মুসলিম যুবকরা এমন সব পোশাক পরিচ্ছদ অবলম্বন করছে, তাদের দেখলে মনে হয় না তারা কোনো মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করছে। তাদের পরিধেয় পোশাকগুলো কোনো প্রকার রুচিশীলতার পরিচয় বহন করে না। তাদের মন-মগজ ও মস্তিষ্ক যে কত নিচে নামছে তা তাদের পোশাক দেখলেই বুঝা যায়। নাটক সিনেমার নায়ক, নায়িকারা কি ধরনের পোশাক পরল সে নিজেও সে ধরনের পোশাক পরিধানে ব্যস্ত। অথচ এ ধরনের পোশাক দ্বারা সতর ডাকা হলো কি হলো না তার প্রতি বিন্দু পরিমাণও ভ্রুক্ষেপ করতে রাজি নয়। এই ছবিগুলোর নামে যে পোশাকটি বের হবে তা কোনো এক বন্ধু যদি আগে কিনে থাকে তাহলে সে অন্য বন্ধুদের প্রশংসা কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়। সম্প্রতি আমরা দেখতে পাই যে, তেরে-নাম, রা-ওয়ান, জিলিক, টাপুর-টুপুর, ওয়াকা-ওয়াকা, বিন্ধু, দেবদাস এ ধরনের বিভিন্ন ছবি, অভিনেতা- অভিনেত্রীর নামে যে পোশাকগুলো বের হয়েছে তা আমাদের যুব সমাজের পছন্দ কুড়িয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। ফলে তারা তাদের অনুকরণে বিভিন্ন নামের পোশাক কিনছে এবং তাকে তারা তাদের ফ্যাশন হিসেবে গ্রহণ করছে। আমাদের যুবক যুবতীরা এমন সব পোশাক পরিধান করছে, যা দেখে মনে হয় না তারা কোনো সভ্য পরিবারে বসবাস করছে। ইসলামী শরীয়তে পোশাকের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে তা যদি সমাজে বাস্তবায়িত হত এবং আমাদের যুব সমাজ তার অনুকরণ করত তাহলে সামাজিক অবক্ষয় অনেকটা কমে যেত। কিন্তু যুব সমাজ যৌন উত্তেজক ও অর্ধ উলঙ্গ পোশাক পরিধান করার ফলে আজ সমাজে আমরা প্রতি নিয়তই দুর্ঘটনার মুখোমুখি হচ্ছি। সামাজিক ক্রাইম-এসিড নিক্ষেপ, ধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন হয়রানী ইত্যাদি দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আজ যদি আমাদের যুবক ভাই ও বোনেরা ইসলামী দিক নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেদের জীবনকে গড়ে তুলত এবং পোশাক পরিচ্ছদে ইসলামী অনুশাসন মেনে চলত, তাহলে তারা তাদের সোনালী ভবিষ্যৎ রচনা করতে পারত। কিন্তু না, তারা তাদের নিজেদের ঐতিহ্যকে বাদ দিয়ে বিজাতিদের পোশাক পরিচ্ছদ গ্রহণেই ব্যাকুল। আর আমাদের প্রাণ প্রিয় নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পোশাক পরিচ্ছদে বিজাতিদের অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। আমরা যাতে আমাদের যাবতীয় কর্মে বিজাতিদের অনুকরণ না করি সে ব্যাপারে তিনি অধিক সতর্ক করেছেন।
একদা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আব্দুল্লাহ ইবন ‘আমরকে দু’টি জাফরান রঙের কাপড় পরে থাকতে দেখে বললেন, “এ ধরনের কাপড় হলো কাফেরদের। অতএব তুমি তা পরো না[1]।”
এ থেকে বুঝা যায় যে, যে ধরনের লেবাস-পোশাক বিজাতির বিশেষ প্রতীক তা কোনো মুসলিম নর-নারী ব্যবহার করতে পারে না।
প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা মোচ ছেঁটে ফেল এবং দাড়ি ছেড়ে দাও। আর একাজ করে তোমরা মুশরিকদের অন্যথাচরণ কর[2]।”
“মোচ ছেঁটে ও দাড়ি রেখে অগ্নিপূজকদের বৈপরীত্য কর[3]।”
“এবং ইয়াহুদী ও খ্রিষ্টানদের সাদৃশ্য অবলম্বন করো না[4]।”
চুল-দাড়ি পেকে সাদা হয়ে গেলে সাদাই রেখে দেওয়া বিজাতীয় আচরণ। তাই ইসলামের আদেশ হল, তা কালো ছাড়া অন্য কোনো রঙ দ্বারা রঙিয়ে ফেল এবং বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করো না[5]। মাথায় পরচুলা ব্যবহার ইয়াহুদী মেয়েদের আচরণ। অতএব তা কোনো মুসলিম নারী ব্যবহার করতে পারে না।[6]
>[2] বুখারী, হাদিস: ৫৮৯৩, মুসলিম, হাদিস: ২৫৯
[3] মুসলিম, হাদিস: ২৬০
[4] আহমাদ, সহীহুল জামে’, হাদিস: ১০৬৭
[5] বুখারী, হাদিস: ৩৪৬২, মুসলিম, হাদিস: ২১০৩, আহমাদ, ত্বাবারানী, সহীহুল জামে’, হাদিস: ১০৬৭, ৪৮৮৭
[6] মুসলিম, হাদিস: ২৭৪২
মানুষ সামাজিক জীব। সমাজ ছাড়া মানুষ বাচতে পারে না। আর একজন মানুষকে সমাজে চলতে হলে, তাকেই অবশ্যই সমাজের মানুষের সাথে উঠা-বসা ও মেলা-মেশা করতে হয়। তবে এখানে আমাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, আমি যাদের সাথে চলা-ফেরা ও বন্ধুত্ব করব, তারা কেমন? তাদের স্বভাব-চরিত্র কেমন? কারণ, সৎ সঙ্গীর সাথে বন্ধুত্ব করা ও নেককার লোকের সাথে উঠা-বসা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানুষ যখন ভালো লোকের সাথে চলা-ফেরা করবে, তার প্রভাব একজন মানুষের মধ্যে অবশ্যই থাকবে। একজন যুবকের জীবনে তার সৎ সঙ্গই কেবলমাত্র তাকে তার সুন্দর একটি ক্যারিয়ার গঠনে সহযোগী হতে পারে। সৎ সঙ্গ একজন মানুষকে ভালো হতে সহযোগিতা করে। পক্ষান্তরে যদি একজন যুবকের সাথী-সঙ্গীরা অসৎ, খারাপ ও দুশ্চরিত্র হয়, তখন তার ভালো হওয়ার সুযোগ থাকে না। যখন একজন মানুষ অসৎ ও মন্দ আখলাকের লোকের সাথে থাকবে তার প্রভাব ও তার দুশ্চরিত্রের প্রভাব তার মধ্যে পরিলক্ষিত হবে। এ কারণেই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«المرء على دين خليله، فلينظر أحدكم من يخالل» رواه الترمذي وحسَّنه
“মানুষ তার বন্ধুর দীনের উপর, তাকে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, কাকে সে বন্ধু বানাবে”।[1] একজন বন্ধুই মানুষের ভালো হওয়া ও খারাপ হওয়ার মূল চালিকা শক্তি। এটি শুধু মুখের কথা বা দাবি নয় বরং বাস্তবতা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَيَوۡمَ يَعَضُّ ٱلظَّالِمُ عَلَىٰ يَدَيۡهِ يَقُولُ يَٰلَيۡتَنِي ٱتَّخَذۡتُ مَعَ ٱلرَّسُولِ سَبِيلٗا ٢٧ يَٰوَيۡلَتَىٰ لَيۡتَنِي لَمۡ أَتَّخِذۡ فُلَانًا خَلِيلٗا ٢٨ لَّقَدۡ أَضَلَّنِي عَنِ ٱلذِّكۡرِ بَعۡدَ إِذۡ جَآءَنِيۗ وَكَانَ ٱلشَّيۡطَٰنُ لِلۡإِنسَٰنِ خَذُولٗا ٢٩ ﴾ [الفرقان: ٢٧، ٢٩]
আর সেদিন যালিম নিজের হাত দুটো কামড়িয়ে বলবে, হায়, আমি যদি রাসূলের সাথে কোনো পথ অবলম্বন করতাম,! হায় আমার দুর্ভোগ, আমি যদি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম। অবশ্যই সে তো আমাকে উপদেশ-বাণী থেকে বিভ্রান্ত করেছিল, আমার কাছে তা আসার পর। আর শয়তান তো মানুষের জন্য চরম প্রতারক।[2]
আবুদ দরদা রা. আবু মুসা আশআরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু হতে বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«إنما مثل الجليس الصالح والجليس السوء كحامل المسك ونافخ الكير، فحامل المسك إما أن يحذيك وإما أن تبتاع منه وإما أن تجد منه ريحاً طيبة، ونافخ الكير إما أن يحرق ثيابك، وإما أن تجد ريحاً خبيثة».
