে দারিদ্রে্যর কারণে হত্যা করোনা আমি তোমাদেরকে ও তাদেরকে আহার দেই। অশ্লীলতার কাছেও যেয়োনা, প্রকাশ্য হোক কিংবা অপ্রকাশ্য, যাকে হত্যা করা আল্লাহ্ হারাম করেছেন তাকে হত্যা করোনা; কিন্তু ন্যায়ভাবে হলে ভিন্ন কথা। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা বুঝ। এতিমদের ধন-সম্পদের কাছেও যেয়োনা; কিন্তু উত্তম পন্থায়- যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপ পূর্ণ কর ন্যায় সহকারে। আমি কারো উপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়-দায়িত্ব চাপিয়ে দেইনা। যখন তোমরা কথা বল, তখন সুবিচার কর। যদিও তা নিকটাত্মীয়ের বিরুদ্ধে হয়। আল্লাহ্‌র অঙ্গীকার পূর্ণ কর। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলোনা। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও’’। (সূরা আনআমঃ ১৫১-১৫৩) এই মুহকাম আয়াতগুলোতে একটি আদেশ এবং একটি নিষেধ রয়েছে। এ রকমই আল্লাহ্ তাআলা ইবরাহীম খলীল (আঃ) এর ব্যাপারে সূরা বাকারার ১৩১-১৩২ নং আয়াতে বলেনঃ

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (১৩১) وَوَصَّى بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَى لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنْتُمْ مُسْلِمُونَ

‘‘স্মরণ করো, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম। এরই অসিয়ত করেছে ইবরাহীম তার সন্তানদেরকে। ইয়াকুবও একই অসীয়ত করেছে তার সন্তানদেরকে। সে বলেছিলঃ হে আমার সন্তানগণ! নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের জন্য এ দ্বীনকে মনোনীত করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে কখনো মৃত্যুবরণ করো না’’।

সাহাবী মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর পিছনে একটি গাধার পিঠে বসে ছিলাম। তিনি তখন আমাকে ডাক দিয়ে বললেনঃ

«يَا مُعَاذُ هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللَّهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ قُلْتُ اللَّهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللَّهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا فَقُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ أُبَشِّرُ بِهِ النَّاسَ قَالَ لاَ تُبَشِّرْهُمْ فَيَتَّكِلُوا»

‘‘হে মুআয! তুমি কি জানো, বান্দার উপর আল্লাহর কি হক রয়েছে? আর আল্লাহর উপর বান্দার কি হক আছে? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো যারা তার সাথে কাউকে শরিক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আমি বললাম, ইয়া রাসূলুল্লাহ, আমি কি এ সুসংবাদ লোকদেরকে জানিয়ে দেব না? তিনি বললেন, তুমি তাদেরকে এ সুসংবাদ দিওনা। তাহলে তারা এবাদত ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে’’।[11]

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ পূর্বের আয়াতগুলোর অর্থ বহন করার কারণেই শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব (রঃ) আয়াতগুলোর পর পরই এ হাদীছটি উল্লেখ করেছেন। আর তা হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পবিত্র জবানের বাণীঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে তারা তাঁরই এবাদত করবে এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করবে না। আল্লামা ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) বলেনঃ বান্দার উপর আল্লাহর হক হচ্ছে, তারা আল্লাহর শরীয়ত মোতাবেক তাঁর এবাদত করবে, নিজের মন যেভাবে চায় সেভাবে নয়। কারণ নিজের মন মত এবাদত করলে তা শয়তানের এবাদতে পরিণত হয়। আর আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করবেনা। এই দু’টি অর্থাৎ আল্লাহর এবাদত করা এবং আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশিত শরীয়ত অনুযায়ী এবাদত করাই নাজাতের একমাত্র মাধ্যম। কতই না সুন্দর এ দু’টি মাধ্যম। আল্লাহর ক্রোধ ও তাঁর জাহান্নাম থেকে কেবল সেই রক্ষা পাবে, যে এই দু’টি বিষয়ের উপর আমল করবে। কিন্তু পরবর্তী যুগের কেউ পথভ্রষ্ট হয়ে আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করেছে। আবার কেউ বিদআতের পথ বেছে নিয়েছে আবার কেউ উভয়টিতেই লিপ্ত হয়েছে।

সুতরাং যে ব্যক্তি একমাত্র আল্লাহর হক তথা এবাদতের কোন অংশ যেমন দুআ করা, সাহায্য চাওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে প্রদান করল, যে সেই এবাদতের হকদার নয় সে তাগুতের প্রতি ঈমান আনয়ন করল, আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করল এবং কুফরী করল।

حَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللَّهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হচ্ছে যারা তার সাথে কাউকে শরীক করবে না, তিনি তাদেরকে শাস্তি দেবেন নাঃ এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, বিবেক দ্বারা আল্লাহর উপর কোন অত্যাবশ্যকীয় ওয়াজিব বা হক নির্ধারণ করা যাবেনা। যেমন ধারণা করে থাকে মুতাযেলা সম্প্রদায়। তাদের ধারণা সৎ লোককে জান্নাতে স্থান দেয়া এবং পাপীকে জাহান্নামে পাঠানো আল্লাহর উপর ওয়াজিব। মূলতঃ আল্লাহ্ তাআলার উপর কোন ওয়াজিব নেই। কিন্তু আল্লাহ্ তাআলার একনিষ্ঠ ও তাওহীদপন্থী বান্দারা যেহেতু তাদের ইচ্ছায়, এবাদতে, আশা-আকাঙ্খায় ও ভয়-ভীতির সময় আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দারস্থ হয়না এবং তাদের কথা ও কাজের মাধ্যমে তথা সকল প্রকার এবাদতের মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও নৈকট্য ও সন্তুষ্টি কামনা করেনা, তাই তাদেরকে শাস্তি না দেয়ার বিষয়টি আল্লাহ তাআলা অনুগ্রহ করে তাঁর নিজের উপর আবশ্যক করে নিয়েছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) জিন ও মানব জাতি সৃষ্টির রহস্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানা গেল। আর তা হচ্ছে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা এবং তাঁর এবাদতে অন্য কাউকে শরীক না করা।

২) এককভাবে আল্লাহর এবাদতই হচ্ছে তাওহীদ। কারণ এটা নিয়েই বিবাদ।

৩) যার তাওহীদ ঠিক নেই, তার এবাদতও ঠিক নেই। আল্লাহ্ তাআলার বাণীঃ وَلا أَنْتُمْ عَابِدُونَ مَا أَعْبُدُ এর অর্থও তাই।

৪) রাসূল পাঠানোর হিকমত ও রহস্য জানা গেল।

৫) সকল উম্মতই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের রিসালাতের আওতাধীন।

৬) সকল নবী-রাসূলের দ্বীন ছিল এক ও অভিন্ন। আর তা হচ্ছে ইসলাম।[12]

৭) সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তাগুতকে অস্বীকার করা ব্যতীত আল্লাহ্ তাআলার এবাদতের কল্পনাও করা যায়না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَمَنْ يَكْفُرْ بِالطَّاغُوتِ وَيُؤْمِنْ بِاللَّهِ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى لَا انْفِصَامَ لَهَا وَاللَّهُ سَمِيعٌ عَلِيمٌ

‘‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস স্থাপন করবে, সে ধারণ করে নিয়েছে সুদৃঢ় হাতল, যা বিচ্ছিন্ন হবার নয়। আর আল্লাহ্ সবই শুনেন ও জানেন’’। (সূরা বাকারাঃ ২৫৬)[13]

৮) আল্লাহর এবাদত ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর এবাদত করা হয়, সেগুলোই তাগুত হিসেবে গণ্য।

৯) সালাফে-সালেহীনের কাছে সূরা আনআমের উল্লেখিত তিনটি মুহকাম আয়াতের বিরাট মর্যাদার কথা জানা যায়। এতে দশটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এর প্রথমটিই হচ্ছে; শির্কের প্রতিবাদ ও তা নিষিদ্ধতার ব্যাপারে।

১০) সূরা ইস্রায় কতগুলো মুহকাম আয়াত রয়েছে এবং তাতে আঠারোটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে। আল্লাহ বিষয়গুলোর সূচনা করেছেন তাঁর এই বাণী দ্বারাঃ

لَا تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتَقْعُدَ مَذْمُومًا مَخْذُولَا

‘‘স্থির করোনা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন উপাস্য। তাহলে তুমি নিন্দিত ও অসহায় হয়ে পড়বে’’। (সূরা ইসরাঃ ২২) আর এই প্রসঙ্গের সমাপ্তি ঘটিয়েছেন তাঁর উক্ত বাণী দ্বারাঃ

وَلاَ تَجْعَلْ مَعَ اللَّهِ إِلَهًا آخَرَ فَتُلْقَى فِي جَهَنَّمَ مَلُومًا مَدْحُورًا

‘‘আর আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন উপাস্য স্থির করোনা। তাহলে নিন্দিত ও আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ থেকে বিতাড়িত অবস্থায় জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হবে’’। (সূরা ইসরাঃ ৩৯) আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা তাঁর এই বাণীঃ ﴾ذَلِكَ مِمَّا أَوْحَى إِلَيْكَ رَبُّكَ مِنَ الْحِكْمَةِ﴿ ‘‘এটা ঐ হিকমতের অন্তর্ভুক্ত, যা তোমার প্রতিপালক তোমাকে অহী মারফত দান করেছেন’’ দ্বারা এ বিষয়গুলোর সুমহান মর্যাদাকে উপলব্ধি করার প্রতি আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন।

১১( এ অধ্যায়ে সূরা নিসার ঐ আয়াতটি জানা গেল, যাতে দশটি হক সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যার সূচনা হয়েছে আল্লাহ তাআলার এই বাণী দ্বারাঃ وَاعْبُدُوا اللَّهَ وَلا تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا ‘‘তোমরা আল্লাহর এবাদত করো; তাঁর সাথে অন্য কাউকে শরীক করোনা আর পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ করো’’।

১২) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অন্তিম অসিয়তের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করা। আর তা হচ্ছে উম্মতকে শির্ক থেকে সতর্ক করা এবং তাতে লিপ্ত হওয়া থেকে নিষেধ করার বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

১৩) আমাদের উপর আল্লাহ তাআলার হক সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করা জরুরী।

১৪) বান্দা যখন আল্লাহর হক আদায় করবে তখন আল্লাহ তাআলার উপর বান্দার হক কী? তা জানা গেল।

১৫) অধিকাংশ সাহাবীই এ বিষয়টি জানতেন না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহুকে মানুষের কাছে মাসআলাটি গোপন রাখার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ তা মানুষকে বলে দিলে তারা আল্লাহর সীমাহীন দয়া ও অনুগ্রহের উপর ভরসা করে আমল ছেড়ে দিতে পারে। তাই মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু মৃত্যুর সময়ই কেবল ইল্ম গোপন করার অপরাধে অপরাধী হওয়ার ভয়ে তা বলে দিয়েছেন। সুতরাং মুআয রাযিয়াল্লাহু আনহু জীবিত থাকা অবস্থায় এ বিষয়টি সম্পর্কে অধিকাংশ সাহাবীরই জ্ঞান ছিল না।

১৬) কোন বিশেষ স্বার্থে ইল্ম গোপন রাখার বৈধতা রয়েছে।

১৭) আনন্দ দায়ক বিষয়ে কোন মুসলিমকে সুখবর দেয়া মুস্তাহাব।

১৮) আল্লাহর অপরিসীম রহমতের উপর ভরসা করে আমল বাদ দেয়ার ভয়।

১৯) অজানা বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তির এই কথা বলা উচিৎ যে, الله ورسوله أعلم অর্থাৎ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই সবচেয়ে ভাল জানেন।[14]

২০) কাউকে বাদ রেখে অন্য কাউকে কোনো বিষয়ে জ্ঞান দান করার বৈধতা সম্পর্কে জানা গেল।

২১) গাধার পিঠে আরোহন করার মধ্যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিনয়-নম্রতার প্রমাণ মিলে। সেই সঙ্গে তাঁর পিছনে মুআযকে বসার সুযোগ দেয়ার মধ্যে তাঁর বিনয়ী হওয়ার বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট।

২২) একই পশুর পিঠে একজনের পিছনে অন্য ব্যক্তি আরোহনের বৈধতা জানা গেল।

২৩) মুআয বিন জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা প্রমাণিত হল।

২৪) তাওহীদের মর্যাদা ও গুরুত্ব জানা গেল।

[7] - শুধু তাই নয়; কুরআন ও সুন্নাহয় এভাবে তাওহীদের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও দলীল-প্রমাণ উপস্থাপন করা এবং শির্ক থেকে কঠোরভাবে নিষেধ করার পরও বর্তমানে মুসলিম জাতির অধিকাংশ লোকের নিকট তাওহীদের বিষয়টি সম্পূর্ণ উপেক্ষিত। মুসলিম সমাজগুলো আজ শির্কে পরিপূর্ণ। অলী-আওলীয়ার কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে শির্কের অগণিত আড্ডা। নির্মিত হয়েছে কবরের উপর অসংখ্য মাজার ও গম্বুজ। অনেক ক্ষেত্রে এ সমস্ত মাজার ও গম্বুজের সৌন্দর্য আল্লাহর ঘর মসজিদকেও হার মানায়। শির্কের এ সমস্ত কেন্দ্রে চলছে ইসলামের নামে নানা প্রকার শির্কী কর্মকান্ড। কবর ও মাজারে সিজদাহ, কবরবাসীর কাছে দুআ করা, তাদের কাছে সাহায্য চাওয়া, তাদের উদ্দেশ্যে পশু কুরবানী করা, মানত করাসহ সকল প্রকার শির্কই চলছে সেখানে। ক্ষেত্র বিশেষে বর্তমান কালের মুসলিমদের র্শিক আইয়্যামে জাহেলিয়াতের শির্ককেও হার মানায়। এ কথা বললে ভুল হবে না যে, বর্তমান কালের বেশ কিছু মুসলিমের শির্ক আইয়্যামে জাহেলীয়াতের আবু জাহেল, আবু তালেব এবং সেকালের অন্যান্য লোকদের শির্কের চেয়েও ভয়াবহ। কারণ সেকালের মুশরিকরা শুধু সুখ-শান্তিতে থাকার সময়ই আল্লাহর সাথে তাদের দেব-দেবীকে শরীক করত এবং তাদের সেই শির্ক ছিল আল্লাহর এবাদত তথা তাওহীদে উলুহীয়াতের ক্ষেত্রেই। মোট কথা নিম্নের তিনটি কারণে বর্তমান কালের মুসলিমদের বিরাট এক জামআতের শির্ক মক্কার কুরাইশদের শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ।

১) সেকালের মুশরিকরা শুধু সুখ-শান্তি ও আমোদ-প্রমোদে থাকার সময়ই আল্লাহর সাথে শরীক সাব্যস্ত করত। আর তাদের উপর বিপদাপদ ও মসীবত আপতিত হলে তারা তাদের বাতিল মাবুদগুলোকে ভুলে যেত এবং খালেসভাবে আল্লাহকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ কুরআনেই উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেনঃ

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে, তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কেই ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে’’। (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫)

কিন্তু আপনি যদি বর্তমান কালের এক শ্রেণীর কবর ও মাজার পূজারী মুসলিমদের দিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, তারা সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শরীক করে থাকে। বিপদে পড়েও তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কল্পিত অলী-আওলীয়াকেই উদ্ধারের জন্য আহবান করে। অথচ মক্কার মুশরিকরা কখনই এ ধরণের কাজ করত না। এমন কি তারা বিশ্বাসও করত না যে, বিপদ হতে উদ্ধারের ক্ষমতা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো আছে। শুধু তাই নয়, তারা একমাত্র আল্লাহকেই সৃষ্টি করা, রিযিক দেয়া বৃষ্টি বর্ষণ করা এবং জীবন-মরণের মালিক মনে করত। সুতরাং যেই মুশরিক শুধু সুখের সময় আল্লাহর সাথে অন্য কিছুকে শরীক করে আর যেই নামধারী মুসলিম সুখে-দুঃখে তথা সকল অবস্থায় আল্লাহর সাথে শরীক করে, তাদের উভয়ের মধ্যে নামধারী মুসলিমের শির্কটিই অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভালভাবে বুঝা উচিৎ।

২) মক্কার কুরাইশরা শুধু আল্লাহর প্রিয় ও নৈকট্যপ্রাপ্ত লোকদেরকেই আল্লাহর সাথে শরীক করত। যেমন লাত, মানাত, উজ্জা এবং অন্যান্য অলী-আওলীয়াকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই অবস্থার বিবরণ দিতে গিয়ে বলেনঃ

وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا

‘‘তারা বলছে: তোমরা তোমাদের উপাস্যদেরকে ত্যাগ করো না এবং ত্যাগ করো না ওয়াদ, সুয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নসরকে’’। (সূরা নূহঃ ২৩) বুখারী ও মুসলিম শরীফে আব্দুল্লাহ্ ইবনে আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে, উল্লেখিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি বলেনঃ এগুলো হচ্ছে নূহ (আঃ)এর জাতির সৎ লোকদের নাম। তারা যখন মারা গেল তখন শয়তান নূহ (আঃ)-এর কাওমের জীবিত লোকদের নিকট আগমণ করে বললঃ তোমরা তাদের মজলিসে তথা বসার স্থানে তাদের ছবি স্থাপন কর। তাদের নামেই এগুলোর নামকরণ কর। কারণ তাদের ছবি দেখলে তোমরা আল্লাহর এবাদতের আগ্রহ পাবে। তারা শয়তানের প্রস্তাবকে সুন্দর মনে করে তাই করল। কিন্তু তখনই তারা এগুলোর এবাদত শুরু করেনি। ঐ যুগের লোকেরা যখন মারা গেল এবং তাদের স্থলে নতুন এক প্রজন্মের আবির্ভাব ঘটল, তখন শয়তান এই নতুন যুগের নতুন প্রজন্মের নিকট আগমণ করল। উল্লেখ্য যে, এই নতুন লোকেরা ঐ সমস্ত অলী-আওলীয়ার আসল ইতিহাস ভুলে গিয়েছিল এবং তাওহীদের শিক্ষা হতে বিচ্যুত হয়েছিল। তাই শয়তান দ্বিতীয়বার আগমণ করে যখন তাদেরকে এগুলোর এবাদতের বা এগুলোর উসীলা দিয়ে আল্লাহর এবাদতের আহবান জানাল, তখন ইলম না থাকার কারণে তারা শয়তানের সেই আহবানে সাড়া দিল এবং এদের এবাদত শুরু হয়ে গেল। এখান থেকেই শির্কের সূচনা হয় এবং বনী আদমের মধ্যে শির্ক প্রবেশ করে।

মোট কথা পূর্ব যামানার লোকেরা আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত সৎ লোক, নিষ্পাপ ফেরেশতা, আল্লাহর অনুগত গাছপালা, পাথর ইত্যাদি মাসুম (নিষ্পাপ) বস্ত্তকে আল্লাহর সাথে শরীক করত। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, বর্তমান কালের নামধারী অসংখ্য মুসলিম আল্লাহর সাথে আল্লাহর এমন মাখলুককে শরীক করে, যারা সর্বাধিক নিকৃষ্ট ও পাপিষ্ঠ। তাদের পাপাচার ও অশ্লীলতা জনগণের কাছে সুপ্রকাশিত। তা সত্ত্বেও লোকেরা তাদেরকে আহবান করছে, তাদের কাছে দুআ করছে, সিজদাহ করছে এবং তাদের কাছে সাহায্য চাচ্ছে। সুতরাং যারা আল্লাহর প্রিয় বান্দাকে আল্লাহর শরীক সাব্যস্থ করে আর যারা আল্লাহর নিকৃষ্ট বান্দাকে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তারা উভয়েই কি সমান। নিঃসন্দেহে দ্বিতীয় দলের শির্ক প্রথম দলের শির্কের চেয়ে অধিক ভয়াবহ। সুতরাং বিষয়টি ভাল করে ভেবে দেখা উচিৎ।

৩) মক্কার মুশরিকদের শির্ক ছিল শুধু তাওহীদে উলুহীয়ার ক্ষেত্রেই। তাওহীদে রুবুবীয়াকে তারা মেনে চলত। তারা যে আল্লাহকে আসমান-জমিনসহ সকল বস্ত্তর একমাত্র সৃষ্টিকারী, রিযিক দাতা, জীবন-মরণের মালিক এবং পৃথিবীর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক মনে করত, কুরআনই তার সাক্ষ্য দিয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ﴾وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ﴿ ‘‘এবং তুমি যদি তাদেরকে প্রশ্ন করো- কে সৃষ্টি করেছে আসমান ও যমীন? তবে অবশ্যই তারা বলবে আল্লাহ্’’। (সূরা লুকমানঃ ২৫) কিন্তু আফসোসের বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে এমন লোকও মুসলিম হওয়ার দাবী করছে, যারা আল্লাহর রুবুবীয়াতেও অলী-আওলীয়াকে শরীক করছে। নিম্নের উদাহরণগুলো মন দিয়ে পড়লে ও গভীরভাবে উপলদ্ধি করলেই বিষয়টি সহজভাবে অনুধাবন করা যাবে।

১) ভেদে মারেফত বা ইয়াদে খোদা নামক বইয়ের ১৫ পৃষ্ঠায় মৃতকে জীবিত করার যে গল্পটা আছে তা নিম্নরুপঃ

শামসুদ্দীন তাব্রীজী নামের এক লোক ছিলেন। লোকেরা তাকে পীর সাহেব কেবলা বলত। এবার আসি মূল গল্পে। একদা হযরত পীর সাহেব কিবলা রোম শহরের দিকে রওয়ানা হইলেন। পথিমধ্যে ঝুপড়ির ভেতর এক অন্ধ বৃদ্ধকে লাশ সামনে নিয়া কাদঁতে দেখিলেন। হুজুর বৃদ্ধকে প্রশ্ন করিলে বৃদ্ধ উত্তর করিলেন, ‘‘হুজুর এই পৃথিবীতে আমার খোঁজ-খবর করিবার আর কেউ নাই, একটি পুত্র ছিল সে আমার যথেষ্ট খেদমত করিত, তাহার ইন্তেকালের পর সে একটি নাতি রাখিয়া যায়। সেই ১২ বছরের নাতি একটা গাভী পালিয়া আমাকে দুগ্ধ খাওয়াইত এবং আমার খেদমত করিত, তার লাশ আমার সম্মুখে দেখিতেছেন। এখন উপায় না দেখিয়া কাঁদিতেছি’’। হুজুর বলিলেন এ ঘটনা কি সত্য? বৃদ্ধ উত্তর করিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তখন হুজুর বলিলেনঃ "হে ছেলে আমার হুকুমে দাঁড়াও"। ছেলেটি উঠে দাঁড়াল এবং দাদুকে জড়াইয়া ধরিল, বৃদ্ধ তাকে জিজ্ঞেস করিল ‘‘তুমি কিরুপে জিন্দা হইলে’’। ছেলে জবাব দিল, ‘‘আল্লাহর অলী আমাকে জিন্দা করেছেন’’। (নাউযুবিল্লাহ) তারপর ঐ অঞ্চলের বাদশাহ হুজুরের এই খবর পেয়ে উনাকে তলব করিলেন। উনাকে পরে জিজ্ঞেস করিলেন "আপনি কি বলিয়া ছেলেটিকে জিন্দা করিয়াছেন"। হুজুর বলিলেন আমি বলেছি ‘‘হে ছেলে আমার আদেশে জিন্দা হইয়া যাও’’। অতঃপর বাদশাহ বলিলেন, ‘‘যদি আপনি বলিতেন আল্লাহর আদেশে’’। হুজুর বলিলেন "মাবুদ! মাবুদের কাছে আবার কি জিজ্ঞেস করিব। তাহার আন্দাজ নাই (নাউ-যুবিল্লাহ)। এই বৃদ্ধের একটি মাত্র পুত্র ছিল তাহাও নিয়াছে, বাকী ছিল এই নাতিটি যে গাভী পালন করিয়া কোনরুপ জিন্দেগী গোজরান করিত, তাহাকেও নিয়া গেল। তাই আমি আল্লাহ পাকের দরবার থেকে জোরপূর্বক রুহ নিয়া আসিয়াছি’’। (নাউ-যুবিল্লাহ)।

এরপর বাদশাহ বলিলেন আপনি শরীয়াত মানেন কিনা? হুজুর বলিলেন ‘‘নিশ্চয়ই! শরীয়াত না মানিলে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শাফায়াত পাইব না’’। বাদশাহ বলিলেন, ‘‘আপনি শির্ক করিয়াছেন, সেই অপরাধে আপনার শরীরের সমস্ত চামড়া তুলে নেওয়া হইবে’’। এই কথা শুনিয়া আল্লাহর কুতুব নিজের হাতের অঙ্গুলি দ্বারা নিজের পায়ের তলা হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত শরীরের চামড়া ছাড়াইয়া তা বাদশাহর কাছে ফেলিয়া জঙ্গলে চলিয়া গেলেন। পরদিন ভোরবেলা যখন সূর্য উঠিল তার চর্মহীন গায়ে তাপ লাগিল। তাই তিনি সূর্যকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন ‘‘হে সূর্য, আমি শরীয়াত মানিয়াছি, আমাকে কষ্ট দিওনা’’। তখন ওই দেশের জন্য সূর্য অন্ধকার হইয়া গেল। দেশের মধ্যে শোরগোল পড়িয়া গেল। এই অবস্থা দেখিয়া বাদশাহ হুজুরকে খুঁজিতে লাগিলেন। জঙ্গলে গিয়া হুজুরের কাছে বলিলেনঃ শরীয়াত জারি করিতে গিয়া আমরা কি অন্যায় করিলাম, যাহার জন্য আমাদের উপর এমন মুসিবত আনিয়া দিলেন। তখন হুজুর সূর্য কে লক্ষ্য করিয়া বলিলেনঃ আমি তোমাকে বলিয়াছি আমাকে কষ্ট দিওনা, কিন্তু দেশবাসীকে কষ্ট দাও কেন? সূর্যকে বশ করা কি কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব? ইহা বলা মাত্র সূর্য আলোকিত হইয়া গেল। আল্লাহ্ পাক তাহার ওলীর শরীর ভাল করিয়া দিলেন।

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ! উপরোক্ত বানোয়াট কাহিনীতে গভীরভাবে দৃষ্টি দিলে দেখা যায় যে এতে একাধিক শির্ক বিদ্যমান। যেমনঃ

ক) কুরআন বলছে, জীবিতকে মৃত্যু দেয়া এবং মৃতকে জীবিত করা একমাত্র আল্লাহর কাজ। কোন নবী বা অলী মৃতকে জীবিত করার ক্ষমতা রাখে না। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ مَنْ يَرْزُقُكُمْ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ أَمْ مَنْ يَمْلِكُ السَّمْعَ وَالْأَبْصَارَ وَمَنْ يُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَيُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَيِّ وَمَنْ يُدَبِّرُ الْأَمْرَ فَسَيَقُولُونَ اللَّهُ فَقُلْ أَفَلَا تَتَّقُونَ

‘‘হে নবী! তুমি জিজ্ঞেস করো, তোমাদেরকে আসমান থেকে ও যমীন থেকে কে রুযী দান করেন? কিংবা কে তোমাদের কান ও চোখের মালিক? তাছাড়া কে জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করেন এবং কেইবা মৃতকে জীবিতের মধ্য থেকে বের করেন? কে করেন কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থাপনা? তখন তারা বলে উঠবে, আল্লাহ! তখন তুমি বলো, তারপরেও তোমরা ভয় করছনা?’’ (সূরা ইউনুসঃ ৩১)

এই আয়াত থেকে বুঝা যায় মক্কার মুশরিকরাও এ কথা বিশ্বাস করতনা যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত বা জীবিতকে মৃত্যু দান করার ক্ষমতা রাখে। অথচ মুসলিম নামধারী পীর ও মুরীদগণ তা বিশ্বাস করে থাকে।

এমনি আরও অনেক আয়াত রয়েছে, যা থেকে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউ মৃতকে জীবিত করতে পারে না। এটি একমাত্র আল্লাহর বৈশিষ্ট। এমন কি আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অসংখ্য মুজেযা থাকা সত্ত্বেও মৃতকে জীবিত করার মুজেযা তাঁকে দেয়া হয় নি। এটি ছিল একমাত্র ঈসা (আঃ)এর মুজেযা।

এ ব্যাপারে তাদের দাপট দেখে মনে হয় তাদের কল্পিত অলীরা মৃতকে জীবিত করার ক্ষেত্রে ঈসা (আঃ) এর চেয়েও বেশী ক্ষমতা সম্পন্ন। কারণ ঈসা (আঃ) মৃতকে জীবিত করতেন قُمْ بِإِذْنِ اللَّهِ বলে অর্থাৎ তুমি আল্লাহর আদেশে জীবিত হও। যেমন আল্লাহ তাআলা ঈসা (আঃ)কে লক্ষ্য করে বলেনঃ (وَإِذْ تُخْرِجُ الْمَوتَى بِإِذْنِي) ‘‘এবং যখন তুমি আমার আদেশে মৃতদেরকে বের করে দাড় করিয়ে দিতে’’। (সূরা মায়িদাঃ ১১০)

আর পীর ও মুরীদদের বিশ্বাস হচেছ, তাদের অলীগণ قُمْ بِإِذْني অর্থাৎ আমার আদেশে উঠে দাঁড়াও এ কথা বলে মৃতকে জীবিত করে থাকেন।

সুতরাং কেউ যদি বিশ্বাস করে যে, কোন পীর বা অলী মৃতকে জীবিত করতে পারে, তাহলে সে মুশরিক হিসেবে গণ্য হবে।

খ) চন্দ্র-সূর্য, নদ-নদী, দিবা-রাত্রি ইত্যাদি আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো হুকুমে চলে না। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآَيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ وَهُوَ الَّذِي مَدَّ الْأَرْضَ وَجَعَلَ فِيهَا رَوَاسِيَ وَأَنْهَارًا وَمِنْ كُلِّ الثَّمَرَاتِ جَعَلَ فِيهَا زَوْجَيْنِ اثْنَيْنِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘‘আল্লাহ্, যিনি উধর্বদেশে স্থাপন করেছেন আকাশমন্ডলীকে স্তম্ভ ব্যতীত। তোমরা সেগুলো দেখ। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। এবং সূর্য ও চন্দ্রকে কর্মে নিয়োজিত করেছেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট সময় মোতাবেক আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় পরিচালনা করেন, নিদর্শন সমূহ প্রকাশ করেন, যাতে তোমরা স্বীয় পালনকর্তার সাথে সাক্ষাত সম্পর্কে নিশ্চিত বিশ্বাসী হও। তিনিই ভূমন্ডলকে বিস্তৃত করেছেন এবং তাতে পাহাড়-পর্বত ও নদ-নদী স্থাপন করেছেন এবং প্রত্যেক ফলের মধ্যে দুই প্রকার (জোড়ায় জোড়ায়) সৃষ্টি করেছেন। তিনি দিনকে রাত্রি দ্বারা আবৃত করেন। এতে তাদের জন্য নিদর্শন রয়েছে, যারা চিন্তা করে।’’ (সূরা রাদঃ ২-৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَلَئِنْ سَأَلْتَهُمْ مَنْ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ لَيَقُولُنَّ اللَّهُ فَأَنَّى يُؤْفَكُونَ

‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করো, কে নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছে, চন্দ্র ও সূর্যকে কর্মে নিয়োজিত করেছে? তবে তারা অবশ্যই বলবে ‘আল্লাহ্’। তাহলে তারা কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে? (সূরা আনকাবুতঃ ৬১)

২) বর্তমান সময়ের সুফীরা বিশ্বাস করে যে, পৃথিবীতে কতিপয় আবদাল, কুতুব এবং আওলীয়া আছেন, যাদের হাতে আল্লাহ তাআলা পৃথিবী পরিচালনার কিছু কিছু দায়িত্ব সোপর্দ করে দিয়েছেন। সুতরাং তারা তাদের ইচ্ছামত পৃথিবীর কাজকর্ম পরিচালনা করে থাকেন।

ফাযায়েলে আমাল বইয়ে এই ধরণের একটি ঘটনা উল্লেখ আছে। ঘটনার বিবরণ এই যে, হজরত শাইখুল হাদীছ বলেছেনঃ আমি আমার আববাজানের নিকট প্রায়ই একটা ঘটনা শুনতাম। উহা এই যে, জনৈক ব্যক্তি বিশেষ কোন প্রয়োজনে পানি পথে যাইতেছিল। পথিমধ্যে যমুনা নদী পড়িল, তাহার অবস্থা তখন এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, নৌকা চলাও মুশকিল ছিল, লোকটি পেরেশান হইয়া গেল। লোকজন তাহাকে বলিল অমুক জঙ্গলে একজন কামেল লোক থাকেন, তাহার নিকট গিয়া স্বীয় প্রয়োজন পেশ কর। তিনি নিশ্চয়ই কোন ব্যবস্থা করিবেন। তবে তিনি প্রথমে রাগ করিবেন। তাহাতে তুমি নিরাশ হইও না। লোকটি তাহাদের কথায় জঙ্গলের মধ্যে গিয়া দেখিলেন সেই দরবেশ তাহার বিবি বাচ্চাসহ একটি ঝুপড়ির মধ্যে বাস করিতেছে। সেই ব্যক্তি স্বীয় প্রয়োজন ও যমুনার অবস্থা বর্ণনা করিল, দরবেশ প্রথমে অভ্যাস মোতাবেক রাগ করিয়া বলিল, আমার হাতে কী আছে? আমি কী করিতে পারি? লোকটি কান্নাকাটি করিয়া আপন সমস্যার কথা বলিল, তখন দরবেশ বলিলঃ যাও, যমুনার কাছে গিয়া বলঃ আমাকে ঐ ব্যক্তি পাঠাইয়াছে, যে জীবনে কখনো কিছু খায় নাই এবং বিবির সহিত সহবাস করে নাই। লোকটি যমুনায় গিয়া দরবেশের কথা জানাইল। যমুনা তাহার কথা মত শান্ত হইয়া গেল। সেই লোকটি পার হইয়া যাওয়ার পর যমুনা আবার ভীষণ আকার ধারণ করিল। (দেখুনঃ ফাযায়েলে আমাল, দ্বিতীয় খন্ড, ১৬২ পৃষ্ঠা)

প্রিয় পাঠক বৃন্দ লক্ষ্য করুন, এটি এমন একটি বিশ্বাস যা মক্কার মুশরিকরাও পোষণ করতো না। তারা যখন সাগর পথে ভ্রমণ করার সময় বিপদে আক্রান্ত হত, তখন তারা সকল দেব-দেবীর কথা ভুলে গিয়ে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আল্লাহ তাআলা মক্কার মুশরিকদের সেই কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ

فَإِذَا رَكِبُوا فِي الْفُلْكِ دَعَوْا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ فَلَمَّا نَجَّاهُمْ إِلَى الْبَرِّ إِذَا هُمْ يُشْرِكُونَ

‘‘তারা যখন জলযানে আরোহণ করে তখন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহ্কে ডাকে। অতঃপর তিনি যখন স্থলে এনে তাদেরকে উদ্ধার করেন, তখনই তারা শরীক করতে থাকে।’’ (সূরা আনকাবুতঃ ৬৫) অথচ বর্তমান সময়ের অসংখ্য মুসলিমকে দেখা যায় তারা চরম বিপদের সময়ও আল্লাহকে বাদ দিয়ে কল্পিত অলী-আওলীয়াদেরকে আহবান করে থাকে, যা মক্কার মুশরিকদের শির্ককেও হার মানিয়েছে। কেননা মক্কার লোকেরা শুধু সুখের সময়ই আল্লাহর সাথে অন্যকে শরীক করতো, কিন্তু বিপদের সময় তারা সেগুলোকে ভুলে গিয়ে এক মাত্র আল্লাহকেই ডাকতো। আর বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম উভয় অবস্থাতেই আল্লাহর সাথে শির্ক করছে। এদিক থেকে মূল্যায়ন করলে দেখা যায় বর্তমানের মাজার পূজারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে মক্কার আবু জাহেল ও আবু লাহাবদের শির্ক অধিক হালকা ছিল।

এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, غوث অর্থ হচ্ছে ত্রাণকর্তা। এটি আল্লাহর গুণ। কোন মানুষ গাউছ হতে পারে না। ঢাকা শহরের মহাখালীতে মাসজিদে গাউছুল আযম নামে বিশাল একটি মসজিদ রয়েছে। আমরা সকলেই জানি এখানে গাউছুল আযম দ্বারা আব্দুল কাদের জিলানীকে বুঝানো হয়েছে। আল-গাউছুল আল-আযাম অর্থ হচ্ছে মহান ত্রাণকর্তা। যারা আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে মহা ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বাস করেন, তাদের কাছে আমাদের প্রশ্ন হলো, তারা কি এ ধরণের কথার মাধ্যমে আব্দুল কাদের জিলানী (রঃ) কে আল্লাহর সমান করে দেন নি? শুধু তাই নয় সুফীদের একটি দল বিশ্বাস করে যে, আব্দুল কাদের জিলানী নিজ হাতে লাওহে মাহফুযে নতুন করে বৃদ্ধি করতে বা তা থেকে কিছু কমানোরও অধিকার রাখেন। (নাউযুবিল্লাহ)

৩) বর্তমান সময়ের অনেক মুসলিম নামধারী লোক বিশ্বাস করে যে, তাদের মাশায়েখ ও অলীগণ বিপদ হতে উদ্ধার করতে সক্ষম। তাই বিপদে তারা তাদের অলীদেরকে আহবান করে থাকে। তারা বলে থাকে মদদ ইয়া আব্দুল কাদের জিলানী, হে উমুক, হে উমুক ইত্যাদি। এভাবে বিপদাপদে পড়ে আল্লাহ ছাড়া অন্যকে আহবান করা প্রকাশ্য শির্কের অন্তর্ভূক্ত। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ لَا أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلَا ضَرًّا إِلَّا مَا شَاءَ اللَّهُ وَلَوْ كُنْتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لَاسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ إِنْ أَنَا إِلَّا نَذِيرٌ وَبَشِيرٌ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ

তুমি বলে দাও, আমি আমার নিজের কল্যাণ এবং অকল্যাণ সাধনের মালিক নই, কিন্তু যা আল্লাহ্ চান। আর আমি যদি গায়বের কথা জেনে নিতে পারতাম, তাহলে বহু মঙ্গল অর্জন করে নিতে পারতাম। ফলে আমার কোন অমঙ্গল কখনও হতোনা। আমি তো শুধু একজন ভীতিপ্রদর্শক ও সুসংবাদ দাতা ঈমানদারদের জন্য। (সূরা আ’রাফঃ ১৮৮)

এমনি আরো অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে, যা প্রমাণ করে বতর্মান কালের মাজারপন্থী ও পীরতন্ত্রের অনুসারী মুসলিমরা তাওহীদে রুবুবীয়াতেও শির্ক করছে। যা থেকে মক্কার মূর্তিপূজক মুশরিকরাও বেঁচে থাকত। সুতরাং এ কথা সহজেই বোধগম্য যে, যেই মুসলিম ইসলামের দাবী করে, কিন্তু তাওহীদে উলুহীয়াতে তথা আল্লাহর এবাদতে অন্য কিছুকে শরীক করার সাথে সাথে রুবুবীয়াতেও আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার চেয়ে যে মুশরিক শুধু তাওহীদে উলুহীয়াতে আল্লাহর সাথে শরীক করে, তার শির্ক ঐ নামধারী মুসলিমের শির্কের চেয়ে অধিকতর হালকা। সুতরাং দলীল-প্রমাণসহ উপরোক্ত বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে প্রমাণিত হল যে, বর্তমান কালের মুসলিমদের শির্ক মক্কার মুশরিকদের শির্কের চেয়েও অধিক ভয়াবহ। সত্যিই চিন্তার বিষয়!

এখানে বিশেষভাবে একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে, বিদআতীরা উপরোক্ত ঘটনাগুলোকে অলীদের কারামত বলে প্রচার করে থাকে। আমরা বলবো যে, কারামতে আওলীয়া সত্য। পূর্ববর্তী জাতিসমূহের মধ্যে এবং এই উম্মতের মধ্যে অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অন্যতম আকীদাহ হচ্ছে অলীদের কারামতে বিশ্বাস করা। আল্লাহ তাআলা তাঁর দ্বীনকে শক্তিশালী করা, তাঁর অলীদেরকে সাহায্য করা এবং তাঁর বান্দাদের মাধ্যমে স্বীয় কুদরত প্রকাশ করার জন্য অলীদের মাধ্যমে কারামত প্রকাশ করেন। চাই তা কুদরত সম্পর্কিত হোক বা কাশফ সম্পর্কিত হোক। তবে এগুলো বর্ণনা করার সময় এমন বাক্য পরিহার করতে হবে, যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে, অলীরা নিজের ক্ষমতা বলেই কারামত প্রকাশ করে থাকে এবং যখন ইচ্ছা তখনই তারা তা প্রকাশ করতে পারে। এ জাতিয় বাক্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা আবশ্যক; বরং এগুলো মানুষের সামনে প্রকাশ করার প্রয়োজন হলে এভাবে প্রকাশ করতে হবে, যাতে কেবল আল্লাহ তাআলার ক্ষমতা ও বড়ত্বের বিষয়টি ফুটে উঠে; অলীদের নয়। সাহাবী ও তাবেয়ীদের মধ্যে এ রকম অনেক কারামত প্রকাশিত হয়েছে। সাহাবী ও তাবেয়ীদের পরে যেহেতু প্রচুর মিথ্যা ঘটনা তৈরী করা হয়েছে, তাই পরবর্তীকালের অলীদের কারামত বর্ণনায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমাদের অন্যতম কিতাব আলামুস্ সুন্নাহ, শরহুল আকীদাহ আলওয়াসেতীয়া এবং শরহুল আকীদাহ আত তাহাবীয়ায় কারামতে আওলীয়ার মূলনীতি এবং উহার বেশ কিছু উদাহরণ বর্ণনা করা হয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য কিতাবগুলো পড়ার অনুরোধ রইল।

[8] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ অপরিচিত অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছে-এ কথার বর্ণনা। সহীহ মুসলিম, হাদীছ নং- ১৪৬, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৩২৩৬, সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭৩।

[9] -ইবনু আবী আসেম কিতাবুস সুন্নাতে বর্ণনা করেছেন, হাদীছ নং- ৬৩, ইমাম আলবানী হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন, দেখুন সহীহা, হাদীছ নং- ১৪৯২, সহীহু সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং- ৪০৬৩। ইমাম ইবনে কাছীর এবং অন্যান্য হাফেযগণ বলেনঃ এই হাদীছটি বিভিন্ন সনদে সহীহ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি সুনান এবং অন্যান্য গ্রন্থেও রয়েছে। মুহাম্মাদ বিন নযরও কিতাবুল ইতেসামে হাদীছটি উল্লেখ করেছেন।

[10] - হাদীছের সনদ দুর্বল। দেখুনঃ যঈফু সুনানে তিরমিজী, হাদীছ নং- ৫৯৩।

[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ ঘোড়া ও গাধার নাম রাখা।

[12] - ইসলামই ছিল সকল নবী-রাসূলের দ্বীন। কুরআনে এই কথার অনেক প্রমাণ রয়েছে। নূহ (আঃ) বলেনঃ

فَإِن تَوَلَّيْتُمْ فَمَا سَأَلْتُكُم مِّنْ أَجْرٍ إِنْ أَجْرِيَ إِلَّا عَلَى اللَّهِ وَأُمِرْتُ أَنْ أَكُونَ مِنَ الْمُسْلِمِينَ

‘‘তোমরা যদি আমার নসীহত থেকে মুখ ফিরিয়ে নাও, তা হলে জেনে রাখো যে, আমি তো তোমাদের কাছে কোনো প্রতিদান চাইনি৷ আমার প্রতিদান তো আল্লাহর কাছেই৷ আমাকে হুকুম দেয়া হয়েছে আমি যেন মুসলিম হিসেবে থাকি’’। (সূরা ইউনূসঃ ৭২) আল্লাহ তাআলা ইবরাহীম (আঃ)এর ব্যাপারে বলেনঃ

مَا كَانَ إِبْرَاهِيمُ يَهُودِيًّا وَلَا نَصْرَانِيًّا وَلَٰكِن كَانَ حَنِيفًا مُّسْلِمًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘ইবরাহীম ইহুদী ছিল না, খৃস্টানও ছিল না বরং সে তো ছিল একজন একনিষ্ঠ মুসলিম এবং সে কখনো মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না ৷ ইবরাহীমের যারা অনুসরণ করেছে তারাই তার সাথে ঘনিষ্ঠতম সম্পর্ক রাখার অধিকারী’’। (সূরা আল ইমরানঃ ৬৭) ইবরাহীম খলীল (আঃ) এবং তাঁর পুত্র ইসমাঈল একসাথে সুর মিলিয়ে বলেছেনঃ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا ِنَّكَ أَنتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘‘হে আমাদের রব! আমাদের দু’জনকে তোমার মুসলিম (অনুগত) বানিয়ে দাও৷ আমাদের বংশ থেকে এমন একটি জাতির সৃষ্টি করো যে হবে তোমার মুসলিম৷ তোমার এবাদাতের পদ্ধতি আমাদের বলে দাও এবং আমাদের ভুল-ত্রুটি মাফ করে দাও৷ তুমি বড়ই ক্ষমাশীল ও অনুগ্রহকারী’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَوَصَّىٰ بِهَا إِبْرَاهِيمُ بَنِيهِ وَيَعْقُوبُ يَا بَنِيَّ إِنَّ اللَّهَ اصْطَفَىٰ لَكُمُ الدِّينَ فَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسْلِمُونَ) ‘‘ঐ একই মিল্লাতের পথে চলার জন্য তিনি তার সন্তানদের উপদেশ দিয়েছিলেন এবং এরই উপদেশ দিয়েছিলেন ইয়াকুবও তার সন্তানদেরকে। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমার সন্তানেরা! আল্লাহ তোমাদের জন্য এই দ্বীনটিই পছন্দ করেছেন। কাজেই তোমরা মুসলিম না হয়ে মৃত্যু বরণ করোনা’’। (সূরা বাকারঃ ১৩২) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (وَقَالَ مُوسَىٰ يَا قَوْمِ إِن كُنتُمْ آمَنتُم بِاللَّهِ فَعَلَيْهِ تَوَكَّلُوا إِن كُنتُم مُّسْلِمِينَ) ‘‘মুসা তার কওমকে বলল, হে লোকেরা! যদি তোমরা সত্যিই আল্লাহর প্রতি ঈমান রেখে থাকো তাহলে কেবল তার উপর ভরসা করো, যদি তোমরা মুসলিম হয়ে থাকো’’। (সূরা ইউনুসঃ ৮৪) সাবার রাণী বলেছিলেনঃ (رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِين) ‘‘হে আমার রব! আমি নিজের উপর বড়ই জুলুম করেছি এবং এখন আমি সুলাইমানের সাথে আল্লাহ রাববুল আলামীনের আনুগত্য কবুল করে নিয়েছি’’। (নামালঃ ৪৪)

[13] - মোটকথা তাগুতকে অস্বীকার না করা পর্যন্ত কারো ইসলাম পরিশুদ্ধ হবেনা। কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহএর মর্মার্থ এটিই। সুতরাং لاإله এই কথার মাধ্যমে প্রত্যেক ঐ তাগুতকে অস্বীকার করা হয়েছে, আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদত করা হয়। আর إلا الله কালেমার এই অংশের মাধ্যমে কেবল আল্লাহর একত্ববাদ সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ (وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِي كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اُعْبُدُوا اللَّهَ وَاجْتَنِبُوا الطَّاغُوتَ) ‘‘আমি প্রত্যেক উম্মতের মধ্যেই রাসূল পাঠিয়েছি। তাঁর মাধ্যমে এ নির্দেশ দিয়েছি যে তোমরা আল্লাহর এবাদত করো, আর তাগুতকে বর্জন করো’’। সুতরাং আল্লাহর এবাদতকে একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। আর তাগুতের এবাদতকে অন্য একটি বিষয় হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। সুতরাং একজন মানুষ কেবল তখনই মুসলিম বলে গণ্য হবে, যখন সে আল্লাহর এবাদত করবে এবং একই সাথে তাগুত থেকে দূরে থাকবে।

আর طاغوت শব্দের উৎপত্তি হয়েছে الطغيان থেকে। তাগুত বলা হয় এমন প্রত্যেক ব্যক্তিকে, যে অন্যায় ও বিদ্রোহে সীমা লংঘন করে। আল্লাহ তাআলা মুসা আলাইহিস সালামকে লক্ষ্য করে বলেছেনঃ ﴾اذْهَبْ إِلَىٰ فِرْعَوْنَ إِنَّهُ طَغَى﴿ ‘‘এখন তুমি যাও ফেরাউনের কাছে। কেননা সে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছে’’। (সূরা তোহাঃ ২৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ (إِنَّا لَمَّا طَغَى الْمَاءُ حَمَلْنَاكُمْ فِي الْجَارِيَةِ) ‘‘যে সময় পানির তুফান সীমা অতিক্রম করলো তখন আমি তোমাদেরকে জাহাজে আরোহন করিয়েছিলাম’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ১১) অর্থাৎ পানি যখন অত্যন্ত বেড়ে গেল। আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ﴾ فَأَمَّا ثَمُودُ فَأُهْلِكُوا بِالطَّاغِيَةِ ﴿ ‘‘তাই সামূদ জাতিকে একটি সীমাহীন বিপদ দিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে’’। (সূরা আলহাক্কাহঃ ৫) অর্থাৎ বিকট ও ভয়াবহ একটি চিৎকারের মাধ্যমে। সুতরাং যে ব্যক্তি বা বিষয় সীমা অতিক্রম করে, তাকেই তাগুত বলা হয়। শয়তানকে আল্লাহর আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার কারণে এবং সীমালংঘন করার কারণে তাগুত বলা হয়। আল্লাহ ব্যতীত অন্য যে মাবুদের এবাদত করা হয়, সেই মাবুদ যদি উক্ত এবাদতের প্রতি সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে তাকে তাগুত বলা হয়। যাদুকর এবং গণক উভয়ই তাগুত। এমনি আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য প্রত্যেক মাবুদই তাগুত।

[14] - আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই অধিক জানেন, -এই কথা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবদ্দশায় বলা বৈধ ছিল। এখন শুধু আমরা বলবোঃ আল্লাহই ভাল জানেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর সালাফদেরকে এই কথা বলতে শুনা যেতনা যে, الله ورسوله أعلم (আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)।
তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ১

ব্যাখ্যাঃ باب তথা অধ্যায় অর্থ হচ্ছে কোনো বিষয়ে বা স্থানে প্রবেশ করার রাস্তা। লেখক বলেনঃ وما يكفره من الذنوب এখানে ما শব্দটি মাসদারীয়া তথা ক্রিয়ামূলের অর্থ প্রদান করেছে। অর্থাৎ তাওহীদ কর্তৃক গুনাহসমূহ মোচন করা সম্পর্কে। ما শব্দটি মাউসূলার অর্থেও ব্যবহৃত হতে পারে। তখন অর্থ হবে والذي يكفره من الذنوب তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ মোচন করে দেয়। এখানে তাওহীদ দ্বারা ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’ উদ্দেশ্য। দুআ, কুরবানী এবং মানতসহ সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য এবাদত কেবল আল্লাহর জন্যই নির্দিষ্ট করার নামই হচ্ছে ‘তাওহীদুল ইবাদাহ্’। সূরা গাফেরের ১৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَادْعُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ

‘‘অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে ডাক দ্বীনকে তাঁর জন্য একনিষ্ঠ করে। যদিও কাফেররা তা অপছন্দ করে’’। সূরা আরাফের ২৯ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃوَادْعُوهُ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَ ‘‘তাঁকে ডাক, দ্বীনকে তাঁর জন্য খালেস করে’’।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الَّذِينَ آَمَنُوا وَلَمْ يَلْبِسُوا إِيمَانَهُمْ بِظُلْمٍ أُولَئِكَ لَهُمُ الْأَمْنُ وَهُمْ مُهْتَدُونَ

‘‘যারা ঈমান এনেছে এবং ঈমানকে যুলুমের সাথে মিশ্রিত করেনি, তাদের জন্যই রয়েছে শান্তি ও নিরাপত্তা এবং তারাই হেদায়াতপ্রাপ্ত’’। (সূরা আনআমঃ ৮২)

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ এখানে যুলুম দ্বারা বড় শির্ক উদ্দেশ্য। মারফু সূত্রে আব্দুল্লাহ্ ইবনে মাসউদ এবং অন্যান্য সাহাবীদের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, উপরোক্ত আয়াতটি নাযিল হলে সাহাবীগণ বলতে লাগলেনঃ আমাদের মধ্যে এমন কে আছে, যে নিজের নফসের উপর জুলুম করেনি? নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ তোমরা এ আয়াতে যুলুম দ্বারা যা বুঝেছ, তা সঠিক নয়। এখানে যুলুম দ্বারা শির্ক উদ্দেশ্য। তোমরা কি আল্লাহর প্রিয় বান্দা লুকমান (আঃ)এর কথা শুন নি? তিনি তাঁর ছেলেকে উপদেশ দিতে গিয়ে বলেছেনঃ يَا بُنَيَّ لا تُشْرِكْ بِاللَّهِ إِنَّ الشِّرْكَ لَظُلْمٌ عَظِيمٌ ‘‘হে প্রিয় বৎস! আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করোনা। নিশ্চয়ই আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করা মহা যুলুম’’। (সূরা লুকমানঃ ১৩) সুতরাং এই অধ্যায়ে উল্লেখিত আয়াত থেকে জানা গেল, যে ব্যক্তি শির্ক থেকে মুক্ত থাকবেনা, তার জন্য নিরাপত্তা ও হেদায়াত অর্জন করা কোন ক্রমেই সম্ভব হবেনা। অপর পক্ষে যে ব্যক্তি শির্ক থেকে বেঁচে থাকবে, ঈমান ও ইসলামের উপর টিকে থাকা অনুপাতে তার জন্য নিরাপত্তা ও হেদায়াত অর্জিত হবে। যে ব্যক্তি এমন অবস্থায় আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে যে, সে জীবিত অবস্থায় সর্বদা কবীরা গুনাহ্ করেনি, পূর্ণ নিরাপত্তা ও হেদায়াত কেবল তার জন্যই অর্জিত হবে। আর যেই তাওহীদপন্থী গুনাহ করে তাওবা না করেই আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে তাওহীদ অনুপাতে নিরাপত্তা ও হেদায়াত প্রাপ্ত হবে এবং গুনাহর অনুপাতে নিরাপত্তা ও হেদায়াত থেকে বঞ্চিত হবে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

ثُمَّ أَوْرَثْنَا الْكِتَابَ الَّذِينَ اصْطَفَيْنَا مِنْ عِبَادِنَا فَمِنْهُمْ ظَالِمٌ لِّنَفْسِهِ وَمِنْهُم مُّقْتَصِدٌ وَمِنْهُمْ سَابِقٌ بِالْخَيْرَاتِ بِإِذْنِ اللَّهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَضْلُ الْكَبِيرُ

‘‘অতঃপর আমার নির্বাচিত বান্দাদেরকেই কিতাবের অধিকারী করেছি। তাদের কেউ কেউ নিজের প্রতি অত্যাচারী, কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী এবং তাদের মধ্যে কেউ কেউ আল্লাহ্‌র নির্দেশক্রমে কল্যাণের পথে এগিয়ে রয়েছে। এটাই মহা অনুগ্রহ’’।[1] (সূরা ফাতিরঃ ৩২) সুতরাং যালেম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সৎ ও অসৎ আমলের মিশ্রণ ঘটানোর মাধ্যমে নিজের উপর যুলুম করেছে। তার ব্যাপারটি আল্লাহর ইচ্ছাধীন। আল্লাহ্ তাআলা ইচ্ছা করলে তাঁকে ক্ষমা করবেন। আর ইচ্ছা করলে গুনাহ্র কারণে তাঁকে শাস্তি দিবেন। কিন্তু তাওহীদের কারণে তাকে চিরকাল জাহান্নামে রাখবেন না; বরং তাকে জাহান্নাম থেকে বের করবেন। মধ্যমপন্থী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে শুধু ওয়াজিবগুলো পালন করে এবং হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে। এটিই আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের অবস্থা। কল্যাণের পথে ও সৎকর্মে অগ্রগামী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে ইলম ও আমলের মাধ্যমে আল্লাহর আনুগত্যে সর্বোচ্চ শক্তি ব্যয় করে পরিপূর্ণ ঈমান অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।[2] শেষ দুই শ্রেণীর মানুষের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে পূর্ণ নিরাপত্তা ও পূর্ণ হেদায়াত অর্জিত হবে। সুতরাং জানা গেল পূর্ণ ঈমানদারের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। আর ত্রুটিপূর্ণ ঈমানদারের জন্য রয়েছে আংশিক বা অসম্পূর্ণ নিরাপত্তা। কেননা পূর্ণ ঈমান মুমিন বান্দাকে দুনিয়াতে পাপ কাজ ও আখেরাতে শাস্তি হতে রক্ষা করবে। সে আল্লাহর সাথে এমন পাপ নিয়ে মিলিত হবেনা, যার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

مَا يَفْعَلُ اللَّهُ بِعَذَابِكُمْ إِنْ شَكَرْتُمْ وَآمَنْتُمْ وَكَانَ اللَّهُ شَاكِرًا عَلِيمًا

‘‘তোমাদের আযাব দিয়ে আল্লাহ্ কি করবেন যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর এবং ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক। আর আল্লাহ্ হচ্ছেন সমুচিত মূল্যদানকারী, সর্বজ্ঞাত’’। (সূরা নিসাঃ ১৪৭) উপরোক্ত আয়াতের অর্থ বর্ণনা করতে গিয়ে আমি যা উল্লেখ করলাম, শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমীয়া এবং ইমাম ইবনুল কায়্যিম (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় তাই বলেছেন। কুরআন এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বক্তব্যও তাই। খারেজী, মুতাযেলা এবং অন্যান্য বিদআতী দলের কথা এর বিপরীত।[3]

সাহাবী উবাদা ইবনে সামেত রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

مَنْ شَهِدَ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَسُولُهُ ، وَأَنَّ عِيسَى عَبْدُ اللَّهِ وَرَسُولُهُ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ ، وَرُوحٌ مِنْهُ وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ أَدْخَلَهُ اللَّهُ الْجَنَّةَ عَلَى مَا كَانَ مِنَ الْعَمَلِ

‘‘যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দান করল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তিনি তাঁর এমন এক কালিমা যা তিনি মরিয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত রুহ বা আত্মা। জান্নাত সত্য, জাহান্নাম সত্য, তাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন। তার আমল যাই হোক না কেন’’।[4]

.............................................................

ব্যাখ্যাঃ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরীক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ রাখা দরকার যে, সাক্ষ্য তখনই গ্রহণযোগ্য হওয়ার উপযুক্ত হয়, যখন তার ভিত্তি হবে ইল্ম, ইয়াকীন এবং সত্যের উপর। অজ্ঞতা এবং সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। অজ্ঞতা সন্দেহের উপর ভিত্তি করে প্রদত্ত সাক্ষ্য দেয়াতে কোন উপকারও নেই। অজ্ঞতা ও সন্দেহের উপর ভিত্তি করে সাক্ষ্য দিলে সাক্ষ্যদাতা মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। কেননা সে যে বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছে, সে ব্যাপারে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই পবিত্র বাক্যটি অর্থাৎ কালেমায়ে তায়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাহ্-এর সাক্ষ্যটি না বাচক এবং হাঁ বাচক বক্তব্যকে শামিল করেছে। لاإله-এর মাধ্যমে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে ইলাহীয়াতকে নাকোচ করা হয়েছে এবং إلا الله-এর মাধ্যমে একমাত্র আল্লাহর জন্য ইলাহীয়াত সাব্যস্ত করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

شَهِدَ اللّهُ أَنَّهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ وَالْمَلاَئِكَةُ وَأُوْلُواْ الْعِلْمِ قَآئِمَاً بِالْقِسْطِ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘আল্লাহ্ সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। ফেরেশতাগণ এবং ন্যায়নিষ্ঠ জ্ঞানীগণও সাক্ষ্য দিয়েছেন যে, তিনি ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। তিনি পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাময়’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ১৮) অনেক লোকই কালেমা তায়্যেবার সঠিক অর্থ না জানার কারণে পথভ্রষ্ট হয়েছে। আর এই শ্রেণীর লোকের সংখ্যাই অধিক। তারা মূল অর্থকে পালটিয়ে দিয়েছে। তারা সৃষ্টির মধ্য হতে কবরবাসী, মাজারের খাদেম, তাগুত, বৃক্ষরাজি, পাথর, জিন এবং অন্যান্য সৃষ্ট বস্ত্তর জন্য উলুহীয়াত সাব্যস্ত করেছে। অথচ কালেমায়ে তায়্যেবার মধ্যে এগুলো থেকে উলুহীয়াতকে সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে। তারা এগুলোর উপাসনা করাকে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে এবং এগুলোকে চাকচিক্যময় ও সুসজ্জিত করে প্রকাশের মাধ্যমে তাওহীদকে বিদআতে রূপান্তরিত করেছে। তারা ঐ সমস্ত তাওহীদপন্থীদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লেগেছে, যারা নির্ভেজাল তাওহীদের দিকে মানুষকে আহবান করে। এই সমস্ত কবর পূজারীদের অবস্থা এই পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে যে, জাহেলী যামানার কুরাইশদের অজ্ঞ কাফেররা কালেমায়ে তায়্যেবার যতটুকু অর্থ বুঝত, এই সমস্ত নামধারী মুসলিমরা এই পবিত্র বাক্যটির অর্থ ততটুকুও বুঝতে সক্ষম নয়। জাহেলী যামানার কাফেররা কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ খুব ভাল করেই বুঝত। কিন্তু কালেমায়ে তায়্যেবা যেই ইখলাস তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার প্রতি আহবান করে, তারা কেবল তাকেই অস্বীকার করেছিল। যেমন আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا قِيلَ لَهُمْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ يَسْتَكْبِرُونَ وَيَقُولُونَ أَئِنَّا لَتَارِكُوا آلِهَتِنَا لِشَاعِرٍ مَّجْنُونٍ

‘‘তাদের যখন বলা হত, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য উপাস্য নেই, তখন তারা অহঙ্কার করত এবং বলত, আমরা কি এক পাগল কবির কথায় আমাদের উপাস্যদেরকে পরিত্যাগ করব? (সূরা আস্ সাফ্ফাতঃ ৩৫-৩৬)

এই উম্মতের বর্তমান মুসলিম নামধারী মুশরিকরা পূর্বকালের মুশরিকদের মতই আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যের এবাদত বর্জন করার দাওয়াতকে অস্বীকার করছে। বর্তমানে এই উম্মতের মুসলিম নামধারী মুশরিকরা আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে মাজার, গম্বুজ, তাগুত এবং অন্যান্য বস্ত্তর পূজা শুরু করে দিয়েছে। মক্কার মুশরিকরা কালেমায়ে তায়্যেবা এবং এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার তাৎপর্য বুঝে-শুনেই মানতে অস্বীকার করেছিল। আর এই যামানার মুসলিমগণ কালেমার অর্থ না বুঝার কারণে তার দাবী বাস্তবায়ন করতে অস্বীকার করছে। এ জন্যই আপনি দেখবেন যে, সে لاإله إلا الله বলছে। আর সেই সাথে সে আল্লাহর সাথে অন্যেরও এবাদত করছে!

আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম (রঃ) বলেনঃ মাবুদ তিনিই হতে পারেন, লোকেরা অন্তরের একনিষ্ঠতার সাথে যার এবাদত করে, তাকে ভালবেসে, ভয়ের সাথে তাঁরই বড়ত্ব প্রকাশ করে, তাঁর দিকেই প্রত্যাবর্তন করে, তাঁকেই সম্মান করে, তাঁর সামনেই নতি স্বীকার করে, তাঁর সামনেই বিনয়ী হয়, তাঁকেই ভয় করে, তাঁর কাছেই আশা করে এবং তাঁর উপরই ভরসা করে।

উযীর আবুল মুযাফ্ফার (রঃ) তার ‘ইফসাহ’ নামক গ্রন্থে বলেনঃ লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর সাক্ষ্য দেয়ার দাবী হচ্ছে, সাক্ষ্যদাতা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান রাখবে যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ্ নেই। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَاعْلَمْ أَنَّهُ لا إِلَهَ إِلا اللَّهُ وَاسْتَغْفِرْ لِذَنْبِكَ وَلِلْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ

‘‘জেনে রেখো, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ নেই। অতঃপর ক্ষমা প্রার্থনা করো, তোমার নিজের গুনাহর জন্য এবং মুমিন পুরুষ ও নারীদের জন্য’’। (সূরা মুহাম্মাদঃ ১৯) এখানে إلا -এর পরে الله মারফু হয়েছে। এর অর্থ দাঁড়ায় আল্লাহই হচ্ছেন এবাদতের একমাত্র হকদার। আল্লাহর যাতে পাক ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের হকদার নন। কালেমায়ে তায়্যেবা সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, এই পবিত্র বাক্যটি আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের সাথে সাথে প্রত্যেক তাগুতকে অস্বীকার করার দাবী জানায়। সুতরাং আপনি যখন আল্লাহ্ ছাড়া অন্যান্য সকল বস্ত্ত হতে উলুহীয়াতকে অস্বীকার করবেন এবং শুধু আল্লাহর জন্যই তা সাব্যস্ত করবেন, তখন আপনি সমস্ত তাগুতকে অস্বীকারকারী এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নকারীদের অন্তর্ভূক্ত হবেন।

ইমাম ইবনে রজব[5] (রঃ) বলেনঃ ইলাহ্ হচ্ছেন সেই সত্তা, যার আনুগত্য করা হয় এবং যার নাফরমানী করা হয়না। যাকে সম্মান করা হয়, যার বড়ত্ব প্রকাশ করা হয়, যাকে ভালোবাসা হয়, যাকে ভয় করা হয়, যার কাছে আশা করা হয়, যার উপর ভরসা করা হয়, যার কাছে চাওয়া হয় এবং যার কাছে দুআ করা হয়। এসব বস্ত্ত মহান আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো জন্য সাব্যস্ত করা শোভনীয় নয়। যে ব্যক্তি উলুহীয়াতের এ সমস্ত বৈশিষ্ট্যে কোন মাখলুককে আল্লাহর সাথে শরীক করল, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলার ক্ষেত্রে তার ইখলাস ত্রুটিপূর্ণ হবে এবং তার মধ্যে সেই ত্রুটি অনুযায়ী মাখলুকের উবুদীয়াত পাওয়া যাবে।

ইমাম বিকাঈ (রঃ) বলেনঃ لاإله إلا الله -এই পবিত্র বাক্যটি মহান বাদশাহ আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন সত্য মাবুদ থাকার কথাকে দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করেছে। এই বিশ্বাসই কিয়ামতের ভয়াবহ আযাব থেকে নাজাতের সর্বোত্তম মাধ্যম। কালেমার এই জ্ঞানটি তখনই প্রকৃত জ্ঞান বলে বিবেচিত হবে, যখন তা উপকারী হবে। আর তা উপকারী তখনই হবে, যখন তা অন্তর থেকে পাঠ করা হবে এবং তার দাবী অনুযায়ী আমল করা হবে। অন্যথায় তা নিছক মূর্খতা বলেই গণ্য হবে।

ভাষ্যকার বলেনঃ আমি বলছি যে, এই উম্মতের পরবর্তী যামানার লোকেরা لاإله إلا الله -এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ। এর সঠিক অর্থকে রুবুবীয়াতের অর্থের মাধ্যমে বদল করে ফেলেছে। অর্থাৎ তারা আল্লাহর জন্য শুধু সৃষ্টি করা ও প্রতিপালন করার ক্ষমতা সাব্যস্ত করছে। এর মাধ্যমে তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ যেই শির্ক থেকে নিষেধ করেছে, তারা আল্লাহর জন্য তাই সাব্যস্ত করেছে। তারা মূর্খতা বশতঃ কালেমা তায়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’& আল্লাহর জন্য যেই এবাদতকে খালেস করতে বলেছে, তা করতে অস্বীকার করেছে। সূরা যুমারের ২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃفَاعْبُدِ اللَّهَ مُخْلِصاً لَّهُ الدِّينَ ‘‘তুমি আল্লাহর এবাদত কর, দ্বীনকে তাঁর জন্য খালেস করে’’।

ইমাম নববী (রঃ) বলেনঃ দীর্ঘ দিন যাবৎ আমর বিল মারুফ এবং নাহী আনিল মুনকার তথা সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধের দরজা বন্ধ রয়েছে। বর্তমান সময়ে খুব সীমিত আকারে কেবল এর নামটি বিদ্যমান রয়েছে। অথচ এটি ইসলামের বিরাট একটি স্তম্ভ। এর মাধ্যমেই কল্যাণের পথ প্রসারিত এবং স্থায়ী হয়। আর এর অবর্তমানে অন্যায় ও অকল্যাণের পথ প্রশস্ত হয়। পৃথিবীতে যখন পাপকাজ ছড়িয়ে পড়ে তখন আল্লাহর শাস্তি ভাল ও খারাপ সকল শ্রেণীর লোককেই পাকড়াও করে। কেউ এ থেকে রেহাই পায়না। ইমাম নববী (রঃ) বর্তমান সময় বলতে হিজরী পঞ্চম এবং ষষ্ঠ শতক উদ্দেশ্য করেছেন। পঞ্চম ও ষষ্ঠ হিজরী সালের অবস্থা যদি এই হয়, তাহলে দশম ও তার পরবর্তী শতকের অবস্থা কেমন ভয়াবহ হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে ইসলামের দুর্বলতা প্রকট আকার ধারণ করেছে তথা সঠিক ইসলাম একেবারেই অপরিচিত হয়ে গেছে। আমাদের শাইখ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব (রঃ) গুরবাতুল ইসলামের এক সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মত সুন্দর ও অভিনব ব্যাখ্যা ইতিপূর্বে অন্য কেউ প্রদান করেনি। শাইখের ব্যাখ্যাটি পাঠ করা অত্যন্ত জরুরী। কেননা এই ব্যাখ্যাটি জানার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।[6]

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ وحده لا شريك له ‘‘তিনি একক, তাঁর কোন শরীক নেই’’-এই বাক্যটি لاإله إلا الله এর অর্থকে শক্তিশালী করছে এবং এর প্রকৃত তাৎপর্যকেই ব্যাখ্যা করছে। মূলতঃ এটিও তাওহীদের প্রমাণ বহন করে। সুতরাং لاإله কথাটি এবাদতের মধ্যে সামান্যতম শির্ক করাকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। لاشريك له কথাটি সেই অর্থকেই সুস্পষ্ট ও ব্যাখ্যা করেছে। অর্থাৎ এবাদতে আল্লাহর কোন শরীক নেই। وحده এর মধ্যে إلا الله এর অর্থ বিদ্যমান। সুতরাং আল্লাহই একমাত্র সত্য ইলাহ। তিনি ব্যতীত আসমান-যমীনের কেউ কোন প্রকার এবাদতের হকদার নয়। কুরআনের মুহকাম আয়াতগুলো এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মুতাওয়াতের হাদীছগুলো এ কথারই প্রমাণ বহন করে। আপনি যখন এই ব্যাখ্যাকে মনোযোগ দিয়ে পড়বেন, তখন আপনার কাছে ঐ সমস্ত লোকদের কথা বাতিল বলে প্রমাণিত হবে, যারা বলে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের কাছে দুআ করা জায়েয। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে বলেনঃ

فَلَا تَدْعُ مَعَ اللَّهِ إِلَهاً آخَرَ فَتَكُونَ مِنَ الْمُعَذَّبِينَ

‘‘অতএব, তুমি আল্লাহ্‌র সাথে অন্য উপাস্যকে আহবান করবেনা। করলে শাস্তিতে পতিত হবে’’। (সূরা শুআরাঃ ২১৩) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে। অচিরেই এর বিস্তারিত আলোচনা আসবে, ইনশা-আল্লাহ্ । সুতরাং وحده لا شريك له এর মধ্যে وحده শব্দটি হাঁ বাচক বিষয়কে জোরদার করছে আর لا شريك له বাক্যটি না বাচক বিষয়কে জোরদার করছে।

হাদীছের অংশ وأن محمدا عبده ورسوله -এর অর্থ হচ্ছে অন্তর থেকে বিশ্বাস ও সত্যায়ন করবে যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূল। এ কথার দাবী হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের অনুসরণ করা হবে, তাঁর আদেশ ও নিষেধের প্রতি সম্মান করা হবে এবং তাঁর সুন্নাতের উপর আমল করা হবে। কোন মানুষের কথা দ্বারা তাঁর সুন্নাতের বিরোধীতা করা যাবেনা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ব্যতীত অন্য কারো কথা ভুলের উর্ধ্বে নয়। আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে ভুল থেকে হেফাজত করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা আমাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার এবং তাঁকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করার আদেশ দিয়েছেন। নিম্নের আয়াতে তাঁর আনুগত্য বর্জনকারীদের শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلا وَرَبِّكَ لا يُؤْمِنُونَ حَتَّى يُحَكِّمُوكَ فِيمَا شَجَرَ بَيْنَهُمْ ثُمَّ لا يَجِدُوا فِي أَنْفُسِهِمْ حَرَجاً مِمَّا قَضَيْتَ وَيُسَلِّمُوا تَسْلِيماً

‘‘অতএব, তোমার পালনকর্তার কসম, সে পর্যন্ত তারা ঈমানদার হবেনা, যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে ন্যায়বিচারক বলে মেনে নেয়। অতঃপর তোমার মীমাংসার ব্যাপারে নিজেদের মনে কোন সংকীর্ণতা পাবেনা এবং তা সন্তুষ্ট চিত্তে কবুল করে নেবে’’। (সূরা নিসাঃ ৬৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে।’’ (সূরা নূরঃ ৬৩) ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ) বলেনঃ আমি ঐ সমস্ত লোকের জন্য আশ্চর্যবোধ করি, যারা হাদীছের সনদ ও তার সত্যতা জানার পরও সুফীয়ানের রায় গ্রহণ করে। অথচ আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَلْيَحْذَرْ الَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘অতএব, যারা তাঁর নবীর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা এ বিষয়ে সতর্ক হোক যে, ফিত্না তাদেরকে গ্রাস করবে অথবা যন্ত্রনাদায়ক শাস্তি তাদেরকে আক্রমণ করবে’’। তুমি কি জান ফিতনা[7] কাকে বলে? ফিতনাহ্ হচ্ছে শির্ক। কোন মানুষ যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কোন কথা প্রত্যাখ্যান করবে, তখন এমন আশঙ্কা রয়েছে যে, তার অন্তরে বক্রতা প্রবেশ করবে। পরিণামে সে ধ্বংস হবে। বর্তমানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাতের অনুসরণ করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট ত্রুটি করা হচ্ছে। তা বর্জনও করা হচ্ছে। তাঁর সুন্নাত ও কথার উপর ঐ সমস্ত লোকদের কথাকে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, যাদের কথার মধ্যে ভুল হওয়া খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আলেমরা এই রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এ বিষয়টি বর্তমানে সকলের নিকট সুস্পষ্ট।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর বান্দা ও রাসূলঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার মধ্যে ঐ মহা সত্যটি তুলে ধরা হয়েছে, যা বিশ্বাস করা ফরয। কুরআনের মুহকাম আয়াতসমূহ দ্বারা বিষয়টি প্রমাণিত। তাতে কাফের খৃষ্টানদের প্রতিবাদও রয়েছে। এরা তিনটি দলে বিভক্ত। এক দলের কথা হচ্ছে, ঈসা (আঃ)-ই আল্লাহ্। অন্য দল বলছে, তিনি আল্লাহর পুত্র। আরেক দলের মত হচ্ছে, আল্লাহ্ তিনজনের একজন। অর্থাৎ ঈসা, তাঁর মা মারইয়াম এবং তৃতীয় হচ্ছেন আল্লাহ।

আল্লাহ্ তাআলা কুরআন মজীদে এ বিষয়ে মূল সত্যটি বর্ণনা করেছেন এবং বাতিলের প্রতিবাদ করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لاَ تَغْلُواْ فِي دِينِكُمْ وَلاَ تَقُولُواْ عَلَى اللّهِ إِلاَّ الْحَقِّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ فَآمِنُواْ بِاللّهِ وَرُسُلِهِ وَلاَ تَقُولُواْ ثَلاَثَةٌ انتَهُواْ خَيْراً لَّكُمْ إِنَّمَا اللّهُ إِلَـهٌ وَاحِدٌ سُبْحَانَهُ أَن يَكُونَ لَهُ وَلَدٌ لَّهُ مَا فِي السَّمَاوَات وَمَا فِي الأَرْضِ وَكَفَى بِاللّهِ وَكِيلاً لَنْ يَسْتَنْكِفَ الْمَسِيحُ أَنْ يَكُونَ عَبْدًا لِلَّهِ وَلا الْمَلائِكَةُ الْمُقَرَّبُونَ وَمَنْ يَسْتَنْكِفْ عَنْ عِبَادَتِهِ وَيَسْتَكْبِرْ فَسَيَحْشُرُهُمْ إِلَيْهِ جَمِيعًا

‘‘হে আহলে-কিতাবগণ! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করোনা এবং আল্লাহ্‌র শানে নিতান্ত সঙ্গত বিষয় ছাড়া কোন কথা বলোনা। নিঃসন্দেহে মরিয়ম পুত্র মসীহ ঈসা আল্লাহ্‌র রাসূল এবং তার বাণী, যা তিনি প্রেরণ করেছেন মরিয়মের নিকট এবং তারই কাছ থেকে আগত একটি রূহ। অতএব, তোমরা আল্লাহ্কে এবং তার রাসূলগণকে মান্য করো। আর এ কথা বলোনা যে, আল্লাহ্ তিনের এক, এ কথা পরিহার করো; তোমাদের মঙ্গল হবে। নিঃসন্দেহে আল্লাহ্ একক উপাস্য। সন্তান-সন্ততি হওয়া তাঁর যোগ্য বিষয় নয়। যা কিছু আসমানসমূহ ও যমীনে রয়েছে সবই তাঁর। আর কর্ম সম্পাদনে আল্লাহ্ই যথেষ্ট। মসীহ্ আল্লাহ্‌র বান্দা হবেন, তাতে তার কোন লজ্জাবোধ নেই এবং ঘনিষ্ঠ ফেরেশতাদেরও না। বস্ত্ততঃ যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে লজ্জাবোধ করবে এবং অহংকার করবে, তিনি তাদের সবাইকে নিজের কাছে সমবেত করবেন’’। (সূরা নিসাঃ ১৭১-১৭২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

لَقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ هُوَ الْمَسِيحُ ابْنُ مَرْيَمَ قُلْ فَمَنْ يَمْلِكُ مِنَ اللَّهِ شَيْئًا إِنْ أَرَادَ أَنْ يُهْلِكَ الْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَأُمَّهُ وَمَنْ فِي الأرْضِ جَمِيعًا وَلِلَّهِ مُلْكُ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا يخْلُقُ مَا يَشَاءُ وَاللَّهُ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ

‘‘নিশ্চয়ই তারা কাফের, যারা বলে মসীহ্ ইবনে মরিয়মই আল্লাহ্। তুমি জিজ্ঞাসা করো, তবে আল্লাহ্ যদি মসীহ্ ইবনে মারইয়াম, তার মা এবং ভূমন্ডলে যারা আছে অচিরেই তাদের সবাইকে ধ্বংস করতে চান, তাহলে এমন কারো সাধ্য আছে কি যে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে তাদেরকে বিন্দুমাত্রও বাঁচাতে পারে? নভোমন্ডল, ভূমন্ডল ও এতদুভয়ের মধ্যে যা আছে, সবকিছুর উপর আল্লাহ্‌রই আধিপত্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। আল্লাহ্ সবকিছুর উপর শক্তিমান’’। (সূরা মায়িদাঃ ১৭)[8] সূরা মায়িদার একাধিক স্থানে এ বিষয়ে বিশদ বর্ণনা এসেছে। এ সমস্ত স্থানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ কথা বলে দিয়েছেন, যা ঈসা (আঃ) জন্মের পর মায়ের কোলে থাকা অবস্থায় ব্যক্ত করেছিলেন। সূরা মারইয়ামের ২৭ থেকে ৩৬ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

فَأَتَتْ بِهِ قَوْمَهَا تَحْمِلُهُ قَالُوا يَا مَرْيَمُ لَقَدْ جِئْتِ شَيْئاً فَرِيّاً يَا أُخْتَ هَارُونَ مَا كَانَ أَبُوكِ امْرَأَ سَوْءٍ وَمَا كَانَتْ أُمُّكِ بَغِيّاً فَأَشَارَتْ إِلَيْهِ قَالُوا كَيْفَ نُكَلِّمُ مَن كَانَ فِي الْمَهْدِ صَبِيّاً قَالَ إِنِّي عَبْدُ اللَّهِ آتَانِيَ الْكِتَابَ وَجَعَلَنِي نَبِيّاً وَجَعَلَنِي مُبَارَكاً أَيْنَ مَا كُنتُ وَأَوْصَانِي بِالصَّلَاةِ وَالزَّكَاةِ مَا دُمْتُ حَيّاً وَبَرّاً بِوَالِدَتِي وَلَمْ يَجْعَلْنِي جَبَّاراً شَقِيّاً وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيّاً ذَلِكَ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ قَوْلَ الْحَقِّ الَّذِي فِيهِ يَمْتَرُونَ مَا كَانَ لِلَّهِ أَن يَتَّخِذَ مِن وَلَدٍ سُبْحَانَهُ إِذَا قَضَى أَمْراً فَإِنَّمَا يَقُولُ لَهُ كُن فَيَكُونُ وَإِنَّ اللَّهَ رَبِّي وَرَبُّكُمْ فَاعْبُدُوهُ هَذَا صِرَاطٌ مُّسْتَقِيمٌ

‘‘অতঃপর তিনি সন্তানকে নিয়ে তার সম্প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হলেন। তারা বললঃ হে মারইয়াম, তুমি একটি অঘটন ঘটিয়ে বসেছ। হে হারুনের বোন! তোমার পিতা অসৎ ব্যক্তি ছিলেন না এবং তোমার মাতাও ব্যভিচারিনী ছিলেন না। অতঃপর তিনি হাত দ্বারা সন্তানের দিকে ইঙ্গিত করলেন। তারা বললঃ কোলের শিশুর সাথে আমরা কেমন করে কথা বলবো? সন্তান বললঃ আমি তো আল্লাহ্‌র বান্দা। তিনি আমাকে কিতাব দিয়েছেন এবং আমাকে নবী করেছেন। আমি যেখানেই থাকি, তিনি আমাকে বরকতময় করেছেন। তিনি আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন, যতদিন জীবিত থাকি ততদিন নামায ও যাকাত আদায় করতে। আর আমি জননীর অনুগত হবো। আমাকে তিনি অহংকারী ও হতভাগ্য করেন নি। আমার প্রতি শান্তি যেদিন আমি জন্মগ্রহণ করেছি, যেদিন মৃত্যুবরণ করবো এবং যেদিন আমাকে জীবিত করে উঠানো হবে। ইনি হচ্ছেন মারইয়ামের পুত্র ঈসা এবং এ হচ্ছে তার সম্পর্কে সত্য কথা, যে সম্পর্কে লোকেরা সন্দেহ করছে। কাউকে সন্তান হিসাবে গ্রহণ করা আল্লাহর জন্য শোভনীয় নয়, তিনি পবিত্র সত্তা। তিনি যখন কোন কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন এ কথাই বলেনঃ হয়ে যাও, অমনি তা হয়ে যায়। আর ঈসা বলেছিলঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক তোমাদের প্রতিপালক। অতএব, তোমরা তাঁর এবাদত করো। এটাই সরল পথ’’। এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ সঠিক পথের আলোচনা করেছেন, যে পথের অনুসারীরা নাজাতের হকদার হবে। আর যে ব্যক্তি ঐ পথের বাইরে চলবে, সে ধ্বংস হবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আল-ইমরানের ৫৯-৬০ নং আয়াতে বলেনঃ

إِنَّ مَثَلَ عِيسَى عِندَ اللّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثِمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ الْحَقُّ مِن رَّبِّكَ فَلاَ تَكُن مِّن الْمُمْتَرِينَ

‘‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ্‌র নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মত। তাকে মাটি দিয়ে তৈরি করেছেন তারপর তাকে বলেছিলেনঃ হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল। যা তোমার প্রতিপালক বলেন তাই যথার্থ সত্য। কাজেই তোমরা সংশয়বাদী হয়োনা’’। আল্লাহ্ তাআলা সীরাতুল মুস্তাকীমকে সুস্পষ্ট ও পরিপূর্ণরূপে বর্ণনা করেছেন এবং তাঁর তাওহীদের দলীল-প্রমাণসমূহ বর্ণনা করেছেন। মুশরিকদের অপছন্দ সত্ত্বেও তিনি সত্যকে প্রমাণিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং মিথ্যাকে বাতিল করেছেন।

ঈসা আলাইহিস সালাম আল্লাহর এমন এক কালিমা, যা তিনি মরিয়ামের প্রতি প্রেরণ করেছেনঃ এখানে কালিমার অর্থ হচ্ছে তাঁর বাণী كُنْ হয়ে যাও। সুতরাং আল্লাহ্ তাআলা ঈসা (আঃ)কে তাঁর কালিমা كُنْ দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। এর দ্বারা আরো প্রমাণিত হল যে, আল্লাহ্ তাআলা কথা বলেন, কথা বলা তাঁর অন্যতম একটি সিফাত। কিন্তু জাহমীয়ারা এতে বিশ্বাস করেনা।

ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রেরিত রূহঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে, তিনি ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যাদেরকে আল্লাহ্ তাআলা আদম (আঃ)এর পৃষ্ঠদেশ থেকে নির্গত করেছেন এবং তাদের থেকে এই মর্মে অঙ্গীকার নিয়েছেন যে, আল্লাহ্ তাআলাই হচ্ছেন তাদের প্রভু ও মাবুদ। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذَ رَبُّكَ مِن بَنِي آدَمَ مِن ظُهُورِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَأَشْهَدَهُمْ عَلَى أَنفُسِهِمْ أَلَسْتُ بِرَبِّكُمْ قَالُواْ بَلَى شَهِدْنَا أَنْ تَقُولُوا يَوْمَ الْقِيَامَةِ إِنَّا كُنَّا عَنْ هَذَا غَافِلِينَ

‘‘আর যখন তোমার প্রতিপালক বনী আদমের পৃষ্টদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদেরকে এবং তাদেরকে তাদের নিজেদের উপর সাক্ষী রেখে প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের প্রতিপালক নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কিয়ামতের দিন বলতে শুরু কর যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিলনা’’। (সূরা আরাফঃ ১৭২) সুতরাং ঈসা (আঃ)এর রূহ ঐ সমস্ত রূহের অন্তর্ভূক্ত, যা তিনি সৃষ্টি করেছেন।

ইবনে জারীর[9] (রঃ) সূরা মারইয়ামের ২২ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ[10] (রঃ)এর বরাত দিয়ে বলেনঃ জিবরীল মারিয়ামের কোর্তার পকেটে ফুঁ দিলেন। ফুঁ-এর প্রভাব মারইয়ামের জরায়ু পর্যন্ত পৌঁছে গেল। এতে তিনি গর্ভবতী হয়ে গেলেন। ইমাম সুদ্দী (রঃ) বলেনঃ ফুৎকারের প্রভাব মারইয়ামের বক্ষদেশে প্রবেশ করল। এতেই তিনি ঈসা (আঃ)কে পেটে ধারণ করলেন। ইবনে জুরাইয (রঃ) বলেনঃ বলা হয় যে, জিবরীল (আঃ) মারইয়ামের কোর্তার গলদ্বারে ও আস্তীনে ফুঁ দিয়েছেন।

সার কথা হচ্ছে, জিবরীল ফুঁ দিয়েছেন আর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর كٌنْ বাক্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর ঈসা (আঃ) সৃষ্টি হয়ে গেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হিজ্রে আদম (আঃ)-এর ব্যাপারে বলেনঃ

وَإِذْ قَالَ رَبُّكَ لِلْمَلائِكَةِ إِنِّي خَالِقٌ بَشَرًا مِنْ صَلْصَالٍ مِنْ حَمَإٍ مَسْنُونٍ فَإِذَا سَوَّيْتُهُ وَنَفَخْتُ فِيهِ مِنْ رُوحِي فَقَعُوا لَهُ سَاجِدِينَ فَسَجَدَ الْمَلائِكَةُ كُلُّهُمْ أَجْمَعُونَ إِلا إِبْلِيسَ أَبَى أَنْ يَكُونَ مَعَ السَّاجِدِيْنَ

‘‘আর তোমার প্রভু যখন ফেরেশতাদেরকে বললেনঃ আমি পচা কর্দম থেকে তৈরি বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁ দেব, তখন তোমরা তার সামনে সেজদায় পরে যেয়ো। তখন ফেরেশতারা সবাই মিলে সেজদা করল। কিন্তু ইবলীস ব্যতীত। সে সেজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হতে অস্বীকৃতি জানালো। (সূরা হিজরঃ ২৮-৩১) সেই সত্তা অতি পবিত্র, যিনি ব্যতীত অন্য কোন সৃষ্টি কর্তা নেই। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ এবাদতের যোগ্যও নয়।

কতিপয় খৃষ্টান মুসলমানদের কতক আলেমের সাথে আল্লাহর বাণীঃ وَرُوحٌ مِّنْهُ অর্থাৎ ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ, -এ কথার মাধ্যমে দলীল পেশ করে তর্ক শুরু করল। তারা বলতে চাইল যে, ঈসা (আঃ) আল্লাহর রূহ তথা আল্লাহর অংশ বা তিনিই আল্লাহ্। তখন মুসলিম আলেমগণ তাদের উত্তরে বললেনঃ এটি শুধু ঈসা (আঃ)এর জন্য খাস নয়; বরং ঈসা (আঃ) এর মতই সকল সৃষ্টি আল্লাহর এবং আল্লাহর পক্ষ হতে। যেমন আল্লাহ্ তাআলা সূরা জাসিয়ার ১৩ নং আয়াতে বলেনঃ

وَسَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَوَاتِ وَمَا فِي الأرْضِ جَمِيعًا مِنْهُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَتَفَكَّرُونَ

‘‘এবং তিনি আসমান ও যমীনের সমস্ত জিনিষকেই তোমাদের অনুগত করে দিয়েছেন। সবকিছুই তাঁর পক্ষ থেকে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে’’। (সূরা জাসিয়াঃ ১৩) অর্থাৎ আসমান-যমীনের সব কিছুর সৃষ্টি কর্তা একমাত্র তিনি। তার মধ্যে ঈসা (আঃ)ও শামিল। অন্যান্য সকল বস্ত্তর ন্যায় তিনি ঈসাকেও সৃষ্টি করেছেন’’।

[1] - এই আয়াতে মানুষকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। (১) যালেমঃ যালেম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে সৎ আমল করার সাথে সাথে খারাপ আমলও করে। কখনো ভাল আমল করে আবার কখনো হারাম কাজে লিপ্ত হয়। এর মাধ্যমে সে নফসের উপর যুলুম করছে। এই শ্রেণীর মানুষের জন্য দুনিয়াতে ও আখেরাতে বিপদের আশঙ্কা রয়েছে। তারা পরিপূর্ণ নিরাপদ ও পরিপূর্ণ হেদায়াতপ্রাপ্ত নয়। দুনিয়াতে তারা পূর্ণ ঈমান ও হেদায়াতের উপর নেই। আর আখেরাতেও তারা আল্লাহর শাস্তি ও পাকড়াও হতে পূর্ণ নিরাপদ নয়। মৃত্যুর পর তাদের বিষয়টি সম্পূর্ণ আল্লাহর ইচ্ছাধীন। ইচ্ছা করলে দয়াময় আল্লাহ্ তাআলা তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। আর ইচ্ছা করলে তিনি তাদেরকে জাহান্নামে শাস্তি দিবেন। তবে শাস্তি দিলেও তিনি তাদেরকে চিরকাল জাহান্নামে রাখবেন না। তাওহীদের কারণে তিনি তাদেরকে জাহান্নাম থেকে বের করে জান্নাতে আশ্রয় দিবেন।

