শারহু মাসাইলিল জাহিলিয়্যাহ ১১-১২. বাতিল ক্বিয়াসের উপর নির্ভর করা ও ছহীহ ক্বিয়াসকে প্রত্যাখ্যান করা শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
বাতিল ক্বিয়াসের উপর নির্ভর করা ও ছহীহ ক্বিয়াসকে প্রত্যাখ্যান করা

ভ্রষ্ট ক্বিয়াসের মাধ্যমে দলীল পেশ করা। যেমন আল্লাহর বাণী:

إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا

তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ (সূরা ইবরাহীম ১৪:১০)।

আর বিশুদ্ধ ক্বিয়াসকে অস্বীকার করা: জামে ও তার পূর্ববর্তী বিষয় অস্বীকার করা। জামে ও ফারেকের জ্ঞান না থাকা।[1]

..............................................

ব্যাখ্যা: উসূলবিদদের নিকট : ক্বিয়াস (তুলনা) দু’প্রকার:

১. ক্বিয়াসু ইল্লাহ (কারণগত ক্বিয়াস)। একই হুকুমে মূল ও শাখা উভয়টি একত্রিত করার জন্য মৌলিক বিষয়ের সাথে শাখা মিলানো। শর্তসমূহের মধ্যে কোন একটি শর্ত ভঙ্গ হলে তা ভ্রান্ত ক্বিয়াস হিসাবে গণ্য হবে। কোন বিধান সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে এর উপর নির্ভর করা যাবে না। এটি একটি মারাত্নক সমস্যা। ইবনুল কাইয়ুম রহিমাহুল্লাহ বলেন, ভ্রান্ত ক্বিয়াসের কারণে অধিকাংশ মানুষ বিপথগামী হয়। আর প্রথমে ক্বিয়াস চর্চা করে ইবলিশ। আদম আলাইহিস সালামকে সিজদা করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাকে নির্দেশ দিলে সে বলে,

قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِينٍ

তিনি বললেন, কিসে তোমাকে বাধা দিয়েছে যে, সিজদা করছ না, যখন আমি তোমাকে নির্দেশ দিয়েছি? সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন থেকে সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন কাদামাটি থেকে (সূরা আরাফ ৭:১২)।

সে ধারণা করে মাটি থেকে আগুন উত্তম। তাই সে আদমের চেয়ে নিজেকে উত্তম মনে করে। এটা ছিল ইবলিশের ভ্রান্ত ক্বিয়াস-তুলনা। কেননা আগুন কখনো মাটির চেয়ে উত্তম হতে পারে না। বরং মাটিই আগুনের চেয়ে উত্তম। কারণ আগুন সাধারণত সব জিনিসকে পুড়িয়ে ধ্বংস করে করে দেয়। অথচ মাটি বিভিন্ন জিনিস ও শস্য উৎপন্ন করে, তাতে মানুষের কল্যাণ রয়েছে। আর যদি আমরা ক্বিয়াসের দিকে অগ্রসর হতাম, তাহলে বলতাম আগুন থেকে মাটি উত্তম। এ ধরণের তুলনা করা ক্বিয়াস নয়। বরং আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা ও অনুগ্রহের উপরই নির্ভর করতে হবে। কারণ আল্লাহ যা চান ও যা ইচ্ছা করেন তাই হয়। আল্লাহ তা‘আলার রয়েছে পূর্ণ হেক্বমাত।

অনুরূপভাবে মুশরিকরাও ক্বিয়াস করে রসূলগণকে মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করে বলতো,

إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا

তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ (সূরা ইবরাহীম ১৪:১০)।

রসূলগণ মানুষ হওয়ার কারণে তাদের উপর রিসালাত বিশুদ্ধ না হওয়ার উপর মুশরিকরা প্রমাণ পেশ করে। তাদের ধারণায় মানুষের উপর রিসালাত বিশুদ্ধ নয়। রিসালাতের ব্যাপারে এটা তাদের ক্বিয়াস। এ ধরণের ক্বিয়াস বাতিল। কেননা তা বিভেদ সৃষ্টিকারী ক্বিয়াস। আল্লাহ তা‘আলা রসূলগণকে অন্যদের উপর মর্যাদা দান করেছেন এবং তাদেরকে পছন্দ করে বাছাই করেছেন। আর তাদের অবস্থা ও রিসালাতের বিশুদ্ধতা সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলাই ভাল জানেন।

اللَّهُ يَصْطَفِي مِنَ الْمَلائِكَةِ رُسُلاً وَمِنَ النَّاسِ إِنَّ اللَّهَ سَمِيعٌ بَصِيرٌ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ

আল্লাহ, ফিরিশতা ও মানুষের মধ্য থেকে রসুল মনোনীত করেন। অবশ্যই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্ব দ্রষ্টা (সূরা হাজ্জ ২২:৭৫,৭৬)।

এ কারণে তারা রসূলগণকে বলতো,

إِنْ أَنْتُمْ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُنَا تُرِيدُونَ أَنْ تَصُدُّونَا عَمَّا كَانَ يَعْبُدُ آبَاؤُنَا فَأْتُونَا بِسُلْطَانٍ مُبِينٍ قَالَتْ لَهُمْ رُسُلُهُمْ إِنْ نَحْنُ إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ يَمُنُّ عَلَى مَنْ يَشَاءُ مِنْ عِبَادِهِ

তোমরা তো আমাদের মতই মানুষ, তোমরা আমাদেরকে আমাদের পিতৃ-পুরুষরা যার ইবাদাত করত, তা থেকে ফিরাতে চাও। অতএব তোমরা আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে আস। তাদেরকে তাদের রসূলগণ বলল, আমরা তো কেবল তোমাদের মতই মানুষ, কিন্তু আল্লাহ তার বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন (সূরা ইবরাহীম ১৪:১১)।

রসূলগণ বলতেন, আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে মর্যাদা দিয়েছেন এবং অনুগ্রহ করে রিসালাতের জন্য আমাদেরকে বাছাই করেছেন। তাই তোমাদের ক্বিয়াস বিভেদ সৃষ্টিকারী। সব মানুষ সমান নয় তাই তারা সমপর্যায়ে থাকতে পারে না। মানুষের মাঝে কাফির, মু’মিন, রসূল, আলেম, সৎলোক, অজ্ঞ ও ফাসেক সবই আছে। তাই মানুষের মাঝে ব্যবধান বিদ্যমান। বিভেদপূর্ণ ক্বিয়াস পরিত্যাজ্য। কেননা উসূলবিদদের নিকট এ ধরণের: ক্বিয়াস নিকৃষ্ট। মানুষের নিকট তাদের মধ্য থেকে রসূলগণের আগমনই যুক্তিযুক্ত, যাতে তিনি তাদেরকে বুঝাতে পারেন।

قُلْ لَوْ كَانَ فِي الْأَرْضِ مَلائِكَةٌ يَمْشُونَ مُطْمَئِنِّينَ لَنَزَّلْنَا عَلَيْهِمْ مِنَ السَّمَاءِ مَلَكاً رَسُولاً

বল, ‘ফেরেশতারা যদি যমীনে চলাচল করত নিশ্চিন্তভাবে তাহলে আমি অবশ্যই আসমান হতে তাদের কাছে ফেরেশতা পাঠাতাম রসূল হিসাবে’ (সূরা বনী ইসরাঈল ১৭:৯৫)।

তাই মানুষের নিকট রিসালাত পৌঁছে দেয়ার জন্য রসূলগণ দাঈ হিসাবে গণ্য। আর মানুষের মধ্যে থেকে রসূল হওয়া যুক্তিযুক্ত। পৃথিবীতে বসবাসকারীগণ যদি ফেরেশতা হতো তাহলে তাদের জন্য ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে রসূল আসতেন।

ঐ সব জাহিলদের বিষয় বড়ই আশ্চর্য! মানুষের মধ্যে থেকে রিসালাত প্রাপ্ত হওয়াকে জাহিলরা অসম্ভব মনে করে। অথচ পাথরের ইবাদত করাকে তারা কিভাবে সম্ভব মনে করে! কিন্তু পাথর ও গাছকে প্রভূ ও উপাস্য স্বীকার করাকেই তারা সম্ভব মনে করে। এতদসত্ত্বেও মানুষের রিসালাত প্রাপ্ত হওয়াকে তারা স্বীকার করে না এবং সম্ভব মনে করে না!

নূহ আলাইহিস সালাম এর কাফির সম্প্রদায় ও অন্যান্যরা এ বাতিল ক্বিয়াসের উপরই ছিল। রসূলগণ মানুষ হওয়ায় তারা রিসালাতকে অস্বীকার করতো। রসূলগণ মানুষ হওয়ার কারণে নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতিসহ অন্যরা তাদের রিসালাতকে অস্বীকার করতো। নূহ আলাইহিস সালাম এর জাতি বলেছিল,