“নেককার সাথী ও অসৎ সাথীর দৃষ্টান্ত: একজন আতর বহনকারী ও একজন কামারের মত। আতর বহনকারী সে হয় তোমাকে আতর দেবে, অথবা তুমি তার থেকে খরিদ করবে অথবা কম পক্ষে তুমি তার থেকে সুঘ্রাণ পাবে। আর কামার সে হয় তোমার কাপড় পুড়িয়ে দেবে অথবা তুমি তার থেকে দুর্গন্ধ অনুভব করবে”[3]।
যারা নেক লোকদের সাথে উঠা-বসা করবে, তারা অবশ্যই ভালো কিছু অর্জন করবে। বিশেষ করে, তারা তাদের সংশ্রব থেকে ভালো কিছু শিখবে বা দো‘আ লাভ করবে। যদিও তাদের আমল ঐ সব ভালো লোকদের আমলের পর্যায়ে পৌছবে না। যেমনটি হাদিসে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«وله قد غفرت، هم القوم لا يشقى بهم جليسهم»
“আমি তাকেও ক্ষমা করে দিলাম, আর তারা এমন এক সম্প্রদায় তাদের সাথে যারা বসবে তারাও বঞ্চিত হবে না”।[4]
অনুরূপভাবে অনুকরণীয় হিসেবে তাদের গ্রহণ করে তাদের ইলম, আমল ও আখলাক দ্বারা প্রভাবিত হওয়া দ্বারাও উপকৃত হবে। যেমনটি হাদিসে উল্লেখ করা হয়,
«المرء على دين خليله، فلينظر أحدكم من يخالل»
“মানুষ তার বন্ধুর দীনের উপর, তাকে অবশ্যই চিন্তা করতে হবে, কাকে সে বন্ধুরূপে গ্রহণ করবে”।[5] যখন কোনো ব্যক্তির বন্ধু সৎ হয়, তার ভালো হওয়ার সুযোগ বেশি থাকে। তার মধ্যে যে সব দোষত্রুটি আছে, তা যখন তার বন্ধুদের সামনে ধরা পড়ে তখন তারা তাকে সংশোধন করে এবং তার দোষত্রুটি ধরিয়ে দেয়। তখন সে নিজেই সংশোধন হতে এবং দোষত্রুটির চিকিৎসা গ্রহণে চেষ্টা করে। হাদিসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«المؤمن مرآة المؤمن»
“একজন মুমিন অপর মুমিনের আয়নাস্বরূপ।”[6] আয়নায় যেমন একজন মানুষ তার চেহারা দেখে অনুরূপভাবে সে তার অপর ভাইয়ের মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়।
নেকলোকদের সাথে উঠা-বসা করা, আল্লাহর মহব্বত লাভের কারণ হয়ে থাকে। হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
«وجبت محبتي للمتحابين فيَّ والمتجالسين فيَّ»
“আমার মহব্বত ওয়াজিব হয়ে যায়, তাদের জন্য যারা আমার জন্য একে অপরকে ভালোবাসে এবং আমার জন্য একে অপরের সাথে একত্রে বসে।”[7] পক্ষান্তরে যারা সৎ লোকদের সাথে উঠা-বসা করে না এবং অসৎ লোকদের সাথে উঠা-বসা করে তারা দুনিয়া ও আখিরাতে অসংখ্য ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
[2] সূরা আল-ফুরকান, আয়াত: ২৭-২৯
[3] মুসলিম, হাদিস: ২৬২৮।
[4] বর্ণনায় মুসলিম, হাদিস: ২৬৮৯।
[5] বর্ণনায় তিরমিযি হাদিস: ২৩৭৮ এবং তিনি হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেন।
[6] বর্ণনায় আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯১৮, আল্লাম ইরাকী ও আল্লামা ইবনে হাজার হাদিসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেন।
[7] বর্ণনায় মালেক এবং ইবনু আব্দিল বার ও মুনযিরি হাদিসটির সনদকে সহীহ বলেন। মুসনাদে আহমাদ ৫/২৩৩, নং ২২০৮৩।
বর্তমান সময়ে যিনা-ব্যভিচার একটি মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে এ ব্যাধি এত মারাত্মক আকার ধারণ করছে যে প্রায় প্রতিটি ফ্লাট বাড়ী একটি যৌন কেন্দ্র। অভিজাত ফ্যামিলির ছেলে মেয়েরা এ সব অপকর্মকে কোনো অন্যায় মনে করছে না। তারা মনে করছে এটি তাদের তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার ও স্বাধীনতা। তারা উন্নত বিশ্বকে তাদের মডেল হিসেবে উপস্থাপন করছে। তারা বলে উন্নত বিশ্বের মেয়েরা রাস্তা-ঘাট, হোটেল, পার্ক সব জায়গায় যেভাবে যৌন ক্ষুধা মিটিয়ে ঘরে ফিরে, তারাও এমন সমাজ ব্যবস্থার পক্ষপাতি। এ সব যেনা-ব্যভিচারের কারণে আজ সমাজে অশান্তি, মানবতার হাহাকার।
সত্য বলেছেন আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সত্য তাঁর নবুওয়তের অহীলব্ধ ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বলেছেন,
«يَا مَعْشَرَ الْمُهَاجِرِينَ خَمْسٌ إِذَا ابْتُلِيتُمْ بِهِنَّ، وَأَعُوذُ بِاللَّهِ أَنْ تُدْرِكُوهُنَّ: لَمْ تَظْهَرِ الْفَاحِشَةُ فِي قَوْمٍ قَطُّ، حَتَّى يُعْلِنُوا بِهَا، إِلَّا فَشَا فِيهِمُ الطَّاعُونُ، وَالْأَوْجَاعُ الَّتِي لَمْ تَكُنْ مَضَتْ فِي أَسْلَافِهِمُ الَّذِينَ مَضَوْا، وَلَمْ يَنْقُصُوا الْمِكْيَالَ وَالْمِيزَانَ، إِلَّا أُخِذُوا بِالسِّنِينَ، وَشِدَّةِ الْمَئُونَةِ، وَجَوْرِ السُّلْطَانِ عَلَيْهِمْ، وَلَمْ يَمْنَعُوا زَكَاةَ أَمْوَالِهِمْ، إِلَّا مُنِعُوا الْقَطْرَ مِنَ السَّمَاءِ، وَلَوْلَا الْبَهَائِمُ لَمْ يُمْطَرُوا، وَلَمْ يَنْقُضُوا عَهْدَ اللَّهِ، وَعَهْدَ رَسُولِهِ، إِلَّا سَلَّطَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ عَدُوًّا مِنْ غَيْرِهِمْ، فَأَخَذُوا بَعْضَ مَا فِي أَيْدِيهِمْ، وَمَا لَمْ تَحْكُمْ أَئِمَّتُهُمْ بِكِتَابِ اللَّهِ، وَيَتَخَيَّرُوا مِمَّا أَنْزَلَ اللَّهُ، إِلَّا جَعَلَ اللَّهُ بَأْسَهُمْ بَيْنَهُمْ».
“হে মুহাজিরদল! পাঁচটি কর্ম এমন রয়েছে যাতে তোমরা লিপ্ত হয়ে পড়লে উপযুক্ত শাস্তি তোমাদেরকে গ্রাস করবে। আমি আল্লাহর নিকট পানাহ চাই, যাতে তোমরা তা প্রত্যক্ষ না কর। যখনই কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা (ব্যভিচার) প্রকাশ্যভাবে ব্যাপক হবে তখনই সেই জাতির মধ্যে প্লেগ এবং এমন মহামারী ব্যাপক হবে যা তাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে ছিল না। যখনই কোনো জাতি ওজন ও মাপে কম দিতে আরম্ভ করবে তখনই তাদেরকে দুর্ভিক্ষ, জীবন-নির্বাহের কষ্ট ও শাসককুলের অত্যাচার পেয়ে বসবে। আর যখনই কোনো জাতি সম্পদের যাকাত প্রদানে বিরত থাকবে তখনই তাদের মধ্যে আকাশ থেকে অনাবৃষ্টি দেখা দিবে। যদি না জীব-জন্তু থাকত, তাদের মোটেই বৃষ্টি দেওয়া হতো না। আর যখনই আল্লাহ ও রাসূলের সাথে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করবে তখনই তাদের অধিকৃত বস্তুর কিছু হাতছাড়া হয়ে যাবে। আর যখনই কোনো জাতির নেতারা আল্লাহর কিতাব কুরআন দ্বারা বিচার-ফয়সালা করা ত্যাগ করবে এবং তা থেকে হুকুম পছন্দ করে গ্রহণ করবে না তখনই তাদের মধ্যে পরস্পর ভীতির সঞ্চার করবেন।”[1]
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “যখনই কোনো জাতি তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তখনই তাদের মাঝে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। যখনই কোনো জাতির মাঝে অশ্লীলতা আত্মপ্রকাশ করে তখনই সে জাতির জন্য আল্লাহ মৃত্যুকে আধিপত্য প্রদান করেন। (তাদের মধ্যে মৃতের হার বেড়ে যায়।) আর যখনই কোনো জাতি যাকাত-দানে বিরত হয় তখনই তাদের জন্য (আকাশের) বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়।”[2]