(২) মুকতাসিদঃ মুক্তাসিদ হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে আল্লাহর সকল হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে। সেই সাথে সকল প্রকার ফরয ও ওয়াজিব আমল সম্পাদন করে। কিন্তু নফল এবাদতের প্রতি তাদের রয়েছে প্রচুর অনাগ্রহ। (৩) সাবিকুন বিল খায়রাতঃ এরা হচ্ছে ঐ শ্রেণীর লোক, যারা সকল প্রকার হারাম কাজ থেকে বিরত থাকে এবং সকল প্রকার ওয়াজিব ও ফরয আমলগুলো সম্পাদন করে। সেই সাথে তারা নফল ও সুন্নাতী আমলের দিকে প্রতিযোগীতামূলকভাবে অগ্রসর হয়। শেষ দুই শ্রেণীর মানুষের জন্যই রয়েছে দুনিয়াতে হেদায়াত এবং আখেরাতে পরিপূর্ণ নিরাপত্তা।

[2] - তারীকুল হিজরাতাইন, পৃষ্ঠা নং- ৩১৪-৩৩৫।

[3] - مقالات الخوارج والمعتزلة – الفَرْق بين الفِرَق ص (73 ،117)

[4]- বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর বানী, হে আহলে কিতাব! তোমরা দ্বীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না।

[5] - তিনি হচ্ছেন হাফেয আব্দুর রাহমান বিন আহমাদ বিন রজব আলবাগদাদী আদ্ দিমাশকী আলহাম্বালী। দ্বীনের খেদমতে তার অনেক লেখনী রয়েছে। তার মধ্যে লাতাইফুল মাআরিফ, যাইলু তাবাকাতিল হানাবেলা এবং জামেউল উলুম ওয়াল হিকাম অন্যতম। তিনি ৭৯৫ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন।

[6]- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

بَدَأَ الإِسْلامُ غَرِيبًا ، وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا ، فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ

‘‘ইসলাম অপ্রসিদ্ধ অবস্থায় এসেছে। অচিরেই তা গরীব অবস্থায় ফিরে যাবে। সুতরাং গরীবদের জন্য সুখবর’’। ইমাম মুসলিম এই হাদীছটি আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেছেন। শাইখ সিন্দী রাহিমাহুল্লাহ ইবনে মাজার হাশীয়াতে বলেনঃ গরীব শব্দের অর্থ হল, ইসলামের সূচনার সময় এর অনুসারী ছিল খুবই কম। মূলতঃ জন্মভূমি থেকে দূরে অবস্থানকারী লোককেও গরীব বলা হয়। অচিরেই ইসলাম আগের মতই গরীব হয়ে যাবে। এর অর্থ হচ্ছে পূর্বে যেমন এর অনুসারী ছিল খুবই কম, আখেরী যামানায়ও অবস্থা সে রকম হবে। সে সময় অল্প সংখ্যক লোকই সঠিক ইসলামকে মেনে চলবে এবং ইসলামের সাহায্য করবে। যদিও সে সময় মুসলমানদের সংখ্যা প্রচুর হয়। সুতরাং ইসলামের এই অল্প সংখ্যক ধারক ও বাহক লোকদের জন্য রয়েছে সুখবর (তুবা)। তুবা শব্দটিকে একাধিক অর্থে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কেউ বলেছেনঃ তুবা হচ্ছে একটি বেহেশতের নাম। আবার কেউ বলেছেনঃ এটি হচ্ছে বেহেশতের একটি বিরাট গাছ।

এতে ইঙ্গিত রয়েছে যে, সত্যিকার ইসলামের সাহায্য করতে চাইলে এবং দৃঢ়ভাবে ইসলামকে ধারণ করতে চাইলে স্বদেশ ত্যাগ করা এবং এ জন্য দুঃখ-কষ্ট সহ্য করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। ইসলামের প্রথম যুগের অবস্থা এ রকমই ছিল। ইমাম নববী (রঃ) হাদীছের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে কাযী ইয়াযের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেনঃ ইসলাম অল্প কয়েকজন মানুষের দ্বারা শুরু হয়েছে। তারপর এর প্রসার ও বিস্তার ঘটেছে। অতঃপর এতে ত্রুটি চলে আসবে এবং শেষ যামানায় অল্প কয়েকজন লোকের মধ্যেই এর অনুসরণ ও অনুশীলন সীমিত হয়ে যাবে। যেমনটি ছিল প্রথম অবস্থায়।

সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের ফতোয়া ও গবেষণা বিভাগের স্থায়ী কমিটির ফতোয়ায় এসেছে, হাদীছের অর্থ হচ্ছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন লোকদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তখন মাত্র অল্প কিছু লোক এই দাওয়াত গ্রহণ করল। সুতরাং তখন এর অনুসারী অল্প হওয়ার কারণে এবং ইসলামের অনুসারীগণ দুর্বল হওয়ার কারণে এটি অপরিচিত ছিল। অপর পক্ষে ইসলামের বিরোধীদের সংখ্যা ছিল প্রচুর, তাদের শক্তি ছিল প্রবল এবং মুসলিমদের উপর তাদের যুলুম ও সীমালংঘন ছিল মাত্রাতিরিক্ত। ফলে মুসলিমদের অনেকেই দ্বীন ও জীবনকে ফিতনা থেকে বাঁচানোর জন্য আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন। এরই ধারাবাহিকতায় সর্বশেষে কঠোর নির্যাতন ভোগ করার পর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও মদীনায় হিজরত করলেন। এই আশায় যে, হয়ত আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দাওয়াতের এমন সমর্থক তৈরী করবেন, যারা তাঁর সাথে যোগ দিয়ে ইসলামের সাহায্য করবেন। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর আশা বাস্তবায়ন করলেন, তাঁর সৈনিকদেরকে সাহায্য করলেন, তাঁর বান্দাকে সাহায্য করলেন, ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি পেল এবং পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম ছড়িয়ে পড়ল। আল্লাহ্ তাআলা কুফরের পতন ঘটালেন এবং তাওহীদের কালেমাকে বুলন্দ করলেন। আল্লাহ্ তাআলা মহা পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। বস্ত্ততঃ আল্লাহ্, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের জন্যই প্রকৃত সম্মান। দীর্ঘ দিন মুসলিমগণ পৃথিবীতে শক্তিশালী ও সম্মানিত ছিল। অতঃপর তাদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়, তাদের মধ্যে দুর্বলতা অনুপ্রবেশ করে। ধীরে ধীরে তারা পশ্চাৎমুখী হতে থাকে। এক পর্যায়ে ইসলাম পূর্বের ন্যায় অসহায় অবস্থায় ফিরে যায়। এবারের এই দুর্বলতা ও অসহায়ত্ব কিন্তু মুসলিমদের সংখ্যা কম হওয়ার কারণে নয়। দ্বীনকে আঁকড়িয়ে না ধরার কারণে, আল্লাহর কিতাবকে মজবুতভাবে ধারণ না করার কারণে এবং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হেদায়াতকে বর্জন করার কারণে বর্তমানে মুসলিমগণ দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মুসলিমদের মাঝেই সঠিক ইসলামের গুরবত প্রকট আকার ধারণ করেছে। অল্প সংখ্যক মুসলিম ব্যতীত বেশীর ভাগ লোকই দুনিয়ার সম্পদ ও সামগ্রী নিয়েই সন্তুষ্ট ও ব্যস্ত রয়েছে। পূর্ববর্তী জাতির ন্যায়ই তারা দুনিয়া অর্জনে প্রতিযোগীতায় লিপ্ত রয়েছে এবং দুনিয়ার সম্পদ ও নেতৃত্ব দখলের মোহে পরস্পর যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত রয়েছে। এতে ইসলামের শত্রুরা সুযোগ পেয়েছে। তারা মুসলিম দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তাদেরকে অপমানিত-অপদস্ত করেছে ও তাদের উপর কঠিন জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে। এটিই হচ্ছে ইসলামের গুরবত, যে অবস্থায় ইসলামের সূচনা হয়েছিল।

শাইখ মুহাম্মাদ রশীদ রেযাসহ এক দল আলেম মনে করেন, অত্র হাদীছে দ্বিতীয়বার ইসলামের দুর্বলতার পর ইসলামের বিজয়ের প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণীঃ وسيعود غريباً كما بدأঅচিরেই সূচনার ন্যায় অবহেলিত অবস্থায় ফেরত যাবে। সুতরাং প্রথমবারের দুর্বলতার পর যেমন ইসলামের বিজয় অর্জিত হয়েছে এবং ইসলামের প্রসার ঘটেছে, তেমনি দ্বিতীয়বার দুর্বলতার পর পুনরায় ইসলামের বিজয় ও প্রসার ঘটবে। এই মতটিই অধিক প্রসিদ্ধ। আখেরী যামানায় ইমাম মাহদী এবং ঈসা (আঃ)এর অবতরণের হাদীছসমূহে এ বিষয়টির সমর্থন পাওয়া যায়। সে সময় ইসলাম ছড়িয়ে পড়বে এবং মুসলিমগণ শক্তিশালী ও বিজয়ী থাকবে। কুফর ও কাফের সম্প্রদায় পরাস্ত ও পদদলিত হবে।

[7] - ফিতনা শব্দের মূল অর্থ হচ্ছে বিরত রাখা, ফিরে যাওয়া, পরিবর্তিত হওয়া ইত্যাদি। এই অর্থেই আল্লাহর এই বাণীতে ফিতনা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَإِنَّكُمْ وَمَا تَعْبُدُونَ (161) مَا أَنْتُمْ عَلَيْهِ بِفَاتِنِينَ (162) إِلَّا مَنْ هُوَ صَالِ الْجَحِيمِ

‘‘কাজেই তোমরা ও তোমাদের এ উপাস্যরা কাউকে আল্লাহ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে না, সে ব্যক্তিকে ছাড়া যে জাহান্নামের প্রজ্জ্বলিত আগুনে প্রবেশকারী হবে’’। (সূরা সাফফাতঃ ১৬১-১৬২) এখানে বলা হয়েছে, হে মুশরেকের দল! তোমরা এবংতোমাদের ঐসব মাবুদ, যাদেরকে তোমরা আল্লাহ ব্যতীত আহবান করে থাকো, তারা কোন মুমিনকেই ঈমান থেকে ফিরিয়ে কুফরীর দিকে নিতে পারবেনা। তবে যাকে আল্লাহ হতভাগ্য বলে জানেন এবং যে ব্যক্তি জাহান্নামী হবে, তার কথা ভিন্ন।

সুতরাং যে ব্যক্তি মুমিন ছিল, সে যদি কাফের হয়ে যায়, তাকে উদ্দেশ্য করে বলা হয় فلان فتن অর্থাৎ অমুক ব্যক্তি ফিতনায় পড়েছে। অর্থাৎ সে ঈমানদার মুসলিম ছিল অতঃপর সে ফিতনায় পড়েছে এবং কল্যাণের পথ ছেড়ে অকল্যাণের পথ ধরেছে ও ঈমানের পথ ছেড়ে কুফুরীর পথে চলেছে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَالْفِتْنَةُ أَشَدُّ مِنَ الْقَتْلِ ফিতনা হত্যার চেয়েও অধিক ভয়াবহ। অর্থাৎ মানুষকে ঈমান থেকে ফিরিয়ে কুফুরীর দিকে নিয়ে যাওয়া তাদেরকে হত্যা করার চেয়েও অধিক ক্ষতিকর।

সুতরাং ইমাম আহমাদ বিন হাম্বাল (রঃ)এর কথার অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি রাসূলের হাদীছ প্রত্যাখ্যান করে এবং মানুষের কথার দিকে যায়, তার ব্যাপারে আশঙ্কা আছে যে, তাকে মানুষের কথা একটু একটু ফিতনার (কুফুরীর) দিকে নিয়ে যেতে পারে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ প্রত্যাখ্যানের শাস্তি স্বরূপই তাকে সেদিকে নিয়ে যাওয়া হবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ ثُمَّ انصَرَفُوا صَرَفَ اللَّهُ قُلُوبَهُم بِأَنَّهُمْ قَوْمٌ لَّا يَفْقَهُونَ ‘‘অতঃপর তারা চুপে চুপে সরে পড়ল৷ আল্লাহও তাদের মন বিমুখ করে দিয়েছেন কারণ তারা এমন একদল লোক যাদের বোধশক্তি নেই’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৭) যেমন আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃفَلَمَّا زَاغُوا أَزَاغَ اللَّهُ قُلُوبَهُمْ ۚ وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ ‘‘অতঃপর যখন তারা বাঁকা পথ ধরলো তখনই আল্লাহও তাদের দিল বাঁকা করে দিলেন৷ আল্লাহ ফাসেকদের হেদায়াত করেন না’’। (সূরা সাফঃ ৫)

[8] - আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّ اللَّهَ ثَالِثُ ثَلَاثَةٍ ۘ وَمَا مِنْ إِلَٰهٍ إِلَّا إِلَٰهٌ وَاحِدٌ ۚ وَإِن لَّمْ يَنتَهُوا عَمَّا يَقُولُونَ لَيَمَسَّنَّ الَّذِينَ كَفَرُوا مِنْهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ

‘‘নিঃসন্দেহে তারা কুফরী করেছে যারা বলেছে, আল্লাহ তিনের মধ্যে এক৷ অথচ এক ইলাহ্ ছাড়া আর কোন সত্য ইলাহ নেই। যদি তারা নিজেদের এসব কথা থেকে বিরত না হয়, তাহলে তাদের মধ্য থেকে যারা কুফরী করেছে তাদেরকে যন্ত্রণা দায়ক শাস্তি দেয়া হবে’’। (সূরা মায়িদাঃ ৭৩) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللَّهِ وَقَالَتِ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللَّهِ ۖ ذَٰلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِئُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَبْلُ ۚ قَاتَلَهُمُ اللَّهُ ۚ أَنَّىٰ يُؤْفَكُونَ اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِّن دُونِ اللَّهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَٰهًا وَاحِدًا ۖ لَّا إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ۚ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ

‘‘ইহুদীরা বলে, উযাইর আল্লাহর পুত্র এবং খৃস্টানরা বলে, মসীহ আল্লাহর পুত্র৷এগুলো একেবারেই আজগুবী ও উদ্ভট কথাবার্তা৷ তাদের পূর্বে যারা কুফরিতে লিপ্ত হয়েছিল তাদের দেখাদেখি তারা এগুলো নিজেদের মুখে উচ্চারণ করে থাকে। আল্লাহর অভিশাপ পড়ুক তাদের উপর, তারা কোথা থেকে ধোকা খাচ্ছে! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে নিজেদের উলামা ও দরবেশদেরকে নিজেদের রব বানিয়ে নিয়েছে এবং এভাবে মারইয়াম পুত্র মাসীহকেও৷ অথচ তাদেরকে এক আল্লাহ ছাড়া অন্য কারোর এবাদত করার হুকুম দেয়া হয়নি। তিনি ছাড়া এবাদতের যোগ্যতা সম্পন্ন আর কোন সত্য ইলাহ নেই৷ তারা যেসব মুশরিকী কথা বলে তা থেকে তিনি পাক পবিত্র’’। (সূরা তাওবাঃ ৩০-৩১)

সুতরাং যেসব খৃষ্টান বলে মসীহ ইবনে মারইয়ামই আল্লাহ, যারা বলে আল্লাহ তিন মাবুদের এক মাবুদ এবং যারা বলেঃ ঈসা ইবনে মারইয়াম আল্লাহর পুত্র- এই তিন দলের সকলেই কাফের।

[9] - তিনি হচ্ছেন, বিখ্যাত মুফাস্সির এবং প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবু জাফর মুহাম্মাদ বিন জারীর তাবারী। তিনি ৩১০ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ তাবাকাতুস শাফেঈয়া (৩/১২০), ওফীয়াতুল আয়ান (১/৩৩২), শাযরাতুয্ যাহাব (২/২৬০)।

[10] - তিনি হচ্ছেন বিশিষ্ট ঐতিহাসিক আল্লামা ইমাম ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ বিন কামিল আল ইয়ামানী। তিনি কিচ্ছা ও ঘটনাবলী বর্ণনার ক্ষেত্রে প্রসিদ্ধতা অর্জন করেন। মুহাদ্দিছগণ তাঁর সমালোচনা করেছেন। অর্থাৎ হাদীছ বর্ণনায় তিনি মুহাদ্দিছদের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিলেন না। তিনি ১১৪ হিজরী সালে ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ সিয়ারু আলামিন্ নুবলা (৪/৫৪৪) , আল ইবার (১/১০৯-১১৩), শাযারাতুয্ যাহাব (১/১৫০)।
তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ২

উপরে বর্ণিত হাদীছে আল্লাহ্ এবং নবী-রাসূলদের শত্রু ইহুদীদেরও প্রতিবাদ করা হয়েছে। ইহুদী-খৃষ্টান, -এই উভয় দলই ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে পরস্পর বিরোধী কথা বলে। আল্লাহর দুশমন ইহুদীরা বলেঃ ঈসা (আঃ) জারজ সন্তান। আল্লাহ্ এদেরকে ধ্বংস করুন। আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে তাদের কথাকে মিথ্যায়ন করেছেন, তাদেরকে মিথ্যুক বলেছেন এবং তাদের ধারণাকে বাতিল করে দিয়েছেন। এমনি উপরোক্ত এবং অন্যান্য আয়াতে ঈসা (আঃ)কে নিয়ে খৃষ্টানদের বাড়াবাড়িরও প্রতিবাদ করেছেন। সুতরাং খৃষ্টানরা ঈসা (আঃ)এর বিষয়ে সীমালঙ্ঘন, বাড়াবাড়ি, কুফরী ও গোমরাহীতে লিপ্ত রয়েছে। অপর পক্ষে ইহুদীরা তাঁর সাথে মারাত্মক দুর্ব্যবহার করেছে। উভয় দলই প্রকাশ্য গোমরাহীর মধ্যে রয়েছে। কুরআনের অনেক স্থানেই আল্লাহ্ তাআলা তাদের এই গোমরাহীর বিষয়টি তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে মূল সত্যটি পরিস্কারভাবে বর্ণনা করার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা তাঁর শানকে উন্নীত করেছেন এবং তাঁকে পাঁচজন উলুল আযম রাসূলদের কাতারে শামিল করেছেন। সূরা আহযাব ও শুরায় তাদের বর্ণনা একসঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা আহযাবের ৭ নং আয়াতে বলেনঃ

وَإِذْ أَخَذْنَا مِنَ النَّبِيِّينَ مِيثَاقَهُمْ وَمِنْكَ وَمِنْ نُوحٍ وَإِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ وَأَخَذْنَا مِنْهُمْ مِيثَاقًا غَلِيظًا

‘‘যখন আমি নবীগণের কাছ থেকে, তোমার কাছ থেকে এবং নূহ, ইব্রাহীম, মূসা ও মারইয়ামের পুত্র ঈসার কাছ থেকে অঙ্গীকার নিলাম এবং অঙ্গীকার নিলাম তাদের কাছ থেকে দৃঢ় অঙ্গীকার। আর সূরা শুরার ১৩ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

شَرَعَ لَكُمْ مِنَ الدِّينِ مَا وَصَّى بِهِ نُوحًا وَالَّذِي أَوْحَيْنَا إِلَيْكَ وَمَا وَصَّيْنَا بِهِ إِبْرَاهِيمَ وَمُوسَى وَعِيسَى أَنْ أَقِيمُوا الدِّينَ وَلَا تَتَفَرَّقُوا فِيهِ كَبُرَ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مَا تَدْعُوهُمْ إِلَيْهِ اللَّهُ يَجْتَبِي إِلَيْهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَهْدِي إِلَيْهِ مَنْ يُنِيبُ

‘‘তিনি তোমাদের জন্য দ্বীনের ক্ষেত্রে সে পথই নির্ধারণ করেছেন, যার আদেশ দিয়েছিলেন নূহকে, যা আমি প্রত্যাদেশ করেছি তোমার প্রতি এবং যার আদেশ দিয়েছিলাম ইব্রাহীম, মূসা ও ঈসাকে এই মর্মে যে, তোমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করো এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করোনা। তুমি মুশরিকদেরকে যে বিষয়ের প্রতি আমন্ত্রণ জানাও, তা তাদের কাছে দুঃসাধ্য বলে মনে হয়। আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা মনোনীত করেন এবং যে তাঁর অভিমূখী হয়, তাকে পথ প্রদর্শন করেন’’। আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে উলুল আযম রাসূলদের ন্যায় সবর করার আদেশ দিয়েছেন। সূরা আহকাফের ৩৫ নং আয়াতে তিনি বলেনঃ

فَاصْبِرْ كَمَا صَبَرَ أُوْلُوا الْعَزْمِ مِنَ الرُّسُلِ وَلَا تَسْتَعْجِلْ لَهُمْ

‘‘অতএব, তুমি সবর করো, যেমন সুদৃঢ় মনোবলের অধিকারী রাসূলগণ সবর করেছেন এবং ওদের বিষয়ে তড়িঘড়ি করবে না’’।

উপরোক্ত ব্যাখ্যা থেকে জানা গেল, সমস্ত নবী-রাসূলের মধ্যে উলুল আযম রাসূলগণ তথা নূহ, ইবরাহীম, মুসা, ঈসা এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন সর্বাধিক উত্তম। এদের মধ্যে এবং অন্যান্য সকল নবী-রাসূলদের মধ্যে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সর্বোত্তম। তাঁর উপর এবং সকল নবী-রাসূলের উপর এবং কিয়মাত পর্যন্ত উত্তমভাবে তাদের অনুসরণকারীদের উপর আল্লাহর দুরূদ ও সালাম বর্ষিত হোক।

জান্নাত সত্যঃ এ কথার সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হল এই বিশ্বাস করা যে, আল্লাহ্ তাআলা মুমিন বান্দাদের জন্য জান্নাত তৈরী করে রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা এতে প্রবেশ করবে। এটি চিরকাল থাকবে। এতে রয়েছে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ, ফলফলাদি, চিরস্থায়ী নেয়ামত এবং আল্লাহর চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকার স্বাদসহ অফুরন্ত নেয়ামত। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হুদের ১০৮ নং আয়াতে বলেনঃ

وَأَمَّا الَّذِينَ سُعِدُوا فَفِي الْجَنَّةِ خَالِدِينَ فِيهَا مَا دَامَتِ السَّمَوَاتُ وَالْأَرْضُ إِلَّا مَا شَاءَ رَبُّكَ عَطَاءً غَيْرَ مَجْذُوذٍ

‘‘আর যারা সৌভাগ্যবান তারা অবস্থান করবে বেহেশতের মাঝে, সেখানেই চিরদিন থাকবে, যতদিন আসমান ও যমীন বর্তমান থাকবে। তবে তোমার প্রতিপালক অন্য কিছু ইচ্ছা করলে ভিন্ন কথা। এ দানের ধারাবাহিকতা কখনো ছিন্ন হওয়ার নয়’’। আল্লাহ্ তাআলা সূরা সিজদার ১৭ নং আয়াতে বলেনঃ

فَلَا تَعْلَمُ نَفْسٌ مَّا أُخْفِيَ لَهُم مِّن قُرَّةِ أَعْيُنٍ جَزَاء بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ

‘‘কেউ জানেনা তাদের কৃতকর্মের জন্য নয়ন শীতলকারী কী প্রতিদান লুকায়িত আছে’’।

জাহান্নাম সত্যঃ এই সাক্ষ্য দানের তাৎপর্য হল, মুমিনগণ এই বিশ্বাস করবে যে, জাহান্নাম হচ্ছে আযাবের স্থান। যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করবে, তাঁর এবাদত, প্রভুত্ব ও মালিকানায় শির্ক করবে এবং তাঁর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন করবে, তিনি তাদের জন্য এটি প্রস্ত্তত রেখেছেন। কিয়ামতের দিন তারা তাতে প্রবেশ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনবেনা সে কুরআন এবং রাসূলগণ যা নিয়ে এসেছেন, তার প্রতি কুফরী করল। কেননা আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জান্নাত ও জান্নাতের চিরস্থায়ী নেয়ামতের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি আরো বর্ণনা করেছেন যে, জান্নাত হচ্ছে আল্লাহ্ ভীরুদের বাসস্থান। আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে জাহান্নামের বর্ণনাও দিয়েছেন এবং তাতে যে শাস্তি রয়েছে, তারও বিবরণ দিয়েছেন। আর এটিকে তিনি কাফের-মুশরিকদের জন্য তৈরী করে রেখেছেন।

তাকে আল্লাহ তাআলা জান্নাত দান করবেন, তার আমল যাই হোক না কেনঃ অর্থাৎ যে ব্যক্তি এ সাক্ষ্য দিল যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। তিনি একক। তাঁর কোন শরিক নেই। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর বান্দা ও রাসূল। ঈসা (আঃ) আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, তিনি তাঁর এমন এক কালিমা, যা তিনি মারইয়াম (আঃ) এর প্রতি প্রেরণ করেছেন এবং তিনি তাঁরই পক্ষ থেকে প্রেরিত একটি রুহ। জান্নাত সত্য জাহান্নাম সত্য, আল্লাহ তাআলা তাকে জান্নাত দান করবেন। তার আমল যাই হোক না কেন। অর্থাৎ তাঁর ইখলাস তথা একনিষ্ঠতার সাথে উপরোক্ত বিষয়গুলোর ঘোষণা দেয়ার কারণে, সত্য বিষয়গুলোর সত্যায়ন করার কারণে, নবী-রাসূলদের প্রতি এবং তাদেরকে যেই নবুওয়াত ও রেসালাত দেয়া হয়েছে, তার প্রতি ঈমান আনয়নের কারণে, খৃষ্টান ও ইহুদীরা ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে যেই বাড়াবাড়ি ও দুর্ব্যবহার করেছে তার প্রতিবাদ ও বিরোধীতা করার কারণে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে ঈসা (আঃ)এর ব্যাপারে আরও দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছে যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও রাসূল, জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতিও ঈমান আনয়ন করেছে। যার আমল ও অবস্থা এই রকম হবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যদিও সৎকর্ম সম্পাদনে তার ত্রুটি রয়েছে এবং তাঁর বেশ কিছু গুনাহ্ও রয়েছে। এ সৎআমলটি অর্থাৎ নির্ভেজাল তাওহীদের ঘোষণা অন্যান্য সকল গুনাহ্-এর তুলনায় ভারী হয়ে যাবে। হে পাঠক! আপনি এই গুরুত্বপূর্ণ হাদীছটি ভাল করে বুঝে নিন।

ইমাম বুখারী ও মুসলিম সাহাবী ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ

«فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ»

‘‘আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[11]

............................................................

