আল ইরশাদ-সহীহ আকীদার দিশারী بيان أصول العقيدة الإسلامية إجمالا وأدلتها - দলীলসহ ইসলামী আকীদার মূলনীতিগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
نقض شبهات المشركين التي يتعلقون بها في تبرير شركهم في توحيد الألوهية - তাওহীদুল উলুহীয়ায় শিরক করার ক্ষেত্রে মুশরিকরা যেসব দলীল পেশ করে, তা খণ্ডন করা প্রসঙ্গে

কবর পূজারী মুশরিকরা এমন অনেক বানোয়াট কাহিনী বলে থাকে, যা অধিকাংশ মানুষের বিভ্রান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা তাদের শিরক ও গোমরাহীর পক্ষে এগুলোকে দলীল হিসাবে পেশ করেছে এবং তাদের বাতিলগুলো নিয়েই তারা সন্তুষ্ট রয়েছে। সুতরাং তাদের মিথ্যা ও বাতিলগুলোর মুখোশ উন্মুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَن بَيِّنَةٍ وَيَحْيَىٰ مَنْ حَيَّ عَن بَيِّنَةٍ﴾

‘‘যে ধ্বংস হওয়ার সে যেন দলীল-প্রমাণ সুস্পষ্ট হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে জীবিত থাকার সে সুষ্পষ্ট প্রমাণ সহকারে জীবিত থাকে’’। (সূরা আল আনফাল: ৪২)

এ সন্দেহগুলোর মধ্যে কিছু সন্দেহ এমন রয়েছে, পূর্বের জাতিসমূহের মুশরিকরা পেশ করতো এবং তার মধ্যে আরো এমন কিছু সন্দেহ রয়েছে, যা বর্তমান সময়ের মুশরিকরা পেশ করে থাকে। এ সন্দেহগুলোর মধ্যে রয়েছে:

প্রথমত: বিভিন্ন জাতির মুশরিকদের বহু দলের মধ্যে এ সন্দেহগুলোর সংমিশ্রণ ঘটেছে। এটি হচ্ছে বাপ-দাদাদের আকীদা-বিশ্বাসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করার সন্দেহ। তারা বলতো, এ আকীদা ও ধর্ম তারা তাদের পূর্বপুরুষ থেকে পেয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَكَذَلِكَ مَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ فِي قَرْيَةٍ مِنْ نَذِيرٍ إِلَّا قَالَ مُتْرَفُوهَا إِنَّا وَجَدْنَا آَبَاءَنَا عَلَى أُمَّةٍ وَإِنَّا عَلَى آَثَارِهِمْ مُقْتَدُونَ﴾

‘‘এমনিভাবে তোমার পূর্বে আমি যখন কোনো জনপদে কোনো সতর্ককারী প্রেরণ করেছি, তখন তাদের বিত্তশালীরা বলেছে, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে পেয়েছি এ পথের পথিক এবং আমরা তাদেরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে চলছি’’। (সূরা আয যুখরুফ: ২৩)

যে ব্যক্তি তার দাবির পক্ষে সঠিক কোনো দলীল-প্রমাণ সংগ্রহ করতে পারে না, সে এ দলীলের আশ্রয় নেয়। এটি একটি বাতিল ও অসত্য দলীল। তর্ক-বিতর্কের সময় এর কোনো মূল্য নেই। কেননা তারা তাদের যেসব বাপ-দাদাদের অন্ধ অনুসরণ করে যাচ্ছে, তারা কোনো সুস্পষ্ট হেদায়াতের উপর ছিল না। যাদের অবস্থা ঠিক এ রকমই তাদের অনুসরণ করা এবং তাদেরকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা জায়েয নেই। আল্লাহ তা‘আলা তাদের প্রতিবাদে বলেন,

﴿قَالَ أَوَلَوْ جِئْتُكُم بِأَهْدَىٰ مِمَّا وَجَدتُّمْ عَلَيْهِ آبَاءَكُمْ قَالُوا إِنَّا بِمَا أُرْسِلْتُم بِهِ كَافِرُونَ﴾