অবৈধ যৌনাচারের ফলে প্রাদুর্ভূত বিভিন্ন পুরনো রোগ তো আছেই। গনোরিয়া, সিফিলিস, শুক্র-ক্ষরণ প্রভৃতি যৌনরোগ ব্যভিচারীদের মাঝেই আধিপত্য বিস্তার করে। গনোরিয়া বা প্রমেহ রোগে জননাঙ্গে ঘা ও জ্বালা সৃষ্টি হয় এবং সেখান হতে পুঁজ নিঃসরণ হয়। মূত্রনালি জ্বালা করে, সুড়সুড় করে। মূত্রত্যাগে কষ্ট হয়। পানির মত প্রস্রাবের পর হলুদ পুঁজযুক্ত পদার্থ বের হয়। সে সঙ্গে মাথা ধরা ও ঘোরা, জ্বর এবং নিম্ন-গ্রন্থি-স্ফীতি তো আছেই।
সিফিলিস বা উপদংশ রোগ শরীরে প্রবেশ করার পর সপ্তাহ মধ্যে লাল দাগ ও ফুস্কুড়ি প্রকাশ পায়। এরপর হতে শরীর অনবরত চুলকায় ও তার চারিধারে প্রবাহযুক্ত পানি-ভরা ফোস্কা দেখা দেয় এবং ঐ সব ফুস্কুড়ি হতে পরে গলে ঘা হয় ও পুঁজ বের হয়। রোগ পুরনো হলে নখ খসে যায়, চুল ওঠে এবং সর্বাঙ্গে বিভিন্ন রোগ ও রোগের উপসর্গ প্রকাশ পায়।
আর শুক্র-ক্ষরণ রোগে তরল বীর্য যখন-তখন ঝরতে থাকে। এর ফলে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, বুক ধড়ফড় করে, মাথা ধরে ও ঘোরে ইত্যাদি।
সুতরাং এমন সব রোগের কথা শুনে শঙ্কিত হওয়া উচিত ব্যভিচারীকে। ক্ষণস্থায়ী সে স্বাদে লাভ কি, যার পরে আছে দীর্ঘস্থায়ী বা চিরস্থায়ী বিষাদ।
ব্যভিচার ব্যভিচারীর জন্য সাংসারিক ও পারিবারিক লাঞ্ছনা ডেকে আনে। আত্মীয়স্বজনের সামনে হতে হয় অপমানিত। কারণ, ব্যভিচারী যতই সতর্কতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করুক না কেন, একদিন না একদিন তার সে পাপ-রহস্য মানুষের সমাজে প্রকাশ পেয়েই যায়। ফলে তার ব্যাপারে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে একটা এমন দুর্নাম ছড়িয়ে পড়ে, যার দরুন সে প্রায় সকলের কাছে নিন্দার্হ ও ঘৃণার্হ হয়। সহজে কেউ তার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অনেক সময় তার কারণে তার পুরো বংশ ও পরিবারেরই বদনাম হয়। শেষে পরিণতি এই দাঁড়ায় যে, ভালো লোকেরা তাদের সহিত কোনো সম্পর্ক কায়েম করতে চায় না। অবশ্য ‘কানা বেগুনের ডগলা খদ্দের’ তো আছেই।
পক্ষান্তরে ব্যভিচারীর জীবনে লাঞ্ছনা যখন আসে, তখন তার হৃদয়ের জ্যোতি বিলীন হয়ে যায় এবং মন ভরে ওঠে অন্ধকারে। অপমানের পর এমনও হয়ে থাকে যে, শেষে সে একজন নির্লজ্জ ধৃষ্টতে পরিণত হয়ে যায়। সমাজে চলার পথে তার আর কোনো প্রকার ‘হায়া-শরম’ বলতে কিছু থাকে না। আর যার লজ্জা থাকে না, তার কিছু থাকে না। লজ্জাহীনের পূর্ণ ঈমানও থাকে না। যার ফলে মানুষের মনুষ্যত্ব ধ্বংস হয়ে যায় এবং পশুর পশুত্ব এসে স্থান নেয় তার মনে ও আচরণে।
ব্যভিচারীর মনে সব সময় এক প্রকার ভয় থাকে। অন্তরে বাসা বাঁধে সার্বক্ষণিক লাঞ্ছনা। যেমন আল্লাহর আনুগত্যে থাকে সম্মান ও মনের প্রফুল্লতা। মহান আল্লাহ বলেন,
﴿وَٱلَّذِينَ كَسَبُواْ ٱلسَّئَِّاتِ جَزَآءُ سَيِّئَةِۢ بِمِثۡلِهَا وَتَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ ٢٧ ﴾ [يونس : ٢٧]
“যারা মন্দ কাজ করে, তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং লাঞ্ছনা তাদেরকে আচ্ছন্ন করবে---।”[3] ব্যভিচারী সর্বদা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। জারজ জন্ম নিলে তো আরও। এ ছাড়া ব্যভিচারের ফলে তার সম্ভ্রম ও আত্মমর্যাদা যায়, স্ত্রী-কন্যার ব্যাপারে ঈর্ষা থাকে না। বরং ব্যভিচারী মিথ্যাবাদীও হয়, খেয়ানত-কারী ও ধোকাবাজ হয়। সাধারণত: বন্ধুর বন্ধুত্বের মানও খেয়াল রাখে না[4]।
ব্যভিচারী দ্বীনী ইলম থেকে বঞ্চিত হয়। কারণ, ইলম হলো আল্লাহর নূর। আর আল্লাহর নূর কোনো পাপিষ্ঠকে দেওয়া হয় না, তথা পাপের কালিমা সে জ্যোতিকে নি®প্রভ করে ফেলে।
ব্যভিচার এমন এক ‘ফ্রি সার্ভিস’ চিত্তবিনোদনের সুন্দর উপায় যে, ব্যভিচারীকে বিবাহ করে ঘর-সংসার করতে বাধা দেয়। তাকে বিবাহে আগ্রহহীন ও নিঃস্পৃহ করে তোলে। বিনা খরচ ও পরম স্বাধীনতায় যদি কাম-চরিতার্থ করা সহজ হয় এবং স্বামীর কোনো প্রকার দায়িত্ব ঘাড়ে না নিয়েই যদি মনের মত ‘বউ’ পাওয়া যায়, তবে কে আর বিয়ে করবে? ব্রিটেনের প্রায় ৯০ শতাংশ যুবক-যুবতী এই দায়-দায়িত্বহীন সম্পর্ককেই পছন্দ করে এবং বিবাহে জড়িয়ে পড়াকে বড্ড ঝামেলার কাজ মনে করে![5]
ব্যভিচার স্বামী-স্ত্রীর সংসারে ফাটল ধরায়। কারণ, অন্যাসক্ত স্বামীর মন পড়ে থাকে অন্য যুবতীর প্রতি। অনুরূপ অন্যাসক্তা স্ত্রীর মন পড়ে থাকে কোনো অন্য রসিক নাগরের যৌবন-আসনে। আর এই উভয়ের মাঝে সন্দেহ বাসা বাঁধে। একে অপরের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলে। সন্দেহ হয় স্বামীর নিজের সন্তানের ব্যাপারেও। প্রতিবাদ ও কৈফিয়ত হলে কলহ বাধে। অতঃপর চলে মারধর। আর তারপরই তালাক অথবা খুন!
ব্যভিচার পিতার পিতৃ-বোধ এবং মাতার মাতৃ-বোধ বিনষ্ট করে ফেলে। পিতৃ ও মাতৃবৎশল্য সন্তানদের উপর থেকে উঠে যায়। যেমন অনেকের জানতে বা অজান্তে সমাজে পয়দা হয় হাজারো জারজ সন্তান।
ব্যভিচার সমাজে নিরাপত্তাহীনতা ডেকে আনে। ধর্ষণের ভয়ে কিশোরী-যুবতীর নিরাপত্তা থাকে না। এমন কি নিরাপত্তা থাকে না কোনো সুদর্শন কিশোরও! বাড়ির ভিতরে থেকেও মনের আতঙ্কে শান্তির ঘুম ঘুমাতে পায় না তারা। অনেকে ঐ শ্রেণীর হিংস্র নেকড়ের পাল্লায় পড়ে জীবন পর্যন্তও হারিয়ে বসে।মানসিক বিপর্যয় ঘটিয়েই ব্যভিচার বহু সমাজ-বিরোধী অপরাধী সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে পিতা-মাতার স্নেহ ও মায়া-মমতা থেকে বঞ্চিত জারজ সন্তানরা মানসিক কঠোরতা ও সামাজিক ঘৃণার মাঝে মানুষ হতে থাকে এবং পরিশেষে অপরাধ জগৎকেই মনের মত জগত বলে নিজের জন্য বেছে নয়।
>[2] হাকেম, হাদিস: ২/১২৬, বাইহাকী, হাদিস: ৩/ ৩৪৬, বায্যার, হাদিস: ৩২৯৯ , সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদিস: ১০৭
[3] সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৭
[4] ইবনুল কাইয়্যেম, রওদাতুল মুহিব্বীন।
[5] আল-ইফ্ফাহ পৃ. ১৯।
ব্যভিচার চরিত্রহীনতা ও এক মহা অপরাধ। এ অপরাধ-রাজ্যে বাস করে মানুষ যে সব সময় আনন্দ পায় তা নয়। যেমন আল্লাহর আনুগত্য ও স্মরণে মন প্রশান্ত থাকে, তেমনি তাঁর অবাধ্যাচরণ ও পাপ-পঙ্কিলতাময় জীবনে মন বিক্ষিপ্ত ও অশান্তিময় থাকে। আর মহান আল্লাহ বলেন,
﴿ أَفَرَءَيۡتَ مَنِ ٱتَّخَذَ إِلَٰهَهُۥ هَوَىٰهُ وَأَضَلَّهُ ٱللَّهُ عَلَىٰ عِلۡمٖ وَخَتَمَ عَلَىٰ سَمۡعِهِۦ وَقَلۡبِهِۦ وَجَعَلَ عَلَىٰ بَصَرِهِۦ غِشَٰوَةٗ فَمَن يَهۡدِيهِ مِنۢ بَعۡدِ ٱللَّهِۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٢٣ ﴾ [الجاثية : ٢٣]
“তুমি কি তাকে লক্ষ্য করেছ, যে তার খেয়াল-খুশীকে নিজের উপাস্য বানিয়ে নিয়েছে। আল্লাহ তা জেনেই তাকে বিভ্রান্ত করেছেন এবং ওর কর্ণ ও হƒদয় মোহর (সীল) করে দিয়েছেন। আর ওর চোখের উপর ফেলে দিয়েছেন পর্দা। অতএব আল্লাহ তাকে বিভ্রান্ত করার পর কে তাকে পথ নির্দেশ করবে? তবুও কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করবে না?”[1]