ব্যাখ্যাঃ এটি বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি দীর্ঘ হাদীছের অংশ। লেখক তা থেকে শুধু ঐ টুকুই বর্ণনা করেছেন, যা এ অধ্যায়ের জন্য প্রযোজ্য। কালেমায়ে তায়্যেবার এটিই প্রকৃত অর্থ। এ পবিত্র বাক্যটি এবাদতের মধ্যে ইখলাসের দাবী জানায় এবং শির্ককে সম্পূর্ণরূপে নাকোচ করে। সিদ্ক এবং ইখলাস এই দু’টি বিষয় এমন, যার একটি অন্যটির সাথে জড়িত। এ দু’টির একটিকে অন্যটি ছাড়া কল্পনাও করা যায়না। বান্দা যদি এবাদতের মধ্যে একনিষ্ঠ না হয়, তাহলে সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে। আর যদি সত্যবাদী না হয়, তাহলে মুনাফেক হিসাবে গণ্য হবে। মুখলিস হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে কালেমায়ে তাওহীদ ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’কে জবান দিয়ে পাঠ করার সাথে সাথে খালেসভাবে কেবল আল্লাহর এবাদত করে। এর নামই তাওহীদ। এটিই ইসলামের মূল কথা। ইবরাহীম (আঃ) এই বিষয়ে বলেছেনঃ

رَبَّنَا وَاجْعَلْنَا مُسْلِمَيْنِ لَكَ وَمِن ذُرِّيَّتِنَا أُمَّةً مُّسْلِمَةً لَّكَ وَأَرِنَا مَنَاسِكَنَا وَتُبْ عَلَيْنَا إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

‘‘হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে তোমার আজ্ঞাবহ করো এবং আমাদের বংশধর থেকেও একটি অনুগত দল সৃষ্টি করো, আমাদের হজ্জের রীতিনীতি বলে দাও এবং আমাদের ক্ষমা করো। নিশ্চয়ই তুমি তাওবা কবুলকারী, দয়ালু’’। (সূরা বাকারাঃ ১২৮) ইয়ামানের সাবা শহরের রাণী বিলকীস বলেছিলঃ

رَبِّ إِنِّي ظَلَمْتُ نَفْسِي وَأَسْلَمْتُ مَعَ سُلَيْمَانَ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, আমি তো নিজের প্রতি যুলুম করেছি। আমি সুলায়মানের সাথে সৃষ্টিজগতের প্রতিপালক আল্লাহ্‌র কাছে আত্মসমর্পন করলাম’’। (সূরা নামলঃ ৪৪) ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছিলেনঃ

إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضَ حَنِيفاً وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। (সূরা আনআমঃ ৭৯) হানীফ ঐ ব্যক্তিকে বলা হয়, যে সম্পূর্ণরূপে শির্ক বর্জন করে, শির্কের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, মুশরিকদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে, তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল আমল ও এবাদত কেবল আল্লাহ্ তাআলার জন্যই সম্পাদন করে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা লুকমানের ২২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

‘‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে’’। মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করার অর্থ হচ্ছে, বান্দা তাঁর এবাদতকে একমাত্র আললাহর জন্য এমনভাবে খালেস করবে যে, তাতে যেন কোন প্রকার শির্ক বা নিফাক স্থান না পায়। আলেমদের সর্বসম্মতিক্রমে এটিই হচ্ছে এ আয়াত এবং অন্যান্য আয়াতের অর্থ। যার অবস্থা এ রকম হবে, কালেমায়ে তাইয়্যেবা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ কেবল তারই উপকার করবে। এ জন্যই আয়াতের শেষাংশে আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى ‘‘সে এক মজবুত হাতল ধারণ করল’’।[12] কিন্তু যে ব্যক্তি কালেমায়ে তাওহীদ পাঠ করার সাথে সাথে আল্লাহ্ ছাড়া অন্যকে আহবান করবে, জীবিত কিংবা মৃত এমন অলীর কাছে সাহায্য চাইবে, যে উপকার কিংবা ক্ষতির মালিক নয় তার কালেমা পাঠ কোন উপকার করবেনা। অধিকাংশ বনী আদমের অবস্থা বর্তমানে এ রকমই। তারা জবানের মাধ্যমে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পাঠ করলেও তাদের কাজ তাদের কথার বিপরীত। কালেমায়ে তাওহীদ তখনই পাঠকের উপকারে আসবে যখন সে নেতিবাচক ও ইতিবাচকের সাথে এর অর্থ ভালভাবে উপলদ্ধি ও বিশ্বাস করার পরই তা পাঠ করবে। কালেমাটির অর্থ সম্পর্কে যে ব্যক্তি অজ্ঞ, কালেমাটি তাঁর কোন উপকার করবেনা।[13] কেননা আরবী ভাষায় যে অর্থে এই পবিত্র বাক্যটি তৈরী করা হয়েছে তা সম্পর্কে সে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। আর তা হচ্ছে শির্ককে সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করা। এমনিভাবে যে ব্যক্তি এর অর্থ জানবে ও বুঝবে, কিন্তু অন্তর দিয়ে তা বিশ্বাস করবেনা, কালেমাটি তারও কোন উপকার করবেনা। কেননা যখন কোন বিষয়ে কারো ইয়াকীন চলে যাবে, তখন ঐ বিষয়ে তার অন্তরে সন্দেহ প্রবেশ করবে। এ জন্যই মুসলিম শরীফের এক বর্ণনায়غَيْرَ شَاكٍ কথাটি এসেছে। অর্থাৎ কালেমায়ে শাহাদাত পাঠ করার সময় আল্লাহ্ তাআলার ওয়াহ্দানিয়াত সম্পর্কে কোন প্রকার সন্দেহ পোষণ করলে কোন উপকার হবেনা। সুতরাং ইলম ও ইয়াকীন ব্যতীত কালেমাটি পাঠ করলে পাঠকের কোন উপকার হবেনা। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ صِدْقًا مِنْ قَلْبِهِ خَالِصاً مِنْ قَلْبِهِ অর্থাৎ পূর্ণ বিশ্বাস এবং একনিষ্ঠতার সাথে কালেমাটি পাঠ করলেই উপকার হবে। এমনি যে ব্যক্তি সত্যবাদী এবং একনিষ্ঠ না হয়ে কালেমাটির স্বীকারোক্তি প্রদান করবে, ঐ ব্যক্তির জন্য কালেমাটি উপকারী হবেনা। কেননা তাঁর অন্তর মুখের স্বীকারোক্তির বিরোধী। মুনাফিকদের অবস্থা এ রকমই। তারা মুখে এমন কথা বলে, যা তাদের অন্তরে নেই। এমনি অবস্থা মুশরিকদেরও। মুশরিকদের থেকেও এই কালেমাটি গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা র্শিক এবাদতের ক্ষেত্রে ইখলাস ও কালেমায়ে তাওহীদের তাৎপর্যের পরিপন্থী। কালেমায়ে তাওহীদ যেমন আল্লাহর কোন শরীক হওয়াকে অস্বীকার করে, তেমনি শির্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদেরও ঘোষণা দেয় এবং একমাত্র আল্লাহর জন্য পরিপূর্ণ ইখলাসেরও প্রমাণ বহন করে। সুতরাং যার স্বীকারোক্তি এই মর্মার্থ হতে মুক্ত হবে, তার এ কালেমার স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসবেনা। এটিই হচ্ছে মাজার পূজারীদের অবস্থা। তারা মুখে বলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’। কিন্তু তারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করতে অস্বীকার করে। শুধু তাই নয়, তারা তাওহীদপন্থীদের সাথে শত্রুতাও পোষণ করে এবং শির্ক ও মুশরিকদের সাহায্যও করে। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর পিতা ও স্বগোত্রীয় লোকদেরকে বলেছিলেনঃ

وَإِذْ قَالَ إِبْرَاهِيمُ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ إِنَّنِي بَرَاء مِّمَّا تَعْبُدُونَ إِلَّا الَّذِي فَطَرَنِي فَإِنَّهُ سَيَهْدِينِ وَجَعَلَهَا كَلِمَةً بَاقِيَةً فِي عَقِبِهِ لَعَلَّهُمْ يَرْجِعُونَ

‘‘আর যখন ইবরাহীম তার পিতা এবং তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, তোমরা যাদের পূজা কর, তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। তবে আমার সম্পর্ক তাঁর সাথে, যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। অতএব, তিনিই আমাকে সৎপথ প্রদর্শন করবেন। এ কথাটিকে তিনি অক্ষয় বাণী স্বরূপ তার সন্তানদের মধ্যে রেখে গেছেন, যাতে তারা আল্লাহ্‌র দিকেই ফিরে আসে’’। (সূরা যুখরুফঃ ২৬-২৮) এটিই হচ্ছে, ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক অর্থ। ইবরাহীম খলীল (আঃ) তাঁর জবানের মাধ্যমে এই অর্থটিকেই প্রকাশ করেছেন। এই অর্থটির জন্যই কালেমাটি গঠন করা হয়েছে এবং তা এই অর্থই প্রকাশ করে। সেটি হচ্ছে শির্ক থেকে মুক্ত হয়ে একমাত্র আল্লাহর এবাদত করা, এতে তার কোন শরীক নেই। ইতিপূর্বে এর বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কালেমাটি পাঠ করবে, কিন্তু এটি যেই ইখলাসের প্রমাণ বহন করে, তা কবুল করেনি, সে এই বাক্যটি পাঠে মিথ্যুক হিসাবে গণ্য হবে। শুধু তাই নয়; বরং এই কালেমাটির অর্থ পরিবর্তনকারী হিসাবে গণ্য হবে, কালেমায়ে তায়্যেবা যেই শির্ককে অস্বীকার করেছে, সেটিকেই সাব্যস্ত করবে এবং এটি যেই ইখলাসকে সাব্যস্ত করে তা অস্বীকারকারী হিসাবে গণ্য হবে।

ইসলামের প্রথম তিন যুগের পর উম্মতে মুহাম্মাদীর অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। এর কারণ হচ্ছে, কালেমায়ে তাওহীদের অর্থ সম্পর্কে জ্ঞান না থাকা এবং প্রবৃত্তির অনুসরণ করা। এই মূর্খতা ও প্রবৃত্তির অনুসরণই মানুষকে সত্য গ্রহণ এবং আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদের জন্য যেই দ্বীন ও তাওহীদসহ নবী-রাসূলগণকে প্রেরণ করেছেন তা কবুল করতে বাধা দেয়।

প্রখ্যাত সাহাবী আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ করেছেন, মূসা (আঃ) বললেনঃ হে আমার রব! আমাকে এমন জিনিস শিক্ষা দিন যা দ্বারা আমি আপনাকে স্মরণ করব এবং আপনাকে ডাকব। আল্লাহ বললেন, ‘হে মূসা! তুমি لا إله إلا الله বল। মূসা বললেনঃ তোমার সব বান্দাই তো এটা বলে। তিনি বললেনঃ হে মূসা! আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা আর সাত তবক যমীন যদি এক পাল্লায় থাকে এবং আরেক পাল্লায় যদি শুধু لا إله إلا الله থাকে তাহলেلا إله إلا الله -এর পাল্লাই বেশী ভারী হবে’’।[14]

..............................................................

ব্যাখ্যাঃ لا إله إلا الله-এর মধ্যে ব্যবহৃত لا অক্ষরটি লায়ে নফী জিন্স। এই প্রকার لا এর পরে যে বিষয়টি আসে, লা-এর মাধ্যমে উক্ত বিষয়ের সকল প্রকারকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়ে শুধু إلا-এর পরে উল্লেখিত বিষয়টির জন্য তা সাব্যস্ত করা হয়। সুতরাং এর অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন সত্য ইলাহ নেই। এখানে আরেকটি বিষয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আর তা হচ্ছে لا- এর খবর উহ্য রয়েছে। মূলতঃ বাক্যটি এরূপ لاإله حق إلا الله অর্থাৎ আল্লাহ্ ছাড়া কোন সত্য মাবুদ নেই।[15] সূরা হজ্জের ৬২ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

ذَلِكَ بِأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْحَقُّ وَأَنَّ مَا يَدْعُونَ مِن دُونِهِ الْبَاطِلُ وَأَنَّ اللَّهَ هُوَ الْعَلِيُّ الْكَبِيرُ

‘‘এটা এ কারণে যে, আল্লাহ্ই সত্য; তার পরিবর্তে তারা যাকে ডাকে, তা অসত্য এবং আল্লাহ্ই সবার উচ্চে’’। সুতরাং আল্লাহই সত্য ইলাহ্। তিনিই এবাদতের একমাত্র হকদার। তিনি ব্যতীত যত ইলাহ আছে, তার সবই বাতিল। যেমনটি বর্ণিত হয়েছে এই আয়াতে এবং অন্যান্য আয়াতসমূহে।

সুতরাং এটিই অর্থাৎ لا إله إلا الله হচ্ছে মহান কালেমা, এটিই মজবুত হাতল, এটিই কালিমাতুত তাকওয়া এবং এটিই কালিমাতুল ইখলাস। এর উপরই আসমান-যমীনের ভিত্তি, এর পূর্ণতার জন্যই ফরয ও সুন্নাতসমূহকে শরীয়তের অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে, পৃথিবীতে এর শিক্ষা ও দাবীকে বাস্তবায়নের জন্যই তলোয়ার কোষমুক্ত করা হয়েছে এবং এর মাধ্যমেই আল্লাহর বান্দাদের মধ্য হতে অনুগত ও নাফরমান বান্দাদের মধ্যে পার্থক্য হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি সত্যায়ন, ইখলাস, মনেপ্রাণে গ্রহণ করে নিয়ে, মুহাববত এবং বিনয়ের সাথে এই বাক্যটি পাঠ করবে এবং এর উপর আমল করবে, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন। তার আমল যাই হোক না কেন।

সহীহ হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

أَفْضَلُ الدُّعَاءِ دُعَاءُ يَوْمِ عَرَفَةَ وَأَفْضَلُ مَا قُلْتُ أَنَا وَالنَّبِيُّونَ مِنْ قَبْلِى لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

‘‘সর্বোত্তম দুআ হচ্ছে আরাফা দিবসের দুআ। আমি এবং আমার পূর্বের নবীগণ যা বলেছেন, তার মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছেঃ

لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهْوَ عَلَى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ

আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন সত্য উপাস্য নেই। তিনি একক। তাঁর কোনো শরীক নেই। মালিকানা তাঁরই। সমুদয় প্রশংসা তাঁরই জন্য। তিনি সকল বিষয়ের উপর ক্ষমতাবান’’।[16]

আব্দুল্লাহ্ ইবনে আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে মারফু সূত্রে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, কিয়ামতের দিন সমস্ত সৃষ্টির সামনে আমার উম্মতের একজন লোকের নাম ধরে চিৎকার করে ডাকা হবে এবং তার সামনে ৯৯টি রেজিষ্টার বই খোলা হবে। চোখের দৃষ্টি যত দূর যায়, ততদূর লম্বা হবে এক একটি রেজিষ্টার। অতঃপর তাকে বলা হবে, তুমি কি এ সমস্ত আমল থেকে কোনো কিছু অস্বীকার করতে পারবে? সে বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! না। কোন কিছুই অস্বীকার করতে পারবনা। তাকে বলা হবেঃ তোমার কোন ওজর (অযুহাত) আছে কি? অথবা তোমার কোন নেকী আছে কি? তখন লোকটি ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে বলতে থাকবেঃ না, আমার কোন নেক আমল নেই। অতঃপর বলা হবেঃ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আমাদের কাছে তোমার একটি নেকী রয়েছে। তোমার উপর কোন প্রকার যুলুম করা হবেনা। অতঃপর তার জন্য একটি কার্ড বের করা হবে। তাতে লেখা থাকবেঃ أَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ অর্থাৎ আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো সত্য উপাস্য নেই। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহর রাসূল। লোকটি তখন বলবেঃ হে আমার প্রতিপালক! এত বিশাল বিশাল বইগুলোর সামনে এই কার্ডটির কোন মূল্য আছে কি? তখন তাকে বলা হবেঃ তোমার উপর কোন রকম যুলুম করা হবেনা। এ কথা বলার পর রেজিষ্টারগুলো রাখা হবে এক পাল্লায় এবং কার্ডটি রাখা হবে আরেক পাল্লায়। এতে বইগুলোর পাল্লা হালকা হয়ে যাবে এবং কার্ডটির পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।[17]

আমি ব্যতীত সপ্তাকাশে যা কিছু আছে তা, আর সাত যমীন যদি এক পাল্লায় রাখা হয়ঃ এখানে আসমান ও যমীনে যা আছে, তার সবই উদ্দেশ্য। আর আমি ব্যতীত এ কথার মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় সত্তাকে আসমানবাসী থেকে আলাদা করেছেন। কেননা তার পবিত্র সত্তা সব কিছুর উর্ধ্বে। আল্লাহ্ তাআলা সুরা বাকারার ২৫৫ নং এবং সূরা শুরার ৪ নং আয়াতে বলেনঃ وَهُوَ الْعَلِيُّ الْعَظِيمُ ‘‘তিনিই সর্বোচ্চ এবং সর্বাপেক্ষা মহান’’। অর্থাৎ তার ক্ষমতা সর্বোচ্চ, তার মর্যাদা সর্বোচ্চ এবং তার সত্তা সকলের উর্ধ্বে। ক্ষমতা, মর্যাদা এবং উঁচু হওয়া- এই তিনটির প্রত্যেকটিই আল্লাহর সিফাত। এগুলো আললাহ্ তাআলার কামালিয়াতের প্রমাণ বহন করে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى

‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। (সূরা তোহাঃ ৫) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَانُ

‘‘অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। তিনি পরম দয়াময়’’। (সূরা ফুরকানঃ ৫৯) এভাবে কুরআনের সাতটি আয়াতে আল্লাহ্ তাআলার আরশে সমুন্নত হওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

إِلَيْهِ يَصْعَدُ الْكَلِمُ الطَّيِّبُ وَالْعَمَلُ الصَّالِحُ يَرْفَعُهُ

‘‘তাঁর কাছে শুধু পবিত্র কথাই উপরের দিকে আরোহণ করে এবং তিনি সৎকর্ম উন্নীত করেন’’। (সূরা ফাতিরঃ ১০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

يَخَافُونَ رَبَّهُمْ مِنْ فَوْقِهِمْ

‘‘তারা তাদের প্রতিপালককে ভয় করে, যিনি তাদের উপরে’’। (সূরা নাহ্লঃ ৫০) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

تَعْرُجُ الْمَلاَئِكَةُ وَالرُّوحُ إِلَيْهِ فِي يَوْمٍ كَانَ مِقْدَارُهُ خَمْسِينَ أَلْفَ سَنَةٍ

‘‘ফেরেশতা এবং রূহ (জিবরীল) তাঁর দিকে উর্ধ্বগামী হয় এমন একদিনে যার পরিমাণ পঞ্চাশ হাজার বছর।’’। (সূরা মাআরেজঃ ৪) আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِذْ قَالَ اللَّهُ يَاعِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ

‘‘আল্লাহ যখন বললেনঃ হে ঈসা! নিশ্চয়ই আমি তোমাকে মৃত্যু দান করবো[18] এবং তোমাকে আমার দিকে উঠিয়ে নেব’’। (সূরা আল-ইমরানঃ ৫৫) এ রকম আরো অনেক আয়াত রয়েছে যা প্রমাণ করে আল্লাহ্ তাআলা উপরে সমুন্নত। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলা মাখলুকের উপরে থাকার গুণটি অস্বীকার করল, সে কুরআন ও সুন্নাহ্র সুস্পষ্ট দলীলের বিরোধীতা করল এবং আল্লাহর নাম ও গুণাবলীতে পরিবর্তন ও বিকৃতি করল। উপরোক্ত হাদীছাংশে আল্লাহ্ ব্যতীত অন্যান্য সকল বস্ত্তর উলুহীয়াত ও উবুদীয়াতকে অস্বীকার করা হয়েছে। উপরোক্ত হাদীছে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, আসমানের ন্যায় যমীনও সাতটি।

এই বিশাল বিশাল সৃষ্টির মুকাবেলায় কেবল ঐ ব্যক্তির ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’র পাল্লা ভারী হবে যে কুরআন ও সুন্নাহ্য় বর্ণিত শর্তসহ এই মহান বাক্যটি পাঠ করবে। আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তাআলা সূরা তাওবা এবং অন্যান্য সূরায় এমন অনেক লোকের আলোচনা করেছেন, যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে, কিন্তু এই পবিত্র বাক্যটি তাদের কোন উপকারে আসবেনা। ইহুদী, খৃষ্টান ও মুনাফেকদের অবস্থা এমনই। এদের সংখ্যা প্রচুর। এদের নিফাকীও বহুরূপী। তাদের স্বীকারোক্তি কোন কাজে আসেনি। কেননা তারা শর্তগুলো পালন সাপেক্ষ এই কালেমাটি পাঠ করেনি। তাদের কেউ কালেমার মর্ম না জেনেই তা পাঠ করেছে। অর্থাৎ যে অর্থে কালেমাটি তৈরী করা হয়েছে, তা না জেনেই পাঠ করছে। এই কালেমাটির মাকসুদ হচ্ছে শির্ক প্রত্যাখ্যান করা এবং তা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া। সেই সাথে সত্যকে মনেপ্রাণে কবুল করা এবং ইখলাসের সাথে আল্লাহর এবাদত করাই এই কালেমার মাকসুদ। এ ছাড়া যে ব্যক্তি এই কালেমার অন্য কোন অর্থ বুঝার এবং তার উপর আমল করার আহবান জানায়, তার কথা গ্রহণ করা যাবেনা। এই কালেমার দাবী অনুযায়ী আনুগত্য বর্জন করা কালেমার মাকসুদের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অতীত ও বর্তমানের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই। তারা কালেমা পাঠ করলেও এর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতেও তারা প্রস্ত্তত নয়। পরবর্তী কালের অধিকাংশ লোকের অবস্থা এ রকমই।

কতক লোক এমন আছে, যাদের অন্তরে অহংকার, কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ এবং অন্যান্য দোষ-ত্রুটি থাকার কারণে কালেমার প্রতি ভালবাসা পোষণ করতে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সূরা তাওবার ২৪ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنْ كَانَ آبَاؤُكُمْ وَأَبْنَاؤُكُمْ وَإِخْوَانُكُمْ وَأَزْوَاجُكُمْ وَعَشِيرَتُكُمْ وَأَمْوَالٌ اقْتَرَفْتُمُوهَا وَتِجَارَةٌ تَخْشَوْنَ كَسَادَهَا وَمَسَاكِنُ تَرْضَوْنَهَا أَحَبَّ إِلَيْكُمْ مِنَ اللَّهِ وَرَسُولِهِ وَجِهَادٍ فِي سَبِيلِهِ فَتَرَبَّصُوا حَتَّى يَأْتِيَ اللَّهُ بِأَمْرِهِ وَاللَّهُ لا يَهْدِي الْقَوْمَ الْفَاسِقِينَ

‘‘বলোঃ তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান, তোমাদের ভাই, তোমাদের স্ত্রী, তোমাদের গোত্র, তোমাদের অর্জিত ধন-সম্পদ, তোমাদের ব্যবসা, যা বন্ধ হয়ে যাওয়ার ভয় কর এবং তোমাদের বাসস্থান, যাকে তোমরা পছন্দ কর, এসব কিছু আল্লাহ্, তাঁর রাসূল ও তাঁর পথে জিহাদ করা থেকে অধিক প্রিয় হয়, তবে অপেক্ষা কর আল্লাহ্‌র বিধান আসা পর্যন্ত, আর আল্লাহ্ ফাসেক সম্প্রদায়কে হেদায়াত করেন না’’।

সুতরাং খাঁটি ঈমানদারগণ যখন জবান দিয়ে এই কালেমাটি পাঠ করে, তখন অন্তর দিয়ে অনুধাবন করেই পাঠ করে এবং এর দাবী অনুযায়ী আমল করে। তারা কালেমার শর্তগুলোও বাস্তবায়ন করে।[19] শর্তগুলো হচ্ছে, কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া এবং অনুগত হওয়া। সেই সঙ্গে তারা কেবল আল্লাহর জন্যই কারও সাথে শত্রুতা পোষণ করে এবং আল্লাহর জন্যই কাউকে বন্ধু বানায়। কাউকে ভালবাসা বা ঘৃণা করার ক্ষেত্রেও কথা একই। সত্যিকার মুমিনদের অবস্থা আল্লাহ্ তাআলা সুরা তাওবায় এবং কুরআনের অন্যান্য স্থানে আলোচনা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা তাদের প্রশংসা করেছেন, তাদের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করেছেন, তাদের জন্য জান্নাত তৈরী করেছেন এবং জাহান্নাম থেকে তাদেরকে পরিত্রাণ দেয়ার ঘোষণা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاء بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلاَةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللّهَ وَرَسُولَهُ أُوْلَـئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللّهُ إِنَّ اللّهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ

‘‘আর ঈমানদার পুরুষ ও ঈমানদার নারী একে অপরের বন্ধু। তারা সৎকাজের আদেশ দেয় এবং অসৎকাজ থেকে বিরত রাখে। নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ্ ও তার রাসূলের আনুগত্য করে। অচিরেই এদের উপর আল্লাহ্ দয়া করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাবান’’। (সূরা তাওবাঃ ৭১) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالأَنصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُم بِإِحْسَانٍ رَّضِيَ اللّهُ عَنْهُمْ وَرَضُواْ عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ

‘‘আর যারা সর্বপ্রথম হিজরতকারী ও আনসারদের মাঝে অগ্রগামী এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ্ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। আর তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন বেহেশত, যার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত হবে নদীসমূহ। সেখানে তারা থাকবে চিরকাল। এটাই হল মহান সফলতা’’। (সূরা তাওবাঃ ১০০) এ রকম আরো অনেক আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা খাঁটি ঈমানদারদের প্রশংসা এবং পরকালে তাদের জন্য প্রস্ত্ততকৃত নেয়ামতের আলোচনা করেছেন। এ সমস্ত সাহাবী এবং উত্তমভাবে তাদের অনুসারীগণই হচ্ছেন লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর প্রকৃত অনুসারী।

যে ব্যক্তি কুরআন নিয়ে গবেষণা করবে, সে আল্লাহ্কে ভালবাসার ক্ষেত্রে, তার তাওহীদের ক্ষেত্রে, তার আনুগত্যের ক্ষেত্রে, তার নাফরমানী থেকে বিরত থাকার ক্ষেত্রে, আগ্রহ ও আমলসহ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে এবং ভয়-ভীতিসহ আল্লাহর অপছন্দনীয় বস্ত্ত বর্জন করার ক্ষেত্রে আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে অনেক পার্থক্য দেখতে পাবে। এমনি সে ব্যক্তি মানুষের অবস্থা, কথা-বার্তা, কর্ম, নিয়ত-উদ্দেশ্য এবং তাদের মধ্যে অন্যান্য বিষয়ে বিরাট পার্থক্য দেখতে পাবে এবং তার কাছে অহংকারী ও দাম্ভিক লোকদের বিভ্রান্তি সুস্পষ্ট হয়ে যাবে। সহীহ হাদীছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে,

«الْكَيِّسُ مَنْ دَانَ نَفْسَهُ وَعَمِلَ لِمَا بَعْدَ الْمَوْتِ وَالْعَاجِزُ مَنْ أَتْبَعَ نَفْسَهُ هَوَاهَا وَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ»

‘‘প্রকৃত জ্ঞানী হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফ্সের হিসাব নিল এবং মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য আমল করল। অক্ষম হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে স্বীয় ন্ফসের চাহিদা পূরণে প্রবৃত্তির অনুসরণ করল এবং আমল ছেড়ে দিয়ে নিজের আশা-আকাঙ্খা পূরণে আল্লাহর উপর ভরসা করে বসে থাকল।[20]

আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা হাদীছে কুদছীতে বলেছেনঃ

«يَا ابْنَ آدَمَ إِنَّكَ لَوْ أَتَيْتَنِى بِقُرَابِ الأَرْضِ خَطَايَا ثُمَّ لَقِيتَنِى لاَ تُشْرِكُ بِى شَيْئًا لأَتَيْتُكَ بِقُرَابِهَا مَغْفِرَةً»

‘‘হে বনী আদম! তুমি যদি যমীন পরিপূর্ণ গুনাহ্ নিয়ে আমার কাছে আগমণ কর এবং আমার সাথে অন্য কিছুকে শরীক না করে মিলিত হও, তাহলে যমীন পরিপূর্ণ ক্ষমাসহ আমি তোমার সাথে সাক্ষাৎ করবো।[21]

.........................................................

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে এমন কথা বর্ণিত হয়েছে, যা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর অর্থকে খোলাসা করেছে। এ জন্যই এটি সমস্ত মাখলুক এবং সকল পাপের মুকাবেলায় ভারী হয়ে যাবে। আর সেই কথাটি হচ্ছে এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার সাথে সাথে ছোট-বড়, কম-বেশী সকল শির্ক বর্জন করা। এটিই হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের দাবী। যে তাওহীদ বাস্তবায়ন এবং কালেমায়ে ইখলাসের দাবী পূরণ করতে পারবেনা, সে কখনই শির্ক থেকে মুক্ত থাকতে পারবেনা। কালেমায় ইখলাসের দাবী ও শর্তগুলো পূর্বে আলোচিত হয়েছে। আর তা হচ্ছে কালেমার অর্থ জানা, তা নিশ্চিতরূপে বিশ্বাস করা, সত্যায়ন করা, একনিষ্ঠতা, এর মর্মার্থকে ভালবাসা, কবুল করে নেওয়া, অনুগত হওয়া ইত্যাদি আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

يَوْمَ لَا يَنفَعُ مَالٌ وَلَا بَنُونَ إِلَّا مَنْ أَتَى اللَّهَ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘‘সে দিন ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন উপকারে আসবেনা; কিন্তু যে সুস্থ অন্তর নিয়ে আল্লাহ্‌র কাছে আসবে’’। (সূরা শুআরাঃ ৮৮-৮৯)

[11] - বুখারী, অধ্যায়ঃ বাড়িঘরে নামাযের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়ঃ জামাআতের সাথে নামায পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।

[12] - العروة الوثقى উরওয়াতুল উছকা হচ্ছে মজবুত হাতল বা রশি। এই রশিকে যে আঁকড়ে ধরবে, রশিটি কখনো ছিড়বেনা এবং সে রশি থেকে বিচ্ছিন্নও হবেনা। এটি তাকে সরাসরি জান্নাতে নিয়ে যাবে। এখানে একটি হাদীছ উল্লেখ করার প্রয়োজন অনুভব করছি। আশা করি এর মাধ্যমে এই রশির অর্থ পরিস্কার হবে। সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন সালামের ফযীলতে ইমাম বুখারী (রঃ) কাইস বিন আববাদের সনদে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। কাইস বলেনঃ আমি একদা মদীনার মসজিদে বসা ছিলাম। তখন একজন লোক মসজিদে প্রবেশ করল। তার চেহারায় ছিল বিনয় ও একাগ্রোতার ছাপ। লোকেরা বললঃ এই লোকটি জান্নাতের অধিবাসী। লোকটি খুব সংক্ষেপে দুই রাকআত নামায আদায় করল। অতঃপর সে মসজিদ হতে বের হয়ে গেল। আমিও তার পিছনে বের হলাম। আমি লোকটিকে বললামঃ তুমি যখন মসজিদে প্রবেশ করেছিলে, তখন লোকেরা বলেছেঃ এই লোকটি আহলে জান্নাতের অন্তর্ভূক্ত। লোকটি বললঃ আল্লাহর কসম! কারো জন্য এমন কথা বলা উচিৎ নয়, যা সে জানেনা। অচিরেই আমি তোমাকে এর কারণ খুলে বলবো।

আসল ব্যাপার এই যে, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় একটি স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নটি আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বর্ণনা করলাম। আমি স্বপ্নে দেখি আমি যেন একটি বাগানের মধ্যে আছি। এ কথা বলে তিনি বাগানের প্রশস্ততা ও তার সবুজ শ্যামল শোভার কথা উল্লেখ করলেন। তারপর বললেনঃ বাগানের মধ্যভাগে ছিল লোহার একটি খুঁটি। খুঁটির নীচের ভাগ ছিল মাটির মধ্যে এবং তার উপরের অংশ ছিল আকাশে। তার উপরের প্রান্তে রয়েছে একটু রশি। আমাকে বলা হলঃ এতে আরোহণ কর। আমি বললামঃ আমি তো পারছি না। এমন সময় আমার কাছে একজন খাদেম এসে পেছন দিক থেকে আমার কাপড় উঁচু করে ধরল। তখন আমি আরোহণ করতে লাগলাম। অবশেষে স্তম্ভটির উপরের প্রান্তে পৌঁছে রশিটা ধরে ফেললাম। তখন আমাকে বলা হল, দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরো। তারপর আমি ঐ রশিটা আমার হাতে ধরা অবস্থায় জেগে উঠলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আমার স্বপ্নের কথা বর্ণনা করলে তিনি বললেনঃ ঐ বাগানটি হল ইসলাম। ঐ স্তম্ভটা হল ইসলামের মূল স্তম্ভ। আর ঐ রশিটা হল ইসলামের সুদৃঢ় রশি। কাজেই মৃত্যু পর্যন্ত তুমি ইসলামের উপরই থাকবে।

[13] - কালেমার অর্থ ও তাৎপর্য না জেনে কেউ যদি তা পাঠ করে, তাহলে এই কালেমা তার উপকারে আসবে কিনা- এ বিষয়টি মতভেদপূর্ণ। তবে অনেক দলীল প্রমাণ করে যে, অজ্ঞতার অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবে। এ বিষয়ে যথাস্থানে বিস্তারিত আলোচনা আসবে ইনশা-আল্লাহ।

[14] - ইবনে হিববান ও হাকিম। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে যঈফ বলেছেন। দেখুনঃ সহীহুত্ তারগীব ওয়াত্ তারহীব, হাদীছ নং- ৯২৩। তবে এই কালেমার শক্তি আসমান-যমীন অপেক্ষা বেশী’’। একাধিক বিশুদ্ধ হাদীছ রয়েছে।

