শরহুল আকীদাহ আল-ওয়াসেতীয়া ১৮ - ইহা সাব্যস্ত করা যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের উপরে সমুন্নত ডঃ সালেহ ফাওযান [অনুবাদ: শাইখ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী]
ইহা সাব্যস্ত করা যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের উপরে সমুন্নত

১৮- إثبات استواء الله على عرشه

১৮- ইহা সাব্যস্ত করা যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর আরশের উপরে সমুন্নত:


আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে সমুন্নত।[1] এই কথা কুরআনের সাত জায়গায় বলা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা সূরা আরাফের ৫৪ নং আয়াতে বলেন,

﴿إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন। আল্লাহ তাআলা সূরা ইউনূসের ৩ নং আয়াতে বলেন,

﴿إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’’। আল্লাহ তাআলা সূরা রা'দের ২ নং আয়াতে বলেন,

﴿اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘‘আল্লাহই ঊর্ধবদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন বিনা স্তম্ভে। তোমরা এটা দেখছো। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। আল্লাহ তাআলা সূরা তোহার ৫নং আয়াতে বলেন, ﴾ الرَّحْمَنُ عَلَى الْعَرْشِ اسْتَوَى ﴿ ‘‘দয়াময় আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন’’। আল্লাহ তাআলা সূরা ফুরকানের ৫৯ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ الرَّحْمَٰنُ فَاسْأَلْ بِهِ خَبِيرًا﴾

‘‘তিনিই ছয়দিনে আকাশ মন্ডলী ও পৃথিবী এবং তাদের মাঝখানে যা কিছু আছে সব তৈরি করে রেখে দিয়েছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপরে সমুন্নত হয়েছেন তিনি পরম দয়াময়’’। আল্লাহ তাআলা সূরা সাজদার ৫৪ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿اللَّهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ وَمَا بَيْنَهُمَا فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ﴾

‘‘আল্লাহই আসমান-যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সকল বস্ত্ত ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’’। আল্লাহ তাআলা সূরা হাদীদের ৪ নং আয়াতে বলেনঃ

﴿هُوَ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ يَعْلَمُ مَا يَلِجُ فِي الْأَرْضِ وَمَا يَخْرُجُ مِنْهَا وَمَا يَنزِلُ مِنَ السَّمَاءِ وَمَا يَعْرُجُ فِيهَا وَهُوَ مَعَكُمْ أَيْنَ مَا كُنتُمْ ۚ وَاللَّهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرٌ﴾

‘‘আললাহই আসমান-যমীনকে ছয় দিনে সৃষ্টি করেছেন। অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। যা কিছু মাটির মধ্যে প্রবেশ করে, যা কিছু তা থেকে বেরিয়ে আসে এবং যা কিছু আসমান থেকে অবতীর্ণ হয় আর যা কিছু আসমানে উঠে, তা তিনি জানেন৷ তোমরা যেখানেই থাকনা কেন, তিনি তোমাদের সাথেই রয়েছেন। আর তোমাদের কৃতকর্ম আল্লাহ প্রত্যক্ষ করেন’’।[2]


ব্যাখ্যা: আল্লাহর কিতাবের সাতটি স্থানে আল্লাহ তাআলা সাব্যস্ত করেছেন যে তিনি আরশের উপরে সমুন্নত। প্রত্যেক স্থানেই মাত্র একটি শব্দ তথা استواء (সমুন্নত হওয়া) দ্বারা আরশের উপর সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করা হয়েছে। বলা হয়েছে استوى على العرش ‘‘তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন’’। ইস্তিওয়া শব্দটি এখানে আসল অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। অন্য অর্থ দ্বারা ব্যাখ্যা করার কোন সুযোগ নেই। ইস্তিওয়া (সমুন্নত হওয়া) আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তাআলার একটি কর্মগত সিফাত। এটি তাঁর পবিত্র সত্তার জন্য সুসাব্যস্ত। অন্যান্য সিফাতের মতই আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মানের জন্য শোভনীয় পদ্ধতিতেই এই সুউচ্চ সিফাতটি তাঁর জন্য সাব্যস্ত করতে হবে। আরবদের ভাষায় চারটি শব্দের মাধ্যমে ইস্তিওয়ার ব্যাখ্যা করা হয়েছে। যথাঃعلا وارتفع وصعد واستقر এই চারটি শব্দের প্রথম তিনটির অর্থ উপরে উঠলেন এবং সমুন্নত হলেন। চতুর্থ শব্দটির অর্থ হচ্ছে স্থির হলেন। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে বর্ণিত استواء শব্দের অর্থে সালাফদের থেকে যা বর্ণিত হয়েছে, তার ভিত্তি এই চারটি অর্থের উপরেই। আসলে ঘুরেফিরে অর্থ একটিই। তা হচ্ছে আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে।