বলাবাহুল্য যে, প্রেম ও ব্যভিচারের মত ক্ষণিকের সুখ ও সম্ভোগের জগতে মন-পূজারী বহু যুবক-যুবতী আপোষের মাঝে প্রেম ও মিলন কলহ নিয়ে কত শত মনের ধিক্কারে আত্মহত্যার শিকারে পরিণত হয়। ১৯৮৭ সালের এক রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, ব্রিটেনে প্রতি ২ ঘণ্টায় একটি করে যুবক আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করে থাকে![2]
ব্যভিচার এমন এক অপরাধ যে, তার ফলে খুন হয় লাখো লাখো সদ্যপ্রসূত কচি-কাঁচা শিশু। নির্দয় পাষণ্ড মা জন্মের পর তাকে ডাষ্টবিনে, নদীতে অথবা কোনো ঝোপে-জঙ্গলে ফেলে আসে! লাখো লাখো সন্তানকে ভ্রƒণ অবস্থায় পেটেই হত্যা করা হয়। কারণ, পিতামাতার উদ্দেশ্য ছিল, কেবল কাম তৃষ্ণা নিবারণ করা, কোনো অযাচিত সন্তান নেওয়া নয়।
ব্যভিচারের ফলে বংশে এমন এক সন্তান অনুপ্রবেশ করে যে সে বংশের কেউ নয়। সে মিরাস পায়, অথচ সে ওয়ারেস নয়। অনেক সময় এই সন্তান প্রকৃত ওয়ারেসীনকে বঞ্চিতও করে। পরিবারে অনেকের সে মাহরাম গণ্য হয়, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে গায়র মাহরাম ও বেগানা। আর এইভাবে একটি পাপের কারণে আরও বহু গুপ্ত ফ্যাসাদ চলতে থাকে সংসারে। যে পাপের কথা কেবল মন জানে, যেমন আসল বাপের কথা কেবল মা জানে।
ব্যভিচার আল্লাহর গযব আনয়ন করে। আল্লাহ বলেন,
﴿فَلۡيَحۡذَرِ ٱلَّذِينَ يُخَالِفُونَ عَنۡ أَمۡرِهِۦٓ أَن تُصِيبَهُمۡ فِتۡنَةٌ أَوۡ يُصِيبَهُمۡ عَذَابٌ أَلِيمٌ ٦٣ ﴾ [النور: ٦٣]
“সুতরাং যারা তাঁর আদেশের বিরুদ্ধাচরণ করে, তারা সতর্ক হোক যে, বিপর্যয় অথবা কঠিন শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে।”[3]
ব্যভিচার এক নিকৃষ্ট মহাপাপ। যে পাপের শাস্তিস্বরূপ অনুরূপ পাপ তার পরিবারে এসে যেতে পারে। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, جَزَآءُ سَيِّئَةِۢ بِمِثۡلِهَا “মন্দের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ।”
﴿ وَٱلَّذِينَ كَسَبُواْ ٱلسَّئَِّاتِ جَزَآءُ سَيِّئَةِۢ بِمِثۡلِهَا وَتَرۡهَقُهُمۡ ذِلَّةٞۖ ٢٧ ﴾ [يونس : ٢٧]
“যারা মন্দ কাজ করে তাদের প্রতিফল অনুরূপ মন্দ এবং তাদেরকে লাঞ্ছনা আচ্ছন্ন করবে ---।”[4]
সাধারণত: ব্যভিচারীদের স্ত্রী অথবা বোন অথবা কন্যাও ব্যভিচারিণী হয়ে থাকে। কারণ, তারা তাদের ব্যাপারে ঈর্ষা-হীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া যে পরস্ত্রীকে অসতী করে বেড়ায়, তার স্ত্রীও অসতী হতে পারে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ٱلۡخَبِيثَٰتُ لِلۡخَبِيثِينَ وَٱلۡخَبِيثُونَ لِلۡخَبِيثَٰتِۖ﴾
“দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্য এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্য”।[5]
অথচ কোনো মানুষ, বরং স্বয়ং ব্যভিচারী ও লম্পটও চায় না যে, তার স্ত্রী ব্যভিচারিণী বা অস্বচ্ছ-অপবিত্রা হোক।
‘নিজেদের নেই মনুষ্যত্ব, জানি না কেমনে তারা-
নারীদের কাছে চাহে সতীত্ব হায়রে শরম-হারা!’
ব্যভিচারী হলেও সে কোনো দিন চাইবে না যে, তার স্ত্রীও তারই মত ব্যভিচার করুক অথবা তার স্ত্রীকে কেউ ধর্ষণ করুক। স্ত্রী খুন হয়েছে শুনে মনে যতটা আঘাত লাগে, স্ত্রী ব্যভিচার করেছে বা ধর্ষিতা হয়েছে শুনে মনে আঘাত লাগে তার থেকে অনেক গুণ বেশী। সা‘দ ইবন ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘যদি আমি আমার স্ত্রীর সাথে অন্য পুরুষকে দেখি, তাহলে তরবারি দ্বারা তার মাথা কেটে ফেলব।’ এ কথা মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, “তোমরা কি সা‘দের আত্মমর্যাদাবোধ বা ঈর্ষায় আশ্চর্যবোধ করছ? আল্লাহর কসম! আমি ওর থেকেও বেশী ঈর্ষা-বান এবং আল্লাহ আমার থেকেও বেশী ঈর্ষা-বান। আর এ জন্যই তিনি গুপ্ত ও প্রকাশ্য সকল অশ্লীলতাকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন।[6]
অনুরূপ কোনো আত্ম-মর্যাদাবান পুরুষই চায় না যে, তার কোনো নিকটাত্মীয় মহিলা ব্যভিচারিণী হোক। অতএব ব্যভিচারী কিরূপে অপরের নিকটাত্মীয় মহিলার সহিত সে কাজ পছন্দ করে?
একদা এক যুবক আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট উপস্থিত হয়ে বলল, ‘আপনি আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন!’ তিনি বললেন, “তুমি কি তোমার মায়ের সাথে তা পছন্দ কর? তোমার বোন বা মেয়ের সাথে, তোমার ফুফু বা খালার সাথে তা পছন্দ কর?” যুবকটি প্রত্যেকের জন্য উত্তরে একই কথা বলল, ‘না। আল্লাহর কসম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার জন্য আমার জীবন উৎসর্গ হোক। (তাদের সঙ্গে আমি এ কাজ করতে চাই না।)’ তখন মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, “তাহলে লোকেরাও তো পছন্দ করে না যে, কেউ তাদের মা, মেয়ে, বোন, খালা বা ফুফুর সাথে ব্যভিচার করুক[7]।” অতএব ব্যভিচারী যুবককে এ ব্যাপারে উপদেশ গ্রহণ করা উচিত।
ব্যভিচার ও লাম্পট্য জগতের এ পাপ কিন্তু এক পর্যায়ের নয়। যেমন, ছোট ব্যভিচার হল, কাম নজরে দেখা চোখের ব্যভিচার। যৌন উত্তেজনামূলক কথা শোনা কানের ব্যভিচার এবং তা বলা জিভের ব্যভিচার। স্পর্শ করা হাতের এবং যৌন-মিলনের উদ্দেশ্যে চলা পায়ের ব্যভিচার। আর দুই যৌনাঙ্গের মিলনে হয় বড় ও আসল ব্যভিচার।[8] কোনো অবিবাহিতা নারীর সহিত ব্যভিচার করার চাইতে বড় ব্যভিচার হলো কোনো বিবাহিতা নারীর সহিত ব্যভিচার। এর চাইতে বড় হলো কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশীর স্ত্রীর সাথে ব্যভিচার। অতঃপর নিজের ভাইঝি-বোনঝি বা খালা-ফুফুর সাথে, অতঃপর নিজের বোনের সাথে, অতঃপর নিজের মেয়ের সাথে এবং সর্বোপরি বড় ব্যভিচার হলো মায়ের সাথে ব্যভিচার! (নাঊযু বিল্লাহি মিন যালিকা কুল্লিহী) অবশ্য একান্ত জানোয়ার ছাড়া নিজের নিকটাত্মীয় এগানা মহিলাদের সাথে কেউ একাজ করতে উদ্বুদ্ধ হয় না। আর এগানা মহিলা হলো সেই সব মহিলা, যাদের সহিত কোনো সময়ই বিবাহ বৈধ নয়।
>[2] আল-ইফফাহ, পৃ. ২৫।
[3] সূরা শূরা, আয়াত: ৪০
[4] সূরা ইউনুস, আয়াত: ২৭
[5] সূরা নূর, আয়াত: ২৬
[6] বুখারী, হাদিস: ৭৪১৬, মুসলিম, হাদিস: ১৪৯৯
[7] আহমাদ ৫/২৫৬-২৫৭, ত্বাবারানী, সিলসিলাহ সহীহাহ, হাদিস: ৩৭০
[8] মিশকাত, হাদিস নং ৮৬; মুসনাদে আহমাদ ২/৩২৯।
যে সব কারণে সাধারণ ব্যভিচার সংঘটিত হয়, তন্মধ্যে রয়েছে,
১- যুবক-যুবতীর নির্জনতা অবলম্বন, একান্তে গমন-ভ্রমণ, কোনো বাড়ি বা রুমে একাকী উভয়ের বসবাস, রিক্সা বা গাড়িতে চালকের সাথে একাকিনী যাতায়াত, দোকানে দোকানদারের কাছে একাকিনী মার্কেট করা, দর্জির কাছে একান্তে পোশাকের মাপ দেওয়া, ডাক্তারের সহিত নার্সের অথবা রোগিণীর একান্তে চিকিৎসা কাজ, প্রাইভেট টিউটরের কাছে একাকিনী পড়াশোনা করা ইত্যাদি। এগুলি ব্যভিচারের এক একটি সূক্ষ্ম ছিদ্রপথ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কোন মহিলার সাথে কোনো পুরুষ যখন নির্জনতা অবলম্বন করে, তখন শয়তান তাদের তৃতীয় জন (কুটনা) হয়।[1]
আর এই কারণেই মহিলার জন্য স্বামীর ভাই ইত্যাদি বেগানা আত্মীয়কে মৃত্যুর সাথে তুলনা করা হয়েছে[2]!