প্রত্যেক নবীই তাদের বলেছেন, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদাদের যে পথে চলতে দেখেছো আমি যদি তোমাদেরকে তার চেয়ে অধিক সঠিক রাস্তা বলে দেই তাহলেও কি তোমরা সে পথেই চলতে থাকবে? তারা সব রসূলকে এ জবাবই দিয়েছে, যে দীনের দিকে আহবান জানানোর জন্য তুমি প্রেরিত হয়েছো, আমরা তা অস্বীকার করি। (সূরা আয যুখরুফ: ২৪)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمْ تَعَالَوْا إِلَىٰ مَا أَنزَلَ اللَّهُ وَإِلَى الرَّسُولِ قَالُوا حَسْبُنَا مَا وَجَدْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْلَمُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ﴾

আর যখন তাদেরকে বলা হয়, এসো সে বিধানের দিকে যা আল্লাহ নাযিল করেছেন এবং এসো রসূলের দিকে, তখন তারা জবাব দেয়, আমাদের বাপ-দাদাকে যে পথে পেয়েছি সে পথই আমাদের জন্য যথেষ্ট। তারা কি নিজেদের বাপ-দাদারই অনুসরণ করে চলবে, যদিও তারা কিছুই জানতো না এবং সঠিক পথও তাদের জন্য ছিল না?  (সূরা আল মায়েদা: ১০৪)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

   ﴿وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ اتَّبِعُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ قَالُوا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُونَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُونَ﴾

‘‘তাদের যখন বলা হয়, আল্লাহ যে বিধান নাযিল করেছেন তা মেনে চলো, জবাবে তারা বলে আমাদের বাপ-দাদাদের যে পথের অনুসারী পেয়েছি আমরা তো সে পথে চলবো। যদিও তাদের বাপ-দাদাদের বিবেক-বুদ্ধিই ছিল না এবং তারা সুপথগামী ছিল না। তবুও কি তারা তাদের অনুসরণ করবে?’’ (সূরা আল বাকারা: ১৭০)

বাপ-দাদারা যদি হকের উপর থাকে, তাহলে তাদের অনুসরণ করা প্রশংসনীয় হয়।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَاتَّبَعْتُ مِلَّةَ آبَائِي إِبْرَاهِيمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ مَا كَانَ لَنَا أَن نُّشْرِكَ بِاللَّهِ مِن شَيْءٍ ﴾

‘‘আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক এবং ইয়াকূবের দীন অনুসরণ করেছি। আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের জন্য শোভনীয় নয়’’। (সূরা ইউসুফ: ৩৮)

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

﴿وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ﴾

‘‘যারা ঈমান গ্রহণ করেছ এবং তাদের সন্তানরাও ঈমানসহ তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে আমি তাদের সেসব সন্তানকেও তাদের সাথে (জান্নাতে) একত্র করে দেব। আর আমি তাদের আমল থেকে কোনো কিছু্ই কমাবো না। প্রত্যেক ব্যক্তিই তার কৃতকর্মের জন্য দায়বদ্ধ’’। (সূরা তুর: ২১)

পথভ্রষ্ট বাপ-দাদারা যে দীনের উপর ছিল, তা দিয়ে দলীল পেশ করার সন্দেহটি মুশরিকদের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করেছে। এ দলীল দিয়ে তারা নবীদের দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করেছে।

নূহ আলাইহিস সালামের কাওমের লোকদেরকে যখন নূহ আলাইহিস সাল্লাম বললেন,

﴿يَا قَوْمِ اعْبُدُوا اللَّهَ مَا لَكُم مِّنْ إِلَٰهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُون فَقَالَ الْمَلَأُ الَّذِينَ كَفَرُوا مِن قَوْمِهِ مَا هَٰذَا إِلَّا بَشَرٌ مِّثْلُكُمْ يُرِيدُ أَن يَتَفَضَّلَ عَلَيْكُمْ وَلَوْ شَاءَ اللَّهُ لَأَنزَلَ مَلَائِكَةً مَّا سَمِعْنَا بِهَٰذَا فِي آبَائِنَا الْأَوَّلِينَ﴾

