হজ সফরে সহজ গাইড প্রারম্ভিকা ও প্রস্তুতি মুহাম্মাদ মোশফিকুর রহমান
কা‘বা ও হজের ইতিহাস

আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

﴿إِنَّ أَوَّلَ بَيۡتٖ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكٗا وَهُدٗى لِّلۡعَٰلَمِينَ ٩٦﴾ [ال عمران: ٩٦]

‘‘নিশ্চয় মানবজাতির জন্য সর্বপ্রথম যে ইবাদত গৃহটি (কা‘বা) নির্মিত হয় সেটি বাক্কায় (মক্কায়) অবস্থিত। একে কল্যাণ ও বরকতময় করা হয়েছে এবং সৃষ্টিকুলের জন্য পথপ্রদর্শক করা হয়েছে’’। [সূরা-আলে ইমরান, আয়াত: ৯৬]

বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বা কা‘বাকে বাইতুল আতীকও বলা হয়। কারণ, আল্লাহ এ ঘরকে কাফের শাসকদের থেকে স্বাধীন করেছেন। অথবা আতীক অর্থ প্রাচীন। কারণ এ ঘরটি সর্ব প্রাচীন ইবাদত ঘর। আশ্চর্যের বিষয় হলো -এ ঘরের স্থানটি পৃথিবীর ভৌগলিক মানচিত্রের কেন্দ্রে অবস্থিত।

কা‘বা ঘর নির্মাণ ও সংস্কার হয়েছে একাধিকবার। কারও কারও মতে পাঁচবার: (১) ফিরিশতা কর্তৃক (২) আদম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৩) ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কর্তৃক (৪) জাহেলী যুগে কুরাইশ সম্প্রদায় কর্তৃক (৫) ইবন যুবায়ের কর্তৃক। তবে বিশুদ্ধ মতে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম সর্বপ্রথম কা‘বা ঘর নির্মাণ করেন।

আল্লাহ তা‘আলা কুরআনুল কারীমে বলেন,

﴿جَعَلَ ٱللَّهُ ٱلۡكَعۡبَةَ ٱلۡبَيۡتَ ٱلۡحَرَامَ قِيَٰمٗا لِّلنَّاسِ﴾ [المائ‍دة: ٩٧]

‘‘আল্লাহ কা‘বাকে সম্মানিত ঘর করেছেন, মানুষের স্থীতিশীলতার কারণ করেছেন’’। [সূরা আল-মায়েদা, আয়াত: ৯৭]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِ‍ۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ﴾ [البقرة: ١٢٥]

‘‘এবং আমরা ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ই‘তিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫]

কা‘বা ও হজের ইতিহাসে রয়েছে ইবরাহীম আলাইহিস সালামের মহৎ ইসলামী আখ্যান। আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামকে তার স্ত্রী হাজের ও পুত্র ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামকে মরুময়, পাথুরে ও জনশূন্য মক্কা উপত্যকায় রেখে আসার নির্দেশ দেন -এটা ছিল আল্লাহর পক্ষ থেকে পরীক্ষাস্বরূপ।

প্রচণ্ড পানির পিপাসায় ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তাঁর মা ‘হাজের’ পানির সন্ধানে সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মাঝে ৭ বার ছুটাছুটি করেন। অতঃপর জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে শিশু ইসমাঈলের জন্য সৃষ্টি করলেন সুপেয় পানির কূপ -যমযম। আল্লাহর নির্দেশে ইবরাহীম ও ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালাম দু’জনে যমযম কূপের পাশে ইবাদতের লক্ষে কা‘বার পুণঃনির্মাণ কাজ শুরু করলেন।

আল্লাহ তা‘আলা ইবরাহীম আলাইহিস সালামের আনুগত্য দেখার জন্য আরেকটি পরীক্ষা নিলেন। তিনি ইবরাহীম আলাইহিসকে সালাম স্বপ্নে দেখালেন যে, তিনি তার পুত্রকে কুরবানি করছেন। আর এ স্বপ্নানুসারে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম যখন বাস্তবে তার পুত্রকে জবাই করতে উদ্যত হলেন তখন আল্লাহ তার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে গেলেন এবং ইবরাহীমের পুত্রের স্থলে একটি পশু কুরবানি করিয়ে দিলেন। সেই থেকে হজের সাথে সাথে চলে আসছে এ নিয়ম, মুসলিম বিশ্বে যা ঈদুল আযহা (কুরবানী ঈদ বা বকরা ঈদ) নামে পরিচিত।