مَا هَذَا إِلَّا بَشَرٌ مِثْلُكُمْ يُرِيدُ أَنْ يَتَفَضَّلَ عَلَيْكُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَنْزَلَ مَلائِكَةً مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي آبَائِنَا الْأَوَّلِينَ إِنْ هُوَ إِلَّا رَجُلٌ بِهِ جِنَّةٌ فَتَرَبَّصُوا بِهِ حَتَّى حِينٍ

এতো তোমাদের মত একজন মানুষ ছাড়া কিছুই না। সে তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করতে চায়। আর আল্লাহ ইচ্ছা করলে অবশ্যই ফেরেশতা নাযিল করতেন। এ কথাতো আমরা আমাদের পূর্বতম পিতৃ-পুরুষদের সময়েও শুনিনিসে কেবল এমন এক লোক, যার মধ্যে পাগলামী রয়েছে। অতএব তোমরা তার সম্পর্কে কিছুকাল অপেক্ষা কর (সূরা মু‘মিনূন ২৩: ২৪,২৫)।

অনুরূপভাবে অন্যান্য জাতিরাও বলতো আর কুরাইশরা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ব্যাপারে বলেছিল,

أَأُلْقِيَ الذِّكْرُ عَلَيْهِ مِنْ بَيْنِنَا

আমাদের মধ্য থেকে কি তার ওপরই উপদেশবাণী পাঠানো হয়েছে ? বরং সে চরম মিথ্যাবাদী অহংকারী (সূরা আল-ক্বামার ৫৪:২৫)।

কাফিরদের নিকট বহুল প্রচলিত রীতি হলো ভ্রান্ত ক্বিয়াস করা।

২. ক্বিয়াসুস শিবহি (قياس الشبه) বা সাদৃশ্য মূলক ক্বিয়াস।

তা হলো দু’টি মূলের মাঝে শাখাকে পুনরাবৃত্তি করা, তারপর মূল দু’টির সাথে বেশি সাদৃশ্যতা সংযোজন করা। আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য করা যাবে না। সৃষ্টির উপর কোন ক্বিয়াস হয় না। কোন ক্বিয়াসই আল্লাহ তা‘আলার সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্যতায় সমান নয়। একমাত্র আল্লাহ তা‘আলার অধিকারের ক্ষেত্রে উত্তম ক্বিয়াস ব্যবহৃত হবে। আর তা হলো এভাবে বলা যে, প্রত্যেক পূর্ণতা সৃষ্টির জন্যই সাব্যস্ত, আর স্রষ্টা আল্লাহ তা‘আলাই তার সৃষ্টি হ্রাস করার প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

وَلِلَّهِ الْمَثَلُ الْأَعْلَى وَهُوَ الْعَزِيزُ الْحَكِيمُ

আল্লাহর জন্য রয়েছে মহান উদাহরণ। আর তিনিই পরাক্রমশালী ও মহাজ্ঞানী (সূরা আন নাহাল ১৬:৬০)। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

فَلا تَضْرِبُوا لِلَّهِ الْأَمْثَالَ إِنَّ اللَّهَ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لا تَعْلَمُونَ

তোমরা আল্লাহর জন্য কোন দৃষ্টান্ত স্থাপন করো না। নিশ্চয় আল্লাহ জানেন আর তোমরা জান না (সূরা আন নাহাল ১৬:৭৪)।

পরবর্তী বিষয়: বিশুদ্ধ ক্বিয়াসকে তারা অস্বীকার করে। তা হলো: মানুষের মধ্যে থেকে রসূল হিসাবে তাদের নিকট মানুষই আগমন করা এবং ফেরেশতাদের মধ্যে থেকে রসূল হিসাবে ফেরেশতাই আগমন করা। এটা বিশুদ্ধ ক্বিয়াস যা বিচক্ষণতার দাবী রাখে যে, প্রেরিত ব্যক্তিকে যাদের নিকট প্রেরণ করা হবে তিনি তাদের মত সমজাতীয় হবেন, অন্য কোন জাতের হবেন না। যারা এ দু’টি বিষয়ে মানুষকে প্ররোচিত করে তারা জামি (ক্বিয়াসের ভিত্তি) ও ফারিক (যা দ্বারা ক্বিয়াস শুদ্ধ হয় না) এর ব্যাপারে অজ্ঞ।জামি (الجامع) বলা হয় যার উপর ভিত্তি করে ক্বিয়াস গঠিত হয়। আর ফারিক (الفارق) হলো যে বিষয়ের মাধ্যমে ক্বিয়াস বিশুদ্ধ হয় না।

[1]. জামে (الجامع) বলা হয় যার উপর ভিত্তি করে কিয়াস গঠিত হয়। আর ফারেক (الفارق) হলো যে বিষয়ের মাধ্যমে কিয়াস বিশুদ্ধ হয় না ।