মানহাজ (আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ) নিত্য নতুন মানহাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উপকারী জবাব শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
প্রশ্ন-১০৩ : বর্তমানকালের বিভিন্ন দল এবং ফিরকা নিজেদেরকে ইসলামের দিকে সম্বন্ধ করে ইসলামী দল, ইসলামী ফিরকা, ইসলামী জামাত বলে; এভাবে বলা কি সহীহ? ইসলামী জামাত তো একক জামাত হওয়ার কথা যেমনটি হুযাইফা রাদ্বিয়াল্লাহ আনহুর হাদীছে বর্ণিত রয়েছে

উত্তর : বিভিন্ন দল বা ফিরকা এর অস্তিত্ব প্রত্যেক কালেই ছিল। এটা কোন দুর্লভ বিষয় নয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন ‘‘ইয়াহূদীরা ৭১ দলে বিভক্ত হয়েছে, খ্রিষ্টানেরা ৭২ দলে বিভক্ত হয়েছে।[1] অচিরেই আমার উম্মাত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। একটিমাত্র দল ছাড়া বাকি ৭২ ফিরকা জাহান্নামে যাবে।

সুতরাং বিভিন্ন দল যে থাকবে তা আমাদের জানা বিষয়। রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  বলেন, তোমাদের মধ্যে যে কেউ বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য দেখতে পাবে।[2]

তবে জামাতের সাথে চলা, যাদের অনুসরণ করা এবং যাদের সাথে লেগে থাকা ওয়াজিব সেটা হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত, আল ফিরকা আন- নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। কেননা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক জামাতই জাহান্নামে যাবে একটি মাত্র জামাত ছাড়া। ছহাবায়ে কিরাম আরয করলেন,

كلها في النار إلا واحدة. قالو : ومن هي ؟ قال : ما أنا عليه وأصحابي

‘সে জামাত কোনটি? তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন ‘‘আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যে জামাতের উপর অটল রয়েছি’।

এটাই হলো মূলনীতি যে, জামাত সমূহের মাঝে দেখতে হবে যে জামাত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং ছাহাবীগণের মানহাজের উপর অটল থাকবে সেই জামাতের অনুসরণ করা ওয়াজিব।[3]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ وَالسَّابِقُونَ الأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَداً ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيمُ }

আর মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে যারা অগ্রগামী ও প্রথম এবং যারা, তাদেরকে অনুসরণ করেছে সুন্দরভাবে, আল্লাহ্ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন আর তারাও আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। এবং তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত করেছেন জান্নাতসমূহ, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত, তারা সেখানে স্থায়ী থাকবে অনন্তকাল। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা আত-তাওবাহ আয়াত নং ১০০)

তারাই হলেন জামাত (الجماعة), একক জামাত (جماعة واحدة) যাতে কোন দলাদলি বা বিভক্তি নেই।[4] আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ وَالَّذِينَ جَاءُوا مِنْ بَعْدِهِمْ يَقُولُونَ رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالأِيمَانِ وَلا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلاً لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَحِيمٌ }

যারা তাদের পরে এসেছে তারা বলে: ‘হে আমাদের রব! আমাদেরকে ও আমাদের ভাই যারা ঈমান নিয়ে আমাদের পূর্বে অতিক্রান্ত হয়েছে তাদেরকে ক্ষমা করুন; এবং যারা ঈমান এনেছিল তাদের জন্য আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ  রাখবেন না; হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি দয়াবান, পরম দয়ালু। (সূরা আল- হাশর আয়াত নং ১০)

এই জামাত রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সময় থেকে নিয়ে কিয়ামাত পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। এই জামাতই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাত (أهل السنة والجماعة)।[5]

আর যে জামাতগুলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিরোধিতা করবে তাদের কোন স্থান নেই। তারা নামধারী ইসলামী জামাত হলেও প্রকৃত ইসলামী জামাত নয়। তারা ইসলামী নাম ধারণ করলো নাকি অন্য কোন নাম ধারণ করলো তাতে কিছু আসে যায় না। যে জামাতই রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জামাতের বিরোধিতা করবে সে জামাতই বিরোধী ফিরকা বলে গণ্য হবে। তাদের সাথে যুক্ত বা সম্পৃক্ত হওয়া জায়েয নয়। আমাদেরকে শুধু আহলুস সুন্নাহ ও আহলুত তাওহীদের সাথেই যুক্ত হতে হবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ - صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ }

আমাদেরকে সরল পথের হিদায়াত দিন।তাদের পথ, যাদেরকে নি‘মাত দিয়েছেন (নাবী, সত্যনিষ্ঠ, শহীদ, সৎকর্মপরায়ণ) (সূরা আল-ফাতিহা ৬-৭)

আল্লাহ তা‘আলা যাদের উপর নিয়ামত বর্ষণ করেছেন, তাদের বর্ণনা দিয়েছেন।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

{ وَمَنْ يُطِعِ اللَّهَ وَالرَّسُولَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِينَ أَنْعَمَ اللَّهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّينَ وَالصِّدِّيقِينَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِينَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيقاً }

আর যারা আল্লাহ ও রসূলের আনুগত্য করে তারা তাদের সাথে থাকবে, আল্লাহ যাদের উপর অনুগ্রহ করেছেন নাবী, সিদ্দীক, শহীদ ও সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে। আর সাথী হিসেবে তারা হবে উত্তম। ( সূরা আন-নিসা আয়াত নং ৬৯)

সুতরাং যে জামাত তার মানহাজ বা কর্মপদ্ধতি হিসাবে কিতাবুল্লাহ এবং সুন্নাহকে গ্রহণ করেছে, যারা রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীছের উপর আমল করেছে।

রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেন,

فإنه من يعش منكم فسيرى اختلافاً كثيراً، فعليكم بسنتي وسنة الخلفاء الراشدين المهديين من بعدي تمسكوا بها وعضوا عليها بالنواجذ، وإياكم ومحدثات الأمور

তোমাদের মধ্যে যে কেউ বেঁচে থাকবে সে অনেক মতানৈক্য লক্ষ্য করবে। সে সময় তোমাদের করণীয় হবে আমার সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা এবং আমার পরবর্তী সুপথপ্রাপ্ত ছাহাবীগণের সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরা। তোমরা মাড়ির দাঁত দ্বারা আঁকড়ে ধরবে। আর তোমরা দীনের মধ্যে নব আবিষ্কৃত বিষয়াবলি থেকে সতর্ক থাকবে।[6]

এটাই হলো গ্রহণযোগ্য জামাত। এছাড়া যত জামাত রয়েছে সেগুলোর কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই। সেগুলো হক থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। প্রত্যেক ফিরকাই শাস্তির হুকুমের অন্তর্ভুক্ত। সকল ফিরকাই জাহান্নামে যাবে। শুধু একটি ফিরকা ছাড়া। আমরা আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করছি।


[1]. মুসতাদরাকে হাকিম খ. ০১ হা.১২৯

[2]. মুসনাদে আহমাদ খ. ০৪ হা. ১২৬

[3]. যে সকল জামাত নিজেদেরকে সালাফী জামাত করে অথচ সালাফদের মানহাজ অনুযায়ী আমল করে না তারা সালাফী জামাত নয়। বরং এটা তাদের মৌখিক দাবি মাত্র। (মুহাম্মাদ নাছীরুদ্দীন আলবানী (রহ.), কিতাব ফাতাওয়াল উলামা আল আকাবির পৃ. ৯৮)।

[4]. নবুওয়াতি পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত জামা‘আতুল মুসলিমীন বা মুসলিমদের জামাত কখনও দলাদলি বা বিভক্তি গ্রহণ করে না। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তার পরবর্তী ছাহাবী (রা.) গণের দাওয়াত ছিল তাওহীদের পতাকাবাহী জামা‘আতুল মুসলিমীন বা মুসলিমদের জামাত প্রতিষ্ঠা করা। কিছু মুসলিমদেরকে নিয়ে খণ্ডিত দল বা জামাত গঠন করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা ছিলেন মুসলিম। তারা ছিলেন আত-ত্বইফাহ আল মানছুরাহ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল। তারা ছিলেন ফিরকায়ে নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। তারাই সালাফে সালেহীন। সালাফে সালেহীনগণ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও ছাহাবীদের পদাঙ্ক পূর্ণভাবে অনুসরণ করতেন এবং অন্যদেরকে আঁকড়ে ধরার নির্দেশ প্রদান করতেন। দলাদলি ও বিচ্ছিন্নতা থেকে বারণ করতেন (হুকমুল ইনতিমা পৃ. ৬০)।

[5]. আহলুল ইসলাম বা ইসলামের অনুসারীদের কুরআনুল কারীম, সুন্নাহ এবং এ দুটোর প্রতি আহবানের ক্ষেত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম  যে সকল গুণাবলি বর্ণনা করেছেন তারা তারই প্রতিচ্ছবি। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আমি এবং আমার ছাহাবীগণ যে মতের উপর রয়েছি যারা এর উপর অটল থাকবে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের গুণ বর্ণনায় আরো বলেছেন, তারা হলো জামাত এবং আত-ত্বইফাহ আল-মানছুরাহ বা সাহায্যপ্রাপ্ত দল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের গুণ বর্ণনায় আরো বলেন, তারা হলেন আল-ফিরকবাহ আন- নাজিয়াহ বা মুক্তিপ্রাপ্ত দল। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ভ্রষ্ট ফিরকা সমূহের দোষ বর্ণনার ক্ষেত্রে জামাত প্রসঙ্গে বলেন, তারা সুন্নাহ এবং তার পদ্ধতির প্রতি সম্বন্ধকৃত থাকবে। তারাই হলেন সালাফে সালেহীন। এই কারণেই যখন বিদআত এবং ভ্রষ্ট প্রবৃত্তি পূজার প্রকাশ পেল তখন বিশুদ্ধ আকীদার অনুসারীদেরকে বলা হতো সালাফী উক্ত, আকীদার অনুসারীদেরকে বলা হতো সালাফী এবং উক্ত আকীদাকে বলা হতো আল-আকীদা আস সালাফিয়্যাহ (হুকমুল ইনতিমা পৃ. ১১২-১১৩)।

[6]. সহীহ: ইবনে মাজাহ হা/৪২, মুসনাদে আহমাদ, দারিমী।