ইসমা‘ঈল আলাইহিস সালামের মৃত্যুর পর পবিত্র কা‘বা বিভিন্ন জাতি-উপজাতির দখলে চলে আসে এবং তারা একে মুর্তি পূজার জন্য ব্যবহার করতে থাকে এবং এ সময়ে উপত্যকা এলাকায় মৌসুমী বন্যার কবলে পড়ে কা‘বা ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।

অতঃপর ৬৩০ খৃষ্টাব্দে মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্বে মুসলিমগণ কা‘বার মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলেন এবং কা‘বাকে পুনরায় আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন।

কুরাইশরা যখন কা‘বা পুণঃনির্মাণ করেন, তখন জান্নাত থেকে আসা পাথর ‘হাজারে আসওয়াদ’কে কা‘বার এক কোণে স্থাপন করা হয় মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। কা‘বার এক পার্শ্বে একটি স্থান রয়েছে যার নাম ‘মাকামে ইবরাহীম’; এখানে দাঁড়িয়ে ইবরাহীম আলাইহিস সালাম কা‘বার নির্মাণ কাজ পর্যবেক্ষণ করতেন, এখানে একটি পাথরে তাঁর পদছাপ রয়েছে। কা‘বা ঘরের উত্তর দিকে কা‘বা সংলগ্ন অর্ধ-বৃত্তাকার একটি উচু দেওয়াল আছে যা কা‘বা ঘরেরই অংশ যার নাম ‘হাতিম’ বা হিজর। হাজরে আসওয়াদ ও কা‘বা ঘরের দরজার মাঝের স্থানকে ‘মুলতাযাম’ বলা হয়। কা‘বা ঘরকে বৃষ্টি ও ধুলাবালীর থেকে রক্ষার জন্য একটি চাদর দ্বারা আবৃত করে রাখা হয় যা ‘গিলাফ’ নামে পরিচিত।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারীরা যেসব পথে ঘুরে হজ পালন করেছেন এর মধ্যে রয়েছে; কা‘বা তাওয়াফ করা, সাফা ও মারওয়া পর্বতের মধ্যে সা‘ঈ করা, মিনায় অবস্থান করা ও আরাফায় উকুফ করা এবং মুযদালিফায় রাত্রিযাপন করা, জামারাতে কংকর নিক্ষেপ করা এবং ইবরাহীম আলাইহিস সালামের ত্যাগের স্মৃতিচারণ ও আল্লাহর স্মরণকে বুলন্দ করার জন্য পশু যবেহ করা।

একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার; আল্লাহ তা‘আলা কা‘বার ভিতরে অবস্থান করেন না বা আমরা মুসলিমরা কা‘বার উপাসনা করি না বা কা‘বা থেকে কোনো বরকত হাসিল করা যায় না। কা‘বা হচ্ছে ‘কিবলা’ - যা মুসলিমদের জন্য দিক নির্ণায়ক ও ঐক্কের লক্ষ্য। আমরা মুসলিমরা সম্মিলিতভাবে কা‘বার দিকে মুখ করে আল্লাহর উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করি।

কা‘বার দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ও উচ্চতা:

উচ্চতা

মুলতাযেমের দিকে দৈর্ঘ্য

হাতিমের দিকে দৈর্ঘ্য

রুকনে ইয়েমানি ও হাতিমের মাঝে দৈর্ঘ্য

হাজরে আসওয়াদ ও রুকনে ইয়েমানি মাঝে দৈর্ঘ্য

১৪ মি.

১২.৮৪মি.

১১.২৮মি.

১২.১১মি.

১১.৫২মি.

 

কা‘বা ও মক্কার ইতিহাস বিস্তারিত জানতে ‘পবিত্র মক্কার ইতিহাস: শাইখ ছফীউর রহমান মোবারকপুরী’ বইটি পড়ুন।