২- অবাধ মেলামেশা। পর্দার সাথে হলেও পাশাপাশি নারী-পুরুষের অবস্থান ব্যভিচারের এক বিপজ্জনক ছিদ্রপথ। একই বাড়িতে চাচাতো প্রভৃতি ভাই-বোন, স্কুল-কলেজে ও চাকুরী-ক্ষেত্রে যুবক-যুবতীর অবাধ দেখা-সাক্ষাৎ, অনুরূপ মার্কেটে, মেলা-খেলায়, বিয়েবাড়ি, মরা-বাড়ি, হাসপাতাল প্রভৃতি জায়গায় নারী-পুরুষের বারবার সাক্ষাতের ফলে পরিচয় এবং প্রেম, আর তারপরই শুরু হয় ব্যভিচার।
আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, ‘তোমাদের কি শরম নেই? তোমাদের কি ঈর্ষা নেই? তোমরা তোমাদের মহিলাদেরকে পর-পুরুষদের মাঝে যেতে ছেড়ে দাও এবং এরা ওদেরকে ও ওরা এদেরকে দেখাদেখি করে!’[3]
৩- বিবাহে বিলম্ব। সঠিক ও উপযুক্ত বয়সে বা প্রয়োজন-সময়ে বিয়ে না হলে যৌন ক্ষুধা নিবারণের জন্য ব্যভিচার ঘটা স্বাভাবিক। অধ্যয়ন শেষ করার আশায় অথবা চাকুরী পাওয়ার অপেক্ষায় অথবা সামাজিক কোনো বাধায় (বিধবা) বিবাহ না হওয়ার ফলে ব্যভিচারের এক চোরা পথ খোলা যায়।
৪- অতিরিক্ত মাহর অথবা পণ ও যৌতুক-প্রথাও ব্যভিচারের একটি কারণ। কেননা, উভয় প্রথাই বিবাহের পথে বড় বাধা।
৫- মহিলাদের বেপর্দা চলন ও নগ্নতা। ব্যভিচার ও ধর্ষণের এটি একটি বড় কারণ। ছিলা কলাতে মাছি বসা স্বাভাবিক। ছিলা লেবু বা খোলা তেঁতুল দেখলে জিভে পানি আসা মানুষের প্রকৃতিগত ব্যাপার। অনুরূপ পর্দা-হীনা, অর্ধ নগ্না ও প্রায় পূর্ণ নগ্না যুবতী দেখলে যুবকের মনে কাম উত্তেজিত হওয়াও স্বাভাবিক। আর এ জন্যই ইসলামে পর্দার বিধান অনুসরণ করা মহিলার উপর ফরয করা হয়েছে। নারীকে তার সৌন্দর্য বেগানা পুরুষকে প্রদর্শন করতে নিষেধ করা হয়েছে। (সূরা নূর, আয়াত: ৩১)
আর মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে,
«الْمَرْأَةُ عَوْرَةٌ، فَإِذَا خَرَجَتْ اسْتَشْرَفَهَا الشَّيْطَانُ»
“নারী হলো গোপনীয় জিনিস। তাই যখন সে (গোপনীয়তা থেকে) বের হয়, তখন শয়তান তাকে পুরুষের চোখে শোভনীয়া ও লোভনীয়া করে তোলে[4]।”
৬- নোংরা ফিল্ম দেখা, অশ্লীল পত্র-পত্রিকা পড়া এবং গান শোনা। যৌবনের কামনায় যৌন-চেতনা বা উত্তেজনা বলে একটা জিনিস আছে। যার অর্থ এই যে, যৌন-কামনা ঘুমিয়ে থাকে বা তাকে সুপ্ত রাখা যায় এবং কখনো কখনো তা প্রশান্ত থাকে বা তাকে প্রশমিত রাখা সম্ভব। বলা বাহুল্য নোংরা ফিল্ম, পত্র-পত্রিকা এবং গান হলো এমন জিনিস, যা সুপ্ত যৌনকামনাকে জাগ্রত করে এবং প্রশান্ত যৌন-বাসনাকে উত্তেজিত করে। এ ছাড়া এ উম্মতের সম্মানিত উত্তরসূরীগণ বলতেন যে, ‘গান হলো ব্যভিচারের মন্ত্র।’
৭- বেশ্যাবৃত্তির স্বীকৃতি ও সমাজে তাদের পেশাদারীর অনুমতি। তাদেরকে ‘যৌনকর্মী’ বলে আখ্যায়িত করে তাদের বৃত্তিকে অর্থোপার্জনের এক পেশা বলে স্বীকার করে নেওয়া ব্যভিচার প্রসার লাভের অন্যতম কারণ।
৮- মদ ও মাদক-দ্রব্যের ব্যাপক ব্যবহার। মদ, হিরোইন প্রভৃতির নেশায় নারীর নেশা ও চাহিদা সৃষ্টি হয় মাতাল মনে। ফলে এর কারণেও ব্যভিচার ব্যাপক হয়।
৯- আর সবচেয়ে বড় ও প্রধান কারণ হল, দ্বীন ও ঈমানের দুর্বলতা, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয়। যার মাঝে ঈমান ও তাকওয়া নেই, সে ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারে না। এমন ব্যক্তির মনের ডোর শয়তানের হাতে থাকে। অথবা নিজের খেয়াল-খুশী মত চালাতে থাকে নিজের জীবন ও যৌবনকে।
বলা বাহুল্য, যুবক যদি উল্লেখিত ব্যভিচারের কারণসমূহ থেকে দূরে থাকতে পারে, তাহলে অবশ্যই সে ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারবে। পক্ষান্তরে উপরোক্ত কারণসমূহের কোনো একটির কাছাকাছি গেলেই ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ে পড়বে। আর মহান আল্লাহর ঘোষণা হল,
﴿ وَلَا تَقۡرَبُواْ ٱلزِّنَىٰٓۖ إِنَّهُۥ كَانَ فَٰحِشَةٗ وَسَآءَ سَبِيلٗا ٣٢ ﴾ [الاسراء: ٣٢]
“তোমরা ব্যভিচারের নিকটবর্তী হয়ো না। কারণ তা হলো অশ্লীল এবং নোংরা পথ।”[5]
ব্যভিচার ব্যাপক আকারে প্রসার লাভ করা এই কথার ইঙ্গিত যে, কিয়ামত অতি নিকটে আসছে।[6]
অতএব যত দিন যাবে, ব্যভিচার পৃথিবীময় তত আরও বৃদ্ধি পাবে। তবে ঈমানদাররা ঈমান নিয়ে অবশ্যই সর্বদা সে অশ্লীলতা থেকে দূরে থাকবে।
ব্যভিচার বন্ধ করার লক্ষ্যে যৌথভাবে সামাজিক যে প্রচেষ্টার প্রয়োজন তা হলো নিম্নরূপ:-
১- পর্দাহীনতা দূর করে, সমাজে পবিত্র পর্দা-আইন চালু করা। আর এ দায়িত্ব হলো প্রত্যেক মুসলিমের, নারী ও পুরুষ, যুবক ও বৃদ্ধ, রাজা ও প্রজা সকলের।
২- ব্যভিচারের ‘হদ্দ্’ দণ্ডবিধি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চালু করা। এমন শাস্তি প্রয়োগ করা, যাতে কোনো লম্পট তার লাম্পট্যে সুযোগ ও সাহস না পায়।
৩- মহিলাকে কোনো মাহরাম বা স্বামী ছাড়া একাকিনী বাড়ির বাইরে না ছাড়া।
৪- কোনো বেগানা (দেওর, বুনাই, নন্দাই, বন্ধু প্রভৃতি) পুরুষের সাথে নারীকে নির্জনতা অবলম্বন করার সুযোগ না দেওয়া। সে বেগানা পুরুষ ফিরিশতা তুল্য হলেও তার সহিত মহিলাকে নির্জন বাস বা সফর করতে না দেওয়া।
৫- সৎ-চরিত্র গঠন করার সামাজিক ভূমিকা পালন করা; অশ্লীল ছবি, পত্র-পত্রিকা, গানবাজনা, যাত্রা-থিয়েটার প্রভৃতি বন্ধ করা এবং রেডিও, টিভি ও পত্র-পত্রিকা ইত্যাদি প্রচারমাধ্যমে সচ্চরিত্র গঠনের উপর তাকীদ প্রচার করা।
৬- সর্বতোভাবে বিবাহের সকল উপায়-উপকরণ সহজ করা। সহজে বিবাহ হওয়ার পথে সকল বাধা-বিপত্তি দূর করা।
৭- স্কুল-কলেজে সহশিক্ষা বন্ধ করে বালক ও বালিকাদের জন্য পৃথক পৃথক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থা করা। অবিবাহিত তরুণ-তরুণী ও কিশোর-কিশোরীকে যৌন-শিক্ষা না দেওয়া।
৮- নারীর জন্য পৃথক চাকুরী-ক্ষেত্র তৈরী করা।
৯- সকল প্রকার বেশ্যাবৃত্তি ও যৌন-ব্যবসা বন্ধ করা।
কিন্তু বন্ধু! তুমি যদি কোনো অমুসলিম রাষ্ট্রে বাস কর, তাহলে নোংরামির স্রোতে গা না ভাসিয়ে নিজেকে ও নিজের পরিবার-পরিজনকে বাঁচানোর জন্য নিম্নের উপদেশমালা গ্রহণ করঃ-
উপদেশমালা:-
১- তোমার পরিবার ও পরিবেশের মাঝে একটি স্বায়ত্ত-শাসনভুক্ত রাষ্ট্র গঠন কর এবং সেই রাষ্ট্রে যথা-সম্ভব ইসলামী আইন চালু কর।
২- অশ্লীলতার মোকাবিলা করার জন্য নিজের আত্মাকে ট্রেনিং দাও। আল্লাহ-ভীতি ও ‘তাকওয়া’ মনের মাঝে সঞ্চিত রাখ। শয়তান ও খেয়াল-খুশীর দাসত্ব করা থেকে বহু ক্রোশ দূরে থাক। ‘নাফসে আম্মারাহ’কে সর্বদা দমন করে রাখ। মনে-প্রাণে আল্লাহর স্মরণ রাখ। মন প্রশান্ত থাকবে।
৩- পরিপূর্ণ মু’মিন হলো সেই ব্যক্তি, যে তার চরিত্রে সবচেয়ে সুন্দর। অতএব তুমি তোমার চরিত্রকে সুন্দর ও পবিত্র কর।
৪- নোংরা পরিবেশে ধৈর্যশীলতা অবলম্বন কর। ধৈর্যের ফল বড় মিঠা হয়। অতএব ধৈর্যের সাথে অশ্লীলতার মোকাবিলা কর।