‘‘হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা! তোমরা আল্লাহর ইবাদত করো, তিনি ছাড়া তোমাদের আর কোনো সত্য মাবুদ নেই, তোমরা কি ভয় করো না? তার সম্প্রদায়ের যেসব সরদার তার কথা মেনে নিতে অস্বীকার করলো তারা বলতে লাগলো, এ ব্যক্তি তোমাদেরই মতো একজন মানুষ ছাড়া আর কিছুই নয়। এর লক্ষ্য হচ্ছে তোমাদের উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা। আল্লাহ পাঠাতে চাইলে ফেরেশতা পাঠাতেন একথা তো আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের আমলে কখনো শুনিনি’’। (সূরা মুমিনূন: ২৩-২৪)

সুতরাং তাদের বাপ-দাদারা যে দীনের উপর ছিল, তাকে দলীল হিসাবে পেশ করে তারা নূহ আলাইহিস সালামের দাওয়াতের বিরোধীতায় লিপ্ত হয়েছিল। সালেহ আলাইহিস সালামের গোত্রের লোকেরা তাকে বলেছিল,

﴿أَتَنْهَانَا أَن نَّعْبُدَ مَا يَعْبُدُ آبَاؤُنَا وَإِنَّنَا لَفِي شَكٍّ مِّمَّا تَدْعُونَا إِلَيْهِ مُرِيبٍ﴾

আমাদের বাপ-দাদারা যেসব উপাস্যের পূজা করতো তুমি কি তাদের পূজা করা থেকে আমাদের বিরত রাখতে চাচ্ছো? আর যে ধর্মের দিকে তুমি আমাদেরকে আহবান করছো, বস্তুত আমরা তো সে সম্পর্কে গভীর সন্দেহ ও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের মধ্যে রয়েছি’’। (সূরা হুদ: ৬২)

ইবরাহীম আলাইহিস সালামের গোত্রের লোকেরা তাকে বলেছিল,

﴿قَالُوا بَلْ وَجَدْنَا آَبَاءَنَا كَذَلِكَ يَفْعَلُونَ﴾

‘‘তারা বলল না, তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে পেয়েছি, তারা এরূপই করতো’’। (সূরা শুআরা: ৭৪) যেমন ফিরআউন মূসাকে বলেছিল,

فَمَا بَالُ الْقُرُونِ الْأُولَى

‘‘তাহলে অতীত যুগের লোকদের অবস্থা কী?’’ (সূরা তোহা: ৫১)

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু  আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন আরবের মুশরিকদেরকে বললো, তোমরা لاإله إلا الله বলো, তখন তারা বলেছিল,

﴿مَا سَمِعْنَا بِهَذَا فِي الْمِلَّةِ الْآخِرَةِ إِنْ هَذَا إِلَّا اخْتِلَاقٌ﴾

‘‘পরবর্তী দীনের ভিতরে এ ধরণের কথা শুনিনি। এটি একটি বানোয়াট কথা’’। (সূরা সোয়াদ: ৭)

দ্বিতীয়ত: বর্তমানে কবর পূজারীরা আরো যেসব সন্দেহকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে, তাহলো তাদের মতে জান্নাতে প্রবেশ করার জন্য শুধু লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ উচ্চারণ করাই যথেষ্ট। এরপর মানুষ যা কিছুই করুক না কেন, لاإله إلا الله বলার পর সে আর কখনো কাফের হবে না। তারা ঐসব হাদীছের বাহ্যিক অর্থকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে যেখানে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কালেমায়ে তাওহীদ ও রেসালাতে মুহাম্মাদীয়ার সাক্ষ্য দিবে, আল্লাহ তা‘আলা তাকে জাহান্নামের জন্য হারাম করে দিবেন।

এ সন্দেহের জবাব হলো, হাদীছগুলোর সাধারণ ও বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। এসব হাদীছকে অন্যান্য হাদীছের সাথে মিলিয়ে বুঝতে হবে। সেসব হাদীছে যা এসেছে, তার অর্থ হলো যে ব্যক্তি জবান দিয়ে لاإله إلا الله পাঠ করবে, তাকে অবশ্যই অন্তর দিয়ে সেটার অর্থ বুঝতে হবে ও বিশ্বাস করতে হবে এবং সেটার দাবি অনুযায়ী আমল করতে হবে। সেই সঙ্গে আল্লাহ ছাড়া অন্যান্য যেসব বস্ত্তর ইবাদত করা হয়, তার প্রতি কুফুরীও করতে হবে। যেমন ইতবান ইবনে মালেকের হাদীছে এসেছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,

