মানহাজ (আল-আজবিবাতুল মুফীদাহ) নিত্য নতুন মানহাজ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের উপকারী জবাব শাইখ ড. ছলিহ ইবনে ফাওযান আল ফাওযান
প্রশ্ন-৫১ : সম্মানিত শায়খ, প্রাথমিক ছাত্রদের প্রতি আপনার নছীহত কামনা করছি

উত্তর : প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার উপদেশ হলো, তারা এমন আলিমগণের নিকট ‘ইলম অর্জন করবে যারা ‘আকীদা, ইলম এবং কল্যাণকামীতার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য।[1]

প্রাথমিক ছাত্রের জন্য উচিত মুখতাছর/সংক্ষিপ্ত কিতাবাদি চয়ন করে সেগুলো মুখস্থ করা এবং শায়খদের নিকট আস্তে আস্তে সেগুলোর ব্যাখ্যাগ্রন্থ পড়ে নেয়া। বিশেষত মাদরাসা (স্কুল-কলেজ) শারঈ প্রতিষ্ঠানের পাঠ্যক্রম পড়ে নেয়া; মাদরাসা ও প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রদের জন্য পাঠ্যক্রম স্তরে স্তরে বিন্যাস করা থাকায় ছাত্রদের জন্য তা খুবই উপকারী।

ছাত্র যদি কোন নিয়মতান্ত্রিক শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য মাসজিদের ইলমী হালকায় শায়েখের কাছে উপস্থিত আবশ্যক। চাই হালকা ফিকহ, নাহু অথবা আকীদা যে বিষয়েই হোক না কেন।

বর্তমানের কিছু প্রাথমিক ছাত্র মুত্বাওয়াল বা বড় বড় গ্রন্থ দ্বারা পড়াশোনা শুরু করে অথবা তাদের কেউ কেউ বই কিনে বাসায় বসে বসে পড়তে বা অধ্যয়ন করতে থাকে (কোন আলিমের স্মরণাপন্ন হয় না), এমনটি করা ঠিক নয়। এটা কোন শিক্ষা নয়। বরং এটা এক প্রকার ধোঁকা। এর দ্বারা কেউ কেউ ইলম না থাকলেও ‘ইলমী বিষয়ে আলোচনা করে অথবা শারঈ বিষয়ে মাসলা-মাসায়িল প্রদান করে এবং ইলম ছাড়াই আল্লাহ তা‘আলা সম্পর্কে অনুচিত কথা বলে। কোন ভিত্তি বা মূলনীতির উপর ‘ইলম অর্জন না করাই এর মূল কারণ।

সুতরাং আলিমদের হালাকায় (ইলমী অনুষ্ঠান) অংশগ্রহণ করা এবং ধৈর্যের সাথে ‘ইলম অর্জন করা অত্যাবশ্যক।

ইমাম শাফিঈ (রহ.) বলেন-

ومن لم يذق ذل التعلم ساعة تجرع كأس الجهل طول حياته

ঘন্টা খানেকেরও জ্ঞানার্জন যে করেনি আস্বাদন

সে তো মূর্খতা পানে কাটিয়েছে তার সারাটি জীবন।


[1]. জ্ঞাতব্য : বর্তমানে ব্যাপকভাবে সবাইকে আলিম বলা হয়। আলিম শব্দ ব্যবহারের সীমারেখা নির্ধারণ করা উচিত। কেননা আলিম শব্দের সঠিক অর্থ না জানার কারণে অনেকে আলিম নয় এমন ব্যক্তিদেরকেও আলিমদের কাতারে গণ্য করে থাকে; তাদের নিকট থেকে ইলম বিষয়ক ফায়ছালা গ্রহণ করতে থাকে এভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। অনেক সাধারণ মানুষ এবং বিশেষত শিক্ষার্থীরা মনে করে যে ব্যক্তিই বই রচনা করে, পা-ুলিপি প্রকাশ করে অথবা লেকচার-বিবৃতি দেয় সেই আলিম।

বর্তমানে বাস্তবিক আলিমের সংখ্যা খুবই কম। শুধু কম নয় কমতর। এর কারণ হলো আলিমের অনেক গুণ রয়েছে যেগুলো বর্তমানে আলিম নামে পরিচিতদের অধিকাংশের মাঝেই নেই। যে ব্যক্তি বক্তৃতায় পটু সেই আলিম নয়, এমনিভাবে যে ব্যক্তিই বই পুস্তক লিখে, তাহক্বীক করে অথবা পা-ুলিপি প্রকাশ করে। অথচ দুঃখের বিষয় হলো আলিম বলা হলেই অনেক যুবক ও সাধারণ লোকের মাথায় এমনটি ভেসে উঠে।