[15] - বাংলা ভাষায় অধিকাংশ ইসলামী বই-পুস্তকগুলোতে ‘আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ নেই’,-এভাবেই لا إله إلا الله-এর অনুবাদ করা হয়েছে। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর অনুবাদ এভাবে করা ঠিক নয়। কারণ বাক্যটির আসল রূপ হচ্ছে لا إله حق إلا الله। যদি অনুবাদ করা হয় যে, আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই, তাহলে حق(হক) শব্দটির অনুবাদ ছুটে যায়। আর আল্লাহ্ ছাড়া কোন মাবুদ নেই- এ কথাটিও অবাস্তব। কারণ আমরা এই পৃথিবীতে অসংখ্য মাবুদ দেখতে পাচ্ছি। মূলতঃ যার এবাদত ও উপাসনা করা হয়, তাই মাবুদ। সে হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায় যে সমস্ত দেব-দেবীর পূজা ও উপাসনা করে, সেগুলো তাদের মাবুদ। মক্কার মুশরিকরা যে সমস্ত মূর্তির উপাসনা করত, সেগুলো ছিল তাদের মাবুদ। যে সমস্ত মুসলিম কবরে সিজদাহ্ করছে, অলী-আওলীয়া ও কবরবাসীর কাছে সাহায্য চাচ্ছে, তারাও এগুলোকে মাবুদ বানিয়ে নিয়েছে। সুতরাং পৃথিবীতে বহু মাবুদ আছে এবং মানুষ সেগুলোর পূজা করছে। তবে এগুলো সত্য ও সঠিক মাবুদ নয়। এ কথাটিই ব্যক্ত হয়েছে লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর মধ্যে। সুতরাং لا إله إلا الله -এর সঠিক অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ ছাড়া সত্য-সঠিক কোন উপাস্য নেই। (অনুবাদক)

[16] - ইমাম মালেক (রঃ) মুআত্তায় তালহা বিন উবাইদুল্লাহ (রাঃ) হতে হাদীছটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ) বলেনঃ সংক্ষিপ্ত কথা হচ্ছে, হাদীছটির শাওয়াহেদ থাকার কারণে তথা অন্যান্য সনদে বর্ণিত হওয়ার কারণে সহীহ। দেখুনঃ সিলসিলা সহীহা, হাদীছ নং- ১৫০৩।

[17] - তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ। ইমাম তিরমিজী হাদীছটি বর্ণনা করার পর সহীহ বলেছেন। ইমাম আলবানী (রঃ)ও হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১৩৫।

হাদীছে বর্ণিত আল্লাহর রহমত কেবল তার বেলায় প্রযোজ্য হবে যার প্রতি আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করবেন। এটা একান্তই আল্লাহর অনুগ্রহ। কাজেই উল্লেখিত রহমতের আশায় এবাদত-বন্দেগী না করে বসে থাকা মোটেই উচিত নয়।

[18] - এখানে মৃত্যু বলতে নিদ্রা উদ্দেশ্য। অর্থাৎ আমি তোমাকে নিদ্রার মাধ্যমে উপরে উঠিয়ে নিবো। কেননা ঈসা (আঃ) মৃত্যু বরণ করেন নি। কিয়ামতের আগে তিনি পুনরায় দুনিয়াতে আগমণ করবেন।

[19] - কালেমার শর্তসমূহঃ

(১) ইতিবাচক ও নেতিবাচক ভাবে অর্থ জানা, যা অজ্ঞতার পরিপন্থী। নেতিবাচক হলো আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো জন্য এবাদাত সাব্যস্ত না করা। আর ইতিবাচক হলো তা (এবাদাত) এককভাবে তাঁর জন্য সাব্যস্ত করা। তাঁর কোন অংশীদার নেই তিনিই একমাত্র এবাদাতের মালিক ও হক্বদার।

(২) এই কালেমার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রাখা, যা সন্দেহের পরিপন্থী। অর্থাৎ এই কালেমার দাবীর প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস রেখে আন্তরিকভাবে নিশ্চিত হয়ে মুখে উচ্চারণ করা।

(৩) এই কালেমাকে মনে প্রাণে গ্রহণ করা, যা প্রত্যাখ্যাণের পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমার সকল দাবী-চাহিদা ও তার বক্তব্য গ্রহণ করা। সংবাদ সমূহের প্রতি বিশ্বাস রাখা, আদেশ সমূহ পালন করা। নিষেধ সমূহ হতে বিরত থাকা। কুরআন ও হাদীসের দলীল পরিত্যাগ ও অপব্যাখ্যা না করা।

(৪) অনুগত হওয়া, যা অগ্রায্য করার পরিপন্থী। আর তা হলো এই কালেমা যে সকল বিধানের নির্দেশ দিয়েছে প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য ভাবে তার প্রতি অনুগত থাকা।

(৫) এই কালেমাকে সত্য জানা, যা মিথ্যার পরিপন্থী। আর তা হলো বান্দা এই কালেমাকে সত্য জেনে অন্তর হতে উচ্চারণ করবে। এই কালেমা পাঠকারীর অন্তর তার কথা মোতাবেক হবে এবং তার বাহ্যিক অবস্থা অভ্যন্তরীণ অবস্থার অনুরূপ হবে। অতঃপর যে ব্যক্তি এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করেছে আর তার দাবীকে অস্বীকার করেছে নিশ্চয়ই তার এই উচ্চারণ কোন কাজে আসবেনা, যেমন মুনাফেকদের অবস্থা ছিল। তারা এই কালেমা মুখে উচ্চারণ করতো অন্তরে অস্বীকার করত।

(৬) পূর্ণ একনিষ্ঠতা থাকা, যা শির্কের পরিপন্থী। আর তা হল বান্দা আমলকে নেক নিয়তের দ্বারা শির্কের সকল প্রকার প্রাদুর্ভাব হতে মুক্ত রাখবে। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا اللَّهَ مُخْلِصِينَ لَهُ الدِّينَতারা তো আদিষ্ট হয়েছিল আল্লাহর আনুগত্যে বিশুদ্ধচিত্ত হয়ে একনিষ্ঠভাবে এবাদাত করার। (সূরা আল-বায়্যিনাঃ ৫)

(৭) এই কালেমার সাথে ভালবাসা রাখা, যা ঘৃণা ও অপছন্দের পরিপন্থী। আর ইহা বাস্তবায়িত হবে কালেমাকে, তার দাবীকে, তার নির্দেশিত বিধানকে এবং যারা এই কালেমার শর্ত মোতাবেক চলে তাদেরকে ভালবাসার মাধ্যমে। আর উল্লেখিত কথাগুলোর বিপরীত কথার সাথে বিদ্বেষ রাখার মাধ্যমে। এর নিদর্শন হলঃ আল্লাহর প্রিয় বস্ত্তকে প্রাধান্য দেয়া, যদিও তা প্রবৃত্তির বিরোধী হয়। আর আল্লাহর যা অপছন্দ তা অপছন্দ করা, যদিও প্রবৃত্তি তার দিকে ধাবিত হয়। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের বন্ধুত্ব রয়েছে তাঁদের সাথে বন্ধুত্ব রাখা। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যাদের শত্রুতা রয়েছে তাদের সাথে শত্রুতা রাখা। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

فَقَدْ كَانَتْ لَكُمْ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ فِي إِبْرَاهِيمَ وَالَّذِينَ مَعَهُ إِذْ قَالُوا لِقَوْمِهِمْ إِنَّا بُرَآَءُ مِنْكُمْ وَمِمَّا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ كَفَرْنَا بِكُمْ وَبَدَا بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمُ الْعَدَاوَةُ وَالْبَغْضَاءُ أَبَدًا حَتَّى تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ وَحْدَهُ

‘‘তোমাদের জন্য ইব্রাহীম ও তাঁর অনুসারীদের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ, তারা তাদের সম্প্রদায়কে বলেছিল, তোমাদের সঙ্গে এবং তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যার এবাদাত কর তার সঙ্গে আমাদের কোন সম্পর্ক নাই। আমরা তোমাদেরকে মানি না। তোমাদের ও আমাদের মধ্যে শুরু হল শত্রুতা ও বিদ্বেষ চিরকালের জন্য, যতক্ষন না তোমরা এক আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন কর। (সূরা মুমতাহিনাঃ ৪) তিনি আরও বলেনঃ

وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يَتَّخِذُ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَنْدَادًا يُحِبُّونَهُمْ كَحُبِّ اللَّهِ وَالَّذِينَ آَمَنُوا أَشَدُّ حُبًّا لِلَّهِ

‘‘মানুষের মধ্যে এমন লোক রয়েছে, যে আল্লাহ ছাড়া অপরকে আল্লাহর সমকক্ষরূপে গ্রহণ করে এবং আল্লাহকে ভাল বাসার ন্যায় তাদেরকে ভালবাসে, কিন্তু যারা ঈমান এনেছে আল্লাহর প্রতি তাদের ভালবাসা দৃঢ়তর’’। (সূরা বাকারাঃ ১৬৫) আর যে ব্যক্তি ইখলাস ও ইয়াকীনের সাথে (لا إله إلا الله) লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ‘‘আল্লাহ ছাড়া সত্য কোন মাবুদ নেই’’ এ কথা বলবে এবং সকল পাপাচার, বিদআত, ছোট শির্ক ও বড় শির্ক হতে মুক্ত থাকবে, সে দুনিয়াতে পথভ্রষ্ঠতা হতে হেদায়াত পাবে। আর আখেরাতে শাস্তি হতে নিরাপত্তা পাবে। তার উপর জাহান্নাম হারাম হয়ে যাবে। এই শর্তগুলো পূর্ণ করা বান্দার উপর আবশ্যক। আর এই শর্তগুলো পূর্ণ করার অর্থ হল যে, এই শর্তগুলো একজন বান্দার জীবনে সমাবেশ ঘটা এবং তা জানা অত্যাবশ্যক হওয়া। তবে ইহা মুখস্থ করা জরুরী নয়। আর এই মহান কালেমা (لا إله إلا الله) হল তাওহীদুল উলুহীয়্যাহ, যা তাওহীদের প্রকারসমূহের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক প্রকার তাওহীদ, এ বিষয়েই নাবীগণ ও তাঁদের সম্প্রদায়ের মাঝে মতানৈক্য সংঘটিত হয়েছিল। আর এরই বাস্তবায়নের জন্যে রাসূলগণকে প্রেরণ করা হয়েছিল।

[20] - তিরমিজী। ইমাম আলবানী হাদীছটিকে দুর্বল বলেছেন। দেখুনঃ শাইখের তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫২৮৯।

[21] - তিরমিজী, অধ্যায়ঃ গুনাহ্ করার পর বান্দার জন্য আল্লাহর ক্ষমা। ইমাম আলবানী (রঃ) হাদীছটিকে সহীহ বলেছেন। দেখুনঃ সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ১২৭।

[22] - যে ব্যক্তি লা-ইলাহা পাঠ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে,- অনেক লোকই এই হাদীছটি বুঝতে ভুল করেছে। তারা মনে করে শুধু জবান দিয়ে এই বাক্যটি উচ্চারণ করাই জান্নাতে যাওয়ার জন্য এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। মূলতঃ বিষয়টি এরূপ নয়। যারা এরূপ মনে করে, তারা বিভ্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত। তারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’-এর সঠিক মর্মার্থ বুঝতে পারে নি। না বুঝার কারণ হল, তারা এ নিয়ে চিন্তা-গবেষণা করেনি। এই পবিত্র বাক্যটির সঠিক অর্থ হচ্ছে, আল্লাহ্ ব্যতীত সকল মাবুদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং সকল প্রকার এবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্যই খাস (নির্ধারণ) করা। এবাদতগুলো এমন পদ্ধতিতে করা, যাতে আল্লাহ্ সন্তুষ্ট হন। এটিই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-এর হক। যে ব্যক্তি এই হক আদায় করবেনা, কিংবা এর কিছু অংশ আদায় করবে, অতঃপর আল্লাহর সাথে অন্যান্য অলী-আওলীয়া ও সৎ লোকদের কাছে দুআ করবে এবং তাদের জন্য নযর পেশ করবে, সে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’এর শর্ত ভঙ্গকারী হিসাবে গণ্য হবে। সে এটি পাঠ করার দাবী করলেও তাতে কোন লাভ হবে না।
তাওহীদের ফযীলত এবং তাওহীদ যে সমস্ত গুনাহ্ মিটিয়ে দেয় - ৩

এ অধ্যায় থেকে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) আল্লাহ্ তাআলার অসীম করুণা।

২) আল্লাহর নিকট তাওহীদের অপরিসীম ছাওয়াব।

৩) অপরিসীম ছাওয়াব দেয়ার সাথে সাথে তাওহীদ দ্বারা পাপসমূহও মোচন হয়ে যায়।

৪) সূরা আনআমের ৮২ নং আয়াতের তাফসীর জানা গেল। অর্থাৎ সেখানে যে যুলুমের বর্ণনা এসেছে, তা দ্বারা সাধারণ যুলুম উদ্দেশ্য নয়; বরং এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে শির্ক।

৫) উবাদা বিন সামেতের হাদীছে বর্ণিত পাঁচটি বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেয়া জরুরী।

৬) উবাদা বিন সামেত এবং ইতবানের হাদীছকে একত্র করলে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র অর্থ সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে এবং ধোঁকায় নিপতিত লোকদের ভুল সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়বে।[22]

৭) ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীছে উল্লেখিত শর্তের ব্যাপারে সতর্কীকরণ। অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কালেমাটি পাঠ করবে। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এটি পাঠ করবে, সে অবশ্যই আমল করবে এবং তা কেবল আল্লাহর জন্যই করবে।

৮) ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র ফযীলতের ব্যাপারে নবীগণকেও সতর্ক করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

৯) সমগ্র সৃষ্টির তুলনায় এ কালেমার পাল্লা ভারী হওয়ার ব্যাপারে অবগতকরণ। যদিও ইখলাসের সাথে পাঠ না করার কারণে এ কালেমার অনেক পাঠকের পাল্লা হালকা হয়ে যাবে।

১০) সপ্তাকাশের মত সপ্ত যমীন বিদ্যমান থাকার প্রমাণ পাওয়া গেল।

১১) যমীনের মত আকাশেও বসবাসকারী রয়েছে।

১২) আল্লাহর সিফাতসমূহকে সাব্যস্ত করা জরুরী। আশআরী সম্প্রদায়ের লোকেরা এগুলোকে অস্বীকার বা এগুলোর অপব্যাখ্যা করে থাকে।

১৩) আপনি যখন সাহাবী আনাস রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত হাদীসটি বুঝতে সক্ষম হবেন তখন জানতে পারবেন যে, ইতবান রাযিয়াল্লাহু আনহুর হাদীছে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বাণীঃ

فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ

‘‘আল্লাহ তাআলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলেছে’। এর মর্মার্থ হচ্ছে শির্ক বর্জন করা। শুধু মুখে বলা এর উদ্দেশ্য নয়।

১৪) আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উভয়ই আল্লাহর বান্দা এবং রাসূল হওয়ার বিষয়টি গভীরভাবে চিন্তা করা।

১৫) কালিমাতুল্লাহ বলে ঈসা (আঃ) কে খাস করার বিষয়টি জানা গেল। এ দ্বারা বিশেষ মর্যাদার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।

১৬) ঈসা (আঃ) আল্লাহর পক্ষ থেকে রূহ হওয়া সম্পর্কে অবগত হওয়া গেল।

১৭) জান্নাত ও জাহান্নামের প্রতি ঈমান আনার মর্যাদা।

১৮) তাওহীদপন্থী লোকেরা জান্নাতে প্রবেশ করবে। আমল যাই হোক না কেন।

১৯) এ কথা জানা গেল যে, কিয়ামতের দিন দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করা হবে। দাঁড়িপাল্লার দুটি পাল্লাও থাকবে।

২০) আরও জানা গেল যে, আল্লাহর অনেক সিফাত রয়েছে। তার মধ্যে আল্লাহর চেহারা তার অন্যতম একটি সিফাত।

যে ব্যক্তি তাওহীদের দাবী পূরণ করবে, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে - ১

ব্যাখ্যাঃ অর্থাৎ বিনা হিসাবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আল্লাহ তাআলা তাদেরকে কোন শাস্তি দিবেন না। হাদীছে এ রকমই বর্ণিত হয়েছে। হাদীছটি সামনে আসছে। তাওহীদের দাবী পূরণ করার অর্থ হচ্ছে শির্ক-বিদআতের কদর্যতা হতে তাওহীদকে মুক্ত রাখা এবং গুনাহ্র উপর স্থির না থাকা। যার অবস্থা এমন হবে অর্থাৎ শির্ক বর্জন করবে এবং সকল পাপ কাজ থেকে বিরত থাকবে, সেই কেবল তাওহীদের দাবী পূরণ করতে সক্ষম হবে। উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে এ ধরণের লোক খুব কমই পাওয়া যাবে, যারা খাঁটি ঈমানদার, তাদের মধ্যেই তাওহীদের দাবীসমূহ পূরণকারী লোক পাওয়া যাবে। আল্লাহ্ তাআলা সকল সৃষ্টির মধ্য হতে তাদেরকে চয়ন করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইউসুফের ২৪ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ هَمَّتْ بِهِ وَهَمَّ بِهَا لَوْلا أَنْ رَأَى بُرْهَانَ رَبِّهِ كَذَلِكَ لِنَصْرِفَ عَنْهُ السُّوءَ وَالْفَحْشَاءَ إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُخْلَصِينَ

‘‘নিশ্চয়ই মহিলা তার বিষয়ে চিন্তা করেছিল এবং সেও মহিলার বিষয়ে চিন্তা করেছিল। যদি না সে স্বীয় পালনকর্তার প্রমাণ অবলোকন করতো। এমনিভাবে আমি তার কাছ থেকে মন্দ ও নির্লজ্জ বিষয় সরিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি আমার মনোনীত বান্দাদের একজন’’। ইসলামের প্রথম যুগে খাঁটি ঈমানদারদের সংখ্যা ছিল প্রচুর। শেষ যামানায় এদের সংখ্যা কম হয়ে গেছে। তারপরও এরা আল্লাহ্ তাআলার নিকট বিরাট সম্মানের অধিকারী। আল্লাহ্ তাআলা ইবরাহীম খলীল (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘অতঃপর সূর্যকে চক্চক্ করতে দেখে বললঃ এটি আমার প্রতিপালক, এটি বৃহত্তর। অতঃপর যখন তা ডুবে গেল, তখন বললঃ হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা যেসব বিষয়কে শরীক কর, আমি ওসব থেকে মুক্ত। আমি একনিষ্ঠ হয়ে স্বীয় চেহারা ঐ সত্তার দিকে ফিরাচ্ছি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন এবং আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। (সূরা আনআমঃ ৭৮-৭৯) অর্থাৎ আমার দ্বীন ও এবাদতকে ঐ সত্তার জন্য একনিষ্ঠ ও নিবেদিত করছি, যিনি আসমান-যমীন সৃষ্টি করেছেন এবং পূর্বের কোন নমুনা ছাড়াই তা তৈরী করেছেন।

হানীফ অর্থ হচ্ছে আল্লাহ্ অভিমূখী। হানীফ অবস্থায় তথা শির্ক ছেড়ে দিয়ে পূর্ণরূপে তাওহীদের দিকে ঝুকে পড়েছি। এ জন্যই তিনি বলেছেন وَمَا أَنَاْ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘আমি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত নই’’। কুরআন মজীদে এই ধরণের অসংখ্য আয়াত রয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নিসার ১২৫ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَنْ أَحْسَنُ دِيناً مِّمَّنْ أَسْلَمَ وَجْهَهُ لله وَهُوَ مُحْسِنٌ واتَّبَعَ مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفاً وَاتَّخَذَ اللّهُ إِبْرَاهِيمَ خَلِيلاً

‘‘যে আল্লাহ্‌র নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করে সৎকাজে নিয়োজিত থাকে এবং ইবরাহীমের দ্বীনের অনুসরণ করে, যিনি একনিষ্ঠ হানীফ ছিলেন, তার চেয়ে উত্তম দ্বীন কার? আল্লাহ্ ইবরাহীমকে বন্ধু রূপে গ্রহণ করেছেন’’। আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَن يُسْلِمْ وَجْهَهُ إِلَى اللَّهِ وَهُوَ مُحْسِنٌ فَقَدِ اسْتَمْسَكَ بِالْعُرْوَةِ الْوُثْقَى

‘‘যে ব্যক্তি সৎকর্মপরায়ণ হয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলকে আল্লাহ্ অভিমুখী করে, সে এক মজবুত হাতল ধারণ করে। সকল কর্মের পরিণাম আল্লাহ্‌র দিকে’’। (সূরা লুকমানঃ ২২)

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেনঃ এখানে আল্লাহ্ তাআলা ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে সংবাদ দিয়েছেন, যে আল্লাহ্ তাআলার জন্য আমলকে খালেস করতঃ তাঁর আদেশাবলীর সামনে মস্তক অবনত করে এবং তাঁর শরীয়তের আনুগত্য করে। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা বলেছেনঃ وهو محسن অর্থাৎ আমল, আনুগত্য, আদেশাবলীর বাস্তবায়ন এবং নিষেধাবলী থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে সে মুখলিস তথা একনিষ্ঠ। সুতরাং এই আয়াতে সুস্পষ্ট দলীল রয়েছে যে, শির্ক বর্জন, শির্ক ও শির্ককারীদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করার মাধ্যমেই কেবল বান্দার তাওহীদ পূর্ণতা লাভ করে। পূর্বের অধ্যায়ে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেছেনঃ

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর হুকুম পালনকারী একটি উম্মত এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। (সূরা নাহলঃ ১২০)

.....................................................

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আল্লাহ্ তাআলা এখানে তাঁর একনিষ্ঠ বান্দাদের ইমাম ও রাসূল ইবরাহীম খলীল (আঃ)এর প্রশংসা করছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলছেন, তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না, ইহুদ-নাসারা এবং অগ্নিপূজকদেরও অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না। এখানে উম্মত[1] বলতে এমন নেতা উদ্দেশ্য যার অনুসরণ করা হয়। আয়াতে বর্ণিত قانت অর্থ হচ্ছে বিনয়ী এবং অনুগত। হানীফ অর্থ শির্ক বর্জন করে তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তনকারী। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ ‘‘তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। প্রখ্যাত মুফাস্সির মুজাহিদ (রঃ) বলেনঃ ইবরাহীম একটি উম্মত ছিলেন- এ কথার অর্থ হচ্ছে, সে সময় তিনি একাই ছিলেন মুমিন এবং অন্যান্য সকল মানুষই ছিল কাফের-মুশরিক।

ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ আমি মনে করি উভয় কথাই সঠিক। ইবরাহীম খলীল (আঃ) সে রকমই ছিলেন। তিনি ছিলেন একাই একটি উম্মত এবং অনুসরণীয় নেতা। মুজাহিদের কথার তাৎপর্য হল, দাওয়াত, নবুওয়াত ও রিসালাতের শুরুর দিকে ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন একমাত্র মুমিন। মুশরিকদের থেকে আলাদা হওয়ার কারণে সে সময় আল্লাহ্ তাআলা তাঁর প্রশংসা করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা মারইয়ামের ৪১-৪২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَاذْكُرْ فِي الْكِتَابِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّهُ كَانَ صِدِّيقاً نَّبِيّاً إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ يَا أَبَتِ لِمَ تَعْبُدُ مَا لَا يَسْمَعُ وَلَا يُبْصِرُ وَلَا يُغْنِي عَنكَ شَيْئاً

‘‘তুমি এই কিতাবে ইবরাহীমের কথা বর্ণনা করো। নিশ্চয়ই তিনি ছিলেন সত্যবাদী নবী। যখন তিনি তার পিতাকে বললেনঃ হে আমার পিতা! যে শুনেনা, দেখেনা এবং তোমার কোন উপকারে আসেনা, তার এবাদত কেন কর? আল্লাহ্ তাআলা আরও বলেনঃ

وَإِنَّ مِن شِيعَتِهِ لَإِبْرَاهِيمَ إِذْ جَاءَ رَبَّهُ بِقَلْبٍ سَلِيمٍ

‘‘আর নূহ-এর দলেরই একজন ছিলেন ইবরাহীম। যখন সে তার পালনকর্তার নিকট বিশুদ্ধ অন্তর নিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন’’। (সূরা আস্ সাফফাতঃ ৮৩-৮৪) এই আয়াতসমূহে ইবরাহীম (আঃ)এর দাওয়াতের প্রাথমিক অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। সে সময় তিনি ব্যতীত পৃথিবীতে অন্য কোন মুমিন ছিলনা। সহীহ হাদীছ দ্বারা এ বিষয়টি প্রমাণিত।

وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন নাঃ অর্থাৎ তিনি অন্তর, জবান এবং সকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মাধ্যমে মুশরিকদের থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তারা আল্লাহর এবাদতে যে সমস্ত বস্ত্তকে শরীক করত, সেগুলোর সরাসরি প্রতিবাদ করেছেন, মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং আল্লাহর রাস্তায় যেসব নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছেন, তাতে সবর করেছেন। আর এভাবেই তিনি দ্বীনের মূল বুনিয়াদ ও তাওহীদের দাবী পরিপূর্ণরূপে বাস্তবায়ন করেছেন। সূরা বাকারার ১৩১ নং আয়াতে আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ قَالَ أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ

‘‘স্মরণ করো, যখন তাকে তার প্রতিপালক বললেনঃ অনুগত হও। সে বললঃ আমি বিশ্বপালকের অনুগত হলাম’’। যারা ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্’ বলে এবং মুসলিম হওয়ার দাবী করে, তাদের অধিকাংশই আল্লাহর এবাদতে অন্যদেরকে শরীক করে এবং মৃত ও অনুপস্থিত অলী-আওলীয়া, তাগুত, জিন এবং অন্যান্য এমন বস্ত্তকে আহবান করে, যা মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ করার মালিক নয়। শুধু তাই নয়, তারা এগুলোকে ভালোবাসে, বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করে, তাদেরকে ভয় করে, তাদের কাছে কল্যাণ কামনা করে এবং যারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করে ও আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত বর্জন করার আহবান জানায় তাদের বিরোধীতা করে। তারা তাওহীদপন্থীদের দাওয়াতকে বিদআত ও গোমরাহী মনে করে, যারা তাওহীদের উপর আমল করে, তাওহীদকে ভালবাসে, শির্কের প্রতিবাদ করে এবং শির্ককে ঘৃণা করে তারা তাদের সাথে শত্রুতা পোষণ করে। বিদআতীদের কোন কোন লোক তাওহীদের ইল্মকে ইলম বলেই স্বীকৃতি দেয়না এবং মূর্খরা তাওহীদের প্রতি মনেপ্রাণে ভালবাসা পোষণ না করার কারণে এদিকে ফিরেও তাকায় না। এ সব বিষয়ের অবসানের জন্য আমরা আল্লাহর আশ্রয় চাই।

আল্লাহ তাআলা আরো বলেনঃ

إِنَّ الَّذِينَ هُمْ مِنْ خَشْيَةِ رَبِّهِمْ مُشْفِقُونَ وَالَّذِينَ هُمْ بِآيَاتِ رَبِّهِمْ يُؤْمِنُونَ وَالَّذِينَ هُمْ بِرَبِّهِمْ لا يُشْرِكُونَ

‘‘নিশ্চয়ই যারা তাদের পালনকর্তার ভয়ে সন্ত্রস্ত, যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে, আর যারা তাদের রবের সাথে শিরক করেনা’’। (সূরা মুমিনুনঃ ৫৭-৫৯)

....................................................................