فَإِنَّ اللَّهَ حَرَّمَ عَلَى النَّارِ مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ يَبْتَغِى بِذَلِكَ وَجْهَ اللَّهِ

  ‘‘আল্লাহ তা‘আলা এমন ব্যক্তির উপর জাহান্নামের আগুন হারাম করে দিয়েছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে লা- ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলেছে’’।[1]

অন্যথায় মুনাফেকরাও তাদের জবান দিয়ে لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ পাঠ করেছে। এরপরও তারা জাহান্নামের সর্বনিমণস্তরে প্রবেশ করবে। লা-ইলাহা-এর উচ্চারণ তাদের কোনো কাজে আসবে না। কেননা তারা তাদের অন্তর দিয়ে এর অর্থকে বিশ্বাস করতো না।

সহীহ মুসলিমে বর্ণিত রয়েছে, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَنْ قَالَ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَكَفَرَ بِمَا يُعْبَدُ مِنْ دُونِ اللَّهِ حَرُمَ مَالُهُ وَدَمُهُ وَحِسَابُهُ عَلَى اللَّهِ

‘‘যে ব্যক্তি ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলবে আর আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্তুর ইবাদত করা হয় তাকে অস্বীকার করবে, তার জান-মাল মুসলিমদের নিকট সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকবে এবং তার অন্তরে লুকায়িত বিষয়ের হিসাব আল্লাহর উপরই ন্যস্ত হবে’’।[2]

এখানে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম জান-মাল হারাম হওয়ার জন্য দু’টি জিনিসের শর্ত করেছেন।

(১) لاإله إلا الله উচ্চারণ করা এবং

(২) আল্লাহ ব্যতীত অন্যান্য যেসব বস্ত্তর ইবাদত করা হয় তাকে অস্বীকার করা। শুধু জবানের উচ্চারণকে যথেষ্ট মনে করা হয়নি। এতে বুঝা গেলো, যে ব্যক্তি لاإله إلا الله পাঠ করবে, কিন্তু মৃত আওলীয়াদের ইবাদত বর্জন করবে না এবং সমাধি-মাজার ইত্যাদির সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করবে না, তার জান-মাল হারাম হবে না।[3]

তৃতীয়ত: কবরপূজারীরা আরো যেসব সন্দেহ উপস্থাপন করে, তার মধ্যে এও রয়েছে যে, তারা দাবি করে এ উম্মতে মুহাম্মাদী যেহেতু لاإله إلا الله محمد رسول الله পাঠ করে নিয়েছে, তাই তাদের মধ্যে আর শিরক প্রবেশ করবে না। আর কবর, সমাধি ইত্যাদির পাশে তারা যে মৃতদের ইবাদত করছে, আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাদের কাছে দু‘আ করছে তাদের মতে এটিকে শিরক বলা হয় না।

তাদের এ কথার জবাব হলো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, ইয়াহূদী- খ্রিষ্টানরা যে দীনের উপর ছিল এ উম্মতের মধ্যেও তার সদৃশ পাওয়া যাবে। ইয়াহূদী- খ্রিষ্টানদের দীনের মধ্যে এটি ছিল যে, তারা তাদের পোপ ও পাদ্রীদেরকে আল্লাহর পরিবর্তে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করেছিল। আর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সংবাদ দিয়েছেন যে, ততোক্ষণ পর্যন্ত কিয়ামত সংঘটিত হবে না যতোক্ষণ না তার একদল উম্মত মুশরিকদের সাথে মিলিত হবে এবং যতোক্ষণ না তার উম্মতের একটি শ্রেণী মূর্তি পূজা করবে। বাস্তবেই এ উম্মতের মধ্যে এমন শিরক এবং ধ্বংসাত্মক মতবাদ এবং ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রবেশ করেছে, যা অনেক মানুষকে ইসলামের গ-- থেকেই বের করে দিয়েছে। অথচ তারা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করে থাকে।