৫- মন্দ পরিণামকে ভয় কর। দুনিয়া ও আখেরাতের লাঞ্ছনা ও শাস্তির ভয় রাখ।
৬- অশ্লীলতা ও ব্যভিচার থেকে বাঁচতে পারলে তাতে যে সওয়াব ও মর্যাদা লাভ হয়, তার লোভ ও আশা রাখ। কিয়ামতে ছায়াহীন মাঠে আরশের ছায়া লাভ এবং বেহেশতে হুরীদের সহিত ইচ্ছাসুখের সম্ভোগের কথা মনে রাখ।
৭- মনে রেখো যে, তুমি যেমন চাও না, তোমার মা-বোন বা স্ত্রী ব্যভিচারিণী অথবা ধর্ষিতা হোক, তেমনি অন্য কেউই তা চায় না। অতএব সকলের ক্ষেত্রে ন্যায়পরায়ণতা বজায় রাখ।
৮- লজ্জাশীলতা ঈমানের একটি অংশ ও শাখা। মু’মিন হিসাবে তুমি সে মহৎ গুণকে তোমার হƒদয় থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিও না। লজ্জাশীলতা তোমার মনের প্রতি অশ্লীলতার সকল ছিদ্রপথ বন্ধ করুক।
৯- হিম্মত উঁচু রাখ। নিজের সচ্চরিত্রতা নিয়ে নিজেকে ধন্য মনে কর। আর মনে রেখো যে, সচ্চরিত্র এক অমূল্য ধন; যা আর কারো না থাকলে তোমার আছে।
১০- সেই সকল অশ্লীল বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পড়া অবশ্যই ত্যাগ কর, যা পড়ে তোমার হƒদয়ে কামনার উদ্রেক হয়, যৌন উত্তেজনা সৃষ্টি হয় দেহ-মনে। আর সেই সকল বই-পুস্তক ও পত্র-পত্রিকা পড়, যাতে এ সব পাপ ও তার শাস্তির কথা আলোচিত হয়েছে, যাতে রয়েছে আল্লাহ-ভীতির কথা।
১১- ইসলাম ও তার শরীয়তকে তোমার জীবনের সকল ক্ষেত্রে জীবন-বিধান বলে জানো ও মানো। দেখবে, সকল সমস্যার সমাধান রয়েছে ইসলামে।
১২- সম্ভব হলে সত্বর বিবাহ করে ফেল। কারণ, বিবাহই হলো এ সমস্যার সবচেয়ে উত্তম সমাধান। বিবাহ হলো অর্ধেক দ্বীন। বিবাহ হলো শান্তির মলম। বিবাহিতকে আল্লাহ সাহায্য করে থাকেন। সুতরাং চাকুরী না হলেও, নিজের পায়ে না দাঁড়ালেও, পড়া শেষ না হলেও তুমি বিবাহ কর। তোমার জন্য আল্লাহর সাহায্য আছে। আর জেনে রেখো যে, ব্যভিচারে পড়ার ভয় থাকলে তোমার জন্য বিবাহ করা ফরয।
১৩- মনের খেয়াল-খুশী ও প্রবৃত্তির ডোর নিজের হাতে ধরে থেকো এবং শয়তানের হাতে ছেড়ে দিও না। তোমার মনকে পবিত্র রেখো। কারণ,
﴿ قَدۡ أَفۡلَحَ مَن زَكَّىٰهَا ٩ وَقَدۡ خَابَ مَن دَسَّىٰهَا ١٠ ﴾ [الشمس: ٩، ١٠]
“যে তার মনকে পবিত্র করবে, সে হবে সফলকাম এবং যে তা কলুষিত করবে, সেই হবে অসফল।”[7]
১৪- মনকে নিয়ন্ত্রিত ও সংযত করার জন্য রোযা রাখ। এই রোযা তোমার যৌন-কামনাও দমন করবে।
১৫- ব্যভিচার থেকে বাঁচার জন্য চোখের ব্যভিচার থেকে দূরে থাক। আল্লাহর হারামকৃত বস্তুর দিকে দৃষ্টিপাত করো না। হারামের সামনে নজর ঝুঁকিয়ে চল।
১৬- সকল প্রকার যৌন-চিন্তা মন থেকে তুলে ফেল। আর এর জন্য ইসলামী ক্যাসেট শোন, বই পড়। নেক বন্ধুর কাছে গিয়ে বস এবং আল্লাহ ও তাঁর রসূলের কথা আলোচনা কর। একা থাকলে কুরআন ও তার অর্থ পড়।
১৭- যৌন উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সকল উপায় ও উপকরণ থেকে দূরে থাক। ভাবী ও চাচাতো-খালাতো-মামাতো-ফুফাতো বোনরা বেপর্দা হলে তাদেরকে নিজের বোনের মত দেখো। বন্ধুর বউ বেপর্দা হলে তার সাথে বন্ধুত্ব বর্জন কর। প্রয়োজন ছাড়া বেড়াবার উদ্দেশ্যে এমন স্থানে (হাটে-বাজারে) বেড়াতে যেও না, যেখানে নেংটা মহিলা নজরে আসে। টিভি-সিনেমা, নাটক-যাত্রা-থিয়েটার দেখা বন্ধ কর। ব্যভিচারের মন্ত্র গান শোনা বর্জন কর। স্কুল-কলেজে সহপাঠিনী থেকে দূরে থাক এবং ধৈর্যের সাথে দৃষ্টি সংযত রাখ।
১৮- সুশীল বন্ধু গ্রহণ কর এবং এমন বন্ধুর সংসর্গ ত্যাগ কর, যে যৌন ও নারীর কথা আলোচনা করে মজা নেয় ও আসর জমায়।
১৯- নির্জনতা ত্যাগ কর। বেকারত্ব দূর কর। কোনো একটা কাজ ধরে নাও এবং সে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাক।
২০- যদি তুমি এমন দেশে থাক, যে দেশে ব্যভিচার কোনো পাপ বা অপরাধ নয় অথবা এমন জায়গায় চাকুরী কর, যেখানে মহিলা সহকর্মীরা অযাচিতভাবে তোমার গায়ে পড়তে আসে, তাহলে সম্ভব হলে তুমি সে দেশ, পরিবেশ ও চাকুরী ত্যাগ করে বিকল্প ব্যবস্থা নাও। অর্থের জন্য নিজের চরিত্র ও ঈমান হারিয়ো না। আল্লাহ তোমার সহায়। যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কিছু ত্যাগ করে, আল্লাহ তাকে বিনিময়ে তার চেয়ে উত্তম জিনিস দান করেন।
২১- তওবা ও ইস্তিগফার করতে থাক। নারীর ফিতনা থেকে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা কর। আল্লাহ তোমাকে নোংরামি থেকে রক্ষা করবেন।
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ ٱتَّقَوۡاْ إِذَا مَسَّهُمۡ طَٰٓئِفٞ مِّنَ ٱلشَّيۡطَٰنِ تَذَكَّرُواْ فَإِذَا هُم مُّبۡصِرُونَ ٢٠١ ﴾ [الاعراف: ٢٠٠]
“অবশ্যই যাদের মনে আল্লাহর ভয় রয়েছে, তাদেরকে শয়তান কুমন্ত্রণা দেওয়ার সাথে সাথে তারা সতর্ক হয়ে যায় এবং তখনই তাদের বিবেচনা-শক্তি জাগ্রত হয়ে ওঠে। (তারা হয় আত্ম সচেতন মানুষ।[8])
>[2] বুখারী, ৫২৩২; মুসলিম, ২১৭২।
[3] দেখুন-হাকাযা তুদাম্মিরু জারীমাতুল জিনসিয়্যাতু আহলাহা পৃ. ২২।
[4] তিরমিযী, হাদিস: ১১৭৩; মিশকাত, হাদিস: ৩১০৯
[5] সূরা ইসরা, আয়াত: ৩২
[6] বুখারী, হাদিস: ৮১, মুসলিম, হাদিস: ২৬৭১
[7] সূরা আস-শামস, আয়াত: ৯-১০
[8] সূরা আ’রাফ, আয়াত: ২০১
তারপর আসা যাক আমাদের পিতা-মাতার কথায়। আমাদের পিতামাতা হচ্ছে সন্তানদের সবচেয়ে বড় শিক্ষক। ছোটকাল থেকে তারা সন্তানদের যে ধরণের শিক্ষা দেন সন্তানরা সেই শিক্ষাতেই বড় হয়ে ওঠে। সন্তানকে আদর্শ ও চরিত্রবান করতে গেলে মা-বাবাদের সেই ধরণের শিক্ষা দিতে হয়। শুধু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই একজন ছেলে/মেয়েকে নৈতিকতা সম্পন্ন মানুষ করতে পারে না। এজন্য পরিবারের বাবা-মায়ের ভূমিকা ব্যাপক এবং বাবা মায়েদের উচিত সন্তানকে ভালো লেখা পড়ার পাশাপাশি নৈতিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া। সে কোথায় যায়, কোনো বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করে এসব বিষয়ে আগ্রহ সহকারে খোঁজখবর নিতে হবে। মনে সবচেয়ে বড় কষ্ট পাই যখন দেখি, S.S.C এবং H.S.C তে A+ পাওয়া ছেলে পেলেগুলো পাড়ার মোড়ে সিগারেট ফুঁকছে কিংবা গার্লস স্কুলের সামনে অসহায়ভাবে দাড়িয়ে থাকছে এবং নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে। তাই বাবা মাকে এইসব ব্যাপারে জরুরী ভূমিকা পালন করতে হবে।