ব্যাখ্যাঃ ইমাম ইবনে কাছীর (রঃ) বলেনঃ নেক ও সৎ আমল করার পরও তারা আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে এবং আল্লাহর শাস্তির ভয়ে ভীত থাকে। হাসান বসরী[2] (রঃ) বলেনঃ মুমিন হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে নেক আমল করার সাথে সাথে আল্লাহ্কে ভয় করে। আর মুনাফিক হচ্ছে ঐ ব্যক্তি, যে পাপ কাজ করে এবং নির্ভয়ে থাকে। যারা তাদের পালনকর্তার আয়াতসমূহে বিশ্বাস স্থাপন করেঃ এ দ্বারা সৃষ্টি ও শরীয়তের নিদর্শন উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ্ তাআলা মারইয়াম (আঃ) সম্পর্কে সূরা তাহরীমের ১২ নং আয়াতে বলেনঃ

وَصَدَّقَتْ بِكَلِمَاتِ رَبِّهَا وَكُتُبِهِ وَكَانَتْ مِنَ الْقَانِتِينَ

‘‘তিনি তার পালনকর্তার বাণী ও কিতাবকে সত্যে পরিণত করেছেন। তিনি ছিলেন বিনয়ীদের অন্তর্ভূক্ত’’। অর্থাৎ তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, তাঁর যে সন্তান হয়েছিল তা আল্লাহর সৃষ্টিগত নির্ধারণ ও ফয়সালা অনুপাতেই হয়েছিল। আল্লাহর শরীয়তে যে সমস্ত আদেশ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হওয়া তিনি পছন্দ করেন। আর যে সমস্ত নিষেধ রয়েছে, তা বাস্তবায়ন হওয়াকে তিনি ঘৃণা ও অপছন্দ করেন। আর দয়াময় আল্লাহর শরীয়তে যে সমস্ত খবর রয়েছে তা সত্য।

আর যারা তাদের রবের সাথে শির্ক করেনাঃ অর্থাৎ তারা আল্লাহর এবাদতে অন্যকে শরীক করেনা; বরং তারা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করে এবং বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ্ ব্যতীত কোন সত্য মাবুদ নেই, তিনি একক এবং অমূখাপেক্ষী। তিনি কোনো স্ত্রী ও সন্তান গ্রহণ করেন নি। তার সমকক্ষ কেউ নেই।

ব্যাখ্যাকারী বলেনঃ আমি বলছি, শির্ক বর্জন করা ব্যতীত তাওহীদের পরিপূর্ণ জ্ঞান অর্জন করা, এর যথাযথ পরিচয় লাভ করা, তাওহীদের প্রতি ভালবাসা, তাওহীদকে কবুল করে নেওয়া এবং তাওহীদের দিকে দাওয়াত দেয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

قُلْ إِنَّمَا أُمِرْتُ أَنْ أَعْبُدَ اللّهَ وَلا أُشْرِكَ بِهِ إِلَيْهِ أَدْعُو وَإِلَيْهِ مَآبِ

‘‘বলোঃ আমাকে এরূপ আদেশই দেয়া হয়েছে যে, আমি যেন আল্লাহ্‌র এবাদত করি এবং তার সাথে যেন কাউকে অংশীদার না করি’’। আমি তার দিকেই দাওয়াত দেই এবং তার কাছেই আমার প্রত্যাবর্তন’’। (সূরা রা’দঃ ৩৬) এই আয়াতে পূর্ণাঙ্গ তাওহীদের বিবরণ দেয়া হয়েছে। আমরা আল্লাহর কাছে এই পরিপূর্ণ তাওহীদ বাস্তবায়নের তাওফীক চাচ্ছি।

হুসাইন বিন আবদুর রহমান থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেনঃ

كُنْتُ عِنْدَ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ فَقَالَ أَيُّكُمْ رَأَى الْكَوْكَبَ الَّذِى انْقَضَّ الْبَارِحَةَ قُلْتُ أَنَا ثُمَّ قُلْتُ أَمَا إِنِّى لَمْ أَكُنْ فِى صَلاَةٍ وَلَكِنِّى لُدِغْتُ.قَالَ فَمَاذَا صَنَعْتَ قُلْتُ اسْتَرْقَيْتُ قَالَ فَمَا حَمَلَكَ عَلَى ذَلِكَ قُلْتُ حَدِيثٌ حَدَّثَنَاهُ الشَّعْبِىُّ فَقَالَ وَمَا حَدَّثَكُمُ الشَّعْبِىُّ قُلْتُ حَدَّثَنَا عَنْ بُرَيْدَةَ بْنِ حُصَيْبٍ الأَسْلَمِىِّ أَنَّهُ قَالَ لاَ رُقْيَةَ إِلاَّ مِنْ عَيْنٍ أَوْ حُمَةٍ فَقَالَ قَدْ أَحْسَنَ مَنِ انْتَهَى إِلَى مَا سَمِعَ وَلَكِنْ حَدَّثَنَا ابْنُ عَبَّاسٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ «عُرِضَتْ عَلَىَّ الأُمَمُ فَرَأَيْتُ النَّبِىَّ وَمَعَهُ الرُّهَيْطُ وَالنَّبِىَّ وَمَعَهُ الرَّجُلُ وَالرَّجُلاَنِ وَالنَّبِىَّ لَيْسَ مَعَهُ أَحَدٌ إِذْ رُفِعَ لِى سَوَادٌ عَظِيمٌ فَظَنَنْتُ أَنَّهُمْ أُمَّتِى فَقِيلَ لِى هَذَا مُوسَى صلى الله عليه وسلم وَقَوْمُهُ وَلَكِنِ انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ فَنَظَرْتُ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِى انْظُرْ إِلَى الأُفُقِ الآخَرِ فَإِذَا سَوَادٌ عَظِيمٌ فَقِيلَ لِى هَذِهِ أُمَّتُكَ وَمَعَهُمْ سَبْعُونَ أَلْفًا يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلاَ عَذَابٍ» ثُمَّ نَهَضَ فَدَخَلَ مَنْزِلَهُ فَخَاضَ النَّاسُ فِى أُولَئِكَ الَّذِينَ يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ بِغَيْرِ حِسَابٍ وَلاَ عَذَابٍ فَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ صَحِبُوا رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم وَقَالَ بَعْضُهُمْ فَلَعَلَّهُمُ الَّذِينَ وُلِدُوا فِى الإِسْلاَمِ وَلَمْ يُشْرِكُوا بِاللَّهِ. وَذَكَرُوا أَشْيَاءَ فَخَرَجَ عَلَيْهِمْ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ «مَا الَّذِى تَخُوضُونَ فِيهِ ». فَأَخْبَرُوهُ فَقَالَ « هُمُ الَّذِينَ لاَ يَرْقُونَ وَلاَ يَسْتَرْقُونَ وَلاَ يَتَطَيَّرُونَ وَعَلَى رَبِّهِمْ يَتَوَكَّلُونَ» فَقَامَ عُكَّاشَةُ بْنُ مِحْصَنٍ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ «أَنْتَ مِنْهُمْ» ثُمَّ قَامَ رَجُلٌ آخَرُ فَقَالَ ادْعُ اللَّهَ أَنْ يَجْعَلَنِى مِنْهُمْ. فَقَالَ «سَبَقَكَ بِهَا عُكَّاشَةُ»

‘‘একবার আমি সাঈদ বিন জুবাইরের কাছে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বললেন, গতকাল রাত্রে যে নক্ষত্রটি ছিটকে পড়েছিল তা তোমাদের মধ্য হতে কে দেখতে পেয়েছ? তখন বললাম, আমি। তবে আমি নামাযরত ছিলামনা। তারপর আমি বললাম, আমি বিষাক্ত প্রাণী কর্তৃক দংশিত হয়েছিলাম। তিনি বললেনঃ তুমি কি চিকিৎসা করেছো? আমি বললাম ঝাড় ফুঁক করেছি। তিনি বললেন, কিসে তোমাকে এ কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছে? আমি বললাম, একটি হাদিছ আমাকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করেছে যা শা’বী আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন। তিনি বললেন, তিনি তোমাদেরকে কী বর্ণনা করেছেন? আমি বললাম তিনি বুরাইদা বিন হুসাইব থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, বদ নযর এবং বিষাক্ত পোঁকার কামড় ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়-ফুঁক নেই। তিনি বললেন, ‘সে ব্যক্তিই উত্তম কাজ করেছে, যে শ্রুত কথা অনুযায়ী আমল করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে’। কিন্তু ইবনে আববাস রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে আমাদের কাছে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, আমার সম্মুখে সমস্ত জাতিকে উপস্থাপন করা হল। তখন এমন নবীকে দেখতে পেলাম, যার সাথে অল্প সংখ্যক লোক রয়েছে। এমন নবীকেও দেখতে পেলাম, যার সাথে মাত্র একজন বা দুইজন লোক রয়েছে। আবার এমন নবীকেও দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেই। এমন সময় আমার সামনে বিরাট একটি জামাআত পেশ করা হল। আমি তখন ভাবলামঃ এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হল, এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর উম্মত।

এরপর আরো একটি বিরাট জামাআতের দিকে আমি তাকালাম। তখন আমাকে বলা হল, এরা আপনার উম্মত। এদের মধ্যে সত্তর হাজার লোক রয়েছে, যারা বিনা হিসেবে এবং বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এ কথা বলে তিনি উঠে বাড়ীর অভ্যন্তরে চলে গেলেন। এরপর লোকেরা ঐ সব ভাগ্যবান লোকদের ব্যাপারে বিতর্ক শুরু করল। কেউ বললঃ তারা বোধ হয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাহচার্য লাভকারী ব্যক্তিগণ। আবার কেউ বললঃ তারা বোধ হয় সেই সব লোক, যারা মুসলিম মাতা-পিতার ঘরে জন্মগ্রহণ করেছে আর আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করেনি। তারা এ ধরনের আরো অনেক কথা বলাবলি করল। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের মধ্যে উপস্থিত হলে বিষয়টি তাঁকে জানানো হল। তিনি তখন বললেনঃ

«هم الذين لا يسترقون ولا يتطيرون ولا يكتون وعلى ربهم يتوكلون»

‘‘তারা হচ্ছে ঐসব লোক যারা ঝাড়-ফুক করেনা। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা। শরীরে ছেঁকা বা দাগ দেয় না। আর তাদের রবের উপর তারা ভরসা করে’’। এ কথা শুনে উক্কাশা বিন মিহসান দাড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্য দুআ করুন যেন আল্লাহ তাআলা আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেন। তিনি বললেনঃ তুমি তাদের দলভুক্ত। অতঃপর অন্য একজন লোক দাঁড়িয়ে বললঃ আল্লাহর কাছে আমার জন্যও দুআ করুন তিনি যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। তিনি বললেনঃ তোমার পূর্বেই উক্কাশা সে সুযোগ নিয়ে গেছে’’।[3]

..............................................................

ব্যাখ্যাঃ তবে আমি নামাযরত ছিলামনাঃ এখানে সালাফদের সতর্কতার প্রমাণ পাওয়া যায়। শ্রোতাগণ যেন এটি না বুঝেন যে, তিনি রাতে নামাযের জন্য ঘুম থেকে উঠেছিলেন, তাই তিনি এ কথাটি বলেছিলেন। বিষয়টি খোলাসা না করলে এমন সম্ভাবনা রয়ে যেত যে, তিনি নিজের জন্য এমন কাজ করার দাবী করছেন, যা তিনি করেন নি। এতে সাহাবী ও তাবেঈদের প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার শির্ক থেকে দূরে থাকার প্রমাণ রয়েছে। তাদের কেউ এমন আমল দ্বারা প্রশংসিত হতে পছন্দ করতেন না, যা তিনি করেন নি।

বদ নযর এবং বিষাক্ত পোঁকার কামড় ব্যতীত অন্য কোন রোগে ঝাড়-ফুঁক নেইঃ এটি ছিল ইসলামের প্রথম দিকে। পরবর্তীতে অন্যান্য বিষয়েও ঝাড়-ফুঁক করার অনুমতি দেয়া হয়, যদি তা কুরআনের আয়াত, সহীহ হাদীছ এবং শির্কমুক্ত দুআ দ্বারা করা হয়।

যে ব্যক্তি শ্রুত বিষয় অনুযায়ী আমল করাকেই যথেষ্ট মনে করেছে সে উত্তম কাজই করেছেঃ এই বাক্যে ইল্ম ও আহলে ইল্মদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হয়েছে। যে কেউ কোন আমল করবে, তার কাছে সেই আমলের দলীল চাওয়া হবে। আরও জিজ্ঞাসা করা হবে যে, তিনি এ ব্যাপারে দলীলের আশ্রয় নিয়েছেন কি না? যার সাথে কোন শরঈ দলীল পাওয়া যাবেনা, তার সেই আমলে কোন অযুহাত গ্রহণযোগ্য হবেনা। এ জন্যই ইবনু আব্দিল বার্ (রঃ) বলেছেনঃ আলেমগণ একমত হয়েছেন যে, মুকাল্লিদ[4] আলেম নয়। ইবনু আব্দিল বার্ (রঃ)এর কথাটি ভালভাবে অনুধাবন করা উচিৎ।

আমার সামনে অনেক উম্মত পেশ করা হলঃ এর ব্যাখ্যায় শাইখ আব্দুর রাহমান বিন হাসান রাহিমাহুল্লাহ বলেনঃ আল্লাহই ভাল জানেন, কখন পেশ করা হয়েছিল? তবে আমাদের জানা মতে পেশ করার অর্থ হল, কিয়ামতের দিন যখন সমস্ত নবী ও তাদের অনুসারীগণ উপস্থিত হবে, তখন যে সমস্ত উম্মত হাজির হবে, আল্লাহ্ তাআলা তাঁর নবীকে সেই পরিমাণ উম্মত দেখিয়েছেন। সুতরাং যে ব্যক্তি নাজাত পাবে, সে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং নবীদের সাথে প্রেরিত দ্বীন ও শরীয়তের অনুসরণের কারণে তথা এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা, তিনি ছাড়া অন্যের এবাদত বর্জন করার কারণে, আল্লাহর হুকুম মান্য করার কারণে এবং তাঁর নিষেধ থেকে বিরত থাকার কারণেই নাজাত পাবে। আল্লাহ্ তাআলা সূরা নূহের ২ ও ৩ নং আয়াতে বলেনঃ

قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُّبِينٌ أَنِ اعْبُدُوا اللَّهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ

‘‘তিনি বললেনঃ হে আমার সম্প্রদায়! আমি তোমাদের জন্যে স্পষ্ট সতর্ককারী। এ বিষয়ে যে, তোমরা আল্লাহ্‌র এবাদত কর, তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য করো’’। এককভাবে আল্লাহর এবাদত করার মাধ্যমেই আল্লাহর তাওহীদ বাস্তবায়ন হয়ে থাকে, তাঁর আদেশ বাস্তবায়ন এবং তাঁর নিষেধ হতে দূরে থাকার মাধ্যমেই তাকওয়া অর্জিত হয়। সেই সঙ্গে তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা জরুরী। এটিই হচ্ছে দ্বীন। দ্বীনের মূল কথা হচ্ছে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্যের এবাদত করা যাবেনা, তাঁর শরীয়ত অনুযায়ীই তাঁর এবাদত করা হবে, চাই আদেশসমূহ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে হোক কিংবা নিষেধ থেকে দূরে থাকার ক্ষেত্রে হোক এবং নিজের ইচ্ছা ও পছন্দের উপর রাসূলের আনুগত্যকে প্রাধান্য দিবে।

আবার এমন নবীকেও দেখতে পেলাম যার সাথে কোন লোকই নেইঃ অর্থাৎ যে জাতির কাছে তাঁকে প্রেরণ করা হয়েছিল, তাদের মধ্য হতে একজনও ঈমান আনয়ন করেনি। আল্লাহ্ তাআলা সূরা হিজরের ১০ ও ১১ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ أَرْسَلْنَا مِن قَبْلِكَ فِي شِيَعِ الأَوَّلِينَ وَمَا يَأْتِيهِم مِّن رَّسُولٍ إِلاَّ كَانُواْ بِهِ يَسْتَهْزِئُونَ

‘‘আমি তোমার আগে পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের মধ্যে রাসূল প্রেরণ করেছি। তবে ওদের কাছে এমন কোন রাসূল আসেনি, যাদের সাথে ওরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করেনি’’। উপরোক্ত হাদীছ থেকে দলীল পাওয়া যাচ্ছে যে, প্রত্যেক যামানাতেই নাজাত প্রাপ্ত লোকের সংখ্যা কম হয়ে থাকে। অধিকাংশের মধ্যেই মানবীয় স্বভাব প্রবল হওয়ার কারণে রাসূলদের বিরোধীতা করে ধ্বংস হয়েছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

وَإِن تُطِعْ أَكْثَرَ مَن فِي الأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَن سَبِيلِ اللّهِ

‘‘আর তুমি যদি পৃথিবীর অধিকাংশ লোকের কথা মেনে নাও, তবে তারা তোমাকে আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিপথগামী করে দেবে’’। (সূরা আনআমঃ ১১৬) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

وَمَا وَجَدْنَا لأَكْثَرِهِم مِّنْ عَهْدٍ وَإِن وَجَدْنَا أَكْثَرَهُمْ لَفَاسِقِينَ

‘‘আর তাদের অধিকাংশ লোককেই আমি প্রতিজ্ঞা বাস্তবায়নকারীরূপে পাইনি; বরং তাদের অধিকাংশকেই পেয়েছি ফাসেক’’। (সূরা আরাফঃ ১০২) আল্লাহ্ তাআলা আরো বলেনঃ

قُلْ سِيرُوا فِي الْأَرْضِ فَانظُرُوا كَيْفَ كَانَ عَاقِبَةُ الَّذِينَ مِن قَبْلُ كَانَ أَكْثَرُهُم مُّشْرِكِينَ

‘‘বলোঃ তোমরা পৃথিবীতে পরিভ্রমণ করো এবং দেখ তোমাদের পূর্ববর্তীদের পরিণাম কী হয়েছে’’। (সূরা রোমঃ ৪২) কুরআনে এ ধরণের আরো অনেক আয়াত রয়েছে।[5] জাহান্নাম থেকে নাজাতপ্রাপ্ত দলের লোকের সংখ্যা খুব অল্প হলেও তাদের জামআতটি বড় হবে। তারা হবে মর্যাদার দিক দিয়ে আল্লাহর নিকট অত্যন্ত বড়। যদিও তারা সংখ্যায় খুব কম। সুতরাং সংখ্যাধিক্য দেখে যেন কেউ বিভ্রান্ত না হয়। অধিক সংখ্যক লোকের অনুসরণ করতে গিয়ে জ্ঞান চর্চার দাবীদার কতিপয় লোকও বিভ্রান্ত হয়েছে। তারা দ্বীনি বিষয়ে এমন এমন বিশ্বাস পোষণ করতে লাগল, যেরূপ বিশ্বাস করে থাকে মূর্খ ও গোমরাহ লোকেরা। এ বিষয়ে তারা কুরআন ও সুন্নাতের দিকে দৃষ্টিপাত করেনি।

[1] - কুরআন ও হাদীছে উম্মত শব্দটি একাধিক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। (১) একদল মানুষ। এ কথার দলীল হচ্ছে আল্লাহ তাআলার বাণীঃ

وَلَمَّا وَرَدَ مَاءَ مَدْيَنَ وَجَدَ عَلَيْهِ أُمَّةً مِنَ النَّاسِ يَسْقُونَ وَوَجَدَ مِنْ دُونِهِمُ امْرَأتَيْنِ تَذُودَانِ قَالَ مَا خَطْبُكُمَا قَالَتَا لَا نَسْقِي حَتَّى يُصْدِرَ الرِّعَاءُ وَأَبُونَا شَيْخٌ كَبِيرٌ

‘‘যখন তিনি মাদইয়ানের কুপের ধারে পৌঁছলেন, তখন কুপের কাছে একটি উম্মতকে (একদল লোককে) পেলেন তারা তাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাচ্ছিল এবং তাদের পশ্চাতে দু’জন স্ত্রীলোককে দেখলেন তারা তাদের জন্তুগুলোকে আগলিয়ে রাখছিল। তিনি বললেন, তোমাদের কী ব্যাপার? তারা বলল, আমরা আমাদের জন্তুগুলোকে পানি পান করাতে পারিনা, যে পর্যন্ত রাখালরা তাদের জন্তুগুলোকে নিয়ে সরে না যায়। আমাদের পিতা খুবই বৃদ্ধ। (সূরা কাসাসঃ ২৩)

২) উম্মত শব্দটি নির্দিষ্ট একটি সময়ের অর্থে ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالَ الَّذِي نَجَا مِنْهُمَا وَادَّكَرَ بَعْدَ أُمَّةٍ أَنَا أُنَبِّئُكُمْ بِتَأْوِيلِهِ فَأَرْسِلُونِ

‘‘দু’জন কারাবন্দির মধ্য থেকে যে মুক্তি পেয়েছিল এবং দীর্ঘকাল পর স্মরণ হলে সে বলল, আমি তোমাদেরকে এর ব্যাখ্যা বলছি। তোমরা আমাকে প্রেরণ করো’’। (সূরা ইউসূফঃ ৪৫)

৩) কতিপয় মুফাসসিরের মতে উম্মত শব্দটি আবার কখনো দ্বীন অর্থেও ব্যবহৃত হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ

‘‘তোমাদের এই উম্মত (দ্বীন) আসলে একই উম্মত এবং আমি তোমাদের প্রতিপালক। অতএব তোমরা কেবল আমারই এবাদত করো’’।

৪) দ্বীনে হানীফের অনুসারী এবং বুদ্ধিতে পরিপক্ক মাত্র একজন লোককেও উম্মত বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ إِبْرَاهِيمَ كَانَ أُمَّةً قَانِتًا لِلَّهِ حَنِيفًا وَلَمْ يَكُ مِنَ الْمُشْرِكِينَ

‘‘নিশ্চয়ই ইবরাহীম ছিলেন একই একটি পরিপূর্ণ উম্মত, সবকিছু থেকে মুখ ফিরিয়ে এক আল্লাহ্‌রই অনুগত এবং তিনি মুশরিকদের অন্তর্ভূক্ত ছিলেন না’’। (সূরা নাহলঃ ১২০)

অর্থাৎ তিনি একাই ছিলেন একটি উম্মতের সমান। যখন দুনিয়ায় কোন মুসলমান ছিলনা তখন একদিকে তিনি একাই ছিলেন ইসলামের পতাকাবাহী এবং অন্যদিকে সারা দুনিয়ার মানুষ ছিল কুফুরীর পতাকাবাহী। আল্লাহর এই একক বান্দা তখন এমন কাজ করলেন, যা করার জন্য একটি উম্মতের প্রয়োজন ছিল। সেই হিসাবে তিনি একজন ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান।

[2] - তিনি হচ্ছেন আবু সাঈদ হাসান বিন হাসান ইয়াসার আলবসরী। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ তাবেঈ, এবাদত গুজার এবং আখেরাতমুখী। ১১০ হিজরী সালে তিনি ইন্তেকাল করেন। বিস্তারিত দেখুনঃ ( العبر 1/103، النهاية 9/278)

[3] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ এই উম্মতের একদল মুসলিমের বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ।

[4] - التقليد (তাকলীদ)শব্দ হতে মুকাল্লিদ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে। শরীয়তের মাসায়েলের ক্ষেত্রে দলীল না জেনেই চোখ বন্ধ করে অন্যের অনুসরণ করাকে তাকলীদ বলা হয়। সুতরাং বিনা দলীলে কারো কথা মেনে নেওয়া ইসলামে বৈধ নয়। আলেমদের উচিৎ দলীল সহকারে শরীয়তের হুকুম-আহকাম বর্ণনা করা। আর সাধারণ মুসলমানদের উচিৎ দলীল জেনেই কারো অনুসরণ করা। (আল্লাহই সর্বাধিক অবগত রয়েছেন)

[5] - যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ وَقَلِيلٌ مِنْ عِبَادِيَ الشَّكُورُ ‘‘আমার বান্দাদের মধ্যে অল্প সংখ্যকই কৃতজ্ঞ’’। (সূরা সাবাঃ ১৩) আল্লাহ তাআলা সূরা ইউসূফের ১০৩ নং আয়াতে আরো বলেনঃ وَمَا أَكْثَرُ النَّاسِ وَلَوْ حَرَصْتَ بِمُؤْمِنِينَ‘‘তুমি যতই চাও, অধিকাংশ লোক বিশ্বাসকারী নয়’’।
যে ব্যক্তি তাওহীদের দাবী পূরণ করবে, সে বিনা হিসেবে জান্নাতে যাবে - ২

এমন সময় আমার সামনে এক বিরাট জামাআত পেশ করা হল। তখন আমি ভাবলাম, এরা আমার উম্মত। কিন্তু আমাকে বলা হলো, এরা হচ্ছে মূসা (আঃ) এবং তাঁর জাতিঃ এখানে বনী ইসরাঈলের ঐ সমস্ত লোকের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যারা মূসা (আঃ) এর প্রতি, অন্যান্য নবী-রাসূলের প্রতি এবং তাওরাত, ইঞ্জিল, যবুর এবং ফুরকানসহ অন্যান্য আসমানি কিতাবের উপর ঈমান আনয়ন করেছিল। দলে দলে বিভক্ত হওয়ার পূর্বে বনী ইসরাঈলের লোক সংখ্যা অনেক ছিল। তাদের মধ্যে অনেক নবীও ছিলেন। অতঃপর ইহুদীরা নানা অপকর্মে লিপ্ত হল। এ হাদীছটি প্রমাণ করে যে, মুসা (আঃ)এর অনুসারীর সংখ্যা ছিল প্রচুর। আল্লাহ্ তাআলা সূরা যাছিয়ার ১৬ নং আয়াতে বলেনঃ

وَلَقَدْ آتَيْنَا بَنِي إِسْرَائِيلَ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ وَرَزَقْنَاهُمْ مِنَ الطَّيِّبَاتِ وَفَضَّلْنَاهُمْ عَلَى الْعَالَمِينَ

‘‘আমি বনী ইসরাঈলকে কিতাব, রাজত্ব ও নবুওয়াত দান করেছিলাম এবং তাদেরকে উৎকৃষ্ট রিযিক দিয়েছিলাম এবং বিশ্ববাসীর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছিলাম’’। অর্থাৎ তাদের যামানায় তাদেরকে অন্যান্য জাতির উপর প্রাধান্য দিয়েছিলাম। কেননা তাদের যামানায় এবং তাদের পূর্বে অসংখ্য লোক কুফুরী করেছিল। তাদের সঠিক সংখ্যা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ জানেনা। যেমন জালুত, বখতে নসর এবং তাদের ন্যায় অন্যান্যরা। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা বনী ইসরাঈলকে ঈমানের মাধ্যমে সম্মানিত করেছেন। এর মাধ্যমেই তারা সমসাময়িক লোকদের তুলনায় অধিক সম্মানিত হয়েছিল। অতঃপর তাদের অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে গিয়েছিল, যার বিবরণ আল্লাহ্ তাআলা সূরা বাকারা এবং অন্যান্য সূরাতে প্রদান করেছেন। অর্থাৎ তারা নবীদের নাফরমানী করেছিল এবং দ্বীন নিয়ে মতবিরোধ করেছিল। আল্লাহ্ তাআলা এই কথা আলোচনা করে ঐ সমস্ত ইহুদীদের প্রতিবাদ করেছেন, যারা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে কুফরী করেছিল। সম্মানিত পাঠকগণের উচিৎ ইহুদীদের ঐ সমস্ত অবস্থা নিয়ে চিন্তা করা, যা মতবিরোধে লিপ্ত হওয়ার পর তাদের উপর আপতিত হয়েছিল।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, অতঃপর আমি উপরের দিকে মাথা উঠিয়ে একটি বড় জামাআতকে দেখতে পেলাম। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সংখ্যাধিক্যের কারণে দলটি আকাশের দিগন্তকে ভরে দিয়েছিল। আমাকে বলা হল এটি আপনার উম্মত। তাদের মধ্যে রয়েছে সত্তর হাজার লোক। তারা বিনা আযাবে এবং বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশ করবেঃ এই হাদীছে উম্মতে মুহাম্মাদীর ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যে সমস্ত উম্মত নবীদের অনুসরণ করেছে, তার মধ্যে উম্মতে মুহাম্মাদীর সংখ্যাই হবে সর্বাধিক। সাহাবায়ে কেরাম, খোলাফায়ে রাশেদীন এবং তাদের পরবর্তী যুগেই মুসলমানদের সংখ্যা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। তাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে গ্রাম, শহর এবং ময়দান ভরপুর হয়ে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পেয়েছিল। জ্ঞান চর্চা ও বিভিন্ন উপকারী শিল্পকর্মে তারা উন্নতি সাধন করেছিল। উপরোক্ত তিনটি সম্মানিত যামানার লোকজন কিতাব ও সুন্নাতের উপর কায়েম ছিল। কিন্তু আখেরী যামানায় জ্ঞানী ও বিজ্ঞ মুসলমানদের সংখ্যা খুব কম হয়ে গিয়েছে। আমাদের সম্মানিত শাইখ এ ক্ষেত্রে বলেনঃ এই হাদীছ দ্বারা উম্মাতে মুহাম্মাদীর ফযীলত প্রমাণিত হয়। কাইফিয়াত ও কাম্মিয়াত (মান ও পরিমাণ) উভয় দিক থেকেই উম্মতে মুহাম্মাদী ফযীলতময়। তাদের সংখ্যা হবে অত্যাধিক এবং তাদের বৈশিষ্ট-গুণাবলীও হবে উত্তম। উপরের হাদীছে বর্ণিত হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছে সত্তর হাজার লোক। তারা বিনা হিসাবে ও বিনা আযাবে জান্নাতে প্রবেশ করবে।

অতঃপর তিনি উঠে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। তাঁর চলে যাওয়ার পর সাহাবীগণ ঐ সত্তর হাজার লোক সম্পর্কে আলোচনা শুরু করল।

এই হাদীছে ইল্মে দ্বীন চর্চায় সাহাবীদের সুউচ্চ মর্যাদা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছ বুঝতে ও তার প্রতি আমল করতে তাদের আগ্রহের প্রমাণ রয়েছে। এতে আরো প্রমাণ পাওয়া যায় যে, কোন বিষয়ে দলীল পাওয়া না গেলে ইজতেহাদ করা জায়েয আছে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ঘরে প্রবেশের পর তারা ইজতেহাদ করে অনেক কথাই বলেছিলেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের কোন প্রতিবাদ করেন নি। তবে কথা হচ্ছে, মুজতাহিদের নিকট যদি কোন দলীল না থাকে, তাহলে তার মতকে নিশ্চিতভাবে সঠিক বলা জায়েয নেই। তার এভাবে বলা উচিৎ যে, সম্ভবত হুকুমটি হবে এ রকম এ রকম। যেমন সাহাবীগণ এই হাদীছের ক্ষেত্রে বলেছিলেন।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের নিকট বের হয়ে এসে বললেনঃ তারা হচ্ছে ঐসব লোক যারা ঝাড়-ফুঁক করেনা, পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা এবং লোহা গরম করে শরীরে উহা দ্বারা দাগ দেয় না। বরং তারা তাদের রবের উপর ভরসা করেঃ অর্থাৎ তারা কারো নিকট গিয়ে ঝাড়-ফুঁক করার আবেদন জানায়না এবং তাদের শরীরে যদি এমন কোন রোগ থাকে, যা দাগ দেয়া ব্যতীত ভাল হওয়ার নয়, তারপরও তারা নিজেদের শরীরে দাগ লাগায় না। তারা পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করেনা। পাখি উড়িয়ে ভাগ্যের ভাল-মন্দ যাচাই করা শির্ক। তাই তারা এ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকে। সেই সঙ্গে তারা নিজেদের প্রয়োজন পূরণের জন্য অপরের নিকট আবেদন করেনা। ঝাড়-ফুঁক বা অন্য যে কোনো প্রয়োজনই হোক না কেন। আরোগ্যের জন্য হলেও তারা শরীরে দাগ লাগায় না। আল্লাহর উপর তাদের মজবুত ভরসা এবং তাদের সকল-কাজকর্ম আল্লাহর নিকট সোপর্দ করার কারণেই তারা এরূপ করেন। আল্লাহ্ তাআলা তাদের নসীবে যা কিছু রেখেছেন এবং তাদের জন্য যা কিছু নির্ধারণ করেছেন, সে বিষয়ে তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো দ্বারস্থ হয়না। সুতরাং তারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারও কাছে কিছুই কামনা করেন না, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেন না। তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেন, যে রোগ বা অন্য কোন মসীবত তাদের নিকট আপতিত হয়েছে, তা কেবল আল্লাহর নির্ধারণ ও ইচ্ছা অনুযায়ীই হয়েছে। সুতরাং ক্ষতি ও অকল্যাণ দূর করার জন্য তারা একমাত্র আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো নিকট গমণ করেনা। আল্লাহ্ তাআলা ইয়াকুব (আঃ) সম্পর্কে বলেনঃ

إِنَّمَا أَشْكُو بَثِّي وَحُزْنِي إِلَى اللَّهِ وَأَعْلَمُ مِنَ اللَّهِ مَا لا تَعْلَمُونَ

‘‘আমি তো আমার দুঃখ ও দুর্দশার অভিযোগ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কারো কাছে করছিনা এবং আমি আল্লাহ্‌র পক্ষ হতে এমন কিছু জানি, যা তোমরা জান না’’। (সূরা ইউসুফঃ ৮৬)

উক্কাশা বিন মিহসান[6] দাড়িয়ে বলল, আপনি আমার জন্য দুআ করুন। আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিদের দলভূক্ত করে নেনঃ এ থেকে বুঝা যাচ্ছে, জীবিত ব্যক্তি কর্তৃক কারো জন্য শাফাআত করার অর্থ হল, যার কাছে দুআ করার আবেদন করা হবে, তিনি শাফাআত প্রার্থনাকারীর জন্য দুআ করবেন। আর মৃত কোন কারও জন্য সুপারিশ করতে অক্ষম। জ্ঞানী ব্যক্তিদের নিকট এর কারণগুলো মোটেই অস্পষ্ট নয়। সুতরাং যে ব্যক্তি মৃত কিংবা অনুপস্থিত ব্যক্তির কাছে কিছু প্রার্থনা করল, সে তার কাছে এমন জিনিষ প্রার্থনা করল, যার মালিক সে নয়। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো নিকট এমন জিনিষ প্রার্থনা করল, যার মালিক একমাত্র আল্লাহ্, সে তাকে আল্লাহর শরীক নির্ধারণ করল। মক্কার মুশরিকদের কাজ এ রকমই ছিল। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,

