কুরআন ও হাদীছের আলোকে হজ্জ, উমরাহ ও মদীনা যিয়ারত চতুর্থ অধ্যায় শাইখ মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রহঃ)
হাজ্জে কুরবানী ওয়াজিব এবং কুরবানীর পশুর বিবরণ

তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যে, হাজ্জ হচ্ছে তিন প্রকার: হাজ্জে তামাত্তু, হজ্জে ক্বিরাণ এবং হাজ্জে ইফরাদ।

আর যে হাজ্জে কুরবানী ওয়াজিব তা হলো, হাজ্জে তামাত্তু ও হাজ্জে ক্বিরাণ।

তামাত্তুকারী ঐ ব্যক্তিকে বলা হয় যে হাজ্জের মাসগুলিতে উমরার ইহরাম করে, অতঃপর তা হতে হালাল হয়ে সেই বছরের একই সফরে হাজ্জের ইহরাম করে। (আর হাজ্জের মাস হচ্ছে শাওয়াল, যিলক্বাদ এবং যিলহাজ্জ মাসেরর প্রথম দশ দিন।[1])

সুতরাং কোন ব্যক্তি যদি শাওয়াল মাস আসার পূর্বেই উমরার ইহরাম করে এবং (বাকি সময়টা) মক্কায় অবস্থান করে সেই বছরেই হাজ্জও করে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব হবে না। কারণ, সে তামাত্তুকারী নয়; কেননা সে হাজ্জের মাস আসার পূর্বেই উমরার ইহরাম করেছে।

তেমনি কোন ব্যক্তি যদি শাওয়াল মাস আসার পর উমরার ইহরাম করে এবং হাজ্জ পরের বছর সম্পাদন করে তাহলে তার প্রতিও হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব হবে না। কারণ, সে তামাত্তুকারী নয়; কেননা সে উমরা এক বছরে এবং হাজ্জ পরের বছরে আদায় করল।

অনুরূপ যদি কোন ব্যক্তি হাজ্জের মাসে উমরার ইহরাম করে এবং ইমরা হতে হালাল হয়ে নিজ দেশে বা বাড়িতে ফিরে চলে আসে, অতঃপর শুধু হাজ্জের ইহরাম করে মক্কায় ফিরে আসে তবুও সে তামাত্তুকারী বলে গণ্য হবে না; কারণ, সে পৃথক সফরে শুধু হাজ্জের নিয়তে ইহরাম করেছে।

আর ক্বিরাণ হাজ্জ এমন হাজ্জকে বলা হয় যে, কোন ব্যক্তি উমরা ও হাজ্জের ইহরাম একই সঙ্গে করল কিংবা প্রথম উমরার ইহরাম করল। অতঃপর উমরার তাওয়াফ শুরু করার পূর্বেই তার সাথে হাজ্জের নিয়ত মিলিয়ে নিল। যেমন এর পূর্বে উল্লিখিত হয়েছে।

হাজ্জে তামাত্তুকারী ও ক্বিরাণকারীর প্রতি হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত হচ্ছে যে, সে যেন মক্কা বা হারামের এলাকার অধিবাসী না হয়। সুতরাং যারা মক্কা বা হারামের এলাকার অধিবাসী তাদের উপর হাদী (কুরবানী) যবহ করা ওয়াজিব নয়। যার দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

(فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ )البقرة 196

যে কেউ উমরাহকে হাজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে উপকার লাভ করতে উচ্ছুক, সে যেমন সম্ভব কুরবানী দিবে এবং যার পক্ষে সম্ভব না হয়, সে ব্যক্তি হাজ্জের দিনগুলোর মধ্যে তিনদিন এবং গৃহে ফেরার পর সাতদিন, এ মোট দশদিন সিয়াম পালন করবে। এটা সেই লোকের জন্য, যার পরিবারবর্গ মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়।[2]

আর জেদ্দাবাসীরা হাজ্জে তামাত্তু বা ক্বিরান করলে তাদের প্রতি হাদী (কুরবানী) করা ওয়াজিব। কারণ, তারা মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়। তবে যদি মক্কার অধিবাসী বিদ্যার্জনের জন্য বা অন্য কোন উদ্দেশে মক্কার বাইরে সফর করে, অতঃপর হাজ্জে তামাত্তু বা ক্বিরানের নিয়তে মক্কা ফিরে আসে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) করা ওয়াজিব হবে না। কারণ, এক্ষেত্রে তার বাসস্থানকে কেন্দ্র করতে হবে, আর তা হলো মক্কাহ্ মুকার্রামাহ্।