হাফিয ইবনু রজব আল-হাম্বালী (রহ.) বলেন, ‘‘বর্তমানে আমরা মারাত্মকভাবে মূর্খতায় নিমজ্জিত হচ্ছি। অনেক লোক মুতাআখখিরীন (পরবর্তী যুগীয়) আলিমদের থেকে উত্তম মনে করে। এদের অনেকে কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে মনে করে যে ‘ সে মনে করে যে বক্তৃতা বিবৃতির আধিক্যের কারণে উক্ত ব্যক্তি ছাহাবীসহ পূর্ববতী যুগের সকল আলিমদের চেয়ে বিদগ্ধ পণ্ডিত।’’

তিনি আরো বলেন, ‘মুতাআখখিরীন অনেক লোক এই ফিতনায় পতিত হয়ে এমন ধারণা করতে লেগেছে যে, অধিক কথা (বক্তৃতা-বিবৃতি), বিতর্কে পারঙ্গমতা, দ্বীনী মাসআলায় মতানৈক্য করা ইত্যাদিই হলো বিদগ্ধ আলিম নির্ণয়ের মাপকাঠি।’’

আমি বলি, এই ছিল ইবনু রজব আল-হাম্বালী (রহ.) এর যামানার কথা। তিনি যদি বর্তমান যামানার আলিম দাবিদারদের কাজ-কর্ম দেখতেন, যারা ক্যাসেট এবং বই-পুস্তক তাদের নিজেদের মতামত দ্বারা পূর্ণ করে। তারা সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত ক্যাসেট এবং মাসে মাসে প্রকাশিত বই-পুস্তক দ্বারা সাধারণ জনগণ ধোঁকায় পতিত হয়। তারা তাদেরকে আলিম ভেবে বসে।

ইবনু রজব (রহ.) বলেন, এই বিশ্বাস রাখা ওয়াজিব যে বাগ্মীই আলিম নন। ‘বায়ানু ফাদ্বলি ইলমিস সালাফ আলা ইলমিল খলাফ’ (পৃ. ৩৮-৪০)।

বর্তমান যামানায় আলিম নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধকে প্রাধান্য দেয়া দরকার এবং ইলম গ্রহণের ক্ষেত্রে বয়োবৃদ্ধের নিকট থেকে ইলম অর্জন করা শর্ত করা উচিত। কেননা বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি জ্ঞান গরীমা-আকল-বুদ্ধিতে বেশি বিদগ্ধ হন এবং প্রবৃত্তির প্ররোচনায় পতিত হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

এ বিষয়ে ইবনু মাসউদ (রা.) বলেন, মানুষেরা যতদিন পর্যন্ত ইলম অর্জনের ক্ষেত্রে তাদের বয়ষ্ক ব্যক্তিদের নিকট থেকে অর্জন করাকে প্রাধান্য দেবে ততদিন পর্যন্ত তারা হকের উপর থাকবে। আর যখন তারা বয়স্কদেরকে বাদ দিয়ে তাদের চেয়ে কম বয়স্কদের নিকট থেকে ইলম অর্জন করবে তখন তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।

খত্বীব বাগদাদী (রহ.) সানাদ সহ ‘নছীহাতু আহলিল হাদীছ’ নামক গ্রন্থে ইবনু ক্বুত্বায়বাহ (রহ.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি এই আছারের ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত লোকদের শায়খ মাশায়িখ বয়োবৃদ্ধ লোক হবে, কোন অল্পবয়স্ক লোক হবে না ততদিন তারা কল্যাণের উপর থাকবে।’ তিনি এই ব্যাখ্যা প্রদান করেন যে এর কারণ হলো, বৃদ্ধের নিকট থেকে যৌবনের বিনোদন আকর্ষণ, তাড়াহুড়া, বোকামি কেটে যায় এবং অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হন। তাই তার ইলমে সন্দেহ সংশয় প্রবেশ করে না, তার উপর প্রবৃত্তি প্রাধান্য পায় না, তিনি লোভ-লালসার দিকে ঝুঁকেন না এবং শয়তানও তাকে প্রাথমিকদের মত বিপথগামী করতে পারে না। আর প্রাথমিকদের ক্ষেত্রে লোভ-লালসা, ক্রোধ-কামনা, তাড়াহুড়া করার প্রবণতা ইত্যাদি প্রবেশ করে যার কারণে তার প্রদেয় ফাতওয়া দ্বারা নিজে ধ্বংস হওয়ার এবং অপরকে ধ্বংস করার সম্ভাবনা থাকে’ (পৃ. ৭)।

ইবনু আব্দিল বার (রহ.) তার ‘জামিউ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাদ্বলিহি’ নামক গ্রন্থে ‘‘রূপক নয় বাস্তবিকভাবে কাকে ফাক্বীহ বা আলিম বলার উপযুক্ত? এবং আলিমদের মধ্য থেকে কার জন্য ফাতওয়াপ্রদান করা জায়েয?’’ একটি অধ্যায় বেঁধেছেন। শিক্ষার্থীদের জন্য এটা পড়ে নেওয়া উচিত।