فَلاَ تَجْعَلُواْ لِلّهِ أَندَاداً وَأَنتُمْ تَعْلَمُونَ

‘‘অতএব তোমরা জেনে-বুঝে আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ করোনা’’। (সূরা বাকারাঃ ২২) অর্থাৎ তোমরা অবগত আছ যে, তিনি তোমাদের এবং তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের প্রভু। তিনি তোমাদেরকে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল প্রকার নেয়ামত দান করেছেন। সুতরাং তোমরা তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে অন্যের দিকে মনোনিবেশ করোনা। বরং একনিষ্ঠভাবে সকল এবাদত তাঁর জন্যই সম্পাদন করো। কম বা বেশী যা কিছু চাও, কেবল আল্লাহর কাছেই চাও।

তুমি তাদের অন্তর্ভূক্তঃ এ কথা বলার কারণ এই যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উকাশার ঈমান, ফযীলত এবং জিহাদ সম্পর্কে অবগত ছিলেন। আল্লাহ্ তাআলা বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই তিনি বলেছেনঃ তোমাদের যা ইচ্ছা করতে পার। আল্লাহ্ তাআলা তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।

অন্য একজন দাঁড়িয়ে বললেনঃ হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আল্লাহর কাছে দুআ করুন, তিনি যেন আমাকেও তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেনঃ এ ব্যাপারে উক্কাশা তোমার অগ্রগামী হয়ে গেছেঃ এ কথা দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অন্যান্য লোকদের জন্য এই পথ বন্ধ করতে চেয়েছেন। যাতে একের পর এক লোকেরা এই আবেদন করতে না থাকে যে, আমার জন্য দুআ করুন, আল্লাহ্ যেন আমাকে তাদের অন্তর্ভূক্ত করেন। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে সম্ভবতঃ এমন ব্যক্তিও একই আবেদন করে ফেলবে, যার উপযুক্ত সে নয়। উপরোক্ত উক্তির দ্বারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দিকেই ইঙ্গিত করতে চেয়েছেন। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) তাওহীদের ব্যাপারে মানুষের বিভিন্ন স্তর থাকার কথা জানা গেল।

২) নবী ইবরাহীম (আঃ) মুশরিক ছিলেন না বলে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৩) তাওহীদের দাবী পূর্ণ করার তাৎপর্য কী, তা জানা গেল।

৪) বড় বড় আওলীয়ায়ে কেরাম শির্ক থেকে মুক্ত ছিলেন বলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবানে আল্লাহ তাআলার প্রশংসা।

৫) ঝাড়-ফুঁক থেকে বিরত থাকা এবং ছেঁকা গ্রহণ পরিত্যাগ করা তাওহীদপন্থী হওয়ার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।

৬) আল্লাহর উপর ভরসাই বান্দার মধ্যে উল্লেখিত গুণাবলীর সমাবেশ ঘটায়।

৭) বিনা হিসাবে জান্নাতে প্রবেশকারী সৌভাগ্যবান লোকেরা কোন আমল ব্যতীত উক্ত মর্যাদা লাভ করেন নি, এটা জানার ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের জ্ঞানের গভীরতা।

৮) কল্যাণ অর্জনের প্রতি তাঁদের অপরিসীম আগ্রহ।

৯) সংখ্যা ও গুণাবলীর দিক থেকে উম্মতে মুহাম্মদীর ফযীলত সম্পর্কে জানা গেল।

১০) নবী মূসা (আঃ) এর উম্মতের মর্যাদা।

১১) সব উম্মতকে তাদের নবীসহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সম্মুখে উপস্থিত করা হবে।

১২) প্রত্যেক উম্মতই নিজ নিজ নবীর সাথে পৃথকভাবে হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবে।

১৩) খুব অল্প সংখ্যক লোকই নবীগণের আহবানে সাড়া দিয়েছিল।

১৪) যে নবীর দাওয়াত কেউ গ্রহণ করেনি তিনি একাই হাশরের ময়দানে উপস্থিত হবেন।

১৫) এ জ্ঞানের শিক্ষা হচ্ছে, সংখ্যাধিক্যের দ্বারা ধোঁকা না খাওয়া আবার সংখ্যাল্পতার কারণে অবহেলা না করা।

১৬) বদনযর লাগা এবং বিষাক্ত কীট-পতঙ্গের কামড়ের চিকিৎসার জন্য ঝাড়-ফুঁকের অনুমতি পাওয়া গেল।

১৭) সালাফে সালেহীনের জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে জানা গেল। قد أحسن من انتهى إلى ما سمع ‘‘সে ব্যক্তি ভাল কাজ করেছে, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে যা শুনেছে তাই আমল করেছে’’ -এ কথাই তার প্রমাণ। তাই প্রথম হাদীছ দ্বিতীয় হাদীছের বিরোধী নয়।

১৮) মানুষের মধ্যে যে গুণ নেই তার প্রশংসা থেকে সালাফে সালেহীনগণ বিরত থাকতেন।

১৯) أنت منهم ‘‘তুমি তাদের অন্তর্ভূক্ত’’ -উক্কাশার ব্যাপারে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ কথা তাঁর নবুওয়াতেরই প্রমাণ।

২০) উক্কাশা রাযিয়াল্লাহু আনহুর মর্যাদা ও ফযীলত।

২১) কোনো কথা সরাসরি না বলে হিকমত ও কৌশল অবলম্বন করা।

২২) ইঙ্গিতের মাধ্যমে কথা বলা জায়েয।

২৩) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উত্তম চরিত্রের বর্ণনা।

[6] - উক্কাশা বিন মিহসান ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ সাহাবী। তিনি বদরসহ সকল যুদ্ধেই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে অংশ গ্রহণ করেছেন। তিনি বনী আসাদ বিন খুজায়মার অন্তর্ভূক্ত ছিলেন। রিদ্দার যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তুলাইহা বিন খুওয়াইলিদ তাঁকে হত্যা করে।

আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ

‘‘আল্লাহ তাঁর সাথে শির্ক করার গুনাহ মাফ করবেন না। শির্ক ছাড়া অন্যান্য যেসব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮)

ব্যাখ্যাঃ মুশরিকের জাহান্নামী হওয়া একটি সাধারণ হুকুম। সে জাহান্নামে প্রবেশ করে তথায় চিরকাল বসবাস করবে। এ বিষয়ে আহলে কিতাব তথা ইহুদী, নাসারা, মূর্তিপূজক এবং অন্যান্য কাফেরের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। যে ব্যক্তি অহংকার বশত কুফরী করে এবং যে ব্যক্তি অন্য কোন কারণে কুফরী করে, হকপন্থীদের নিকট তাদের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এ ক্ষেত্রে মিল্লাতে ইসলামীয়ার বিরোধী এবং ইসলাম গ্রহণ করার পর যার উপর কুফরীর হুকুম লাগানো হয়েছে, তার মাঝে কোন পার্থক্য নেই। কেননা সে এমন বিষয়কে অস্বীকার করেছে, যা অস্বীকার করা কুফরী। তবে যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করেছে, তার জান্নাতে প্রবেশের বিষয়টি নিশ্চিত। তবে যে ব্যক্তি এমন কবীরা গুনাহ করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করল, যার উপর সে মৃত্যু পর্যন্ত অবিচল ছিলনা। সে বিনা আযাবে প্রথমেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যদি কবীরা গুনাহ করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে, তাহলে সে আল্লাহর ইচ্ছাধীন থাকবে। আল্লাহ্ তাআলা যদি তাকে ক্ষমা করে দেন তাহলে সে প্রথমেই জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর তিনি যদি তাকে ক্ষমা না করেন, তাহলে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। অতঃপর সে জান্নাতে প্রবেশ করবে এবং তথায় চিরকাল থাকবে।

ব্যাখ্যাকারী বলেনঃ আমি বলছি, এটিই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অভিমত। এ ব্যাপারে তাদের মাঝে কোন মতভেদ নেই। শির্ক থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক হওয়ার বিষয়ে এটি একটি অন্যতম বিরাট আয়াত। আল্লাহ্ তাআলা মুশরিককে ক্ষমা না করার ঘোষণা দিয়েছেন। সেই সঙ্গে তার জন্য জাহান্নাম অবধারিত করেছেন। সেখানে সে চিরকাল লাঞ্ছিত অবস্থায় থাকবে। এটি একটি সাধারণ হুকুম। এই হুকুমকে কোন কিছুর সাথে শর্তযুক্ত করা হয়নি। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ ‘‘শির্ক ছাড়া অন্যান্য যে সব গুনাহ রয়েছে সেগুলো যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন’’। সুতরাং ক্ষমা পাওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে শির্ক থেকে বেঁচে থাকা। ফলে যেই গুনাহর প্রকৃত অবস্থা ঠিক এ রকমই অর্থাৎ যাতে লিপ্ত ব্যক্তিকে আল্লাহ ক্ষমা করেন না, তাতে লিপ্ত ব্যক্তির নাজাতের কোন আশা নেই। তবে মৃত্যুর পূর্বে তাওবা করলে সে কথা ভিন্ন। ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম আল্লাহ তাআলার কাছে এ দু’আ করেছিলেনঃ

وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الْأَصْنَامَ

‘‘আমাকে এবং আমার সন্তানদের মূর্তিপূজা থেকে রক্ষা করো’’ (ইবরাহীমঃ ৩৫) ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন আল্লাহর খাঁটি বন্ধু। খুল্লাত তথা খাঁটি বন্ধুত্বের স্তর হাবীব বা মুহাববাতের স্তর হতে অনেক উর্ধ্বে। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা তাঁর দু’জন প্রিয় বান্দাকে খলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ইবরাহীম এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। ইবরাহীম (আঃ)এর কথা আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে শির্ক হতে বাঁচাও। এই আয়াতটি বান্দার জন্য ভয়ের কারণ। ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ্ তাআলা একটি উম্মত বানিয়েছেন এবং বেশ কিছু বিষয় দিয়ে তাকে পরীক্ষা করেছেন। আর তিনি সে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। আল্লাহর একনিষ্ঠ বান্দাদের ইমাম হওয়া সত্ত্বেও যদি ইবরাহীম (আঃ) শির্ককে ভয় করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃوَإِبْرَاهِيمَ الَّذِي وَفَّى ‘‘এবং ইবরাহীমের কিতাবে, যে তার দায়িত্ব পূর্ণরূপে পালন করেছিল’’। (সূরা নাজমঃ ৩৭) আল্লাহ্ তাআলা তাঁকে স্বীয় পুত্র ইসমাঈলকে জবেহ করার আদেশ দিলে তিনি তাঁর প্রভুর সেই আদেশ পালন করেছেন। তিনি মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেছেন এবং মুশরিকদের কড়া প্রতিবাদ করেছেন। এত কিছু করার পরও তিনি শির্কের ফিতনায় পড়ার আশঙ্কা করতেন। কেননা তিনি জানতেন আল্লাহর হেদায়াত ও তাওফীকই কেবল তাঁকে এ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে। স্বীয় ক্ষমতা ও কৌশল প্রয়োগ করে এ থেকে বাঁচার কোন সুযোগ নেই। এ বিষয়ে ইবরাহীম আত্ তাইমী অত্যন্ত সুন্দর কথা বলেছেন। তিনি বলেনঃ ইবরাহীমের পরে আর কে মসীবত থেকে মুক্ত থাকতে পারবে?[1]

এটি এমন একটি বিষয় যাতে লিপ্ত হওয়া থেকে কেউ নিরাপদ নয়। সম্মানিত তিন যুগের পর এই উম্মতের অনেক জ্ঞানী লোকও এই অন্যায় কাজে লিপ্ত হয়েছে। ফলে মূর্তিগুলোকেই মাবুদ নির্ধারণ করা হয়েছে এবং সেগুলোর পূজা করা হয়েছে। ইবরাহীম খলীল (আঃ) নিজের উপর এবং তাঁর সন্তানদের উপর যেই বিষয়ের ভয় করতেন, তাতে সম্মানিত তিন যুগের পর এই উম্মতের অধিকাংশ লোকই লিপ্ত হয়েছে। কবরগুলোর উপর মসজিদ ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে এবং তাতে নানা প্রকার এবাদত পেশ করা হচ্ছে। লোকেরা এটিকেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছে। এই কবর ও মাজারগুলো নূহ (আঃ)এর জাতির মূর্তির স্থলাভিষিক্ত। এগুলোর মধ্যে এবং লাত, মানাত, উয্যা এবং আরব ও অন্যদের মূর্তির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

প্রিয় পাঠক! এই উম্মতের আখেরী যামানার লোকদের অবস্থার প্রতি লক্ষ্য করুন। জাহেলী যামানার আরব ও অন্যান্য মুশরিকদের অবস্থার সাথে একদম মিলে গেছে। তাদের শির্ক তাওহীদে উলুহীয়াতের মধ্যেই সীমিত নয়; এবাদতের সীমা পার হয়ে রুবুবীয়াতের স্তর পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর বিস্তারিত বিবরণ দেয়া সম্ভব নয়। ইবরাহীম খলীল (আঃ) যেই কারণে নিজের উপর এবং তাঁর বংশধরের উপর শির্কের ভয় করেছেন আল্লাহ্ তাআলা সূরা ইবরাহীমের ২৬ নং আয়াতে তাঁর কথা উল্লেখ করে বলেনঃ

رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘‘হে আমার প্রতিপালক! এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব, যে আমার অনুসরণ করবে সে আমার অন্তর্ভূক্ত এবং যে কেউ আমার নাফরমানী করবে নিশ্চয়ই তুমি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। ইবরাহীম (আঃ)এর যামানায়, তার পূর্বে এবং তাঁর পরে বহু জাতি বিভ্রান্ত হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কুরআনের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করবে, সে মানব জাতির অবস্থা এবং তারা যেই বড় বড় শির্কে লিপ্ত হয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হবে। অথচ এই শির্কে লিপ্ত হতে নিষেধ করার জন্য এবং যারা এতে লিপ্ত হবে, তাদেরকে শাস্তির ভয় দেখানোর জন্যই আল্লাহ্ তাআলা নবী-রাসূলদেরকে প্রেরণ করেছেন। যারা শির্ক বর্জন করবে তাদের জন্য নবী-রাসূলগণ ছাওয়াবের ঘোষণাও দিয়েছেন। কুরআন থেকে বিমুখ থাকার কারণে এবং আল্লাহ্ তাআলা কুরআনে যেই আদেশ দিয়েছেন ও যা থেকে নিষেধ করেছেন তা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকার কারণে আল্লাহ্ তাআলা অনেক জাতিকে ধ্বংস করেছেন। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন আমাদেরকে ইসলামের উপর অটল রাখেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাওহীদের উপর দৃঢ়পদ রাখেন। তিনিই এর উপর ক্ষমতাবান। আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কেউ পাপের কাজ হতে বিরত রাখতে পারেনা এবং আল্লাহ তাআলা ব্যতীত আনুগত্যের কাজে অন্য কোন তাওফীক দাতা নেই। আল্লাহ্ তাআলা সূরা মায়েদার ১১৮ নং আয়াতে বলেনঃ

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে তুমিই পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাবান’’। এই আয়াতে ঈসা ইবনে মারইয়াম (আঃ) খৃষ্টান মুশরিকদের ক্ষমা বা শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর উপর সোপর্দ করে দিয়েছেন, তেমনি ইবরাহীম (আঃ)ও তাদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন।[2] আর মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর যেই কুরআন নাযিল হয়েছে তাতে মুশরিকদের ব্যাপারে তাঁর হুকুম হল তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। উভয় আয়াতের মধ্যে কোন বৈপরিত্য নেই। আল্লাহ্ তাআলা মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মুশরিকদের ব্যাপারে তাঁর ফয়সালা প্রদান করেছেন। আল্লাহ্ তাআলা সূরা ফুসসিলাতের ৪২ নং আয়াতে বলেনঃ

لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ

‘‘এতে মিথ্যার প্রভাব নেই, সামনের দিক থেকেও নেই এবং পেছন দিক থেকেও নেই। এটা প্রজ্ঞাময়, প্রশংসিত আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে অবতীর্ণ’’। (সূরা ফুস্সিলাতঃ ৪২)

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«أخوف ما أخاف عليكم الشرك الأصغر فسئل عنه فقال الرياء»

‘‘আমি তোমাদের জন্য যে জিনিসের সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হচ্ছে শির্কে আসগার অর্থাৎ ছোট শিরক। শির্কে আসগার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তরে বললেন, ছোট শির্ক হচ্ছে রিয়া’’ অর্থাৎ মানুষকে দেখানোর জন্য আমল করা’’।[3] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সাহাবীদের উপর শির্কের ভয় করতেন। অথচ তারা কেবল এক আল্লাহরই এবাদত করতেন, তাদেরকে যেই আদেশ দেয়া হয়েছিল, তারা শুধু তাই করতেন। সুতরাং তারা হিজরত করেছেন, তাদের নবী তাদেরকে যেই তাওহীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন, তারা তা খুব ভালভাবেই বুঝেছিলেন এবং এককভাবে আল্লাহর এবাদত করা এবং শির্ক থেকে মুক্ত থাকার যেই হুকুম আল্লাহ্ তাআলা স্বীয় কিতাবে নাযিল করেছেন, তাও তারা খুব ভালভাবেই বুঝতে পেরেছেন। সুতরাং যারা ইল্ম ও আমলে সাহাবীদের সমকক্ষ নন, তাদের উপর শির্কের ভয় করবেন না- এটা কিভাবে হতে পারে?

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এই উম্মতের মধ্যে বড় শির্ক প্রবেশ করবে বলে আগাম সংবাদ দিয়েছেন। ছাওবান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

وَلاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَلْحَقَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِى بِالْمُشْرِكِينَ وَحَتَّى تَعْبُدَ قَبَائِلُ مِنْ أُمَّتِى الأَوْثَانَ

‘‘আমার উম্মতের বিরাট একটি জামাআত মুশরিকদের সাথে মিলিত না হওয়া পর্যন্ত এবং তাদের একটি দল মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হওয়া পর্যন্ত কিয়ামত প্রতিষ্ঠিত হবে না’’।[4] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা বলেছেন, তাই হয়েছে। অধিকাংশ অঞ্চলেই এই ফিতনা ছড়িয়ে পড়েছে। শির্ক নিষিদ্ধ হওয়া এবং অনেক সহীহ হাদীছ ও কুরআনের অনেক সুস্পষ্ট আয়াতে তা থেকে ভয় দেখানোর পরও লোকেরা শির্ককেই দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করেছে। আল্লাহ্ তাআলা বলেনঃ

إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ

‘‘নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে শরীক করবে তার জন্য আল্লাহ জান্নাত হারাম করে দিবেন, তার স্থান হবে জাহান্নাম’’। (সূরা মায়েদাঃ ৭২) আল্লাহ্ তাআলা সূরা হজ্জের ৩০ ও ৩১ নং আয়াতে বলেনঃ

فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ حُنَفَاء لِلَّهِ غَيْرَ مُشْرِكِينَ بِهِ

‘‘সুতরাং তোমরা বর্জন করো মূর্তিপূজার অপবিত্রতা এবং দূরে থাকো মিথ্যা কথা থেকে। আল্লাহ্‌র দিকে একনিষ্ঠ হয়ে, তাঁর সাথে শরীক না করে। এটিই হচ্ছে সেই তাওহীদ যার আলোচনা পূর্বের অধ্যায়েও করা হয়েছে। অতঃপর আল্লাহ্ তাআলা তাঁর বান্দাদেরকে শির্ক থেকে সতর্ক করে সূরা হজ্জের ৩১ নং আয়াতে বলেনঃ

وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَكَأَنَّمَا خَرَّ مِنَ السَّمَاء فَتَخْطَفُهُ الطَّيْرُ أَوْ تَهْوِي بِهِ الرِّيحُ فِي مَكَانٍ سَحِيقٍ

‘‘যে কেউ আল্লাহ্‌র সাথে শরীক করল সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল। অতঃপর পাখী তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে দূরবর্তী কোনো স্থানে নিক্ষেপ করল’’। এই আয়াতের মধ্যে চিন্তা-গবেষণা করার পরও যে ব্যক্তি এবাদতের ক্ষেত্রে শির্ক থেকে বাঁচতে পারবেনা তার হেদায়াতের কোন আশা নেই।

ইবনে মাসউদ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ

«مَنْ مَاتَ وَهْوَ يَدْعُو مِنْ دُونِ اللَّهِ نِدًّا دَخَلَ النَّارَ»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অনুরূপ কাউকে আহবান করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[5]

ব্যাখ্যাঃ এই হাদীছে শির্ক থেকে সাবধান ও ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। সুতরাং যে ব্যক্তি কোন মৃত অথবা অনুপস্থিত ব্যক্তিকে আহবান করে এবং স্বীয় মুখমণ্ডল ও অন্তরকে তার দিকেই ধাবিত করে, তার কাছেই আশা করে, তাকেই ভয় করে, চাই তার কাছে কোন কিছু প্রার্থনা করুক বা না করুক- এটিই হচ্ছে সেই শির্ক, যা আল্লাহ্ তাআলা ক্ষমা করবেন না। এ জন্যই আল্লাহ্ তাআলা তিনি ব্যতীত অন্য কাউকে সুপারিশকারী বানানো হারাম করেছেন এবং যারা এরূপ করবে কঠোর ভাষায় তাদের প্রতিবাদ করেছেন। কেননা এটি ইখলাসের পরিপন্থী। আর বান্দা যে সমস্ত বিষয়কে ভয় করে, যা কিছু সে কামনা করে, যার মাধ্যমে সে আল্লাহর নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা করে এবং যে সমস্ত বিষয়কে সে দ্বীন হিসাবে গ্রহণ করে তাতে মন-প্রাণ ও মুখমণ্ডলসহ আল্লাহর দিকে ধাবিত হওয়ার নামই হচ্ছে ইখলাস। আর এটি জানা কথা যে, বান্দা যখন কোনো সুপারিশকারীর দিকে দৃষ্টি দিবে এবং তার কাছে কোনো কিছু প্রার্থনা করবে, সে অন্তর ও মুখমণ্ডলসহ আল্লাহ্ তাআলা থেকে বিমুখ হল এবং তিনি ব্যতীত অন্যের দিকে মুখ ফিরাল। আর এটিই ইখলাসের পরিপন্থী। শাফাআত অধ্যায়ে এ বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ আসবে ইনশা-আল্লাহ্।

সহীহ মুসলিমে সাহাবী জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন

«مَنْ لَقِىَ اللَّهَ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَنْ لَقِيَهُ يُشْرِكُ بِهِ دَخَلَ النَّارِ»

‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যু বরণ করবে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরিক করে মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে’’।[6]

ব্যাখ্যাঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করে মৃত্যু বরণ করবে,- এ কথার মধ্যেই ইখলাসের ব্যাখ্যা সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে এ কথার আলোচনা হয়েছে। আর যে ব্যক্তি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করা অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে- এটিই হচ্ছে শির্কের ব্যাখ্যা। সুতরাং যে ব্যক্তি শির্ক করে আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করবে, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। তার শির্ক কম হোক বা বেশী, তাতে কিছু আসে যায়না। শির্কে আকবার করলে কোন আমলই কবুল হওয়ার যোগ্য থাকেনা। শির্কে আকবারে লিপ্ত ব্যক্তি জাহান্নামে প্রবেশ করবে এবং তথায় চিরস্থায়ী হবে। তবে শির্কে আসগার যেমন রিয়া করা, এরূপ কথা বলাঃ আল্লাহ্ যা চান এবং তুমি যা চাও, আল্লাহ্ এবং তুমি ব্যতীত আমার আর কেউ নেই, এ ধরণের কথা বলা কুফরী নয়। তবে এ ধরণের কথার কারণে বান্দার নেকীর পাল্লার তুলনায় গুনাহ্এর পাল্লা ভারী হয়ে যাবে।

কতক আলেম বলেনঃ এখানে শুধু শির্ক না করাকেই যথেষ্ট মনে করার কারণ হল এর দ্বারা তাওহীদের দাবী সাব্যস্ত হয়ে যায়। সেই সাথে এর মাধ্যমে আল্লাহ্ তাআলা কর্তৃক নবী-রাসূল প্রেরণের বিষয়টিও আবশ্যিকভাবে প্রমাণিত হয়ে যায়। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহর রাসূলদেরকে অস্বীকার করল, সে আল্লাহ্কেই অস্বীকার করল। আর যে ব্যক্তি আল্লাহ্ তাআলাকে অস্বীকার করল, সে মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে। সুতরাং উপরোক্ত হাদীছগুলোতে শির্ক না করে মৃত্যু বরণ করার তাৎপর্য হল যেসব বিষয়ের উপর ঈমান আনয়ন করা জরুরী সে সকল বিষয়ের উপর ঈমান আনয়ন করে। ঈমানের যে সমস্ত বিষয় সংক্ষিপ্তভাবে বর্ণিত হয়েছে তাতে সেভাবেই এবং যে সমস্ত বিষয় বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে, তাতে সেভাবেই ঈমান আনয়ন করে থাকে। এ অধ্যায় থেকে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জানা যায়ঃ

১) শির্ককে ভয় করে চলতে হবে।

২) রিয়া শির্কের মধ্যে শামিল।

৩) রিয়া হল ছোট শির্কের অন্তর্ভূক্ত।

৪) সৎ লোকদের জন্য ভয়ের বস্ত্তসমূহের মধ্যে সর্বাধিক ভীতিপ্রদ বিষয় হচ্ছে শির্কে আসগার তথা ছোট শির্ক।

৫) জান্নাত ও জাহান্নাম মানুষের একদম কাছাকাছি।

৬) জান্নাত ও জাহান্নাম নিকটবর্তী হওয়ার বিষয়টি একই হাদীছে বর্ণিত হয়েছে।

৭) আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক না করে মৃত্যুবরণ করলে মৃত ব্যক্তি জান্নাতে যাবে। পক্ষান্তরে আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক বানিয়ে মৃত্যু বরণ করলে মৃত ব্যক্তি যত বড় এবাদতকারীই হোক না কেন, সে জাহান্নামে যাবে।

৮) ইবরাহীম খলীল (আঃ)এর দুআর প্রধান বিষয় হচ্ছে, তাঁকে এবং তাঁর সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা তথা শির্ক থেকে রক্ষা করা হোক।

৯) رب أنهن أضللن كثيرا من الناس ‘‘হে আমার রব! এ মূর্তিগুলো বহু লোককে গুমরাহ করেছে’’ এ কথা দ্বারা ইবরাহীম (আঃ) বহু লোকের অবস্থা থেকে শিক্ষা ও উপদেশ গ্রহণ করেছেন।

১০) এখানে ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র তাফসীর রয়েছে। যা ইমাম বুখারী (রঃ) বর্ণনা করেছেন।

১১) শির্ক মুক্ত ব্যক্তির মর্যাদা।

[1] - এই অর্থেই ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালামের উক্তিটি এসেছে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কথা কুরআনে উল্লেখ করে বলেনঃ وَلَا أَخَافُ مَا تُشْرِكُونَ بِهِ إِلَّا أَن يَشَاءَ رَبِّي شَيْئًا ‘‘এবং তোমরা যাদেরকে তাঁর সাথে শরীক করছো তাদেরকে আমি ভয় করি না, তবে আমার রব যদি অন্য কিছু চান তাহলে অন্য কথা’’। (সূরা আনআমঃ ৮০) শুআইব আলাইহিস সালাম বলেছেনঃوَمَا يَكُونُ لَنَا أَن نَّعُودَ فِيهَا إِلَّا أَن يَشَاءَ اللَّهُ رَبُّنَا ‘‘আমাদের পক্ষে সে দিকে ফিরে যাওয়া আর কোনক্রমেই সম্ভব নয়। তবে আমাদের রব আল্লাহ যদি না চান, তাহলে সে কথা ভিন্ন’’। (সূরা আরাফঃ ৮৯)



[2] - এখানে একটু অস্পষ্টতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এভাবে বললে বিষয়টি পরিস্কার হবে বলে মনে হচেছঃ ইবরাহীম খলীল (আঃ) বলেছেন

رَبِّ إِنَّهُنَّ أَضْلَلْنَ كَثِيرًا مِنَ النَّاسِ فَمَنْ تَبِعَنِي فَإِنَّهُ مِنِّي وَمَنْ عَصَانِي فَإِنَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ

‘‘হে আমার প্রতিপালক, এরা অনেক মানুষকে বিপথগামী করেছে। অতএব, যে আমার অনুসরণ করে সে আমার অন্তর্ভূক্ত এবং যে কেউ আমার অবাধ্যতা করবে নিশ্চয়ই আপনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু’’। এখানে ইবরাহীম (আঃ) তাওহীদের বিরোধীতাকারীদের বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়েছেন। যেমন ঈসা (আঃ) তাঁর জাতির বিষয়টি আল্লাহর নিকট সোপর্দ করে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেনঃ

إِن تُعَذِّبْهُمْ فَإِنَّهُمْ عِبَادُكَ وَإِن تَغْفِرْ لَهُمْ فَإِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

‘‘তুমি যদি তাদেরকে শাস্তি দাও, তবে তারা তো তোমারই বান্দা। আর যদি তুমি তাদেরকে ক্ষমা করো, তবে তুমিই পরাক্রান্ত, প্রজ্ঞাবান’’।

মুশরেকদের বিষয়টি আল্লাহর দিকে সোপদ করে দেয়ার অর্থ এ নয় যে, আল্লাহ তাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন। বরং যারা মুশরেক অবস্থায় মৃত্যু বরণ করবে, তাদের হুকুম আল্লাহ তাআলা আমাদের শরীয়তের মধ্যে বর্ণনা করেছেন। আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

إِنَّ اللَّهَ لَا يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَٰلِكَ لِمَن يَشَاءُ ۚ وَمَن يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَىٰ إِثْمًا عَظِيمًا

‘‘আল্লাহ অবশ্যই শির্ক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না৷ এ ছাড়া অন্যান্য যত গুনাহ হোক না কেন তিনি যাকে ইচ্ছা মাফ করে দেন৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে আর কাউকে শরীক করেছে সে তো এক বিরাট মিথ্যা রচনা করেছে এবং কঠিন গুনাহ্র কাজ করেছে’’। (সূরা নিসাঃ ৪৮)

[3] - মুসনাদে আহমাদ, দেখুন সিলসিলায়ে সহীহা, হাদীছ নং- ৫৯১।

[4] - আবু দাউদ, অধ্যায়ঃ ফিতনার আলোচনা। দেখুনঃ আলবানী (রঃ)এর তাহকীকসহ মিশকাত, হাদীছ নং- ৫৪০৬।

[5] - বুখারী, অধ্যায়ঃ আল্লাহর বাণীঃ আর এমন অনেক লোক রয়েছে যারা অন্যান্যকে আল্লাহ্‌র সমকক্ষ সাব্যস্ত করে।

[6] - সহীহ মুসলিম, অধ্যায়ঃ যে ব্যক্তি শির্ক না করে মৃত্যু বরণ করল, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
দেখানো হচ্ছেঃ থেকে ১০ পর্যন্ত, সর্বমোট ৮৫ টি রেকর্ডের মধ্য থেকে পাতা নাম্বারঃ 1 2 3 4 5 6 7 8 9 পরের পাতা »