প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেনঃ إِنَّ رَبَّكُمْ اللَّهُ ‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অর্থাৎ তিনি তোমাদের সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর নেয়ামতরাজি দ্বারা প্রতিপালনকারী। সুতরাং তোমাদের উপর আবশ্যক হচ্ছে তোমরা এককভাবে তাঁরই এবাদত করবে। যিনি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছেন। তিনি সৃষ্টিজগতের স্রষ্টা, আসমান-যমীনসমূহের সৃষ্টিকারী এবং আসমান ও যমীনের মাঝখানে যা আছে, তার সবই তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি ছয়দিনে এগুলো সৃষ্টি করেছেন। এই দিনগুলো হচ্ছে রবিবার, সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার, বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার। শুক্রবার দিন সকল সৃষ্টি সম্পন্ন হয়েছে। এতেই আল্লাহ আদম (আঃ)কে সৃষ্টি করেছেন।

ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ অতঃপর তিনি আরশে সমুন্নত হয়েছেনঃ অর্থাৎ যেভাবে আরশের উপর সমুন্নত হওয়া তাঁর বড়ত্ব ও মর্যাদার জন্য শোভনীয়, তিনি আরশের উপর সেভাবেই সমুন্নত হয়েছেন। প্রথম ও দ্বিতীয় আয়াতের এই অংশ থেকেই দলীল গ্রহণ করা হয়েছে।

আভিধানিক অর্থে বাদশার সিংহাসনকে আরশ বলা হয়। তবে এখানে সবগুলো দলীল দ্বারা সেই সিংহাসন উদ্দেশ্য, যার রয়েছে একাধিক খুঁটি এবং যাকে আল্লাহর ফেরেশতাগণ বহন করে আছেন। সেটি সমস্ত সৃষ্টিজগতের উপর তাঁবু বা গম্বুজ স্বরূপ। এক কথায় আরশ হচ্ছে সমস্ত সৃষ্টিজগতের ছাদ।[3]

তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ আল্লাহই ঊর্ধবদেশে আকাশমন্ডলী স্থাপন করেছেন বিনা স্তম্ভেঃ অর্থাৎ যমীনের অনেক উপরে আসমানকে এমনভাবে স্থাপন করেছেন যে, তাকে স্পর্শ করা এবং সে পর্যন্ত পৌঁছা সম্ভব নয়।

بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا তিনি আসমানকে বিনা খুঁটিতে উপরে স্থাপন করেছেন, যা তোমরা দেখতে পাচ্ছঃ খুঁটি ও স্তম্ভকে عمد বলা হয়। عمَد শব্দটি عماد -এর বহুবচন। আল্লাহ তাআলা আসমানসমূহকে এমন কোন খুঁটি ও স্তম্ভের উপর দাঁড় করান নি যে, উহা সেই খুঁটির উপর দাঁড়িয়ে আছে। বরং আল্লাহ তাআলা স্বীয় কুদরতের মাধ্যমে আসমানসমূহকে খুঁটি ছাড়াই সুউচ্চে স্থাপন করেছেন। আকাশের খুঁটি নেই, এই কথাকে শক্তিশালী করার জন্য عمد এর পর ترونها (তোমরা দেখতে পাচ্ছ) বাক্যটি আনয়ন করা হয়েছে।

কেউ কেউ বলেছেনঃ আসমানের খুঁটি আছে। কিন্তু আমরা তা দেখিনা। তবে প্রথম কথাটিই অধিক বিশুদ্ধ।

ثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ অতঃপর তিনি আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেনঃ তৃতীয় আয়াতের এই অংশ থেকেই আল্লাহ তাআলা আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার দলীল নেয়া হয়েছে। বাকী আয়াতগুলোর ক্ষেত্রেও কথা একই। আয়াতগুলোর যেখানেثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ রয়েছে, সেখান থেকেই দলীল গ্রহণ করা হয়েছে।