আর যদি কোন মক্কার অধিবাসী বসবাসের উদ্দেশ্যে অন্য কোন এলাকায় চলে যায়, তারপর তামাত্তু বা ক্বিরাণ হাজ্জের উদ্দেশ্যে মক্কায় ফিরে আসে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) করা ওয়াজিব। কারণ, সে বর্তমান মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়।

হাজ্জে তামাত্তুকারী বা ক্বিরাণকারী যদি হাদী (কুরবানীর পশু) না পায় বা তার খরচ-খরচা এবং বাড়ি ফিরে আসার মত পয়সার অতিরিক্ত কুরবানী ক্রয় করার পয়সা না থাকে তাহলে তার প্রতি হাদী (কুরবানী) ওয়াজিব হবে না, বরং তার সিয়াম পালন করা আবশ্যক হবে। যার দলীল মহান আল্লাহর বাণী:

(فَمَن تَمَتَّعَ بِالْعُمْرَةِ إِلَى الْحَجِّ فَمَا اسْتَيْسَرَ مِنَ الْهَدْيِ فَمَن لَّمْ يَجِدْ فَصِيَامُ ثَلاثَةِ أَيَّامٍ فِي الْحَجِّ وَسَبْعَةٍ إِذَا رَجَعْتُمْ تِلْكَ عَشَرَةٌ كَامِلَةٌ ذَلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ) البقرة 196

যে কেউ উমরাকে হাজ্জের সঙ্গে মিলিয়ে উপকার লাভ করতে উচ্ছুক, সে যেমন সম্ভব কুরবানী দিবে এবং যার পক্ষে সম্ভব না হয়, সে ব্যক্তি হাজ্জের দিনগুলোর মধ্যে তিনদিন এবং গৃহে ফেরার পর সাতদিন, এই মোট দশদিন সিয়াম পালন করবে। এটা সেই লোকের জন্য, যার পরিবারবর্গ মসজিদে হারামের বাসিন্দা নয়।[3]

আর এ তিনদিনের সিয়াম তাশরীক্বের দিনগুলিতে রাখা জায়েয। আর তা হলো, যিলহাজ্জ মাসের ১১, ১২ ও ১৩ তারীখ।

এর প্রমাণ, আয়িশা ও আব্দুল্লাহ বিন উমার (রা.)-এর উক্তি: তাশরীক্বের দিনগুলিতে একমাত্র ঐ সব লোকেদের ছাড়া যারা হাদী (কুরবানী) করতে সক্ষম নয়, অন্য লোকেদের সিয়াম রাখার অনুমতি দেয়া হয়নি।[4]

আর যদি উপলব্ধী করতে পারে যে, সে কুরবানী দিতে পারবে না তাহলে উমরার ইহরাম করার পরেই তিনটি সিয়াম পালন করা জায়েয। এর প্রমাণ, নাবী (সা.) এর বাণী:

دَخَلَتِ الْعُمْرَةُ فِي الْحَجِّ إلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

কিয়ামাত পর্যন্ত উমরা হাজ্জের মধ্যে প্রবেশ করেছে।[5]

সুতরাং কেউ যদি উমরার অবস্থায় তিনটি সিয়াম পালন করে তাহলে সে হাজ্জের দিনেই সিয়াম পালন করল। তবে ঈদের দিনে এই সিয়াম পালন করবে না।

কেননা আবূ সাঈদ খুদরী (রা.)-এর বর্ণিত হাদীসে রয়েছে যে, নাবী (সা.) দুই দিনে সিয়াম পালন করতে নিষেধ করেছেন: ঈদুল ফিতিরের দিন এবং ঈদুল আযহার দিন।[6]আর এই সিয়ামগুলি পরস্পর রাখা এবং বিরতি দিয়েও রাখা জায়েয। তবে তাশরীক্বের দিনগুলির পরে রাখবে না। আর অবশিষ্ট সাতটি সিয়াম নিজ গৃহে ফিরার পরে মন চাইলে বিনা বিরতিতে অথবা বিরতি দিয়ে আদায় করবে। কারণ, আল্লাহ পাক এই সিয়াম ওয়াজিব করেছেন, কিন্তু এক নাগাড়ে সিয়াম পালনের শর্তারোপ করেননি।

>
[1]. সহীহ বুখারী ১৫৬০ নং হাদীসের বাব দেখুন।

[2]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৯৬

[3]. সূরা বাক্বারা ২ঃ ১৯৬

[4]. সহীহ বুখারী ১৯৯৭-১৯৯৮।

[5]. সহীহ: তিরমিযী ৯৩২, আবূ দাঊদ ১৭৯০, মুসনাদে আহমাদ ২১১৫

[6]. সহীহ মুসলিম ১১৩৮, সহীহ বুখারী ১৯৯৩