চতুর্থত: তারা আরো যেসব সন্দেহের আশ্রয় নিয়েছে, তার মধ্যে শাফা‘আতের বিষয়টি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা বলে, আমরা আল্লাহর পরিবর্তে আওলীয়া ও সালেহীনদের কাছে প্রয়োজন পূরণ করার জন্য দু‘আ করি না। তবে তাদের থেকে আমরা চাই যে, তারা আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট সুপারিশ করবেন। কেননা তারা খুব ভালো মানুষ এবং আল্লাহ তা‘আলার নিকট তাদের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে। সুতরাং আমরা তাদের সম্মানের মাধ্যমে এবং তাদের শাফা‘আতের মাধ্যমে আল্লাহর কাছেই চাই।

তাদের এ সন্দেহের জবাব হলো, জাহেলী যুগের মুশরিকরা তাদের বাতিল দীনের পক্ষে হুবহু এই সন্দেহটিই ব্যক্ত করতো। এরপরও আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে কাফের বলেছেন এবং মুশরিক হিসাবেই নামকরণ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেনঃ

﴿وَيَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمْ وَلَا يَنْفَعُهُمْ وَيَقُولُونَ هَؤُلَاءِ شُفَعَاؤُنَا عِنْدَ اللَّهِ قُلْ أَتُنَبِّئُونَ اللَّهَ بِمَا لَا يَعْلَمُ فِي السَّمَاوَاتِ وَلَا فِي الْأَرْضِ سُبْحَانَهُ وَتَعَالَى عَمَّا يُشْرِكُونَ﴾

‘‘আর তারা ইবাদত করে আল্লাহ্কে বাদ দিয়ে এমন বস্তুর, যা তাদের কোনো ক্ষতিসাধন করতে পারতোনা এবং তাদের কোনো উপকারও করতে পারতোনা। তারা বলে, এরা তো আল্লাহর কাছে আমাদের সুপারিশকারী মাত্র। তুমি বলো, তোমরা কি আল্লাহ্কে এমন বিষয়ে অবহিত করছ, যে সম্পর্কে তিনি অবহিত নন আসমান ও যমীনের মাঝে? তিনি পবিত্র ও মহান সেসব বস্তু থেকে যাকে তোমরা শরীক করছো’’। (সূরা ইউনুস: ১৮)

শাফা‘আত সত্য। কিন্তু তার মালিক একমাত্র আল্লাহ। আল্লাহ তা‘আলা সূরা যুমারের ৪৪ নং আয়াতে বলেন,

﴾  ﴿قُلْ لِلَّهِ الشَّــفَاعَةُ جَمــِيعًا

‘‘বলো, সমস্ত শাফা‘আত কেবল আল্লাহরই মালিকানাধীন’’।

সুতরাং তা কেবল আল্লাহর কাছেই চাইতে হবে। মৃত অলী-আওলীয়াদের কাছে নয়। কেননা আল্লাহ তা‘আলা ফেরেশতাদের কাছে, নবীদের কাছে কিংবা অন্যদের কাছে শাফা‘আত চাওয়ার অনুমতি দেননি। অতএব শাফা‘আত আল্লাহর অধিকারভুক্ত এবং তা তার কাছেই চাইতে হবে। যাতে করে তিনি সুপারিশকারীকে সুপারিশ করার অনুমতি দেন। শাফা‘আতের যে নিয়ম মানব সমাজে প্রচলিত আছে, আল্লাহ তা‘আলার কাছে সে নিয়ম অগ্রহণযোগ্য। মানুষের নিকট পরিচিত শাফা‘আতের স্বরূপ হলো, তাদের বড়দের নিকট বিনা অনুমতিতেই শাফা‘আতকারীগণ কারো জন্য শাফা‘আত করার দাবি নিয়ে আসে। বড়রা এ ক্ষেত্রে সুপারিশকারীদের সুপারিশ কবুল করতে বাধ্য। যার ব্যাপারে সুপারিশ করা হচ্ছে, যদিও তারা তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে। কারণ সুপারিশ কারীদের প্রতি তাদের প্রয়োজন রয়েছে। তাদের সাহায্য, সহযোগিতা ও সমর্থন ছাড়া চলতে পারে না।