সবগুলো আয়াত থেকে যা সাব্যস্ত হচ্ছে, তা হলো আল্লাহর বড়ত্ব ও সম্মানের জন্য যেভাবে আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া শোভনীয়, আল্লাহর জন্য সেভাবেই আরশের উপরে সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করতে হবে। এই আয়াতগুলোতে ঐসব লোকদের প্রতিবাদ করা হয়েছে, যারা ইস্তিওয়াকে الاستيلاء (দখল করা, অধিকারী হওয়া) ও القهر (পরাজিত করা)এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করে এবং আল্লাহর আরশকে ব্যাখ্যা করে আল্লাহর রাজত্বের মাধ্যমে। তারা বলে আল্লাহ তাআলা আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন এর অর্থ হচ্ছে استولى على الملك وقهر غيره ‘‘তিনি তাঁর রাজত্বের অধিকারী হলেন এবং অন্যদেরকে পরাজিত করলেন’’। একাধিক কারণে এই ব্যাখ্যা বাতিল।

(ক) এটি একটি বিদআতী ব্যাখ্যা। এই ব্যাখ্যা সাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের অনুসারী সালাফে সালেহীনের ব্যাখ্যার সুস্পষ্ট বিরোধী। জাহমীয়া ও মুতাযেলারাই সর্বপ্রথম ইস্তিওয়ার এই ব্যাখ্যা করেছে। সুতরাং এই ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যাত।

(খ) استوى على العرشএর ব্যাখ্যা যদি استولى على الملك হতো, তাহলে আরশ এবং নিম্ন জগতের সাত যমীন, যমীনে বিচরণকারী জীব-জন্তু এবং সমস্ত মাখলুকের মধ্যে মর্যাদার দিক থেকে কোন পার্থক্য থাকতোনা। কেননা তিনি সমস্ত মাখলুকের উপর আধিপত্য বিস্তারকারী এবং তিনি সবকিছুর মালিক। সুতরাং استوى এর দ্বারা ইস্তিওলা উদ্দেশ্য করা হলে আরশের উল্লেখ করা নিরর্থক হতো। আল্লাহর কালামে নিরর্থক কিছু নেই।

(গ) আরশের উপর আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়া সাব্যস্ত করার জন্য কুরআন সুন্নাহয় শুধু استوى على العرش (আল্লাহ তাআলা আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন) এই বাক্যটিই উল্লেখিত হয়েছে। একবারও استولى على العرش (আরশের অধিকার গ্রহণ করলেন) বাক্যটি আসেনি। একবারও যদি তা আসত, তাহলে অন্য আয়াতগুলোতে উল্লেখিত استوى শব্দকে استولى এর মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা যেত ।[4]

(ঘ) উপরোক্ত আয়াতগুলোর যেখানেই আসমান-যমীন সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে, তার পর সবখানেই ثم আনয়ন করে বলা হয়েছেঃثُمَّ اسْتَوَىٰ عَلَى الْعَرْشِ (অতঃপর আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন), যা বিলম্বের সাথে ধারাবাহিকতার অর্থ প্রদান করে।استواء على العرش দ্বারা যদি استيلاء على العرش والقدرة عليه (আরশের অধিকারী হওয়া এবং উহার উপর ক্ষমতা লাভ করা) উদ্দেশ্য হতো, তাহলে خلق السموات والأرض বলার পর ثم استوى على العرش বলতেন না। কেননা আসমান-যমীন সৃষ্টির ৫০ হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহর আরশ বিদ্যমান ছিল। যেমন সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। সুতরাং কিভাবে এটি বলা বৈধ হতে পারে যে, আসমান-যমীন সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহ তাআলা আরশের অধিকারী ছিলেন না এবং এর উপর তিনি ক্ষমতাবানও ছিলেন না? এই ধরণের কথা সম্পূর্ণ বাতিল।


[1] - আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার বড়ত্ব মর্যাদার জন্য যেভাবে আরশের উপর সমন্নত হওয়া বা আরশের উপরে উঠা শোভনীয়, তিনি সেভাবেই আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। এক মাখলুক যেভাবে অন্য মাখলুকের উপর উঠে আরশের উপর আল্লাহর উঠা বা সমুন্নত হওয়া সেরকম নয়। ইমাম মালেক (রঃ)কে যখন এক লোক প্রশ্ন করল, الرحمن على العرش استوى كيف استوى؟ আল্লাহ তাআলা আরশের উপর সমুন্নত হয়েছেন। তা কিভাবে? জবাবে ইমাম মালেক (রঃ) বলেছেনঃالاستواء معلوم والكيف غير معلوم الإيمان به واجب والسوال عنه بدعة আরশের উপর আল্লাহর সমুন্নত হওয়া একটি জানা বিষয়। এর ধরণ আমাদের কাছে অজ্ঞাত। এর উপর ঈমান আনয়ন করা ওয়াজিব। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা বিদআত। অতঃপর সেই প্রশ্নকারীকে বিদআতী আখ্যা দিয়ে ইমাম মালেক (রঃ)এর মজলিস থেকে বের করে দেয়া হলো। আরশের উপর আল্লাহ তাআলার সমুন্নত হওয়ার ক্ষেত্রেই নয়; বরং সকল সিফাতের (বিশেষণের) ক্ষেত্রেই একই কথা। আল্লাহর সিফাতের (বিশেষণের) ধরণ আল্লাহই জানেন। আমরা জানিনা। যেমন আল্লাহর সত্তা কেমন, তা আমরা জানিনা। সুতরাং আল্লাহর সিফাত সম্পর্কে কথা বলা আল্লাহর যাত (সত্তা) সম্পর্কে কথা বলার মতই।

