আল-ফিকহুল আকবর হেদায়াত, কবর, অনুবাদ, আয়াতসমূহের মর্যাদা, রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আত্মীয়গণ, মিরাজ, কিয়ামতের আলামত ইত্যাদি ড. খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর (রহ.)
৮. ৪. মিরাজ বিষয়ক জাল ও ভিত্তিহীন ধারণা

ইসলামের অন্যান্য বিষয়ের ন্যায় মি’রাজ বিষয়েও দ্বিবিধ বিভ্রান্তি বিদ্যমান। একদিকে খারিজী, মু’তাযিলী ও সমমনা গোষ্ঠীগুলো যুক্তি, বিজ্ঞান বা দর্শনের নামে কুরআন মাজীদ ও সহীহ হাদীসে উল্লেখিত ও বর্ণিত ঘটনাবলি অস্বীকার করেছে এবং ব্যাখ্যার নামে প্রকাশ্য অর্থ বাতিল করেছে। অপরদিকে শীয়াগণ এবং সুন্নী সমাজের শীয়া প্রভাবিত অনেক ব্যক্তি ও গোষ্ঠী এ বিষয়ে অনেক জাল ও বানোয়াট কাহিনী প্রচার করেছে। তারা এ বিষয়ক কুরআন মাজীদ ও সহীহ হাদীসে বিধৃত বিষয়গুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেন না। বরং তাদের প্রচারিত জাল ও বানোয়াট কাহিনীগুলোকেই ‘‘মিরাজ’’-এর মূল বিষয় বলে বিশ্বাস ও প্রচার করে।

জাল হাদীস বিষয়ক গ্রন্থগুলোতে আমরা মিরাজ বিষয়ক অনেক জাল হাদীস দেখতে পাই। মিরাজের রাত্রিতে জান্নাতের সকল স্থানে ফাতিমা (রা), আলী (রা) ও তাঁর পরিবারের ‘পাক পাঞ্জাতনের’ নাম দেখা, তাদের ইমামতের সাক্ষ্য দেখা ইত্যাদি বিষয় এ সকল হাদীসের প্রতিপাদ্য। এ জাতীয় কিছু জাল হাদীস রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর আরশে আরোহণ কেন্দ্রিক।

কুরআনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সিদরাতুল মুনতাহার নিকট আল্লাহর মহান নিদর্শনাবলির দর্শনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করে আরশে গমনের কথা উল্লেখ করা হয় নি। সিহাহ সিত্তা ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ হাদীস গ্রন্থের হাদীসগুলোতে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) মিরাজের রাত্রিতে আরশে গমন করেছেন বলে উল্লেখ করা হয় নি। রাফরাফে চড়া, আরশে গমন করা ইত্যাদি কোনো কথা সিহাহ সিত্তা, মুসনাদে আহমদ ও অন্যান্য প্রসিদ্ধ কোনো হাদীস-গ্রন্থে সংকলিত কোনো হাদীসে নেই। ৫/৬ শতাব্দী পর্যন্ত সংকলিত ইতিহাস ও সীরাত বিষয়ক গ্রন্থগুলোতেও এ বিয়য়ে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। দশম হিজরী শতাব্দী ও পরবর্তী যুগে সংকলিত সীরাতুন্নবী বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থে রাফরাফ-এ আরোহণ, আরশে গমন ইত্যাদি ঘটনা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে আল্লামা মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল বাকী যারকানী (১১২২ হি) ‘আল-মাওয়াহিব আল-লাদুন্যিয়া’ গ্রন্থের ব্যাখ্যা ‘শারহুল মাওয়াহিব’ গ্রন্থে আল্লামা রাযী কাযবীনীর একটি বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেন:


لَمْ يَرِدْ فِيْ حَدِيْثٍ صَحِيْحٍ وَلاَ حَسَنٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ جَاوَزَ سِدْرَةَ الْمُنْتَهَى، بَلْ ذُكِرَ فِيْهَا أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى مُسْتَوًى سَمِعَ فِيْهِ صَرِيْفَ الأَقْلاَمِ فَقَطْ. وَمَنْ ذَكَرَ أَنَّهُ جَاوَزَ ذَلِكَ فَعَلَيْهِ الْبَيَانُ، وَأَنَّى لَهُ بِهِ! وَلَمْ يَرِدْ فِيْ خَبَرٍ ثَابِتٍ وَلاَ ضَعِيْفٍ أَنَّهُ رَقِىَ الْعَرْشَ. وَافْتِرَاءُ بَعْضِهِمْ لاَ يُلْتَفَتُ إِلَيْهِ.


‘‘কোনো একটি সহীহ, হাসান অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন। বরং বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি তথায় এমন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছেছিলেন যে, কলমের খসখস শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন। যিনি দাবি করবেন যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সিদরাতুল মুনতাহা অতিক্রম করেছিলেন তাকে তার দাবীর পক্ষে প্রমাণ পেশ করতে হবে। আর কিভাবে তিনি তা করবেন! একটি সহীহ অথবা যয়ীফ হাদীসেও বর্ণিত হয় নি যে, তিনি আরশে আরোহণ করেছিলেন। কেউ কেউ জালিয়াতি-মিথ্যাচারে লিপ্ত হয়েছে। তাদের এরূপ মিথ্যাচারের প্রতি দৃকপাত করা যায় না।’’[1]

মিরাজ বিষয়ক এ জাতীয় জাল ও বানোয়াট কথার মধ্যে রয়েছে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর জুতা পায়ে আরশে আরোহণের গল্প, মিরাজের রাত্রিতে ‘‘আত-তাহিয়্যাতু’’ লাভ, মুহূর্তের মধ্যে মি’রাজের সকল ঘটনা সংঘটিত হওয়া ইত্যাদি।[2]

[1] যারকানী, শারহুল মাওয়াহিব ৮/২২৩।

[2] বিস্তারিত দেখুন: খোন্দকার আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর, হাদীসের নামে জালিয়াতি পৃ. ৩৫০-৩৫৫।