সুতরাং তারা তাদের কাজে সমর্থক ও সাহায্যকারীদের প্রতি মুখাপেক্ষী। আর আল্লাহ তা‘আলার ব্যাপারে কথা হলো, তার অনুমতি ছাড়া কেউ তার কাছে সুপারিশ করতে পারবে না এবং যার জন্য সুপারিশ করা হবে, তার প্রতিও আল্লাহ তা‘আলার সন্তুষ্টি থাকতে হবে। কেননা আল্লাহ তা‘আলার কোনো সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন পড়ে না এবং তিনি কারো প্রতি মুখাপেক্ষীও নন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,

﴿وَكَمْ مِنْ مَلَكٍ فِي السَّمَاوَاتِ لَا تُغْنِي شَفَاعَتُهُمْ شَيْئًا إِلَّا مِنْ بَعْدِ أَنْ يَأْذَنَ اللَّهُ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَرْضَى﴾

‘‘আকাশ মণ্ডলে এমন অনেক ফেরেশতা রয়েছে, যাদের শাফা‘আত কোনো কাজেই আসবে না, তবে আল্লাহ তা‘আলা নিজ ইচ্ছায় যাকে খুশি তার জন্য সুপারিশ করার অনুমতি দিলে সে কথা ভিন্ন। (সূরা আন নাজম: ২৬)

পঞ্চমত: এসব লোকের সন্দেহের মধ্যে এও রয়েছে যে, তারা বলে আল্লাহ তা‘আলার নিকট অলী ও সৎ লোকদের বিরাট মর্যাদা রয়েছে। সুতরাং আমরা তাদের সম্মান ও মর্যাদার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি।

তাদের এ সন্দেহের জবাবে আমরা বলবো যে, সমস্ত মুমিন আল্লাহর অলী। তবে খাস করে দৃঢ়তার সাথে নির্দিষ্ট করে কোনো ব্যক্তির দিকে ইঙ্গিত করে এ কথা বলা যাবে না যে, অমুকের পুত্র অমুক আল্লাহর অলী। কেননা এ রকম বলতে গেলে কুরআনুল কারীম এবং রসূলের সুন্নাহ থেকে কোনো না কোনো দলীলের প্রয়োজন রয়েছে। কুরআন ও সুন্নাহর দলীলের মাধ্যমে যার বেলায়াত প্রমাণিত হয়েছে, তার ব্যাপারে আমাদের জন্য বাড়াবাড়ি করা এবং তার থেকে বরকত ও কল্যাণ হাসিল করা বৈধ নয়। কেননা এটি শিরকের অন্যতম মাধ্যম। আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন সরাসরি তার কাছে দু‘আ করি, তার মাঝে ও আমাদের মাঝে কোনো মাধ্যম নির্ধারণ না করি। কেননা পূর্বের মুশরিকরাও এ কথা বলতো যে, তাদের মূর্তিগুলোকে তাদের মাঝে এবং আল্লাহর মাঝে সুপারিশকারী ও মধ্যস্থতাকারী নির্ধারণ করেছে। তারা আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা ও নৈকট্যের মাধ্যমে প্রার্থনা করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের এ কাজের প্রতিবাদ করেছেন।


[1]. বুখারী, অধ্যায়: বাড়িঘরে নামাযের স্থান নির্ধারণ করা, মুসলিম, অধ্যায়: জামা‘আতের সাথে সালাত পড়া হতে বিরত থাকার অনুমতি।

[2]. মুসলিম, অধ্যায়: লা-ইলাহা পাঠ না করা পর্যন্ত লোকদের সাথে জিহাদ করার আদেশ।

[3]. আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি, কারো জান-মালের উপর আক্রমণ করা কোনো ব্যক্তি বিশেষের দায়িত্ব নয়। এটি সরকার বা সরকারের প্রতিনিধি ও প্রশাসনের দায়িত্ব। সুতরাং বিষয়টি ভালোভাবে উপলব্ধি করা আবশ্যক।