সেই সঙ্গে আরো স্মরণ রাখা দরকার যে, আরশের প্রতি আল্লাহর প্রয়োজন রয়েছে বলেই তিনি আরশে আরোহন করেছেন- এমনটি নয়; বরং অন্যান্য মাখলুকের মত আরশও আল্লাহর প্রতি মুহতাজ (মুখাপেক্ষী)। কারণ আরশ আল্লাহর অন্যতম সৃষ্টি। কোন সৃষ্টির প্রতিই আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। আরো স্মরণ রাখা আবশ্যক যে, আরশ আল্লাহকে বহন করে আছে- এমন ধারণা করা ভুল; বরং আল্লাহই আরশকে ধারণ করে আছেন। যেমন ধারণ করেছেন আসমান-যমীনসহ অন্যান্য সৃষ্টিকে। আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে আরোহন করেছেন এই বিশ্বাস করাতে এটি আবশ্যক হয়না যে, আল্লাহ আরশের সাথে মিশে আছেন; বরং কুরআন-হাদীছে শুধু বলা হয়েছে- আল্লাহ আরশের উপরে। কত উপরে তার কোন সীমা নির্ধারিত হয়নি। সুতরাং আল্লাহর সিফাতের ব্যাপারে নিজের পক্ষ হতে অনুমান করে কিছু বলা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদার পরিপন্থী।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা আরশের উপর সমুন্নত হওয়ার বিষয়টি সহীহ আকীদাহর অনেক আলেম ও সাধারণ লোক বুঝতে ভুল করেছেন। তারা الرحمن على العرش استوى এই আয়াতের অনুবাদ করে থাকেন এভাবে যে, আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন। এই অনুবাদ সঠিক নয়। আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন এই আকীদাহ পোষণ করা ভুল। কারণ সমাসীন কথার সরল বাংলা অর্থ হচ্ছে উপবিষ্ট হয়েছেন বা আসন গ্রহণ করেছেন, যা ইস্তাওয়ার অর্থ নয়। যদি বলা হয়, আল্লাহ আরশে সমাসীন (উপবিষ্ট), তাহলে আল্লাহর জন্য অবস্থা সাব্যস্ত হয়ে যাবে। অথচ সালাফে সালেহীনের কেউ এমন কথা বলেন নি, যাতে বুঝা যায় যে, আল্লাহ আরশে উপবিষ্ট বা সমাসীন।

লক্ষণীয় যে, আহলে হাদীছ সমাজের অনেক আলেম ও বক্তা জোরালোভাবেই বলে থাকেন যে, আল্লাহ আরশের উপরে সমাসীন। কুরআন মজীদের যেসব বাংলা অনুবাদ পাওয়া যাচ্ছে, তার অধিকাংশ অনুবাদ গ্রন্থেই استوى এর অনুবাদ করা হয়েছে সমাসীনের মাধ্যমে। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে এখান থেকেই আমাদের আলেম ও দাঈদের মধ্যে ভুলটি প্রবেশ করেছে। এই ভুলের কারণে এখন আহলে হাদীছ বিদ্বেষীগণ ফেসবুকসহ ইন্টারনেটের বিভিন্ন ওয়েব সাইটে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে বলে বেড়াচ্ছে যে, সালাফীদের আল্লাহ আরশে বসে আছেন। তাই ভুলটি সংশোধন করে নেওয়া আবশ্যক।

যেসব আহলে হাদীছ ভাই-বোন আমাদের এই লেখাটি পড়বেন, তাদের কাছে আমাদের জোরালো আবেদন হলো, তারা যেন ভুলটি সংশোধন করে নেন। কারণ আল্লাহ তাআলা আরশে সমাসীন (বসা বা উপবিষ্ট) এটি আমাদের (আহলে হাদীছদের) আকীদাহ নয়। শাইখুল ইসলাম, ইমাম ইবনুল কায়্যিম এবং কোন সালাফী আলেম থেকে এই ধরণের কথা পাওয়া যায়নি। ইমাম মালেক (রঃ) এর কথা থেকেও আল্লাহ আরশের উপর সমাসীন এ কথা বুঝা যায়না। তার কথার অর্থ আল্লাহ আরশের উপরে সমুন্নত।