পাশাপাশি বাসায় ইসলামী শিক্ষাদান করতে হবে কারণ মানুষের নৈতিক চরিত্র বিকাশের ক্ষেত্রে ইসলামী শিক্ষার বিকল্প নেই। ‘তুমি ভালো রেজাল্ট করলেই তার সাত খুন মাফ’ অথবা ‘আমার দরকার ভালো রেজাল্ট, তারপর তুমি যা খুশী তাই কর আমার কোনো আপত্তি নেই’ সন্তানদের প্রতি এ ধরণের মনোভাব আজকাল পিতামাতার মধ্যে বেশী দেখা যাচ্ছে এ ধরনের মন মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। কোনটা সঠিক পথ আর কোনটা ভুল পথ সেটা স্পষ্ট করে সন্তানদের বোঝাতে হবে। কিন্তু বর্তমানে কিছু বাবা-মায়ের হয়ত ধারণা জন্মেছে সন্তান ভালো করে লেখাপড়া করলে, ভালো রেজাল্ট করলেই সে ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু এই ধরণের ধারণা শুধু অমূলক নয় রীতিমত ভয়ংকরও বটে। আমার করুণা হয় ঐসব অভিভাবকদের প্রতি যারা তাদের মেয়েদের ওড়না ছাড়া টি-শার্ট, জিনসের প্যান্ট পরে বাইরে বের হতে দেয়। অবশ্য তাদের বাবা মাও যদি অমন চরিত্রের হয় তাহলে বলার কিছু থাকে না। কারণ, সর্বাঙ্গে ব্যথা ঔষধ দিব কোথা। অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের উগ্র পোশাক পরতে দেয় তাহলে তাদেরকেই পস্তাতে হবে। আরব্য কবির একটি উক্তি মনে পড়ে যায়, তা হল- ‘ইন্নাকা লা-তাজনি মিনাশ শাওকিল ইনাব’ তুমি কাঁটাযুক্ত বৃক্ষ থেকে কখনো আঙ্গুর ফল পাবে না। সারা দেশ নয়, শুধু ঢাকা শহরেই লাখ লাখ মা-বাবা রয়েছেন যারা তাদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন।
অভিভাবকদের করনীয়
১- সালাতের তাকীদ দেয়া:-
অভিভাবকদের অবশ্যই তার সন্তানদের সালাতে যত্নবান হতে শেখাতে হবে। কারণ, সালাত মানুষকে ভালো হতে শেখায় খারাব বা মন্দ হতে বারণ করে। তবে এর জন্য জরুরী হলো মাতা-পিতা/অভিভাবক নিজেও সালাতে অভ্যস্ত হতে হবে। আর যদি তারা নিজেরাও সালাত আদায়কারী বা সালাতে যত্নবান না হন, তবে আমাদের আর বলার কিছুই থাকে না। কারণ, সর্ব জায়গায় ক্ষত মলম দিব কত। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “তোমরা তোমাদের সন্তানদের সাত বছর বয়সে সালাত আদায়ের নির্দেশ দাও আর যখন তারা দশ বছর বয়সে পৌঁছে যাবে, তখন তোমরা তাদের সালাত আদায় না করার উপর প্রহার কর।”[1]
২-সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা:- সন্তানদের অবশ্যই ভালো শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার পরিবেশ ইত্যাদি অবশ্যই বিবেচ্য। আপনার ছেলে কি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছে কিনা, কোন ধরনের শিক্ষকের নিকট থেকে সে শিক্ষা অর্জন করছে তার চরিত্র কি? আপনি যে স্কুল বা মাদ্রাসায় আপনার ছেলে পাঠাচ্ছেন সেখানকার পরিবেশ কি তা অবশ্যই আপনাকে বিবেচনায় আনতে হবে। আর যদি আপনি শুধু সার্টিফিকেট নির্ভর পড়া লেখায় বিশ্বাসী হয়ে থাকেন তাহলে তো কোনো কথাই না। মনে রাখবেন, কু-শিক্ষার চেয়ে অ-শিক্ষা ভালো। যে শিক্ষা একজন মানুষকে চরিত্রবান করে গড়ে তুলে না, যে শিক্ষা একজন মানুষকে মানবতা শেখায় না, সে শিক্ষাই কু-শিক্ষা। গুরুজনকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় তার তালীম দেওয়া এবং সে ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দেয়া সুশিক্ষা হিসেবে বিবেচ্য।
>বর্তমানে যুব সমাজের চরিত্র হরণের অন্যতম উপকরণ হল, প্রচার মাধ্যম। পেপার, পত্রিকা, ম্যাগাজিন, রেডিও, টেলিভিশন ইত্যাদি বর্তমানে যুবকদের বিপথগামী করা এবং তাদের নৈতিক পতনের অন্যতম কারণ। এ সব প্রচারমাধ্যম নারী ও পুরুষের নগ্ন ছবি, উলঙ্গ, অর্ধ উলঙ্গ চিত্র ও বিভিন্ন প্রকারের খারাব দৃশ্য দ্বারা ভরে থাকে। ফলে যুবকরা এ সব খারাব দৃশ্য দেখে প্রভাবিত হচ্ছে এবং অপকর্মের প্রতি ধাবিত হচ্ছে। যেখানে প্রচার মাধ্যমগুলোর কাজ ছিল মানুষের নিকট সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ খবরগুলো তুলে ধরা, মানুষকে অন্যায় অপরাধ থেকে সতর্ক করা এবং মানুষের চারিত্রিক উন্নতি সাধনে কাজ করে যাওয়া, তা না করে, বর্তমানে প্রচার মাধ্যমগুলো মিথ্যা খবর পরিবেশন করে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্ত চড়াচ্ছে এবং মানুষকে অপরাধপ্রবণ করে তুলছে এবং অপকর্মের প্রতি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রচার মাধ্যমগুলো আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতিকে মুছে দিয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার-বিজাতীয় সংস্কৃতিকে আমাদের মুসলিম দেশগুলোতে বাস্তবায়ন করতে চায়। কিন্তু এর পরিণতি যে কত ভয়াবহ ও বিপদজনক তা আমাদের মুসলিম যুবকরা বুঝতে পারছে না এবং তা বুঝার জন্য যে পরিমাণ জ্ঞান-বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা দরকার তা তাদের অনুপস্থিত। আমাদের মুসলিম যুবকদের পশ্চিমাদের বিষাক্ত ছোবল থেকে বাচাতে হলে, প্রচার মাধ্যমগুলোকে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে এবং মিথ্যা খবর পরিবেশন থেকে বিরত রাখতে হবে। বিশেষ করে টেলিভিশন, রেডিও ইত্যাদিতে যুবকরা খারাপ সিনেমা, নাটক, গান-বাজনা ইত্যাদি দেখে এবং শোনে এক অজানা গন্তব্যের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তারা বুঝতে পারছে না যে তাদের পরিণতি ও ভবিষ্যৎ কত অন্ধকার। শুধু আমরা টেলিভিশন, পত্রিকা, রাজনৈতিক মঞ্চ এবং সভা সেমিনারে যতই নান্দনিক এবং শ্রুতিমধুর ভুলি বর্ষণ করি না কেন, সুন্দর ও আলোকিত সমাজ এবং সমৃদ্ধ জাতি গড়তে হলে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে আমাদের এ প্রজন্ম যুব সমাজের নৈতিক উন্নতির প্রতি। অবক্ষয় থেকে বাঁচতে হলে প্রতিষ্ঠা করতে হবে একটি মাদক মুক্ত, পশ্চিমা সংস্কৃতির নগ্ন ছোবল থেকে মুক্ত একটি আধুনিক সমাজ।
বর্তমান সময়ে, রাস্তাঘাটে উঠতি বয়সের কিছু ছেলেকে দেখা যায় তাদের মাথার চুল উস্কুখুস্কু, শর্ট শার্ট পরা, জিনসের প্যান্ট কোমরের নিচের দিকে পরা, হাত একটু উঁচু করলেই লজ্জা স্থানের কিয়দংশ দেখা যায়। প্যান্টের নিচের অংশ পায়ের পাতার নিচে পরে থাকে অনেকটা ঝাড়ুদারের কাজ করে। দাঁড়ি কেটে মুখের বিশেষ জায়গায় এমনভাবে রাখে যেটা নিশ্চিত কোনো ইহুদী, খৃস্টান, হিন্দু অথবা তথাকথিত মুসলিম নামধারী নায়ক কিংবা কণ্ঠশিল্পীরা করে থাকে।
আর কিছু মেয়েরা ধর্ম, জাত-পাত সব ভুলে পোশাক ছোট করতে করতে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে আশংকা হয় তারা ক’দিন পরে চিড়িয়াখানার সদস্যদের মত কিছু দাবি না করে বসে।
এ সবের মুল কারণ হল, লজ্জাহীনতা। যখন মানুষের মধ্যে লজ্জা না থাকে, তখন সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। লজ্জা মানুষকে খারাপ ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে, ভালো কাজে উদ্বুদ্ধ করে। লজ্জা আত্মার একটি ভালো গুণ এবং যাবতীয় উন্নত চরিত্রের মূল, ঈমানের সৌন্দর্য ও ইসলামের নিদর্শন। যেমন- হাদিসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"إن لكل دين خُلقًا، وخُلُقُ الإسلام الحياء".