সুতরাং الرحمن على العرش استوى এর সঠিক অনুবাদ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা আরশের উপরে সমন্নত। সমুন্নত না লিখে শুধু ‘উপরে’ কথাটি লিখে বা বলে ছেড়ে দিলেও ভুল হবেনা। কিন্তু কোন ক্রমেই সমাসীন বলা চলবেনা। কারণ আরশের উপর আল্লাহ তাআলা কিভাবে সমুন্নত হয়েছেন, তার কোন ধরণ কুরআন ও সহীহ হাদীছে বলা হয়নি। এমনি আল্লাহর অন্য কোন সিফাতেরও ধরণ বলা যাবেনা। আল্লাহ যেমন, তাঁর সিফাতও তেমন। তাঁর পবিত্র সত্তার প্রকৃত অবস্থা আমরা যেমন জানিনা, তিনিই জানেন তেমনি তাঁর অন্য কোন সিফাতের প্রকৃত অবস্থাও আমরা জানিনা। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, তাঁর অনেক সিফাতে কামালিয়া রয়েছে, যা কোন মাখলুকের সিফাতের মত নয়। যদি সমাসীন বলা হয়, তাহলে আল্লাহর বিশেষ একটি অবস্থা (বসা) সাব্যস্ত হয়ে যাবে, যা কোন দলীল বা সালাফদের উক্তি দ্বারা সমর্থিত নয়। (আল্লাহই সর্বাধিক জানেন)

[2] - তোমরা কোনো স্থানেই তাঁর জ্ঞান, তাঁর অসীম ক্ষমতা, তাঁর শাসন কর্তৃত্ব এবং তাঁর ব্যবস্থাপনার আওতার বাইরে নও। মাটিতে, বায়ুতে, পানিতে, অথবা কোন নিভৃত কোণে যেখানেই তোমরা থাক না কেন, সর্বাবস্থায়ই আল্লাহ জানেন তোমরা কোথায় আছো। সেখানে তোমাদের বেঁচে থাকাটাই এ কথা প্রমাণ করে যে, আল্লাহ ঐ স্থানেও তোমাদের জীবন ধারণের উপকরণ সরবরাহ করছেন। তোমাদের হৃদপিন্ডে যে স্পন্দন উঠছে, তোমাদের ফূসফূস যে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ করছে, তোমাদের শ্রবণ শক্তি ও দৃষ্টিশক্তি যে কাজ করছে এসব কিছুরই কারণ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় তোমাদের দেহের সব যন্ত্রপাতি ঠিকমত কাজ করছে। কোন সময় যদি তোমাদের মৃত্যু আসে তাহলে এ কারণে আসে যে, আল্লাহ তা'আলার পক্ষ থেকে তোমাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাপনার পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে তোমাদেরকে প্রত্যাহার করে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।

[3] - রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেনঃ

فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ، وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تُفَجَّرُ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ». (بخارى:2790)

‘‘যখন তোমরা আল্লাহর কাছে জান্নাত চাইবে তখন তোমরা জান্নাতুল ফিরদাউস চাও। কেননা এটি হচ্ছে জান্নাতের সর্বোচ্চ ও সর্বোত্তম জান্নাত। তিনি বলেন, আমার মনে হচ্ছে, উহার উপর আল্লাহর আরশ এবং তা থেকে জান্নাতের নদীসমূহ প্রবাহিত হয়েছে’’।

১ - আল্লাহ তাআলা সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং সকল বস্ত্তর মালিক একমাত্র তিনিই। অনন্তকাল থেকেই সকল বস্ত্তর উপর তাঁর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত এবং সকল বস্ত্ত বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও আল্লাহ এবং তাঁর মালিকানা বহাল থাকবে। আল্লাহর ক্ষেত্রে এমন বিশ্বাস পোষণ করা ঠিক হবেনা যে, আল্লাহ পূর্বে অমুক বস্ত্তর মালিক ছিলেন না। পরে মালিক হয়ে গেছেন। এ ধরণের অর্থ গ্রহণ করা হলে, আল্লাহ যে মহান ক্ষমতাবান তাতে বিশ্বাস পরিপূর্ণ হবেনা এবং মহান আল্লাহর সাথে মানুষের সাথে তুলনা হয়ে যাবে। (নাউযুবিল্লাহ)