প্রতিটি দ্বীনের জন্য উত্তম চরিত্র রয়েছে, আর ইসলামের উত্তম চরিত্র হল, লজ্জা।[1] যার মধ্যে লজ্জা আছে, তার চরিত্র ঠিক আর যার মধ্যে লজ্জা নেই তার চরিত্র ঠিক নেই। লজ্জা মানুষকে নিরাপত্তা দেয় অপমান অপদস্থের হাত থেকে রক্ষা করে।
ওহাব ইবন মুনাব্বেহ রহ. বলেন, ঈমান বস্ত্রহীন, ঈমানের পোশাক তাকওয়া আর ঈমানের সৌন্দর্য লজ্জা। কেউ কেউ বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানকে লজ্জার পোশাক পরিধান করাবে, লোকেরা তার দোষ দেখতে পাবে না।
লজ্জা গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ হওয়ার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে, ইসলাম লজ্জার প্রতি মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে এবং উৎসাহ দেয়। এমনকি লজ্জাকে ঈমান বলে আখ্যায়িত করে। বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"الإيمان بضعٌ وسبعون شعبة، فأفضلها قول: لا إله إلا الله، وأدناها: إماطة الأذى عن الطريق، والحياء شعبة من الإيمان".
ঈমানের শাখা সত্তরের অধিক, সর্বোত্তম শাখা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলা, আর সব চেয়ে ছোট শাখা হল, কষ্টদায়ক বস্তুকে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়া। আর লজ্জা ঈমানের অন্যতম শাখা।[2] অপর একটি হাদিসে বর্ণিত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"الحياء والإيمان قرنا جميعًا، فإذا رفع أحدهما رفع الآخر".
“লজ্জা ও ঈমান একটি অপরটির পরিপূরক। যখন একটি বিলুপ্ত হবে, তখন অন্যটি এমনিতেই চলে যাবে”। লজ্জা ঈমান হওয়ার রহস্য- ঈমান ও লজ্জা উভয়টি মানুষকে কল্যাণের প্রতি আহ্বান করে এবং খারাপ কর্ম হতে দূরে সরায়।
যখন তুমি মানুষের মধ্যে উদাসীনতা, অশ্লীলতা ও নোংরামি দেখবে, তখন তুমি বুঝবে যে মানুষের মধ্যে লজ্জাহীনতা বেড়ে গেছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
"إن مما أدرك الناس من كلام النبوة الأولى: إذا لم تستحِ فاصنع ما شئت".
“পূর্বের যুগের নবীদের অবশিষ্ট কথা যা পরবর্তী যুগের উম্মতরা পেয়েছে, তা হল, যখন তুমি লজ্জা করবে না, তখন তুমি যা চাও তাই কর”।[3]
>[2] নাসায়ী, হাদিস: ৫০০৫
[3] বুখারি, হাদিস:৬১২০
যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম মোবাইল ফোন এখন আর শুধু কথা বলার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। চীনের সুবাদে ইন্টারনেট, চ্যাটিং, অডিও, ভিডিও সহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ মোবাইল সেটের মূল্য সকলের সাধ্যের মধ্যেই আছে। আকাশ সংস্কৃতি, ইন্টারনেট, মোবাইল, ভিডিও’র মত প্রযুক্তি এখন সবার জন্য অবারিত। নিত্য নতুন বহুরূপী সুযোগ সুবিধা সমৃদ্ধ মোবাইল সেট তরুণদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
মোবাইল সেট নিয়ে সব চেয়ে বেশী মাতামাতি লক্ষ্য করা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কখনও প্রয়োজনে কখনও সময়ের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে অভিভাবকরা বাধ্য হয়েই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছে মোবাইল নামক যন্ত্র। কিন্তু কখনও কি অভিভাবকরা চিন্তা করে দেখেছে মোবাইলের পার্শ্ব কিছু অপব্যবহারের কারণে তার সন্তান বিপথগামী হয়ে পড়ছে? সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সংবাদের দিকে একটু নজর দিলেই বোঝা যায় মোবাইল মানুষের নৈতিকতাকে কিভাবে ধ্বংস করছে। খুন, ধর্ষণ, ইভ-টিজিং সহ যে সকল ঘটনা অহরহ ঘটে চলেছে তার পিছনে মোবাইলের একটা ভূমিকা বরাবরই লক্ষ্য করা যাচ্ছে। স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ জড়িয়ে পরেছে মোবাইল পর্ণোগ্রাফি বা ব্লু ফিল্ম আসক্তিতে। ইন্টারনেটের সুবাদে এবং বিভিন্ন মোবাইল সার্ভিসিং সেন্টার থেকে গান ঢুকানোর নামে শিক্ষার্থীরা সুলভেই তাদের মোবাইল ম্যামোরীতে নগ্ন ভিডিও ক্লিপস লোড করে নিচ্ছে। এ সব নগ্ন ভিডিও এক সাথে অনেকে মিলে দেখছে এবং ব্লুটুথ এর সুবাদে তা এক হাত অন্য হাত হয়ে ছড়িয়ে পরছে সবার হাতে হাতে। শুধু তাই নয় ক্লাসের পিছনের বেঞ্চে বসে ক্লাসের সময় শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে মোবাইলের অপব্যবহারের কথাও শোনা গেছে। ভাবার বিষয় হচ্ছে, এ আসক্তি শুধু ছেলেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, মেয়েদের ও একটা বড় অংশ ব্লু ফিল্ম আসক্তিতে জড়িয়ে পরেছে। এর ফলে খুব অল্প বয়সেই ছেলে মেয়েদের মাঝে যৌন আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ইভ-টিজিং, আত্মহত্যা, অপহরণসহ অসামাজিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা। আধুনিকতার নামে এই উগ্র আধুনিকতার কবলে পড়ে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম দিন দিন ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে যাচ্ছে। তরুণ প্রজন্মকে এই ধ্বংস থেকে বাঁচাতে তাদের নৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা সব থেকে বেশী জরুরী। পাশাপাশি সন্তানদের মোবাইল সেট কিনে দেওয়ার সময় অভিভাবকদের ও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যাতে করে মোবাইলের অপব্যবহার না হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে যাতে করে ব্যাঙ্গের ছাতার মত গড়ে উঠা সার্ভিসিং সেন্টারগুলো থেকে মোবাইলে পর্ণোগ্রাফি ছড়িয়ে পড়তে না পারে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে মাধ্যমিক পড়ুয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মোবাইল ব্যবহারের ব্যাপারে বিধি নিষেধের ব্যাপারে সরকারীভাবে ভেবে দেখার সময় এসেছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক যুব সমাজের জন্য একটি মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে যুব সমাজ ফেসবুক ইন্টারনেটের প্রতি প্রতিটি মুহূর্তে হুমড়ি খেয়ে ঝুঁকে পড়ছে। লেখাপড়া ফাঁকি দিয়ে ফেসবুকে চ্যাট করে কেউ কেউ রাত পার করে দিচ্ছে। পড়া-লেখা নষ্ট হচ্ছে, সময় নষ্ট হচ্ছে, তার প্রতি কোনো ভ্রুক্ষেপ তারা করছে না। বর্তমানে যুবক যুবতীরা ফেসবুক ইন্টারনেটের প্রতি খুব আসক্ত হয়ে পড়ায় তাদের জীবন এখন হুমকির মখে পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম এ ফেসবুককে তারা তাদের বিভিন্ন ধরনের অপকর্মের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কাজে লাগাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের জীবনের মহা মূল্যবান সময়কে প্রতিদিনই এখানে ব্যয় করছে। ফলে তারা পড়ালেখা হতে দূরে সরে যাচ্ছে এবং দেখা অদেখা যুবক যুবতীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলে নানাবিধ সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ছে।